আশাপূর্ণা দেবী
আবার উটোউটি? আবার বেড়াল নাড়ানাড়ি কুকুর নাড়ানাড়ি? তোমার কতা আর সহ্যি হতেচে না বাপু। আবার ক্যানে? সাগরের চেরে ফাঁটা ভাঙ্গা গলার এই উত্তেজিত প্রশ্নটা যেন আর্তনাদের মত শোনায়, ‘না। কোথাও যাবনি। মরতি হয় এই চুলোতিই মরব।’
কাঠি চাঁছা নারকেল পাতার সরু ফালিগুলো দিয়ে জ্বাল ঠেলে ঠেলে ভাত সেদ্ধ করছিল সাগর। পাতা পোড়ার কটু গন্ধ ধোঁয়া। আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে উনোনের ধারটা, তবু তার অন্তরালস্থিত ভাত ফোটার গন্ধটা অটল দাসের সমস্ত চৈতন্যটাকে যেন একটা মোহময় সুখের স্বাদে আচ্ছন্ন করে তুলল।
অটল দাস তার অবুঝ পরিবারকে খিঁচোতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘অদেষ্ট। গাঁ ভুঁই ছাড়া অবদিই তো বেদের টোল ফেলে ফেলে দিন গোঞাচচি।’
কোথা থেকে যেন ঘুরে এসেছে অটলদাস, হয়তো এই সুসংবাদটি আহরণ করতেই তার যাওয়া। গরমের দুপুর, পরণের ঘাড়গাটা হাতা ছেঁড়া হাফ হাতা হাওয়াই শার্টটা ঘামে ভিজে সপসপিয়ে উঠেছে, পরণের খাটো খেঁটে তালি সেলাই মারা ধুতিটাও তথৈবচ। তবু অটল দাস শুধু জামাটারই তত্ত্বাবধান করতে উঠোনে নামল। উঠোন মানে তিন কোণা এক চিলতে মেটে জায়গা যার বুকে একটি পেয়ারাগাছ যেন সবুজ স্নেহে এই অনেক আশার স্বপ্নে ঘেরা ছোট্ট সংসারটুকুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাখা দুলিয়ে দুলিয়ে ভালবাসা জানায়।
এইখানে এসেই ওই পেয়ারার চারাটা পুঁতেছিল সাগর কোথা থেকে যেন সংগ্রহ করে। আর যত্ন নিয়েছিল প্রয়োজনের অতিরিক্ত।
তা গাছটা বেইমান নয়, ফল দিয়েছে। গত বছর দিয়েছে এ বছরও দেবার আশ্বাস। যেন আরো বেশীরই আশ্বাস। ছোট ছোট কষাকষা শিশু ফলের সম্ভারে ভরা শাখাগুলি তার ইসারা বহন করছে।
পেয়ারা গাছটার কোলের গোড়ায় সাগরের তুলসীমঞ্চ। সেও অনেক যত্নে গড়া। গাছটা হয়েছিল নিজের খেয়ালে, সাগর আহ্লাদে অভিভূত হয়ে এখান ওখান থেকে দু—চারখানা ভাঙ্গা ইঁট জোগাড় করে তার ঘের দিয়ে আর মাটি লেপে মঞ্চটি খাড়া করেছিল। সাঁঝের পিদ্দিমটা নিত্য দিতে অবিশ্যি তেলে কুলোয় না তবে সকালে জলটুকু দেয় নিয়ম করে। মনে মনে বাল্যের লেখা মন্তরটি উচ্চারণ করে, তুলসী, তুলসী নারায়োণ, তুমি তুলসী বৃন্দাবন…
অটল দাসের এক ভাজ এসেছিল একবার কোথায় যেন যাবার পথে। ধরে করে তাকে দুদিন রেখেছিল সাগর। অতিথ আত্মীয় এলে তাকে ধরাকরা করে থাকতে বলাই তো সংসারের রীতি। সেটাই সংসারের স্বাদ। সাগর যে আবার সংসার করতে পেয়েছে, এইটুকুই জানাতে ইচ্ছে হয়েছিল সাগরের দেশের দূর সম্পর্কের ওই জাটিকে। জানানো হয়েছিল ধরে রেখে আর যত্ন করে। চেনা মানুষই যদি সুখের দৃশ্য না দেখল তো সুখের অর্থ কী?
সাগর তখন তার সংসারটিকে ‘সুখের’ বলেই ভাবতে শুরু করেছিল। কারণ তখন অটল এই পড়ে পাওয়া ভাঙ্গা ঘরটুকুকে নিজের হাতে ছ্যাচাবেড়া, আর দর্মা তালি মেরে একখানা বাসস্থানের রূপ দিয়ে ফেলেছিল আর তিনকোণা ওই মাটিটুকু যাকে সাগর উটোন বলে সেইটুকুকে তখন কুড়িয়ে আনা বাঁশবাখারি কচাব ডাল বিছুটির ডাল দিয়ে ঘেরার কাজটা সদ্য শেষ করেছিল। আর সেই তখনই সাগরের পেয়ারা গাছটা সুগোল মসৃণ হালকা সবুজ রঙা ফলগুলি প্রসব করতে শুরু করেছিল।
আর তুলসী ঝাড়টা? যেন ভগবানের অকৃপণ আশীর্বাদের মত।
তা ওই গাছে জল ঢালার মন্ত্রটি কানে যেতেই বড়জা বলে উঠেছিল ‘আমরণ! তুলসী তো হচছেন গে মেয়েছেলে আদাআনীর সতীন, তাঁকে আবার ‘নারায়ণ’ বলা ক্যানো?’
সাগর এতো জানে না। সাগর তো শৈশবকালে গুরুজনদের মুখেই এই মন্ত্র শুনেছে আর শুনে শুনে শিখেছে। তাই সাগর তার এই শাস্ত্রজ্ঞ বড় জায়ের মুখের দিকে না তাকিয়েই প্রণামান্তে বলেছিল ভগোমানের আবার ব্যাটাছেলে মেয়ে ছেলে কী?
‘মরণ! ভগোমানের মেয়েছেলে ব্যাটাছেলে নেই? বলি মা কালীকে তুই বাবা কালি বলবি? না শিবঠাকুরকে মা গো শিবঠাকুর বলবি?
সাগর বুঝেছিল সুবাসিনীর এটা মনান্তর বাধাবার ছল। ভেতরের হিংসের প্রকাশ। সর্বস্বান্ত সাগর যে বেদের টোল ফেলে ফেলে অবশেষে একটা আশ্রয় পেয়েছে আর দৈত্যের মত পরিশ্রমী অটলের চেষ্টায় যত্নে সে আস্তানায় এমন লক্ষ্মীশ্রী ফুটেছে, তাই দেখে সুবাসিনীর ভেতরে ভেতরে হিংসের জ্বালা ধরেছে। উদাস গলায় সাগর বলেছিল তোমার মতন শাস্তোর পালা তো জানিতে সুবাসদি, ছোটকালে মা—পিসির মুকে যা শুনিচি, তাই শিকিচি।
‘ভুল শিক্ষে।’
সুবাসিনী আত্মস্থ গলায় রায় দিয়েছিল আদাআনীর পূজোয় তুলসী দেবার জো নাই। সতীন বলেই না?
তবু সুবাসিনীর যাবার বেলায় সাগর খইয়ের মোয়া করে দিয়েছিল চারটি, আর গাছের পেয়ারা দিয়েছিল পেড়ে পেড়ে।
চলে যাবার পর শংকু আর তুষু রাগ রাগ গলায় মাকে বলেছিল, ওই বুড়িটাকে সব মোয়াগুলান দিয়ে দিলি? গাচটা নিসুট্যি করে প্যায়ারা দিলি? ক্যানো? বুড়িটাতো পাজী।’
সাগর তাড়াতাড়ি বলেছিল, ‘ছিঃ। গুরুজন না?’
কিন্তু সেই সাগরই আবার বরের কাছে গুরুজনের নিন্দে করতে ছাড়েনি! গলা নামিয়ে বলেছিল, ‘যাই বলিস তোর ভাজ বড্ড খালি হিঁসকুটে।’
তা তুই—ই তো রাকলি পায়ে ধরে? অটলের সাফ জবাব দুদিন ওনার নৈবিদ্যি জোগান দিতে নিজেদের পেটে টান।
‘তা হোক’, সাগর জবাব দিয়েছিল, মানুষ মনিষ্যিতি বলে একটা কতা আচে তো? না কি নাই?
তার মানে সাগর ধরে নিয়েছিল এখন তার মানুষ মনিষ্যত্ব দেখাবার অধিকার জন্মেছে। তার মানে তখন সাগর ধরে নিয়েছিল; অনেক দুঃখু ধান্ধার শেষে আদার কেটে ভোর হয়েছে তার।
তকতকে করে লেপা পোঁছা তুলসীমঞ্চ চকচকে করে নিকোনো উনোন যুগল, ছ্যাঁচাবেড়া আর দর্মা ঘেরা এই ঘরখানির মধ্যেই সাজানো সংসার। এ সবের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেক দূর অবধি স্বপ্ন দেখতো সাগর কল্পনার রাশ ছেড়ে দিয়ে।
দেখবে না কেন? ভগবান যে তার সহায়। নচেৎ যখন এই অজানা গেরামের একটেরে এই ছোট্ট পোড়ো জমিটুকুনের উপর একখানা ভাঙ্গা কুঁড়ে দেখে তার মধ্যে স্বামী ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢুকে পড়েছিল, তখন অটল কি তার দুঃসাহসে কম ভয় পেয়েছিল? বলেছিল নাকি মালিক এসে দূর দূর করে বের করে দেবে কুকুর ছাগলের মতন পুলিশেও ধইরে দেতে পারে।
কিন্তু হয়েছে সে সব?
বানভাসি হয়ে ঘুরে ঘুরে সাত ঘাটের জল খেয়ে আর বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সত্যি বেড়াল নাড়ানাড়ি কুকুর নাড়ানাড়ি করে মরে, এই মাথা গোঁজার আচ্ছাদনটুকু পেয়েছে ওরা। গ্রামের লোকেরা বলে ‘এটা নাকি’ একটা সাধুর কুঁড়ে। একা এখানে বাস করতো সাধু। রাঁধতো কিনা রাঁধতো কে জানে দেখেনি কেউ, ভকত টকতও দেখেনি!
হঠাৎ আর কবে থেকে যেন দেখা গেল না তাকে।
শেকল তুলে দেওয়া দরজাটার ওপারে কি আছে দেখবার জন্যে কৌতূহলী ছেলেপুলে দরজাটা খুলে দেখেই পালিয়েছে। বলেছে, ‘ওরে সন্নিসীটা আবার আসচে রে। ঘরের মধ্যে দড়িতে কাপড় চাদর ঝুলতেছে।
কিন্তু কালক্রমে ঝড়—বৃষ্টি সেই শেকল বন্ধ দরজাখানাকেই কোথায় আছড়ে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে। সেই চাদর কাপড় কোথায় লোপাট হয়ে গেছে। কিন্তু ঘরটা বেদখল হয়নি। দখল নিলে এসে সাগররা।
অটল ভর দেখালেই সাগর মুখ ঝামটা দিয়েছে, ‘কতো লোক কতো জামজিরেৎ জবর দখল করে ঘর বাড়ি বানিয়ে রাজা হয়ে বসতেছে, শুনতে পাসনে? কি হয় তাদের? গরমেণ্ট হার মেনে ছেড়ে দেয়। আর এতো বেঅয়ারিশ! কার জায়গা গেরামের লোকও জানে না। বলে পুকুরটা আগে মস্ত ছেলো শুকোতে শুকোতে এই জমি উটেচে।
অতসব সাগর স্বপ্ন দেখেছে।
কিন্তু সাগরের স্বপ্ন আর তার কল্পনার পাখায় ভর করে বেশী দূর এগোতে পায়নি। দিনকাল খারাপ হয়ে যাচছে দিনের দিন। ছেলেমেয়ে দুটো ক্রমশ ডাগর হয়ে উঠছে। শুধু ভাত জোটাতেই জান ছুটে যাচ্ছে অটলের। জাত ব্যবসা ঘরামির কাজ করে নগদা মজুর খেটে যখন যেভাবে পারে উঞ্ছবৃত্তি করে, যা পাচছে শুধু জঠরাগ্নিতে আহুতি দিতেই ফুরিয়ে যাচছে।
সাগর যে ভেবেছিল হাঁস পুষে আর ছাগল পুষে সে নিজে কিচু ওজগার করবে তা আর হবার আশা কই? প্রথমটায় তো পয়সা কড়ি খরচা করে তারপর শুরু করতে হবে?
তবু সাগর এই হাভাতের সংসারেও—তুলসীতলা নিকোয় দাওয়ায় কোলে পাতা উনুন দুটোকে পরিপাটি করে মাটি লাগায় ভাত কটা সেদ্ধ হয়ে গেলেই…কাজে তো লাগে একটা উনুন পাতা লতা জ্বেলে ভাতকটা সেদ্ধ করতে তবু দুটো উনুনকে সমান যত্ন করে সাগর।…
পাতবার সময় অটল হেসেছিল। ‘প্রাণপাত করে পুকুর পাড় থেকে মাটি নে এসে দু দুটো চুলো গড়বার কি দরকার পড়ল রে সাগর? কত যজ্ঞি রাদবি?
এখন সাগরের সামান্য যা পুঁজি ছিল তাও একটা করে বিক্রমপুরে যাচছে। কিছুদিন অটল দাস হঠাৎ বেশ কিছু রোজগার করে ফেলেছিল। কেমন যেন কাজ পেয়ে যাচছিল ঝপাঝপ গ্রামের আর একজন আধবুড়ো ঘরামি তার সাকরেদের সঙ্গে ঝগড়া করে আলাদা হয়ে গিয়ে হঠাৎ অটলদাসকে দেখে লুফে নিয়েছিল।
কাল হলো ডালভাঙ্গা গ্রামে এক যাত্রা পার্টি আসায়। যাত্রাদলের প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজে কাজ পেল অটল দাসের সেই মুরুব্বি ফকির মোড়ল, অতএব অটলও। অসুরের মত খাটল অটল, ফকির গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে তদারকী করল আর মজুরি ভাগের সময় ফকির একেবারে চোখের চামড়াহীনের মত কাজ করল। করল তার কারণও ছিল, ফকির টের পেয়ে গেল তার পুরনো সাকরেদ তলে তলে তার জামাই হবার পথ পাকা করে বসছে। অতএব তার সঙ্গে মিটমাট করা ছাড়া গতি কী।
কিন্তু অটল দাস এতো কারণের ধার ধারবে কেন? ছেড়ে দিল ফকিরের সাকরেদি।
একাই কাজ চালাতে লাগল বটে অটল, কিন্তু তেমন সুযোগ সুবিধে জোটে না। ফকিরকে সবাই চেনে, তার সঙ্গে আর কে আসে কে দেখে?
তারপর তো ক্রমশই আকাল লাগছে দেশে। রুজি—রোজগার শূন্যের অঙ্কে ঠেকতে বসছে।
ফকিরের কাছে থাকতে থাকতে তার সঙ্গেই মাঝে মাঝে হাটে গিয়েছে অটল, সাগরের বায়না মিটোতে এটা—ওটা কিনে কিনে এনেছে।
না, সাগর কোনদিন গন্ধতেল কাচের চুড়ি সাবান আলতা চায়নি, ডুরে শাড়িও না, সাগরের বায়না শুধু সংসারী জিনিসে। ‘নোয়ার একটা কড়াই’ যেই হলো, অমনি সাগরের মাথায় ‘দুখান এনেমেলের শানকির ভূত চাপলো। সেটা যদি হলো তো একটা সিলবারের ভাত আঁদবার হাঁড়ি।
মাটির হাঁড়ি মালসা নিত্যি ভাঙ্গে ‘ছুঁতো’ হয়।
একে একে সাগরের অনেক কিছু হয়েছিল। বঁটি, কাটারি, শিলনোড়া, ডালের কাঠি, এনেমেলের থালা চারজন—এর চারখানা ইত্যাদি।
পিঁড়ি অবশ্য অটল বানিয়ে দিয়েছিল।
দাওয়ার ধারে সেই পিঁড়িতে বসে সাগর যখন উনুনে কাঠ ঠেলতে ঠেলতে ঘটঘটিয়ে ডালে কাঠি দিত, রাণী মনে হতো সাগরের।
ক’দিনেরই বা খেলা? কালের কবলে সবই যাচ্ছে একে একে।
এই সেদিন প্রাণের অধিক প্রিয় ‘সিলবারের’ হাঁড়িটা বেচে দিতে হয়েছে গোষ্ঠ মুদির কাছে দেনার দায়ে।
তাছাড়া খুচখাচ সবই গেছে, ননী ধোপানীর কাছে, দীনু কামানীর কাছে, সত্য গয়লার মেয়ের কাছে।
তাছাড়া দরকারও তো ফুরিয়ে আসছে ক্রমশঃ। ডালই যদি রান্না না হয় তো ডালের কাঠি কোন কর্মে লাগবে? ব্যঞ্জন না রাঁধলে বাটনা বাটবার শিলনোড়া? কুটনো কোটার বঁটি?
ভাতই কি সবদিন জুটছে আর? হয়তো দুদিন হাহাকারের পর একদিন নারকেল পাতা পোড়া গন্ধের সঙ্গে ভাত ফোটার গন্ধ।
মাঝে মাঝে নারকেল কাঠি চাঁছার কাজ জোটায় সাগর, তার দরুন ওই সরু সরু কাঠিগুলো পায়।
ঘামে ভেজা জামাটা ঝেড়ে পেয়ারা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়ে অটল একটা কাঁচা ডালের আগা ভেঙ্গে নিয়ে সেইটা দুলিয়ে দুলিয়ে বাতাস খেতে বলল, ‘রান্না হয়ে গেচে?’
এখন ‘সিলবারের’ হাঁড়ি নেই। আবার মাটির মালসা। ফেন গালারও প্রশ্ন নেই। ভাত সেদ্ধ হয়ে আসার মুখে জ্বাল টেনে নিলেই ফেন বসে ভাত ঠিক হয়ে যাবে।
সাগর সেই জ্বাল টেনে নিতে নিতে ভারী গলায় বলল, ‘আন্না একেবারে ধনে ধান কাবাসে বান’ কতো। শউর—শাউরির মরার হবিষ্যির পিণ্ডি আঁদচি।
অটল জো পায়। বলে ওঠে, তবু তো ঘোট করে বসে থাকতি চাইছিস। মরি তো এইখেনে মরবো। বলি নিজেরা নয় না খেয়ে মরলাম, শংকু? তুষু?
সাগরের দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে অসহায়তা। তবু তার গলার স্বর কঠিন, ‘বাস উটিয়ে যেখেনে যেতি বলচো সেখেনে দুবেলা খেতে দিতি পারবি ওদের, এ গেরাণ্টি আচে?’
অটল উৎসাহের গলায় বলে, না থাকলি কি বলতেচি? পেট পুরে খেতি দেবে, থাকবার জায়গা দেবে—’
সাগর আরো কঠিন মুখে বলে, ‘তুই যেমন গাড়োল তাই এইসব কতায় বিশ্বেস করতেচিস। কার বাপ—মা মরা দায় পড়েচে যে তোকে আমাকে বুকে ধরে নে গিয়ে খেতি পরতি দেবে? গরমেণ্ট? সেবারে যেমন দেছলো?
অটল একটু নিস্প্রভ গলায় বলে, ‘সে আর এ এক হল?’
‘ও সবই এক।’
‘ও সবই এক।’ সাগর দৃঢ় গলায় বলে, ‘য্যাখন বেদের টোল ফেইলে ফেইলে ঘুইরে মরিচি, ত্যাখন পিত্যেক বার বলিস নাই, সাগর বাঁচতে চাস তো চল এখেন থেকে—। দুটো কাঁচা খোকা খুকি কোলে নে, কী নাটাপাকড়ি খেইচি তা আমিই জানি আর ভগোমান জানে।’
অটল এখন খেঁকিয়ে ওঠে বলে, ভগোমান দেলো তো, রুজি—রোজগার কেড়ে নেলো না? পেটে কীল মেরে আর কদিন চলবে? নেকচার বাবুরা তো বলতেচে এ কতা? না খেয়ে কদিন থাকবে তোমরা? চলো—ভাতের দেশে, মাচের দেশে—’
সাগর দপ করে জ্বলে ওঠে, ‘বুড়ো হয়ে মরতি চললি, ঘটে একটুকু বুদ্ধি এলো না? নিযাস এই ঘরখানা আর জমিটুকুন নে নেবার মতলোব, তাই ভুজুং দিয়ে ঘরছাড়া করতি চাইচে।’
এবার অটলের অটহাস্যের পালা আমায় তো বোকা বুদ্ধু নিব্বুদ্দি অনেক বলিস, নিজে কী? নেকচার বাবুরা আমাদের এই ছ্যাঁচা বেড়ার ঘরখানা নিতি আসবে? যেনারা জিপ গাড়ি চড়ি রাস্তা মাতিয়ে আসচে যাচচে। শুদু তোকে আমায় বলতেচে না কি? রসুলপুর জবর দখল কলোনির সব্বাইকে বলতেচে। গরমেণ্ট তো না, ওনারা হল গে, দেশসেবা মানুষ।
অটল মহোৎসাহে বোঝাতে থাকে শুনে এসেছে এইসব দুঃখী মানুষদের জন্যে ব্যবস্থা হয়ে গেছে, নিশ্চিত অন্নের নিশ্চিত আশ্রয়ের।
যত কথা শুনে এসেছে অটল, তবে সবটা বলে তার অবুঝ পরিবারের কাছে। হয়তো বা বেশী করেও বলে। তার মনটা এখন দড়ি—ছেঁড়া হয়ে গেছে। দেখতে পাচছে ওই যাত্রায় সে আর এতোদিনের মত একা নয়। সঙ্গী আছে। সঙ্গী পাবে। দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে।
এযাবৎ নিজেরাই ভেসে ভেসে বেড়িয়ে বেড়িয়ে আশ্রয় খুঁজছে দুটো কচি ছেলেমেয়ে নিয়ে।
শহরবাসী বড়মানুষদের গাঁয়ের পোড়ো দালান বাড়ী ভেঙ্গে হুমড়ে পড়া ঠাকুরবাড়ীর দালানের আস্ত একটু কোণ, ছেলেদের কেলাব ঘরের পিছনের এক টুকরো চাতাল। কত জায়গায় হাঁপিয়ে বসে পড়েছে পুঁটলি পাটলা আর বাচ্চা দুটোকে নিয়ে, জায়গাগুলোকে আপাত বেওয়ারিশ ভেবে। ওমা কোথা থেকে না কোথা থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে ওয়ারিশ এসে হাজির হয়েছে, দূরদূর করে তাড়িয়ে দিতে।
আবার বুকে বল করে লোকেরা দোরে দোরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে এই আবেদন নিয়ে,মাইনে দিতি নাগবেনি বাবু। শুদু দুটো ভাত, আর একটু আশ্রয়। দুই মানুষে গতরে খেটে শোধ দেব—ঘরামির কাজ জানি। কোলে দু—দুটো ছেলে নিয়ে এই আবেদন।
কেউ মুখ বাঁকিয়েছে, কেউ উপহাসের হাসি হেসেছে।
সাগর বুঝে ফেলে কাতর অনুনয় করেছে ‘এদিগে কিচু দিতি হবেনি মা, আমাদের পেট মেরেই এদিগের পেট চাইল্যে দেবো—’ কিন্তু সাগর পাগল বলে, তারা তো আর পাগল নয়?
সেবার অনেক দুঃখের শেষে একবার হঠাৎ কপাল খুলে গেল। একটা খামার বাড়ীতে কাজ পেয়ে গেল তারা। মালিক কাজ চায়, পাহারাদার চায়। স্ত্রী পুত্র কন্যা সমেত একটা লোকের মত নির্ভরযোগ্য পাহারাদার আর কোথায় মিলবে? চুরিচামারি করে চট করে পালাতে পারবে না।….
চার—চারটে পেট বলে চমকালো না খামারের মালিক। দুটো ভাতে তার কিছু যায় আসে না। কাজ দরকার। তা কাজ সে ভদ্রলোক পেয়েছিল বৈকি।
মরা হাতী লাখ টাকা রোদে জলে ঘুরে বেড়ানো অটল দাসও দুটো দিন মাথায় তেল আর পেটে ভাত পেয়ে অসুর অবতার… সাগরও কম নয়।…বস্তা বস্তা মুগ কলাই অড়র খেসারি তোলাপাড়া ঝাড়াবাছা, কুলো পাছড়ানো, এসব কাজ অবলীলায় করেছে সাগর, আর অটল থেকেছে শস্যের ভার ক্ষেত থেকে এনে খামারজাত করা আর আবার তাদের লরীতে বোঝাই করার কাজে।
খাটুনি থাকুক বড় আনন্দে কেটে ছিল সেই দিন ক’টা।
কিন্তু অভাগার ভাগ্য। সেই ভর—ভরন্ত খামার বাড়িতে একদিন লাগলো আগুন।
তার মানে আগুনই অটল দাসদের কপালেই লাগলো।
হতাশ অটল ছুটে মনিবকে খবর দিতে গেছে। সেও তো অনেকটা দূরে।
ওই ভস্মাবশেষের কাছে লুটিয়ে পড়ে অটল দাস বুক চাপড়ে মাথা চাপড়ে বলেছে, বাবু আমায় জেলে দেন, ফাঁসি দেন, গলায় পা দে মেইরো ফেলান। হতভাগা আমি আমার কোত্তব্য কোরতে পারি নাই। আমি থাকতি, এই সব্বোনাশ হয়ে গেলো। তবে ভগোমান সাক্ষী বাবু অটল বেইমান নয়।
কর্তা ওর হাত ধরে তুলে বলে ছিলেন, আচছা আচছা থাম। তোরা চারটে যে বেগুনপোড়া হয়ে মরিসনি এই আমার ওপর ভগবানের দয়া।…এ কাজ যে কে করেছে তা বুঝেছি আমি। জ্ঞাতি শত্রুর কাজ। তোরা আর কি করবি বাবা! এখন, অন্য কাজ দেখগে।
অতএব আবার নিরাশ্রয়। মাইনের দাবি ছিল না, তবু অতোখানি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষটা জোর করে অটল দাসের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিলেন না করিছস কেন? কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে রাত পোহালে মুখে দিবি কী?
‘মানুষ না, দ্যাবতা। বলেছিল সাগর।
আর সেই দেবতার আশীর্বাদীটুকুর শেষাংশ হাতে থাকতে থাকতেই ভগবানের দেওয়া আস্তানা পেয়ে গিয়েছিল ওরা।…তখন অটল দাস আর সাগরবালা ভেবেছিল এবার রাত কাটলো, সকাল হলো, এখন শুধু আলোর দিকে এগোনো।
কিন্তু নিভে গেছে সেই আলোর আশ্বাস। আর কি দিন ফিরবে? তবু সাগর তার বড় যত্নে গড়া এই সংসারটার দিকে তাকিয়ে দেখে। ঘরের মধ্যে সারা দেওয়াল জুড়ে পেরেক গুঁজে গুঁজে জিনিস রাখা।…ঠাকুরের পট, মাটির টিয়াপাখী, সাধুর ঘুড়ি ইত্যাদি।
ঘরের একধারে দেওয়াল ঘেঁষে অটল দাসের নিজের হাতের শিল্প কলার নমুনা—বাঁশ বাখারি দিয়ে গড়া আধখানা ঘর জোড়া নীচু মাচান।
এইসব বাঁশ বাখারি সবই সংগ্রহের জিনিস। পরের ঝাড়ের বাঁশ কেটে নেওয়াকে খুব দোষের মনে করে না অটল।…
কেউ বাঁশ কাটতে দেখে জিগ্যেস করলে অটল সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলে, ‘বাবুদের নেগে কাটতেচি।’
একজন ঘরামির পক্ষে এটা খুবই স্বাভাবিক, তাই দ্বিতীয় কথা ওঠে না।
ওই মাচাটা বানাবার সময় সাগর বকবক করেছিল, জানিনে বাবা, এ আবার কী মোতি বুদ্ধি। ওইটুকুখানি ঘরের মদ্যে একখান বীরভদ্দর মাচান কিসের নেগে।’
কিন্তু পরে যখন অটল দাস তার উপর চ্যাটাই চট বিছিয়ে মাদুর কাঁথা সাজিয়ে বিছানা পেতে ফেলল, আর হাঁড়ি কলসী বাসনপত্রগুলো তার তলায় ঢুকিয়ে লুকিয়ে রাখল, তখন সাগর হঠাৎ ঢিপ করে তাকে একটা পেন্নাম করে বলেছিল ‘ধন্যি বটে। করেচো একখান কাজের মতন কাজ।’
এইসব ফেলে রেখে অনিশ্চিত এক অজানার উদ্দেশে পা বাড়াতে হবে? সাগর বলে উঠে, ‘কাদায় গুণ ফেলে বসি থাক। আবার দিন আসবে।’
আসবে! বলেচে তোকে। দেকচিস মানুষ দলে দলে গেরাম ছেড়ে চলে যেতেচে।’
এটা অস্বীকার করতে পারি না সাগর। একটু গুম হয়ে থেকে বলে ওঠে, তার মানে আবার সেই হাঁটা। সেই পা ছিঁড়ে পড়া, মাজা খসি পড়া!…আর শংকু, তুষু? ওরা পারবে হাঁটতি?’
‘এই দ্যাকো! তবে এতোক্ষণ শুনলি কী?’ অটল দাস একটু চতুর হাসি হেসে বলে, ‘হাঁটনের দিক দেও যেতি হবে না! ওদের ‘টেরাকে’ চড়িয়ে নে যাবে সব্বাইকে।’
সাগর ভ্রুকুটি করে, ‘ওদের গরজ?
অটল অকারণেই গলা নামিয়ে বলে, ‘অটল দাস যে নিজেকে কলোনির লোক বলে নাম নিকিয়ে এলো রে।’
‘তুই নিকিয়ে এলি, আর ওরা নিকালো?’
‘আরে বাবা, অনেক প্যাঁচ কষে কায়দা কোশুল করে তবেই হয়েছে। এখোন ওদের সবার যা বেবস্থা, আমাদেরও তাই বেবস্থা?’
‘আর ধরা পড়লে?’
‘দূর ক্ষেপী! এর আবার ধরা পড়াপড়ি কী? বসন্ত সাক্ষী দেচে অটল দাস তার বোনাই!’
সাগরের মন অটলের মত খোলামেলা নয়, খুঁৎখুঁতে। তাই সেই একইভাবে বলে, ‘ক্যানো? বসন্ত মিচে কতা বলতে গ্যালো ক্যানো?
‘আহা দোস্তি হয়েচে না ওর সঙ্গে? দোস্তোর জন্যি একটু মিচে কতা কইলে পুণ্যি বৈ পাপ নাগে না।…ঘর এমন নিঃঝুম যে? ব্যাটা বেটি দুটো গ্যালো কোতা? খাবেনি?
‘ঘাটে গামচা ছাঁকা দে পুঁটি ধরতে গ্যাচে। বলেছে মাচ এনে তবে মাচ পোড়া দে ভাত খাবে।’
অটল হেসে বলে, ‘লবাবের ব্যাটাবেটি। নে বাবা চল এবার মাচের রাজ্যিতে। কত খাবি খা।’
সাগর সন্দেহের গলায় বলে, ‘কোনখেনে নে যাবে?’
অটল আত্মস্থ। বলে ‘গোসাবা, বাসন্তী, মোরেলগঞ্জ। সোঁদরবন, বুইলে সোঁদরবন।’
সাগর চমকে ওঠে, ‘সোঁদরবন! মোরেলগঞ্জ! সেখেনে নে যাবে? সত্যি ঠিক বলতেচো?’
অটলও চমকায়। বলে, ‘তা শুনে এমন বেভুল মারলি ক্যানো? আচে না কি কেউ সেখানে?
এখন নাই—’ সাগর যেন আচ্ছন্নের মতো বলে, ‘ছেলো। বাবা ছেলো। আর আমি ছিনু।’
‘তুই ছিলি? সোঁদর বনে গেচিস তুই?’
অনেক দিন পরে সাগরের গলায় অভিমানী তরুণীর কণ্ঠ শোনা যায়, ‘জানিস নাই না কি? ছোটকালে গপপো করি নাই? আমার কতা তো কখনো কান দে শুনিস না। মা মরে যেতে আতদিন কাঁদি কাটি, পিসি বাবাকে বললো, মেয়েটারে তোর সঙ্গে নে যা। বোটে বোটে ননচে ননচে ঘুরবে, দশটা দিশ্য দেকবে, মনডা বুঝ হবে।
…তা নে গেল বাবা। …বাবা তো একজনা ফলেস্টাবাবুর চাপরাশি ছেলো? বাবু আমাদের ‘পাঁজিয়া’ গেরামেরই। বাবাকে চাকরি দে নে গেছল চেনা জানা বিশ্বাসী নোক বলে। ধলাইতলা ঘাট থে নৌকোয়, তারপর ননচা। কাঁহা কাঁহা মুলুকে যে গেচে বাবা আমায় নে।’
সাগর আনমনা ভাবে বলে, ‘ফলেস্টা আপিসের বাড়িগুলান কী সোন্দর। ইয়া ইয়া খুঁটি গেড়ে তার উপরি কাটের পাটাতন দে উঁচু বাড়ি বানিয়েচে যেন সায়েব বাড়ি। সিঁড়ি দে উটে গেলে দেকবি তার মদ্যি চ্যায়ার টেবিল খাট বেছনা। বারেণ্ডা দে ঝুকে ঝুকে দ্যাকো ওই জলির মদ্যি ক্যাঁকড়া শিঙ্গি জলঢোঁড়া সাপ কিলবিলোচচে, তার সঙ্গে আবার কুচো চিংড়ি ছটকাচছে।
‘কুচো চিংড়ি ছটকাচছে।’
অটল জিভের জলটা একটু শুকিয়ে নিল। বলল, ‘তোর ভয় নাগতো নি?’
‘ভয়? ত্যাখোন কি আর ভয়ের বয়েস গো? বরং সোঁদরবনে এসে বাঘ দেখনু না ক্যানো এই আক্ষেপ করে করে বাবাকে জ্বালিয়ে খেতুম।…বাবা বলতো ‘খবরদার নাম করবিনে। বল মা বনবিবি রক্ষে করো।’…বাবার মনিব বাবু, নাম মনে নাই, আমি সদ্য মা মরা গেচি বলে কতো ভালো কতা বলতো।…আর কী খাওয়া। বললে হাঁ হবি। যতো বেপারিদের নৌকো পাশ করবে, সব থেকে ফলেস্ট্রো বাবুকে ভেট দে যাবে।….একা বাবু কত খাবে। বস্তাবন্দী নারকেল, কলসী কলসী মদু, কাঁটাল, হাঁসের ডিম, হরিণের মাংস আর মাছ। নেকাজোকা নেই এতো মাচ। ঝোড়া ঝোড়া মাচ ঢেলে দে যায় আপিস বাড়ির বারেণ্ডায়। মাচ খেয়ে খেয়ে অরুচি জম্যে গেচলো। ভাত মানেই মাচের ছেরাদ্দ।
অটল দাস তাড়াতাড়ি বলে ‘আহাহা এই ভালো ভালো গপ্পো সব ফুইরে ফেলাস না…ওদের আসতে দে—’
সাগর মুচকি হেসে বলে ‘ওর অনেক শুনেচে।’
তা শুনেছে বৈকি। ছেলে মেয়ের কাচে গল্প মানেই তো ছেলেবেলার গল্প।
অবিশ্যি বেশীদিন বাপের সঙ্গে ঘুরতে পায়নি সাগর। একটু ডাগর হতেই গাঁয়ে রেখে গেলো বাপ পিসির কাছে!
শংকু আর তুষু এলো ঘেমে লাল হয়ে।
তবু বিজয় গৌরব। চার—পাঁচটা পুঁটি পেয়েছে! আবার ক’টা ‘ঘেনি কাঁকড়া!’
‘ওমা, পোড়া নয় পোড়া নয় ঝাল রেঁদে দে—
‘এখোন অ্যাতো বেলায় আবার ঝাল। আকার গরমের মদ্যি গুঁজে দে, দিব্যি দলকে যাবে, নুন দে মেকে খাবি।’
‘না মা না।’ শংকু বলে ‘অ্যাতো কষ্ট করে ধরলাম—’
অগত্যাই উঠতে হয় সাগরকে।
অটল মেয়েটাকে কাছে টেনে পেয়ারা ডালটা দিয়ে বাতাস করতে করতে বলে, ‘এই মাচটুকু নিয়েই অ্যাতো আহ্লাদ? এইবার চল মাচ—ভাতের দেশে!
‘মাচ ভাতের দেশে!’
অটল বোঝাতে বসে ছেলেমেয়েদের। হ্যাঁ, স্বর্গরাজ্যই। প্রাচুর্যের দেশে। ফেলা ছড়ার দেশ। মাছ খেয়ে খেয়ে অরুচি জন্মে যায় সে দেশে।
‘অ্যাঁ।’
‘সোঁদরবন?’
‘মায়ের বাপের সেই সোঁদরবন? শংকুর মুখ উত্তেজনায় আরক্ত।’
অটল হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, বাপ! তোদের মায়ের বাপের সেই সোঁদরবন! এ্যাখোন তোদের বাপের হবে।’
‘বাপ, শব্দটার উপর একটু কৌতুক হাস্যের মিশেল দেয় অটল দাস। তুষু আর শংকু বাপের এই হাস্যরঞ্জিত মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বর্তে যায়। কত কত দিন যেন বাপের এমন হাসি হাসি মুখ দেখে নি তারা। সর্বদাই তো একটা রুক্ষ—শুষ্ক উদভ্রান্ত চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচছে অটল।
তবে যতো দুর্দশাই হোক, ছেলেমেয়েকে কখনো গালমন্দ করে না অটল। শুধু কথাবার্তাগুলো ছাড়া—ছাড়া নীরস বিরস। আর তুষুর বন্ধু পুঁটির বাপ? রাত—দিন ছেলেমেয়েদের গাল দেয়, দূর হয়ে যা না, দূর হয়ে যা। আমার হাড়ে বাতাস নাগুক।
পুঁটির মা নেই। পাঁছ—ছটা ছেলে মেয়েকে ফেলে রেখে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে।…দেখে অবাক লাগে তুষুর। মা—বাপ আবার অমন রাক্ষোস—এর মতন, ডাইনের মতন হয়?
তবু উদভ্রান্ত অন্যমনস্ক বাপের দিকে আজকাল আর তেমন ঘেঁষছিল না তুষু। নইলে মেয়ে তো ছিল অটলের গলার হার। কাজে যাচছে মেয়ে সঙ্গে করে, হাটে যাচছে মেয়ে কাঁধে করে, খেতে বসতে তো মেয়েকে সঙ্গে চাই—ই চাই।
সাগর যদি রাগ করেছে, ‘ওকে তো পেট চিরে গিলিয়েচি, আবার নিজের থে ভাগ দেওয়া ক্যানো?
অটল হেসে হেসে বলেছে, ‘তুষু যেন তোমার সতীন ঝি! বুইলি তুষু? ওইটা তোর মা না, সৎমা।’
শংকু সাহস করে বলে, সোঁদরবনে অনেক মদু আচে না বাবা?
‘আচেই তো—মদু তো আচেই।’
অটল উৎসাহে ওঠে দাঁড়ায়, ‘আসল কতা বল মাচ আচে, ভাত আচে। দুবেলা পেট পুরে শুদু ভাত আর মাচ! তার সঙ্গে ওসব তো আচেই। মদু কাঁটাল নারকেল পানিকল—পাঁটা হাসের ডিম—’
ছেলে মেয়ে দুটো বাপের গা ঘেঁষে বসে। জ্বলজ্বলে চোখ নিয়ে শুনে যায়।
কী সূত্রে কোন পথ দিয়ে আসবে এসব কথা ভাবে না অটল দাস। ওর স্বপ্নাতুর চোখের সামনে ওই মায়াময় আকর্ষণীয় জিনিসগুলো যেন ভেসে ভেসে উঠতে থাকে নাম—না—জানা নোনা নদীর জল থেকে।
অটল নদীর নাম জানে না। সাগরেরও যে খুব মনে আছে তা নয়, তবু স্মৃতির অনুশীলন করতে করতে হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে যাচছে—’ভোলা’ ‘বলেশ্বর’ ‘রূপসী’ ‘মৌলা’।
মনে পড়াতক শৈশব বাল্যের সেই ধূসর স্মৃতি, যা নাকি বানের জলে ধুয়ে যাবার কথা, আর এত দিনের ঝড়—ঝঞ্ঝার উড়ে যাবার কথা, তা যেন আবার নতুন রঙের ছোপ খেয়ে খেয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ছেলেমেয়ে দুটোও মায়ের চোখ দিয়েই যেন সেই সমারোহময় জীবনের ছবি দেখতে পায়।
‘মা, কবে যাওয়া হবে?’
‘তোর বাপকে শুদো। ওজই তো বলবে দু দিন বাদ।’
‘দু দিন দু দিন করে দশ দিন হয়ে গ্যালো।’
‘মা, আমার গিন্নী পুঁতুলটা নে যাবো?
‘শুদেগে তো বাপকে। বলচে তো কিচ্চু নে যেতে হবে নি, মোট পুঁটুলিতে ভার করতি হবে নি, ওরা সব দেবে। তুই ওটাকে নুকিয়ে সঙ্গে নে।’
‘মা প্যায়রাগুলান সব গাঁয়ে পড়ে থাকবে?’
সাগরও সেই সবুজ পাতার নাচনের আড়ালে লুকিয়ে বসে—থাকা ছোট ছোট পেয়ারাগুলোর দিকে তাকিয়েছিল।
সামনের আকর্ষণ তীব্র, তবু ফেলে যাওয়া মাটির মমতাও তো কম নয়। এক এক সময় মনে হয়, চিরদিন কি আকাল যাবে? কষ্ট করে আর কিছু দিন এখানে চেপে বসে থাকতে পারলে আবার সুদিনের মুখ দেখা যেতো।
‘মা, সেই দেশটা খুব সোন্দর বলে সোঁদরবন নাম, তাই না?
‘তাই তো। আবার কী? শংকুর খুব বুদ্ধি আচে।’
তলে তলে দেয়ালে গোঁজা পেরেকগুলো উপড়ে উপড়ে জড়ো করে সাগর। আঁচলের কোণে বেঁধে নিয়ে যাবে। যাওয়া মাত্তর কে সাগরকে পেরেক দড়ি এসব জোগান দেবে?
‘থাকতে তো দেবে, কিন্তু ঘরটা কেমন দেবে? মনের মধ্যে প্রশ্নের তোলাপাড়া।
নিজেই চাপান নিজেই কাটান। নিঘঘাত ছোট মোটই হবে। বলেছে বটে, জবর দখলের মানুষগুলোকে মনিষ্যি হয়ে তারা ছাগল ভেড়ার মতন খোয়াড়ে পড়ে আচিস, দেখে প্রাণ কাঁদে—’
তবু এতো হুদো হুদো নোককে কি আর পেল্লাই পেল্লাই ঘর দিতি পারবি? ধরে নেয় সাগর ছোটই ঘর, কিন্তু কেমন হবে তার চেহারাটা?….সেই অদেখা ঘরটাকে কিছুতেই স্পষ্ট করে তুলতে পারে না সাগর।
‘খণ্ডখোলা’ গ্রামের তার সেই শ্বশুর বাড়ির মাটির ঘরটা, সেই কিছু দিনের বাসা খামার বাড়ির খড়ের চালাটা মামুদপুরের এই ছ্যাঁচা বেড়ার ঘরটা, সব যেন একাকার হয়ে যায়। আর তার উপর মোহময় একখানা ঘরের ছবি মাঝে মাঝে আবছা হয়ে ভেসে ভেসে ওঠে।
মোটা মোটা উঁচু উঁচু গরাণের খুঁটি শালের খুঁটির উপর কাঠের পাটাতন পাতা, তার উপরে বারান্দা—ঘেরা ছবির মতন সুন্দর বাড়ি! ভিতরে খাট বিছানা আয়না আলনা।
‘কবে তোমার টেরাক আসবি শুনি? সাগর যেন আর এই ভাঙ্গা সংসারটা টানতে পারছে না। বর্ষা পড়ে গেছে, জলের ঝাপটায় দাওয়ায় বসে ভাত রাঁধা যায় না, ঘরের মধ্যে নারকেল পাতার জ্বালের ধোঁয়ায় অন্ধকার।
সাগরের মনে হয় ছুটে বেরিয়ে গিয়ে সেই রথে চড়ে বসে, যে রথ তাদের নিয়ে যাবে সেই সবুজ দিগন্তের দেশে।
‘তোকে ভাঁত্ততা দিয়ে বাড়তি একটা নাম নিকিয়ে নেচে মুকপোড়া বসন্ত। দেকিস, ওই টিকিটে ওর সত্যি কার বোনাই বেয়াই কেউ টেরাকে চড়ি পড়বে। য্যাখন বাবুরা খাতা ধরি বলবি—অটল দাস? অন্য আর একটা মিনসেকে ধরে দেকিয়ে বলবি এই যে হুজুর।’
অটল অটল বিশ্বাসে বলে, কী যে বলিস! তুই যে যাত্তারা পালা নিকলি না ক্যানো, তাই ভাবতেচি। দেকিস পরে।
তবু ভিতরে ভিতরে ভয় নেই তা নয়, তাই এবেলা ওবেলা তিন চার মাইল রাস্তা হেঁটে রসুলপুর ঘুরে আসে অটল।
তারপর সত্যিই একদিন আসে।
‘কাল ভোর রাত্তিরে টেরাক আসবি—হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে অটল, বেলা বারোটায় ছাড়বি। বসন্ত বলে দেচে শেষ রাত্তিরে গে পৌচে বসন্তর গুষ্টির সামিল হয়ে বসি থাকতি! আর আলসেমি না।—শংকু, তুষু, তোদের ঘুম ভাঙ্গবে তো ত্যাখন?’
ছটফট করে বেড়ায় অটল দাস।
একবার তার নিজে হাতে বাঁধা বেড়ার ডালগুলো টানে, একবার দর্মার দেওয়ালগুলোয় হাত চাপড়ায়, একবার বসে, একবার হাঁটে।…সাগর কিন্তু সুস্থির। ও যতটা সম্ভব পুটলী বাঁধছে।
ওদিকে দশ বছরের শংকু গাছে উঠে, কষা কষা পেয়ারার গাদা পেড়ে পেড়ে জড়ো করছে। কিন্তু ট্রাক কই?
ভোর থেকে বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া, বসে থাকতে থাকতে কাঁপুনি ধরে যাচছে।…অটল দাস ঘোরাঘুরি করছে, আসছে—যাচছে, সাগর তার পুঁটলি পোঁটলা আর ছেলেমেয়ে দুটোকে আগলে নিয়ে বসে আছে শুকনো মুখে। আর থেকে থেকে ভগবানকে শাপ—শাপান্ত করছে এই দুর্যোগের জন্যে।
হঠাৎ অটলদাস ঘুরে এসে একটা সুখবর দিল।
ট্রাক আসছে। তার সঙ্গে আরো একটা ট্রাক আসছে তার মধ্যে হাণ্ডা হাণ্ডা খিচুড়ি। কলোনির লোকেরা আজ সংসার উঠিয়ে চলে যাচছে, রান্না খাওয়ার সুবিধে হবে না, তাই এই ব্যবস্থা?
‘ভগোমান। তুমি তবে আচো।’ সাগর দুহাতে নিজের নাক কান মলে, ‘হেই ঠাকুর, হেই ভগোমান, অপরাদ নিওনি।’
ঝড়ে শালপাতা উড়ে যাচছে, বা হাতে চেপে ধরে তবে খাওয়া। স্বাদও যদি না থাকে তবু ও অমৃত!
ওই শক্ত কাঠ কাঠ বিবর্ণ বিস্বাদ খিচুরি ডেলার মধ্যে যেন ‘জীবনের’ স্বাদ, বর্ণাঢ্য ভবিষ্যৎ।
ঝোড়ো হাওয়া বয়েই চলেছে। মানুষগুলো যেন পাতার মত উড়ে যাবে। অথচ গত রাত পর্যন্ত আকাশ শান্ত ছিল! ছিল জ্যোৎস্না।
সাগর বলল, ‘অদেষ্টটা দ্যাকো।’
অটল বলল, ‘একা তোর আমার নয়, এই এতোগুলো মানুষের।’
সেই ঝোড়ো বাতাসের মধ্যেই ট্রাক বোঝাই হতে থাকে। মানুষগুলোকে আর ছাগল ভেড়া বলেও মনে হয় না। যেন মাল মাত্র। যেভাবে মালের লরী বোঝাই হয়, সেইভাবেই হতে থাকে।
একসময় ট্রাক ছেড়ে দেয়।
শোরগোল চেঁচামেচি থামতেই চায় না। বেদম ঝোড়ো হাওয়ার শব্দকে পাল্লা দিয়ে মানুষের কলকল্লোল এগিয়ে চলে জানা অজানা পথ পার হয়ে।
মা—বাপের সঙ্গে আর কথা চলছে না। দুই ভাইবোনে গায়ে গা পিষে চুপি চুপি কথা!
‘দাদা দ্যাক আমরা চলে যেতেচি বলে, এখেনের গাচপালাগুলো যেন মাতা ঝুঁইকে ঝুঁইকে কানতেচে—
‘ঠিক বলিচিস! নুটিয়ে নুটিয়ে কানচে।’
‘আত্তিরে আবার খেতি দেবে দাদা?’
‘দেবেই তো। বসন্ত কাকা বলেচে—ননচে আঁদাবাড়া হবে, রাজাই খাওয়া—দাওয়া।’
‘আর কক্ষনো এখেনে আসা হবেনি দাদা?’
দাদা নিজ মহিমা দেখাতে জোর গলায় বলে,—ক্যানো হবেনি? আমরা কি কইদী নাকি? জেলখানায় নে যাচচে?
কত পথ পার হয়ে, কত মাঠঘাট—ক্ষেতখামার ছাড়িয়ে ট্রাক চলেছে মানুষ বোঝাই দিয়ে।
যাত্রা শুরুর সেই কলকোলাহল আশ্চর্যরকম থেমে গেছে। এখন সকলেরই মুখ মলিন বিষণ্ণ। এ যেন অনন্ত যাত্রার পথে চলেছে তারা।
হঠাৎ তীব্র একটা আঁশটে গন্ধ এই বাতাসকেও ছাপিয়ে উঠে ছড়িয়ে পড়ল।
‘দাদা।’ ঠেলা মারল তুষু ঘুমন্ত দাদাকে, ‘এসে গেচি বোদায়। মাচ মাচ গন্ধ আসতেচে—’
হঠাৎ রব উঠল, ‘ক্যানিং ক্যানিং।’
আর ঠিক সেই সময় বৃষ্টি নামল মুষলধারে। সারাদিনের আফসানির শেষ পরিণতি।
তারপর এক অবর্ণনীয় হুলস্থূল কাণ্ড। ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি, আর্তনাদ, হাহাকার। কার হাতের পুঁটুলি পড়ে গেছে, কে ছেলেপুলেকে দেখতে পাচছে না, তবু লাঠির গুতো খেতে খেতে কাদার চড়া ভেঙে লঞ্চে উঠতে হচছে।
লঞ্চের মধ্যে আলোর রেখা, কাদার চড়া, ঘুটঘুটে অন্ধকার।
…যারা সব নিজের নিজের হারিকেন লণ্ঠন সঙ্গে এনেছিল, তারা খুঁজে পাচছে না। জ্বালবার চেষ্টাও অবশ্য বাতুলতা।…মাঝি মাল্লাদের হুঙ্কার, সারেঙের হুইশিল, বৃষ্টির শব্দ ক্রমশঃ চৈতন্যকে অসাড় করে দিচছে।
তবু দু’হাতে দুই ছেলেমেয়ের হাত শকত করে চেপে ধরে কাদার চড়া ভেঙে ভেঙে লঞ্চের সিঁড়িতে উঠছে সাগর, অটলের কাঁধে মালপত্র। মাথার উপর বৃষ্টির মুষলধারা। চেঁচিয়ে উঠল সাগর, ‘আজকেই কি ভগোমানের পেলয়ের দিন গো? পিথীমীর শেষ আজ?’
কে একটা বলে উঠল—’মর মাগী। কথার কী ছিরি।’
তারপরই একটা কাতর শিশুকণ্ঠ, ‘দাদা প্যায়েরা পড়ে যাচছে।’
কিন্তু পড়ে গেল কি শুধুই। দুটো অবোধ শিশু বাহিত ক’টা কষা পেয়ারা?…সৃষ্টি কর্তার হাত থেকে পড়ে গেল না কি তার আপন সৃষ্টির কিছু সঞ্চয়?
ঘাট জুড়ে লঞ্চ। আগে পিছে, দূরে! একটাতে চড়ে পড়তে পারলে, তার থেকে সিঁড়ি নামিয়ে পিছনেরটায় চড়ে পড়া যাবে। কে কোনটায় চড়বে, কেউ জানে না। কোথায় নির্দশনামা, কোথায় কে?
থেকে থেকে শুধু রণ হুঙ্কারের মত হুঙ্কার ছাড়ছে মাঝি মাল্লারা।…বিশেষ একটা সাংকেতিক শব্দ। এই পটভূমিকায় ভয়াবহ মনে হচছে।
এই ভয়ঙ্করকে চিরে ফেলে সহসা একটা নারীকণ্ঠ উদ্দাম হয়ে উঠল, ‘শংকু! তুষু। ওগো ওরা যে ওঠে নাই।’
‘উটেচে, উটেচে!’
‘কই কোতায় উটেচে? শংকু, শংকুরে! তুষু! তুষুরে!’
‘আমি উটবনি! আমি যাবনি! আমার নাইমে দ্যাও।’
উন্মাদিনীর এই প্রলাপ বাক্যে কে কর্ণপাত করবে? লঞ্চ তো ছেড়ে দিয়েছে।
‘খপরদার আমায় ধরোনি, আমি যাবনি। আমি জলে ঝাঁপ দে চলে যাব।’
কিন্তু কে তাকে ছাড়বে?
হঠাৎ বসন্তর অভয়কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তারা তো উই আগের ননচে উঠলো দেখলাম।’
‘আগের ননচে!’
‘কোন আগের?’
‘উই যে যেটার গায়ে হলদে হলদে করে কী সব লেখা ছিলো।’
‘সেটা কোন খেনে যাবে?’
‘সবই এক জায়গা যাবে বাবা। অটলদাস তোমার পরিবারকে বুঝ দাও। চড়ে যখন পড়েছে, ঠিকই পৌঁছাবে।’
‘পৌঁচাবে। কখন পৌঁচাবে?’
‘তা জানি নে। বাতাসের মুখ বুঝে।’
এখন আর এলোমেলো চীৎকার নয়, শুধু একটানা একটা কাতর কান্না,—’ওরে শংকু বাপ আমার, ওরে মা তুষু, তোরা ক্যানো আমার হাত ছাইড়ে এগুয়ে গেলি? এই রাস্কোস ঠাঁইতে তোদের আমি কোতায় খুঁজবো?’
অনেকেই এ কান্নায় বিরক্ত হয়। যাত্রাকালে এ কী মড়া কান্না! কেউ কেউ আবার সান্ত্বনাও দিতে আসে, তোমাদের চেনা লোক যখন বলছে অন্য লঞ্চে উঠতে দেখেছে তখন যাবে কোথায়? ড্যাঙায় নাবলে ঠিক পেয়ে যাবে। ভাত রান্না হচছে, খাও দাও।
অটলদাস কিছুই বলছে না। সাগরকে তার বড় ভয়। সান্ত্বনা দিতে এসে হয়তো হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এখন শুধু ড্যাঙার অপেক্ষা।
কিন্তু কোথায় সেই ডাঙা? যেখানে সাগর আর অটলদাস পায়ের তলায় মাটি পাবে?
সকালে প্রকৃতি মনোহারিণী রূপসী। কে বলবে কাল ওই কাণ্ড গেছে।
ভিজে মাটির চড়ার ওপর ঝকঝকে রোদ। বাসন্তীতে নোঙর করেছে এই লঞ্চ। ক্যাম্প পড়েছে চড়ার ওপর দিকে উঁচুতে। আরো কিছু কিছু ক্যাম্প পড়েছে গোসাবায়। সেখানে আগে নেমে গেছে আগের লঞ্চের লোক।
‘তোমার ছেলেমেয়ে বোধহয় ওই ওই আগের লঞ্চেই চেপে বসেছিল বাছা! মাঝি মাল্লাদের বলে কয়ে দ্যাখো। যদি ফিরতি পথে তোমাদের নিয়ে যায়।’
‘নে যাবি?’
‘যাবে না কেন? সংসারে ভাল নোকও আছে বৈকি।’
বৌয়ের কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচছিল অটলদাস, সাহস করে একবার এগিয়ে আসে। বলে, ‘মাজিদের বলেচি, নে যাবে। কাল তো এতোটুকুন কিছু দাঁতে কাটিস নাই, ওখেনে পাউরুটি আর চা দেচছে।’
এতোক্ষণ গুণগুনুনি চলছিল, আর চলছিল বৃথা খোঁজা। হঠাৎ বাঘিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সাগর নামের মেয়েছেলেটা। আর শত চক্ষুর সামনে দু হাতে কীল মারতে থাকে একটা শক্তসমর্থ পুরুষকে। ক্যানো আনলি তুই। ক্যানো আনলি? বল ক্যানো আনলি? এনে দে আমার শংকু তুষুকে। দে এনে!
কিন্তু কী সাধ্য অটল দাস নামের তুচ্ছ মানুষটার যে ওই লোনা জলের গভীর তলা থেকে সাগরের হারানে মানিক দুখানা খুঁজে এনে দেবে? দিন রাত পার হয়ে গেছে।…গোসাবা তো খুঁজে এল, খুঁজে এল মোরেলগঞ্জ খুঁজতে ফিরে এল ক্যানিং পর্যন্ত।…আবার গেল সেই গোসাবায়!
পথ চিনতে না পেরে মা—বাপকে খুঁজে খুঁজে কোথায় কোথায় হয়তো ঘুরে বেড়াচছে দুটো ছোট্ট মানুষ।
একশোবার জিগ্যেস করা হয়েছে বসন্তকে, ‘বসন্ত তুমি কি সত্যি দেখেছিলে?’
বিপদকালে একটা স্তোক বাক্য উচ্চারণ করে ফেলে যে এমন বিপদে পড়তে হবে তা কি ভেবেছিল বসন্ত? বলে, ‘দেখলাম তো দাদা। নিজের চক্ষেই তো দেখলাম।’
বলে ফেলেছে তার জের তো টেনে চলতে হবে।
নিজের চক্ষে দেখেছে বসন্ত। তবে?
তবে এই জায়গাটা ছেড়ে রেখে কোথায় যাবে সাগর আর অটল? কিন্তু দুজনে কী একসঙ্গে? নাঃ সাগর একলা ফেরে। হঠাৎ হঠাৎ প্রবল শব্দে ডাক দেয়, শংকুরে—তুষুরে—! আর অটলকে ধারে কাছে আসতে দেখলেই ধাঁই ধাঁই করে মারতে থাকে।
নিশ্চিত খাওয়া নেই, নিশ্চিত নাওয়া নেই, নিশ্চিত আশ্রয় নেই, শেয়াল কুকুরের মতো ঘুরে ঘুরে, এখানে সেখানে দিন রাত্রি কাটানো।
হঠাৎ একদিন অটল দাস ওই পাগলীর মায়ের হাতটা চেপে ধরল, বলল, ‘সাগর আমার দিকে তাকা। পষ্ট করি তাকা। দ্যাক আমার কি কিছুই নাগে নাই? তুষু আমার গলার হার ছেলো না? শংকু আমার পাজরার হাড়? জানিস নাই তুই?’
পাগলীর রুদ্র মূর্তি সহসা স্থির হয়ে যায়। তাকিয়ে থাকে ওই বেদনার্ত মুখটার দিকে। বারো বছর বয়েস থেকে এই বত্রিশ বছর বয়েস পর্যন্ত যে মুখটার দিকেই তাকিয়ে কাটিয়ে এসেছে সে। সুখে দুঃখে জলে আগুনে অভাবে অনটনে। আগুন জ্বলা ধক ধকে চোখ দুটোর গভীর গহ্বর থেকে হঠাৎ বাষ্পোচ্ছ্বাস ওঠে, তারপর প্রবল জলোচ্ছ্বাস।
ডুকরে কেঁদে উঠে সাগর নামের সেই মেয়েটা, যে মেয়েটা একদিন জ্যালজেলে চেলির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় চলে এসেছিল অটলদাসের পিছু পিছু সবিস্ময়ে তার চওড়া কাঁধ আর চ্যাটানো পিঠখানার দিকে তাকাতে তাকাতে।
শ্বাস নেই তবু হাড় ক’খানা আছে, মাস নাই তবু কাঠামোখানা আছে। সেই কাঠামোখানার ওপরই আছড়ে পড়ে মুখ চেপে ধরে হু হু করে কেঁদে চলে সাগর। লোনা জলে ভাসিয়ে দেয় অটলদাসের চওড়া বুকের খাঁচাখানা।
কাঁদতে দেয় ওকে অটল। মনে মনে বলে কাঁদ, কান্নাই ওষুধ।
অনেকক্ষণ পরে আস্তে বলে, যদি পাবার হয় তো একদিন খুঁজি পাবো সাগর। আর যদি ভগমানের কড়িনুকোনো খেলা হয়তো কিচু করার নাই।…কিন্তুক আমরা দু মানুষতো আচি? একদা ওরা ছেলো না, আসে নাই। শুদু তুই আর আমি থেকেচি। মনে ভাব সেই দিনে ফিরে গেচি আবার। তুই আর আমি নোতুন করে জেবন আরম্ভ করতেচি।…
শরীরে আর সেই অসুরের বল নেই।
নেই সেই পেশী কঠিন চওড়া বুক পিঠ। নেই টগবগে মুখ, রগরগে চুল। তবু লোকটা অটল দাস।
এধার ওধার যেতে আসতে লোকে দেখে আলতু ফালতু কুড়োনো মাল হোগলা গোল পাতা, নারকেল পাতা খেজুরছড়া দিয়ে দিব্যি একখানা ঝুপড়ি বানিয়ে ফেলেছে একটা চরে ঘুরে বেড়ানো আধবুড়ো লোক বানিয়ে ফেলার পর কোথা থেকে যেন বয়ে বয়ে আনছে, মাটির মালসা জ্বালানিপাতা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন