বাউলকবি রশিদ উদ্দিন এবং তার শিষ্যরা

জালাল খাঁ (১৮৯৪-১৯৭২)

জালাল উদ্দীন খাঁ ১৮৯৪ সালের ২৫ এপ্রিল নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার আসদহাটি গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম : সদরুদ্দীন খা। তাঁর গানের বই ‘জালাল-গীতিকা’ পঞ্চম খণ্ড পর্যন্ত প্রকাশিত। তাঁর গানের সংখ্যা হাজারের অধিক। তত্ত্বদর্শনে তার জ্ঞান ছিল অগাধ। থাকতে ক্ষুধা প্রেমের সুধা পান করে যা পাগল মন/ দিন গেলে যে হবে না আর ভাটা যদি লয় যৌবন। মানুষ থুইয়া খোদা ভজ এই মন্ত্রণা কে দিয়েছে’, ‘দরবেশ তুমি আল্লাহ খোঁজ/ ঋষি খোঁজ ভগবান’। ভাব বিনে কি ভাবের মানুষ ধরতে পারা যায়, অচেনা এক ভাবের পাখি হৃদয়পথে উড়ছে সদায়সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান। ১৯৭২ সালে ৩১ জুলাই তিনি সিংহের গাঁও নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

উকিল মুন্সি (১৮৮৫-১৯৭৮)

উকিল মুন্সি ১৮৮৫ সালে ১১ জুন নেত্রকোণা জেলার । খালিয়াজুরি উপজেলায় নূরপুর বোয়ালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃত নাম আব্দুল হক আকন্দ।
তিনি গ্রাম্য মসজিদে ইমামতি এবং মক্তবে শিক্ষকতাও করেন। তিনি শরিয়ত পন্থি বাউল ছিলেন। তাঁর দরদী কণ্ঠে বিচ্ছেদ-বিরহের গান শুনে উপস্থিত শ্রোতারা অশ্রু সংবরন করতে পারতো না। ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে কর তোমার মনে যাহা লয়। আষাঢ় মাসের ভাসা পানি রে, পুবালী বাতাসে/ বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসেরে। বন্ধু আমার নিঃদুনিয়ার ধন-রে/ তারে দেখলে জুড়ায় জীবন-আমার, না দেখলে মরণ রে’ ‘তুমি ধর গুরুর সঙ্গ, তোমার পাপে ভরা অঙ্গ। ভিতর বাহির আগে কর পরিষ্কার’সহ অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে।
তার ছেলে সাত্তার মুন্সিও একজন প্রথিতযশা বাউলশিল্পী ছিলেন। ১৯৭৮ সালে ছেলে বাউল সাত্তারের মৃত্যুর কিছুদিন পরে তিনি ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

শাহ আব্দুল করিম (১৯১৬-২০০৯)

শাহ আব্দুল করিম ১৯১৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি মাসে সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার ধলআশ্রম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : ইব্রাহিম আলী এবং মাতার নাম নাইওরজান। তাঁর অসংখ্য গান মানুষের মুখে মুখে। তাঁর প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে ‘আফতাব সংগীত’ (১৯৪৮), ‘গণ সংগীত’ (১৯৫৭), ‘কালনীর ঢেউ’ (১৯৮১), ধলমেলা’ (১৯৯০), ‘ভাটির চিঠি (১৯৯৮), কালনীর কূলে’ (২০০১) ও শাহ আব্দুল করিমের রচনাসমগ্র’ (২০০৯) বাউলদের মধ্যে শাহ আব্দুল করিম তাঁর জীবদ্দশায় যেমন মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন তেমনি অনেক সম্মাননা পেয়েছেন।
তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হল রাগীব রাবেয়া সাহিত্য পদক (২০০০), একুশে পদক (২০০১), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা (২০০৪), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা (২০০৮)। ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে। আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। গাড়ি চলে না চলে না চলেনা রে’। কোন মেস্তরি নাও বানাইছে’। বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে’ মাটিরও পিঞ্জারই সোনার ময়না রে’সহ অসংখ্য গান এখনও সবার মুখে মুখে। ২০০৯ সালে ১২ সেপ্টেম্বর
শনিবার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সাধক চাঁন মিয়া (১৯১৮-১৯৯২)

সাধক চাঁন মিয়ার আসল নাম চান্দেজ্জামান আকন্দ চাঁন মিয়া। তিনি ১৯১৮ সালে নেত্রকোণা জেলার খাটপুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : মিয়া হোসেন আকন্দ।
তিনি ১৫ বছর বয়স থেকে গান লেখা এবং সুরারোপ করা শুরু করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা আনুমানিক ৫০০-৬০০ মত হতে পারে। বন্ধুর মুখের হাসিরে কত ভালোবাসিরে। ইসলামের সদাই লইয়ারে নবীজি আমার/ ভবের হাটে এসেছিলেন হইয়া দোকানদার রে’। কই গেলি পিরীতি শিখাইয়ারে বন্ধু বিনোদিয়া। নৌকা ডুবলে, ডুবলে। ভাসানি বড় দায়। তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত গানের বই ‘সুরেশ্বরী চান গীতিকা’ এবং পরে ‘আজাদ চান গীতিকা’ প্রকাশিত হয়। ১৩৯৯ বাংলা ২৮ শ্রাবণ
১৯৯২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।

আলী হোসেন সরকার (১৯২৩-১৯৯২)

আলী হোসেন সরকার ১৯২২ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর মদন উপজেলার ঝাউলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছোট বেলা থেকে তাঁর জারিগানের প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল। অল-ইন্ডিয়া আর্ট কনফারেন্স সংগীত প্রতিযোগিতায় জারিগানে গোল্ডমেডেল পান।
জারিগানে সর্বমোট ১৪০টি পুরস্কার লাভ করেন। জারি, সারি, বাউল, মুর্শিদী সবই তিনি গাইতেন। হাবিবে খোদা তুমি/ সারোয়ারে আলম/ তোমারই খাতিরে পয়দা/ এই চৌদ্দ ভুবন’। ঢাকা ও সিলেট বেতারের তিনি নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।
১৯৯৪ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর ৭২ বছর বয়সে তিনি পরলোক গমন করেন।

মিরাজ আলী (১৮৯৭-১৯৯৭)

মিরাজ আলী ১৮৯৭ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার আটপাড়া উপজেলার অভয়পাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমজাদ আলী এবং মাতার নাম আলফতের মা। তাঁর কণ্ঠস্বর খুবই শ্রুতিমধুর ছিল। তাঁর রচিত গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘সোনা বন্ধুরে/ অপরাধী হইলেও আমি তোর/ আমি তোর পিরিতের মরা/ দেখলে না এক নজর। বানাইয়া মাটির ঘর, কত জিনিস তার ভিতর/ ভরিয়া রেখেছে থরে থর’। মায়াজালে বন্দি হইয়া, চিনলেনা তুমি তোমার। তাঁর গান বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী গেয়েও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ১৯৯৭ সালে এই বরেণ্য বাউলশিল্পী না-ফেরার দেশে চলে যান।

তৈয়ব আলী (১৮৯৩-১৯৭৮)

তৈয়ব আলী ১৮৯৩ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোণা জেলার কাওয়ালিকোণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : রুশমত মুন্সি। তাঁর বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম। ৮/৯ বছর বয়সে তৈয়ব আলী টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্ধ হওয়ার পর ঘরে বসে বসে তৈয়ব আলী করুণ সুরে গজল গাইতেন। রশিদ উদ্দিন তাকে গানের তালিম দিয়ে যোগ্য ছাত্র হিসাবে তৈরি করেন। বাউলগানে তিনি খুব সুনাম অর্জন করেছিলেন। ১৯৭৮ সালে ৯ মার্চ মোবারকপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন।

ইদ্রিস আলী (১৯১৪-২০০৫)

ইদ্রিস আলী ১৯১৩ সালে ২৪ নভেম্বর মাসে নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলা উপজেলার পূর্বধলা সদরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : কালু মিয়া। ১৯২৭ সালে পূর্বধলা থানার ছেছাউড়া গ্রামের রহিম মিয়ার বাড়ির সামনে সপ্তাহব্যাপী একটি মালজোড়া গানের আসর হয়েছিল। এই আসরে নেত্রকোণা জেলার সকল বাউলশিল্পী অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই আসরে তরুণ বাউলকবি ইদ্রিস আলী একতারা বাজিয়ে একটি গান পরিবেশনা করেন যা শুনে রশিদ উদ্দিন সহ সকলে তার প্রসংশা করেন। মালজোড়া গানে তার বিচক্ষণতা সবাইকে মুগ্ধ করতো। তাঁর জীবদ্দশায় একটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৫ সালে ২৬ ডিসেম্বর তিনি ৯২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

আব্দুল মজিদ তালুকদার (১৮৯৮-১৯৮৮)

বাউলকবি আব্দুল মজিদ তালুকদার ১৮৯৮ সালে। নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার ইটাউতা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : আমছর আলী তালুকদার এবং মাতার নাম মঘলের মা। নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করে তিনি মালজোড়া গানের প্রতি আসক্ত হয়ে যান। তিনি বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। ১৯৪২ সালে অল-ইন্ডিয়া রেডিওতে তালিকাভুক্ত হয়ে গান গেয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে মজিদ সংগীত’, পূর্ববঙ্গ সংগীত, ইসলামতত্ত্ব, মিলনগীতি, রাহী, মোমেনশাহীর জারি গান, গ্রামের পথে, শেষ নবী আরবে, রসের বাইদানি। তিনি ১৯৮৮ সালে ইন্তেকাল করেন।

খেলু মিয়া (১৯২১-১৯৬৩)

আব্দুল জব্বার তালুকদার ওরফে খেলু মিয়া ১৯২১ সালে নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার পাবই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : ইব্রাহিম তালুকদার।
খেলু মিয়ার স্বরাজের সুর এবং নিজের মধুর কণ্ঠ একাকার হয়ে যেতো গানের আসরে। মালজোড়া গানে তার সুনাম চারদিকে প্রসারিত হতে থাকে। ধরাট বা প্রশ্নের দিক দিয়ে তিনি খুবই বিচক্ষণ ছিলেন। তাঁর মৃত্যু ছিল খুবই দুঃখজনক।
গান ভালোবেসে যিনি সারাটা জীবন কাটিয়েছেন ১৯৬৩ সালে ২২ জানুয়ারিতে কলমাকান্দা উপজেলার বিশরপাশা বাজারে এক মালজোড়া বাউলগানের আসরে রক্তবমি করে মঞ্চেই মারা যান।

জমশেদ উদ্দিন (১৯০৩-১৯৭১)

বাউল জমশেদ উদ্দিন নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার রামশিদ গ্রামে ১৯০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজী সিদ্দিক বেপারী। বাউলগানের একজন জনপ্রিয় গায়ক ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৮ দিন পূর্বে ১৯৭১ সালে ২৮ নভেম্বর রামসিদ গ্রামে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আবেদ আলী (১৯২৩-১৯৯৮)

বাউল আবেদ আলী ১৯২৩ সালের ৬ জানুয়ারি নেত্রকোণা জেলার বৈশ্যপাট্টা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আত্মতত্ত্ব সন্ধানী বাউল হিসাবে তিনি সমাধিক পরিচিত। তার বিচ্ছেদি গান বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষের খুবই প্রিয়। ‘বন্ধুর বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে প্রেমের নদী/ পাখা নাই যে উড়িয়া যাইতাম রে ও হে দারুন বিধি।’ ‘আমারে বিদেশে পাঠাইয়া গিয়াছ ভুলিয়া/ পাই না খুঁজিয়া দিদার।’ আবেদ আলীর অসংখ্য ছাত্রদের মধ্যে বর্তমানে জনপ্রিয় বাউলশিল্পী সালাম সরকার এবং পুত্র লিটন সরকার অন্যতম। ২৩ এপ্রিল ১৯৯৮ সালে এই মহান বাউলসাধক দেহ ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র

১. নেত্রকোণার বাউলগীতি, গোলাম এরশাদুর রহমান, বাংলা একাডেমি,
প্রকাশকাল ১৯৯৪।

২. বাউল সাধক উস্তাদ রশিদ উদ্দিন ও তার গান, আবু দায়েন, সমাচার,
বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০১৩।

৩. রশিদ গীতিকা, অধ্যক্ষ মো: গোলাম মোস্তফা, পরিবেশক বাংলাদেশ
বইঘর, বাংলাবাজার, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০১৩।

৪. নেত্রকোণার লোকসাহিত্য ভাণ্ডার ও মৈমনসিংহ গীতিকা, এমদাদ খান,
প্রকাশক পলল প্রকাশনী, প্রকাশকাল ২০১৩।

অধ্যায় ৩ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন