আগন্তুক

হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

বাইরে প্রবল বৃষ্টি। এ বৃষ্টি হঠাৎ থামবে এমন আশা কম। ঘরের মধ্যে আমরা তিনজন। সমীর, পলাশ আর আমি। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। হাতে কোনো কাজ নেই। আড্ডা দিয়েও সবাই ক্লান্ত।

বর্ষার বিকালে খবরের কাগজের ওপর তেল-নুন-মাখা মুড়ি তেলেভাজা দিয়ে চিবোতে চিবোতে গল্প চলেছে। প্রথমে ক্রিকেটের গল্প, তারপর ফুটবল, কিছুক্ষণ সিনেমার কথা, শেষকালে এই আবহাওয়ার উপযুক্ত কাহিনি শুরু হল, ভূতের গল্প।

সমীর বলল, ‘ভূত আলবত আছে। পৃথিবীর বড়ো বড়ো লোক ভূতের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন।’

পলাশ মুখ-চোখের অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলল, ‘আছে বই কী! আছে তোদের মতন নিষ্ক্রিয় লোকদের মগজে। ভূতের জন্মস্থান ভয়ের এলাকায়।’

দুজনে আমাকে সাক্ষী মানল।

বিপদে পড়লাম। খুব সাহসী এমন অপবাদ কেউ দেবে না। ভূত অবশ্য দেখিনি, কিন্তু ভূত নেই একথা জোর গলায় বলি কী করে!

সারাক্ষণ দিনের আলো থাকবে না। একসময়ে অন্ধকার হবে। চারদিক থেকে নানারকম শব্দ শোনা যাবে। তখন?

কাজেই কোনো পক্ষ সমর্থন না-করে বললাম, ‘কী জানি ভাই, বলতে পারব না। ভবিষ্যৎ নিয়ে এত চিন্তা করছি যে, ভূতের কথা ভাববার সময় পাইনি।’

সমীর হাত গুটিয়ে টান হয়ে চেয়ারে বসল। বলল, ‘ভূত আছে কিনা শোন। আমাদের রাঁচিতে একটা বাড়ি আছে জানিস তো। আমি সেখানে অনেক দিন ছিলাম।’

পলাশ এমন সুযোগ ছাড়ল না। সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘তুই যে রাঁচি ফেরত, সেটা তোর হালচালেই মালুম হয়।’

সমীর খেপে লাল।

আমি বহুকষ্টে দুজনকে থামালাম। সমীরকে বললাম, ‘নাও, তোমার গল্প চালাও।’

সমীর তবু ক্ষুণ্ণ। ‘গল্প?’

নিজেকে সংশোধন করে বললাম, ‘না হে, গল্প নয়, সত্য ঘটনা বলো।’

সমীর শুরু করল, ‘রাঁচির বাড়িতে ভূতের উপদ্রব। আমরা খেতে বসেছি, হঠাৎ ভাতের ওপর মাটির গুঁড়ো পড়ল, ডালের বাটি নিজের থেকেই কাত হয়ে গেল, হাত বাড়াতে দুধের বাটি সরে যেতে লাগল। অন্যসময় কিছু নয়, সব স্বাভাবিক। যত গোলমাল কেবল খাবার সময়। আমার ঠাকুরদা তখন বেঁচে। তিনি বললেন, ”এ নিশ্চয় অতৃপ্ত আত্মার ব্যাপার। গয়ায় পিণ্ড দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”।’

তাই স্থির হল। আমার এক কাকা রেলে চাকরি করতেন। তাঁকেই বলা হল পিণ্ড দিয়ে আসতে।

কিন্তু গয়াতে পিণ্ড দিতে গিয়েই এক বিপত্তি।

সমীরের বরাত। ভূতের গল্প কিছুতেই বেচারি শেষ করতে পারছে না।

এই অবধি বলেই তাকে থামতে হল।

বাইরে থেকে দারুণ একটা গোঙানির শব্দ আসছে। একটানা, থামবার লক্ষণ নেই।

এই গোঙানির মধ্যে গল্প বলা অসম্ভব।

আমরা তিনজনেই বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এক ফালি রোয়াক। বৃষ্টির জলে ভিজে গেছে। তারই এক কোণে একটি মানুষ।

মানুষ না বলে কঙ্কাল বলাই সমীচীন। খালি গা। প্রত্যেকটি হাড় গোনা যায়। মাথা ন্যাড়া। পরনে জরাজীর্ণ ফুলপ্যান্ট, হাঁটুর ওপর গোটানো। শুধু কোমরবন্ধের বাহাদুরি আছে। লাল, প্রায় নতুন একটা টাই কোমরে বাঁধা।

লোকটা ঠান্ডায় ঠক ঠক করে কাঁপছে আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে গোঙানি বের হচ্ছে।

এ-দৃশ্য দেখে সকলেরই দয়া হল।

আমিই বললাম, ‘এই তুমি ভিতরে এসো। এই বৃষ্টিতে ভিজলে নিমোনিয়া হবে।’

লোকটা কিছুক্ষণ একদৃষ্টে আমাদের দিকে দেখল। আমার কথাগুলো যেন বুঝতেই পারল না।

এবার সমীর চেঁচিয়ে বলল, ‘উঠে ঘরের মধ্যে এসো, শুনছ?’

লোকটা আস্তে আস্তে দেয়াল ধরে দাঁড়াল। একটু দম নিল, তারপর আমাদের পিছন পিছন ঘরের মধ্যে এল।

‘বসো ওই কোণে।’ পলাশ আঙুল দিয়ে ঘরের কোণ দেখিয়ে দিল।

লোকটা সসংকোচে বসল। দুটো হাঁটুর ওপর মুখ রেখে।

আমি ভিতরে গিয়ে একটা পুরোনো শার্ট এনে লোকটার দিকে ছুড়ে দিলাম। লোকটা কৃতজ্ঞতা-ভরা চোখে আমার দিকে দেখল, তারপর শার্টটা গায়ে দিয়ে নিল।

আমি সমীরের দিকে ফিরে বললাম, ‘এবার নাও হে, তোমার গয়ায় পিণ্ডদানের কাহিনি বলো।’

সমীর ভ্রূ কোঁচকাল। ‘আমার পিণ্ডদানের কাহিনি?’

অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, ‘আহা, তোমার নয়, তোমার ভূতের।’

পলাশ ফোড়ন কাটল, ‘ওই একই হল। ভূত আর সমীরে তফাত নেই। ভূত হচ্ছে গাঁজা, আর সমীর সেই গাঁজার আড়তদার।’

ঠিক এইসময় আমাদের তিনজনকে অবাক করে দিয়ে লোকটি কথা বলল।

‘কে বললে বাবু, ভূত গাঁজা?’

পলাশ এবার লোকটির দিকে ফিরল।

‘তুমিও ভূতের গল্প জানো নাকি হে?’

লোকটা দুটো হাত রগড়াতে রগড়াতে বলল, ‘গল্প নয় বাবুরা, নিজের চোখে ভূত দেখেছি।’

‘সে কী হে? বলো শুনি।’

তিনজনই লোকটার কাছে এগিয়ে বসলাম।

লোকটা হাতদুটো দিয়ে নিজের শরীর ঘষে নিল, বোধ হয় গরম করার চেষ্টায়, তারপর বলতে লাগল—

‘একসময়ে আমি ট্রেনের কামরায় কামরায় প্লাস্টিকের চিরুনি ফেরি করে বেড়াতাম। সকাল সাতটায় বের হতাম। দুপুর বেলা রাস্তার ধারে কিছু খেয়ে নিতাম, তারপর আবার রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত চিরুনি বিক্রির চেষ্টা। রাত্রি বেলা কোনো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের এক কোণে শুয়ে কাটাতাম।

একদিন হয়েছে কী, ঠিক এমনই বাদলা। যাত্রীর সংখ্যা কম। যারা আছে তাদের চিরুনি কেনার দিকে দৃষ্টি নেই, কোনোরকমে বাড়ি পৌঁছোতে পারলে বাঁচে। আমিও কোণের এক বেঞ্চে বসে ঢুলতে ঢুলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।

যখন ঘুম ভাঙল, মনে হল অনেক রাত। বৃষ্টি থেমেছে। জানলা দিয়ে ম্লান জ্যোৎস্না গাড়ির মধ্যে এসে পড়েছে। জানলা দিয়ে উঁকি মেরে বুঝতে পারলাম, ট্রেন শেডের মধ্যে রয়েছে।

ভালোই হল। বেঞ্চের ওপর পা তুলে ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মনে হল কোথায় যেন খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে।

একবার ভাবলাম ইঁদুর। কিন্তু ইঁদুর মালগাড়ি ছেড়ে এ-গাড়িতে আসবে কেন? এদিক-ওদিক চোখ ঘেরাতে ঘোরাতে দেখতে পেলাম, বাথরুমে হাতলটা নাড়ছে। কে যেন খোলবার চেষ্টা করছে, পারছে না।

একটু ভয় হল, চোর-ডাকাত নয় তো?

তারপর আবার মনে হল, চোর হোক, ডাকাত হোক, আমার কী! আমার সম্বল দু-টাকার চিরুনি আর পকেটে দেড় টাকা।

চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

হঠাৎ মুখের ওপর গরম নিশ্বাস পড়তে চমকে চোখ খুলেই আঁতকে উঠলাম।

সামনে একজন লোক। লোকই বা বলি কী করে! মুণ্ডু নেই, মুণ্ডুটা নিজের হাতে ধরা। দুটো চোখ বীভৎসভাবে বেরিয়ে আছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভটা ঝুলে পড়েছে। সেই জিভ দিয়ে টপ টপ করে রক্তের ফোঁটা ঝরছে।

আমি চিৎকার করতেই মুণ্ডুটা জিভটাকে ভিতরে টেনে নিয়ে চাপা গলায় বলল, ”চুপ, ভয়ের কিছু নেই। আমিও তোমার মতন ট্রেনে লজেন্স হজমিগুলি ফেরি করে বেড়াতাম। নিজে গান বেঁধে সুরে করে গাইতাম। গানের গলা ছিল বলে বাবুরা খুশি হয়ে শুনত, তারপর আমার জিনিস কিনত। সেইজন্য অন্য ফেরিওয়ালারা আমায় হিংসা করত, বিশেষ করে তারক। সে আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। আমার মতন গাইবার চেষ্টা করত, পারত না। এক সন্ধ্যায় টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আমি গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে। ট্রেনের গতি একটু কমলে পাশের কামরায় উঠব। তারক ঠিক আমার পিছনে। হঠাৎ সে সজোরে আমাকে ধাক্কা দিল। পাশের লাইন দিয়ে দার্জিলিং মেল আসছিল নক্ষত্রবেগে। ট্রেনের গতিবিধি আমাদের নখদর্পণে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছিটকে একেবারে লাইনের ওপর। তারপর দার্জিলিং মেলের চাকা—’

লোকটির কথা শোনা গেল না। চোখ-বাঁধানো বিদ্যুতের আলো, তারপরই খুব কাছে কোথাও বাজ পড়ল।

জানালার কাচ ঝনঝন করে উঠল। মেঝে কেঁপে উঠে মনে হল চেয়ারগুলো উলটে ফেলে দেবে।

আমরা সবাই প্রথমে ভাবলাম বুঝি ভূমিকম্প, তারপর বুঝতে পারলাম, না, বাজের শব্দ।

পলাশ বলল, ‘খুব ভূতের গল্প ফেঁদেছ তো হে!’

কোনো উত্তর নেই।

আমি তাড়াতাড়ি উঠে সুইচ টিপলাম। আলোয় ঘর ভরে গেল।

কী আশ্চর্য, কোণ খালি! লোকটা কোথাও নেই।

অথচ লোকটা ঘরের মধ্যে ঢোকবার পর দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দরজা সেইরকমই বন্ধ আছে।

বাইরে একটা মোটরের শব্দ। অনেকগুলো লোকের চিৎকার।

দরজা খুলে আমরা বাইরে এলাম। বৃষ্টি কমে গেছে। একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে। গোটা চারেক পুলিশ রোয়াকের কাছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হল?’

ইনস্পেকটর বলল, ‘আপনাদের পাশের বাড়ি থেকে থানায় ফোন করেছিল, এখানে মড়া পড়ে আছে।’

‘মড়া!’

আমরা উঁকি দিয়েই চমকে উঠলাম। সেই লোকটা পড়ে রয়েছে চিত হয়ে। দুটো হাত বুকের ওপর জড়ো করা। দুটো চোখের তারা বিস্ফারিত।

‘কখন মারা গেল?’

‘ঠিক বলা মুশকিল। তবে ঘণ্টা দুয়েক তো নিশ্চয়। একেবারে কাঠ হয়ে গেছে।’

কিন্তু বলতে গিয়েই সামলে নিলাম। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। লোকটার পরনে আমার দেওয়া পুরোনো শার্ট, যেটা তাকে আধঘণ্টা আগে দেওয়া হয়েছিল।

ওদের মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, সমীর আর পলাশ দুজনেই সেটা লক্ষ করেছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন