কুকুরদল – ২৮

কিশোর পাশা ইমন

অধ্যায় ২৮

ক্যাম্পাসে ফিরে মুহিব লক্ষ্য করলো চারপাশে একটা থমথমে ভাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা শরীরের মতো। মেইন গেইট থেকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেই যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাত্র বুঝতে পারে প্রতিষ্ঠানটির শরীর এখন কেমন। আবহাওয়ার পূর্বাভাস কি। যখন আনন্দের কোনো খবর থাকে, তখনও গেট থেকে কয়েক পা ঢুকে পড়লেই সেটা শরীর দিয়ে অনুভব করা যায়। চাপমুক্ত একটা পরিবেশ, যে কোনো নিয়মিত বাসিন্দাই অনুভব করতে পারবেন। তেমন থমথমে পরিবেশটাও ষষ্ঠ ইন্দ্ৰীয় ধরে নেয় খুব দ্রুত। গ্যাঞ্জামের কয়েক ঘণ্টা আগ থেকেই নিয়মিত ছাত্ররা জানে আজকে একটা কিছু হবে।

অ্যাড বিল্ডিংয়ের কাছে ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। এই ছেলেটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের কাছে তাদের গর্ব, তবে শিক্ষকরা দ্বিমত প্রকাশ করবেন। এই বয়সেই নিজের পোষা রোবট বানিয়ে ফেলেছে ইন্দ্ৰ। ভর্তি হওয়ার পর পর স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশাল খেলার মাঠে তাকে কোয়াড কপ্টার ওড়ানোর চেষ্টা করতে দেখেছিলো মুহিব, সেই থেকে ইন্দ্রের সাথে পরিচয়। রাতদিন সে নতুন কিছু বানানোয় ব্যস্ত থাকে। যেন আরেকজন টমাস আলভা এডিসন।

“উঠলো কেমন?” কাছে এসে জানতে চাইলো ইন্দ্র, “যমুনা ফিউচার আর বসুন্ধরায় না গেলি?”

“সাড়ে চার লাখ।” হাতে হাত মেলালো মুহিব, “খুব একটা খারাপ না। মোট কালেকশন ত্রিশ লাখের কাছে চলে এসেছে। আর মাত্র ষাট লাখ। হয়ে যাবে আশা করি।”

মাথা দোলালো ইন্দ্ৰ, ওরা দু’জনই জানে ষাট লাখ ‘দেখতে দেখতে’ উঠে যাওয়ার মতো পরিমাণ না। চুপচাপ হাঁটলো কিছুক্ষণ। কয়েকবার আড়চোখে তাকালো মুহিবের দিকে, যেন একটা কিছু বলতে চাইছে কিন্তু বলতে পারছে না।

“কি? কিছু বলবি?” অবশেষে নিজেই প্রশ্ন করলো মুহিব।

“গত মাসের রবোটিক্স কম্পিটিশনটার কথা মনে আছে? গ্রিন ব্রেইন?” মাথা দোলালো মুহিব। বেশ বড় একটা কম্পিটিশন ছিল ওটা। প্রথম পুরষ্কার ছিল এক লাখ টাকার। ইন্দ্র অবশ্য প্রথম হতে পারেনি। প্রথম পুরষ্কারটি পেয়েছেন ‘০৯-এর সাদলি ভাই। তবে দ্বিতীয় হয়েছিলো সে, দ্বিতীয় পুরষ্কার পঞ্চাশ হাজার টাকার। ইন্দ্রর ব্যাপারটা মুহিবের মনে আছে, কারণ সেদিন ফলাফল ঘোষণার পর ওরা সবাই তাকে চেপে ধরেছিলো ‘ট্রিট’ দেওয়া জন্য।

“মনে থাকবে না কেন? তুই তো ব্যাটা কম্পিটিশন কুপিয়েই লাখপতি।”

“গতকাল আমাদের টাকাটা দেওয়ার কথা ছিল। আমরা গেলাম। সাদলি ভাইকে ধরায় দিলো পাঁচ হাজার টাকা। আমার খামে ছিল আড়াই হাজার।”

রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে গেলো মুহিব, “কি?”

“ঠিকই শুনছিস। লাখপতি হওয়া সম্ভব হয়নি।”

“কোন হারামজাদা মেরে দিয়েছে তোদের টাকা?”

“শুনলাম নানা ভাগ বাটোয়ারা আছে। পলিটিকাল কিছু গেছে। স্যারদের পকেটেও গেছে শুনলাম। কথা হলো এইখানে এক লাখ টাকা জিতলে তুই পাবি পাঁচ হাজার। আর বাকিটা পাবে অন্যরা। আমি ভেবেছিলাম অন্তত রোবটের পার্টসগুলোর দাম উঠে আসবে, প্লাস একটা জার্ভিস বানানোর ইচ্ছে ছিল। পুরষ্কারের টাকা দিয়ে তো আমি আর শার্ট কিনতাম না। নেক্সট প্রজেক্টে ঢালতাম।”

“হোগাচোদারা।” মুহিব খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুব অশ্লীল একটা গালি দিলো।”তবে এবার ভেবেছিলাম ধারদেনা শোধ করার পর দশ পনেরো হাজার টাকা থেকে যাবে, ওটা লিটুর জন্য দিয়ে দেবো। মাদারচোতগুলার জন্য হলো আর কই। তুই এইটা রাখ।”

তড়িঘড়ি করে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো ইন্দ্র। খামটার বাইরে গ্রিন ব্রেইনের সিল দেওয়া। ভেতরে থাকার কথা ছিল একটা চেক। খামের ভেতর তো আর পঞ্চাশ হাজার টাকা রাখা যায় না। খামটা খুলে দেখলো মুহিব, ভেতরে পাঁচটা পাঁচশ’ টাকার নোট। ইন্দ্র তার প্রাইজমানির পুরোটাই লিটুর চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিয়েছে। একজন সদ্য টিনএজ পেরুনো ছেলে মনে কতোটা আঘাত পেলে খাম থেকে প্রাইজমানি একবারও বের না করে দান করে দিতে পারে?

খামটা ব্যাকপকেটে রেখে পেছনের গেটের দিকে রওনা দিলো মুহিব। এভাবে পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অচিরেই হলে সিট পাবে ওরা, এমন একটা গুঞ্জন শোনা যায়। ০৮ এর ভাইরা বিদায় নিয়ে চলে গেছে কয়েক মাস হয়ে গেলো। এখন সময় নতুনদের হলে উঠিয়ে নেওয়ার। তবে এর আগে অতি অবশ্যই রাজনীতির সাথে জড়িত থাকা ছেলেদের হলে সিট দেওয়া হবে, ফেলটু আর জুনিয়ররাও স্রেফ রাজনীতি

করার কারণে হলে সিট পেয়ে যাবে। এসব নিয়ম হলগুলোতে খুব ঘটা করে মেনে চলে সংগঠনগুলো। হলের ম্যানপাওয়ার যেন ঠিক থাকে। বিরোধীদলের ছাত্র সংগঠন শোডাউন করতে এলে যেন ‘যোদ্ধা’র অভাব না হয়।

আজিজ মামার দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনলো মুহিব। লিটুর অসুস্থতার পর সিগারেট খাওয়াটা কমে গেছে। এখন আর খরচ করতেই ইচ্ছে করে না। নব্বই লাখ টাকার চিন্তা মাথার ভেতর জাঁকিয়ে বসেছে একেবারে শামস হত্যা নিয়েও বেশি ভাবতে ভালো লাগে না আর। লিটুটা যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতো তাড়াতাড়ি! সে সম্ভাবনা অবশ্য কম। লিটু এখন তার নিজের মাকে দেখলেও চিনতে পারে না। একেবারেই কোমায়, ক্লিনিকালি ডেড। আইসিইউ থেকে বের করলে চব্বিশ ঘণ্টাও বাঁচবে না ডাক্তাররা এ বিষয়ে নিঃসংশয়। তাছাড়া ভাইরাসটা মস্তিষ্কে সংক্রমণ করেছে, অনেকগুলো স্নায়ু বিকল হয়ে গেছে বলেই ডাক্তারদের আশঙ্কা।

পেছনের গেট দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও থমথমে ভাবটা চলে গেলো না। এদিকে প্রায় ডজনখানেক মেস আছে, সবগুলোতেই সিংহভাগ ভাড়াটে স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ক্যাম্পাসে থম ধরে গেলে তার ছোঁয়া অবধারিতভাবে শহরের এই অংশে এসেও লাগে। থমথমে পথে হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্রর সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু অংশ নিয়ে ভাবলো মুহিব।

ইন্দ্র বাংলাদেশের একজন সম্ভাবনাময় তরুণ আবিষ্কারক। রাজা আর বানরের গল্পটা সবাই জানে। রাজা বানরকে আদর করলেও একটা করে বেতের বাড়ি দিতেন। সভাসদরা জানতে চেয়েছিলেন বানরকে আদর করলে বেত দিয়ে মারার দরকার কি? কাজেই রাজা তাদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বেত মারা বন্ধ করেছিলেন। ফলাফল প্রথম দিন বানর রাজার পায়ে, দ্বিতীয় দিন কোলে, তৃতীয় দিন লাফিয়ে একেবারে মাথায় চড়ে বসলো।

স্টেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক সম্প্রদায় ইন্দ্রকে ঘৃণা করেন। তার পক্ষে কথা বলেছে এমন যে কোনো শিক্ষার্থিকে ভুগতে হয়েছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্ভাবনাময় তরুণ ইনভেনটরকে তার শিক্ষকরা ঘৃণা করবেন কেন? সব বানরকে আদরের পাশাপাশি বেত মারতে হয় না। কিছু বানরকে মাথায় চড়তে দিতে হয়, তারা তা করার যোগ্য। ইন্দ্র তেমন একজন বানর। অথচ এই ছেলেটির প্রাইজ মানি পর্যন্ত চুরি হয়ে যাচ্ছে। প্রতিভারা উৎসাহ উদ্দীপনা না পেলে এই কাজে লেগে থাকবে কেন? পৃষ্ঠপোষকতার বদলে যা উপার্জন করে নিচ্ছে তাও হয়ে যাচ্ছে চুরি।

মুহিব একটা ব্যাপার নিশ্চিতভাবে জানে, শিক্ষকদের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলনে যদি সাধারণ ছাত্ররা নামে তো শিক্ষক সম্প্রদায় একবিন্দু সহানুভূতি পাবে না। শিক্ষকদের ছোটো ছোটো শত ঘটনার মিলে বিন্দু বিন্দু হয়েছে মহাসমুদ্র। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসাবশতঃ অ্যাকাডেমিক ফলাফল নির্ধারণ, নিরাপত্তার অভাবে দুর্বৃত্ত ছিনতাইকারী দ্বারা আহত হওয়া ছাত্রদের ‘পরিস্থিতির শিকার’ ঘোষণা, সেমিস্টার ফাইনালের খাতা দেখায় স্বচ্ছতার অভাব, ছাত্রদের প্রাপ্তবয়স্কের মর্যাদা না দেওয়া, তাদের অযথাই ভোগানোর চেষ্টা করা, উচ্চ সিজিপিএ না থাকা ছাত্রদের অবহেলা-অপমান করা, এখানে ওখানে বেফাঁশ মন্তব্য করে ফেলাসহ শিক্ষকদের ওপর ছাত্রদের ক্ষেপে থাকার শ’য়ে শ’য়ে কারণ আগেই ছিল। ইন্দ্রদের টাকাটা শিক্ষকরা মেরে দিয়েছে এমন একটা খবর খুব দ্রুতই সবার কানে কানে পৌছে যাবে। আরও একটা কারণ যোগ হবে তাদের ঘৃণা করার

ছাত্ররা তাদের ঘৃণা করবেই না কেন? ইন্দ্রর টাকা শিক্ষকদের কেউ চুরি করেছেন নাকি অন্য কেউ তা তো নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। শিক্ষকরা জবাবদিহিতা করবেন না যে! পরীক্ষার খাতায় স্বচ্ছতা যদি বজায় রাখা হয়েও থাকে, তা তো নিশ্চিত করে জানার উপায় নেই। যেহেতু এ বিষয়ক কোনো চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া নিষিদ্ধ। কেউ যদি চ্যালেঞ্জ করেও বসে, একই কারণে এর নিষ্পত্তি হবে না। শিক্ষকরা জবাবদিহিতা করবেন না। শিক্ষকরা যেহেতু শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্ট থেকে ‘ওঁচা, তারা নিম্নশ্রেণির কারও সামনে জবাবদিহিতা করতে চান না। অথচ পরীক্ষার খাতা ঐ আন্ডারগ্র্যাড স্টুডেন্টের, ভবিষ্যতটাও তার। যেমনভাবে প্রাইজমানির টাকাটা ইন্দ্রর। এখানে জবাবদিহিতা না থাকা মানেই দুর্নীতির পথ খোলা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মানেই তো আকাশ থেকে নেমে আসা ফেরেশতা নন। জবাবদিহিতা যেহেতু নেই, স্বচ্ছতার সুযোগ নেই, ঘৃণা ছাড়া আর কোনো পথও ছাত্রদের জন্য শিক্ষক সম্প্রদায় খোলা রাখেননি।

নিজের মেসের সামনে এসে বড় এক জটলা দেখতে পেলো মুহিব। জাহিদ আর আসাদকে জটলার হোতা মনে হলো। আসাদ জটলায় নেতৃত্ব দিতেই পারে। ছুরি খেয়ে সেলেব্রিটি হওয়ার কারণে তার গ্রহণযোগ্যতা আছে, একটা ফেস ভ্যালু আছে। কাজেই সরাসরি তার কাছে গিয়ে জানতে চাইলো, “কি হচ্ছে রে আজ?”

ওকে শক্ত আলিঙ্গন করে স্বাগত জানালো আসাদ, “আরে মিয়া, তুমি চইলা আসছো? আমি তো ভাবলাম ঢাকায় ক্যাম্পেইন করতাছো। লিটুর কি অবস্থা?”

লিটুকে আইসিইউ-য়ে গিয়ে দেখে এসেছিলো মুহিব। শীতাতপ নিয়ন্ত্ৰিত একটা ঘরে অসহায়ের মতো শুয়ে থাকা একজন মানুষ। চারপাশে অসংখ্য নাম না জানা যন্ত্রপাতি। শ্বাস প্রশ্বাসটাও চলছে যন্ত্রের সাহায্যে। মুহিবের মনে হয়েছিলো এই দেখাই তার সাথে শেষ দেখা। ব্যাঙ্গালোরের নারায়ণ হেলথ সেন্টারে তাকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এর অর্থ খরচ আরও বাড়বে, তবে দিনশেষে লিটুর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে। আসাদকে এতোকিছু বলল না মুহিব। পাল্টা আলিঙ্গন করে কেবল বলল, “অবস্থা আগের মতোই। ভালো খবর যে আর অবনতি হয়নি।”

লিটুর অসুখের পর থেকে এই মিথ্যেগুলো খুব ভালোমতো আয়ত্ব করেছে ওরা।”কোনো উন্নতি নেই” বলা যাবে না, বলতে হবে “আর অবনতি হয়নি”। সবার ভেতরে আশা জিইয়ে রাখতে হবে। চেষ্টা করে যেতে হবে। নিরাশ হয়ে কেউ যেন লিটুর পাশ থেকে সরে না যায়।

“তাও ভালো।” মুহিবের কাঁধে বার দুয়েক চাপড় দিয়ে বলল আসাদ, “আমরা এখন যাচ্ছি অবস্থান নিতে। পয়ত্রিশ ক্রেডিট সিস্টেমের নামে যে বাল-ছাল আমাদের ওপর চাপায় দিতেছে প্রশাসন, সেইটার একটা গতি না করে নড়ছি না।”

বিষয়টা এবার স্পষ্ট হলো মুহিবের কাছে। এজন্য এতো আয়োজন? এজন্যই থমথমে পরিবেশ ক্যাম্পাসজুড়ে? তাই হবে। পয়ত্রিশ ক্রেডিট সিস্টেমটা শিক্ষক সমাজের নিয়ন্ত্রণলিপ্সায় নতুন সংযোজন। যদিও তারা সকাল সন্ধ্যা বলে যাচ্ছেন, “এটা আমরা ছাত্রদের ভালোর জন্য করছি!” তবে রাজনীতিবিদ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখের কথার ফুটো পয়সা দামও নেই দেশের এই প্রান্তে। সাধারণ ছাত্ররা মনে করে এই নতুন সিস্টেম চাপিয়ে দেওয়ার কারণ ছাত্রদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তাদের ধারণা ভুল-এমনটা প্রমাণ করার মতো শক্ত যুক্তি শিক্ষকরা দিতে পারেননি।

এতোদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারি অন সিস্টেম ছিল। কেউ যদি একটা সেমিস্টার একেবারেই ক্লাস না করতো, সে পরের সেমিস্টারে ভর্তি হয়ে এগিয়ে যেতে পারতো। পরবর্তিতে ব্যাকলগ পরীক্ষা দিয়ে ঐ আগের সেমিস্টারের পরীক্ষাগুলোয় পাশ করার একটা সুযোগ দেওয়া হতো। এতে করে একজন ছাত্রকে ঠিক ঠিক সবগুলো বিষয়ই পড়তে হচ্ছে এবং পাশ করতে হচ্ছে। কোথাও কোনো কারচুপির ব্যাপার নেই। এটা ঠিক, যারা সেমিস্টার ফাইনাল একটা দিলো না সেইসব ছাত্রদের অনেক বেশি চাপ নিতে হচ্ছে। ছয় মাসে দশটার জায়গায় তেরোটা কোর্স পড়তে হচ্ছে, পাশ করতে হচ্ছে। তবে ছাত্রদের এই চাপ নেওয়াতে কোনো আপত্তি ছিল না।

নতুন পয়ত্রিশ ক্রেডিট সিস্টেম অনুসারে, কেউ যদি এক শিক্ষাবর্ষে চল্লিশের মধ্যে পয়ত্রিশ ক্রেডিট উত্তীর্ণ হতে না পারে, তাকে এক বছর ডিমোশন দেওয়া হবে। স্কুলের মতো অনেকটা। ক্লাস নাইনের ফাইনালে ফেল করলে আবারও ক্লাস নাইনে ভর্তি হও। অর্থাৎ ছাত্রটির জীবন থেকে এক বছর নষ্ট করে দেওয়া হবে। কে অসুস্থ হওয়ার কারণে একটা পরীক্ষায় ফেল করলো বা অনুপস্থিত থাকলো তা প্রশাসনের দেখার বিষয় থাকছে না। তুমি পরীক্ষা দিতে আসোনি, বেশ তো, এক বছর পিছিয়ে গেলে। জুনিয়রদের সঙ্গে নতুন বছরে ভর্তি হয়ে যাও! আর ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা যে সব শিক্ষক চরিতার্থ করেন, তাদের তো পোয়াবারো। ক্রিকেটার জাফরভাইদের সময় এই নিয়ম চালু থাকলে উনি আজও ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করতেন, পাশ আর করা লাগতো না। এই কর্তৃত্ব শিক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়ার ঘোর বিরোধী অনেকেই। এর প্রতিবাদেই লিটুরা আন্দোলন করতে চেয়েছিলো। যে রাতে লিটু অসুস্থ হয়ে পড়লো, এই আন্দোলন নিয়েই উত্তেজিত হয়ে আলোচনা করছিলো সে।

আজ লিটু ক্যাম্পাসে নেই, তবে তার লিগেসি চলছে। জটলার দিকে তাকিয়ে মুহিব লক্ষ্য করলো সবার মুখেচোখে অদ্ভুত এক রঙ লেগে আছে। এ অন্য রকম এক দৃঢ়তা। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ছেলেরই পরিবারের অবস্থা ভালো না। চালচুলো নেই। অনেকের বাবা চাষাভূষো মানুষ। অনেকে এরই মধ্যে সংসারের হাল ধরেছে। লিটুর মতোই তাদের মুখে সব সময় লেগে থাকে সংশয়। তবে এই এক ইস্যু নিয়ে তারা একসাথে দাঁড়িয়েছে। তাদের চেহারায় সংকল্পবদ্ধতা। নিজেদের অধিকার আদায়ের সময় বাঙালি ছাত্রের চিরায়ত রূপ। অথবা, যখন বাঙালি ছাত্ররা মনে করে তারা ন্যায়ের পথে লড়ছে, তখন তাদের মুখে এই রঙটা ছড়িয়ে যায়।

“মুহিব, সামনে থাকিস আমাদের সাথে।” জাহিদ পেছন থেকে ওর পিঠ চাপড়ে দিলো।

মাথা নাড়লো মুহিব, “একেবারে ভচকে গেছি, দোস্ত। তোরা শুরুটা কর, পর জয়েন করবো। আমার ছয় ঘণ্টা না ঘুমালে চলছে না।”

লিটুর ক্যাম্পেইনে শামীম-মুহিবের ছোটাছুটির কথা সবাই জানে। আপত্তি তোলার কেউ ছিল না। জাহিদ হাত মিলিয়ে মিছিলের সামনের দিকে চলে গেলো। ফাঁকে ফোকড়ে অনিক, শাওনকে দেখা যাচ্ছে সবাইকে সঙ্ঘবদ্ধ করে লাইন ফর্ম করছে। ভালোই ছোটাছুটি যাচ্ছে তাদের।

মাথা গরম এক ছাত্র হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠলো, “জ্বালো জ্বালো…”

অতিউৎসাহী আর কয়েকজন গলা মেলালো, “… আগুন জ্বালো!”

ইউআরপি’র শাফাকাত তার টি-শার্ট খুলে ফেলেছে। টিশার্টের সামনে বড় বড় অক্ষরে লিখা “মাদারফাকার”। শাফাকাত কড়িৎকর্মা ছেলে। মেসের সামনে ট্রাকের গ্যারেজ, সেখান থেকে চটপট এক ক্যান গ্যাসোলিন যোগাড় করে ফেললো সে। খানিক বাদেই দেখা গেলো আধডজন মশাল জ্বালিয়ে ফেলা হয়েছে। রণহুঙ্কারে কেঁপে উঠছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।

অজান্তেই ঠোঁটের ফাঁকে মুচকি হাসির একটা রেখা ফুটে উঠলো মুহিবের এখানে দু’শ ছাত্রকে দেখা যাচ্ছে। ক্যাম্পাসে ঢুকতে ঢুকতে এই মিছিল হবে ছয়শ জনের। ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস ঘেরাও করার সময় সেখানে থাকবে অন্তত দেড় হাজার মানুষ। চল্লিশ বছর ধরে শিশুতোষ কমন সেন্স দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে গেলে একদিন তো পাল্টা ধাক্কা লাগবেই। লাগুক, তা নিয়ে মুহিবের কোনো আপত্তি নেই। হাতে কাজ না থাকলে এদের সঙ্গে জুটে যেতো সে নিজেও। কাছের একটা ছেলের হাত থেকে লিফলেট নিয়ে পুরোটা পড়লো।

নয় নম্বর কর্মসূচিতে আছে “ক্লাস বর্জন”। মাথা দোলালো মুহিব, ওই পর্যন্ত তাদের আন্দোলন যাবেও। এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনও নিঃশর্তভাবে ছাত্রদের দাবি মানেনি। যদি পরীক্ষা পেছানোর অ্যাপ্লিকেশন গ্রহণ করেছে, তো পরের পরীক্ষা জেদ দেখিয়ে ফেলেছে চার মাস পর। শিক্ষকদের আবার জেদ! একদিন বন্ধ বাড়িয়ে দেওয়ার অ্যাপ্লিকেশনে সাক্ষর করেছে, তো পরের এক সামার ভ্যাকেশন পনেরোদিনের বন্ধসহ গায়েব করে দিয়েছে। এমন প্রতিশোধপরায়ণ প্রশাসন সহজে মাথা নত করতে যাচ্ছে না। অর্থাৎ ক্লাস বর্জন হবেই।

ক্লাস এখন দুই চার সপ্তাহ না হলেই সবার জন্য মঙ্গল। একটু সরে এসে ফোন বের করলো ও। শিয়ার নম্বরে ডায়াল করছে।

সকল অধ্যায়

১. কুকুরদল – ০
২. কুকুরদল – ১
৩. কুকুরদল – ২
৪. কুকুরদল – ৩
৫. কুকুরদল – ৪
৬. কুকুরদল – ৫
৭. কুকুরদল – ৬
৮. কুকুরদল – ৭
৯. কুকুরদল – ৮
১০. কুকুরদল – ৯
১১. কুকুরদল – ১০
১২. কুকুরদল – ১১
১৩. কুকুরদল – ১২
১৪. কুকুরদল – ১৩
১৫. কুকুরদল – ১৪
১৬. কুকুরদল – ১৫
১৭. কুকুরদল – ১৬
১৮. কুকুরদল – ১৭
১৯. কুকুরদল – ১৮
২০. কুকুরদল – ১৯
২১. কুকুরদল – ২০
২২. কুকুরদল – ২১
২৩. কুকুরদল – ২২
২৪. কুকুরদল – ২৩
২৫. কুকুরদল – ২৪
২৬. কুকুরদল – ২৫
২৭. কুকুরদল – ২৬
২৮. কুকুরদল – ২৭
২৯. কুকুরদল – ২৮
৩০. কুকুরদল – ২৯
৩১. কুকুরদল – ৩০
৩২. কুকুরদল – ৩১
৩৩. কুকুরদল – ৩২
৩৪. কুকুরদল – ৩৩
৩৫. কুকুরদল – ৩৪
৩৬. কুকুরদল – ৩৫
৩৭. কুকুরদল – ৩৬
৩৮. কুকুরদল – ৩৭
৩৯. কুকুরদল – ৩৮
৪০. কুকুরদল – ৩৯
৪১. কুকুরদল – ৪০
৪২. কুকুরদল – ৪১
৪৩. কুকুরদল – ৪২
৪৪. কুকুরদল – ৪৩
৪৫. কুকুরদল – ৪৪
৪৬. কুকুরদল – ৪৫
৪৭. কুকুরদল – ৪৬
৪৮. কুকুরদল – ৪৭
৪৯. কুকুরদল – ৪৮
৫০. কুকুরদল – ৪৯
৫১. কুকুরদল – ৫০
৫২. কুকুরদল – ৫১
৫৩. কুকুরদল – ৫২
৫৪. কুকুরদল – ৫৩
৫৫. কুকুরদল – ৫৪
৫৬. কুকুরদল – ৫৫
৫৭. কুকুরদল – ৫৬
৫৮. কুকুরদল – ৫৭
৫৯. কুকুরদল – ৫৮
৬০. কুকুরদল – ৫৯
৬১. কুকুরদল – ৬০

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন