দীঘলবাড়ির দুরন্ত দিনগুলো

সৈকত মুখোপাধ্যায়

দীঘলবাড়ির দুরন্ত দিনগুলো

এক

আমার নাম নীল…নীল চ্যাটার্জি। বাড়ি কলকাতার বরানগরে, কিন্তু বাড়িতে থাকি কম। বছরের বেশিরভাগ সময় ভারতবর্ষের নানান বনে-জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরেই আমার সময় কেটে যায়। কানহা, করবেট, কেওলাদেও, কাজিরাঙা—কোনো জঙ্গল বাদ নেই।

আসলে আমি একজন ওয়াইল্ড-লাইফ ফোটোগ্রাফার। বন্য জন্তু, পাখি, ফুল, প্রজাপতি—এইসবের ছবি তুলি। প্রথমে ফোটো তোলাটা ছিল হবি। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে যখন বেশ নামডাক হয়ে গেল, তখন এটাকেই প্রফেশন বানিয়ে নিলাম। এখন অনেক টিভি-চ্যানেল কিংবা ম্যাগাজিন ভারতের বন্যজীবনের ওপর ডকুমেন্টারি বানাতে চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমি তাদের প্রয়োজন মতন ছবি তুলে দিই। সেটা হাতির ছবিও হতে পারে আবার ফড়িং-এর ছবিও হতে পারে। প্রকৃতির রাজ্যে সবাই সমান সুন্দর।

গতমাসে এরকম এক ইনটারন্যাশনাল চ্যানেলের পক্ষ থেকে আমার কাছে খবর এল, তারা নাকি হর্নবিল পাখির ওপরে একটা ডকুমেন্টারি বানাতে চায়। আমাকে বলল ডুয়ার্সের জঙ্গল থেকে হর্নবিল পাখির কিছু মুভি আর স্টিল তুলে দিতে।

ডুয়ার্সে অজস্রবার গিয়েছি, দিনের পর দিন জঙ্গলে থেকেছি। কিন্তু হর্নবিল পাখির ওপরে এর আগে কোনও কাজ করিনি। হর্নবিল পাখির বাংলা নাম ধনেশ। যত বড় পাখি তার তত বড় ঠোঁট। কোনো কোনো প্রজাতির ধনেশের ক্ষেত্রে সেই বিশাল ঠোঁটের ওপরে আবার একটা উলটোনো শিঙের মতন ব্যাপার থাকে।

আমাদের নর্থবেঙ্গলের জঙ্গলে বেশ কয়েক জাতের হর্নবিল পাওয়া যায়। কোনোটার নাম বড়াকাও, কোনোটার নাম ছোটাকাও, কোনোটার নাম কোলেপ। কিন্তু ধনেশের সেরা ধনেশ হল রাজধনেশ, যার ইংরিজি নাম গ্রেট পায়েড হর্নবিল। রাজ তো সত্যিই রাজ। যেমন বিরাট তার চেহারা, তেমনি তার সাদা-কালো পালক আর হলদে ঠোঁটের বাহার। কিন্তু জঙ্গলে ওদের সংখ্যা ক্রমশ কমে যাচ্ছে। গ্রেট হর্নবিল এখন রেয়ার বার্ড।

ওদের দেখা পাওয়া কঠিন বলেই ঠিক করলাম ওই গ্রেট হর্নবিলেরই ছবি তুলব, স্পেশালি তাদের বাসা বাঁধা আর বাচ্চা বড় করার ছবি। সে এক দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কেন সেটা পরে বলছি।

যাই হোক, ক্যামেরা-ট্যামেরা নিয়ে পৌঁছে গেলাম আলিপুরদুয়ার। সেখান থেকে বক্সা টাইগার রিজার্ভের ভেতর জয়ন্তীগ্রাম। প্রথমেই জয়ন্তী গেলাম, কারণ ওখানে রয়েছে ফরেস্ট গার্ড মানিক বর্মন। সে আমার অনেক এক্সপিডিশনের সঙ্গী, আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক দাদা-ভাইয়ের মতন। ডুয়ার্সের জঙ্গলকে মানিক ভীষণ ভালো চেনে। এত বড় জঙ্গলের মধ্যে কখন কোন ডোবায় লেপার্ড জল খেতে আসবে আর কোন ঘাসের বনে কোন ঋতুতে লাল মুনিয়া বাসা বাঁধবে, সমস্ত ওর নখদর্পণে। তাই ডুয়ার্সের জঙ্গলে ছবি তুলতে এলে আমি মানিককে সঙ্গে না নিয়ে কোথাও যাই না।

এবারে কিন্তু মানিককে পেলাম না। আগে থাকতেই ওকে ফোনে বলে রেখেছিলাম; ও নিউ আলিপুরদুয়ার স্টেশনে আমার জন্যে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ওইটুকুই। দেখা হতেই মানিক ভারী কাঁচুমাচু মুখে জানাল জঙ্গলে ‘এলিফ্যান্ট-সেনসাস’ মানে হাতি-গুনতির কাজ চলছে, তাই একজন ফরেস্ট গার্ডেরও ছুটি মিলবে না। ও নিজেও ছুটি পায়নি, তাই এ যাত্রায় আমার সঙ্গে যেতে পারবে না।

শেষ চেষ্টা হিসেবে আমি বললাম, তাহলে জয়ন্তীর জঙ্গলেই ছবি তুলি। এখানে তো তুই আমার সঙ্গে থাকতে পারবি?

মানিক মাথাটাথা চুলকে বলল, সেটা হলে তো খুব ভালোই হত। কিন্তু এখন জয়ন্তীর জঙ্গলে একটিও রাজধনেশ নেই। জয়ন্তী তো প্রায় সমতল। ওদের এখন পাওয়া যাবে পাহাড়ের আরেকটু উঁচুতে, যেখানে বড় বড় চিকরাশি আর ময়নার গাছ আছে। ওরকম আকাশছোঁয়া গাছের কোটরেই এই এপ্রিল মাসে রাজধনেশ বাসা বাঁধে।

ওর কথা শুনে আমি বললাম, পাহাড় তো চারিদিকেই। মাইলের পর মাইল পাহাড় আর জঙ্গল। তার মধ্যে কোন জায়গাটায় যেতে হবে তুই বলে দে। আমি একাই চলে যাব।

মানিক বলল, দাঁড়াও দেখছি। তারপর ওয়াকি-টকি বার করে হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করল। কথা শুনে বুঝতে পারছিলাম, ও নানান জঙ্গলের ফরেস্ট গার্ডদের কাছে খোঁজ করছে তাদের এরিয়ায় গ্রেট হর্নবিল আছে কিনা। তারপর ওয়াকি-টকির সুইচ অফ করে বলল, নীলদা, তুমি চলে যাও দীঘলবাড়ি। ওখানে ডিউটিতে আছে আমার বন্ধু সুকুমার ভাওয়াল। সেও ফরেস্ট গার্ড। ক’দিন আগেই সুকুমার একজোড়া হর্নবিল দেখেছে। খুব সম্ভবত পাখিদুটো বাসা বাঁধার তোড়জোড় করছে। তুমি এখন গেলে একেবারে শুরু থেকে শেষ অবধি ফিল্মে ধরতে পারবে। কিন্তু একটা মুশকিল আছে।

আমি বললাম, আবার কী মুশকিল?

দীঘলবাড়ি অবধি গাড়ি যাওয়ার মতন রাস্তা নেই। কাল সকালে তোমাকে আমি হাতিবাড়ি অবধি পৌঁছিয়ে দিতে পারি। তারপর ওখান থেকে ষোল কিলোমিটার পায়ে হেঁটে যেতে হবে। পারবে তো?

আমি বললাম, আমাকে এইভাবে অপমান করিস না মানিক। ‘পারবে তো’ আবার কী? তুই তো আমার সঙ্গে অনেক ট্রেক করেছিস। কখনো দেখেছিস আমাকে পিছিয়ে পড়তে?

মানিক থতমত খেয়ে বলল, তা ঠিক। আর ওই রাস্তাও এমন কিছু চড়াই নয়। আস্তে আস্তে ঢালু হয়ে উঠে গেছে। কিন্তু নীলদা, তোমাকে তো এবার মাল বইবার জন্যে কোনও পোর্টারও দিতে পারব না। সবাই তো এলিফ্যান্ট-সেনসাসের কাজে গেঁথে গেছে।

আমি বললাম, দরকার নেই। আমার ক্যামেরা-ব্যাগ আর অল্প কয়েকটা জামা-কাপড় হ্যাভারস্যাকে ভরে নিয়ে আমি চলে যাচ্ছি দীঘলবাড়ি। বাকি মালপত্তর তোর কাছেই রেখে যাব। তোর সেনসাসের কাজ তো দিন পনেরো বাদেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখন তুই ওগুলো নিয়ে দীঘলবাড়িতে চলে আসিস। কিন্তু আমাকে এখনই যেতে হবে। না হলে হর্নবিলের বাসা বাঁধার ফার্স্ট স্টেপগুলো মিস করে যাব। ডকুমেন্টারি-টা ইনকমপ্লিট থেকে যাবে।

তাই ঠিক হল। প্রথম রাতটা জয়ন্তী নদীর ধারে মানিকের কাঠের বাড়িতে কাটালাম। একটু রাত হতেই বনের শব্দ শুরু হল। অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে আসছিল সম্বর হরিণের ডাক, প্যাঁচার ডাক, আরও কত নাম-না-জানা পাখির ডাক। একধরনের ঝিঁঝিঁপোকা এদিকে খুব ডাকে। শুনলে মনে হয় মাটির নীচে কোনো ঘরে যেন কেউ অনেক সোনার মোহর ছড়িয়ে দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। আর এই সব শব্দের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল পাথর থেকে পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে ছুটে চলা জয়ন্তীর খরস্রোতের শব্দ। বারান্দায় বসে বসে দেখছিলাম, নদীর ওপারের পাহাড়গুলোয় একটার পর একটা আগুনের মালা এদিক থেকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ওই এপ্রিল মাসে বনে ঝরাপাতায় আগুন লাগে। ওগুলো তারই আলো।

ভোর হতেই মানিক আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল হাতিবাড়ির দিকে। হাতিবাড়ি অবধি আগেও অনেকবার এসেছি। কিন্তু ওখানে পৌঁছানোর পরে মানিক আমাকে যে রাস্তাটার মুখে ছেড়ে দিল সেটা একদমই অচেনা।

রাস্তাটার ওপর প্রথম স্টেপ-টা ফেলেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। মানিক তখনো জিপের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমাকে দেখছিল। ওকে বললাম, এখানে তো একসময় পিচের রাস্তা ছিল বলে মনে হচ্ছে রে।

মানিক গলা তুলে বলল, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। একসময় আলিপুরদুয়ার থেকে দীঘলবাড়ি অবধি চওড়া পিচের রাস্তা ছিল। তবে পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন করে পিচ না পড়লে কি রাস্তার কিছু থাকে? ওই যেটুকু রয়ে গেছে।

আমি বললাম, কেন? পিচ-রাস্তা ছিল কেন?

পিচ-রাস্তা কী বলছ নীলদা? আলিপুরদুয়ার টু দীঘলবাড়ি রেললাইন অবধি ছিল। সেই লাইন ধরে মালগাড়ি যাতায়াত করত।

আমি তো শুনে হাঁ। বললাম, কেন রে মানিক? এইরকম জংলা জায়গায় পিচরাস্তা, রেললাইন ওসব ছিল কেন?

আহা, চিরকালই কি জায়গাটা জংলা ছিল নাকি? একসময়ে দীঘলবাড়িতে ইন্ডিয়ান ডোলোমাইট কোম্পানির খনি ছিল। ওখানে পাহাড়ের খাদানে খুব হাইক্লাস ডোলোমাইট-পাথর পাওয়া যেত। সিমেন্ট-কারখানায় যে কোয়ালিটির ডোলোমাইট লাগে, সেইরকম ডোলোমাইট। সেই ডোলোমাইট-পাথর নিয়ে যাওয়ার জন্যেই রাস্তা ছিল, রেললাইনও ছিল।

তারপর? ডোলোমাইট ফুরিয়ে গেল নাকি?

কী যে বল। আস্ত আস্ত পাহাড়গুলোই তো ডোলোমাইটে তৈরি। ও জিনিস ফুরিয়ে যায় নাকি? হল কি, পাঁচ বছর আগে একটা মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল জঙ্গলের মধ্যে কোনোরকম ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে না। তাতে ওয়াইল্ড-লাইফের ক্ষতি হবে। ব্যাস, ডুয়ার্সের জঙ্গলের মধ্যে যেখানে যত ব্যবসা ছিল, সে করাতকল-ই হোক কিংবা ডোলোমাইটের খাদান, সব বন্ধ করে দিতে হল। তখন থেকেই আর কেউ দীঘলবাড়ি যায় না। রাস্তা, রেললাইন সব আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে গেল। এখন তো ওখানে গভীর জঙ্গল।

আমি বলালম, বাঃ! ভালোই হয়েছে। এইরকম না হলে কি আর ধনেশ পাখিরা ওখানে বাসা বানাবার সাহস পেত? এই বলে আমি সেই খোয়া-ওঠা, ভাঙাচোরা রাস্তা ধরে পা চালালাম দীঘলবাড়ির দিকে। এ রাস্তা দিয়ে এখন যে আর কোনো গাড়িই যেতে পারবে না সেটা পরিষ্কার। হণ্টন ছাড়া উপায় নেই।

দুই

যতই এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই বন্ধ হয়ে যাওয়া সেই ডোলোমাইট মাইনস-এর নানান চিহ্ন চোখে পড়ছিল। কোথাও ঘন জঙ্গলের মধ্যে থেকে মুখ বাড়িয়ে আছে একটা ভাঙা ক্রেনের টুকরো। কোথাও মাথার ওপরে লতাপাতার আড়ালে দেখা যাচ্ছে এক-টুকরো ইলেকট্রিকের তার। রাস্তার ধারে ধারে মরচে-ধরা লোহার রেলিং আর ল্যাম্পপোস্ট তো প্রায়ই দেখতে পাচ্ছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, এত দূর থেকে সমস্ত সম্পত্তি সরিয়ে নিয়ে যেতে গেলে যে খরচা পড়বে সেই খরচাটা ওই কোম্পানি করতে চায়নি, তাই কমদামি কিংবা অকেজো জিনিসগুলো এখানেই ফেলে গিয়েছে।

আমার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল হরপ্পা কিংবা মহেঞ্জোদাড়োর মতন কোনো সভ্যতার সমাধির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। শুধু এই সভ্যতা কোনো প্রাচীন সভ্যতা নয়, আমাদের সময়েরই একটা শহর এখানে জঙ্গলের নীচে চাপা পড়ে গেছে।

জঙ্গল যে কি দ্রুতগতিতে নিজের হারানো রাজ্যপাট দখল করে নিতে পারে, সেটা দেখেও গা শিরশির করছিল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে একটা জমজমাট জায়গা ঘন জঙ্গলের মুঠোর মধ্যে ঢাকা পড়ে গেছে। ভাবছিলাম, আজ কলকাতা শহরটাকেও যদি পাঁচ-দশ বছরের জন্যে জঙ্গলের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে তার অবস্থাও নিশ্চয় এরকমই হবে। আবার সেই জোব চার্নকের আমলের মতন কালীঘাটে ঘুরে বেড়াবে সুন্দরবনের বাঘ। লোকজনকে বাঘের ভয়ে দল বেঁধে মন্দিরে যেতে হবে।

এইসব উলটোপালটা ভাবতে ভাবতেই একসময় দীঘলবাড়ি পৌঁছিয়ে গেলাম।

দুটো জিনিস দেখে চারিপাশের জঙ্গল থেকে জায়গাটাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল। এক, কংক্রিটে বাঁধানো একটা বড় চত্বরকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকটা ভাঙাচোরা বাড়ি। ওখানেই নিশ্চয় পাঁচ বছর আগে ইন্ডিয়ান ডোলোমাইট কোম্পানির অফিস ছিল। আর দ্বিতীয় চিহ্ন, একটা সবুজ রঙের কাঠের ঘর, যেটার গায়ে সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা দীঘলবাড়ি বীট-অফিস।

ফরেস্ট-ডিপার্টমেন্ট থেকে যে কোনো জঙ্গলকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে দেখাশোনা করা হয়। এক একটা ছোট ভাগ-কে বলা হয় বীট।

বুঝতেই পারছিলাম, ডোলোমাইট কোম্পানির ভাঙা বাড়িগুলোর ভেতরে শেয়াল আর বড়জোর দু-একটা ভূত ছাড়া আর কাউকে পাব না। তাই বীট-অফিসের দিকেই পা চালালাম। ওখানেই তো মানিকের সহকর্মী সুকুমারের থাকার কথা, যাকে মানিক জানিয়ে রেখেছে যে আমি আসছি। সুকুমারের কাছেই আমার আগামী দু-মাস থাকার প্ল্যান। না হলে এই বেঘো জঙ্গলে আর কোথায় থাকব?

কিন্তু বীট-অফিসে পৌঁছে আমার মাথায় বাজ পড়ল। দেখি দরজার কড়ায় মস্ত একটা তালা ঝুলছে আর সেই তালার সঙ্গে সেলোটেপ দিয়ে আটকানো একটা ভাঁজ করা কাগজ। কাগজটার ওপরে ইংরেজিতে আমার নাম লেখা দেখে ওটা তালার গা থেকে খুলে নিলাম। ভাঁজ খুলে দেখলাম সেটা আসলে আমার প্রতি সুকুমার ভাওয়ালের এক ভয়াবহ বার্তা। কী বার্তা? না, হঠাৎ করেই জয়ন্তীর হেড-অফিস থেকে হাতি-গুনতির কাজে তলব এসেছে। তাই সুকুমারবাবুকে এই মুহূর্তে দৌড়তে হল জয়ন্তী। আমি যেন আপাতত দীঘলবাড়িতে থাকার চেষ্টা না করে অন্য কোথাও ফিরে যাই।

চিঠিটা হাতে নিয়ে হাঁ করে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর পকেট থেকে সেলফোনটা বার করলাম। ভাবলাম মানিককে একবার পরিস্থিতিটা জানিয়ে জিগ্যেস করি, ও কী করতে বলছে।

ও বাবা! মোবাইলের স্ক্রিন বিলকুল ফরসা। টাওয়ারের টা-ও নেই।

নাঃ, ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই দেখছি। মনটা তো খারাপ হয়েই ছিল। আরো বেশি খারাপ হল যখন মাথার ওপরে সাঁই সাঁই শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখলাম একটা বটগাছের মগডাল থেকে ঝাঁপ দিয়ে উড়ে গেল দুটো গ্রেট হর্নবিল। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওদের মুখে বাসা বানানোর কুটো।

বুঝতে পারছিলাম, এখনই ফেরার পথ ধরা ভালো, না হলে মাঝ রাস্তায় রাত নেমে যাবে। কিন্তু আমার শরীর চলছিল না। যতই সহজ রাস্তা হোক, আবার ষোল কিলোমিটার হাঁটা তো মুখের কথা নয়। তাই ভারলাম, একটু রেস্ট নিয়ে নিই, আর সেইসঙ্গে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার চেষ্টা করে দেখি, অন্য কোনো অপশন আছে কি না।

পিঠ থেকে হ্যাভারস্যাক-টা নামিয়ে একটা পাথরের ওপরে পা ছড়িয়ে বসলাম।

ওই পাথরটার ওপরে না বসাই ভালো।—হঠাৎ ভারী গলার আওয়াজে এত জোর চমকে উঠলাম যে, সামলে নিয়ে পেছন ফিরে তাকাতে সময় লাগল পাক্কা দশ সেকেন্ড। তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে ডবল আশ্চর্য হলাম। দেখলাম, একজন বয়স্ক মানুষ একটা লাঠির ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এবং মন দিয়ে আমাকে মাপছেন। বয়স তাঁর পঁয়ষট্টির আশেপাশে হবে। ছিপছিপে চেহারা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, ধারালো নাক। গায়ের রং ফর্সা। পরনে খাকি ট্রাউজার, সাদা হাফশার্ট। দুটোই বেশ দামি। ওনাকে এক্ষুনি যদি রবীন্দ্র সরোবরের সান্ধ্য ভ্রমণকারীদের দলে ছেড়ে দিই, তাহলে তাদের মধ্যে বেমালুম মিশে যাবেন। দীঘলবাড়ির জঙ্গল যে ওনার নিজের জায়গা নয় সেটা পরিষ্কার।

পাথরটার ওপর থেকে উঠে দাঁড়ানোই ভালো। ভদ্রলোক আবার বললেন। পরিষ্কার বাংলাতেই কথা বলছিলেন উনি।

কেন? উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতেই আমি জিগ্যেস করলাম।

উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এলেন। রাস্তা থেকে একটা ভাঙা ডাল কুড়িয়ে নিয়ে পাথরটার নীচে ঠেকিয়ে, পাথরটাকে একটু সরিয়ে দিয়ে বললেন, এইজন্যে।

যা দেখলাম তাকে মুহূর্তের মধ্যে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। দুটো প্রমাণ সাইজের কাঁকড়াবিছে—এক একটার সাইজ আমার হাতের পাতার মতন হবে—লেজের হুল উঁচিয়ে বুঝবার চেষ্টা করছে তাদের মাথার ওপরের ছাদ-টা কোন হতভাগা সরিয়ে নিল। আমি লাফ মেরে চার হাত সরে গিয়ে বললাম, থ্যাঙ্ক ইউ। কিন্তু আপনি কেমন করে জানলেন?

গত দু’বছরে এই জঙ্গলের প্রত্যেকটা ঘাসকে চিনে নিয়েছি। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না। দীঘলবাড়িতে আগে কখনো দেখেছি কি?

আমি বললাম, না। আজকেই প্রথম একটা প্রোজেক্ট নিয়ে এখানে পা রেখেছিলাম। তবে মনে হচ্ছে সেই প্রোজেক্ট ক্যানসেল করতে হবে।

কিসের প্রোজেক্ট?

আমি ওনাকে তখন আমার নাম, ধাম, পেশা এবং এখানে আসার উদ্দেশ্য সবই গুছিয়ে বললাম। বললাম, হর্নবিলের বাসা বাঁধার ভিডিও তুলতে এসেছিলাম কিন্তু সেটা তো প্রথম থেকে তুলতে না পারলে লাভ নেই। আর থাকার জায়গা আপাতত নেই। তাই আমি ফিরে যাব বলে ঠিক করেছি।

আমার মুখে হর্নবিল পাখির কথা শুনতে শুনতে উনি কী যেন চিন্তা করছিলেন। হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা ভাই নীল, তুমি পাখির ব্যাপারে পণ্ডিত, তাই না?

উনি কি সুন্দর সামান্য পরিচয়েই আমাকে আপন করে নিলেন, নাম ধরে তুমি সম্বোধন করলেন, দেখে সত্যিই ভালো লাগল।

ওনার প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, না না। আমার কোনো ডিগ্রি-টিগ্রি নেই। ওই নিজে নিজে বইপত্তর ঘেঁটে আর সত্যিকারের পক্ষীবিদদের সঙ্গে মিশে যেটুকু শিখেছি।

উনি বললেন, তাতেই হবে। চলো তো তুমি আমার সঙ্গে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কোথায়?

আমার ঘরে, আবার কোথায়? ঘর মানে অবশ্য ওই ডোলোমাইট-কোম্পানির একটা ভাঙা বাংলো। ওদের মধ্যপ্রদেশের হেড-অফিসে আমার এক বন্ধু রয়েছে। সেই পারমিশন করিয়ে দিয়েছে যাতে বাড়িটা ব্যবহার করতে পারি। গত দু’বছরের মধ্যে অন্তত চোদ্দবার এখানে এসেছি। প্রত্যেকবার ওখানেই উঠেছি। এবারেও ভাবছি মাস-দুয়েক থেকে যাব। তুমিও আমার সঙ্গে থাকবে। আমরা একে অন্যকে রিসার্চের কাজে হেল্প করব, কেমন?

আমি বললাম, আপনিও কি এখানে কোনো রিসার্চের কাজে এসেছেন নাকি? আমি তো ভাবছিলাম, ইয়ে….মানে ট্যুরিস্ট।

উনি একগাল হেসে বললেন, এই দ্যাখো। নিজের পরিচয়টাই এখনো দিইনি। তাহলে তুমি আর অমন কথা ভাবতে না। এই বলে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমি ডক্টর সব্যসাচী মিত্র। মেডিক্যাল অ্যানথ্রোপোলজিস্ট।

ওনার সঙ্গে শেকহ্যান্ড করলাম ঠিকই, তবে মুখে হাসি ফোটাতে পারলাম না। কারণ, সেই মুহূর্তে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করছিলাম ‘মেডিক্যাল অ্যানথ্রোপলজি’ শব্দটা আগে শুনেছি কি না।

আমার মুখ দেখে ডক্টর মিত্র সেটা নিশ্চয় ধরতে পারলেন। তাই বুঝিয়ে বললেন, সাবজেক্টটা আসলে নানান যুগে মানুষ কেমন সব অসুখে ভুগত আর তার জন্যে তারা কোন ধরনের ওষুধবিষুধ ব্যবহার করত, তার চর্চা। অসুখ তো চিরকালই ছিল, কিন্তু হসপিটাল আর ডাক্তারখানা তো এল সেদিন। তাই বলে কি চিকিৎসা হত না? আমাদের আয়ুর্বেদের কথাই ভাবো না। কত প্রাচীন এক চিকিৎসা-পদ্ধতি!

মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, ওসব জেনে কী লাভ হয়?

ডক্টর মিত্র কিচ্ছু মাইন্ড করলেন না। দিব্যি ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বললেন, জ্ঞানলাভ তো হয়ই। ভাষা শুনে কিংবা গায়ের চামড়ার রং দেখে যেমন বোঝা যায় কোন কোন গোষ্ঠির মানুষের মধ্যে আত্মীয়তা রয়েছে, তেমনই আজকাল ওষুধবিষুধের মিল থেকেও বোঝা যায় কারা কাদের সঙ্গে রিলেটেড। আর তাছাড়া…।

উনি কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তারপর বললেন, আরও কাজ আছে আমাদের। সেসব পরে বলব তোমাকে। এখন চলো আমার সঙ্গে। অন্ধকার নেমে আসছে।

সত্যিই, আমাদের কথার মধ্যেই কখন যেন বনস্পতিদের ছায়া চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরেছিল। খুব কাছেই কোনো একটা জায়গা থেকে ভেসে এল বুনো হাতির ডাক। আমি আর বাক্যব্যয় না করে হ্যাভারস্যাকটা পিঠে ফেলে ডক্টর মিত্রের পেছন পেছন পা চালালাম ওই পরিত্যক্ত টাউনশিপের দিকে।

তিন

ডক্টর সব্যসাচী মিত্র আমাকে নিয়ে ঢুকলেন একটা একতলা বাড়ির মধ্যে। বাইরে থেকে বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি মনে হলেও ভেতরটা দেখলাম বেশ সুন্দর করে সাজানো। একথা ঠিক যে ইলেক্ট্রিকের কানেকশন নেই। সে তো অনেক ফরেস্ট-বাংলোতেও নেই। কিন্তু তার বদলে সোলার ব্যাটারিতে চলা বড় বড় ল্যাম্প রয়েছে বেশ কয়েকটা। একটা টেবিল, কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার, দুটো ক্যাম্পখাট, বাথরুমে বালতি, মগ, টাওয়েল—কোনো কিছুরই অভাব নেই।

বাংলোটায় দুটো শোবার ঘর, একটা ড্রইং কাম ডাইনিং-রুম আর একটা বাথরুম। বাথরুমের চৌবাচ্চায় ঠান্ডা জল ধরা ছিল। আরাম করে চান করলাম। ইতিমধ্যে ডক্টর মিত্র নিজেও ধরাচূড়া ছেড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে নিয়েছেন। এর মধ্যেই দু-কাপ চাও বানিয়ে ফেলেছেন দেখলাম। আমি চান সেরে ঘরে ফেরা মাত্র আমার হাতে চায়ের কাপ আর গরম ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, সোফা-টোফা নেই। ওই চৌকিটার ওপরেই আরাম করে বসো। উনি নিজেও আমার মুখোমুখি একটা মোড়ায় চায়ের কাপ নিয়ে বসলেন।

আমি জিগ্যেস করলাম, রান্নাবান্না কি নিজেই করেন?

উনি বললেন, দরকার পড়লে করতে পারি না যে তা নয়, তবে আপাতত কাজল রয়েছে। ও আমাকে কোনো কাজই করতে দেয় না। দেখবে ওকে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি। উনি মোড়া ছেড়ে উঠে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। একটু বাদেই একটা ছেলের হাত ধরে নিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই হল কাজল।

দেখলাম, কাজলের বয়স তেরো কি চোদ্দ বছর। গায়ের রং কুচকুচে কালো। ঘাড় অবধি লুটিয়ে পড়েছে, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। মুখটা ক্যালেন্ডারের শ্রীকৃষ্ণের মতন সুন্দর। শরীরের পেশীগুলো এই বয়সেই যেমন ডেভেলপ করেছে তাতে বোঝা যায় ওকে পরিশ্রম করে বাঁচতে হয়। কিন্তু ছেলেটা ভীষণ লাজুক। মুখ তুলে আমার দিকে তাকাতেই পারছিল না।

ডক্টব মিত্র আবার মোড়ায় বসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই হাসতে হাসতে বললেন, ওর আসল নামটা খুব খটোমটো, আমি উচ্চারণই করতে পারতাম না। তাই নিজেই একটা নতুন নাম দিয়ে দিয়েছি। কাজল নামটা ভালো না?

আমি ঘাড় হেলালাম। তারপর জিগ্যেস করলাম, তুমি কোথায় থাকো কাজল?

উত্তরে কাজলের মুখ দিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ বেরিয়ে এল। আমি চমকে তাকালাম সব্যসাচী মিত্রের মুখের দিকে। উনি বিষণ্ণ মুখে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, ঠিকই ধরেছ। কাজল কানে একেবারেই শুনতে পায় না আর সেইজন্যেই কথা বলতেও শেখেনি। জন্ম থেকেই ওইরকম। তবে ভীষণ বুদ্ধিমান। আমার ইশারাগুলো সবই বুঝতে পারে। তোমার ঠোঁট নাড়া দেখে বুঝতে পারছে তুমি কিছু বলছ, কিন্তু উত্তর দিতে পারছে না। ঠিক আছে কাজল, তুমি যাও বাবা।

ডক্টর মিত্রের ইশারা দেখে কাজল বুঝতে পারল, তাকে চলে যেতে বলা হচ্ছে। সে পালিয়ে বাঁচল।

আমি জিগ্যেস করলাম, একে কোথায় পেলেন?

আর বোলো না। ওকে খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই তো আমার দীঘলবাড়ি সম্বন্ধে ইন্টারেস্ট বেড়ে গেল। সে এক লম্বা গল্প। কালকে বলব বরং। আজ তুমি টায়ার্ড আছ। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ো।

আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম। বললাম, এখন আমি আর একটুও টায়ার্ড নই। তাছাড়া আমার অনেক রাত অবধি জেগে থাকা অভ্যেস। এত তাড়াতাড়ি শুলে আমার ঘুমও আসবে না। আপনি বরং কাজলের গল্পটাই বলুন।

ডক্টর মিত্র কাঁচাপাকা চুলের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে কিছুক্ষণ যেন ভাবলেন কোথা থেকে শুরু করবেন। তারপর বললেন, মেডিক্যাল অ্যানথ্রোপলজির একটা বিশেষ উদ্দেশ্যের কথা তোমাকে তখন বলিনি। সেটা হচ্ছে, আদিবাসীদের ওষুধের ভাণ্ডার থেকে নতুন ওষুধ খুঁজে বার করা।

বহুযুগ ধরে ওরা অসুখে-বিসুখে নানা ধরনের গাছগাছড়া, শেকড়বাকড় আর খনিজ পদার্থ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তার মধ্যে কোনো কোনোটা সত্যিই রোগ সারিয়ে তুলতে দারুণ কাজ দেয়। আমাদের কাজ হচ্ছে, সেই সব শেকড়বাকড়, মিনারেলস আর লতা-পাতাকে আইডেন্টিফাই করা। তারপর সেগুলোর কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করে দেখা, তাদের মধ্যে রোগ সারাবার আসল উপাদানটা কী? যদি সত্যিই সেরকম কিছু খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তাই দিয়ে লার্জ স্কেলে অ্যালোপ্যাথি ওষুধ তৈরি করে সভ্য সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

পুরো প্রসেসটা অবশ্য এত সহজ নয়। এর মধ্যে অনেক সাবধানতা নেওয়ার ব্যাপার থাকে।

ডক্টর মিত্র থামলেন। তারপর একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি নিজেই ওরকম বেশ কয়েকটা ওষুধ খুঁজে বার করেছি। যেমন মধ্যপ্রদেশের গোন্থ উপজাতির একটা গ্রামে খুঁজে পেয়েছিলাম হেপাটাইটিস বি-এর মোক্ষম ওষুধ। ওরা একটা গাছের শেকড় বেটে রুগিকে খাওয়াত। ওই শেকড়ে ছিল একধরনের রেয়ার অ্যালক্যালয়েড। সেটাকে আমি আইডেন্টিফাই করেছিলাম। টেস্ট করে দেখলাম, সত্যিই, হেপাটাইটি বি-এর ট্রিটমেন্টে ওই অ্যালক্যালয়েডটা দারুণ কাজ দিচ্ছে। এখন ওই অ্যালক্যালয়েড দিয়ে অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিন তৈরি করা হচ্ছে।

যাই হোক, এটা গেল ভূমিকা। এবার দীঘলবাড়ির কথায় আসি। এই জায়গাটার রেফারেন্স আমি পেয়েছিলাম। জ্যোতির্ময় ভিষগরত্নের হাতে লেখা পুঁথি থেকে। দেড়শো বছরের পুরোনো পুঁথিটা ওনার নবদ্বীপের বাড়িতে ঠাকুরের আসনে রাখা আছে। এখনো গেলে দেখতে পাবে।

জ্যোতির্ময় ভিষগরত্ন কে? আমি জিগ্যেস করলাম।

তিনি ছিলেন সেইসময়ের এক ডাকসাইটে বৈদ্য; যাকে বলা হয় কবিরাজ। শুনেছি কৃষ্ণনগরের রাজার চিকিৎসাও তিনি করতেন, আবার লালমুখো সাহেবরাও তাঁর কাছে লতাপাতা জড়িবুটির ওষুধ চাইতে আসত। তা এই জ্যোতির্ময় মানুষটি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন গবেষক। বনে-জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে তিনি অনেক নতুন ঔষধি বৃক্ষ আবিষ্কার করেছিলেন।

প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এরকম যত গাছগাছড়া আবিষ্কার করেছিলেন, তাদের কথাই তিনি লিখে রেখেছিলেন তুলোট কাগজে তৈরি একটা মোটা খাতায় আর সেই খাতাটাকেই তাঁর বংশধরেরা জ্যোতির্ময়ের পুঁথি বলে ঠাকুরের বেদিতে রেখে পুজো করেন। কিন্তু ওটার মধ্যে ধম্মকম্মের কথা কিছু নেই। যা আছে তা পিওর বিজ্ঞান। পাতার পর পাতা বিভিন্ন গাছের পাতা, মূল, ফুল, ফল, শেকড়ের নিখুঁত লাইন-ড্রইং। পাশে মুক্তোর মতন হাতের লেখায় কোন অংশটা কোন রোগে কীভাবে কাজ করে তার বিবরণ।

জ্যোতির্ময়ের বংশধরদের অনেকরকম ভাবে পটিয়ে-পাটিয়ে আমি ওই পুঁথিটার ফোটোকপি করার অনুমতি পেয়েছিলাম। আমাদের এ-ফোর সাইজের পাতার প্রায় একশো পাতা লেগেছিল পুরো খাতাটা কপি করতে। এক বছর ধরে একটু একটু করে আশিরকমের গাছগাছড়ার বিবরণ পড়েছিলাম। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দেখলাম, ওই গাছপালাগুলো জ্যোতির্ময়ের আমলে অজানা হলেও, পরবর্তী সময়ের কবিরাজদের হাতে অনেক ব্যবহার হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরিতেও গাছপালাগুলোর কেমিক্যাল অ্যানালিসিস করা হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। যাই হোক, রিসার্চের নিয়মই তো এই। তুমি একশোটার মধ্যে নিরানব্বইটা রাস্তা ধরে এগিয়ে দেখবে দেয়ালে আটকে গেছ। একটা রাস্তায় হয়তো সাফল্য পাবে। ও নিয়ে আমি হতাশ হই না।

তবে ওই খাতাটায় একটা এন্ট্রি ছিল আশ্চর্য। সেখানে ছিল একটা পাতার ছবি। গাছ নয়, শেকড় নয়, ফুল-ফল কিচ্ছু নয়। শুধু একটা পাতা। তাও আবার শুকনো পাতা। কেন? উনি কি গাছটাকে দেখেননি? শুধু কয়েকটা শুকনো পাতা দেখেছিলেন?

আমি জিগ্যেস করলাম, ওই পাতাটার সম্বন্ধে কিছু লিখে যাননি?

হ্যাঁ, লিখেছিলেন।

পরের কথাটা বলার আগে সব্যসাচী মিত্র একমুহূর্ত ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন। তারপর আমাকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা নীল, তুমি প্যানাসিয়া শব্দটা শুনেছ? পি এ এন এ সি ই এ। প্যানাসিয়া শুনেছ?

আমি বললাম, হ্যাঁ শুনেছি। অরিজিনালি গ্রিকদের কল্পনা। এমন এক ওষুধ যা নাকি যে কোনো রোগকে সারিয়ে তুলতে পারে। যাকে ভালো বাংলায় বলে ‘সর্বরোগহর’। এখন অবশ্য ইংরেজিতে প্যানাসিয়া শব্দটাকে মুশকিল-আসান অর্থে ব্যবহার করা হয়। অনেকগুলো প্রবলেমের যখন একটাই সল্যুশন তখন তাকে বলা হয় প্যানাসিয়া।

বাঃ! তাহলে তোমাকে বোঝাতে অসুবিধে হবে না। জ্যোতির্ময় ভিষগরত্ন একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ওই পাতাটার সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন, তার অর্থ, ওই পাতাটি প্যানাসিয়া। মানুষের এমন কোনো রোগ নেই যা ওই পাতাটি চিবিয়ে খেলে সেরে না যায়। আর ভিষগরত্নমশাই সেই পাতাটি কোথায় খুঁজে পেয়েছিলেন জানো? এই দীঘলবাড়িতে।

আমি যে কতক্ষণ হাঁ করে ডক্টর মিত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, জানি না। শেষ অবধি উনিই বললেন, চলো, খেয়ে নেওয়া যাক। কাজল অনেকক্ষণ ধরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে বললাম, কিন্তু কাজলকে কীভাবে পেলেন তার পেছনেও একটা গল্প আছে বলছিলেন যে।

আচ্ছা, চলো ডিনারটা সেরে নিই। তারপরে বলছি।

চার

ডক্টর সব্যসাচী মিত্র খাওয়ালেন মন্দ নয়। গরম গরম রুটি, তেলাকুচোর মতন একরকম জংলি ফলের ভাজি, লঙ্কার আচার আর কাঠের আঁচে রান্না করা দেশি মুরগির কারি। কাজলের রান্নার হাত দেখলাম অসাধারণ।

খাওয়া-দাওয়ার পরে আমি আর ডক্টর মিত্র দুটো চেয়ার নিয়ে বারান্দায় বসলাম। তখন রাত প্রায় নটা বাজে। ঘন অন্ধকারে ডুবে আছে দীঘলবাড়ির জঙ্গল। চোখে কিছু দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে নিশাচরদের আওয়াজ। ঝিঁঝিঁপোকার শব্দ, নাইটজার পাখির একটানা টং টং ডাক, শেয়ালের আর্তনাদ। সবকিছুকে ছাপিয়ে ছাপিয়ে মাঝে মাঝেই ভেসে আসছিল বুনো হাতিদের সেই শাঁখের আওয়াজের মতন চিৎকার। এই বাংলোর পেছনদিকেই একটা পাহাড়ি ঝোরা আছে। পাথর থেকে পাথরে ধাক্কা খেয়ে ছুটে চলা সেই ঝোরার জলের ঝরঝর শব্দও সারাক্ষণ কানে আসছিল।

বারান্দার অন্য কোণে দু-হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে উদাস ভঙ্গিতে বসেছিল কাজল। ভাবছিলাম বেচারা এত শব্দের কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কী ভীষণ নিস্তব্ধ ওর জগৎ।

ডক্টর মিত্র বললেন, সেই শুকনো পাতার ড্রইংটা কপি করে কলকাতার সবচেয়ে বড় কয়েকজন ট্যাক্সোনমিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম। পৃথিবীবিখ্যাত কয়েকজন বটানিস্টের কাছেও পাতার ছবিটা পাঠালাম। প্রত্যেকেই একবাক্যে বললেন, এই ছবি থেকে তাঁরা গাছটাকে চিনতে পারছেন না। কেউ কেউ বললেন, যদি তাজা পাতার ছবি পেতেন কিংবা ফল-ফুল ইত্যাদির, তাহলে একটা চেষ্টা করে দেখতে পারতেন। কিন্তু এত কম তথ্য থেকে একটা গাছকে আইডেন্টিফাই করা মুশকিল।

এইবার তোমার মনে একটা প্রশ্ন জাগা খুব স্বাভাবিক, নীল। আমি তাহলে কিসের ভরসায় বারবার দীঘলবাড়িতে ফিরে আসছি? কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছি ওই অবিশ্বাস্য গল্প আর অপরিচিত গাছের পাতার ছবিকে?

আমি বললাম, একদম ঠিক বলেছেন। আপনাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করতে যাচ্ছিলাম।

উনি বললেন, উত্তরটা হচ্ছে, ঠিক ওই গল্পটাই আমাকে এখানকার একজন মানুষও বলেছেন। এমন একজন মানুষ, যাঁর পক্ষে জ্যোতির্ময় ভিষগরত্নের পুঁথি চোখে দেখা তো দূরের কথা, সেই খাতার অস্তিত্ব জানাও অসম্ভব। একই কাহিনি যখন দু-জায়গা থেকে শুনলাম তখন তাকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দিই কেমন করে?

আমি অবাক হয়ে বললাম, তাই নাকি! তিনি কে?

তাঁর নাম দয়াল সর্দার। বয়স নব্বই। তিনি আমাদের কাজলের দাদু। আমি যখন দু’বছর আগে প্রথমবারের জন্যে দীঘলবাড়িতে আসি তখনই যদি তাঁর সঙ্গে দেখা না হত তাহলে হয়তো এই প্যানাসিয়ার খোঁজ ওইখানেই বন্ধ করে দিতাম।

মনে আছে, প্রথমবার দীঘলবাড়িতে এসে যখন দেখলাম এখানে কোনো গ্রাম নেই তখন খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। যদি গ্রাম না থাকে, গ্রামের মানুষ না থাকে, তাহলে কার কাছে খোঁজ নেবো আশ্চর্য সেই গাছের ব্যাপারে? ঠিক তখনই একদিন আবিষ্কার করলাম দয়াল সর্দারকে।

আমি জিগ্যেস করলাম, আবিষ্কার বলছেন কেন?

হাঁটুতে চাপড় মেরে ডক্টর মিত্র জোরগলায় বললেন, আবিষ্কার, একশোবার আবিষ্কার। আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার। উনি তো কাজলকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। ভাগ্য আমাকে সাহায্য করেছিল, তাই আমি ওনাকে খুঁজে পেয়েছিলাম। কোথায় পেয়েছিলাম জানো? একটা মালগাড়ির কামরার মধ্যে।

অ্যাঁ! ডক্টর মিত্রের কথা শুনে আমার মুখটা আবার হাঁ হয়ে গেল। বললাম, মালগাড়ির কামরা? এইখানে?

তবে আর বলছি কী? জঙ্গলের মধ্যে একটা মালগাড়ির কামরা সেই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময় থেকেই পড়ে আছে। উনি তার মধ্যে কাজলকে নিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন।

তারপর?

ভাগ্য ভালো বলতে হবে, একদিন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি, এগারো-বারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে উদভ্রান্তের মতন এদিক থেকে ওদিকে দৌড়চ্ছে আর মুখে কেমন যেন অদ্ভুত আওয়াজ করছে। আমি ছেলেটার কাছে যেতেই দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বারবার সেই কামরাটার দিকে আঙুল তুলে দ্যাখাতে লাগল। বুঝলাম, বাচ্চাটা বোবা, আর কোনো একটা বিপদে পড়েছে।

যাই হোক, তারপর ওর সঙ্গে সেই মালগাড়ির কামরার ভেতরে ঢুকে দেখি দিব্যি পরিপাটি এক সংসার। কিন্তু একদিকে একটা খাটিয়ার ওপর একজন বুড়োমানুষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।

তারপর?

ওষুধবিষুধ দিয়ে সাতদিনের মধ্যে বুড়োকে খাড়া করে দিলাম। এইসব মানুষ উপকারীকে ভোলে না। বুড়ো আর তার নাতি, মানে কাজল, আমার কেনা হয়ে রইল। সুস্থ হওয়ার পর দয়াল সর্দার নিজে থেকেই আমাকে বলতে শুরু করলেন তাঁর অদ্ভুত কাহিনি।

ওনারা আসলে এই দীঘলবাড়িরই লোক। কিন্তু যখন ভারত সরকার দীঘলবাড়িকে রিজার্ভ ফরেস্ট বলে ডিক্লেয়ার করল, তখন গ্রামের সমস্ত লোক বর্ডার পেরিয়ে চলে গেল ভুটানের জঙ্গলে। কারণ, রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতরে তো ওরা শিকারও করতে পারবে না, আর ফলমূল বা মধুও সংগ্রহ করতে পারবে না। ওদের জাতের লোকেরা আবার একেবারেই আদিম মানুষদের মতন স্রেফ শিকার করেই খায়। চাষবাস, গোরু চরানো কিছুই জানে না।

প্রায় চল্লিশ বছর বাদে দয়াল সর্দার তাঁর একমাত্র নাতিটিকে সঙ্গে নিয়ে আবার দীঘলবাড়িতে ফিরে এসেছেন এক আশ্চর্য পাতার খোঁজে, যেটি খেলে তাঁর একমাত্র জীবিত বংশধর, তাঁর নাতিটি, আবার কথা বলার বা কানে শোনার ক্ষমতা ফিরে পাবে।

নীল! যখন দয়াল সর্দার এই কথা আমাকে বললেন, তখন আমার মনের অবস্থা যে কী হয়েছিল সে আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি দয়াল সর্দারকে জিগ্যেস করলাম, এরকম পাতার খোঁজ উনি পেলেন কোথা থেকে? তাতে উনি বললেন, ওনাদের জাতের মধ্যে হাজার বছর ধরে নানান গান-ছড়া আর গল্পের মধ্যে দিয়ে অসুখ সারানো সেই আশ্চর্য পাতার গল্প চলে এসেছে। কিন্তু সে কথা জানে শুধু ওনাদের জাতের লোক, বাইরের কাউকে এর কথা বলা নিষেধ।

দয়াল সর্দারের এই উত্তর শুনে আমার বিশ্বাস আরো পাকা হল। আমরা যারা অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে কাজ করি, তারা সকলেই জানি, নিরক্ষর আদিবাসীদের জ্ঞানভাণ্ডার ধরা থাকে ওদের এইসব মুখে মুখে চলে আসা ছড়া, গান আর গল্পের মধ্যে, যেগুলোকে এক কথায় বলে folk lore। ফোক-লোর হয়তো অনেক কথাই সংকেতে বলে, কিন্তু কখনো মিথ্যে বলে না।

আমি দয়াল সর্দারকে জিগ্যেস করেছিলাম, আমি তো বাইরের লোক। তাহলে আমাকে এসব কথা বলছেন কেন? তাতে উনি বলেছিলেন, আমি না থাকলে শুধু যে উনি মারা পড়তেন তাইই নয়, ওনার বাচ্চা নাতিটাও এই জঙ্গলের মধ্যে না খেতে পেয়ে মারা পড়ত। তাই আমাকে উনি আত্মীয় বলে মেনে নিয়েছেন। আমার কাছে কিছুই লুকোবেন না।

তারপর?

তারপরেই হয়েছে মুশকিল। আমি তো তবু জ্যোতির্ময়ের পুঁথি থেকে প্যানাসিয়ার একটা ছবি পেয়েছি। দয়াল সর্দার তো তাও পাননি। উনি শুধু নানান ছড়া আর গানের মধ্যে সেই আশ্চর্য পাতার ঘোরানো-প্যাঁচানো বর্ণনা পেয়েছেন। কাজেই আলাদা আলাদাভাবে আমরা দুজনেই জানি দীঘলবাড়িতে সেই আশ্চর্য গাছ আছে, কিন্তু কোথায় যে সেই গাছ জন্মায়, কী যে তার নাম, কিছুই জানি না। দুজনেই নিজের মতন করে খুঁজে যাচ্ছি।

আমি ডক্টর মিত্রকে প্রশ্ন করলাম, আপনি দয়াল সর্দারকে জ্যোতির্ময়ের পুঁথির কথা বলেছেন?

না, বলিনি। এমনকি এও বলিনি যে, আমি ওই পাতার খোঁজেই এখানে এসেছি। সর্দার জানেন, আমি এখানকার পাহাড়ের মিনারেলস নিয়ে কাজ করছি। সব কথা সবাইকে বলতে নেই। তুমিও যেন ওনাকে কিছু বোলো না।

ডক্টর মিত্রের কথাগুলো আমার খুব খারাপ লাগল। আমার মনে হল কাজটা উনি ঠিক করেননি। তবে কিছু বললাম না। অত বড় মাপের একজন বিজ্ঞানীর কাজের সমালোচনা করা আমার শোভা পায় না। এও ঠিক করলাম, উনি যদি কিছু না বলেন তাহলে আমিও দয়াল সর্দারকে ওনার কাজের ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাব না।

তারপরেও কিছুক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা বলে উঠলেন সব্যসাচী মিত্র। বললেন, তুমি একবার ওই পুঁথির পাতাটা দেখবে?

আমি বললাম, সে দেখতে পারি। কিন্তু যেখানে অত বড় বড় বটানিস্টরা কিছু বলতে পারেননি সেখানে আমি আর কী বলব?

ডক্টর মিত্র বললেন, শুধু সো-কলড প্যানাসিয়ার ছবিই তো নয়, ওই একই পেজে আরো দুটো স্কেচ ছিল। আমি আলাদা আলাদা পাতায় কপি করে রেখেছি। দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি। এই বলে উঠে গিয়ে আলমারির থেকে একটা ফাইল নিয়ে এলেন। আমাদের দুজনের মাঝখানে একটা ব্যাটারি-ল্যাম্প নামানো ছিল। সেটার সামনে একটা নির্দিষ্ট পাতা খুলে ধরে বললেন, দ্যাখো। এর মানে কী?

আমি দেখলাম, প্রথমেই নানান অ্যাঙ্গেল থেকে কয়েকটা শুকনো পাতার ড্রইং। পাতাটা দেখতে অনেকটা পানপাতার মতন, কিন্তু সাইজে অনেক ছোট। সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার, পুরো পাতাটাই খুব ছোট ছোট রোঁয়ায় ঢাকা। এত বনে-জঙ্গলে ঘুরেছি, কিন্তু এরকম কোনো গাছের পাতা আমি আজ অবধি দেখিনি।

ডক্টর মিত্র আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি হতাশ হয়ে ঘাড় নাড়তেই উনি দ্বিতীয় আরেকটা পেজ খুলে ধরলেন। এই পেজটায় একগুচ্ছ ঘাসের ছবি। ঘাসগুলোর মাথা থেকে শীষ বেরিয়েছে। সেই শীষ ভরা ছোট ছোট বীজের দানা। এই ছবিটা বরং একটু চেনা লাগল। অনেক জলাভূমির ধারে এরকম ঘাসবন দেখেছি।

ডক্টর মিত্র বললেন, জ্যোতির্ময়ের পুঁথির একটা পাতাতেই এই দুটো স্কেচ ছিল। কিন্তু প্যানাসিয়া পাতার সঙ্গে এই ঘাসের সম্পর্ক কী? আরো আছে। দেখাচ্ছি। এই বলে তিনি ফাইলের তৃতীয় একটা পাতা খুললেন। এই ছবিটা দেখে আমি নড়েচড়ে বসলাম। এটা গাছের নয়, পাখির ছবি। আর পাখির ব্যাপারে আমি অল্প হলেও কিছু জানি।

ল্যাম্পের আলোয় ছবি-টা মন দিয়ে দেখলাম। প্যারাকিট জাতীয় কোনো পাখি যে, তাতে সন্দেহ নেই। মানে সোজা বাংলায় টিয়া জাতীয় পাখি। আমাদের দেশে এরকম পাখি বেশ কয়েকটা রয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলোকে আমরা ঘরের আশেপাশেই দেখতে পাই—যেমন গলায় কণ্ঠিওলা টিয়া, ডানায় লাল ছোপওলা চন্দনা, লাল-মাথা ফুলটুসি। আবার ছোট্ট লরিকিট কিংবা স্লেট রঙের মাথাওলা টিয়াকে মানুষের ঘরবাড়ির কাছে দেখা যায় না। কিন্তু ভিষগরত্নমশাই এটা যে কোন জাতের টিয়ার ছবি এঁকেছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। তার জন্যে অবশ্য আমাকে দোষ দেওয়া যায় না, ছবিতে রঙ না থাকলে টিয়া চেনা মুশকিল। চেহারা তো সবারই প্রায় একরকম, শুধু রঙেই যা তফাৎ।

তবে মনে হল টিয়ার মতন দেখতে ওই পাখিটার আকার খুব ছোট। নাকি ভিষগরত্নমশাই ছবিটা এঁকেছেনই ছোট করে? কে জানে?

ডক্টর মিত্রকে বললাম আমার ধারণার কথা। উনি ফাইলটা মুড়ে রেখে হতাশ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন। বললেন, একটা পাতাতেই তিনটে ছবি। শুকনো পাতা, ঘাসের শীষ আর টিয়াপাখি। ডেসক্রিপশন রয়েছে শুধু প্রথমটার। সেটা নাকি পৃথিবীর সমস্ত রোগ সারিয়ে দেয়। কিন্তু বাকি দুটোর সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? সম্পর্ক না থাকলে একই পাতায় তিনটে স্কেচ করবেন কেন?

আমিও এ রহস্যের মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারলাম না। রাত হয়ে গিয়েছিল। ঠিক করেছিলাম, পরদিন ভোরে উঠে কাজলকে নিয়ে হর্নবিলের বাসা খুঁজতে যাব। তাই আর দেরি না করে শুয়ে পড়লাম। আর সারাদিনের ক্লান্তির চাপে ঘুমিয়েও পড়লাম সঙ্গে সঙ্গেই।

পাঁচ

আজ ভারী অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতা হল। আলাপ হল প্রাচীন ভারতের এক ঋষির সঙ্গে। তাঁর নাম দয়াল সর্দার। সত্যি, মানুষটাকে দেখলে আর তাঁর সঙ্গে কথা বললে বৈদিকযুগের তপোবনবাসী ঋষি ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। ওইরকমই শান্ত চোখের দৃষ্টি, নব্বই বছর বয়সেও সটান শিরদাঁড়া। বুক অবধি লুটিয়ে পড়া ধবধবে সাদা দাড়ি।

শুধু তাঁর কুটিরটি তপোবনের পাতার কুঁড়ে নয়; একেবারে যন্ত্রযুগের লৌহ-শকট।

শুরু থেকেই বলি। প্ল্যান মতন আজ খুব ভোরে আমি আর কাজল বেরিয়ে পড়েছিলাম হর্নবিলের বাসা খুঁজতে। এই বাসার ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং। হর্নবিল বাসা বানায় গাছের কোটরে। গাছটা হতে হবে খুব উঁচু আর কোটরটা হতে হবে বেশ বড়। খুব পুরোনো গাছ ছাড়া অমন উচ্চতা আর অমন কোটর কোথায় পাওয়া যাবে? এদিকে জঙ্গলের যত পুরোনো গাছ সবই তো কাঠের জন্যে কেটে ফেলা হচ্ছে।

অনেকে ভাবেন একটা গাছ কেটে ফেলে তার বদলে আরেকটা গাছ লাগিয়ে দিলেই বোধহয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এর চেয়ে ভুল ধারণা যে আর কিছু হয় না, সেটা হর্নবিল পাখিরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করে দিচ্ছে। নতুন গাছের গুঁড়িতে তো আর কোটর থাকে না। তাই আজকাল শুধু বাসা বানানোর জায়গার অভাবেই সারা পৃথিবী থেকে হর্নবিল পাখিরা হারিয়ে যেতে বসেছে।

ভাগ্য ভালো, দীঘলবাড়ির জঙ্গলে এখনো বেশ কিছু অমন ‘আদিম মহাদ্রুম’ বেঁচেবর্তে রয়েছে। কিন্তু তারা রয়েছে প্রায় চল্লিশ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ঠিক কোন গাছটায় আমার দেখা সেই গ্রেট হর্নবিলের জোড়া বাসা বাঁধবার জন্যে কাঠকুটো নিয়ে গেল কেমন করে বুঝব?

কজলই আমাকে ইশারায় বোঝাল, দাদুর কাছে চলো। আমিও ইশারাতেই জিগ্যেস করলাম, কেন রে? তাতে ও চারিদিকের পাহাড়, নদী, জঙ্গলের দিকে একটা হাত ঘুরিয়ে আর একটা হাত নিজের মাথার ওপরে রাখল। বুঝলাম, এই বিশাল জঙ্গলের পুরোটাই ওর দাদুর মাথার মধ্যে ধরা রয়েছে। তা হতেই পারে। আমি যেমন কলকাতার কোন গলিতে ভালো রাধাবল্লভী পাওয়া যায় আর কোথায়ই বা ভালো স্যুট বানাবার ওস্তাগর সবকিছুই জানি, সেইরকম উনিও এই জঙ্গলের খুঁটিনাটি জানবেন সেটাই তো স্বাভাবিক। এখানেই তো উনি জন্মেছিলেন। তারপর প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়স অবধি এই দীঘলবাড়িতেই কাটিয়েছিলেন।

আর, যে-গাছের কোটরে একবার হর্নবিল বাসা বানায় সেই কোটরেই বছরের পর বছর হর্নবিলের বাসা বানানো চলতে থাকে। একটা পাখির জোড়া মরে গেলে তাদের পরের জেনারেশন সেই কোটরের দখল নেয়। কাজেই এরকম হতেই পারে যে পঞ্চাশ বছর আগে দয়াল সর্দার যে কোটরগুলোতে হর্নবিলের বাসা দেখে গিয়েছিলেন, তারই কোনো একটায় আমার দেখা পাখিগুলো বাসা বাঁধতে শুরু করেছে।

আমি তাই আপত্তি করলাম না। কাজলকে বললাম, চল। তোর দাদুর সঙ্গে আলাপ করে আসি।

আগেই শুনেছিলাম, উনি মালগাড়ির কামরার মধ্যে ঘর বেঁধেছেন, তবু প্রথম যখন ঘরটা দেখলাম তখন ভারী অবাক হলাম। কেউ বলে না দিলে জঙ্গলের মধ্যে ঘরটাকে খুঁজে বার করা অসম্ভব। দু’দিকে বড় বড় গাছের সারি। মাথার ওপরে লতার চাঁদোয়া। তারই নীচ দিয়ে মিটার-গেজের রেল-লাইন চলে গেছে হাতিবাড়ির দিকে। লাইনটার একদম গোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে খোলা ওয়াগানটা। লোহার চাকার ওপর লোহার মেঝে। একদিন ওই মেঝের ওপরে চাপিয়ে দীঘলবাড়ি থেকে আলিপুরদুয়ার অবধি ডোলোমাইট পাথর নিয়ে যাওয়া হত। এখন ওর ওপরে বাঁশ, কাঠ আর শুকনো পাতা দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে একটা কুঁড়েঘর। মাটি থেকে কুঁড়েঘরের দরজা অবধি একটা কাঠের মই ঠেকানো রয়েছে। ওই মইটা তুলে নিলেই ঘরটা বন্যজন্তুদের হাত থেকে নিরাপদ।

তাছাড়া এসব জায়গায় বর্ষাকালে প্রায়ই বন্যা হয়ে যায়। তখনও ওই উঁচু মেঝে ঘরটাকে বাঁচায়।

মনে মনে স্বীকার করলাম, দয়াল সর্দার ঘর বানাবার জায়গাটা খারাপ পছন্দ করেননি।

ওই মই বেয়েই কাজলের পেছন পেছন ঘরে ঢুকলাম। দয়াল সর্দারকে কেমন দেখলাম সে তো শুরুতেই বলেছি। আরো অদ্ভুত লাগল ওনার কথা শুনে। আমার ধারণা ছিল, শিকারি জাতের লোক যখন, তখন বনের পশুপাখিদের উনি বোধহয় কুমড়ো-কচুর মতন দেখেন। মারো আর খাও—এটাই বোধহয় সম্পর্ক। কিন্তু দুটো কথা বলেই বুঝলাম, পশুপাখিদের উনি যতটা ভালোবাসেন অতটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

একটা সময় কথা বলতে বলতে আমরা মই বেয়ে ঘরের বাইরে নেমে এলাম আর দয়াল সর্দারকে ঘরের বাইরে দেখামাত্র গাছ থেকে যতরকমের পাখি, কাঠবেড়ালি এমনকি একজোড়া বুনো খরগোশ অবধি লাফাতে লাফাতে এসে ওনাকে ঘিরে ধরল। উনিও ধুতির খুঁট থেকে বাদামের মতন কি যেন মুঠোয় ভরে ওদের দিকে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন। পাখি আর কাঠবেড়ালিগুলো ওনার সারা শরীর জুড়ে খেলা করে বেড়াচ্ছিল।

এর পরেও যদি তপোবনের কথা মাথায় না আসে তাহলে তো বলতে হবে আমার মাথায় গণ্ডগোল আছে।

দয়াল সর্দার বললেন, উনি পশু-পাখিদের কথা বুঝতে পারেন। ওরাও নাকি দয়াল সর্দারের কথা বোঝে। আমি কথাটা অবিশ্বাস করলাম না।

হর্নবিলের বাসার কথা বলতে উনি এককথায় আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেলেন। চলতে চলতে অবধারিতভাবেই প্যানাসিয়া প্রসঙ্গ এল। আমিই বললাম, শুনেছি আপনি নাতির অসুখ সারাবার জন্যে এই জঙ্গলে পড়ে আছেন?

উনি হাসলেন। বললেন, জঙ্গলে আবার আলাদাভাবে কী পড়ে থাকব? জঙ্গলই তো আমাদের মা। জঙ্গলের বুকেই তো আমরা থাকি। হ্যাঁ, বলতে পারেন নিজের আত্মীয়দের থেকে দূরে পড়ে আছি।

আমি বললাম, দুঃখিত। আমার কথাটা ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি নাকি এক আশ্চর্য পাতার খবর জানেন, যার রস পেটে গেলে যে কোনো অসুখ সেরে যায়?

উনি বললেন, ঠিকই শুনেছেন। অমৃত পাতা। আমাদের জাতের লোকেরা ওই পাতাকে দেবতা মানে।

দয়াল সর্দার গল্প করতে করতে বললেন, অমৃত পাতার ম্যাজিকের অন্তত একটা উদাহরণ উনি ছোটবেলায় দেখেছেন। লেপার্ডের আঁচড়ে ওনাদের গ্রামের একটা ছেলের পায়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে যায়। তখন গ্যাংগ্রিনের মানে ছিল অবধারিত মৃত্যু। কিন্তু সেই সময়ে গাঁয়ের যিনি মোড়ল ছিলেন তিনি একাই বেরিয়ে পড়েন অমৃত পাতার খোঁজে। তারপর সেই অমৃত পাতা রোজ একটি করে চিবোনোর ফলে সাতদিনের মধ্যে ছেলেটার পায়ের বিষাক্ত ঘা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যায়।

ওনার কথা শেষ হবার পর আমি বললাম, দুটো জিনিস জানতে ইচ্ছে করছে। বলব?

বলুন।

অমৃত পাতার খোঁজে মোড়ল একা গিয়েছিলেন কেন?

সেটাই বরাবরের নিয়ম। শুধু গাঁয়ের মোড়লেরাই জানবেন কোথায় ওই পাতা পাওয়া যায়। মৃত্যুর সময় এক মোড়লমশাই পরবর্তী মোড়লের কানে কানে বলে দিয়ে যান অমৃত পাতার হদিস। এই গোপনীয়তা না থাকলে সকলে মিলে ওই পাতার উৎসকে নষ্ট করে দিত না?

আমি বললাম, সে কথা ঠিক। এবার দ্বিতীয় প্রশ্নটা করি। আপনার নব্বই বছরের জীবনে মাত্র একবার কেন দেখেছেন ওই আশ্চর্য পাতার গুণ? আপনাদের মোড়লমশাই যখন ইচ্ছে নিয়ে আসতে পারেন না ওই পাতা?

দয়াল র্সদার একটু অবাক হয়ে বললেন, সেকি! আপনি জানেন না? মিত্রবাবু আপনাকে বলেননি?

কী বলবেন?

অমৃত পাতা যে সবসময়ে পাওয়া যায় না? বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকতে হয় তার জন্যে। সে যে কখন ফুটবে সে কথা কোনো মানুষই জানে না। মোড়লও না। না হলে আমিই বা কেন দু’বছর ধরে এখানে অপেক্ষা করে বসে আছি, বলুন।

যখন ফুটবে তখন কেমন করে সেই গাছকে চিনবেন? কেমন করে বুঝবেন, এত বড় জঙ্গলের মধ্যে কোথায় ফুটল অমৃত গাছের চারা?

দয়াল সর্দার বললেন, আমাদের গাঁয়ের মেয়েরা কত যুগ ধরে কে জানে ঘরের দেয়ালে অমৃত পাতার ছবি এঁকে রাখে। ওরা বিশ্বাস করে, তাহলে ঘরে অসুখ-বিসুখ ঢোকে না। শুধু দেয়ালেই নয়, তুলোট কাগজের পটেও ওই অমৃত পাতার ছবি এঁকে ঠাকুরের আসনে রেখে দেয় ওরা। সেরকম একটা পট সঙ্গে নিয়ে এসেছি, ছবি দেখে গাছের পাতা মিলিয়ে নেব বলে।

উনি কাজলকে ইশারা করলেন একটা কিছু নিয়ে আসার জন্যে। কাজল এক দৌড়ে ঘরের ভেতর থেকে একটা গুটিয়ে রাখা কাগজ নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিল।

খুলুন! দয়াল সর্দার বললেন।

মোড়কটা খুললাম এবং যা দেখলাম তাতে অনেকক্ষণ আমার মুখ দিয়ে কথা সরল না জ্যোতির্ময় ভিষগরত্ন তাঁর পুঁথিতে সাদা-কালোয় যে ছবি এঁকেছিলেন এখানে মোটামুটি সেই ছবিই রং দিয়ে আঁকা। হয়তো গ্রামের মেয়ের অপটু হাতের আঁকা বলে ডিটেইলস একটু কম এসেছে। তবু রোঁয়ায় ঢাকা পানপাতার মতন পাতাটাকে চিনতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। পাতাটার ছবি দেখে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছিলাম তার দু’পাশের দুটো ছবি দেখে।

একটা ঘাসের শীষ।

আর একটা টিয়াপাখি।

ঘাসের রং কখনো ওরকম টকটকে লাল হয় না আর ওরকম ময়ূরকণ্ঠি রঙের টিয়াপাখিও রূপকথার বইয়ের বাইরে দেখা যায় না। বোঝাই যাচ্ছে, গান শুনে যে মেয়েটা ছবি এঁকেছে, তার আঁকার মধ্যে নিজের কল্পনার রং মিশে গিয়েছে। তবু অমৃত পাতার সঙ্গে ঘাসের শীষ আর টিয়াপাখির সম্পর্ক এই পটচিত্র থেকে আবার প্রমাণিত হল।

আমি ছবিটার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই দয়াল সর্দারকে জিগ্যেস করলাম, দয়ালজি, এই ছবি দুটোর মানে কী? এই ঘাসের শীষ আর টিয়াপাখি?

দয়াল সর্দার নিজেও ঝুঁকে পড়ে ছবিটা ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, ঠিক বলতে পারব না বাবুজি। সবকিছুর কি আর মানে থাকে? আপনারা লক্ষ্মীর আলপনায় ধানের শীষ আঁকেন না? আমি তো জন্ম থেকে যখনই অমৃত পাতার ছবি দেখেছি তখনই তার দু’পাশে অমন ঘাসের শীষ আর টিয়াপাখির ছবি দেখেছি। টিয়াপাখিকে ওই পাতাদেবতার বাহন বলে অনেকে।

টিয়াপাখি ওই পাতাদেবতার বাহন? কথাটা শোনার পর থেকেই কী যেন একটা মনে পড়ব পড়ব করেও মনে পড়ছিল না। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর হাল ছেড়ে দিয়ে পটচিত্রটা কাজলের হাতে ফিরিয়ে দিলাম।

ছয়

পরের কয়েকটা দিন আমার নিজের কাজ নিয়ে মেতে উঠেছিলাম। প্যানাসিয়ার কথা তাই মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল।

দয়াল সর্দারের কল্যাণে খুঁজে পেয়েছিলাম হর্নবিলের বাসা। আকাশছোঁয়া একটা ওদলা গাছের একেবারে মাথার কাছে একটা কোটরে সেই হর্নবিল পাখি দুটো বাসা বানাতে শুরু করেছিল। আমি জানতাম, কোটরের ভেতর খড়কুটোর বিছানা বানানো শেষ হলেই মা-পাখিটা ওই বাসায় ঢুকে পড়বে। তারপর নিজের বিষ্ঠা দিয়ে কোটরের মুখে তুলে দেবে একটা শক্তপোক্ত দেয়াল। সেই দেয়ালের গায়ে থাকবে ছোট্ট একটা ফুটো। পরের দু’মাস ওই বন্ধ কোটরে বসে মা-পাখি ডিমে তা দেবে আর বাবা-পাখি ওই ছোট ফুটোটার মধ্যে দিয়ে বাইরে থেকে মা-পাখির ঠোঁটে খাবার তুলে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

দু’মাস বাদে ডিম ফুটে ছানা বেরোবে। তখন মা-পাখি দেয়াল ভেঙে বাইরে বেরিয়ে আসবে। তারপর মা-পাখি আর বাবা-পাখি দুজনে মিলে বাচ্চাদের জন্যে খাবার নিয়ে আসবে। এইরকমই চলবে যতক্ষণ বাচ্চাগুলো বড় হয়ে উড়তে না শেখে।

এই পুরো ঘটনাটা ভিডিওতে তুলে রাখবার জন্যে কাজলের সাহায্য নিয়ে আমাকে কাছাকাছি একটা গাছের ওপর মাচা বানাতে হল, আর সেই মাচার ওপর বেশ শক্তপোক্ত লুকোনো একটা ঘর। ভোরবেলায় ব্যাগে কিছু শুকনো খাবার, জলের বোতল আর ক্যামেরা নিয়ে ওই মাচা-ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়তাম। নামতাম বিকেলবেলায়, পাখি দুটো কোটরের পাশে একটা ডালে যখন সব কাজ শেষ করে ডানা মুড়ে বসত, তখন। পাখি দুটো আমাকে দেখতে পেত না, কিন্তু আমি দিব্যি ওদের বাসা বানানোর প্রত্যেকটা স্টেজের ছবি তুলে যাচ্ছিলাম।

এর মধ্যেই একদিন একটা কাণ্ড হল। সেদিন হর্নবিলদের কাণ্ডকারখানা দেখতে দেখতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গিয়েছিল। মাচা থেকে যখন নামলাম তখন অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। ঘরে ফেরার সময় একটা দাঁতাল হাতির মুখোমুখি পড়ে গেলাম।

এই দলছুট একলা দাঁতালগুলো বেশ খ্যাপাটে হয়। বিনা কারণেই মানুষকে চার্জ করে। এদের ইংরেজিতে বলা হয় rogue elephant। পায়ে চলা সরু রাস্তার একটা বাঁক ঘুরতেই একদম ওটার মুখোমুখি পড়ে গেলাম। আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম, হাতিটার কান দুটো মাথার পেছনে লেপটে গেছে। শুঁড় গুটিয়ে নিয়েছে দাঁতের নীচে। এই সবই চার্জ করার পূর্বলক্ষণ। হাতির সঙ্গে দৌড়ে পারা যায় না, বিশেষত যেখানে আমার আর ওর মধ্যে মাত্র পনেরো ফুটের তফাৎ। আমি মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।

হঠাৎ খুব শান্ত গলায় একটা ডাক ভেসে এল—শিবা….শিবা….শিবা!

ডাকটা আসছিল হাতিটার পেছনদিক থেকে। হাতির শরীরের আড়ালের জন্যেই আমি মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না।

আবার সেই ডাক। শিবা….শিবা….শিবা! চলে আয়। আয়, আয়।

আশ্চর্য ব্যাপার। সেই ডাক শুনে হাতিটা হঠাৎ আমাকে খুন করার মতলব ছেড়ে পেছন ফিরল। যিনি ওকে ডাকছিলেন তাঁকে এবার আমি দেখতে পেলাম। দয়াল সর্দার। খ্যাপা হাতিটা মাথা নাড়াতে নাড়াতে গিয়ে দাঁড়াল ওনার সামনে। উনি কি বললেন জানি না, শেষ একবার একটা হুংকারে আমার বুক কাঁপিয়ে দিয়ে সেই খ্যাপা হাতি হুড়মুড় করে রাস্তার ধারের বনের মধ্যে ঢুকে গেল।

মৃত্যুর মুখ থেকে সদ্য ফিরে এসে আমার তখন আর দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা ছিল না। সারা শরীর কাঁপছিল। আমি সেই ধুলোয়-ভরা কাঁচা রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছিলাম। দয়াল সর্দার এসে আমার হাত ধরে টেনে তুললেন। বললেন, এরকম দেরি করবেন না। জঙ্গলকে সম্মান দিয়ে চলবেন, তা নাহলে সে শোধ নিয়ে নেবে।

আমি হাঁফাতে হাঁফাতে প্রশ্ন করলাম, বুনো হাতিও আপনার কথা শোনে?

সব হাতি শোনে না। এ তো পাড়ার মস্তান। এখানেই থাকে। তাই আমাকে চেনে, আমার কথা শোনে।

তারপর থেকে আমি বাড়ি ফিরতে আর দেরি করিনি।

সাতটা দিন কেটে গেল। এই ক’দিন আমি আমার মতন ধনেশ পাখির ছবি তুলেছি। দয়াল সর্দার আর ডক্টর সব্যসাচী মিত্রও নিজেদের মতন করে প্যানাসিয়া কিংবা অমৃত পাতা খুঁজে বেড়িয়েছেন। তবে বেশিরভাগ সময় সব্যসাচী মিত্রকে দেখেছি একটু দূর থেকে দয়াল সর্দারের ওপর নজর রাখতে। উনি নিশ্চয় জানেন, ওনার শহুরে চোখকে সেই গাছ এড়িয়েও যেতে পারে, অরণ্যচারী দয়াল সর্দারের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না।

উনি কি তখন দয়াল সর্দারের কাছ থেকে সেই পাতা কেড়ে নেবেন?

কিছুই অসম্ভব নয়। পরশু রাতেই খাওয়া-দাওয়ার পর যখন আমি আর ডক্টর মিত্র বারান্দায় বসেছিলাম, তখন ওনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, সত্যিকারেই যদি এরকম কোনো প্যানাসিয়া খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে কী হবে?

উনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলেন, লাল হয়ে যাব।

কথাটা আমার কানে ভীষণ খারাপ শুনিয়েছিল। একজন বিজ্ঞানীর মনে কি পয়সার কথাটাই প্রথম আসবে? প্যানাসিয়া মানুষের জীবনকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, সেটা ভাববেন না?

ডক্টর মিত্র গতকাল রাতে আমাকে বললেন, নীল, পরশু এশিয়াটিক সোসাইটি-তে আমাকে একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে হবে। তাছাড়া আমার আন্ডারে যে ক’জন স্টুডেন্ট পি এইচ ডি করছে তাদেরও পড়াশোনা একটু দেখিয়ে দিয়ে আসতে হবে। আমি তাই আগামীকাল এক সপ্তাহের জন্যে কলকাতা ফিরে যাচ্ছি।

আমি বললাম, আমিও কি তাহলে…

উনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন। বললেন, আরে আমি কি তোমাকে ঘর ছাড়তে বলেছি নাকি? তুমি যেমন আছ থাক। চাল-ডাল, মশলাপাতি যা আছে এখনো দশদিন হেসেখেলে চলে যাবে। আর আমি যখন ফিরব, তখন তো আবার স্টোর কিনে নিয়েই ফিরব। ওইসব বয়ে আনবার জন্যে আমার সঙ্গে দুটো ছেলেও থাকবে। কোনো চিন্তা নেই।

তারপর গলা নামিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, তুমি থাকলে বরং আমার সুবিধেই হবে। এর আগে যতবার এইভাবে দীঘলবাড়ি ছেড়ে গিয়েছি ততবারই মনে খুব টেনশন নিয়ে গিয়েছি। সারাক্ষণ টেনশনে থাকতাম, দয়াল সর্দার প্যানাসিয়া নিয়ে চম্পট দেবে না তো? এবার আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারব, কারণ, তুমি রইলে। একটু বুড়োর ওপরে নজর রেখো বুঝলে। এমনিতে তো লোকটা খুব সরল, কিছু খুঁজে পেলে তোমাকে নিশ্চয় বলবে। তুমি লোকেশনটা একটু মনে রাখবে, যাতে আমি ফিরলে আমাকে দেখিয়ে দিতে পার। তারপর যা করতে হবে আমি বুঝে নেব।

শেষ কথাটা বলবার সময় ডক্টর সব্যসাচী মিত্রের সৌম্য মুখটা হঠাৎই কেমন যেন ভেঙেচুরে শয়তানের মতন হয়ে গেল। নাকি, আমারই চোখের ভুল? কে জানে!

আমার দীঘলবাড়ি পৌঁছনোর অষ্টমদিনে ডক্টর সব্যসাচী মিত্র কলকাতায় ফিরে গেলেন, আর সেইদিনই সন্ধেবেলায় আমি মাচা থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরিভাবে পা মচকালাম। অতএব ন-নম্বর দিনটা আর ধনেশ পাখির ছবি তুলতে যেতে পারলাম না। বাড়িতেই বসে রইলাম।

দয়াল সর্দার মচকানোর জায়গাটায় কি একটা পাতার রস গরম করে মাখিয়ে দিয়ে কলাপাতার মতন আরেকটা পাতার টুকরো দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন। এমনই আশ্চর্য সেই চিকিৎসা যে, দুপুরের মধ্যে দেখি ফোলা-টোলা কমে গিয়েছে। অল্প অল্প ব্যথা তখনো ছিল। তাই জঙ্গলের দিকে পা বাড়ালাম না। কিন্তু দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর কাজল একটা ছিপ নিয়ে এসে যখন আমাকে ইশারায় মাছ ধরতে যাবার ডাক দিল, তখন না যাবার কোনো কারণই দেখতে পেলাম না। সত্যি কথা বলতে কি ঘরে শুয়ে থাকতে খুবই বোর লাগছিল। ওর সঙ্গে একটু বেরোবার সুযোগ পেয়ে বাঁচলাম।

কাজলও এই জঙ্গলকে হাতের তালুর মতন চেনে। জানোয়ারদের পায়ে পায়ে তৈরি হওয়া সুঁড়িপথ ধরে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেল যে জায়গাটায় আমি আগে কোনোদিন আসিনি। এখানে বিশাল গাছেদের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে ছোট একটা লেক। তার জলের রং ঘন নীল। লেকের পাড়ে অনেকটা পরিষ্কার ঘাসজমি। সেখানে নানা রঙের ঘাসফুল ফুটে আছে। জায়গাটার সৌন্দর্য ভাষায় বোঝানো যায় না।

কাজল লেকের এক কোনায় চার ছড়িয়ে মাছ ধরতে বসে গেল। আমি পাড় বরাবর পায়চারি করতে করতে গুনগুন করে গান গাইছিলাম। একটু বাদে বাদেই হাওয়ার ভেতর দিয়ে ছিপ টানবার সাঁইই শব্দ আর তার সঙ্গে কাজলের উল্লাসধ্বনি কানে আসছিল। তার মাছ উঠছে মন্দ নয়।

কিছুক্ষণ হাঁটার পরে মনে হল, এতটা বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। কালকেই পায়ে এত বড় চোট লেগেছিল, আজ এত হাঁটাহাঁটি করা ঠিক হচ্ছে না। আমি একটা পাথরের ওপর পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম।

আমি যেখানটায় বসেছিলাম ঠিক তার পেছনদিকেই লেকের উঁচু পাড় ঢালু হয়ে মিশেছিল বনের গাছপালার সঙ্গে। আমি সাবধানতা হিসেবেই একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিতে গেলাম যে, ওই জঙ্গল-লাগোয়া জায়গাটায় সাপখোপ আছে কি না।

সাপ দেখতে পেলাম না। তবে যা দেখলাম তাতে পায়ের ব্যথা ভুলে লাফ মেরে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

দেখলাম একরকমের ঘাসে পুরো জমিটা ঢাকা পড়ে গেছে। সেই ঘাসের মাথায় লম্বা লম্বা শীষ। শীষের গায়ে ছোট ছোট বীজের দানা। আর পাতা, শীষ, বীজ সবকিছুরই রং লাল—আলতার মতন টকটকে লাল।

সাত

আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম সেই ঘাস দিয়ে বোনা প্রকৃতির লাল কার্পেট। একেবারে কপালজোরেই এখানে পৌঁছে গিয়েছি। না হলে লেকের উঁচু পাড় আর জঙ্গলের মাঝখানে ওই একফালি জমিটার অবস্থান এমনই যে, দশহাত দূর থেকেও দেখতে পাওয়া অসম্ভব।

কিন্তু সে তো মানুষদের কথা। আর যাদের দেখার তারা ঠিকই দেখেছে। পুরো জমিটা জুড়ে যেন পশুপাখি আর পতঙ্গদের মেলা বসে গেছে। দুটো হরিণ এমন মন দিয়ে ওই লাল ঘাস খেয়ে যাচ্ছে যে, এত কাছে আমি এসে দাঁড়িয়েছি, সেদিকে খেয়ালই নেই। ব্রাউন স্কুইরেলের দল ঘাসের শীষগুলোর ওপরে চড়ে দানা খাচ্ছে। অজস্র মুনিয়া পাখিও ওই একই কাজে ব্যস্ত। আর ভোমরার মতন নানারকমের পোকার তো শেষ নেই।

আমি একবার লেকের অন্য পাড়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম, কাজলের সমস্ত মনোযোগ এখন ছিপের ফাতনার দিকে। আর কিছুই ও দেখছে না। আমি পায়ে পাসে ঘাসজমিটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর সাবধানে একটা শীষের গা থেকে কয়েকটা বীজ ছাড়িয়ে এনে মুখে পুরে দাঁতের আলতো চাপ দিলাম। সঙ্গে সঙ্গেই মিষ্টি রসে আমার মুখ ভরে গেল। কোনো ঘাসের বীজ যে এমন সুস্বাদু আর সুগন্ধী হতে পারে তা আমার ধারণা ছিল না।

আমি আবার পায়ে পায়ে উঠে এলাম লেকের ধারে। তারপর একটা চক্কর দিয়ে কাজলের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বাকি সময়টা কাজলের মাছধরা দেখেই কাটিয়ে দিলাম। সন্ধের আগেই কাজল ছিপ-টিপ গুটিয়ে উঠে পড়ল। ইশারায় বলল, চলো, ফেরা যাক।

এখানে আসার সময় কিছুই খেয়াল করে দেখিনি, কাজলের পেছন পেছন অন্ধের মতন চলে এসেছিলাম। ফেরার সময় কিন্তু কোথায় কখন কোনদিকে বাঁক নিচ্ছি সব মুখস্থ করতে করতে ফিরলাম। এরপর থেকে আমি একাই ওই লেকে পৌঁছতে পারব। পৌঁছতে আমাকে হবেই।

আমি বুঝতে পারছিলাম না ওই লাল ঘাসের সঙ্গে অমৃত পাতার সম্বন্ধ কী? কিন্তু সম্বন্ধ যে একটা আছেই এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না। ঠিক করলাম, ওই লাল ঘাসের বনের দিকে যতটা পারি নজর রাখব।

পরের দুটো দিন হর্নবিল দেখতে যাওয়ার নাম করে ওই লেকের ধারে গিয়ে বসে রইলাম। কিছুই ঘটল না। তৃতীয়দিন সকালে গিয়ে দেখলাম ওরা এসেছে।

ওই ময়ূরকণ্ঠী রঙের টিয়ারা।

তখন সকালের আলোয় লাল ঘাসের বন চুনিপাথরের মতন ঝলমল করছিল। অন্যদিন যারা ছিল সকলেই ছিল—সেই হরিণ, কাঠবেড়ালি, মুনিয়া আর ভ্রমরের ঝাঁক। শুধু আজ তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ছটা টিয়াপাখি। তারা ঘাসের শীষের ওপর ঝুলতে ঝুলতে বীজে ঠোকর মারছিল আর মাঝে মাঝেই উল্লাসে ঠ্যাঁ ট্যাঁ করে ডেকে উঠছিল। কখনো একদম বিনা কারণেই আকাশে একটা চক্কর মেরে আবার এসে বসছিল ঘাসের শীষের ওপর।

ওই ঘাস যেমন আমার অচেনা, এই টিয়ারাও আমার অচেনা।

আমি চোখ তুলে তাকালাম সামনের দিকে। বনের গাছের মাথা পেরিয়ে যতদূর চোখ যায় পাহাড়, শুধু পাহাড়। ওই পাহাড়ের ঢেউ ভারতের সীমা ছাড়িয়ে ভুটান ছাড়িয়ে চলে গেছে রহস্যময় তিব্বত মালভূমির দিকে। তার কতটুকু আর আমরা চিনি? এমন কত অচেনা পাখি, কত অচেনা লতা পাতা ফুল যে এখনো হিমালয়ের বুকে লুকিয়ে আছে কে জানে।

এই পাখিরাও নিশ্চয় হিমালয় পেরিয়েই এসেছে। এসেছে ওই ঘাসের বীজের টানে। ওরা নিশ্চয় জানে কখন, কত বছর পরে, কোথায় মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা বীজ থেকে মাথা তুলবে লাল ঘাসের চারা। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠবে। মাটির ওপরে বীজে ভরা শীষের চামর দোলাবে দু’মাস কি বড়জোর তিনমাস। সেই দু-তিন মাসের জন্যেই এখানে ছুটে আসবে ময়ূরকণ্ঠী টিয়ারা।

এইভাবেই ওরা হাজার বছর ধরে আসছে। হাজার বছর আগেও দয়াল সর্দারের অরণ্যবাসী পূর্বপুরুষেরা ওই ঘাস দেখেছিল, ওই পাখি দেখেছিল। হয়তো অমন সুন্দর আর দুর্লভ বলেই তারা ওই ঘাস আর পাখিকে দেবতার মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু….

কিন্তু সবার ওপরে তারা স্থান দিয়েছিল অমৃত পাতাকে। সেই পাতা কোথায়?

জ্যোতির্ময়ের পুঁথির তিনজনের মধ্যে দুজন যখন উপস্থিত, তখন তিননম্বরও কি বেশিদিন দূরে থাকবে? কোথায় ফুটে উঠবে সেই অমৃতপত্র, সেই সাতরাজার স্বপ্ন…..প্যানাসিয়া?

সারাদিন ধরে সেই ছটা পাখিকে ওয়াচ করলাম। ছটা পাখি মানে তিনটে পেয়ার। একটা পুরুষপাখি আর একটা স্ত্রীপাখিকে নিয়ে এক একটা পেয়ার। পুরুষপাখিগুলোর গলার কাছে একটা হলুদ ছোপ আছে, মেয়েপাখিগুলোর নেই। তাই দেখেই ওদের আলাদা করতে পারছিলাম।

আমি ভাবছিলাম হয়তো পাহাড় পেরিয়ে অমন ময়ূরকণ্ঠী টিয়ার আরো ঝাঁক এখানে, এই ঘাসবনে এসে নামবে। কিন্তু না। পরের দু’দিনে আর একটাও অমন পাখি এল না। পরিযায়ী পাখিদের স্বভাব তারা একই সঙ্গে একইদিকে যাত্রা করে। এই যে আর কোনো ময়ূরকণ্ঠী টিয়া এল না, এর একটাই মানে দাঁড়ায়। অমন টিয়া আর নেই।

সারা পৃথিবীতে মাত্র ছটা পাখি? আমি কি তাহলে সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবার আগে একটা প্রজাতির শেষ কয়েকটা পাখিকে দেখছি?

এককালে নিশ্চয় ওরা সংখ্যায় অনেক ছিল। না হলে দয়াল সর্দারের জাতের লোকেরা ওদের বছরের পর বছর ধরে দেখেছিল কেমন করে?

আজ ওরা হারিয়ে যাচ্ছে কেন? সে কি লাল ঘাস হারিয়ে যাচ্ছে বলে? তাই হবে। পরিবেশ বদলাচ্ছে। বাড়ছে বাতাসের তাপমাত্রা, গলে যাচ্ছে গ্লেসিয়ার। আর তার সঙ্গেই প্রতিদিন কত ঘাস, লতা, কত অর্কিড, প্রজাপতি মুছে যাচ্ছে প্রকৃতির কোল থেকে। হয়তো লাল ঘাসও সেরকমই এক লাজুক প্রজাতি, যে বদলে যাওয়া পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি। কমতে কমতে, পেছু হটতে হটতে, এখন এসে ঠেকেছে এই লেকের ধারের একটুকরো জমিতে।

আর সেই একটুকরো জমিতেই এখন মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে ছ’টা ময়ূরকণ্ঠী টিয়া।

তৃতীয়দিন ওখানে যেতে পারিনি, কারণ আমার ধনেশ পাখিরাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করেছিল….বাসার দরজা সীল করার কাজ। সেই ছবিটা তুলে রাখা ভীষণ জরুরি ছিল আমার কাছে, যদিও মন পড়েছিল ওই লেকের দিকে। চতুর্থদিন সকাল হতে না হতেই তাই লেকের ধারে চলে গেলাম আর গিয়েই যা দেখলাম, তাতে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। দেখলাম ময়ূরকণ্ঠী টিয়ারা বাসা বাঁধার উদ্যোগ নিচ্ছে।

লেকের ধারে তিনটে আলাদা আলাদা গাছের কোটরে ওরা বারবার মুখে খড়কুটো নিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

পরদিন আমি কাজল আর দয়াল সর্দারকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম লেকের ধারে। দেখালাম লাল ঘাসের জঙ্গল আর ময়ূরকণ্ঠী টিয়াদের বাসা বাঁধার উদ্যোগ। দয়াল সর্দার আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরে বারবার আমাকে আশীর্বাদ করতে শুরু করলেন। ওনার বিশ্বাস, এতদূর যখন সত্যি হয়েছে, তখন অমৃত পাতাও আমাদের কাছে ধরা দেবে। কীভাবে?

তা উনি জানেন না।

কিন্তু একটা অস্বস্তি কিছুতেই আমার মনকে ছেড়ে যাচ্ছিল না। কী যেন একটা জানা জিনিস ভুলে যাচ্ছি? এইযে হঠাৎ করে একটা জায়গায় একটা মরশুমি ঘাসের মাথা চাড়া দেওয়া, তার সঙ্গে নেমে আসা টিয়ার ঝাঁক…. কোথায় যেন এমন কিছু পড়েছিলাম? নাকি কারুর মুখে শুনেছিলাম এমন গল্প? ঠিক করলাম একবার শুভঙ্করদাকে ফোন করব।

শুভঙ্কর বসু একজন নামকরা অরনিথোলজিস্ট, মানে পক্ষীবিজ্ঞানী। এখন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটিতে গবেষণা করছেন। উনি আসলে কিন্তু আমাদের বরানগরেরই মানুষ। শুভঙ্করদা যতদিন কলকাতায় ছিলেন, প্রায়ই ওনার বাড়িতে চলে যেতাম। উলটেপালটে দেখতাম পাখির ওপর অজস্র বই আর ম্যাগাজিন। উনিই আমাকে গল্পের ছলে পাখিদের অ আ ক খ শিখিয়েছিলেন।

সেইজন্যেই পরদিন আর কোথাও না গিয়ে চড়াই বেয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে শুরু করলাম। হাতে খোলা মোবাইল। আন্দাজ পাঁচশো ফিট উঠে যাওয়ার পর একটা জায়গায় হঠাৎ বেশ পরিষ্কার টাওয়ার ধরতে পারলাম। ওখানে চারিদিকের গাছপালা বেশ হালকা। পাহাড়ের দেয়ালও দূরে সরে গিয়েছিল। হয়তো সেইজন্যেই সিগনাল আসছিল।

ভাগ্য ভালো। এক চান্সেই শুভঙ্করদাকে পেয়ে গেলাম। উনি বললেন, কীরে নীল, খবর কী? কোথায় আছিস এখন?

শুভঙ্করদাকে সংক্ষেপে আমার প্রোজেক্ট-হর্নবিলের কথা বললাম। শুনে খুব খুশি হলেন। কয়েকটা প্রয়োজনীয় পরামর্শও দিলেন। আমি বললাম, শুভঙ্করদা, আরেকটা ব্যাপারে তোমাকে ফোন করেছিলাম। আচ্ছা, একটা জায়গায় হঠাৎ একরকমের ঘাস জন্মাচ্ছে আর তার দানা খাওয়ার জন্যে বহু দূর থেকে ছুটে আসছে পাখির ঝাঁক—এরকম একটা ঘটনা তুমিই কি আমাকে বলেছিলে?

শুভঙ্করদা ফোনের মধ্যেই হইহই করে উঠল। বলল, আরে তুই তো দেখছি স্প্লেনডিড-প্যারাকিটের কথা বলছিস। সাউথ অস্ট্রেলিয়ার পাখি। দারুণ কালারফুল।

আমি বললাম, ময়ূরকণ্ঠী রং কী?

শুভঙ্করদা বলল, ধুত, ওরকম রঙের কোনো টিয়া আছে বলে তো জানি না। তবে তুই যেরকম বলছিলিস, ওই স্প্লেনডিড-প্যারাকিটরা ঠিক ওইরকমই করে। সাউথ অস্ট্রেলিয়া তো মরুভূমির দেশ। কিন্তু কখনো কোথাও এক পশলা বৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে একটা প্রাণের মেলা বসে যায়। বৃষ্টির জল পেয়ে শুকনো মাটি ফুঁড়ে মাথা তোলে ঘাসের বন। দেখতে দেখতে ফুলে আর বীজে ভরে যায় সেইসব ঘাসের শীষ। কীট-পতঙ্গেরা ভিড় জমায়। তাদের খেতে ছুটে আসে গিরগিটি আর টিকটিকি। তাদের পেছন পেছন আসে নানা জাতের সাপ।

কিন্তু সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার হাজার মাইল দূরে থাকলেও স্প্লেনডিড-প্যারাকিটদের কাছেও কেমন করে যেন খবর পৌঁছে যায় যে, ওখানে ঘাস গজিয়েছে। তারা যাযাবরের মতন সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যায়। যতদিন খাওয়ার মতন ঘাসের বীজ আছে ততদিনের মধ্যেই বাসা বেঁধে, ডিম পেড়ে, বাচ্চা বড় করে, আবার কোনদিকে উড়ে পালায় কে জানে। বছরের পর বছর আর তাদের ওখানে দেখতে পাবি না। আবার ওরা ফিরে আসবে যখন ঘাস গজাবে তখন।

আমি বললাম, শুভঙ্করদা, তুমি সত্যি জানো, আমাদের ভারতবর্ষে ওরকম কোনো পাখি আসে না?

শুভঙ্করদা বলল, না। এখানকার টিয়ারা সকলেই ছোটখাটো এরিয়ার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এখানে তো অত খাবারের অভাব নেই, কোন দুঃখে হাজার মাইল দৌড়বে! তবে কি জানিস তো নীল, কোথায় যে কোন পাখি লুকিয়ে আছে সে তো নিশ্চিত করে বলা যায় না। এখনো দু-তিন বছর অন্তর কোনো না কোনো নতুন প্রজাতির পাখি খুঁজে পাচ্ছি আমরা। বিশেষ করে হিমালয়ের বনে। তা তুই এত সব খোঁজ নিচ্ছিস কেন?

পরে বলব।

শুভঙ্করদাকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা রেখে দিতে যাচ্ছিলাম। শুভঙ্করদাই আমাকে থামিয়ে বলল, শোন।

স্প্লেনডিড-প্যারাকিটদের ব্যাপারে আরেকটা ইন্টারেস্টিং কথা মনে পড়ল। ওরা বাসার মধ্যে সুগন্ধী গাছের পাতা এনে রেখে দেয়, জানিস তো? বাসা তো বানায় গাছের কোটরের মধ্যে খড়কুটো দিয়ে। তাহলে ওই দু-চারটে পাতা কী কাজে লাগে? সে ব্যাপারে আমরা এখনো কোনো কনক্লুশনে পৌঁছতে পারিনি, বুঝলি? ওরা কি বাসার দুর্গন্ধ দূর করার জন্যে পাতাগুলোকে নিয়ে আসে?

শুভঙ্করদার এই শেষ কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার চোখের সামনে থেকে হঠাৎ একটা কালো পর্দা সরে গেল। জ্যোতির্ময়ের পুঁথি…দয়াল সর্দারের পটচিত্র….শুকনো পাতা, গাসের শীষ, টিয়া—যে সুতোটা দিয়ে এরা একসঙ্গে বাঁধা সেই সুতোটা আমি হাতের মুঠোয় ধরে ফেললাম। বললাম, রাখছি শুভঙ্করদা। থ্যাঙ্ক ইউ। ঝড় আসছে, আমি রাখছি।

তারপরেই আমি হোঁচট খেতে খেতে উৎরাই বেয়ে নামতে শুরু করলাম। দীঘলবাড়ির জঙ্গলের মধ্যে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মালগাড়িটার সামনে গিয়ে হাঁক পাড়লাম—দয়ালজি, দয়ালজি! আমি জানি কোথায় আছে অমৃত পাতা। আমি জানি। দেখবেন তো শিগ্গিরি আসুন।

আট

এই নিয়ে বোধহয় দশবার দয়াল সর্দার আমার ক্যামেরার ভিউ-ফাইন্ডারে চোখ লাগালেন।

আমরা এখন বসে আছি ওই ময়ূরকণ্ঠী টিয়াদের বাসা-গাছের যতটা কাছাকাছি সম্ভব একটা জায়গায়। আমার ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করা আছে। ওদের বাসা বানানোর কাজ এখন প্রায় শেষ। এখন ওরা যা করছে সেই কাজটা স্প্লেনডিড-প্যারাকিটও করে থাকে—অনেকদূরের কোনো গোপন বন থেকে এক-দুটো সবুজ পাতা ঠোঁটে করে বয়ে এনে বাসার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। পাতাটাকে বাসার মধ্যেই রেখে দিয়ে বেরিয়ে আসছে। আবার উড়ে গিয়ে নিয়ে আসছে আরো একটা পাতা।

তিনটে বাসাতেই চলছে একই কর্মকাণ্ড।

দয়াল সর্দার ভিউ-ফাইন্ডার থেকে চোখ সরিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, বাবুজি, তার মানে অমৃত পাতার গাছ এই জঙ্গলে জন্মায় না। কোথায় জন্মায় তাও আমরা কেউ কোনোদিন জানতে পারব না।

আমি উত্তর দিলাম, ঠিক বলেছেন দয়ালজি। সেইজন্যেই আপনার পূর্বপুরুষেরা গাছের ছবি আঁকতে পারেননি। শুধু পাতার ছবিই এঁকেছিলেন। আরেকজনও পারেননি, তাঁর নাম জ্যোতির্ময় ভিষগরত্ন। দেড়শো বছর আগে তিনি বোধহয় এই আমরা যেখানে বসে আছি, এইখানে বসেই দেখেছিলেন লাল ঘাস, ময়ূরকণ্ঠী টিয়া আর তাদের ঠোঁটে ধরে রাখা অমৃত পাতা। নিশ্চয় আপনার পূর্বপুরুষদের মধ্যেই কেউ তাঁকে এই সবকিছুর হদিস দিয়েছিলেন।

দয়াল সর্দার অবাক চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি বললাম, হ্যাঁ দয়ালজি। সেই খাতার কপি ডক্টর মিত্রের কাছে রয়েছে। সেখানে ঠিক আপনাদের পটচিত্রের মতন টিয়াপাখি, ঘাস আর শুকনো পাতার ছবি রয়েছে।

উনি আমাকে কোনোদিন বলেননি তো ওই খাতার কথা! আহত গলায় বললেন দয়াল সর্দার। কেন এমন করলেন?

আমি ওনার পিঠে হাত রেখে বললাম, আমরা শহরের লোকেরা মাঝে মাঝে এরকম সব কাজ করি। ও নিয়ে ভাববেন না। আচ্ছা দয়ালজি…

বলুন বাবু।

ওই যে জ্যোতির্ময় ভিষগরত্নের কথা বলছিলাম, উনি শুকনো পাতার ছবি এঁকেছিলেন কেন বলতে পারবেন? তাজা পাতার ছবি কেন নয়?

দয়াল সর্দার বললেন, তার কারণ উনি মহৎ লোক ছিলেন। জ্ঞানী লোক ছিলেন।

মানে?

যতদিন পাখিরা বাসায় ছিল, ততদিন উনি সেই বাসায় হাত দেননি। মানুষের হাতের ছোঁয়া লাগলে পাখি সেই বাসা ছেড়ে চলে যায় জানেন তো? তখন ডিম নষ্ট হয়, বাচ্চা নষ্ট হয়। তাই উনি পাখিরা বাসা ছেড়ে চলে যাবার পর শুকনো পাতা সংগ্রহ করেছিলেন।

একদম ঠিক বলেছেন দয়ালজি। আমরাও কি তাই করব?

আমরাও তাই করব বাবু। এত বছর যখন অপেক্ষা করলাম তখন আর দুটো মাস অপেক্ষা করতে পারব না? ময়ূরকণ্ঠী টিয়ারা তাদের বাচ্চা নিয়ে নিজেদের দেশে ফিরে যাক, তারপর আমরা ওই ছেড়ে যাওয়া বাসা থেকে শুকনো অমৃত পাতা কুড়িয়ে নিয়ে আসব।

আমাদের পেছনদিক থেকে কে যেন বলে উঠল, কিন্তু আমার হাতে তো অত সময় নেই দয়াল সর্দার। আমি তো এখনই পাতা তুলব।

আমি, দয়াল সর্দার আর কাজল তিনজনেই চমকে পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম, ডক্টর সব্যসাচী মিত্র দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কখন যে উনি এত নিঃশব্দে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বুঝতেই পারিনি। আমাদের সমস্ত কথাই উনি নিশ্চয় শুনেছেন।

এই রাকেশ, ব্রিজেশ! ইধার আও! উনি ঘাড় ফিরিয়ে কাদের যেন ডাকলেন। আমরা তিনজনেই উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। দেখলাম ওনার ডাক শুনে জঙ্গলের মধ্যে থেকে দুটো সাতাশ-আটাশ বছরের ছেলে বেরিয়ে এল। সম্ভবত দুই ভাই হবে। চোখমুখ দেখলেই বোঝা যায় দুটোই পাক্কা ক্রিমিনাল।

এই, তোরা উঠে পড় ওই গাছে। কোটরের মধ্যে যা পাবি বার করে নীচে ফেল।

আমাদের তিনজনের চোখের সামনে রাকেশ আর ব্রিজেশ তরতর করে একটা গাছে উঠে পড়ল। ওই গাছটার কোটরে যে ময়ূরকণ্ঠী টিয়া দুটো বাসা বেঁধেছিল তারা করুণ গলায় আর্তনাদ করতে করতে পাক খেতে শুরু করল ওদের মাথার ওপরে, কিন্তু তাতে কি আর ওদের আটকানো যায়। গাছের ওপর থেকে ওরা প্রথমে দুটো ছোট সাদা ডিম নীচে ছুঁড়ে ফেলল, তারপরে ঘাস-পাতা দিয়ে বোনা ছোট বাটির মতন সুন্দর একটা বাসা।

ডক্টর মিত্র দৌড়ে গেলেন মাটিতে পড়ে থাকা বাসাটার দিকে। ঝুঁকে পড়ে ওটার ভেতর থেকে তুলে নিলেন একমুঠো সবুজ পাতা। অমৃত পাতা। রাকেশ আর ব্রিজেশ এগিয়ে গেল দ্বিতীয় গাছটার দিকে। এবার ওই গাছের পাখি দুটো আর্তনাদ করে উঠল। আমি আর দেখতে পারছিলাম না। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এল। ‘আঃ, জান লে লি ভাইয়া’। তারপরেই ‘রুখো, পাকড়ো শয়তানকো’, এইসব বলে অন্য একটা গলায় চিৎকার।

মুখ ফিরিয়ে দেখি রাকেশ বলে ছেলেটা কপাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর হাতের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর কাজলকে জাপটে ধরে রয়েছে ব্রিজেশ নামে অন্য ছেলেটা। কাজলের হাতে তখনো শক্ত করে ধরা রয়েছে একটা বড় পাথরের টুকরো। এইটা ছুঁড়বার সময় পেলে ব্রিজেশের মাথাটাও ও ফাটিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব হবে? কারণ, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, একহাতে কাজলকে জাপটে ধরে অন্যহাতে একটা বড় ছোরা উঁচু করে মাথার ওপর তুলে ধরেছে ব্রিজেশ। রাকেশও এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। দুই ভাইয়ের চোখেই খুনির দৃষ্টি।

এই দৃশ্য দেখে নব্বই বছরের শরীর নিয়ে যতটা জোরে দৌড়নো যায় ততটাই জোরে দৌড়তে শুরু করলেন দয়াল সর্দার। তাঁর পেছন পেছন আমি। কাজলকে বাঁচাতে হবে।

ডক্টর মিত্রর বা� হাতে তখনো প্যানাসিয়ার পাতাগুলো মুঠো করে ধরা। সেই অবস্থাতেই উনি ডান হাতটা ব্লেজারের বুকের কাছে ঢুকিয়ে একটা রিভলবার বার করে আনলেন। তারপর হাতটা সামনে বাড়িয়ে খুব ভালো করে টিপ করলেন দয়াল সর্দারের বুকের দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, ভয় দেখাতে চাইছেন না, উনি খুন করতে চাইছেন দয়াল সর্দারকে, যাতে অমৃত পাতার হদিস গোপন থাকে।

ডক্টর মিত্রের জন্যেই আমরা কাজলের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। কাজল যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। দেখলাম, ওর বাঁ হাতের ওপর দিকটায় ব্রিজেশের ছুরি বসে গেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর পুরো শরীর। কিন্তু ওরা তাতেও সন্তুষ্ট নয়। রাকেশ এবার ছুরি তুলেছে। কাজলকে ওরা খুন করতে চায়।

ঠিক তখনই পেছনের জঙ্গল থেকে একটা অন্ধকারের স্তূপ যেন আলগা হয়ে বেরিয়ে এল। শাঁখের মতন আওয়াজে থরথর করে কেঁপে উঠল দীঘলবাড়ির নদী, জঙ্গল আর পাহাড়। শিবা….সেই খ্যাপা হাতি। কেমন করে যে ও দয়াল সর্দারের শত্রুদের চিনে নিল জানি না, কিন্তু সেই চিনে নেওয়ার মধ্যে কোনো ভুল ছিল না।

প্রথমে ও রাকেশকে শুঁড়ে জড়িয়ে ছুঁড়ে দিল একটা পাথরের ওপর। যেভাবে রাকেশের ঘাড়টা একদিকে কাত হয়ে গেল তাতে বুঝলাম ঘাড়টা ভেঙে গেছে। তারপর ব্রিজেশকে পায়ের নীচে ফেলে পিষে দিল। ডক্টর মিত্র হাতিটাকে লক্ষ করে একটা গুলি চালালেন। না চালালেই ভালো করতেন। একটা কালো ঘূর্ণির মতন শিবা দৌড়ে গেল ডক্টর মিত্রের দিকে। একটা গা হিম করে দেওয়া মরণ আর্তনাদ। তারপরই চারিদিক অদ্ভুত শান্ত হয়ে গেল। এতটাই শান্ত যে, লাল ঘাসের বন থেকে ভেসে আসা ভ্রমরের গুনগুনানিও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম।

শিবা যেমন হঠাৎ এসেছিল সেরকম হঠাৎই আবার জঙ্গলের মধ্যে ফিরে গেল। লেকের ধারে তখন দাঁড়িয়েছিলাম শুধু আমি আর দয়াল সর্দার। বাকি চারটে দেহ এখানে-ওখানে মাটির ওপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। আমরা দুজনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কাজল যেখানে মাটির ওপরে মুখ গুঁজে পড়েছিল, সেখানে।

কাজল বেঁচে ছিল। কিন্তু যেভাবে ওর শরীর থেকে রক্ত ঝরে পড়ছিল তাতে খুব বেশিক্ষণ যে বাঁচবে না সেটাও বুঝতে পারছিলাম। আমি গায়ের শার্ট ছিঁড়ে ওর কাঁধের ক্ষতটা চেপে বেঁধে দিলাম। তারপর ওকে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে এক পা এক পা করে ফিরে এলাম মালগাড়ির কামরার ওপর দয়াল সর্দারের কুঁড়েঘরে।

কী করব বুঝতে পারছিলাম না। কাজলকে এখুনি যে কোনো হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ষোলো কিলোমিটার পথ ওকে আমি একা নিয়ে যাব কেমন করে? দয়াল সর্দার কাজলের মাথাটা কোলে নিয়ে বসেছিলেন। মাঝে মাঝেই কান্নাভেজা গলায় ডেকে উঠছিলেন কাজলকে। কিন্তু কাজল সাড়া দেওয়ার মতন অবস্থায় ছিল না।

হঠাৎ দয়াল সর্দারের কুঁড়েঘরের ঠিক বাইরে আবার সেই শাঁখের আওয়াজ।

শিবা ফিরে এসেছে। কী চায় শিবা? ও কি কাজলকে ছেড়ে যেতে পারছে না?

পেছনদিক থেকে একটা প্রবল ধাক্কায় পুরো কামরাটা থরথর করে কেঁপে উঠল আর মরচে ধরা চাকাগুলো ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে উঠল। দয়াল সর্দারের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি বিস্ফারিত চোখে কামরার পেছনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

আবার একটা ধাক্কা। কামরাটা সামনের দিকে অল্প গড়িয়ে গেল।

দয়াল সর্দার আমাকে বললেন, কী হচ্ছে বুঝতে পারছেন বাবু?

আমি ঘাড় নাড়লাম।

বুঝছেন না? শিবা কাজলকে শহরের হাসপাতালে পৌঁছবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

তার মানে?

পুরো লাইনটাই তো ঢালু জমির ওপর দিয়ে চলে গেছে। চলে গেছে সেই হাতিবাড়ি অবধি। একবার যদি চাকার জ্যাম ছাড়িয়ে গাড়িটাকে ঠেলে দেওয়া যায়, তো পুরো রাস্তাটাই গড়গড় করে চলে যাবে। আমাদের মাথায় যেটা আসেনি, সেটা ওই বুনো জন্তুটার মাথায় এসেছে। ও মাথা দিয়ে ঠেলে গাড়িটাকে লাইনের ওপর গড়িয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু থামাব কেমন করে?

দয়াল সর্দার বললেন, সে চিন্তা নেই। এই কামরায় এয়ার-ব্রেক লাগানো আছে। আমি যখন ঘর বানিয়েছিলাম তখনই দেখে নিয়েছি। ওই চাকাটা একটু বাঁদিকে ঘোরান।

আমি দয়াল সর্দারের কথামতন কামরার সামনের দেয়ালে লাগানো লোহার চাকাটাকে একটু বাঁদিকে ঘোরাতেই গাড়িটার স্পিড কমতে শুরু করল।

দয়াল সর্দার বললেন, এবার ডানদিকে ঘোরান। ব্রেক ছেড়ে দিলেই ঢাল বেয়ে গাড়ি নামতে শুরু করবে। কোনো চিন্তা নেই বাবু, কোনো চিন্তা নেই।

জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম দীঘলবাড়ির বনস্পতিরা ধীরে ধীরে পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম এই স্পিডেও যদি যাই তাহলেও একঘণ্টার মধ্যে হাতিবাড়ি পৌঁছে যাব।

আর একটু পরেই আমার মোবাইলে সিগন্যাল ফিরে পেলাম। মানিককে ফোন করে সব কথা বললাম। ও বলল, হাতিবাড়িতে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে অপেক্ষা করবে।

একটু বাদেই দু’পাশের বন হালকা হয়ে এল। ঠিক তখনই অনেক দূর থেকে শেষবারের মতন ভেসে এল হাতির চিৎকার। যেন শিবা কাজলকে ডেকে বলল, ভালো হয়ে ফিরে এসো।

উপসংহার

সেবার আর দীঘলবাড়ির হর্নবিলের ওপর ডকুমেন্টারিটা শেষ করতে পারিনি। পরের বছর আবার ফিরে গিয়েছিলাম। দয়াল সর্দারকে জানিয়ে রেখেছিলাম, কখন যাব। উনি আর কাজল শুধু আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যেই ভুটান থেকে দীঘলবাড়ি এসেছিলেন। কাজলকে সম্পূর্ণ সুস্থ দেখে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে ইশারায় জিগ্যেস করলাম, ভালো আছিস তো কাজল?

কাজল লাজুক হেসে উত্তর দিল, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন কাকু?

কাজল নিজের মুখে উত্তর দিল। ইশারায় নয়। কথা বলে উত্তর দিল। এই প্রথমবার শুনলাম ওর গলার আওয়াজ।

আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর তাকালাম দয়াল সর্দারের মুখের দিকে।

দয়াল সর্দার হাতের পাতায় চোখ মুছে বললেন, হ্যাঁ বাবুজি। মিত্রবাবুর হাতের মুঠো থেকে সেই অমৃত পাতার গোছা বার করে নিয়েছিলাম। যখন দেখলাম কাজল ক্রমশ নেতিয়ে পড়ছে, তখন ওই পাতার রস একটু একটু করে ওর ঠোঁটে দিয়েছিলাম। সেইজন্যেই অত রক্তপাতের পরেও ছেলেটা বেঁচে গেল। তাছাড়া আর যা হয়েছে সে তো দেখতেই পাচ্ছেন। ও যে কানে শোনার ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে সেটা শিলিগুড়ির হাসপাতালেই বুঝতে পেরেছিলাম। কানে শুনতে পাচ্ছে বলেই গত একবছর ধরে একটু একটু করে কথা বলতেও শিখে নিয়েছে।

আমরা তিনজন সেদিনই সেই লেকের ধারে গিয়েছিলাম। দেখলাম লাল ঘাস এ বছরেও গজিয়েছে। কিন্তু ময়ূরকণ্ঠী টিয়ারা আর ফেরেনি।

কাজল কান্না-কান্না গলায় বলল, ওরা আর ফিরবে না কাকু। যেখানে একবার বাসার ওপর হামলা হয়েছে সেখানে কোনো পাখি আর দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না।

আমি একটা পাথরের ওপর বসে আমার ক্যামেরা থেকে এক এক করে গতবছরের তোলা ময়ূরকণ্ঠী টিয়াদের সবকটা ছবি ডিলিট করে দিলাম। অমৃত পাতার বাহনদের কথা ভুলে যাওয়াই ভালো।

পারব কি ভুলতে?

___

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন