৬৪. ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতেও যেতে হল অনেকখানি পথ। খড় বিছিয়ে তার ওপর একটা চট পাতা, দিব্যি বিছানার মতন, শুয়ে যাওয়া যায়। একটানা ক্যাঁচর-কোঁচর শব্দ শুনতে শুনতে ঘুম আসে, বারীন্দ্র প্রথম থেকেই ঘুমোচ্ছে, ভরত জেগে আছে। উপুড় হয়ে শুয়ে দেখছে পথের দৃশ্য! বাংলার গ্রাম দেখার অভিজ্ঞতা তার বিশেষ নেই মাটির রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা, দু পাশে ধানখেত। এখনও ধান পাকার সময় হয়নি, দিগন্ত পর্যন্ত সবুজের ঢেউ। অনেক দূরে দূরে গ্রাম, চাষের খেতই বেশি! এত ফসল দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না যে এ দেশে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। গত বৎসরের দুর্ভিক্ষে কয়েক লক্ষ মানুষ মারা গেছে, এই তো ইংরেজ শাসনের সুফল!

রাস্তাটা এক একবার যাচ্ছে কোনও গ্রামের পাশ দিয়ে। এদিককার গ্রামে একটাও পাকা বাড়ি দেখা যায় না, সবই মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি। কোনও লোকের গায়েই জামা নেই, অবশ্য এখন গ্রীষ্মকাল, শীতেও এদের অতিরিক্ত পরিধান কিছু থাকে বলে মনে হয় না। ভরত উড়িষ্যার গ্রামাঞ্চল কিছু কিছু দেখেছে, প্রায় একই রকম প্রকৃতি, তবে কটক ছাড়ালেই কিছু পাহাড়-টিলা চোখে পড়ে। বাংলার এই অঞ্চল একেবারে সমতল।

হঠাৎ এক জায়গায় জোর ঝাঁকুনি লাগতেই বারীন্দ্র ধড়মড় করে উঠে বসল। গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করল, কোথায় এলাম? মেদিনীপুর শহর আর কত দূর?

গাড়োয়ান জানাল, আর বেশি দূর নেই, ক্রোশ খানেক হবে।

বারীন্দ্র ব্যস্ত হয়ে বলল, থামাও থামাও, আমরা এখানেই নামব।

পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে দুজনে নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে। গাড়োয়ানকে ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া হল। ঠা-ঠা রোদ, গরম হাওয়া বইছে। কাছেই একটা পুরনো বট গাছ, তার তলায় কিছু পোড়া কাঠ ও ভাঙা হাঁড়ি-কলসি ছড়ানো, সম্ভবত সেটা স্থানীয় শ্মশান। সেখানকার ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বারীন্দ্র বলল, শোনো ভরতদাদা, এখান থেকে আমাদের ছাড়াছাড়ি, আমরা একসঙ্গে শহরে ঢুকলে কেউ সন্দেহ করতে পারে। নতুন মানুষ দেখলেই লোকে সন্দেহ করে। এই শহরে আমার এক মামা থাকে, সত্যেন মামা, আমি গিয়ে উঠব তার বাড়িতে। তুমি যার বাড়িতে থাকবে, তার নাম হেমচন্দ্র কানুনগো, আমাদের সমিতির খুব বড় একজন কর্মী। আগে থেকে বলা আছে, তোমার ওখানে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ভরত জিজ্ঞেস করল, তার বাড়ি আমি চিনব কী করে? মানুষটাকেও চিনি না।

বারীন্দ্র বলল, চেনা খুব সহজ। শহরে ঢুকে তুমি প্রথমে পোস্ট অফিসের খোঁজ করবে। পোস্ট অফিস পেয়ে গেলে সেখানে জিজ্ঞেস করবে কানুনগোদের বাড়িটা কোথায়। মোটামুটি কাছেই হবে। দিনের বেলা আর আমাদের দেখা হবে না, সন্ধের পর কোনও গোপন জায়গা ঠিক করা থাকবে, সে তুমি খবর পেয়ে যাবে। ও ভাল কথা, আমরা আর কেউ কারুর নাম ধরে ডাকব না, এখন থেকে তোমার নাম ঙ-বাবু!

ভরত বলল, ঙ-বাবু! সে আবার কী রকম নাম?

বারীন্দ্র বলল, ক-খ-গ-ঘ এই চারটে অক্ষর যে আগেই খরচ হয়ে গেছে। আমাদের লিডার, মানে দলনেতা হচ্ছেন ক-বাবু। কখনও তার আসল নাম জানতে চাইবে না, জানলেও উচ্চারণ করবে না। আমি হলাম গবাবু।

ভরত বলল, ঙ-বাবু কেমন যেন বিচ্ছিরি শোনাবে। কাঁদুনে ছোট ছেলের মতন। আমি তবে ভ-বাবু হয়ে যাই!

বারীন্দ্র বলল, আরে না, না, আসল নামের আদ্যক্ষর চলবে না। তা হলে তো সহজেই বোঝা যাবে। ঠিক আছে, ঙ পছন্দ না হলে তুমি চ-বাবু হয়ে যাও! এখন আমি আগে যাচ্ছি, তুমি খানিকক্ষণ বাদে রওনা হয়ো!

বারীন্দ্র নিজের পুটলি কাঁধে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সে বাঁকের আড়ালে মিলিয়ে গেলেও ভরত দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। সম্পূর্ণ একজন অচেনা মানুষের বাড়িতে তাকে আশ্রয় নিতে হবে। তার চেয়ে কোনও হোটেল-সরাইখানায় উঠলে হত না? অবশ্য এ সব জায়গায় সে রকম আছে কি তাই-ই বা কে জানে! রেল স্টেশনে নামার পর পুলিশের এক সেপাইকে দেখে বারীন্দ্র উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, দাদা, ও দিকে তাকিয়ো না, আমার সঙ্গে আর কথা বলবে না, আমাকে না চেনার ভান করে গেটের বাইরে চলে যাও!

ভরত এ রকম উত্তেজনার কারণ বুঝতেই পারেনি। সে সেপাইটি খৈনি টিপতে টিপতে একজন ফেরিওয়ালার সঙ্গে গালগল্প করছিল। পুলিশ তাদের সন্দেহ করবে কেন? এই ক মাসে তো সার্কুলার রোডে এক আখড়ায় মাঝে মাঝে কুস্তি আর লাঠিখেলা হয়েছে। এ রকম শরীরচর্চায় তো কোনও সরকারি নিষেধ নেই! তাও সেই আখড়ায় শরীরচর্চা যত না হয়েছে, তার চেয়ে গুলতানিই হয়েছে বেশি। এখানেও ট্রেন থেকে অনেক লোক নামল, শুধু তাদের দুজনকে আলাদা করে কেউ সন্দেহ করতে যাবে কেন?

হেমচন্দ্র একজন তিরিশ-বত্রিশ বছরের বিবাহিত ব্যক্তি। ভরতকে সে মান্য অতিথির মতন অভ্যর্থনা জানাল এবং পৃথক একটি ঘর দিল। কিছুক্ষণ আলাপ-পরিচয়ের পর ভরত বুঝতে পারল, হেমচন্দ্র একজন বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিজ্ঞান থেকে শিল্পকলা পর্যন্ত বহু বিষয়ে তার আগ্রহ। কলেজ জীবনে এফ এ পড়তে পড়তে হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে ভর্তি হয়েছিল মেডিক্যাল কলেজে। কিছুদিন পর ডাক্তারি পড়তে আর ভাল লাগল না, খুব ছবি আঁকার ঝোঁক হল, ভর্তি হল গিয়ে গরকার আট স্কুলে। বছর দু-এক পরে মনে হল, ওখানেও আর কিছু শেখার নেই। তারপর থেকে ছাত্রজীবন ঘুচে গেল। জীবিকার জন্য হেম এখন একটা ইস্কুলে ড্রয়িং শেখায়, আর একটা কলেজে কেমিস্ট্রির ডেমনস্ট্রেটর। এর পরেও সময় পেলেই একা একা গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।

ভরতের আশ্চর্য লাগল দেখে যে হেমচন্দ্র বিবাহিত, সংসারী মানুষ। ছেলেমেয়ে আছে, তবু কেন সে গুপ্ত সমিতি গড়ার ঝুঁকি নিয়েছে? বারীনের আখড়ায় যে কজন জুটেছে, তারা সবাই নিতান্ত ছেলে-ছোঁকরা, বিয়ে-থা করেনি, বাড়ির কোনও দায় দায়িত্ব নেই। ভরতের কথা আলাদা, তার বয়েস এদের থেকে বেশি, কিন্তু তার কোনও চালচুলো নেই, কোনও পিছুটান নেই। সে অনেকটা কৌতূহলের বশেই এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। হেম একরোখা ধরনের মানুষ, খুব পড়য়া, সংসারের অবস্থা তেমন সচ্ছল না হলেও সে প্রচুর বই কেনে। তার বিশেষ আগ্রহ ইতিহাসে, বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস পাঠ করে তার ধারণা হয়েছে যে পরাধীন অবস্থায় জীবন ধারণ করাই বৃথা। যে কোনও দেশেই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বেশ কয়েক হাজার যুবককে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়, হেম ঠিক করেই নিয়েছে যে সে দেশের জন্য প্রাণ দেবে। এই সিদ্ধান্ত তার নিজস্ব। বাড়ি ঘর, স্ত্রী-সন্তান-সংসারের প্রতি তার একটুও মায়া নেই। বিপ্লব শুরুর দিকে যারা প্রাণ দেয়, তাদের অনেকেরই ইতিহাসে নাম থাকে না, কেউ তাদের কথা জানতে পারে না, হেম সে সম্পর্কেও সচেতন, এবং সে নাম-যশের কাঙাল নয়। সে হাসতে হাসতে বলে, যারা মিষ্টি খেতে ভালবাসে, তারা এক বাটি রাবড়ি খেলে যে রকম চরম আনন্দ পায়, আমার কাছে প্রাণ দেওয়াটা সে রকম চরম আনন্দের।

দুদিন ভরতকে বাড়ি থেকে বেরুতেই দেওয়া হল না। উঠোনের এক কোণের ঘরে সে দরজা বন্ধ করে থাকে, হেম ছাড়া আর কেউ সে ঘরে আসে না, হেমই তার খাবার এনে দেয়। যেন সে এক পলাতক ও আত্মগোপনকারী। ভরতের মজাই লাগে, সে কিছুই করেনি, অথচ তাকে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে কেন? এটাই নাকি কবাবু অর্থাৎ নেতার নির্দেশ। সেই প্রধান নেতাকে ভরত এখনও চোখেই দেখেনি।

দুপুরবেলা হেম কাজে চলে যায়, ভরত বাইরের দিকে একটা জানলা একটু ফাঁক করে বসে থাকে। দুপুরে তার ঘুমোনোর অভ্যেস নেই, হেমের কাছ থেকে সে বেশ কিছু বই চেয়ে নিয়েছে, ভরত বই পড়ে, ম্যাসিনি ও গ্যারিবলডির জীবনী পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে চেয়ে থাকে বাইরের দিকে। খুব কাছেই একটি পোড়ো বাড়ি, শখ করে কেউ একটা দোতলা বাড়ি বানিয়েছিল, এখন দরজা-জানলা নেই, এক দিকের ছাদ ধসে পড়েছে, হয়তো বাড়ির সবাই এক সঙ্গে ওলাওঠা কিংবা পান বসন্ত রোগে নিঃশেষ হয়ে গেছে। গ্রামের দিকে এই সব বাড়িকে ভূতের বাড়ি বলে। বেশ কিছু আম-জাম-কাঁঠালের গাছ আছে সে বাড়ির বাগানে, পেছনে একটা পানাপুকুর। রোজই দম্পরে গোটা চার-পাঁচ বালক এসে সেখানে হুটোপাটি করে, হনুমানের মতন গাছে চড়ে লাফায়। এই সময় দশ বারো বছর বয়েসী বালকদের স্কুলে থাকার কথা, কিন্তু এরা বোধহয় স্কুল-পালানো, বাপে-তাড়ানো, মায়ে-খেদানো ছেলের দল। এরা ভূতুড়ে বাড়িকেও ভয় পায় না।

খেলতে খেলতে ওই ছেলেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি বাধিয়ে দেয়। তখন গালাগালির বন্যা ছোটে, হাতাহাতির পর তারা নিষ্ঠুরের মতন ইট-পাথর ছুঁড়ে পরস্পরকে আঘাত হানে। ভরতের ইচ্ছে করে দৌড়ে গিয়ে ওদের ছাড়িয়ে দেয়, কিন্তু তার বাইরে বেরুনো নিষেধ।

মারামারির সময় একটি ছেলে থাকে এক দিকে, বাকি চার পাঁচজন এক দলে। একলা রোগা পাতলা ছেলেটির তেজ দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়, সে অসীম সাহসে রুখে দাঁড়ায়, খুব মার খেলে একেবেঁকে ছোটে, কিন্তু কিছুতেই হার মানে না। কতকগুলো কাঁচা আম সে পেড়েছে, অন্যদের ভাগ দিতে রাজি নয়, ইটের ঘা খেয়ে তার মাথা দিয়ে রক্ত পড়ছে, তবু সে ছুটে পালাল।

পরের দিন আবার ওই ছেলেরা খেলতে এল একসঙ্গে, যেন আগের দিন কিছুই ঘটেনি। কিছুক্ষণ বাদেই অবশ্য মারামারি শুরু হয়ে যায়। আজও রোগা ছেলেটির সঙ্গে অন্যদের লড়াই। এই ছেলেটির নাম খুদি, তার বন্ধুরা ওই নামে চ্যাঁচায়। আজ ওই খুদি এমন একটা কাণ্ড করল, যাতে ভরতেরই বুক ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। খুদির পরনে মালকোঁচা মারা খাটো ধুতি, খালি গা, ধুতির কোঁচড়ে অনেক আম বাঁধা, অন্যদের তাড়া খেয়ে পালাতে না পেরে সে সরসর করে পুকুরের ধারের একটা তালগাছের ডগায় চড়ে বসল। অন্যরা তাল গাছ বেয়ে উঠতে পারে না, তারা এই শালা খুদি, এই শুয়োরের বাচ্চা খুদি বলে গালাগাল দিতে লাগল প্রাণ ভরে, তারপর ঢেলা ছুঁড়তে লাগল। তালগাছের মাথায় লুকিয়ে বসে থাকলে ঢিল লাগে না, কিন্তু সেখানে একটা চিলের বাসা, এক ঝাঁক চিল এসে ঠোকরাতে লাগল খুদিকে। তখনও সে গাছ বেয়ে নীচে নামল না, এক লাফ দিল পুকুরে। ভরত আঁতকে উঠল, অত উঁচু থেকে লাফ দিলে কেউ বাঁচে? খুদি কিন্তু হাঁসের মতন দ্রুত সাঁতার কেটে চলে গেল পুকুরের অন্য পারে!

ভরত নিজের কথা ভাবে। ওই বয়েসে সে কত ভিতু আর লাজুক ছিল। তার কোনও খেলার সঙ্গী ছিল না। শুধু কয়েক দিনের জন্য খেলতে এসেছিল মনোমোহিনী, সেই মেয়েটি তার জীবনপ্রবাহ সম্পূর্ণ বদলে দিয়ে গেল।

দুদিন দুঃসহ গরমের পর তৃতীয় দিন সন্ধ্যাকালে আকাশে ঘনিয়ে এল কৃষ্ণবর্ণ মেঘ। শুরু হল গুরুগুরু গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলক। হেমের সঙ্গে এই কদিন আলাপ-আলোচনায় ভরতের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে, হেম তাকে বন্ধু বলেই সম্বোধন করে। হেম এসে বলল, চলো বন্ধু, আজ বেরুতে হবে।

ভরত সঙ্গে সঙ্গে রাজি। ঘরে বসে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। দুজনে বাড়ির বাইরে আসার পর ভরত জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

হেম সংক্ষেপে উত্তর দিল, কোথাও না।

ভরত বিস্মিত হল। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই কি বেড়াবার সময় নাকি!

হেম বলল, নির্দেশ এসেছে, আজ আমাদের বৃষ্টি ভিজতে হবে।

ভরত বলল, তার মানে! শুধু শুধু বৃষ্টি ভিজব কেন?

হেম বলল, যতক্ষণ বৃষ্টি পড়বে ততক্ষণ বৃষ্টি ভিজব। যখন আমাদের অ্যাকশন শুরু হবে, তখন এ রকম ঝড়জলের মধ্যেও আমাদের বেরুতে হবে। সেই জন্য অভ্যেস করা দরকার। শরীরকে সইয়ে নিতে হবে।

ঝড়ের তোড়ে মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে গাছের ডাল। প্রবল বাজ পড়ার শব্দে পিলে পর্যন্ত চমকে যায়, অন্ধকারে পথ দেখা যায় শুধু অশনি সঙ্কেতে। ভরতের ভয় করছে না, বরং আনন্দই হচ্ছে। এই বৃষ্টি ভেজাটাই দেশের কাজ।

হেম বেশি কথা বলে না। দুজনে প্রায় দেড় ঘণ্টা ভিজে, বৃষ্টি একেবারে থেমে গেলে, বাড়ি ফিরে এল। হেমের খালি পা, ভরত ভুল করে জুতো পরে গিয়েছিল, সেই জুতো একেবারে কাদায় মাখামাখি। গায়ের জামা কাপড় সপ সপ করছে।

পরদিন সকাল থেকেই আকাশ পরিষ্কার, চড়া রোদ। রবিবার, হেমের স্কুল ছুটি, দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরই হেম বলল, এখন আমরা ঘুরতে যাব।

এমন রোদে ছাতা ছাড়া কেউ বেরোয় না, গরিব চাষারাও মাথায় টোকা দেয়। হেম ছাতা নিল না। আজ তাদের রোদ্র সহ্য করার পরীক্ষা। দু ঘণ্টা রোদে ঘুরতে হবে। কাল রাতে বৃষ্টি ভিজতে কষ্ট হয়নি, মাথায় বাজ পড়ার আশঙ্কা ছিল শুধু। আজ একটু পরেই দরদরিয়ে ঘাম শুরু হল, মুখের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছে। আজ জুতো পরে আসেনি ভরত, মাটিতে পা রাখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ ঘোরার পর ভরত বলল, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, কোনও বাড়ি থেকে একটু জল চেয়ে খেলে হয় না?

হেম বলল, জল খাওয়া নিষেধ। হয়তো এমন জায়গায় আমাদের যেতে হবে, যেখানে জল পাওয়া যাবে না!

অদূরেই একটা খড়ের চাল দেওয়া মাটির বাড়ি। কালো রঙের স্থলাঙ্গিনী এক যুবতী মাটির কলসিতে করে কোথা থেকে যেন জল এনে ঢুকছে সেই বাড়িতে। অন্য দিক থেকে ছুটে এল একটি দশ-বারো বছরের ছেলে। এ সেই খুদি, আজ সে একটু খোঁড়াচ্ছে।

ভরত সেদিকে তাকিয়ে বলল, ওঃ, এই ছেলেটার সাহস আছে বটে।

হেম বলল, ক্ষুদিরাম? গোটা মেদিনীপুর শহরে ওর মতন দুর্দান্ত ছেলে আর দুটি নেই। সাঙ্ঘাতিক বিচ্ছু! কত রকম দসিপানা যে করে! যত ওকে মারো ধরো, ও মুখে টু শব্দটি করবে না। ওকে শায়েস্তা করাও যাবে না।

ভরত বলল, কাল দেখলাম, তাল গাছের মাথা থেকে পুকুরে ঝাঁপ দিল, ওর প্রাণের ভয়ও নেই।

হেম বলল, ছোটবেলা থেকে এত মার খেয়েছে, এত বকুনি, ওর বাপ মা নেই, বুঝলে, দিদি জামাইবাবুর বাড়িতে দুটো খেতে পেত, তার বদলে কত যে লাথি ঝটিা, তাতেই শরীরটা ওর। দড়কচ্চা হয়ে গেছে।

স্থলাঙ্গিনী মহিলাটির দিকে ইঙ্গিত করে ভরত জিজ্ঞেস করল, ওই ওর দিদি?

হেম বলল, নাঃ, দিদির বাড়ি থেকে ও পালিয়েছে। ওই স্ত্রীলোকটি, আমাদের সমাজে যাদের পতিতা বলে, তাই। এক বাবুর রক্ষিতা। কিন্তু প্রকৃত দেবী বলা যায় এদেরই। ক্ষুদিরামকে শুধু যে খেতে পরতে দেয় তাই নয়, ওর কাছ থেকেই ক্ষুদিরাম একমাত্র স্নেহের স্বাদ পেয়েছে। ও ছেলেকে সামলানো তো সোজা কথা নয়, সব সময় দুষ্টু বুদ্ধি, প্রত্যেকদিন মারামারি করে ঘরে ফেরে।

একটু থেমে হেম আবার বলল, এই রকম ছেলেদেরও ঠিক পথ দেখালে দেশের কাজে লাগতে পারে।

ভরত বলল, ও তো এখনও খুব ছোট!

হেয় অন্যমনস্ক ভাবে বলল, হুঁ।

কয়েকদিন পর পর এ রকম রৌদ্রে ঘোরাঘুরি ও বৃষ্টি ভেজা চলল। হেমের অভ্যেস আছে, কিন্তু সর্দি জ্বর হয়ে গেল ভরতের। নিজেকে তার অপরাধী মনে হয়। এটুকু সে পারছে না, তা হলে দেশের সৈনিক হবে কী করে? জ্বরে ঝাঁ ঝাঁ করছে শরীর, তবু সে বিছানায় শুয়ে থাকতে চায় না।

এরই মধ্যে একদিন খবর এল, দলের নেতা কবাবু এসেছেন মেদিনীপুরে।

এ পর্যন্ত এই নেতাকে কখনও দেখেনি ভরত। শুনেছে, তিনি বাংলার বাইরে কোথাও থাকেন। বারীন্দ্র কেমন যেন একটা রহস্যের আবরণ দিয়ে রাখে তাঁর গতিবিধি সম্পর্কে। কলকাতায় সার্কুলার রোডের আখড়ায় কবাবু কখনও আসেননি, সেখানকার দল পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে আছেন খবাবু। তাঁর নাম ভরত জেনেছে, যতীন বাড়জ্যে, এক সময় নাকি কোনও সেনাবাহিনীতে ছিলেন, তলোয়ার বন্দুক চালাতে জানেন। তাঁর মুখে প্রায়ই টাকাপয়সার কথা শোনা যায়। বিপ্লবের প্রথম প্রয়াস অর্থ সংগ্রহ করা, কিছু ধনী ব্যক্তির কাছে চাঁদা চেয়েও সুবিধে হয়নি, সকলকে আসল উদ্দেশ্য খুলে বলাও যায় না। ডাকাতি করা ছাড়া টাকা তোলার অন্য উপায় নেই, যতীন বাড়জ্যের এই মত, অনেক পরিকল্পনাও হয়েছে, এ পর্যন্ত অভিযান অবশ্য হয়নি। যতীনের সঙ্গে বারীন্দ্রের প্রায়ই ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাধে। যতীনের নির্দেশ বারীন মানতে চায় না। এ আখড়ায় যতীনের সঙ্গে একটি যুবতী মেয়ে থাকে, তাকে নিয়েও ফিসফিসানি শুরু হয়েছে, যতীন তাকে নিজের ভগিনী বলে পরিচয় দেয়, তা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। বয়স্থা মেয়ে, কেন তার বিবাহ হয়নি, কেন সে তার দাদার সঙ্গে থাকে? তা ছাড়া সেই যুবতীর চক্ষে আছে গুপ্ত ঝিলিক, ওষ্ঠে আছে রসের ইঙ্গিত, মাঝে মাঝেই সে বারান্দার রেলিঙে ঠেস দিয়ে দু বাহু তুলে দাঁড়ায়।

একদিন সন্ধের পর স্বয়ং কবাবু এলেন হেমের বাড়িতে। তাঁকে দেখে ভরত চমকে উঠল। এঁকে তো সে চেনে, একবার ট্রেনের কামরায় আলাপ হয়েছিল, মিস্টার এ ঘোষ। তবে সেবার ওঁকে  দেখে মনে হয়েছিল, খানিকটা ভুলোমনা, বাস্তবজ্ঞানহীন বই-সর্বস্ব মানুষ, সরাসরি কারুর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারেন না, একটার পর একটা সিগারেট খান। এর মধ্যে অনেকখানি। পরিবর্তন হয়েছে, গাম্ভীর্যমাখা মুখে আত্মবিশ্বাসের ছাপ, আগে বাংলা বলতে পারতেন না প্রায়। এখন বেশ ভাল বাংলা শিখে নিয়েছেন। সিগারেট অবশ্য টানছেন আগেরই মতন।

অরবিন্দ অবশ্য ভরতকে চিনতে পারলেন না। একটা চেয়ারে বসতে দেওয়া হল তাঁকে। সঙ্গে এসেছে বারীন আর সত্যেন। প্রথমেই কাজের কথা শুরু করার ভঙ্গিতে তিনি হেমকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের এখানকার সমিতির সদস্য ক’জন?

মেদিনীপুরে হেমচন্দ্রের সমমনস্ক আরও কয়েকজন মানুষ আছে, তারা মাঝে মাঝে মিলিত হয়ে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্ব রাজনীতি এবং ভারতের অবস্থা নিয়ে। সে রকম নিয়মবদ্ধ সমিতি কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অরবিন্দর সঙ্গে এখানকার এই গোষ্ঠীর যোগাযোগ হয়েছে সত্যেনের সূত্রে। সত্যেন অরবিন্দ ও বারীনের আত্মীয়।

অরবিন্দ হেমের মুখে বিবরণ শুনে বললেন, ওভাবে হবে না। কঠোর বিধিনিষেধ মেনে সিক্রেট সোসাইটি স্থাপন করতে হবে। মহারাষ্ট্রে এ রকম সিক্রেট সোসাইটি আগেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, বাংলা পারবে না? প্রত্যেক জেলায় জেলায় এ রকম সমিতি গড়া চাই। আমি যে কদিন থাকব, তার মধ্যে নতুন নতুন সদস্য জোগাড় করুন, আমি দীক্ষা দিয়ে যাব। দেশ আজ জেগে উঠেছে এমনকী পাহাড়ে পাহাড়ে আদিবাসীরাও অস্ত্র নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত, এই সময় বাংলা ঘুমিয়ে থাকবে!

এরপর অরবিন্দ দীক্ষার শপথগুলি শোনালেন। সোসাইটির তরফ থেকে যখন যা আদেশ করা হবে, প্রত্যেক সদস্যকে তা পালন করতেই হবে, নচেৎ মৃত্যুদণ্ড। দেশের শত্রুদের ঠাণ্ডা মাথায় খুন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। প্রয়োজনে ডাকাতি করতে হবে। সোসাইটি যদি কোনও সদস্যকে অন্য কোথাও যাবার নির্দেশ দেয়, তা হলে আত্মীয়-বন্ধুদের তা জানানো চলবে না, কারুর কাছ থেকে বিদায় না নিয়েই চলে যেতে হবে। দেশের কাজে সর্বৰ্ষ সমর্পণ করতে হবে, নিজের বিষয় সম্পত্তি ও টাকাকড়ির ওপরেও অধিকার থাকবে না। ধরা পড়লে দ্বীপান্তর বা ফাঁসি বা দীর্ঘ কারাবাসের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, বিচারের সময় সহকর্মীদের সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করা যাবে না।

পরদিনই দীক্ষার ব্যবস্থা হল হেমের বাড়িতেই রাত্রিবেলা। হেম আগে থেকে আরও বেশ কয়েকটি যুবককে দলে টানার ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু শপথগুলির কথা শুনে তারা অনেকেই ভয়ে আসতে রাজি হল না। একজন একেবারে প্রস্তুত হয়ে এসে ঘরের মধ্যে বসেছিল, অরবিন্দ হাতে। একটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতেই সে বলল, একটু পেচ্ছাপ করে আসছি। তারপর বোধহয় সে পৃথিবীর শেষতম প্রান্তে ওই কার্যটি সারতে চলে গেল, আর ফিরে এল না।

দীক্ষা হল মোট পাঁচজনের। এক হাতে গীতা, অন্য হাতে তলোয়ার খুঁয়ে প্রত্যেকে শপথ বাক্য উচ্চারণ করল। শেষ ব্যক্তি ভরত, অরবিন্দ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, যুবক, দেশের জন্য প্রাণ দিতে তোমার মনে কোনও দ্বিধা নেই তো?

ভরত বলল, না।

অরবিন্দ বিলেতি কায়দায়, রাজা রানিরা যে ভাবে নাইটহুড প্রদান করেন সেই ভাবে ভরতের কাঁধে তলোয়ারটি রাখলেন।

তারপর বললেন, তলোয়ারটি আসলে প্রতীক। এ কালের যুদ্ধ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে হয় না। পিস্তলবন্দুক ব্যবহার রপ্ত করতে হবে সকলকে। এখানে কি কেউ একটা বন্দুক জোগাড় করতে পারবে? তা হলে আমিই শিখিয়ে দিয়ে যেতাম।

হেম সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিই জোগাড় করব। দুদিন সময় দিতে হবে।

অস্ত্র আইনে কোনও ভারতবাসীরই বাড়িতেই বন্দুক-পিস্তল রাখার অধিকার নেই। দেশীয় রাজা-রাজড়া বা জমিদারগণ তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে দুচারটি আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারেন, হেমের মতন একজন স্কুল মাস্টার বন্দুক পাবে কোথায়? অথচ সে সংক্ষিপ্ত দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিল এবং সত্যিই পরের দিন একটা বন্দুক সংগ্রহ করে আনল।  কোথা থেকে কিংবা কী করে পেল, সে সম্পর্কে সে কিছু বলতে চায় না। তি

এহ বারই প্রথম পুলিশের নজরে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। কেননা, বন্দুক চালাতে গেলে শব্দ হবেই, এবং এ শব্দ অন্য কোনও শব্দেরই মতন নয়। বন্দুকটা হাতে ধরলেই একটা বেআইনি কাজ করার উত্তেজনায় শরীর থরথর করে কাঁপে।

সত্যেন একটা উপযুক্ত স্থানের সন্ধান নিয়ে এল। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে এক ঊষর প্রান্তরের মধ্যে বড় একটি খাদ আছে। সেখানকার ভূমি ছোট ছোট নুড়ি পাথরে ভর্তি। রেল কোম্পানির প্রয়োজনে সেখান থেকে ওই নুড়ি পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বছর খানেক ধরে। খুড়তে খুঁড়তে একটা বিশাল খাদ হয়ে গেছে, বর্ষার সময় সেই খাদ জলে ভরে যায়, এখন খবার সময়ে সেটা একেবারে শুষ্ক। অতি প্রত্যুষে, কাক-পক্ষী জাগার আগে সেই খাদে নেমে বন্দুক চালালে সেই শব্দ কেউ শুনতে পাবে না।

উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমই হল না, রাত শেষ না হতেই বেরিয়ে পড়ল দলটি। নিঃসাড়, ঘুমন্ত সব বাড়ি, এরা সঙ্গে কোনও ঝুতি নেয়নি, আকাশে রয়েছে ফ্যাকাসে চাঁদের আলো।

সেই খাদটি বেশ বড়, তার এক প্রান্তে একটি চাঁদমারি তৈরি করা হল। কাছাকাছি কোনও বাড়ি নেই। ভোরের আলো না ফুটলে নিশানা ঠিক করা যাবে না। একটা সিগারেট ধরিয়ে অপেক্ষা করতে করতে অরবিন্দ বললেন, অস্ত্রের অভাব হবে না। দেশীয় রাজ্য থেকে অনেক অস্ত্র পাওয়া যাবে, বিদেশ থেকেও আসবে। সারা ভারতে একসঙ্গে হাজার হাজার বন্দুক গর্জে উঠবে ইংরেজের বিরুদ্ধে। অন্য সব রাজ্যগুলি তাকিয়ে আছে বাংলার দিকে। কলকাতা ভারতের রাজধানী, প্রথম আঘাত হানতে হবে এই কলকাতা থেকেই।

প্রথমে শোনা গেল একটা কুবো পাখির ডাক, পূর্ব দিগন্তে দেখা গেল আলোর আভা। অরবিন্দ বন্দুকটি নিয়ে তৈরি হলেন। কুঁদো বুকে চেপে, ট্রিগারে হাত দিয়ে, মাছিতে চোখ রেখে তিনি বললেন, প্রথমে এই ভাবে শক্ত করে চেপে ধরে, নিশানার দিকে মনটাকে একাগ্র করে নিতে হবে। প্রথম প্রথম একটু সময় লাগবে, কিন্তু একবার অভ্যেস হয়ে গেলে…

অরবিন্দ ট্রিগার টেপার পর গুলিটা কোথায় গেল বোঝা গেল না, কিন্তু উল্টো ধাক্কায় তিনি ছিটকে পড়লেন, বন্দুকটাও খসে গেল হাত থেকে। সবাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে অরবিন্দকে তুলে ধরল।

তার মুখোনি বিবর্ণ হয়ে গেছে, বুকে বেশ জোরেই ব্যথা লেগেছে মনে হয়। তিনি মস্ত বড় বিদ্বান ও পণ্ডিত বটে, কিন্তু বোঝা গেল, বন্দুক চালনার অভিজ্ঞতা তাঁর একেবারেই নেই। তিনি আর চেষ্টাও করলেন না।

বারীন বন্দুকটা একবার তুলে নিয়ে তাক করতে গিয়েও আবার নামিয়ে রেখে বলল, থাক, যতীনদাকেই ডাকতে হবে দেখছি।

ভরত বলল, আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি?

বন্দুক-পিস্তল ভরতের কাছে খুব অচেনা বস্তু নয়। মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের নানা রকম আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহের শখ ছিল, তিনি নিজে উত্তম শিকারি ছিলেন। অন্য রাজকুমাররাও শিকারে যেত। ভরত সে সুযোগ কখনও পায়নি বটে, কিন্তু দেখেছে অনেক। তার শিক্ষক শশিভূষণও ছিলেন দক্ষ বন্দুক চালক। একবার রাজবাড়ি সংলগ্ন দিঘির ওপারে যে জঙ্গল, সেখানে কয়েকটি হায়না এসে পড়েছিল, শশিভূষণ গুলি চালিয়ে একটাকে মেরেছিলেন, তখন ভরত ছিল তাঁর পাশে।

ভরত কখনও তলোয়ার চালনাও শিক্ষা করেনি। কিন্তু একবার কটকে আসার পথে ডাকাতদের পাল্লায় পড়ে মরিয়া হয়ে সে তলোয়ার হাতে নিয়ে নিজের স্ত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।

সেই ভরসাতেই সে বন্দুকটি হাতে তুলে নিল। কুঁদোটা চেপে নিল বগলে, একটুক্ষণ তাক করে ট্রিগার টিপল। চাঁদমারিতে লক্ষ্যভেদ হল না বটে, গুলিটা একটু দুরে আঘাত করে পাথর ছিটকে দিল, সে নিজেও ধরাশায়ী হল না।

অন্য সকলে উচ্ছ্বসিতভাবে সাবাশ সাবাশ বলে পিঠ চাপড়াতে লাগল ভরতের। অরবিন্দ বললেন, তা হলে তো আপনিই আমাদের শেখাতে পারবেন। ভরত লজ্জা লজ্জা মুখ করে নীরব রইল। সে যে এই প্রথমবার ট্রিগার টিপেছে, সে কথা আর জানাল না।

বারীন বলল, ভরতদাদা, আর একবার চালাও তো দেখি।

এবার ভরতের অনেকটা আত্মবিশ্বাস এসে গেছে। দ্বিতীয় গুলিটা লাগল চাঁদমারির মাত্র এক বিঘত দূরে।

অরবিন্দ বললেন, যতীনকে পাঠাতে হবে না। আপনিই হবেন এখানকার শিক্ষক।

অরবিন্দ এবং বারীন সেদিনই ফিরে গেলেন কলকাতায়। ভরতের কোনও তাড়া নেই। তার পক্ষে কলকাতায় থাকা কিংবা মেদিনীপুরে থাকা সমান, কোনও জায়গাতেই তার জন্য কেউ অপেক্ষা করছে না। মেদিনীপুরে তার ভালই লাগছে। শুধু একটা ব্যাপারে তার অস্বস্তি হয়, হেমের বাড়িতে সে দিনের পর দিন অন্ন ধ্বংস করছে, এর তো একটা খরচ আছে! কারুর বাড়িতে দু-তিন দিনের বেশি অতিথি হয়ে থাকা উচিত নয়। হেমকে কিছু টাকাপয়সা দেবার প্রস্তাব করলে সে হেসে উড়িয়ে দেয়।

অনেক চেষ্টা করেও গুপ্ত সমিতির সদস্যসংখ্যা বিশেষ বাড়ানো গেল না। আর দুটি যুবককে কোনওক্রমে জোটানেনা গেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও কেমন যেন চঞ্চল ভাব। তারা লাঠি খেলা শিখতে আগ্রহী, কিন্তু বন্দুক ছুতে ভয় পায়। কেউ কেউ স্পষ্ট বলে, স্বাধীনতার জন্য এত হ্যাঁঙ্গাম করার দরকার কী, ব্রিটিশ রাজত্বে আমরা তো বেশ আছি! সাহেবদের নেকনজরে পড়লে চাকরি পাওয়া যায়, সাহেবরা না থাকলে যে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে, তা কে সামলাবে?

প্রতি রাত্রেই হেমের সঙ্গে ভরতের নানান কথা হয়। দুজনের মনেই একটা খটকা লেগেছে। এখানে গুপ্ত সমিতির সদস্যসংখ্যা সাকুল্যে সাতজন, কাছাকাছি অন্যান্য জেলাতে কিছুই গড়ে ওঠেনি। তা হলে বাংলার যুবসমাজকে স্বাধীনতার সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে আরও কত বছর, কত যুগ লাগবে? প্রধান নেতা অরবিন্দ ঘোষ বলে গেলেন, ভারতের আর সর্বত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের চরম প্রস্তুতি চলছে, বাংলা তাতে অংশগ্রহণ করবে কী করে?

ভরত বলল, আমি ভারতের বেশ কটি রাজ্যে ঘুরেছি, কোথাও এ রকম প্রস্তুতি দেখিনি। অবশ্য নিশ্চিত সবই খুব গোপন। পাহাড়ের লোকরা যে জাগল, তাদের কে জাগাল, কোথায় সেই নেতা?

হেম খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, বন্ধু, এক কাজ করলে হয় না? বেশি লোককে জানাবার দরকার নেই, শুধু তুমি আর আমি মিলে যদি কোনও বড় ইংরেজ রাজপুরুষকে খুন করি, তবে কেমন হয়? তাতে গোটা ভারতে সাড়া পড়ে যাবে। সবাই জানবে বাঙালি ঘুমিয়ে নেই। হয়তো তাতে আমরা ধরা পড়ে যাব, প্রাণ যায় যাবে, তবু তো অনেকের টনক নড়বে। তুমি কী বলে?

ভরত বলল, আমার আপত্তি নেই।

হেম বলল, শোনা যাচ্ছে ছোটলাট শিগগিরই এই অঞ্চল পরিভ্রমণে আসবেন। সেই সময়…আমি সামনে থাকব, ধরা যদি দিতেই হয়, আমি প্রথম ধরা দেব, তুমি পালাবার চেষ্টা করবে।

ভরত হেসে বলল, তোমার তো বউ ছেলে আছে, আমার তো ও সব বালাই নেই। প্রাণ দেবার দাবি আমারই বেশি।

এই পরিকল্পনা অবশ্য বেশিদূর এগোল না, আপাতত স্থগিত রাখতে হল। কলকাতার সমিতি থেকে নির্দেশ এল, ভরতকে কলকাতায় ফিরতে হবে অবিলম্বে, যোগাযোগ করতে হবে শ্রীমতী সরলা ঘোষালের দলের সঙ্গে।

সকল অধ্যায়

১. ০১. জমিদারের বজরা
২. ০২. সকালবেলা থেকেই ভারী মিষ্টি সানাই বাজছে
৩. ০৪. দুপুরগুলোই সরলার কাছে মনে হয় সবচেয়ে দীর্ঘ
৪. ০৩. কাশিয়াবাগানে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়ি
৫. ০৫. গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে
৬. ০৬. গিরিশচন্দ্র বেকার
৭. ০৭. রামবাগানে গঙ্গামণি
৮. ০৮. ত্রিপুরা সরকারের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন শশিভূষণ
৯. ০৯. কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার
১০. ১০. নরেনের রূপান্তর
১১. ১১. লয়েড কম্পানি
১২. ১২. কটক শহরে ভরতের বাসা-বাড়ি
১৩. ১৩. অনেকদিন পর দুই বন্ধুতে দেখা
১৪. ১৪. ভাল খেলিয়াও পরাজিত
১৫. ১৫. মধ্যরাত পার হয়ে গেছে
১৬. ১৬. একটি স্পেশাল ট্রেনে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য
১৭. ১৭. গড়গড়া টানছেন অর্ধেন্দুশেখর
১৮. ১৮. দুরন্ত ঝঞ্ঝা স্বামী বিবেকানন্দ
১৯. ১৯. বক্তৃতার চুক্তি থেকে মুক্তি
২০. ২০. জমিদারির কাজ তদারকির জন্য শিলাইদহ
২১. ২১. মহিলামণির ক্রোড়ে একটি পুত্র সন্তান
২২. ২২. বন্ধু ও ভক্ত পরিবৃত হয়ে সুরেন্দ্রনাথ
২৩. ২৩. শরীর পোড়ানো গ্রীষ্ম
২৪. ২৪. চা পান করছিল যাদুগোপাল
২৫. ২৫. বিশ্বনাথ দত্তের মধ্যমপুত্র মহেন্দ্রনাথ
২৬. ২৬. স্বামী বিবেকানন্দর এই দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ডে আগমন
২৭. ২৭. অর্ধেন্দুশেখর এখন কর্মহীন
২৮. ২৯. এক বস্ত্রে, কপর্দকশূন্য অবস্থায়
২৯. ২৮. ভিকটোরিয়া ড্রামাটিক ক্লাব
৩০. ৩০. থিয়েটারের জগতে অমরেন্দ্রনাথ
৩১. ৩১. রানি সুমিত্রার সংলাপ
৩২. ৩২. স্বামী বিবেকানন্দ যখন লন্ডনে
৩৩. ৩৩. মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মৃত্যুর পর
৩৪. ৩৪. সরলাকে বাড়ি থেকে বেরুবার জন্য
৩৫. ৩৫. লেখার টেবিলে বসে আছে ইন্দিরা
৩৬. ৩৬. বিপদ যখন আসে
৩৭. ৩৭. মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেন
৩৮. ৩৮. এলাহাবাদ থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পদব্রজে
৩৯. ৩৯. এখনও ভোর হতে দেরি আছে
৪০. ৪০. নয়নমণির উদ্দেশে গানের কলি
৪১. ৪১. বাল গঙ্গাধর তিলকের মামলা
৪২. ৪২. নৈনিতাল থেকে ঘোড়ার পিঠে যাত্রা
৪৩. ৪৩. শ্রাবণ মাসে যখন তখন বর্ষা নামে
৪৪. ৪৪. প্রয়োজনে মানুষ কী না করে
৪৫. ৪৫. তিনজন বিদেশিনীকে নিয়ে অমরনাথ শিখরে
৪৬. ৪৬. বাল গঙ্গাধর তিলকের কারাদণ্ড
৪৭. ৪৭. গঙ্গার প্রায় সন্নিকটে বোসপাড়া
৪৮. ৪৮. কয়েকদিন হল শীত পড়েছে
৪৯. ৪৯. সারাদিন ধরে একটা গানের কলি
৫০. ৫০. ছিলেন শৈব, হয়ে গেলেন শাক্ত
৫১. ৫১. জানুয়ারি মাসের এক অপরাহ্নে
৫২. ৫২. মানুষ সবচেয়ে কম দেখে নিজেকে
৫৩. ৫৩. কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ভূমিকা
৫৪. ৫৪. লম্বা রেল গাড়ির বাষ্পীয় ইঞ্জিন
৫৫. ৫৫. বাতাসে স্পষ্ট একটা পরিবর্তনের গন্ধ
৫৬. ৫৬. পাঠ নিতে বসে অরবিন্দ
৫৭. ৫৭. দ্বারিকার পুত্রটির বয়েস দেড় বৎসর
৫৮. ৫৮. জগদীশচন্দ্র পরীক্ষাতেই মেতে আছেন
৫৯. ৫৯. বিশাল পদ্মানদীর এপার ওপার
৬০. ৬০. প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে কিছু মোসাহেব দরকার
৬১. ৬১. শরৎ নামে একজন শিষ্য
৬২. ৬২. ভারতবর্ষ থেকে কিছুদিন দূরে থেকে
৬৩. ৬৩. এই মানুষে সেই মানুষ আছে
৬৪. ৬৪. ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে
৬৫. ৬৫. সবসময় টাকার চিন্তা
৬৬. ৬৬. নয়নমণি এখন সারা সকাল
৬৭. ৬৭. শোকের সময়ও পেলেন না নিবেদিতা
৬৮. ৬৮. সার্কুলার রোডের বাড়িটি
৬৯. ৬৯. সিংহল, বর্মা সমেত এই যে ভারতবর্ষ
৭০. ৭০. থিয়েটার দেখতে এসেছেন মহেন্দ্রলাল সরকার
৭১. ৭১. সার্কুলার রোডের আখড়া
৭২. ৭২. প্রথম পঙক্তিটি আসে আকাশ থেকে
৭৩. ৭৩. স্বামী ও স্ত্রী দুজনেরই খুব বাসনা ছিল
৭৪. ৭৫. অস্থায়ী মন্দির বানিয়েছেন অরবিন্দ
৭৫. ৭৪. জানলা দিয়ে ভোরের আলো
৭৬. ৭৬. বউবাজারের বাড়ি থেকে থিয়েটারে
৭৭. ৭৭. কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ব্রাহ্মসমাজ
৭৮. ৭৮. মধ্য কলকাতায় ব্যারিস্টার আবদুল রসুল
৭৯. ৭৯. স্টিমার ছাড়ল খুলনা থেকে বরিশালের দিকে
৮০. ৮০. সাপ্তাহিক ‘যুগান্তর’ পত্রিকা
৮১. ৮১. যাত্রীবাহী স্টিমারটিতে প্রচণ্ড ভিড়
৮২. ৮২. টাঙ্গা ছাড়ল সাড়ে দশটায়
৮৩. ৮৪. নাটক সদ্য শেষ হয়েছে
৮৪. ৮৩. ব্রহ্মপুত্র মহাভাগে শান্তনু কুলনন্দন
৮৫. ৮৫. কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি
৮৬. ৮৬. কবি যদি হতেন নিছক কল্পনা-বিলাসী
৮৭. ৮৭. সন্ধের সময় একখানি বই
৮৮. ৮৮. লেখকের কথা

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন