ছায়ালীন

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ছায়ালীন

চক্র

মাঝরাতে হঠাৎ কী খেয়াল হলো, নীতু বলল, “আয় চক্রে বসি।”

সাথে সাথে সবাই হই হই করে বলল, “চল, চল বসি৷”

গরমের ছুটির শেষে মাত্র সবাই হোস্টেলে ফিরে এসেছে, ক্লাসের চাপ এখনো পুরোপুরি চেপে বসেনি। প্রতি রাতেই সবাই বসে গল্পগুজব করতে করতে রাত গভীর করে ফেলে, ছুটিতে কী হয়েছে সেটা নিয়ে সবারই কিছু না কিছু বলার আছে। অতি সাধারণ ঘটনা সেটা শুনেই সবাই হেসে কুটি কুটি হয়। গরমের ছুটিতে মৌসুমী নামের মেয়েটিরই শুধু সত্যিকার অর্থে বলার মতো একটি ঘটনা রয়েছে। তার দূরসম্পর্কের এক চাচা বেড়াতে এসে সবাইকে নিয়ে চক্রে বসে মৃত আত্মাদের ডেকে এনেছিলেন। চক্রে বসা মানুষদের ওপর আশ্রয় নিয়ে মৃত আত্মারা কথাবার্তা বলেছে, মৌসুমীর নিজের চোখে দেখা ঘটনা অবিশ্বাস করার উপায় নেই।

ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের আড্ডায় গল্পটি এর মাঝে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে এবং আজ রাতে ঠিক যখন আড্ডা ভাঙার সময় এসেছে তখন নীতু এই চক্রে বসার প্রস্তাবটি করেছে। শাহানা দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করল, বলল, “কিন্তু কীভাবে চক্রে বসতে হয় আমরা তো জানি না।”

নীতু বলল, “কে বলেছে জানি না? মৌসুমী আমাদের বলল না?”

কথাটি সত্যি, কীভাবে চক্রে বসতে হয় বিষয়টা মৌসুমী এর মাঝে বেশ কয়েকবার সবার কাছে বর্ণনা করে ফেলেছে। ভীতু প্রকৃতির কয়েকজন মেয়ে তারপরেও দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করল কিন্তু অন্যদের প্রবল উৎসাহে সেই আপত্তি জায়গা করতে পারল না।

তাই কিছুক্ষণের মাঝে নওরীনের রুমের খাটগুলো পেছনে ঠেলে জায়গা করা হলো, টেবিল ধাক্কা দিয়ে কোনায় সরিয়ে নেয়া হলো, চেয়ারগুলো ঘর থেকে বের করা হলো এবং ঘরের মেঝেতে একটা বড় চাদর বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে গেল। ঘরের আলো নিভিয়ে ছোট একটা পিরিচে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নেয়া হয়েছে। মোমবাতির আলোর কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক বেশ সহজেই ঘরের ভেতরে কেমন যেন একটা ছমছমে আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল।

নীতু বলল, “‘সবাই সামনে হাত রাখ, একজনের বাম হাতের ওপর আরেকজনের ডান হাত। তাই না রে মৌসুমী?”

মৌসুমী মাথা নাড়ল।

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব?”

মৌসুমী বলল, “চোখ বন্ধ করে মৃত মানুষের কথা ভাবতে থাক।”

“কোন মৃত মানুষের কথা ভাবব?”

নীতু ধমক দিয়ে বলল, “তোর যাকে ইচ্ছা।”

শাহানা বলল, “আমি মরা মানুষের কথা ভাবতে পারব না। আমার ভয় করে।”

“ভয় করলে চুপ করে বসে থাক। অন্যদের ডিস্টার্ব করবি না।”

মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতেই ঘরের ভেতরে একটা আবছা অন্ধকার নেমে আসে। সাথে সাথে শাহানা হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “না না ভাই। আমি বসব না। আমার ভয় করে।”

নীতু ধমক দিয়ে বলল, “এতগুলো মানুষ বসে আছে, তার মাঝে তোর ভয়টা কিসের?”

শাহানা যুক্তিতর্কের মাঝে গেল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বসব না বাবা আমি যাই। আমার এসব ভালো লাগে না।”

সত্যি সত্যি শাহানা দরজা খুলে বের হয়ে যায়। নীতু পেছন থেকে বলল, “দাঁড়া। আগে প্রেতাত্মারা আসুক। আমরা যদি তাদের তোর ঘরে না পাঠাই।”

শাহানা চলে যাবার পর অন্যেরা খানিকক্ষণ শাহানাকে নিয়ে গজগজ করে আবার চক্রে বসে পড়ে। একজনের হাতের ওপর অন্যজনের হাত রেখে তারা মৃত মানুষের কথা ভাবতে থাকে। ঘর অন্ধকার, সবার চোখ বন্ধ এবং মাথা নিচু, দেখতে দেখতে ঘরের ভেতর একধরনের আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।

মৌসুমীর গল্পে চক্রে বসার বিষয়টি যে রকম ভাবগম্ভীর এবং চমকপ্রদ ছিল এখানে অবিশ্যি মোটেও সেটা এরকম হলো না। যারা বসেছে তাদের মাঝে মিতুলের একটু হাসির রোগ আছে এবং দেখা গেল কিছুক্ষণের মাঝেই সে হাসতে শুরু করে দেয়। হাসিটা গোপন রাখার জন্যে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু তার শরীর কাঁপতে থাকে এবং মাঝে মাঝে মুখ থেকে বিদঘুঁটে একটা-দুইটা শব্দ বের হয়ে আসে। মধ্যরাত্রিতে চক্রে বসে মেয়েরা দ্বিতীয় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে হাসি অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ এবং মিতুলের দেখাদেখি নাজু, নওরীন আর সাথী দিয়ে শুরু করে একটু পরে নীতি আর মৌসুমীর মতো এক-দুজন সিরিয়াস মেয়ে ছাড়া অন্য সবাই গা দুলিয়ে হাসতে শুরু করে দেয়।

মৃত আত্মারা নিশ্চয়ই কৌতুকপ্রিয় মেয়েদের মাঝে আসতে পছন্দ করে না, তাই ঘণ্টাখানেক পরে সবাই আবিষ্কার করল রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে কিন্তু তাদের কেউ মিডিয়াম হয়ে কোনো আত্মাকে আনতে পারেনি।

মৌসুমী বিরক্ত হয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন শেষ কর।”

নীতু বলল, “তোদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না। চক্রে বসেও শুধু ফাঁচ ফাঁচ করে হাসিস।”

মৌসুমী বলল, “এটা মোটেও হাসির ব্যাপার না। এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার।” মিতুল হাসি চেপে বলল, “হাসি উঠে গেলে আমি কী করব?” নীতু রেগে বলল, “হাসি উঠে গেলে এরকম জায়গায় আসবি না।” মৌসুমী বলল, “অমার চাচা বলেছেন চক্রে মৃতআত্মা আনার পর ঠাট্টা-তামাশা করলে আত্মার কষ্ট হয়।” মিতুল বলল, “তাহলে মৃত আত্মা না এনে জীবন্ত আত্মা আনলেই হয়।”

নীতু বলল, “জীবন্ত আত্মাটা কী জিনিস।”

“যে মানুষ মারা যায় নাই তার আত্মা।” জীবন্ত মানুষের আত্মা আনার পুরো ব্যাপারটি মিতুলের কাছে খুব কৌতুকের মনে হলো এবং সেটা কল্পনা করে সে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

নওরীন বলল, “আচ্ছা! মিতুল তো ঠিকই বলেছে। চক্রে বসে যদি জীবন্ত মানুষের আত্মা আনার চেষ্টা করি তাহলে কী হবে?”

মৌসুমী বিরক্ত হয়ে বলল, “‘ফাজলেমি করবি না। চক্রে বসে ডাকা হয় মৃত আত্মাদের–”

“আমরা ডাকব জীবন্ত মানুষের আত্মাদের।”

মিতুল হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “আয় আমরা এক্সপেরিমেন্টটা করে ফেলি। চক্রে বসে আমরা শাহানাকে ডাকি! দেখি এই ভীতুর ডিমটার ঘুম ভেঙে যায় কী না!”

মৌসুমী বলল, “দেখ। চক্র ব্যাপারটা হাসি-তামাশার না। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। এটা নিয়ে ফাজলেমি করবি না।”

“আমরা ফাজলেমি করছি কে বলল?” মিতুল বলল, “আমরা একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। মৃত মানুষের আত্মাকে না ডেকে জীবন্ত মানুষের আত্মাকে ডাকছি। জীবন্ত মানুষকে পরে জিজ্ঞেস করব সে কিছু টের পেয়েছে কী না!”

খানিকক্ষণ এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক হলো এবং শেষ পর্যন্ত সবাই আবার চক্রে বসতে রাজি হলো, তবে এবারে মৃত মানুষকে ডেকে জীবন্ত মানুষকে ডাকা হবে। কোনো জীবন্ত মানুষকে ডাকা হবে সেটা নিয়ে অবিশ্যি কোনো তর্কবিতর্ক হলো না! শাহানাই হবে সেই মানুষ।

ঘরের বাতি নিভিয়ে আবার তারা গোল হয়ে বসে। একজনের হাতের ওপর আরেকজন হাত রেখে চোখ বন্ধ করে তারা শাহানার কথা ভাবতে থাকে। মিতুল পর্যন্ত হাসি বন্ধ করে রইল, মৌসুমী ফিসফিস করে বলল, “শাহানা! আমরা তোমাকে চক্রে আহ্বান। করছি। তুমি আসো! তুমি আসো আমাদের মাঝে।”

মিনিট দশেক এভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। তাদের মাঝে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে নাজু হঠাৎ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে, মনে হতে থাকে তার বুঝি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয় তার শরীরটা থরথরকরে কাঁপতে শুরু করে, পাশে বসে থাকা নওরীন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই নাজু! কী হয়েছে তোর?”

নাজু কোনো কথা বলল না, শুধু তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে, শরীরটা আরো জোরে কাঁপতে থাকে। মুখ দিয়ে হঠাৎ গোঙানোর মতো একধরনের শব্দ হতে থাকে।

নীতু জিজ্ঞেস করল, “নাজু৷ কী হয়েছে তোর?”

নাজু কোনো উত্তর করল না।

নীতু আবার ডাকল, “নাজু। এই নাজু৷”

নাজু এবারে উত্তর দেয়, চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে, “ আমি নাজু না।”

“তাহলে তুই কে?”

“আমি শাহানা।”

সবাই কেমন জানি চমকে উঠল। মৌসুমী বলল, “তুই এখানে কী করছিস?”

“তোরা আমাকে ডেকেছিস, তাই আমি এসেছি। তোরা বল কেন আমাকে ডেকেছিস কেন?

তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, শুধু যে কণ্ঠস্বর হুবহু শাহানার মতো তা নয়, কথা বলার ভঙ্গি এমন কী কথায় রাজশাহী অঞ্চলের টানটুকু পর্যন্ত আছে। মৌসুমী বলল, “ তুই আসলেই শাহানা?”

“হ্যাঁ।”

“তোর কেমন লাগছে?”

“ভালো লাগছে না।”

“কেন ভালো লাগছে না?”

শাহানার গলার স্বরটা হঠাৎ কেমন জানি হাহাকারের মতো শোনায়। ভাঙা গলায় বলল, “তোরা কেন আমাকে ডাকলি? কেন?”

শাহানার গলার স্বরে নাজু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। মৌসুমী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “চক্র ভেঙে দাও সবাই। হাত ছেড়ে দাও।”

সবাই তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল, প্রায় সাথে সাথেই নাজু কান্না বন্ধ করে মাথা তুলে তাকাল। নীতু গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়, হঠাৎ করে আলো জ্বালানোয় সবারই চোখ সয়ে যেতে একটু সময় লাগে। সবাই নাজুর মুখের দিকে তাকাল। নীতু জিজ্ঞেস করল, “নাজু তোর কী হয়েছিল?”

নাজুকে কেমন যেন বিচলিত দেখায়, শুকনো মুখে বলল, “আমি জানি না। আমার স্পষ্ট মনে হলো—”

“কী মনে হলো?”

নাজু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “আয় আগে দেখি শাহানা কী করছে।”

“ঠিকই বলেছিস,” বলে নীতু দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। করিডরের শেষ মাথায় শাহানার সিঙ্গেল সিটেড রুম। তারা দ্রুত পায়ে শাহানার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নীতু দরজায় শব্দ করে ডাকল, “শাহানা।”

ভেতর থেকে কোনো শব্দ হলো না। তখন নীতু আরো জোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই শাহানা। শাহানা-”

শাহানা তবুও জেগে উঠল না। তখন অন্যেরাও দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করে, ভয় পাওয়া গলায় ডাকতে থাকে, “শাহানা! দরজা খোল শাহানা!”

তাদের হইচই শুনে আশেপাশের রুম থেকে অন্যেরা জেগে উঠে ভিড় করে তবু শাহানা ঘুম থেকে জাগে না। ভয় পেয়ে এবারে একসাথে কয়েকজন মিলে দরজায় ধাক্কা দেয়। কয়েকবার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজার ছিটকানি ভেঙে হঠাৎ করে দরজাটা খুলে যায়।

মেয়েরা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল। একজন লাইট সুইচটা টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল। মশারির ভেতর একধরনের অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে শাহানা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নীতু ছুটে গিয়ে শাহানাকে ঘুরিয়ে নেয়-তার চোখ দুটো আধখোলা সেখানে শূন্য দৃষ্টি। মুখটা অল্প একটু ফাঁক হয়ে জিব খানিকটা বের হয়ে আছে।

নীতু একটা আর্তচিৎকার করে পেছনে সরে আসে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

বিছানায় শুয়ে শাহানার মৃতদেহ শূন্যদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। চক্রে বসে সত্যি সত্যি তারা শাহানার আত্মাটিকে বের করে এনেছে।

আংটি

কফিল উদ্দিন পকেট থেকে চিরুনিটা বের করে তার চুলের ওপর দিয়ে আলতোভাবে একবার বুলিয়ে নিল, এই চেহারাটা তার একটা বড় সম্পদ তাই সে এটার যত্নআত্তি করে। সে রীতিমতো জেলখাটা ঘাগু অপরাধী কিন্তু তার চেহারার মাঝে মফস্বল কলেজের বাংলা শিক্ষকের নির্দোষ একটা সারল্য আছে। মানুষ তার চেহারা দেখে তাকে বিশ্বাস করে এবং কফিল উদ্দিন সেই সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগায়। এখন পর্যন্ত তার হাতে কেউ খুন হয়ে যায়নি কিন্তু মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে সে তার জীবনে অনেককে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দিয়েছে।

এ মুহূর্তে কফিল উদ্দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় সে একটু বিব্রত এবং হতচকিত ভাব ফুটিয়ে রেখেছে যদিও সে ভেতরে ভেতরে একেবারে একশ’ ভাগ সজাগ। সে একটি শিকার খুঁজছে যাকে আজ রাতে সে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দেবে। ট্রেনের টিকিট খুঁজতে এসেছে এরকম মানুষকে সে ভেতরে ভেতরে যাচাই করে দেখছে। প্রথম ষণ্ডা গোছের মানুষটাকে সে বাতিল করে দিল, দ্বিতীয় মানুষটিকে শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দিল কারণ মনে হলো তার কাছে টাকা-পয়সা বেশি থাকবে না। তৃতীয় মানুষটিকে তার বেশ পছন্দ হলো এবং সে মাকড়সার সতর্ক পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে যায়। মানুষটা টিকিট কাউন্টারে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে। কাছাকাছি গিয়ে কফিল উদ্দিন বলল, “শুনছেন?”

“জি। আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ। ইয়ে-আমি একটা ছোট ঝামেলার মাঝে পড়েছি।” কফিল উদ্দিন মুখে চমৎকার একটা বিব্রতভাব ফুটিয়ে তুলল।

“কী ঝামেলা?”

“আমার আর এক বন্ধুর আজ রাতে সিলেট যাবার কথা। ফার্স্ট ক্লাস বার্থে দুটা টিকিট ছিল। একটু আগে ফোন করে বলল সে আসতে পারছে না–”

মানুষটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “আপনার কাছে স্লিপিং বার্থের একটা টিকিট আছে?”

কফিল উদ্দিন বিব্রতভাবে বলল, “হ্যাঁ। আপনি যদি ইন্টারেস্টেড হন-”

“হা হা-অবশ্যই।”

কফিল উদ্দিন পকেট থেকে টিকিটটা বের করে মানুষটির হাতে দিল, সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মুখে সন্তুষ্টির ভান করে তার মানিব্যাগে হাত দেয়। কফিল উদ্দিন বলল, “আপনাকে এখনই দিতে হবে না। আমিও তো যাচ্ছি। ট্রেনে সারা রাত একসাথে থাকব পরে দিয়ে দেবেন।”

মানুষটি বলল, “না, না। এখনই দিয়ে দিই।” সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে, কফিল উদ্দিন নিস্পৃহ ভঙ্গি করে কিন্তু উত্তেজিত হয়ে লক্ষ করল মানিব্যাগটা মোটা, সেখানে থরে থরে নোট সাজানো। মানুষটার সাথে একটা হ্যান্ড ব্যাগ, ভারী হ্যান্ড ব্যাগ-ভেতরে নিশ্চয়ই ভালো জিনিসপত্র আছে। হাতে আংটি আর ঘড়ি, পকেটে মোবাইল ফোন, কফিল উদ্দিন দ্রুত হিসেব করে দেখল আজ রাতের দাওটি খারাপ হবার কথা না। এখন সব ভালোয় ভালোয় শেষ করতে পারলে হয়।

.

দুজনের কেবিন, নিচের বার্থ কফিল উদ্দিনের ওপরের বার্থটা মানুষটির। দুজনে যখন আরাম করে বসেছে তখন লম্বা হুইসিল দিয়ে ট্রেনটা মোটামুটি সময়মতো ছেড়ে দিল, এটেনডেন্ট এসে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “স্যার আপনারা কিন্তু রাত্রে জানালা বন্ধ রাখবেন।”

কফিল উদ্দিন বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমরা বন্ধ করে

দেব।”

“চোর-ছ্যাঁচড়ে দেশ ভরে গেছে স্যার।”

এটেনডেন্ট চলে যাবার পর কফিল উদ্দিন একটা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “দেশের অবস্থাটা দেখেছেন? একজন মানুষ ট্রেনের জানালা খোলা রেখে ট্রাভেল করতে পারে না।”

সঙ্গী মানুষটি বলল, “কোন জায়গায় জানালা খোলা রাখতে পারে?”

কফিল উদ্দিন মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।” তারপর সে ঢাকা শহরে আসার পর একজন মানুষ কীভাবে অপরাধীর পাল্লায় সর্বস্বান্ত হয়েছে তার একটা নিখুঁত বর্ণনা দিল। বানানো গল্প কিন্তু এ মানুষটার সেটা বোঝা সম্ভব না। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলতে থাকলে এখন এ মানুষটারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটা গল্প বলার কথা, কিন্তু মানুষটি তার চেষ্টা করল না। সম্ভবত নিজের গাড়িতে চলাচল করে, হাইজ্যাক-ছিনতাই দেখেনি।

কফিল উদ্দিন তার ব্যাগ খুলে একটা ইংরেজি বই বের করল-তার পড়াশোনা নেই। বানান করেও ইংরেজি পড়তে পারে না কিন্তু এ মানুষটার বিশ্বাস অর্জন করার জন্যে এগুলো দরকার। বইটা সিটের ওপরে উপুর করে রেখে সে পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে তার কাল্পনিক স্ত্রীর সাথে কথা বলার অভিনয় শুরু করে, “রুমানা?” প্রথমে কিছু একটা শোনার অভিনয় করল, বলল, “না, না কিছু দরকার নেই-এত সকালে বেচারা ড্রাইভারের স্টেশনে আসার কোনো দরকার নেই। আমি একটা স্কুটার নিয়ে নেব।” আবার কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে এবং হুঁ হাঁ করে জিজ্ঞেস করল, “তিন্নি কী করে? দাও দেখি তার সাথে একটু কথা বলি।” কফিল উদ্দিন তারপর একটা ছোট মেয়ের সাথে খানিকক্ষণ কাল্পনিক কথাবার্তা বলল। সঙ্গী মানুষটি পুরো কতাবার্তা মনোযোগ দিয়ে না শুনলেও যেটুকু শুনেছে তাতেই তাকে একজন সচ্ছল ভালোমানুষ বিবাহিত সুখী পারিবারিক মানুষ হিসেবে ধরে নেবে।

মোবাইল টেলিফোনটা রেখে কফিল উদ্দিন সঙ্গী মানুষটার সাথে আবার একটু-আধটু কথাবার্তা বলে, মানুষটি একটু কম কথার মানুষ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাপে আলাপে টেনে আনা গেল। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক। স্ত্রীকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে, কারণ, তার কথা বলার সময় আঙুলের আংটিটাতে বারবার হাত বুলিয়ে দেখল। নিশ্চয়ই বিয়ের আংটি, কফিল উদ্দিনও আড়চোখে আংটিটা দেখে, খাঁটি সোনার মোটা একটা আংটি, দামি পাথরও আছে! শুধু এই আংটির জন্যেই এ মানুষের ওপর একটা দাও মারা যায়।

ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই কফিল উদ্দিন মানুষটার সাথে আন্তরিকতার একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দুজন দুজনের সাথে ছোটখাটো ব্যক্তিগত কথা বলল হালকা দু-একটা রসিকতাও করা হলো এবং যখন মনে হলো পরিবেশটা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে তখন কফিল উদ্দিন তার আসল কাজ শুরু করে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “খিদে লেগে গিয়েছে। খেয়ে আসতে পারিনি। আপনি খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ খেয়েছি।”

“আমি আসার সময় ফাস্টফুডের দোকান থেকে কয়টা স্যান্ডউইচ তুলে এনেছি। একটু খেয়ে নিই যদি কিছু মনে না করেন?”

“না, না-আমি কী মনে করব? আপনি খান।”

কফিল তার ব্যাগ থেকে একটা খাবারের প্যাকেট বের করল, কয়েকটা স্যান্ডউইচ পাশাপাশি সাজানো-প্রথমটাতে ধুতুরার বিষ মেশানো। অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছে বাজারের অন্য বিষের তুলনায় এখনো ধুতুরার বিষটাই ভালো, কোনো গন্ধ নেই, তিতকুটে স্বাদ নেই, মানুষকে সহজে খাইয়ে নেয়া যায়।

কফিল স্যান্ডউইচের প্যাকেটটা একনজর দেখে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল–‘অনেক দিয়েছি দেখি। খাবেন একটা?”

মানুষ যদি একটা তুলে নেয় প্রথমটাই নেবে, সেটাই ধুতুরার বিষ দেয়া। কিন্তু মানুষটা নিল না। বলল, “না, না, আমি খেয়ে এসেছি। থ্যাংক ইউ।”

কফিল আর জোর করল না, বলল, “খেয়ে এসে থাকলে খামোখা স্যান্ডউইচ খেয়ে মুখ নষ্ট করবেন না। সে প্যাকেট থেকে দ্বিতীয় স্যান্ডউইচটা তুলে খেতে শুরু করে। খেতে খেতে সে বাঙালির খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে একটু রসিকতা করল, “বুঝলেন? ভেতো বাঙালি তো স্যান্ডউইচ খেলে পেট ভরে না! এই খাবারটা যে কারা আবিষ্কার করেছে।”

মানুষটি হাসল, বলল, “বিপদে পড়ে খেতে হয়। শখ করে কে আর কোনো দিন স্যান্ডউইচ খেয়েছে?”

“তা ঠিক।” কফিল উদ্দিন প্যাকেট থেকে দুটি কোল্ড ড্রিংকসের এলুমিনিয়ামের ক্যান বের করল, একটার মাঝে ধুতুরার বিষ মেশানো। দ্বিতীয়টা ভালো। সে মানুষটার দিকে এগিয়ে দিলে বলল, “নেন, একটা ড্রিংকস খান।”

শতকরা নব্বই ভাগ চান্স যে মানুষটা কোল্ড ড্রিংকস নেবে। সত্যি সত্যি নিল এবং ধুতুরার বিষ মেশানোটাই। ক্যানটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করলেও মানুষটা বুঝতে পারবে না যে একটা সূক্ষ্ম ফুটো করে এখানে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে ধুতুরার বিষ ঢোকানো হয়েছে। ফুটোটা নিখুঁতভাবে ইপক্সি দিয়ে বুজে দেয়া আছে। মানুষটা ক্যান হাতে নিয়ে সেটা খুলে ঢকঢক করে খানিকটা ড্রিংকস খেয়ে নেয় এবং সাথে সাথে কফিল তার বুকের ভেতর থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দেয়। কাজ হয়ে গেছে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার, মানুষটা যখন ঘুম থেকে উঠবে-সম্ভবত কোনো একটা হাসপাতালে তখন অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করবে কেমন করে সে এখানে এসেছে।

কফিল আড়চোখে মানুষটাকে লক্ষ করে, ক্যান থেকে ঢকঢক করে আরো খানিকটা ড্রিংকস খেয়ে হঠাৎ কেমন যেন একটু অবাক হয়ে কফিল উদ্দিনের দিকে তাকাল। কফিল উদ্দিন তার দৃষ্টি এড়িয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। মানুষটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে কেমন যেন বিচিত্রভাবে চোখ পিট পিট। করতে থাকে। কফিল একটু সরে গিয়ে বলল, “ঘুম পাচ্ছে? শুয়ে পড়ুন তাহলে। অনেক রাত হয়েছে?”

মানুষটি কেমন যেন অস্বস্তির ভাব করে মাথা নাড়ে, এদিক-সেদিক তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে বলে, “শরীরটা ভালো লাগছে না।”

“তাই নাকি?” কফিল উদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “শুয়ে থাকেন-কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন তাহলে।”

মানুষটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কেমন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কফিল মানুষটাকে বার্থে তুলে দেয়, মাথার নিচে একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও সোনার চাঁদ।”

কফিল কেবিনের লাইটটি নিভিয়ে দিতেই জানালা দিয়ে ভেতরে জ্যোৎস্নার একটা নরম আলো এসে ঢুকল, কফিল উদ্দিন খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল জ্যোৎস্নার আলোতে বাইরে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এটা কি সুন্দর নাকি অসুন্দর সে বুঝতে পারে না।

কফিল কোনো তাড়াহুড়ো করল না। ঘণ্টাখানেক পর সে কেবিনে, লাইট জ্বালিয়ে মানুষটাকে পরীক্ষা করার জন্যে গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠল, মানুষের শরীরটা আশ্চর্য রকম শীতল। সে ভয়ে ভয়ে মানুষটার দিকে তাকাল, মানুষটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে আবার সে মানুষটার বুকে হাত দিল, হৃদস্পন্দনের কোনো চিহ্ন নেই। হঠাৎ করে ভয়াবহ আতঙ্কে কফিল লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। সর্বনাশ! এই মানুষটা মরে গেছে।

কফিল উদ্দিনের ইচ্ছে হলো ভয়ংকর একটা চিৎকার করে কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে যায়, কিন্তু সে জানে এটা সে করতে পারবে না। তাকে এখন এই মৃত মানুষের দেহটি নিয়ে এই কেবিনে বসে থাকতে হবে। কফিল উদ্দিন হঠাৎ কুল কুল করে ঘামতে থাকে।

অনেক কষ্ট করে কফিল উদ্দিন নিজেকে শান্ত করল। এখন যদি সে নিজের মাথা ঠাণ্ডা না রাখে তাহলে ভয়ানক বিপদে পড়ে যেতে হবে। যেভাবেই হোক তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, ঠাণ্ডা মাথায় খুব সাবধানে পরের স্টেশনে নেমে যেতে হবে। যতক্ষণ পরের স্টেশন না আসে ততক্ষণ তাকে চুপচাপ বসে থাকতে হবে।

ঠিক তখন ট্রেনটা আস্তে আস্তে থেমে যায়, এখানে সে নেমে যেতে পারে, কিন্তু মানুষটার মানিব্যাগ ঘড়ি-আংটি কিছুই এখনো নেয়া হয়নি। এত কষ্ট করে শেষে সে তো শুধু খালি হাতে নেমে যেতে পারে না। কফিল উদ্দিন মানুষটার পকেটে হাত দিয়ে তার মানিব্যাগটা খুঁজতে থাকে ঠিক তখন জানালায় একজন মানুষের মুখ দেখা গেল, মানুষটি অবাক হয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে। কফিল উদ্দিন লাফিয়ে সরে এলো, জানালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? কী চাও?”

“মিনারেল ওয়াটার লাগবে? ঠাণ্ডা মিনারেল ওয়াটার?”

“না না লাগবে না।”

মানুষটা সরে যাবার পরও সে জানালা থেকে সরল না। কেউ যেন দেখতে না পারে ভেতরে কী হচ্ছে।

একটু পরে ট্রেনটা আবার ছেড়ে দিলে কফিল উদ্দিন এসে মানুষটার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে। ভেতরে নোটগুলোর বেশির ভাগ পাঁচ শ টাকার নোট, এখন গোনার সময় নেই কিন্তু চোখ বন্ধ করে আট-দশ হাজার টাকা হয়ে যাবে। কফিল হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নেয়, বুক পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোনটা নেয়। বাম হাতের মাঝখানের আঙুলে তার বিয়ের আংটিটা খুলতে অনেক সময় নিল। আংটিটা শক্ত হয়ে আটকে গেছে, টেনে খোলা যাচ্ছিল না, কফিল উদ্দিন একবার প্রায় হাল ছেড়েই দিচ্ছিল কিন্তু খাঁটি সোনার মোটাসোটা পাথর বসানো আংটিটার লোভ ছেড়ে দেয়া এত সোজা নয়। টানাটানি করে শেষ পর্যন্ত আংটিটা ছুটিয়ে নিয়ে আসে। নিজের আঙুলে পরে দেখল বেশ ফিট করে গেছে। কফিল উদ্দিন আংটিটা আর খুলল না, আঙুলে লাগিয়ে রেখে দিল।

কফিল উদ্দিন তারপর মানুষটার ব্যাগ খুলল। ভেতরে কাপড়, জামা, তোয়ালে এবং তার তলায় একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। কফিলের মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে ল্যাপটপটা বের করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। এখন সে মোটামুটি ট্রেন থেকে নেমে যাবার জন্যে প্রস্তুত। মানুষটাকে মেরে ফেলার তার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। মানুষটার সম্ভবত হার্টের সমস্যা ছিল। হয়তো এমনিতেই মারা যেত-আজ ধুতুরার বিষ খেয়ে একটু আগে মারা পড়েছে।

কফিল উদ্দিন মানুষটার দিকে তাকাল, আধখোলা চোখ-মুখটা অল্প একটু খোলা। গায়ের রংটা এর মাঝে কেমন জানি অসুস্থ নীলাভ হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে চোখ-মুখ একটু ফুলেও এসেছে। কফিল উদ্দিনের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে-একটু আগেই মানুষটা বেঁচে ছিল তখন তাকে এতটুকু ভয় লাগেনি, কিন্তু এখন তার দিকে তাকাতেই তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠতে থাকে।

কফিল উদ্দিন কোথায় বসবে বুঝতে পারে না, মৃতদেহটির পাশে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, ওপরের বার্থে ওঠার সাহস করছে না। শেষ পর্যন্ত সে চাদরটা বিছিয়ে মেঝেতেই বসে পড়ল। এখন ট্রেনটা থামতেই সে নেমে পড়বে।

মেঝেতে বসে যাবার পর কফিল উদ্দিনের চোখ একটু পর পর মৃতদেহটার দিকে যেতে লাগল এবং প্রতিবারই সে চমকে উঠতে লাগল। একটি মৃতদেহ দেখে এত ভয় লাগে কেন কে জানে? একবার ইচ্ছে হলো বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু মৃতদেহটা রেখে দরজা খোলা রাখাও বিপজ্জনক। কেউ যদি ঢুকে গিয়ে দেখে ফেলে তখন কী হবে?

কফিল উদ্দিন কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কেবিনের লাইট নিভিয়ে দিল, সাথে সাথে ভেতরে জ্যোৎস্নার একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে। আবছা অন্ধকারে হঠাৎ করে মৃতদেহের বিভীষিকাটা আড়াল হয়ে যায়। মানুষটাকে এখন আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্নায় আবছা আলোতে শুধু তার অবয়বটুক অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। কফিল উদ্দিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল-এখন ট্রেনটা কোনো একটা স্টেশনে থামতেই সে নেমে পড়বে।

ট্রেনটা থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না। গভীর রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে গ্রাম ক্ষেত নদী গাছপালা ভেঙে ট্রেনটা ছুটে যেতে থাকে। কফিল উদ্দিন অপেক্ষা করতে থাকে, ঠিক কী কারণ জানা নেই তার ভেতরে হঠাৎ অন্য একধরনের আতঙ্ক এসে ভয় করে। অশরীরী আতঙ্ক।

কফিল উদ্দিন চোখ বুজে বসে থাকে, সে ভুলে যাবার চেষ্টা করে এই কেবিনের বার্থে একটা মৃতদেহ শুয়ে আছে এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করে ছোঁয়া যায় এরকম দূরত্বে সে মেঝেতে বসে অপেক্ষা করছে ট্রেনটি থামার জন্যে।

হঠাৎ তার মনে হলো কেউ তার ঘাড়ে স্পর্শ করেছে। কফিল উদ্দিন আতঙ্কে চমকে উঠে চোখ খুলে তাকায় এবং একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। জ্যোৎস্নায় আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল সামনের বার্থে মৃতদেহটি উঠে বসেছে। চলন্ত ট্রেনটা দুলছে। কিন্তু তার ভেতরে বসে থাকা মৃতদেহটি আশ্চর্য রকম স্থির। কফিল উদ্দিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে দেখতে পেল মৃতদেহটি আবার হাত বাড়িয়ে তার ঘাড়টি স্পর্শ করেছে। ভয়ংকর আতঙ্কে তার ছুটে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা তার মাঝে জেগে উঠল কিন্তু সে কোথায় ছুটে যাবে? কোনদিকে ছুটে যাবে।

মৃতদেহটি কিছু একটা বলছে, কথাটা সে শুনতে পেল না, কিন্তু অসুস্থ একধরনের দুর্গন্ধ তার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। মৃতদেহটি আবার কথা বলল, “খসখসে একধরনের কণ্ঠস্বর, চাপা গলায় বলছে, “আংটি।”

কফিল উদ্দিন কী করবে বুঝতে পারল না, মৃতদেহটি তার আংটিটি ফেরত চাইছে। সে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না, বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো সে তার আংটি খোলার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা আঙুলে আটকে গেছে, টেনে খুলতে পারছে না।

মৃতদেহটি খপ করে তার কাধ ধরে নিজের দিকে টেনে এনে জড়িত গলায় বলল, “আংটি। আমার আংটি।”

ভয়ংকর আতঙ্কে কফিল উদ্দিন চিৎকার করে ওঠে কিন্তু মৃতদেহটির কোনো ভাবান্তর হলো না, লোহার মতো শক্ত শীতল হাতে তার বাম হাতটা ধরে মাঝের আঙুলটি নিজের দিকে নিতে থাকে। কিছু বোঝার আগে মৃতদেহটি তার আঙুলটি কামড়ে ধরে।

কফিল উদ্দিন প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে, নিজের ভেতরে শুধু একটা চিন্তা কাজ করছে, তার নিজেকে মুক্ত করতে হবে, যেভাবে হোক তাকে পালিয়ে যেতে হবে। প্রাণপণে সে নিজের হাতকে মুক্ত করে জানালা দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে-বাতাসে তখনো তার আর্তনাদ শোনা যেতে থাকে।

কেবিনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ট্রেনের কর্মকর্তারা একটা মৃতদেহকে আবিষ্কার করলেন। সেটি মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সোজা করার পর দেখা গেল তার মুখে রক্ত।

কাছেই একটি আঙুল পড়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ আঙুলটি ছিঁড়ে শরীর থেকে আলাদা করেছে।

মৃতদেহটির পকেটে মানিব্যাগ, মোবাইল টেলিফোন বাঁ হাতে ঘড়ি ছিল না।-শুধু বাম হাতের মধ্যমাতে একটা আংটি ছিল। পাথর বসানো সোনার সুদর্শন একটি আংটি।

মুকিদ আলীর শেষ পর্ব

মুকিদ আলীর বাবা খুব শখ করে তার ছেলের নাম রেখেছিল মোহাম্মদ মুকিদ আলী, কিন্তু এখন তাকে কেউ সেই নামে চিনে না, সবাই তাকে ডাকে মুইক্কা চোরা’। মুকিদ আলীর মাঝে মাঝে যে এটা নিয়ে দুঃখ হয় না তা না। একসাথে চুরি করতে গিয়ে ইদরিস আলী ধরা পড়ল না বলে তার কিছু হলো না আর সে ধরা পড়ে গেল বলে তার নাম হয়ে গেল মুইক্কা চোরা। শুধু কি নাম? সবাই মিলে এমন মার মেরেছিল যে পুরো এক মাস তার বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। এখনো বাম পা-টাতে জোর পায় না একটু টেনে টেনে হাঁটতে হয়। কার্তিক মাসের অভাবের সময় অন্য দশজনের মতো সেও ছোটখাটো চুরি-চামারি করেছে কিন্তু এটাই যে তার সত্যিকার পেশা হয়ে যাবে সেটা সে কোনো দিন কল্পনা করে নাই। নামের পেছনে চোরা শব্দটা লেগে যাবার পর তার আর কোনো উপায় থাকল না, কেউ কাজকর্ম দেয় না, কোথাও গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাই শেষ পর্যন্ত এ কাজেই তাকে পাকাপাকিভাবে লেগে যেতে হলো। এখন সে মোটামুটিভাবে চুরি-চামারি করেই দিন কাটায়-তবে সমস্যা একটাই, আশেপাশে দশ গ্রামে কোনো বাড়িতে চুরি হলে থানাওয়ালারা প্রথমেই তাকে ধরে আনে, তারপর যা একটা পিটুনি দেয় তার কোনো মা-বাপ নেই। পাবলিকের মার তবু সহ্য করা যায় কিন্তু পুলিশের মার খুব কঠিন বস্তু।

.

চোর হলেও এ এলাকার মানুষ যে তাকে খুব হেলাফেলা করে তা না। অন্য গ্রামে বিএ পাস মাস্টার আছে, দারোগা আছে, পাস করা ডাক্তার আছে তাদের গ্রামের বিখ্যাত মানুষ বলতে এই মুইক্কা চোরা। কাজেই গ্রামের লোকজন তাকে অল্পবিস্তর খাতির করে। বলাইয়ের চায়ের দোকানে গেলে বলাই চোখ টিপে বলে, “কী রে মুইক্কা-আজকে কার সর্বনাশ করে আইলি?” মুকিদ আলী তখন দুর্বলভাবে হাসে কিছু বলে না। চোর-মানুষদের কথা বলা ঠিক না, কেউ তাদের কথা বিশ্বাস করে না। বলাই তার সাথে একটু-আধটু ইয়ারকি-তামাশা করে ঠিকই, কিন্তু দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় না। ভেতরে গিয়ে বসলেও আপত্তি করে না। মন-মেজাজ ভালো থাকলে একটা কুকি বিস্কুট, আধখানা গজা বা এক কাপ চা খেতে দেয়।

আজকে সন্ধ্যেবেলা মুকিদ আলী বলাইয়ের চায়ের দোকানে চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে, যা একটা ঠাণ্ডা পড়েছে সে আর বলার মতো না। গরম চা আর একটা বিড়ি টেনেও শরীরটা ঠিক মতোন গরম হচ্ছে না। সাহস করে আরো এক কাপ চা চেয়ে ফেলবে কী

বুঝতে পারছিল না। তখন গ্রামের মাতব্বর মোদাব্বের মুন্সী এসে ঢুকল, সে কখনো একা চলাফেরা করে না, সব সময়ে তার সাথে দু-একজন থাকে। আজকেও আছে, এ গ্রামেরই দুজন-কুদ্দুস আর গহর আলী। সবাইকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে একবার তাকাতেই তার মুকিদ আলীর দিকে নজর পড়ল। মোদাব্বের মুন্সী ভুরু কুঁচকে বলল, “‘কী রে মুইক্কা তুই এইখানে? কবে ছাড়া পেলি?”

মুকিদ আলী হাত কচলে বলল, “‘বছর দুই হইছে চেয়ারম্যান সাহেব।”

“দুই বছর জেলের বাইরে? বলিস কী রে মুইক্কা?”

মুকিদ আলী কথা না বলে তার ময়লা হলুদ দাঁত বের করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

“তা এইখানে কী মতলব? চুরি না অন্য কিছু?”

“কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব!” মুকিদ আলী নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “জব্বর ঠাণ্ডা পড়ছে তাই ভাবলাম বলাই কাকার রেস্টুরেন্টে এক কাপ চা খায়া যাই।”

“তোদের আবার ঠাণ্ডা লাগে নাকি? মাঘ মাসের শীতে খালি গায়ে তেল মাইখ্যা চুরি করস না?”

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় দেয়া সম্ভব নয়, তাই মুকিদ আলী তার চেষ্টা করল না। হাসার একটা দুর্বল ভঙ্গি করে বলল, “ কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব!”

মোদাব্বের মুন্সী গ্রামের একজন গণ্যমান্য মানুষ, একটা চোরের সাথে তার বেশি সময় কথা বলা ঠিক না, তাই সে হঠাৎ মুখটা কঠিন করে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মুকিদ আলীকে যেন দেখতেই পায় নাই এরকম ভান করে বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বলাই, তিন কাপ চা দো ফ্রেশ পাত্তি দিবি।”

বলাই বলল, “জে আচ্ছা চেয়ারম্যান সাহেব।”

মোদাব্বের মুন্সী তখন কুদ্দুস আর গহর আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তারপর কী হলো মোসলেম মিয়ার?”

“কী আর হবে। ঠাঠা পড়লে শরীরের কী কিছু থাকে? এত বড় জোয়ান মানুষ, পুরা শরীর পুইড়া কয়লা।”

মোসলেম মিয়া এই গ্রামেরই মানুষ, নানারকম অসামাজিক কাজ নেশা ভাং এসব নিয়ে থাকতো। বাবার একমাত্র ছেলে, বাবার সব সহায়-সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে মোটামুটিভাবে উচ্ছন্নে গিয়েছিল।

গতরাত্রে হঠাৎ করে অসময়ের ঝড়ে বাজ পড়ে মারা গিয়েছে। গ্রামের এতগুলো মানুষ, মৃত্যু এখানে এমন কিছু অপরিচিত বিষয় নয় তবে বাজ পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। সারা গ্রামেই এখন সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা উত্তেজনা রয়েছে।

মোদাব্বের মুন্সী মাথা নেড়ে বলল, “আমি কতবার কইছি মোসলেম মিয়ারে এই নাফরমানি কাজ বন্ধ কর, হারামজাদা আমার কথা শুনল না। আল্লাহর গজব কারে কয় এখন বুঝল কী না?”

গহর আলী মাথা নেড়ে বলল, “আল্লাহর মাইর চিন্তার বাইর।”

মোদাব্বের মুন্সী বলল, “তার বাপ ছিল ভদ্রলোক। ছেলেটা এইভাবে নষ্ট হলো?”

কুদ্দুস বলল, “একদিক দিয়া ভালোই হইছে মরছে। টাকা-পয়সার খুব কষ্টে আছিল নাকি।”

গহর আলী বলল, “মনে আছে চেয়ারম্যান সাহেব, বাপের একমাত্র ছেলে কত সহায়-সম্পত্তি? বিয়া করল কাঞ্চনপুর গ্রামে?”

কুদ্দুস বলল, “বউটা মইরা বাঁচছে।”

মোদাব্বের মুন্সী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। বউটার হায়াত নাই”

গহর আলী বলল, “এর বউটা ভালো ছিল। বউটা বাঁইচা থাকলে মনে হয় মোসলেম মিয়ার এই অবস্থা হয় না। টাকা-পয়সা এইভাবে নষ্ট করে না।”

কুদ্দুস বলল, “নষ্ট বলে নষ্ট। শেষের দিকে নাকি ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। কী অবস্থা!”

মোদাব্বের মুন্সী হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করল। কুদ্দুস অবাক হয়ে বলল, “কী হলো চেয়ারম্যান সাহেব? হাসেন কেন?”

“মানুষের কপাল! এই মোসলেম মিয়ার টাকা-পয়সার কত দরকার, সেই টাকা-পয়সার খনি আল্লাহ তারে দিল কিন্তু ভোগ করার উপায় নাই!”

কুদ্দুস এবং গহর আলী কেউই ঠিক বুঝতে পারল না মোদাব্বের মুন্সী কী বলছে। একজন আরেজকনের দিকে তাকিয়ে তারা মোদাব্বের মুন্সীর দিকে তাকাল। কুদ্দুস বলল, “কী বলছেন চেয়ারম্যান সাহেব? টাকা-পয়সার খনি?”

মোদাব্বের মুন্সী মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়তে লাগল, বলল, “খনি না তো কী? দুই-চাইর লাখ টাকার কম না!”

কুদ্দুস সোজা হয়ে বসে বলল, “কী জিনিস দুই-চার লাখ টাকার কম না?”

মুকিদ আলীর একটা ঝিমুনির মতো এসেছিল, দুই-চার লাখ টাকার কথা শুনে মুহূর্তের মাঝে তার ঝিমুনি দূর হয়ে গেল কিন্তু সেটা সে কাউকে বুঝতে দিল না। চোখে-মুখে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে মোদাব্বের মুন্সীর কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগল।

মোদাব্বের মুন্সী এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “তোমরা জানো না মানুষের শরীলে ঠাঠা পড়লে কী হয়?”

“কী হয় চেয়ারম্যান সাহেব?”

“ঠাঠা হইলো ইলেকট্রিসিটি। শরীলের ভেতর দিয়া যখন ইলেকট্রিসিটি যায় তখন চুল চামড়া গোশত পুইড়া কয়লা হইয়া যায়। কিন্তুক”

“কিন্তুক কী?”

“শরীলের হাড্ডির মাঝে পরিবর্তন হয়। শরীলের হাড্ডি চুমুক হয়ে যায়।”

গহর আলী চোখ বড় বড় করে বলল, “চুম্বুক? চুম্বুক কী চেয়ারম্যান সাহেব?”

“চুম্বুক হইলো সোনা থেকে দামি। এমন এক জিনিস যেটা সবকিছু আকর্ষণ করে।”

মোদাব্বের আলী চুম্বক নামক বস্তুটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “ আকর্ষণের মতো একটা কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে পেরে বিশেষ প্রীত হলো। মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “এই মোসলেম মিয়া-তার টাকা-পয়সার কত অভাব। কিন্তু চিন্তা করো তার শরীলের মূল্য এখন লাখ টাকার কম না!”

কুদ্দুস এবং গহর আলীর চোখে একধরনের লোভ খেলা করে সেটা আবার দপ করেনিভে যায়। একটা মৃত মানুষের পুড়ে যাওয়া শরীরের মূল্য যতই হোক সেটা তারা তুলে আনতে পারবে বিক্রিও করতে পারবে না।

মুকিদ আলীর কথা ভিন্ন, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে, কিন্তু সে সেটা কাউকে বুঝতে দিল না। মাথাটা পেছনে হেলান দিয়ে সে ঘুমের ভান করে বসে রইল। কুদ্দুস কিংবা গহর আলীর সাহস

থাকতে পারে কিন্তু তার সাহসের অভাব নাই। মোসলেম মিয়ার মূল্যবান শরীর সে ঠিকই তুলে আনতে পারবে! শুধু তার কবরটা খুঁজে বের করতে হবে। কোথায় দিয়েছে কবর? সে আবার কান খাড়া করে, কারণ শুনতে পেল মোদাব্বের মুন্সী ঠিক সেই প্রশ্নটাই করেছে।

“কবর দিছে কোনখানে?”

কুদ্দুস বলল, “সরকারি গোরস্তানে।

“সরকারি গোরস্তানে জায়গা কই?”

“একটা পুরান কবরের ভেতরে কবর দিছে। পশ্চিম দিকে একেবারে দেওয়ালের কাছে।”

“অ” মোদাব্বের মুন্সী একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মোসলেম মিয়ার আত্মীয়স্বজন নাই। যদি থাকত আমি কী বলতাম জানো?”

“কী বলতেন চেয়ারম্যার সাহেব?”

“আমি বলতাম লাঠি-সড়কি নিয়া কবর পাহাড়া দিতে। এই কবর এখন সোনার খনি।”

কুদ্দুস এবং গহর আলীর চোখ আবার চকচক করে উঠে আবার দপ করে নিভে যায়।

বলাই ততক্ষণে টেবিলে চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে মোদাব্বের মুন্সী তখন রাজনীতির আলাপ করে। আমেরিকা এবং চীন কেন এ দেশের দিকে নজর দিচ্ছে সেই ব্যাপারটি সে কুদ্দুস এবং গহর আলীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মুকিদ আলী সেগুলো বসে বসে শুনে কিন্তু কোনো কথাই তার মাথার ভেতরে ঢুকে না। সে চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পায় সরকারি গোরস্তানের পশ্চিম পাশে মোসলেম মিয়ার কবর, যেটা খুঁড়ে সে লাখ টাকা দামের পোড়া একটা শরীর বের করে আনছে। তার এ কষ্টের জীবন হয়তো এভাবেই শেষ হবে খোদা হয়তো এটাই তার কপালে রেখেছেন।

মোদাব্বের মুন্সী কুদ্দুস আর গহর আলীকে নিয়ে না ওঠা পর্যন্ত মুকিদ আলী ঘুমের ভান করে বসে রইল। তারা উঠে যাবার পর সেও উঠে দাঁড়ায়। বলাই চোখ মটকে বলে, “কী রে মুইক্কা কই যাস?”

“বাড়ি যাই। শরীলের মাঝে জুত পাই না।”

“এত সকালে বাড়ি গিয়া কী করবি? রাত গভীর না হলে কী চুরিতে বার হওয়া যায়?”

মুকিত আলী ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠল, সত্যিই সে আজ রাতটা গম্ভীর হলেই চুরি করতে বের হবে কিন্তু বলাইয়ের সেইটা জানার কথা না। মুকিদ আলী জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “আপনি যে কী কন বলাই কাকা!”

.

বাইরে ঘন কুয়াশা এবং কনকনে শীত। মুকিদ আলীর মনটা ভালো হয়ে গেল কবর খুঁড়ে লাশ চুরির জন্যে এর চাইতে ভালো পরিবেশ আর কিছু হতে পারে না। সরকারি কবরস্থান গ্রামের বাইরে, আশেপাশে বসতি নাই। বসতি থাকলেও এই শীতে কেউ বের হবে না। যদি বেরও হয় এই ঘন কুয়াশায় কেউ তারে দেখবে মনে হয় খোদা তার জন্যেই এইরকম একটা অবস্থা করে দিয়েছেন!

ঘরে ফিরে এসে মুকিদ আলী চারটে ভাত ফুটিয়ে নেয়। দুপুরের বাসি তরকারি ছিল, সেটা দিয়েই সে তৃপ্তি করে খায়। মোসলেম মিয়ার শরীর তুলে আনার পর তার আর বাসি তরকারি দিয়ে ভাত খেতে হবে না। থালাবাসন ধুয়ে সে তার ঘরের বারান্দায় বসে একটা বিড়ি ধরাল, তার ভেতরে একধরনের উত্তেজনা-কোথাও চুরি করতে যাবার আগে সে সব সময় এরকম উত্তেজনা টের পায়।

মুকিদ আলীর ঘড়ি নাই কিন্তু ঘড়ি ছাড়াই সে সময়ের আন্দাজ করতে পারে। ঠিক মাঝরাতে সে একটা কোদাল আর একটা বস্তা নিয়ে বের হলো। অন্ধকার রাত, ঘন কুয়াশায় ঢাকা, গ্রামের নির্জন পথে একটা মানুষ নেই। মুকিদ আলী নিঃশব্দে গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যায়, দীর্ঘদিনের অভ্যাস-হাঁটলে তার পায়ের কোন শব্দ হয় না।

সরকারি গোরস্তানের কাছাকাছি এসে সে খালের পাড়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে কিছুক্ষণ বসে রইল। কেউ যদি আশেপাশে থেকে থাকে তাহলে তার চোখে পড়বে। যখন দেখল কেউ নেই তখন সে সাবধানে দেওয়াল টপকে গোরস্তানের ভেতরে ঢুকল। ভেতরে একধরনের সুনসান নীরবতা। গোরস্তানের ভেতর বড় বড় গাছ, নিচে গাছের শুকনো পাতা-অন্য যে কেউ হলে শুকনো পাতার শব্দ হতো কিন্তু মুকিদ আলী নিঃশব্দে হেঁটে গেল।

কৃষ্ণপক্ষের রাত, মাঝরাতের দিকে চাঁদ ওঠার কথা, হয়তো এতক্ষণে উঠে গেছে। ঘন কুয়াশায় এই চাঁদের আলো অন্ধকার দূর করতে পারছে না, চারপাশে শুধু একটা ঘোলাটে অস্বচ্ছ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। মুকিদ আলী গোরস্তানের ভেতরে আবছা অন্ধকারে বাঁধানো কবরগুলো দেখতে পায়, সেগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ তার বুকের ভেতরে একধরনের কম্পন অনুভব করে, সে ছোটখাটো দুর্বল মানুষ,কিন্তু তার পরিচয় “মুইক্কা চোরা”–সে অনেক রাতবিরেতে অনেক বনজঙ্গল খালবিল গোরস্তান শ্মশানে রাত কাটিয়েছে, কখনো ভয় পায় নি। আজ এই মধ্যরাতে গোরস্তানে এসে হঠাৎ করে তার বুকে প্রথমবার ভয়ের একধরনের কাঁপুনি খেলে গেল।

মুকিদ আলী ভয়টাকে ঠেলে দূর করে দিয়ে পশ্চিম দিকের দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এইখানে কোনো এক জায়গায় মোসলেম মিয়াকে কবর দেয়া হয়েছে। নতুন কবর, বের করা কোনো সমস্যা হবে না। ওপরে ঢিবির মতো করে মাটি উঁচু করে দেওয়া থাকবে। ঘাসপাতা ঝোঁপঝাড় থাকবে না। শেয়াল যেন না আসে সেজন্যে তুষ ছিটিয়ে দেওয়া থাকবে। মুকিদ আলী অন্ধকারের মাঝে হাতড়ে হাতড়ে দেখতে থাকে। ঠিক তখন সে প্রথমবার শব্দটা শুনতে পায়। খুব মৃদু একটা শব্দ। হুম হুম করে কেউ যেন শব্দ করছে।

মুকিদ আলীর হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ করে যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল। তার একবার মনে হলো বুঝি সে চিৎকার করে ছুটে পালায়, কিন্তু সে পালাল না, শক্ত হয়ে বসে রইল। শব্দটা থেমে থেমে হয়–একটানা কিছুক্ষণ হবার পর আবার থেমে যায়।

“প্যাঁচা।” মুকিদ আলী বোঝাল, “নিশ্চয়ই হুতোম প্যাঁচা।”

মুকিদ আলী গ্রামের মানুষ, গ্রামের পশুপাখির ডাক সে খুব ভালো করে চিনে। মুইক্কা চোরা হিসাবে রাতবিরেতে খালবিলের পাশে, ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বসে বসে অনেক রাতজাগা পাখির শব্দ শুনেছে, সে খুব ভাল করে জানে এটা প্যাঁচার ডাক না তবুও সে নিজেকে বোঝাল এটা আসলে একটা প্যাঁচার ডাক।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে কবরগুলো হাতড়ে হাতড়ে মুকিদ আলী মোসলেম মিয়ার কবরটা খুঁজে বের করল। কাঁচা মাটির ঢিবি, ওপরে তুষ ছড়ানো ঠিক সে যে রকম অনুমান করেছিল।

মুকিদ আলী গামছাটা কোমরে বেঁধে খুব সাবধানে কবরটা খুঁড়তে শুরু করে। কোদালের প্রথম কোপটা দেয়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে হুম হুম শব্দটা থেমে গেল। এতক্ষণে এই হুম হুম শব্দে মুকিদ আলী কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে শব্দটা থেমে যাওয়ায় সে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করে। অস্বস্তির কারণটা সে জোর করে নিজের ভেতরে থেকে সরিয়ে রাখে… তার কেমন জানি মনে হয় এই কবরের ভেতর থেকেই শব্দটা আসছে।

“কবরের ভেতর মোসলেম মিয়ার পুড়ে কয়লা হওয়া শরীল” মুকিদ আলী ফিসফিস করে নিজেকে বোঝাল “এই শরীলের প্রত্যেকটা হাড্ডি একটা করে চম্বুক। চম্বুক হচ্ছে সোনার থেকে দামি! মোদাব্বের মিয়ার নিজের মুখের কথা। আমি নিজের কানে। শুনেছি। কোনোমতে শরীলটা তুলে বস্তা করে বাড়ি নিয়া যামু। বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখমু! সময় হলে খোঁজখবর নিয়া এই হাড্ডি বেচে আমি বড়লোক হয়ে যামু।” মুকিদ আলী একটা উত্তেজনা অনুভব করে। ফিসফিস করে বলে, “আর চুরিচামারি না। এই মুইক্কা চোরা আর চুরি করবে না। এই হচ্ছে শেষ চুরি। জন্মের মতো শেষ।”

মুকিদ আলী নিঃশব্দে কবর খুঁড়তে থাকে। নরম মাটি সহজেই কোদালের কোপের সাথে উঠে আসে। আধাআধি হওয়ার পর হঠাৎ যেভাবে থেমে গিয়েছিল ঠিক সেইভাবে হুম হুম শব্দটা ফিরে এলো, আগের চেয়ে আরো অনেক জোরে, অনেক

স্পষ্টভাবে। শব্দটা লম্বা এবং দীর্ঘ সময়ের, হুম্মম হুম্মম করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মুকিদ আলীর মনে হয় কোনো মানুষ বুঝি জ্বরের ঘোরে কাতর শব্দ করছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কনকনে শীতের মাঝে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। হঠাৎ করে সে নিজের ভেতরে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, একধরনের জান্তব ভয়ে তার শরীর শিউরে ওঠে। এতক্ষণ সে নিশ্চিত হতে পারেনি কিন্তু এখন সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই শব্দটি আসছে কবরের ভেতর থেকে।

মুকিদ আলী কোদালটি হাতে নিয়ে জোরে জোরে মাটিতে দুবার ঘা দিল সাথে সাথে শব্দটা থেমে গেল। ঠিক কী কারণ কে জানে শব্দটা থেমে যাওয়ায় মুকিদ আলীর আতঙ্কটা কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

“এইসব কিছু না।” মুকিদ আলী নিজেকে বোঝাল, “মোসলেম মিয়ার পোড়া লাশ ভেতরে। এই লাশের হাড্ডি হচ্ছে সাত রাজার ধন। সোনার চেয়ে দামি। আমি এই লাশ না নিয়ে যামু না। কিছুতেই যামু না।”

মুকিদ আলী কোদাল হাতে নিয়ে আবার কোপাতে থাকে। শীতের রাতে তার শরীর ঘেমে যায়। চাদরটা খুলে সে কবরে নেমে মাটিগুলো ওপরে তুলতে থাকে। দেখতে দেখতে গর্ত গম্ভীর হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সে কবরের ওপরে ছাউনির মতো করে দেয়া বাঁশগুলোর সন্ধান পায়।

ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, একটু আলো থাকলে খুব সুবিধে হতো। তার খুটের ভেতর ম্যাচ আছে সে একবার জ্বালাবে কী না বুঝতে পারছিল না। বাঁশগুলো সরালেই সে কাফন দিয়ে মোড়ানো লাশটা পেয়ে যাবে। মুকিদ আলী উবু হয়ে বসে বাঁশগুলো তুলতে শুরু করে।

হঠাৎ হুমমম করে একটা বিকট শব্দ হলো-সাথে সাথে কবরের বাঁশ ভেঙে সাদা কী একটা যেন ছিটকে বের হয়ে আসে। মুকিদ আলী আর্তচিৎকার করে পিছিয়ে আসে, আবছা অন্ধকারে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না সাদা মতোন কিছু একটা দুলছে, দুলতে দুলতে সেটা হুমমম করে একটা শব্দ করছে। শব্দের সাথে সাথে মাংস পোড়া একটা দুর্গন্ধে পুরো জায়গাটা যেন ভরে গেল।

মুকিদ আলী কঁপা হাতে তার কোমরে গোজা ম্যাচটা বের করে ফস করে একটা কাঠি জ্বালাল। কাফনে মোড়া মোসলেম মিয়ার শরীর, কাফন থেকে মাথাটা বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাচের কাঠির আলো থেকে আড়াল করার জন্যে মোসলেম মিয়া দুই হাত সামনে তুলে ধরল, পোড়া মাংসের আড়াল থেকে হাড় বের হয়ে আছে।

“মুকিদ আলী কোদালটা হাতে নিয়ে পিছিয়ে আসে! প্রচণ্ড আতঙ্কে সে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, সে শুধু জানে তাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক পালাতে হবে।

ঠিক তখন কুয়াশা কেটে চাঁদের আলোতে হঠাৎ করে পুরো এলাকাটা আলোকিত হয়ে উঠল। মুকিদ আলী দেখল গোরস্তানের দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে ছায়ামূর্তির মতো কারা যেন বসে আছে। দীর্ঘ দেহ ক্রুদ্ধ চোখের দৃষ্টি।

কোদালটা ফেলে দিয়ে সে উল্টোদিকে দৌড় দেবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল, তাকিয়ে দেখে সেদিকেও কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা একটা ছায়ামূর্তি, মনে হয় মাথাটা বুঝি গাছের ডগা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চেখের দৃষ্টিতে ক্রোধ এবং ঘৃণা।

গোঙানোর মতো একটা শব্দ করে মুকিদ আলী মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, আর উঠল না।

জীবনের শেষ চুরিটি সে আর সমাপ্ত করতে পারল না।

টেলিভিশন

যখন বিকেলবেলা রওনা দিয়েছি তখন একবারও সন্দেহ করিনি সন্ধ্যের পর এরকম অবস্থা হবে। শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত মোটামুটি গাড়ি চালিয়ে আনা গেছে, শ্রীমঙ্গলের পর হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন কুয়াশা এসে চারিদিক ঢেকে ফেলল। শীতকালে সন্ধ্যেবেলায় একটু-আধটু কুয়াশা পড়তেই পারে, কিন্তু তাই বলে এরকম কুয়াশা? দেখে মনে হয় যেন সামনে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল, গাড়ির হেডলাইট সেই দেওয়ালকে ভেদ করে যেতে পারে না-শুধু সেটাকে সামনে কয়েক ফুট ঠেলে সরিয়ে দেয়। কুয়াশায় সেই দেওয়ালকে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে গারি চালানো নিশ্চয়ই খুব সহজ ব্যাপার না, ঘণ্টাখানেক চালিয়ে আমার ড্রাইভার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবস্থা জটিল স্যার।”

আমার ড্রাইভার কম কথার মানুষ। কোনো পরিস্থিতিকেই তার কাছে জটিল মনে হয় না-শেষবার সে যখন বলেছিল অবস্থা জটিল-তখন কিছু ডাকাত রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ডাকাতি করার চেষ্টা করেছিল। আমাদের করিৎকর্মা ড্রাইভারের নির্বুদ্ধিতার কাছাকাছি দুঃসাহসিকতা আর কপাল গুনে সেবার বেঁচে গিয়েছিলাম। কাজেই আজকে সে যখন আবার বলল, “অবস্থা জটিল, তখন আমি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কী করবে তাহলে? গাড়ি থামাবে?”

ড্রাইভার ঘন কুয়াশায় সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থেমে বলল, “না স্যার, গাড়ি থামানো যাবে না। জায়গাটা ভালো না।”

জায়গাটা কেন ভালো না আমি সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না, আমি জানি জিজ্ঞেস করলে সে কথার উত্তর দেবে না। রাস্তাঘাট বা গাড়ি চালানো এরকম কিছু বিষয়কে সে পুরোপুরি তার নিজস্ব বিষয় বলে বিবেচনা করে, আমার সাথে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আমি বললাম, “ সামনে কোনো চা বাগানে ঢুকে গেলে কেমন হয়?”

ড্রাইভার আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, আমি আন্দাজ করেছিলাম সে উত্তর দিবে না। আমি প্রস্তাবটাকে আরেকটু জোরদার করার জন্যে বললাম, “চা বাগানে সব সময় একটা গেস্ট হাউস থাকে।”

ড্রাইভার এবারেও কোনো উত্তর দিল না। আমার প্রস্তাবটি এখনো তার কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমি বললাম, “আমার পরিচিত একজন ম্যানেজার আছে–

ড্রাইভার এবারে কথার উত্তর দিল। বলল, “কোন বাগানের ম্যানেজার, স্যার?”

“বাগানের নাম মনে হয় চাকলী ছড়া। এই আশেপাশে থাকার কথা।”

ড্রাইভার আমার কথার এবারেও কোনো উত্তর দিল না, কাজেই তার হাতে পুরোপুরি নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া এখন আমার আর কিছু করার নেই। কুয়াশায় একটু পরে পরে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তাই ওয়াইপার দিয়ে সেটা পরিষ্কার করতে হচ্ছে কিন্তু কাঁচ পরিষ্কার হচ্ছে কীনা বোঝার কিছু নেই-সামনে কুয়াশার দুর্ভেদ্য সাদা দেওয়াল। মাঝে মাঝে একেবারে হঠাৎ করে সামনে থেকে আসা কোনো গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়-কিন্তু সেটা দেখা যায় একেবারে কাছে চলে আসার পর, দূর থেকে দেখা যাবার কোনো উপায় নেই। ভাগ্যিস কুয়াশার ভয়ে সবাই গাড়ি চালাচ্ছে একেবারে শামুকের গতিতে তা না হলে যে কী অবস্থা হতো কে জানে। প্রত্যেকবার সরু রাস্তায় একটা ট্রাক বা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাই আর আমি বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিই। এই ভয়ংকর রাস্তা কখন শেষ হবে কখন ঢাকা পৌঁছাব কে জানে।

এভাবে আরো কতক্ষণ গিয়েছে কে জানে, হঠাৎ ড্রাইভার ব্রেক করে গাড়িটা থামাল। আমি ভয় পাওয়ার গলায় বললাম,”কী হয়েছে?”

“বাগান।”

“বাগান?”

“জে। চাকলী ছড়া বাগান।”

এই ঘোর কুয়াশার মাঝে সে চাকলী ছড়া চা বাগান কেমন করে খুঁজে পেল কে জানে। আমি ডানে-বামে তাকিয়ে ঘন কুয়াশায় দেওয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “ কোথায় বাগান?”

“ওইদিকে। বাম দিকে।”

আমি বাম দিকে তাকালাম এবং মনে হলো ঘন কুয়াশার মাঝে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে কুয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে তার উত্তপ্ত গলায় আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে কম কথার মানুষ এবং যে দু-একটি কথা বলে সেটি ঠাণ্ডা গলায় বলতে পারে না। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবার আগে আমিও গাড়ি থেকে নেমে টিমটিমে আলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট একটা চালাঘরের মাটির মেঝেতে কাঠকুটো দিয়ে একটা আগুন জ্বালিয়ে একজন হালকা-পাতলা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা গরম করছে। আমার ড্রাইভার আবার গর্জন করে বলল, “গেট খুলো তাড়াতাড়ি।”

চাদর মুড়ি মানুষটা বলল, “আপনারা কেডা? কী চান?”

ড্রাইভার আবার হুঙ্কার দিয়ে বলল, “সেইটা দিয়ে তোমার কী হবে? গেট খুলতে বলছি গেট খুলো।”

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ম্যানেজার সাহেব আমার পরিচিত, তার সাথে দেখা করতে যাব।”

মানুষটা উঠে পঁড়িয়ে আগুনের আলোতে আমাকে যাচাই করে দেখল, মনে হলো তার পরীক্ষায় আমি পাস করে গেলাম। ইউনিভার্সিটির মাস্টারদের চেহারায় একধরনের গোবেচারা গোবেচারা ভাব থাকে, কেউ খুব একটা সন্দেহ করে না। সে তার কোমরে সুতায় বাঁধা একটা চাবি হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেটটা অবিশ্যি খুব সরল, একটা বাঁশ আড়াআড়িভাবে ফেলে রেখেছে, সেটাই শিকল দিয়ে বাঁধা। বাঁশের ওপরে এবং নিচ দিয়ে যে কোনো প্রাণী চলে যেতে পারবে সেটা নিয়ে কারো কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এই গেটের উদ্দেশ্য গাড়িকে আটকানো।

বাঁশটা তুলে দেবার পর ড্রাইভার গাড়িতে বসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “ম্যানেজার সাহেবের বাসা কোথায়?” দারোয়ান গেট খোলা এবং বন্ধ করার বাইরে কোনো দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, সে অনিশ্চিত একটা ভঙ্গি করে বলল, “ওই যে হেই দিকে।”

কথাটি দিয়ে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, ড্রাইভারও কিছু বুঝল বলে মনে হলো না, কিন্তু সে তার সাথে কথা বলে আর সময় নষ্ট করল না, চা বাগানের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেলল। একটু আগে রাস্তাটি অন্তত পাকা রাস্তা ছিল, এখন রাস্তাটি কাঁচা, ঘন কুয়াশায় সেটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কোথায় শেষ হয়েছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি ভয়ে ভয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম, সে মুখের মাংসপেশি শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছে। উঁচু-নিচু খানাখন্দ ভেঙে সে ঘন কুয়াশা ভেদ করে যে পথ দিয়ে যাচ্ছে সেটা যে একটি রাস্তা আমার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। কতক্ষণ এভাবে গিয়েছি জানি না, এক সময় ড্রাইভার ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে বলল, “এসে গেছি।”

আমি আশেপাশে ঘন কুয়াশা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম। না, কিন্তু ড্রাইভার যখন বলেছে এসে গেছি তখন নিশ্চয়ই এসে গেছি। আমি গাড়ি থেকে নামলাম, সত্যি সত্যি মনে হলো দুই পাশে আবছা জমাট বাঁধা অন্ধকার, এগুলো নিশ্চয়ই বাড়িঘর। চা বাগানের ম্যানেজার বা স্টাফদের বাসা এখানে থাকার কথা। কোথায় গিয়ে কীভাবে খোঁজ নেব বিষয়টি নিয়ে যখন একটু অস্বস্তি বোধ করছি ঠিক তখন মনে হলো অন্ধকার কুঁড়ে হঠাৎ একজন মানুষ আমার সামনে হাজির হলো। আমি চমকে উঠেছিলাম, কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যানেজার সাহেবের বাসা কোনটা?”

“এই তো এইটা।” বলে মানুষটা হাত তুলে কিছু একটা দেখিয়ে দিল, আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি বড় বড় গাছে ঢাকা একটা বাসা, কুয়াশার জন্যে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

“গেটটা কোথায়?”

“এই যে এইখানে–” মানুষটা হাত তুলে সামনে দেখাল। আমি একটু এগিয়ে দেখি সত্যি সত্যি একটা গেট। গেট খুলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে থাকি–বেশ কিছুক্ষণ থেকে আমি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, এখন অস্বস্তিটা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। আমি ড্রাইভারের কাছে বেশ জোর গলায় দাবি করেছি এই বাগানের ম্যানেজারের সাথে আমার পরিচয় আছে–কথাটা আসলে পুরোপুরি সত্যি নয়। একদিন ট্রেনে করে আসার সময় ম্যানেজার সাহেব পাশের সিটে বসেছিলেন, ট্রেনে পাশাপাশি বসলে যেরকমটি কথা হয় তার সাথে সেরকম কথা হয়েছে এবং ট্রেন থেকে নামার সময় আমাকে বলেছিলেন, “একদিন বাগানে বেড়াতে আসবেন।” আমিও বলেছিলাম, “আসব, নিশ্চয়ই আসব।” ভদ্রলোকও ভদ্রতা করে বলেছিলেন আমিও ভদ্রতা করে উত্তর দিয়েছিলাম। এখন সত্যি সত্যি বিনা আমন্ত্রণে রাত কাটাতে চলে এসেছি বিষয়টি রীতিমতো লজ্জাজনক। ম্যানেজার ভদ্রলোক যদি আমাকে চিনতে না পারেন, তখন কী হবে?

আমি লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে দরজায় টোকা দিলাম, কয়েকবার শব্দ করার পর কালো এবং শুকনো মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দরজা খুলে দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম, “ম্যানেজার সাহেব বাসায় আছেন?”

“জে। আছে।” মানুষটা আমাকে একটু খুঁটিয়ে দেখে বলল, “ বসেন। সাহেবরে খবর দিই।”

ভেতরে দামি সোফা। শোকেসে নানা ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই। দেওয়ালে কিছু বাঁধানো ছবি। ঘরে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে কিন্তু ভোল্টেজ কম আলোগুলি অনুজ্জ্বল এবং মন খারাপ করা। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসে আছি, ম্যানেজার সাহেব আসার পর তিনি যদি আমাকে না চেনেন তাহলে কীভাবে কথা বলব?

আমি যখন এ ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি ঠিক তখন ভেতর থেকে একজন লোক বের হয়ে এলো, এই শীতের মাঝে তার পরনে হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল, “আরে আপনি?”

আমি লোকটাকে এবার চিনতে পারলাম, এই চা বাগানের ম্যানেজার। ট্রেনে তিনি যখন আমার পাশে বসেছিলেন তখন রীতিমতো স্যুট-টাই পরেছিলেন এখন হাফ প্যান্ট পরে আছেন বলে চিনতে পারছি না। চা বাগানের ম্যানেজাররা যে হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতে পারেন আমি সেটা কখনো কল্পনাও করিনি! ম্যানেজার সাহেব এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘আপনি যদি আর একদিন আগে আসতেন কী চমৎকার হতো!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

“আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হতো। আজ দুপুরেই ঢাকা গেছে।”

ট্রেনে পাশাপাশি বসে আসার সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম চা বাগানের ম্যানেজারেরা খানিকটা নিঃসঙ্গ হন। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবার পর ভালো স্কুলে যাবার জন্যে ঢাকা চলে যায়, সাথে মায়েরাও থাকে, নিঃসঙ্গ বাবা একা একা চা বাগানে ঘুরে বেড়ান। ম্যানেজার সাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আমার স্ত্রী থাকলে খুব খুশি হতো–এই সেদিনও তার সাথে আপনার কথা বলছিলাম!”

এই ভদ্রলোক তার স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্কে কী কথা বলছিলেন আমি আর সেটা নিয়ে কৌতূহল দেখালাম না। ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পেরেছেন তাতেই আমি খুশি। বুকের মাঝে আটকে থাকা চাপা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বললাম, “ আমিও ঢাকা যাচ্ছিলাম। পথে যা কুয়াশা পড়েছে সেটা আর বলার মতো নয়। ড্রাইভার আর এগুতে সাহস করছে না, ভাবলাম এখানে রাত কাটিয়ে যাই।”

ম্যানেজার সাহেব হাসার ভঙ্গি করে বললেন, “কুয়াশাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তার কারণে অন্তত আমাদের বাগানে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল!”

আমি বললাম, “আমার পায়ের ধুলো এত মূল্যবান জানলে তো আমি অনেক আগেই খামে ভরে এক প্যাকেট পাঠিয়ে দিতে পারতাম।”

আমার এই মোটা রসিকতাতেই ম্যানেজার সাহেব হা হা করে হাসতে লাগলেন, হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার স্ত্রী থাকলে খুব খুশি হতো। সে খুব মানুষ পছন্দ করে। আপনাদের মতো মানুষ হলে তো কথাই নেই!”

আমাদের মতো মানুষ বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন আমি সেটা নিয়েও কৌতূহল দেখালাম না। ম্যানেজার সাহেব হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি এত লম্বা জার্নি করে এসেছেন নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড।”

আমি বললাম, “না, না–আমি মোটেও টায়ার্ড নই। ঢাকা পর্যন্ত যাবার কথা ছিল–অর্ধেক রাস্তাও যাইনি। টায়ার্ড হবার সময় পাইনি।”

“টায়ার্ড না হলে ভালো কিন্তু আগে আপনাকে হাত-পা ছেড়ে একটু রিলাক্স করার ব্যবস্থা করে দিই। আমার স্ত্রী থাকলে আপনাকে কিছুতেই গেস্ট হাউসে থাকতে দিতো না–এই বাসাতেই রাখতো। কিন্তু আমি সেই রিস্ক নেব না। আপনাকে গেস্ট হাউসেই ব্যবস্থা করে দিই, সেখানে সাপোর্ট স্টাফ ভালো।”

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “হঠাৎ করে চলে এসে আপনাকে কী ঝামেলার মাঝে ফেলে দিলাম!”

ম্যানেজার সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “ছিঃ ছিঃ–আপনি ঝামেলার কথা কী বলছেন! আমার কত বড় সৌভাগ্য আপনি এসেছেন। আর আমাদের চা-বাগানে গেস্ট হাউস সবসময় রেডি থাকে–কখন কে চলে আসে তার ঠিক নেই। আসেন যাই–”

ম্যানেজার সাহেব উঠে একটা হাঁক দিতেই কয়েকজন মানুষ ছুটে এলো, তিনি তাদের একজনকে পাঠালেন গেস্ট হাউস খুলে দিতে, একজনকে পাঠালেন বাবুর্চিকে ডেকে আনতে এবং একজনকে পাঠালেন গাড়ি থেকে আমার ব্যাগ নামিয়ে আনতে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে চা-বাগানের ম্যানেজাররা মোটামুটি জমিদারদের মতো থাকেন।

গেস্ট হাউসে বেশ কয়েকটি ঘর, আমার জন্যে এক কোনার একটা ঘর খুলে দেয়া হলো, কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা সবচেয়ে ভালো ঘর। ভেতরে ঢুকে আমার নিজেরও সন্দেহ থাকল, মোজাইক করা মেঝে, টাইল করা বাথরুম, বড় বড় কাঁচের জানালা, দেয়ালে এয়ারকুলার। বড় বিছানা আমার সামনেই হইচই করে বিছানার চাদর, কম্বল পাল্টে মশারি টানিয়ে দেয়া শুরু হলো।

ম্যানেজার সাহেব এদিক-সেদিক দেখে অপ্রয়োজনে দুই-চারটি ধমক দিয়ে দিলেন এবং তখন চারিদিকে অনেক মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ম্যানেজার সাহেব এই ফাঁকে আমাকে গেস্ট হাউসটা ঘুরিয়ে দেখালেন। সেই ব্রিটিশ আমলে বাংলো ধাঁচে তৈরি, ইটের গাঁথুনির ওপর টিনের ছাদ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকবার ভেতরে পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন বাইরে থেকে এটাকে পুরনো একটা বাংলো মনে হলেও ভেতরে একেবারে আধুনিক আয়োজন। এয়ারকুলার, গরম পানি, ফ্রিজ এমন কী মাঝখানের হলঘরে একটা টেলিভিশন পর্যন্ত রয়েছে! আমি টেলিভিশনটি দেখে বললাম, “চা বাগানের এই নিরিবিলিতে টেলিভিশনটা কেন জানি মানায় না।”

ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। টেলিভিশনের পাশে রিমোট কন্ট্রোলটি রাখা, অনেকটা অভ্যাসের বশেই আমি সেটা হাতে নিয়ে টিপে দিয়েছি, সাথে সাথে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ করে টেলিভিশনটি চালু হয়ে গেল। রিসেপশন খুব খারাপ ঝিরঝিরে স্ক্রিনের ভেতর বাংলা নাটকের আঠা আঠা ভালোবাসার একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। নায়ক কিংবা নায়িকা কারো চেহারাই স্পষ্ট নয় ভাসাভাসা ভাবে তাদের আবেগাপ্লুত গলা শোনা গেল। আমি চ্যানেল পাল্টানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, “কিছুই তো দেখা যায় না।”

“না।” ম্যানেজার বললেন, “পাহাড়ের আড়ালে সে জন্যে সিগন্যাল পাওয়া যায় না।”

আমি বললাম, “উঁচুতে একটা এন্টেনা ঝোলালে মনে হয় ভালো রিসেপশন হবে।”

ম্যানেজার সাহেব হাত নেড়ে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বললেন তারপর এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, “বাগানের মালিকের জন্যে রাখতে হয়-তার টেলিভিশন রোগ আছে।”

“কিন্তু কিছু যদি দেখা না যায় তাহলে টেলিভিশন রেখে লাভ কী?

‘লাভ নেই। কিন্তু অনেকের কাছে টেলিভিশনটা একটা থেরাপির মতো। কাছাকাছি আছে জানলে তাদের একধরনের আরাম হয়। না থাকলে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে!”

আমি শব্দ করে হাসলাম, ব্যাপারটা সত্যি হতেও পারে।

.

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসেছি। কুয়াশা একটু কমেছে বলে মনে হলো, আশেপাশে উঁচু টিলা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ আছে কী না দেখা যাচ্ছে না কিন্তু চারিদিকে একটা নরম আলো। পুরো এলাকাটাতে একধরনের অপার্থিব সৌন্দর্য। গেস্ট হাউসের বয় এসে আমাদের চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে বললাম, “জায়গাটা কী সুন্দর!”

ম্যানেজার সাহেব হাসলেন, বললেন, “বাইরে থেকে যারাই আসে তারাই এই কথা বলে। কিন্তু কয়েকদিন একসাথে থাকতে হলেই তারা হাঁপিয়ে ওঠে। চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যায়।”

আমি বললাম, “সৌন্দর্য জিনিসটা মনে হয় অল্প অল্প করে দেখার জিনিস। মাঝে মাঝে দেখলে ভালো লাগে। একটানা বেশি দেখলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।”

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না, আমি বললাম, “আপনার কেমন লাগে?

“আমার?”

“হ্যাঁ।”

“আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থাকি–এখানে সৌন্দর্য আছে না অসৌন্দর্য আছে সেটাই কখনো খেয়াল করে দেখি না।”

ঠিক এরকম সময় দূর থেকে ঢং ঢং করে দশটা বাজার শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকদিন পর হাতে বাজানো ঘণ্টার শব্দ শুনছি, বিষয়টি এখনো আছে সেটাই জানতাম না। বললাম, “ভারি মজা তো। হাত দিয়ে পিটিয়ে সময় জানিয়ে দিচ্ছে।”

“হ্যাঁ। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে।”

আমি বললাম, “মাত্র দশটা বাজে, মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।”

ম্যানেজার সাহেব বললেন, “চা বাগানে রাত দশটা হচ্ছে নিশুতি রাত।”

আমি বললাম, “আপনার টেলিভিশন ঠিক থাকলে এখন খবর শোনা যেতো।”

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। আমি একটু পরে বললাম, “মনে হচ্ছে পৃথিবীর একেবারে বাইরে চলে এসেছি।”

“উঁহু! পুরোপুরি মনে হচ্ছে না। তাহলে পৃথিবীর খবর শোনার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত হতেন না।”

আমি হাসলাম, বললাম, “এটা অভ্যাস। খবর না শুনলে পত্রিকা না পড়লে কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকে।”

ম্যানেজার বললেন, “ এন্টেনা নাড়াচাড়া করে আপনাকে খবরটা শুনিয়ে দিতে পারি। আমাদের এটেনডেন্ট এ ব্যাপারে মহাওস্তাদ।”

“থাক!” আমি বললাম, “দরকার নেই। এক রাত খবর না শুনলে এমন কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না।”

“থ্যাংক ইউ।” ম্যানেজার সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি টেলিভিশন একেবারে পছন্দ করি না।”

আমি হেসে বললাম, “এটা পছন্দ করার বিষয় নয়। এখনো কাউকে দেখিনি যে টেলিভিশন অপছন্দ করে।”

ম্যানেজার সাহেব বললেন, “আমার অপছন্দ একটি অন্যরকম।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “কী রকম?”

“টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নয়-টেলিভিশন জিনিসটাই আমি দেখতে পারি না। সহ্য করতে পারি না। আমার আমার—”

ম্যানেজার কথা থামিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কী?”

“আসলে টেলিভিশন নিয়ে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল, সেই থেকে আমি আর এটা সহ্য করতে পারি না।”

“কি ঘটেছিল?”

“আমি সাধারণত এটি কাউকে বলি না, বললে বিশ্বাসও করবে না। আপনাকে বলি। বিশ্বাস না করতে চাইলে করবেন না।”

“বিশ্বাস করব না কেন?”

ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনলেই বুঝতে পারবেন।”

কাছাকাছি কোনো গাছে একটা রাতজাগা পাখি পাখা ঝাঁপটিয়ে শব্দ করে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে গেস্ট হাউসের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। বহু দূর থেকে কোন একটা বুনো পশুর ডাক শুনতে পেলাম। চারিদিকে সুনসান নীরব, তার মাঝে ম্যানেজার সাহেব তার গল্প শুরু করলেন। গল্পটা এরকম:

আমার যখন বিয়ে হয় আমি তখনো বুঝতে পারিনি যে আমার স্ত্রী নীলা, অন্য দশটা মেয়ে থেকে অন্যরকম। কখনো গান গাইতে শিখেনি কিন্তু খুব সুন্দর গানের গলা। ছবি আঁকতে শিখেনি। কিন্তু রঙিন কাগজ কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে চমৎকার ডিজাইন করে ফেলতে পারতো। আমার জন্মদিনে একটা পাঞ্জাবি উপহার দিল, নিজ হাতে সেখানে বাটিকের কাজ করেছে। এত সুন্দর যে যেই দেখে সেই অবাক হয়ে যায়। বই পড়ার খুব সখ আমি মোটামুটি চাঁছাছোলা মানুষ তার আগ্রহেই আমারও আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস হলো। মানুষটাও খুব ভোল, হাসি-খুশি চঞ্চল টাইপের। মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো আমার মত মানুষের এত ভালো বউ পাওয়ার কথা না।

আমার স্ত্রী নীলার আগ্রহ কিংবা অনাগ্রহের কারণে আমরা কোনোদিন টেলিভিশন কিনি নি। সে টেলিভিশন পছন্দ করতো না, বলতো যন্ত্র আমার যেটা দেখার দরকার সেটা দেখিয়ে দেবে, যেটা শোনার দরকার সেটা শুনিয়ে দেবে, যেটা বোঝার দরকার সেটা বুঝিয়ে দেবে সেরকম যন্ত্রের আমার দরকার নেই। আমার যখন দেখার দরকার তখন দেখব যখন শোনার দরকার তখন শুনব, যখন বোঝার দরকার তখন বুঝব। যুক্তিটা ভালো না খারাপ আমি জানি না কিন্তু নীলাকে আমি এত ভালোবাসি যে সে যেটা বলে সেটাই আমার সব কিছু। তাই আমার বাসায় শেলফ ভরা বই, তাক ভরা লং প্লেয়িং রেকর্ড, দেওয়াল ভরা পেইন্টিং কিন্তু কোন টেলিভিশন নেই। টেলিভিশন না দেখে দেখে আমারও কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেল। মাঝে মাঝে যখন কারো বাসায় বেড়াতে যাই, তারা যখন টেলিভিশন চালু করে রাখে আমার তখন কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগতে থাকে।

আমি তখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। এর মাঝে হেড অফিস থেকে চিঠি এসেছে আমাকে ছয় সপ্তাহের জন্যে আমেরিকা যেতে হবে। আমি নীলাকে বললাম “তুমিও চল।”

নীলা বলল “তোমার কোম্পানি আমাকে নেবে কেন?”

আমি বললাম “আমার কোম্পানি নেবে আমাকে, আমি নেব তোমাকে।”

“আর এই বাসা? এটা কে দেখবে।”

“তালা মেরে চলে যাব।”

নীলা হেসে বলল, “তাহলে যখন ফিরে আসবে তখন দেখবে তোমার বাসা ধু ধু খালি। নীলক্ষেতে পুরানো বইয়ের দোকান থেকে আমার সব বই খুঁজে খুঁজে বের করে কিনতে হবে।”

আমি বললাম, “তুমি চিন্তা করো না, আমি একজনকে খুঁজে বের করব যে তোমার বাসা ছয় সপ্তাহ পাহারা দেবে।”

“আগে খুঁজে বের করো তারপর দেখা যাবে।”

কাজটা যত সহজ হবে ভেবেছিলাম সেরকম সহজ হলো না। একই সাথে বিশ্বাসী এবং ছয় সপ্তাহের জন্যে কাজকর্ম নেই এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। শেষ পর্যন্ত মনে হলো দারোয়ান বা কেয়ার টেকার ধরনের একজন মানুষকে রেখে যেতে হবে তখন হঠাৎ করে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন নীলার বাবা! নীলার মা মারা গেছেন বেশ অনেক দিন হলো, এখন একা মানুষ দেশের বাড়িতে থাকেন। তিনি আমাদের বাসায় ছয় সপ্তাহ থাকতে রাজি হলেন, তবে একটা শর্ত সাপেক্ষে। টেলিভিশনে তখন খুব জমজমাট একটা সিরিয়াল হচ্ছে সেটা দেখার জন্যে প্রতি বুধবার তাকে বাড়ি যেতে হবে। আমরা বললাম, তার কোনো প্রয়োজন নেই ছয় সপ্তাহের জন্যে তিনি তার টেলিভিশনটাই এখানে নিয়ে আসতে পারবেন। নীলা যেখানে টেলিভিশন দেখতে পারে না সেখানে তার বাবা এরকম টেলিভিশন ভক্ত কেমন করে হলো কে জানে?

নীলার বাবাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমরা প্লেনে করে সোজা নিউইয়র্ক। আমি সারাদিন অফিসে কাজ করি নীলা নিউইয়র্কের মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে আর বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যেবেলা কোনো ছোট রেস্টুরেন্টে খাই, কোনো কোনোদিন নিজেরা কিছু রান্না করি। উইক এন্ডে ছুটি তখন আরো দূরে কোথাও যাই, সব মিলিয়ে খুব চমৎকার ছয় সপ্তাহ কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম। রওনা দেবার আগে টেলিফোনে নীলার বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি। দেশে লাইন পাওয়া খুব কঠিন, পাওয়া গেলেও কানেকশন এত দুর্বল যে কথা বলা যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাসায় এসেছি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, ভেতরে টেলিভিশন চলছে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু যতই বেল বাজাই কেউ দরজা খুলে না। শেষে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আমরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। টেলিভিশনের সামনে নীলার বাবা মৃত পড়ে আছেন, টেলিভিশনে একটা হাসির নাটক হচ্ছে। নাটকের চরিত্রগুলো একটু পরে পরে হেসে উঠছে, দেখে মনে হয় মৃতদেহটি দেখে হাসছে। কী ভয়ানক একটা দৃশ্য!

নীলার বাবা কতদিন আগে মারা গেছেন কে জানে-আমি সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে চাই না। নীলাকে সরিয়ে নিয়ে কোনোভাবে লোকজনকে খবর দিলাম। পুলিশ এলো, ডাক্তার এলো, আত্মীয়স্বজন এলো। ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। জানাজা পরিয়ে দাফন করিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে আমরা যখন আবার আমাদের জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি তখন প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে।

নীলার সাথে তার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল। মা মারা যাবার পর সেটি আরো গম্ভীর হয়েছিল। হঠাৎ করে বাবার এরকম অস্বাভাবিক একটা মৃত্যু নীলাকে খুব বড় একটা ধাক্কা দিল। সে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। আমি বাসায় এসে আবিষ্কার করতাম সোফায় পা তুলে চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে। প্রায় সময়েই আবিষ্কার করতাম সে টেলিভিশনটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

একদিন আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “টেলিভিশনটা কী করব বলো দেখি?”

“বিক্রি করে দাও।”

“বিক্রি করে দেব?”

“হ্যাঁ।”

“পুরনো টিভি-কয় টাকায় আর বিক্রি হবে।”

“তাহলে কাউকে দিয়ে দাও।”

“কাউকে দিয়ে দেব?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে।”

আমি তাই টেলিভিশনটা কাকে দেয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। আজকাল গ্রামে ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে, গ্রামে গরিব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাউকে দিয়ে দিলেই হবে। গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজন আসে-পরের বার তাদের কেউ এলে এটা ধরিয়ে দেয়া যাবে। কেমন করে নেবে সেটা তাদের দায়িত্ব।

এর মাঝে একদিন একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তাকিয়ে দেখি পাশে নীলা নেই। আমি বিছানায় উঠে বসেছি তখন মনে হলো পাশের ঘর থেকে মানুষের কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি অবাক হয়ে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি টেলিভিশন চলছে এবং তার সামনে সোফায় শুয়ে নীলা ঘুমুচ্ছে। আমি নীলাকে ডেকে বললাম, “নীলা।”

নীলা চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “কী?”

“তুমি এখানে কী করছ?”

“ঘুম আসছিল না তো-তাই এখানে শুয়েছি।”

“আমাকে ডাকলে না কেন?”

নীলা কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল।

আমি বললাম, “শুতে চলো।”

নীলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “চলো।”

আমি টেলিভশনটা বন্ধ করে নীলাকে শোয়ার ঘরে নিয়ে এলাম।

এরপর থেকে আমি মাঝে মাঝেই দেখি নীলা টেলিভিশন অন করে বসে আছে। টেলিভিশন দেখাটা এমন কিছু বড় অপরাধ নয়, তার মানসিক এই অবস্থায় সে যদি টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠান দেখে ভুলে থাকতে চায় সেটা একদিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু আমি একটা বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করলাম। সে টেলিভিশন অন করে তাকিয়ে থাকে কিন্তু সেখানে কী হচ্ছে সে তার কিছু লক্ষ করে না। সে টেলিভিশনটা দেখে, তার অনুষ্ঠানকে দেখে না। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি তো আগে টেলিভিশন দেখতে না। এখন দেখো?”

নীলা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, “মাঝে মাঝে দেখি।”

“কোন অনুষ্ঠান তোমার প্রিয়?”

“অনুষ্ঠান?” নীলা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মনে হলো আমার কথাটা বুঝতে পারছে না।

“হ্যাঁ। কোন অনুষ্ঠান?”

নীলা আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে–” সে তার কথা শেষ করল না।

এরকম সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাই শহরে এসেছে, মোটামুটি অপদার্থ পরিবারের ছেলে, যখনই টাকার দরকার হয় কোনো ছল-ছুতোয় শহরে হাজির হয়। আমার মনে হলো টেলিভিশনটা দূর করার এই সুযোগ। নীলাকে কথাটা বলতেই সে কেমন যেন চমকে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, “ না, না, প্লিজ এখন দিও না।”

“কেন? তুমি তো আগে কখনো টেলিভিশন দেখতে না।”

নীলা মাথা নেড়ে বলল, “আমি এখনও দেখি না। কিন্তু মানে ইয়ে—”

“কী?”

নীলা একটু ছটফট করে বলল, “মানে এটা তো বাবার একটা স্মৃতি। সেজন্যে ভাবছিলাম–”

“কী ভাবছিলে?”

“আরও কয়দিন যাক? তারপর দেব।” আমার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ।”

কাজেই টেলিভিশনটা বাসাতেই থেকে গেল।

আমাদের বাসার পরিবেশটা কিন্তু অনেক পাল্টে গেছে। নীলা কথা বলে খুব কম। সেরকম বইও পড়ে না, গানও শুনে না। আমার ধারণা আমি যখন থাকি না তখন সে সারাক্ষণ টেলিভিশন চালিয়ে তার সামনে বসে থাকে। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে আমি আবিষ্কার করি সে বিছানা থেকে উঠে টিলিভিশনের সামনে বসে আছে। আগে সোফায় বসে থাকতো-এখন সে বসে টেলিভিশনের খুব কাছে। শুধু তাই নয় চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে এমন একটা চ্যানেল বের করে যেখানে কোনো অনুষ্ঠান নেই। তারপর সেই শূন্য স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে কী দেখে আমি বুঝতে পারি না–কারণ আমি যখন তাকে এভাবে আবিষ্কার করি তখন সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে! মনে হয় সে সত্যিই কিছু দেখছে।

আমি একদিন গভীর রাতে তাকে আবিষ্কার করলাম টেলিভিশন স্ক্রিনের সাথে প্রায় মুখ লাগিয়ে সে দেখছে। আমি আস্তে আস্তে নীলার পিঠে হাত রেখে ডাকলাম, “নীলা।”

সে চমকে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো। আমি বললাম, “কী হয়েছে নীলা?”

“কিছু হয় নাই।”

“কী দেখছ টেলিভিশনে?”

নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখছ?”

“বাবাকে।”

আমি অবাক হয়ে বলাম, “বাবা! কোথায়?”

নীলা টেলিভিশনটি দেখিয়ে বলল, “এই তো এখানে।”

“কোথায়?”

নীলা কিছুক্ষণ টেলিভিশনটির দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, “এখন নাই।”

আমি তার হাত ধরে বললাম, “উঠ। চলো, শোবে।”

নীলা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “চলো।”

আমি কয়েকদিন খুব দুশ্চিন্তার মাঝে কাটালাম। ব্যাপারটা নিয়ে কার সাথে কথা বলতে পারি সেটাও বুঝি না। নীলার সাথেও কথা বলতে পারি না, দিনেরবেলা বিষয়টাকে রীতিমতো হাস্যকর বলে মনে হয়।

কয়দিন পর আবার গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম নীলা ফিসফিস করে কথা বলছে। আমি পা টিপে টিপে উঠে গেলাম, গিয়ে দেখি নীলা টেলিভিশনের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। শুনতে পেলাম সে মাথা নেড়ে বলছে, “ভয় করে বাবা। অনেক ভয় করে।”

আমি বুকের ভেতর একধরনের গভীর শূন্যতা অনুভব করি, নীলা প্রায় মানসিক রোগীর মতো হয়ে গেছে। তার ধারণা সে টেলিভিশনে তার বাবাকে দেখছে, কথা শুনছে।

আমি নীলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম, আমার মনে হলো আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম টেলিভিশন থেকে অস্পষ্ট গলার কেউ একজন বলল, “কোনো ভয় নেই।

“সত্যি বাবা?”

আমি আবার শুনলাম, “হ্যাঁ সত্যি। তুই ছাদ থেকে লাফ দে। তাহলেই তুই আর আমি একসাথে থাকব।”

আতঙ্কে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল। নীলা বলল, “ তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে বাবা?”

“থাকব। এই তো আছি দেখছিস না?”

আমি টেলিভিশনের দিকে তাকালাম, সত্যি সত্যি সেখানে একজন মানুষের ছবি দেখা যাচ্ছে। আবছা অস্পষ্ট ছবি কিন্তু মানুষের ছবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নীলা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, “যাচ্ছি বাবা। তুমি আমার সাথে থাকবে তো?”

“হ্যাঁ থাকব। তোর কোনো ভয় নেই।”

নীলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল, আমি আতঙ্কে পাথর হয়ে দেখলাম সে ছিটকিনি খুলে বারান্দায় যাচ্ছে। সেখান থেকে নিচে লাফিয়ে পড়বে?

টেলিভিশন থেকে আবার একটা কণ্ঠস্বর বের হয়ে এলো, “ এগিয়ে যা মা। রেলিংয়ের ওপর দাঁড়া। আমি যখন বলব, ওয়ান টু থ্রি তখন লাফ দিবি। পারবি না?”

“পারব বাবা।”

“চমৎকার। তাহলে তুই আমার কাছে চলে আসবি। আমার আর তোর কাছে আসতে হবে না।”

“ঠিক আছে।”

আমি তখন দরদর করে ঘামছি। কী করছি বুঝতে পারছি না, কোনোমতে নীলার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলাম। সে ঝটকা মেরে আমার থেকে মুক্ত হয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। আমি আবার তাকে ধরার চেষ্টা করলাম, কীভাবে কীভাবে জানি সে আবার নিজেকে মুক্ত করেনিল। আমি শুনতে পেলাম টেলিভিশন থেকে আবার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “রেলিংয়ের ওপর দাঁড়া।”

নীলা বলল, “‘দাঁড়াচ্ছি।”

আমি ভয়ে অধীর হয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, নীলা রেলিংয়ের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে।

টেলিভিশনে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি বলল, “ওয়ান।”

নীলা খুব ধীরে ধীরে তার দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়াল, মনে হলো সে বুঝি এক্ষুনি উড়ে যাবে।

টেলিভিশন ছায়ামূর্তি এবারে অনেক স্পষ্ট হয়ে এসেছে, কঠিন আর স্পষ্ট গলায় বলল, “টু।”

আমি তখন ঘরের ভেতরে ছুটে গেলাম কী করছি না বুঝেই হ্যাঁচকা টানে।

টেলিভিশনটা তুলে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে আছড়ে মারলাম, কয়েকটা বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ আর পোড়া গন্ধ ভেসে এলো তারপর হঠাৎ সারা ঘর নীরব হয়ে গেল।

নীলা তখনও রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখলাম সে থরথর করে কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে সে ওখান থেকে পড়ে যাবে। আমি আবার বারান্দায় ছুটে এলাম, শুনলাম নীলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় ডাকলাম, “নীলা”।

নীলা বলল, “আমার কী হয়েছে?”

আমি বললাম, “তোমার কিছু হয়নি। তুমি নেমে এসো।”

নীলা বলল, “আমার ভয় করছে আমি যদি পড়ে যাই?”

আমি পেছন থেকে তাকে ধরে বললাম “তুমি পড়বে না। আমি আছি না?”

নীলা নিচে নেমে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

.

ম্যানেজার সাহেব তার গল্প শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিশ্বাস হলো?”

আমি অন্ধকার নির্জন কুয়াশা ঢাকা রাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কাল দিনের বেলা কী মনে হবে জানি না। এখন তো অবিশ্বাস করার কিছু দেখছি না।”

ম্যানেজার সাহেব হাসলেন, বললেন, “শুয়ে পড়েন। অনেক রাত হয়েছে।”

আমিও উঠে দাঁড়ালাম। শুতে যাব সেটা ঠিক আছে, ঘুমাতে পারব কী না কে জানে! আমি আবার খুব ভীতু মানুষ!

রবিন জানালার গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়েছিল। এখন তার খুব মন খারাপ, যখন তার খুব মন খারাপ হয় তখন সে এভাবে জানালায় গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রবিনের বয়স মাত্র বারো। বারো বছরের বাচ্চার খুব বেশি মন খারাপ হবার কথা না, কিন্তু রবিনের প্রায়ই মন খারাপ হয়। কেন তার মন খারাপ হয় সেটা সে খুব ভালো করে জানে কিন্তু সেটা সে কাউকে বলতে পারবে না। যখন ছোট ছিল তখন বলতো আর তার আব্বু-আম্মু ভয় পেয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেত। ডাক্তার তাকে কী ওষুধ দিয়েছিল কে জানে, তখন সে সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু ঘুমাতো। তার কিছু মনে থাকতো না, সবকিছু কেমন যেন আবছা দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে যেত। তাই সে এখন কাউকে কিছু বলে না, যেটা ঘটে সেটা সে সহ্য করে নিজের ভেতর চেপে রাখে। রবিন জানে সে অন্যরকম, কেন সে অন্যরকম সেই কথাটাও সে কখনো কাউকে বলতে পারবে না। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে সে নিশ্চয়ই এতদিনে পাগল হয়ে যেত, রবিন পাগল হয়নি। সে সবকিছু সহ্য করে, একা একা সহ্য করতে গিয়ে তার শুধু মন খারাপ হয়।

রবিন অন্যমনস্কভাবে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা ফেরিওয়ালার দিকে তাকিয়েছিল। ঠিক তখন সে শুনতে পেল কেউ যেন স্পষ্ট স্বরে বলল, “কী খোকা? তোমার খুব মন খারাপ?”

রবিন না হয়ে অন্য কেউ হলে চমকে উঠে এদিক-সেদিক তাকাতো, কাউকে না দেখে ভয়ে-আতঙ্কে অস্থির হয়ে যেত। রবিন এদিক-সেদিক তাকাল না শুধু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এটাই হচ্ছে তার সমস্যা, সে মানুষজনের কথা শুনতে পায়, মাঝে মাঝে মানুষজনকে দেখতেও পায়। ভয়ংকর ভয়ংকর মানুষ ভয়ংকর তাদের কথাবার্তা। কেন সে তাদের দেখে, তাদের কথা শুনে সে বুঝতে পারে না।

“খোকা। কথা বলছ না কেন? তোমার কী মন খারাপ?”

রবিন এবারে একটু অবাক হলো। সে যাদের কথা শুনে তাদের কথা সাধারণত প্রলাপের মতো, ভীত-আতঙ্কিত মানুষের আর্তনাদের মতো। যাদের দেখতে পায় তারাও সেরকম, মাথা থেঁতলে যাওয়া, রক্তে ভেসে যাওয়া, পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া মানুষ। তারা তার সাথে কথা বলে না ভয়ে ছোটাছুটি করে, চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু এখন সে যার কথা শুনছে সে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করছে না, তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করছে। রবিন একটু অবাক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল, কে তার সাথে কথা বলতে চাইছে তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করল। আশেপাশে কেউ নেই, সামনে একটা রাস্তা, রাস্তা দিয়ে লোকজন যাচ্ছে-আসছে। সবাই স্বাভাবিক মানুষ, কোথাও কোনো অস্বাভাবিক মানুষ নেই।

“খোকা! তুমি আমার কথা শুনছ না?”

রবিন বুঝতে পারল না সে প্রশ্নের উত্তর দেবে কী না। এর আগে কেউ তাকে কখনো এভাবে প্রশ্ন করেনি।

“কথা বলো আমার সাথে। তোমার কোনো ভয় নেই।”

রবিন ফিসফিস করে বলল, “কে? কে কথা বলে?”

“আমি। আমাকে তুমি চিনবে না খোকা। আমি ঠিক তোমার মতো একজন!”

“আমার মতো একজন?”

“হ্যাঁ। তোমার মতো একজন। তুমি যে রকম অনেক রকম কথা শোনো অনেক মানুষকে দেখো আমিও সেরকম।”

রবিন এবারে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কোথায়?”

“এই তো রাস্তায়। একজন বুড়ো ফেরিওয়ালা দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি।”

“একটা লুঙ্গি আর সবুজ রঙের শার্ট? ঘাড়ে গামছা। আমি সেই মানুষ। আমাকে দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি। আপনি এখন হাত নাড়ছেন?”

“হ্যাঁ বাবা, আমি হাত নাড়ছি। তুমি কোথায়? আমি জানি তুমি আছ আশেপাশে, কিন্তু আমি তোমায় দেখছি না।”

“আমি জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। লাল বিল্ডিংটার তিন তালায়। আমিও এখন হাত নাড়ছি।”

“হ্যাঁ! হ্যাঁ। এখন তোমাকে দেখছি। অনেক দূর তো, তাই ভালো করে দেখা যায় না, তার ওপর বয়স হয়েছে তো তাই। সবকিছু ঝাপসা দেখি।”

রবিন প্রথমবার উত্তেজিত হয়ে ওঠে, চাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনি কেমন করে আমার সাথে কথা বলছেন?”

“আমরা পারি বাবা। দশ লাখ বিশ লাখে আমাদের মতো একজন দুজন মানুষের জন্ম হয় যারা এগুলো পারে। তুমি যে রকম আমি সেরকম। আমরা অনেক কিছু দেখি, অনেক কিছু শুনি যেটা অন্যেরা দেখে না, শুনে না।”

রবিন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তাহলে পাগল না?”

মানুষটি হাসল, বলল, “ছিঃ বাবা! পাগল কেন হবে! এটা তোমারে দেওয়া আল্লাহর একটা ক্ষমতা।”

“আমি চাই না এই ক্ষমতা। কচু ক্ষমতা!”

“ছিঃ বাবা। এভাবে বলে না। আল্লাহ্র দেয়া ক্ষমতারে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে আল্লাহ্ নারাজ হবেন।”

“কিন্তু আমার যে ভয় করে–”

“তোমার কোনো ভয় নাই বাবা। আমাদের চারপাশে সব সময় এগুলো হচ্ছে, তুমি দেখতে পাচ্ছ একজন মানুষ এখন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে-দেখছ?”

“হ্যাঁ দেখছি। রক্তেভেজা–”

“মানুষটা দুই রাস্তা পরে একসিডেন্টে মারা গেছে। মানুষটা জানে না সে মরে গেছে। সে ছুটতে ছুটতে বাড়িতে যাচ্ছে-তার আশেপাশে আরো কয়েকজন মানুষ দেখেছে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। দেখেছ? এই রকম অনেক কিছু হয় চারপাশে। সাধারণ মানুষ এইগুলো দেখে না। এইগুলো বুঝে না। আমরা দেখি, বুঝি। এইটা আমাদের একটা ক্ষমতা।”

“কিন্তু ডাক্তার যে বলে অন্যকথা।”

মানুষটা আবার হাসল, বলল, “ডাক্তারেরা কী জানে? তারা তাদের পরিচিত রোগশোকের কথা জানে। তার বাইরে কিছু জানে তাছাড়া এইটা তো রোগ না বাবা। এইটা ক্ষমতা। রোগের চিকিৎসা হয়, ক্ষমতার চিকিৎসা হয় না।”

রবিন বলল, “আমি এই ক্ষমতা চাই না। এই ক্ষমতা নাই করে দেওয়া যায় না?

“সেইটা তো জানি না, বাবা। চেষ্টা করলে তো সবকিছুই হয়। তুমি যদি খুব চেষ্টা করো তাহলে হয়তো আস্তে আস্তে একসময় ক্ষমতাটা চলে যেতে পারে। মানুষটা সুর পাল্টে বলল, “কিন্তু তুমি কেন এই ক্ষমতাটা দিয়ে দিতে চাও?”

“সবাই ভাবে আমি পাগল। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তাছাড়া আমার ভয় করে, ভয়ংকর ভয়ংকর মানুষ আসে চিৎকার করে আমারে ভয় দেখায়। আমি পড়তে পারি না ঘুমাতে

পারি না।”

“বাবা তোমারে আমি বলি। তুমি যাদের দেখে তারা হচ্ছে খুব দুঃখী। তারা খুব কষ্টে আছে। তাদের সাহায্যের দরকার, কেউ তাদের সাহায্য করতে পারে না। শুধু তোমার আর আমার মতো মানুষ ইচ্ছা করলে পারে আর কেউ তাদের সাহায্য করতে পারবে তুমি তো এখন ছোট, তোমার কোনো অভিজ্ঞতা নাই, সেই জন্যে হয়তো কারো সাহায্য করো নাই। যখন আস্তে আস্তে বড় হবে, অভিজ্ঞতা হবে তখন দেখবে তুমিও তাদের সাহায্য করতে পারবে।”

“না-না আমি পারব না। আমি সাহায্য করতে চাই না। আমি কিছু করতে চাই না।”

“ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবা। তুমি যদি না চাও, তাহলে তোমার সাহায্য করতে হবে না। কিন্তু দেখবে, একদিন যখন বড় হবে কারো কষ্ট দেখে তুমি নিজে থেকেই সাহায্য করতে যাবে।”

“না! যাব না।” রবিন কাদো কাদো হয়ে বলল, “আমি কিছু করতে চাই না।”

“ঠিক আছে বাবা, তোমারে কিছু করতে হবে না। শুধু তোমারে একটা কথা বলি।”

“কি কথা?”

“তুমি এই ব্যাপারটা নিয়ে ভয় পাবা না। মন খারাপ করবা না। আমি জানি এইটা স্বাভাবিক ব্যাপার না, কিন্তু এইটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নাই। তুমি মন খারাপ করবা না ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“আমি এখন যাই বাবা? আমার খুব তাড়া আছে। একজন মানুষ খুব বিপদে পড়েছে, তারে সাহায্য করতে যাচ্ছি।”

“কী বিপদ?”

“খুব বড় বিপদ। মানুষ বেঁচে থাকতে যে রকম বিপদ হয়, মরে যাবার পরেও বিপদ হয়। এই কালে যে রকম জন্তু-জানোয়ার আছে, পরকালেও সেই রকম জন্তু-জানোয়ার-দানব আছে। তারা অনেক সমস্যা করে। তারা বেঁচে থাকার সময় বিপদে পড়লে তারে সাহায্য করা যায়। মরে যাবার পরে তারে অন্য কেউ সাহায্য করতে পারে না– শুধু আমরা চাইলে পারি।”

“ও।”

“যাই বাবা?”

“ঠিক আছে।”

“তোমার নামটা তো জিজ্ঞেস করলাম না।”

“আমার নাম রবিন।”

“যাইগো রবিন।”

রবিন দেখল তার দিকে হাত নেড়ে বুড়ো মতোন ফেরিওয়ালাটা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। সে অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষটার সাথে তার যে কথাটা হয়েছে সেটা সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কী সে শুনেছে নাকি পুরোটা তার কল্পনা? তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আসলে সে পাগল না, সে যেটা দেখে যেটা শুনে সেটা সত্যি, অন্যেরা সেটা শুনতে পায় না দেখতে পায় না সেটা হচ্ছে পার্থক্য। রাত্রিবেলা খাবার টেবিলে আম্মু একটু অবাক হয়ে লক্ষ করলেন রবিন আজ বেশ হাসিখুশি। তার অন্য দুই ছেলেমেয়ে থেকে এই ছেলেটি ভিন্ন, এ বয়সেই সে বড়দের মতো গম্ভীর। কথাবার্তা বলে খুব কম, সব সময়ই মনে হয় কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে। আজকে তাকে একটু হাসিখুশি দেখে আম্মুরও ভালো লাগল, হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে রবিন? তোর আজকে খুব স্ফুর্তি মনে হচ্ছে?”

রবিন কোনো কথা না বলে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

“কী নিয়ে এত স্মৃর্তি? কিছু হয়েছে নাকি?”

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “না আম্মু কিছু হয় নাই।”

বড় বোন ঈশিতা বলল, “কিছু হলে তোমাকে রবিন বলবে না কি? রবিন যদি লটারিতে দশ লাখ টাকা পায় তাহলেও মুখটা এমন করে রাখবে যেন কিছু হয় নাই।”

ছোট ভাই লিটন বলল, “কেন আপু? কেন মুখটা এরকম রাখবে?”

ঈশিতা বলল, “দেখিস না রবিন গুনে গুনে কথা বলে।” আব্বু বললেন, “কেন আমার ছেলেটাকে জ্বালাতন করছিস?

ঈশিতা বলল, “আমি মোটেও জ্বালাতন করছি না। সত্যি কথা বলছি।”

আম্মু বললেন, “যাক এত সত্যি কথা বলতে হবে না।” ঈশিতা বলল, “আসলে কী হয়েছে জানো?”

“কী?”

“রবিনের বয়স আসলে বাহাত্তর। ভুলে সে দশ বছরের ছেলের শরীরে আটকা পড়ে গেছে। তাই না রে রবিন?”

রবিন দাঁত বের করে হেসে বলল, “আর তোমার বয়স আসলে পাঁচ। ভুল করে ষোলো বছরের মেয়ের শরীরে আটকা পড়ে গেছ।”

রবিনের কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল! ছেলেটা খুব কম কথা বলে, কিছু একটা বলে হাসাহাসি করলে সবাই অল্পতেই খুশি হয়ে ওঠে।

.

রবিন আর লিটন এক ঘরে ঘুমায়, ঈশিতা অন্য ঘরে। লিটন ঘুমকাতুরে ছেলে, একটু রাত হলেই সে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়। রবিনের বেলায় ঠিক তার উল্টো, যত রাত হতে থাকে ততই সে যেন জেগে ওঠে। সেজন্যে রবিনকে অবিশ্যি দোষ দেয়া যায় না, রাত যত গম্ভীর হতে থাকে সে ততই বিচিত্র কথাবার্তা শুনতে থাকে, মাঝে মাঝে বিচিত্র মানুষকে দেখতে পায়। সে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে, চাদরের নিচে মাথা ঢেকে সে গভীর রাত পর্যন্ত ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

আজ রাতে সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। আম্মু মশারি খুঁজে দিয়ে লাইট নিভিয়ে চলে যাবার পর রবিন তার বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে লিটনকে ডাকল, লিটন।”

“কী?”

“ঘুমিয়ে পড়েছিস?”

“না।”

“আচ্ছা লিটন তুই কী কখনো ঘুমের মাঝে কারো কথা শুনতে পাস।”

লিটন মাথা নাড়ল, “নাহ্।”

“তুই কী কখনো ভয়ের স্বপ্ন দেখিস?”

“সব সময় দেখি।”

“কী দেখিস?”

“কালকে দেখেছি একটা বাঘ আমার হাত কামড় দিয়ে খেয়ে ফেলছে। এই মোটা বাঘ-যা ভয় লেগেছিল।”

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ও।”

রবিন আরো কিছুক্ষণ হাঁটু মুড়ে বসে থেকে লিটনকে ডাকল, “লিটন।”

লিটন কোনো উত্তর দিল না। রবিন আবার ডাকল, “এই লিটন।”

লিটন ঘুম ঘুম গলায় বলল, “না।” তারপর পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে গেল।

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে, লিটনের ওপর তার একটু হিংসে হয়। সেও যদি তার মতো এত তাড়াতাড়ি ঘুমাতে পারতো তাহলে কী চমৎকারই না হতো।

রবিন হাঁটুতে মাথা রেখে নিঃশব্দে বসে থাকে। ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার, জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো এসে পড়েছে, মেঝেতে সেই আলোটা একটা বিচিত্র নকশার মতো তৈরি করেছে। মাঝে মাঝে গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখে ঘরের ভেতরে কোনো একজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ভয়ংকর আতঙ্কে সে চাদর দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

রবিন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাল, তারপর শুয়ে পড়ল। ঠিক যখন তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল তখন সে রক্ত শীতল করে একটা আর্তনাদ শুনতে পেল। রবিন আতঙ্কে চমকে উঠে দুই হাতে নিজের কান বন্ধ করে শুয়ে থাকে। তারপরেও সেই আর্তনাদটি মিলিয়ে যায় না, রবিন স্পষ্ট শুনতে পায় একজন মানুষ গোঙাতে গোঙাতে চিৎকার করছে। রবিন আগে জানতো না সেগুলো কী, এখন সে জানে, এগুলো মৃত মানুষের চিৎকার। কেন তাকে তাদের চিৎকার শুনতে হবে? কেন? রবিন দুই হাত দিয়ে কান বন্ধ করে শুয়ে থেকে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।

গভীর রাতে হঠাৎ রবিনের ঘুম ভেঙে গেল। সে শুনতে পেল চাপা স্বরে একজন মহিলা কথা বলছে, “সুমন। আমার সুমন। সুমন কোথায়?”

ঘুম ভেঙে রবিন পুরোপুরি জেগে ওঠে কিন্তু তবুও সে বিছানায় ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে।

“কোথায় সুমন? কোথায় গেলি বাবা?”

রবিনের মনে হয় একজন মা তার ছেলেকে খুঁজছে। এত রাতে তার ঘরে একটা মা কেন ছেলেকে খুঁজে? রবিন খুব সাবধানে চাদর থেকে মাথা বের করে তাকাল, ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় একটু অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে, আবছা আবছা বোঝা যায় সেটি একজন মহিলা। মহিলাটি ব্যাকুল গলায় বলল, “সুমন। বাবা আমার তুই কোথায়?”

তারপর মহিলাটি লিটনের বিছানার কাছে গিয়ে ডাকল, “ সুমন! বাবা সুমন।”

লিটন ঘুমের মাঝে অস্পষ্ট একটা শব্দ করে পাশ ফিরে শুলো, মহিলাটি তখন রবিনের বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসা এক চিলতে আলোতে মুহূর্তের জন্যে রবিন মহিলাটাকে দেখতে পেল, মাথার বাম পাশটি থেঁতলে গেছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মহিলাটি রবিনের বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়, মশারির ভেতরে তার মাথাটা ঢুকিয়ে রবিনের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে। এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে রবিন মহিলাটির নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়, তার সাথে একধরনের কটু গন্ধ। মহিলাটি বলল, “সুমন। বাবা সুমন।”

রবিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে, মহিলাটি কাতর গলায় আবার বলল, “সুমন। তুই কোথায় গেলি? কথা বলিস না কেন?”

রবিন ফিসফিস করে নিজেকে বলল, “আমি ভয় পাব না। কিছুতেই ভয় পাব না। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলেই চলে যাবে।”

মহিলাটি কিন্তু চলে গেল না, বলল, “বাবা সুমন। তুই কোথায় গেলি?”

রবিন বিড়বিড় করে বলল, “এখানে নাই।”

“নাই এখানে?”

রবিনের বুক ধক ধক করতে থাকে, চাপা গলায় বলল, “না। এখানে নাই।”

“তাহলে সে কোথায় গেল?”

“আমি জানি না। আপনি-আপনি–”

আমি কী?”

“আপনি অন্য জায়গায় খুঁজেন।”

মহিলাটি একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি তো সব জায়গায় খুঁজছি। কোথাও তো পাই না আমার সুমনকে!”

রবিন চোখের কোনা দিয়ে দেখে মহিলাটি ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, দরজাটা ক্যাচ ক্যাচ করে একটু শব্দ করল তারপর মহিলাটি অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকে দেখা না গেলেও রবিন তার গলার স্বর শুনতে পায়, “সুমন। বাবা সুমন। তুই কোথায় গেলি?”

তখন সে আরো কয়েকজন মানুষের গলা শুনতে পায়। কেউ একজন বলল, “রাহেলা তুমি এভাবে সুমনকে পাবে না! তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে তুমি মারা গেছ। তুমি বেঁচে নেই।”

মহিলাটি আবার বলল, “সুমন! আমার সুমন!”

খুব ধীরে ধীরে সবার গলার স্বর অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে যাবার পরও রবিন ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল। তারপর বুক থেকে একটা গভীর নিঃশ্বাস বের করে সে চাদরটা টেনে নিজেকে ঢেকে পাশ ফিরে শোয়। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সে একজন মৃত মানুষের সাথে কথা বলেছে। রবিন অবাক হয়ে আবিষ্কার করে তার যেটুকু ভয় লাগার কথা তার সেটুকু ভয় লাগছে না। একটা মা তার ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছে না সেটা চিন্তা করে শুধু তার ভেতরে কেমন জানি একটু দুঃখ লাগছে।

.

ভোরবেলা খাবার টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আব্বু খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলেন, কিছু একটা দেখে হঠাৎ মাথা নেড়ে বললেন, ‘ইশ!”

ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আব্বু?”

“আমাদের বাসার কাছে একটা খারাপ একসিডেন্ট হয়েছে। মা আর ছেলে ছিল। মাটা স্পট ডেড।”

আম্মু বললেন, “আহা রে। ছেলেটা?”

“ছেলেটা বেঁচে গেছে। ক্রিটিক্যালি ইনজুরড। হাসপাতালে আছে।”

রবিনের হঠাৎ কী মনে হলো কে জানে, জিজ্ঞেস করল, “ আব্বু, ছেলেটার নাম কী সুমন?”

আব্বু অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকালেন, “হ্যাঁ। তুই কেমন করে জানিস?”

রবিন থতমত খেয়ে বলল, “নামানে-ইয়ে–”

খাবার টেবিলে সবাই অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। রবিন তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে টোস্টটা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করে।

স্কুল থেকে আসার সময় রাস্তার মোড়ে রবিন আর লিটন দাঁড়িয়ে গেল। সামনে অনেক মানুষের ভিড়, ভিড় ঠেলে কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ একটু সরে দাঁড়াতেই মুহূর্তের জন্যে রবিন দেখতে পেল রাস্তায় একজন মানুষ পড়ে আছে, পুরো জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লিটন ফ্যাকাসে মুখে বলল, “কী হয়েছে ভাইয়া?”

“একসিডেন্ট।”

“চল ভাইয়া যাই, আমার ভয় করছে।”

লিটন ভীতু প্রকৃতির, রাস্তার মাঝে একসিডেন্টের দৃশ্য দেখে ভয় পাবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। সে লিটনের হাত ধরে দুই পা এগিয়ে যেতে যেতে একটা দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল। পুলিশের সাথে একজন মানুষ উত্তেজিত গলায় কথা বলছে, মানুষটির সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে, একটা হাত বিচিত্রভাবে শরীর থেকে ঝুলছে, দেখে মনে হচ্ছে না এটা তার শরীরের অংশ। রবিন এক পলক দেখেই বুঝতে পারে এটি একসিডেন্টে মরে যাওয়া মানুষটি, সে ছাড়া আর কেউ তাকে দেখছে না।

লিটন রবিনের হাত ধরে টেনে কঁদো কাদো গলায় বলল, “ চল ভাইয়া।”

“দাঁড়া। তুই এক সেকেন্ড দাঁড়া।”

“তুমি কোথায় যাও?”

“আমি এক্ষুনি আসছি।”

লিটন কিছু একটা বলতে চাইছিল তাকে তার সুযোগ না দিয়ে রবিন ছুটে গেল। পুলিশটার কাছাকাছি এসে শুনতে পায় রক্তে ভেসে যাওয়া মানুষটা বলছে, “লাল রঙের পাজেরো। আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল-শুয়োরের বাচ্চা একবার থামল পর্যন্ত না!”

পুলিশটার হাতে একটা ছোট নোটবই, সেটা অন্যমনস্কভাবে হাত বদল করে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকায়। তারপর গলা উঁচিয়ে বলল, “কেউ ভিড় করবেন না। সরে যান।”

মানুষগুলো সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখাল না। পুলিশটা তখন গলা আরেকটু উঁচু করে বলল, “সরে যান সবাই। সরে যান।”

কয়েকজন মানুষ তখন একটু সরে দাঁড়াল।

“কেউ কী দেখেছেন ঘটনাটা? আছে কেউ?”

রক্তাক্ত মৃতদেহটা বলল, “আমি দেখেছি। বললাম তো আমি-লাল পাজেরো। গাড়ির নম্বর ঢাকা গ বারো তারপর চার আট আট–”

“কেউ দেখেছেন?”

রক্তাক্ত মৃতদেহটা বলল, “বললাম তো! আমি দেখেছি। লাল পাজেরো। ড্রাইভারের পাশে একটা মেয়ে বসে আছে-নীল শাড়ি–”

পুলিশটা ভিড়কে সরাতে সরাতে বলল, “না দেখে থাকলে সরে যান। সবাই।”

রবিন এবারে পুলিশটার শার্টের হাতা ধরে একটু টান দিল। পুলিশটা ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী হয়েছে?

“লাল পাজেরো।”

“একসিডেন্ট করেছে?”

রবিন মাথা নাড়ল।

“তুমি দেখেছ?”

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রবিন হড়বড় করে বলল, “ড্রাইভারের পাশে নীল শাড়ি পরা একটা মেয়ে ছিল। গাড়ির নম্বর ঢাকা গ বারো তারপর চার আট আট “

পুলিশ ভুরু কুঁচকে বলল, “তুমি দেখছে?”

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “আরেকজন দেখেছে।”

“সে কোথায়?”

“সে নাই।”

পুলিশটা হাত দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, “ সে নাই তো তুমি ভাগো। যাও।”

রবিন বলল, “বিশ্বাস করেন–”

“যাও যাও ভাগো।”

রবিন একটু সরে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে রক্তাক্ত মৃতদেহটি দাঁড়িয়ে ছিল, একটা বিচিত্র দৃষ্টিতে সে রবিনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, “কিছু বুঝতে পারছি না। কেউ আমার কথা শুনতে চায় না কেন? ব্যাপারটা কী? শরীরে ব্যথা নাই কেন?”

মানুষটা রবিনের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “কী হয়েছে আমার?”

রবিন ফিসফিস করে বলল, “আপনি মরে গেছেন।”

মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “কেন আমি মরে যাব? আমি মরি নাই। এই দেখো আমি দাঁড়িয়ে আছি।”

রবিন এক পা এক পা করে পেছনে সরে আসে, তারপর লিটনের দিকে ছুটতে থাকে। লিটন ফোঁস ফোঁস করে কাঁদছে। রবিনকে দেখে নাক মুছে বলল, “তুমি কী করো ওইখানে। আমার ভয় করে। বাসায় চলো।”

“চলো। বাসায় চলো।”

হাঁটতে হাঁটতে সে পেছনে ফিরে তাকাল। রক্তাক্ত মৃত মানুষটা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা এখনো জানে না সে মরে গেছে। রবিন দেখতে পায় মৃত মানুষটাকে ঘিরে আরো কয়েকজন মানুষ ভিড় করেছে। তারাও মৃত। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে সে মারা গেছে। মানুষটার জন্যে রবিন নিজের ভেতরে বিচিত্র একধরনের কষ্ট অনুভব করে।

.

গভীর রাতে মেয়েকণ্ঠে কান্নার একটা শব্দ শুনে রবিন জেগে উঠল। রবিন দুই হাতে কান চেপে ধরে রাখে কিন্তু তবুও শব্দটা চলে গেল না। রবিন কান থেকে তার হাত দুটো সরিয়ে নেয় এবং হঠাৎ তার মনে হয় শব্দটা পাশের ঘর থেকে আসছে। মনে হচ্ছে ঈশিতা যন্ত্রণায় কাঁদছে।

রবিন লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামল। ঈশিতার ঘরের দরজা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে যায় আর রবিন শুনতে পায় সত্যি সত্যি ঈশিতা যন্ত্রণায় কাঁদছে।

রবিন ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ঈশিতার বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। ঈশিতা কুঁকড়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে। রবিন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু! কী হয়েছে তোমার?”

“ব্যথা! খুব ব্যথা করছে পেটে।” ঈশিতা কোনোমতে বলল, “ আব্বু-আম্মুকে ডাক। তাড়াতাড়ি। মরে যাচ্ছি আমি।”

রবিন আব্বু-আম্মুর ঘরে গিয়ে চিৎকার করতে থাকে, “ আব্বু-আম্মু, তাড়াতাড়ি উঠো! ঈশিতা আপুর পেটে ব্যথা।”

সাথে সাথেই সবাই ঘুম থেকে উঠে গেল। রবিনদের ছোট চাচা ডাক্তার, তাকে ফোন করা হলো। কিছুক্ষণের মাঝে চাচা এসে গেলেন। পেটে চাপ দিয়ে কিছু পরীক্ষা করে ছোট চাচা মুখ গম্ভীর করে বললেন, “অ্যাপেন্ডিসাইটিস। এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে।”

আব্বু-আম্মু আর ছোট চাচা মিলে ঈশিতাকে তখন তখনই হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রবিন আর লিটন বাসায় রয়ে গিয়েছে। লিটন ফাস ফাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ভাইয়া। আপু কী মরে যাবে?”

রবিনের বুকটা ধক করে উঠল কিন্তু সেটা বুঝতে দিল না, লিটনকে ধমক দিয়ে বলল, “ধুর গাধা! মরে যাবে কেন?”

“এখন কী হবে ভাইয়া?”

“অপারেশন করবে। অপারেশন করে অ্যাপেন্ডিসাইটিস ফেলে দেবে।”

“কেন ফেলে দেবে ভাইয়া?”

উত্তরটা রবিনের ভাল করে জানা ছিল না তাই ইতস্তত করে বলল, “ব্যথা করছে যখন ফেলে দিতে হবে না?”

“আমারও তো মাঝে মাঝে হাঁটু ব্যথা করে, তখন কী হাঁটু ফেলে দেয়?”

রবিন একটু রেগে বলল, “বকবক করবি না। এখন ঘুমা।”

“ঘুম আসছে না।”

“তাহলে চুপ করে শুয়ে থাক।”

লিটন চুপ করে শুয়ে রইল। ঘণ্টাখানেক পরে হাসপাতাল থেকে আম্মু ফোন করে বললেন, ঈশিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাকে স্যালাইন আর ওষুধপত্র দিচ্ছে, ব্যথা কমেছে। এখন ঘুমিয়ে আছে। সকালে ডাক্তারেরা এলে অপারেশনের সময় ঠিক করা হবে। কাজেই চিন্তার কোনো কারণ নেই।

চিন্তার কোনো কারণ নেই শুনে লিটন প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে গেল। রবিন দীর্ঘ সময় বিছানায় ছটফট করে ভোররাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

সকালের দিকে আম্মু হাসপাতাল থেকে এসে কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে আবার হাসপাতালে ফিরে গেলেন। রবিন আর লিটনের কেউই স্কুলে গেল না, বাসায় মুখ শুকনো করে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দুপুরবেলা খবর পেল ঈশিতাকে অপারেশন করাতে নিয়ে গেছে। ঘণ্টা দুয়েক পরে খবর পেল অপারেশন ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে, এখন ঘুমাচ্ছে।

সন্ধ্যের দিকে আব্বু এসে রবিন আর লিটনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। রবিনের ধারণা ছিল হাসপাতালে বুঝি হাজার হাজার মানুষ গিজ গিজ করছে, কিন্তু দেখা গেল এটা মোটেও সেরকম না। প্রাইভেট হাসপাতাল, তার ওপর নতুন তৈরি হয়েছে। চারিদিক ঝকঝক-তকতক করছে। মানুষের ভিড় নেই। লিফটে করে তারা দোতলায় উঠে এলো। বেশ বড় একটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে সুন্দর সুন্দর চেয়ার, সামনে টেলিভিশন। কিছু মানুষ সেখানে চুপচাপ বসে আছে। রবিন জিজ্ঞেস করল, “আব্বু। আপু কোথায়?”

আব্বু একটা ঘর দেখিয়ে বললেন, “এইখানে। অপারেশন হবার পর কয়েক ঘণ্টা এখানে রাখে। ঠিকমতোন জ্ঞান ফিরে এলে তখন কেবিনে নিয়ে যায়।

লিটন জিজ্ঞেস করল, “আপুর ঠিকমতোন জ্ঞান ফিরে নাই?”

“ওষুধ দিয়ে রেখেছে তো তাই ঘুমিয়ে আছে।”

রবিন বলল, “আপুকে একটু দেখে আসি?”

আব্বু বললেন, “দাঁড়া। ডাক্তারের সাথে কথা বলে নেই। এটা তো রিকভারি রুম, ডাক্তার-নার্স ছাড়া আর কেউ ঢুকতে পারে না।”

“এদের বেশি বাড়াবাড়ি মহিলার গলা শুনে তারা মাথা ঘুরিয়ে দেখল মাঝবয়সী একজন মহিলা। রাগ রাগ মুখে বললেন, “ আমাকে পর্যন্ত আমার মায়ের কাছে যেতে দিতে চায় না। কত কাজ ফেলে এসেছি–”

আব্বু বললেন, “সার্জারির ব্যাপার। একটু কেয়ারফুল থাকা ভালো।

মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কার কী হয়েছে?”

আব্বু বললেন, ‘আমার মেয়ে। অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশন।” একজন কিছু একটা জিজ্ঞেস করলে তাকে পাল্টাপাল্টি সেটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে ভদ্রতা। তাই আব্বু জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার?”

“আমার বাবা। গল ব্লাডার অপারেশন।”

“কেমন আছেন আপনার বাবা?”

“ভালো। কেবিনে নেয়ার জন্যে বসে আছি।” ভদ্রমহিলা রাগ রাগ মুখে বিড়বিড় করে আরো কয়েকটা কথা বলে একটু সরে গেলেন।

আব্বু ডাক্তারের সাথে কথা বলে রবিন আর লিটনকে এক মিনিটের জন্যে ভেতরে নিয়ে যাবার অনুমতি নিলেন। প্রথমে লিটন ঈশিতাকে দেখে এলো। তারপর রবিন, ঠিক তখন আব্বুর একটা ফোন চলে এলে বলে রবিন একাই ঢুকে গেল। বেশ বড় একটা ঘর, তার মাঝে দুই পাশে শুধু দুটি বিছানায় দুজন শুয়ে আছে। একটি বিছানাকে ঘিরে অনেক মানুষ কাজেই অন্যজন নিশ্চয়ই ঈশিতা।

রবিন বিছানাটার কাছে এগিয়ে গেল, ঈশিতা চোখ বন্ধ করে শুয়ে। আছে। রবিন আস্তে করে কপালে হাত রেখে ডাকল, “আপু।”

ঈশিতা চোখ খুলে রবিনের দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসল।

“আপু, তুমি কেমন আছ?”

ঈশিতা বলল, “ভালো।”

“দেরি নাই। আর দেরি নাই, সময় হয়ে গেছে—” পাশের বিছানায় ঘিরে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে জোরে জোরে কথা বলতে থাকে। রিকভারি রুমে কোনো মানুষ ঢোকার কথা নয়, এতগুলো মানুষ কেমন করে ঢুকে এত জোরে কথা বলছে? রবিন ভালো করে তাকিয়ে হঠাৎ একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। এরা আসলে সত্যিকারের মানুষ না। এরা সব মৃত মানুষ। রিকভারি রুমের বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই এখন মারা যাবে, আত্মীয়স্বজন সবাই তাকে নিতে এসেছে।

“কষ্ট হচ্ছে নাকি?”

“একটু তো হচ্ছেই। মৃত্যুর একটা কষ্ট থাকে।”

“এইটা শেষ কষ্ট। এর পরে আর কষ্ট নাই।”

ইশিতা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী দেখিস তুই?”

রবিন বলল, “না কিছু না।”

পাশের বিছানায় ঘিরে থাকা সব মানুষ তখন একসাথে মাথা ঘুরিয়ে রবিনের দিকে তাকাল। চোখের দৃষ্টি কী তীব্র, রবিনের বুকের ভেতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

বুড়ো মতোন একজন মানুষ রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ খোকা তুমি আমাদের দেখতে পাও?

রবিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। পাই।”

“আশ্চর্য!” মানুষগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল, তারপর আবার রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখন যাও। মানুষের মৃত্যু মুহূর্ত খুব ভয়ানক।”

“যাই। আমি যাই।”

ঈশিতা দুর্বল হাতে রবিনের হাত ধরে নিচু গলায় বলল, “তুই কার সাথে কথা বলিস?”

“কারো সাথে না–”

“তাহলে?”

“আমি এখন যাই আপু। এই রোগীটা এক্ষুনি মারা যাবে।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“পরে বলব আপু-” রবিন কথা শেষ না করেই বাইরে বের হয়ে আসে। রোগীর আত্মীয়স্বজন চেয়ারে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে টেলিভিশনে খবর শুনছে। তারা কেউ জানে না তাদের রোগীটি এক্ষুনি মারা যাবে।

রবিন কানখাড়া করে রেখেছিল, হঠাৎ করে রিকভারি রুমের ভেতর থেকে একটা অ্যালার্মের মতো শব্দ শুনতে পেল। প্রথমে একজন নার্স তার পরে বেশ কয়েকজন ডাক্তার হঠাৎ ছোটাছুটি করতে শুরু করে।

রবিন নিঃশব্দে বসে থাকে, সে জানে ছোটাছুটি করে কোনো লাভ নেই। এ মানুষটিকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

.

ঈশিতা তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বিছানায় তার পায়ের কাছে বসেছে রবিন। কেবিনে এখন আর কেউ নেই। ঈশিতা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “বল।”

ঈশিতা কী শুনতে চাইছে রবিন খুব ভালো করে জানে তারপরেও সে না বোঝার ভান করল, বলল, “কী বলব?”।

“রিকভারি রুমে তুই কী দেখেছিলি? কার সাথে কথা বলছিলি?”

“আমি কাউকে দেখি নাই, কারো সাথে কথা বলি নাই।”

“মিথ্যে কথা বলবি না, কান ছিঁড়ে ফেলব তাহলে।” রবিন দুর্বল গলায় বলল, “আমি মিথ্যা কথা বলছি না।”

“এইটাও একটা মিথ্যা কথা।” ঈশিতা হাত নেড়ে বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি–”

“তোমাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রেখেছিল। ঘুমের মাঝে কী দেখতে কী দেখেছ, কী শুনতে কী শুনেছ–”

“আমি মোটেও ঘুমাচ্ছিলাম না রবিন। আমার সাথে ফাজলামো করবি না। কী হয়েছিল বল।”

“কিছু হয় নাই।”

“তুই বললি রোগীটা এক্ষুনি মারা যাবে। সত্যি সত্যি মারা গেল। কেমন করে তুই জেনেছিলি–”

রবিন কোনো কথা না বলে উদাস মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা এবারে একটু অনুনয় করে বলল, “রবিন। সোনা ভাই, আমাকে বল প্লিজ। আমি কাউকে বলব না।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

রবিন কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, “কী হলো?”

“না।”

“কী না?”

“আমি বলতে পারব না।”

ঈশিতা চোখ বড় বড় করে বলল, “কেন বলতে পারবি না?”

“আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আব্বু-আম্মুকে বলেছিলাম। মনে নাই তখন কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে নাই? ওষুধ দিয়ে আমাকে ছাড়াভেড়া করে দিয়েছিল। আমি দিনরাত খালি ঘুমাতাম—”

ঈশিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তুই সত্যি সত্যি কিছু একটা দেখিস?”

রবিন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ।”

“তাদের কথাও শুনিস?”

“হ্যাঁ।”

“দেখতে কী রকম।”

“তোমাদের বললে তোমরা বুঝবে না।”

“কাদেরকে দেখিস?”

রবিন এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, “যারা মরে গেছে তাদের।”

ঈশিতা চমকে উঠল, “সত্যি?”

রবিন মাথা নাড়ল।

“তাদের কথা শুনে তুই বুঝতে পেরেছিলি রোগীটা মারা যাবে?”

রবিন আবার মাথা নাড়ল। ঈশিতা বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “‘কী আশ্চর্য! তোর ভয় করে না?”

রবিন মাথা নাড়ল, “করে। অনেক ভয় করে।” এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “

“তুমি কাউকে বলবে না তো?”

“বলব না।”

“খোদার কসম?” ঈশিতা বলল, “খোদার কসম। আয় তুই কাছে আয়।”

রবিন কাছে এলে ঈশিতা তার হাত ধরে বলল, “এই যে তোর গা ছুঁয়ে বলছি, আমি কাউকে বলব না। আর শোন–”

“কী?”

“যদি তোর কখনো ভয় করে, তুই আমাকে বলবি। বুঝলি?”

রবিন মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইছিল ঠিক তখন কেবিনের দরজা খুলে আব্বু এসে ঢুকলেন বলে কথাটা আর বলা হলো না।

.

অনেকদিন থেকে আব্বুর গ্রামের বাড়িতে যাবার কথা। প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল সবাই মিলে কমপক্ষে দশ দিনের জন্যে যাবে। পূজার ছুটিতে যখন পরিকল্পনা পাকাপাকি করা হলো তখন দেখা গেল ঈশিতার পরীক্ষা সে যেতে পারবে না। তাই ঈশিতাকে একেবারে একা না রেখে রবিনকেও রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। আব্বু ছুটি নেবার সময় আবিষ্কার করলেন একটানা এতদিন ছুটি নেয়া এত সহজ ব্যাপার নয়, তাই দশ দিনের ভ্রমণকে কমিয়ে পাঁচ দিনে নামিয়ে নিয়ে এলেন।

যাবার আগে আম্মু অনেক ধরনের উপদেশ দিয়ে গেলেন। বাসায় ঈশিতা আর রবিন ছাড়াও ফুলি-খালা থাকবে। ফুলি-খালা তাদের বাসায় অনেকদিন থেকে আছে, আম্মু তার ওপর বিশ্বাস করে আগেও বাচ্চাদের রেখে গেছেন। ফ্রিজে রান্না করে কিছু খাবার রাখা হয়েছে। আলমারিতে শাড়ির নিচে খামের ভেতরে কিছু টাকা রয়েছে। পাঁচ দিন খুব বেশি সময় নয়, তারপরেও কোনোদিন কার কোন জামা-কাপড় পরতে হবে আম্মু সেগুলোও বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন।

আম্মু-আব্বু লিটনকে নিয়ে চলে যাবার পর সন্ধ্যেবেলা ঈশিতা আর রবিন আবিষ্কার করল বাসাটা একটু বেশি নির্জন। ঠিক কী কারণ জানা নেই, তাদের খিদে পেল তাড়াতাড়ি। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তারা বেশি কথাবার্তা বলল না। ঈশিতা আবার তার পড়াশোনাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। রবিন টেলিভিশনে আধখানা বাংলা নাটক দেখে বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে টেলিভিশন বন্ধ করে নিজের রুমে ফিরে এলো। খানিকক্ষণ ইংরেজি পড়ার চেষ্টা করে তার ঘুম পেয়ে গেল, ফুলি-খালা মশারি টানিয়ে দিয়ে গেল, রবিনও দাঁত ব্রাশ করে শুয়ে পড়ল।

গভীর রাতে রবিনের ঘুম ভেঙে গেল-ঠিক কী জন্যে ঘুম ভেঙেছে রবিন বুঝতে পারছিল না কিন্তু তারপরেও পাশ ফিরে শুয়ে নিজের অজান্তেই কিছু একটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যিই সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেল।

ছোট একটা বাচ্চার কান্না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাটি কাঁদছে। রবিন দুই হাত দিয়ে নিজের কান ঢেকে শুয়ে রইল কিন্তু শব্দটি চলে গেল না। তখন সে বিছানায় উঠে বসে কে কাঁদছে দেখার চেষ্টা করে। তার ঘরের এক কোনায় জমাট বাঁধা খানিকটা অন্ধকার, মাঝে মাঝে সেটা একটু একটু নড়ছে, সেখান থেকেই কান্নার শব্দটা আসছে। দেখে মনে হয় একটা শিশু। ঘরে আলো জ্বেলে রাখলে অনেক সময় এরা চলে যায়, সেভাবে কিছুক্ষণ ঘরের আলো জ্বেলে শিশুটাকে ঘর থেকে বাইরে বের করে দেবার চেষ্টা করবে কী না ঠিক বুঝতে পারল না। রবিন আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চাপা গলায় শিশুটিকে ডাকল, “এই।”

সাথে সাথে কান্নার শব্দ থেমে গেল। বাচ্চাটি চলে যায়নি, ঘরের কোনায় জমাট বাঁধা অন্ধকারটি এখনো দেখা যাচ্ছে। রবিন আবার ডাকল, “এই, তুমি এখানে আছ?”

রবিন বড় বড় নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পায় কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। রবিন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছ কেন?”

এবারে বাচ্চাটি উত্তর দিল, “আমার ভয় করছে।”

রবিন কখনোই এরকম একটি উত্তর আশা করেনি, অবাক হয়ে বলল, “তোমার ভয় করছে?”

“হ্যাঁ।”

“কীসের ভয়?”

“আমি হারিয়ে গেছি। আমি কোথায় যাব জানি না।”

রবিন এত অবাক হলো বলার নয়। জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় যাবে জানো না?”

“না।”

“তুমি এখানে এসেছ কীভাবে?”

“আমাকে-আমাকে–”

“তোমাকে কী?”

“আমাকে ভয় দেখাচ্ছিল, ধরে নিতে চাচ্ছিল তখন দেখলাম এখানে ভয় নাই-তখন এখানে ঢুকে গেছি।”

“কে তোমাকে ধরে নিতে চাচ্ছিল?”

“আমি চিনি না।”

“কেন তোমাকে ধরে নিতে চাচ্ছিল?”

“আমি জানি না।”

“তোমার আম্মু-আব্বু নাই?”

“আছে।”

“তারা কোথায়?”

“জানি না।” তারা বেঁচে আছে না মারা গেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে রবিন থেমে গেল। একটা ছোট বাচ্চাকে কেমন করে কেউ এই কথা জিজ্ঞেস করে?

বাচ্চাটা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। রবিন বিছানা থেকে নেমে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?”

“ওই যে আসছে। আমাকে ধরে নিতে আসছে! কী হবে এখন?”

“কে আসছে? কে?”

রবিন বিছানা থেকে নেমে ছোট বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যায় আর ঠিক তখন ঘরের ভেতরে একটা ঝাঁজালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। রবিন অবাক হয়ে দেখল, ঘরের মাঝখানে ধোঁয়ার মতো কিছু একটা জমাট বাঁধছে, দেখতে দেখতে সেটা কুৎসিত আধা মানুষ আধা পশুর মতো বিচিত্র একটা প্রাণীর রূপ নিয়ে নিল। খাটো রোমশ দেহ, উঁচু কপাল আর কপালের নিচে দুটি চোখ ধকধক করে জ্বলছে।

এটি মানুষ নয়, মানুষের মতো কোনো একটি প্রাণী। রবিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, প্রাণীটি ছোট বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে একধরনের জান্তব শব্দ করল। রবিন বাচ্চাটার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাতে বাচ্চাটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে বলল, “যাও! তুমি যাও! যাও এখান থেকে।”

প্রাণীটা তার ছোট ছোট চোখ দুটি দিয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। রবিন ফিসফিস করে বলল, “তুমি যাও। যাও এখান থেকে–”

প্রাণীটি তবু চলে গেল না। হাতের কাছে লাইট সুইচটা আছে, হঠাৎ করে লাইট জ্বালিয়ে দিলে প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে যাবে-কিন্তু ছোট বাচ্চাটির কী হবে? তীব্র আলোতে সেটাও তো থাকতে পারবে না–কোথায় যাবে তখন এই বাচ্চাটি?

রবিনের হঠাৎ করে তখন চার্জারের সাথে লাগানো টর্চ লাইটটার কথা মনে পড়ল। এক ছুটে সেটার কাছে গিয়ে হাতড়ে হাতড়ে লাইটটা হাতে নিয়ে সেটা প্রাণীটার মুখের ওপর জ্বালিয়ে দেয়-যন্ত্রণায় একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেল, সাথে সাথে একটা পোড়া গন্ধে ঘরটা ভরে যায়। একটা লুটোপুটির শব্দ হলো তারপর হঠাৎ করে ঘরটা নীরব হয়ে গেল। এত নীরব যে মনে হয় নিঃশ্বাসের শব্দটাও শোনা যাবে। প্রাণীটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

রবিন লাইটটা নিভিয়ে দিল, আবছা অন্ধকারের ঘরটা ঢেকে গেল সাথে সাথে। রবিন নিচু গলায় ডাকল, “এই ছেলে।”

কোনো উত্তর নেই। বাচ্চাটিও কী তাহলে চলে গেছে?

রবিন আবার ডাকল, “এই ছেলে।”

এবারে সে ফুঁপিয়ে কান্নার একটা শব্দ শুনতে পেল। “কোথায় তুমি?”

“এই যে। এখানে।”

রবিন বিছানার কাছে তাকাল। তার বিছানা আর টেবিলটার পাশে ছোট একটা জায়গায় সে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। রবিন বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে যায়। আবছা অন্ধকারে বাচ্চাটা তার দিকে তাকাল, কী সুন্দর মায়াকাড়া চেহারা। বড় বড় দুটি চোখ, কোকড়ানো চুল। এর আগে যখনই কাউকে দেখেছে তাদের শরীর ছিল রক্তাক্ত, মাথা থেঁতলানো, মুখ বিকৃত। শুধু এ ছেলেটির শরীরে আঘাতের কোনো চিহ্ন নাই। রবিন অবাক হয়ে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘরের আলো জ্বালিয়ে বাচ্চাটিকে ঠিক করে দেখতে পারলে হতো কিন্তু রবিন তার সাহস করল না। সে জানে তীব্র আলোতে এদের কষ্ট হয়।

“তোমার কী হয়েছিল?”

“আমি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিলাম।”

“তারপরে।”

তারপর আমি দেখি আমি সিঁড়িতে পড়ে আছি। আমার আম্মু আর আন্ধু আমাকে নিয়ে গাড়ি করে কোথায় জানি নিয়ে গেল

“নিশ্চয়ই হাসপাতালে?”

বাচ্চাটা মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ হাসপাতালে।”

“তখন তুমি কী করলে?”

“আমি চিৎকার করে আমার আম্মু আর আব্বুকে ডাকলাম। তারা আমার কথা শুনল না।”

“তখন?”

“তখন আমি পেছনে পেছনে যেতে চাইলাম, তারপর আমি হারিয়ে গেলাম!” বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

“কেউ তোমাকে নিতে আসে নাই?”

“না।”

“কেউ না? বয়স্ক মানুষ। সাদা কাপড় পরা মানুষ তোমার কাছে আসে নাই?”

“না।”

“একজনও আসে নাই?”

“না।”

ঠিক এরকম সময় দরজা খুলে ঈশিতা এসে ঢুকল, অবাক হয়ে বলল, “রবিন? কার সাথে কথা বলিস?”

ছোট বাচ্চাটা ভয়ে চিৎকার করে মুখ ঢেকে ফেলে। রবিন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ঈশিতাকে বলল, “শ-স-স-স–”

ঈশিতা ফিসফিস করে বলল, “কী হয়েছে?”

“বলছি আপু। অনেক সিরিয়াস ব্যাপার।”

ছোট বাচ্চাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আম্মুর কাছে যাব। আম্মুর কাছে যাব।”

রবিন নিচু হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী ছেলে?”

“জয়।”

“জয় তুমি কেঁদো না।”

“আমার ভয় করে।”

“ভয়ের কিছু নেই জয়। আমরা আছি না।”

তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?”

“না যাব না।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, “তুই কার সাথে কথা বলছিস?”

“বলছি আপু। বাইরে আসো–”

জয় চিৎকার করে বলল, “না, না, আমাকে ছেড়ে বাইরে যেও না। আমার ভয় করে।”

“তোমার কোনো ভয় নেই জয়। আমি যাব না। আমি এখানেই আছি। তুমি চুপ করে বসে থাকো।”

জয়কে বসিয়ে রবিন বাইরে বের হয়ে এলো, ঈশিতা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, “তুই কার সাথে কথা বলছিস?”

“একটা ছোট ছেলে, নাম জয়।”

“তুই একটা ছোট ছেলেকে দেখছিস?”

“হ্যাঁ।”

“সে তোর সাথে কথা বলছে?”

“হ্যাঁ আপু।”

“ছেলেটা আসলে মরে গেছে?”

রবিন ইতস্তত করে বলল, “এইটাই হচ্ছে সমস্যা। আমি দেখেছি যখন কেউ মারা যায় তখন তার সব আত্মীয়স্বজন, অন্যান্য মারা যাওয়া মানুষেরা তার কাছে চলে আসে। কিন্তু—”

“কিন্তু কী?”

“এই ছেলেটার বেলায় অন্যরকম। সে একা। সে হারিয়ে গেছে। কেউ তাকে নিতে আসছে না–ভয়ংকর প্রাণী শুধু ভয় দেখাচ্ছে, নিয়ে যেতে চাইছে।”

ঈশিতা বলল, “তার মানে কী?”

“আমি জানি না। শুধু মনে হচ্ছে-”

“কী মনে হচ্ছে?”

রবিন ইতস্তত করে বলল, “মনে হচ্ছে ছেলেটা আসলে মারা যায়নি।

“তাহলে?”

“শুধু তার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।”

“কী বলছিস তুই? সেটা আবার কী”

রবিন মাথা নাড়ল, “সেটা আমি জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সে এখনো পুরোপুরি মারা যায়নি। আমার মনে হচ্ছে যদি আমরা এখন জয়কে তার শরীরের কাছে নিয়ে যেতে পারি তাহলে হয়তো বেঁচে যাবে।”

ঈশিতা অবাক হয়ে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, “তুই কেমন করে এটা জানিস?”

“আমি জানি না। আমি আসলে কিছু জানি না। আমার শুধু এটা মনে হচ্ছে।”

“তাহলে? তাহলে এখন কী করবি?”

রবিন কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। ঈশিতা রবিনের দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে এখন খুঁজে বের করতে হয়, ছেলেটার শরীর কোথায় আছে।”

“কেমন করে বের করবে?”

“আয় হাসপাতালে হাসপাতালে ফোন করি।”

“ঠিক আছে।” রবিন বলল, “আমি দেখি ছেলেটার সাথে কথা বলে আরো কিছু খবর বের করতে পারি কী না।”

রবিন বাচ্চাটার সাথে কথা বলে নুতন কিছুই বের করতে পারল না। ঈশিতা তখন একটা ডায়েরি খুঁজে বের করল, তার মাঝে সব হাসপাতালের টেলিফোন নম্বর দেয়া আছে। সে একটা একটা নাম্বার বের করে টেলিফোন করতে শুরু করে। এত রাতে কেউ সহজে টেলিফোন ধরতে চায় না, টেলিফোন ধরলেও উত্তর দিতে চায় না, তার মাঝেও ঈশিতা লেগে থাকল। ঘণ্টাখানেক চেষ্টা করে যখন ঈশিতা প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিল তখন হঠাৎ করে একটা হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট ঘুম ঘুম বলল, সন্ধ্যেবেলা তাদের এখানে একটা ছোট বাচ্চাকে আনা হয়েছে। মাথায় ব্যথা পেয়ে অজ্ঞান হয়েছিল সে যতদূর জানে এখনো জ্ঞান ফিরেনি। ঈশিতা বাচ্চাটার নাম জানতে চাইছিল রিসেপশনিস্ট বলতে পারল না। বাচ্চার আত্মীয়স্বজন কেউ আশেপাশে আছে কী না জিজ্ঞেস করল, রিসেপশনিস্ট সেটাও বলতে পারল না। হাসপাতালের নাম প্যারামাউন্ট হাসপাতাল, তাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয়।

টেলিফোনটা রেখে ঈশিতা রবিনকে জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করবি?”

রবিন মাথা চুলকে বলল, “ছেলেটাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই।

“এত রাতে যাবি কেমন করে?”

“স্কুটার ক্যাব কিছু একটা পাওয়া যাবে না?”

ঈশিতা বলল, “দেখি চেষ্টা করে।”

রবিন বলল, “না পেলে হেঁটে চলে যাব।”

তাদের অবিশ্যি হেঁটে যেতে হলো না, বাসা থেকে বের হবার পর কিছুক্ষণের মাঝেই একটা রিকশা পেয়ে গেল। এত রাতে রিকশাওয়ালা কী করছে সেটা একটা রহস্য। রাস্তায় দুবার পুলিশ রিকশাকে থামাল, ঈশিতা বলল, “জরুরি কাজে হাসপাতালে যাচ্ছে। এত রাতে এভাবে রিকশা করে যাওয়ার ব্যাপারটা পুলিশ ভালো চোখে দেখল না কিন্তু হাসপাতালে যাচ্ছে শুনে শেষ পর্যন্ত। যেতে দিল।

যে ব্যাপারটি ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা সেটা অবিশ্যি রবিন ছাড়া আর কেউ জানল না। সেটি ছিল ছোট বাচ্চাটাকে রাজি করিয়ে তাদের সাথে আনা। সে কিছুতেই ঘরের বাইরে যেতে চাইছিল না, তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শুনে শেষ পর্যন্ত আসতে রাজি হয়েছে। সত্যিকারের একজন বাচ্চাকে হাত ধরে বা কোলে করে নেয়া যায়। কিন্তু যাকে স্পর্শ করা যায় না দেখা যায় না শোনা যায় না কিন্তু সত্যিকার একটা শিশুর মতো অবুঝ তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া সহজ না। রবিন অনেক কষ্ট করে বাচ্চাটিকে নিজের শরীরের কাছাকাছি রেখে কোনোভাবে তাকে নিয়ে হাসপাতালে চলে এলো।

হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ব্যাপারটি অবিশ্যি সহজ হয়ে গেল। জয়ের মা আইসিইউয়ের বাইরে দুই হাতে মুখ ঢেকে বসেছিলেন, জয় আম্মু আম্মু বলে ডাকতে ডাকতে ছুটে গিয়ে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। মা কেমন যেন চমকে মুখ তুলে তাকালেন। তারপাশে একটি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল, বলল, “কী হয়েছে মা?”

মা বললেন, “কী আশ্চর্য! আমার মনে হলো আমার জয় যেন আমাকে আম্মু আম্মু বলে ডাকল।”

কেউ দেখতে পাচ্ছিল না শুধু রবিন দেখল জয় পাগলের মতো তার মায়ের মুখটি ধরার চেষ্টা করছে কিন্তু ধরতে পারছে না। ব্যাকুল হয়ে সে কাঁদতে শুরু করল, “আম্মু, তুমি আমার দিকে তাকাও না কেন? কথা বলো না কেন?”

রবিন তখন বাচ্চাটিকে ডাকল, “জয়।”

যারা পঁড়িয়ে ছিল তারা সবাই চমকে উঠে রবিনের দিকে তাকাল। রবিনের কিছু করার নেই, সবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মাঝেই তাকে বাকি কাজটুকু করতে হবে, সে ফিসফিস করে বলল, “জয়। তোমাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না!”

“কেন দেখতে পাচ্ছে না?”

“তুমি তোমার শরীর থেকে বের হয়ে গেছ। তুমি যাও, তোমার শরীরের ভেতরে যাও। তাহলে সবাই তোমাকে দেখবে। যাও।”

“কোথায় আমার শরীর?”

“এই ঘরটার ভেতরে। এসো আমার সাথে—”

আইসিইউতে কারো ঢোকার কথা নয়, কিন্তু কেউ রবিনকে বাধা দিল না। সবাই বিস্ফারিত চোখে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার ভেতরে সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। সারি সারি বিছানায় মরণাপন্ন রোগীরা শুয়ে আছে, তার মাঝে জয় রবিনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। রবিন না তাকিয়েও বুঝতে পারে হাসতালের সব নিয়ম ভেঙে

তারপাশে জয়ের মা বাবা ভাই বোন দাঁড়িয়ে আছে। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে ডাক্তার নার্সও তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন আর এক মুহূর্ত নষ্ট করার সময় নেই। রবিন জয়ের বিছানাটি খুঁজে বের করল, ছোট শিশুটির শরীরে নানারকম যন্ত্রপাতি। লাগানো, সে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। রবিন জয়কে দেখাল, “এই যে। এটা তোমার শরীর। তোমার এখানে ঢুকতে হবে।”

“আমি কেমন করে ঢুকব?”

“আমি জানি না। কিন্তু ঢুকতে হবে। যদি না ঢুকো তাহলে তোমার মা কোনোদিন তোমাকে দেখতে পাবে না। যাও দেরি করো না।”

জয় বিভ্রান্তের মতো একবার রবিনের দিকে তাকাল, আরেকবার তার মায়ের দিকে তাকাল। কাদো কাদো হয়ে বলল, “আমার ভয় করে।”

“ভয় করলে হবে না। জয়, যাও দেরি করো না।”

জয়ের নিথর দেহের চারপাশে যারা দাঁড়িয়েছিলেন তারা সবিস্ময়ে দেখলেন তার শরীরটি কেমন জানি কেঁপে উঠল, হাতটা একটু তোলার চেষ্টা করল। মাথাটা একপাশ থেকে অন্যপাশে নাড়াল। সমস্ত শরীরে একটা খিচুনীর মতো হলো তারপর হঠাৎ সে চোখ খুলে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। তার শরীরে লাগানো অনেক যন্ত্রপাতি হঠাৎ করে সচল হয়ে বিপ বিপ শব্দ করতে শুরু করল। জয়ের মা পাগলের মতো তার সন্তানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন, দুজন ডাক্তার তাকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল।

কে একজন রবিনের কনুই ধরে টান দিচ্ছে, রবিন মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখে ঈশিতা। ঈশিতা ফিসফিস করে বলল, “বের হয়ে আয়। কুইক।”

রবিন দ্রুত বের হয়ে আসে। এই মুহূর্তে কেউ তাদের লক্ষ করছে না। এখনই তাদের সরে যেতে হবে। এক্ষুনি। তা না হলে আর কোনোদিন তারা এখান থেকে বের হতে পারবে না। যে ব্যাপারটা ঘটেছে সেটা কাউকে রবিন বোঝাতে পারবে না।

গভীর রাতে রিকশা করে দুই ভাই-বোন বাসায় ফিরে যাচ্ছিল। ঈশিতা গভীর মমতায় তার ছোট ভাইটিকে ধরে রেখেছে। যাকে সে কখনো বুঝতে পারেনি, আজকে সে জেনে গেছে তাকে কখনো সে বুঝতে পারবেও না।

দানব

খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে শারমিন হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আম্মু তুমি কী ভূতে বিশ্বাস করো?”

লাবনী চোখের কোনা দিয়ে মেয়েকে এক নজরে দেখে বলল, “তুই বিশ্বাস করিস?”

শারমিন বলল, “আমি আগে জিজ্ঞেস করেছি। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”

লাবণী প্লেটে একটু ভাত নিতে নিতে বলল, “ভূত বিশ্বাস করি কী না জানি না তবে পেত্নী বিশ্বাস করি।”

শারমিন হেসে ফেলল, বছর দুয়েক আগে তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে।

নীলা নামের কমবয়সী যে মেয়েটাকে বিয়ে করার জন্যে শারমিনের বাবা সাজ্জাদ তার স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে চলে গেছে তাকে। এই বাসায় পেত্নী বলে সম্বোধন করা হয়। নীলার চেহারা খারাপ নয় কিন্তু একজন মানুষকে অপছন্দ করলে তার সবকিছুকেই খারাপ লাগে।

শারমিন বলল, “আম্মু সত্যিকার ভূতের কথা বলছি।”

“সত্যিকার ভূত?”

“হ্যাঁ।”

লাবণী বলল, “তুই যদি এখন আমাকে জিজ্ঞেস করিস যখন লাইট জ্বলছে, ফ্যান

ঘুরছে, টেলিভিশন চলছে, আশেপাশে লোকজন-তখন আমি বলব, ভূত বলে কিছু নাই!

কিন্তু মনে কর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছি, রাত্রিবেলা জোছনার আলোতে বারান্দায় বসেছি। বাড়ির পেছনে বাঁশঝাড়ে বাতাসের শিরশির শব্দ হচ্ছে দূরের গোরস্তান থেকে শেয়াল ডেকে উঠল, তখন যদি জিজ্ঞেস করিস ভূত বলে কিছু আছে কী না তখন আমি বলব, ইয়ে মানে পৃথিবীতে ব্যাখ্যা করা যায় না সেরকম তো কত কিছুই আছে! ভূত তো থাকতেও পারে।”

শারমিন গম্ভীর মুখে বলল, “তার মানে তুমি পরিষ্কার করে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”

লাবণী বলল, “কে বলেছে দিলাম না? আমি বলেছি ভূত বলে কিছু নাই কিন্তু ভূতের ভয় আছে!”

শারমিন হি হি করে হেসে উঠল, বলল, “তুমি যে কী অদ্ভুত কথা বলো আম্মু! একটা জিনিস যদি না থাকে তাহলে তার ভয়টা থাকে কেমন করে?”

“থাকতে পারে না?”

“না।”

“মাকড়সা?”

শারমিন একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে মাকড়সায়?”

“তুই মাকড়সাকে ভয় পাস না? এইটুকুন ছোট একটা। মাকড়সাকে দেখলে তুই চিৎকার করে ছুটে পালাস কি না?

“হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?”

এই রকম ছোট একটা মাকড়সাকে ভয় পাওয়ার পেছনে কোনো যুক্তি আছে? এই মাকড়সা তোকে খেয়ে ফেলবে?

শারমিন বলল, “সেটা তো অন্য জিনিস। মাকড়সাকে দেখলেই কেমন গা শিরশির করে ওঠে–”

লাবণী বলল, “একই জিনিস। ভয় পেতে হলে তার পেছনে যুক্তি থাকতে হয় না। এইটুকুন মাকড়সাকে ভয় পাবার কিছু নাই কিন্তু তুই ভয় পাস। ভূত বলে কিছু নাই কিন্তু মানুষ ভূতকে ভয় পায়।”

শারমিন হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যুক্তি হচ্ছে একেবারে উল্টাপাল্টা যুক্তি। তুমি তোমার ছাত্রীদের কী পড়াও খোদাই জানে। সব নিশ্চয়ই উল্টাপাল্টা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে এসো।”

“ছাত্রী–এত দূরে যাচ্ছিস কেন? তুই কী দোষ করলি। তোকে উল্টাপাল্টা কিছু শিখাই নাই?”

“নিশ্চয়ই শিখিয়েছ, আমি যেটা টের পাই না। আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই টের পায় আর আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

শারমিন কিছু বলল না, হয়তো আম্মুর কথাই ঠিক। বিচিত্র জিনিস আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা সুন্দর। সবকিছু যদি ছকে বাঁধা নিয়ম মাফিক হতো তাহলে পৃথিবীটা হয়তো একঘেয়ে হয়ে যেত।

এই অক্টোবরে শারমিনের বয়স হবে আঠারো। লাবণী খেতে খেতে মেয়ের দিকে তাকাল, যে বাবা তাকে ছেড়ে চলে গেছে মেয়েটার চেহারায় সেই বাবার চেহারার একটা ছাপ আছে। ঠিক কোথায় সে ধরতে পারে না, হয়তো চোখে কিংবা কথা বলার ভঙ্গিতে। এই কথা বলার ভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয়ে লাবণী এক সময় সাজ্জাদকে পাগল হয়ে বিয়ে করেছে। কে জানে এই কথা বলার ভঙ্গি দেখেই মুগ্ধ হয়েই হয়তো নীলা নামের কমবয়সী মেয়েটাও তার সংসারটা ভেঙে নিয়ে চলে গেছে। দুই বছর আগের ঘটনা কিন্তু এখনো বুকের ভেতর কেমন যেন দগদগে একটা ঘা। এরকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে সেটা লাবণী স্বপ্নেও বিশ্বাস করত না, অথচ ঠিক তার জীবনেই এটা ঘটে গেল। যে মানুষটার জন্যে সে সবকিছু দিয়ে দিতে পারত তার জন্যে এখন কোনো অনুভূতি নেই।

লাবণী ভেবেছিল সাজ্জাদের জন্যে বুঝি তার বুকের ভেতর একটা তীব্র ঘৃণা থাকবে। কিন্তু সেটিও নেই। কে জানে কোনো অনুভূতি না থাকা হয়তো তীব্র ঘৃণা থেকেও ভয়ংকর।

লাবণীর জন্যে পুরো ব্যাপারটা ছিল খুব কষ্টের কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে সামলে নিয়েছে। শারমিন সামলে নিতে পারেনি। সাজ্জাদের সাথে তার ভিন্ন একটা জগৎ ছিল, বাবা এবং মেয়ের ভালোবাসার জগৎ। সেই জগৎটাই ওলটপালট হয়ে গেছে। শারমিন মাঝে মাঝে সাজ্জাদের সাথে দেখা করতে যায় কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে কিংবা কোনো শপিংমলে কেনাকাটা করতে কিন্তু লাবণী বুঝতে পারে সুরটুকু কেটে গিয়েছে। বাবার জন্যে ভালোবাসাটুকু আছে কিন্তু তার সাথে বিচিত্র একটা বিতৃষ্ণা এসে যোগ হয়েছে। একজন মানুষকে কী একই সাথে ভালোবাসা এবং ঘৃণা করা যায়? দুই বছর আগে স্ত্রী-কন্যাকে ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে শারমিন অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তার ওপর বিচিত্র একটা বিষণ্ণতা এসে ভর করে। নিজের ঘরে দিনের পর দিন চুপচাপ বসে থাকে।

লাবণী কী করবে বুঝতে পারে না, বিষয়টা নিয়ে কোনোরকম বাড়াবাড়ি না করে শান্তভাবে মেনে নেবার চেষ্টা করে। মেয়েটা বুদ্ধিমতী তার নিজেকেই এই অবস্থা থেকে একদিন বের হয়ে আসতে হবে।

লাবণী শারমিনের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, “সে কী! পুরো সবজিটুকু রেখে দিলি মানে?”

“আমি মোটেই পুরোটুকু রাখিনি মা। তুমি আমাকে যেটুকু দিয়েছ সেটা নিয়ে এক পল্টন আর্মিও খেয়ে শেষ করতে পারবে যতটুকু খাওয়া সম্ভব ততটুকু খেয়েছি”

“ব্যস। অনেক বক্তৃতা হয়েছে-খা বলছি। খেয়ে শেষ কর। মাথা ভেঙে ফেলব তা না হলে।

শারমিন মুখটা কুঁচকে সবজিগুলো খুঁটে খুঁটে খেতে চেষ্টা করে। লাবণী খানিকক্ষণ সেটা লক্ষ করে বলল, “এবারে তুই বল।”

“কী বলব?”

“তুই ভূত বিশ্বাস করিস?”

“আমি?” শারমিন চোখ কপালে তুলে বলল, “আমি ভূত বিশ্বাস করব? তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে? আমাকে দেখে কী মনে হয় আমি ভূত-প্রেত বিশ্বাস করি?”

“কেন ক্ষতি কী বিশ্বাস করলে?”

“আম্মু তুমি কলেজের একটা টিচার হয়ে আমাকে ভূত বিশ্বাস করতে বলো?”

“আমি তোকে ভূত বিশ্বাস করতে বলছি না।”

শারমিন বলল, “তাহলে কী বলছ?”

“আমি বলছি মানুষের জীবনে একটু কল্পনা থাকতে হয়। শুধু কাঠখোট্টা মানুষের মতো যেটা সত্যি সেটা বিশ্বাস করলে হয় না-কিছু কল্পনার জিনিসও বিশ্বাস করতে হয়। আইনস্টাইন কী বলেছেন জানিস না?”

“জানি জানি আম্মু। তুমি দিনে দশবার করে মনে করিয়ে দাও, না জেনে উপায় আছে!”

লাবণী বিজয়ীর মতো বলল, “তাহলে?”

“আম্মু, আইনস্টাইন মোটেও ভূত বিশ্বাস করতে বলেননি, বলেছেন ইমাজিনেশন ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান নলেজ। জ্ঞান থেকে কল্পনা বেশি ইম্পরট্যান্ট।”

“একই কথা। ভূত কী আছে? নেই! তাহলে ভূতকে পাব কেমন করে? কল্পনায়। ইমাজিনেশনে। তুই জানিস পৃথিবীতে কতো ফাটাফাটি ভূতের গল্প আছে?”

শারমিন মাথা নেড়ে বলল, “তোমার যুক্তিগুলো খুবই পিকুলিয়ার। পৃথিবীতে ফাটাফাটি ভূতের গল্প আছে, সেই গল্পগুলো

এনজয় করার জন্যে ভূতকে বিশ্বাস করে বসে থাকি!”

লাবণী হেসে বলল, “এই যুক্তিটি তোর কাছে পিকুইলিয়ার মনে হচ্ছে? এটা একেবারে এক নম্বুরী যুক্তি।”

শারমিন বলল, “থাক আম্মু! থাক। তোমার সাথে তর্ক করার থেকে সাদিবের সাথে তর্ক করা সোজা।”

“সাদিবটা কে?”

“আমাদের সাথে পড়ে। একেবারে পাগল। শুধু পাগল না, পাগল এবং ছাগল!”

লাবণী হেসে বললেন, “কেন? কী করেছে?”

“কী করে নাই বলো। একেকদিন তার মাথায় একেকটা ঝোঁক আসে। তুমি বিশ্বাস করবে না মাঝখানে একবার ঠিক করল ঘাস খেয়ে থাকবে।”

“ঘাস?”

“হ্যাঁ। ঘাস। সেই ঘাস খেয়ে সিরিয়াস ডায়েরিয়া, হাসপাতালে থাকতে হলো পুরা এক সপ্তাহ। সেই থেকে সবাই ডাকে ছাগল।”

“আচ্ছা পাগল দেখি।”

“হ্যাঁ। এখন সে ব্ল্যাক আর্ট করে।”

লাবণী ভুরু কুঁচকে বলল, “ব্ল্যাক আর্ট?”

“হ্যাঁ। আমাদেরকেও শেখাচ্ছে।”

“কী শিখাচ্ছে?”

শারমিন মাথা নেড়ে বলল, “অনেক কিছু। সব তোমাকে বলাও যাবে না। যেটা সবচেয়ে সহজ সেটা এরকম। তুমি রাত্রিবেলা বাথরুমে দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়াবে। বাথরুমের লাইট নিভিয়ে এক কোনায় একটা ছোট মোমবাতি জ্বালাবে যেন আবছা অন্ধকার থাকে। তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাতচল্লিশ বার বলবে ব্লাডি মেরি–”

লাবণী বাধা দিয়ে বলল, “সাতচল্লিশ বার? সাতচল্লিশ বার কেন?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “আমি জানি না। সাদিবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সেও জানে না। মনে হয় সাতচল্লিশ প্রাইম নম্বর সেই জন্যে।”

“ভূতেরা তাহলে প্রাইম নম্বর বুঝে?”

“মনে হয় বুঝে।”

“ঠিক আছে। সাতচল্লিশ বার ব্লাডি মেরি বললাম তখন কী হবে?”

“তখন তুমি আয়নার ব্লাডি মেরিকে দেখবে।”

“ব্লাডি মেরিটা কে?”

“একটা ডাইনি। আমেরিকাতে নাকি সালেম নামে একটা শহর আছে সেখানে তাকে পুড়িয়ে মেরেছিল।”

“কে পুড়িয়ে মেরেছিল?”

“জানি না। মনে হয় শহরের লোকজন।”

“কবেকার ঘটনা?”

“তাও জানি না। অনেক আগেরই হবে। আজকাল কী আর কেউ কাউকে পুড়িয়ে মারে!”

লাবণী শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সাদিব ব্লাডি মেরিকে দেখেছে?”

“এখনো ভালো করে দেখেনি। অবস্থা আবছা নাকি দেখেছে!”

লাবণী পানি খাচ্ছিল শারমিনের কথা শুনে হাসি চাপাতে গিয়ে বিষম খেল। বলল, “ব্লাডি মেরির চেহারা কেমন?”

“চেহারা এখনো স্পষ্ট দেখে নাই। ডাইনি বুড়ির চেহারা আবার কেমন হবে?”

লাবণী মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু চেহারা ভালো হবার কথা। আমেরিকান কমবয়সী ডাইনি রীতিমতো রূপসী হয়। তোর সাদিবকে বলিস আবার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে না যায়।”

এইবার শারমিন হি হি করে হাসতে লাগল। বলল, “ভালোই বলেছ আম্মু–এটা সাদিবকে বলতে হবে। আয়নার এইপাশে সাদিব অন্যপাশে ব্লাডি মেরি। দুইজন দুইজনকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে। কিন্তু একজন আরেকজনের কাছে আসতে পারবে না।”

রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে শারমিন বাথরুমে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে বলল “ব্লাডি মেরি,” গুনে গুনে সাতচল্লিশ বার। আয়নায় কিছুই হলো না। কিছু একটা হবে সেটা অবিশ্যি সে আশাও করেনি! রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল তাকে পুড়িয়ে মারার জন্যে শহরের শত শত মানুষ তাকে ধাওয়া করেছে, সে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ছুটছে। যখন তার ঘুম ভাঙল তখনো তার বুক ধুকধুক করছে, পুরো শরীর ঘামে ভেজা।

কয়দিন পর শারমিন ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে, লাবণী জিজ্ঞেস করল, “তোদের ব্ল্যাক আর্টের খবর কী? পাগল সাদিবের সাথে ব্লাডি মেরির দেখা হয়েছে?”

শারমিন দাঁত বের করে হাসল, বলল, “সাদিব এখন তার গল্প পাল্টে ফেলেছে।

“কীভাবে পাল্টেছে?”

“এখন বলছে আসলে হঠাৎ করে বললে হবে না। সাধনা করতে হবে।”

লাবণী চোখ বড় বড় করে বলল, “সাধনা? প্রেতসাধনা?”

“হ্যাঁ। রীতিমতো প্রেত সাধনা।”

“সেটা কী রকম?”

“গরুর মাংস ডিম এসব খাওয়া যাবে না। রসুন খাওয়া যাবে না। সাদা রঙের সেলাই ছাড়া কাপড় পরতে হবে। প্রতি রাত বারোটার সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্লাডি মেরিকে ডাকতে হবে, টানা সাতচল্লিশ দিন বলার পর অমাবস্যার রাতে নাকি ব্লাডি মেরি আসবে।”

লাবণী হেসে ফেলল, বলল, “এত পরিশ্রম করলে শুধু ব্লাডি মেরি কেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরও চলে আসার কথা!”

“ঠিকই বলেছ। সাদিব অবিশ্যি বলছে ব্লাডি মেরি ছাড়া অন্যদেরও আনা যাবে। যার নাম বলবে সেই আসবে।”

তাহলে তো খারাপ হয় না। ইয়াহিয়া খানকে ডেকে আনলে হয়, তারপর ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে সিধে করে দিতাম।”

“না আম্মু ওরা খালি দেখা দিবে। আয়না থেকে বের হতে পারবে না।” লাবণী বলল, “তাহলে আর লাভ কী। বের করে একটা বোতলের ভেতর ভর্তি করে ফেলতে পারতাম তাহলে না মজার হত।”

শারমিন হি হি করে হেসে বলল, “সেটা ঠিকই বলেছ। বোতলে ভর্তি করে যদি ভূত বিক্রি করা যেত কী মজা হতো তাই না?”

.

সেদিন রাতে ঘুমানোর আগে শারমিন বাথরুমে দাঁত ব্রাশ করছে, হঠাৎ তার ব্লাডি মেরির কথা মনে পড়ল। সে দাঁত ব্রাশ করা শেষ করে বাথরুমের লাইটটা নিভিয়ে দেয়। বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইরের এক চিলতে আলো ভেতরে এসে একটা আলো-আঁধারির মতো হয়েছে। আয়নায় নিজেকে আবছায়ার মতো দেখা যায়। শারমিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে সাতচল্লিশবার বলল “ব্লাডি মেরি”।

তারপর চোখ খুলে তাকাল, আয়নায় কিছুই দেখবে না সে খুব ভালো করেই জানে তারপরও নিজের আবছা প্রতিবিম্বটা দেখে একটু আশা ভঙ্গ হলো! ঠিক কী কারণ কে জানে শারমিনের মনে হচ্ছিল সে কিছু একটা দেখে ফেলবে। কী দেখবে সে জানে না কিন্তু আলৌকিক কিছু একটা।

বাথরুমের আলো জ্বালাতে গিয়ে সে থেমে গেল। সাদিব বলেছিল শুধু যে ব্লাডি মেরিকে ডাকা যায় তা নয় অন্য যে কোনো মৃত মানুষকেও ডাকা যায়। বেচারি ব্লাডি মেরিকে নিশ্চয়ই সবাই ডাকডাকি করছে। সারা পৃথিবীর সবার কাছে তার ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। সে তাহলে অন্য কাউকেই ডাকবে। দেখা যাক কী হয়।

শারমিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখ বন্ধ করল, হঠাৎ তার মনে হলে বাথরুমের আবছা অন্ধাকারে তার সাথে অন্য কেউও আছে। জীবনে যেটা হয়নি হঠাৎ করে তার সেটা হলো তার বুকের মাঝে ভয়ের কেমন যেন একটা কাঁপুনি স্পর্শ করে গেল। শারমিন ফিসফিস করে বলল, “যদি এই ঘরে আমার সাথে কোনো বিদেহী আত্মা থেকে থাকো, কোনো অতিপ্রাকৃত প্রাণী, কোনো ভূত কোনো প্ৰেত এসে থাকো তাহলে তুমি দেখা দাও। তুমি আসো তুমি আসো তুমি আসো”

গুনে গুনে সাতচল্লিশ বার বলার পর শারমিন থামল। সে এখন চোখ খুলে তাকাবে হঠাৎ করে তার বুকের ভেতর কেমন জানি ধক করে ওঠে। তার মনে হতে থাকে এই বাথরুমে তার সাথে অন্য কেউ আছে। শুধু তাই নয় তার মনে হয় সে যখন চোখ খুলে তাকাবে তখন আয়নায় সে নিজেকে দেখবে না, অন্য কাউকে দেখবে। শারমিন অল্প অল্প কঁপতে শুরু করে, মনে হতে থাকে বাথরুমটা বুঝি অসম্ভব ঠাণ্ডা, একেবারে হিম শীতল।

শারমিন বিড়বিড় করে বলল, “না। আমি চোখ খুলে তাকাব না। আমি হাতড়ে হাতড়ে লাইটের সুইচটা বের করে আলো জ্বালিয়ে দেব। প্রচণ্ড আলোয় সব কিছু ভেসে যাবে।”

শারমিন হাতড়ে হাতড়ে লাইটের সুইচটা বের করল, সুইচটা টিপে জ্বালানোর আগের মুহূর্তে তার ঠিক কী মনে হলো কে জানে। সে চোখ খুলে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্যে সে অশরীরী একটা আতঙ্ক অনুভব করল, কিন্তু সেটা মুহূর্তের জন্যেই, চোখ খুলে সে আয়নায় নিজেকেই দেখতে পেল, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শারমিন আবছা অন্ধকারে নিজের প্রতিবিম্বটির দিকে তাকিয়ে থাকে, এটি তার প্রতিবিম্ব কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছে এখানে কিছু একটা গোলামাল আছে। গোলমালটা কী সে ধরতে পারছে শারমিন ভালো করে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। সে ডান হাতটা দিয়ে দেওয়ালে লাইটের সুইচটা স্পর্শ করে আছে কিন্তু আয়নার প্রতিবিম্বে দেখা যাচ্ছে দুই হাত দুই পাশে দিয়ে সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটা কী সত্যিই তার প্রতিবিম্ব? নাকি অন্য কারো?

শারমিন তার মাথাটি ডান থেকে বামে দোলাল–প্রতিবিম্বটি নড়ল না, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শারমিন আতঙ্কে একটা চিৎকার দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে লাইট সুইচটা টিপে দিতেই মুহূর্তে তীব্র আলোয় পুরো বাথরুমটা আলোকিত হয়ে যায়।

এতক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর হঠাৎ করে আলো জ্বালানোর ফলে শারমিনের চোখ ধাঁধিয়ে যায়। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে আয়নার দিকে তাকাল, না আয়নায় অদ্ভুত কিছু নাই। তার নিজেকেই দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো শক্ত করে বাঁধা, গোলাপি ফুলফুল তার ঘুমের পোশাক। দুই চোখে একধরনের হতচকিত বিস্ময়।

শারমিন বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিল, পুরো বিষয়টা হঠাৎ করে তার কাছে ছেলেমানুষী মনে হতে থাকে। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার, সত্যি সত্যি সে ভেবে বসেছিল যে আয়নায় সে অন্য কাউকে দেখছে! সেটা কী কখনো সম্ভব?

শারমিন ট্যাপ খুলে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে নিজের মুখ ভালো করে ধুয়ে নিতে শুরু করে তখনই শুনতে পেল বাইরে থেকে লাবণী ডাকছে, “কী হলো বাথরুমে ঘুমিয়ে গেলি নাকি।”

“এই তো আম্মু আসছি।”

বাথরুমে কী হয়েছিল সেটা বলার জন্যে শারমিন বের হয়ে আসে, আম্মুর সাথে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সে হাসাহাসি করবে ভাবছিল, কিন্তু ঠিক কী কারণ সে বুঝতে পারল না সে আম্মুকে ব্যাপারটা বলতে পারল না। লাবণী তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটু অবাক হয়ে বলল, “কী হলো তোর চোখ-মুখ এমন লাল হয়ে আছে কেন?”

শারমিন নিচু গলায় বলল, “লাল হয়নি আম্মু। চোখ-মুখ কেন লাল হবে?”

‘ঘুমা তাড়াতাড়ি। কত রাত হয়েছে দেখেছিস?”

.

শারমিন রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে থাকে। তার কেমন জানি একটু অস্থির অস্থির লাগছে। ঠিক কী কারণ সে জানে না, কিন্তু তার ভেতরে একধরনের চাপা ভয়। শুধু ভয় নয় একধরনের চাপা আশঙ্কা। কেন জানি মনে হচ্ছে খুব অশুভ একটা কিছু ঘটেছে কিন্তু সেটা সে ধরতে পারছে না। যতবার সে ঘুমানোর চেষ্টা করছে হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে গেছে, মনে হয়েছে কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। শারমিনের একবার মনে হলো সে তার নিজের বিছানা থেকে উঠে গিয়ে লাবণীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়বে। আগে কতবার গভীর রাতে আম্মুর পাশে জায়গা করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়েছে। আম্মু ঘুমের মাঝে জিজ্ঞেস করেছে, “কী হলো শারমিন?” শারমিন বলেছে, “ঘুম আসছে না আম্মু, লাবণী তখন শারমিনকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে। এত বড় একটা মেয়ে হয়েও সে গুটিশুটি মেরে মায়ের বুকের মাঝে শুয়ে পড়ে প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কিন্তু আজ রাতে সে তার আম্মুর কাছে গেল না, বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগল।

.

পরদিন ভোরবেলা লাবণী শারমিনকে দেখে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী রে শারমিন তোর শরীর খারাপ নাকি?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু।”

“তাহলে তোর এরকম চেহারা হয়েছে কেমন করে?”

“কী রকম চেহারা?”

“চোখের নিচে কালি? চোখ-মুখ লাল-জ্বর উঠেছে নাকি? কাছে আয় দেখি।”

শারমিন কাছে এলো। লাবণী শারমিনের হাত ধরে দেখল গায়ে জ্বর বরং নেই, শরীরটা আশ্চর্য রকম ঠাণ্ডা।

শারমিন বিড়বিড় করে বলল, “বললাম তো আমার কিছু হয়নি।”

“কিছু হয়নি তাহলে তোকে দেখতে এরকম লাগছে কেন?”

“রাতে ভালো ঘুম হয়নি।”

লাবণী আরও কিছু শোনার জন্যে অপেক্ষা করে কিন্তু শারমিন হঠাৎ চুপ করে গেল, আর কিছু বলল না।

.

ইউনিভার্সিটিতে শারমিন ক্লাসে মন দিতে পারল না। তাদের ক্যালকুলাস ক্লাস নেয় মাত্র পাস করে আসা একজন শিক্ষক, দেখে মনে হয় বাচ্চা ছেলে। এতগুলো ছেলে-মেয়ের সামনে বেচারা একেবারে নার্ভাস হয়ে থাকে, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে এমনভাবে চমকে ওঠে যে দেখে সবাই হেসে কুটি কুটি হয়ে যায়। তবে বেচারা খুব পরিশ্রম করে। ইন্টিগ্রেশন বোঝানোর জন্যে রীতিমতো জান কোরবান করে ফেলে। ক্লাসের পেছন দিকে বসে কয়েকজন মিলে ক্যালকুলাস স্যারকে নিয়ে হাসি-মশকরা করছিল। অন্য যে কোনোদিন হলে শারমিনও তাদের সাথে যোগ দিতো কিন্তু আজকে সে চুপচাপ বসে আছে। ক্যালকুলাস স্যার কোথায় জানি ভুল করে ফেলল এবং সেটা বের করতে গিয়ে স্যার আরো নার্ভাস হয়ে ঘামতে লাগল তখন শারমিন নিচু গলায় পাশে বসে থাকা সাদিবকে ডাকল, “এই সাদিব।”

সাদিব মাথা এগিয়ে বলল, “কী?”

“ব্লাডি মেরি কী সত্যিই কাজ করে?”

“ধুর! সাদিব হাত নেড়ে বলল, “এগুলো ঠাট্টা-তামাশা–”

“ঠাট্টা-তামাশা? তাহলে তুই যে সেদিন বললি–”

সাদিব দাঁত বের করে হাসল, বলল, “ইয়ারকি মারছিলাম।”

“ইয়ারকি মেরেছিস?”

“হ্যাঁ।” সাদিব শারমিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই রেগে উঠছিস কেন? তুই কী যারব কমান্ডার হয়ে গেলি নাকি যে তোর সাথে ইয়ারকি মারতে পারব না।”

“আমি রাগী নাই। কিন্তু তুই আমার সাথে ফিউচারে ইয়ারকি মারবি না।”

সাদিব মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে। মারব না।”

ক্যালকুলাস স্যার তার ভুলটা খুঁজে পেয়েছে, খুব উৎসাহ নিয়ে সেটা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেছে তাই শারমিন চুপ করে গেল।

ক্লাস শেষ হবার পর যখন সবাই ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে আসছে তখন শারমিন সাদিবের শার্টের কোনা টেনে ধরল। সাদিব একটু অবাক হয়ে বলল, “শার্ট ছাড়।”

শারমিন শার্ট ছেড়ে দিয়ে বলল, “সাদিব তুই সত্যি করে বল দেখি এই যে ব্লাডি মেরি-ফেরির কথা বলেছিস এগুলো ইয়ারকি নাকি সত্যি?”

সাদিব মাথা নেড়ে বলল, “আরে বাবা আমি তো ইয়ারকিই জানি।”

“তুই কোথা থেকে এটা শুনেছিস?”

“একটা বইয়ে পড়েছি। ব্ল্যাক আর্ট ফর ইডিয়টস।” সাদিব শারমিনের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? কী জন্যে জিজ্ঞেস করছিস?”

শারমিন ফিসফিস করে বলল, “আমার কাছে ব্লাডি মেরি এসেছে। ঠিক ব্লাডি মেরি না তার মতো একজন।”

সাদিব কয়েক সেকেন্ড শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে ফাঁকা বাঁশের মতো শব্দ করে হা হা করে হাসতে শুরু করল। শারমিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল, হাসিটা শেষ হওয়া মাত্রই সে সাদিবের মুখে একটা ঘুষি মারবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মারতে পারল না কারণ ঠিক তখন লম্বা পা ফেলে কান্তা তার কাছে এসে হাজির হলো, বলল, “শারমিন।

“কী হলো?”

“তোর আব্বু এসেছে।”

শারমিনের মুখটা শক্ত হয়ে যায়। ফিসফিস করে বলল, “ আব্বু না। বল তোর আম্মুর এক্স হাজবেন্ড।”

কান্তা মাথা নেড়ে বলল, “ছিঃ শারমিন এভাবে কথা বলে না। তাড়াতাড়ি যা।”

“কোথায় যাব?”

“ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।”

ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে সাজ্জাদকে দেখে শারমিন হকচকিয়ে গেল, দেখে মনে হচ্ছে সাজ্জাদের বয়স বুঝি দশ বৎসর কমে গেছে। মাথায় কুচকুচে কালো চুল, চোখে দামি সানগ্লাস, পরনে একটু রংচঙে টি-শার্ট, রং ওঠা জিনসের প্যান্ট এবং পায়ে কেডস। শারমিনকে দেখে সাজ্জাদ সানগ্লাসটা খুলে একটু হাসল, বলল, “কী রে বেটি! ভালো আছিস?”

যখন তার আব্বু সামনে থাকে না তখন শারমিন তার ওপর ভয়ংকর রেগে থাকে, কিন্তু যখন সামনাসামনি থাকে তখন সে রেগে থাকতে পারে না। শারমিন চেষ্টা করেও মুখটা কঠিন রাখতে পারল না, হাসি হাসি মুখে বলল, “আব্বু, তোমার বয়স দেখি দশ বৎসর কমে গেছে।

সাজ্জাদ চুলের ভেতর দিয়ে আঙুলগুলো টেনে নিয়ে বলল, “ চুলগুলি ডাই করে ফেললাম। কেমন হয়েছে।”

“ভালো। তোমাকে হ্যান্ডসাম লাগছে।”

“আর হ্যান্ডসাম!” সাজ্জাদ হাসার চেষ্টা করল, “তুই কী ব্যস্ত? ক্লাস আছে নাকি?”

শারমিনের একটা ক্লাস ছিল কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামাল না। বলল, “নাহ! নেই।”

“চল তাহলে লাঞ্চ করি। যাবি কোথাও?”

“কাছাকাছি কোথাও হলে যেতে পারি।”

“আয়। এই কাছেই একটা ফাস্টফুডের দোকান আছে।”

ছোট একটা টেবিলে দুজন সামনাসামনি বসে। কোল্ড ড্রিংকসে চুমুক দিয়ে সাজ্জাদ বলল, “তোর আম্মু কেমন আছে?”

“ভালো।” বলবে না বলবে না করেও জিজ্ঞেস করে ফেলল, “ তোমার ওয়াইফ কেমন আছে?”

সাজ্জাদ চোখ তুলে মেয়ের দিকে একনজর তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “ভালো।”

ঠিক তখন শারমিন লক্ষ করল সাজ্জাদের ডান গালে একটা আঁচড়ের দাগ, প্রায় চোখ পর্যন্ত চলে গেছে। এজন্যে কী কালো সানগ্লাস পরে আছে? প্রায় না বুঝেই সে হাত দিয়ে সাজ্জাদের গালে হাত দিয়ে বলল, “আব্বু তোমার মুখে কী হয়েছে?”

সাজ্জাদ মেয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “কিছু না।”

শারমিন কিছুক্ষণ সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বু। আর ইউ হ্যাপি?”

সাজ্জাদ এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “তোর আম্মুকে তো আমি কোনো টাকা-পয়সা দিতে পারি না। আমার থেকে কিছু নেবে”

“তোমার এতদিনের ওয়াইফ ছিল। তোমার থেকে ভালো করে আর কে আম্মুকে চিনবে?”

সাজ্জাদ আরেকটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মানুষ চেনা এত সহজ নয় শারমিন। সারাজীবন পাশাপাশি থেকেও একজন আরেকজনকে চিনতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ মানুষ নিজেই নিজেকে চিনতে পারে না-আর অন্যকে!”

শারমিন কোনো কথা না বলে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। লাবণীকে ডিভোর্স দিয়ে নীলাকে বিয়ে করে মানুষটা মনে হয় সুখী হতে পারেনি। সুখ জিনিসটা মনে হয় খুব সহজ জিনিস নয়, ধরা দিতে গিয়েও ধরা দেয় না।

সাজ্জাদ হঠাৎ করে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “ শারমিন, তোর মা তো আমার কোনো টাকা-পয়সা নিতে চাচ্ছে না। তুই নিবি?”

“আমি?” শারমিন একটু অবাক হয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকাল।

“হ্যাঁ। তুই। আমি লেখাপড়া করে দিয়ে যাই?”

“দিয়ে কোথায় যাবে?”

“না। যাব আর কোথায়! এটা একটা কথার কথা। যদি হঠাৎ মরেটরে যাই।”

শারমিন শব্দ করে হাসল। বলল, “আব্বু, যত দিন যাচ্ছে তত তোমার বয়স কমছে। তুমি এখন মরেটরে যাবে কেন?”

“এগুলো বাইরের ব্যাপার।” সাজ্জাদ দুর্বলভাবে হাসে, বলে, “ ভেতরে ভেতরে আমি আসলে বুড়ো হয়ে যাচ্ছি।”

“এভাবে বলো না, শুনতে ভালো লাগে না।”

“ঠিক আছে বলব না।” সাজ্জাদ সোজা হয়ে বসে বলল, “ তোর আম্মু রাগ হোক আর যাই হোক আমি আমার প্রপার্টি ভাগাভাগি করে দিয়ে যেতে চাই। তুই আমার মেয়ে, তোকে না দিলে কাকে দেব? তুই তোর আম্মুর সাথে কথা বলিস।”

শারমিন বলল, “বলব আব্বু।”

সাজ্জাদ অন্যমনস্কভাবে তার গালে হাত বুলায়, একটা খামচির দাগ তার গাল থেকে উঠে চোখ পর্যন্ত গিয়েছে। নীলা কি খামচি দিয়ে তার চোখটা তুলে নিতে চাইছে? শারমিন ভেতর ভেতরে একটু শিউরে ওঠে, কী সর্বনাশ।

.

রাত্রিবেলা শারমিন হঠাৎ একধরনের অস্থিরতা অনুভব করে। যতই রাত হতে থাকে ততই তার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অস্থিরতাটুকু কী নিয়ে সে বুঝতে পারছিল না, কিন্তু ঘুমানোর আগে সে দাঁত ব্রাশ করার জন্যে বাথরুমে গিয়েই অস্থিরতার কারণটুকু বুঝতে পারে। সে আবার বাথরুমে আবছা অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গতরাতের মতো প্রেতাত্মাকে ডাকতে চায়। পুরো ব্যাপারটা নিয়ে তার ভেতরে একধরনের অশুভ আশঙ্কা কাজ করছে কিন্তু একই সাথে তার জন্যে একধরনের তীব্র আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে। যারা ড্রাগস খায় তারা মনে হয় তাদের ড্রাগসের জন্যে এরকম একধরনের আকর্ষণ অনুভব করে।

শারমিন নিঃশব্দে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাইট নিভিয়ে দিল। জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো এসে অন্ধকার বাথরুমে একটা আবছা আলো-আঁধারির জন্ম দিয়েছে। শারমিন আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়, হাত নাড়ালে তার প্রতিবিম্বটুকু হাত নাড়ছে, মাথা ঝাঁকালে প্রতিবিম্বটুকু মাথা ঝাঁকাচ্ছে। শারমিন চোখ বন্ধ করে হাত দুটি বুকের কাছে নিয়ে এসে মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বলল, “হে বিদেহী আত্মা, হে পরাজগতের বাসিন্দা, হে অতিপ্রাকৃত প্রাণী তুমি কে আমি জানি না, শুধু জানি তুমি আমাকে দেখা দাও। তুমি এসো। আমি তোমাকে আহ্বান করছি। এসো তুমি এসো। আমি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি।”

বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে শারমিন আচ্ছন্নের মতো হয়ে গেল। তার মনে হতে থাকে সে এক গভীর অন্ধকার জগতে তলিয়ে যাচ্ছে। মনে হতে থাকে সে বুঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, সে বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তখন সে চোখ খুলে তাকাল এবং বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। বাথরুমের চতুষ্কোণ বড় আয়নাটি থেকে হালকা একটা নীল আলো বের হচ্ছে। সেখানে আবছা কুয়াশার মতো এবং সেই কুয়াশার ভেতর থেকে আবছায়ার মতো একটা মূর্তি স্পষ্ট হয়ে আসছে। মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল। শীর্ণ মুখ, কোটরের মাঝে ঢুকে থাকা দুটি চোখ, মুখে বয়সের বলিরেখা। মূর্তিটি ফিসফিস করে বলল, “ আমি এসেছি। আমাকে বের হতে দাও”

শারমিন একটা চিৎকার করে লাইটের সুইচটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আলো জ্বেলে দেয়। মুহূর্তে পুরো বাথরুমটা তীব্র আলোতে ভেসে গেল। কিন্তু শারমিন সেটা দেখতে পেল না। সে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে চিৎকার করতে থাকে।

লাবণী বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ভেতরে ঢুকে আবিষ্কার করল শারমিন বাথরুমের মেঝেতে গুটিশুটি মেরে বসে দুই হাতে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছে।

লাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে শারমিন? কী হয়েছে?”

শারমিন কোনো কথা বলতে পারে না, ভয় পাওয়া গলায় গোঙানোর মতো শব্দ করতে থাকে। লাবণী তাকে ধরে বাথরুম থেকে বের করে আনে, তখনো সে থরথর করে কাঁপছে। লাবণী শারমিনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “কী হয়েছে শারমিন? কথা বল।”

শারমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “সে এসেছে আম্মু। সে এসেছে।”

“কে এসেছে?”

“আমি যাকে ডেকেছিলাম।”

“তুই কাকে ডেকেছিলি?”

“আমি জানি না আম্মু-সে এসেছে। সে বের হতে চাইছে।”

লাবণী কিছু বুঝতে পারছিল না, জিজ্ঞেস করল, “কোথা থেকে বের হতে চাইছে?”

লাবণী অপ্রকৃতিস্থের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আয়নার ভেতর থেকে।

হঠাৎ করে লাবণীর কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই ব্লাডি মেরিকে ডেকেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, “না আম্মু। ব্লাডি মেরি না। অন্য কেউ।”

“সে কে? দেখতে কেমন?”

শারমিন চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস করো না আম্মু। আমার ভয় করে। আমার অনেক ভয় করে।”

.

সে রাতে লাবণী শারমিনকে নিজের বিছানায় নিয়ে ঘুমাল। সারারাত সে শারমিনকে শক্ত করে ধরে রাখল। শারমিন ঘুমের মাঝে ছটফট করে, অস্ফুট গলায় কথা বলে-লাবণী তার কোনো কথা বুঝতে পারে না। সে অবাক হয়ে দেখে তার ঘরটা আশ্চর্য রকম শীতল। শুধু শীতল নয় ঘরে বিচিত্র একধরনের গন্ধ, পুরনো মাটির গন্ধ, শ্যাওলার গন্ধ। লাবণীর বিশ্বাস হতে চায় না কিন্তু তার মনে হয় এ ঘরে অন্য কেউ আছে, যে ফিসফিস করে কথা বলছে, কথাগুলোও যেন বোঝা যায়, মনে হয় যেন বলছে, “আমি এসেছি! আমি এসেছি।”

লাবণী সারারাত শারমিনকে বুকে ধরে রেখে জেগে বসে রইল।

পরদিন শারমিন ঘুম থেকে উঠল বেশ দেরি করে। নাস্তার টেবিলে লাবণী নিজে থেকে গত রাতের বিষয়টা তুলতে চাইছিল না কিন্তু শারমিন কিছু বলতে চাইছে না দেখে শেষ পর্যন্ত লাবণীকে তুলতেই হলো। খুব স্বাভাবিক একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে এরকম ভান করে বলল, “কাল রাতে কী পাগলামো করলি বলবি একটু?”

শারমিন একটু লজ্জা পেয়ে যায়। বলল, “না আম্মু। বলব না।

.

না বললে হবে কেমন করে। বল শুনি।”

“বলতে লজ্জা করছে আম্মু।”

“লজ্জা করলে হবে না। বল শুনি।

শারমিন তখন পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে লাবণী কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল। চিন্তিত মুখে বলল, “দেখ শারমিন আমি কিন্তু বিশ্বাস করি না ভূত-প্রেত বলে কিছু আছে। কিন্তু তুই যেটা বললি সেটার সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে সত্যিই কোনো ভৌতিক প্রাণী এসেছিল—”

শারমিন শুকনো মুখে বলল, “কিন্তু আম্মু তুমি যদি দেখতে তাহলে বুঝতে—”

“আমার দেখার কোনো শখ নেই। জ্যান্ত মানুষের যন্ত্রণাতেই বাঁচি না। এখন যদি ভূতের যন্ত্রণাও সহ্য করতে হয় তাহলে তো মুশকিল।” লাবণী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “তবে একটা জিনিস তোকে বলে রাখি।”

“কী জিনিস?”

“বাথরুমে গিয়ে অন্ধকারে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভূত-প্রেত ব্লাডি মেরিকে ডাকাডাকি বন্ধ। বুঝেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, “বুঝেছি।”

“তুই সত্যিই ভূত-প্রেত ডেকে আনিস আমি সেটা বিশ্বাস করি না কিন্তু সেলফ হিপনোটাইজের মতো কিছু একটা হয়ে তুই যে। আজগুবি জিনিস কল্পনা করতে শুরু করিস সেটা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।”

শারমিন আবার বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আম্মু।”

লাবণী মুখ শক্ত করে বলল, “ইনফ্যাক্ট আগামী কয়েকদিন তোকে আমি একা বাথরুমেই যেতে দেব না।”

শারমিন চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছ তুমি আম্মু?”

“আমি ঠিকই বলছি। তুই গতরাতে যেভাবে ভয় পেয়েছিস সেটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার না। তাছাড়া–”

“তাছাড়া কী?”

লাবণীর হঠাৎ গতরাতের কথা মনে পড়ে যায়। কনকনে ঠাণ্ডা ঘরে পচা ভেজা মাটির এবং শ্যাওলার মতো একধরনের গন্ধ, বিচিত্র একধরনের ফিসফিস শব্দ, মনে হচ্ছে কেউ একজন নিঃশব্দে ঘরের মাঝে হাঁটছে, তার মাঝে সারারাত সে শারমিনকে বুকে চেপে ধরে জেগে বসে আছে।

শারমিন আবার জিজ্ঞেস করল, “তাছাড়া কী আম্মু?”

লাবণী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিছু না।”

.

বিকেলে লাবণী একটা বইয়ের প্যাকেট নিয়ে বাসায় ঢুকল। শারমিন জিজ্ঞেস করল, “কী বই কিনেছ আম্মু?”।

লাবণী একটা ইতস্তত করে বলল, “বই কী কেনার উপায় আছে নাকি! বইয়ের কী দাম জানিস?”

“তবুও তো কিনে ফেলেছ?”

“হ্যাঁ। কিনলাম, ব্ল্যাক আর্টের ওপর দুইটা। আরেকটা প্রেতচর্চার ওপর ইন্ডিয়ান বই।”

শারমিন হেসে ফেলল, বলল, “কী আশ্চর্য আমিও আজকেই সাদিবের কাছ থেকে তার ব্ল্যাক আর্টের বইগুলো নিয়ে এসেছি।”

“দেখি তোর বইগুলো!”

দুজনই তখন তাদের বইগুলো নিয়ে আসে। টেবিলে রেখে ওলটপালট করে দেখে। লাবণী অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “কী আশ্চর্য একটা ব্যাপার! এরকম উদ্ভট একটা বিষয়ের ওপর কতগুলো মানুষ কতগুলো বই লিখে ফেলেছে দেখেছিস?”

শারমিন বলল, “এখন তুমি এটাকে উদ্ভট বলছ কেন? কয়দিন আগেই না তুমি আমাকে বোঝাচ্ছিলে এগুলো বিশ্বাস করলে আইনস্টাইন হওয়া যায়!” লাবণী রেগে গিয়ে বলল, “ ফাজলেমি করবি না। আমি মোটেও সেটা বলিনি। সন্ধ্যেবেলা দেখা গেল সোফায় হেলান দিয়ে দুজনেই খুব মনোযোগ দিয়ে ব্ল্যাক আর্টের ওপর বই পড়ছে। রাত্রিবেলা অবস্থার একটু পরিবর্তন হলো। হঠাৎ করে দেখা গেল শারমিনের ভেতর একটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তার চোখ-মুখ কেমন যেন লালচে হয়ে গেল এবং সে হঠাৎ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল। দেখে মনে হচ্ছে তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লাবণী একটু অবাক হয়ে বলল, “ তোর কী হয়েছে? শারমিন, তুই এরকম ছটফট করছিস কেন?” শারমিন উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে বলল, “জানি না আম্মু। কেমন যেন অস্থির লাগছে।”

“অস্থির লাগছে মানে কী?”

“মানে ঠিক জানি না। শুধু মনে হচ্ছে-মনে হচ্ছে–”

“শুধু-কী মনে হচ্ছে?”

শারমিন মাথায় চুলগুলো ভেতর আঙুল দিয়ে ঘষতে ঘষতে বলল, “মনে হচ্ছে কিছু একটা করতে হবে”

লাবণী তীক্ষ্ণ চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে শীতল গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কী করতে হবে?”

“একজনকে ডাকতে হবে।”

লাবণী কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর জিজ্ঞেস করল, “আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে ডাকতে চাস?”

শারমিনের মুখে অপরাধবোধের একটা ছাপ পড়ল। মাথা নেড়ে বলল, “হা আম্মু।”

লাবণী উঠে গিয়ে শারমিনের হাত ধরে টেনে এনে সোফায় তার নিজের পাশে বসাল, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমি জানি

তোর কী হয়েছে শারমিন। তবে যেটাই হয়ে থাক সেটা থেকে তোর বের হয়ে আসতে হবে। বুঝেছিস?”

শারমিন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ বুঝেছি।”

“আজ সারারাত আমি তোর সাথে থাকব। তোকে আমি এক সেকেন্ডের জন্যে ছাড়ব না। বাথরুমে গেলেও না।

শারমিন দুর্বলভাবে একটু হাসার চেষ্টা করল। লাবণী দেখল তার ঠোঁটগুলো কেমন যেন কালচে দেখাচ্ছে, মনে হচ্ছে চোখ দুটো গর্তে ঢুকে গেছে এবং সেখান থেকে জ্বলজ্বল করছে। চুলগুলো এলোমেলো এবং চেহারার মাঝে একধরনের অপ্রকৃতিস্থ ভাব। লাবণী শারমিনের হাত ধরে বলল, “আয় ঘুমাবি।”

শারমিন বলল, “আমার ঘুম পাচ্ছে না আম্মু।”

“ঘুম না পেলেও ঘুমাতে হবে। তোকে একটা সিডেটিভ দিয়ে দিই, খেয়ে মড়ার মতো ঘুমাবি।”

শারমিন আপত্তি করল না। একটা সিডেটিভ খেয়ে লাবণীর বিছানায় লাবণীর পাশে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ বিছানায় ছটফট করে শারমিন একসময় শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। লাবণী আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, যখন দেখল শারমিনের নিঃশ্বাস ঘুমন্ত মানুষের মতো নিয়মিতভাবে পড়ছে তখন সে বিছানা থেকে উঠে বাসার সব কয়টা বাথরুমের দরজায় তালা মেরে দিল। রাত্রে ঘুমের মাঝে উঠেও শারমিন যেন গিয়ে নতুন কোনো পাগলামি করে ফেলতে না পারে। লাবণী তার বইগুলো নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে। এক হাতে শারমিনকে ধরে রেখে অন্য হাত দিয়ে বইটা কোলের ওপর রেখে পড়তে শুরু করে। ব্ল্যাক আর্ট, শয়তানের উপাসনা এবং প্রেতচর্চা নিয়ে যে পৃথিবীতে এত কিছু ঘটে গেছে সেটা সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। বইয়ে এমনভাবে লেখা আছে যেন সত্যিই পৃথিবীতে অলৌকিক জিনিস আছে, যেন সত্যিই ভূত-প্রেত আছে, তারা মানুষের কাছে আসতে পারে, মানুষকে বশ করতে পারে। বইগুলো পড়তে পড়তে লাবণী এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।

গভীররাতে শারমিন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। লাবণী বলেছিল তাকে যে সিডেটিভ খাওয়ানো হয়েছে আগামীকাল ভোরের আগে তার ঘুম ভাঙবে না, কিন্তু তার ঘুম ভেঙে গেল কেন সে বুঝতে পারল না। শারমিনের মনে হলো তাকে কেউ ডেকেছে-কিন্তু কে ডাকতে পারে? তার আম্মু এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুচ্ছে, বুকের ওপর একটা বই। শারমিন তার শরীর থেকে লাবণীর হাতটা সরিয়ে উঠে বসল। তাকে কিছু একটা করতে হবে কিন্তু সেটা কী সে মনে করতে পারল না। কেউ একজন তার জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে তার ডাকতে হবে, পুরো ব্যাপারটি অত্যন্ত ভয়ংকর। অত্যন্ত অশুভ কিন্তু তার কিছু করার নেই। তাকে যেতেই হবে। শারমিন সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এলো, তার আম্মু ঘুমাচ্ছে কিছু টের পেল না।

শারমিন বাথরুমের দরজায় হাত দিয়ে দেখে সেটা তালা মেরে বন্ধ করে রাখা। হঠাৎ করে সে নিজের ভেতরে একধরনের ক্রোধ অনুভব করে, অত্যন্ত বিচিত্র একধরনের বিজাতীয় ক্রোধ। ক্রোধটা কার ওপরে সে বুঝতে পারে না, কিন্তু তার হঠাৎ করে সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করে, তার মনে হতে থাকে ইচ্ছে করলেই সে বুঝি সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে পারবে। শারমিন তখনই শোয়ার ঘরে ফিরে আসে। তার আম্মু বিছানায় শুয়ে আছে, মাথার কাছে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে, বুকের ওপর একটা বই খোলা। শারমিন মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই ড্রেসিং টেবিলটা চোখে পড়ল, সেখানে একটা বড় আয়না। হঠাৎ শারমিনের চোখগুলো চকচক করে ওঠে, সে পায়ে পায়ে ড্রেসিং টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল, কী আশ্চর্য! তাকে দেখতে একটা অপরিচিত মেয়ের মতো মনে হচ্ছে। সে স্থির দৃষ্টিতে নিজের দিকে তাকায়।

ঠিক তার কানের কাছে ফিসফিস করে কে যেন বলল, “ আমি এসেছি! আমি এসেছি।”

শারমিনের হঠাৎ মনে হলো ঘরের ভেতর একটা দমকা বাতাস তাকে ঝাঁপটা দিয়ে গেল, হিমশীতল বাতাসে তার সারা শরীর কেঁপে ওঠে। কিছু একটা ঘটবে এখন, কী ঘটবে সে বুঝতে পারছে না। শারমিন আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে দেখে তার চুলগুলো ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। মুখের চামড়ায় বয়সের বলিরেখা দেখা দেয়, চোখগুলো কুঠুরিতে ঢুকে গিয়ে সেগুলো ধকধক করে জ্বলতে শুরু করে। শারমিন দেখল গোলাপি ফুলফুল ঘুমের পোশাকে ছোপছোপ রক্তের ছাপ পড়েছে। শারমিন তার হাতটা ওপরে তুলল-আয়নায় দেখা যায় সেটি কংকালসার শীর্ণ, হাত সেখান থেকে নখ বাঁকা হয়ে বের আছে। শারমিন স্থির চোখে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটগুলো ঝুলে পড়ছে, ধারালো দাঁত বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। দাঁতের ফাঁক থেকে একটা লাল লকলকে জিব উঁকি দিয়ে ওঠে। চাপা একটু দুর্গন্ধ শারমিনের নাকে ভক করে এসে ধাক্কা দেয়, পচা মাংসের সেই দুর্গন্ধে হঠাৎ করে শারমিনের সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।

আয়নার সেই ভয়ংকর ছায়ামূর্তি শারমিনের দিকে তাকিয়ে হাসল, সেই ভয়ংকর হাসি দেখে শারমিনের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে। সে ভয়ংকর আতঙ্কে সেই ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে, খুব ধীরে ধীরে সে আয়নার ভেতর থেকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে, ঠিক আয়নার সামনে এসে আর বের হতে পারে না। তখন সে ফিসফিস করে শারমিনকে ডাকে, খসখসে চাপা গলায় বলল, “আমি এসেছি! আমাকে বের হতে দাও।”

শারমিন ভয়ানক আতঙ্কে ছুটে যেতে চায়। কিন্তু তার পা মনে হয় মেঝেতে গেঁথে গেছে সে এখান থেকে নড়তে পারছে না, অবর্ণনীয় একটা আতঙ্কে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে। ছায়ামূর্তিটি আবার শারমিনকে ডাকে, “কাছে এসো! আমাকে স্পর্শ করো। আমাকে বের হতে দাও।”

শারমিনের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে সেটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

শারমিনের মুখ হঠাৎ বিকৃত হয়ে ওঠে, তার চোখ ফেটে পানি বের হয়ে আসে। ছায়ামূর্তিটি ফিসফিস করে তাকে ডাকে, “এসো। এসো আমার কাছে। আমাকে ছোও-মাত্র একটিবার-”

শারমিন কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে যায়। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে তার কিছুতেই আয়নাটি স্পর্শ করা উচিত না। স্পর্শ করলেই খুব ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। কিন্তু সে বুঝতে পারে তাকে আয়নাটা স্পর্শ করতে হবে। অসহায়ের মতো সে হাত তুলে আয়নাটা স্পর্শ করে, সাথে সাথে হঠাৎ পুরো আয়নাটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। বিস্ফারিত চোখে শারমিন দেখল আয়নার ভেতর থেকে কুৎসিত একাটা প্রাণী বের হয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শারমিন চিৎকার করে নিচে পড়ে যায়, তার বুকের ওপর বসে সেই কুৎসিত প্রাণীটি তার লাল জিব বের করে শারমিনের মুখের দিকে এগিয়ে আসে, ধারালো দাঁত বসিয়ে দেয় তার কাঁধে। ভয়ংকর আতঙ্কে শারমিন চিৎকার করতে থাকে, কিছুতেই সে আর থামতে পারে না। মনে হয় চিৎকারে তার গলার মাংসপেশি ছিঁড়ে গলগল করে রক্ত বের হয়ে যাবে কিন্তু তবুও সে থামতে পারে না।

শারমিনের চিৎকার শুনে লাবণী লাফিয়ে বিছানা থেকে উঠল, বিস্ফারিত চোখে দেখল শারমিন মেঝেতে শুয়ে দুই হাতে অদৃশ্য কোনো একটা প্রাণীকে তার বুকের ওপর থেকে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছে। সারা ঘরে ভাঙা আয়নার কাঁচ, সেই কাঁচের আঘাতে শারমিনের হাত-পা-মুখ কেটে গেছে, সেখান থেকে রক্ত ঝরে দেখতে দেখতে তার ঘুমের কাপড়ে ছোপছোপ লাল রং লেগে যাচ্ছে না।

লাবণী ছুটে এসে শারমিনের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়, চিংকার কের ডাকতে থাকে, “শারমিন, এই শারমিন।”

শারমিনের শরীর থরথর করে কাঁপছে, তার মাঝে সে চোখ খুলে লাবণীর দিকে তাকাল, অপ্রকৃতিস্থ সেই চোখের দৃষ্টি দেখে হঠাৎ লাবণীর বুক কেঁপে ওঠে। ভয় পাওয়া গলায় সে আবার ডাকল, “শারমিন।”

শারমিনের মুখটা অল্প একটু খুলে যায়, সে ফিসফিস করে স্পষ্ট গলায় বলল, “আমি শারমিন না।”

লাবণী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “তুমি কে?”

শারমিন তীব্র দৃষ্টিতে লাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “ আমি কাফ্রীদা।”

তারপর অমানুষিক গলায় খলখল করে হাসতে শুরু করল।

সেই হাসির শব্দ শুনে হঠাৎ করে লাবণীর সমস্ত শরীর শীতল হয়ে যায়।

.

টেলিফোনের শব্দে সাজ্জাদের ঘুম ভেঙে যায়। সে বালিশের নিচে থেকে তার ঘড়ি বের করে দেখল, রাত একটা তিরিশ মিনিট। এত রাতে তাকে কে ফোন করবে?

পাশে শুয়ে থাকা নীলা ঘুমঘুম গলায় বলল, “ফোনটা ধরো না প্লিজ।” সাজ্জাদ বিছানা থেকে নেমে বাইরের ঘরে গিয়ে ফোন ধরল, বলল, “হ্যালো।”

অন্যপাশ থেকে একটা নারীকণ্ঠ শুনতে পায়, “সাজ্জাদ?”

“হ্যাঁ, সাজ্জাদ কথা বলছি।”

“আমি লাবণী।”

সাজ্জাদ সাথে সাথে সোজা হয়ে বসে। তার নীলার সাথে একটা সম্পর্ক আছে জানার পর থেকে লাবণী একটিবারও তার সাথে কথা বলেনি। আজ এই প্রথমবার। এই গভীর রাতে। হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় সাজ্জাদের বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “‘কী হয়েছে লাবণী?”

“শারমিনের খুব বড় বিপদ। তুমি একটু আসবে?”

“কী হয়েছে শারমিনের?”

টেলিফোনের অন্যপাশে লাবণী কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “আমি জানি না। হিস্টিরিয়ার মতো অবস্থা, ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে সারা শরীর কেটেকুটে গেছে কিন্তু সেটা ইম্পরট্যান্ট না।”

“তাহলে কোনটা ইম্পরট্যান্ট।”

“তাকে ধরে বেঁধে রাখা যাচ্ছে না। চিৎকার করছে, ছটফট করছে আর বলছে-” লাবণী হঠাৎ থেমে গেল।

“সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, কী বলছে?”

“বলছে সে শারমিন না। সে অন্য কেউ।”

সাজ্জাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। মাত্র গতকাল শারমিনকে নিয়ে সে ফাস্টফুডের দোকানে গিয়েছে, একসাথে খেয়েছে, গল্প করেছে। হঠাৎ করে তার বুকের ভেতরটা কেমন জানি ওলটপালট হয়ে যায়। শারমিন! তার আদরের শারমিনের কী হয়েছে এটা? সাজ্জাদ বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “লাবণী। আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি।”

“থ্যাংক ইউ সাজ্জাদ।” হঠাৎ লাবণীর গলা ভেঙে যায়, “ আমার খুব ভয় করছে।”

সাজ্জাদ যখন বেডরুমে ফিরে এলো তখন বিছানা থেকে নীলা ঘুমঘুম গলায় বলল, “কে ছিল?”

“লাবণী।”

নীলার কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে লাবণী মানুষটা কে। যখন বুঝতে পারল তখন সে প্রায় লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। তীক্ষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল, “লাবণী?”

“হ্যাঁ।”

“এত রাতে? এত রাতে কেন ফোন করেছে?”

“শারমিনের কিছু একটা হয়েছে।”

“কী হয়েছে?”

“ঠিক বুঝতে পারছে না।”

“বুঝতে না পারলে তোমাকে ফোন করেছে কেন? হাসপাতালে নিয়ে যায় না কেন?”

সাজ্জাদ নীলার দিকে তাকিয়ে রইল, হঠাৎ করে তার কথা বলার ইচ্ছে করল না। সে স্টিলের আলমারি খুলে একটা প্যান্ট বের করে। নীলা হঠাৎ করে যেন খেপে যায়, চিৎকার করে বলল, “ তুমি কী করছ?”

“কাপড় পরছি।”

“কেন?”

“শারমিনকে দেখতে যাব।”

“এত রাতে?”

“হ্যাঁ।”

“এত রাতে কেন যেতে হবে? কাল সকালে কেন যাও না?”

সাজ্জাদ শান্ত গলায় বলল, “কারণ বিপদটা কাল সকালে হয়নি। বিপদটা হয়েছে এখন। এত রাতে।”

“এত রাতে ড্রাইভার নেই তুমি কেমন করে যাবে?”

“আমি ড্রাইভিং জানি। আমার ড্রাইভারস লাইসেন্স আছে।”

নীলা হঠাৎ মশারি থেকে বের হয়ে এলো, তাকে কেমন যেন খ্যাপা একটা বাঘিনীর মতো দেখাচ্ছে, সে হিংস্র গলায় বলল, “তুমি এখন যেতে পারবে না।”

সাজ্জাদ খানিকটা অবাক এবং অনেকখানি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি এখন যেতে পারব না?”

“না। আমাকে একা রেখে তুমি যেতে পারবে না।”

“একা রেখে? বাসায় দুজন কাজের মানুষ-গেটে দারোয়ান”

“আই ডোন্ট কেয়ার। তুমি আমাকে বিয়ে করেছিলে কী মাঝরাতে এক্স-ওয়াইফের কাছে যাবার জন্যে?”।

সাজ্জাদ অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, “আমি মাঝরাতে আমার এক্স-ওয়াইফের কাছে যাচ্ছি না, আমি আমার অসুস্থ মেয়ের কাছে যাচ্ছি।”

“তোমার মেয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেল? আর সাথে সাথে তোমার ওয়াইফ তোমাকে ফোন করল? এত প্রেম কবে থেকে হয়েছে?”

সাজ্জাদ শীতল চোখে বললে, “দেখো নীলা, তুমি এভাবে কথা বলবে না।”

নীলা হঙ্কার দিয়ে বলল, “কী? তোমার এত বড় সাহস? তুমি আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলো?”

“আমি তোমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলিনি। আমি তোমাকে বলছি যে আমার মেয়ে অসুস্থ—”

“তোমার মেয়েই তোমার সব? দিন নেই রাত নেই শুধু মেয়ে মেয়ে মেয়ে–আমি কী বানের জলে ভেসে এসেছি?”

সাজ্জাদ বুঝতে পারল নীলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই। যত দিন যাচ্ছে এ মেয়েটি যেন ততই অবুঝ এবং মেজাজি হয়ে উঠছে। ছোট একটা বিষয়কে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে একটা বিশাল ব্যাপারে পাল্টে দেয়, মাঝে মাঝে সাজ্জাদের কাছে অসহ্য মনে হয়। সে নীলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করল না, তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নিয়ে মানিব্যাগ আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। সারাক্ষণ নীলা রাগে ফুঁসছে এবং অর্থহীন কথা বলছে, ঠিক যখন সাজ্জাদ দরজা খুলে বের হবে তখন খপ করে তার বুকের কাপড় খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, “না, তুমি যেতে পারবে না।”

সাজ্জাদ থমথমে গলায় বলল, “কাপড় ছাড় নীলা।”

নীলা চিৎকার করে বলল, “ছাড়ব না আমি ছাড়ব না। তুমি কী করবে?”

হঠাৎ সাজ্জাদের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে শক্ত হাতে নীলার হাত ধরে নিজেকে মুক্ত করে একটা ধাক্কা দিয়ে তাকে সরিয়ে দিল। তাল সামলাতে না পেরে নীলা বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেখান থেকে ঝট করে উঠে বসে হিংস্র চোখে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আমার গায়ে হাত তুলেছ? তুমি জানো আমি প্রেগনেন্ট? তুমি জানো আমার পেটে বাচ্চা?”

সাজ্জাদ একেবারে হকচকিয়ে গেল। অবাক হয়ে বলল, “তুমি প্রেগনেন্ট?”

“হ্যাঁ। তুমি তোমার প্রেগনেন্ট বউয়ের গায়ে হাত তুলেছ?”

“তুমি প্রেগনেন্ট সেটা আমাকে কখনো বলোনি কেন?”

নীলা চিৎকার করে বলল, “আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ, দিয়েছ সুযোগ?”

“সুযোগ?” সাজ্জাদ অবাক হয়ে নীলার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। নীলা। আমি এটা নিয়ে তোমার সাথে পরে কথা বলব। এখন আমি যাই–আমার মেয়ে অসুস্থ-”

নীলা চিৎকার করে বলল, “তোমার অসুস্থ মেয়ে যেন কোনোদিন সুস্থ না হয়। সে যেন মুখে রক্ত উঠে মারা যায়।”

সাজ্জাদের মাথার মাঝে একটা বিস্ফোরণ হলো, তার মনে হলো সে গিয়ে নীলার টুটি চেপে ধরবে, কিন্তু সে কিছু করল না, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

লাবণী দরজা খুলে একটু সরে দাঁড়ায়-সাজ্জাদ ভেতরে ঢুকে লাবণীর দিকে তাকাল। গত দুই বৎসর এই প্রথম তারা একজন আরেকজনের সামনাসামনি দাঁড়িয়েছে, অন্য যে কোনো সময় হলে এরকম একটি মুহূর্ত হতো অত্যন্ত অস্বস্তিকর মুহূর্ত, কে কী নিয়ে কথা বলবে তারা বুঝতে পারত না। কিন্তু এখন সেরকম কিছু হলো না। সাজ্জাদ শুকনো গলায় বলল, “কেমন আছে শারমিন?”

আগের মতো। ভয়ানক চেঁচামেচি করছে। দেখে মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। হঠাৎ করে লাবণীর গলা ভেঙে যায়, কাতর গলায় বলল, “আমার খুব ভয় করছে সাজ্জাদ।”

সাজ্জাদ লাবণীর পিঠে হাত রেখে বলল, “ভয় কী লাবণী। সব ঠিক হয়ে যাবে। কী হয়েছে আগে বলো।”

লাবণী ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, সবকিছু শুনে সাজ্জাদ হতবাক হয়ে মাথা নেড়ে বলল, “আমি বিশ্বাস করি না।”

লাবণী মাথা নেড়ে বলল, “আমিও বিশ্বাস করি না। কিন্তু যেটা ঘটেছে তোমাকে সেটাই বলেছি।”

সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করছে শারমিন?”

“বিছানায় বসে আছে। কেউ কাছে এলেই ভয়ংকর চেঁচামেচি শুরু করে।”

“চলো গিয়ে একটু দেখি।”

শারমিন বিছানায় হাঁটুর ওপর মুখ রেখে বসে ছিল। ঘরটা অসম্ভব শীতল এবং বাতাসে একধরনের দূষিত গন্ধ। ঘরের বাতি নেভানো, পাশের ঘর থেকে যা একটু আলো এসে পড়েছে তাতেই আবছা দেখা যাচ্ছে। সাজ্জাদ লাবণীকে বলল, “একটু লাইট জ্বালাও।”

লাবণী ফিসফিস করে বলল, “জ্বালাচ্ছি। খুব চিৎকার করবে কিন্তু।”

“করুক।”

লাবণী সুইচ টিপে আলো জ্বালাতেই শারমিন দুই হাতে মুখ ঢেকে জান্তব গলায় চিৎকার করতে থাকে। তার মুখে কাটা দাগ, শরীরের নানা জায়গায় রক্তের ছোপ, এলোমেলো চুল এবং চোখেমুখে অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ছাপ। সাজ্জাদ এগিয়ে গিয়ে শারমিনের কাছে দাঁড়িয়ে বলল, “শারমিন। মা আমার।”

শারমিন চিৎকার করে বলল, “মড়াখোগা জানোয়ার। আমার কাছে আসবি না। খবরদার।”

সাজ্জাদ বলল, “ছিঃ মা। ছিঃ। এভাবে কথা বলে না।”

“কাছে আসবি না তুই। খবরদার। খুন করে ফেলব তোকে।”

সাজ্জাদ অনুনয় করে বলল, “শারমিন। শোন মা। একটু শান্ত হ। প্লিজ। শারমিন”

শারমিন দুই দিকে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “আমি শারমিন না। না-না-না—”

“তুই তাহলে কে?”

“আমি কাফ্রীদা। কা-ফ-রি-দা!” তারপর সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে খলখল করে হাসতে থাকে। শারমিনের চোখের দৃষ্টি দেখে সাজ্জাদ হতভম্ব হয়ে যায়। দেখে মনে হয় না এটি মানুষের দৃষ্টি।

সাজ্জাদ একটু এগিয়ে গিয়ে শারমিনকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতেই শারমিন বন্য পশুর মতো জান্তব একটা শব্দ করে। সাজ্জাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, সাজ্জাদ প্রস্তুত ছিল না, সে পা বেধে নিচে পড়ে গেল। হিংস্র হায়েনা যেভাবে আক্রমণ করে অনেকটা সেভাবে শারমিন সাজ্জাদকে কামড়ানোর চেষ্টা করতে থাকে। লাবণী ব্যাপারটা দেখেছে সে প্রস্তুত ছিল, ছুটে এসে কোনোভাবে সে শারমিনকে টেনে সরিয়ে নেয়। তার ফলটা হয় আরো ভয়ানক, শারমিন দেওয়ালে মাথা কুটে জান্তব একধরনের শব্দ করতে থাকে, দেখতে দেখতে তার চোখ-মুখ রক্তাক্ত হয়ে যায়।

সাজ্জাদ একধরনের অসহায় আতঙ্ক নিয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, এখনও সে পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছে বিড়বিড় করে বলল, “মেডিক্যাল হেল্প দরকার। এক্ষুনি মেডিক্যাল হেল্প দরকার।”

লাবণী মাথা নাড়ল, জিজ্ঞেস করল, “হাসপাতালে নেবে?”

“এভাবে হাসপাতালে নেবে কেমন করে? একজন ডাক্তারকে ডাকি। এসে আগে ট্রাংকোয়ালাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিক।”

লাবণী মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

সাজ্জাদের স্কুলজীবনের বন্ধু, ড. আরশাদ এখন মেডিক্যাল কলেজে নিউরলজির হেড। তাকে সে যখন খুশি ফোন করতে পারে, রাত দুটোর সময়েও। সাজ্জাদ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল, টেলিফোনে যতটুকু সম্ভব ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল এবং ড. আরশাদ প্রায় সাথে সাথেই রওনা দিয়ে দিল। এত রাতে রাস্তাঘাটে একেবারে ভিড় নেই, যে পথটুকু আসতে দিনের বেলা এক ঘণ্টা থেকেও বেশি লেগে যায় ড. আরশাদ বিশ মিনিট থেকে কম সময়ে সেটুকু চলে এলো।

ড্রয়িংরুমে সাজ্জাদ আর লাবণী ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেয় এবং ড. আরশাদ গম্ভীর মুখে পুরোটুকু শুনে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আই হোপ তোরা এটাকে সুপার ন্যাচারাল কিছু ভেবে বসিসনি।”

সাজ্জাদ আর লাবণী দুজনেই দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নাড়ল। লাবণী বলল, “না আমি ভাবতে চাই না।”

ড. আরশাদ বলল, “মানুষের মস্তিষ্ক যে কোনো সুপার ন্যাচারাল ফেনোমেনোন থেকে বেশি চমকপ্রদ। কোনো একটা জিনিস তাকে খুব ডিস্টার্ব করছে। তার বয়স কত?”

“আঠারো।”

“খুব সেনসিটিভ বয়স।” ড. আরশাদ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের জানা মতে কোনো ড্রাগের সমস্যা আছে?”

লাবণী মাথা নাড়ল, “না নেই।”

“কোনো এফেয়ার?”

লাবণী আবার বলল, “সেরকম কিছু নেই। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক ফ্রি, ছেলে বন্ধু মেয়ে বন্ধু আছে। কিন্তু মনে হয় না কোনো রিলেশনশিপ আছে।”

“শিওর?”

“শিওর। মেয়ে আমার সাথে খুব ফ্রি।”

“আপনাদের ফেমিলিতে কারো মানসিক সমস্যা আছে?”

দুজনেই মাথা নড়ল, “না নেই।”

“আগে কখনো এ ধরনের কোনো কিছু করেছে?”

“না করেনি।”

“ইদানীং কোনো ঘটনা কী খুব এফেক্ট করেছে?”

লাবণী সাজ্জাদের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “আপনি হয়তো জানেন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। সেই ঘটনা তাকে এফেক্ট করেছিল। কিন্তু তারপর দুই বছর হয়ে গেছে। সে বেশ মেনে নিয়েছে।”

“মাথায় কী কখনো কোনো রকম ব্যথা পেয়েছে?”

“না, পায়নি।”

“মাথাব্যথা বা এধরনের কোনো রকম কমপ্লেন করেছে?”

“না করেনি।”

“ঘুম হয় না এ ধরনের কোনো কোনো কমপ্লেন করেছে?”

“না, করেনি।”

“জেনারেল হেলথ কেমন?”

“ভালো। বেশ ভালো।”

ড. আরশাদ চিন্তিত মুখে খানিকক্ষণ মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আপনার মেয়েকে একটু দেখি।”

“আসুন।”

ঘরে ঢোকামাত্রই শারমিন অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করতে শুরু করল। শারমিন যে এ ধরনের গালাগাল জানে লাবণী সেটা জানতোই না। ড, আরশাদ খুব বিচলিত হলো না। বেশ সহজভাবে কাছে গিয়ে শারমিনের হাত ধরল, শারমিন ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করল কিন্তু ড, আরশাদ তাকে ছাড়ল না। শারমিন ছটফট করতে শুরু করতেই লাবণী আর সাজ্জাদ দুপাশ থেকে তাকে শক্ত করে ধরে ফেলল। ড. আরশাদ তার পালস দেখল, ব্লাড প্রেশার মাপল, চোখের মণি দেখল, জিবের রং দেখল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এখন একটা ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

সাজ্জাদ আর লাবণী দুজনেই মাথা নাড়ল। ড, আরশাদ বলল, “কাল ভোরে ওকে একটা ক্লিনিকে ট্রান্সফার করা যাক।”

সাজ্জাদ বলল, “ঠিক আছে।”

“আমি অ্যাম্বুলেন্স আর স্টাফ পাঠিয়ে দেব।”

সাজ্জাদ আবার বলল, “ঠিক আছে।”

ড. আরশাদ ইনজেকশন বের করতে গিয়ে থেমে গিয়ে লাবণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবী, আপনি বলেছিলেন শারমিন আয়নাতে কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছিল?”

“হ্যাঁ।” আপনাদের বাসায় কী বড় আয়না আছে?”

“কেন?”

“একটা জিনিস একটু ট্রাই করতাম। যেহেতু আয়নায় কিছু একটা দেখে ভয় পেয়েছে, তাই সামনে বড় আয়না রেখে যদি দেখানো যেত এটা হার্মলেস, হয়তো সে পুরোটা রিকভার করে ফেলত।”

কিন্তু লাবণী ইতস্তত করে বলল, “যদি উল্টো আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়? যদি অন্য কিছু ঘটে যায়?”

ড. আরশাদ দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, “এখন যে স্টেজে আছে তার থেকে বেশি আর কী হবে? দেখি চেষ্টা করে। সিমিলার একটা কেসে একবার পেশেন্ট পুরোপুরি রিকভার করেছিল। আছে বড় আয়না?”

লাবণী বলল, “ড্রেসিং টেবিলে যেটা ছিল সেটা তো ভেঙে ফেলেছে। বাথরুমে ফুল লেংথ আয়না আছে, কিন্তু সেটা তো দেওয়ালে লাগানো।”

সাজ্জাদ বলল, “ক্রু ড্রাইভার আছে? ক্লিপ দিয়ে লাগানো থাকে, খুলে আনা যাবে।”

ভ্রু ড্রাইভার খুঁজে পাওয়া গেল না বলে রান্নাঘর থেকে একটা চাকু এনে সাজ্জাদ বাথরুম থেকে বড় একটা আয়না খুলে আনল। ড. আরশাদ সেটা শারমিনের সামনে ধরে বলল, “শারমিন। এদিকে তাকাও। তাকাও এদিকে।”

শারমিন তাকাল না। মাথা সরিয়ে চিৎকার করতে লাগল। ড. আরশাদ বলল, “তাকাও। তাকাও আয়নার দিকে।”

শারমিন তাকাল না। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। মুখ ঢেকে চিৎকার করতে লাগল। ড. আরশাদ বলল, “থাকুক।”

আয়নাটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে ড. আরশাদ তার ব্যাগ হাতে নেয়। ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে একটু ছোট কাঁচের অ্যাম্পুল থেকে ঘুমের ওষুধ সিরিঞ্জে ভরে শারমিনের দিকে এগিয়ে গেল। সাজ্জাদ আর লাবণী দুই পাশ থেকে শারমিনকে ধরে রাখল। ড. আরশাদ তখন তার হাতে ইনজেকশনটি দিয়ে দেয়।

ইনজেকশনের প্রায় সাথে সাথেই শারমিন খানিকটা নির্জীব হয়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে শুয়ে থাকে। ড. আরশাদ খানিকক্ষণ শারমিনকে লক্ষ করল। তারপর বলল, “কিছুক্ষণেই এখন ঘুমিয়ে যাবে। ঘুম সহজে ভাঙবে না। একেবারে দুপুর পর্যন্ত ঘুমানোর কথা। আমরা সকালে ক্লিনিকে নিয়ে যাব।

সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “থ্যাংকস আরশাদ। তুই না থাকলে যে আমি কী করতাম আমি জানি না।”

“তোরা চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন একটু বিশ্রাম নে।”

ড. আরশাদ চলে যাবার পর দুজন আবার শারমিনের ঘরে ফিরে এলো। তাদের পায়ের শব্দ শুনে শারমিন চোখ খুলে তাকায়, আরশাদ বলেছিল ঘুমিয়ে যাবে কিন্তু শারমিন এখনো ঘুমায়নি। সাজ্জাদ কাছে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় তার পাশে বসল, অন্যবার যেরকম চিৎকার করে গালাগাল শুরু করে দিত এবার সেরকম কিছু করল না। সাজ্জাদ তার মাথায় হাত রাখল, শারমিন দুর্বলভাবে হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল। সাজ্জাদ ভালো করে শুনতে না পেয়ে মাথাটা আরেকটু এগিয়ে দিয়ে বলল, “কী বললি, শারমিন?”

“পারবি না। তোরা পারবি না।”

“কী পারব না?”

“এই মেয়েটাকে বাঁচাতে পারবি না। আমি এই মেয়েটাকে নিব।”

সাজ্জাদ বলল, “ছিঃ এইভাবে কথা বলে না শারমিন।”

“তোর বউ ঠিক কথাই বলেছে।”

সাজ্জাদ চমকে উঠে শারমিনের দিকে তাকাল, শারমিনের মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে, ফিসফিস করে বলে, “তোর মেয়ে মুখে রক্ত উঠে মরবে। মরবেই মরবে।”

“কী বলছিস তুই।”

শারমিনের মুখে হাসিটা আরও বিস্তৃত হয়, সে খলখল করে হাসতে হাসতে বলল, “তোর বউয়ের পেটে বাচ্চাটা আছে সেটাও

মরে যাবে! কেমন করে মরবে জানিস?”

“কেমন করে?”

“তুই মারবি। তুই তুই!”

সাজ্জাদ বিস্ফারিত চোখে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। শারমিন ভয়ংকর ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে বলল, “কেন মারবি জানিস?”

“কেন?”

“কারণ বাচ্চাটা তোর না! তোর বউ তোকে ঠকিয়েছে। বুড়া হাবড়া কোথাকার–”

সাজ্জাদ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো উঠে দাঁড়াল, একধরনের অবিশ্বাস নিয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। লাবণী একটু দূর দাঁড়িয়েছিল বলে শারমিন কী বলছে শুনেনি। এবারে একটু এগিয়ে। এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সাজ্জাদ?”

সাজ্জাদ কোনো কথা না বলে হতচকিতের মতো একবার শারমিনের দিকে আরেকবার লাবণীর দিকে তাকাল। লাবণী আবার জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কী বলেছে শারমিন?”

সাজ্জাদ ফিসফিস করে বলল, “না কিছু না।” তারপর লাবণীর দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাত দিয়ে শারমিনকে দেখিয়ে বলল, “এ শারমিন নয়।”

“কী বলছ তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি জানি এ আসলেই কাফ্রীদা!”

শারমিন বিছানায় নির্জীবের মতো শুয়ে থেকে খলখল করে হাসতে থাকে।

.

ড. আরশাদ বলেছিল শারমিন কয়েক মিনিটের মাঝে ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু সত্যি সত্যি যখন শেষ পর্যন্ত সে যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন এক ঘণ্টা থেকেও বেশি সময় পার হয়েছে। এ সময়টুকু লাবণী শারমিনের হাত ধরে বসেছিল। শারমিন ফিসফিস করে দুর্বোধ্য প্রলাপ বকেছে, লাবণী সেগুলো শুনেছে, শুনে সেও ফিসফিস করে শারমিনের সাথে কথা বলেছে। কাফ্রীদার ভেতর কোথাও তার আদরের শারমিন লুকিয়ে আছে, সে সেই শারমিনের সাথে কথা বলে গেছে। কাফ্রীদা তাকে বলতে দিতে চায় না কিন্তু সে তবু বলেছে। ভয়ংকর এই দানবের হাতে আটকে পড়া তার ছোট মেয়েটিকে সে সাহস দিয়েছে, সান্ত্বনা দিয়েছে, আদর আর ভালোবাসা দিয়েছে। তার আদরের শারমিন সেটা বুঝতে পেরেছে কী না সে জানে না, কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যেও থামেনি।

শারমিন যখন শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে গেছে তখন লাবণী বাইরের ঘরে এসেছে। সেখানে সোফায় সাজ্জাদ চুপচাপ দুই গালে হাত দিয়ে বসেছিল। লাবণীকে দেখে বলল, “ঘুমিয়েছে?”

লাবণী মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, ঘুমিয়েছে।”

“আরশাদ বলেছিল, কয়েক মিনিটে ঘুমাবে, আসলে কত সময় লেগেছে দেখেছ?”

“আমিও তাকে একটা সিডেটিভ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়েছিলাম। তারপরেও উঠে গেছে।”

“কোনো একটা কারণে মেটাবলিজম খুব বেশি।”

দুজন চুপচাপ বসে থাকে, দীর্ঘ দুই বছর পর একজন আরেকজনকে দেখছে, দুজনের মনেই ছোটখাটো কথা এসে ভিড় করছে কিন্তু বলতে পারছে না। শারমিনের বিষয়টা এমন একটা চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে যে দুজনের কেউ আর অন্যকিছু ভাবতে পারছে না। সাজ্জাদ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি নিজের চোখে না দেখলে এটা বিশ্বাস করতাম না।”

লাবণী বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেও এটা বিশ্বাস করতে পারছি না।

“এমন কিছু কথা বলেছে যেটা ওর জানার কথা না।”

লাবণী কোনো কথা না বলে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে রইল। সাজ্জাদ মাথা নেড়ে বলল, “ভয়ংকর ভয়ংকর সব কথা।”

লাবণী বলল, “আমি আজ সারাদিন ভূত-প্রেত-দানব আর ব্ল্যাক আর্ট নিয়ে পড়াশোনা করেছি। সেখানে লেখা আছে এরা যখন কোনো মানুষকে বশ করে ফেলে তখন তার মুখ দিয়ে যেসব কথা বলে সেগুলো বেশির ভাগ হয় মিথ্যা। ভয় দেখানোর জন্যে ভয়ংকর ভয়ংকর কথা।”

সাজ্জাদ মাথা নাড়ল, বলল, “আমাকে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো মিথ্যা না।”

“হতে পারে।” লাবণী নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বইয়ে লেখা আছে পশুপাখি, পোকামাকড় নাকি ওদের উপস্থিতি বুঝতে পারে। যখন ওরা আসে তখন নাকি সব জন্তু-জানোয়ার, পোকামাকড় পালিয়ে যায়। এখানে কত মশা কিন্তু ওই ঘরে একটি মশাও নেই। দেওয়ালে টিকটিকি পর্যন্ত নেই।”

সাজ্জাদ বলল, “ঘরটা কেমন ঠাণ্ডা।”

“হ্যাঁ, বইগুলোতে সেটাও লেখা আছে। ঘরে মাংস পচার মতো একধরনের গন্ধ হবে।”

সাজ্জাদ মাথা নাড়ে, বলে, “হ্যাঁ পচা একটা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না।”

“সবচেয়ে ভয়ংকর কথা কী জানো?”

“কী?”

“এরা শক্তি পায় কোথা থেকে জানো?”

“কোথা থেকে?”

“অন্যের প্রাণ থেকে। একটা করে জীবন্ত প্রাণ নেয় আর তখন সেই জীবনীশক্তিটা পেয়ে যায়। সেজন্যে এরকম সময় ঘরে কোনো জীবিত প্রাণী রাখতে হয়, পাখি, কুকুর, বিড়াল–”

“সেগুলো মেরে ফেলে?”

“তাই পড়েছি। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে মানুষ মারতে।”

“মানুষ?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে চেষ্টা করবে শারমিনের কিছু করতে?”

“না-না-শারমিন হচ্ছে ওর হোস্ট। শারমিনের ওপর ভর করে সে টিকে আছে। তাই শারমিনের কিছু করবে না। অন্যদের করবে। কাছাকাছি মানুষের, আপনজনের।”

“সাজ্জাদ বলল, “তার মানে তোমার কিংবা আমার?”

“হ্যাঁ। তোমার কিংবা আমার।”

লাবণীর কথা শেষ হবার আগেই সাজ্জাদের চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, চাপা গলায় বলে, “হায় খোদা!”

“কী হয়েছে?” বলে লাবণী সাজ্জাদের দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকায় এবং সাথে সাথে তার শরীর পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়।

শোয়ার ঘরের দরজা দিয়ে শারমিন বের হয়ে আসছে। সে দুই হাতে শক্ত করে একটা চাকু ধরে রেখেছে-চাকুটা লাবণী আর সাজ্জাদ দুজনেই চিনতে পারল। ড. আরশাদের জন্যে বাথরুম থেকে আয়নাটা খুলে আনতে গিয়ে ভ্রু ড্রাইভার খুঁজে না পেয়ে এ চাকুটা সে রান্নাঘর থেকে নিয়ে গিয়েছিল। চাকুটা ভুল করে শোয়ার ঘরে রেখে এসেছিল, শারমিন ভুল করেনি সেটা তুলে এনেছে।

সাজ্জাদ হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, কী ভয়ংকর চেহারা শারমিনের, মাথার চুলগুলো উড়ছে, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে জ্বলছে, মুখে ভয়ংকর একটি ক্রুর হাসি। সাজ্জাদ ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল, লাবণী তাকে থামাল। শারমিন দুই হাতে চাকুটা আরো একটু ওপরে তুলে লাবণীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

লাবণী নিচু গলায় বলল, “শারমিন।”

শারমিন হিসহিস কর ওঠে, “আমি শারমিন না!”

লাবণী তীব্র গলায় বলল, “অবশ্যই তুই শারমিন। আমি জানি তুই শারমিন। তোকে আমি পেটে ধরেছি, বুকে চেপে বড় করেছি। তুই শারমিন!”

শারমিন খ্যাপার মতো দুই পাশে মাথা নাড়ল, বলল, “না-না-না আমি শারমিন না। আমি কাফ্রীদা।”

‘কাফ্রীদা একটা দানব। তার জায়গা হবে দোজখে–” লাবণী চিৎকার করে বলল, “আমার সোনামণি শারমিনের ওপরে কোনো দানব থাকতে পারবে না। যা তুই দানব, দূর হয়ে যা–”

“যাব না। আমি যাব না—”

লাবণী আকুল হয়ে বলল, “সোনামণি শারমিন মা আমার, তুই কারো কথা শুনবি না। তুই শুধু আমার কথা শোন-আমি জানি তুই আমার কথা শুনছিস। আয় মা তুই আমার কাছে। তুই জেগে ওঠ, ঝাড়া দিয়ে এই নোংরা-ময়লা জানোয়ারটাকে, এই দানবটাকে ফেলে দে। আমি জানি তুই পারবি! তুই পারবি–”

শারমিন চাকু হাতে আর দুই পা এগিয়ে আসে, খলখল, করে হেসে ওঠে বলে, “পারবি না তুই! পারবি না আমার সাথে। আমি কাফ্রীদা! অনেকদিন পর আমি ছাড়া পেয়েছি, আমার অনেক খিদে পেয়েছে। আমাকে এখন খেতে হবে, খেতে হবে—”

লাবণী বলল, “শারমিন মা আমার! তুই আমার চোখের দিকে তাকা। একবার তুই আমার চোখের দিকে তাকা। আমি তোর আম্মু! মনে নাই তোর, তোকে আমি বুকে করে মানুষ করেছি! আয় মা তুই আমার কাছে, তোকে বুকে জড়িয়ে ধরব! আমার বুকটা খা খা করছে–”

“তোর বুকে আমি চাকু বসাব। রক্তের বন্যা হবে এখানে–”

“না!” লাবণী চিৎকার করে বলল, “না! না! না! শারমিন তুই তোর মায়ের বুকে চাকু বসাতে দিবি না! তুই জেগে ওঠ, জেগে উঠে দেখ তোক কী করছে! এই দানব তোর হাতে করে চাকু ধরিয়ে আনছে তোর আম্মুকে খুন করার জন্যে। তুই কী পারবি কখনো?

পারবি না–ছুঁড়ে ফেলে দে চাকু, আয় আমার কাছে মা। আয়। আমার চোখের দিকে তাকা! আমি জানি তুই আছিস! আমি জানি তুই আছিস, তুই আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস!”

শারমিনের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে ওঠে। লাবণী তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। শূন্যে অপ্রকৃতিস্থ একটা দৃষ্টিতে হঠাৎ একধরনের জীবনের স্পন্দন দেখা যায়। লাবণী সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে শারমিনের ভয়ংকর ক্রুর মুখটিতে হঠাৎ ব্যথার চিহ্ন ফুটে উঠছে। দুই চোখে হঠাৎ গভীর ভালোবাসা আর গভীর বেদনার আভাস দেখা দিতে থাকে। লাবণী এক পা অগ্রসর হয়ে বলে, “আয় মা আমার। বুকে আয় তোর জন্যে আমি পাগল হয়ে অপেক্ষা করছি! আয় মা আমার–“

শারমিন এক পা অগ্রসর হয়, হঠাৎ করে তার পা টলে ওঠে, দুই হাতে শক্ত করে ধরে রাখা চাকুটা হাত থেকে খুলে নিচে এসে পড়ে। শারমিন এক পা এগিয়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, “আম্মু,আম্মু তুমি কোথায় ছিলে?”

শারমিন তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখেমুখে চুমো দিয়ে বলল, “এই তো আমি আছি তোর সাথে। এই দেখ মা—”

“আমার খুব ভয় করছে মা। খুব ভয় করছে–”

“তোর কোনো ভয় নেই। আর কোনো ভয় নেই।”

“সত্যি?”

“সত্যি।”

শারমিনের মুখে একটা সূক্ষ হাসি ফুটে ওঠে এবং হঠাৎ করে সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে যায়। লাবণী বলল, “সাজ্জাদ ওকে একটু ধরো। আমি একা পারছি না।”

সোফায় শুইয়ে রেখে লাবণী শারমিনের মুখে নিজের মুখ স্পর্শ করে আকুল হয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “বেডরুম থেকে তুমি একটা চাদর এনে দেবে প্লিজ। শারমিনের মনে হয় শীত করছে–“

চাদর না নিয়েই সাজ্জাদ এক মুহূর্ত পরে ফিরে এলো। তার মুখ ফ্যাকাসে এবং হাত অল্প কাঁপছে। লাবণী অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে।”

“তুমি বিশ্বাস করবে না! তুমি কিছুতেই বিশ্বাস করবে না “

“কী বিশ্বাস করব না?”

“শোয়ার ঘরে যে আয়নাটা ছিল–“

“কী হয়েছে সেই আয়নাটার?”

“সেই আয়নার ভেতরে ভয়ংকর একটি মূর্তি!” লাবণী তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “খবরদার ওটা ছুঁবে না! খবরদার

“কী হবে ছুঁলে?”

“আবার বের হয়ে যাবে।”

“তাহলে কী করব?”

“আরেকটা আয়না খুলে আনো, তারপর এই আয়নাটার ওপর সেটা মুখোমুখি বসিয়ে দাও। তাহলে প্রতিবিম্বের প্রতিবিম্ব হয়ে এই দানব যুগের পর যুগ আটকা পড়ে যাবে! দূর থেকে দূরে চলে যাবে–“

“তুমি কেমন করে জানো?”

“আমি জানি। তুমি যাও দেরি করো না। আমি শারমিনকে ছেড়ে যাব না।”

সাজ্জাদ যখন দ্বিতীয় আয়নাটা খুলে নিয়ে আসে তখন আয়নার ভেতরে আটকা পড়ে থাকা ভয়ংকর মূর্তিটার মাঝে অস্বাভাবিক একটা চাঞ্চল্য দেখা দেয়। সেটি ভেতরে হুটিপুটি খায়, ছটফট করে এবং যখন দুটি আয়না কাছাকাছি এসে প্রতিবিম্বের ভেতর প্রতিবিম্ব দিয়ে একটি অসীম সুরঙ্গের মতো সৃষ্টি হয় সেটি ছটফট করতে করতে সেই সুরঙ্গ দিয়ে অতলে অদৃশ্য হয়ে যায়। সাজ্জাদ তারপরেও কোনো ঝুঁকি নিল না। দুটো আয়না শক্ত করে বেঁধে রাখল। তার পরিচিত এক বন্ধুর সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি আছে। বিশাল ফার্নেসে সেখানে সবকিছু গলিয়ে ফেলা যায়। এ দুটি আয়নাকে এভাবে রেখেই সে গলিয়ে ভস্ম করে দেবে। কাফ্রীদা নামের দানব যেন আর কোনোদিন ফিরে আসতে না পারে।

.

ভোরবেলা নাস্তার টেবিলে শারমিন খেতে বসেছে। সাজ্জাদ শারমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে, বলল, “আমি এখন যাই।”

শারমিন বলল, “আমাদের সাথে নাস্তা করে যাও।”

সাজ্জাদ লাবণীর দিকে তাকাল, লাবণী বলল, “হ্যাঁ। নাস্তা করে যাও। আয়োজন খুব ভালো নয়–আগেই বলে রাখছি।”

সাজ্জাদ একসময়ে তার জন্যে নির্ধারিত যে চেয়ার ছিল সেটাতে বসে বলল, “এর চাইতে ভালো আয়োজন কী আমার জন্মে আমি কখনো পাব?”

লাবণী কোনো কথা বলল না। শারমিন বলল, “পাবে আব্বু। তুমি পাবে। তুমি ইচ্ছে করলেই পাবে।”

সাজ্জাদ লাবণীর দিকে তাকাল। লাবণী খুব সাবধানে তার চোখের কোনা মুছে নিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে সাজ্জাদের দিকে তাকাল, বলল, “কী খাবে তুমি? চা না কফি?”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন