ভজগৌরাঙ্গ কথা

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়

ভজগৌরাঙ্গ কথা

হাবুল সেন বর্ধমানে মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে। ক্যাবলা গেছে বাবা-মার সঙ্গে নাইনিতালে। তাই পুজোর ছুটিতে পটলডাঙা আলো করে আছি চার মূর্তির দুজন–আমি আর টেনিদা।

বিকেলবেলা ভাবছি, ধাঁ করে লিলুয়ায় ছোট পিসিমার বাড়ি থেকে একটু বেড়িয়ে আসি–হঠাৎ বাইরে থেকে টেনিদার গাঁকগাঁক করে চিৎকার!

–প্যালা, কাম–কুইক!

নতুন ডাক্তার মেজদা হসপিটালে গোটাকতক রুগী-টুগী মেরে ফিরে আসছিল। নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে দাঁত খিঁচিয়ে আমায় বলে গেল : যাও জাম্বুবান–তোমার দাদা হনুমান তোমায় ডাকছে। দুজনে মিলে এখন লঙ্কা পোড়াওগে।

জাম্বুবান কখনও লঙ্কা পোড়ায়নি–মেজদাকে এই কথাটা বলতে গিয়েও আমি বললুম না। ওকে চটিয়ে দিলে মুশকিল। একটু পেটের গণ্ডগোল হয়েছে কি, সঙ্গে সঙ্গে সাতদিন হয়তো সাগু বার্লি কিংবা স্রেফ কাঁচকলার ঝোল খাইয়ে রাখবে, নইলে পটাং করে পেটেই একটা ইনজেকশান দিয়ে দেবে। তাই মিথ্যে অপবাদটা হজম করে যেতে হল।

আবার টেনিদার সেই পাড়া কাঁপানো বাজখাঁই হাঁক প্যালা, আর ইউ ডেড?

টেনিদার চিৎকার শুনলে মড়া অবধি লাফিয়ে ওঠে, আর আমি তো এখনও মারাই যাইনি। হুড়মুড় করে দোতলা থেকে নেমে এসে বললুম কী হয়েছে, চ্যাঁচাচ্ছ কেন অত?

টেনিদা আমার চাঁদির ওপর কড়াং করে একটা গাট্টা মারল। বললে : তুই একটা নিরেট ভেটকি মাছ। আমি তো শুধু চ্যাঁচাচ্ছি ব্যাপারটা শুনলে তুই একেবারে ভজ গৌরাঙ্গ ভজ গৌরাঙ্গ বলে দু-হাত তুলে নাচতে থাকবি। যাকে বলে, নরীনৃত্যতি।

কাণ্ডটা দ্যাখো একবার–টেনিদা সংস্কৃত আওড়াচ্ছে। পণ্ডিতমশাই একবার ওকে গো শব্দরূপ জিজ্ঞেস করায় বলেছিল, গৌ–গৌবৌ-গৌবরঃ। শুনে পণ্ডিতমশাই চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যেতে যেতে সামলে গিয়েছিলেন। আর ওকে বলেছিলেন– কী বলেছিলেন, সেটা নাইবা শুনলে!

কিন্তু সংস্কৃত যখন বলছে, তখন ব্যাপারটা নিশ্চয় সাংঘাতিক। বললুম : খামকা আমি নাচব কেন? আর যদিই বা নাচি, ভজ গৌরাঙ্গ বলব কেন? তোমার নাম ধরে ভজহরি ভজহরি বলেও তো নাচতে পারি! (তোমরা তো জানোই, টেনিদার পোশাকী নাম ভজহরি মুখুজ্যে।)

টেনিদা আমার নাকের সামনে বুড়ো আঙুল নাচিয়ে বললে : ভজহরি বলে নাচলে কচুপোড়া পাবি। আরে, আজ সন্ধের পর ভজগৌরাঙ্গবাবু যে পোলাও-মাংস খাওয়াচ্ছেন। তোকে আর আমাকে।

শুনে খানিকক্ষণ আমি হাঁ করে থাকলুম।

-কে খাওয়াচ্ছে বললে?

–ভজগৌরাঙ্গবাবু।

আমার হাঁ-টা আরও বড় হল : ভালো করে বলো, বুঝতে পারছি না।

বলেই বুঝতে পারলুম, কী ভুলটাই করেছি। টেনিদা সঙ্গে সঙ্গে আমার কানের কাছে মুখ এনে ভজগৌরাঙ্গ বলে এমন একখানা হাঁক ছাড়ল যে আমি আঁতকে তিন হাত লাফিয়ে উঠলুম। কান কনকন করতে লাগল, মাথা বনবন করে উঠল!

টেনিদা হিড়হিড় করে টানতে টানতে আমাকে চাটুজ্যেদের বোয়াকে নিয়ে এল। বললে : শুনে যে তোর মুচ্ছো যাওয়ার জো হল দেখছি। বিশ্বেস হচ্ছে না বুঝি?

বাঁ-দিকের কানটা চেপে ধরে আমি বললুম : ভজগৌরাঙ্গ আমাদের মাংসপোলাও খাওয়াবে?

–আলবত। তোকে আর আমাকে।

–ভজগৌরাঙ্গ সমাদ্দার?

নির্ঘাত!

বলে কী টেনিদা? পাগল হয়ে গেছে না পেট খারাপ হয়েছে? ভজগৌরাঙ্গবাবুর মতো কৃপণ সারা কলকাতায় আর দুজন নেই। একাই থাকেন। ওঁর ছেলে রামগোবিন্দ চাকরি পেয়েই নিজের মাকে নিয়ে কেষ্টনগরে চলে গেছে–মানে পালিয়ে বেঁচেছে। ভজগৌরাঙ্গ পাটের দালালি করছেন, আর টাকা জমাচ্ছেন। বাড়ির সামনে ভিক্ষুক এলে লাঠি নিয়ে তাড়া করেন। একবার গোটাকয়েক ডেয়ো পিঁপড়ে ওঁর একটুখানি চিনি খেয়ে ফেলেছিল, ভদ্রলোক পিঁপড়েগুলোকে ধরে একটা শিশিতে পুরে রাখলেন আর পর পর তিনদিন সেই পিঁপড়ে দিয়ে চা করে খেলেন। সেই ভজগৌরাঙ্গ পোলাও-মাংস খাওয়াবেন আমাকে আর টেনিদাকে? উঁহু, মাথা খারাপ হলেও একথা লোকে ভাবতে পারে না। টেনিদারই পেট খারাপ হয়েছে!

টেনিদা বললে : অমন শিঙাড়ার মতো মুখ করে, ছাগলের মতো তাকিয়ে আছিস যে? তা হলে সব খুলে বলি, শোন!

কাল শেষরাত্তিরে ছোট কাকা সরকারি কাজে এরোপ্লেনে চেপে সিঙ্গাপুরে গেছে। আমি দমদমে ছোট কাকাকে তুলে দিয়ে যখন ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরেছি, তখন রাত চারটে। গলির মধ্যে ঢুকেই দেখি যে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার! একটা লোক ল্যাম্পপোস্টের ওপর ঝুলছে; আর নীচ থেকে একজন পাহারাওলা উতারো-উতারো বলে তার ঠ্যাং ধরে টানছে।

এগিয়ে এসে দেখি ল্যাম্পপোস্ট ধরে যে-লোকটা ঝুলছে, সে আর কেউ নয়–ভজগৌরাঙ্গবাবু!

বলল কী–ভজগৌরাঙ্গবাবু? তা শেষরাত্তিরে ল্যাম্পপোস্ট ধরে ঝুলতে গেল কেন?

–আরে, সেইটেই তো গণ্ডগোল! পাহারাওলা তো এক হ্যাঁচকা টানে ভজগৌরাঙ্গকে চালকুমড়োর মতো ধপাত করে নামিয়ে নিলে। তারপর বলে, তো ইলেকট্রিকের তার চুরি করতা হ্যায়–চলো থানামে! আর ভজগৌরাঙ্গ হাঁউমাউ করতে থাকে, আমি শেষ রাত্রে বৈঠকে বৈঠকে হিসাব লিখতা থা, একঠো কাগজ উড়কে ল্যাম্পপোস্টকে উপরে গিয়ে লটকে গিয়া, সেইঠো পাড়তে গিয়া। পাহারাওলা তা বিশ্বেস করবে কেন? খালি বলে, তোম চোর হ্যায়–চলো থানামে।

আমাকে দেখেই ভজগৌরাঙ্গবাবুর সেকি কান্না! বলে, বাবা টেনি, আমায় বাঁচাও। এই বুড়ো বয়েসে চোর বলে ধরে নিয়ে গেলে আমি আর বাঁচব না।

যাই হোক, আমি পাহারাওলাকে অনেক বোঝালুম। বললুম, এ দারোগা সাব–এ লোক আচ্ছা আদমি, চুরি নেহি করতা। ছোড় দিজিয়ে দারোগা সাহেব।–দারোগা সাহেব বলাতে লোকটা একটু ভিজল। খানিকটা খইনিটইনি খেয়ে, ভজগৌরাঙ্গবাবুর টিকিতে একটা টান দিয়ে বলল, আচ্ছা, আজ ছোড় দেতা। ফের যদি তুম্ ল্যাম্পপোস্টে উঠে গা, তো তুমকো ফাঁসি দে দেগা।–বলে চলে গেল। 

তখন ভজগৌরাঙ্গ আমার হাত জড়িয়ে ধরলেন। বললে, বাবা টেনি, তুমি আমায় ধনে-প্রাণে বাঁচিয়েছ। একথা কাউকে বোলো না–তা হলে পাড়ায় মুখ দেখাতে পারব না। তোমাকে আমি চারটে পয়সা দিচ্ছি, ডালমুট খেয়ো। আমি বললুম, অত সস্তায় হবে না স্যার! যদি আমাকে আর প্যালাকে কাল সন্ধেয় পোলাও-মাংস খাওয়াতে পারেন, তবেই ব্যাপারটা চেপে যাব। 

শুনে বুড়োর চোখ কপালে চড়ে গেল। বলে, এই গরমে পোলাও-মাংস খেতে নেই বাবা-শেষে অসুখ করে পড়বে। তার চে বরং দুই আনা পয়সা দিচ্ছি-তুমি আর প্যালারাম বোঁদে কিংবা গুজিয়া কিনে খেয়ো। পাকৌড়াও খেতে পারো।

আমি বললুম, এই আশ্বিন মাসে মোটেই গরম নেই–ওসব বাজে কথা চলবে না। জেলের হাত থেকে বাঁচালুম, একশো-দুশো টাকা ফাইনও হতে পারত, তার বদলে কিনা বোঁদে আর পাকৌড়া। বেশ, কিছু খাওয়াতে হবে না আপনাকে। সকাল হলেই আমি আর প্যালা দুটো চোঙা মুখে নিয়ে রাস্তায় বেরুব। আমি বলব–পটলডাঙার ভজগৌরাঙ্গ, প্যালা বলবে–তার-চোর। আমি বলব–পুলিশ ধরে কাকে? প্যালা বলবে–ভজগৌরাঙ্গকে। ব্যাস–বুড়ো একদম ঠাণ্ডা। সুড়সুড় করে রাজি হয়ে গেল। বুঝলি প্যালা–একেই বলে পলিটিকস্।

তা হলে আজ সন্ধেয় আমরা পোলাও কালিয়া খাচ্ছি? ভজগৌরাঙ্গের বাড়িতে?

–নিশ্চয়। ঠেকাচ্ছে কে?

এবারে সত্যি সত্যিই আমি নেচে উঠলুম! চেঁচিয়ে বললুম : ডি-লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

টেনিদা বলল :ইয়াক–ইয়াক!

.

সন্ধের পরে ভজগৌরাঙ্গের বাড়ি গিয়ে তো সমানে কড়া নাড়ছি দুজনে। পুরো পনেরো মিনিট কড়া নাড়বার পরেও কোনও সাড়াশব্দ নেই। বুড়ো চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে ভেতরে। সারা রাত কড়া নাড়লেও দরজা খুলবে বলে মনে হল না।

আমি বললুম : হল তো? খাও এখন পোলাও-কালিয়া। পিঁপড়ে দিয়ে ও চা খায়–ওর কথায় তুমি বিশ্বাস করলে?

টেনিদা খেপে গেল। খাড়া নাকটাকে গণ্ডারের মতো উঁচু করে বললে : দরজা খুলবে না। দাঁড়া–খোলাচ্ছি। আমি বলছি–ভজগৌরাঙ্গ–তুই সঙ্গে সঙ্গে বলবি–

মনে আছে। হাঁক পাড়ো

টেনিদা যেই আকাশফাটা চিৎকার তুলেছে–ভজগৌরাঙ্গ, আর আমি কাঁসরের মতো ক্যানকেনে গলায় জবাব দিয়েছি–তার-চোর,–অমনি চিচিং ফাঁক! ক্যাঁচ দরজা খুলে গেল। একমুখ কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে ভজগৌরাঙ্গ বেরিয়ে এলেন সুট করে।

–আহা-হা, করছ কী! চুপচুপ!

–চুপচুপ মানে? আধ ঘণ্টা ধরে কড়া নাড়ছি–কোনও সাড়াই নেই? ভেবেছেন কি আপনি? প্যালা–এগেইন।–

ভজগৌরাঙ্গ তাড়াতাড়ি বললেন : না-না–এগেইন নয়! আহা-হা, বড় কষ্ট হয়েছে তো তোমাদের। আমি কড়ার আওয়াজ শুনতেই পাইনি। মানে–এই–পেট ব্যথা করছিল কিনা, তাই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। এসো–এসো–ভেতরে এসো

বারান্দায় একটা ছেঁড়া মাদুর পাতা, তার একপাশে কতকগুলো হিসেবের কাগজপত্র। একটা লণ্ঠন মিটমিট করে জ্বলছে। বাড়িতে ইলেকট্রিকের লাইন নিয়ে পয়সা খরচ করবেন, এমন পাত্রই নন ভজগৌরাঙ্গ। কাগজপত্রগুলো সরিয়ে দিয়ে বললেন : বোসো বাবা বোসো, একটু জিরোও আগে।

টেনিদা বলল : জিরোবার দরকার নেই, দোরগোড়ায় আধ ঘণ্টা জিরিয়েছি আমরা। পোলাও-কালিয়া কোথায় তাই বলুন!

–পোলাওকালিয়া?–ভজগৌরাঙ্গ খাবি খেলেন।

হুঁ, পোলাওকালিয়া!–টেনিদা বাঘাটে গলায় বললে; সেই রকমই কথা ছিল। কোথায় সে? 

ভজগৌরাঙ্গ বললেন : এঃ, তাই তো একেবারে মনেই ছিল না। মানে সারা দিন খুব পেটের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছিলুম কিনা, সেইজন্যেই তা ইয়ে, তোমাদের বরং চার আনা পয়সা দিচ্ছি, শেয়ালদায় পাঞ্জাবিদের দোকানে গিয়ে দুআনার মাংস আর দুআনার পুরি

আমি বললুম : দু আনায় মাংস দেয় না, চিবুনো-হাড় দিতে পারে একটুকরো।

টেনিদা গর্জন করে বললে : চালাকি? ফাঁকি দেবার মতলব করেছেন? জেল থেকে বাঁচিয়ে দিলুম–তার এই প্রতিদান? যাক, আমরা কিছু খেতে চাই না। চল প্যালা–এখুনি বেরিয়ে পড়ি চোঙা নিয়ে।

–আহা-হা, চোঙা আবার কেন?–ভজগৌরাঙ্গ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন : চোঙা-টোঙা খুব খারাপ জিনিস। ছিঃ বাবা টেনি, চোঙা নিয়ে চেঁচাতে নেই–ওতে লোকের শান্তি ভঙ্গ হয়।

–সে আমরা বুঝব। আমরা চোঙা ফুঁকে আপনাকে শিঙে ফুঁকিয়ে ছাড়ব। প্যালা–চলে আয়–

–আহা, থামো—থামো–ভজগৌরাঙ্গ টেনিদার হাত চেপে ধরলেন। তারপর ডিম ভাজার মতো করুণ মুখ করে মিহিদানার মতো মিহি গলায় বললেন : নিতান্তই যদি খাবে, তা হলে আমার খাবারটাই খেয়ে যাও। আমি নয় আজ রাতে এক গ্লাস জল খেয়েই শুয়ে থাকব।–বলেই ভজগৌরাঙ্গের দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

–আপনার খাবারটা কী?–আমার সন্দেহ হল।

–ভালো মাছ আছে আজকে–পুঁটি মাছ ভাজা। সেই সঙ্গে পান্তা ভাত। দশ দিন পরে দুগণ্ডা পয়সা দিয়ে একটুখানি মাছ এনেছিলুম আশা করে, কিন্তু কপালে না থাকলে। আবার বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ভজগৌরাঙ্গের।

বটে, পুঁটি মাছ ভাজা আর পান্তো ভাত। ও রাজভোগ আপনিই খান মশাই। পালা, চোঙা দুটো রেডি আছে তো? চল–বেরিয়ে পড়ি

ভজগৌরাঙ্গ কাঁউকাঁউ করে কী বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ খটখট করে বাজের মতো বেজে উঠল দরজার কড়া। সঙ্গে সঙ্গে বিদঘুটে মোটা গলায় কে বললে : ভাজগুড়ুংবাবু হ্যায়–ভাজগুড়ুং বাবু?

ভজগৌরাঙ্গ থমকে থেমে গেলেন। টেনিদা জিজ্ঞেস করলে : কোন্ হ্যায়?

আবার সেই মোটা গলা শোনা গেল : হামি লালবাজার থানা থেকে আসছে।

ভজগৌরাঙ্গ ঠকঠক করে কেঁপে উঠলেন।

–এই সেরেছে! টিকিটা টেনে দিয়েও পাহারাওয়ালা রাগ যায়নি নির্ঘাত লালবাজারের গিয়ে নালিশ করেছে–আর পুলিশে আমায় ধরতে এসেছে। বাবা টেনি, কাল মাংস পোলাও-চপ-কাটলেট সব খাওয়াব, আমাকে আজ যেমন করে হোক বাঁচাও।

বাইরে থেকে আবার আওয়াজ এল : জলদি দরজা খুলিয়ে দেন হামি লালবাজারসে আসছে!

–ওকে বলো–ইয়ে, তোমরা আমার ভাইপো, আর আমি তিন মাসের জন্যে দিল্লি গেছি বলেই ভজগৌরাঙ্গ চট করে অন্ধকার ঘরে ঢুকে পড়লেন, তারপরই একেবারে তক্তপোশের তলায়। সেখান থেকে কুকুরের বাচ্চার ডাকের মতো কুঁকুঁ করে আওয়াজ উঠতে লাগল। বোঝা গেল, ভজগৌরাঙ্গ প্রাণপণে কান্না চাপবার চেষ্টা করছেন।

–এ ভাজগুড়ুং বাবু–দরজা খোলিয়ে

টেনিদা ফিসফিস করে বললে : ব্যাপার সুবিধে নয় রে প্যালা, লালবাজারের পুলিশ কেন আবার? বুড়োর জন্যে আমরাও ফেঁসে যাব নাকি?

আমি বললুম : আমরা তো কখনও ল্যাম্পপোস্টে উঠিনি, আমাদের ভয় কিসের? দরজা খুলে দেখাই যাক।

তক্তপোশের তলায় আবার কুঁকুঁ করে আওয়াজ উঠতে লাগল।

টেনিদা দরজা খুলল ভয়ে ভয়ে। বাইরে খাকী জামাপরা এক পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে তার হাতে একটা মস্ত বড় হাঁড়ি। আমাদের দেখেই এক প্রকাণ্ড স্যালুট ঠুকল। তারপর একটা চিঠি দিয়ে বললে : চটর্জি সাহেব দিয়া। হামি সাহাবকো আরদালী আছে।

রাস্তার আলোয় চিঠিটা পড়ে দেখলুম আমরা। কেষ্টনগর থেকে লিখেছে রামগোবিন্দ :

বাবা, পুলিশ অফিসার মিস্টার চাটার্জি আমার বন্ধু। কেষ্টনগরে বেড়াতে এসেছিলেন। ওঁর সঙ্গে তোমার জন্যে এক হাঁড়ি ভালো সরপুরিয়া আর সরভাজা পাঠালুম। ঘরে রেখে পচিয়ো না–খেয়ো। আমি আর মা ভালো আছি। প্রণাম নিয়ো।
রামগোবিন্দ।

টেনিদা একবার আমার দিকে তাকাল, আমি তাকালুম টেনিদার দিকে। আমি বললুম : আচ্ছা আরদালী সাহেব, সব ঠিক হ্যায়।

আরদালী সাহেব আবার স্যালুট করে, জুতো মচমচিয়ে চলে গেল।

আমি কী বলতে যাচ্ছিলুম, টেনিদা ঝট করে আমাকে দরজার বাইরে টেনে নিয়ে এল।

–চুপ, স্পিকটি নট! এক হাঁড়ি সরভাজা আর সরপুরিয়া–খাঁটি কেষ্টনগরের জিনিস। পোলাও-কালিয়া কোথায় লাগে এর কাছে।

দরজাটা টেনে দিতে দিতে টেনিদা হাঁক পাড়ল : ভজগৌরাঙ্গবাবু, লাইন ক্লিয়ার! পুলিশ তাড়িয়েছে। কাল আর ঘর থেকে বেরুবেন না। পরশু সন্ধ্যায় আমরা পোলাও কালিয়া খেতে আবার আসব। এখন দরজাটা বন্ধ করে দিন।

তারপর?

তারপর সেই সরভাজা আর সরপুরিয়ার হাঁড়ি নিয়ে আমরা দুজন সোজা টেনিদাদের তে-তলার ছাদে। টেনিদা একখানা গোটা সরভাজা মুখে দিয়ে বললে; ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস–

আমি সরপুরিয়ায় কামড় দিয়ে বললুম : ইয়াক–ইয়াক!

সকল অধ্যায়

১. একটি ফুটবল ম্যাচ
২. দধীচি, পোকা ও বিশ্বকর্মা
৩. খট্টাঙ্গ ও পলান্ন
৪. মৎস্যপুরাণ
৫. পেশোয়ার কী আমীর
৬. কাক-কাহিনী
৭. ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি
৮. পরের উপকার করিও না
৯. চেঙ্গিস আর হ্যামলিনের বাঁশিওলা
১০. ঢাউস
১১. নিদারুণ প্রতিশোধ
১২. তত্ত্বাবধান মানে–জীবে প্রেম
১৩. দশাননচরিত
১৪. দি গ্রেট ছাঁটাই
১৫. ক্যামোফ্লেজ
১৬. কুট্টিমামার হাতের কাজ
১৭. সাংঘাতিক
১৮. বনভোজনের ব্যাপার
১৯. কুট্টিমামার দন্ত-কাহিনী
২০. প্রভাতসঙ্গীত
২১. ভজহরি ফিল্ম কর্পোরেশন
২২. চামচিকে আর টিকিট চেকার
২৩. ব্রহ্মবিকাশের দন্তবিকাশ
২৪. টিকটিকির ল্যাজ
২৫. বেয়ারিং ছাঁট
২৬. কাঁকড়াবিছে
২৭. হনোলুলুর মাকুদা
২৮. হালখাতার খাওয়াদাওয়া
২৯. ঘুঁটেপাড়ার সেই ম্যাচ
৩০. টেনিদা আর ইয়েতি
৩১. একাদশীর রাঁচি যাত্রা
৩২. ন্যাংচাদার ‘হাহাকার’
৩৩. ভজগৌরাঙ্গ কথা
৩৪. চারমূর্তি
৩৫. চার মূর্তির অভিযান
৩৬. কম্বল নিরুদ্দেশ
৩৭. টেনিদা আর সিন্ধুঘোটক
৩৮. ঝাউ-বাংলোর রহস্য

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন