বেলা শেষের আলোয়

অর্পিতা সরকার

বেলা শেষের আলোয়

আশ্রমে সকালের দিকেই ডাক্তারের গাড়িটা ঢুকল।

অপর্ণার বরাবরের অভ্যেস ভোর ভোর ঘুম থেকে ওঠা। যখন সংসারের মধ্যে ছিল তখন ভোরে উঠেও কাজকর্ম সামাল দিতে পারত না। আর এই আশ্রমে সকাল সকাল উঠেও কোনো কাজ নেই।

নিরবচ্ছিন্ন অবসর। একঘেয়ে অবসর।

সাংসারিক জীবনে দুদণ্ড অবসরের জন্য মন কেঁদে উঠত। দুপাতা বই পড়ার সময় পেতো না অপর্ণা। আর এখন বই পড়ে পড়েও সময় কাটানো দুঃসহ ব্যাপার হয়ে গেছে। তাই অরুন্ধতীদির পরামর্শে সকালে উঠে আশ্রমের বাগানে চলে যায় অপর্ণা। গাছগাছালি আর রঙিন ফুল প্রজাপতির সাথে গল্প করে কাটে বেশ কিছুক্ষণ। ”সূর্যাস্ত” কে বৃদ্ধাশ্রম বলতে কয়েকজনের বেশ আপত্তি আছে। বিশ্বনাথবাবু মানে এক্স আর্মি অফিসার তার মধ্যে একজন।

ওনার মতে আমরা কেউ বুড়ো নই। আমরা স্বেচ্ছায় সংসার জীবনের এক কোণের নির্বাসন থেকে বাঁচতেই এসে পৌঁছেছি সূর্যাস্তের মধ্যে। এখানে আমাদের সমবয়সি কত বন্ধুবান্ধব। একবারের জন্যও কেউ বলে না, আঃ তোমার বয়েস হয়েছে বাবা, সব ব্যাপারে এত কথা বলো না তো। নিজের ঘরে, নিজের মতো কাটাও না সময়টা!

সারাদিনের নিঃসঙ্গতা, আপনজনের কাছ থেকে শীতল ব্যবহার পেতে পেতে আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছিলাম। সূর্যাস্ত আমাদের সেই অকালবার্ধক্য থেকে পরিত্রাণ দিয়েছে। সকলে একবাক্যে মেনে নিয়েছে আর্মি অফিসারের কথাটা।

তাই কেউ আর সূর্যাস্তকে বৃদ্ধাশ্রম বলে না।

অপর্ণা হলদে গোলাপের গোড়ার জমে থাকা একগুচ্ছ ঘাসকে পরিষ্কার করার সময়েই দেখতে পেল সকাল সকাল একজন ডাক্তারের গাড়ি ঢুকল আশ্রমে। বিশ্বনাথবাবু যতই না মানুক সূর্যাস্তের মানুষরা কেউ প্রৌঢ় নয়, অপর্ণা জানে ষাটের ওপরে মানুষগুলোর শরীরে নানা রোগের বাস। রোগকে অস্বীকার করার ক্ষমতা হয়তো আর্মি অফিসারের আছে, কিন্তু বাকি সকলের নেই। তাই মাঝে মাঝেই রুটিন চেকআপের জন্য ডক্টর আসেন সূর্যাস্তের বিশাল গেটটা পেরিয়ে।

হলুদের থেকে লাল গোলাপগুলো আকারে বেশি বড় হয়েছে। তাই বলে অপর্ণা হলুদের থেকে বেশি লালকে যত্ন করেছে তা নয়।

শোভন আর সুনন্দা দুজনকেই একইরকমভাবে পেটে ধরেছিল অপর্ণা। তাই দুজনের যত্নেরই ত্রুটি রাখেনি ও। যদিও শোভনের ধারণা ছিল, মায়ের বেশি আদরের মেয়ে সুনন্দা।

এটাই তো সমস্যা, বিজ্ঞান এত এগিয়ে গেলেও মনের ভিতরে প্রবেশ করার মতো কোন যন্ত্র এখনো কেউ আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি। তাই সেদিনও শোভনকে নিজের অন্তরটা দেখাতে পারেনি অপর্ণা, আর আজ সুনন্দাকেও দেখাতে পারল না।

সূর্যাস্তে অপর্ণা এসেছিল জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। তা প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। সুনন্দার ছেলেটার বয়েস যখন পাঁচ বছর হল, তখনই সুনন্দা বলল, মা তুমি বরং কোনো ওল্ডএজ হোমে গিয়ে থাকো। ছোট ফ্ল্যাট, রনি স্কুলে ভর্তি হয়েছে, অনির্বাণ আর আমি তো সারাদিন অফিসে…আগে তাও রনিকে নিয়ে সময় কাটাতে পারতে, এখন তুমি সারাদিন করবেটা কি এইটুকু ফ্ল্যাটের মধ্যে! তার থেকে বরং ওল্ডএজ হোমে অনেক বন্ধুর সাথে ভালো থাকবে। তোমার জামাইও বলছিল, মা বড্ড বোর হয়।

সুনন্দার কথায় প্রথমে চমকে উঠেছিল অপর্ণা। সদ্য রিটায়ার করেছে স্কুল থেকে। এতদিন পর্যন্ত তো স্কুল সামলে সুনন্দার সংসার, সন্তান এগুলোও সামলেছে অপর্ণা। মাত্র ছয়মাস হল রিটায়ার করেছে ও। নিশ্চিন্ত মনে একটু ছুটি কাটবে ভেবেছিল মেয়ে, জামাই, নাতির সাথে। কিন্তু তারা তো অপর্ণার একেবারে ছুটির ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপর্ণা স্তম্ভিত গলায় শুধু একটা কথাই বলেছিল, সুনন্দা আমার ব্যবস্থা আমিই করে নেব, জামাইকে বারণ করিস অত চিন্তা করতে।

সুনন্দা আলগোছে বলেছিল, আসলে মা ওকে দোষ দেওয়া যায় না। অনির্বাণ খুব ভালো ছেলে বলেই আমায় বিয়ে করেছে। না হলে তোমার আর বাবার সেপারেশনের কথা শুনে বেশিরভাগ পাত্রই তো পালাচ্ছিল। মা, আমি অনির্বাণকে ভালোবাসি। তাই আমি তোমার মতো রনিকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি কখনো। তুমি যেমন সারাটা জীবন বাবাকে ছেড়ে কাটিয়ে দিলে সেভাবে আমি থাকতে চাই না। তাই নিজের সংসারটা এবার নিজে গুছিয়ে নিতে চাই। অনির্বাণ ভয় পায় মা। আমিতো তোমারই সন্তান, তাই আমার মধ্যেও যদি আলাদা থাকার প্রবণতা কাজ করে, তাই ও ভয় পায়!

তুমি রাগ কোরো না মা, আমি চাই না, তুমি এবাড়িতে থাকার জন্য আমার আর অনির্বাণের মধ্যে কোনো মানসিক দূরত্ব তৈরি হোক!

স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অপর্ণা। তার গর্ভের সন্তানের এমন পরিপাটি গোছানো কথা শুনে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছিল অপর্ণার, এই মেয়েই মাঝরাতে বাথরুমে যাবার জন্য মাকে ডেকে তুলত? এই মেয়েরই মায়ের চুল বাঁধা ছাড়া পছন্দ হত না? এই মেয়েই বিয়ের রাতে বলেছিল, আমার মাও থাকবে আমার সাথে। মাকে ছাড়া আমি বাঁচব না!

ভাবতে কষ্ট হলেও নিজের কান আর চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না। তাই সুনন্দার স্পষ্ট করে বলা কথাগুলোর অর্থ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল অপর্ণার কাছে। সুনন্দা বা অনির্বাণ কেউই চায় না অপর্ণা তাদের সংসারে থাকুক। এরপরেও যদি অপর্ণা মেয়ের বাড়িতে পড়ে থাকে, তাহলে আত্মসম্মান শব্দের অর্থটাই ওর কাছে ঝাপসা হয়ে যাবে।

রনির দিদান ডাকটার জন্য কষ্ট হবে বৈকি। সুনন্দার মা ডাকটা মিস করবে তো বটেই। তবুও…

নিজের লাগেজ প্যাক করতে সময় নেয়নি অপর্ণা।

সুনন্দা বলেছিল, মা, আমি তোমাকে কালকেই চলে যেতে বলিনি। আমরাই একটা ভালো ওল্ডএজ হোমের ব্যবস্থা করে তোমায় রেখে আসব।

অপর্ণা স্মিত হেসে বলেছিল, পারব রে। তোর বাবাকে ছেড়ে এতগুলো বছর যখন পারলাম, তখন তোদের ছেড়েও পারব।

আসলে কি বল তো, স্কুলে চাকরি করার জন্যই একটা বদভ্যাস হয়ে গেছে, বাচ্চাদের বকবকম আওয়াজটা ছাড়া বড্ড অস্থির লাগে। তুই চিন্তা করিস না আমি রনিকে ছাড়াও ম্যানেজ করে নেব।

সুনন্দা বলেছিল, মা তোমার ভালোর জন্যই বলা!

আলতো করে হেসেছিল অপর্ণা। মনে মনে বলেছিল, আমার ভালোর জন্যই তো সবাই সবকিছু করে রে।

যেদিন শোভন বলেছিল, তোমার মতো মা থাকার থেকে না থাকা ভালো, সেদিনও সুনন্দা আর শোভনের বাবা কোনো প্রতিবাদ না করেই বলেছিল, অপর্ণা, তুমি বড্ড শাসন করো ওদের। কই আমাকে নিয়ে তো শোভনের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তাহলে কেন তোমার ছেলে তোমাকে সহ্য করতে পারছে না?

অপর্ণা বোঝাতে চেয়েছিল, আমি মা হয়ে ওর খারাপ আচরণের জন্য বকতে পারব না?

শোভনের বাবা বলেছিল, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বকে বকে ওটাই তোমার অভ্যেস হয়ে গেছে। নিজেকে সংশোধন করো অপর্ণা। ছেলেমেয়ের সামনে চুপচাপ অপমানিত হয়েছিল অপর্ণা।

আজ আবার মেয়ে-জামাইয়ের কাছে নতুন করে অপমানিত হওয়ার ইচ্ছে ছিল না বলেই, সূর্যাস্তে এসে আশ্রয় নিয়েছিল অপর্ণা। সুনন্দা আর অনির্বাণ অবশ্য বলেছিল, মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসতে দিন দুয়েক, কিন্তু নিজের গর্ভের সন্তানের আতিথ্য গ্রহণের ইচ্ছে ছিল না অপর্ণার। তাই এই দেড় বছর ওরা বার তিনেক এলেও অপর্ণা যায়নি সুনন্দার বাড়ি। অভিমান না আত্মসম্মান তার ব্যাখ্যায় যায়নি অপর্ণা।

বই পড়া, গান শোনা, বাগানের পরিচর্যা আর এই আশ্রমের মানুষদের সাথে মিশে বেশ ভালই কাটছে অপর্ণার।

গীতাদি মর্নিং ওয়াক করতে করতে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলল, ডেঙ্গু না ম্যালেরিয়া কোনটা হলে জ্বর ছাড়ে না গো?

মৃন্ময় ঘোষালের সেটাই হয়েছে বোধহয়। তিনদিন আগে ছেলে ফেলে দিয়ে গেছে, সেদিন রাত থেকেই জ্বর এসেছে, এখনো ছাড়েনি। সূর্যাস্তের সুপার কাবেরীদি আর সুনির্মলদা খুব চিন্তায় পড়েছেন ভদ্রলোককে নিয়ে। আর ওদিকে গুণধর ছেলেও ফোন ধরছে না।

গীতাদি এমন ল্যাজা মুড়ো বাদ দিয়েই ঝড়ের গতিতে কথা বলে। আবার হাঁটতে লাগল গীতাদি।

পায়ে পায়ে হলদে বিল্ডিংয়ের দিকে এগোতে লাগলো অপর্ণা। কার শরীর খারাপ হল আশ্রমে!

 দক্ষিণের ঘরের সামনে বেশ ভিড় রয়েছে। জনা পাঁচজন নিজেদের মধ্যে মৃদু আলোচনা করছে। ঘরের সামনে ডাক্তারের জুতো খোলা রয়েছে। অপর্ণা ঘরে ঢুকতেই দেখল কাঁচা-পাকা দাড়ি, বেশ রোগা লম্বা লোকটা খাটে শুয়ে আছে। ডাক্তারবাবু বললেন, বুঝতে পারছি না ওনার কোনো ওষুধে অ্যালার্জি ছিল কিনা! হঠাৎ গায়ে লাল লাল এগুলো কি বেরোলো সেটাই চিন্তার। অপর্ণা আলটপকা বলে দিল, ডাক্তারবাবু ওনার বোধহয় পেনিসিলিন যুক্ত কোনো ওষুধে এলার্জি আছে। ডাক্তারবাবু একটু অবাক হয়েই বললেন, আপনি কি করে জানলেন? তারপর ওষুধগুলো একটু দেখেই বললেন, মনে হচ্ছে তাই, এই একটা ওষুধে পেনিসিলিনের ডোজ আছে। আমি বরং এই ওষুধটা চেঞ্জ করে দিচ্ছি। কালকে আরেকবার দেখবো। অপর্ণা ধীরে ধীরে গিয়ে বসল মৃন্ময়ের মাথার কাছে। কাবেরীদি আমি কি একটু ওনার কাছে বসব?

কাবেরীদি এতদিন পর্যন্ত অপর্ণাকে দেখেছে, সব ব্যাপারেই বড্ড চুপচাপ। নিজের মধ্যেই যেন নিজে ডুবে থাকে। আশ্রমের সবার সাথেই কথা বলে, তবুও যেন মিশে যেতে পারে না সকলের সাথে। সে হঠাৎ আজ নিজে উপযাচিত হয়ে বলছে, রোগীর সেবা করতে চায় এটাই আশ্চর্যের। কাবেরীদি বললেন, সে তো খুব ভালো কথা। আশ্রমের অনেকেই পালা করে ওনার পাশে বসে রাত জেগেছে। তিনদিন ধরে জ্বর ছাড়ছে না। তুমি যদি আজ একটু হেল্প করো তাহলে খুব উপকার হয়। আসলে সূর্যাস্তের মানুষরা একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসবে এটাই আমি চাই অপর্ণা। অপর্ণা ঘাড় নেড়ে বলল, ওনার ওষুধ, খাবার এগুলো আমায় বুঝিয়ে দিন। কাবেরীদি বললেন, দেখো অপর্ণা তুমি পারবে তো রাত জাগতে? তোমার তো আবার মাইগ্রেনের যন্ত্রণা হয়। অপর্ণা হাসি মুখে বলল, আপনি পঁয়ষট্টি বছর বয়সে সকলের নিখুঁতভাবে খেয়াল রাখতে পারেন আর আমি এটুকু পারব না? কাবেরীদি হাসিমুখে বললেন, এই ঘরে বিরাজবাবুও থাকেন, ওনাকে শিফট করতে বাধ্য হলাম। ভদ্রলোক এত কথা বলেন যে রোগী আরো অসুস্থ হয়ে যাবেন। তাই আপাতত মৃন্ময়বাবু একাই আছেন এ ঘরে। যদিও একজন করে রোজ থাকছে। এমন অসুস্থ মানুষকে তো আর একা রাখা যায় না। কাবেরীদি ওষুধ আর খাবার বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। অপর্ণা অপলক তাকিয়ে আছে মৃন্ময় ঘোষালের দিকে।

ফর্সা রংটা একটু জ্বলে গেছে। অর্ধেকের বেশি চুলে সাদা রং ধরেছে। নাকের দুপাশে চশমার দাগটা আরো গভীর হয়েছে। দুদিনের না কামানো সাদা-পাকা দাড়ি।

চোখ বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে মৃন্ময়।

কপালে আলতো করে হাত রাখল অপর্ণা। কপালটা এখনো বেশ গরম। ঠান্ডা হাতের ছোঁয়া পেয়েই হোক বা ধুম জ্বরের প্রকোপ একটু কম হওয়ার জন্যই হোক, অপর্ণার হাতের ওপরে নিজের দুর্বল হাতটা রাখলো মৃন্ময়। দুবার কেঁপে উঠল ওর চোখের পাতাগুলো। বোধহয় তাকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। অপর্ণা বেশ বুঝতে পারছে ওর ভিতরের শুষ্ক মরুভূমির মতো মনটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ভিজছে। অনেক কষ্টে নিজের চোখের নোনতা জলকে আবার শাসন করল অপর্ণা, সারাজীবন যে ভাবে শক্ত থেকেছে, সেভাবেই বাটিতে জল নিয়ে জল পট্টি দিতে শুরু করল ও।

তবুও স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠছিল সেই অভিশপ্ত সকালের ছবিটা। যেদিন ইগো নামক বস্তুটি খুব সাবধানে ঢুকে পড়েছিল অপর্ণার সংসারে।

হঠাৎ ডিভোর্সের কথা আসছে কোথা থেকে?

আর তাছাড়া শোভন তো তোমারও ছেলে নাকি?

ইজি চেয়ার থেকে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল মৃন্ময়।

অপর্ণা খুব শীতল গলায় বলল, না, শোভন আমার ছেলে নয়। গর্ভে ধারণ করলেই আমার সন্তান হয়ে যায় না। ওর শরীরে যেহেতু তোমার রক্ত বইছে, তাই ও তোমার মতো হয়েছে। ক্লাস ইলেভেনের ছেলের এত জেদ আসে কোথা থেকে। আমি কিছু বলতে গেলেই বলে, বাবার যদি আমায় নিয়ে প্রবলেম না হয় তাহলে তোমার কেন হচ্ছে?

মৃন্ময় বিরক্ত মুখে বলল, তুমি একটু বেশিই শাসন করছ ছেলেটাকে। ইলেভেনের ছেলে, তাকে একটা কম্পিউটার কিনে দিয়েছি তাতেও তোমার সমস্যা!

বেশি শাসন ভালো নয় অপর্ণা।

অপর্ণা চিরুনিটা ড্রেসিংটেবিলে রেখে বললো, ভালো নয় বলেই তো চলে যেতে চাইছি তোমার সুখের স্বর্গ থেকে। তুমি তোমার ছেলেকে নিয়ে থাকো। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে ভালোই থাকব।

মৃন্ময় একটু গম্ভীর স্বরে বলল, তোমার মেয়ে সুনন্দা এখন সবে ক্লাস সেভেন। তাই তার নিজস্ব মতামত প্রকাশের জায়গা নেই। সেইজন্যই তোমার সবরকম অত্যাচার ও মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে।

অপর্ণা সন্তানের সাথে বন্ধুর মতো মিশতে শেখ। দেখো, আমাদের বুড়ো বয়েসে ওরাই আমাদের লাঠির কাজ করবে।

অপর্ণা আরো কঠিন গলায় বলল, তাই বলে তুমি শোভনকে ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে? দামি দামি জিনিস, যা চাইছে তাই দিয়ে তুমিই ওকে স্বেচ্ছাচারী করে তুলছ!

মৃন্ময় বিরক্ত হয়ে বলল, ছোট্ট একটা ব্যাপারকে তুমি একটু বেশিই বড় করে ফেলছ!

অপর্ণা সোজাসুজি বলল, আমি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে চাই, সুনন্দাকে নিয়ে আমি চলে যাব। আমার স্কুলের মাইনেতে আমাদের দুজনের খুব অসুবিধে হবে না। বরং মারাত্মক বিলাসিতার হাত থেকে সুনন্দাকে আমি রক্ষা করতে পারব।

মৃন্ময় একটু চমকে উঠেই বলল, এসব কি বলছ তুমি?

শোভনও তো তোমারই সন্তান। আর আমি? আমাকে ছেড়ে …তাছাড়া সুনন্দা আমারও মেয়ে অপর্ণা, তাকে তুমি কেন আমার কাছ থেকে দূরে করতে চাইছ?

অপর্ণার গলাটা একটু কেঁপে গেল। দূরে যেতে চাইছি কারণ তোমার কাছে থাকলে ও দাদার মতো অমানুষ তৈরি হবে। শোভনকে দেখে ও শিখবে বাবা-মাকে সম্মান করার বদলে অপমান করতে হয়।

মৃন্ময় ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলল, তোমার দেখছি নিজের সম্পর্কে একটু বেশিই কনফিডেন্স। তোমার কাছে থাকলেই সুনন্দা মানুষ হবে, আমার কাছে থেকে শোভন অমানুষ হবে! আজ অবধি মৃন্ময় ঘোষালকে সমাজে অত্যন্ত ভদ্রমানুষ বলেই লোকে জানে। তার কাছে থেকে যদি শোভন অমানুষ হয়, তাহলে তোমার মতো অহংকারী মায়ের কাছে থেকেও সুনন্দার মধ্যে মনুষত্ববোধ তৈরি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। অপর্ণা হালকা গলায় বলল, গরিব স্কুল মাস্টারের আবার অহংকার থাকতে আছে নাকি? বরং প্রফেসরকে ওটা মানায়, কি বলো মৃন্ময়?

মৃন্ময় গম্ভীর গলায় বলল, ডিভোর্স, এবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা কিন্তু তোমার অপর্ণা। প্রফেসরের নয়। আর তাছাড়া এতগুলো বছর তো এই প্রফেসরের সাথে কাটালে, কি এমন অহংকারের সম্মুখীন হতে হয়েছে তোমাকে?

অপর্ণা বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, হয়েছে, হয়েছে…প্রতিদিন আমার স্কুলে বেরোনোর আগে তোমার দৃষ্টির অবজ্ঞাটা আমাকে সইতে হয়েছে বৈকি।

মৃন্ময় চিৎকার করে বলে উঠেছে, এটা তোমার কল্পনা অপর্ণা। আমি তোমার প্রাইমারি স্কুলের চাকরিটা চাইনি কারণ আমি চেয়েছিলাম, তুমি বাড়িতে থেকে দুই সন্তানকে মনের মতো মানুষ করো। কিন্তু সেটা তোমার চাকরিকে অপমান করা নয়। অপর্ণা যুক্তি দিয়ে কেটেছে মৃন্ময়ের কথা। না, বরং প্রফেসরের স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের জব করে বলে তোমার অহংকারে আঘাত করেছে, তাই তুমি চাওনি আমি চাকরিটা করি। আর সেইজন্যই আজ তুমি শোভনের সামনে আমাকে এভাবে অপমান করতে পারলে। না মৃন্ময়, আর এভাবে তোমার আর তোমার ছেলের কাছে অপমানিত হয়ে এ বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া আমি সুনন্দাকে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। দেখি তুমি শোভনকে বেশি ভালো মানুষ করো, নাকি আমি আমার মেয়েকে! মৃন্ময় ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেছিল, ভালো স্কুল, উন্নত শিক্ষা দিতে গেলে অর্থটাও বোধহয় জরুরি, কি বলো অপর্ণা? আর শোভন এগুলো সবই পাবে। কিন্তু সুনন্দা পাবে না। তাই বড় হয়ে ও কিন্তু তোমাকেই দোষারোপ করবে। অকারণ জেদ করো না। আমার টাকায় সুখে থাকতে থাকতে তুমি ভুলেই গেছ বাইরের জগৎটা ঠিক কতটা কঠিন। যাচ্ছ যাও, দুদিন পরে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। মাঝখান থেকে আমার মেয়েটার পড়াশোনার ক্ষতি হবে। মৃন্ময়ের ঠোঁটে তখনও ঝোলানো ছিল বিদ্রুপের হাসিটা।

ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিল অপর্ণা। শুরু হয়েছিল মৃন্ময়কে ছাড়া অপর্ণার লড়াই।

মাসখানেক পর মৃন্ময় স্কুলের সামনে গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হয়েছিল। অপর্ণা ওকে দেখে ভিতরে ভিতরে ভেঙে গিয়েছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে মৃন্ময় বলেছিল, আমি ট্রান্সফার নিয়ে চলে যাচ্ছি, তোমার সাথে আর হয়তো দেখা হবে না, তাই…

অভিমানে কেঁপে উঠছিল অপর্ণার ঠোঁট, মৃন্ময়ের চোখের কোনটাও বোধহয় চিকচিক করে উঠেছিল। কিন্তু দুজনের কেউই অভিমান ভেঙে এগিয়ে যায়নি।

অপর্ণা বলেছিল, যদি আবার নতুন করে শুরু করতে চাও, আমি ডিভোর্স দিতে রাজি। মৃন্ময় আলতো হেসে বলেছিল, শুরুতে আর লোভ নেই, তোমার প্রয়োজন হলে পেপার পাঠিও আমি সাইন করে দেব।

বেরিয়ে গিয়েছিল মৃন্ময়ের গাড়িটা। একবারের জন্যও মৃন্ময় বলেনি, অপর্ণা ফিরে চলো, তোমায় ছাড়া থাকতে কষ্ট হচ্ছে!

অপর্ণার নোনতা জল শাসন না মেনে ওর গাল স্পর্শ করেছিল সেদিন। কিন্তু সেদিনই কঠিন হাতে মুছে দিয়েছিল সেটুকুকে। সুনন্দাকে প্রকৃত শিক্ষিত করে তোলার লড়াইয়ে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিল অপর্ণা। যেন মনে হত অলক্ষ্যে প্রতিপক্ষ হাসছে আর বলছে পারছ না অপর্ণা তুমি পারছ না।

শোভনের উচ্চমাধ্যমিকের ভালো রেজাল্টের খবরে কালীমন্দির গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছে অপর্ণা। মনে মনে বলেছে, শোভনকে আর ওর বাবাকে ভালো রেখো ঠাকুর।

কিভাবে যেন দিনের পর দিন, বছরের পর বছর কেটে গেছে। দূরে চলে গেছে মৃন্ময় আর শোভন। ওরাও আর খোঁজেনি অপর্ণা বা সুনন্দাকে। অপর্ণাও জেদ ধরে খবর রাখেনি ওদের। দিন, মাস, বছরগুলো কারোর জন্য অপেক্ষা না করেই নিজের গতিতে এগিয়ে গেছে। অপর্ণার চোখের পাওয়ার বেড়েছে, ঝুলপির চুলে পাক ধরেছে আর সুনন্দা কিশোরী থেকে যুবতী হয় উঠেছে।

জল, জল খাবো… মৃন্ময়ের ক্ষীণ গলার স্বর শুনে অন্যমনস্ক অপর্ণা দেখলো ওর চোখের জল অবাধ্য হয়ে গাল বেয়ে চিবুকের দিকে ছুটছে। আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে, গ্লাসের জলটা নিয়ে মৃন্ময়ের মুখের কাছে ধরে, ওর মাথাটা সামান্য তুলে ধরে জলটা খাইয়ে দিল অপর্ণা। শরীর খারাপ হলে মানুষটা বরাবরই কাতর হয়ে পড়ত। মুখে বলত, আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তুমি আমার ছেলেমেয়েদের দেখো অপর্ণা।

অপর্ণা বিরক্ত হয়ে বলত, সিজন চেঞ্জের সময় প্রতিবার তোমার জ্বর-সর্দি হয় মৃন্ময়, এটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এমনকি মৃন্ময়ের ঠান্ডা লাগলে ও করুণ গলায় বলত, আজ আর স্কুলে না গেলেই নয়, যদি বাড়ি ফিরে দেখো আমার কিছু হয়ে গেছে…

শেষে অপর্ণার বকুনিতে থামত মানুষটা। কপালে বয়েসের ভাঁজ পড়েছে মৃন্ময়ের। কপালে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অপর্ণা ভাবছিল, শোভন কেন তার বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাল? শোভন তো খুব ভালো করেই জানত, মা কষ্ট করতে পারলেও বাবা একেবারেই কষ্ট সহ্য করতে পারে না। তারপরেও মানুষটাকে এভাবে এখানে রেখে যাওয়ার অর্থটা কি। শোভনের ওপরে ভীষণ রাগ হচ্ছিল অপর্ণার। মৃন্ময়ের প্রশ্রয়ে ছেলেটা তার মানে অমানুষ তৈরি হয়েছে। তাই বাবার অত আদর পেয়েও অসুস্থ বাবাকে সূর্যাস্তে রেখে গেছে। মনে মনে গজ গজ করে বলল, ঠিক হয়েছে, অবাধ্য মানুষের এমনই তো হওয়া উচিত। তখনই বলেছিলাম, ছেলেটাকে এতটা প্রশ্রয় দিও না, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে ছেলেটা। কে শোনে কার কথা! এখন শেষ বয়সে এসে উঠতে হল এই আশ্রমে। যে মানুষটা মাছ-মাংস ছাড়া একমুঠো খেতে পারে না, সে কি করে থাকবে এখানে কে জানে? এখানে তো সপ্তাহে দুদিন মাছ আর একদিন মাংস হয় নিয়ম করে। মৃন্ময় পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

অপর্ণার হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে রয়েছে মৃন্ময়। হাতটা ধরা অবস্থাতেই পাশ ফিরল। অপর্ণা বাধ্য হয়ে কিছুটা ঝুঁকে গেল মৃন্ময়ের দিকে। নাকে এসে লাগল সেই পরিচিত গন্ধটা।

বিয়ের পর কলেজ থেকে ফিরে ওই ঘেমো গায়ে, বাইরের পোশাক পরেই অপর্ণাকে জড়িয়ে ধরত মৃন্ময়। অপর্ণা রাগ করে বলত, আগে বাথরুমে যাও। মৃন্ময় বাচ্চা ছেলের মতো বলত, আগে আদর করো, তারপর ওসব হবে। আদর না পেলে কিছুতেই ছাড়ব না। অপর্ণা বাধ্য হয়ে হাতের কাজ ফেলে, গ্যাসের নব বন্ধ করে ওর পাগলামিতে সায় দিত।

মুখে বলত, ঘেমো ঘেমো বিশ্রী গন্ধ তোমার গায়ে। মৃন্ময় অপর্ণার বুকে মুখ ডুবিয়ে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বলত, আর তোমার গায়ে জুঁই ফুলের মিষ্টি একটা গন্ধ। তুমি যেদিন এই জেসমিনের পারফিউমটা মাখো সেদিন আমার আরো বেশি করে আদর করতে ইচ্ছে করে।

অপর্ণা ফিসফিস করে বলতো, কড়াইয়ে রাতের তরকারি আছে, ছাড়ো…

মৃন্ময় ওর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে বলত, তোমার উষ্ণতায় পুড়তে দাও আমাকে। ভিজিয়ে দাও তোমার আর্দ্রতায়।

সেই চেনা ঘেমো ঘেমো গন্ধটা আবার এসে নাড়িয়ে দিয়ে গেল দীর্ঘ বছর আগের ফেলে আসা সন্ধেকে। অপর্ণা এই বুড়ো বয়েসেও আরেকবার কেঁপে উঠল মৃন্ময়ের স্পর্শে। কাল বোধহয় স্নান করেনি। তাই বাসী জামা পরে রয়েছে। কতগুলো বছর পরে যে দেখল মানুষটাকে হিসেব করতে করতেই ধূসর হয়ে যাচ্ছিল ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো। কুড়ি বছর না তার বেশি!

মৃন্ময়ের চেহারাটাও বড্ড ভেঙে গেছে। মোটা কোনোদিনই ছিল না, কিন্তু তবুও এমন রোগাও ছিল না। মানুষটার ওপরে অভিমান করে বোধহয় ভুলই করেছিল অপর্ণা। ভিতরে ভিতরে বড্ড ভেঙেছে মানুষটা। বয়েসের তুলনায় একটু বেশিই বুড়িয়েছে যেন। বুকের ভিতর তোলপাড় হচ্ছে অপর্ণার। জীবনের মূল্যবান বছরগুলো শুধু লড়াই করে কাটিয়ে দিলো ওরা। অকারণে বোকার মতো যুদ্ধ করে গেছে দুজনে। জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে শূন্য হাতে আজ দুজনেই বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিয়েছে। ব্যর্থ বাবা-মায়ের খেতাব তো পেয়েই গেছে ওরা।

চোখ মেলে ঘোলা ঘোলা লাল চোখে তাকিয়ে আছে মৃন্ময়। আস্তে করে বলল, আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

অপর্ণা নিজের হাতটা ওর মুঠোর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, না স্বপ্ন দেখছ না। আমি সত্যিই এসেছি। দেখতে এসেছি তোমার গুণধর পুত্র তোমায় কি অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে।

মৃন্ময় একটু লজ্জিত স্বরে বলল, না না শোভনের দোষ নেই। আমিই স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি। দেখি না শেষ জীবনটা একটু অন্যরকম করে কাটাতে পারি যদি মন্দ কি! মৃন্ময়ের কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছে দেখেই অপর্ণা বলল, আমি সব বুঝেছি, তুমি এখন একটু খেয়ে নাও। দুদিন কি কিছুই মুখে দাওনি? কাবেরীদি বলছিল, তুমি নাকি বলেছ জ্বর হলে তুমি কিছু খেতে পারো না? জ্বর হলে তুমি কিন্তু দুধ দিয়ে পাউরুটি খেতে ভালোবাসো। মৃন্ময় অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, অপর্ণা, মনে রেখেছ তুমি আমায়? জানো আমি বেঁচে ছিলাম। তবে বিশ্বাস করো আর বাঁচতে চাই না। অনেক তো হল।

অপর্ণার ভিতরটা কেঁদে উঠল। সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, তোমার শরীর খারাপ বলে, আমাকে আশ্রম থেকে ডেকে পাঠিয়েছে। আশাকরি তুমি আমার কথাগুলো শুনে, আমার মান রাখবে।

মৃন্ময় একটু দ্বিধামিশ্রিত গলায় বলল, কিন্তু আশ্রমে আমি তো তোমার অ্যাড্রেস দিইনি অপর্ণা।

অপর্ণা বলল, তুমি দাওনি, তোমার গুণধর ছেলে হয়ত দিয়ে গেছে।

মৃন্ময় শান্ত স্বরে বলল, সে ভালোই করেছে। তাই মরার আগে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেল। সুনন্দার বিয়ের পর অনির্বাণ আর সুনন্দাকে পাঠিয়েছিলে আমাকে প্রণাম করে আসতে। সেদিনই আমি সুনন্দাকে বলেছিলাম, তোর মাকে বলিস, আমি মরার আগে যেন একবার দেখাটা অন্তত করে। মেয়ে, জামাই সব কেমন আছে অপর্ণা? আমি খুব খুশি হয়েছি গো, তুমি সুনন্দাকে লেকচারার করছ বলে। অপর্ণা বাটিতে খাবারটা নিয়ে চামচে করে মৃন্ময়ের মুখে দিতে দিতে বলল, সুনন্দা, অনির্বাণ, আমার নাতি রনি সবাই খুব ভালো আছে।

মৃন্ময় কাঁপা গলায় বলল, তুমি কি আজই চলে যাবে?

অপর্ণা শান্ত স্বরে বলল, তোমার শরীর ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই আছি।

মৃন্ময় বলল, ভালো আছো তো অপর্ণা?

অপর্ণা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, খুব ভালো আছি। সুনন্দা, অনির্বাণ আমায় খুব আদরে রেখেছে গো।

মৃন্ময়ের মুখে স্মিত হাসি। অস্ফুটে বলল, আমি খুব খুশি হলাম অপর্ণা, তুমি ভালো আছো জেনে, খুব খুশি হলাম।

অপর্ণা খাবারটা খাইয়ে নিজের আঁচল দিয়ে মৃন্ময়ের মুখটা মুছিয়ে দিতে দিতে বললো, আজ কিন্তু হালকা গরম জল দিয়ে স্নান করিয়ে দেব। জ্বর হলেই স্নান বন্ধর রোগটা এখনো আছে দেখছি।

মৃন্ময় ক্লান্ত হেসে বলল, আমি ভালো হয়েই বা কি হবে অপর্ণা? ব্যাংকে টাকা আছে, নিজের ফ্ল্যাট আছে, শুধু একলা থাকার ভয়ে পালিয়ে এসেছি এখানে। বেশিদিন এখানের লোকগুলোকে ভোগাতে চাই না গো।

অপর্ণা বলল, কেন তোমার ছেলে, ছেলের বউ তাড়িয়ে দিল কেন? দিনরাত তো ছেলেকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছিলে, তারপরও কেন…

মৃন্ময় আলতো করে নিজের উষ্ণ হাতটা রাখল অপর্ণার হাতের ওপরে। শোভন আর সায়নী দুজনেই খুব ভালো গো, আমিই বোধহয় তাল মেলাতে পারছিলাম না ওদের সাথে। ওরা শেষমেষ বিরক্ত হয়েই বলল, মায়ের সাথেও তোমার অ্যাডজাস্ট হয়নি, এখন আমাদের সাথেও হচ্ছে না। তোমার ছেলে আমার সামনে আঙুল তুলে বলল, আমিই নাকি তাকে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত করেছি। আমার অহংকারের জন্যই নাকি তার মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর জানো অপর্ণা অদ্ভুত একটা ব্যাপার দেখলাম, আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে শোভনের বড্ড আনন্দ। আমিও চালাক কম নই। যতই নিজের ছেলে হোক, রোজ আমাকে অপমান করে আনন্দ পাবার মতো সুখ থেকে ওকে বঞ্চিত করব বলেই চলে এলাম ওদের ছেড়ে। এখন বুঝুক, আর কাকে বলবে, তোমার মতো অকর্মণ্য আর কেউ নেই! বাড়িতে বসে থাকার থেকে একটু বাজার করেও তো উপকার করতে পারো।

বুঝলে অপর্ণা, আমি যে কদিন বাজার করে এনেছি, সে কদিন সায়নী বলেছে, বাজারের লোকগুলো নাকি আমাকে ঠকায়, আমাকে পচা মাছ দিয়ে দেয়। মোট কথা আমাকে দোষারোপ করে ওরা যে আনন্দ পাচ্ছিল, সেই মজা আমি আর ওদের পেতে দেব না। এবারে বল তো, আমি কেমন জব্দ করেছি তোমার ছেলেকে?

অপর্ণার দুচোখে জল বাঁধ মানছে না কিছুতেই। মৃন্ময়ের চোখে সব হারানোর বেদনা। শোভনকে কেন্দ্র করেই নিজের সবকিছু সাজিয়েছিল মৃন্ময়। সেটা আর কেউ জানুক আর না জানুক, অপর্ণা খুব ভালো করেই জানে।

অপর্ণা গলার মধ্যে দলা পাকানো কষ্টটাকে ঠেলে ভিতরে পাঠিয়ে বলল, এই আশ্রমে কলাইয়ের ডাল বেশি রান্না হয়, তোমার পছন্দের। তুমি তো ওই একটা ডালই খেতে।

মৃম্ময় মুচকি হেসে বলল, কাবেরীদির কাছ থেকে মেনু জেনে পালাতে ইচ্ছে করছে তাই না অপর্ণা?

কলাইয়েরডাল, বাটামাছ, কুমড়ো এগুলো সব বেশি হয় এই আশ্রমে। তিনটেই তো তুমি খাও না, তুমি এ দুদিন কি করে থাকবে অপর্ণা? তোমার খুব কষ্ট হবে তাই না?

মৃন্ময় একটু অস্থির ভাবে বলল, দেখছি, এক্সট্রা টাকা দিয়ে যদি রুইমাছ আর মুগের ডাল রান্না করানোর ব্যবস্থা করা যায়।

অপর্ণা লাজুক হেসে বলল, আমার প্রিয় পদগুলো এখনো মনে রেখেছ?

মৃন্ময় চোখটা বন্ধ করে বলল, কষ্ট করে মনে রাখতে হয়নি, গোটা তুমিটাই মনে রয়ে গেছো।

চিরকালের কাঠখোট্টা অপর্ণার মনের দুয়ারেও এই বয়সে নতুন করে ভালোবাসা নামক ক্ষণস্থায়ী শব্দটা এসে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।

অপর্ণা অস্ফুটে বলল, বেশি কথা বলো না, তোমার কষ্ট হবে। একটু চুপ করে শুয়ে থাকো।

দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই মৃন্ময় বলল, সারাটা জীবন তো চুপ করেই থাকব অপর্ণা। নেহাত অসুখে পড়লাম বলেই সূর্যাস্তে এসে তোমার দেখা পেলাম। তুমি তো থাকবে মাত্র দুদিন, তারপরেই তো চলে যাবে তোমার গোছানো সংসারে। এই দুদিন আমাকে একটু কথা বলতে দাও। কথাগুলো তো জমে জমে পাথর হয়ে গেছে। তাই অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করলেও বলতে পারছি না তেমন। জানো অপর্ণা, শোভনের বউ বলত, আপনার বয়স হয়েছে, এত কথা বলেন কেন? চুপ করে ঘরে বসে থাকুন।

তোমার মনে আছে অপর্ণা, বিয়ের পর পর তুমি কত রেগে যেতে আমি স্বল্পভাষী বলে। রেগে রেগে বলতে, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেও সুখ নেই মৃন্ময়।

তোমার বেশিরভাগ কথাতে হুঁ, আর হ্যাঁ বলে উত্তর দিতাম বলে একদিন সারারাত তুমি ডাইনিংয়ে শুয়ে কাটিয়েছিলে। শেষে ভোর রাতে আমি তোমায় কোলে তুলে শোবার ঘরে এনেছিলাম।

মৃন্ময় পরিপূর্ণভাবে তাকিয়ে বলল, রোগা বউ হওয়ার ওটাই সুবিধে, যেকোনো সময় বাংলা সিনেমার হিরোর মতো নায়িকাকে কোলে তুলে নেওয়া যায়।

অপর্ণা বলল, চলো গরম জলে একটু স্নান করে নেবে। শরীরটা ঝরঝরে লাগবে।

মৃন্ময়কে যেন আজ কথায় পেয়েছে। ডায়রির পাতা উল্টে চলে গেছে সেই বিয়ের পরের বসন্তের দিনগুলোতে। অপর্ণার অস্বস্তিকে গুরুত্ব না দিয়েই বলে চলেছে মৃন্ময়।

চোখ দুটো অর্ধেক বুজে টাইম ট্র্যাভেল করে ফিরতে চাইছে সেই দিনগুলোয়।

অপর্ণা, ওসব স্নান খাওয়া হবে’খন। বাঁচতে গেলে তো খেতেই হবে। একটু স্থির হয়ে বসো তো আমার পাশে।

আমার মাথায় তোমার ঠান্ডা হাতটা একটু রাখো।

দীর্ঘবছরের অদর্শনে চিরপরিচিত মানুষটার সামনেও এসে ভিড় করে কিছু সংকোচ। সেই সংকোচটাকে কিছুতেই কাটাতে পারছে না অপর্ণা। মৃন্ময় কিন্তু খুব স্বাভাবিক। এত বছর যোগাযোগবিহীন থেকেও কত অল্প সময়ে আপন করে নিল অপর্ণাকে। যেন মাঝের এই সময়টা ভোর রাতের দুঃস্বপ্ন ছিল। মনে হচ্ছে যেন, মৃন্ময় ঘুম ভেঙে উঠেই স্বাভাবিক গলায় অপর্ণাকে ডেকে বলবে, কি গো চা হল? তোমারটাও নিয়ে এসে বসো, কয়েকটা জরুরি কথা আছে।

অপর্ণা আড়ষ্টভাবেই নিজের হাতটা রাখল ওর উষ্ণ কপালে। মৃন্ময় চোখ বুজেই হাসল। ঠোঁটের কোণে পরিতৃপ্তির হাসি।

বুঝলে অপর্ণা, নতুন বিয়ের পরে পরে কলেজে গিয়ে ঢুললেই স্টুডেন্টরা মুচকি হেসে বলত, স্যার রাতে ভালো ঘুম হয়নি বুঝি?

আমিও বোকার মতো বলতাম, না ভালো হয়নি।

পরে বুঝলাম, বিচ্ছুগুলো আমার লেগপুল করত।

এই অপর্ণা, তোমার মনে আছে অষ্টমঙ্গলার পরের দিন, আমরা গল্প করতে করতে ভোর দেখেছিলাম। হঠাৎ আমাদের কাঁচের জানালায় একটা হলদে পাখি এসে ঠোঁট ঠুকে ঠুকে আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল, ভোর হলো।

অপর্ণা মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ওটা বোধহয় ফিঙে পাখি ছিল।

মৃন্ময় হেসে বলল, ফিঙে না টুনটুনি জানিনা, তেনাকে দেখেই আমার লাল শাড়ি পরা নতুন বউটার পাখি পোষার নেশা হয়েছিল।

অপর্ণা বলল, শেষ পর্যন্ত সে পাখির পরিচর্যা কে করবে ভেবেই আর পোষা হয়নি।

মৃন্ময় বাঁ হাতে ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বলল, তখন নাহয় দুজনেই চাকরি করতাম। এখন তো একখানা মুনিয়া পুষলেও হয়।

তারপরেই আনমনে বলল, ওহ, আমি কেমন ভুলো দেখ, তুমি যে চলে যাবে, সেই হিসেবটাই ভুলে যেতে বসেছি। মনে হচ্ছে যেন সূর্যাস্তের এই ঘরটাই আমাদের সংসার।

সেই বিয়ের পরের ভাড়াবাড়ির পুতুল পুতুল সংসার।

নুন আনা হয় তো তেল ভুলে যাই, তেল মনে থাকে তো চিনি…। তবে কি জানো তো অপর্ণা, বাজার থেকে ফেরার পর আমার ভুলের জন্য যে বকুনিটা আমি খেতাম আমার নতুন বউয়ের কাছে, সেটা এক কেজি চিনির থেকেও বেশি মিষ্টি ছিল।

অপর্ণার দিকে তাকিয়ে মৃন্ময় বলল, অবাক হচ্ছ? ভাবছ বুড়োর হল কি? এভাবে এত কথা বলতে তুমি তো কখনো দেখনি আমাকে, তাই না!

আসলে কি জানো অপর্ণা, হাতে সময় কমছে, দিন গোনা শুরু হয়েছে ওপরে, তাই তড়িঘড়ি সব বলতে চাই তোমায়। কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে, হাতে সময় কম। ঘড়ির কাঁটাটা যেন দ্রুত দৌড়াচ্ছে।

অপর্ণা মৃন্ময়ের ঠোঁটের ওপরে রাখল নিজের হাতটা।

রাগী গলায় বলল, তুমি থামবে, নাকি আমি চলে যাব?

মৃন্ময় মুখে কিছু না বলে শক্ত করে ধরল অপর্ণার হাতটা।

চলো স্নান করে নাও।

মৃন্ময় মুচকি হেসে বলল, মনে আছে হানিমুনে গিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়।

অপর্ণা লাজুক স্বরে বলল, টাওয়েল চেয়েছিলে, দিতে গিয়েই বিপত্তি।

মৃন্ময় বলল, অপর্ণা সত্যি করে বল তো, আমাকে একটুও মনে পড়ত না তোমার? এতগুলো বছরে একবারও মনে পড়েনি? জানি আমি ভীষণ খারাপ লোক, ইগোইস্টিক, গোঁয়ার। তবুও, আমাদের ভালোবাসার, ভালো থাকার মুহূর্তগুলো কি একবারের জন্যও এসে দাঁড়ায়নি তোমার সামনে?

অপর্ণা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঘৃণা করেও মনে রাখা যায়, এটা জান তো।

প্রতি মুহূর্তে সেই মানুষটাকে ভুলতে চাওয়ার চেষ্টা করতে হয়, কারণ সে গোটা মন জুড়ে বসে থাকে বলেই।

তোমার মতো গোঁয়ার অসভ্য মানুষ আর কিছু পারুক না পারুক নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে ভালই জানে। তাই দূরে থেকেও চব্বিশ ঘণ্টা আমার গোটা মন জুড়ে বসে ছিলে। নিজের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় হাল ছেড়ে বলেছিলাম, বেশ ওই মনটা তোমারই থাকুক। আমি বরং একটা কাঠিন্যের মুখোশ পরে নিই।

সেই থেকেই ওই মুখোশটা এঁটে বসে গেল আমার মুখে। আয়নার সামনে দাঁড়ালেও তখন শুধু ওই মুখোশ পরা অপর্ণাকেই দেখতে পেতাম। যে মৃন্ময় নামক মানুষটাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও ঘৃণা করত। যে মৃন্ময় ভালো থাকুক ভেবেও লড়াই করত তাকে একা করে দেবার জন্য।

তাই তোমাকে মনে পড়ত না, এতবড় মিথ্যেটা বলি কি করে!

মৃন্ময় উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টাল খেল। মাথাটা ঘুরে গেল ওর।

অপর্ণা শক্ত হাতে ওকে ধরে বলল, আমায় ধরে ধরে চলো। মৃন্ময় অপর্ণার কাঁধে ভর দিয়ে বলল, ভাগ্যিস তুমি এলে মুখোশ থেকে বেরিয়ে। ভাগ্যিস শোভন শেষবেলায় বাবার ওপরে এটুকু করুণা করল। তাই তোমায় খবরটা অন্তত পাঠিয়েছিল, যে আমি অসুস্থ।

অপর্ণা বাথরুমে একটা প্লাস্টিক টুলের ওপরে বসিয়ে মৃন্ময়ের মাথায় জল ঢালতে ঢালতে বলল, পিঠে তেল লাগাওনি বহুদিন, তাই না?

সেই একুশে সেপ্টেম্বর লাস্ট লাগিয়ে দিয়েছিলে। তারপর…আমার হাত যায় না জানো তো!

ডেটটা অবধি মনে রেখেছ?

হ্যাঁ মনে আছে, কারণ, তার ঠিক পাঁচদিন পরেই তুমি ওবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলে। আমার টেবিলে আমার প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে রেখে। কিন্তু অপর্ণা, তুমি কি সত্যিই জানতে না, ওই গোছানো জিনিসগুলোই এলোমেলো হয়ে যাবে তোমার হাতের স্পর্শ না পেলে?

গামছা দিয়ে মৃন্ময়ের মাথাটা মোছাতে মোছাতে অপর্ণা বলল, তখন তো তুমিও বলেছিলে, আমার জন্যই নাকি তোমার ছেলে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে!

মৃন্ময় ক্ষীণ গলায় বলল, ভুল করেছিলাম অপর্ণা। তুমিই ঠিক ছিলে। আমি শোভনকে মানুষ করতে ব্যর্থ। কিন্তু তুমি সুনন্দাকে তোমার আদর্শে মানুষ করেছ, তাই তো তোমার শেষ আশ্রয় সূর্যাস্ত হয়নি।

অপর্ণা বলল, জামাটা পরে নাও। আমি তোমার খাবারটা নিয়ে আসি।

মৃন্ময় বলল, আরে তুমি কোথায় যাবে? এখানের কাউকেই তো তুমি চেনো না। দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমিই বরং কাউকে ডেকে পাঠাই ফোনে।

অপর্ণা বিরক্ত হয়ে বলল, বেশি বকবক না করে বসো, আমি ঠিক খুঁজে নেবো।

মৃন্ময় আলতো হেসে বলল, কতদিন পরে এমন মিষ্টি বকুনি খেলাম।

অপর্ণা বেরিয়ে এসেছে মৃন্ময়ের ঘর থেকে। নিজের মিথ্যে ধরা পড়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।

মৃন্ময় জেনে যাবে মা হিসাবে অপর্ণা ঠিক কতটা ব্যর্থ হয়েছে। একদিন যে মেয়ের হাত ধরে অপর্ণা বেরিয়ে এসেছিল, সেই মেয়েই আজ তাকে বিতাড়িত করেছে। মৃন্ময়ের সাথে এত বছরের লড়াইয়ের রেজাল্ট শূন্য। একরাশ অপ্রাপ্তি। কিন্তু মৃন্ময়ের সামনে আর হেরে যেতে রাজি নয় অপর্ণা। ও অন্তত জানুক, অপর্ণা খুব ভালো আছে সুনন্দার বাড়িতে। এই বয়সে এসে এতটা অপমান সহ্য করেছে অপর্ণা, আবার মৃন্ময়ের চোখেও ব্যঙ্গ দেখতে পারবে না ও। মৃন্ময় হয়তো মুচকি হেসে বলবে, অপর্ণা, এই তোমার সন্তান মানুষ করা? যার জন্য তুমি ওবাড়ি ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে, নিজের সংসারকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে এসেছিলে, সেই আজ তোমায় সূর্যাস্তে রেখে গেল? তাহলে আর আমি কি এমন অপদার্থ বাবা হলাম! অপদার্থতা শব্দটা তো আমাদের দুজনের মধ্যেই ভাগ করে নেওয়া উচিত।

আশ্রমের রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতেই ভাবছিল অপর্ণা, চলে যেতে হবে সূর্যাস্ত ছেড়ে। মৃন্ময়ের সামনে থেকে পালাতে হবে ওকে। কিন্তু বুড়ো বয়েসে আবার যে লোভ নামক বস্তুটি হাতছানি দিয়ে ডাকছে অপর্ণাকে। মৃন্ময়ের ছোঁয়ায় আবার নিজেকে গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করছে। আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু অপর্ণা কিছুতেই পারবে না হার স্বীকার করতে। কিছুতেই বলতে পারবে না, মৃন্ময় তুমি একা শোভনকে মানুষ করতে পারোনি তাই নয়, আমিও সুনন্দাকে মানুষ করতে পারিনি গো। সেও বড্ড স্বার্থপর তৈরি হয়েছে, ঠিক শোভনেরই মতো। হয়তো আমার ডিম্বাণু আর তোমার শুক্রাণুর দোষেই ওরা অমন হল।

রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই অপর্ণা বলল, নীলিমা, আমাকে মৃন্ময়বাবুর জন্য একটু খাবার সাজিয়ে দেবে?

নীলিমা রান্নাঘরের দায়িত্বে আছে। ভারী মিষ্টি স্বভাব মেয়েটির। হেসে বলল, মাসিমনি তো মৃন্ময়বাবুর আর আপনার খাবার নিয়ে গেলেন এই মাত্র!

কাবেরীদি খাবার নিয়ে চলে গেছে? তাহলে হয়তো করিডোর দিয়ে গেছে, তাই অপর্ণার সাথে দেখা হয়নি। অপর্ণা ফিরছিল ক্লান্ত পায়ে।

ডাইনিং হলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সকলের হাসির আওয়াজ শুনল। লাঞ্চ করতে করতে বক বক করছে সকলে। অন্যদিন অপর্ণাও এদের সাথেই লাঞ্চ সেরে নেয়। আজ মৃন্ময়ের সাথে একসাথে বসে খাবে। কত যুগ পরে আবার….

কাল-পরশুর মধ্যেই অপর্ণাকে সূর্যাস্ত ছাড়তে হবে। মৃন্ময় এখানে থাকুক, এখানে সকলে ওকে ভালো রাখবে। দেড়বছর এখানে থাকার পরে অপর্ণা বেশ বুঝেছে, সূর্যাস্তের মানুষদের ব্যবহার খুবই আন্তরিক। তাই মৃন্ময় বেশ ভালোই থাকবে। ধীর পায়ে এগোচ্ছিল অপর্ণা।

মৃন্ময়ের ঘরের সামনে যেতেই শুনতে পেল, কাবেরীদি বলছেন, অপর্ণা এই আশ্রমে প্রায় দেড় বছর আছে। ওর কাছ থেকে শুনবেন সূর্যাস্তের সকলে কেমন থাকে। একটু সুস্থ হয়ে যান, তারপর গোটা আশ্রম ঘুরে দেখবেন।

কাবেরীদি অপর্ণাকে দেখেই বললেন, এসো এসো। আমি তোমাদের দুজনের খাবারই ওই টেবিলের রাখলাম, তুমি ওনাকে একটু খাইয়ে দিও।

কাবেরীদি চলে গেছেন।

দুটো থালায় সাদা ভাত, আলুভাজা, মুগের ডাল, মাছ সাজানো পড়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না। ঘরের মধ্যে দুজনের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।

অপর্ণার একটু আগেও ভীষণ ক্ষিদে পাচ্ছিল। এখন আর ক্ষিদে নেই।

মৃন্ময়ের চোখের দিকে না তাকিয়েই অপর্ণা বলল, উঠে বসো,খেয়ে নাও, তারপর দুটো ওষুধ খেতে হবে।

মৃন্ময় আলতো করে বলল, কার দোষ, কার ভুল, কে ঠিক এসব হিসেব তো হল অনেক। বেশকিছু না মেলা অঙ্কও পড়ে রইল সাদা খাতায়। এবার ফিরি চলো।

আমাদের ফ্ল্যাটটা তো আছে। হয়তো ধুলো জমেছে আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে কিন্তু চেষ্টা করলে কি দুজনে মিলে ঝেড়ে ফেলতে পারব না?

মৃন্ময় ওর উষ্ণ হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, দুজন পরাজিত মানুষ একই নৌকায় উঠলে সব সময় নৌকা ডুবে যায় না। কখনো কখনো ধীরে ধীরে চলতে শুরু করে, উল্টো দিকে থেকে হয়তো পালে হাওয়া লাগে, তাই আস্তে হলেও ভাসে। আমাদের বুড়োবুড়ির সংসার নাহয় অমন ধীরে ধীরেই চলবে।

অপর্ণা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, সব সময় বুড়োবুড়ি বলবে না তো, তুমি মোটেই বুড়ো হয়ে যাওনি।

মৃন্ময় নরম গলায় বলল, এই বেশ ভালো হল বুঝলে অপর্ণা। একজন জিতে গেলে তার অহংকার থাকত, কিন্তু ভগবান আমাদের দুজনকেই হারিয়ে জিতিয়ে দিতে চেয়েছেন।

ভাতের মধ্যে ডালটা মেখে একমুঠো মৃন্ময়ের মুখে ভরে দিতে দিতে অপর্ণা বলল, আবার কিন্তু ঝগড়া হবে, আবার ঠোকাঠুকি।

মৃন্ময় অপর্ণার হাতটা ধরে বলল, আবার ভালোবাসা বাসিও কিন্তু হবে।

জানালা দিয়ে সূর্যের আলো পড়ে অপর্ণার সাদা হয়ে যাওয়া চুলের চওড়া সিঁথিতে সিঁদুরটা আরেকবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

সমাপ্ত

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন