কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১

এম আর আখতার মুকুল

পলাশীর যুদ্ধ থেকে নীল চাষীদের বিদ্রোহের আমল

ভারতীয় উপ-মহাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের জের হিসেবে এদেশে বৃটিশ সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হলেও ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ১৯০ বছরের মধ্যে এদেশে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বারবার বিদ্রোহ হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, এই ১৯০ বছরের মধ্যে প্রথম ১০০ বছর পর্যন্ত উপ-মহাদেশের শাসনভার ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে এবং পরবর্তী ১০ বছরকাল ইংরেজ সরকার দ্বারা সরাসরিভাবে পরিচালিত হয়েছে।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এ কথা বলতে হয় যে, ১৭৬৪ সালের বকসার যুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশীয় রাজন্যবর্গ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষিপ্তভাবে যে সব লড়াই করেছে তার ইতিহাস পাওয়া গেলেও ১৭৬৯-৭০ সালের মহামন্বতর-এর পর থেকে শ্রেণীগতভাবে যে সব রক্তাক্ত বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সে সবের তথ্যভিত্তিক পূর্ণাংগ ইতিহাস আজও পর্যন্ত রচিত হয়নি।

এ সব বিদ্রোহের মধ্যে শুধুমাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে অনুষ্ঠিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৬৩-৭৮), মেদিনীপুরের বিদ্রোহ (১৭৬৩-৮৩), ত্রিপুরার সমশের গাজীর বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৯), কৃষক-তন্তুবায়ের লড়াই (১৭৭০-৮০) এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকলা বিদ্রোহ (১৭৭৬৮৭) প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই ঐতিহাসিক পটভূমিতে উপ-মহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও বিহারের নীল চাষ-এর সূত্রপাত হয়। মশিয়ে লুই বন্নো নামে জনৈক ফরাসী ব্যবসায়ী ১৭৭৭ খৃষ্টাব্দে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে নীল চাষ আরম্ভ করেন এবং পরের বছর ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে ক্যারল ব্লুম নামে জনৈক ইংরেজ এদেশে প্রথম নীল কুঠি স্থাপন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইংল্যাণ্ড-এ শিল্প বিপ্লবের জের হিসেবে দ্রুত বস্ত্রশিল্প গড়ে উঠলে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, এ সময় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলাদেশে যে নীল প্রতি পাউণ্ড চার আনায় ক্রয় করতো, ইংল্যাণ্ড-এ তার বিক্রয় মূল্য ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকার মতো এবং বাংলাদেশ থেকেই সমগ্র বিশ্বের নীলের চাহিদা মেটানো হতো।

প্রথমদিকে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর নীলকর সাহেবরা স্থানীয় জমিদারদের সক্রিয় সহযোগিতায় তাদের প্রজাদের দিয়ে প্রজাদেরই জমিতে নীল চাষ করাতেন এবং সস্তায় ফসল ক্রয় করে নিজেদের ব্যবস্থাধীনে নীল রং নিষ্কাশন করাতেন। নীল রং নিষ্কাশন-এর এসব কেন্দ্রকেই ‘কুঠি’ বলা হতো। কিন্তু স্বল্পদিনের ব্যবধানে দেখা যায় যে, ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজেরাই জমিদারী ক্রয় করে কিংবা ইজারা গ্রহণ করে প্রজাদের জমিতে বাধ্যতামূলকভাবে নীল চাষের ব্যবস্থা করেছে। এখানেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। অর্থ ও প্রতিপত্তি বাড়ার সংগে সংগে এরা নিজেদের এলাকা ছাড়াও অন্যান্য জমিদার ও জোতদারদের অধীনস্থ প্রজাদের জোর করে দাদন বা অগ্রিম টাকা দিয়ে চুক্তিপত্রে দস্তখত করিয়ে নিতে শুরু করলো। চুক্তিবদ্ধ চাষীকে কি পরিমাণ জমিতে নীল চাষ করতে হবে এবং উৎপন্ন ফসল কি মূল্যে কুঠিয়ালদের কাছে বিক্রি করতে হবে সবই চুক্তিপত্রে লেখা থাকতো।

একবার চুক্তিপত্রে দস্তখত করলে চাষীকে আমৃত্যু নীল চাষ করতে হতো। শর্ত পূরণে ব্যর্থ হলে চাষীদের উপর নেমে আসতো “হাবিয়া দোজখ”-এর অবর্ণনীয় অত্যাচার। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক হারাণ চন্দ্র চাকলাদার তাঁর ‘ফিফটি ইয়ার্স এগো’ (১৯০৫ জুলাই) নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন, “বাংলাদেশের ফৌজদারী আদালতের সমসাময়িক নথিপত্রই এই অকাট্য প্রমাণ বহন করে যে, নীল চাষ প্রবর্তনের দিনটি থেকে শুরু করে তা একেবারে না উঠে যাওয়া পর্যন্ত যে সমস্ত পন্থায় রায়তদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো তার মধ্যে ছিল হত্যাকান্ড, বিচ্ছিন্নভাবে খুন, ব্যাপকভাবে খুন, দাংগা, লুটতরাজ, বসতবাটি জ্বালানো এবং লোক অপহরণ প্রভৃতি।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ (অক্ষয় কুমার দত্ত সম্পাদিত) এবং ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ (হরিশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত) পত্রিকা দু’টোতে এসব অত্যাচারের ‘ছিটেফোটা কাহিনী’ প্রকাশিত হতো। এমনকি প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পুস্তকেও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কিছু বিবরণ রয়েছে।

এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইংরেজ আদালতে কোনও ন্যায্য বিচারের ব্যবস্থা ছিলো না। ইংরেজ বিচারকদের আদালতে ইংরেজ নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রতিটি বিচারই প্রহসনে পরিণত হয়েছিল। বাস্তব অবস্থাটা ছিলো খুবই করুণ। সুবিচার তো হতোই না; বরং ইংরেজ নীলকরদের আক্রোশ আরও বেড়ে যেতো আর চাষীদের হতো সর্বনাশ।

১৭৭৮ থেকে চাষীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের নীল চাষীরা কোন সময়েই ইংরেজ কুঠিয়ালদের এসব নৃশংস অত্যাচার নীরবে সহ্য করেনি। চাষীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হয় ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দ থেকে এবং তা নীল চাষ উঠে যাওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দের ‘ক্যালকাটা রিভিউ’-এর সংখ্যায় এ সম্পর্কে জনৈক ইংরেজের লেখা এক চাঞ্চল্যকর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। “প্ল্যান্টার্স: সাম হার্টি ইয়ার্স এগো” প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, “অসংখ্য ভয়াবহ দাংগা-হাংগামার কথা আমরা জানি। মাত্র দৃষ্টান্ত হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি যেখানে দু’জন তিনজন এমনকি দুশ’জনও নিহত হয়েছে এবং আহতও হয়েছে সেই অনুপাতে। অসংখ্য খন্ডযুদ্ধে ‘ব্রজ’ ভাষাভাষী অবাঙালি ভাড়াটে সৈন্যরা এমন দৃঢ় তার সংগে যুদ্ধ করেছে যে, তা যে কোনও যুদ্ধে কোম্পানীর সৈনিকদের পক্ষে গৌরবজনক হতো। বহু ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব কৃষক লাঠিয়ালদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তাদের তেজস্বী ঘোড়ার পিঠে চেপে অতি দক্ষতার সংগে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা সশস্ত্র আক্রমণের দ্বারা নীলকুঠি ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে, অনেক জায়গায় এক পক্ষ বাজার লুট করেছে, তার পরক্ষণেই অপর পক্ষ এসে তার প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে।” (দেশাত্মবোধক ও ঐতিহাসিক বাংলা নাটকঃ ডঃ প্রভাত কুমার গোস্বামী)।

সমসাময়িককালের ঐতিহাসিক তথ্যাদি থেকে এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে যে, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবকে (বিদ্রোহ) সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজরা পৈশাচিক হত্যাকান্ড ও ভয়াবহ অত্যাচারের মাধ্যমে দমন করলেও সেসময় বাংলাদেশে নীল চাষীদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত ছিলো। ১৮৫৯-৬০ খৃষ্টাব্দে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমশ তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।

বাংলার নীল চাষীদের এই বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী দারুণভাবে আতংকগ্রস্ত হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে তদানীন্তন লেঃ গভর্নর গ্রান্ট-এর বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। “শত সহস্র মানুষের বিক্ষোভের এই প্রকাশ, যা আমরা বংগদেশে প্রত্যক্ষ করছি, তাকে কেবল রং সংক্রান্ত অতি সাধারণ বাণিজ্যিক প্রশ্ন না ভেবে গভীরতর গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বলে যিনি ভাবতে পারছেন না, তিনি আমার মতে সময়ের ইংগিত অনুধাবন করতে মারাত্মক ভুল করছেন। “……আর সেই কৃষক অভ্যুত্থান ভারতের ইউরোপীয় ও অন্যান্য মূলধনের পক্ষে যে সাংঘাতিক ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে তা যে কোনও লোকের চিন্তার বাইরে।”

এ সময়ের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনাকালে ভারতের নয়া গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং নিজেই লিখেছেন, নীল চাষীদের বর্তমান বিদ্রোহ আমার মনে এমন উৎকণ্ঠা জাগিয়েছিল যে, দিল্লীর ঘটনার (১৮৫৭ খৃষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহ) সময়েও আমার মনে ততটা উৎকণ্ঠা জাগেনি। আমি সব সময়েই ভেবেছি যে, কোনও নির্বোধ নীলকর যদি ভয়ে বা রাগান্বিত হয়ে একটিও গুলী ছোড়ে তা হলে সেই মুহূর্তে দক্ষিণ বাংলার সব কুঠিতে আগুন জ্বলে উঠবে।” (বেংগল আন্ডার লেঃ গভর্নরসঃ ই, বাকল্যান্ড ১ম খন্ড)।

অবস্থাদৃষ্টে দেখা যায় যে, ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দে বাংলার নীল চাষীদের বিদ্রোহ রক্তাক্ত আকার ধারণ করে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে। এই কৃষক বিদ্রোহের দু’টি স্তর ছিলো। প্রথমদিকে অত্যাচারিত কৃষকরা ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর মানবিকতা এবং ন্যায়বোধের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছিলো। এতে কোনও ফল না পাওয়ায় দ্বিতীয় স্তরে কৃষকরা নীল চাষে অস্বীকৃতি জানিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। ইংরেজ কুঠিয়ালরা নিজস্ব গুণ্ডাবাহিনী ছাড়াও পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সাহায্যে কৃষকদের নীল চাষে বাধ্য করার প্রচেষ্টা করার সংগে সংগেই কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু হয়।

.

১৭৯৩ সালটা উপ-মহাদেশে, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য এক উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। এই বছরেই প্রবর্তিত হয়েছিলো কুখ্যাত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত… যাকে আমরা সহজে বোঝার জন্য জমিদারী প্রথা বলে থাকি। এই আইনের ফলে অচিরেই এদেশে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার জমিদারী প্রথার সৃষ্টি হলো। (১৬২ বছর পর ১৯৫৫ সালে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ হয়)।

এই জমিদারী প্রথার দীর্ঘ পূর্ব ইতিহাস রয়েছে। পাঠান ও মোঘল আমলে সরকারের প্রাপ্য জমির খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের জন্য নানা ধরনের মধ্যস্বত্বের সৃষ্টি করা হয়। ক্রমে এঁরাই প্রতিপত্তিশালী জমিদারে পরিণত হন। ১৭২২ সালে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ সমগ্র বাংলাকে ২৫টি জমিদারী ও ১৩টি জায়গীর বন্দোবস্ত করেন। ফলে রাজশক্তি বার্ষিক আয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে সক্ষম হয়। কিছুদিনের মধ্যেই এসব জমিদারী ও জায়গীরগুলোর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। সাধারণতঃ এই সময়সীমা ১০ বছরের জন্য ছিল বলেই এই পদ্ধতিকে দশসালা বন্দোবস্ত বলা হতো।

প্রাসংগিক হবে বিধায় এখানে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান প্রধান দশসালা বন্দোবস্তের খতিয়ান ও চুক্তির টাকা বৃদ্ধির চিত্র উপস্থাপন করা বাঞ্ছনীয় মনে করছি। :

বন্দোবস্ত এলাকার নামমুর্শিদ কুলি খাঁর আমলমীর কাসেমের আমল
দিনাজপুর (৮৯ পরগনা)৪,৬২,৯৬৪ টাকা১৮,২০,৭৮০ টাকা
রাজশাহী (১৩৯ পরগনা)১৬,৯৬,০৮৭ টাকা৩৫,৫৩,৪৮৫ টাকা
বর্ধমান (৫৭ পরগনা)২০,৪৭,৫০৬ টাকা৩২,২৬,৯৩৪ টাকা
নদীয়া (৭৩ পরগনা)৫,৯৪,৮৪৬ টাকা১০,৯৮,৩৭৯ টাকা
বীরভূম (২২ পরগনা)৩,৬৬,৫০৯ টাকা১৩,৪২,১৪৩ টাকা
যশোর (২৩ পরগনা)১,৮৭,৭৫৪ টাকা৪,১৬,৩১৮ টাকা
ঢাকা (১৫৫ পরগনা)৮,৯৯,৭৯০ টাকা
ফকিরকুণ্ডী বা রংপুর
(২৪৪ পরগনা)
২,৩৯,১২৩ টাকা৬,৩৭,৬৩২ টাকা

(এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নাল ১৮৭৫ (৩নং) এবং কালী প্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত বাংলার ইতিহাসঃ নবাবী আমল)

ইংরেজ শাসনের আমলে জমিদারী বন্দোবস্তের এসব টাকার অংক আরও বৃদ্ধি পায় এবং আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত নানা মধ্যস্বত্বের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। এসব মধ্যস্বত্বের মধ্যে জায়গীরদার, ডিহিদার, চাকলাদার, তরফদার, তালুকদার, চৌধুরী ক্রোরী, হাজারী, কানুনগো, পাটোয়ারি, আমিল, শিকদার প্রভৃতি অন্যতম। এ থেকে সহজেই অনুমান করা সম্ভব যে, সে আমলে এদের ভরণ-পোষণ থেকে শুরু করে জমিদারদের পুরো খরচ ও মুনাফা ছাড়াও রাজশক্তির পুরো পাওনাটাই বাংলার কৃষকদের বহন করতে হতো।

হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর ব্যাপক প্রভাব

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সামাজিক ইতিহাসে আরও একটা ব্যাপার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তা’ হচ্ছে কোলকাতায় ধনাঢ্য বাঙালি হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর ব্যাপক প্রভাব। এই সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে বিপুল অর্থ সঞ্চিত হওয়ারও ইতিহাস রয়েছে। এদেশে ইংরেজদের আগমনের প্রথম থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী একচেটিয়া ‘বাণিজ্যের সনদ লাভ করেছিলেন। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছাড়া আর কোন ইংরেজ কোম্পানীর পর্যন্ত ভারতে বাণিজ্যের অধিকার ছিল না। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম থেকেই বাণিজ্যের সুবিধার জন্য এদেশে ‘এজেন্সী হাউস’ স্থাপন করে। এসব প্রতিষ্ঠানে সাধারণতঃ ৩/৪ জন অংশীদার থাকত এবং এরা সবাই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী। এসব এজেন্সী হাউসগুলো স্থাপন করতে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের কোন মূলধনের পর্যন্ত প্রয়োজন হয়নি। কোম্পানীর কর্মচারীদের আমানত ও বাৎসরিক সঞ্চয় প্রাথমিক মূলধন সৃষ্টির মূল সূত্র। স্থানীয় বণিক সম্প্রদায়ও এসব হাউসগুলোতে অর্থ গচ্ছিত রাখতেন। ক্রমান্বয়ে দেখা যায় যে, এরা এ সময় একচেটিয়াভাবে বাংলা তথা ভারতের রেশম, পাট, নীল ও তূলা প্রভৃতি ব্যবসা করা ছাড়াও ব্যাংকিং-এর সমস্ত রকমের কাজ করতে শুরু করেছে। দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের নিকট প্রদত্ত ধারের সুদের হার ছিল ১৮% থেকে ২০% পর্যন্ত। (বিনয় ঘোষ : বাংলার নবজাগৃতি

দি বেংগল ডিরেক্টরী এ্যান্ড আলম্যানাক (১৭৯৭)-এ কোলকাতায় স্থাপিত এ ধরনের প্রায় ১৯টি এজেন্সী হাউস-এর নাম পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে মেসার্স ককারেল ট্রেল এ্যান্ড কোং, মেসার্স বারবার পামার এ্যান্ড কোং, মেসার্স টড এ্যান্ড মিলার, মেসার্স ক্যাম্বেল এ্যান্ড ক্লার্ক, মেসার্স হ্যামিলটন এ্যান্ড এবার্ডিন প্রভৃতি অন্যতম। ১৮১০ সাল নাগাদ কোলকাতায় এ ধরনের এজেন্সী হাউসের সংখ্যা প্রায় ২৭টি-তে দাঁড়ায়। স্বল্পকালের ব্যবধানে এই এজেন্সী হাউসগুলো অকল্পনীয়ভাবে মুনাফা অর্জন করায় খোদ ইংল্যান্ডেও এ ব্যাপারে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় অন্যান্য ইংরেজ কোম্পানীগুলো ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের সনদ বাতিলের দাবী উত্থাপন করে। বৃটেনের হাউস অব কমল-এর সিলেক্ট কমিটির নিকট প্রদত্ত টমাস ব্রেকোর জবানবন্দী বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীন উচ্চপদস্থ সিভিল ও মিলিটারী কর্মচারীরা চাকরি ছেড়ে ক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁরা দেখলেন যে, কোম্পানীর দাসত্ব করার চাইতে এই বণিকবৃত্তি অবলম্বন করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে। বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা গচ্ছিত পেলেন এবং মূলধন হিসেবে সেই টাকা ব্যবসায় খাটিয়ে প্রচুর মুনাফা সঞ্চয় করলেন। এইভাবে তাঁরা এক-একজন বেশ মোটা পুঁজি নিয়ে ইংল্যান্ড ফিরলো।”

ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারীদের অধীনের কার্যকলাপের জের হিসেবে ১৮১৩ সালে ভারতে এই কোম্পানীর একচেটিয়া অধিকার বাতিল করা হয়। বিপুল মূলধন নিয়ে স্থাপিত অনেকগুলো বৃটিশ কোম্পানী তখন কোলকাতায় আগমন করে। এসব বৃটিশ কোম্পানীর সংগে প্রতিযোগিতায় পুরোনো এজেন্সী হাউসগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকী সবগুলোই পাততাড়ি গুটাতে বাধ্য হল। নতুন ইংরেজ কোম্পানীগুলোর মধ্যে মেসার্স র‍্যালি ব্রাদার্স, ম্যালকম এ্যান্ড কোং, বেগ ডানলপ এ্যান্ড কোং, মার্টিন পিলার্স এ্যান্ড কোং প্রভৃতি অন্যতম। এঁরা এজেন্সী হাউস পরিচালনা এবং রফতানী বাণিজ্য করা ছাড়াও নানা ধরনের শিল্পের মূলধন বিনিয়োগ শুরু করল। এসবের মধ্যে কয়লা, অভ্র, লৌহ, ম্যাংগানিজ প্রভৃতি খনিজ শিল্প অন্যতম। এছাড়া চা-বাগান স্থাপনের জন্য এরা বিপুল পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করল।

হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণী কিভাবে ধনাঢ্য হল

এটাই হচ্ছে এই উপ-মহাদেশে ইংরেজ রাজত্বের বণিক স্বার্থের নব অধ্যায়ের সূচনা কাল। এসময়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে বিপুল ধন-সম্পদ সঞ্চয়। এঁরা ইংরেজ রাজশক্তির ছত্র ছায়ায় লালিত-পালিত হয়ে দ্রুত বর্ধিত হন। এসব বণিকরা প্রথমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আমলের ‘এজেন্সী হাউসগুলোর দেওয়ানী, মুৎসুদ্দীগিরি ও দালালী করতেন এবং পরবর্তীতে (১৮১৩ সালের পর) এরাই আবার বড় বড় বৃটিশ কোম্পানীগুলোর বেনিয়ান ও এজেন্ট নিযুক্ত হলেন। এ ধরনের দেওয়ানী, দালালী, বেনিয়ানগিরি ও এজেন্টের কাজ করে এঁরা অভাবনীয় অর্থের মালিকে পরিণত হলেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এসব ব্যবসায়ীদের যেসব নাম পাওয়া গেছে তাঁরা হচ্ছেন : ১. লক্ষ্মী কান্ত বড়াল

২. দত্তরাম দত্ত

৩. রামমোহন পাল

৪. মথুরামোহন সেন

৫. নিত্যচরণ সেন

৬. রামসুন্দর পাইন

৭. স্বরূপ চাঁদ শীল

৮. জগমোহন শীল

৯. আনন্দমোহন শীল

১০. স্বরূপ চাঁদ আঢ্য

১১. কানাই লাল বড়াল এবং

১২. সনাতন শীল প্রমুখ

এঁরা সবাই ছিলেন বাঙালি হিন্দু এবং এঁদের স্বার্থ পরাশক্তি ইংরেজদের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। (বার্ষিক ডিরেক্টরী ও আলম্যানাক ১৮০৫-০৬)

বাংলার তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করতে হলে এসব ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপ সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যাদান অপরিহার্য। গবেষকদের মতে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার ব্যবসায়ী লক্ষ্মীকান্ত ধর ওরফে নকুড় ধর, মতিলাল শীল, দ্বারকনাথ ঠাকুর, রামহরি বিশ্বাস, সুখময় রায়, রামচরণ রায়, রাজা নবকৃষ্ণ প্রমুখদের ধন-সম্পদ নবাবী আমলের জগৎশেঠ কিংবা অমিচাদের তুলনায় নেহায়েৎ কম ছিল না।

পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এদেশীয়দের মধ্যে যারা কোম্পানী আমলে এজেন্সী হাউসগুলোর দেওয়ানী ও মুৎসুদ্দীগিরি করত, পরবর্তীকালে তারাই নতুন নতুন ব্রিটিশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এজেন্ট নিযুক্ত হল। সবাই ধনাঢ্য ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অর্জন করল।

শ্রী শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বংগসমাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন, “তখন নিমক মহলের দেওয়ানী লইলেই লোকে দুই দিনে ধনী হইয়া উঠিত। এইরূপে শহরের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ধনী হইয়াছেন।” কথিত আছে যে, নকুড় ধরের অর্থ সাহায্যের দরুন ইংরেজরা পর্যন্ত অনেক সময় বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছে। তাঁর কোনও পুত্র সন্তান ছিন না। ফলে তাঁর কন্যার একমাত্র পুত্র সুখময় রায় উত্তরাধিকারী সূত্রে বিপুল ধন-সম্পদ লাভ করেন। লর্ড মিন্টোর আমলে সুখময় ‘রাজা’ উপাধি লাভ করেন। তিনিই ছিলেন ‘ব্যাংক অব বেংগল’-এর একমাত্র বাঙালি ডিরেক্টর। প্রসংগত উল্লেখ্য যে, ১৭৭০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে ইংরেজদের উদ্যোগে শুধুমাত্র কোলকাতা নগরীতে ১১টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এসবের কোনও শাখা ছিল না।

মতিলাল শীল আদিতে বোতল ও কর্কের ব্যবসা করতেন। কিন্তু অচিরেই তিনি ইংরেজ ব্যবসায়ীদের সংস্পর্শে এসে দালালী ব্যবসায় লিপ্ত হন। তখনকার দিনে কোলকাতার ৫০/৬০টি ইংরেজ বাণিজ্য কুঠির ২০টির জন্য তিনি বেনিয়ান নিযুক্ত হন। এরপর মতিলাল বিদেশী ‘এজেন্সী হাউস’-এর অংশীদার হন। এসব হাউস-এর মধ্যে ফার্গুশন ব্রাদার্স এ্যান্ড কোং প্রভৃতি অন্যতম। এছাড়াও মতিলাল শীল জমির ব্যবসা করতেন এবং তিনি কয়েকটা আটা কলের মালিক ছিলেন।

বিশ্বম্ভর সেন সামান্য পুঁজি (মাত্র ১০ টাকা) নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। অচিরেই তিনি প্রায় ২০টি ইংরেজ বাণিজ্যকুঠির বেনিয়ান নিযুক্ত হন। মৃত্যুকালে তাঁর গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল দুই লাখ পাউন্ডের মতো।

রাজা নবকৃষ্ণ ছিলেন মীর জাফরের নবাব হবার সময় লর্ড ক্লাইভ-এর দেওয়ান এবং তিনি বিপুল অর্থ সঞ্চয় করেন। গভর্নর ভ্যানসিটাট ও জেনারেল স্মিথ-এর দেওয়ানী করে রামচরণ রায় বিশাল সম্পত্তির অধিকারী হন।

ভুলুয়া ও চট্টগ্রামের লবণের এজেন্ট হ্যারিস সাহেবের দেওয়ানী করে রামহরি বিশ্বাস এবং তদীয় পুত্র প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস ও জগমোহন বিশ্বাস প্রভূত অর্থ উপার্জন করেন।

প্রামার কোম্পানীর খাজাঞ্চি গংগা নারায়ণ সরকার অচিরেই কোলকাতার বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গোকুল চন্দ্র মিত্র ইংরেজদের সহযোগিতায় রসদের ঠিকাদারী করে সমৃদ্ধি লাভ করেন এবং কৃষ্ণচন্দ্র পাল চৌধুরী লবণের ব্যবসায় বিপুল সম্পদ অর্জন করেন।

রাম দুলাল দে বাণিজ্য সূত্রেই ধন লাভ করেন। সমসাময়িককালে তিনিই ছিলেন কোলকাতার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তি। দে মহাশয় প্রথমে ফেয়ারলি কোম্পানীর দেওয়ান ছিলেন এবং পরে তাঁর ব্যবসা আমেরিকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিলো।

বাংলার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ দর্প নারায়ণ ঠাকুর হুইলার কোম্পানীর দেওয়ানী করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেন। এঁর পুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুর প্লাউডেন সাহেবের দেওয়ান নিযুক্ত হয়ে প্রচুর ধন সঞ্চয় করে পৃথকভাবে বাণিজ্য শুরু করেন। এসব বাণিজ্যের মধ্যে নীল ও রেশম রফতানী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর কোম্পানীর নাম ছিল ‘টেগোর এ্যান্ড কোং’, তিনি ইউনিয়ন ব্যাংক-এর প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে তিনিই ছিলেন এই ইউনিয়ন ব্যাংকের একমাত্র মালিক। এ থেকেই তাঁর সম্পদের পরিমাণ কিছুটা আন্দাজ করা যায়। দ্বারকানাথ ঠাকুর তাঁর জমিদারীর প্রায় সর্বত্রই নীলের কারখানা স্থাপন করেছিলেন। এমনকি তিনি এদেশে চিনি উৎপাদনের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিলেন এবং কয়লা খনির মালিকানার জন্য আগ্রহী হয়েছিলেন। সরকার ছাড়াও কোলকাতার প্রতিটি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সংগে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল এবং সমাজে তাঁর প্রতিপত্তি ছিল অসাধারণ।

এ সময়ের আরও কয়েকজন বাঙালি হিন্দু ধনাঢ্য ব্যক্তিরা হচ্ছেন যথাক্রমে গোবিন্দ রাম মিত্র, মথুরা মোহন সেন, শিব নারায়ণ ঘোষ, রামমোহন, বৈষ্ণব দাস মরিক ও নীলমণি মল্লিক প্রমুখ। (সূত্রঃ বাংলার নব জাগৃতিঃ বিনয় ঘোষ)

এখানে একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, ইংরেজ কোম্পানীগুলোর ছত্রছায়া এবং পৃষ্ঠপোষকতায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ নাগাদ কোলকাতা কেন্দ্রিক বাঙালি হিন্দু সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে প্রচুর ধন-সম্পত্তি সঞ্চিত হওয়ায় ইংরেজ রাজশক্তি ‘কিছুটা চিন্তিত’ হল। তাঁরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে, এক্ষণে এই সঞ্চিত মূলধন স্বাভাবিকভাবেই শিল্প স্থাপনে বিনিয়োগ হবে এবং যা কখনই ইংরেজদের কাম্য নয়। ইংরেজরা চা-শিল্প, খনি শিল্প এবং নতুন নতুন শিল্প ও কারখানা স্থাপনের বিষয়গুলো নিজেদের সম্পূর্ণ করায়ত্তে রাখতে আগ্রহী। এসময় দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাম দুলাল দে, মতিলাল শীল, রাম গোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ স্বাধীনভাবে শিল্প স্থাপনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন, সেটাই ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর উল্লিখিত চিন্তাধারাকে আরও বদ্ধমূল করে। অথচ ইংরেজরা তাঁদের এই সম্পূরক ও সহযোগী শক্তিকে কোন অবস্থাতেই বৈরী ভাবাপন্ন করতে ইচ্ছুক নন। এজন্যই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিকল্প ব্যবস্থা হচ্ছে ১৭৯৩ সালে জমিদারী প্রথার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের চাঞ্চল্যকর ইতিহাস

চিরস্থায়ী হিসেবে জমিদারীর বন্দোবস্ত দেয়ার প্রস্তাব করে ১৭৯৩ সালের ৬ই মার্চ লর্ড কর্নওয়ালিস ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর লণ্ডনস্থ ডিরেক্টরদের কাছে লেখা চিঠিতে বললেন, “বেশ কিছুসংখ্যক ‘নেটিভ’-দের হাতে যে বিপুল পরিমাণে মূলধন রয়েছে, তা’ বিনিয়োগ করার আর কোনও পথ নেই।…….. তাই জমিদারীর বন্দোবস্ত নিশ্চিত (চিরস্থায়ী) করা হলে শিগগির উল্লেখিত সঞ্চিত মূলধন জমিদারী ক্রয়ে বিনিয়োগ হবে।”

লর্ড কর্নওয়ালিস-এর এই চিন্তাধারা ইংরেজদের দৃষ্টিকোণ থেকে সময়োপযোগী ও সঠিক ছিল। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করার সংগে সংগে দেওয়ানী, মুৎসুদ্দিগিরি, বেনিয়ানি এবং ব্যবসার মাধ্যমে কোলকাতার সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর হাতে যে বিপুল পরিমাণ মূলধন সঞ্চিত হয়েছিল, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তা’ জমিদারী ক্রয়ে বিনিয়োগ হতে শুরু করল। এই নব্য ধনীরা দলে দলে নতুন জমিদার শ্রেণীতে পরিণত হল।

লর্ড কর্নওয়ালিস এ সময় আর একটা ‘অর্থবহ’ পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তিনি জানতেন যে, প্রাচীন বনেদী জমিদাররা নির্দিষ্ট দিনক্ষণে রাজকোষে প্রাপ্য টাকা জমা দিতে অভ্যস্ত নয়। তাই সামান্যতম গাফিলতির দরুন এবং নতুন বন্দোবস্তের কড়া আইনের দরুন এসব জমিদারী একে একে নীলামে উঠতে লাগল। আর কোলকাতার নব্য ধনী মুৎসুদ্দি বেনিয়ানরা নীলাম থেকে এসব জমিদারী কিনে নতুন জমিদার হলেন।

ডব্লউ ডব্লউ হান্টার-এর (বেংগল এম এস রেকর্ড চার ভলিউম, লণ্ডন ১৮৯৪ : ১নং ভলিউম-ভূমিকা) বক্তব্য থেকে দেখা যায় যে, ১৭৯৬-৯৮ সালের মধ্যে ৫৫ লাখ ২১ হাজার ২৫২ টাকার রাজস্বওয়ালা জমিদারী নীলামের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এই টাকা মোট জমির প্রাপ্য খাজনার এক-পঞ্চমাংশের মতো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পরবর্তী ২২ বছরের মধ্যে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ থেকে অর্ধেক পরিমাণ জমিদারী নীলামে বিক্রির মাধ্যমে হস্তান্তর হয়। অর্থাৎ বনেদী জমিদারদের হাত থেকে নব্য ধনীদের নিকট হস্তান্তর হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ১৮০০ সালের মধ্যে দিনাজপুর রাজবংশের প্রায় সব সম্পত্তি নীলাম হয়ে যায়। ১৭৯৩ সালেই বাকী খাজনার দায়ে নাটোরের রাজাকে রাজবাড়ীতেই বন্দী করা হয়।

১৭৯৫ সালের ২৭শে মার্চ গভর্নর জেনারেল ইন কাউন্সিল-এর নিকট দাখিলকৃত সিলেক্ট কমিটির এক রিপোর্টে বলা হয়, “বাংলাদেশের বাকী রাজস্বের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই দু’জনের কাছে বাকী : বীরভূম ও রাজশাহীর জমিদার। সরকারী রাজস্ব থেকে নিজেদের ব্যভিচার ও বিলাসিতার জন্য প্রচুর অর্থ অপব্যয় করার দরুনই তাঁদের দেয় রাজস্ব তাঁরা দিতে পারেননি এবং তাদেরই বংশধরদের নির্দেশে জমিদারী থেকে তাঁদের বঞ্চিত করা হয়।”

কিন্তু একথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের এই নতুন গোত্রান্তরিত জমিদার গোষ্ঠীর চরিত্র বনেদী জমিদারদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তাঁদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এমনকি পোশাক-পরিচ্ছদ পর্যন্ত স্বতন্ত্র ছিল। নব্য জমিদাররা তাঁদের জমিদারীকে এক ধরনের ব্যবসা বলে মনে করতেন। তাই এঁরা নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য মধ্য স্বত্বভোগীদের বলগাহীন শোষনের লাইসেন্স প্রদান করল। এর ফলে গ্রাম-বাংলায় নতুন শ্রেণী বিন্যাসের সূচনা হল।

লর্ড কর্নওয়ালিসের আরও ধারণা ছিল যে, কোলকাতার ধনাঢ্য সুবর্ণ বণিক শ্রেণীর নব্য জমিদার হিসেবে গোত্রান্তর হলে এঁদের জীবনের নতুন প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি এবং এঁরা কর্মক্ষমতা হারিয়ে অতিরিক্ত অর্থ নতুন ধরনের বিলাসিতা এবং মামলা-মোকদ্দমায় ব্যয় করবে। কার্যক্ষেত্রে ইংরেজ শাসক গোষ্ঠীর চিন্তা খুবই বাস্তবমুখী বলে প্রমাণিত হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার পর এই নব্য জমিদাররা নিজেদের ব্যক্তিগত বিলাসিতা, যৌথ সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা এবং জমিদারীতে উদ্ধৃত প্রজাদের দমনে গুণ্ডা ও লাঠিয়াল বাহিনী ভাড়া করা ইত্যাদি ব্যাপারে কত লাখ লাখ টাকা যে ব্যয় করেছে তার কোনও সঠিক হিসাব পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এছাড়া অন্নপ্রাসন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ এবং নারী, মদ ও জুয়াখেলায় ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণও কেউ বলতে পারে না।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ায় স্বল্প দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশে প্রবর্তিত হলো জমির বর্গা প্রথা। এটাকেই উত্তরবংগ এলাকায় আধিয়ার প্রথা বলা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে এই প্রথা চালু হবার প্রাক্কালে বিত্তশালীরা বর্গাপ্রথার সুযোগে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে এক সংগে বহু জমি কিনে মালিকানা লাভ করলো। সে আমলে এ ধরনের জমির মালিকদের ‘লটদার’ বলা হতো। ‘লট’ হিসেবে জমি কিনতো বলেই এঁদের লটদার’ নামকরণ হয়েছে। পরবর্তীকালে এরাই হচ্ছেন গ্রামবাংলার প্রতিক্রিয়াশীল ‘কুলাক’ (রাশিয়ায় জারের আমলে বিত্তশালী কৃষকদের কুলাক মলা বলা হতো) সম্প্রদায়। এক কথায় গ্রামাঞ্চলের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘জোতদার শ্রেণী।

এখানে লক্ষণীয় এই যে, ১৯৫৫ সালে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ হলেও এই বর্গা প্রথা আজও পর্যন্ত বাংলাদেশে চালু রয়েছে। শুধুমাত্র ‘বর্গা প্রথা’কে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তেভাগা সংক্রান্ত কয়েকটি বিধি জারী করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে পরবর্তী প্রায় পৌনে দু’শ বছর পর্যন্ত এই বর্গা প্রথায় চাষের জন্য বাংলার কৃষকরা নির্মমভাবে শোষিত হয়েছে। আলোচ্য সময় শুধুমাত্র জমির মালিকানার বদৌলতে জোতদাররা উৎপন্ন ফসলের অর্ধেকটা লাভ করতো। অথচ চাষের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম থেকে শুরু করে কৃষি উপকরণ সবটাই ছিলো আধিয়ার কৃষকের দায়িত্ব। এর অন্যথা হলেই যথেচ্ছভাবে জমি থেকে বর্গাচাষীদের উচ্ছেদ করা হতো। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশে জোতদার শ্রেণী গঠনের গোড়ার কথা।

বাঙালি মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে দুঃসময়

মুসলমান বিত্তশালীরা নিজেদের হাত থেকে ইংরেজদের কাছে শাসনভার চলে যাওয়ার ‘অভিমানে’ এবং একশ্রেণীর ধর্মান্ধ মোল্লা মৌলভীদের প্ররোচণায় শাসক গোষ্ঠীর প্রতি কিছুটা ‘অসহযোগিতা’ প্রদর্শনের জের হিসেবে সযত্নে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখায় হিন্দু বণিক, সরকারী কর্মচারী এবং বিত্তশালীরা জমির মধ্যস্বত্ব লাভের সুযোগ পূর্ণভাবে গ্রহণ করে। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশে নতুন আর এক ধরনের ‘জমিদার শ্রেণী’ সৃষ্টির গোড়ার কথা। এই জমিদার শ্রেণী সৃষ্টি হওয়ার সংগে সংগে বাংলাদেশের সামাজিক পটভূমির ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এরই ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই, যেসব বাঙালি হিন্দু বিত্তশালীরা ভারতের তৎকালীন রাজধানী কোলকাতা নগরীতে ইংরেজদের অনুকরণে ব্যবসা ও শিল্প স্থাপনের প্রচেষ্টা করছিলেন, তাদের অনেকেই আবার জমির উপর প্রলুব্ধ হলেন এবং রাতারাতি জমিদার হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করলেন। এরই জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে দ্বারকানাথ ঠাকুর। ‘কার ঠাকুর কোম্পানী এবং রাণীগঞ্জ কোলিয়ারীতে মূলধন বিনিয়োগ করে যে দ্বারকানাথ ঠাকুর একসময় বিশিষ্ট শিল্পপতি হওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তিনিই শেষ পর্যন্ত জমিদারে পরিণত হলেন। তা’হলে সে আমলের সার্বিক সামাজিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলাদেশে প্রায় কয়েক দশক পর্যন্ত ‘অস্থিরতা আর ‘অরাজকতা’র পর ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নয়া সহযোগী হিসেবে স্থানীয়ভাবে বাঙালি শিক্ষিত হিন্দুদের মাঝ থেকে শহরভিত্তিক যে মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠতে শুরু করেছিলো, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মাঝ দিয়ে জমিদারী ও জোতদারী প্রথার প্রবর্তনের সংগে সংগে তা’ পূর্ণতাপ্রাপ্ত হলো। অবশ্য সমসাময়িককালেই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার এবং চাকরিজীবী প্রভৃতি পেশায় লিপ্ত (প্রায় সবাই হিন্দু) ব্যক্তিরা ইতিমধ্যে এই উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এ প্রসংগে একটা বিষয়ের দিকে সবারই দৃষ্টি আকর্ষণ করা অপরিহার্য বলে মনে করছি। অবিশ্বাস্য হলেও একথা সত্য যে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত বাংলার এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীতে মোটামুটিভাবে মুসলমানেরা অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমন এবং সুফী মনীষীদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু হওয়ার ছ’শ বছরের মধ্যে এটাই ছিলো বাংলার মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে দুঃসময়। মুসলমানদের হাত থেকে রাজ সিংহাসন চলে যাওয়ার বছর অর্থাৎ ১৭৫৭ সাল থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ বছর পর্যন্ত সময়কালকে বাংলার মুসলমানদের জন্য “অন্ধকার কাল” বলে চিহ্নিত করা যায়।

নীল দর্পণ নাটক ইংরেজীতে অনুবাদ করে পুস্তকাকারে প্রকাশ করায় যে সমাজ সংস্কারক রেভারেন্ড জেলং-এর জেল ও জরিমানা হয়েছিল, তিনি ১৮৬৯ সালের ২১শে জানুয়ারী বেংগল স্যোশাল সায়েন্স এসোসিয়েশনের অধিবেশনে তৎকালে বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করলেন। তিনি মন্তব্য করলেন, “জীর্ণ প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ এবং শোচনীয় সামাজিক দুরবস্থার দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এদেশের মুসলমানরা নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছেন। এক সময় যারা এত বড় একটা রাজ্য শাসন করেছেন, আজ তাঁদের বংশধররা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছেন। –বাংলাদেশের কোনও গভর্ণমেন্ট অফিসে উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারী বিশেষ দেখা যায় না; কিন্তু মুসসলমান দফতরী আর পিওন সব অফিসে ভরে গেছে।……..”

তাই অবস্থাদৃষ্টে একথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আলোচ্য শতাব্দীতে ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ বাঙালি হিন্দুরা যেভাবে সানন্দে গ্রহণ করেছিলো, বাঙালি মুসলমানরা সেভাবে করেনি। পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট মার্কসিস্ট গবেষক ও সমালোচক বিনয় ঘোষের মতে, “ক্ষমতাচ্যুত মুসলমান সমাজের ইংরেজ-বিদ্বেষ এবং নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে গোঁড়ামি ও গর্ববোধ থাকা তখন স্বাভাবিক। বাংলার মুসলমানদের নিজেদের শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্বন্ধে এই গোঁড়ামি, দম্ভ ও রক্ষণশীলতা এবং স্বাভাবিক ইংরেজ-বিদ্বেষের জন্য সে সময় ইংরেজের শিক্ষা ব্যবস্থা ও শাসন ব্যবস্থার প্রতি সহযোগিতার মনোভাব তাঁদের মধ্যে বিশেষ দেখা যায়নি। প্রথম যুগে ইংরেজদের সমস্ত কার্যকলাপ তাঁরা সন্দেহের চোখে দেখেছেন। ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তনও তারা সুনজরে দেখেননি। এই অসহযোগিতার ও গোঁড়ামির জন্যই তাঁরা শিক্ষা ও সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পিছনে পড়ে গেছেন।…… মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস ও বিদ্বেষভাব থাকার জন্য ইংরেজ শাসকরাও হিন্দুদের মতন শিক্ষার সুযোগ মুসলমানদের দেননি।

এ সম্পর্কে তিনি আরও মন্তব্য করেছেন, “প্রথম যুগে বৃটিশ গভর্ণমেন্টের নীতি মুসলমান-বিদ্বেষ এবং হিন্দু পক্ষপাতিত্বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। তাই হিন্দুরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ও উৎসাহ পেয়েছে, সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন এবং ইংরেজদের অধীনে কিছু কিছু মোটা বেতনের সরকারী চাকরিও পেয়েছেন। মুসলমানরা সেরকম সুযোগ বা উৎসাহ পাননি। নিজেদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে মিথ্যা অহংকার তাঁদের ছিল।….. ইংরেজদের নতুন জমিদারী ব্যবস্থার ফলে শুধু যে মুসলমান জমিদার-জায়গীরদারেরা ধ্বংস হয়ে গেলেন তা নয়, বাংলার যে কৃষক প্রজারা ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হল তাদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান বাংলার প্রায় প্রত্যেক জেলায় এই উৎখাত নিঃস্ব প্রজাদের ধূমায়িত বিক্ষোভ দস্যুবৃত্তি (?) ও কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করলো। সেই সময় এলো ওয়াহাবী আন্দোলনের ঢেউ। ধর্মান্দোলনের ঢেউ, কৃষক বিদ্রোহ, মুসলমান অভিজাত শ্রেণীর প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি ও ইংরেজ বিদ্বেষের এই সম্মিলিত প্রকাশকে বৃটিশ শাসকরা বৃটিশ-বিরোধী ‘জিহাদ’ বলে প্রচার করলেন।”

বাঙালি মুসলমানদের এই মনমানসিকতা সম্পর্কে লর্ড এলেনব্যুরোর মন্তব্য হচ্ছে, “ইংরেজদের প্রতি মুসলমানদের একটা জন্মগত বিদ্বেষ ও শত্রুতা আছে বলে আমার দৃঢ়-বিশ্বাস।” (প্রবলেমস্ অব ইণ্ডিয়াঃ সেলভনকরঃ পূঃ ২২)।

১৮৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারী কোলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘বেঙ্গল সোশ্যাল সাইন্স এসোসিয়েশন’-এর দ্বিতীয় অধিবেশনে জনাব এ লতিফ বাংলাদেশে মুসলমানদের শিক্ষার অবস্থা সম্পর্কে যে নিবন্ধ পাঠ করেন; সে সম্পর্কে আলোচনাকালে ইংরেজ বিচারপতি জে বি ফিয়ার-এর বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেন, “ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় থেকে এদেশের মুসলমান ভদ্রশ্রেণী লোকচক্ষে হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন। শিক্ষায় ও সামাজিক সম্মান লাভে তাঁরা শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রশ্রেণী থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে রয়েছেন। মুসলমান সম্প্রদায়ের এই পশ্চাদগতির রাজনৈতিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিতে বাধ্য।”

তাই এসময়কালের অবস্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, একদিকে ক্ষমতা হস্তচ্যূত হওয়ায় মুসলমান বিত্তশালীরা কিছুটা ‘আক্রোশ’ ও কিছুটা ‘অভিমানে’ ইংরেজ রাজশক্তি থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেছে এবং পাশ্চাত্য ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি সব কিছুকেই বর্জন করেছে; অন্যদিকে ‘অভিভাবকহীন বাংলার মুসলিম গণমানুষের নেতৃত্ব সবার অলক্ষ্যে এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলভীর (অনেকেই উত্তর ভারতীয় অঞ্চল থেকে আগত) কুক্ষিগত হয়েছে। এঁরা ইংরেজী শিক্ষার বিরুদ্ধে ‘ফতোয়া জারি এবং কয়েক শতাব্দী ধরে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ ঘোষণা করলো। সর্বোপরি এঁরা বাংলার মাটির সংগে সম্পর্কহীন এক ধরনের ‘জগা-খিচুড়ি ভাষা ও তমুদ্দুন’-এর প্রবর্তন করলো।

এতসব ঘটনা প্রবাহের আলোকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজ জীবনে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে এবং ইংরেজ পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সৃষ্টি হলো, বাঙালি মুসলিম শিক্ষিত ও বিত্তশালীরা অন্তত তার অন্তর্ভুক্ত হলো না। এজন্য কারা দায়ী সে কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ না করেও শুধু এটুকু মন্তব্য করা যথার্থ হবে যে, এটাই হচ্ছে বাস্তব ও ঐতিহাসিক সত্য। সে আমলের বাংলার এই নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণী কিছুতেই ধর্ম নিরপেক্ষ ছিলো না। অথচ ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার চৌহদ্দিতেই গড়ে উঠে নির্ভেজাল প্রকৃত জাতীয়তাবাদ।

বাংলার ইতিহাস পুংখানুপুংখভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে শুরু করে পুরো ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে কোলকাতা কেন্দ্রিক যে বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে, তাদের কর্ণধারেরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের দাবীদার হিসেবে যত কথাই বলে থাকুক না কেন, তা আসলে বাঙালি হিন্দু জাতীয়তাবাদের কথাবার্তা। এজন্যই তো ঔপন্যাসিক বঙ্কিম চন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র মূল সুরই হচ্ছে যবন-বিরোধী। সে আমলে এঁদের রচিত বাংলা সাহিত্যের সর্বত্রই ‘হিন্দুয়ানীর ঢক্কানিনাদ। ‘বন্দেমাতরম’ শ্লোগানের আড়ালে সামগ্রিকভাবে বাঙালি সমাজের দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পেতো। (পরবর্তীতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথসহ জনাকয়েক ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী। মানব প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী।)

সুষ্ঠু ও একটা পরিচ্ছন্ন আলোচনার সুবিধার্থেই বংগীয় এলাকায় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টির গোড়ার কথা এবং এঁদের বিকাশের ধারাবাহিকতার ইতিহাস সংক্ষেপে উপস্থাপিত করলাম। এই প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে যখন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোলকাতার বাসিন্দাদের ব্যাপক বিকাশের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তখন থেকেই এক শ্রেণীর বাঙালি শিক্ষিত হিন্দু বিদেশী রাজশক্তির সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। স্বল্প দিনের ব্যবধানে অত্যন্ত দ্রুত এরই ধারাবাহিকতার জের হিসেবে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী (এটাকেই জাতীয়তাবাদী বাঙালি মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা করা হয়।) পূর্ণতা লাভ করে।

আগেই উল্লেখ করেছি যে, মোটামুটিভাবে এর পেছনে চারটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমতঃ বিদেশী রাজশক্তির সংগে বাঙালি মুসলমানদের অসহযোগিতায় সৃষ্ট সুযোগ গ্রহণ। দ্বিতীয়তঃ নিরক্ষর ও অর্ধশিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর এক শ্রেণীর ধর্মান্ধ মোল্লা-মৌলভীদের ব্যাপক প্রভাব। তৃতীয়তঃ ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশ প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ায় নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটের সৃষ্টি এবং চতুর্থতঃ বর্গাচাষের ভিত্তিতে জোতদার প্রথার প্রবর্তনে গ্রামাঞ্চলে রাজশক্তির সমর্থক হিসেবে নতুন শক্তির সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন।

গবেষক বিনয় ঘোষের মতে, “১৮৭২-৭৩ সালের প্রশাসনিক রিপোর্টে দেখা যায় যে, মধ্যস্বত্বের বিস্তারের ফলে জমিদারীর সংখ্যা বাংলাদেশে দেড় লাখের বেশী হয়েছে, বিশ হাজার একরের উপরে বড় জমিদারীর সংখ্যা পাঁচশ’র কিছু বেশী, ত্রিশ হাজার থেকে পাঁচশ’ একরের মধ্যে মাঝারি জমিদারী প্রায় ষোল হাজার এবং পাঁচশ’ ও তার কম ছোটো জমিদারীর সংখ্যা দেড় লাখের কিছু কম। এর সঙ্গে যদি জমিদার-পত্তনিদার-জোতদারদের গোমস্তা নায়েব তহশীলদার পাইক দফাদার প্রভৃতি কর্মচারী ও ভৃত্যের সংখ্যা যোগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে ঊনিশ শতকের শেষ পর্বে বৃটিশ ভূমি রাজস্ব নীতির ফলে বাংলাদেশের গ্রাম্য সমাজে কমপক্ষে সাত-আট লাখ লোকের এমন একটি ‘শ্রেণী’ (সামাজিক ‘স্তরায়ন’) তৈরী হয়েছে, যে শ্রেণী বৃটিশ শাসকদের সুদৃঢ়. স্তম্ভস্বরূপ। অবশ্য সামাজিক শ্রেণী হিসেবে বলতে গেলে একটি শ্রেণী বলা যায় না, দু’টি শ্রেণী বলতে হয়— ‘একটি’ নতুন জমিদার শ্রেণী, আর একটি নতুন মধ্যস্বত্বভোগী ও গ্রাম্য মধ্য শ্রেণী। নামে দুই শ্রেণী হলেও, কাজ ও স্বার্থের দিক থেকে এদের চিন্তা-ভাবনা ও আচরণ এক শ্রেণীর মতোই।”

নব-সৃষ্ট হিন্দু মধ্য শ্রেণীর ভুয়া রেনেসাঁ

“-এ পাশে নাগরিক সমাজে, যেমন কোলকাতা শহরে, বৃটিশ শাসকরা তাদের বিশ্বাসভাজন আরও দু’টি শ্রেণী তৈরী করেছিলেন— একটি নতুন নাগরিক ধনিক শ্রেণী, আর একটি নতুন নাগরিক মধ্য শ্রেণী। এই মধ্যশ্রেণীর মধ্যে ছোটো ছোটো ব্যবসায়ী, দোকানদার, দালাল প্রভৃতির সংখ্যা অনেক, বাকী নানারকমের চাকরিজীবী। নাগরিক মধ্য শ্রেণীর একটি বিশেষ স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল বাঙালি ইংরেজী শিক্ষিত এলিট শ্রেণী। বৃটিশ আমলে বাঙালি সমাজের এই শ্রেণী রূপায়ণ নিশ্চয় একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং আগেকার পিরামিডের মতো স্তরিত সমাজের সঙ্গে এর পার্থক্য অনেক। আগে বলেছি, নবযুগের নতুন শ্রেণী বিন্যাস অচল নয়, সচল— ঊর্ধ্বাধঃ গতিশীল এবং সেই গতির প্রধান চালিকা শক্তি ‘টাকা’। টাকা সচল, শ্রেণীও তার ছন্দে সচল। বাঙালি সমাজে আঠারো ঊনিশ শতকে এ সত্যও নির্মম বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার জন্যই কি তাকে ‘রেনেসাঁস’ বলা যায়?”

পরবর্তীকালে অনেকেই ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার ‘এই নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত’ শ্রেণীর দ্রুত বিকাশকে পঞ্চদশ শতাব্দীর ইউরোপীয় কিংবা ষোড়শ শতাব্দীর ইংল্যান্ডের রেনেসাঁর সংগে তুলনা করে থাকেন। এঁদের মতে, বাংলার এই যুগই হচ্ছে ‘নব জাগরণের যুগ’। বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণী তখন ইংরেজী শিক্ষায় দীক্ষিত হতে শুরু করেছে – তাঁদের সম্মুখে তখন ‘পশ্চিমের নতুন দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে। মানববাদী দর্শনের সুচতুর আবরণে পাশ্চাত্যের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ছাড়াও আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি সব কিছুই এঁদের দৃষ্টিতে ‘সজীব ও মহান’। রেনেসাঁ আর নব-জাগরণের ধ্বজা উত্তোলন করে বাংলার বর্ধিষ্ণু বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী তখন ‘বাবু কালচারের পাশাপাশি ‘সাহেবী কালচার’কে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপকভাবে প্রয়াসী হয়েছে।

কিন্তু একটা কথা স্মরণ রাখা দরকার যে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৮ খৃষ্টাব্দে আক্রমণকারী দুর্ধর্ষ হিস্পানী আর্মাডাকে যখন ইংরেজরা পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়, তখন থেকেই তীব্র জাতীয়তাবাদ বোধের ভিত্তিতে সমগ্র ইংল্যাণ্ডে রেনেসাঁ বা নব-জাগরণের জোয়ার বয়ে যায়। ইংরেজদের এই নব জাগ্রত দেশপ্রেমের প্রতীক এবং এর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রাণী এলিজাবেথ।

তাই ইংল্যাণ্ডের রেনেসাঁর শুরু যেখানে হিস্পানী আর্মার্ডার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিজয়ের মাঝ দিয়ে; সেখানে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বাংলার নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রেনেসাঁর সূচনা হচ্ছে জাতির পরাজয়ের মাঝ দিয়ে। এই রেনেসাঁ বা নবজাগরণই হচ্ছে, কখনও পরোক্ষভাবে আবার কখনওবা নগ্নভাবে সাম্রাজ্যবাদী শাসক গোষ্ঠীর গুণকীর্তন করে। অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বলতে হয় যে, সে আমলে বাংলার মধ্যবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ‘নবজাগরণ’ হচ্ছে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সম্পূরক শক্তি হিসেবে। এই নবজাগরণের’ মোদ্দা কথাটাই হচ্ছে ‘বশ্যতা মেনে নিয়ে পরাধীনতার শৃংখল সুদৃঢ় করা

এ সম্পর্কে বিনয় ঘোষ ‘বাংলার নবজাগৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, “……বাংলার নতুন হিন্দু জমিদার শ্রেণী ও উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণীর সংগে আপোস করে, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সরকারী চাকরির মাধ্যমে নিম্নস্তরের উচ্ছিষ্ট দিয়ে সন্তুষ্ট করে। …… ইংরেজী শিক্ষার সুযোগ হিন্দুরা যেভাবে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন, মুসলমানেরা সেভাবে করেননি।” শ্রী ঘোষ সে আমলের হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকার সরাসরি সমালোচনা করতে সাহসী হননি। তিনি মোদ্দা কথাগুলো কিছুটা ঘুরিয়ে বলেছেন, “প্রধানতঃ বৃটিশ কূটকৌশলের জন্য এবং আংশিকভাবে মুসলমান সমাজের আত্মাভিমান, অসহযোগিতা ও গোড়ামির ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে হিন্দুদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, বুদ্ধিজীবীরা এই সামগ্রিক বিষয়টাকেই ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ অর্থাৎ নবজাগরণ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ভ্রমাত্মক আদর্শ কোনও ইজম-এর সুদৃঢ় ভিত্তি হতে পারে না

সে আমলের এই মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ ‘বাঙালি হিন্দুয়ানীকেই” ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলো বলে এক রকম নিশ্চিত হয়েছিলো। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বংগভংগ আন্দোলন পর্যন্ত এই চিন্তাধারা অনেকের কাছেই সঠিক বলে বিবেচিত হয়েছে।

কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, বাস্তবে এই ব্যাপারটা কত ‘নাজুক’ ও ‘ঠুনকো’ ছিলো। একটা ভ্রমাত্মক আদর্শ কোনও ইজম-এর জন্য সুদৃঢ়. ভিত্তি হতে পারে না। প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে “বাংগালি হিন্দুয়ানীকেই’ ‘বাংগালি জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টাকে বিলীন করতে ‘অপরিপক্ক’ প্রতিপক্ষের চার যুগের বেশী সময়ের প্রয়োজন হলো না। প্রথম পর্যায়ে ধর্মীয় শ্লোগান উচ্চারণ করে এই প্রতিপক্ষ ‘বাংগালি হিন্দুয়ানীকে’ পদ্মার ওপারে বিশাল অবাংগালি জনসমুদ্রে ঠেলে দিলো। আর দ্বিতীয় পর্যায়ে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিপক্ষ মাত্র ২৪ বছরের ব্যবধানে নির্ভেজাল বাঙালি জাতীয়তাবাদের শ্লোগান উচ্চারণ করে রক্তাক্ত পথে ধর্মান্ধদের হটিয়ে দিয়ে পৃথক আবাসভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করলো।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এই গাংগের বদ্বীপ এলাকার পুরো জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৮৮ ভাগই ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে এখানকার দ্রুত সৃষ্ট নয়া মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী সমাজে এর কিছুটা স্পর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। তবুও একথা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, প্রচন্ড বাধা-বিপত্তির দুর্গম পথ অতিক্রম করে প্রকৃত ও পরিপূর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ এই বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। এটাই হচ্ছে ইতিহাসের অমোঘ নির্দেশ। এখন বাংলাদেশে প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের শৈশবকাল চলছে। অবশ্য টাকার এপিঠে বাঙালি হিন্দুয়ানীর মতো ওপিঠের বাঙালি মুসলমানীর’ প্রবক্তারা মাঝে মাঝে কিছুটা ‘ধূলিঝড়ের সৃষ্টি করবে বৈকি! কিন্তু তা হচ্ছে নিতান্তই সাময়িক। বাংলাদেশের তরুণ সমাজই এদের মোকাবেলা করে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করতে সক্ষম।

বাঙালি হিন্দু পরিচালিত তৎকালীন সংবাদপত্রের নিন্দনীয় ভূমিকা

যা হোক, অত্র নিবন্ধে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়কাল থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত দেড়শত বছরে বঙ্গীয় এলাকায় বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সৃষ্টির অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সংক্ষিপ্ত আকারে কিছুটা উপস্থাপিত করেছি। এক্ষণে আলোচ্য সময়ে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কর্মকাণ্ড এবং বিরাজমান মনমানসিকতা অনুধাবনের লক্ষ্যে তথ্য ভিত্তিক আলোচনা অপরিহার্য মনে করছি।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অর্থাৎ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত বাঙালিত্বের দাবীদার কোলকাতা কেন্দ্রিক বর্ণহিন্দু এই বুদ্ধিজীবী সমাজ নিজেদের শ্রেণী স্বার্থে কিভাবে ইংরেজ পরাশক্তির ‘লেজুড়’ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে তা বিশেষভাবে লক্ষণীয় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আদর্শ দেশপ্রেম আর রেনেসাঁর কথা-বার্তা বলে এরা যত ধূলিঝড়ের-ই সৃষ্টি করুক না কেন এ কথা আজ় গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী আলোচ্য সময়ে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে গণমানুষের আন্দোলনে নেতৃত্বদান কিংবা “ভ্যানগার্ড’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমস্ত প্রচেষ্টাকে হয় এঁরা বিদ্রুপ করেছে— না হয় উলংগভাবে বিরোধিতা করেছে।

এই প্রেক্ষিতে প্রথমেই কোলকাতা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন সংবাদপত্রের ভূমিকার কথা উল্লেখ করতে হয়। সে আমলে অবিভক্ত বাংলার ‘কৃষক বিদ্রোহ”, ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কিংবা ‘নীলচাষীদের বিদ্রোহ’ কোনটাকেই এসব পত্র-পত্রিকা সুনজরে দেখেনি। সর্বত্রই শ্রেণী স্বার্থ রক্ষার উদগ্র বাসনায় এসব সংবাদপত্রের পরাশক্তির সমর্থক হিসেবে অতি নিন্দনীয় ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়। সংবাদপত্রে সমাজের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’র সময়ে কোলকাতার সংবাদগুলোতে সিপাহীদের এসব কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মন-মানসিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা ইংরেজের প্রতি দাসসুলভ মনোভাবের পরিচায়ক বলে উল্লেখ করা যায়।

সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েশনের অন্যতম নেতা শ্রীযুক্ত দক্ষিণামোহন মুখোপাধ্যায়ের সুস্পষ্ট মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। “যে হতভাগ্যরা ‘ এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণের মারফত যাঁদের অস্ত্রধারণপূর্বক নিজেদের মানব জীবনের অবমাননা করেছেন অথচ এঁদেরই পূর্বসুরীদের রাজত্বকালে এসব হতভাগ্যরা এবং এদের পূর্ব-পুরুষরা গত একশ’ বছর ধরে জীবন ও ধন-সম্পত্তির নিরাপত্তার জন্য কৃতজ্ঞতাবোধ করেছেন এবং গত দশ শতাব্দীর মধ্যে আমাদের সৌভাগ্যের দরুন সর্বোৎকৃষ্ট হিসেবে বিবেচিত যাদের রাজত্বে আমরা বসবাস করছি; আমি নিজেকে আমাদের সমাজের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে এবং যে সমাজের প্রতিটি সদস্যই দেশবাসীর মনোভাব সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ও যাঁরা মহারাণীর দেশীয় প্রজাসাধারণের অধিকাংশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করছেন, আমি তাঁদেরই একজন হিসেবে সবার জন্য প্রযোজ্য একটা কথা সোচ্চার করে উচ্চারণ করতে চাই যে, সরকার আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে কোনও রকম হস্তক্ষেপ করেনি এবং এতে করে সরকারের শত্রুদের এমন কোন যুক্তি নেই যাতে আনুগত্যের ক্ষেত্রে শিথিলতার উদ্রেক হতে পারে।”

ঝাঁসির রাণীকে ‘কুলটা’ বলে ভর্ৎসনা

সে আমলের বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের শ্রেণী স্বার্থের পক্ষে দক্ষিণামোহন মুখোপাধ্যায় অকাট্য সত্য ভাষণ করেছেন। এসময় সাময়িকভাবে হলেও কবি ঈশ্বর গুপ্তের মতো ব্যক্তিত্বের চিন্তাধারাও দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলো। তিনি ঝাঁসির রাণীকে ‘কুলটা’ বলে ভর্ৎসনা করলেন।

সার্বিকভাবে বলতে হলে, এ সময় কোনও কোনও বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী ভিন্ন মত পোষণ করলেও তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় নেহাৎই নগণ্য এবং সিপাহী বিদ্রোহ সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে ব্যাপকভাবে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল।

এ সম্পর্কে বিশিষ্ট মনীষী শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের মন্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় লিখলেন, ‘সিপাহী বিদ্রোহের উত্তেজনার মধ্যে বংগদেশের ও সমাজের এক মহোপকার সাধিত হইল, এক নবশক্তির সূচনা হইল, এক নব আকাঙ্ক্ষা জাতীয় জীবনে জাগিল’। (রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বংগ সমাজ)

ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড থমসন এবং জি টি গ্রান্ট যৌথভাবে তাঁদের রচিত ‘রাইজ এ্যান্ড ফুলফিলমেন্ট অব বৃটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া’ (এলাহাবাদ ১৯৬২) গ্রন্থে যথার্থভাবে মন্তব্য করেছেন, “সিপাহী যুদ্ধের মত সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা যখন দূরে সরে যাচ্ছে মনে হলো, তখন ভারতবাসীর এক বিরাট অংশ বৃটিশ শাসনকে স্থায়ীভাবে গ্রহণ করলেন এবং এই নতুন শাসকদের সংগে সহযোগিতা করে বা তাদের উপর প্রভাব বিস্তার করে কি উপায়ে নিজেদের এবং বংশধরদের উন্নতি হতে পারে তারই চেষ্টা শুরু করলো।”

আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তৎকালীন বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কর্ণধারেরা শিক্ষিত সমাজের মধ্যে বিরাজমান মনমানসিকতাকে মধ্যযুগের ইউরোপীয় রেনেসাঁর অনুকরণে আমাদের দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁ বা ‘মানববাদী জীবনাদর্শের নব জাগরণ’ হিসেবে মাখ্যায়িত করলো। অথচ এই নব জাগরণের শুরুটা হচ্ছে পরাধীনতার সুদৃঢ়. বন্ধনে।

১৮৫৭ সালের জানুয়ারী মাসে সিপাহী বিদ্রোহের প্রথমে সূত্রপাত হয় বহরমপুর ও ব্যারাকপুরে। এরপর এই বিদ্রোহ দ্রুত সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়লে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও জলপাইগুড়ির সৈন্য ছাউনিতে এই বিদ্রোহের বহ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হয়। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, এই সিপাহী বিদ্রোহ কোন অবস্থাতেও সে আমলে কোলকাতা কেদিদরক বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলের সামান্যতম সমর্থন লাভ করেনি। বরং এই বিদ্রোহ তৎকালীন বুদ্ধিজীবী মহলের ‘বিরক্তির কারণ হয়েছিলো।

সম্প্রতি এ সম্পর্কে মূল্যায়ন করে ঐতিহাসিক রমেশ চন্দ্র মজুমদার মহাশয় মন্তব্য করেছেন, “বাংলাদেশের জনসাধারণ বিদ্রোহী সিপাহীদের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখায় নাই। তৎকালীন শিক্ষিত সমাজও ইহাকে কোনও জাতীয় অভ্যুত্থান বা ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রাম বলে মনে করে নাই।” (বাংলাদেশের ইতিহাস আধুনিক যুগঃ রমেশ চন্দ্র মজুমদার ১৩৭৮)।

যে যুগের প্রখ্যাত কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় ১৮৫৭ সালের ২০শে জুন তারিখে প্রকাশিত মন্তব্যে বলা হয় যে, “কয়েক দল অধার্মিক অবাধ্য অকৃতজ্ঞ হিতাহিত-বিবেচনাবিহীন এতদ্দেশী সেনা অধার্মিকতা প্রকাশপূর্বক রাজবিদ্রোহী হওয়াতে রাজ্যবাসী শান্ত স্বভাব অধন সধন প্রজামাত্রেই দিবা-রাত্র জগদীশ্বরের নিকট এই প্ৰাৰ্থনা করিতেছেন, — এই দন্ডেই হিন্দুস্থানে পূর্ববৎ শান্তি স্থাপিত হউক। হে বিঘ্নহর! তুমি সমুদয় বিঘ্নহর, সকল উপদ্রব নিবারণ কর….. যাহারা গোপনে গোপনে অথবা প্রকাশ্যরূপে এই বিষমতর অনিষ্ট ঘটনার ঘটক হইয়া উল্লেখিত জ্ঞানান্ধ সেনাগণকে কুচক্রের দ্বারা কুপরামর্শ প্রদান করিয়াছে ও করিতেছেন তাহাদিগ্যে দন্ডদান কর। তাহারা অবিলম্বেই আপনাপন অপরাধ বৃক্ষের ফল ভোগ করুক।” বৃটিশদের মতো একটা পরাশক্তির পক্ষে এর চেয়ে বড় ধরনের দালালী আর কি হতে পারে?

এখানেই শেষ নয়। সে আমলের কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী মহলের মনমানসিকতার প্রতিধ্বনি করে ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার সম্পাদক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মহাশয় আরও লিখলেন, “এই রাজই (ইংরেজ রাজত্ব) তো রাম রাজ্যের ন্যায় সুখের রাজত্ব হইয়াছে, আমরা যথার্থরূপ স্বাধীনতা সহযোগে পদ, মত্ত বিদ্যা এবং ধর্ম, কর্মাদি সকল প্রকার সাংসারিক সুখে সুখি হইয়াছি, কোন বিষয়েই ক্লেশের লেশমাত্র জানিতে পারি না, জননীর নিকট পুত্রেরা লালিত পালিত হইয়া যদ্রুপ উৎসাহে ও সাহসে অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া অন্তকরণে কৃতার্থ করেন, আমরাও অবিকল সেইরূপে পৃথিবীশ্বরী ইংলন্ডেশ্বরী জননীর নিকটে পুত্রের ন্যায় প্রতিপালিত হইয়া সর্বমতে চরিতার্থ হইতেছি।”

একই দিনে (২০শে জুন ১৮৫৭) পন্ডিত গৌরী শংকর ভট্টাচার্য সম্পাদিত এবং কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সম্বাদ ভাস্কর’ পত্রিকার মন্তব্য আরও ভয়াবহ, চাঞ্চল্যকর ও লজ্জাকর। সম্পাদক পন্ডিত গৌরী শংকর লিখেছেন, “হে পাঠক সকল, ঊর্ধবাহু হইয়া পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া জয় ধ্বনি করিতে করিতে নৃত্য কর…….. আমাদিগের প্রধান সেনাপতি মহাশয় সসজ্জ হইয়া দিল্লী প্রদেশে প্রবেশ করিয়াছেন, শত্রুদিগের মোর্চা শিবিরাদি ছিন্ন ভিন্ন করিয়া দিয়াছেন, তাহারা বাহিরে যুদ্ধে আসিয়াছিল আমাদের তোপমুখে অসংখ্য লোক নিহত হইয়াছে, রাজসৈন্যরা ন্যূনাধিক ৪০ তোপ এবং শিবিরাদি কাড়িয়া লইয়াছেন, হতাবশিষ্ট পাপিষ্ঠারা দুর্গ প্রবিষ্ট হইয়া কপাট রুদ্ধ করিয়াছে। আমাদের সৈন্যরা দিল্লীর প্রাচীরে উঠিয়া নৃত্য করিতেছে।

এছাড়াও তৎকালীন বৃটিশ ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন এবং বাঙালি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মধ্যে কিশোরী চাঁদ মিত্র, শম্ভু চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেছেন যে, ‘সিপাহী বিদ্রোহ হচ্ছে সিপাহীদের ব্যাপার এবং এর সংগে জনসাধারণের কোনই সম্পর্ক নেই।’ আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বুদ্ধিজীবী মহলের কেউই এমনকি পরোক্ষভাবেও সিপাহী বিদ্রোহের পক্ষে কোনও কথাই বলেননি। আধুনিক যুগের ভাষায় এঁদের ‘হিন্দু রাজাকার’ নামে আখ্যায়িত করা যায়।

এক্ষণে সমসাময়িককালে বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারা এবং মনমানসিকতা অনুধাবন করার লক্ষ্যে সে আমলের নাট্য আন্দোলন ও এতদসম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়াদির প্রতি লক্ষ্য করা বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে প্রথমেই দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ নাটক এবং মীর মোশারফ হোসেনের জমিদার দর্পণ নাটকের কথা বলতে হয়। এই দু’টি নাটকের রচনার ইতিহাস এবং তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করলেই, সে আমলের বুদ্ধিজীবী সমাজের দাস সুলভ মনোভাব উপলব্ধি করা সম্ভব হবে। প্রথমেই বলে রাখা দরকার যে, ‘নীল দর্পণ’ নাটকের পরিণতি হতাশাব্যঞ্জক এবং নাটকটি সংস্কারপন্থী। ‘জমিদার দর্পণ’ নাটকটি সিরাজগঞ্জে ১৮৭২-৭৩ সালে রক্তাক্ত কৃষক বিদ্রোহের সময় রচিত হলেও এতে কোন বিদ্রোহী কৃষকের চরিত্র পর্যন্ত নেই এবং নাটকটির পরিণতি নৈরাশ্যজনক। তবুও তৎকালীন কোলকাতা কেন্দ্ৰিক বুদ্ধিজীবী সমাজ এ দু’টো নাটকের একটিকেও সহ্য করতে পারেনি।

অধ্যায় ১ / ১৬

সকল অধ্যায়

১. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১
২. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ২
৩. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৩
৪. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৪
৫. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৫
৬. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৬
৭. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৭
৮. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৮
৯. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ৯
১০. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১০
১১. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১১
১২. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১২
১৩. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১৩
১৪. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১৪
১৫. কোলকাতা কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ
১৬. কোলকাতা কেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবী – ১৬

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন