৩১-৪০. সেজেনি চেইন ব্রিজ

ড্যান ব্রাউন

অধ্যায় ৩১

বুদাপেস্ট শহরের আটটি ব্রিজের মধ্যে অন্যতম হলো সেজেনি চেইন ব্রিজ। দানিয়ুব নদীর হাজার ফিট উপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের দুই পাড়কে সংযুক্ত করেছে এই সেতু। মনে করা হয়, এটাই পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর ব্রিজ।

আমি করছিটা কি? রেলিংয়ে ঝুঁকে নিচের কালচে পানির দিকে তাকিয়ে। অবাক হয়ে ভাবলেন রাবাই কোভেস। বিশপ আমাকে বলেছিলেন নিজের বাড়িতেই থাকতে।

কোভেস জানেন, তার এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বের হওয়াটা ঠিক হয়নি, তাপরও যখনই তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন তখনই এই ব্রিজে ছুটে আসেন। অনেক বছর ধরেই তিনি এই ব্রিজে রাতের বেলায় হাটাহাটি করে আসছেন। রাতের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তিনি। পূর্বদিকে আছে পেস্ট, সেজেন্ট ইস্টভান বাজিলিকার বেল টাওয়ারে বিপরীতে আলোকিত গ্রেশাম প্রাসাদটি দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। পশ্চিমে বুদা শহরের পাহাড়ের উপরে আছে ক্যাসল হিল। উত্তরদিকে দানিয়ুবের তীরে অবস্থিত অভিজাত আর উঁচু পার্লামেন্ট ভবনটি হাঙ্গেরির সবচেয়ে বিশাল ভবন।

ব্রিজের উপরে এই সৌন্দর্য দেখাটাই যে তাকে এখানে বার বার নিয়ে আসে সে-ব্যাপারে কোভেসের মনে সন্দেহ রয়েছে। আসল কারণটা একেবারেই ভিন্ন।

হ্যান্ডকাফ।

ব্রিজের সমগ্র রেলিং জুড়ে শত শত হ্যান্ডকাফ ঝুলে আছে-প্রতিটাতেই আছে ভিন্ন ভিন্ন ইনিশিয়াল, প্রতিটাই চিরকালের জন্য ব্রিজের সাথে লক করে রাখা আছে।

ঐতিহ্যটা হলো, দুজন প্রেমিক-প্রেমিকা এই ব্রিজে এসে একটা হ্যান্ডকাফে তাদের নামের আদ্যাক্ষর লিখে ব্রিজের সাথে ওটা লক করে দেয়, তারপর চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিচের পানিতে, যেখানে ওটা চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। তাদের সম্পর্কের বন্ধন যেন অনন্তকাল অটুট থাকে সেটার প্রতীক হিসেবে এ কাজ করে তারা।

খুবই সহজ সরল একটি প্রতীজ্ঞা, ভাবলেন কোভেস। মৃদু দুলতে থাকা একটি হ্যান্ডকাফ স্পর্শ করলেন তিনি। আমার হৃদয় তোমার হৃদয়ের সাথে চিরকালের জন্য লক করা আছে।

কোভেসের যখনই মনে হয় পৃথিবীতে অপার ভালোবাসার অস্তিত্ত্বটা যে রয়েছে সেটা তার স্মরণ করা দরকার তখনই তিনি এই হ্যান্ডকাফগুলো দেখতে। চলে আসেন এখানে। আজ রাতটাও সেরকমই কিছু বলে মনে হচ্ছে তার। নিচে প্রবাহমান জলরাশির দিকে তাকিয়ে তার মনে হলো, এই পৃথিবী যেন আচমকা খুব দ্রুত গতিতে সরে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। সম্ভবত আমি আর এখানকার কেউ নই।

এক সময় কয়েক মিনিট বাসে করে ঘোরা, অথবা কাজে যাবার সময় হাটা, কিংবা কোন অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য অপেক্ষার সময়গুলো ছিল জীবনের নিজস্ব একটি মূহূর্ত এখন তার কাছে সেগুলোই মনে হয় অসহ্য। লোকজন সারাক্ষণ ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, কানে ইয়ারফোন ঢুকিয়ে রাখে, গেম খেলে, টেকনোলজির নেশা থেকে নিজেদেরকে বের করে আনতে অক্ষম এরা। অতীতের অলৌকিক ঘটনাগুলো বিবর্ণ হয়ে পড়েছে, যা-কিছু-নতুন তার প্রতি প্রচণ্ড ক্ষুধার কারণে ধুয়েমুছে গেছে।

এখন ইয়েহুদা কোভেস নিচের জলরাশির দিকে চেয়ে আছেন, নিজের ভেতরে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগটা টের পাচ্ছেন তিনি। মনে হলো তার দৃষ্টি ঝাঁপসা। হয়ে আসছে, দেখতে শুরু করলেন পানির উপরে অদ্ভুত, আকৃতিহীন কিছু। জিনিস ভেসে বেড়াচ্ছে। নদীটা যেন আচমকা কোন প্রাণীর মতো জীবন পেয়ে। উঠে আসতে চাইছে গভীর থেকে।

আ ভিজ এল, পেছন থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। পানি জীবন্ত।

রাবাই ঘুরে দেখতে পেলেন কোকড়ানো চুলের এক তরুণ প্রাণবন্ত চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ইয়েহুদাকে তার শৈশবের কথা মনে করিয়ে দিলো।

বুঝলাম না, কী বললে? রাবাই বললেন।

কথা বলার জন্য ছেলেটা মুখ খুললেও কথার বদলে তার মুখের জিভ দিয়ে বের হয়ে এলো ইলেক্ট্রনিক শব্দ, আর তার চোখ থেকে চমক দিয়ে উঠলো চোখ ধাঁধানো সাদা ধবধবে আলো।

দম ফুরিয়ে রাবাই কোভেস জেগে উঠলেন, সোজা হয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে।

ওয় গেভাল্ট!

তার ডেস্কের ফোনটার রিং বাজতে শুরু করলে বৃদ্ধ রাবাই ভড়কে গিয়ে নিজের হাৎজিকো স্টাডির চারপাশে উদভ্রান্তের মতো তাকালেন। ভাগ্য ভালো যে তিনি ঘরে একদম একা। টের পেলেন তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে।

খুবই অদ্ভুত স্বপ্ন, ভাবলেন তিনি। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন।

ফোনটার রিং বেজেই চলছে, কোভেস জানেন রাতের এ সময় যখন কল এসেছে তখন ওটা নির্ঘাত বিশপ ভালদেসপিনোই করেছেন। তাকে মাদ্রিদে নিয়ে যাবার কী ব্যবস্থা করতে পেরেছেন সে-ব্যাপারে জানাতে চাইছেন হয়তো।

বিশপ ভালদেসপিনো, রাবাই ফোনটা তুলে বললেন। এখনও পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেননি। কী খবর, বলেন?

রাবাই ইয়েহুদা কোভেস? একটা অপরিচিত কণ্ঠ জানতে চাইলো। আপনি আমাকে চিনবেন না, আর আমিও আপনাকে ভড়কে দিতে চাচ্ছি না। তবে আমি চাই আমার কথাগুলো মন দিয়ে শুনবেন।

মুহূর্তেই পুরোপুরি সজাগ হয়ে গেলেন কোভেস।

কণ্ঠটা কোন মহিলার তবে তাতে কিছুটা আড়াল আছে, একটু বিকৃতও শোনাচ্ছে। কলার ইংরেজিতে বললেও তাতে রয়েছে প্রচ্ছন্ন স্প্যানিশ টান। আমি প্রাইভেসির জন্য আমার কণ্ঠটা ফিল্টারিং করেছি। সেজন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থি। তবে কিছুক্ষণ পরই আপনি বুঝতে পারবেন কেন এটা করেছি।

আপনি কে?! জানতে চাইলেন কোভেস।

আমি একজন ওয়াচডগ-এমন একজন, জনগণের কাছ থেকে সত্য লুকানোর চেষ্টা করে যারা তাদেরকে মোটেও তারিফ করে না।

আমি তো…কিছুই বুঝতে পারছি না।

রাবাই কোভেস, আমি জানি তিনদিন আগে মন্তসেরাতের আশ্রমে আপনি, বিশপ ভালদেসপিনো আর আল্লামা সাঈদ-আল-ফজল এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে একটি প্রাইভেট মিটিং করেছেন।

এই মেয়ে এটা কিভাবে জানে?!

আরো আছে, আমি জানি এডমন্ড কিয়ার্শ আপনাদের তিনজনকে তার নতুন আবিষ্কারের ব্যাপারে বিস্তারিত সব বলেছে…যেটা প্রকাশ না করার জন্য আপনারা এখন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

কি?!

আপনি যদি আমার কথা মন দিয়ে না শোনেন, তাহলে আমার অনুমাণ আপনি আগামীকালের সকালের মধ্যেই মারা যাবেন। বিশপ ভালদেসপিনোর হাত অনেক লম্বা, সেই হাতই আপনাকে চিরতরের জন্য দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেবে। কলার একটু থামলো। ঠিক যেভাবে এডমন্ড কিয়াৰ্শ আর আপনার বন্ধু সাঈদ আল-ফজলকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

.

অধ্যায় ৩২

বিলবাওর লা সালভে ব্রিজটি নারভিওন নদীর উপর দিয়ে গুগেনহাইম মিউজিয়ামের এত কাছ ঘেষে চলে গেছে যে, এই দুটো স্থাপনাকে দেখে মনে হয় একটা আরেকটার সাথে বুঝি মিশে গেছে। এর মাঝখানের অনন্য অংশটি সবার আগে চোখে পড়ে-ইংরেজি H অক্ষরের মতো দেখতে লাল টকটকে বিশাল বড় একটি স্ট্রট।

এই ব্রিজের লা সালভে নামটি নেয়া হয়েছে এক নাবিকদলের সমুদ্র যাত্রা থেকে নিরাপদে ফিরে আসার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ প্রার্থনা করার একটি লোকজ গল্প থেকে।

রাতের অন্ধকারে ভবনের পেছন দিক দিয়ে বের হবার পর জাদুঘর আর নদীর তীরের মধ্যে যে দূরত্বটা আছে সেটা দ্রুত পেরিয়ে ব্রিজের নিচে ফুটপাতে তারা অপেক্ষা করছে এখন, যেমনটা উইনস্টন তাদেরকে বলেছে।

কীসের জন্য অপেক্ষা করছি? ভাবনাটা চলেই এলো ল্যাংডনের মাথায়।

অন্ধকারে অপেক্ষা করার সময় ল্যাংডন দেখতে পেলো পাতলা কাপড়ে ঢাকা অ্যাম্ব্রার ক্ষীণ দেহটা কাঁপছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে ওর গায়ে চাপিয়ে দিলো সে। হাতার দিকটা একটু ঘষে উষ্ণ করারও চেষ্টা করলো।

হুট করে তার দিকে তাকালো অ্যাম্রা।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো সে বুঝি সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে, কিন্তু তার বদলে অ্যাম্ব্রার চোখেমুখে কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ দেখতে পেলো।

ধন্যবাদ, আপনাকে, ফিসফিসিয়ে বলল সে, আমাকে সাহায্য করার জন্য।

ল্যাংডনের চোখে চোখ রেখে তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে নিলো অ্যাম্ৰা। শক্ত করে ধরে রাখলো সেটা। তারপর আচমকাই আবার হাতটা ছেড়ে দিলো।

দুঃখিত, নিচুকণ্ঠেই বলল। কনদুক্তা ইমপ্রোপিয়া, আমার মা এটাই বলতেন সব সময়।

তাকে আশ্বস্ত করার হাসি দিলো ল্যাংডন। এসব তুচ্ছ বিষয় আমলে নেবার মতো পরিস্থিতি এটা নয়-আমার মা আবার এটা বলতেন।

মহিলা হেসে ফেলল, তবে সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। এডমন্ডকে ওভাবে…অন্যদিকে তাকিয়ে বলল সে। …খুবই অসুস্থ বোধ করছি আমি।

খুবই ভয়ানক…মারাত্মক ঘটনা এটা, বলল প্রফেসর। ভালো করেই জানে সে নিজেও কী রকম শক পেয়েছে।

জলরাশির দিকে চেয়ে আছে অ্যাম্ব্রা। আর আমার ফিয়ান্সে ডন হুলিয়ান এসবের মধ্যে জড়িত আছে কথাটা ভাবতেই…।

ল্যাংডন তার কণ্ঠে বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়ার যন্ত্রণাটা টের পেলো। কী বলবে ভেবে পেলো না সে। আমি বুঝতে পারছি আপনার কেমন লাগছে, অল্প জায়গার মধ্যে একটু পায়চারি করলো এবার, কিন্তু আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না এটা। যুবরাজ হুলিয়ান আজকের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আগে থেকে কিছুই জানতেন না তারও কিন্তু সম্ভাবনা রয়েছে। খুনি হয়তো একাই কাজটা করেছে। কিংবা যুবরাজ নয়, অন্য কারোর হয়ে কাজটা করেছে সে। স্পেনের ভবিষ্যৎ রাজা প্রকাশ্যে একজন মানুষকে খুন করাবেন এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে বিশেষ করে তাকে সরাসরি ট্রেস করা যায় এরকমভাবে তো করবেনই না।

এটা ট্রেস করা গেছে কারণ উইনস্টন বের করতে পেরেছে শেষ মুহূর্তে আভিলাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে অতিথিদের তালিকায়। হয়তো হুলিয়ান ভেবেছে, ট্রিগারটা কে টেনেছে সেটা বের করা সম্ভব হবে না কারো পক্ষে।

ল্যাংডনকে মেনে নিতেই হলো মহিলার কথায় যুক্তি আছে।

আমার উচিত হয়নি এডমন্ডের প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে হুলিয়ানের সাথে কথা বলা, তার দিকে ফিরে বলল অ্যাম্ব্রা। ও আমাকে বার বার বলেছে আমি যেন এটাতে অংশ না নেই। সেজন্যে আমি তাকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলাম, আমার অংশগ্রহণটা হবে খুবই সামান্য। আমার মনে হয় আমি হুলিয়ানকে এটাও বলেছিলাম, এডমন্ড তার স্মার্টফোন থেকে আবিষ্কারের ঘোষণাটি দেবে। একটু থামলো সে। এর মানে তারা যদি জানতে পারে আমরা এডমন্ডের ফোনটা নিয়ে নিয়েছি তাহলে বুঝে যাবে তার আবিষ্কারটি প্রচার হবার সম্ভাবনা এখনও

আছে। আমি সত্যি জানি না, হুলিয়ান এ ব্যাপারে কতো দূর যেতে পারে।

সুন্দরি মহিলাকে কিছুক্ষণ ধরে দেখে গেল ল্যাংডন। আপনি আপনার ফিয়ান্সেকে মোটেও বিশ্বাস করেন না, তাই না?

গভীর করে নিঃশ্বাস নিলো অ্যাম্ৰা। সত্যি কথা কি জানেন, আমি তাকে খুব ভালো করে চিনিও না।

তাহলে আপনি কেন তাকে বিয়ে করতে রাজি হলেন?

হুলিয়ান আমাকে এমন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল যে, আমার আর কোন উপায় ছিল না।

ল্যাংডন কোন কিছু বলার আগেই টের পেলো পায়ের নিচে সিমেন্টের ফুটপাতটা কাঁপছে। একটা শব্দও হচ্ছে আশেপাশে। আর সেই শব্দটা বাড়ছে

ক্রমশ। তার মনে হলো, শব্দটা আসছে তাদের ডানদিকে থাকা নদী থেকে।

ল্যাংডন ঘুরে দেখতে পেলো কালো আকৃতির একটা জিনিস দ্রুতগতিতে তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে-একটা পাওয়ারবোট তাদের দিকে এগিয়ে আসছে রানিংলাইট না জ্বালিয়েই। তাদের থেকে একটু দূরে সিমেন্টের উঁচু একটা ব্যাঙ্কের কাছে এসে গতি কমিয়ে দিলো ওটা, তারপর আস্তে করে চলে এলো ঠিক তাদের কাছে।

ক্রাফটার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালো প্রফেসর। এই মুহূর্তের আগপর্যন্ত সে নিশ্চিত ছিল না এডমন্ডের কম্পিউটার ডোসেন্টের উপরে কতোটা আস্থা রাখা ঠিক হবে, কিন্তু এখন এই ইয়েলো ওয়াটার-ট্যাক্সিটা দেখে সে বুঝতে পারছে উইনস্টনের মতো সেরা বন্ধু এ মুহূর্তে তারা কোনভাবেই পেতো না।

বোর্ড থেকে অগোছালো ক্যাপ্টেন তাদের উদ্দেশে হাত নাড়লো। আপনাদের ঐ বৃটিশ ভদ্রলোক আমাকে কল করেছিলেন, লোকটা বলল। তিনি বলেছেন, ভিআইপি ক্লায়েন্ট তিনগুন টাকা দেবে। কী বলবো…ভেলোসিদাদ ভে দিসক্রেসন? তাই আমি রাজি হয়ে গেলাম-দেখতেই পাচ্ছেন, বাতিটাও জ্বালাইনি!

হ্যাঁ, ধন্যবাদ আপনাকে, বলল ল্যাংডন। দারুণ, উইনস্টন। গতি আর বিচক্ষণতা।

ক্যাপ্টেন এগিয়ে এসে অ্যাম্রাকে বোটে উঠতে সাহায্য করলো। সঙ্গে সঙ্গে ও কেবিনের ভেতরে চলে গেল উষ্ণতা পাবার জন্য। ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন চওড়া হাসি দিলো। এটা আমার ভিআইপি? সিনোরিতা অ্যাস্ত্রা ভিদাল?

ভেলোসিদাদ ভে দিসক্রেসন, স্মরণ করিয়ে দিলো লোকটাকে।

সি, সি! ঠিক আছে! লোকটা বোটের হাল ধরলো, স্টার্ট দিলো ইঞ্জিন। কিছুক্ষণ পরই নারভিওন নদী দিয়ে ছুটতে লাগলো পাওয়ারবোটটা।

বোটের সামনে দাঁড়িয়ে গুগেনহাইমের বিশাল কালো মাকড়টাকে দেখতে পেলো ল্যাংডন, অসংখ্য পুলিশের গাড়ির বাতির আলোতে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওটাকে। মাথার উপরে একটি টিভি চ্যানেলের হেলিকপ্টার খবরের সন্ধানে ছুটে যাচ্ছে জাদুঘরের দিকে।

আরো অনেকগুলো আসবে, তবে এটাই প্রথম, ল্যাংডন মনে মনে বলে উঠলো।

প্যান্টের পকেট থেকে এডমন্ডের সাংকেতিক লেখাসংবলিত কার্ডটা বের করলো রবার্ট ল্যাংডন। BIO-EC346। এডমন্ড বলেছিল একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে এটা দেখালেই হবে। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে ভাবেনি ট্যাক্সির বদলে এটা হতে পারতো কোন ওয়াটার ট্যাক্সি।

আমাদের বৃটিশ বন্ধু…ইঞ্জিনের গর্জনের মধ্যেই ল্যাংডন চেঁচিয়ে বলল ড্রাইভারকে। সম্ভবত আপনাকে বলেছে আমরা কোথায় যাবো?

হ্যাঁ, তা তো বলেছেই! আমি তাকে বলে দিয়েছি, বোট দিয়ে আমি কেবল ওই জায়গাটার কাছাকাছি যেতে পারবো। তিনি বলেছেন, কোন সমস্যা নেই। আপনারা তিনশ মিটার হাঁটতে পারবেন না?

অবশ্যই পারবো। ওটা এখান থেকে কতো দূরে?

নদীর তীর ধরে যে হাইওয়েটা চলে গেছে ওটা দেখিয়ে বলল লোকটা, রোড সাইন বলছে সাত কিলোমিটার, কিন্তু নদী দিয়ে যেতে হলে আরেকটু বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে।

জ্বলজ্বলে হাইওয়ে সাইনটার দিকে তাকালো ল্যাংডন।

এরোপুয়ের্তো বিলবাও (বিআইও) ৭ কি.মি

এডমন্ডের কণ্ঠটা তার মাথার ভেতরে উচ্চারিত হতেই না হেসে পারলো না ল্যাংডন। এটা খুবই সহজ একটি কোড, রবার্ট। তার কথাই ঠিক। কিছুক্ষণ আগে যখন ল্যাংডন এই কোডটার মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিল তখন সে একটুখানি লজ্জিতও হয়েছিল এটা বের করতে এতটা সময় লাগলো বলে।

এটা ঠিক যে, BIO একটা কোড-যদিও বিশ্বব্যাপি এরকম আরো অনেক কোডই আছে যেগুলোর অর্থ বের করা তেমন কঠিন কিছু না : BOS, LAX, JFK।

BIO হলো স্থানীয় এয়ারপোর্টের কোড।

এডমন্ডের বাকি কোডটা এখন জলবৎ তরল।

EC346।

এডমন্ডের প্রাইভেট জেটটা কখনও দেখেনি ল্যাংডন, তবে ওটার কথা শুনেছে। তার মনে তেমন একটা সন্দেহ নেই, স্প্যানিশ জেটের কান্ট্রি কোডটা E অক্ষর দিয়েই শুরু হবে-E মানে এসপানিয়া।

EC346 হলো একটা প্রাইভেট জেট।

এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কোন ট্যাক্সি ড্রাইভার তাকে বিলবাওর এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিলে ল্যাংডন যদি এই কার্ডটা দেখাতো তবে তাদেরকে এসকর্ট করে এডমন্ডের প্রাইভেট জেট প্লেনে নিয়ে যাওয়া হতো।

আশা করি উইনস্টন পাইলটকে বলে দিয়েছে আমরা আসছি, ভাবলো ল্যাংডন। পেছনে ফিরে জাদুঘরটা দেখলো সে। ধীরে ধীরে ছোট থেকে ছোট হয়ে আসছে ওটা।

কেবিনের ভেতরে গিয়ে অ্যাম্ব্রার সাথে যোগ দেবার কথাটা মাথায় এলেও। রাতের চমৎকার বিশুদ্ধ বাতাসের ঝাঁপটা তার ভালোই লাগছে। ঠিক করলো, মেয়েটাকে একান্তে কিছুটা সময় দেয়া দরকার।

আমিও এই সময়টা কাজে লাগাতে পারবো, ভাবলো সে। বো-এর কাছে চলে গেল এবার।

বোটের সামনে আসতেই প্রবল বাতাসে তার চুলগুলো উড়তে লাগলো। বো-টাইটা খুলে পকেটে ভরে নিলো ল্যাংডন। এরপর কলারের উইংটিপ বোতামটাও খুলে ফেলে যতোটা সম্ভব বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো এবার।

এডমন্ড, ভাবলো সে। তুমি কী করেছো?

.

অধ্যায় ৩৩

যুবরাজ হুলিয়ানের অন্ধকারাচ্ছন্ন অ্যাপার্টমেন্টে পায়চারি করতে থাকা কমান্ডার গারজা রীতিমতো ফুঁসছে, বিশপের নীতিবাগিশ লেকচারটা সহ্য করতে বেগ পাচ্ছে সে।

আপনি আপনার জায়গা রেখে অন্য জায়গায় এসে নাক গলাচ্ছেন, ভালদেসপিনোকে চেঁচিয়ে বলতে চাইছে গারজা। এটা আপনার ধর্মশালা না!

আরো একবার প্রাসাদের রাজনীতিতে বিশপ নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। চার্চের আলখাল্লা পরে ভুতের মতো হুলিয়ানের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হয়ে এখন যুবরাজকে স্পেনের ঐতিহ্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, অতীতের ধর্মপরায়ণ রাজা রাণীদের গপ্পো এবং সঙ্কটের সময় স্বস্তি দান করতে চার্চের কী প্রভাব রয়েছে এসব নিয়ে সারমন দিয়ে যাচ্ছেন ভালদেসপিনো।

এটা সেই মুহূর্ত না, গারজা গজ গজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আজ রাতে যুবরাজের দরকার হবে অতি সূক্ষ্ম পাবলিক রিলেশন্স পারফর্মেন্স দেখানো। গারজা কোনভাবেই চাইছে না ভালদেসপিনো তাকে ধর্মিয় এজেন্ডা তুলে দিয়ে বিপথে চালনা করুক।

বিশপের এক তরফা ঘ্যানঘ্যানানিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে স্বস্তির সাথেই গারজার ফোনটা বেজে উঠলো এসময়।

সি, দাইম, বেশ জোরেই বলল গারজা। নিজেকে যুবরাজ আর বিশপের মাঝখানে দাঁড় করালো সে। কুয়ে তাল ভা?

স্যার, বিলবাও থেকে এজেন্ট ফনসেকা ফোন করেছে, কলার দ্রুত বলে চলেছে স্প্যানিশে। বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা শুটারকে ধরতে পারিনি। উবার তার গাড়িটা ট্র্যাক করতে পারেনি কোনভাবেই। ওদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই ঐ গাড়ির ড্রাইভারের। শুটার বোধহয় আগে থেকেই বুঝে গেছে আমরা কিভাবে তাকে ট্র্যাক করবো।

নিজের ক্রোধটা বহু কষ্টে দমন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গারজা। চেষ্টা করলো বর্তমানে তার যে মানসিকতা বিরাজ করছে সেটা যেন তার কণ্ঠে প্রকাশ

পায়। বুঝতে পেরেছি, নির্বিকার কণ্ঠে বলল সে। এ মুহূর্তে তোমাদের একমাত্র দায়িত্ব হলো মিস ভিদাল। যুবরাজ উনার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই উনাকে এখানে নিয়ে আসা হবে।

দীর্ঘ একটা নীরবতা নেমে এলো ফোনের ওপাশে। বেশ দীর্ঘ।

কমান্ডার? ফনসেকা মিনমিনে গলায় বলল। আমি দুঃখিত, স্যার…একটা খারাপ খবর আছে। মনে হচ্ছে, মিস ভিদাল আর ঐ আমেরিকান প্রফেসর এই ভবন থেকে চলে গেছে-একটু থেমে আবার বলল-আমাদেকে রেখেই।

হাত থেকে ফোনটা প্রায় ফেলেই দিতে গেছিল গারজা। বুঝলাম না…কী বললে…আবার বলো?

স্যার…মিস ভিদাল আর রবার্ট ল্যাংডন এখান থেকে চলে গেছেন। মিস ভিদাল ইচ্ছেকৃতভাবে উনার ফোনটা ফেলে দিয়েছেন যাতে করে আমরা তাকে ট্র্যাক করতে না পারি। তারা কোথায় গেছেন আমাদের কোন ধারণাই নেই।

কথাটা শুনে চোয়াল ঝুলে পড়লো গারজার। এতক্ষণ পর যুবরাজ তার দিকে ফিরে তাকালেন চিন্তিত ভঙ্গিতে। ভালদেসপিনোও একটু ঝুঁকে কথাগুলো শুনতে উদগ্রিব। আগ্রহের তীব্রতায় তার ভুরু কপালে উঠে গেছে।

আহ্-দারুণ খবর দিলে! আচমকা বলে উঠলো গারজা। মাথা দোলালো সে। ভালো কাজ করেছে। আজকের রাতের মধ্যেই তোমাদের সবাইকে আমি এখানে দেখতে চাই। ট্রান্সপোর্ট, প্রটোকল আর সিকিউরিটির ব্যবস্থা করো। এক মিনিট…

গারজা ফোনটা হাত দিয়ে চেপে রেখে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে হাসলো। সব ঠিক আছে। আমি পাশের ঘরে গিয়ে ওদেরকে ডিটেইল বলে দিচ্ছি কী। করতে হবে। এই ফাঁকে আপনারা একান্তে কিছুটা সময় কথা বলে নেন।

যুবরাজকে ভালদেসপিনোর সাথে একা রেখে যেতে ইচ্ছে না করলেও বাধ্য হয়েই গারজা এ কাজটা করলো। এখন এমন একটা কল সে করবে যেটা তাদের সামনে করা সম্ভব নয়। সেজন্যে পাশের বেডরুমে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো সে।

কুয়ে দিয়াবলোস আ পাসাদো? দাঁত কিটমিট করে বলল ফোনে। এইসব হচ্ছেটা কী?

ফনসেকা যা বলল সেটা শুনে মনে হলো ফ্যান্টাসি কোন গল্প বুঝি।

বাতি নিভে গেছিল? গারজা জানতে চাইলো। একটা কম্পিউটার সিকিউরিটি অফিসার সেজে তোমাদেরকে ভুল তথ্য দিয়েছে? এ কথা শোনার পর আমি কী বলবো বুঝতে পারছি না!

আমি বুঝতে পারছি এটা কল্পনা করাও কঠিন, স্যার। কিন্তু যা বললাম ঠিক তা-ই ঘটেছে। আমরা কেবল বুঝতে পারছি না, কম্পিউটার আচমকা তার মন বদলালো কেন।

মন বদলালো?! ওটা বালের একটা কম্পিউটার!

মানে, আমি বলতে চাচ্ছি, এর আগে কম্পিউটারটা খুবই সাহায্য করেছে আমাদেরকে-শুটারের নাম-পরিচয় খুঁজে বের করা, খুনের ব্যাপারটা আগেভাগেই বুঝতে পারা, খুনি যে একটা উবারের গাড়িতে করে পালিয়ে গেছে সেটা বের করা, সবই করেছে ও। তারপর হুট করেই আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করলো। আমরা বুঝতে পারছি, রবার্ট ল্যাংডন তাকে কিছু একটা বলার পর পরই সবকিছু বদলে যায়।

এখন আমাকে একটা কম্পিউটারের সাথে লড়তে হচ্ছে? গারজা বুঝতে পারলো সে আধুনিক দুনিয়ার জন্য একটু বেশিই বুড়ো হয়ে গেছে। গার্ডিয়া রিয়েলকে একটা কম্পিউটার ধোঁকা দিয়ে যুবরাজের ফিয়ান্সেকে এক আমেরিকানের সাথে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে, এরকম খবর জানাজানি হয়ে গেলে ব্যাপারটা যুবরাজকে কতোটা বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেবে জানো? 

আমরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন আছি।

তোমাদের কি কোন ধারণা আছে, কী জন্যে তারা পালিয়ে গেল? আমার কাছে এটা একেবারেই দুর্বোধ্য আর অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে।

আমি যখন প্রফেসর ল্যাংডনকে বললাম তাকে মাদ্রিদে নিয়ে যাবো তখন তিনি একদমই রাজি হননি। তিনি পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিলেন, আমাদের সঙ্গে যাবেন না।

আর সে-কারণে তিনি হত্যাকা-ের ঘটনাস্থল থেকে পালালেন? গারজা অন্য কিছুর গন্ধ পাচ্ছে, কিন্তু সেটা কী তা বুঝতে পারছে না। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। এই খবর জানাজানি হবার আগেই মিস ভিদাল কোথায় আছে। সেটা খুঁজে বের করে আজকের রাতের মধ্যে তাকে প্রাসাদে নিয়ে আসাটা খুবই জরুরি।

বুঝতে পারছি, স্যার। কিন্তু ডিয়াজ আর আমি, আমরা দু-জন ছাড়া এখানে আর কেউ নেই। আমাদের পক্ষে তো সারা বিলবাও শহর তন্ন তন্ন করে খোঁজা সম্ভব নয়। সব ধরণের কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেয়া দরকার আমাদের। ট্রাফিক ক্যামেরাগুলোর অ্যাকসেসও পেতে হবে আমাদেরকে। এয়ার সাপোর্ট আর–

প্রশ্নই ওঠে না! তেতে উঠলো গারজা। এত বড় বিব্রতকর ঘটনা আমরা মেনে নিতে পারবো না এ মুহূর্তে। তোমরা নিজেরাই তাদেরকে খুঁজে বের করো। মিস ভিদালকে যতো দ্রুত সম্ভব আমাদের হেফাজতে নিয়ে নাও।

জি, স্যার।

রেগেমেগে ফোনটা রেখে দিলো গারজা।

বেডরুম থেকে বের হতেই সে দেখতে পেলো ফ্যাকাসে মুখের এক তরুণী হলওয়ে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা পরে আছে টেকি কোক-বোটল চশমা আর বাদামি রঙের প্যান্ট-সুট। তার হাতে একটা কম্পিউটার ট্যাবলেট। চোখেমুখে স্পষ্ট উদ্বিগ্নতা।

ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করো, ভাবলো গারজা। এখন এসব না।

মনিকা মার্টিন প্রাসাদের নতুন এবং এ পর্যন্ত সবচেয়ে তরুণতম পাবলিক রিলেশন্স কো-অর্ডিনেটর-মিডিয়ার সাথে লিয়াজোঁ রাখা, পিআর স্ট্র্যাটেজিস্ট হিসেবে কাজ করা এবং কমিউনিকেশন্স ডিরেক্টরের একটি পদে আছে সে-এরফলে মেয়েটাকে সব সময়ই ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়।

মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে মার্টিন কমিউনিকেশন্স ডিগ্রি অর্জন করেছে মাদ্রিদের কমপুতেন্স ইউনিভার্সিটি থেকে, দু-বছরের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করেছে বিশ্বের সবচেয়ে নামকরা কম্পিউটার স্কুল বেইজিংয়ের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে-এরপর সে শক্তিশালি গ্রুপো প্লানেতার পিআর হিসেবে কিছুদিন কাজ করে যোগ দেয় স্প্যানিশ টিভি নেটওয়ার্ক এন্তেনা ৩-এর কমিউনিকেশন্সের। উঁচুপদে।

গত বছর স্পেনের তরুণ জনগোষ্ঠির কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকা টুইটার, ফেসবুক, ব্লগসহ যাবতিয় অনলাইন মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে তাদের কাছে সহজে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে রাজপ্রাসাদ। ফলে পত্রপত্রিকা আর টিভি মিডিয়ার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ পুরনো পিআর প্রধানকে অব্যহতি দিয়ে এই মেয়েটাকে নিয়োগ দেয়া হয়।

যুবরাজের কাছে ভীষণ ঋণী মার্টিন, গারজা এটা জানে।

প্রাসাদের স্টাফ হিসেবে এই মেয়েকে চাকরি দেয়াটা যুবরাজের জন্য বিরল ঘটনা ছিল। কারণ হুলিয়ান কখনও এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাতো না-সব কিছু তার বাবাই দেখাশোনা করতেন। মার্টিন এ কাজের জন্য একেবারে উপযুক্ত একজন মানুষ। কিন্তু গারজার কাছে মেয়েটার সন্দেহবাতিকতা আর নার্ভাস আচার-আচরণ খুবই ক্লান্তিকর লাগছে।

কন্সপিরেসি থিওরি, কাছে আসতেই মার্টিন তাকে জানালো, নিজের ট্যাবলেটটার দিকে ইশারা করলো সে। চারপাশে ডানা মেলছে।

অবিশ্বাসের সাথে পিআর কো-অর্ডিনেটরের দিকে তাকালো গারজা। আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি এখন? এইসব আজগুবি থিওরির চেয়ে আজ রাতে অনেক বেশি জরুরি বিষয় আছে চিন্তা করার জন্য। তুমি কি আমাকে বলবে, রয়্যাল রেসিডেন্স থেকে এভাবে ছুটে আসলে কেন?

কন্ট্রোল রুম থেকে এইমাত্র আপনার জিপিএস-এ পিঞ্জড করা হয়েছিল। গারজার বেল্টের দিকে ইঙ্গিত করলো সে।

চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল গারজা। নিজের বিরক্তিটা হজম করতে হলো তাকে। এই নতুন পিআর কো-অর্ডিনেটরের সাথে সাথে প্রাসাদ থেকে নতুন একটি ইলেক্ট্রনিক সিকিউরিটি ডিভিশনও স্থাপন করা হয়েছে। ওটা গারজার টিমকে জিপিএস, ডিজিটাল সার্ভিল্যান্স, প্রোফাইলিং, আর প্রিএম্পটিভ ডাটা মাইনিং-এর সার্ভিস দিয়ে থাকে। প্রতিদিন গারজার স্টাফরা আরো বেশি বিচিত্র আর তরুণতর হয়ে উঠছে।

আমাদের কন্ট্রোল রুমটা দেখলে মনে হয় কোন কলেজ ক্যাম্পাসের কম্পিউটার সেন্টার।

বোঝাই যাচ্ছে, এই নতুন টেকনোলজি ব্যবহার করে গার্ডিয়া এজেন্টদের মতো গারজাকেও ট্র্যাক করা যায়। একদল পোলাপান বেইজমেন্টে বসে বসে জেনে যায় সে এখন কোথায় আছে-এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই দুশ্চিন্তা ভর করলো তার মধ্যে।

আমি নিজেই আপনার কাছে চলে এসেছি, ট্যাবলেটটা হাতে ধরে বলল মার্টিন, কারণ আমি জানি আপনি এটা দেখতে চাইবেন।

ট্যাবলেটটা তার হাত থেকে নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকালো গারজা। ওখানে দেখতে পেলো সাদা-দাড়ির এক স্পেনিয়ার্ডের অনেকগুলো ফটো আর সংক্ষিপ্ত জীবনী, যাকে কিনা বিলবাওর শুটার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে লোকটা রয়্যাল নেভির লুই আভিলা।

খুবই ক্ষতিকর কথাবার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলল মার্টিন, এর বেশিরভাগই আভিলা নামের লোকটা যে রয়্যাল নেভিতে ছিল সেটা নিয়ে।

আভিলা নেভিতে ছিল! আৎকে উঠলো গারজা।

হ্যাঁ। টেকনিক্যালি রাজা হলেন সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার–

চুপ করো, আদেশের সুরে বলল গারজা, ট্যাবলেটটা মেয়েটার কাছে ফিরিয়ে দিলো। রাজা কোনভাবে সন্ত্রাসি কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত, এরকম কথাবার্তা কেবলমাত্র কন্সপিরেসি থিওরিতে বিশ্বাসি মাথামোটাদের পক্ষেই বলা সম্ভব। আজকের রাতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার সাথে এর কোন সম্পর্কই নেই। আমাদের জন্য আশির্বাদ জপ করতে করতে নিজের কাজে ফিরে যাও। এই উন্মাদটা হবু রাণীকেও খুন করতে পারতো, কিন্তু তা না করে সে খুন করেছে এক আমেরিকান নাস্তিককে। একদিক থেকে দেখলে, খুব একটা মন্দ হয়নি!

মেয়েটা এ কথা শুনে মোটেও ভড়কে গেল না। আরেকটা ব্যাপার আছে, স্যার। এটার সাথে রাজপরিবারের সম্পর্ক রয়েছে। আমি চাইনি আপনি অন্ধকারে থাকেন।

মার্টিন কথা বলতে বলতে ট্যাবলেটে অন্য একটা সাইটে ঢোকার চেষ্টা করলো। এই ছবিটা কয়েকদিন আগে থেকেই অনলাইনে আছে কিন্তু কেউ খেয়াল করেনি। এখন এডমন্ড কিয়ার্শের খবরটা ভাইরাল হওয়াতে এই ছবিটা সংবাদে উঠে এসেছে। ট্যাবলেটটা আবারো গারজার হাতে ধরিয়ে দিলো সে।

শিরোনামের দিকে আগে চোখ গেল তার : এটাই কি ফিউচারিস্ট এডমন্ড কিয়ার্শের শেষ ছবি?

একটা ঘোলাটে ছবিতে দেখা যাচ্ছে কালো সুট পরা কিয়ার্শ একটা খাড়া পাহাড়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

ছবিটা তিনদিন আগে তোলা হয়েছিল, মার্টিন বলল, কিয়ার্শ তখন মন্তসেরাতের অ্যাবিতে গিয়েছিলেন। ওখানকার এক শ্রমিক কিয়াকে দেখে চিনে ফেললে, সে তার মোবাইলফোন দিয়ে ছবিটা তোলে। আজকে কিয়াশ

খুন হবার পর ঐ শ্রমিক ছবিটা আবার পোস্ট করেছে নিহত মানুষটির শেষ ছবি। হিসেবে।

এটা আমাদের সাথে কিভাবে সম্পর্কিত হলো? গারজা জানতে চাইলো বিরক্ত হয়ে।

স্ক্রল করে পরের ছবিটা দেখুন।

স্ক্রল করে দ্বিতীয় ছবিটা দেখেই টলে গেল গারজা। নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য দেয়ালটা ধরতে হলো একহাতে। এটা…এটা সত্যি হতে পারে না।

একই শটের আরেকটু ওয়াইডার-ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে, এডমন্ড কিয়ার্শ

দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহি লাল রঙের ক্যাথলিক আলখাল্লা পরা লম্বা এক লোকের সাথে। লোকটা বিশপ ভালদেসপিনো।

এটা সত্যি, স্যার, মার্টিন বলল, কয়েকদিন আগে কিয়ার্শের সাথে ভালদেসপিনো দেখা করেছিলেন।

কিন্তু…কয়েক মুহূর্তের জন্য কথা বলতে একটু ইতস্তত করলো গারজা। তাহলে বিশপ কেন এটা উল্লেখ করলেন না? বিশেষ করে আজকের রাতে যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটা বিবেচনায় নিলে তো তার এটা জানিয়ে দেয়া উচিত ছিল।

সন্দেহজনক একটি ভঙ্গি করলো মার্টিন। এজন্যেই আমি মনে করেছি, সবার আগে আপনার সঙ্গেই কথা বলা দরকার।

কিয়ার্শের সাথে ভালদেসপিনো দেখা করেছিলেন! নিজের চিন্তাভাবনা পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারলো না গারজা। আর বিশপ কিনা এ কথা পুরোপুরি চেপে গেছেন? খবরটা সাংঘাতিক। গারজা বুঝতে পারলেন যুবরাজকে সতর্ক করে দেয়া উচিত।

দুভার্গের ব্যাপার হলো, মেয়েটি বলল এবার, আরো কিছু আছে, স্যার। ট্যাবলেটটা নিয়ে আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে।

কমান্ডার? লিভিং রুম থেকে হঠাৎ ভালদেসপিনোর কণ্ঠটা ভেসে এলো। মিস ভিদালকে এখানে নিয়ে আসার কী হলো?

মনিকা মার্টিন মুখ তুলে তাকালো, তার চোখদুটো বিস্ফোরিত যেন। এটা কি বিশপের গলা? নিচুকণ্ঠে বলল সে। ভালদেসপিনো আজ রাতে এখানে আছেন?

হ্যাঁ। যুবরাজকে কাউসেলিং করছেন।

কমান্ডার! আবারো ডেকে উঠলেন ভালদেসপিনো। আপনি কি ওখানে আছেন?

বিশ্বাস করুন, ফিসফিসিয়ে বলল মার্টিন, তার কণ্ঠের ভীতিটা সুস্পষ্ট, আরো কিছু তথ্য আছে যা আপনার এক্ষুণি জানা দরকার-বিশপ অথবা যুবরাজের সাথে কোন কথা বলার আগেই। আমি যখন বলবো, আজকের রাতের সঙ্কটটা আপনি যতোটা কল্পনা করেছেন তার চাইতে অনেক বেশি

আঘাত করবে আমাদেরকে, তখন আমার কথাটা বিশ্বাস করবেন।

পিআর কো-অর্ডিনেটরকে কয়েক মুহূর্ত পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো গরজা। নিচের লাইব্রেরিতে যাও। আমি এক মিনিট পরই আসছি।

মার্টিন সায় দিয়ে চলে গেল সেখানে।

এখন একা, গভীর করে দম নিয়ে নিলো গারজা। নিজেকে রিল্যাক্স রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। শান্ত পদক্ষেপে ফিরে গেল লিভিং রুমে।

মিস ভিদালের সবকিছু ঠিক আছে, ভেতরে ঢুকেই হাসিমুখে বলল গারজা। একটু পরই উনাকে এখানে নিয়ে আসা হবে। আমি নিজে সিকিউরিটি অফিসকে বলেছি উনার ট্রান্সপোর্টেশন করার জন্য। হুলিয়ানের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করলো, তারপরই তাকালো বিশপের দিকে। একটু পরই আমি ফিরে আসছি। আপনি যাবেন না।

এ কথা বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেল সে।

*

অ্যাপার্টমেন্ট থেকে গারজাকে বেরিয়ে যেতে দেখে বিশপ ভালদেসপিনো ভুরু কুঁকচে চেয়ে রইলেন।

কি হয়েছে? যুবরাজ জানতে চাইলেন, বিশপের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে আছেন তিনি।

হুম, হুলিয়ানের দিকে ফিরে তাকালেন ভালদেসপিনো। পঞ্চাশ বছর ধরে আমি মানুষের কনফেশন নিয়ে আসছি। কে কখন মিথ্যে বলে সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে।

.

অধ্যায় ৩৪

কন্সপিরেসিনেট.কম

ব্রেকিং নিউজ

অনলাইন কমিউনিটিতে জল্পনা-কল্পনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে

এডমন্ড কিয়ার্শের হত্যাকাণ্ডের পর পর এই ফিউচারিস্টের অনলাইন ফলোওয়াররা দুটো আর্জেন্ট ইস্যুর উপরে নানা রকম জল্পনা-কল্পনার ঝড় বয়ে দিচ্ছে।

কিয়ার্শের আবিষ্কারটি কী ছিল?
তাকে কে খুন করলো, কেন খুন করলো?

কিয়ার্শের আবিষ্কারটি নিয়ে ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরণের তত্ত্বের বন্যা বয়ে যাচ্ছে, সূত্রপাত ঘটাচ্ছে নানা রকম টপিকের-ডারউইন থেকে অপার্থিব জীব, সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে আরো অনেক কিছুতে। তার হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে যেসব থিওরি ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মধ্যে উগ্র ধর্মিয় গোষ্ঠি, কপোরেট এসপিওনাজ আর সংক্ষুব্ধ কোন ব্যক্তির কথাও আসছে। কন্সপিরেসিনেট কথা দিচ্ছে, খুনির উপরে এক্সকু সিভ তথ্য পাওয়ামাত্রই আপনাদের সাথে সেটা শেয়ার করা হবে।

.

অধ্যায় ৩৫

ওয়াটার টেক্সির কেবিনে একা দাঁড়িয়ে আছে অ্যাম্ব্রা ভিদাল, রবার্ট ল্যাংডনের জ্যাকেটটা নিজের গায়ে চাপিয়ে রেখেছে সে। কিছুক্ষণ আগে ল্যাংডন যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কেন অল্প পরিচয়ের একজন মানুষকে বিয়ে করতে রাজি হলো, অ্যাম্ব্রা তখন একেবারে সত্যি কথাটাই বলেছিল।

আমার কোন উপায় ছিল না।

হুলিয়ানের সাথে তার এনগেজমেন্টটা এমন দুর্ভাগ্যজনক ছিল যে, আজ রাতে সেটা সহ্য করতে পারছে না আর। বাকি যেসব ঘটনা ঘটে গেছে সেগুলোর কথা না-হয় বাদই দেয়া গেল।

আমি ফাঁদে পড়ে গেছিলাম।
আমি এখনও ফাঁদে পড়ে আছি।

এখন কেবিনের ময়লা জানালার কাঁচে নিজের প্রতিবিম্বটা দেখতে পেয়ে তার মনে হচ্ছে সুতীব্র এক একাকিত্ব গ্রাস করে ফেলেছে তাকে। নিজেকে করুণা করার মতো মেয়ে অ্যাম্ব্রা ভিদাল নয়, কিন্তু এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে তার হৃদয়টা ভেঙে খান খান হয়ে গেছে, লক্ষ্যহীনভাবে সেটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এমন একজন মানুষের সাথে এনগেজড যে একটা বর্বরোচিত হত্যাকা-ের সাথে জড়িত।

অনুষ্ঠানের আগে একটা ফোন কল করেই যুবরাজ নির্ধারণ করে দিয়েছে এডমন্ডের পরিণতি। অতিথিদের স্বাগত জানাতে গিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিল অ্যাম্ব্রা, এমন সময় এক তরুণী স্টাফ হন্তদন্ত হয়ে এসে তাকে এক টুকরো কাগজ। ধরিয়ে দেয়।

সেনোরা ভিদাল! মেনসায়ে পারা উস্তেদ!

মেয়েটা দম ফুরিয়ে স্প্যানিশে বলতে থাকে, একটু আগে ফ্রন্ট ডেস্কে জরুরি একটা ফোন এসেছিল।

আমাদের কলার আইডি বলছে, মেয়েটা বলে, ওটা মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদ থেকে এসেছে, তাই আমি কলটা রিসিভ করি! বুঝতে পারি যুবরাজ হুলিয়ানের অফিস থেকে ফোনটা করা হয়েছে!

তারা ফ্রন্ট ডেস্কে ফোন করেছে? অ্যাম্ৰা জিজ্ঞেস করে। তাদের কাছে তো আমার নাম্বার আছেই।

যুবরাজের সহকারি বলেছেন, তিনি আপনার ফোনে কল করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সংযোগ পাননি।

অ্যাম্ৰা তার ফোন চেক করে দেখে তখন। আজব। কোন মিস কল নেই। এরপরই সে বুঝতে পারে, একটু আগে কিছু টেকনিশিয়ান জাদুঘরের ভেতরে সেলুলার ফোন জ্যামিং করার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখেছিল। হুলিয়ানের সহকারি নিশ্চয় সে-সময়ই কলটা দিয়েছে।

মনে হচ্ছে বিলবাও থেকে যুবরাজের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাকে ফোন করে অনুরোধ করেছেন আজকের অনুষ্ঠানে যেন তিনি ঢাকার অনুমতি পান। একটুকরো কাগজ অ্যাম্ব্রার হাতে ধরিয়ে দেয় মেয়েটি। তিনি আশা করছেন, আপনি যেন আজকের অনুষ্ঠানে আরেকজন অতিথির নাম যোগ করে দেন।

মেসেজটা দেখে অ্যাম্রা।

আলমিরাস্তে লুই আভিলা (অবঃ)
আরমাদা এসপানিওলা

স্প্যানিশ নেভির একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা? তারা একটা ফোন নাম্বারও দিয়েছে আমার কাছে, বলেছে, আপনি চাইলে সরাসরি ফোন করে এ নিয়ে কথা বলতে পারতেন। কিন্তু যুবরাজ হুলিয়ান একটা মিটিংয়ে গেছেন, সুতরাং আপনি এখন তাকে পাবেন না। তবে আমাকে যে ফোন করেছিল সে জোর দিয়ে বলেছে, যুবরাজ চান তার অনুরোধটি যেন রক্ষা করা হয়।

অনুরোধ রক্ষা করবো? অ্যাম্ব্রা রাগে গজ গজ করতে থাকে। এরইমধ্যে তুমি আমাকে যে অবস্থায় ফেলেছে তারপরও?

আমি দেখছি ব্যাপারটা, বলেছিল অ্যাম্ৰা। ধন্যবাদ তোমাকে।

তরুণী স্টাফ খুশিতে এমনভাবে নাচতে নাচতে চলে গেছিল যেন এইমাত্র স্বয়ং ঈশ্বরের কোন বার্তা পৌঁছে দিয়ে গেল। যুবরাজের মেসেজের দিকে চেয়ে ছিল অ্যাম্ব্রা। এভাবে তাকে দিয়ে এরকম একটা অনুরোধ করিয়ে নেবে এ কথা

সে ভাবলো কী করে, সেটাই তাকে বেশি খোঁচাচ্ছিলো। বিশেষ করে এমন একটা অনুষ্ঠানে, যেখানে তাকে জড়িত না থাকার জন্য খুবই চাপাচাপি করেছে।

আরেকবার তুমি আমাকে নিরুপায় অবস্থায় ফেলে দিলে, ভেবেছিল সে। সে যদি এই অনুরোধটি না রাখে তাহলে একজন উচ্চপদস্থ নাভাল অফিসার জাদুঘরের দরজার সামনে থেকে অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে। অনুষ্ঠানটি খুবই হিসেব করে সাজানো হয়েছিল, নজিরবিহীন মিডিয়া কাভারেজ আকর্ষণ করতে পেরেছিল তারা। হুলিয়ানের কোন ক্ষমতাধর বন্ধুকে অপমান করে বিব্রতকর কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হোক সেটা আমি কোনভাবেই চাই না।

অ্যাডমিরাল আভিলার ব্যাপারে কোন খোঁজখবর নেয়া হয়নি, অথবা ক্লিয়ার লিস্টেও তার নাম নেই। কিন্তু অ্যাম্ব্রার কাছে মনে হয়েছিল, সিকিউরিটি চেকের কথা বললে সেটা যেমন অপ্রয়োজনিয় কাজ হবে তেমনি অপমানজনকও হবে। হাজার হোক, মানুষটা উচ্চপদস্থ নেভি অফিসার। এতটাই ক্ষমতাবান যে, রাজ প্রাসাদে ফোন করে হবু রাজাকে দিয়ে একটা অনুরোধ করাতে পেরেছেন।

আর তাই, টাইট শিডিউলের জন্য অ্যাম্ব্রা একটা সিদ্ধান্তই নিতে পেরেছিল। সামনের প্রবেশদ্বারে অ্যাডমিরাল আভিলার নাম সে অতিথিদের তালিকায় লিখে। দেয়, সেই সাথে হেডসেটের মাধ্যমে ডোসেন্ট সুবিধাটি যেন পায় সেটারও ব্যবস্থা করে ফেলে।

এটা করেই সে আবার কাজে ফিরে গেছিল।

আর এখন এডমন্ড মারা গেছে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাস্তবে ফিরে এলো আবার। এই যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিটা মাথা থেকে দূর করতে গিয়ে অদ্ভুত একটি চিন্তার উদয় হলো তার মধ্যে।

আমি সরাসরি হুলিয়ানের সাথে কথা বলিনি…মেসেজটা পুরোপুরি থার্ড পার্টির মাধ্যমে পেয়েছি। অন্য কারো কাছ থেকে।

এই ভাবনাটা তার মধ্যে ছোট্ট একটি আশার আলো জ্বালাতে পারলো।

রবার্ট যা বলেছে, সেটা কি তাহলে সম্ভব? হুলিয়ান হয়তো নিদোষ?

কথাটা অনেকক্ষণ ধরে ভেবে গেল, তারপর তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। বাইরে।

আমেরিকান প্রফেসর বোটের একেবারে সামনের রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে, যেন রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করছে সে। অ্যাম্ব্রা তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। তাদের বোটটা যে নারভিওন নদী থেকে উত্তরদিকের ছোট একটি শাখানদী ধরে এগোচ্ছে সেটা দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো।

ল্যাংডনকে সে দ্রুত জানিয়ে দিলো কিভাবে হুলিয়ানের অফিস থেকে ফোন করে তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। আমি কেবল জানি, মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদ থেকে মিউজিয়ামের ফ্রন্ট ডেস্কে কল করা হয়েছিল। টেকনিক্যালি ঐ কলটা যে কেউ করে দাবি করতে পারে সে হুলিয়ানের সহকারি।

তার কথার সাথে সায় দিলো ল্যাংডন। এজন্যেই হয়তো সেই লোক সরাসরি আপনার সাথে কথা না বলে অনুরোধটা মেসেজের মাধ্যমে করেছে। কে জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করেন? এডমন্ডের সাথে বিশপ ভালদেসপিনোর বিবাদের কথাটা বিবেচনায় নিলে, তার নামটাই আসে সবার আগে।

যে কেউ হতে পারে, বলল অ্যাম্ব্রা। রাজপ্রাসাদ এখন খুবই নাজুক সময় পার করছে। হুলিয়ান যেহেতু সবকিছুর কেন্দ্রে, তার বহু পুরনো উপদেষ্টারা তোড়জোর শুরু করে দিয়েছে কে কার চেয়ে বেশি বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে পারে। দেশটা বদলে যাচ্ছে, আমার মনে হয় অনেক বয়স্ক কর্মকর্তা মরিয়া হয়ে আছে। পুণরায় ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য।

তো, যে-ই জড়িত থাকুক না কেন, ল্যাংডন বলল, আশা করি তারা যেন বুঝতে না পারে আমরা দুজন এডমন্ডের পাসওয়ার্ডটা খোঁজার চেষ্টা করছি, আবিষ্কারের কথাটা জানাতে চাচ্ছি সবাইকে।

কথাটা বলামাত্রই তাদের চ্যালেঞ্জটা নিয়ে ভাবলো ল্যাংডন। সেই সাথে বিপদটাও আঁচ করতে পারলো সে।

এই তথ্যটা যাতে প্রকাশ করা না হয় সেজন্যেই এডমন্ডকে হত্যা করা হয়েছে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য ল্যাংডনের মনে হলো তার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ হতে পারে সোজা এয়ারপোর্ট থেকে দেশে চলে যাওয়া। বাকি সবকিছু অন্যরা সামলাক।

নিরাপদ, হ্যাঁ, ভাবলো সে, এটা একটা অপশন হতে পারে…কিন্তু আমি এটা করবো না।

নিজের পুরনো ছাত্রের প্রতি একটা কর্তব্যবোধ অনুভব করলো ল্যাংডন। সেইসঙ্গে, একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে নির্মমভাবে সেন্সর করার জন্য ভীষণ ক্ষিপ্তও সে। তাছাড়া, এডমন্ডের আবিষ্কারটি নিয়ে তার মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহতো রয়েছেই।

আর অ্যাম্ব্রা ভিদালও আছে, ল্যাংডন জানে।

মহিলা বেশ সঙ্কটের মধ্যে পড়ে গেছে। সে যখন তার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহায্যের জন্য আকুতি জানালো, ল্যাংডন তখন তার মধ্যে গভীর অনুতাপও দেখেছে…অবশ্য প্রচণ্ড ভয়ের মেঘও দেখেছে সে। একটা সিক্রেট আছে, আঁচ করতে পেরেছিল প্রফেসর। মহিলার দরকার সাহায্য।

হঠাৎ করেই অ্যাম্ব্রা চোখ তুলে তাকালো, যেন ল্যাংডনের ভাবনাটা আঁচ করতে পেরেছে। আপনার খুব শীত করছে, জ্যাকেটটা নিয়ে নিন।

মৃদু হাসি দিলো প্রফেসর। আমি ঠিক আছি।

আপনি কি এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর পর স্পেন ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছেন?

হেসে ফেলল ল্যাংডন। সত্যি বলতে এটা আমার মাথায় এসেছিল।

এটা করবেন না, প্লিজ। রেলিংয়ের কাছে পৌঁছে ল্যাংডনের হাতের উপর আলতো করে তার হাতটা রাখলো সে। আজ রাতে কীসের মুখোমুখি হবো সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আপনি এডমন্ডের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন, একবার সে আমাকে বলেছিল, আপনার বন্ধুত্বকে কতোটা মূল্যায়ন করে, আপনার মতামতের উপরে তার অনেক আস্থা ছিল। আমার ভয় হচ্ছে, রবার্ট…আমার মনে হয় না আমি একা একা এই কাজটা করতে পারবো।

অ্যাম্ব্রার মধ্যে হঠাৎ করে এমন নাজুক মনোভাব দেখে একটু চমকে গেল ল্যাংডন। ঠিক আছে, সায় দিয়ে বলল সে। এডমন্ডের কাছে আপনার আমার দু-জনেরই একটা দায়বদ্ধতা রয়েছে। সত্যি বলতে কি, বিজ্ঞানের কাছেও আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। পাসওয়ার্ডটা খুঁজে বের করে এই আবিষ্কারের কথা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।

মিষ্টি করে হাসলো অ্যাম্ৰা। ধন্যবাদ আপনাকে।

বোটের পেছনে তাকালো ল্যাংডন। আমার মনে হয় আপনার গার্ডিয়া এজেন্টরা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে আমরা জাদুঘর থেকে বেরিয়ে গেছি।

তাতে কোন সন্দেহ নেই আমার। কিন্তু উইনস্টন দারুণ কাজ দেখিয়েছে, তাই না?।

একদম মাথানষ্ট, জবাবে বলল ল্যাংডন। এডমন্ড যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সেও বিস্ময়কর উন্নতি করতে পেরেছে সেটা এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছে সে। এডমন্ডের প্রোপ্রাইটারি ব্রেকথ্র টেকনোলজি যাই হোক না কেন, এটা পরিষ্কার, সে মানবসভ্যতার ইতিহাসে নতুন আর সাহসি একটি বিশ্বের দ্বার উন্মোচনের সূচনা করে গেছে।

আজ রাতে উইনস্টন প্রমাণ করেছে সে তার সৃষ্টিকর্তার বিশ্বস্ত এক সেবক, সেইসাথে অ্যাম্ব্রা আর ল্যাংডনের জন্য অমূল্য একটি সম্পদও বটে। অতিথিদের তালিকা দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে উইনস্টন একটা হুমকিকে চিহ্নিত করতে পেরেছে, তারপর এডমন্ডের হত্যাকাণ্ড থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করেছে। খুনি যে গাড়িতে করে পালিয়েছে সেটার পরিচয়ও সেই বের করেছে দ্রুততার সাথে, জাদুঘর থেকে পালাতে ল্যাংডন আর অ্যাম্রাকে দারুণ সাহায্য করেছে। শেষে।

আশা করি এডমন্ডের পাইলটকে আগেভাগেই আমাদের আসার কথা বলে দিয়েছে উইনস্টন, ল্যাংডন বলল।

আমি নিশ্চিত সে এটা করেছে, অ্যাম্ব্রা খুব আশাবাদি এ ব্যাপারে। তবে আপনার কথা ঠিক, ফোন করে উইনস্টনকে আমার বলে দেয়া উচিত ছিল ডাবল-চেক করার জন্য।

দাঁড়ান, অবাক হয়ে বলল ল্যাংডন। আপনি উইনস্টনকে ফোন করতে পারেন? জাদুঘর থেকে যখন পালালাম তখন ভেবেছিলাম আমরা রেঞ্জের বাইরে চলে গেছি, তাই…

হাসতে হাসতে মাথা ঝাঁকালো অ্যাম্ব্রা। রবার্ট, উইনস্টনের অবস্থান কিন্তু গুগেনহাইমের ভেতরে নয়। গোপন কোন জায়গায় একটা কম্পিউটারে তাকে রাখা হয়েছে। রিমোট অ্যাকসেসের মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করা যায়। আপনি কি মনে করেন, উইনস্টনের মতো এমন একটি রিসোর্স নির্মাণ করার পর এডমন্ড চাইবে না দুনিয়ার যেকোন প্রান্ত থেকে তার সাথে যোগাযোগ করতে? এডমন্ড সারাক্ষণ উইনস্টনের সঙ্গে কথা বলতো-বাড়িতে, ভ্রমণে, এমন কি হাটাহাটি করতে গেলেও তারা দুজন যেকোন সময় সিম্পল একটা। ফোন কলের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারতো। এডমন্ডকে আমি দেখেছি। ঘন্টার পর ঘণ্টা উইনস্টনের সাথে চ্যাট করছে। এডমন্ড তাকে ব্যক্তিগত সহকারির মতো ব্যবহার করতো-ডিনার রিজার্ভেশনের জন্য কল করা, তার পাইলটদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, যা যা দরকার তার সবই। সত্যি বলতে, আজকের অনুষ্ঠানের জন্য যখন আমরা দিনরাত খেটে চলেছি তখন আমি প্রায়শই উইনস্টনের সঙ্গে কথা বলতাম ফোনে।

ল্যাংডনের জ্যাকেটের পকেট থেকে এডমন্ডের ফোনটা বের করে চালু করলো অ্যাম্ৰা। জাদুঘরে থাকতেই ফোনটা বন্ধ করে রেখেছিল ল্যাংডন ব্যাটারি সেভ করে রাখার জন্য।

আপনার নিজের ফোনটাও চালু করুন, অ্যাম্ব্রা বলল, তাহলে আমরা দু-জনেই উইনস্টনের অ্যাকসেস পাবো।

আপনি কি ভয় পাচ্ছেন না, আমরা যদি আমাদের ফোনগুলো অন করি। তাহলে আমাদেরকে ট্র্যাক করা হতে পারে?

মাথা ঝাঁকালো অ্যাস্ত্রা। কোর্ট থেকে অনুমতি পাবার মতো সময় কর্তৃপক্ষের হাতে নেই। সুতরাং আমার মনে হয় ঝুঁকিটা আমরা নিতেই পারি-বিশেষ করে উইনস্টন আমাদেরকে গার্ডিয়ার ব্যাপারে আপগ্রেড জানাতে পারে কিনা দেখতে পারি, আর এয়ারপোর্টের ব্যাপারটা তো আছেই।

অস্বস্তির সাথে নিজের ফোনটা চালু করলো ল্যাংডন। আর চালু হতেই তার মনে হলো, মহাশূণ্যে থাকা প্রতিটি স্যাটেলাইট বুঝি তাকে লোকেট করে ফেলল।

তুমি অনেক বেশি স্পাই মুভি দেখে ফেলেছে, নিজেকে বলল সে।

চালু হতে না হতেই ল্যাংডনের ফোনটা বিপ আর ভাইব্রেট করতে শুরু করলো অসংখ্য মেসেজ আসার কারণে। দীর্ঘ সময় এটা বন্ধ ছিল, ফলে তার সাথে যোগাযোগ করে অনেকেই পায়নি। তাকে অবাক করে দিয়ে দুশোরও বেশি টেক্সট মেসেজ আর ইমেইল জমা হলো তার ফোনে।

মেসেজগুলোর সবই তার বন্ধু আর কলিগদের। শুরুর দিকে কিছু মেসেজে তাকে আজকের অনুষ্ঠানের লেকচারের জন্য কংগ্রাচুলেশন্স দেয়া হয়েছে-দারুণ বলেছো! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না তুমি এখন ওখানে? কিন্তু এরপরই আচমকা মেসেজগুলো পরিণত হলো উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। এরমধ্যে তার বইয়ের এডিটর জোনাস ফকম্যানও আছে : হায় ঈশ্বর-রবার্ট তুমি ঠিক আছে তো??!! ল্যাংডন কখনও এই পণ্ডিতকে একসাথে দুবার কোন যতি চিহ্নের ব্যবহার করতে দেখেনি।

একটু আগপর্যন্ত ল্যাংডনের মনে হচ্ছিলো, বিলবাওয়ের নদীপথে সে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যেন জাদুঘরটা কোন ম্রিয়মান হয়ে আসা স্বপ্ন।

সারা দুনিয়া জেনে গেছে, বুঝতে পারলো সে। কিয়ার্শের রহস্যময় আবিষ্কার এবং তার নির্মম হত্যাকা-…সেই সাথে আমার নাম আর চেহারাটা।

উইনস্টন আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল, কিয়ার্শের ফোনের দিকে তাকিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা। গত আধঘণ্টায় এডমন্ডের ফোনে তিপান্নটি মিস কল এসে জমেছে। সবগুলোই একটা নাম্বারের। প্রত্যেক কলই

একদম কাটায় কাটায় ত্রিশ সেকেন্ডের বিরতিতে দেয়া হয়েছে। মুচকি হাসলো। সে। ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় উইনস্টনের অনেক গুণের মধ্যে একটি।

ঠিক তখনই এডমন্ডের ফোনটাতে রিং বাজতে লাগলো।

অ্যাম্ব্রার দিকে তাকিয়ে হাসলো ল্যাংডন। ভাবছি, কে হতে পারে।

ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো অ্যাম্ব্রা। নিন…কথা বলুন।

ল্যাংডন ফোনটা নিয়ে স্পিকার বাটনটা চেপে দিলো। হ্যালো?

প্রফেসর ল্যাংডন, সুপরিচিত সেই বৃটিশ বাচনভঙ্গিতে উফুল্লের সাথে বলে উঠলো উইনস্টন। আমাদের মধ্যে আবার যোগাযোগ হওয়াতে আমি ভীষণ খুশি। অনেকবার চেষ্টা করেছি আপনার সাথে যোগাযোগ করার।

হ্যাঁ, সেটা জানি, জবাব দিলো ল্যাংডন, তিপান্নটি কল দিয়ে না পেয়েও কম্পিউটারের কণ্ঠ শান্ত আর আবেগহীন দেখে মুগ্ধ হলো সে।

কিছু ঘটনা ঘটে গেছে, উইনস্টন জানালো। আপনারা এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর আগেই সেখানকার কর্তৃপক্ষকে আপনাদের ব্যাপারে অ্যালার্ট করে দেবার সম্ভাবনা আছে। আরেকবার বলবো, আপনারা আমার সাজেশন একটু মন দিয়ে শুনবেন।

আমরা এখন তোমার হাতেই, উইনস্টন, বলল প্রফেসর। বলো কী করতে হবে।

প্রথম কথা হলো, আপনি এখনও আপনার ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দেননি, এটা এক্ষুণি করা দরকার।

তাই নাকি? ফোনটা আরো শক্ত করে ধরলো ল্যাংডন। আমাদের ফোনগুলো ট্র্যাক করার আগে তাদেরকে কোর্ট থেকে অর্ডার নিতে হবে না?

সম্ভবত কোন আমেরিকান পুলিশ শো-এ এরকমটা দেখেছেন, কিন্তু আপনারা এখন মোকাবেলা করছেন স্প্যানিশ গার্ডিয়া রিয়েল আর রাজপ্রাসাদকে। তারা তাদের প্রয়োজনে যা যা করা দরকার সবই করতে পারবে।

নিজের ফোনটার দিকে তাকালো ল্যাংডন, এটাকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে না তার। আমার পুরোটা জীবন এর মধ্যে আছে।

এডমন্ডের ফোনের কী হবে তাহলে? অ্যাম্ব্রা জানতে চাইলো উদ্বিগ্ন হয়ে।

ওটা ট্রেস করা যায় না, জবাবে বলল উইনস্টন। হ্যাকিং আর কর্পোরেট এসপিওনাজ নিয়ে এডমন্ড সব সময়ই চিন্তা করতেন। তিনি নিজে একটা IMEIIMSI ভেইলিং প্রোগ্রাম লিখেছিলেন, যার ফলে তার ফোনটা যেকোন জিএসএম ইন্টারসেপ্টরকে ফাঁকি দিতে পারে।

অবশ্যই সে এটা করেছে, ল্যাংডনও সায় দিলো মনে মনে। যে জিনিয়াস উইনস্টনকে সৃষ্টি করেছে তার কাছে অন্য সব ফোনের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাডভান্স ফোন বানানো তো ডালভাত।

নিজের সাদামাটা ফোনটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। ঠিক তখনই অ্যাম্ব্রা আস্তে করে তার হাত থেকে ওটা নিয়ে কোন কথা না বলেই নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। নারভিওন নদীর কালচে পানির নিচে তলিয়ে গেল সেটা। ফোন হারানোর শোকে সামান্য একটু কাতর হলো ল্যাংডন।

রবার্ট, ফিসফিসিয়ে বলল অ্যাম্ব্রা, ডিজনির প্রিন্সেস এলসার সেই কথাটা মনে রাখবেন।

ল্যাংডন তার দিকে তাকালো। কী বললেন, বুঝলাম না?

মৃদু হেসে বলল অ্যাম্ৰা, যেতে দিন।

.

অধ্যায় ৩৬

সুমিশন তোদাভিয়া নো আ তারমিনাদো, আভিলার ফোনে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। তোমার মিশন এখনও শেষ হয়নি।

কথাটা শুনে উবার গাড়িটার পেছনের সিটে সোজা হয়ে বসলো আভিলা।

একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, স্প্যানিশে বলতে লাগলো তার কন্ট্যাক্ট। আমরা চাই তুমি বার্সেলোনায় ফিরে যাও। এক্ষুণি।

বার্সেলোনা? আভিলাকে বলা হয়েছিল কাজশেষে মাদ্রিদে চলে যেতে। ওখানে আরো কিছু কাজ করতে হবে তাকে।

আমরা জানতে পেরেছি, কণ্ঠটা বলতে লাগলো, মি.  কিয়ার্শের দু-জন সহযোগি আজ রাতেই বার্সেলোনায় যাচ্ছে। তারা আশা করছে, মি.  কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশনটা আবার প্রচার করতে পারবে।

আভিলার শরীর আড়ষ্ট হয়ে গেল কথাটা শুনে। এটা কি সম্ভব?

আমরা নিশ্চিত নই। কিন্তু তারা যদি সফল হয়ে যায় তাহলে আমাদের সব কাজ ভেস্তে যাবে। এক্ষুণি বার্সেলোনায় আমার একজন লোক চাই। যতো দ্রুত সম্ভব ওখানে গিয়ে আমাকে কল দাও।

এ কথা বলার পর পরই কানেকশনটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

দুঃসংবাদটিকে অদ্ভুতভাবেই স্বাগত জানালো আভিলা। আমাকে এখনও দরকার। মাদ্রিদ থেকে বার্সেলোনা বেশ দূরে, তবে হাইওয়ে ধরে সর্বোচ্চ গতিতে ছুটে চললে সেখানে যাওয়া যাবে তাড়াতাড়ি। সময় নষ্ট না করে আভিলা তার পিস্তলটা আবারো ঠেকালো ড্রাইভারের মাথার পেছনে। লোকটার স্টিয়ারিং ধরে থাকা হাত কাঁপতে লাগলো।

লিভামে আ বার্সেলোনা, আভিলা হুকুম দিলো তাকে।

ড্রাইভার তার গাড়িটা এ-ওয়ান হাইওয়েতে নিয়ে গেল। রাতের এ সময় পুরো মহাসড়কটিই ফাঁকা। হাতেগোণা কিছু বড়বড় ট্রাক্টর আর ট্রেইলর ছাড়া কিছু নেই। সবগুলো গাড়িই ছুটে যাচ্ছে পাম্পলোনা হয়ে হুয়েস্কা থেকে লেইদাতে, অবশেষে ভূমধ্যসাগরের অন্যতম বৃহৎ বন্দরনগরী বার্সেলোনায়।

আভিলার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে পর পর কিছু ঘটনা কিভাবে তাকে আজকের এই মুহূর্তে নিয়ে এসেছে। গভীরতম হতাশা থেকে, আমি উঠে এসেছি আমার সবচাইতে গৌরবোজ্জ্বল সার্ভিস দেবার মুহূর্তটায়।

কয়ে মুহূর্তের জন্য আভিলা যেন ফিরে গেল এক অতল গহ্বরে, সেভিয়ার বিধ্বস্ত ক্যাথেড্রালের ধোয়ায় আচ্ছন্ন বেদিতে, মৃতমানুষের দঙ্গল থেকে তার স্ত্রী আর সন্তানকে খুঁজছে। যদিও জানতো তারা আর বেঁচে নেই।

ঐ হামলার এক সপ্তাহ পরও আভিলা তার ঘর থেকে বের হয়নি। নিজের কাউচে শুয়ে শুয়ে কাটিয়ে দিয়েছে সে, অসংখ্য দুঃস্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে তাকে। আগুনের দানবগুলো তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে অন্ধকার এক গহ্বরের দিকে, তাকে ঢেকে দিচ্ছে কালচে অন্ধকারে, প্রচণ্ড ক্ষোভ আর দম। বন্ধ করা অপরাধবোধে।

ঐ গহ্বরটা হলো প্রায়শ্চিত্ত…এক ধরণের পারগেটরি, তার পাশে বসে নান বলেছিল মৃদুকণ্ঠে। সে ছিল চার্চ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া শত শত গ্রিফ কাউন্সেলরদের একজন, যারা বেঁচে যাওয়াদের কষ্ট প্রশমন করার কাজে নিয়োজিত ছিল। আপনার আত্মা অশুভ এক কাল্পনিক জগতে আটকা পড়ে গেছে। ক্ষমা করে দেয়াই এ থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র উপায়। এ কাজ যারা করেছে তাদেরকে ক্ষমা করে দেবার একটা পথ খুঁজে নিতে হবে আপনাকে। তা না হলে আপনার রাগ-ক্ষোভ আপনাকে পুরোপুরি গিলে ফেলবে। কথাটা বলার পর বুকে ক্রুশ এঁকেছিল নান। ক্ষমাই আপনার একমাত্র মোক্ষ লাভের। উপায়।

ক্ষমা? কথা বলার চেষ্টা করেছিল আভিলা, কিন্তু ভেতরে থাকা দানবটা তার গলা চেপে ধরে। ঐ মুহূর্তে প্রতিশোধই একমাত্র মোক্ষ লাভের উপায় বলে মনে হয়েছে তার কাছে। কিন্তু কার উপরে প্রতিশোধ নেবে? চার্চে বোমা। বিস্ফোরণের দায়দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি কখনও।

আমি জানি, ধর্মের নামে সন্ত্রাস করা ক্ষমার অযোগ্য, নান বলেছিল। তারপরও একটা কথা মনে রাখলে হয়তো স্বস্তি পাবেন, আমাদের নিজেদের ধর্ম ঈশ্বরের নামে শত বছর ধরে ইনকুইজিশন করে গেছে। আমরা আমাদের ধর্মের নামে অসংখ্য নিদোষ মানুষকে হত্যা করেছি। এজন্যে আমরা সারা পৃথিবীর কাছে, আমাদের নিজেদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। দীর্ঘ সময়ের পর আমরা আমাদের এই ক্ষত থেকে সেরেও উঠতে পেরেছি।

এরপর নান বাইবেল থেকে পড়ে শোনায় তাকে : মন্দ লোকের সাথে লড়তে যেয়ো না। কেউ তোমার গালে একটা চড় দিলে তুমি তার দিকে আরেকটা গাল বাড়িয়ে দাও। নিজের শত্রুকে ভালোবাসো, যে তোমাকে ঘৃণা করে তার প্রতি সদয় হও। যে তোমাকে অভিশাপ দেয় তাকে তুমি আশির্বাদ করো। তোমার সাথে যারা দুর্ব্যবহার করে তাদের জন্য প্রার্থনা করো।

সেই রাতে নিঃসঙ্গ আর যন্ত্রণাকাতর আভিলা আয়নার দিকে চেয়ে ছিল। আয়নার মানুষটাকে দেখে চিনতে পারেনি সে। নানের বলা কথাগুলো তার সুতীব্র কষ্ট আর যন্ত্রণাকে মোটেও লাঘব করতে পারেনি।

ক্ষমা? আমি আমার আরেক গাল বাড়িয়ে দেবো!

আমি এমন এক শয়তানের কাজ দেখেছি যাকে কোনভাবেই ক্ষমা করা যায় না!

তীব্র রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে আভিলা বাথরুমের আয়নায় ঘুষি চালায়। ভেঙে খান খান করে দেয় সেটাকে। নিজেও ভেঙে পড়ে কান্নায়।

একজন উচ্চপদস্থ নাভাল অফিসার হিসেবে আভিলা সব সময়ই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো-শৃঙ্খলাবোধের একজন পরাকাষ্ঠা ছিল, সম্মান-শ্রদ্ধা আর চেইন অব কমান্ড-কিন্তু সেই মানুষটি এখন আর নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে আভিলা এক কুয়াশার মধ্যে পড়ে যায়। ডাক্তারের দেয়া ওষুধ আর অ্যালকোহল পান করে নিজেকে অবশ করে রাখতো। খুব দ্রুতই কেমিক্যালের অবশ-অসাড় অনুভূতি পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো সে। যখনই জেগে উঠতো সে-সব নিতো আবার। নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলল একাকিত্বের খাঁচায়।

কয়েক মাস পরই স্প্যানিশ নেভি তাকে বাধ্য করে অবসরে যেতে। এক সময়ের শক্তিশালি যুদ্ধজাহাজ এখন বিকল আর পরিত্যাক্ত। আভিলাও জানতো সে আর সমুদ্রে যেতে পারবে না। যে নেভির হয়ে সে সারাটা জীবন কাজ করে। গেছে তারা তাকে সামান্য স্টাইপেন্ড দিলো, যা দিয়ে তার পক্ষে জীবন ধারণ করাই কষ্টকর।

আমার বয়স আটান্ন বছর, বুঝতে পেরেছিল সে। আর আমার কাছে কিছুই নেই।

নিজের লিভিং রুমে বসে বসে টিভি দেখে, ভদকা খেয়ে দিন পার করেছে সে, আর অপেক্ষা করে গেছে আশার কোন আলো জ্বলে ওঠে কিনা। লা ওরা মাস অসকুরা এস জুস্তো আস্তেস দেল আমানেসের, বিড়বিড় করে বলতো সে বার বার। কিন্তু বহুল পুরনো নেভির এই মন্ত্র কোন কাজেই লাগেনি। রাতের অন্ধকার নিছকই ভোরের আগের অবস্থা নয়, বুঝতে পেরেছিল সে। ভোরের উদয় কখনও হবে না।

তার উনষাটতম জন্মদিনে সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, ভদকার খালি বোতলের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থেকে আভিলার মনে সাহস সঞ্চয় হলো, উঠে গিয়ে তার নেভির পিস্তলটা ক্লজিট থেকে বের করে ব্যারেলটা মাথায় ঠেকালো সে।

মাফ করে দিও আমাকে, বিড়বিড় করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। টিপে দিলো ট্রিগার। শব্দটা যেমন হবার কথা তেমন হলো না। নিছক একটা ক্লিক করে শব্দ হলো কেবল।

পিস্তলটা ফায়ার করতেও ব্যর্থ হলো। কয়েক বছর ক্লজিটের ধুলোর মধ্যে অযত্নে পড়ে থাকা আভিলার সেরেমোনিয়াল পিস্তলটা অকেজো হয়ে পড়েছিল। মনে হলো, এরকম কাপুরুষোচিত কাজও তার পক্ষে করা সম্ভব নয় এখন।

রাগেক্ষোভে পিস্তলটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারলো সে। এবার একটা বিস্ফোরণ হলে ঘরটা কেঁপে উঠলো। হাটুর নিচে তীব্র যন্ত্রণা টের পেলো আভিলা। যন্ত্রণার চোটে তার মাতাল ভাবটা কেটে গেল মুহূর্তে। মেঝেতে পড়ে গিয়ে রক্তাক্ত পা ধরে চিৎকার করতে শুরু করলো সে।

ভয় পেয়ে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসে তার দরজায়, একটু পর সাইরেন বাজার শব্দ পায় সে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সেভিয়ার প্রোভিন্সিয়াল দে সান লাজারো হাসপাতালে আবিষ্কার করে। সেখানে বলতে। বাধ্য হয় কিভাবে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে, আর গুলিটা লেগেছে তার পায়ে।

পরদিন সকালে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অ্যাডমিরাল আভিলা যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিল তখন তার কাছে একজন ভিজিটর আসে।

শুটার হিসেবে তো আপনি যাচ্ছেতাই, এক তরুণ বলেছিল স্প্যানিশে। তারা যে আপনাকে জোর করে অবসরে পাঠিয়েছে তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

আভিলা লোকটাকে কিছু বলার আগেই সে উঠে গিয়ে জানালা খুলে দিতেই ঘরে ঢুকে পড়ে সূর্যের আলো। চোখ কুঁচকে ফেলে সে। এবার ভালো করে দেখে তরুণকে। পেশিবহুল শরীর, মাথার চুল ক্রপ করা। জিশুর ছবিসম্বলিত একটি টি-শার্ট পরা।

আমার নাম মাকো, তার বাচনভঙ্গিতে আন্দালুজের টান সুস্পষ্ট। আপনাকে আমি রিহ্যাব করার জন্য ট্রেইনিং দেবো। আমি আপনাকে আমার জন্য অ্যাসাইন করতে বলেছি কেন জানেন, আপনার আর আমার মধ্যে একটা মিল রয়েছে।

মিলিটারি? তার বাহ্যিক দিকটা খেয়াল করে বলেছিল আভিলা।

না। ছেলেটা আভিলার দিকে সরাসরি তাকালো এবার। ঐদিন, শনিবারের সকালে আমিও ছিলাম সেখানে। ক্যাথেড্রালের কথা বলছি। সন্ত্রাসি হামলা।

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো আভিলা। আপনিও সেখানে ছিলেন?

ছেলেটা তার প্যান্টের এক পা তুলে দেখালো সেখানে একটা কৃত্রিম পা। আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি আপনি নরকের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। আর আমি সেমিপ্রফেশনাল ফুটবল খেলে যাচ্ছি, সুতরাং আমার কাছ থেকে কোন রব ম সহমর্মিতা আশা করবেন না। আমি অনেকটা ঈশ্বর-তাদেরকে-সাহায্য করে-যা বা-নিজেদেরকে-সাহায্য-করে টাইপের মানুষ।

কী ঘটতে যাচ্ছে বোঝার আগেই আভিলাকে একটা হুইলচেয়ারে তুলে নিয়ে বসায় মাকো। হলওয়ে দিয়ে তাকে ঠেলে নিয়ে যায় ছোট্ট একটা জিমনেশিয়ামে, একটা প্যারালাল বারের উপর তুলে দেয় তাকে।

একটু ব্যথা পাবেন, ছেলেটা বলেছিল, কিন্তু চেষ্টা করুন অন্যপ্রান্তে যাবার জন্য। একবার করে দেখান। তাহলেই আপনি নাস্তা করতে পারবেন।

যন্ত্রণাটা ছিল খুবই তীব্র কিন্তু একপায়ের কোন লোকের কাছে সেটা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করেনি আভিলার। তাই দু-পাশের বার ধরে হাতের উপর সমস্ত ভর দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেছিল সে।

দারুণ, মাকে বলেছিল। আবার করুন ওটা।

কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন একবার—

হ্যাঁ, তা বলেছিলাম, তবে সেটা মিথ্যে ছিল। আবার করুন।

অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো আভিলা। অ্যাডমিরাল হিসেবে দীর্ঘকাল সে কোন রকম অর্ডার শোনেনি। ব্যাপারটা তার কাছে বেশ নতুন লাগলো। মনে হলো সে বুঝি কোন তরুণ-নেভিতে রিক্রুট হবার পর তার যে অনুভূতি হয়েছিল ঠিক সেরকম। আভিলা ঘুরে আবারো এ প্রান্তে ফিরে আসে। আস্তে আস্তে।

আমাকে এখন বলেন, মাকো বলেছিল। আপনি কি এখনও সেভিয়ার ক্যাথেড্রালের মাস-এ যান?

কক্ষনো না।

ভয় পান?

মাথা ঝাঁকালো আভিলা। ভয় না, রাগ।

হেসে ফেলল মাকো। হ্যাঁ, আমাকে অনুমান করতে দিন। নানেরা আপনাকে বলেছিল ঐ হামলাকারিদের ক্ষমা করে দিতে, তাই না?

ঠিক!

আমাকেও একই কথা বলেছিল তারা। চেষ্টাও করেছিলাম, কিন্তু অসম্ভব। নানেরা আমাদেরকে ফালতু উপদেশ দিয়েছে। কথাটা বলেই হেসে ফেলে সে।

আভিলা তরুণের টি-শার্টের উপরে জিশুর ছবিটার দিকে তাকায়। কিন্তু দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি এখনও…

ওহ, হ্যাঁ। আমি এখনও একজন খৃস্টান। আগের চেয়েও বেশি ধার্মিক বলতে পারেন। তবে আমি সৌভাগ্যবান যে, আমি আমার মিশন খুঁজে পেয়েছি-ঈশ্বরের শত্রুদের হাতে যাদের ক্ষতি হয় তাদেরকে সাহায্য করা।

খুবই ভালো কথা, একটু ঈর্ষার সাথেই বলেছিল আভিলা। তার কাছে মনে হচ্ছিলো, তার পরিবার আর নেভি ছাড়া তার জীবনটাই বৃথা…উদ্দেশ্যহীন।

একজন মহান মানুষের সাহায্য আমাকে আবার ঈশ্বরের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, মাকে বলতে থাকে। ঐ লোকটা আর কেউ নন…স্বয়ং পোপ। তার সাথে আমি বেশ কয়েকবার দেখা করেছি।

কী বললেন…পোপ?

হ্যাঁ। ক্যা

থলিক চার্চের প্রধান?

হ্যাঁ। আপনি চাইলে আপনার সাথেও তার সাক্ষাৎকার করিয়ে দিতে পারবো আমি।

ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলো আভিলা, তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আপনি আমাকে পোপের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?

মার্কোকে দেখে মনে হলো একটু কষ্ট পেয়েছে সে। আমি বুঝতে পারছি, আপনি একজন উচ্চপদস্থ নেভি অফিসার ছিলেন, আপনি বিশ্বাস করতে পারছেন না সেভিয়ার এক পঙ্গু ফিজিক্যাল ট্রেইনার ভিকার অব ক্রাইস্টের সাথে দেখা করতে পারে যখন তখন। কিন্তু আমি আপনাকে সত্যি কথাই বলেছি। আপনি চাইলে উনার সাথে আপনার দেখা করিয়ে দিতে পারবো আমি। উনি আপনাকে আবারো সঠিক পথে নিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারবেন। ঠিক যেভাবে উনি আমাকে সাহায্য করেছেন।

প্যারালাল বারের উপর ঝুঁকে এসেছিল আভিলা। বুঝতে পারছিল না কী বলবে। এর আগের পোপকে সে খুবই ভক্তি করতো-পুরোপুরি নিখাদ রক্ষণশীল একজন মানুষ, যিনি কঠোরভাবে ঐতিহ্যপ্রিয় ছিলেন। একেবারেই অর্থোডক্সিক্যাল একজন মানুষ। কিন্তু দুভার্গের ব্যাপার হলো আধুনিক দুনিয়ার প্রায় সবখান থেকেই তার বিরুদ্ধে সামালোচনা করা শুরু হয়। শোনা যাচ্ছিলো খুব জলদিই তিনি উদারপন্থিদের চাপে পড়ে অবসরে চলে যাবেন। তার সঙ্গে দেখা করতে পারলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো কিন্তু

বেশ, মাকো তার কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠেছিল। আমি তাহলে আগামিকালই সেটার ব্যবস্থা করে ফেলি।

আভিলা কখনও কল্পনাও করেনি পরদিনই সে নিরাপদ একটা স্যাঙ্কচুয়ারিতে পোপের মুখোমুখি বসে তার জীবনের সবচাইতে শক্তিশালি ধর্মিয় শিক্ষাটা লাভ করবে।

মোক্ষ লাভের অসংখ্য পথ রয়েছে।

ক্ষমা করাই একমাত্র পথ নয়।

.

অধ্যায় ৩৭

মাদ্রিদের রাজপ্রাসাদের গ্রাউন্ডফ্লোরে অবস্থিত রয়্যাল লাইব্রেরিটার কক্ষ চোখ ধাঁধানো অলঙ্কারে সজ্জিত। হাজার হাজার অমূল্য সব বই-পুস্তক রয়েছে সেখানে। এর মধ্যে রাণী ইসাবেলার পাণ্ডিত্যপূর্ণ বুক অব আওয়ার্স, বেশ ক জন রাজার ব্যবহৃত বাইবেল, আর একাদশ আলফানসোর আমলের লোহার বাইন্ডিং করা কোডেক্সও রয়েছে।

তড়িঘরি করে গারজা ঢুকে পড়লো লাইব্রেরিতে, যুবরাজকে ভালদেসপিনোর হাতে খুব বেশি সময় একা ছেড়ে দেবার ইচ্ছে তার নেই। কয়েক দিন আগে যে ভালদেসপিনো গোপনে এডমন্ড কিয়ার্শের সাথে মিটিং করেছিলেন আর সেই মিটিংয়ের কথা কাউকে জানাননি, সেই খবরটা হজম করতে এখনও বেগ পাচ্ছে সে। এমনকি কিয়ার্শের প্রেজেন্টেশন এবং তার হত্যাকা-ের ঘটনার পরও নয়?

অন্ধকারাচ্ছন্ন লাইব্রেরির যেখানটায় পিআর কো-অর্ডিনেটর মনিকা মার্টিন দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এগিয়ে গেল সে। মেয়েটার হাতে এখনও ট্যাবলেটটা ধরা। সেটার আলোকিত স্ক্রিন ঘরে একটু আলো দান করেছে।

আমি বুঝতে পারছি, আপনি খুবই ব্যস্ত আছেন, স্যার, মার্টিন বলল, কিন্তু আমারা এখন খুবই নাজুক অবস্থার মধ্যে আছি। আমি উপরে গেছিলাম আপনাকে খুঁজে বের করতে কারণ আমাদের সিকিউরিটি সেন্টার কন্সপিরেসিনেট নেট থেকে একটি উদ্বেগজনক ইমেইল পেয়েছে।

কাদের কাছ থেকে বললে?

কন্সপিরেসি থিওরির খুবই জনপ্রিয় একটি সাইটের নাম কন্সপিরেসিনেট। খুবই সস্তা টাইপের সাংবাদিকতা করে থাকে তারা। একেবারেই শিশুসুলভ বলতে পারেন। কিন্তু তাদের রয়েছে কয়েক মিলিয়ন ফলোওয়ার। তারা মিথ্যে খবর ছড়াতে পটু। তবে কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের কাছে সাইটটা খুবই আস্থাভাজন।

আস্থাভজন আর কন্সপিরেসি থিওরি পদবাচ্য দুটো একসাথে শুনতে পেরে অবাকই হলো গারজা।

তারা কিয়ার্শের ঘটনাটা নিয়ে সারারাত ধরে স্কুপ-নিউজ দিয়ে যাচ্ছে, মার্টিন বলতে লাগলো। আমি জানি না তারা কোত্থেকে এসব তথ্য পায় কিন্তু সাইটটা এখন ব্লগার আর কন্সপিরেসি থিওরিস্টদের একটি আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এমনকি অনেক টিভি চ্যানেলও তাদের কাছ থেকে খবর নিয়ে ব্রেকিং নিউজ দিয়ে থাকে।

আসল কথা বলো, গারজা তাড়া দিলো।

কন্সপিরেসিনেট-এর কাছে নতুন যে খবরটি আছে সেটা আমাদের প্রাসাদ সম্পর্কিত, চশমাটা কপালের উপরে তুলে দিলো মার্টিন। দশ মিনিটের মধ্যে তারা এটা তাদের সাইটে ছেড়ে দেবে। তারা চাইছে এর আগেই এ বিষয়ে যদি আমাদের কিছু বলার থাকে তবে সেটাও প্রচার করবে।

অবিশ্বাসে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো গারজা। এইসব মুখরোচক গসিপের ব্যাপারে রাজপ্রাসাদ কোন মন্তব্য করে না!

একবার একটু দেখুন, স্যার। ট্যাবলেটটা বাড়িয়ে দিলো মার্টিন।

গারজা ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে দেখতে পেলো নেভির অ্যাডমিরাল লুই আভিলার দ্বিতীয় ছবিটা। দেখে মনে হচ্ছে ঘটনাচক্রে এটা তোলা হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে আভিলা সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে একটা পেইন্টিংয়ের সামনে। মনে হয়, জাদুঘরের কোন দর্শনার্থি কোন একটা পেইন্টিংয়ের ছবি তুলতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবেই এটা তুলে ফেলেছে।

আমি জানি আভিলা দেখতে কেমন, একটু চটে গিয়েই বলল গারজা, যুবরাজ আর ভালদেসপিনোর ওখানে ফিরে যাবার জন্য উদগ্রিব সে। এটা আমাকে কেন দেখাচ্ছো তুমি?

পরের ছবিটাতে যান।

গারজা তাই করলো। পরের ছবিতে একটা ছবিকে বড় করে দেখানো হয়েছে-এটাতে অ্যাডমিরালের ডানহাতের তালুর উল্টোপিঠটা দেখা যাচ্ছে। সেখানে যে ট্যাটুটা আছে সেটা দেখামাত্রই চিনে ফেলল গারজা।

ট্যাটু

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ইমেজটার দিকে চেয়ে রইলো সে। এই সিম্বলটা অন্য অনেক স্পেনিয়ার্ডদের মতো তারও ভালো করেই চেনা আছে। বিশেষ করে বয়স্করা এটা বেশি চিনতে পারে।

ফ্রাঙ্কোর সিম্বল।

বিংশ শতাব্দিতে স্পেনের অনেক জায়গায় এটা দেখা যেত। এই সিম্বলটা অতিকট্টর রক্ষণশীল স্বৈরাচারি শাসক জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর সমার্থক। যার দুঃশাসন জাতীয়তাবাদ, কর্তৃত্ববাদি শাসন, মিলিটারিজম আর উদারতাবাদবিরোধি মতবাদসহ ন্যাশনাল ক্যাথলিজমকেও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল।

গারজা জানে, এই প্রাচীন সিম্বলটিতে রয়েছে ছয়টি অক্ষর, ওগুলো একসাথে করলে একটি লাতিন শব্দে রুপ নেয়-যে শব্দটি ফ্রাঙ্কোর নিজের ইমেজটাকে নিখুঁতভাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকে।

ভিক্টর।

নির্মম, সহিংস আর আপোষহীন ফ্রাঙ্কো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল জার্মানির নাৎসি মিলিটারি আর ইতালির মুসোলিনির সহায়তায়। ১৯৩৯ সালে দেশের ক্ষমতা পুরোপুরি কুক্ষিগত করার আগে সে হাজার হাজার বিরোধি পক্ষকে হত্যা করে। ক্ষমতা নিয়েই নিজেকে এল কদিয়ো-উপাধিতে ভূষিত করে সে। এটা জার্মান শব্দ ফুয়েরার স্প্যানিশ সমার্থক শব্দ। স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময়, ফ্রাঙ্কোর ক্ষমতা গ্রহনের প্রথম বছরে যারাই তার বিরুদ্ধাচারণ। করেছে তারা হয় গুম হয়ে গেছে নয়তো জায়গা করে নিয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে। ওখানে তিনলাখেরও বেশি মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

ক্যাথলিক স্পেনের রক্ষক আর নাস্তিক কমিউনিজমের শত্রু হিসেবে নিজেকে দাবি করলেও মেয়েদের ব্যাপারে তার মনোভাব ছিল খুবই সঙ্কিৰ্ণ আর রক্ষণশীল। তার সময়ে সরকারের বিভিন্ন পদ থেকে প্রচুর সংখ্যক নারীকে সরিয়ে দেয়া হয়। উচ্চশিক্ষায় তাদের শিক্ষকতা করার সুযোগ, বিচারক হিসেবে তাদের নিয়োগ, ব্যাঙ্কের গুরুত্বপূর্ণ পদের চাকরিতে প্রায় অলিখিভাবে নিষিদ্ধ হয়ে যায় নারীরা। এমনকি অত্যাচারি স্বামীর হাত থেকে মুক্তি পাবার অধিকারও কেড়ে নেয়া হয় ঐ সময়। এসবের পাশাপাশি ডিভোর্স, জন্মনিয়ন্ত্রণ, গর্ভপাত এবং সমকামিতাও নিষিদ্ধ করা হয় তার আমলে।

ভাগ্য ভালো যে, এখন তার সবই বদলে গেছে।

তারপরও গারজা অবাক হলো, কতো দ্রুতই না তার দেশ অন্ধকার অতীতের কথা ভুলে বসে আছে।

ফ্রাঙ্কোর শাসনামলের সবকিছু ভুলে যাবার জন্য একমত পোষণ করে স্পেনে প্যাক্তো দে অলভিদো নামের একটি রাজনৈতিক চুক্তি করা হয়। এর মানে, স্পেনের স্কুলের ছেলেমেয়েরা এই স্বৈরাচার সম্পর্কে খুব কম কথাই জানতে পারে। স্পেনে এক জরিপে দেখা গেছে, এখানকার টিনেজাররা স্বৈরাচারি শাসক ফ্রাঙ্কোর চেয়ে অভিনেতা হামেস ফ্রাঙ্কোকে বেশি চেনে।

যদিও বয়স্ক প্রজন্ম কখনও এসব কথা ভুলে যায়নি। এই ভিক্টর সিম্বলটি নাৎসিদের সোয়াস্তিকার মতোই সেই সময়কার লোকজনের কাছে ভীতিকর একটি সিম্বল হিসেবে পরিচিত। এখনও যেসব বয়স্ক লোকজন বেঁচে আছে তারা এটা দেখলে রীতিমতো আৎকে ওঠে ফ্রাঙ্কোর জঘন্য অত্যাচারি শাসনের কথা মনে করে। আজকাল অনেকেই উদ্বেগের সাথে সতর্ক করে দেয় যে, স্প্যানিশ সরকার এবং ক্যাথলিক চার্চের উচ্চপদে এখনও অনেক ফ্রাঙ্কো সমর্থক রয়েছে। তাদের গোপন এজেন্ডা হলো, স্পেনকে আবারও উগ্র-ডানপন্থি দেশ হিসেবে বিগত শতকে ফিরিয়ে নেয়া।

গারজাকে এটা স্বীকার করতেই হলো, বয়স্কদের মধ্যেও অনেকে মনে করে। বর্তমান স্পেনের যে অবস্থা চলছে তাতে করে দেশটি কেবলমাত্র রক্ষা পেতে পারে একটি শক্তিশালি রাষ্ট্রধর্মের অধীনে অপেক্ষাকৃত কর্তৃত্ববাদি সরকারের। অধীনে থাকলে।

তোমাদের সন্তানদের দিকে তাকাও, চিৎকার করে বলতে চায় তারা। ওরা সবাই লক্ষ্যহীনভাবে ছুটে চলেছে।

কয়েক মাসের মধ্যেই স্পেনের সিংহাসনে বসবে নতুন রাজা যুবরাজ হুলিয়ান। রক্ষণশীলদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, খোদ রাজপ্রাসাদ হয়তো। এবার খুব দ্রুতই প্রগতিশীলদের সাথে কণ্ঠ মেলাতে শুরু করে দেবে। দেশের অনেক কিছুই বদলে যাবে তখন। তাদের এই আশঙ্কার আগুনে ঘি ঢেলেছে কিছুদিন আগে অ্যাম্ৰা ভিদালের সাথে হুলিয়ানের এনগেজমেন্টটা-মেয়েটা কেবল বাস্কই নয়, বরং প্রকাশ্যে বলে বেড়ায় সে একজন অজ্ঞেয়বাদি। স্পেনের রাণী হিসেবে সে তার স্বামীকে চার্চ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাবান্বিত করতে পারবে।

বিপজ্জনক দিন ঘনিয়ে আসছে, গারজা জানে।

ধর্মিয় সমস্যা ছাড়াও স্পেনকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে রাজনৈতিক কিছু সঙ্কটেরও। দেশটা কি তার রাজতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে পারবে? নাকি অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরিসহ আরো অনেক ইউরোপিয় দেশের মতোই চিরতরের জন্য রাজতন্ত্র বিলোপ করে দেয়া হবে? সময়ই কেবল বলে দিতে পারবে। পথেঘাটে বয়স্ক ঐতিহ্যবাদিরা স্পেনের পতাকা নাড়িয়ে থাকে, অথচ প্রগতিশীল তরুণেরা গর্বের সাথে রাজতন্ত্রবিরোধি বেগুনি, হলুদ আর লাল রঙের টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়ায়-এই রঙগুলো ছিল পুরনো রিপাবলিকানের ব্যানারের রঙ।

হুলিয়ান উত্তরাধিকারসূত্রে একটি অস্থির সময়কে পাবে।

আমি যখন ফ্রাঙ্কোর ট্যাটুটা প্রথম দেখি, গারজার মনোযোগ আবার ট্যাবলেটটার দিকে ফেরানোর জন্য মার্টিন বলল, ভেবেছিলাম ওটা ডিজিটালি বসানো হয়েছে একটা নাটক সাজানোর জন্য। কন্সপিরেসি সাইটগুলো ফ্রাঙ্কো কানেকশন খুঁজে বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা জানে এরকম একটি কানেকশান বের করতে পারলে কতোটা সাড়া পাওয়া যাবে, বিশেষ করে আজ রাতে কিয়ার্শের খৃস্টবিরোধি প্রেজেন্টেশনটার পর।

গারজা জানে মেয়েটা ঠিক বলেছে। এটা নিয়ে কন্সপিরেসি থিওরিস্টরা পাগল হয়ে যাবে।

ট্যাবলেটের দিকে তাকাতে তাকাতে বলল মার্টিন। তারা একটু পর যে সংবাদটি আপলোড দেবে সেটা একটু পড়ে দেখুন।

কন্সপিরেসিনেট কম

এডমন্ড কিয়ার্শের আপডেট

এডমন্ড কিয়ারে হত্যাকাণ্ডটি কোন সংক্ষুব্ধ ধর্মিয় গোষ্ঠি করেছে বলে শুরুতে সন্দেহ করা হলেও অতিকট্টর রক্ষণশীল ফ্রাঙ্কোইস্ট সিম্বলটা উদঘাটিত হবার পর মনে হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক মোটিভেশনও থাকতে পারে। সন্দেহ করা হচ্ছে, স্প্যানিশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে, এমন কি খোদ রাজপ্রাসাদও বর্তমান রাজার অবধারিত মৃত্যুর পর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যুদ্ধে ব্যস্ত আছে…।

অপমানজনক, রেগেমেগে বলল গারজা। যথেষ্ট পড়েছে, আর না। ঐ একটামাত্র ট্যাটু থেকে এতকিছু অনুমাণ করে ফেলেছে? কোন মানেই হয় না। ঘটনাস্থলে অ্যাম্ব্রা ভিদালের উপস্থিতিই বলে দেয়, এই ঘটনার পেছনে আর যে ই থাকুক রাজপ্রাসাদ জড়িত নেই। এসব ফালতু গুজবের ব্যাপারে কোন মন্তব্য করা হবে না।

স্যার, মার্টিন আরেকটু তাড়া দিলো। আপনি যদি পুরোটা পড়েন তাহলে জানতে পারবেন, তারা অ্যাডমিরাল আভিলার সাথে বিশপ ভালদেসপিনোর একটি লিঙ্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। তারা বলছে, বিশপ সম্ভবত গোপনে একজন ফ্রাঙ্কোইস্ট, বছরের পর বছর ধরে তিনি যুবরাজের কানে এমন সব কথা তুলে দিচ্ছেন যার ফলে তাকে দিয়ে দেশের দ্রুত আমূল পরিবর্তন আনা যায়। মেয়েটা থামলো একটু। এ ধরণের অভিযোগ অনেক মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেবে।

আরো একবার কোন কথা খুঁজে পেলো না গারজা। যে দুনিয়াতে সে বাস করে সেটা আর তার কাছে পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না।

ভুয়া সংবাদের ওজন এখন সত্যিকারের সংবাদের ওজনের মতোই সমান।

মার্টিনের দিকে তাকালো গারজা, শান্তভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করলো সে। মনিকা, এগুলো সব ফ্যান্টাসিস্টদের লেখা বানোয়াট কল্পকাহিনী। তারা। এসব লিখে মজা পায়। আমি তোমাকে আশ্বস্ত করে বলতে পারি, ভালদেসপিনো মোটেও কোন ফ্রাঙ্কোইস্ট নন। কয়েক দশক ধরে তিনি রাজার সেবা করে গেছেন, ফ্রাঙ্কোইস্ট খুনির সাথে তার জড়িত হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। রাজপ্রাসাদ এরকম নিউজের ব্যাপারে কোন কমেন্ট করবে না। বুঝতে। পেরেছো আমার কথা? কথাটা বলেই দরজার কাছে চলে গেল গারজা। যুবরাজ আর ভালদেসপিনোর ওখানে যাবার জন্য মুখিয়ে আছে সে।

স্যার, একটু দাঁড়ান! মার্টিন কাছে এসে তার হাতটা ধরে ফেলল। থমকে দাঁড়ালো গারজা, অল্পবয়েসি মেয়েটার এমন কাণ্ডে অবাক সে।

সঙ্গে সঙ্গে মার্টিন তার হাতটা সরিয়ে নিলো। সরি, স্যার। কিন্তু কন্সপিরেসিনেট আমাদের কাছে একটু আগে বুদাপেস্টে করা একটি ফোনালাপের রেকর্ডিংও পাঠিয়েছে। মোটা কাঁচের চশমার পেছনে মেয়েটার চোখ পিটপিট করছে। এটাও আপনার পছন্দ, হবে না।

.

অধ্যায় ৩৮

আমার বস্ নিহত হয়েছেন।

বিলবাও এয়ারপোর্টের মেইন রানওয়েতে এডমন্ড কিয়ার্শের গালফস্ট্রিম জি৫৫০ প্রাইভেট বিমানটি নিয়ে যাবার সময় ক্যাপ্টেন জস স্টিগেল মনে মনে বলল। টের পেলো তার হাতদুটো কাঁপছে।

ফ্লাই করার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই, ভাবলো সে। ভালো করেই জানে তার কো-পাইলটের অবস্থাও তারই মতো।

এডমন্ডের হয়ে দীর্ঘদিন পাইলটের কাজ করে যাচ্ছে সিগেল, সেজন্যে তার বসের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডটি তাকে হতবিহ্বল করে তুলেছে। একঘণ্টা আগে সে এবং তার কো-পাইলট এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে টিভিতে গুগেনহাইম জাদুঘর থেকে সরাসরি প্রচারিত অনুষ্ঠানটি দেখছিল।

টিপিক্যাল এডমন্ড ড্রামা, জোক করে বলেছিল সিগেল, তার বসের বিশাল সংখ্যক দর্শক টানার ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়েছিল সে। কিয়ার্শের এই অনুষ্ঠানটি দেখার সময় সে লক্ষ্য করে এয়ারপোর্ট লাউঞ্জেও উপচে পড়া দর্শক আগ্রহ নিয়ে অনুষ্ঠানটি দেখছে যতোক্ষণ পর্যন্ত না ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটে যায়।

ঘটনার পর সিগেল আর তার কো-পাইলট থম মেরে বসেছিল, টিভি কাভারেজ দেখতে দেখতে ভাবছিল তাদের এখন কী করা উচিত।

এর দশ মিনিট পরই সিগেলের ফোনটা বেজে ওঠে; কলার আর কেউ নয়, এডমন্ডের ব্যক্তিগত সহকারি উইনস্টন। তার সঙ্গে সিগেলের কখনও দেখা হয়নি, তারপরও এই বৃটিশটাকে কেমনজানি অদ্ভুত লাগে তার কাছে। তার সঙ্গে ফ্লাইট নিয়ে প্রায়শই কো-অর্ডিনেট করতে হয় সিগেলকে, এ কাজে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

আপনি যদি টিভি না দেখে থাকেন, বলেছিল উইনস্টন, তাহলে টিভি ছেড়ে দেখে নিন।

আমি ওটা দেখেছি, সিগেল জবাব দিয়েছিল। আমরা দু-জন খুবই ভেঙে পড়েছি ওটা দেখে।

প্লেনটা বার্সেলোনায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে আপনাকে, উইনস্টন বলে। যে ঘটনা ঘটে গেছে সেটা বিবেচনায় নিলে তার কণ্ঠ অদ্ভুত রকমেরই নির্বিকার। যেন খুব জরুরি কাজের কথা বলছে। টেকঅফ করার জন্য প্রস্তুত হোন। কিছুক্ষণ পর আমি আবার কল দেবো। আমাদের মধ্যে কথা না হবার

আগপর্যন্ত টেকঅফ করবেন না দয়া করে।

সিগেলের কোন ধারণাই নেই উইনস্টনের এমন ইন্সট্রাকশন এডমন্ডের ইচ্ছেতে হচ্ছে কিনা। তবে এ মুহূর্তে যেকোন ধরণের গাইডেন্স পাওয়াতেই সে খুশি।

উইনস্টনের কথামতো সিগেল আর তার কো-পাইলট প্লেনটা কোনো যাত্রি বহন না করে ফ্লাই করার জন্য প্রস্তুত করে নেয়। ওরা এটাকে বলে ডেডহেড ফ্লাইট। তাদের জগতে এটা প্রায়ই ঘটে। কিন্তু তাপরই, এখন থেকে ত্রিশ মিনিট আগে উইনস্টন আবারো তাকে কল করে।

আপনি কি টেকঅফ করার জন্য প্রস্তুত?

হ্যাঁ। আমরা প্রস্তুত।

বেশ। আমি ধরে নিচ্ছি আপনি যথারীতি পূর্বমুখি রানওয়েটা ব্যবহার করছেন?

ঠিক। উইনস্টন যে খুবই ভালোমতো তথ্য পেয়ে যায় সেটা বুঝতে পারলো সিগেল।

টাওয়ারের সাথে কন্ট্যাক্ট করে টেকঅফের জন্য অনুরোধ করুন, প্লিজ। প্লেনটা এয়ারফিল্ডের শেষ মাথায় নিয়ে রাখুন, কিন্তু রানওয়েতে তুলবেন না ওটা।

আমি অ্যাকসেস রোডের উপরে প্লেনটা থামিয়ে রাখবো?

হ্যাঁ, কয়েক মিনিটের জন্য। ওখানে যাবার সাথে সাথে আমাকে জানাবেন।

অবাক হয়ে সিগেল আর তার কো-পাইলট একে অন্যের দিকে তাকায়। উইনস্টনের অনুরোধটার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারেনি না তারা।

টাওয়ার তো এটা নিয়ে নির্ঘাত আপত্তি জানাবে।

যাই হোক, সিগেল কথামতোই প্লেনটা এয়ারপোর্টের পশ্চিমপ্রান্তে নিয়ে যায়। এখন অ্যাকসেস রোড থেকে একশ মিটার দূরে আছে তারা, সেখান থেকে নব্বই ডিগ্রি ডানে ঘুরে গেলেই পূর্বমুখি রানওয়েটা পড়বে সামনে।

উইনস্টন? সিগেল বলল, আমরা অ্যাকসেস র‍্যাম্পের শেষ প্রান্তে চলে এসেছি।

একটু অপেক্ষা করুন ওখানে, প্লিজ, উইনস্টন বলল। আমি একটু পরই ফিরে আসছি।

আমি এখানে এভাবে অপেক্ষা করতে পারি না! সিগেল ভাবলো। উইনস্টন কী করছে ভেবে পেলো না সে। সৌভাগ্যের কথা হলো, গালফস্ট্রিমে পেছনদিকের ক্যামেরা দিয়ে কোন প্লেন দেখতে পেলো না। তার মানে, আর যাই হোক, তারা অন্য কোন প্লেনের পথ আগলে দাঁড়িয়ে নেই এখন। এখান থেকে একমাত্র যে আলোটা দেখা যায় সেটা দুই মাইল দূরে কন্ট্রোল টাওয়ারের ঘোলাটে বাতি।

ষাট সেকেন্ড পার হয়ে গেল।

এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে বলছি, হেডসেটে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো। ইসি৩৪৬, আপনি ক্লিয়ার। টেকঅফ করতে পারেন এক নাম্বার রানওয়ে দিয়ে। আবারো বলছি, আপনাকে ক্লিয়ারেন্স দেয়া হলো।

টেকঅফ করার জন্য সিগেল একপায়ে রাজি কিন্তু এডমন্ডের সহকারির ফোন না পেলে কাজটা করতে পারছে না। ধন্যবাদ, কন্ট্রোল, বলল সে। আমাদেরকে এক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। একটা ওয়ার্নিং লাইট জ্বলেছে, আমরা এখন ওটা চেক করে দেখছি।

রজার দ্যাট। প্রস্তুত হলে আমাকে জানাবেন।

.

অধ্যায় ৩৯

এখানে? ওয়াটার ট্যাক্সির ক্যাপ্টেনকে দেখে মনে হলো দ্বিধান্বিত। আপনারা এখানে থামাতে চাচ্ছেন? এয়ারপোর্ট তো এখান থেকে অনেক দূরে। আমি আপনাদেরকে ওখানে নিয়ে যেতে পারবো।

ধন্যবাদ, তার আর দরকার নেই, আমরা নিজেরাই ওখানে চলে যেতে পারবো, উইনস্টনের উপদেশমতো বলল ল্যাংডন।

ক্যাপ্টেন কাঁধ তুলে বোটটা পুয়ের্তো বিদিয়া নামের ছোট্ট একটা ব্রিজের পাশে থামালো। এখানকার নদীর পাড়টা লম্বা লম্বা ঘাসে পূর্ণ। দেখে মনে হয়

মানুষজন এখান দিয়ে খুব একটা যাতায়াত করে। অ্যাম্ব্রা এরইমধ্যে বোট থেকে নেমে পড়তে শুরু করেছে।

কতো দিতে হবে আপনাকে? ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলো ল্যাংডন।

এক পয়সাও না, লোকটা বলল। আপনার ঐ বৃটিশ ভদ্রলোক আমাকে আগেই টাকা দিয়ে দিয়েছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। তিনগুণ দিয়েছে।

উইনস্টন টাকা দিয়ে দিয়েছে! ল্যাংডন এখনও কিয়ার্শের কম্পিউটারাইজড সহকারির সাথে কাজ করতে অভ্যস্ত হতে পারেনি।

প্রতিদিন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের বিভিন্ন ধরণের কাজকর্ম দেখলে উইনস্টনের এই সক্ষমতায় অবাক হবার কিছু নেই। খুবই জটিল জটিল কাজ করে এরা, এমনকি উপন্যাস লেখাও-এরকম একটি বই আরেকটুর জন্য জাপানের একটি সাহিত্যিক পুস্কারও বাগিয়ে নিয়েছিল।

ক্যাপ্টেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ল্যাংডনও নেমে পড়লো বোট থেকে। নদীপাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠার সময় পেছনে ফিরে বিস্মিত লোকটার দিকে তাকিয়ে তর্জনি উচিয়ে মুখের কাছে ধরলো সে। দিসক্রেশন পার ফাভোর।

সি, সি, ক্যাপ্টেন তার দুচোখ বন্ধ করে বলল। নো এ ভিস্তো নাদা!

ল্যাংডন এবার দ্রুত ঢাল বেয়ে একটা রেললাইন অতিক্রম করে একটা মেঠো পথের কাছে চলে এলো, অ্যাম্ৰা আগেই ওখানে পৌঁছে তার জন্য

অপেক্ষা করছে।

ম্যাপে যা দেখেছি, উইনস্টন বলল এডমন্ডের স্পিকারফোনে, আপনারা এখন পুয়ের্তো বিদিয়া আর রিও আসুয়া ওয়াটারওয়ের সংযোগস্থলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনারা কি শহরের মাঝখানে ছোট্ট একটি চত্বর দেখতে পাচ্ছেন?

পাচ্ছি, অ্যাম্ব্রা জবাব দিলো।

দারুণ। ঐ চত্বর থেকে বিকে বিদিয়া নামের ছোট্ট একটি রাস্তা চলে গেছে। ওটা ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকুন।

দুই মিনিট পর অ্যাম্ৰা আর ল্যাংডন গ্রামটা পেরিয়ে একটা মেঠোপথ ধরে হনহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে ল্যাংডন দেখতে পেলো তাদের ডানদিকে, বহু দূরে ছোটছোট টিলার উপরে আকাশ কিছুটা আলোকিত।

ওগুলো যদি টার্মিনালের লাইট হয়ে থাকে, বলল ল্যাংডন, তাহলে আমরা অনেক দূরে আছি।

আপনাদের এখান থেকে টার্মিনালটা তিন কিলোমিটার দূরে, বলল উইনস্টন।

চমকে উঠে অ্যাম্ৰা আর ল্যাংডন একে অন্যের দিকে তাকালো। উইনস্টন তাদেরকে বলেছিল মাত্র আট মিনিটের হাটাপথ।

গুগল স্যাটেলাইট ইমেজ বলছে, উইনস্টন বলতে লাগলো, আপনাদের ডানদিকে বিশাল একটা মাঠ আছে। ওটা দেখে কি যাতায়াতের উপযোগি বলে মনে হচ্ছে?

বিশাল মাঠটার দিকে তাকালো ল্যাংডন। মাঠটা আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে উঠে গেছে টার্মিনাল লাইটগুলোর দিকে।

আমরা যেতে পারবো ওখান দিয়ে, ল্যাংডন বলল, কিন্তু তিন কিলোমিটার।

শুধু উঠে যান টিলাটা বেয়ে, প্রফেসর। আমার ডিরেকশন ঠিকঠাকমতো অনুসরণ করুন। উইনস্টনের কণ্ঠ যেমন মার্জিত তেমনই আবেগহীন। তারপরও ল্যাংডনের মনে হলো, তাতে একটু ভৎর্সনার সুর আছে।

দারুণ, টিলার উপরে উঠেই বলল অ্যাম্ব্রা। উইনস্টনকে কখনও এরকম বিরক্ত হতে দেখেনি।

*

ইসি৩৪৬, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে বলছি, সিগেলের হেডসেটে বলে উঠলো কণ্ঠটা। আপনি হয় টেকঅফ করে র‍্যাম্পটা ক্লিয়ার করেন নয়তো হ্যাঙ্গারে ফিরে যান রিপেয়ার করার জন্য। আপনার বর্তমান স্ট্যাটাস কি?

এখনও কাজ করে যাচ্ছি, মিথ্যে বলল স্টিগেল। রিয়ারভিউ ক্যামেরার দিকে তাকালো। কোন প্লেন নেই-দূরের একটা টাওয়ারের মৃদু আলো শুধু চোখে পড়ছে। আমার আরেক মিনিট সময় লাগবে।

রজার দ্যাট। আমাদেরকে জানাতে থাকুন কী হলো না হলো।

সিগেলের কাঁধে টোকা দিলো তার কো-পাইলট, উইন্ডশিল্ড দিয়ে বাইরে একটা জায়গা দেখালো সে।

সিগেল সেখানে তাকিয়ে শুধুমাত্র প্লেনের সামনে উঁচু বেড়াগুলোই দেখতে পেলো। কিন্তু হঠাৎ করেই বেড়ার ওপাশে ভুতুরে কিছু চোখে পড়লো তার। এটা আবার কী?

বেড়ার ওপাশে, অন্ধকারাচ্ছন্ন মাঠে দুটো আবছায়া মূর্তি ধীরে ধীরে উদ্ভাসিত হতে লাগলো তাদের কাছে। মাঠের অন্যপ্রান্তে, টিলার উপর থেকে তারা প্লেনের দিকেই এগিয়ে আসছে। অবয়ব দুটো কাছে আসতেই সিগেলের চোখে পড়লো সাদার মধ্যে কালো বরফির স্ট্রাইপের অতি পরিচিত পোশাকটি। কিছুক্ষণ আগে টিভিতে সে এটা দেখেছে।

এটা কি অ্যাম্ব্রা ভিদাল না?

প্রায়শই কিয়ার্শের সাথে অ্যাম্ব্রা ফ্লাই করে। এই চোখ ধাঁধানো স্প্যানিশ সুন্দরিকে তার প্লেনে দেখলে সব সময়ই সিগেলের হৃদস্পন্দন একটুখানি হলেও বেড়ে যায়। বিলবাও এয়ারপোর্টের এরকম একটি বিরাণ মাঠের মতো জায়গায় সে কী করছে তা বুঝে উঠতে পারলো না পাইলট।

তার সঙ্গে কালো জ্যাকেট পরা লম্বামতোন যে ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে। তাকেও চিনতে পারলো সিগেল। আজকের অনুষ্ঠানে এই লোকটাও ছিল।

আমেরিকান প্রফেসর রবার্ট ল্যাংডন।

হঠাৎ করেই উইনস্টনের কণ্ঠটা শোনা গেল। মি.  সিগেল, আপনি এখন যে দু-জন মানুষকে দেখতে পাচ্ছেন, আশা করি তাদেরকে চিনতে পেরেছেন। সিগেলের কাছে মনে হলো এই বৃটিশ সহকারির কণ্ঠ অতিরিক্ত রকমের গোছানো। দয়া করে জানবেন, আজ রাতের ঘটনাগুলো আমি আপনার কাছে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে পারবো না। তবে আমি আশা করবো। মি.  কিয়ার্শের ইচ্ছে পূরণের জন্য আপনি আমার কথামতো কাজ করবেন। এ মুহূর্তে আপনি কেবল পরের কথাগুলোই জানতে পারবেন। একটু থামলো উইনস্টন। এডমন্ড কিয়াকে যে লোক খুন করেছে সে এখন অ্যাম্ব্রা ভিদাল আর রবার্ট ল্যাংডনকেও হত্যা করতে চাইছে। তাদেরকে নিরাপদে রাখার জন্য আপনার সহযোগিতা লাগবে।

কিন্তু…ঠিক আছে, সিগেল একটু তোতলালো। কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করলো সে।

এখনই মিস ভিদাল আর প্রফেসর ল্যাংডনকে আপনার প্লেনে তুলে নিতে হবে।

এখান থেকে?! সিগেল জোরেই বলল কথাটা।

এভাবে প্যাসেঞ্জার তুলতে যে টেকনিক্যাল সমস্যা হতে পারে সে-ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সচেতন আছি কিন্তু–

আপনি কি বলতে চাইছেন, এয়ারপোর্ট ঘিরে থাকা দশ ফুট উঁচু বেড়ার উপর দিয়ে নেবার ব্যাপারেও যে টেকনিক্যাল সমস্যা আছে সে-ব্যাপারেও সচেতন আছেন?!

সেটাই, শান্তকণ্ঠেই বলল উইনস্টন। মি.  সিগেল, যদিও আপনার সাথে কয়েক মাস ধরে আমি কাজ করছি, তারপরও আমি চাইবো আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন। এখন আমি আপনাকে যা করতে বলবো, এডমন্ড বেঁচে থাকলে এরকম পরিস্থিতিতে ঠিক সেটাই করতে বলতো।

অবিশ্বাসের সাথে উইনস্টনের কথাগুলো শুনে গেল সিগেল।

আপনি যা করতে বলছেন সেটা করা অসম্ভব! সিগেল বলল।

আমি বরং বলবো, উইনস্টন বলল এবার, এটা করা সম্ভব। প্রতিটি ইঞ্জিনের ওজন প্রায় পনেরো হাজার পাউন্ড, আর প্লেনেরে নাকের চোখা অংশটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যে, এটা সাতশ মাইল গতি-

আমি ফিজিক্স নিয়ে চিন্তিত নই, সিগেল চটে গেল একটু। আমি চিন্তিত এর বৈধতা নিয়ে-এটা করতে গেলে আমার পাইলটের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে!

আমি সেটা বুঝি, মি.  সিগেল, নির্বিকার কণ্ঠেই প্রতিক্রিয়া জানালো উইনস্টন। কিন্তু এই মুহূর্তে স্পেনের ভবিষ্যৎ রাণী কঠিন বিপদের মধ্যে পড়ে গেছেন। আপনার এই কাজটা তার জীবন বাঁচাতে সাহায্য করবে। আমাকে বিশ্বাস করুন, সত্যটা যখন বেরিয়ে আসবে তখন আপনাকে শাস্তি দেয়া হবে না, বরং রাজার কাছ থেকে একটা মেডেল পাবেন।

*

লম্বা ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে উঁচু বেড়ার দিকে তাকালো ল্যাংডন। প্লেনের হেডলাইটের আলোয় ওটা জ্বল জ্বল করছে।

উইনস্টনের কথামতো তারা এখন বেড়া থেকে আরেকটু পিছিয়ে এসেছে। ইঞ্জিনের শব্দ বাড়ছে আর আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে প্লেনটা। কিন্তু ওটা মোড় নিয়ে অ্যাকসেস র‍্যাম্পের দিকে না গিয়ে বরং তাদের সামনে থাকা বেড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। বেড়ার একেবারে কাছে এসে প্লেনটার গতি একটু কমে এলো। এখন ওটার নাক প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে বেড়ার সাথে।

ল্যাংডন দেখতে পাচ্ছে নাকের তীক্ষ্ণ অংশটা বেড়ার সাপোর্ট হিসেবে থাকা একটি লোহার পোস্টের দিকে তাক করা। বিশাল নাকটা পোস্টের সাথে লাগতেই ইঞ্জিনের গর্জন একটু বেড়ে গেল।

ল্যাংডন ভেবেছিল এতটা সহজে হবে না কিন্তু দুটো শক্তিশালি রোলস রয়েস ইঞ্জিন আর চল্লিশ টনের জেট প্লেনটা খুব সহজেই বেড়ার পোস্টটাকে ফেলে দিতে পারলো।

ল্যাংডন দৌড়ে গিয়ে পড়ে থাকা বেড়াটা আরেকটু নামিয়ে দিলো যাতে অ্যাম্ব্রা খুব সহজেই ওটা টপকাতে পারে। তারা টারমার্কে পা রাখতেই প্লেনের গ্যাংওয়ে সিঁড়িটা নামতে শুরু করলো। ইউনিফর্ম পরা দু-জন পাইলট হাত নেড়ে উপরে ওঠার জন্য ইশার করলো তাদেরকে।

ল্যাংডনের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো অ্যাম্ৰা। এখনও উইনস্টনের ব্যাপারে কোন সন্দেহ আছে?

সিম্বলজির প্রফেসরের আর কিছু বলার নেই।

তারা দু-জন তড়িঘরি প্লেনের ভেতরে ঢুকে পড়তেই ককপিট থেকে সেকেন্ড পাইলট কথা বলল টাওয়ারের সাথে।

হ্যাঁ, কন্ট্রোল, আমি আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি, পাইলট বলল, তবে আপনার গ্রাউন্ড নিশ্চয় ভুল হিসেব করে ফেলেছ, সেজন্যে আমরা অ্যাকসেস র‍্যাম্পে যেতে পারিনি। আবারো বলছি, আমরা এখন মোড় নিয়ে অ্যাকসেস র‍্যাম্পের দিকে যাচ্ছি। আমাদের ওয়ার্নিং লাইটগুলো এখন অফ হয়ে গেছে। টেকঅফ করতে আমরা প্রস্তুত।

কো-পাইলট দরজাটা বন্ধ করতেই পাইলট প্লেনটাকে বেড়া থেকে বেশ খানিকটা পেছনে নিয়ে গেল, এরপর সেটা মোড় নিয়ে চলে এলো রানওয়েতে।

অ্যাম্রার বিপরীতে বসে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে ফেলল তারপর হাফ ছাড়লো ল্যাংডন। ইঞ্জিনটা গর্জন করতে শুরু করলো এবার। প্লেনটা ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো রানওয়ে দিয়ে।

কিছুক্ষণ পরই প্লেনটা আকাশের দিকে মুখ করে উঠতে শুরু করলো। তার গতিপথ এখন বার্সেলোনার দিকে।

.

অধ্যায় ৪০

নিজের স্টাডি থেকে হন হন করে বের হয়ে এলেন রাবাই ইয়েহুদা কোভেস, বাগানটা পেরিয়ে বাড়ির সামনের দরজা দিয়ে বের হয়ে রাস্তার ফুটপাতে নেমে এলেন তিনি।

আমি আর নিজের বাড়িতে নিরাপদ নই, নিজেকে সুধালেন রাবাই। তার হৃৎপিণ্ডটা লাফাচ্ছে রীতিমতো। আমাকে সিনাগগে যেতে হবে।

ডোহানি স্ট্রিটের সিনাগগটি নিছক কোন স্যাঙ্কচুয়ারি নয়, এটাকে দূর্গ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। এই ধর্মশালাটির চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা, চব্বিশজন গার্ড দিনরাত পাহারা দেয় বুদাপেস্টের অ্যান্টি-সেমিটিজম, অর্থাৎ ইহুদি-বিদ্বেষের সুদীর্ঘ ইতিহাসের কথাটি মাথায় রেখে। আজ রাতে এরকম একটি জায়গার চাবি তার কাছে আছে বলে কৃতজ্ঞ বোধ করলেন কোভেস।

সিনাগগটি তার বাড়ি থেকে পনেরো মিনিটের পথ দূরত্বে-প্রতিদিন এই পথটি কোভেস শান্তিপূর্ণ পদক্ষেপেই পাড়ি দেন কিন্তু আজ রাতে কসুথ লাওস স্ট্রিট ধরে যাবার সময় প্রচণ্ড একটা ভীতি জেঁকে বসেছে তার মধ্যে। মাথাটা নিচু করে ভয়ার্তভাবে সামনে থাকা অন্ধকারের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে হাটছেন তিনি।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এমন কিছু দেখতে পেলেন যে, ভয়ে কাঠ হয়ে গেলেন।

রাস্তার ওপারে কালচে একটি অবয়ব বেঞ্চের উপর উপুড় হয়ে বসে আছে–খুবই শক্তিশালি গড়নের একজন মানুষ, পরে আছে নীল রঙের জিন্স আর বেইজবল ক্যাপ-হাতে থাকা স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফোনের ডিসপ্লের আলোতে তার দাড়িটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

এই লোক আশেপাশে কোথাও থাকে না, কোভেস জানেন এটা। হাটার গতি বাড়িয়ে দিলেন আরো।

বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটি মুখ তুলে তাকালো, রাবাইকে কয়েক মুহূর্ত দেখে আবার ফোনের দিকে ফিরে গেল সে। কোভেস তবুও হাটার গতি কমালেন না। এক ব্লক পার হবার পর নাভাস ভঙ্গিতে পেছন ফিরে তাকালেন। বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটি আর বেঞ্চিতে নেই দেখে যার পর নাই ঘাবড়ে গেলেন তিনি। লোকটা এখন রাস্তা পার হয়ে ফুটপাত দিয়ে কোভেসের পেছন পেছন আসছে।

সে আমাকে ফলো করছে। রাবাইর পা আরো দ্রুত চলতে শুরু করলো, দম ফুরিয়ে হাপাতে লাগলেন তিনি। ভাবলেন, বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলে বিরাট বড় ভুলই করে বসলেন কিনা।

ভালদেসপিনো বার বার বলে দিয়েছিলেন বাড়ির ভেতরে থাকার জন্য! কিন্তু আমি কাকে বিশাস করবো?

ভালদেসপিনোর লোকজন তাকে মাদ্রিদে নিয়ে যাবার জন্য আসবে এখানে, তোক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরিকল্পনাই করেছিলেন কোভেস, কিন্তু ফোনকলটা সবকিছু বদলে দেয়। সন্দেহের বীজ দ্রুতই অঙ্কুরোদগম করতে। শুরু করে।

ফোন করে মেয়েটা তাকে সাবধান করে দিয়েছিল : বিশপ আপনাকে মাদ্রিদে নিয়ে যাবার জন্য নয়, আপনাকে খুন করার জন্য লোক পাঠাচ্ছেন-ঠিক যেভাবে সাঈদ আল-ফজলকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে দুনিয়া থেকে। এরপর মেয়েটা গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হাজির করলে কোভেস ভড়কে গিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন।

এখন ফুটপাত দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাবার সময় কোভেসের মনে হচ্ছে, তিনি আর নিরাপত্তার জন্য সিনাগগে হয়তো পৌঁছাতে পারবেন না। বেইজবল। ক্যাপ পরা লোকটি এখনও তার পিছু পিছু আসছে। বড়জোর তার থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে আছে সে।

তীক্ষ্ণ একটি শব্দ রাতের বাতাসকে বিদীর্ণ করলে লাফ দিয়ে উঠলেন কোভেস। শব্দটি একটি সিটি বাসের দেখে স্বস্তি পেলেন তিনি। ঠিক তার পাশ ঘেষেই থামলো ওটা। তার মনে হলো, এটা যেন ঈশ্বরই পাঠিয়েছে। দ্রুত। বাসটাতে উঠে বসলেন তিনি। পুরো বাস ভর্তি হৈহল্লা করতে থাকা একদল ছাত্রছাত্রি। তাদের মধ্যে দু-জন ভদ্রভাবেই কোভেসের জন্য জায়গা ছেড়ে দিলো।

কোসজোনোম, হাফাতে হাফাতে বললেন রাবাই। ধন্যবাদ।

বাসটা যেই না ছেড়ে যাবে অমনি বেইজবল ক্যাপ পরা লোকটা দৌড়ে এসে বাসে উঠে গেল।

ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলেন কোভেস। কিন্তু লোকটা তার দিকে না তাকিয়েই পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়লো। উইন্ডশিন্ডের প্রতিফলনে রাবাই দেখতে পেলেন লোকটা আবার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে কোন ভিডিও গেম খেলায় ডুবে আছে।

এত বেশি সন্দেহবাতিক হয়ো না, ইয়েহুদা, নিজেকে বললেন তিনি। তোমার ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নেই।

বাসটা যখন ডোহানি স্ট্রিটের স্টপেজে থামলো, কোভেস উদগ্রিব হয়ে সিনাগগের দিকে তাকালেন। মাত্র কয়েক ব্লক দূরেই ওটা। তারপরও যাত্রিভর্তি নিরাপদ বাস থেকে নেমে গেলেন না।

আমি যদি নেমে পড়ি তাহলে ঐ লোকটাও নেমে পড়বে…আমাকে ফলো করবে…

নিজের সিটেই বসে থাকলেন কোভেস। এই ভিড়ের মধ্যেই তিনি বেশি নিরাপদে থাকবেন বলে ঠিক করলেন। আরো কিছুক্ষণ বাসে থেকে শাসপ্রশাসটাও স্বাভাবিক করে নিতে পারবো, ভাবলেন তিনি। যদিও তার মনে হচ্ছে, বাড়ি থেকে তড়িঘরি বের হবার আগে একবার টয়লেটে গেলে ভালো হতো।

কিছুক্ষণ পরই বাসটা যখন ডোহানি স্ট্রিট ছেড়ে এগিয়ে গেল সামনে, রাবাই কোভেস বুঝতে পারলেন তার পরিকল্পনায় মারাত্মক একটি গলদ আছে।

আজ শনিবার, আর যাত্রি বলতে একদল ছেলেপেলে।

কোভেস এখন বুঝতে পারছেন, এই বাসের সবাই একটা স্টপেজেই নেমে পড়বে-বুদাপেস্টের জিউস কোয়ার্টার থেকে এক স্টপেজ আগেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐ এলাকাটি ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু স্ট্রাকচারগুলো এখন ইউরোপের সবচাইতে চোখ ধাঁধানো বার সিনগুলোর একটি-রুইন বারস্ হিসেবেই বিখ্যাত এটি-হাল আমলের নাইটক্লাবগুলো এইসব জীর্ণ ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। সপ্তাহান্তে ছাত্রছাত্রি আর পর্যটকের দল গ্রাফিতিতে ঢাকা বোমায় বিধ্বস্ত এইসব পুরনো ম্যানশন আর ওয়্যারহাউজগুলোতে জড়ো হয় পার্টি করতে। সাউন্ড সিস্টেম আর রঙবেরঙের বাতির সমারোহ চলে তখন।

পরের স্টপেজে বাসটা থামতেই সব ছাত্রছাত্রি একসাথে নেমে পড়লো। কিন্তু ক্যাপ পরা লোকটি বসে থাকলো নিজের সিটে, এখনও ফোন নিয়েই ব্যস্ত সে। কোভেসের অন্তরাত্মা বলছে যতো দ্রুত সম্ভব বাস থেকে নেমে পায়ে হেঁটে ছাত্রছাত্রিদের ভিড়ের সাথে মিশে চলে যেতে। সেটাই করলেন তিনি।

তবে বাসটা ছেড়ে যেতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো আবার, হিসহিস শব্দ করে খুলে গেল ওটার দরজা, বেইজবল ক্যাপ পরা বাসের একমাত্র যাত্রিটি নেমে পড়লো। কোভেস টের পেলেন তার নাড়িস্পন্দন রকেটের গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। এবারও লোকটা কোভেসের দিকে তাকালো না, বরং ছাত্রছাত্রিদের ভিড়ে না মিশে হুট করে ঘুরেই বিপরীত দিকে হাটা ধরলো। যেতে যেতে একটা ফোন করলো সে।

কাল্পনিক সব জিনিস ভাবা বন্ধ করো, নিজেকে বললেন কোভেস। নিজের শাসপ্রশ্বাস ঠিক রাখার চেষ্টা করলেন।

বাসটা চলে যেতেই ছাত্রছাত্রিদের দলটি বারগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। নিরাপত্তার জন্যই রাবাই কোভেস যতোক্ষণ সম্ভব তাদের সঙ্গেই থাকবেন বলে ঠিক করলেন। এক পর্যায়ে হুট করেই বামদিকে মোড় নিয়ে সিনাগগের দিকে হাঁটতে লাগলেন।

মাত্র কয়েক ব্লক দূরে ওটা, নিজেকে বললেন তিনি। পাদুটো যে ভারি হয়ে আসছে, প্রস্রাবের তীব্রতায় যে তলপেট ব্যথা করছে সেসব পরোয়া করলেন না।

রাস্তার দু-পাশে রুইন বারগুলো লোকে লোকারণ্য। কোভেসের চারপাশে ইলেক্ট্রনিক মিউজিক বেজে চলেছে প্রচণ্ড শব্দে, বাতাসে বিয়ার আর সোপিয়ানি সিগারেটের গন্ধ।

মোড়ের কাছে আসার পরও কোভেসের মনে হলো তাকে এখনও নজরদারি করা হচ্ছে। আস্তে করে আরেকবার পেছনে ফিরে তাকালেন। জিন্স প্যান্ট আর। ক্যাপ পরা লোকটাকে দেখতে না পেয়ে স্বস্তি বোধ করলেন তিনি।

*

অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রবেশমুখে উপুড় হয়ে থাকা আবছা অবয়বটি অন্ধকার থেকে বের হয়ে মোড়ের দিকে তাকানোর আগে টানা দশ সেকেন্ড একদমই নড়েনি।

ভালো চেষ্টাই করেছো, বুড়ো, ভাবলো সে। ভালো করেই জানে সময়মতো দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে পেরেছে।

পকেটে থাকা সিরিঞ্জটা ডাবল চেক করে নিয়ে লোকটি বেরিয়ে এলো অন্ধকার থেকে। বেইজবল ক্যাপটা অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন