০১. দোলাবৌদি

নিমাই ভট্টাচার্য

মেমসাহেব

ওয়েস্টার্ণ কোর্ট
জনপদ
নিউদিল্লী

দোলাবৌদি,

তোমার চিঠি পেলাম। অশেষ ধন্যবাদ। তুমি আমাকে ভালবাস, স্নেহ করা। তাইতো স্বপ্ন দেখ আমি ঘর বাঁধি, সুখী হই। একটা রাঙা টুকটুকে বৌ আসুক আমার ঘরে। আমাকে দেখাশুনা করুক, একটু ভালবাসুক, আমার জীবনের একটা অবলম্বন হোক। তাই না? ভাবতে বেশ লাগে। আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে একটা জুনিয়র দোলা এসে দোলা দিলে মন্দ হতো না! হয়ত তাঁর আবির্ভাব হলে নিজের জীবনটাকে নিয়ে এমন জুয়া খেলতাম না, ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি করতাম না। হয়তো তাঁর ছোঁয়া পেলে বুকের ব্যথাটা সেরে যেত, হয়ত নিকট ভবিষ্যতে মূসৌরী বা নৈনীতালের কোন নার্সিংহোমে যাবারও প্রয়োজন হতো না। হয়ত আরো অনেক কিছু হতো। নিজের কাছ থেকে নিজেকে এমনভাবে লুকিয়ে রেখে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতাম না। তাই না দোলাবৌদি?

সত্যি কথা বলতে কি, বিয়ে করতে আমার সম্মতি না থাকলেও যদি কোন মেয়ে আমাকে বিয়ে করে তাতে আমার বিশেষ অসম্মতি নেই। বরং বেশ আগ্রহই আছে। আর তাছাড়া আগ্ৰহ না থাকার কি কারণ থাকতে পারে?

তুমি তো নিজেই আঠারো কি উনিশ বছর বয়স থেকে খোকনদাকে দোলা দিতে শুরু করেছিলো। ইউনিভার্সিটির দুই গেট দিয়ে দুজনে বেরুতে। তুমি ইউনিভার্সিটির দোরগোড়া থেকে ২-বি বাসে চাপতে আর খোকনদা মেডিক্যাল কলেজের পিছন থেকে ননম্বর বাসে চাপত। দুজনে দুটি বাসে চাপলে কি হয়। দুজনেই তো নেমে পড়তে লিণ্ডসে স্ট্রটএর মোড়ে। ডিসেম্বরের হাড়কঁপানো শীতে ফাঁকা দাৰ্জিলিং উপভোগ করেছ তোমরা দুজনে। এসব আমি জানি। আরো জানি তুমি নিজের হাতের কঙ্কণ আর গলার মোটা হারটা বিক্ৰী করেছিলে বলেই খোকনদা অত দিন ধরে রিসার্চ করে পি-এইচ-ডি হতে পারল। এমনি করে দোলা দিতে দিতে একদিন অকস্মাৎ নিজের দোলনায় তুলে নিলে খোকনদাকে।

এসবই তো নিজের চোখে দেখা। আরো অনেককেই তো দেখলাম। মঞ্জরী, লিপি, কণিকারাই কি কম খেল দেখাল। আমার প্রথম যৌবনের সেই সবুজ কাঁচ দিনগুলিতে তোমরা সবাই আমাকে যথেষ্ট ইনফ্লুয়েন্স করেছিলো। হয়ত আজো সে ইনফ্লুয়েন্স শেষ হয় নি। আর ঐ অনুরাধা? কত বড় বড় কথা, কত লেকচার, কত তর্ক-বিতর্ক। বিয়ে? সরি! শেষ পৰ্যন্ত একটা পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার জন্য আমাকে শিকার করবে? নেভার, নেতার, নেতার!

মনে পড়ে দোলাবৌদি? অনুরাধা শেষকালে চীৎকার করে হেনরি ফিল্ডিংকে কোট্‌ করে বলত, His designs were strictly honourable, as the saying is : that to rob a lady of her fortune by way of marriage.’

আমাদের সেই অনুরাধাও একদিন বর্ধমানের নীতীশের গলায় মালা পরাল। আমি দিল্লীতে ছিলাম না। তাই অনুরাধার আমন্ত্রণ পেতে একটু দেরী হওয়ায় সে দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার হয় নি। কিন্তু তার বৌভাত-ফুলশয্যার দিন আমি বর্ধমান না গিয়ে পারিনি। প্ৰাচীন কাব্যে আছে অনন্তযৌবন উর্বশীর ক্যাবারে ডান্সের ঠেলায় স্বৰ্গরাজ্যের ম্যানেজিং ডাইরেকটরদের সব কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছিল। কিন্তু মুনি-ঋষিদের নাচে উর্ষণীয় ধ্যানভঙ্গ? না, পড়িনি। তবে দেখলাম অনুরাধার বেলায়। একটা ভাঙা জীপগাড়ি, দু’টো কনেস্টবল আর একটা পেটমোটা সাব-ইন্সপেকটরের ঘাড়ে চড়ে আই-পি–এস নীতীশ এমন নাচই নাচল যে, অনুরাধাও ক্লিন বোল্ড হয়ে গেল।

ঐ উৎসবের বাড়িতেই লোকজনের ভিড় একটু পাতলা হলে আমি কানে-কানে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, অনু, এ কি হলো? ছিঃ ছিঃ। শেষ পর্যন্ত পুরুষের তৃষ্ণা মেটাবার শিকার হলে?

তুমি তো অনুরাধাকে ভালভাবেই জান। ও ভাঙবে কিন্তু মাচকাবে না। তাই শেকসপিয়ারের অ্যান্টনি অ্যাণ্ড ক্লিওপেট্ৰ থেকে কোট করে বলল, My salad days when I was green in judgement.’

চমৎকার! তোমাদের এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার বিয়ে করার ইচ্ছা হওয়া কি স্বাভাবিক নয়? মাঝে মাঝেই ভাবি আমিও যদি খোকনদা বা নীতীশের মত…।

যাকগে ওসব। আচ্ছা দোলাবৌদি, তাছাড়া পাত্র হিসেবে কি আমি খুব খারাপ? বোধ হয় না, তাই না? লেখাপড়া না শিখলেও কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে গেছি কবছর। খবরের কাগজের স্পেশ্যাল করাসপেনডেণ্টের চাকরিটাও নেহাত মন্দ নয়। বেশ চটক আছে। মাইনেও নেহাত কম পাই না। বাড়ি না। থাকলেও গাড়ি আছে, নায়েব না থাকলেও স্টেনে তো আছে। তাছাড়া শুনেছি আজকালকার মেয়েরা বিলেত-ফেরত দুষ্ট ছেলেদের বেশ পছন্দ করে। মেয়েদের বাপ-মা স্মার্ট-সফিসটিকেটেড বলে। ঐসব দুষ্ট ছেলেদের জামাই করতে আপত্তি করেন না। সেদিক থেকে আমি ওভার-কোয়ালিফায়েড! একবার নয়, বহুবার গেছি। বিলেত। লোকে বলে দুষ্টুমিও নাকি করেছি।

আরো একটা ব্যাপার আছে। পটলডাঙার গোবিন্দ বিলেতফেরত বলে বিয়েতে ফিল্মস্টারদের মত ইনক্যাম ট্যাকস ফ্রি দশ হাজার টাকা ব্ল্যাকমানি পেয়েছিল। সুতরাং আমার ভবিষ্যতও বেশ উজ্জল মনে হয়। আর তাছাড়া তোমার মত হাই ফাস্টক্লাশ পাওয়া এজেণ্ট যখন আছে। পয়সাওয়ালা বোকা বোকা লোকের একটা উদ্ভুত উড়ু, মেয়ে শিকার করা অধ্যাপিকা দােলা সরকারের পক্ষে নিশ্চয়ই খুব কষ্টকর নয়।

তবে তার আগে মেমসাহেব উপাখ্যানটা তোমাদের সবার জেনে নেওয়া দরকার। আমার ঐ কালো মেমসাহেবকে নিয়ে তোমরা অনেকদিন হাসি-ঠাট্টা করেছ। হয়ত কিছু ধারণাও করেছ মনে মনে। শুধু তুমি কেন, অনেকের মনেই আমার মেমসাহেবকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন। কেউ-কেউ ভাবে মেমসাহেব বলে কেউ নেই। পুরোটাই গুল, ফোরটোয়েন্ট। আবার কেউ-কেউ ভাবেন মেমসাহেবকে আমি শুধু ভালবাসিনি, বিয়েও করেছি। নানা ধরনের নানা লোকজনের কাছ থেকে মেমসাহেব সম্পর্কে চিঠিপত্রও কম পাই না।

যার সঙ্গেই নতুন আলাপ হয়, তিনিই প্রশ্ন করেন, মেমসাহেব কে? ছেলেমেয়ে বুড়ো-বুড়ী সবারই ঐ এক প্রশ্ন। এইত কদিন আগে দিল্লী ইউনিভার্সিটির এক তথ্বী-শ্যামার সঙ্গে আলাপ হলো। বাড়িতে নিয়ে গেলেন। দু’টো থিন-এরারুট বিস্কুট, একটা প্যাড়া সন্দেশ আর এক কাপ চা দিয়েই মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, মা জানতে চাইছিলেন মেমসাহেবের আসল নাম কি?

বছরখানেক আগে সিউড়ি থেকে এক বৃদ্ধ পার্শেল করে একটা লাল টুকটুকে সিল্কের শাড়ী পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠি ছিল। লিখেছিলেন, তোমার মেমবৌকে এই শাড়ীটা আশীৰ্বাদী পাঠাচ্ছি। বিদেশী মেমকে এই শাড়ীটা পরলে ভালই লাগবে। মাতৃতুল্য স্নেহাতুর বৃদ্ধাকে আমি লিখেছিলাম, মা, শাড়ীটা আপনি সাবধানে রেখে দিন। সময় মত আপনার মেমবৌকে নিয়ে ওখানে গিয়েই শাড়ীটা গ্ৰহণ করব।

মেমসাহেবকে নিয়ে আরো কত কি কাণ্ডই হয়। তাইতো এবার ভেবেছি তোমাদের সঙ্গে এমন করে আর লুকোচুরি না খেলে পুরো ব্যাপারটাই খুলে বলব। তাছাড়া আমার জীবনের এইসব ইতিহাস না জানলে তোমার পক্ষে ঘটকালি করারও অসুবিধা হতে পারে। তোমাকে সব কিছু লেখার আগে নৈতিক দিক থেকে মেমসাহেবের একটা অনুমতি নেওয়া দরকার। কিন্তু আজ সে এতদূরে চলে গেছে যে, তার অনুমতি যোগাড় করা প্ৰায় অসম্ভব। আর হ্যাঁ, তাছাড়া ঠিকানাটাও ঠিক আমার জানা নেই।

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

১. ০১. দোলাবৌদি
২. ০২. চিঠি পড়ে ঘাবড়ে গেছ
৩. ০৩. সেদিন কি তিথি, কি নক্ষত্র, কি লগ্ন ছিল
৪. ০৪. এলাহাবাদ-বাস শেষ হবে
৫. ০৫. দিল্লী ফিরে এসেছি
৬. ০৬. খোকনদার দেখা পেয়েছিলে
৭. ০৭. চিঠিগুলো বড় বড় হয়ে যাচ্ছে
৮. ০৮. প্রাগৈতিহাসিক অধ্যায়
৯. ০৯. তোমার চিঠি পেয়েছি
১০. ১০. বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে
১১. ১১. জীবনের গতিপথ ও গতিবেগের পরিবর্তন হয়
১২. ১২. দীর্ঘদিন তৈলমর্দন করেও
১৩. ১৩. বাঙালীর ছেলেরা ঘর ছেড়ে বেরুতে চায় না
১৪. ১৪. মেমসাহেবের দিল্লীবাস
১৫. ১৫. আমাকে কিছু করতে হলো না
১৬. ১৬. ঘুম ভাঙতে অনেক বেলা হয়েছিল
১৭. ১৭. মেজদির উপকার
১৮. ১৮. ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দুনিয়া
১৯. ১৯. সেবারের কলকাতা যাওয়া
২০. ২০. তারপরের ইতিহাস

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন