বউ নিয়ে খেলা

বিমল কর

শচীন আসতেই তার বন্ধুরা সাদর অভ্যর্থনা করে বলল, “আয় আয়, তোর পথ চেয়ে বসে আছি।”

শচীনের বন্ধু বলতে আপাতত এই ঘরে চারজন: প্রতাপ, সুবিমল, আশু আর হালদার। চারজনেরই বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। প্রতাপ হয়তো চল্লিশে পা দিয়েছে, বাকিরা সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে। প্রতাপের চেহারাও কলকাতার পুরনো বাবু-বাড়ির বংশধরদের মতন: গোলগাল, ফরসা, মাথায় টাক, চোখে চশমা। হগ মার্কেটে ফুলের দোকান প্রতাপের। আর তার বাড়ির বৈঠকখানায় বন্ধুদের আড্ডা। সুবিমল কলেজের বাংলা টিচার, আগে বোধ হয় কবিতা লিখত, এখন রচনাবই লেখে, কবিতার ভাঙা লাইন আর রচনা-বইয়ের স্থূলতার মতন তার চেহারা। চোখ মুখ ভাঙা ভাঙা দেখালেও গায়ে গতরে চর্বি জমেছে। আশু হল ইনকাম ট্যাক্সের উকিল। ছিপছিপে চেহারা, চোখে মুখে ঝরঝরে হাসি। গালের আধখানা জুলফি দিয়ে ঢেকে রেখেছে। হালদারই সবচেয়ে নিরীহ ধরনের; দেখলেই বোঝা যায় অম্লশূলের রোগী।

প্রতাপ তার চুরুটের পিছনে কাঠি করতে করতে বলল, “গিয়েছিলি?”

শচীন একপাশে বসল। বসে তার বাঁ হাতটা সুবিমলের দিকে বাড়িয়ে দিল। “পালস্‌টা একবার দেখ তো, ভাই?”

সুবিমল বলল, “কেন? জ্বর হয়েছে তোর?”

মাথা নাড়ল শচীন। “হার্ট সিঙ্ক করে যাচ্ছে। বাব্বা কী জিনিস দেখলাম। জঙ্গলের বাঘ দেখেছি। এ ভাই বাঘের বাবা। সরি, মা।”

আশু বলল, “খুলে বলো! আমরা হাঁ করে বসে আছি তোমার জন্যে। গজেন কাটলেট আনতে গিয়েছে। এসে পড়বে এখুনি।”

হালদার বলল, “কলকাতায় বড় কলেরা হচ্ছে। কাটলেটটা না খেলেই পারতেন।”

“রাখুন তো মশাই, কলেরা টাইফয়েড করেই আপনি গেলেন।”

প্রতাপ বলল, “ব্যাপারটা বল, শচীন।”

শচীন বলল, “ভাই আমি যথারীতি যথাস্থানে গিয়েছিলাম। একেবারে কাঁটায় কাঁটায় ছ’টা। পাঁচতলা বাড়ি, তেতলায় অফিস। লিফট নেই। উঠলাম ওপরে। অফিসের বাইরে দরজার সামনে টুলে এক দরোয়ানি মেয়ে বসে ছিল। হাতে কাগজ পেনসিল। নাম লিখে দিলাম। তারপর ডাক পড়ল।”

সুবিমল হাত বাড়িয়ে আশুর সিগারেটের প্যাকেট টেনে নিল।

শচীন বলল, “ঘরের মধ্যে ঘর। প্রথম ঘরে জনা চারেক মহিলা। লম্বা, বেঁটে, কালো ফরসা নানা টাইপের। চেহারায় সব ক’জনই পুষ্ট। আন্ডার সিক্সটি কেউ নয়।”

“বয়েস?”

“না না, বয়েস কেন হবে, কেজি-তে। মহিলারা কফি-ব্রেক করছিলেন, উইথ চানাচুর। ঘরে দিব্যি সেন্টের গন্ধ। আমায় দেখে চোখে চোখে খেলা চলল। গলায় ব্লটিং-চাপা হাসি।”

এমন সময় গজেন এল। লম্বা চওড়া চেহারা, মাথায় চুল কোঁকড়ানো, পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। হাতে কাগজের ঠোঙায় কাটলেট।

প্রতাপ বলল, “ডিস্টার্ব করবি না, বোস। যা কাটলেটগুলো তোর বউদিকে দিয়ে আয় ভেতরে। চায়ের সঙ্গে দিতে বলবি।”

গজেন ভেতরে গেল। হাঁক মারল। আবার ফিরে এল।

শচীন বলল, “ঘরের মধ্যে আর একটা ছোট ঘরে ঢুকে দেখলাম, দারুণ ব্যাপার। মেঝেতে জুট কার্পেট, একপাশে ছোট সোফা, সামনে সেক্রেটারিয়েট টেবিল, ওপাশে বিশাল চেয়ার, এপাশে একটি মাত্র চেয়ার, ঘরের একদিকে এক ছোট আলমারি, গোটা দুয়েক ছবি ঝুলছে।”

“তুই বড় বেশি গৌরচন্দ্রিকা করছিস,” সুবিমল বলল।

শচীন বলল, “গাছে না উঠে এক কাঁদি তো হয় না, ভাই। ব্যাপারটা চোখে না দেখলে বুঝবে না, তবু মুখে বললাম।… তা টেবিলের ওপাশে ছিলেন রেহান লাহিড়ি।”

“রেহান! পুরুষ মানুষ নাকি?” আশু জিজ্ঞেস করল।

“না, মহিলা। লেডি। তবে পুরুষের কান কাটেন। একেবারে বয়কাট চুল, চোখের চশমা কালো কর্ড দিয়ে বুকের কাছে ঝুলিয়ে রাখেন, মাঝে মাঝে পরেন চোখে, আবার ঝুলিয়ে দেন বুকের ওপর। চেইন স্মোকার। রোস্টেড টোবাকো বোধ হয়, যা গন্ধ!”

হালদার বলল, “পরনে কি প্যান্ট?”

“না প্যান্ট নয়। অন্তত আজ প্যান্ট দেখলাম না। শাড়িই পরেছেন। তবে শাড়িটা নেহাত গায়ে জড়ানো। থাকে থাকে খুলে যায়।”

“ব্লাউজ-টাউজ ছিল না—?” আশু চোখ টিপে বলল।

“যেটুকু থাকার ছিল। মিনিমাম।… মুখে নো রংচং; হাতে ডবকা সাইজের ঘড়ি। গলায় এক পাথরের মালা।”

“তা ওজন-টোজন কেমন?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“মিনিমাম পঁচাত্তর। আশি কেজিও হতে পারে।”

“বাপস! হাতি নাকি?”

“আজ্ঞে না। উনি আদিতে ছিলেন রোহিনী। রোহিনী থেকে রেহান।”

সুবিমল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল! “হায় বঙ্কিম!”

আশু বলল, “যাক, তারপর কী হল—শুনি!”

শচীন এবার একটা সিগারেট ধরাল। কয়েকটা টান মেরে বলল, “কথাবার্তা হল। তা প্রায় আধঘণ্টা মতন। আমায় কফি খাওয়ালেন।”

গজেন বলল, “কী কথাবার্তা হল সেটা বল! ওটাই তো আসল।”

শচীন বলল, “আমি স্পষ্টই বললাম, একটা ডিভোর্স কেস প্রায় সেটল্‌ড—সেটা আনসেটেল করতে হবে। শুনে রেহান তো প্রথমে চটে গেলেন। বললেন, দেখুন, আমরা মেয়েদের ইনটারেস্ট দেখার জন্যে এই অরগানিজেশান খুলেছি। আমাদের উদ্দেশ্য মেয়েদের স্বার্থ দেখা। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন।… আমাকে প্রায় উঠিয়েই দিচ্ছিলেন, কিন্তু অত সহজে কি আমাকে ওঠানো যায়! লাইফ ইনসিওরেন্সের এজেন্সি দিয়ে লাইফ শুরু করেছিলাম ভাই। ‘না’ কে ‘হ্যাঁ’ করাতে পারি। মিষ্টি কথা, ন্যাকা কথা, তৈল দান—শেষে পকেট থেকে চেক বই বার করে এক শো একান্ন টাকার অ্যাডমিশান চার্জ দিতেই রেহান আমায় তাঁদের ক্লায়েন্ট করে নিলেন। খাতায় নাম-ধাম লেখা হল। আমার নম্বর হল…” বলে শচীন পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করল—ব্যাগ হাতড়ে একটা রসিদ। বলল, “নম্বর হল, জিরো জিরো থার্টি ওয়ান।”

প্রতাপ হাত বাড়াল। “দেখি রসিদটা…।”

শচীন রসিদটা দিল।

দেখল প্রতাপ। বলল, “নামটা পশু ক্লেশ নিবারণ সমিতির মতন মনে হচ্ছে যে!”

“হ্যাঁ,” মাথা নাড়ল শচীন, “রেহানদের সমিতিও অনেকটা ওই ক্লাসের। ওটা মহিলা পীড়ন নিবারণ সমিতি গোছের।”

আশু বলল, “তা, ওখানে আর যে সব জিনিস দেখলে, যাঁরা কফি খাচ্ছিলেন—তাঁদের কেমন মনে হল, ক্লেশ আছে।”

শচীন বলল, “ভেতরে থাকতে পারে, ওপরে দেখলাম না। সকলেই বেশ ব্রে-শ-”।

আশু জোরে হেসে উঠল। সুবিমল বলল, “তোর নজর ভাল।”

এমন সময় ভেতর থেকে চা এল। চা আর কাটলেট।

গজেন সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

হালদার বলল, “ব্যাপারটা একটু ইয়ে হয়ে যাচ্ছে না?”

কাটলেট চিবোতে চিবোতে আশু বলল, “ইয়ে হবে কেন! যা হওয়া উচিত তাই হচ্ছে।”

হালদার সাহস করে কাটলেটের দিকে হাত বাড়াতে পারছিল না। গন্ধটা নাকে লাগছিল! প্রতাপ কচকচ করে স্যালাড চিবোচ্ছে। জিভে জল আসছিল হালদারের।

“না, আমি বলছিলাম”, হালদার ঠোঁট চাটল, “ব্যাপারটা তো তেমন সিরিয়াস নয়। শচীনবাবুর স্ত্রী সত্যি সত্যি তো আর ডিভোর্স করছেন না।”

“কে বলল?” শচীন আবার খানিকটা কাটলেট মুখে পুরল। “আর কত সিরিয়াস হবে! আমার বউ আজ তিন হপ্তা হল তার বাপের বাড়ি চলে গেছে। ও-বাড়িতে গেলে দেখা করে না। ফোন করলে ধরে না। চিঠি লেখেছি, জবাব দেয়নি। বলছিল, লিগ্যাল হেল্প নিচ্ছে। নিতেই পারে। ওর এক কেমন মাসতুতো দাদা ছিল। আই থিঙ্ক হার লাভার, প্রি-ম্যারেজ। সে বেটা উকিল। এই চান্সে বেটা বগল বাজাবে।”

প্রতাপ বলল, “না না, কাজটা ভালই হয়েছে। বরং আমি বলব, স্টেটসম্যানে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়ে শচীনকে খুব হেল্প করল। না কি সুবিমল?”

সুবিমল চায়ের কাপ টানল। “নিশ্চয়। একেই বলে গডস ব্লেসিং।”

“বিজ্ঞাপনটা ভাগ্যিস আশুর চোখে পড়েছিল।”

আশু বলল, “আমার চোখে সবই পড়ে। শচীনদার যা হাল দেখেছিলাম…”

হালদার হাত বাড়িয়ে কাটলেটের সিকি ভাগ তুলে নিল। “না, আমি বলছিলাম—এ-সব ব্যাপার যদি নিজেরা সেটল করা যেত!”

“কেমন করে যাবে?” শচীন বলল, “আমার বউয়ের দশ দফা দাবি। চার দফা আমি কোনো রকমে মেটাবার চেষ্টা করতে পারি।”

“কী কী?” প্রতাপ জিজ্ঞেস করল।

“ধর, যদি পাই—ধারকর্জ করে একটা ফ্ল্যাট কেনার টাকা যোগাড় করতে পারি। দুই: দু’বছর অন্তর বউকে হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারি কলকাতার বাইরে। তিন: ঝি না থাকলে হোটেলে খেতে পারি। চার: আমি কিছু টাকা বউয়ের হাত-খরচা হিসেবে স্পেয়ার করতে পারি। ব্যাস,..আর কিছু পারব না।”

আশু বলল, “বাকি ছ’ দফার মধ্যে কোনটা একেবারেই পারবে না।”

“বাচ্চা! বাচ্চা আমদানি আমার হাতে নয়। আমার বউকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না, তার কপালে যদি না থাকে আমি কী করব? এ তো কুমারটুলিতে অর্ডার দিলে পাওয়া যায় না।”

প্রতাপ বলল, “তোর অর্ডার প্লেস সঠিক জায়গায় কর, হয়ে যাবে।” বন্ধুরা হোহো করে হেসে উঠল।

ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল একটু বলা দরকার।

শচীন হল সেই ধরনের মানুষ যার মধ্যে এক ধরনের পৌরুষ আছে। অর্থাৎ সে তেজি এবং তেড়া। ভয়ঙ্কর আড্ডাবাজ এবং অসংসারী। সে বউকে ঠিক ততখানি তোয়াক্কা করতে নারাজ যতটা করলে ঘরে শান্তি থাকে। এই স্বভাবের জন্যে তাকে বিয়ের পর থেকেই পস্তাতে হচ্ছে। আজ চার বছরে তার বউ—মলয়া বার ছয়েক শচীনকে জব্দ করার জন্যে নানা রকম কাণ্ড করেছে। একবার, বিয়ের নতুন নতুন অবস্থায় চার আউন্স ক্যাস্টর অয়েল খেয়েছিল। শচীন তাতে যত না জব্দ হয়েছিল তার চারগুণ হয়েছিল মলয়া নিজেই। ধাত ছেড়ে যাবার জো হয়েছিল তার। পরের বার মলয়া আর অয়েলে যায়নি, ট্যাক্সি ধরে চলে গিয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায়। ভেবেছিল হয় আত্মবিসর্জন দেবে, না হয় সন্ন্যাসিনী হবে। সারাদিন ভেবেও মতি স্থির করতে পারেনি। রাত্রে ফিরে এসে দেখে শচীন পাঞ্জাবির দোকানের কষা মাংস খাচ্ছে, তার পাশে ছোট এক বোতল হুইস্কি। মলয়াকে দেখে শচীন বলল, “আমি ভাবলাম তুমি দুর্গাপুরে লাটুদার কাছে বেড়াতে গেছ।” স্বামীর ব্যবহার দেখে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিল মলয়া। তৃতীয়বার মলয়া টানা বাহাত্তর ঘণ্টা উপবাস করেছিল পলিটিক্যাল চাল মেরে। শচীন তাতেও কাবু হল না, বরং শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বলে এল, “আমি অফিসের কাজে নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছি, আপনাদের মেয়েকে দেখবেন।” এইভাবে চতুর্থও পঞ্চম বারের পর মলয়া ইঁদুর মারা বিষ খেয়েছিল, কিন্তু ভেজাল বিষ তেমন কোন কাজ করল না শরীরে; মলয়া বার দুয়েক বমি করল। শচীন বলল, “চলো তোমায় গাইনির কাছে নিয়ে যাই। এই সময়ে বমি ভাল।”

মলয়া শেষ পর্যন্ত বুঝে ফেলেছিল, শচীন বদলাবার নয়। তার কাছে স্ত্রী আর ডাক্তারের কাছে স্টেথসকোপ একই জিনিস। দুটোই গলায় ঝোলাবার। কাজে লাগানোর যন্ত্র। শচীনের না আছে বউ নিয়ে আদিখ্যেতা, না গদগদ ভাব, না স্বার্থত্যাগ। দায়িত্বহীন, আড্ডাবাজ, নেশুড়ে, নিস্পৃহ—এই মানুষটাকে আর সহ্য করা সম্ভব হল না মলয়ার। তার ওপর বাচ্চাকাচ্চাও হল না বেচারির। কী নিয়ে থাকবে সে?

চটেমটে মলয়া বলল, “তোমার সঙ্গে আমি থাকব না।”

কাঁচি দিয়ে গোঁফ ছাঁটতে ছাঁটতে শচীন বলল, না থাকলে—!”

“এত বড় কথা! বেশ, আমি ডিভোর্স করব তোমায়।”

“করো ।”

“তোমায় আমি শায়েস্তা করব, তবে আমার নাম।”

“ভয় দেখিও না, আমি তোমার মতন একগণ্ডা মেয়েছেলে পকেটে পুরতে পারি।”

“পারো বলেই তো আমার এই হাল।… আমি আজই চলে যাচ্ছি।”

“যাও। আই ডোন্ট কেয়ার।”

“অল রাইট।”

মলয়া তার ট্রাংক সুটকেস গুছিয়ে, লকারের চাবি নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে গেল সেই দিনই। শচীন মাথা ঘামাল না। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। সাত দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

সাত দিনের হিসেব পনেরো, তারপর একুশ দিনে গিয়ে দাঁড়াল। মলয়া আর ফিরল না। শচীন প্রথম দিকে গ্রাহ্য করেনি। ধীরে ধীরে গ্রাহ্য করতে বাধ্য হল। বাড়িতে তার দ্বিতীয় আত্মীয়া নেই। ঠিকে ঝি আর ঠিকে বামুনের ভরসায় সংসার। তারা সকালটা চালিয়ে দেয়, বিকেলে কেউ আসে না। শচীন বাড়ি থাকে না, আসবে কেমন করে। সব দিকেই অসুবিধে হতে লাগল। বাধ্য হয়েই শচীন একদিন ফোন করল শ্বশুরবাড়িতে। মলয়াই ফোন ধরেছিল। বলল, “উকিলের সঙ্গে কথা হচ্ছে। কানুদা বলেছে, সব ব্যবস্থা করে দেবে। আজকাল ডিভোর্স পাওয়া জল-ভাত। তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”

শচীন বলল, “বাঃ, নেই মানে? তুমি আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। কানু দাদার বাড়ি পেয়েছে!”

“আমি তোমার ওয়াইফ নই। লিগ্যাল ঝি ছিলাম। আর থাকব না। তুমি ছোটলোক, শয়তান।”

শচীন বলল, “বাড়াবাড়ি কোরো না, পস্তাতে হবে।”

“তোমাকেও হবে।” ফোন ছেড়ে দিল মলয়া।

শচীন তার পৌরুষকে খাটো করে গেল শ্বশুরবাড়িতে। শ্বশুরমশাই বললেন, “তুমি যা করেছ এরপর কোন মুখে এবাড়িতে এসেছ! মালু যাবে না।”

শাশুড়ি কেঁদে বললেন, “মেয়ের তুমি যা হাল করেছ, ছিছি, তোমায় পুলিশে দেওয়া উচিত।”

বড় শালা বললে, “মালুকে তুমি শ্যাটার করে দিয়েছ। ওর নার্ভ ব্রেক করেছে। ওকে আমরা আর পাঠাব না। ডিভোর্স স্যুট ফাইল করব।”

শচীন ফিরে এল। বুঝল, মাথা-খাওয়া আদুরে মেয়ের মাথা আরও নষ্ট করে দিচ্ছে তার বাপের বাড়ির লোক। এমনিতেই মলয়া আদুরি, ন্যাকা, জেদি, ছিটেল, অপদার্থ। এখন তার আরও মাথা খাবার ব্যবস্থা হচ্ছে।

শচীনের দুঃখই হল। বউ তার, অথচ মাতব্বরি করছে বাইরের পাঁচজনে।

বন্ধুদের কাছে শচীন সবই বলত। বন্ধুরা শুনত, কোনো উপায় বাতলাতে পারত না। ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ করে চলত।

শেষ পর্যন্ত আশুই একদিন বিজ্ঞাপনটা আবিষ্কার করে ফেলল। একটা কুকুর বাচ্ছা কিনবে বলে আশু স্টেটসম্যান-এর বিজ্ঞাপন হাতড়াচ্ছিল, হঠাৎ চোখে পড়ল এক মজাদার বিজ্ঞাপন। আশুর মাথা বড় সাফ। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুদের কাছে চালান করে দিল কাগজটা।

বন্ধুরা প্রথমটায় সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। আজকাল নারী জাগরণের দিন। চতুর্দিকে হইহই চলছে। লিব মুভমেন্ট, নারীবর্ষ। নানা ধরনের নারী সমিতি আসরে নামছে। তারা ভেবেছিল সেই রকম কিছু একটা হবে। এই সমিতি মেয়েদের নানান সমস্যা ও সামাজিক পীড়ন নিয়ে মাথা ঘামাবার জন্য তৈরি হয়েছে। তা হোক। কিন্তু ব্যাপারটা মেয়েদের, শচীনের মামলা তারা নেবে কেন?

আশু বলল, “কেন নেবে না! কেস শচীনদার একলার নয়, সঙ্গে বউদি আছে।”

সুবিমল বলল, “একবার ট্রাই নিতে পারে শচীন। নেয় নেবে, না নেয় না নেবে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে তো দেবে না।”

প্রতাপ বলল, “তুই চলে যা শচীন। কেঁদে ককিয়ে পড়বি। ট্রাই ইয়োর লাক।”

শচীন বন্ধুদের পরামর্শ কানে তুলে বলল, “বেশ যাব।”

দিনক্ষণ ঠিক করে দিল বন্ধুরা। শচীন যথারীতি গেল। ফিরে এসে যা বলল—তার বিবরণ আগেই দেওয়া হয়েছে।

দিন দুই বাদে অফিসে শচীন ফোন পেল। রেহানের গলা। বলল, “আপনাকে আজ একবার আসতে হবে।”

“অফিসে?”

“হ্যাঁ। পাঁচটার পর আসুন। বাই ফাইভ থারটি।”

ঢোঁক গিলে শচীন বলল, “অন্য পার্টিও কি থাকছে?”

“অন্য পার্টি? ও!… না কেউ থাকছে না। আমাদের কিছু কোশ্চেন আছে। ঘণ্টা খানেক সময় লাগবে। আপনার ফিজ লাগবে পঁচিশ টাকা।”

“পঁচিশ?”

“মেয়েদের কাছে পনেরো নিই। আপনার কাছে তিরিশ নেওয়া উচিত ছিল আমরা কনসিডার করেছি…। যদি আপত্তি থাকে আসবেন না।”

“না না আমি যাব।”

হগ মার্কেটে প্রতাপকে একটা ফোন করে খবরটা জানিয়ে দিল শচীন। “ওরে আমার ডাক এসেছে। পাঁচটায় যাচ্ছি। পঁচিশটা টাকা গচ্চা যাবে।”

প্রতাপ বলল, “সঙ্গে অ্যাসিস্ট্যান্ট নিবি? আমি খালি আছি।”

“না। একলা যাব। কবি বলেছেন—একলা চলো রে!”

“যা তবে। সন্ধেবেলায় বাড়িতে আসিস। শুনব।”

শচীন যথাসময়ে ওয়েলেসলিতে হাজির হল।

আগের মতনই সব। সেই আয়া, স্লিপ লেখা। ডাক এল সঙ্গে সঙ্গেই।

রেহানের ঘরে ঢোকার আগে শচীন আজ মাত্র দুজন মহিলাকে দেখল। একজন টাইপ করছে। অন্য জন ফাইল ঘাঁটছিল।

রেহানের ঘরে ঢুকতেই রেহান বলল, “আসুন।”

শচীন নমস্কার করল। “দেরি হয়ে গেল?”

“না, বসুন।”

বসল শচীন। দেখল রেহানকে। রেহানের পরনে তাঁতের সাদা শাড়ি, কালো পাড়। গায়ের জামা সাদা। আজ গলায় মালা নেই, যথারীতি গলায় চশমা ঝুলছে। রেহান একটা ফাইল টানল। পাতা ওলটাল। “আপনার ফাইল দেখলাম। কিছু ডিটেল দরকার।”

“বলুন?”

“আপনার স্ত্রীর ঠিকানা আপনি দেননি। ঠিকানা কী?”

শচীন ঠিকানা বলল। রেহান ঠিকানা টুকে নিল। পেনসিলটা হাতেই থাকল। “মিসেস বাপের বাড়িতে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কত দিন?”

“মাস খানেক।”

“এর মধ্যে কোনো যোগাযোগ হয়নি?”

“আজ্ঞে সরাসরি নয়। ফোনে একবার হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলাম—পাত্তা পাইনি।”

“আপনার ম্যারেজ লাইফ চার বছরের?”

মাথা নাড়ল শচীন।

রেহান পেনসিল ফেলে দিয়ে এবার একটা সিগারেট ধরাল, লাইটার দিয়ে। “আপনার এগেনসটে কী কী কমপ্লেন মিসেসের?”

শচীন দুবার মাথা চুলকাল, কাশল বারকয়েক। “আজ্ঞে, কমপ্লেন তো হাজারো রকম। স্ত্রীরা স্বামীর বিরুদ্ধে কী না কমপ্লেন করে বলুন। ফ্রম এ টু জেড—!”

“স্বামীরাও করে, আপনিও করেছেন। কাজের কথা বলুন, ইউ মাস্ট টক বিজনেস, নাথিং এলস। আপনার মিসেস যে কমপ্লেনগুলো মেইনলি করতেন—বলুন!”

“মেইনলি! বলছি…! মেইন কমপ্লেন বলতে আমার বউ…”

“বউ নয়, স্ত্রী। সম্মান দিয়ে কথা বলুন। বউ বর এ সব ভালগার ওয়ার্ড ইউজ করবেন না।”

“আজ্ঞে বউ তো…।”

“প্লিজ স্টপ। কমপ্লেনের কথা বলুন।”

শচীন পকেট থেকে রুমাল বার করল। কপাল মুছল। বলল, “আমার স্ত্রীর মেইন কমপ্লেন হল—আমি স্ত্রৈণ নই।”

“স্ত্রৈণ! মানে আপনি স্ত্রীর বাধ্য ছিলেন না?”

“আজ্ঞে, কোনো কালেই নয়। স্ত্রী তো আমার জননী নয় যে বাধ্য হব!”

“আপনি বড় বাজে কথা বলেন।” বলেই রেহান বেল বাজালেন।

পাশের ঘর থেকে ফরসা বেঁটে ওজনদার এক মহিলা এসে দাঁড়াল।

রেহান বললেন, “সন্ধ্যা, জাস্ট সিট ডাউন। এই ভদ্রলোককে আমি তোমার কেয়ারে দিচ্ছি। তুমি কেসটা হ্যান্ডল করবে। এখন বসো, লিসন টু আওয়ার টকস। পরে ফাইলটা দেখে নিও। নিন, কমপ্লেনগুলো বলুন।”

শচীন সন্ধ্যা নাম্নী মহিলাকে দেখে নিল। সব দিকেই মানানসই। পছন্দই হল শচীনের। শচীন বলল, “আজ্ঞে আমার স্ত্রীর ধারণা, আমি ইরেসপনসিবল আমি আড্ডাবাজ। আমার মায়াদয়া নেই। আমি স্বার্থপর। স্ত্রীকে নাকি আমি ইগনোর করি। আমি নেশাখোর। আর লাস্টলি হল, আমি ইয়ে—মানে ফ্যামিলি ক্রিয়েট করছি না।” বলে শচীন অসহায় মুখ করল।

“বাচ্চা কাচ্চা না হবার কারণ?”

“ভগবান জানেন।”

“ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

“সব রকম। সবাই আশা দিচ্ছে। কিন্তু…”

“বুঝেছি। তা আপনার কী কী গ্রিভান্স আছে স্ত্রীর বিরুদ্ধে?”

শচীন নিজে এবার সিগারেট খাবার জন্যে উসখুশ করতে লাগল। তারপর পকেট থেকে প্যাকেট বার করল সিগারেটের। “আমার গ্রিভান্স একটাই। আমার বউ—মানে স্ত্রী টু মাচ আদুরে। তার বাপের বাড়ি বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে মলয়ার। খুকি করে রেখে দিয়েছে।”

রেহান হাতের সিগারেট অ্যাশট্রেতে গুজে দিল। বলল, “অন্য কিছু না?”

“না, স্যার”, বলেই নিজেকে শুধরে নিল শচীন, “সরি ম্যাডাম।”

আবার পেনসিল তুলে নিয়ে দাঁতে টোকা দিল রেহান। “ডিভোর্সের প্রপোজালটা কার?”

“আমার স্ত্রীর!”

“তা ডিভোর্স যদি হয়—আপনার অসুবিধে কী?”

শচীন সিগারেট ধরাল। ধোঁয়া গিলে বলল, “অসুবিধে কিছুই নেই তেমন। তবে আফটার অল চার বছর একসঙ্গে ছিলাম। ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তা ছাড়া ভদ্রলোক একবারই বিয়ে করে। আমি আবার একটা বউ কোথায় পাব বলুন?”

রেহান বলল, “ঠিক আছে। আমরা দেখি কী করতে পারি।… ওই সন্ধ্যা আপনার কেস হ্যান্ডল করবে। আপনি ওর অ্যাডভাইস মতন চলবেন। ভাল কথা, সন্ধ্যার ঘোরাফেরা, এটা-ওটার কস্টও আপনাকে বিয়ার করতে হবে। সেটা আমাদের বিলে থাকবে না। আমরা পরে একটা বিল করব আপনাকে। অফ কোর্স ব্যাপারটা সেটল করতে পারলে।”

শচীন একবার সন্ধ্যার দিকে তাকাল।

রেহান বলল, “আমাদের চার্জটা?”

“ও! হ্যাঁ!” শচীন মানিব্যাগ খুলে পঁচিশটা টাকা বার করল।

টাকা নিল রেহান। “সন্ধ্যা, ওঁকে রসিদ দিয়ে দাও।”

প্রতাপরা অপেক্ষা করছিল বাড়িতে। শচীন আসতেই হর্ষধ্বনি করে উঠল।

“আয় আয়—হাঁ করে বসে আছি। কী হল?”

শচীন বলল, “দাঁড়া আগে দম নিই তারপর বলছি।”

গজেন তার চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল শচীনকে। “নাও দাদা, চা খাও, তোমার গলা শুকিয়ে গিয়েছে।”

চা খেতে খেতে শচীন বিকেলের বৃত্তান্ত বর্ণনা করল।

সব শুনে সুবিমল বলল, “তোর তো ভালই হল রে? নাকের বদলে নরুণ পেলি। লেগে যা। উইশ উই বেস্ট লাক।”

সন্ধ্যা মেয়েটিকে বেশ পছন্দই হয়ে গেল শচীনের। অবশ্য সন্ধ্যা মেয়ে নয়, মহিলা। বছর বত্রিশ বয়েস। গোলগাল চেহারা। একটু ভারি গড়ন। গায়ের রং ফরসা। মুখটি হাসিখুশি মাখানো। বিবাহিতা। চট করে ধরা যায় না। স্বামী থাকে জাহাজে। মেরিনের লোক। ছ’ মাসে ন’ মাসে ঘরে ফেরে।

সন্ধ্যার আর সবই ভাল। বুদ্ধিমতী, স্মার্ট, জীবন্ত। কিন্তু বড় বেশি খাদ্যলোভী। শচীনকে নিয়ে যখন রেস্টুরেন্টে ঢোকে কম করেও দশ বারো টাকার খাদ্য একাই খায়। দুটো মোগলাই একসঙ্গে যদি বা সাঁটা যায়, তার সঙ্গে ডবল ডেভিল কেমন করে মানুষ হজম করে কে জানে। কাটলেট আর চপ একই সঙ্গে কেমন করে ওড়ায় মানুষ কে জানে! ভেলপুরি, চানা মটর তো হরদম হচ্ছে। মুহূর্মুহূ কোল্ড ড্রিঙ্ক। তার সঙ্গে ট্যাক্সি, সিনেমা।

শচীন হিসেব করে দেখল সাত দিনে সন্ধ্যার পিছনে তার প্রায় শ’ দুয়েক টাকা বেরিয়ে গিয়েছে। এইভাবে চললে কলসির জল তো ফুরিয়ে যাবে।

সেদিন বিকেলে মেট্রো সিনেমার কাছে দেখা হতেই সন্ধ্যা বলল, “আধঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, ব্যাপার কী?”

“একটু দেরি হয়ে গেল। অফিসের কাজ।”

“আমার খিদে পেয়ে গিয়েছে। টিকিট কেটেছেন কুরবানির?”

“না, পারিনি।”

“জানতাম আপনি পারবেন না। আমি কেটে রেখেছি। নাইট শো।”

“নাইট শো।”

‘আটটা থেকে। আগে চলুন পেট ঠাণ্ডা করি। মার্কেটের রেস্টুরেন্টে যাব। বেড়াব খানিকটা, তারপর কুরবানি।”

শচীন বলল, “আজ আমার শরীরটা ভাল নেই। জ্বর জ্বর লাগছে।”

“ও ঠিক হয়ে যাবে। একটা স্যারিডনই যথেষ্ট। লেট আস গো।”

শচীন হিসেব করে দেখল, আজ তার অন্তত পঁচিশ ত্রিশ টাকা গচ্চা যাবে। উপায় নেই। পরের বউ বা অন্য মহিলা নিয়ে ঘোরাফেরা সত্যি বড় এক্সপেনসিভ। নিজের বউ এর ফিফটি পার্সেন্টও ছিল না। শচীনের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

রেস্টুরেন্টে খেতে বসে শচীন বলল, “ওদিকে আমার কতটা কাজ হল?”

“হচ্ছে।”

“হচ্ছে মানে?”

“কথাবার্তার চেষ্টা চলছে, সন্ধ্যা বলল ফাউল কাটলেট চিবুতে চিবুতে। “আপনার স্ত্রী ভীষণ অ্যাডামান্ট।”

“বলছে কী?”

“অনেক কথা। আপনি কোনো ভাবেই স্বামী হবার যোগ্য নয়।”

শচীন মাছ মাংসের দিকে যায়নি। পুডিং চা খাচ্ছিল। সন্ধ্যা আজ সিল্কের শাড়ি পরেছে, চন্দনের রং ব্লাউজটা একেবারেই খাটো, চুলের স্টাইল পালটেছে, দারুণ গন্ধ মেখেছে। শচীন বলল, “যোগ্য নয় বললে আমি আর কী বলব! আচ্ছা আপনিই বলুন—?”

“কী বলব?”

“না, আমার সঙ্গে মেশামেশিতে আপনার কী মনে হচ্ছে?”

সন্ধ্যা মুখ তুলে শচীনকে দেখল। চোখ ভরা হাসি। “আমার তো খুবই পছন্দ আপনাকে। ভীষণ।”

শচীন খুশি হল। “তা হলে? আপনার মতন মহিলা যদি পছন্দ করতে পারেন আমাকে আমার স্ত্রী কেন পারবেন না বলুন?”

সন্ধ্যা কাঁটা চামচ নামিয়ে দু হাত খোঁপার কাছে তুলে চুল ঠিক করল। হাসল। “সকলের পছন্দ এক নয়। আমি আপনাকে যতই দেখছি ততই ইমোশানালি অ্যাটাচড হয়ে পড়ছি। সত্যি! আমাদের যদি আগে দেখা হত…”

শচীন আহ্লাদে গলে গেল যেন। “কপাল! জীবনটা এই রকমই। যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাহি না…।”

“বাঃ! আপনি কবিতা লেখেন নাকি? কবিরা স্বামী হলে স্ত্রীদের কত আনন্দ—তাই না?”

শচীন সিগারেট ধরাল। “না আমি কবি নই। তবে আপনাকে দেখে মাঝে মাঝে পোয়ট্রি ফিল করি।”

সন্ধ্যা যেন খেলাচ্ছলে বুকের আঁচল সরিয়ে আবার শাড়ির ভাঁজ ঠিক করল। চাপা হাসি মুখে। “আমি জানি। আপনার চোখ বলে আপনি কী ফিল করেন। কিন্তু আমি কী ফিল করি আপনি বোঝেন?”

শচীন বলতে গিয়েও বলল না। তাকিয়ে থাকল।

সন্ধ্যা বলল, “পুরুষরা মেয়েদের কথা বোঝে না। আমরা কিন্তু আপনাদের কথা বুঝি।…নিন, এবার উঠব। আর ভাল লাগছে না। কুরবানিতে আমাদের সিট খুব ভাল।”

খানিকটা ঘোরাফেরা শেষ করে সিনেমা হলে।

সন্ধ্যার বাহাদুরি বলতে হবে। চমৎকার এক জোড়া সিট জোগাড় করেছে। একেবারে পিছনের সারি, ডানপাশের দেয়াল ঘেঁষা।

শচীন হিন্দি সিনেমার ভক্ত নয়। মাঝে মাঝে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যায়। রগড় দেখে আর হাসে।

সিনেমায় তার মন ছিল না। সন্ধ্যার সঙ্গে একটু খেলাখেলি করার ইচ্ছেই ছিল আসল। পায়ে পায়ে, কনুইয়ে কনুইয়ে, কাঁধে কাঁধে কিছুক্ষণ খেলাধুলো চলল, তারপর শচীন বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুরে আসি।”

‘ঘুম! এই রকম ছবি দেখা ছেড়ে?”

“আমার এই সময়ে একটু ঘুম-ঘুম পায়। বাইরে একটা চক্কর দিলে ঘুম কেটে যাবে। আপনি বরং ছবি দেখুন, আমি শোয়ের শেষে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।”

“ঠিক?”

“বিলকুল ঠিক।”

“আসুন তা হলে?”

শচীন বেরিয়ে গেল। বাইরে এসে ঘড়ি দেখল। হাতে ঘণ্টা খানেকেরও বেশি সময়। ব্রিস্টল থেকে দেড়খানা মেরে আসা যায়। আর দাঁড়াল না শচীন। হন হন করে ছোট ব্রিস্টলের দিকে এগুলো।

শচীন তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। মুখে পান সিগারেট। চোখ সামান্য লালচে। সন্ধ্যা আসতেই শচীন হাত তুলল। “এই যে!”

কাছে এল সন্ধ্যা। শচীন বলল, “একটু তাড়াতাড়ি করুন। বৃষ্টি আসবে।”

“তাই নাকি? তা হলে ট্যাক্সি ধরতে হয়।”

“ধরা যাবে। আসুন।”

সন্ধ্যাকে নিয়ে ফাঁকায় আসতেই ট্যাক্সি পাওয়া গেল।

সন্ধ্যাকে উঠিয়ে শচীন উঠছে তার কানে এল কে যেন বলল, “শালার হেভি ব্ল্যাক মানি। সুখের পায়রা মাইরি। কেমন জুটিয়েছে।”

শচীন তাকাল। জনাপাঁচেক লোফার টাইপের ছোঁড়া।

ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে শচীন বলল, “আমি একটা কথা ভাবছিলাম।”

“জানি” সন্ধ্যা বলল।

“জানেন? কী—?” শচীন গায়ে গায়ে বসল, একটা হাত সন্ধ্যার পিঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে দিল। “কী জানেন?”

“আপনিই বলুন?”

“না, আপনি। মেয়েরা অনেক কিছু আগে বোঝে বলছিলেন না তখন? দেখি, কী বুঝেছেন আপনি?”

সন্ধ্যা খানিকটা ক্লান্তির ভাব করে আরও ডুবে গেল গদির মধ্যে। তার কাঁধে শচীনের হাত। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সন্ধ্যা বলল, “ভাবছিলেন ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়াই ভাল। তাই না?”

শচীন হাঁ হয়ে গেল। বলল, “একজ্যাক্টলি। আপনি কি থট রিডিং জানেন?”

“তা জানি। কিন্তু একতরফা যদি ডিভোর্স হয় লাভ কী? আমার তো মুক্তি নেই।”

“আপনিও করে নিন।”

“তার পর?”

“তারপর তো সবই সম্ভব। আমরা দুজনেই তখন মুক্ত।”

“না বাবা, আমার অত মুক্ত থাকতে ভাল লাগে না।”

“আহা—অত থাকবেন কেন? দু-এক মাস। তারপর আমরা যুক্ত হব।”

সন্ধ্যা শচীনের ঝোলানো এবং চঞ্চল হাত নিয়ে খেলা করতে লাগল। “মুখেই বলছেন। কাজের বেলায় তখন—?”

“না না মুখে বলব কেন! আমি মন থেকে বলছি।”

“যাঃ! মদ খেয়ে বলছেন?”

শচীন যেন বেজায় ধাক্কা খেল। বলল, “মাত্র দেড় খেয়েছি। এতে মাথা গোলমাল হয় না। যা বলছি একেবারে সজ্ঞানে।”

“সজ্ঞানে কেউ বোকা কথা বলে না,” সন্ধ্যা হাসল।

“মানে?”

“মানে আপনি আমার কেস। ক্লায়েন্ট। আপনার পরামর্শ শুনতে গেলে আমার কী দশা হবে! রেহানদি তাড়িয়ে দেবে আমায়। আমার চাকরি যাবে।”

“যাক। আমি চাই তোমার চাকরি যাক। কিসের পরোয়া তোমার! আমার সবকিছু তোমার।” বলে শচীন সন্ধ্যার কোলের ওপর ঢলে পড়ল।

সন্ধ্যা শচীনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি একেবারে নেংটি মাতাল। আমার এই নেংটি মাতালদের ভাল লাগে না। একদিন ধেড়ে মাতাল হয়ে কোলে শুয়ো তখন ক-ত আদর করব। নাও ওঠো। আর ন্যাকামি কোরো না।” বলে সন্ধ্যা চুলের ঝুঁটি ধরে শচীনকে তুলে বসিয়ে দিল।

জরুরি তলব রেহানের। টেলিগ্রাম হলে লেখা হত: কাম শার্প। ফোনে রেহান গম্ভীর গলায় বলল, “ছ’ টায় আসুন। জরুরি দরকার।”

শচীন বেশ ভয় পেল! দিন দুই আর দেখা নেই সন্ধ্যার। হয়তো অসুখ-বিসুখ করেছে। তার বাড়িটাও জানে না শচীন। জানবার চেষ্টা করেও পারেনি। সন্ধ্যা বলেছে, এটা আমাদের বলতে নেই। কনফিডেনসিয়াল। কী হবে বাড়ির ঠিকানা জেনে, ঠিকানার মানুষই তো হাজির।

শচীন এটাও লক্ষ করেছে, সন্ধ্যাকে যখনই ট্যাক্সি চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিতে গিয়েছে এলগিন রোডের মুখে এসে সন্ধ্যা বলেছে, আর নয়—এবার আপনি আসুন.’ একটা লোক এলগিন রোডের মুখ থেকে যে কোনো দিকে চলে যেতে পারে—সোজা ডাইনে বাঁয়ে—কাজেই সন্ধ্যা কোন দিকে যায়, কতটা যায়—তা শচীনের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

শচীন ভাবল প্রতাপকে একবার ফোন করে। করল না। করে লাভ নেই।

ঘড়িতে ছ’টা বাজার আগে আগেই শচীন রেহানের অফিসে গিয়ে হাজির। অন্যদের দেখল, সন্ধ্যাকে দেখতে পেল না।

রেহানের ঘরে ঢুকতেই দেখল, রেহান একেবারে সার্কাসের ড্রেস পরে বসে আছে। প্যান্ট, গেঞ্জি ধরনের জামা। হাতে সিগারেট।

শচীন প্রথমেই কেমন ভড়কে গেল।

“বসুন।”

বসল শচীন। রেহান টেবিল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিল। দু মুহূর্ত চুপচাপ! তারপর বলল, “আপনি গত দু’ হপ্তা কী কী করেছেন—তার রিপোর্ট আমি দেখেছি। নাউ টেল মি, আপনার মোটিভটা কী?”

শচীন ঘাবড়ে গেল। “মানে?”

“মানে, আপনি কোন মতলব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? আপনার স্ত্রীকে আপনি ফিরে পেতে চেয়েছিলেন—তাই না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই।”

“আপনার স্ত্রী ডিভোর্সের মামলা আনছেন এই ভয়ে আপনি আমাদের কাছে ছুটে এসেছিলেন। আপনি চাইছিলেন, এই মামলা যেন তোলা না হয়। ইউ আর উইলিং টু গেট ব্যাক ইওর ওয়াইফ! কারেক্ট?”

শচীনের মনে হল, রেহান নিশ্চয় ল’ পাস করেছে, এবং প্র্যাকটিস করে। চমৎকার জেরা করছে। শচীন বলল, “হ্যাঁ, দ্যাটস রাইট।”

“মুখে রাইট বলছেন, কিন্তু কাজে কী করছেন?”

“কাজে। কেন, কাজে কী করব! আই ডিড নাথিং।”

“মিথ্যে কথা বলবেন না।” বলেই রেহান ফট করে টেবিলের ফড়িং টাইপের বাতিটা জ্বেলে দিয়ে হাতের কাছের ফ্ল্যাট ফাইল তুলে নিল। ফাইলটা তুলে নাচাবার ভঙ্গি করল—যেমন করে লোকে হাতের চাবুক নাচায়। “এখানে আপনার ডে টু ডে অ্যাকটিভিটি লেখা আছে নিন দেখুন—।’ রেহান ফাইলটা ছুড়ে দিল। দিয়ে ল্যাম্পটার মুখ ঘুরিয়ে দিল। “রিড ইট।”

শচীন রীতিমত ঘাবড়ে যাচ্ছিল। ফাইলটা খুলে নিয়ে পাতা ওল্টাল।

পাতা উলটে শচীন অবাক। সন্ধ্যা প্রতিদিনের রিপোর্ট পেশ করেছে বেশ গুছিয়ে। এরকম রিপোর্ট সামারি পেলে অফিসের বড়কর্তারা নিশ্চয় খুশি হতেন। কখন কোথায় দেখা হল, দেখা হবার পর কোথায় যাওয়া হল, কথাবার্তা কী হল, কেমন খাওয়া-দাওয়া হল—তার সমস্ত বিবরণ সংক্ষেপে লেখা।

শচীন এর কোনোটাই আপত্তি-যোগ্য বলতে পারে না।

“দেখলাম। কিন্তু আপনি যে বলেছেন আমি কিছু করেছি, কই, এখানে তা লেখা কোথায়?”

রেহান আবার একটা সিগারেট ধরাল। “করেননি?”

“না।”

“আপনি শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন?”

“চোখ বুলিয়েছি।”

“দুজনে মিলে নাইট শোয়ে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন?”

“গিয়েছিলাম।” শচীন সাহস সংগ্রহের জন্যে একটা সিগারেট ধরাল।

“সিনেমা হলে আপনি—কী বলব—সন্ধ্যার হাত-টাত কাঁধ ধরেছিলেন?”

“ধরাধরির কী আছে মশাই! উনি টিকিট কেটেছিলেন নিজে। সিট দুটোও ভাল ছিল। চুপচাপ বসে সিনেমা দেখতে আমি পারি না। আমার একটু ইয়ে হয়…। আমি জাস্ট মজা করছিলাম।”

“মজা!… মজা ছেড়ে আপনি মদ খেতে বেরিয়ে গেলেন?”

“মজা ঠিক মতন করতে না পারলে বোর করে। আমার হাই উঠছিল, ঘুম পাচ্ছিল। সামান্য খেতে বেরিয়েছিলাম।”

রেহান হাত বাড়াল। ফাইলটা ফেরত নেবে। “সিনেমা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে আপনি যা সব কাণ্ড করেছেন তা থেকেই বোঝা যায় আপনি তো একটা যাচ্ছেতাই ধরনের মানুষ।”

শচীন চুপ করে থাকল দু’মুহূর্ত, তারপর বলল, “কাণ্ড কিছুই করিনি। মানে তেমন কিছু!”

“করেননি! ইউ আর এ ড্যাম লায়ার! সন্ধ্যার হাত ধরে কী সব বলেছিলেন? ছি ছি, এদিকে আমাদের কাছে কাঁদুনি গাইতে এসেছেন, স্ত্রী যেন ডিভোর্স না করে, ওদিকে অন্য একজনের স্ত্রীকে উসকোচ্ছেন সে যাতে স্বামী ত্যাগ করে। তারপর…”

“আমি”, শচীন বাধা দিয়ে বলল, “কী বলেছি খেয়াল নেই। টু টেল ইউ ফ্র্যাংকলি খানিকটা নেশার ঘোরে ছিলাম। তবে হ্যাঁ, এটা বলেছিলাম, আমার তো কিছু হল না—আপনারও যা হাল—তাতে দুজনেই লেজ খসিয়ে পরে আবার ইয়ে করলে ভাল হয়।”

“ভাল হয়! আশ্চর্য! আপনি একজন পরস্ত্রীকে…”

“দেখুন! পরস্ত্রী-টরস্ত্রী জানি না। আমার গাঁটগচ্ছা কত যাচ্ছিল রোজ জানেন! বাড়িতে হিসেবের খাতায় লিখে রেখেছি।”

রেহান টেবিলের ওপর জোর থাপ্পড় মারল। “চুপ করুন। খরচার কথা তুলবেন না। আপনাকে বলাই হয়েছিল, সন্ধ্যার প্রফেশন্যাল এক্সপেন্সেস আপনাকে দিতে হবে। আপনি রাজি হয়েছিলেন।”

শচীন মাথা কাত করল। “হয়েছিলাম। তা বলে এত খরচ? মশাই খাওয়ার শেষ নেই। এক এক দিন চোদ্দো টাকার খাবার একাই খেতেন উনি। তার ওপর সিনেমা, ট্যাক্সি চড়ে হাওয়া খাওয়া…! আমাকে ফতুর করার জন্যে আপনি এই জিনিসটি আমার ঘাড়ে চাপিয়েছিলেন। তা আমি দেখলাম—পয়সা যখন যাচ্ছে তখন আমিই বা একতরফা খরচ করে যাই কেন শুধু শুধু, একটু রিটার্ন তো দরকার।”

রেহান বিকটভাবে চিৎকার করে উঠল, “রিটার্ন! দাঁড়ান রিটার্ন দেখাচ্ছি।” বলতে বলতে রেহান ঘণ্টি টিপল। ও-ঘর থেকে একজন এসে দাঁড়াল।

“সন্ধ্যাদের আসতে বল!”

শচীন কেমন ঘাবড়ে গেল। যাচ্চলে, সন্ধ্যাও আছে তা হলে? কোথায় ছিল সন্ধ্যা লুকিয়ে, শচীন তো দেখতে পায়নি!

রেহান হাত বাড়িয়ে ল্যাম্পটা টেনে নিজের দিকে করে নিল।

শচীন বলল, “একটা কথা বলব?”

“বলুন?”

“আমি আপনাদের অ্যায়সা প্যাঁচে পড়েছিলাম যে প্যাঁচ কেটে বেরুবার উপায় পাচ্ছিলাম না। ইচ্ছে করেই ওসব করেছি।”

“আমরা আপনাকে প্যাঁচে ফেলেছিলাম?”

“দারুণ প্যাঁচে ফেলেছিলেন। বউ ফিরিয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে এক্সপ্লয়েট করছিলেন। আপনারা…”

শচীনের কথা শেষ হল না, দরজা খুলে সন্ধ্যা এল; সঙ্গে আর-এক মহিলা।

শচীন তাকিয়ে দেখল। তারপর তার ধাত ছেড়ে যাবার জো। মলয়া। একেবারে জ্বলজ্যান্ত। শচীনের গলা শুকিয়ে গেল।

রেহান সন্ধ্যাদের দেওয়াল-ঘেঁষা সোফায় বসতে বলল। তারপর শচীনের দিকে তাকাল। “আপনি বলছিলেন, আমরা আপনাকে প্যাঁচে ফেলেছি। তা খানিকটা ফেলেছি অবশ্য। যে রিপোর্টগুলো আপনি দেখলেন, তার একটা করে কপি আমরা সব সময় আপনার স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়েছি, টু ইনফর্ম হার অ্যাবাউট ইওর মিসডিডস!”

শচীন ঘামতে লাগল। এ তো সর্বনেশে জায়গা রে বাবা!

রেহান সন্ধ্যাদের দিকে তাকাল। মলয়াকে বলল, “ভাই, এবার আমি তোমাকে ওই স্বামী নামক মানুষটির কিছু কথাবার্তা শোনাব। প্লিজ লিসন।” বলে রেহান কোথায় একটা কল টিপল। তারপর শোনা গেল শচীনের গলা।

শচীন চমকে উঠেছিল। তারপর বুঝতে পারল রেহান আজকের কথাবার্তা কায়দা করে টেপ করে নিয়েছে। টেবিল ল্যাম্পটার দিকে তাকাল শচীন। তার একবারও মনে হয়নি, ওটা শুধু বাতি নয়, আর-এক গেঁড়াকল।

রেহানের টেবিলের আড়াল থেকে টেপ বাজতে লাগল।

আর শচীন বসে বসে ঘামতে লাগল।

শেষকালে টেপ শেষ হল।

একেবারে চুপচাপ।

রেহান বলল, “ভাই মলয়া, এই তোমার স্বামী। নিজের কানেই সব শুনলে। তুমি কি ওঁর কাছে ফিরে যেতে চাও? না কি ডিভোর্স স্যুট ফাইল করবে? আমরা তোমার তরফে সাক্ষী দিতে পারি। রেডি ডকুমেন্ট আছে।”

সন্ধ্যা বলল, “আমি কোর্টে আরও অনেক কিছু বলব। মোস্ট আনফেথফুল হাজবেন্ড। তুমি ডিভোর্স পেয়ে যাবে।”

শচীন চিৎকার করে বলল, “এ-সব কী হচ্ছে! বাঃ! আমি বউ ফেরত পাবার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরছি—আর আপনারা ব্যাপারটা কাঁচিয়ে দিচ্ছেন!”

রেহান বলল, “আপনি কি স্ত্রী ফেরত পাবার যোগ্য?”

“তার মানে!” শচীন আসামীর মতন মলয়ার দিকে তাকাল। “আমার এখানে আসার উদ্দেশ্যটা কী ছিল বলুন? স্ত্রীর জন্যেই এসেছিলাম। শালীদের জন্যে নয়।”

রেহান থ। তারপরই গর্জন। “কী বললেন, শালী!”

শচীন বলল, “স্ত্রীর বোনরা শালীই হন। বাংলা মতে। …নিন, অনেক হয়েছে, আর আমায় ঘাঁটাবেন না।” বলে শচীন মলয়ার দিকে তাকাল। “তুমি তোমার দিদিদের সব কথা বিশ্বাস কোরো না, প্লিজ। যা করেছি তোমার জন্যে। ঘরে চলো লক্ষ্মী! পা ধরব?”

সন্ধ্যা খিল খিল করে হেসে উঠল।

রেহানও হাসছিল। হাসতে হাসতে বলল, “মলয়া, এমন লেজকাটা ভগ্নিপতি আমি দেখিনি ভাই। তা যা করার তোমরাই ঠিক করো। এই মশাই, বউ নিয়ে যান আর না-যান আমাদের পুরো ফিজ কিন্তু দিয়ে যাবেন।”

ট্যাক্সিতে পাশাপাশি বসে শচীন বলল, “তুমি আমার বাইরে বাইরে চিনলে ভাই, ভেতরটা দেখলে না?”

মলয়া কথা বলল না।

শচীন স্ত্রীর হাত টেনে নিয়ে বলল, “তোমার প্রাণে একটু মায়া নেই। চার বছরের স্বামী। দেড় মাস তাকে খেলালে?”

মলয়া বলল, “মায়া-টায়া জানি না। তবে খুব খেলছিলে। তোমার খেলার কথা শুনে গা আমার রিরি করত, বাড়ি চলো—খেলা দেখাব।”

শচীন বউয়ের কোলে হাত ডুবিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই দেখাবে। তোমার খেলা না দেখে মরে যাচ্ছিলাম মাইরি।”

মলয়া স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “অসভ্যতা কোরো না।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন