রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অস্ত গেল দিনমণি । সন্ধ্যা আসি ধীরে
 দিবসের অন্ধকার সমাধির ‘ পরে
 তারকার ফুলরাশি দিল ছড়াইয়া ।
 সাবধানে অতি ধীরে নায়ক যেমন
 ঘুমন্ত প্রিয়ার মুখ করয়ে চুম্বন ,
 দিন-পরিশ্রমে ক্লান্ত পৃথিবীর দেহ
 অতি ধীরে পরশিল সায়াহ্নের বায়ু ।
 দুরন্ত তরঙ্গগুলি যমুনার কোলে
 সারাদিন খেলা করি পড়েছে ঘুমায়ে ।
 ভগ্ন দেবালয়খানি যমুনার ধারে ,
 শিকড়ে শিকড়ে তার ছায়ি জীর্ণ দেহ
 বট অশত্থের গাছ জড়াজড়ি করি
 আঁধারিয়া রাখিয়াছে ভগন হৃদয় ,
 দুয়েকটি বায়ূচ্ছ্বাস পথ ভুলি গিয়া
 আঁধার আলয়ে তার হয়েছে আটক ,
 অধীর হইয়া তারা হেথায় হোথায়
 হু হু করি বেড়াইছে পথ খুঁজি খুঁজি!
 শুন সন্ধ্যে! আবার এসেছি আমি হেথা ,
 নীরব আঁধারে তব বসিয়া বসিয়া
 তটিনীর কলধ্বনি শুনিতে এয়েছি ।
 হে তটিনী , ও কি গান গাইতেছ তুমি!
 দিন নাই , রাত্রি নাই , এক তানে শুধু
 এক সুরে এক গান গাইছ সতত —
 এত মৃদুস্বরে ধীরে , যেন ভয় করি
 সন্ধ্যার প্রশান্ত স্বপ্ন ভেঙে যায় পাছে!
 এ নীরব সন্ধ্যাকালে তব মৃদু গান
 একতান ধ্বনি তব শুনে মনে হয়
 এ হৃদি-গানেরি যেন শুনি প্রতিধ্বনি!
 মনে হয় যেন তুমি আমারি মতন
 কী এক প্রাণের ধন ফেলেছ হারায়ে ।
 এসো স্মৃতি , এসো তুমি এ ভগ্ন হৃদয়ে —
 সায়াহ্ন-রবির মৃদু শেষ রশ্মিরেখা
 যেমন পড়েছে ওই অন্ধকার মেঘে
 তেমনি ঢালো এ হৃদে অতীত-স্বপন!
 কাঁদিতে হয়েছে সাধ বিরলে বসিয়া ,
 কাঁদি একবার , দাও সে ক্ষমতা মোরে!
 যাহা কিছু মনে পড়ে ছেলেবেলাকার
 সমস্ত মালতীময় — মালতী কেবল
 শৈশবকালের মোর স্মৃতির প্রতিমা ।
 দুই ভাই বোনে মোরা আছিনু কেমন!
 আমি ছিনু ধীর শান্ত গম্ভীর-প্রকৃতি ,
 মালতী প্রফুল্ল অতি সদা হাসি হাসি ।
 ছিল না সে উচ্ছ্বসিনী নির্ঝরিণী সম
 শৈশব-তরঙ্গবেগে চঞ্চলা সুন্দরী ,
 ছিল না সে লজ্জাবতী লতাটির মতো
 শরম-সৌন্দর্যভরে ম্রিয়মাণ-পারা ।
 আছিল সে প্রভাতের ফুলের মতন ,
 প্রশান্ত হরষে সদা মাখানো মুখানি ;
 সে হাসি গাহিত শুধু উষার সংগীত —
 সকলি নবীন আর সকলি বিমল ।
 মালতীর শান্ত সেই হাসিটির সাথে
 হৃদয়ে জাগিত যেন প্রভাত পবন ,
 নূতন জীবন যেন সঞ্চরিত মনে!
 ছেলেবেলাকার যত কবিতা আমার
 সে হাসির কিরণেতে উঠেছিল ফুটি ।
 মালতী ছুঁইত মোর হৃদয়ের তার ,
 তাইতে শৈশব-গান উঠিত বাজিয়া ।
 এমনি আসিত সন্ধ্যা ; শ্রান্ত জগতেরে
 স্নেহময় কোলে তার ঘুম পাড়াইতে ।
 সুবর্ণ-সলিলসিক্ত সায়াহ্ন-অম্বরে
 গোধূলির অন্ধকার নিঃশব্দ চরণে
 ছোটো ছোটো তারাগুলি দিত ফুটাইয়া ,
 নন্দনবনের যেন চাঁপা ফুল দিয়ে
 ফুলশয্যা সাজাইত সুরবালাদের ।
 মালতীরে লয়ে পাশে আসিতাম হেথা ;
 সন্ধ্যার সংগীতস্বরে মিলাইয়া স্বর
 মৃদুস্বরে শুনাতেম শৈশব-কবিতা ।
 হর্ষময় গর্বে তার আঁখি উজলিত —
 অবাক ভক্তির ভাবে ধরি মোর হাত
 একদৃষ্টে মুখপানে রহিত চাহিয়া ।
 তার সে হরষ হেরি আমারো হৃদয়ে
 কেমন মধুর গর্ব উঠিত উথলি!
 ক্ষুদ্র এক কুটির আছিল আমাদের ,
 নিস্তব্ধ-মধ্যাহ্নে আর নীরব সন্ধ্যায়
 দূর হতে তটিনীর কলস্বর আসি
 শান্ত কুটিরের প্রাণে প্রবেশিয়া ধীরে
 করিত সে কুটিরের স্বপন রচনা ।
 দুই জনে ছিনু মোরা কল্পনার শিশু —
 বনে ভ্রমিতাম যবে , সুদূর নির্ঝরে
 বনশ্রীর পদধ্বনি পেতাম শুনিতে ।
 যাহা কিছু দেখিতাম সকলেরি মাঝে
 জীবন্ত প্রতিমা যেন পেতেম দেখিতে!
 কত জোছনার রাত্রে মিলি দুই জনে
 ভ্রমিতাম যমুনার পুলিনে পুলিনে ,
 মনে হত এ রজনী পোহাতে চাবে না ,
 সহসা কোকিল-রব শুনিয়া উষায় ,
 সহসা যখনি শ্যামা গাহিয়া উঠিত ,
 চমকিয়া উঠিতাম , কহিতাম মোরা ,
 ‘ এ কী হোল! এরি মধ্যে পোহাল রজনী! ‘
 দেখিতাম পূর্ব দিকে উঠেছে ফুটিয়া
 শুকতারা , রজনীর বিদায়ের পথে ,
 প্রভাতের বায়ু ধীরে উঠিছে জাগিয়া ,
 আসিছে মলিন হয়ে আঁধারের মুখ ।
 তখন আলয়ে দোঁহে আসিতাম ফিরি ,
 আসিতে আসিতে পথে শুনিতাম মোরা
 গাইছে বিজনকুঞ্জে বউ-কথা-কও ।
 ক্রমশ বালককাল হল অবসান ,
 নীরদের প্রেমদৃষ্টে পড়িল মালতী ,
 নীরদের সাথে তার হইল বিবাহ ।
 মাঝে মাঝে যাইতাম তাদের আলয়ে ;
 দেখিতাম মালতীর শান্ত সে হাসিতে
 কুটিরেতে রাখিয়াছে প্রভাত ফুটায়ে! 
সঙ্গীহারা হয়ে আমি ভ্রমিতাম একা ,
 নিরাশ্রয় এ-হৃদয় অশান্ত হইয়া
 কাঁদিয়া উঠিত যেন অধীর উচ্ছ্বাসে ।
 কোথাও পেত না যেন আরাম বিশ্রাম ।
 অন্যমনে আছি যবে , হৃদয় আমার
 সহসা স্বপন ভাঙি উঠিত চমকি ।
 সহসা পেত না ভেবে , পেত না খুঁজিয়া
 আগে কী ছিল রে যেন এখন তা নাই ।
 প্রকৃতির কি-যেন কী গিয়াছে হারায়ে
 মনে তাহা পড়িছে না । ছেলেবেলা হতে
 প্রকৃতির যেই ছন্দ এসেছি শুনিয়া
 সেই ছন্দোভঙ্গ যেন হয়েছে তাহার ,
 সেই ছন্দে কী কথার পড়েছে অভাব —
 কানেতে সহসা তাই উঠিত বাজিয়া ,
 হৃদয় সহসা তাই উঠিত চমকি ।
 জানি না কিসের তরে , কী মনের দুখে
 দুয়েকটি দীর্ঘশ্বাস উঠিত উচ্ছ্বসি ।
 শিখর হতে শিখরে , বন হতে বনে ,
 অন্যমনে একেলাই বেড়াতাম ভ্রমি —
 সহসা চেতন পেয়ে উঠিয়া চমকি
 সবিস্ময়ে ভাবিতাম , কেন ভ্রমিতেছি ,
 কেন ভ্রমিতেছি তাহা পেতেম না ভাবি! 
একদিন নবীন বসন্ত-সমীরণে
 বউ-কথা-কও যবে খুলেছে হৃদয় ,
 বিষাদে সুখেতে মাখা প্রশান্ত কী ভাব
 প্রাণের ভিতরে যবে রয়েছে ঘুমায়ে ,
 দেখিনু বালিকা এক , নির্ঝরের ধারে
 বনফুল তুলিতেছে আঁচল ভরিয়া ।
 দুপাশে কুন্তলজাল পড়েছে এলায়ে ,
 মুখেতে পড়েছে তার উষার কিরণ ।
 কাছেতে গেলাম তার , কাঁটা বাছি ফেলি
 কানন-গোলাপ তারে দিলাম তুলিয়া ।
 প্রতিদিন সেইখানে আসিত দামিনী
 তুলিয়া দিতাম ফুল , শুনাতেম গান ,
 কহিতাম বালিকারে কত কী কাহিনী ,
 শুনি সে হাসিত কভু , শুনিত না কভু ,
 আমি ফুল তুলে দিলে ফেলিত ছিঁড়িয়া ।
 ভর্ৎসনার অভিনয়ে কহিত কত কী!
 কভু বা ভ্রূকুটি করি রহিত বসিয়া ,
 হাসিতে হাসিতে কভু যাইত পলায়ে ,
 অলীক শরমে কভু হইত অধীর ।
 কিন্তু তার ভ্রূকুটিতে , শরমে , সংকোচে ,
 লুকানো প্রেমেরি কথা করিত প্রকাশ!
 এইরূপে প্রতি উষা যাইত কাটিয়া ।
 একদিন সে-বালিকা না আসিত যদি
 হৃদয় কেমন যেন হইত বিকল —
 প্রভাত কেমন যেন যেত না কাটিয়া —
 দিন যেত অতি ধীরে নিরাশ-চরণে!
 বর্ষচক্র আর বার আসিল ফিরিয়া ,
 নূতন বসন্তে পুনঃ হাসিল ধরণী ,
 প্রভাতে অলস ভাবে , বসি তরুতলে ,
 দামিনীরে শুধালেম কথায় কথায়
 ‘ দামিনী , তুমি কি মোরে ভালোবাস বালা ? ‘
 অলীক-শরম-রোষে ভ্রূকুটি করিয়া
 ছুটে সে পলায়ে গেল দূর বনান্তরে —
 জানি না কী ভাবি পুনঃ ছুটিয়া আসিয়া
 ‘ ভালোবাসি — ভালোবাসি — ‘ কহিয়া অমনি
 শরমে-মাখানো মুখ লুকালো এ বুকে ।
 এইরূপে দিন যেত স্বপ্ন-খেলা খেলি ।
 কত ক্ষুদ্র অভিমানে কাঁদিত বালিকা ,
 কত ক্ষুদ্র কথা লয়ে হাসিত হরষে —
 কিন্তু জানিতাম কি রে এই ভালোবাসা
 দুদিনের ছেলেখেলা , আর কিছু নয় ?
 কে জানিত প্রভাতের নবীন কিরণে
 এমন শতেক ফুল উঠে রে ফুটিয়া
 প্রভাতের বায়ু সনে খেলা সাঙ্গ হলে
 আপনি শুকায়ে শেষে ঝরে পড়ে যায় —
 ওই ফুলে থুয়েছিনু হৃদয়ের আশা ,
 ওই কুসুমের সাথে খসে পড়ে গেল!
 আর কিছুকাল পরে এই দামিনীরে
 যে কথা বলিয়াছিনু আজো মনে আছে ।
 ‘ দামিনী , মনে কি পড়ে সে দিনের কথা ?
 বলো দেখি কত দিন ওই মুখখানি
 দেখি নি তোমার ? তাই দেখিতে এয়েছি!
 জোছনার রাত্রে যবে বসেছি কাননে ,
 দুয়েকটি তারা কভু পড়িছে খসিয়া ,
 হতবুদ্ধি দুয়েকটি পথহারা মেঘ
 অনন্ত আকাশ-রাজ্যে ভ্রমিছে কেবল ,
 সে নিস্তব্ধ রজনীতে হৃদয়ে যেমন
 একে একে সব কথা উঠে গো জাগিয়া ,
 তেমনি দেখিনু যেই ওই মুখখানি
 স্মৃতি-জাগরণকারী রাগিণীর মতো
 ওই মুখখানি তব দেখিনু যেমনি
 একে একে পুরাতন সব স্মৃতিগুলি
 জীবন্ত হইয়া যেন জাগিল হৃদয়ে ।
 মনে আছে সেই সখি আর-এক দিন
 এমনি গম্ভীর সন্ধ্যা , এই নদীতীর ,
 এইখানে এই হাত ধরিয়া তোমার
 কাতরে কহেছি আমি নয়নের জলে ,
 ‘ বিদায় দাও গো এবে চলিনু বিদেশে ,
 দেখো সখি এত দিন বাসিয়াছ ভালো ,
 দুদিন না দেখে যেন যেয়ো না ভুলিয়া!
 সংসারের কর্ম হতে অবসর লয়ে
 আবার ফিরিয়া যবে আসিব দামিনী ,
 নব-অতিথির মতো ভেবো না আমারে
 সম্ভ্রমের অভিনয় কোরো না বালিকা! ‘
 কিছুই উত্তর তার দিলে না তখন ,
 শুধু মুখপানে চেয়ে কাতর নয়নে
 ভর্ৎসনার অশ্রুজল করিলে বর্ষণ ।
 যেন এই নিদারুণ সন্দেহের মোর
 অশ্রুজল ছাড়া আর নাইকো উত্তর!
 আবার কহিনু আমি ওই মুখ চেয়ে ,
 ‘ কে জানে মনের মধ্যে কি হয়েছে মোর
 আশঙ্কা হতেছে যেন হৃদয়ে আমার
 ওই স্নেহ-সুধামাখা মুখখানি তোর
 এ জনমে আর বুঝি পাব না দেখিতে । ‘
 নীরব গম্ভীর সেই সন্ধ্যার আঁধারে
 সমস্ত জগৎ যেন দিল প্রতিধ্বনি
 ‘ এ জনমে আর বুঝি পাব না দেখিতে । ‘
 গভীর নিশীথে যথা আধো ঘুমঘোরে
 সুদূর শ্মশান হতে মরণের রব
 শুনিলে হৃদয় উঠে কাঁপিয়া কেমন ,
 তেমনি বিজন সেই তটিনীর তীরে
 একাকী আঁধারে যেন শুনিনু কী কথা ,
 সমস্ত হৃদয় যেন উঠিল শিহরি!
 আর বার কহিলাম , ‘ বিদায় — ভুলো না । ‘
 তখন কি জানিতাম এই নদীতীরে
 এই সন্ধ্যাকালে আর তোমারি সমুখে
 এমনি মনের দুখে হইবে কাঁদিতে ?
 তখনো আমার এই বাল্যজীবনের
 প্রভাত-নীরদ হতে নব-রক্তরাগ
 যায় নি মিলায়ে সখি , তখনো হৃদয়
 মরীচিকা দেখিতেছিল দূর শূন্যপটে ।
 নামিনু সংসারক্ষেত্রে যুঝিনু একাকী ,
 যাহা কিছু চাহিলাম পাইনু সকলি ।
 তখন ভাবিনু যাই প্রেমের ছায়ায়
 এতদিনকার শ্রান্তি যাবে দূর হয়ে ।
 সন্ধ্যাকালে মরুভূমে পথিক যেমন
 নিরখিয়া দেখে যবে সম্মুখে পশ্চাতে
 সুদূরে দেখিতে পায় প্রান্ত দিগন্তের
 সুবর্ণ জলদজালে মণ্ডিত কেমন ,
 সে-দিকে তারকাগুলি চুম্বিছে প্রান্তর ,
 সায়াহ্নবালার সেথা পূর্ণতম শোভা ,
 কিন্তু পদতলে তার অসীম বালুকা
 সারাদিন জ্বলি জ্বলি তপন-কিরণে
 ফেলিছে সায়াহ্নকালে জ্বলন্ত নিশ্বাস ।
 তেমনি এ সংসারের পথিক যাহারা
 ভবিষ্যৎ অতীতের দিগন্তের পানে
 চাহি দেখে স্বর্গ সেথা হাসিছে কেবল
 পদতলে বর্তমান মরুভূমি সম ।
 স্মৃতি আর আশা ছাড়া সত্যকার সুখ
 মানুষের ভাগ্যে সখি ঘটে নাকো বুঝি!
 বিদেশ হইতে যবে আইসে ফিরিয়া
 অতি হতভাগা যেও সেও ভাবে মনে
 যারে যারে ভালোবাসে সকলেই বুঝি
 রহিয়াছে তার তরে আকুল-হৃদয়ে!
 তেমনি কতই সখি করেছিনু আশা ,
 মনে মনে ভেবেছিনু কত-না হরষে
 দামিনী আমার বুঝি তৃষিতনয়নে
 পথপানে চেয়ে আছে আমারি আশায় ।
 আমি গিয়ে কব তারে হরষে কাঁদিয়া ,
 ‘ মুছ অশ্রুজল সখি , বহু দিন পরে
 এসেছে বিদেশ হতে ললিত তোমার ‘ ।
 অমনি দামিনী বুঝি আহ্লাদে উথলি
 নীরব অশ্রুর জলে কবে কত কথা ।
 ফিরিয়া আসিনু যবে — এ কী হল জ্বালা!
 কিছুতে নয়নজল নারি সামালিতে ।
 ফেরো ফেরো চাহিয়ো না এ আঁখির পানে ,
 প্রাণে বাজে অশ্রুজল দেখাতে তোমায়!
 জেনো গো রমণি , জেনো , এত দিন পরে
 কাঁদিয়া প্রণয় ভিক্ষা করিতে আসি নি ,
 এ অশ্রু দুঃখের অশ্রু — এ নহে ভিক্ষার!
 কখনো কখনো সখি অন্য মনে যবে
 সুবিজন বাতায়নে রয়েছ বসিয়া
 সম্মুখে যেতেছে দেখা বিজন প্রান্তর
 হেথা হোথা দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন কুটির
 হু হু করি বহিতেছে যমুনার বায়ু —
 তখন কি সে-দিনের দুয়েকটি কথা
 সহসা মনের মধ্যে উঠে না জাগিয়া ?
 কখন যে জাগি উঠে পার না জানিতে!
 দূরতম রাখালের বাঁশিস্বর সম
 কভু কভু দুয়েকটি ভাঙা-ভাঙা সুর
 অতি মৃদু পশিতেছে শ্রবণবিবরে ;
 আধো জেগে আধো ঘুমে স্বপ্ন আধো-ভোলা —
 তেমনি কি সে-দিনের দুয়েকটি কথা
 সহসা মনের মধ্যে উঠে না জাগিয়া ?
 স্মৃতির নির্ঝর হতে অলক্ষ্যে গোপনে ,
 পথহারা দুয়েকটি অশ্রুবারিধারা
 সহসা পড়ে না ঝরি নেত্রপ্রান্ত হতে ,
 পড়িছে কি না পড়িছে পার না জানিতে!
 একাকী বিজনে কভু অন্য মনে যবে
 বসে থাকি , কত কী যে আইসে ভাবনা ,
 সহসা মুহূর্ত-পরে লভিয়া চেতন
 কী কথা ভাবিতেছিনু নাহি পড়ে মনে
 অথচ মনের মধ্যে বিষণ্ন কী ভাব
 কেমন আঁধার করি রহে যেন চাপি ,
 হৃদয়ের সেই ভাবে কখনো কি সখি
 সে-দিনের কোনো ছায়া পড়ে না স্মরণে ?
 ছেলেবেলাকার কোনো বন্ধুর মরণ
 স্মরিলে যেমন লাগে হৃদয়ে আঘাত ,
 তেমনি কি সখি কভু মনে নাহি হয়
 সে-সকল দিন কেন গেল গো চলিয়া
 যে দিন এ-জন্মে আর আসিবে না ফিরি!
 পুরাতন বন্ধু তারা , কত কাল আহা
 খেলা করিয়াছি মোরা তাহাদের সাথে ,
 কত সুখে হাসিয়াছি দুঃখে কাঁদিয়াছি ,
 সে-সকল সুখ দুঃখ হাসি কান্না লয়ে
 মিশাইয়া গেল তারা আঁধার অতীতে! 
চলিনু দামিনী পুনঃ চলিনু বিদেশে —
 ভাবিলাম একবার দেখিব মুখানি ,
 একবার শুনাইব মরমের ব্যথা ,
 তাই আসিয়াছি সখি , এ জনমে আর
 আসিব না দিতে তব শান্তিতে ব্যাঘাত ,
 এ জন্মের তরে সখি কহো একবার
 একটি স্নেহের বাণী অভাগার ‘ পরে ,
 ভ্রমিয়া বেড়াব যবে সুদূর বিদেশে
 সে-কথার প্রতিধ্বনি বাজিবে হৃদয়ে! ‘ 
থামো স্মৃতি — থামো তুমি , থামো এইখানে ,
 সম্মুখে তোমার ও কি দৃশ্য মর্মভেদী ?
 মালতী আমার সেই প্রাণের ভগিনী ,
 শৈশবকালের মোর খেলাবার সাথী
 যৌবনকালের মোর আশ্রয়ের ছায়া ,
 প্রতি দুঃখ প্রতি সুখ প্রতি মনোভাব
 যার কাছে না বলিলে বুক যেত ফেটে ,
 সেই সে মালতী মোর হয়েছে বিধবা!
 আপনার দুঃখে মগ্ন স্বার্থপর আমি
 ভালো করে পারিনু না করিতে সান্ত্বনা!
 নিজের চোখের জলে অন্ধ এ নয়নে
 পরের চোখের জল পেনু না দেখিতে!
 ছেলেবেলাকার সেই পুরানো কুটিরে
 হাসিতে হাসিতে এল মালতী আমার ,
 সে-হাসির চেয়ে ভালো তীব্র অশ্রুজল!
 কে জানিত সে-হাসির অন্তরে অন্তরে
 কালরাত্রি অন্ধকার রয়েছে লুকায়ে!
 একদিনো বলে নি সে কোনো দুঃখ-কথা ,
 একদিনো কাঁদে নি সে সমুখে আমার!
 জানি জানি মালতী সে স্বর্গের দেবতা!
 নিজের প্রাণের বহ্নি করিয়া গোপন ,
 পরের চোখের জল দিত সে মুছায়ে ।
 ছেলেবেলাকার সেই হাসিটি তাহার
 সমস্ত আনন তার রাখিত উজ্জ্বলি ,
 কত-না করিত যত্ন করিত সান্ত্বনা ।
 হাসিতে হাসিতে কত করিত আদর!
 কিন্তু হা , শ্মশানে যথা চাঁদের জোছনা
 শ্মশানের ভীষণতা বাড়ায় দ্বিগুণ —
 মালতীর সেই হাসি দেখিয়া তেমনি
 নিজের এ হৃদয়ের ভগ্ন-অবশেষ
 দ্বিগুণ পড়িত যেন নয়নে আমার!
 তাহার আদর পেয়ে ভুলিনু যাতনা ,
 কিন্তু হায় , দেখি নাই , বিজন-শয্যায়
 কত দিন কাঁদিয়াছে মালতী গোপনে!
 সে যখন দেখিত , তাহার বাল্যসখা
 দিনে দিনে অবসাদে হইছে মলিন ,
 দিনে দিনে মন তার যেতেছে ভাঙিয়া ,
 তখন আকুলা বালা রাত্রে একাকিনী
 কাঁদিয়া দেবতা কাছে করেছে প্রার্থনা —
 বালিকার অশ্রুময় সে প্রার্থনাগুলি
 আর কেহ শুনে নাই অন্তর্যামী ছাড়া!
 দেখি নাই কত রাত্রি একাকিনী গিয়া
 যমুনার তীরে বসি কাঁদিত বিরলে!
 একাকিনী কেঁদে কেঁদে হইত প্রভাত ,
 এলোথেলো কেশপাশে পড়িত শিশির ,
 চাহিয়া রহিত উষা ম্লান মুখপানে!
 বিষময় , বহ্নিময় , বজ্রময় প্রেম ,
 এ স্নেহের কাছে তুই ঢাক মুখ ঢাক ।
 তুই মরণের কীট , জীবনের রাহু ,
 সৌন্দর্য-কুসুম-বনে তুই দাবানল ,
 হৃদয়ের রোগ তুই , প্রাণের মাঝারে
 সতত রাখিস তুই পিপাসা পুষিয়া ,
 ভুজঙ্গ বাহুর পাকে মর্ম জড়াইয়া
 কেবলি ফেলিস তুই বিষাক্ত নিশ্বাস ,
 আগ্নেয় নিশ্বাসে তোর জ্বলিয়া জ্বলিয়া
 হৃদয়ে ফুটিতে থাকে তপ্ত রক্তস্রোত ।
 জরজর কলেবর , আবেশে অসাড় ,
 শিথিল শিরার গ্রন্থি, অচেতন প্রাণ ,
 স্খলিত জড়িত বাণী , অবশ নয়ন ,
 আশা ও নিরাশা-পাকে ঘুরিছে হৃদয় ,
 ঘুরিছে চোখের ‘ পরে জগতসংসার!
 এই প্রেম , এই বিষ , বজ্র-হতাশন
 কবে রে পৃথিবী হতে যাবে দূর হয়ে!
 আয় স্নেহ , আয় তোর স্নিগ্ধসুধা ঢালি
 এ জ্বলন্ত বহ্নিরাশি দে রে নিবাইয়া!
 অগ্নিময় বৃশ্চিকের আলিঙ্গন হতে ,
 সুধাসিক্ত কোলে তোর তুলে নে তুলে নে!
 প্রেম-ধূমকেতু ওই উঠেছে আকাশে ,
 ঝলসি দিতেছে , হায় , যৌবনের আঁখি ,
 কোথা তুমি ধ্রুবতারা ওঠো একবার ,
 ঢালো এ জ্বলন্ত নেত্রে স্নিগ্ধ-মৃদু-জ্যোতি ।
 তুমি সুধা , তুমি ছায়া , তুমি জ্যোৎস্নাধারা ,
 তুমি স্রোতস্বিনী , তুমি উষার বাতাস ,
 তুমি হাসি , তুমি আশা , মৃদু অশ্রুজল ,
 এসো তুমি এ প্রেমেরে দাও নিভাইয়া ।
 একটি মালতী যার আছে এ সংসারে
 সহস্র দামিনী তার ধূলিমুষ্টি নয়! 
ক্রমশ হৃদয় মোর এল শান্ত হয়ে
 যন্ত্রণা বিষাদে আসি হল পরিণত ।
 নিস্তরঙ্গ সরসীর প্রশান্ত হৃদয়ে
 নিশীথের শান্ত বায়ু ভ্রমে গো যখন ,
 এত শান্ত এত মৃদু পদক্ষেপ তার
 একটি চরণচিহ্ন পড়ে না সরসে ,
 তেমনি প্রশান্ত হৃদে প্রশান্ত বিষাদ
 ফেলিতে লগিল ধীরে মৃদুল নিশ্বাস ।
 নিরখিয়া নিদারুণ ঝটিকার মাঝে
 হাসিময় শান্ত সেই মালতী কুসুমে
 ক্রমশ হৃদয় মোর এল শান্ত হয়ে ।
 কিন্তু হায় কে জানিত সেই হাসিময়
 সুকুমার ফুলটির মর্মের মাঝারে
 মরণের কীট পশি করিতেছে ক্ষয়!
 হইল প্রফুল্লতর মুখখানি তার ,
 হইল প্রশান্ততর হাসিটি তাহার ,
 দিবা যবে যায় যায় , হাসিময় মেঘে
 দূর আঁধারের মুখ করয়ে উজ্জ্বল —
 এ হাসি তেমনি হাসি কে জানিত তাহা!
 একদা পূর্ণিমারাত্রে নিস্তব্ধ গভীর
 মুখপানে চেয়ে বালা , হাত ধরি মোর
 কহিল মৃদুলস্বরে — ‘ যাই তবে ভাই! ‘
 কোথা গেলি — কোথা গেলি মালতী আমার
 অভাগা ভ্রাতারে তোর রাখিয়া হেথায়!
 দুঃখের কণ্টকময় সংসারের পথে
 মালতী , কে লয়ে যাবে হাত ধরি মোর ?
 সংসারের ধ্রুবতারা ডুবিল আমার ।
 তেমন পূর্ণিমা রাত্রি দেখি নি কখনো ,
 পৃথিবী ঘুমাইতেছে শান্ত জোছনায় ;
 কহিনু পাগল হয়ে — ‘ রাক্ষসী পৃথিবী
 এত রূপ তোরে কভু সাজে না সাজে না! ‘ 
মালতী শুকায়ে গেল , সুবাস তাহার
 এখনো রয়েছে কিন্তু ভরিয়া কুটির ।
 তাহার মনের ছায়া এখনো যেন রে
 সে কুটিরে শান্তিরসে রেখেছে ডুবায়ে!
 সে শান্ত প্রতিমা মম মনের মন্দির
 রেখেছে পবিত্র করি রেখেছে উজ্জ্বলি!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন