১৫. ধর্মাতের যুদ্ধে মহারাজা যশোবন্ত সিংহ

কালিকারঞ্জন কানুনগো

পঞ্চদশ অধ্যায় – ধর্মাতের যুদ্ধে মহারাজা যশোবন্ত সিংহ

ঈর্ষাপরায়ণ গুপ্তশত্রু কাসিম খাঁর ন্যায় জগদ্দল পাথর বুকে চাপাইয়া সম্রাট শাহজাহান মহারাজা যশোবন্তকে ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ মালব-সীমান্তে আওরঙ্গজেব ও মোরাদকে বাধা দেওয়ার জন্য দক্ষিণ দিকে প্রেরণ করিয়াছিলেন (ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ১৬৫৭ খ্রিঃ)। সেনাপতিদ্বয়ের উপর প্রকাশ্য হুকুম ছিল তাঁহারা একযোগে কাজ করিবেন, পারতপক্ষে রক্তপাত ঘটাইবেন না। অধস্তন সেনানীমণ্ডলী এবং সাধারণ সৈনিকগণ প্রথম হইতেই মনে করিয়াছিল এই অভিযানে যুদ্ধের আশঙ্কা নাই; হয়তো কিঞ্চিৎ হৈ-হল্লা হইবে মাত্র, বাদশাহী ফরমান পৌঁছিলেই আওরঙ্গজেব-মোরাদ ভড়কাইয়া যাইবেন।

মালব-অভিযানের মুখ্য সেনাপতি মহারাজ যশোবন্ত (জন্ম ডিসেম্বর ১৬২৬ খ্রিঃ)। এই সময়ে ত্রিশ অতিক্রম করিয়া মাত্র একত্রিশে পা বাড়াইয়াছেন; সুতরাং সেকালের দরবারী বয়সের পরিমাপে তিনি নাবালক, প্রথম শ্রেণীর পক্ককেশ আমীরগণের কৃপাকুটিল বক্রদৃষ্টিতে মাতৃ-অঙ্কশায়ী শিশু। বারো বৎসর বয়সে মাড়বার রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়া মহারাজা যশোবন্ত মোগল-দরবারে সামত্তমণ্ডলীর মধ্যে ক্রমশ উচ্চতম মনসবের অধিকারী হইয়াছিলেন, প্রতিষ্ঠা ও শৌর্যে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁহার পশ্চাতে রহিয়াছে রাঠোরকুলের লক্ষ তরবারির উন্মুক্ত তেজোদৃপ্ত গৌরবচ্ছটা।

মহারাজা যশোবন্ত ও কাসিম খাঁ পরিচালিত সেনাবাহিনী আগ্রা হইতে মামুলি চালে কুচ করিয়া প্রায় দুই মাস পরে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে (১৬৫৮ খ্রিঃ) শিপ্রাতীরে উপস্থিত হইল। আওরঙ্গজেব তখনও বহু দূরে—খান্দেশের রাজধানী বুরহানপুর অতিক্রম করেন নাই। নর্মদার দক্ষিণ তীর হইতে কোনও সংবাদ বাদশাহী ফৌজের কাছে পৌঁছবার সর্ববিধ উপায় অনাগতবিধাতা আওরঙ্গজেব অনেক পূর্বেই বন্ধ করিয়াছিলেন, অথচ কাসিম খাঁ ও যশোবত্তের গতিবিধি তাঁহার নিকট প্রত্যক্ষবৎ, যেহেতু তাঁহার চরের দুরবীনের পাল্লায় আগ্রাই ছিল নিকটতম স্থান। যুদ্ধ করিতে আসিয়া যশোবন্ত অকূল পাথারে পড়িলেন, শত্রু কোথায় কখন এবং কোন্ পথে আসিবে তিনি ভাবিয়া পাইলেন না; বাদশাহী হরকরা বা গুপ্তচরসমূহ তাঁহাকে কোনও নির্ভরযোগ্য সংবাদ দিতে পারিল না। একবার পশ্চিমে, একবার দক্ষিণে লক্ষ্যহীনভাবে কুচ করিয়া বাদশাহী ফৌজ হয়রান হইয়া গেল; যশোবন্ত উজ্জয়িনীতে শিবির স্থাপন করিয়া শত্রুর আগমন প্রতীক্ষা করাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা অবশেষে করিলেন।

বিন্ধ্যপর্বতের যে বিচ্ছিন্ন বাহু গুজরাটের পূর্বসীমান্ত হইতে নর্মদা নদীকে বরাবর প্রায় ২০/২৫ মাইল দক্ষিণে রাখিয়া পূর্ব দিকে ধারা নগরী পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে এবং আবার দক্ষিণ দিকে মাণ্ডু শহর ছাড়াইয়া প্রায় পুনরায় নর্মদার কাছে পৌঁছিয়াছে, তাহার অনতিদূরে নদীর দক্ষিণ তীরে আকবরপুরের ঘাট, আকবরপুর হইতে দাক্ষিণাত্যের প্রধান রাস্তা মাণ্ডু, ধারা ও উজ্জয়িনী হইয়া ঢোলপুরে চম্বল নদী পার হইয়া আগ্রা পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। আকবরপুর হইতে মাণ্ডু প্রায় সোজা উত্তরে আনুমানিক বিশ মাইল; মাণ্ডুর ১৬/১৭ মাইল উত্তরে ধারা নগরী এবং ধারা ও উজ্জয়িনীর ব্যবধান প্রায় পঞ্চাশ মাইল, গুজরাট হইতে দোহদ হইয়া বাদশাহী সড়ক বহু ব্যবধানে ঈষৎ উত্তর-পূর্ব হইয়া উজ্জয়িনী পৌঁছিয়াছে। কোন্ বুদ্ধিতে যশোবন্ত সুদূর উজ্জয়িনীতে ঘাঁটি স্থাপন করিয়া আওরঙ্গজেব ও মোরাদকে ঠেকাইবেন ভাবিয়াছিলেন বলা যায় না। তাঁহার প্রধান শিবির মাণ্ডুর কাছে থাকিলে তিনি হয়তো আওরঙ্গজেবকে নর্মদা তীরে আটকাইয়া মোরাদকে একাকী যুদ্ধ করিবার জন্য বাধ্য করিতে পারিতেন। যশোবন্ত মাণ্ডুর ফৌজদার রাজা শিবরামের উপর নর্মদা তীরে পাহারার ভার অর্পণ করিয়া এবং মাণ্ডু ও ধারার মধ্যবর্তী স্থানে কয়েকটি থানা বসাইয়া উজ্জয়িনীতে নিশ্চেষ্ট হইয়া রহিলেন, অথচ এই চালে যুদ্ধের পূর্বেই তিনি পরাজয় বরণ করিয়া লইয়াছেন এই কথা বুঝিতে পারিলেন না।

আওরঙ্গজেব বিনা বাধায় দাক্ষিণাত্য বাহিনীকে নর্মদা পার করাইয়া (৩রা এপ্রিল ১৬৫৮ ) মাণ্ডু ও ধারা অধিকার করিলেন; ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বাদশাহী থানা জোয়ারের মুখে বালির বাঁধের ন্যায় ভাসিয়া গেল। রাজা শিবরামের ভগ্নদূত যশোবন্তের শিবিরে পৌঁছিবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আওরঙ্গজেবের অগ্রগামী সেনাদল উজ্জয়িনীর বিশ মাইলের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছিল। তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য যশোবন্ত ও কাসিম খাঁ উজ্জয়িনীর ঈষৎ পশ্চিম-দক্ষিণে ১৪ মাইল দূরে ধর্মাত (বর্তমান ফতেয়াবাদ) নামক স্থানে যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইলেন। গুজরাট বাহিনীর কোনও সংবাদ তখন পর্যন্ত যশোবন্তের কাছে পৌঁছায় নাই; পরে শুনিলেন শাহজাদা মোরাদ ধর্মাত হইতে মাত্র এক মঞ্জিল (৫/৬ মাইল) ব্যবধানে বাদশাহী ফৌজের কান ঘেঁষিয়া দক্ষিণ দিকে চলিয়া গিয়াছেন এবং ১৪ই এপ্রিল চম্বলের উপনদী গম্ভীরার পশ্চিম তীরে আওরঙ্গজেবের সহিত একত্র হইয়া যুদ্ধের আয়োজন করিতেছেন।

খোলা ময়দানে অবিলম্বে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ না করিয়া আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করিবার জন্য মহারাজা যশোবন্ত এমন এক স্থানে সেনাব্যূহ স্থাপন করিলেন যেখানে তাঁহার প্রধান ভরসা অশ্বারোহীবাহিনীর গতিবেগ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ এবং যুদ্ধকৌশল নিষ্ক্রিয় হইয়া পড়িল। ধর্মাত বা বর্তমানে ফতেয়াবাদের কিঞ্চিৎ পশ্চিমে নিম্নভূমির মধ্যভাগে একটি দ্বীপের মতো অপরিসর উচ্চভূমিতে ঠাসাঠাসি ভাবে বাদশাহী তোপখানা ও অশ্বারোহী স্থান গ্রহণ করিয়াছিল। ইহার প্রায় তিন দিক জলাভূমিবেষ্টিত। ব্যূহের আশেপাশে যে জায়গায় ফাঁক ছিল, নৈশ আক্রমণের ভয়ে সে জায়গায় পরিখা খনন করিয়া ১৪ই এপ্রিল দিবাভাগে উহা শত্রুর পক্ষে দুর্ভেদ্য করা হইয়াছিল। ইহাই হইল যেন বোতলের পেটে প্রবিষ্ট যশোবন্তের স্বখাতসলিলে ডুবিবার ব্যবস্থা। সম্মুখে সংকীর্ণ নির্গম পথে বাদশাহী তোপখানা পথ আগলাইয়া রহিল, উহার পশ্চাতে সুসজ্জিত বাদশাহী হরাবল বা অগ্রগামী অশ্বাদি। প্রধানত তোপখানার উপর ভরসা করিয়া বোধ হয় কাসিম খাঁর পরামর্শে যশোবন্ত এইরূপ স্থানে সৈন্যসজ্জা করিয়াছিলেন; কিন্তু সিংহের নিরাপত্তা ও বিক্রম গুহার বাইরে অন্তহীন অরণ্যানীর মধ্যে, ভিতরে পশুরাজের অসহায় অবস্থা। আওরঙ্গজেব বুঝিলেন রাজপুত বরাহ ভয়ভীত হইয়া মরণের ফাঁদে পা দিয়াছে।

যুদ্ধের পূর্বদিনেই ধীরবুদ্ধি সুচতুর যোদ্ধা আওরঙ্গজেব সম্মিলিত গুজরাট ও দাক্ষিণাত্য সেনাবাহিনীকে দাবার গুটির মতো যুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে বিভিন্ন সেনানায়কগণের স্থান ও সৈন্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করিয়া সাজাইয়া রাখিলেন। আওরঙ্গজেবের বিরাট তোপখানা ব্যূহমুখে কিঞ্চিৎ অগ্রগামী স্থানে স্থাপিত হইয়া রাজপুতবাহিনীকে সন্ত্রস্ত ও ছত্রভঙ্গ করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া রহিল। অবস্থা সঙ্গীন দেখিয়া মহারাজা যশোবন্তের সামন্ত প্রধান অসকরণ ১৪ই এপ্রিল সন্ধ্যার পরে তাঁহার সহিত গোপনে সাক্ষাৎ করিয়া নিবেদন করিলেন মহারাজ, শাহজাদাদ্বয় আমাদের মুখোমুখি তাঁহাদের তোপখানা খাড়া করিয়াছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে রাজপুত স্ত্রীপুত্রের মায়া কিংবা নিজের প্রাণের মমতা রাখে না এই কথা আপনার অজানা নয়, যদি অনুমতি হয় আমরা চারি সহস্র রাজপুত সহায় করিয়া মধ্যরাত্রে অতর্কিত আক্রমণে ওই তোপখানা অধিকার করিব। যশোবন্ত উত্তর দিলেন, “ছলকৌশলে রাত্রির অন্ধকারে শত্রুকে বধ করা বীরধর্ম নহে; উহা রাজপুত পৌরুষের অবমাননা।” পরের দিন প্রকাশ্য দিবালোকে অগ্নিবর্ষণ উপেক্ষা করিয়া রাজপুতের অসি যে কার্য সাধন করিয়াও যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারিল না, সেই কাজ রাত্রিকালে সম্পন্ন করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল এবং তোপখানা ধ্বংস হইলে আওরঙ্গজেব ওইস্থানে হয়তো যুদ্ধই করিতেন না। মহারাজ যশোবত্তের প্রাচীন ক্ষত্রিয়োচিত উক্তি আর্যধর্ম হইতে পারে, কিন্তু ইসলামের অনুশাসন উহার সম্পূর্ণ বিপরীত, যুদ্ধে কোন কার্যই পাপ কিংবা বিধিবিগর্হিত নহে। আসল কথা, রাজপুতানার ইতিহাসে ভীষ্ম ভীম অভিমন্যু পাওয়া যায়, কিন্তু পার্থসারথি নাই; এই জন্যই মধ্যযুগে হিন্দু কোনও কুরুক্ষেত্র-জয়ও করিতে পারে নাই।

১৫ই এপ্রিল সূর্যোদয়ে রণদামামা বাজিয়া উঠিল। নিজ বাহিনীকে নিখুঁত বাবরশাহী কায়দায় ব্যূহবদ্ধ করিয়া আওরঙ্গজেব ধর্মাতের যুদ্ধক্ষেত্রে পানিপথ খানোয়ার পুনরভিনয় করিতে চলিলেন। উভয় পক্ষে সেনাবল সমান, প্রত্যেক পক্ষে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী; কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রে যোদ্ধার মনোবল ও সেনাপতিত্বে আওরঙ্গজেবের বাহিনী বাদশাহী ফৌজ অপেক্ষা প্রবল। সমর ব্যূহের কেন্দ্রস্থলে বর্মাচ্ছাদিত গজপৃষ্ঠে স্বয়ং আওরঙ্গজেব; কেন্দ্রভাগের দক্ষিণ ও বামপার্শ্বে রহিল যথাক্রমে সাহসী ও বিশ্বস্ত সেনানায়ক শেখমীর এবং সফশিকন খাঁর নেতৃত্বে পার্ফিরক্ষক অশ্বারোহী সৈন্য। ভীমকর্মা মোরাদ বক্‌স মূল বাহিনীর দক্ষিণ পক্ষ (right wing) এবং নামমাত্র অধিনায়ক আওরঙ্গজেবের বালক-পুত্র আজমের উপদেষ্টা স্বরূপ মূল তফাত খাঁ বামপক্ষ পরিচালনা করিতেছিলেন। কেন্দ্রভাগের কিঞ্চিৎ অগ্রভাগে উহার পর্দাস্বরূপ ইল্লিমিশ বা অগ্রগামী সহায়কসেনা; আওরঙ্গজেবের দেহরক্ষী সৈন্য লইয়া মূর্তাজা খাঁর নেতৃত্বে এই দল যুদ্ধার্থ প্রস্তুত রহিল। ইল্লিমিশ সেনার পুরোভাগে অষ্ট সহস্র রণকুশল বর্মাবৃত অশ্বারোহী পরিবৃত আওরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদ সুলতান হরাবল বা ব্যূহমুখ পরিচালনার ভার গ্রহণ করিলেন। এই হরাবল অশ্বযোদ্ধা লইয়া গঠিত হইলেও হামলার প্রথম ধাক্কা সামলাইবার জন্য ইহার সঙ্গে কয়েকটা কামান ও যুদ্ধহস্তী দেওয়া হইয়াছিল। বিশাল দত্তযুগলে সুশাণিত তরবারি বদ্ধ, শুশুদ্বারা ভল্লযুদ্ধে শিক্ষিত, মনুষ্য-মাংস-স্বাদোন্মত্ত পৃষ্ঠে হাওদার মধ্যে বন্দুকধারী যোদ্ধা রক্ষিত, সর্বাঙ্গ লোহার সাজে সুসজ্জিত রণহস্তী এযুগের অভেদ্য ট্যাঙ্কের ন্যায় সেকালের যুদ্ধে নিজপক্ষে ছত্রভঙ্গ সেনার আশ্রয় সচল দুর্গবুরুজ এবং প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী-ব্যূহ বিপর্যস্ত করিবার দুর্বার কীলক-স্বরূপ ব্যবহৃত হইত। হরাবলের সামনে ছিল যাহাকে বলা হইত হরাবলের “মোরগ বাচ্চা” (জৌজা-ই হরাবল); ইহা একটি দীর্ঘ পাতলা পাকা ঘোড়সোওয়ারের পর্দা। শত্রুর অবস্থানের সংবাদ সংগ্রহ এবং ইতস্তত আক্রমণ ও পলায়নের ভান করিয়া শত্রুকে বিভ্রান্ত করাই ছিল মোরগ বাচ্চার কাজ। মোরগ বাচ্চার আড়ালে রহিল আওরঙ্গজেবের প্রধান তোপখানা এবং তোপখানারক্ষক বন্দুকধারী বরকন্দাজ ও অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক অসমসাহসী এবং স্থিরবুদ্ধ মুর্শিদকুলি খাঁ। এইভাবে সুশৃঙ্খলার সহিত মন্থর গতিতে অগ্রসর হইয়া বেলা এক প্রহরের সময় আওরঙ্গজেবের বাহিনী অপেক্ষমাণ বাদশাহী ফৌজের দৃষ্টিপথে উপস্থিত হইল।

যুদ্ধের জন্য মোগলাই কায়দায় প্রতিব্যূহ রচনা করিবার উপযোগী স্থান যশোবত্তের ছিল না। কাসিম খাঁর তোপখানা নামে বাদশাহী, আওরঙ্গজেবের তোপখানার তুলনায় কিন্তু আতসবাজির বাড়া কিছুই নয়। এহেন তোপখানা সামনে রাখিয়া উহার পশ্চাতে যশোবন্ত রাজপুত মুসলমান দুই দলে বিভক্ত বাদশাহী হরাবল বা অশ্বযোদ্ধার ব্যূহমুখ স্থাপন করিলেন। হরাবলের দশ হাজার অশ্বারোহীর মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সংখ্যায় সমান; কাসিম খাঁ মুসলমান এবং মুকুন্দসিংহ হাড়া রাজপুত বাহিনীর অধিনায়ক মনোনীত হইয়াছিলেন। হরাবলের সম্মুখে রহিল তাতার অশ্বারোহীর ইতস্তত ধাবমান “মোরগ বাচ্চা”। দুই হাজার রাঠোর অশ্বারোহী পরিবেষ্টিত হইয়া বাহিনীর মধ্যভাগে যশোবন্ত সেনাপতির স্থান গ্রহণ করিলেন। স্থানাভাবে যশোবত্তের দক্ষিণ ও বামপার্ফি (right and left hand sides of the centre) কেন্দ্রস্থ বাহিনীর উভয় পার্শ্বে বগলদাবা হইয়া রহিল; উহার বামে দক্ষিণে ব্যূহের পক্ষবিস্তার করিবার স্থান না থাকায় বাদশাহী ফৌজ একরকম ঠুটো জগন্নাথ হইয়া পড়িল। হরাবল এবং কেন্দ্রভাগের মধ্যবর্তী স্থানে ইল্লিমিশ বা অগ্রগামী সহায়ক সেনা রাজপুত অশ্বারোহী লইয়া গঠিত হইয়াছিল। একজন রাঠোর এবং একজন গৌর রাজপুত মনসবদার এই দলের সেনাধ্যক্ষ নিযুক্ত হইলেন। যুদ্ধস্থলের পশ্চাতে রাজা দেবীসিংহ বুন্দেলার ফৌজ মূল শিবির ও অসামরিক ব্যক্তিগণের জন্য নিযুক্ত হইল।

যুদ্ধের প্রারম্ভে আওরঙ্গজেবের তোপখানা পাল্লার ভিতরে পৌঁছিবার পূর্বেই বাদশাহী তোপখানা ফাঁকা মাঠে গোলা ছুঁড়িতে লাগিল। আওরঙ্গজেবের তোপখানা অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিতে সারিবদ্ধ হইয়া যখন অব্যর্থ লক্ষ্যে গোলা বর্ষণ আরম্ভ করিল তখন বাদশাহী তোপখানার নাভিশ্বাস উপস্থিত। দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের সুবাদারি গ্রহণ করিবার পর হইতে (১৬৫২ খ্রিঃ) আওরঙ্গজেবের কামানে মরিচা ধরার অবকাশ ছিল না, গোলন্দাজেরা গোলকুণ্ডা-বিজাপুরে চারি বৎসর যাবৎ হাত পাকাইয়াছে; অধিকন্তু তিনি উচ্চ বেতনে সুদক্ষ ফিরিঙ্গি, পর্তুগীজ ও ফরাসি কর্মচারী তোপখানায় ভর্তি করিয়া উহাকে ভয়াবহ মারণাস্ত্র করিয়া তুলিয়াছিলেন। বাদশাহী তোপখানার হিন্দুস্তানী গোলন্দাজ কোনও কালেই রুমী ও ফিরিঙ্গির মতো কাজের লোক ছিল না; কান্দাহার অভিযানের পর (১৬৫৩ খ্রিঃ) তাহারা সেলামী তোপদাগা কিছুই করে নাই। মোট কথা, কয়েক দফা গোলা দাগিবার পর বাদশাহী তোপখানা নিস্তব্ধ হইয়া গেল, কারণ ইতিমধ্যে গোলাবারুদ ফুরাইয়া গিয়াছে! পরে খবর রটিয়াছিল যে, বিশ্বাসঘাতক কাসিম খাঁর ইঙ্গিতে আওরঙ্গজেবের উৎকোচে বশীভূত বাদশাহী গোলন্দাজগণ পূর্বরাত্রেই গোপনে অধিকাংশ গোলাবারুদ মাটির ভিতর পুঁতিয়া ফেলিয়াছিল। এই গুজব অবিশ্বাস করিবার কোনও সঙ্গত কারণ নাই।

বাদশাহী তোপখানাকে ঠাণ্ডা করিয়া আওরঙ্গজেবের তোপখানা দ্বিগুণ তেজে বাদশাহী হরাবলের উপর অগ্নিবৃষ্টি আরম্ভ করিল। কয়েকটা গোলা ফাটিবার পর হরাবলের তুরানী মোরগ বাচ্চা উধাও হইয়া গেল; নিতান্ত চাকরির দায়ে তাহারা “কাফের” দারার পক্ষে ধর্মপ্রাণ আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিল। তখন বাদশাহী হরাবলের ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা, প্রতি মুহূর্তে তোপের গোলায় সাহসী অশ্বযোদ্ধৃগণ অসহায় ভাবে ভূপতিত হইতে লাগিল। পরাক্রম ও সাহসে হরাবলের রাজপুত অধিনায়ক মুকুন্দসিংহ হাড়ার সমকক্ষ সেযুগে বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়া ব্যতীত মোগলসাম্রাজ্যে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না। তিনি দেখিলেন শত্রুর তোপখানা দখল করিতে না পারিলে কেহই বাঁচিবে না। সহসা তরঙ্গায়মান রণসমুদ্রে ঝটিকাবর্ত সৃষ্টি হইল, রাজপুত অশ্বারোহীদের “রাম রাম” যুদ্ধধ্বনি তোপের গর্জনকে উপহাস করিয়া দিগন্ত কাঁপাইয়া তুলিল। নিষ্কাশিত তরবারি হস্তে মহাকালের বক্ষ অসিলাঞ্ছিত করিয়া মৃত্যুকে জয় করিবার জন্য মুকুন্দসিংহ হাড়া, রতনসিংহ রাঠোর, দয়ালসিংহ ঝালা, অর্জুনসিংহ গৌর, সুজানসিংহ শিশোদিয়া তোপখানা লক্ষ্য করিয়া ঘোড়া ছুটাইলেন, পশ্চাতে বিভিন্ন কুলের পঞ্চসহস্র রণোন্মত্ত রাজপুত অশ্বারোহী মৃত্যুর সহিত পাল্লা দিয়া চলিয়াছে। তোপের গোলা ও বন্দুকের অবিশ্রান্ত অগ্নিবর্ষণকে তাহারা শিলাবৃষ্টির ন্যায় উপেক্ষা করিয়া বেপরোয়া হামলা করিল, বাঁচা-মরার কোনও খতিয়ান নাই। অনেক হতাহত হইলেও রাজপুতগণ তোপখানা অধিকার করিয়া লইল; তোপখানারক্ষী অশ্বারোহীর অধিনায়ক মুর্শিদকুলী খাঁ অমিতবিক্রমে যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করিলেন এবং তাঁহার সৈন্যেরা ছত্রভঙ্গ হইয়া পলায়ন করিল। কামানগুলিতে কীলক প্রবিষ্ট করাইয়া নিষ্ক্রিয় করিবার মতো সাজসরঞ্জাম বিজয়ী রাজপুতগণের সঙ্গে ছিল না; অন্য কোন বুদ্ধি তাহাদের মগজে আসিবার কথা নয়। তাহারা মনে করিল গোলন্দাজ মরিয়াছে, কামান কি করিবে?

এই দিকে মুখরক্ষার খাতিরে কাসিম খাঁ হরাবলের অপরাধ লইয়া রাজপুতের পিছনে পিছনে কিছুক্ষণ ঘোড়া দৌড়াইয়া দেখিলেন রাজপুতের মাথায় বুনো শুয়োরের গোঁ চাপিয়াছে, পিছে ফিরিবার আশঙ্কা নাই। গায়ে আঁচড় লাগিবার পূর্বেই তাঁহার পঞ্চসহস্র মুসলমান অশ্বারোহী সহযোদ্ধা রাজপুতগণকে মরণের মুখে ফেলিয়া নিরাপদ স্থানে ফিরিয়া আসিল। মুকুন্দসিংহ হাড়ার নেতৃত্বে জয়দৃপ্ত রাজপুতগণ বলাবল বিবেচনা না করিয়া প্রচণ্ড ঝঞ্ঝার ন্যায় আওরঙ্গজেবের হরাবলের উপর আপতিত হইল। আওরঙ্গজেব শঙ্কিতচিত্তে দেখিতে লাগিলেন উন্মত্ত রাজপুত বরাহ তাঁহার হরাবল বিদীর্ণ করিয়া উহার মধ্যভাগে উপস্থিত হইয়াছে, কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো তাঁহার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করিবে। হরাবলের পুনর্বার ব্যূহবদ্ধ করিবার জন্য তিনি অগ্রগামী সহায়ক দলকে কুমার মহম্মদ সুলতানের সাহায্যার্থ প্রেরণ করিলেন এবং মূল বাহিনীর মধ্যভাগসহ স্বয়ং অগ্রসর হইয়া হরাবলের পশ্চাৎ হইতে যুদ্ধ পরিচালনা করিতে লাগিলেন।

বাদশাহী ফৌজের রাজপুত হরাবল পূর্ণবেগে কীলকের ন্যায় শত্রুব্যূহের মধ্যে প্রবেশ করিয়াও পশ্চাতে আগুয়ান যশোবন্তের অশ্বসেনার জন্য পথ প্রস্তুত করিতে পারিল না; দুই দিক হইতে নূতন শত্রুসৈন্য আসিয়া হরাবলের ভগ্ন স্থানসমূহ পূর্ণ করিল। যশোবত্তের অগ্রগামী সহায়ক সেনার একাংশ মাত্র মুকুন্দসিংহ হাড়ার সাহায্যার্থ শত্রুব্যূহে প্রবেশ করিয়াছিল, উহার মুখে যশোবত্তের বাহিনী প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াও অবরুদ্ধ হইয়া রহিল। আওরঙ্গজেবের হরাবলের পেটের মধ্যে জালবদ্ধ সিংহযুথের ন্যায় মুকুন্দসিংহ প্রমুখ রাজপুত সেনানীগণ মহামারী কাণ্ড ঘটাইলেন, কিন্তু তাহাদের অতুলনীয় শৌর্য নীতিনিয়ন্ত্রিত না হইয়া নিয়তির বিধানে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। একযোগে শত্রুব্যূহের এক নির্দিষ্ট অংশের উপর আঘাত হানিবার পরিবর্তে হাড়া, রাঠোর, গৌর, শিশোদিয়া নিজ নিজ কুলপতির নেতৃত্বে বিক্ষিপ্ত ভাবে যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। আওরঙ্গজেবের কৌশলে প্রত্যেক জঙ্গী হাতিকে কেন্দ্র করিয়া যুদ্ধের এক-একটি আবর্ত সৃষ্টি হওয়ায় রাজপুত আক্রমণের বেগ স্তিমিত হইয়া গেল। তখন কোন্ যোদ্ধা কতজনকে মারিয়া মরিতে পারিবে ইহাই হইল তাহাদের শেষ প্রয়াস,––যুদ্ধ কেবল দুই হাতে কোপাকোপি, হয় মাথা না হয় তলোয়ার না খসিলে বিরাম নাই। চক্রব্যূহবদ্ধ সপ্তরথীবেষ্টিত বীর অভিমন্যুর ন্যায় মুকুন্দসিংহ হাড়া প্রমুখ ছয়জন রাজপুত চমুপতি এইভাবে সানুচর বীরগতি প্রাপ্ত হইলেন, পঞ্চসহস্রের মধ্যে কেহ অবশিষ্ট রহিল না।

এই সময়ে যুদ্ধের সঙ্গীন অবস্থা, জয় পরাজয় অনিশ্চিত। মহারাজা যশোবন্ত স্বয়ং যুদ্ধে নামিয়াছেন, রাজপুত মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। এই সঙ্কট মুহূর্তে আওরঙ্গজেবের নিস্তব্ধ তোপখানা পরিত্যক্ত স্থান হইতে হঠাৎ বজ্ৰনাদে গর্জিয়া উঠিল। মুকুন্দসিংহ হাড়ার তলোয়ারের পাল্লার ভিতরে পড়িবার পূর্বেই আওরঙ্গজেবের গোলন্দাজগণ পলাইয়া গিয়াছিল। রাজপুত হরাবল মহম্মদ সুলতানের সেনামুখের মধ্যে অদৃশ্য হইবার পর গোলন্দাজগণ ময়দান খালি দেখিয়া পুনরায় ফিরিয়া আসিল এবং কামান সাজাইয়া সোজা যশোবন্তের সৈন্যবাহিনীর উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ আরম্ভ করিল। ইতিমধ্যে শাহজাদা মোরাদ আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ পক্ষ লইয়া যশোবত্তের বামপারিক্ষক ইফতিখার খাঁ-র সেনাভাগকে আক্রমণ করিলেন। ইফতিখার খাঁ নিমকহালাল করিয়া যুদ্ধস্থলে প্রাণ দিলেন। যশোবন্তের বামপার্শ্ব ছিন্নভিন্ন করিয়া মোরাদ একেবারে যশোবন্তের শিবির রক্ষক দেবীসিংহ বুন্দেলার উপর আপতিত হইলেন। দেবীসিংহ আত্মসমর্পণ করিলেন, বাদশাহী ফৌজের সর্বস্ব লুঠ হইয়া গেল। এইবার আওরঙ্গজেব বিজয় দামামা বাজাইয়া তাঁহার সমগ্র বাহিনীকে অগ্রসর হওয়ার হুকুম দিলেন।

যুদ্ধের অবস্থা দেখিয়া যশোবন্তের সেনাবাহিনীর অগ্রভাগ হইতে রায়সিংহ শিশোদিয়া এবং দক্ষিণপার্শ্ব হইতে অমরসিংহ চন্দ্রাবত (শিশোদিয়া) ও সুজানসিংহ বুন্দেলা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করিলেন। এই সুযোগে আওরঙ্গজেবের উভয় পারিক্ষক সেনা লইয়া শেখমীর ও সফশিকন খাঁ যশোবস্তের ভগ্নাবশিষ্ট ব্যূহের কোমরে আঘাত হানিতে লাগিল। প্রারম্ভেই বাদশাহী ফৌজের প্রায় অর্ধেক সৈন্যসহ কাসিম খাঁ যুদ্ধক্ষেত্র হইতে সরিয়া দাঁড়াইয়া দূর হইতে যশোবত্তের দ্রুত সদগতি কামনা করিতেছিলেন। শাহজাদা মোরাদ দেবীসিংহ বুন্দেলাকে পরাজিত করিবার পর কাসিম খাঁকে না ঘাঁটাইয়া পশ্চাৎ দিক হইতে যশোবন্তের প্রতি ধাবিত হইলেন। মহারাজা যশোবন্ত তখনও অটুট বিক্রমে যুদ্ধ করিতেছিলেন, আহত হইয়াও আঘাতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ নাই; কিন্তু তাঁহার বাহিনীর তখন সমুদ্রে ভাঙা জাহাজের অবস্থা। যশোবত্তের মাথার উপরে অগ্নিবৃষ্টি, সম্মুখে আওরঙ্গজেব, পশ্চাতে মোরাদ, দৃষ্টিপথে অক্ষত শরীর উদাসীন কাসিম খাঁ; চতুর্দিক হইতে নবোদ্যমে শত্রুবাহিনী তরঙ্গের পর তরঙ্গের ন্যায় তাঁহার হতাবশিষ্ট সেনাকে গ্রাস করিবার জন্য ছুটিয়া আসিতেছে। জয়ের আশা না থাকিলেও সম্মুখে মৃত্যুর পথ উন্মুক্ত, সেই পথ লক্ষ্য করিয়া যশোবন্ত ঘোড়া ছুটাইলেন, সহসা শোণিতাপ্লুত অশ্বারোহীব্যূহে যশোবস্তের অশ্ব অবরুদ্ধ হইয়া পড়িল। তিনি দেখিলেন সম্মুখে আওরঙ্গজেব-মোরাদ নয়, রণভূমিকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করিয়া রুখিয়া দাঁড়াইয়াছেন প্রভুভক্ত অস্করণ, গোবর্ধন দাস, মহেশ দাস গৌর—ইহারা কেহই কাপুরুষ নহেন, তাঁহার জন্য ত্যক্তজীবিত মৃত্যুঞ্জয়ী বীর। ইহারা সসম্ভ্রমে অকম্পিতকণ্ঠে নিবেদন করিলেন, “মহারাজ, আপাতত আপনি বন্দী, সৈন্যদলের নেতৃত্বভার আমরা গ্রহণ করিয়াছি। মারবাড়ের রাজলক্ষ্মীকে অনাথা করিয়া আত্মঘাতী হইবার অধিকার আপনার নাই।” উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া তাঁহারা দ্বিধাগ্রস্ত যশোবত্তের অশ্ব যুদ্ধক্ষেত্রের বাহিরে টানিয়া লইয়া গেলেন। রাওযোধার বংশধর অজাতসন্তান যশোবন্তের নিকট প্রজার অধিকার দাবি করিয়াই সেনাধ্যক্ষগণ দৃঢ়তা অবলম্বন করিয়াছিলেন। যাহারা তাঁহার জন্য অসাধ্যসাধন করিয়া প্রাণ দিয়াছে, তিনি বাঁচিয়া না থাকিলে তাহাদের অনাথ স্ত্রী-পুত্রগণকে ভরণপোষণ করিবে কে? আওরঙ্গজেবের যে রোষাগ্নি তিনি প্রজ্বলিত করিয়াছেন উহার লেলিহান প্রতিহিংসা-শিখা হইতে রাঠোরকুলকে রক্ষা করা কি রাজধর্ম নহে? নিজের বিশ্বস্ত সামন্তগণের হস্তে অসম্পূর্ণ কর্তব্যের দায়ে বন্দীদশা স্বীকার করিয়া অন্তঃরুদ্ধবীর্য হতমান নাগরাজের ন্যায় মহারাজা যশোবন্ত গৃহাভিমুখে চলিলেন; আওরঙ্গজেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া খোদাতালাকে ধন্যবাদ দিলেন — হার-জিত আল্লার মর্জি।

ধর্মাতের আট ঘণ্টাব্যাপী তুমুল সংগ্রাম হিন্দু-মুসলমানের শক্তিপরীক্ষা নহে, আওরঙ্গজেবের সৈন্যদলে রাঠোর, বুন্দেলা, কচ্ছীরাজপুত ও মারাঠা সমান উৎসাহে বিপক্ষের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল। হিন্দুর সংখ্যা এক-চতুর্থাংশ না হইলেও তাঁহার পক্ষে নিহত চারিজন খ্যাতনামা সেনাধ্যক্ষের মধ্যে একজন ছিলেন হিন্দু। বাদশাহী ফৌজে মুসলমান রাজপুত অপেক্ষা অর্ধেকের বেশি হইলেও ধর্মাতের যুদ্ধে নিহত পঁচিশজন প্রসিদ্ধ সেনানায়কের মধ্যে চব্বিশজন রাজপুত, একজন মাত্র মুসলমান; সাধারণ যোদ্ধার মধ্যে মুসলমানের মৃত্যুর অনুপাত ইহা অপেক্ষাও কম। রাজপুত ন্যস্ত বিশ্বাসের অবমাননা করে নাই, স্বামী-ঋণ কড়ায়গণ্ডায় শোধ করিয়া ছয় হাজার মরিয়াছে, অস্ত্রাঘাতে অর্ধমৃত হইয়াছে ইহার অনেক বেশি। ছোটবড় প্রত্যেক রাজপুতকুলের বহুসংখ্যক শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা এই যুদ্ধে নিহত হইয়াছিলেন; তাঁহাদের সকলের স্মৃতি বহন করিয়া আজও দাঁড়াইয়া আছে মুকুন্দসিংহ হাড়ার মৃত্যুর সহযাত্রী রাজা রতনসিংহ রাঠোরের রণশয্যার পরবর্তীকালে নির্মিত এক স্মারকচিহ্ন।

মহারাজা যশোবন্ত তাঁহার হতাবশিষ্ট সামন্তবর্গের সহিত যোধপুরে ফিরিয়া আসিলেন। অতঃপর তাঁহার কি দশা হইল? যশোবন্ত যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিয়াছেন এই কথা যোধপুর দূরে থাকুক হিন্দুস্তানে কেহ সহজে বিশ্বাস করিতে পারে নাই। এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া মুখে মুখে বিবিধ জনরব আগ্রার বাজার পর্যন্ত ছড়াইয়া গিয়াছিল, সামসাময়িক বেসরকারি বৃত্তান্তে উহা ইতিহাসের স্থান দখল করিয়াছে; অথচ এইরূপ কোনও কাহিনীর অস্তিত্ব এবং ঐতিহাসিকতা রাজস্থানের আধুনিক খ্যাতনামা ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন না। ধর্মাতের যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত কোনও শিশোদীয় রাজকুমারীকে যশোবন্ত বিবাহই করেন নাই; তিনি সমসাময়িক মহারাণা রাজসিংহের ভায়রাভাই, বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়ার জামাতা, যশোবত্তের শাশুড়ি শিশোদিয়া বংশ-জাতা ছিলেন। এক শিলালিপিতে পাওয়া গিয়াছে বুন্দীরাজ ছত্রশাল হাড়া দেবলিয়ার শিশোদীয় রাবত সিন্হা-র রাজকুমারী নামক কন্যাকে বিবাহ করিয়াছিলেন। এই স্ত্রীর গর্ভজাতা কন্যা করমেতা বাঈর সঙ্গে যশোবন্তের বিবাহ হইয়াছিল।*

[* গৌরীশঙ্কর ওঝা-কৃত যোধপুর রাজ্যকা ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ ৪৩৫ পাদটীকা দ্রষ্টব্য। কবিরাজ শ্যামল দাস (বীর-বিনোদ) গল্পটা একেবারে উড়াইয়া না দিয়া লিখিয়াছেন, ছত্রশাল হাড়ার কন্যাই যোধপুর দুর্গে পলাতক পতিকে প্রবেশ করিতে বাধা দিয়াছিলেন, অথচ কুত্রাপি এই গল্পের সহিত ছত্রশালের কন্যার সম্বন্ধ দেখা যায় না। তিনি এইরূপ আরও কয়েকটি কাহিনীর ঐতিহাসিক “শুদ্ধি” করিয়াছেন; আসলে কিন্তু ইহা এইরূপ গল্পের শুদ্ধি বা বিচার নয়, অভিনব “সৃষ্টি”—যাহার অধিকার ঐতিহাসিকের নাই। পণ্ডিত বিশ্বেশ্বরনাথ রেউ (মারবাড় রাজ্যবর্গ ইতিহাস, প্রথম খণ্ড) ইহা সম্পূর্ণ বর্জন করিয়াছেন।]

টড সাহেবের ইতিহাসে শিশোদীয় রানি কর্তৃক যোধপুর দুর্গে যশোবস্তের প্রবেশ নিষেধ; কন্যাকে বুঝাইবার জন্য মেবার হইতে মাতার আগমন ইত্যাদি কাহিনীর পুনরুল্লেখ অন্তত বাঙ্গালাদেশে নিষ্প্রয়োজন।

যাহা হউক, ইহাতে নাটক-উপন্যাসের ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। ইতিহাস শুধু কায়া নহে, ছায়াও ইতিহাস হইতে পারে যদি উহাতে কোনও জাতি বা সমাজের সুপরিজ্ঞাত মনোবৃত্তির যথার্থ প্রতিচ্ছায়া আমরা দেখিতে পাই। এই কাহিনীর উপর মানিনী রাজপুত বীরনারীর মনোভাবের একটা ছাপ নিশ্চয়ই আছে, প্রাচীন রাজস্থানী কবির এক নায়িকা সখীকে বলিতেছেন : –

ভল্লা হুআ জু মারিয়া, বহিনি মহারা কন্তু।
লজ্জজ্জেতু বয়ংসিঅহু জদ ভগ্‌গা ঘর এস্তু।।

অর্থাৎ, ভগ্নি! আমার পতি মারা গিয়াছেন ভালোই হইয়াছে। যদি তিনি পলায়ন করিয়া ঘরে ফিরিতেন, তাহা হইলে আমি সমবয়সী সখিগণের কাছে লজ্জা পাইতাম।

পুরুষের বীরত্ব নারীর দেশ ও কুলাভিমান এবং ত্যাগধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত; যে সমাজে নিত্য শাঁখা-সিন্দুরের ভাবনা সে সমাজে নিরাপত্তাই মুখ্য, বাঁচিয়া থাকিলেই বাহাদুরি।

সকল অধ্যায়

১. ১. বাল্য ও কৈশোরের ঐতিহাসিক পটভূমিকা
২. ২. ছায়া পূর্বগামিনী
৩. ৩. দারার মনসব ও সুবাদারি
৪. ৪. শাহজাদা দারাশুকোর কান্দাহার অভিযান
৫. ৫. দারাশুকোর কান্দাহার-অভিযানের উদ্যোগ-পর্ব
৬. ৬. দারাশুকোর কান্দাহার-অবরোধের প্রথম পর্ব
৭. ৭. দারাশুকোর কান্দাহার-অভিযান
৮. ৮. দারাশুকোর কান্দাহার দুর্গ আক্রমণ ও পরাজয়
৯. ৯. দারাশুকোর পাণ্ডিত্য ও তত্ত্বজ্ঞান
১০. ১০. দারা-বাবালাল সংবাদ
১১. ১১. ভ্রাতৃ-বিরোধের পূর্বাভাস
১২. ১২. দোটানা স্রোতে দিল্লীশ্বর তথা মোগল সাম্রাজ্য
১৩. ১৩. গৃহযুদ্ধের কারণ ও দায়িত্ব
১৪. ১৪. গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়
১৫. ১৫. ধর্মাতের যুদ্ধে মহারাজা যশোবন্ত সিংহ
১৬. ১৬. গৃহযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়
১৭. ১৭. দারার বিদায় (সামুগঢ়ের যুদ্ধ; মে ২৯, খ্রিঃ ১৬৫৮)
১৮. ১৮. শাহজাহানের শেষ দরবার
১৯. ১৯. দারার পরাজয় ও পলায়ন
২০. ২০. পিতা-পুত্রের ভাগ্যবিপর্যয়
২১. ২১. এক বিয়োগান্ত ইতিহাসের পরিসমাপ্তি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন