জালাল উদ্দীন খাঁর গান

সুমনকুমার দাশ

জালাল উদ্দীন খাঁর গান

অর্থ ছাড়া ফকিরি কই, তালাশিয়ে দেখো রে মন
দুনিয়ার দরবেশি যত, টাকা-পয়সাই মূল কারণ ॥
ওই যে দেখো লম্বা দাড়ি, মোল্লা কিম্বা হাফেজ-কারী যা
র তার ভাবে ফতোয়া জারি, নিজেরা ঠিক নাই কখন ॥
কথা কয় না কায়দা ছাড়া, পাগড়ি মাথে মার্কা মারা
ফন্দি খুঁজে বেড়ায় তারা কিসে হবে উপার্জন ॥
তবে হয়তো বলতে পারি, ওই যে বেটা জটাধারী
পুত্র-কন্যা ঘরবাড়ি, ছেড়ে ঘোরে কি কারণ;
দেখো কয়টা পয়সা দিয়া, নেয় কি না দেয় ফেলিয়া
পয়সার লোভ ছেড়ে দিয়া আছে বটে দুই একজন ॥
যাদের মুখে শব্দ নাই, ছেড়ে দিছে ভবের বড়াই
প্রেম সাগরে খেলছে লাই, পলক ছাড়া দুই নয়ন;
তারা করে একের আশা, জঙ্গলেতে করছে বাসা
সম্পর্ক নাই রতি-মাসা, সব দিয়েছে বিসর্জন।।

আগে জানলে না তুই দেহের খবর কোনখানে কোন বস্তু আছে
অমূল্য ধন চিনলে না মন মানব জীবন বিফলে গিয়াছে ॥
বিন্দু হতে এই সুন্দর দেহ যে করল গঠন
কত দূরে আছেন তিনি নাই রে নিরূপণ
তার অন্বেষণ করে সাধন করলেই পরম চিনবে পাছে ॥
চৌষট্টি জেলা আছে ওই মন রাজার রাজ্যেতে
দশজন তাহার কর্মচারী পঞ্চ বিভাগেতে
আদায় তহশিল নিজের হাতে মালখানায় সব ভরিতেছে ॥
পরব্রহ্ম হয় রে যিনি ব্যাপিয়া সংসার
তার উপরে না আছে আর কারো অধিকার
জ্ঞান সমুদ্রের নাই পারাপার কাছে গিয়া যে দেখেছে ॥
চন্দ্র-সূর্য উপরে দিয়া ঘুরছে নিরন্তর
জালালে কয় নদনদী আর পর্বত-সাগর
ভিতরে এক চুম্বক পাথর হজম করে সব নিতেছে ॥

আচানক এক পাখি এসে বসে গাছে
ডিম পাড়িয়ে উড়ে গেল ॥
দেখিতে মোহন কায়া, মধুর মায়া
অন্ধকার করেছে আলো—
জানি না কি শক্তি ধরে, এই ব্রহ্ম-অণ্ডে ঘুরে
কেউ না তারে চিনতে পারল ॥
বেঁধে বাসা মধ্যস্থলে, কি কৌশলে
হাওয়াতে মিশিয়ে গেল—
কেউ বলে সে উজ্জ্বল-সাদা লাল জরদা
কেউ বলে সে নিরেট কালো ॥
ডিম্বেতে পাখির ছায়, ওই শোনা যায়
মধুর শব্দ করছে ভালো—
ব্রহ্ম-অণ্ড ফুটবে যেদিন, উড়বে সে দিন
কেমনে তারে দেখবে বলো ॥
যে-জন গিয়ে গাছের তলে, খুব নিরলে
এক ধ্যানেতে চেয়ে রইল—
যাবার কালে দেখছে তারে,
এ সংসারে জালাল উদ্দীন কানেই শুনল ॥

আছে রে তার নামে মধু, খেয়ে সাধু
পার হয়ে যায় অকূল জলে
যে-নাম হৃদয়পুরে, হাওয়ায় ঘুরে
আপনি আপন কথা বলে ॥
সেই নাম সঞ্জীবনী সুধা, রয় না ক্ষুধা
এক দম সোদা না হইলে—
আপনি বাঁশি বাজিল যার, টুটল আঁধার
ভয় কি তাহার ভূমণ্ডলে?
আঁধার গেলে চন্দ্র ওঠে, ফুলটি ফোটে
সাধুজনের হৃদকমলে—
মানুষেতে লইলে স্মরণ, জন্ম-মরণ
জরা ব্যাধি সব দূরে চলে।।
অন্তরে যার পরশমণি, অষ্ট ফণি
নিশ্বাসেতে আগুন জ্বলে—
জালালে কয় দেহের ভিতর প্রেম-সরোবর
চিনে না বেহুঁশের দলে।।

আজ আমার কিসের আপদ কিসের বিপদ
ভাবনা আবার কিসের তরে ॥
দুনিয়ার এই ধাঁধায় পড়ে মোহের ঘোরে
ঘুরছি কত জনম ভরে—
করেছি কতই কর্ম ধর্মাধর্ম হিসাব নিকাশ কেবা করে ॥
শাস্ত্রে কয় আছে নিকাশ হয় না বিশ্বাস
কর্মফলেই সঙ্গে ঘোরে—
ভাবনা কি আছে রে আর তুমি যাহার বিরাজ করো হৃদয়পুরে ॥
এবার আমি ঠিক বুঝেছি ঠিক ধরেছি—
তোর খেলা কেউ বুঝতে নারে—
সকলই যে তোমার বটে ভবের হাটে দোষী আমি অহংকারে।।
এই ভবে আমার আমার করব না আর
তোমাতেই সব দিছি ছেড়ে—
দেখা দেও স্বরূপ নিয়া সরল হইয়া জালালকে আজ স্মরণ করে।।

আত্মসাধন করলে না মন বসে আছো কার আশে
বনে যাওয়ার নাই প্রয়োজন, চিনতে পারলে গৃহবাসে ॥
চোখের জলে প্রাণের টান, শুদ্ধজ্ঞানে স্বরূপ ধ্যান
করলে পাবে মোক্ষ সন্ধান, প্রাণায়াম কি রুদ্ধশ্বাসে ॥
পরম যুক্ত জীব সর্বক্ষণ, ঘৃত বিলীনে দুগ্ধে যেমন
দই পেতে তার করলে মন্থন, ঘোলের উপর মাখন ভাসে ॥
যে অখণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ডময়, দেহাশ্রিতে খণ্ড তিনিই হয়
নিরাকার আকারে রয়, আলোক যখন আঁধার নাশে ॥
খণ্ডের যে জন লয় পরিচয়, এক দেখে সে জগৎময়
জালাল উদ্দীন ভাবিয়া কয়, কান টানিলেই মাথা আসে ॥

আঁধারের মাঝে ঘুরিয়ে বেড়াই, নেও না মোরে তালাশিয়ে,
নুরানি জ্যোতি পন্থ দেখায়ে নেও না একবার আসিয়ে ॥
রহমত কুদরতে, পারি কোনও মতে, বুঝিতে কিছু মেহেরবানি
না মিলে দিদার খুঁজিলে সংসার
লা-শরিক লান্তারানি;
রাখো মারো যা করো তুমি—
তোয়াক্কা দিয়েছি আমি,
আপন সিফতে, ইজম-জাতে
আগেই উঠেছ ফুটিয়ে।।
সেই ফোটা ধ্বনি জাগিছে আপনি, আগুন-মাটি-জল-পবনে
স্বর্ণ লতিকায় বিহঙ্গের গায়
মলয় হাওয়ায় গগনে;
নামটি লিখেছে অন্তহীন—
শানে-জাল্লো রব্বেল-আলমিন
আপন স্বভাবে জালাল উদ্দীন ভাবে
ওঠ না একবার হাসিয়ে ॥

আমার দিন কি গোঁসাই এমনি যাবে
মায়ার বন্ধন করে ছেদন, মনটাকে নেও তোমার ভাবে ॥
দুষ্টের দলটা হয় না বাধ্য, আর কি আছে আমার সাধ্য
তুমি আমার প্রাণারাধ্য, ভব-জ্বালা সব ঘোচাবে
কৃপা-বারি ছিটাইয়া, মধুর নামের বীজ লাগাইয়া
আপনা হাতে যত্ন নিয়া, এই মরুতে ফুল ফোটাবে ॥
বেলা হলো প্রায় অবসান, সুতায় ধরে মারবে এক টান
কাঁদিছে জালালের প্রাণ, দেহটাকে কীড়ায় খাবে! ॥

আমার ভাঙা নায়ের ভরসা কি আর
ধনীর জাহাজ যায় যে মারা না পেয়ে তার কূল-কিনার ॥
কাল মেঘ আকাশের গায়, সাজিয়াছে ওই দেখা যায়
জীবন রক্ষা ঘটিল দায়, কে করে জিজ্ঞাসা কার ॥
অগাধ জলধি-নীরে, বেয়ে তরি চলেছি ধীরে
কবে গিয়া লাগবে তীরে, নিশ্চয় নাহি আছে তার ॥
পার হইবে আশার আশে, এক তরঙ্গে সবেই ভাসে
কেউ কাঁদে কেউ বা হাসে, কর্মফলে যেমন যাহার ॥
জালালের জীর্ণ তরি, ভবসাগরে ঘোরাঘুরি
যদি তরিতে পার হতে নারি, অকূল জলে দিব সাঁতার ॥

১০

আমি-তুমি দুয়ের মাঝে ঘরে একজন থাকলেই হয়
দুজনাতে ঠেলাঠেলি গোল বাজে তাই সব সময়
ঘর আমার দুয়ার আমার আনাগোনা কেন তোমার
বিশ্রাম নাহি একটু যে আর এ যন্ত্রণা বিষময়,
তোমার কাছে আমি যাই না আর কখনও যেতে চাই না
তুমি একবার ঘর ছাড়ো, না দেখা দিতে কষ্ট হয় ॥
করতে হয় যা আমিই করি তুমি নও তার অংশীদারী
কথায় কেবল বাহাদুরি নিতে আছো সবসময়,
আমার কাজে হিসাব নিয়া আছো তুমি কি লাগিয়া
সদায় কেবল চোখ রাঙাইয়া ইশারাতে দেখাও ভয় ॥
ইষ্টজন হলে পরে কিছুদিন পরে পরে
সামনে এসে জিজ্ঞাস করে ভালোমন্দ কথা কয়,
জন্মের মতো যাও ছাড়িয়া আমি থাকি আমায় নিয়া
তা না হলে তুমিই থাকো আমারে করিয়া লয় ॥

১১

আরশিতে যা দেখবে তুমি পাবে তারে সাধনায়
পরকে সাধন করলে পরে পাবে রে সেই আপনায় ॥
দেহ-নৌকায় তিনটি গুণ টানিতেছে তিনজনায়
পাছায় বসা মানুষ একজন, হালের বৈঠা সেই ঘুরায় ॥
বাহিরেতে লিঙ্গ নাভি, মধ্যে উদয় শশী-রবি
চন্দ্র-সূর্য একই হবি যাবি যখন উপর তলায় ॥
ঊর্ধ্ব দিকে টানে যারা সহজেতে পায় তারা
মন তো পবনের ঘোড়া প্যাঁচ লেগেছে আউলা সুতায় ॥
চেতন মানুষের হয়ে চেলা শিক্ষা করো দমের খেলা
পঞ্চমে বাজাও বেহালা দিবানিশি সপ্তম খানায় ॥

১২

উল্টা কথা ভাও করিয়া, দিয়ে যাও হে গুরুধন,
জন্মের আগে খাইতে গেলাম ভূতের বাড়ির নিমন্ত্রণ ॥
যারে দিয়া দুনিয়া আলো, সে কেন গো দেখতে
কাল সাপের মণি ব্যাঙে নিল, ময়ূর পালায় কী কারণ?
পিতার যেদিন মৃত্যু হলো, সেই দিন মা যুবতী হলো
আগেই ছেলে জন্ম নিলো, পাই না কথার নিরূপণ ॥
ভাইয়ের দেখা হইল পথে, ভগ্নী গেল উঠে রয়ে
অমাবস্যা পূর্ণিমা গতে, লাগে কোথায় চন্দ্রগ্রহণ?
শিয়ালের শিং সাপের পাও, আমাকে নিয়ে দেখাও
জালালে কয় ঠিক বলে যাও, উল্টা তত্ত্বের বিবরণ ॥

১৩

এই যে আমার সাধের পিঞ্জর শূন্য করে
মন-পাখি তুই যাইসনে উড়ে ॥
তুই রে সাধনের পাখি তোমায় ডাকি
মায়ার বাঁধন যাইস না ছিঁড়ে—
আনন্দে তুই থাক রে ও মন সুখের স্বপন
দেখতে থাকো ঘুমে পড়ে ॥
হইয়া কতই পেরেশানি আপন জানি
খাওয়াইলাম জনম ভরে—
সারা জীবন সুখে রইলে কথা কইলে
মোর পানে আর নাহি ফিরে ॥
একবার তুমি শান্ত হইয়া আমায় লইয়া
ভাসিলে না প্রেমসাগরে—
গেল না রে তোর ছটফটানি কই বা জানি
যাইতে ইচ্ছা রয় অন্তরে ॥

১৪

একদিন যেন হয় গো দেখা,
তুমি আমি দুজন ভিন্ন, ভালো নয় কেউ সঙ্গে থাকা ॥
খুলিয়ে হৃদয়ের দ্বার, দেখাইব ছবি তোমার
নিচে আবার তুই বঁধুয়ার সোনার জলে নামটি লেখা ॥
দেখলেই তখন বুঝবে পিয়া, কত না যতন করিয়া
তোমারই চাঁদ-মুখ চাহিয়া, কাঁদি কত বসে একা ।।
তব প্রেমের বালাই নিয়ে, জালালকে তোমারে দিয়ে
যাব আমি বিদায় হয়ে, নিয়ে মাত্র স্মৃতি-রেখা ॥

১৫

এপার আমি ওপার তুমি কিসে দিব পাড়ি তার
ঢেউ দেখিয়া রইলাম চাইয়া অন্তহীন দরিয়ার।।
হাওয়ার চোটে উতাল পানি, ছুটে কোথা যায় না-জানি
কাঁপছে ভয়ে পরানখানি কে হবে মোর কর্ণধার ॥
কতদিন আর বসে বসে, মরব আমি হা-হুতাশে
ভাঙা তরি কিনারে ঘেঁষে বেয়ে দেখব ভাটি তার ॥
যাদের নায়ের মাঝি পাকা, তাদের নাহি লাগে ধোঁকা
চলছে কত জাহাজ নৌকা উঠছে পড়ছে বৈঠা দাঁড় ॥
জালাল উদ্দীন নিদান কালে, ডাকছে বন্ধু এসো বলে
প্রাণ যাবে মোর তা না হলে কলঙ্ক থাকিবে তোমার ॥

১৬

এমন বিদেশ-বিপাকে আর কেউ কোনোদিন এসো না ॥
কেউ কোনোদিন এসো না আর, ঠকের হাতে পইড়ো না,
চোরের সাক্ষী চোরে দিবে, তোর কথা কেউ কইতো না ॥
এই দেশেরই লোকের সনে দোস্তি রাখা চলে না
অঙ্গের মাংস কেটে দিলেও আপন বলে বোঝে না ॥
ভুখ-পিয়াসে কার বাড়িতে অতিথেরো নাই খানা
পোলা-পানে বস্ত্র টানে, পায় ধরিলেও ছাড়ে না ॥
ওই না দেশের এমনি ধারা, চোখ থাকিলেও হয় কানা
জালাল উদ্দীন দিশেহারা, পথ খুয়াইয়া আনাগোনা।।

১৭

ও মন, গহিন গাঙের পাড়ে
বৎসরেতে ছত্রিশ দিন, এসে প্রভু খেলা করে।।
ছুটিলে গঙ্গা-যমুনা, বাঁধতে কারো শক্তি হয় না
জলের সঙ্গে ভাসে ফেনা, আটাশ দিনের পরে;
মনোরঙ্গে প্রেম-তরঙ্গে ডুবতে যে জন পারে—
রঙ মাখিয়া সঙ সাজিয়া ভাসে গিয়া পরপারে ॥
যখন নদীর জোয়ার ডাকে, জলের নিচে মানুষ থাকে
সাঁতার খেলে ফাঁকে ফাঁকে, সুধা তালাশ করে;
লুকি দিয়া থাকে মানুষ লোহিত সাগরে-
পাইয়া সে ধন পরশ-রতন, চুম্বকে আহার করে ॥
জালালে কয় মন রে কানা, ছেড়ে দিয়ে টালবাহানা
খুঁজে লও হীরার দানা, মণি-মুক্তা কতই ঝরে;
বাহ্যরূপে ভুলে রইলে, ভাবনা নাই অন্তরে—
খেলা ভাঙলে নয়ন মেলে, দেখবি আটকা অন্ধকারে ॥

১৮

ও মন চিনো যেয়ে তারে-
স্থূল দেহেতে বিরাজ করে সূক্ষ্ম বস্তু শূন্যাকারে
যারে মানুষ বলে, সে আছে উল্টা কলে
সর্বত্রই বিরাজিত চৌদ্দ ভুবন ছেড়ে;
জগতের বাহিরে থাকে স্রষ্টা বলে তারে-
আজ্ঞা-চক্রের ঊর্ধ্বে থেকে মহাসিন্ধুর বিন্দু ঝরে ॥
সেই বিন্দু বাষ্প হইয়া, অহম ভাবে যায় মিশিয়া
জীবের জীবন নাম ধরিয়া হংস-ধ্বনি করে;
সাধনবলে ‘সোহহং’ শব্দ যে জাগাইতে পারে—
ইচ্ছাতে হয় কর্ম সিদ্ধি, শমনের কি ধার ধারে?
স্বরূপে অরূপের বিন্দু, ভরা আছে কাম-সিন্ধু
মণিপুরে বিরাজিত, মহাজনে কয় তারে;
বায়ুরূপে আসা-যাওয়া স্থূল দেহের ভিতরে—
তার কি কখন ধ্বংস আছে? ছায়া-মূরত গগন ভরে ॥
জালালের পাগল মন, কি জানি কিসের কারণ
ভাবিতেছে জন্ম-মরণ কেমনে যাবে দূরে;
জলবিন্দু যদি গিয়া মিশে যায় সাগরে
মহাসাগর নাম ধরিবে ভাবনা কি আর আছে রে ॥

১৯

ও মন চেতন থাকতে গুরু ভজো, নিকটে নিদান রে ॥
উপরে আসমান, নিচে শ্রীকলার বাজার
আসা-যাওয়া করে জীব, একুশ হাজার ছয় শো বার,
বিরাজ করে হংস-হংসী নিত্যই গুপ্ত বৃন্দাবনে রে
কুকথায় পঞ্চমুখ ত্রিশূল লয়ে করে
কণ্ঠমূলে দাঁড়াইলে তবে সে জীব মরে
চিনে যারা সাধু তারা, জ্বরা-ব্যাধি গেছে দূরে রে ॥
দেহেতে উদয় চন্দ্ৰ, চন্দ্রের সুধা ক্ষীর
চার চন্দ্র সাধনা করলে সোনা হয় শরীর
ভাবছে বসে দিবানিশি, যোগী ঋষি যোগ ধ্যানে রে ॥

২০

ও মন তালাশ করো তারে-
যার তরে ভজনা করো, থাকিতে এই সংসারে ॥
করিলে নমাজ বন্দেগি, সর্ব অঙ্গ হবে নেকি
বিনয়ে ডাকিছে খাকি, আয় রে আমার ঘরে;
খাক যাবে খাক মিশে, বাদ যাইবে উড়ে—
আতসে আর জ্বালাইবে রুহু মিশবে শূন্যাকারে ।।
কেহ যদি হজ করিবা, দেখবে আপন ঘরে কাবা
অতিশয় মনোলোভা দীল-দরিয়ার পারে;
ঘরের ভিতর ছয় মদিনা, কেন যাও মন দূরে—
চোখ মুদিয়া চেয়ে দেখো, ফেরেশতায় সেজদা করে ॥
জালালে কয় শুভ-বাণী, আবে হায়াতের পানি
দেহের মধ্যে আছে জানি, চিনতে কয়জন পারে;
‘সারাবন্-তহুরা’ খাইলে যাবে অমরপুরে—
একটি রোজা একবার নমাজ করিলেই আদমের সারে ॥

২১

কত আশা ছিল রে বন্ধু কত আশা ছিল
আগে না জানিয়ে পাছে না বুঝিয়ে, জীবন ভরিয়ে কাঁদিতে হইল ॥
যৌবন সময়ে কত সহ্য করে, অপরের ঘরেতে দিন গেল
আসিবে বলে আশাতে রাখিলে, নিরাশ করিলে হইত ভালো ॥
গেল দিনমণি আসিল রজনী, তবে আগমনি কতই বাজিল
কত যে বসন্ত গেল নাহি অন্ত, প্ৰাণকান্ত বিদেশেই রইল ॥
জালাল উদ্দীন বলে মরণকালে, দিও হাতে তুলে পথের আলো
মুখ পানে চাহিও হাসিয়া কহিও, হৃদয়ে বসিও কথা ফুরাইল ॥

২২

করো পরশনে যেমন বেজে ওঠে তার,
মম হৃদি-যন্ত্র বাজে তেমনি পরশে তোমার ।।
ছুটিছে মলয় গাইছে কোকিল, স্থাবর, জঙ্গম অনল অনিল
একই তালে ধরিয়ে জ্বিল, আকাশ পাতাল পিছনে আর ॥
সে-সুরে এই ভুবন ছাওয়া, সে রাগিণী হয় না গাওয়া
সার হয়েছে তরি বাওয়া, অকূলে না পেয়ে কিনার ।।
এক চাবিতে জন্মের মতো, ঘুরছে ঘড়ির কাঁটা যত
গোপন থাকে চোরের মতো, সদায় দিতেছে ঝঙ্কার ॥
কখন কাঁদি আবার হাসি, যতই ডুবি ততই ভাসি
জানতে গেলেই গলায় ফাঁসি, এ তোমার ভুল নয় অবিচার ॥
ভেবে কয় জালাল উদ্দীন, এমন দিন গিয়েছে একদিন
আছো কি নাই ভাবতে গিয়ে, করতাম সোজা অস্বীকার ॥

২৩

কাজল বরণ রূপের কন্যা, দুনিয়া তোর পাছে
তোমার মতো এমন সুন্দর, আর নি কেহ আছে রে—
কাজল বরণ রূপের কন্যা রে ॥
আসমানে তোর ছায়া রে কন্যা জমিনে তোর বাড়ি
রূপ লইয়া তোর চান-সুরুজে, লাগছে কাড়াকাড়ি রে ॥
মেঘের বেলায় সিনান্ করো, রৌদ্রে শুকাও কেশ
বিজলি তোর মুখের হাসি, চমকে ওঠে দেশ রে ॥
গুণেতে অসীম তুমি শক্তিতে নাই পার
গাছ পাথরে দিছে তোমার দেহের অলঙ্কার রে ॥
এই দুনিয়ার সবেই তোমায় বিয়ে করতে চায়
সোনার থালায় অন্ন থুইয়া গাছের পাতা খায় রে ॥
কথার বেলায় সুন্দর তুমি দেখতে গেলেই ভুল
জালাল তোরে বিয়ে করতে হয়েছে ব্যাকুল রে ॥

২৪

কামিনী ফুল ফুটিয়াছে
মধু খেতে লোভ করিয়া যাইও না কেউ ফুলের কাছে ॥
রূপে তাহার মুগ্ধ হয়ে কত জন তার কাছে গিয়ে
সর্বস্ব ধন হারাইয়ে পথের কাঙাল সাজিয়াছে ॥
রঙ দেখিলে সেই ফুলের, মন গলে যায় সাধুজনের
দোষ দেখি ওই কপালের, কাঁদিয়ে হয় পাছে পাছে ॥
মধু পানে হইলে মত্ত, হারায়ে যায় পুরুষত্ব
যে জানে গোপন তত্ত্ব, তার কাছে সে হার মেনেছে ॥
মধু নয় সে সুধাবিন্দু, জালালে কয় প্রেম-সিন্ধু
কি মুসলমান কিবা হিন্দু, নিত্য খাইলে মরা বাঁচে ॥

২৫

কার কাছে বলিব গো, এসব কথা বুঝিতে
সারা জীবন গেল আমার খুঁজিতে খুঁজিতে গো ॥
আসমানেতে বীজ বুনিয়া, চাষ করে খায় লোকে
স্ত্রীর পেটে স্বামীর জন্ম, দুধ খাইব কোন্ মুখে গো ॥
দাদা রইল দিদির পেটে, খুড়ায় কথা কয়
সেই সময়ে সন্তানের বয়স, ছয়টি বৎসর হয় গো ॥
এক গাছেতে ফলেতে জন্ম, অন্যেতে ফুল ধরে
এক জীবের মার্গে দিয়া, অন্যে আহার করে গো ॥
চিনি হইতে চিরতা মিষ্টি খাইতে যদি জানে
জালালে কয় ভাবের কথা, বুঝিও সন্ধানে গো ॥

২৬

কী দিব যে তার তুলনা, এমন সুন্দর কেবা আছে
জীবের জীবন হৃদয়-মোহন, সে বিনে কি পরাণ বাঁচে?
রূপসিনী বলছে সদাই, আমার মতো সুন্দরী নাই
তুচ্ছ নারী-রূপের বড়াই, সামান্য এক ফুলের কাছে ॥
অভিমানী ময়ূর পাখি, আপনার চরণ দেখি
পেখম ছেড়ে বলছে একি, আমার মস্ত দোষ রয়েছে ॥
চন্দ্রেতে কালিমা রেখা, সেও তো বটে ভাবছে একা
হয়তো চতুর নইলে বোকা, যে আমাকে গড়িয়েছে ॥
যার একবিন্দু রূপের ছটায়, ত্রিভুবনে সব দেখা যায়
পূর্ণ জ্যোতি কেমন বা হায়, বিচার করে দেখো না পাছে ॥
জালাল সেই রূপের নেশায়, সে-সব পন্থা খুঁজে বেড়ায়
কেউ যদি তা জানিতে পায়, পাগল বলে উঠবে নেচে ॥

২৭

কী সুরত বানাইলে খোদা রূপ মিশায়ে আপনার,
এই সুরত দোজখে যাবে, যে বলে সে গোনাগার ॥
মানব-সুরতের মাঝে, তুমিই আছো তোমার কাজে,
আদম বানাইলে কি বনলে তুমি, লীলা বোঝা হলো ভার ॥
মানব-দেহেতে খোদা, দম থাকতে হা হবে জুদা,
কেবা আদম কেবা খোদা, কে করিবে কার বিচার?
দেখিলাম দুনিয়া ঘুরে, দুই সুরত এক মিল না পড়ে,
লক্ষ-কোটি আকার ধরে, সাজিলে তুই নিরাকার।।
এত রূপ যে ধরতে পারে, তোমরা কী বলো গো তারে
হয় কি না-হয় এই আকারে, বেহদ্ রূপে আপনার ॥
যে ডুবছে ওই রূপের শানে, কালির লেখা আর কি মানে?
জালাল উদ্দীন এ-জীবনে, সার বুঝেছে এক-আকার ॥

২৮

কেন হয় না তারে চিনা—
আদমের কালেবের মাঝে এলাহির বারামখানা ॥
যদি মন তুই চিনবে তারে, বৈদিক বিষয় দেও গে ছেড়ে
ভাব-ভক্তি হৃদয়ে রেখে, ধ্যানে করো কল্পনা ॥
অধরাকে ধরতে গেলে আগে চিন্‌ আপনা-
দমের কোঠায় চাবি দিয়া ‘হু-হু’ শব্দ করো জপনা ॥
‘কুলুবেল-মোমিনের’ কাছে কলবেতে চাপা আছে
দীলের ভিতর পর্দা আছে সফেদ রঙ নমুনা;
দুই পাশেতে আল্লা-রসুল কলিজাতে থানা-
দিবানিশি শব্দ করে, ঘুমাইলেও বারণ হয় না ॥
আছে বাজার শ্রীকলা, যত আল্লা তত আল্লা
লক্ষ সিফতে সাঁই, জাতি হয় একজনা;
আপনি আপন নামটি জপে আলেকসাঁই রাব্বানা-
লাহুতে থাকিয়া ওঠে, নাসুতে তার আনাগোনা ॥
বেহেশত দোজখের কাছে রাজা-প্রজা বসে আছে
বয়তুল্লা শরিফের নিচে মক্কা আর মদিনা;
‘ছেদ্রাতুল-মতাহা’ পুরী মগজে ঠিকানা—
জালালের যেতে আশা, বিধি জানে নিবে কিনা ॥

২৯

কোথা হতে এলে তুমি, কই যাবি রে মন
ঠিক ঠিকানা জানো কিনা, কোন দেশে তোর জন্ম ধারণ?
স্কুলে কারও নাই রে ভুল, প্রবর্তে হয় গণ্ডগোল
সাধক সিদ্ধি দুই সমতুল, করিলে সাধন-ভজন;
কোন রসে আছো মজিয়ে, গুরু গোঁসাই না ভজিয়ে
পিছের পানে দেখো না চেয়ে, ঘুরিতেছে কাল শমন ॥
ওই যে তোমার বসত বাড়ি, লাগছে ভূতের মারামারি
যেতে চাইলে রাজ্য ছাড়ি, মন-বেপারি করে বারণ ॥
কোথায় যাবে আঁধার রাতে, পড়ে থাকো আমার সাথে
ধরে নিব হাতে হাতে, ভাবনা-চিন্তার নাই কারণ ॥
আছে একটি চোরের দল, জানে তারা কতই কৌশল
সিঁধ কাটিয়া নিচ্ছে সকল, বাকি মাত্র প্রাণে মরণ ॥
নয় দরজায় কাঁটা দিয়া, রাখছে সব পথ বান্ধিয়া
ডাক দিবে যে বাহির হইয়া, এমন যোগাড় নাই কখন ॥
ষোল জন চৌকিদারে, পরম সুখে খায় সরকারে
ঘুমের ঘোরে বারেবারে দেখিতেছে এই স্বপন
পুষ্করিণী নিল চোরে, চান-সুরুজ পাতালে ঘোরে
জালালে কয় হৃদয়-পুরে কানাইলালের তিন আসন ॥

৩০

কোনখানে সেজদা করবে, জায়গা নাই আর দুনিয়ায়
শয়তান লইয়া সেজদা দিলে কবুল না হইবে দরগায় ॥
আদমকে করলে এতেকাদ, শয়তান হয়ে যাবে তফাত
থাকে যদি দ্বিলের সাধ, সেজদা দেও মানুষের পায়;
কালি কলম কাগজে, তারাও যখন মানুষ ভজে তবে
কেন মাঝে মাঝে, শরিয়তে আজ লাঠি ঘুরায় ॥
এই চৌদ্দ ভুবন জুড়িয়া, গেলো মকরুম সেজদা দিয়া
তুমি এখন কোথায় গিয়া শির ঝুঁকাবে হায় রে হায়?
দেখ্‌ না যে তোর কেতাব টেনে, আদমকে খোদা জেনে
মুরুম যখন নাহি মানে, লান্নতের তৌক তার গলায় ॥
থাকতে শয়তান পৃথিবীতে, যাবে না আর সেজদা দিতে
করলে একবার সরল চিতে, মুক্তি দিত আজ বিধাতায়;
সে কথা সব ভুলে গিয়ে, নমাজ পড়ো কই বসিয়ে
জালালে কয় বিচারিয়ে, বাকি রইলো মানুষের পায় ॥

৩১

কোন রূপে ভজিব আমি পাই না যে ঠিকানা তার
বিশ্ব জুড়ে আছো তুমি সাকারেতেই নিরাকার ।।
হিন্দুরা কয় শিব-দুর্গাদি সাকার রূপে নাই অবধি
মৎস্য-কুর্ম-বরাহাদি কতই রঙের অবতার ॥
ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষি যত অরূপ-রূপের বিশ্বাস গত
ধ্যান-ধারণায় অবিরত ভাসে জ্যোতি নাশে আঁধার ॥
লেখা দেখেই লোকে কয় কথার নাহি আছে নিৰ্ণয়
কল্পনাতে ভাব-বিপর্যয় ঠিকের ঘরে একটাই সার ॥
জালাল কহে ওরে মূর্খ মিছেই কেবল করলি তর্ক
সব রূপে সে মিশে গিয়ে নিজের রূপটি নাই রে আর ॥

৩২

গুরু কও সত্য বাণী
সমুদ্দুরের তলায় আগুন, পাহাড়েতে পানি গুরু—
গুরু গো ইন্দুরে বিড়াল খাইয়াছে গাইয়ে মারছে বাঘা
তিনদিন পরে শিয়ালের ভয়ে হাতির ছোটে হাগা গুরু—
গুরু গো আলমেরই সাথে হইল একটা বেটির বিয়া
মুরগিতে মেহমান খাইয়াছে চিথো পিঠা দিয়া গুরু—
গুরু গো শিকড় গেল আকাশেতে, জমিনে নামছে পাতা
ফল ধরে তার পলকেতে মধ্যস্থলে মাথা গুরু—
গুরু গো হাতির বিচা মাথায় গেল ইঁচার লাথি খাইয়া
ঘোড়ার ডিমে বাচ্চা ফোটে কোন বা দেশে গিয়া গুরু—

৩৩

গুরু তোমার আশা করে ভাসিলাম এ ভবসাগরে
কূল দেও কি অকূলে রাখো, প্রাণ সঁপেছি আজ তোমারে ॥
তের-নদী সপ্ত-সাগর, জলের উপর ভাসে লহর
মাঝখানে এক বালুচর, কাছে গেলে ডাকাইতে মারে ॥
ঘোর অন্ধকার সকল সময়, কূল কোথায় নাহি নিৰ্ণয়
ফিরে এসে কেহই না কয়, কোথায় গিয়ে কিবা করে ॥
দেখে যাও আজ বিশ্ববাসী, জানি না আর কবে আসি
পৃথিবীর ওই কান্না-হাসি মুক্ত করলাম এক্কেবারে।।
জালালাউদ্দীর ভাঙা নায়, আর একজন পার হতে চায়
সেই মানুষটি আছে কোথায়, ভাবুক বিনে জানে না রে ॥

৩৪

গুরু বিনে আপন কেবা আছে রে তোর সংসারে
পথের সাথী কেউ হবে না পড়বে যেদিন অন্ধকারে ॥
রাস্তাঘাটের নাই পরিচয় ভয় লাগে তাই সব সময়
ফিরে এসে কেহই না কয় কোথায় গিয়া কী করে
গুরু যে নাম দিচ্ছে কানে তারে লও সর্বস্ব জেনে
ভুল করো না অযতনে সুখে-দুঃখে জনম ভরে ॥
দিন থাকতে মন করলে হেলা ঠেকবে গিয়া শেষের বেলা
ভেঙে গেলে ভবের মেলা বুক ভাসাবে অশ্রুধারে ॥
যার কাছে মন ডোবে গিয়া তারেই রাখো ধ্যান
করিয়া দুকূলের সব কর্ম ক্রিয়া জালালে কয় যাবে সেরে ॥

৩৫

গোঁসাই তোমার করণ-কারণ, দেহের গঠন
অভাজনে কেমনে জানি।।
পাইর-মাডুল জুড়া তাড়া, খাম্বা গাড়া
কি দিয়ে তার দিছো ছানি-
কার লাগিয়ে ঘরে এসে, কোথায় বসে
বলছ কথা কানাকানি ।।
কখন থাকো কোন দেশেতে, কি বেশেতে
কোন ভাবে তোর কোন নিশানি
কেন তুমি ধরা দেও না, কাছে নেও না
জানি না তার নিগূঢ় মাইনি ।।
কেউ বলে আগুন আল্লা, মাটির ঢেলা
কেউ কয় আল্লা হাওয়া পানি—
চার চিজে দুনিয়া বান্ধা, লাগছে ধান্ধা
গেলো না মনের ছটফটানি ॥
কোন কোঠায় কিবা ধন, করছ গোপন
কোন দিন হবে বিকিকিনি—
জালালে কয় তোমার কাছে পাওনা আছে
তবু কি আজ হলেম ঋণী?

৩৬

ঘুম দিয়েছো রিপুর দেশে, মন-রঙ্গের বসতি
আসল কাজের উপায় কী ॥
দরিয়া পাড়ি দিতে হবে, সঙ্গে না কেউ যাবে
জোর করিয়া লইয়া যাবে, খাটবে না মিনতি
মাঝি-মাল্লা ঠিক করলে না, কে হবে রে কাণ্ডারি ॥
একটু চিন্তা নাই তোর মনে, এলে কি কারণে
লাভ হলো না কানাকড়া, আসলেই ডাকাতি
জালালে কয় আজ অবধি গেল না মোর পাগলামি ॥

৩৭

চিন্‌গে মানুষ ধরে,–
মানুষ দিয়া মানুষ বানাইয়া, সেই মানুষে খেলা করে ॥
কিসে দিব তার তুলনা, কায়া ভিন্ন প্রমাণ হয় না
পশু-পক্ষী জীব আদি, যত এ-সংসারে;
দুইটি ভাণ্ডের পানি দিয়া, অষ্ট জিনিস গড়ে—
তার ভিতরে নিজে গিয়ে, আত্ম রূপে বিরাজ করে ॥
মায়া সুতে জাল বুনিয়ে, প্রেমের ঘরে ভাব জাগায়ে
প্রাণেতে প্রাণ মিশাইয়ে, রহে জগত জুড়ে;
নব রঙ্গে ফুল ফুটিলে ভ্রমর আসে উড়ে—
ফুলের মধু দেখতে সাদা, আপনি খেয়ে উদর ভরে ॥
সমুজ নিয়ে দেখ হয়ে, চল ভেদ-বিচারে;
একটি পুরুষ নিজ ছুরতে, জগৎ মাঝে ঘোরে-
লক্ষ নারীর মন যুগাইয়া প্রেমের মরা আপনি মরে ॥

৩৮

জলের নিচে চাঁদ উঠেছে, ধরতে গেলে বাজে গোল
নদীর উপরতলা খুব চঞ্চলা, ভাবতে গেলে প্রাণ আকুল ॥
জোয়ারেতে ভাটির পানি, উজায় কেন নাহি জানি
আষাঢ় মাসে নওজোয়ানি, তরঙ্গে ভাঙে দু’কূল ॥
প্রেমিকের সাধনার ধন, না-চিনলে কে করে যতন
ভাসিয়ে যায় পরশ-রতন, হইয়া তৃণ সমতুল ।।
আকাশেতে গাছের শিকড়, পাতালে ফুলের ভিতর
মধুপানে মত্ত ভ্রমর, ডালে বসে নাচে বুলবুল ॥
নেশা খেয়ে আছো পড়ে, কাম-কামিনীর সঙ্গ ধরে
গুরুর নাম আশ্রয় করে, অন্ধ আঁখি ফোটায়ে তোল ॥
জালাল উদ্দীন দিশেহারা, হয় না চন্দ্র সাধন করা
মরিয়ে তিন যুগের মরা, কলিতে ফোটাবে ফুল ॥

৩৯

জাতি ধর্ম বলে কারে—
জাতে জাতে যার তার মতে, গেছে ধর্ম বিভাগ করে ॥
যে বলুক যেমন আমায়, ধর্ম হবে কার্যতায়
নিরাকার চৈতন্য প্রভু, ভেদ নাহি জাত বিচারে
সৃষ্টিকর্তা সবার একজন, সমান দৃষ্টি করে-
এক ভিন্ন দ্বিতীয় নাহি, নহে সে গণ্ডির ভিতরে
খণ্ড করে ভাবে যারা, কিছুতেই পাবে না তারা
মিছে কেবল শাস্ত্র পড়া, হিংসানলে পোড়ে
থাকলে আছে সবার কাছে, সব ধর্মের ভিতরে —
একেশ্বর সত্য কথা, আবোল-তাবোল দেও গে ছেড়ে
যেদিন তোমার এই নয়নে, দেখে শান্তি আসবে মনে
নারী-পুরুষ ছোটো-বড়ো সম জ্ঞান করে ॥
সে দিন তারাও দেখবে তোমায়, সমান ভক্তিভরে—
জালালে তাই প্রাণ খুলিয়ে, বিশ্ব-প্রাণের সাধন করে ॥

৪০

জীবন থাকতে সামনে পড়ে স্বরূপ ধরে
দেখা দিয়া যাও আমারে ॥
অখণ্ড সাঁই খণ্ড হইয়া আছো বইয়া
আমার এই যে হৃদয়পুরে—
নিদ্রাকালে স্বপ্নে আসো সামনে ভাসো
নিজেই তুমি ইচ্ছা করে
ডেকে আনবার সাধ্য তো নাই হে আলেক সাঁই
‘দেখা দেও মোর নয়ন ভরে’
তোমায় দেখে মরতে পারলে যাব চলে
অমরার সেই অমরপুরে
কেঁদে কহে জালাল উদ্দীন আর কত দিন
থাকব আমি আশার ঘরে—
স্বরূপে তুই না আসিলে প্রাণ ত্যাজিলে
দোষ পড়বে সব আমার ঘাড়ে ॥

৪১

জীবন ভরিয়া যতন করিয়া
পুষেছি এক জংলি পাখি জীবন ভরিয়া ॥
জানি না ওই কালো পাখি আগে ছিল কার
নাম শুনিয়া কাগা ময়না হলেম তাবেদার,
যত্ন নিতে আহার দিতে নিকটে তার পড়ে থাকি ॥
কর্মফলের মূল্য দিয়া পাখি কিনতে হয়
তা হলে তার কাছে কয়দিন বন্দির ভাবে রয়,
মিশে না সে কারও সনে ছটফটি ভাব চঞ্চল আঁখি ॥
চৌদ্দ তলার পিঞ্জরেতে উপরে তার আসন
নিচের দিকে নেমে আসে মন লয় যখন,
ডিম পাড়িয়া যায় উড়িয়া তা দেওয়া রাখিয়া বাকি ॥
চৌরাশি ক্রোশ ভেদ করিয়া নদী একটি আছে
সেই পাড়েতে পাখির বাসা হাজরা বাগের কাছে,
আপন বংশ রাজহংস গলা ভাঙছে তারে ডাকি ॥
সংসার জুড়ে ওই পাখির জাত নামে অধর চান
ধরবার আশে যোগী ঋষি রাস্তায় পাতে ফান,
জালাল বলে ভূমণ্ডলে কত নামেই আমরা ডাকি ।।

৪২

তারে সহজে না মিলে-
আকাশে-পাতালে পায় না, ভেসে ওঠে ঢেউয়ের জলে ॥
শ্রীকলায় সেই মানুষ থাকে, ত্রিবেণীর উজান বাঁকে
কেউ নাহি তার খবর রাখে, আদমপুরে চলে—
আদমি আদম খোদা এক দম দু’জনাতে মিলে
ধরম-করম জ্ঞান-চরিত্র, দমে যোগায় আপন দিলে ॥
যত কিছু এ জগতে, সবেই পয়দা এক সিফতে
খেইল পাতিয়া জাতে জাতে, ঘুরছে প্রেমের কলে;
মানুষের ভিতরে মানুষ, পরশমণি জ্বলে—
অন্তরে অনন্ত লীলা, দেখবে আত্মসাধন হলে ॥
যে জন ভাসে দর্পণেতে, সেই মানুষ সব হৃদয়েতে
জাগ্রত হয় কুম্ভকেতে, নিশ্বাসেতে চলে;
‘খোদ’ বলো কি খোদাই বলো যার তার সাধন বলে—
সেই মানুষ তোর আপন বটে, ফাঁকে পড়ে হারাইলে ॥
রূপের সিদ্ধি করছে যারা, অধরাকে ধরছে তারা
আপনার ছবি সামনে খাড়া, ভেবে কয় জালালে;
সেই আলোকে আঁধার নাশে, তত্ত্বজ্ঞান শিখিলে—
আলোক চেয়ে রাস্তা ধরো থাকে যদি কর্মফলে ॥

৪৩

তুচ্ছ জিনিস উচ্চ করে দিয়েছেন সাঁই দয়াময়
জানতে গেলে তালাশ করো ছাড়িয়া কলঙ্কের ভয়।।
ভক্তি আর বিশ্বাসের বলে বাহ্য ভাব ছাড়িয়া দিলে
মুর্শিদের চরণ তলে শিশুর মতো লও আশ্রয়।।
সেই জিনিসের এমনই গুণ জলের নিচে জ্বলে আগুন
দিনে দিনে বাড়লে দ্বিগুণ পুড়ে মরবে রিপুদ্বয়।।
প্রতি ঘটে আছে যিনি চেতনায় চৈতন্য তিনি
ঝারিলে তার অঙ্গের পানি নতুন জীবন জন্ম লয় ॥
তুচ্ছ বস্তু দেখতে মন্দ গ্রহণে তার হয় আনন্দ
শুনলে প্রথম লাগে ধন্ধ অন্ধকারে পড়তে হয় ॥
চারি চন্দ্র করে খাঁটি পুড়ে লওগা কাঁচা মাটি
যাবে না আর ভবের ভাটি ভাবিয়া জালালে কয় ॥

৪৪

তোমায় খুঁজে হতাশ হইলাম
জীবনে না পাইলাম কভু আর
আয়ু-সূর্য-অস্তাচলে
ঘিরছে এসে অন্ধকার ॥
অনন্ত দুরন্ত দেশের যে অচিন্ত্য মহাজন
চিন্তা করে ধ্যানে এনে কয়জনে তার লয় স্মরণ
পিছনেতে ঘুরছে শমন বাঁচাতে সাধ্য নাই কাহার ॥
কত জন্ম ভ্রমণ করি কোন সে কর্মফলে
মানব লীলা ঘুরে এলাম দুখের ধরাতলে
দিন যেতেছে অবহেলে চৈতন্য হলো না আর ॥
ব্রহ্ম রন্ধ পথে একদিন শূন্যে উড়ে যাব
যেথা ছিলাম তথায় গিয়া মনের মানুষ পাব
এমন কঠিন যন্ত্রণালোকে ফিরে আসতে চাই না আর ॥

৪৫

তোমায় তুমি না চিনাইলে প্রভু তোরে কে চিনে?
পথের নাহি আছে অন্ত যে পথ চলো রাত্র-দিনে ॥
গুটিপোকার জাল বুনিয়া, তার ভিতরে আটক হইয়া
বহুরূপীর ভাব ধরিয়া ব্যাপ্ত রও ক্ষিতি-বিমানে ।।
নিশ্বাসের বিশ্বাস নাই, অখণ্ড অসীম সাঁই
ভাণ্ডে বিরাজিত সদাই, হারাইয়াছি খণ্ড জ্ঞানে ।।
তপস্যা করো কিংবা অনশন শ্বাস রোধ করে আজীবন
ছাড়াইতে না পারছি শমন সদাই চলে পিছনে ॥
আগে বাবা ডেকে পিতায় যেমনি পুত্রে ডাকতে শিখায়
তেমনি করে তুমি আমায় চিনায়ে যাও নিজ গুণে ॥
অকর্মে তোর সুকর্ম ভাব বিস্তারিতে নিজের প্রভাব
হইয়াছে আমিত্ব লাভ, জালাল মাত্র এই জানে ।।

৪৬

তোমার মতো দয়াল ভবে নাই
দয়া গুণ আছে বলে তোমার কাছে দয়া চাই ॥
মজিয়া তোমারই প্রেমে প্রাণটি কোরবান করতে চাই
জন্মাবধি সবাই বাদী কোনো জায়গায় পাই না ঠাঁই
তুমি যারে দয়া করো নিকাশের ভয় তাহার নাই ॥
গুপ্তধনের অধিকারী গোপনে বাজাও সানাই
প্রেম-রাজ্যের রাজা হয়ে ফকির বেশ ধরেছ তাই
কব্বর-হাসর পুলসিরাতে তরাইয়া লও কানাই ॥
গোলামের দোষ পদে পদে মনিব যদি ধরে তাই
জাহান্নামে ডুববে তরি এই গোলামের উপায় নাই
জাগ্রত রয়েছে সদাই তোমার মধ্যে আলেক সাঁই ॥

৪৭

দয়াল গুরু বিনে কইব কথা কার সনে,
থেকে থেকে দিবানিশি, ওঠে আমার মনে গো ॥
চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে, করলাম দুর্গাপূজা
জন্মাষ্টমীর দিনে রাখলাম, কোন বা নিয়তের রোজা গো ॥
আশা রইল সুন্দরবনে, লেংটি রইল ডালে
বিড়ালে এক হস্তী লইয়া, ডুবে গেল পাতালে গো ॥
সাগরে নাই একবিন্দু জল, মাছ উঠেছে গাছে
ষাঁড়ের পেটে গাইয়ের বাছুর, কি খাইয়া প্রাণ বাঁচে গো?
শীতলি মায়ের হাঁড়ি ভেঙে খাইয়া গেল শ্যামে
জালালে কয় বুঝতে বিষয়, পণ্ডিতেরও ঘামে গো ॥

৪৮

দিনে দিনে শক্ত করে বন্দি হলেম মায়াজালে
পিঞ্জর হতে পারলাম না আর ছুটতে কোনও কৌশলে ॥
খেইল দিয়াছে সাঁই দয়াময়, খেলিতে তাই ইচ্ছা হয়
অমনি এসে রিপু ছয় ফেলিয়া যায় গোলমালে ।।
পারে উঠব আশা করি উঠিতে পড়িয়া মরি
বিপদকালে পাই না তরি ভাসতে থাকি অকূলে ।।
এমনই রঙ্গ লীলার ফেরে পৃথিবীতে সবাই ঘোরে
রাজ্য সম্পদ তুচ্ছ করে বাস করে কেউ বন-জঙ্গলে ॥
সারা জীবন ভেবে মনে জালাল উদ্দীন রাত্র-দিনে
এক দুই তিন গুনে চলেছে এবার ফাঁকতালে ॥

৪৯

দ্বিদলেতে লুকাইয়া আছে মনচোর
পাই না তারে জীবন ভরে যদিও না অনেক দূর ।।
সপ্ততলা ভেদ করিয়া রত্ন কাঞ্চন নেয় হরিয়া
যার ধন তারে দিয়া প্রেমানন্দে রয় বিভোর,
শূন্যপুরে দিবানিশি করিতেছে মিশামিশি
সিদ্ধ হইয়া যোগী-ঋষি বাঁশিতে ফুটাইল সুর ॥
সবার ঘটেই চিরকাল অনাহতে বাজে তাল
আসিলে মরণকাল দেখবে যদি হও চতুর,
পূর্ণিমাতে অর্ধচন্দ্র চলে যথায় ব্রহ্মরন্ধ্র
সহস্রারের ভাব স্বতন্ত্র অটল মূর্তি শ্রীগুরুর ॥
শমন যখন আসবে কাছে পলাইতে স্থান রয়েছে
পরদার আড়ে প্রাণটি বাঁচে যাইতে পারলে শূন্যপুর,
সেই ভাবনায় জালালাউদ্দী লোপ করেছে বিষয়-বুদ্ধি
তবু হইল না চিত্ত-শুদ্ধি মন ছাড়ে না মদনপুর ।।

৫০

দেখবে যদি তোরা আয়
রঙ-বেরঙের ফুল ফুটেছে প্রেমের বাগিচায় ।।
ডাইনে আল্লা বামে রসুল, মাঝখানে ফুটেছে ফুল
সেই ফুলেতে দিবানিশি গুঞ্জরে প্রাণ-ভ্রমরায় ।।
লাহুত-মুলকুতের ঘরে নাছুত-জবরুত পরে
চার ফেরতা বিরাজ করে সিয়া-সফেদ-লাল জরদায় ॥
গলার মধ্যে পুলসেরাত, বাঁকা নদী আবে-হায়াত
পার হলে সেই জলপ্রপাত অমর হবে দুনিয়ায় ।।
হও যদি বাগানের মালী লওগে রে কলঙ্কের ডালি
জালাল উদ্দীন ঘুরছে খালি চোখ-বান্ধা বলদের প্রায় ॥

৫১

দেহ জমি পতিত রইল আবাদ করিল না
খাসমহালের খাজনা বাকি জীবনে আর শোধ হলো না ॥
পঞ্চতত্ত্ব চিনো রে মন মাটির নিচে আছে রতন
যার ধন তারে দিয়ে ওয়াশিল করো বাকি দেনা ॥
ভক্তি আর বিশ্বাসের বলে এই ভূমিতে বীজ বুনিলে
গুরু গোঁসাইর কৃপা হলে সহজেতেই ফলবে সোনা
আসিলে সদরের আমিন শ্রীগুরু হইবে জামিন
না হলে আর শেষের দিন উপায় কিছুই দেখি না
ছোটা খাইয়া মোটা হইয়া বলদ গেছে জোয়াল ভাঙিয়া
ডাকলে নাহি চায় ফিরিয়া দৌড়াইলেও আর ধরা দেয় না ॥

৫২

ধরতে গেলে কই চলে যাও কেউ তারে খুঁজিয়া পায় না
আপনা হইতে ভালোবাসো খেলা কিছুই বোঝা যায় না ॥
মুখ দেখিয়া দুঃখ বুঝিয়া, নয়নের জল মুছাইয়া
রোগে শোকে হাত বুলাইয়া, সদাই করে দেও সান্ত্বনা ॥
কী খাব আর কেমনে রব, সর্বদাই ভাবনা তব
কিসে আমি সুখী হবো, করতেছ সেই ভাব যোজনা ॥
মাতা হয়ে করো পালন, পিতা হয়ে করো পোষণ
বন্ধু হয়ে প্রেমালিঙ্গন, জীবনে আর ছেড়ে যাও না ॥
করো ভার্যা হয়ে প্রেমাচরণ, পুত্র হয়ে অন্ত্যেষ্টি করণ
তুমিময় এ বিশ্বভুবন, চিনতে তোমায় পারলাম না ॥
জালাল তোরে চাহে এবার, ঘুচায়ে সব মায়ার আঁধার
চরণে লুটায়ে তোমায়, জুড়াইয়া নেও যাতনা ॥

৫৩

নদী তুই কিসে হবে পার—
শুকনা গাঙ্গে জোয়ার এসে পলকেতে হয় সাঁতার ॥
সাধনে হয় সপ্তগুণ, পুরুষেতে রয় নবগুণ
আটচল্লিশ গুণ আছে রে মন, মেয়ের অলংকার;
জীবন-মরণ দুই দিকেতেই মেয়ের অধিকার—
কর্মক্ষেত্রে নিয়ে পরে ছেড়ে দিয়ে ধরে আবার ॥
ধরা পড়ে স্তন্য পিয়ে, সবাই আজি সতেজ হয়ে
জাতের জাতকে করছি বিয়ে, দিয়ে ধর্মের ভার;
কায়া-ছায়া একই শুধু, ভিন্ন তার ব্যবহার—
পরকালে পাবে কিসে, জানে কয়জন সেই বিচার ॥
জীবন-পথে যে সঙ্গিনী, ধর্মপথে সেই তিনি
ঘরের মানুষ নাহি চিনি, যে করবে উদ্ধার;
জালালে কয় মূলধন চিনি, বুঝে লয় ব্যাপারে—
মেয়ের হাটে মেঘের ঘাটে, মেয়ে ছাড়া নাই দোকানদার ॥

৫৪

নাম নিলে হয় দেহ শুদ্ধ আনন্দে প্রাণ ঢেউ খেলায়
নামের বলে অকূল জলে পাথরও ভাসিয়া যায় ॥
পান করিলে নামের সুধা, থাকতে না রে ভবক্ষুধা
যে নামেতে ছিল বাঁধা গৌর-নিতাই নদীয়ায় ॥
হনুমান হয়ে ভক্ত, নাম ধরেছিল খুবই শক্ত
রাম নামে তার বুকের রক্ত, চিরিয়া সীতারে দেখায় ॥
নাম ধরে তার ডাকবে যদি, রবে না আর কোনও ব্যাধি
সে বিনে নাই কার্য সিদ্ধি যায় যদি কেউ গাছতলায় ॥
বৃক্ষ লতা পশু পাখি, নাম নিতে কেউ নাই রে বাকি
জালালে কয় জ্ঞানের আঁখি খুললে সবই দেখা যায় ॥

৫৫

নিকটের বন্ধু তুমি, তোমার মতো নাই আপন
ভুলে পড়ে ভুলে গেছি, স্মরণ হয় না জন্ম-মরণ ॥
তোমার মতো এত কাছে, পৃথিবীতে কেউ না আছে
আছাড় খেয়ে শিশু বাঁচে, দেখে অবাক হই তখন ॥
নিশ্বাসের বায়ু যত, কিনে যদি আনতে হতো
ধনরত্নে না কুলাইত, এমন সস্তা নাই কোনও ধন ॥
তুমি তাতে আছো বলে, মহাপ্রাপ্য করে দিলে
বিচার করলে জগৎমূলে, হয় না তার মূল পূরণ ॥
জানি না কোন মায়ায় পড়ে, রাখলে এত আদর করে
বিনিময়ে কী দেই তোরে, কাঁদতেছে জালালের মন ॥

৫৬

নৌকা আমার ভাসবে যেদিন সেদিন কি আর যাব কয়ে
অকূল দইরার দৃশ্য হেরি এক ধ্যানেতে রবো চেয়ে ।।
কৌসরের পানি দিয়া মনের মতো স্নান করিয়া
শুভ্র বসন পরে নিয়া আগে আগে চলব ধেয়ে ॥
অজানা কোন অচিন দেশে যাবে তরি ভেসে ভেসে
বন্ধুরা সব ধারে এসে রইবে চির বিদায় লয়ে ॥
কোন আকাশের কোন সুদূরে গান শুনিয়া শিরিন সুরে
উঠবো আমি ঘুরে ঘুরে বেহেশতের ওই সিঁড়ি বেয়ে ॥
চক্ষু থুইয়া হবো অন্ধ জালালি হাওয়া বন্ধ
শুনব না কার ভালোমন্দ কত কিছুই যাবে কয়ে ।।

৫৭

নৌকা বাইয়া বাইয়া যাই বিদেশের ব্যাপার করিতে ॥
ব্যাপার করিতে না রে, ঘাটে নাও লাগাইতে
পাইলে কিছু লাভের কড়ি ফিরব না এই দেশেতে ।।
অকূল নদীর ব্যাকুল হাওয়া, ঢেউ লাগে এই পাড়েতে
থরথরিয়ে কাঁপে তরি তরঙ্গেরই আঘাতে ॥
ঘোর তুফানে এ জীবনে আশা নাই আর বাঁচিতে
ডুইবে মরি হায় কি করি, অকূল দরিয়ার তলাতে ॥
জালালে কয় চলেছি একা, সঙ্গী নাই মোর জগতে
মইরে গেলে কিসের মাটি, কবর আছে সঙ্গেতে ॥

৫৮

প্রকাশে মানব ছবি, গুপ্ত নিরঞ্জন
খোদা তুই গোপনের গোপন ॥
রয়েছ কৌশল করে, ফেলিয়া ভুলের ফেরে
যোগী-ঋষি সাধন করে, পায় না নিশ্চয় নিরূপণ ॥
মিছরির মধ্যে মিঠা থাকে, জানে সব জগতের লোকে
মিছরি সবেই চক্ষে দেখে, মিঠার হয় না দরশন।
বৃক্ষে যখন ফল ধরে, বিচি থাকে তার ভিতরে
অঙ্কুরে আকৃতি লয়ে, গাছের আগায় বৃক্ষ সৃজন
জীব সমষ্টি তেমনি মায়ায়, হাসে কাঁদে নাচে গায়
বিকাশিতে মাতাপিতায় হয়েছিল প্রেমাকৰ্ষণ ॥
তোমার লীলা বোঝা যায় না, আমি নাহি তুমি বিনা
সকলই তোমার বাহানা, আমি কেবল কথার কথন ॥
ধরাতে অধরা হয়ে, খেলছ সদাই আমার লয়ে
জালাল উদ্দীন গেল কয়ে, তুমি নিদ্রা আমি স্বপন ॥

৫৯

প্রভু তুমি আছো কোথায়, আমি কি তার খবর জানি
থাকতে নাহি পেলেম সন্ধান, দিলে কতই পেরেশানি ॥
যত শাস্ত্র প্রমাণে কয়, আছো তুমি বিশ্বময়
সৃষ্টি আর স্থিতি-লয়, সকল কর্মে তুই করণী ॥
ধরিয়ে অসংখ্য আকার, নাম ধরেছ সাঁই নিরাকার
কইব কি মহিমা তোমার, কখন আগুন কখন পানি ॥
মাটির দেহ মরলে পরে, মাটি হইয়ে যায় কবরে
আমি তুমি থাকব পরে হইয়ে রুহু ইনছানি ॥
এখনও রয়েছি তেমন, উপরে একজন নিচে একজন
ব্যাকুল হয়ে সারা জীবন, দমের ঘরে টানাটানি ॥
জালালে কয় বিচার করে, প্রভেদ নাই পরস্পরে
কার বিচার কে বা করে, যা হতেছে সব এখনি ।।

৬০

প্রেম-আশায় এ দুনিয়ায় জীবে রে সাঁই দেয় জীবন
সৃষ্টি করে জগৎ সেরা আদম নামটি রাখে তখন ।।
কিবা মনের অভিলাষে মজিয়া আপনা রসে
প্রকাশিত মানুষ বেশে আত্মারূপে রয় গোপন ।।
নিত্য নতুন রঙ্গে পয়দা বিকশিত একই খোদা
প্রেমপুরীতে নয় সে জুদা ঘটে পটে নিরঞ্জন ॥
ধ্যান করিলে লাল কমলে দেখা যায় ভূমণ্ডলে
বিশ্বাস নিলে অন্তরস্থলে স্বরূপে অরূপের গঠন ॥
প্রেম হইতে মায়া আসে মায়াতেই জগৎ ভাসে,
মায়ামুক্ত হইলে শেষে প্রেমের সুখে হয় মরণ ॥

৬১

প্রেম-নদীতে রসের খেলা, খেলবি যদি আয়
সাধু যারা জানে তারা, সন্ধানে পার হয়ে যায় ॥
স্নান করিতে ঘাটে গিয়া, লাল নিশানে ভক্তি দিয়া
কলসির মুখ বান্ধিয়া, ধ্যানে রেখো মণি-কোঠায় ॥
কুম্ভীর একটি থাকে ঘাটে, নামলেই পাগল হয়ে ছোটে
দেখে যদি না যাও হটে, সাধ্য নাই যে ধরবে তোমায় ॥
যদি ওঠে তুফান ভারি, পারে বেঁধে রাখবি তরি
গুরু ভিন্ন নাই কাণ্ডারি, সেই নদীর জোয়ার-ভাটায় ॥

৬২

বাইরে আলো ঘরে আঁধার,
মানবদেহ কলিকাতা অতি চমৎকার ॥
চৌষট্টি গল্পির মাঝে, ষোল জন প্রহরী আছে
তিনশত ষাইট নম্বরে রাস্তা হয় বাহাত্তর হাজার ॥
মেজাজ খারাপ মির্জাপুরে, লাল বাজারে নিশান ওড়ে
বৌবাজারে গেলে পরে জীবন রাখা বড়োই ভার ॥
চিন্তা-গারদ আলিপুরে, হাটখোলা হুগলীর পারে
বেলুড় মাঠে কালিঘাটে আছে তিনজন অবতার ॥
খাসা লাল দিঘির পানি, ধর্মে কয় না মিষ্ট শুনি
ধরমতলা ত্রিমোহনী, গড়ের মাঠ কি চমৎকার ॥
চিড়িয়াখানা যাদুঘর, মণি-মঠ হলের ঘর
খিদিরপুর থরে থরে, ঘাটে বান্ধা ইস্টিমার ॥
ললাটে লাটের বাড়ি, জিহ্বাতে হয় জজ-কাচারি
কপাল-গঞ্জ দুনিয়াদারি, জালাল উদ্দীন কহে সার ।।

৬৩

বিচার করলে নাই রে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান
রক্ত-মাংস একই বটে সবার ঘটে একই প্ৰাণ ।।
জীবন যারে বলা হয়, সে তো সুন্দর দেহ নয়
প্রাণ সম্বন্ধে জগত্ময় সবাতে তার এক সন্ধান ।।
মাথাতে মস্তিষ্ক থাকে, মলমূত্র পেটেতে রাখে
পায়ে হাঁটে চোখে দেখে একই বায়ু করে পান ।।
বাতাস খেয়ে জীবন বাঁচে বায়ুতে পরাণ আছে
পরমায়ু তারই কাছে একজনে করেছে দান ।।
একই যদি সবার গোড়া, আছে যখন স্বীকার করা
ভিন্ন করে ভবে কারা দিয়ে গেল বিভেদের জ্ঞান ॥
খাওয়া পরা চালচলনে, ভিন্ন হইয়া ভিন্ন মনে
যার-তার ভাবে নিচ্ছি টেনে হরি-আল্লা-ভগবান ॥
একের বিচার কোথায় গেল, পরম কিসে চিনা হলো
জালাল উদ্দীন ঠেকে রইল, গাইল শুধু ভাবের গান ॥

৬৪

বিচারিলে পাওয়া যায় কী একটা যেন প্রতি ঘটে
নাই বলে আর লাভ কী আছে, তাই তুমি সাঁই আছো বটে ॥
কতজনে কতই কয়, যাহার যেমন মনে লয়
কল্পনাতে ভাব বিপর্যয় ঘুরে মরছি ভবের হাটে ॥
আপন ঘরে আপন সাঁই, তাহা ছাড়া আর কিছু নাই
বাজে কত শঙ্খ সানাই, এরই লাগি মন্দির মঠে ॥
মক্কা কিংবা যাও মদিনা, যতই করো দান দক্ষিণা
সেই যে শুধু পায় সান্ত্বনা সব হতে যে রয় নিকটে ॥
আমি আছি বলেই তুমি, থাকতে আছো অন্তর্যামী
যেই তুমি সেই যে আমি, জালালে কয় চিত্তপটে ॥

৬৫

ভব-নদীর কূলে বসে ভাবছ কি রে মন
পাড়ি দিয়ে যেতে হবে, দিন থাকতে করো আয়োজন ॥
দমের উপর বাড়িঘর, খালি হবে সাধের পিঞ্জর
কে লইবে কার খবর, এলে বেটা কাল শমন;
যমের লাঠি মারলে মাথে, ভাই-বন্ধু যাবে তফাতে
যাদের লাগি দিবারাতে, খেটে করলে উপার্জন ।।
দালান-কোঠা-নাট-মন্দির, ছেড়ে শয্যা কূলে নদীর
হবে যে দিন সুন্দর নারীর, কে দেবিরে চাঁদ-বদন;
শূন্য করে পরের ঘর, জমাইলে টাকা-মোহর
নিদান কালে সে ধন কি তোর, ধনের কাজ দিবে কখন? ॥
মন্দের ভাগী কেউ না হবে, ভুলবে এ-সব আলাপন
আসিয়ে সম্বন্ধী-শালা, ভাঙিবে সিন্দুকের তালা
জালালে কয় নামের মালা, বিনে কিছুই নাই আপন ॥

৬৬

ভরিয়াছি পাপের ভরা—সাধন করা
হইল না আর এই বিদেশে ॥

নৌকাতে ছয়জন দাঁড়ী বৈঠা ছাড়ি
জানি না কার কোন উদ্দেশে—
ফেলে যাইতে চায় আমারে বারেবারে
লাগায় তরি কিনার ঘেঁষে ॥

যাদেরে জানতাম আপন তারাই এখন
আড়ে থাইক্যা মুচকি হাসে-
দিচ্ছে কতই করতালি গালাগালি
চেয়ে আছি অনিমেষে ॥

চালায় তরি পঞ্চভূতে—কলের সুতে
পঞ্চ হাওয়া মিলবে এসে—
জালাল সেদিন কাঁদবে একা—পথের দেখা
ঠেকায় পড়ে দিতে এসে ।।

৬৭

ভাব বিনে কি ভাবের মানুষ ধরতে পারা যায়
অচেনা এক ভাবের পাখি, হৃদাকাশে উড়ছে সদায় ॥
প্রেমময়ের প্রেম-মুখ, দেখবার আশে কতই দুঃখ
স্থুল জগতে হইল সূক্ষ্ম, তাই সে চিনা বিষম দায় ॥
ভাবেতে ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে, বিশ্বব্যাপী একটি তারে
প্রাণের কথা ধীরে ধীরে, কানের কাছে কয়ে যায় ॥
কাননে ওই কুসুম কলি, ঝরে ফোটে আসে অলি
রক্তজবা যুঁই চামেলি, আপনা রঙ্গ আপনি চায় ।।
গিরি গুহায় বর্তমান, আছে কত ভাবের পাষাণ
একজনেরই অনুসন্ধান, করতেছে লতায়-পাতায়।।
কেন জন্ম-মৃত্যু হয়, কয়জনে তার খবর লয়
গ্রহ-তারা গণনময়, মিটিমিটি কেন চায় ।।
ভাবের সাগর গভীর ভারি, সকলের ঘটে না পাড়ি
প্রেমিকের ভাঙা তরি, বিন বাতাসে উজান ধায় ॥
ভাবনদীতে জীবনধারা, চলছে ভাটি, রয় না খাড়া
তেমনি করে যায় যে মোরা, বাহ্য-লীলা ভুল কোথায় ।।
জালাল কয় মোর ভাবের গোলা, গুরু বিনে যায় না খোলা
দুই চক্ষে পড়েছে ধুলা, মন মজে না চরণ-সেবায় ॥

৬৮

ভুলে পড়ে জগৎ ঘুরে, যায় না মনের অন্ধকার
সত্য বিষয় উদ্ধারিতে প্রাণে চাহে কয়জনার ।।
নয় হাজার বৎসর গেল, মানব নাম পরিচয় হলো
এর আগে ভেদ নাহি ছিল, সবেই ছিল একাকার ॥
বিধির বিধান জাগরণে, পশু ক্রমবিকাশ গুণে
মানবত্বে চলে এল—রূপ সাজিল চমৎকার ।।
কোটি বর্ষে রূপান্তরে বানরের বংশ ধরে
শিম্পাঞ্জি গরিলা হয়ে শেষে বন্য-মানুষ আকার ॥
মনু কিম্বা আদম বলো, একজনেই নাম প্রকাশিল
সেই হতে নাম বিভেদ হলো হিন্দু-মুসলেম জাতি সবার ॥
সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, ভাব-ব্যবহার নানা রঙ্গে
আসল কিন্তু ঠিকই আছে স্রষ্টা যে জন তোর আমার ॥
ক্রমোন্নতি যতই হলো, অভেদের জ্ঞান ভুলে গেল
হিংসা এসে প্রবেশিল, একে-অন্যের অত্যাচার ॥
জালালে কয় হিংসা ছাড়ো, নিগূঢ় তত্ত্বে সার উদ্ধারো
এক যদি সব হতে পারো বদ্ধ রাখে সাধ্য কার?

৬৯

মইলাম চৌকিদারি চাকরি করে—
কম বেতনে তলে-পড়া, হাজিরা দেই থানার ঘরে ॥
যত সব মাটির গড়া, আমার হাতে বাতাস ভরা,
পাড়ায় পাড়ায় জন্ম-মরা লেখি কয়দিন পরে পরে,
মদনা চোরায় সিঁদ কাটিয়া, গৃহস্থের মাল নেয় টানিয়া
দফাদার-চৈতারে লইয়া পাহারা দেই অন্ধকরে ॥
জ্ঞান-দারোগায় তহরি খায়, মন ম্যাজিস্ট্রেট অংশ পায়
আসল পাজি পুলিশ ছয়টায় ফন্দি-সন্ধির যোগাড় করে।
জুতার বোঝাও বইতে জানি, রাত্রদিনেই মরা টানি
নামটি আমার হয় পরাণী, চক্কিয়া ডাকে সবাই মোরে ॥
জালালে কয় এই বেটারে, সেসব বেটায় চিনতে পারে
ধন্য তারা এ সংসারে, অনায়াসে গেছে তরে ॥

৭০

মন তুই, পড়গে চরণ তলে—
যারে ভজলে গয়া-কাশী, তীর্থ বারানসী মিলে ॥
মুসলমানের বয়তুল্লা, সেইখানে বিচারের পাল্লা
আল্লা আর রসুলের খেলা, আদমে যোগ মিলে;
হিন্দুরা কয় ত্রিবেণির ঘাট, স্নান করে তার জলে—
স্নান করিয়া শুদ্ধ হইয়া, মুক্তির আশা ভূমণ্ডলে ॥
অধো ভাণ্ডে রাখিয়া-ঊর্ধ্ব ভাণ্ডের ধন খাওয়াইলা
শিশুকালে পালন করে, লইয়ে যে জন কোলে;
ঘরে থাকে এক রমণী, সেই দূষিত মিলে—
বিয়ে করে ঘরে এনে, পায়ের ধূলা কেন বানাইলে?
বেদ কোরানে আছে জানা, গোপনতত্ত্ব জানতে দেয় না
ভাবুক বিনে কেউ বোঝে না, বৈরাগ্যে না গেলে;
এক ডুবেতে ভবের পাড়ি, জালাল উদ্দীন বলে—
ব্যাপারের ভাও না পেয়ে, লাভে মূলে সব খোয়াইলে ॥

৭১

মন তোমার এই মানব-তরি, বোঝাই ভারি
উজান পাড়ি চলে না রে ॥
পাছার মাঝি হয়ে যে জনা, দেয় মন্ত্রণা
বাধ্য করে ছয়জনা রে-
মাস্তুলের নাই জাঙ্ঘা টানা, হাইল মানে না
ছিঁড়া বাদাম হাওয়া নাই রে ॥
করে তুই লাভের আশা, বুদ্ধিনাশা
দস্তা সিসা চিনলে না রে—
রূপগঞ্জের বাজারে গিয়া বেহুঁশ হইয়া
কিনলে কেবল সস্তা দরে।
তিন ধারে ছুটছে জল, করে কলকল
গুণ দিয়েছে পুবের পারে—
পারে থেকে লোকে হাসে, কোনো দেশে
গিয়ে তরি ডুবে মরে ।।
দয়াল নামের সারি গেয়ে, ভাটি বেয়ে
উজানে যাও সাহস করে—
জালাল উদ্দীন ভেবে সারা, নাই কিনারা
মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে ॥

৭২

মনা ভাইরে অকূল নদীয়ার জলে
ভাসিয়া যায় মোর ভেলা ॥
সঙ্গের সাথী নাই রে আমার গগনে নাই বেলা-
জানলে কি আর এমন সময় করতাম আমি মেলা?
কূল নাই কিনারা নাই, নাই রে গাঙ্গের তলা—
মন-মাঝি বিমনা হইয়া কাঁদতেছে নিরালা ॥
ঢেউয়ের ফাঁকে নদীর বাঁকে কুম্ভীর ভাসে কালা–
রক্ষাকর্তা থাকলে কেহ এমন সময় কই রইলা ॥
ত্রিমোহনার মাঝে এলেম তিন দিকেতে তিন নালা–
জালালে কয় সামনে চলো জোরে জোরে বৈঠা ফালা ॥

৭৩

মনের মানুষ হৃদয় খুঁজে দেখলে না
ধরতে তারে আপন ঘরে ধ্যান রাখে ওই সাধুজনা ॥
আট কোঠাতে ষোল তলা দ্বিদলে পাতিয়া খেলা
মণিপুর হয় মদনজ্বালা হেথায় আছে আর এক থানা ॥
চতুর্দলে বিষের ফণি দ্বাদশ দলে হংসমণি সাঁ
তার দিয়ে যায় উজানি দল সহস্রে লয় ঠিকানা ॥
ষোল দল সাধনা হলে দ্বিদলেতে যাবে চলে
পড়িতে হয় বিষম গোলে গুরু-ভজন যার হলো না ॥
সাধিষ্ঠানের অধিষ্ঠাতা মণিপুরে আছে গাঁথা
অনাহত পদ্মপাতা ছিঁড়তে তোমরা কেউ যাইও না ॥

৭৪

মন্ত্র পড়ে চাই না আমি বিধি তোমার স্বর্গে যেতে
শাস্ত্রে ইতি দিয়ে নিলাম বিচার নিয়া দুনিয়াতে ॥
যথায় নরক তথায় দোজখ হরি আল্লাহ এক বিচারক
মিছে কেবল ঠেলাঠেলি সাম্য ভাবের গম্য পথে ॥
মন যদি হয় মনের মতো থাকব সুখে অবিরত
বিশ্বে তোমার ইচ্ছামতো জাগতে পারো আপনা হতে ॥
নাহি অন্ত নাহি আদি পঞ্চভূতেই বিলীন বিধি
সেই কারণে আজ অবধি দেখা হয়নি কারও সাথে ॥
ঠিকের বস্তু একই রয় ভাবে শুধু হয় বিপর্যয়
জালাল উদ্দীন বলে নিশ্চয় চাষ করিব নিজের ক্ষেতে ॥

৭৫

মরিলে যেন পাই গো তারে
সারাটা দুনিয়া দেখিলাম খুঁজিয়া, ভিখারি সাজিয়া দ্বারে দ্বারে ॥
শুনেছি কানে না দেখি নয়নে, আসমান জমিনে সদায় ঘুরে
বাঁশিটি বাজায় হাসায় আর কাঁদায়, তালাশে লুকায় ছলনা করে
শুয়ে মোর বিছানায় সঙ্গেতে ঘুমায়, ঘুমাইলে জাগায় আদর কইরে
পিপাসার জল সহায় সম্বল, চঞ্চল পাখি বদ্ধ পিঞ্জরে ।।
কহে জালালউদ্দীন কিবা অপরাধী, জনম অবধি কাঁদি উচ্চস্বরে
হয়েছি হারা জিয়ন্তে মরা, ধরা না দিল কেবল আমারে ॥

৭৬

মাঝি বাইও বাইও তরি বেলা থাকতে দেই পাড়ি ॥
গলুই ভাঙা নিশান টাঙ্গা, ছয়জন নায়ের দাঁড়ি
যার-তার ভাবে ফেললে বৈঠা, হয় না আড়া-আড়ি ॥
সোনারগাঁইয়া বাইছা তোমরা বইছ সারি সারি
এমন সময় সাজে কিরে বৈঠা কাড়াকাড়ি?
সেই পারে মথুরার বাজার, প্রাণ বঁধুয়ার বাড়ি
উল্টা হাওয়ায় নাও লইয়া যায় মদনগঞ্জের খাড়ি ॥
পুরান তক্তা পুরান লোহা, গলুই দিছে ছাড়ি
ঝাঁকির চোটে পানি ওঠে, সিঞ্চ তাড়াতাড়ি ॥

৭৭

মাটির দেহ খাঁটি করো, খোলে তোমার দীল-কোরান
বাড়ি জমির হিসাব নিবে, সাক্ষ্য দিচ্ছে বেদ-পুরাণ ॥
আমি শব্দে কে-বা হয়, নিঃশব্দে কি কথা কয়
যম কোথায় রসে রয়, কই বা থাকে পঞ্চপ্রাণ
গুরুর সঙ্গ স্বভাব নিয়া নিগূঢ় তত্ত্ব লও খুঁজিয়া
বিশ্ব-বিজ্ঞান পাঠ করিয়া, সকলেই দেখো সমান ॥
বেছে নিবে মন্দের ভাগ, শ্রদ্ধা ভক্তি অনুরাগ
হিংসা নিন্দা পরিত্যাগ করলে আটক মদন-বাণ
অনন্তে মিশিবে তবে আর না আসিবে ভবে
সঙ্গীরা সব বাধ্য হবে, ভাটি ছেড়ে যাবে উজান ॥
কাঁচা মাটি পুড়ছে যারা, সিদ্ধ পুরুষ ভবে তারা
জীবন থাকতে গেছে মারা, স্বর্গ-নরক এক সমান
ভয় থাকে না তার অন্তরে, ডুব দেওগে প্রেমসাগরে
পাথরে কি ঘুণে ধরে? জালাল উদ্দীন কথা মান্ ॥

৭৮

মানব-লীলা কী চমৎকার, বুঝতে পারি না
মানুষ হয়ে নুরনবি, করেছেন কী ঘটনা ॥
আলেফেতে আল্লা-বারি, পাঞ্জাতন পাক-নুরি
মায়ার ছলে মীম হরফে, ছাপিয়েছেন রব্বানা;
মোহাম্মদের মীম যুদা, চক্ষেতে দিয়াছে পর্দা
নইলে আহাদ-আহমদ-খোদা, এক বিনে দুই দেখি না ॥
আউয়ালে আহাদ-নুরি, দুয়মে মোহাম্মদ জারি
সিয়মে আদমতনে গুপ্ত মক্কা মদিনা;
খোদা গেছেন মানুষ হইয়া, মানুষে তারে চিনল না ॥
শরিয়তে চাবি দিয়া, রয়েছেন অমর হইয়া
অধিক বলা উচিত নহে, কলঙ্ক হয় ঘোষণা;
মুনশি-মোল্লা বেজার হবে, কাতলের হুঁশুম দিবে
হায়াতেন্নবী আছেন ভবে, জালাল তাঁরে চিনল না ॥

৭৯

মানুষ থুইয়া খোদা ভজো, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজো কোরান খোঁজো, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে ॥
খোদার নাহি ছায়া কায়া স্বরূপে ধরেছে মায়া
রূপে মিশে রূপের ছায়া, ফুল কলি ছয় প্রেমের গাছে ॥
আরব দেশে মক্কার ঘর, মদিনায় রসুলের কবর
বয়তুল্লায় শূন্যের পাথর, মানুষে সব করিয়াছে ॥
মানুষে করিছে কর্ম, কত পাপ কত ধৰ্ম
বুঝিতে সেই নিগূঢ় মর্ম, মন-মহাজন মধ্যে আছে ॥
দ্বিলের যখন খুলবে কপাট, দেখবে তবে প্রেমের হাট
মারিফত সিদ্ধের ঘাট, সকলই মানুষের কাছে ॥
সৃষ্টির আগে পরোয়ারে, মানুষেরই রূপ নেহারে
ফেরশতা যাইতে নারে, মানুষ তথায় গিয়াছে ।।
মানুষের সঙ্গ লইয়া, পৃথিবীতে জন্ম হইয়া
খেলতে হইল মানুষ লইয়া, জাত বিনে কি জাতি বাঁচে? ॥
মানুষের ছবি আঁকো, পায়ের ধূলি গায়ে মাখো
শরিয়ত সঙ্গে রাখো, তত্ত্ব-বিষয় গোপন আছে ॥
জালালে কয় মন রে পাজি, করলে কত বে-লেহাজি
মানুষ তোমার নায়ের মাঝি, একদিন গিয়া হবে পাছে ॥

৮০

মানুষের ভিতরে মানুষ তার সনে মন করো খেলা
অন্তরঙ্গে বহিরঙ্গে ধ্যান রাখিয়া সারাবেলা ॥
আগে আত্মসংযম করো, মন মানুষের সঙ্গ ধরো,
নিশ্বাসেতে মিলন করো বসে বসে খুব নিরালা ॥
মনের মানুষ শূন্যের ঘোড়া, হৃদ-মন্দিরে কপাট মারা,
মরতে পারলে জেতা মরা খুলিবে সেই কোঠার তালা ॥
নিজের মুরতি নিয়া, ধ্যানে বসো বিভোর হইয়া,
মনের চোখেই দেখবে চাইয়া দুনিয়া সব উজালা ॥

৮১

মায়া নদীর অতল নীরে দেহতরি দিস না ছেড়ে
তা হলে তোর মুক্তি নাহি লক্ষ জনম ঘুরে-ফিরে
দমে ভাটির পানে ধায় শমন রাজার ঘাটে লাগায়
নামের বাদাম তোল নৌকায় প্রেম ভক্তি বাতাসের জোরে ॥
মাঝি ছয়টা আনাড়ি সদায় করে মারামারি
ঘূর্ণিপাকে লাখে লাখে ডুবে তরি ভব-সাগরে ॥
পাইলে সুজন কর্ণধার উজান তরি চলে যায় তার
ডুবাইলেও না ডোবে ভরা লোকসান কিছু নাহি পড়ে ॥
হবি যদি মায়া মুক্ত, মনকে আগে করগে শক্ত
গুরু গোসাইর হও রে ভক্ত, শ্রদ্ধা বিশ্বাস অটল করে ॥

৮২

মায়া মোহে আটকা আছি ছুটে যাওয়া খুব কঠিন
আর তো আমার শোধ হলো না মহাজনের পাওয়া ঋণ ॥
পৃথিবীর এই ধুলা খেলায় দিন গিয়াছে মনের হেলায়
ঠেকছি এবার শেষের বেলায় দেহটা হইল শক্তিহীন,
দেখে আইলাম জন্ম ভরে কত মানুষ গেছে মরে
আজ আছে বেশ দুদিন পরে মাটিতে হয় সব বিলীন ॥
দর্শনের এই তত্ত্ব যত জ্ঞানী বিজ্ঞানী শতে শত
কালের কাছে পরাহত হতেছে সব দিনের দিন,
যেতে হবে পরপারে ভেদ নাহি রয় জাত বিচারে
কেউ রাখতে না পারবে কারে জালে বদ্ধ সকল মীন ॥
বাইরে ঘরে উপরে নিচে চতুর্দিকে যত আছে
দুই দিন পরে সবেই মিছে রইবে না কার কোনও চিন,
জালাল উদ্দীন তাই ভাবিয়া দিছে ধূলি উড়াইয়া
শেষ কথাটি যাই বলিয়া আত্মাকে বানাইও স্বাধীন ॥

৮৩

মারিফত বিচার করো, বসিয়ে শরিয়তের কোলে
ষাইট হাজার গোপনের কথা নিষেধ করেছেন রসুলে ॥
শরিয়তে নমাজ-রোজা, এবাদতের রাস্তা সোজা
মারফতে আলি-মর্তজা, মধু খেয়ে গেছেন ফুলে ॥
শরিয়তে নাও সাজাইয়া, তরিকতে মাল ভরিয়া
হক্ সাহেবের হাটে গিয়া, দেও মারফতের পাল্লায় তুলে ॥
হাওয়া মাটি আগুন পানি, তাদের কি খোদা মানি?
দশ-দিকেতে টানাটানি, পড়ে মস্ত কথার ভুলে ॥
কানে কানের কথা শুনে, সন্দেহ লেগেছে প্রাণে
লেখা কথায় পাই কেমনে, কোন কথা রয়েছে মূলে ॥
লেখা ছেড়ে দেখা বিচার, করলেই বুঝবে সারাসার
জালাল না পেয়ে বিচার, পড়িতেছে বিষম গোলে ॥

৮৪

মিছে ভবের মায়ায় ভুলে মন তোমার আর হুঁশ হইল না
কয়বার এসে কয়বার গেলে আসা-যাওয়া দূর করলে না ॥
পড়েছ চৌরাশির ফেরে, ঘুরিতেছ অন্ধকারে
কবে যাবে সাগর পারে হিসাব ধরে দেখলে না ॥
নেশার ধুমে মাতাল রইলে, দিনে দিনে সব খুয়াইলে
একদিন এসে ধরবে কালে বিনয় করলেও ছাড়বে না ॥
নিকাশের পড়েছে বাকি খাটবে না আর ফাঁকিঝুকি
কারে লইয়া থাকবে সুখী জালাল করছে এই ভাবনা ॥

৮৫

মুকরম আবেদ শয়তান হলো আদমকে না সেজদা করে
এই অহংকার কোন শয়তানে ঢুকাইয়া দেয় তার অন্তরে? ॥
আদম দেহে খোদা গিয়া, সেজদা করার হুকুম দিয়া
আজও আছে লুকাইয়া ভুলছ এবার কোন বিচারে ॥
তন্ত্র-মন্ত্র মুখের কথা, ভক্তি হয় হৃদয়ে গাঁথা
দীল-ইমানে নোয়াও মাথা ভাব-ভক্তি অনুরাগ ভরে ॥
লম্বা লম্বা কালাম কইয়া, আছো মনের শান্তি লইয়া
ফেরেশতায় যে সেজদা দিল কোনও কালাম নাকি পড়ে।
আদম খোদা খোদাই আদম, নয় জুদা দুই-একটি দম
শরিয়তে ঘটাইল ভ্রম নিষেধ দিয়া এক্কেবারে ।।

৮৬

মুর্শিদ আছে পাছা নায়ের কাণ্ডারি
পার ঘাটে মন দেও পাড়ি ॥
অন্তহীন সেই পারাবারে দম সমর্থে যে সাঁতারে
নাও বৈঠা তার লাগে নারে পার হয়ে যায় তাড়াতাড়ি ॥
দিন থাকতে নাও খোলে যারা সুজন সাধু বটে তারা
হয় না কভু পন্থহারা গেয়ে যায় নামের সারি ॥
সাত দরিয়ার লোনা পানি না খায় যদি তুচ্ছ জানি
হউক না সে মহাজ্ঞানী ভাগ্যে নাই তার প্রেমপুরী ।।
প্রেমের দেশে গেলে রে মন ষোল আনা ঠিক করো ওজন
জালালে কয় যার তার মতন মূলতত্ত্ব লও বিচার করি ॥

৮৭

মুর্শিদ আমার মৌলা ধন কেমনে পাইব তোমার দরশন
দেখবার আশায় আমি সদায় থাকতে আছি উচাটন ॥
লুকি দিয়া কোথায় গেলা ডেকে মরছি তোমারে
শাস্ত্র ছেড়ে আকার ধরে দেখা দেও আজ আমারে
দেখা দিতে আশেকে রে নাই কি তোমার প্রয়োজন ॥
এদিক-সেদিক চাই তোমারে দেখি দেখি পাই না
হাত বাড়াইয়া ধরতে গেলে হাতে কিছুই আসে না
তুমি ধরা নাহি দিলে ধরবে তোমায় কেমন জন ॥
সাক্ষী দিলো কোরান এসে দেখে তোমার বাসস্থান
খুঁজতে গেলাম না পাইলাম হলো শুধু অপমান
জালালে কয় ফাঁকা ময়দান দেখবার আশা অকারণ ॥

৮৮

মেয়েরূপী কাল-সাপিনী, জগত খেয়ে চেয়ে রয়
অবিচারে পুরুষ মরে, মেয়ে কিন্তু দোষী নয় ॥
যত আছে মায়ের বংশ, আদ্য-শক্তির অর্ধ-অংশ
তার কাছে সবই ধ্বংস, ধনী কাঙাল যত হয়।।
ফুল ফোটে যার বারো মাস, তাতে হয় শক্তি বিকাশ
তার চরণে হয়ে দাস, মধু খায় সে মৃত্যুঞ্জয় ॥
উথলিয়া লোহিত-সাগর, তিন দিন ভাসে লহর
মানুষ গড়া ছাঁচের ভিতর; নতুন মানুষ জন্ম লয় ॥

৮৯

যত দেখি বিশ্ব মাঝে সকলই তোমার দান
কি আশ্চর্য মানব-দেহ সৃষ্টিতে প্রধান।
গয়া কাশী বৃন্দাবনে শ্রীক্ষেত্ৰ পীঠ-স্থানে
সাধন করে সিদ্ধাগণে, নিত্য গঙ্গায় করে স্নান।।
বিলাতে রাজার বাড়ি পঞ্চম জর্জ রাণী মেরী
কলিকাতায় কর্মচারী, সেনা-সৈন্য নেগাবান ।।
তিন দিকে তিনটি তারে মিশে বাহাত্তর হাজারে
দিবানিশি শব্দ করে, মাঝখানে রয় খাড়া নিশান ॥
চৌদ্দ পোয়া জমিদারি পঁচিশজন তার কর্মচারী
ষোলজন মাল-প্রহরী, ছয়জন আছে দারোয়ান ॥

৯০

যাবে যদি ছুটে আয় শোনো তোরে কই মন পাগল
ঘোর অন্ধকার ভয়ের সঞ্চার না আছে পথের সম্বল ॥
অষ্টধাতুর দেহখানি চালাইতেছে খোদ কোম্পানি
তার ভেতরে আছে পানি হাওয়ার যোগে হয় প্রবল ॥
উপরে জ্বলে পরশমণি নিচে ঘুমায় অষ্ট ফনি
হংস রবে উঠছে ধ্বনি সোহহং শব্দে চলাচল ॥
মূলাধার হইতে গিয়া কুম্ভকেতে দম আঁটিয়া
খুঁজতে থাকো চোখ মুদিয়া ধ্যান করে সহস্র দল ॥
ষোল তালায় চাবি দিয়া তিন তারেতে ঝঙ্কারিয়া
শুনতে পাবে কান পাতিয়া নিত্যধামের কোলাহল ॥
আছে দুইটি নিশান খাড়া উপরের তালা বদ্ধ করা
রতন মানিক মধ্যে ভরা নয়টি নালে আসে জল ॥
যাবে যদি প্রেমনগরে দাঁড়াইও না বালুচরে
দিকদর্শন যন্ত্র ধরে জালালে কয় সোজা চল ॥

৯১

রূপের ঘরে ডুব দিয়ে দেখো ‘স্বরূপ’ ছাড়া নাই সাধন
স্বরূপ তোমার সেই রূপ বটে, ঘটে ঘটেই নিরঞ্জন ॥
স্বরূপে রূপ মিশে যাহার, হয়ে যায় একই আকার
কাষ্ঠ লোহা পুড়ে অঙ্গার, আগুনেতে হয় যেমন ॥
খোদার প্রেমে হয় আশেক, মনসুরে কয় ‘আন্তাল হক’
অবশেষে ‘আইনল-হক’-আমিই আমার নিরঞ্জন ॥
বুঝে দেখো ভাবের ঘরে, খেলছে খেলা চার রঙ ধরে
আলেফ-হে-মীম-দাল অক্ষরে যুগে যুগে হয় মিলন ॥
মোহাম্মদে আলেফ নাই, স্বরূপে মিশিলেন সাঁই
এক মীমে ঘেরিল তাই, আহাম্মদের গুলবদন
আউয়ালে আহাদ ইছিম, আহাম্মদে পাইল জিছিম
কালেব লইয়া মিম, আলাপেতেই হয় গোপন
আদমের ‘হে’ উঠাইয়া নিল, হাওয়াতে মিশায়ে দিল
ধরা মানুষ অধর হইল, জালালে কয় পাই না এখন ॥

৯২

রূপের ঘরে দরজা খুলে দেখো না আকাশ-পাতাল ছাড়া
আছে মানুষ তারি কাজে সন্ধ্যা বেলায় কর্ম সারা ॥
ছয়টি গ্রামে এক চৌকিদার পরাণ পেয়াদা জবান সর্দার
থাকে নদীর পুবের পাড় মার্গে দিয়া এক পেরেক মারা,
স্বাধিষ্ঠানে মণিপুরে নদীর পারে হরিণ চরে
ব্যাধে যখন শিকার ধরে নিচে থেকে দেয় নাড়া ॥
অনাহতে বৃষ্টি ঝরে ভেড়া ভেড়ি ভিজিয়া মরে
জ্ঞান ঠাকুরে আগুন ধরে গিয়ে তখন কোনাপাড়া,
রাজাইলের মদনা কুকুর ভেড়া-ভেড়ির মামাশ্বশুর
পঞ্চমে তার ওঠে সুর লেজটা থাকে সদায় খাড়া ।।
জালালে কয় ভাব বুঝিয়া ঘরের ভিতর লও খুঁজিয়া
রসিক নইলে রস মিলাইয়া কে বোঝে মোর ইশারা,
যে করেছে দেহের বিচার ঘুচে গেল তার অন্ধকার
দমের সনে বেঁধেছে তার প্রাণ বঁধুরে হয় না হারা ॥

৯৩

লাভের আশায় করলে কী হায়
আসিয়া এই ভবের হাটে ॥
বাজারের ভাও জানে না,
মনের কানা যমের থানা হয় নিকটে—
ছয়জন আছে কর্মচারী, চালাক ভারী
কেউ না তাদের সঙ্গে আঁটে ॥
আনিলে রত্ন-সোনা, হীরা দানা
করতে দুনা ব্যাপার বটে—
রাস্তায় ডাকাইতে জুটে, নিবে লুটে
ফন্দি কিছুই নাহি খাটে ।।
জালালের পড়ছে লোকসান, মান-অপমান
কিছুই নাহি আছে মোটে—
স্বভাব নষ্ট সঙ্গ-গুণে, নিশিদিনে
বিলায়ে ধন ঘাটে মাঠে ॥

৯৪

সংসার-বিদেশে বিদেশীর বেশে
মিছামিছি এসে কষ্ট পেয়ে যাই রে ॥
কার লাগি করি এই ভূতের চাকুরি
অনাহারে অনিদ্রায় কত ভাবে ঘুরি
করে ধানা-পানা, দেহে তো কুলায় না
বেশি দিন আর বাকি নাই রে ॥
বেজার হয়ে বসে থাকে রমণী রতন
কোথায় কি করো পুত্র-কন্যা-ধন
ডাকি বারেবারে, থাকে আড়ে আড়ে
ধারে-কাছে কারেও পাই না রে ॥
পরেরে আনিয়ে ঘরে আপনার বদল
চক্ষের নেশাতে পড়ে দিয়েছি সকল
আজি সে অভাগী, করে রাগারাগি
ভূতে-পাওয়া রোগী হইয়াছি রে ॥
কী করিতে এসেছিলাম, করে গেলাম কী
মনে হলে কাঁদি আর নয়ন মুছি
যা হবার তাই হলো, জালালে কয় বলো
প্রাণ খুলিয়ে আলেক-সাঁই রে ॥

৯৫

সবাই করে একের আশা এক ভিন্ন আর কিছুই নাই
সর্বাঙ্গ তার খুঁজে নেওয়া জন মানবের সাধ্য নাই ॥
বুঝে দেখো আপন ঘরে, নিশ্বাসে কে ওঠে পড়ে
দুনিয়াজোড়া সব অন্তরে, ডুবাডুবি খেলছে লাই ।।
সদাই সকল জীবের সঙ্গে, ঘুরিতেছে মানোরঙ্গে
শক্তি দিয়া সর্ব অঙ্গে, নিজের নাই একটু ঠাঁই ।।
যদি কেহ দেখিতে চাও, নিজকে আগে চিনে নাও
প্রেমের ঘরে আগুন জ্বালাও, পুড়তে পুড়তে হওগে ছাই ॥
কালি-কলম-কাগজ ফেলে, তৌহিদের শিক্ষা লইলে
আল্লা না হয় খোদা মিলে, প্রাণ থাকিতে দেখো রে ভাই ॥

৯৬

সাধন করবি যদি তোরা
হাইনা তাওয়ায় দিবানিশি, হয়ে যাওগে কামার পোড়া ॥
শেষে যাবে লালবাজারে, চারি রঙের নিশান ওড়ে
অগ্নির মতো ধু-ধু করে মধ্যে জিনিস ভরা;
হে হরফের চাবি দিয়ে, সদায় গিয়ে ঘুরা—
তালা খুললে নয়ন মেলে, দেখবে সাদা তিন কোটরা ॥
তিন তালাতে এক নাম ফোটে, হাহাকার এক শব্দ ওঠে
ঢেউ লাগে ত্রিবেণির ঘাটে, দেখছে রসিক যারা
ভালোবাসা ভবের আশা, মিটাইয়াছে তারা— ঘু
মের ঘোরে রইলে পড়ে, দৌড়াইলেন না দমের ঘোড়া ॥
মোরাকেবার মাঠে ঘুরে, মোসাহেদা আমল করে
লা-মোকামে লাগাম দিয়া, সদায় গিয়ে দৌড়া;
উল্টা পথে ছাড়গে অশ্ব, নইলে যাবে মারা—
দিন থাকিতে হও রে স্বাধীন, পিছনে যমদূত খাড়া ॥
জালাল বলে স্বভাব নিতে, পারিলাম না এ জগতে
হিন্দু কি মুসলমান জাতে, একই ভাবে গড়া,
একই মায়ের লক্ষ সন্তান, কেউ কারো নয় ছাড়া—
ভক্তি শক্তি মুক্তির পথে, শরিয়তে মারফত ঘেরা ॥

৯৭

সাধের তরি বোঝাই ভারি ঠেকিল আজ বালুচরে
মাঝিমাল্লা পলাইয়াছে পাছা নায়ের হাইল ছেড়ে ॥
ছয়জনে ছয়দিকে টানে আমার কথা নাহি শোনে
দয়াল তুমি নিজ গুণে বারণ রাখো এই সবে রে ॥
নিজেই তুমি সাথি হইয়া নৌকা চালাও পাছায় বইয়া
প্রেমের বাতাস তুলে দিয়া পার করে নেও সেই পারে ॥
জালালালের তরিখানি ঘুরছে ফাঁকে দিন-রজনী
রক্ষা করো দয়াল ধনী দীনবন্ধু কই তোমারে ॥

৯৮

সেই পাড়ে তোর বসত-বাড়ি, এই পাড়েতে তোর বাসা
ভব-দরিয়া পাড়ি দিতে কেমনে করলে আশা রে
সেই পাড়ে তোর বসত বাড়ি রে ॥
পরকে লইয়া বসত করো আপন মানুষ ছাড়ি
আপন থুইয়া সদায় করো পরের খবরদারি রে ।।
লাভ করিতে আসল গেল, হইল রে বেদিশা
রতন-কাঞ্চন বদল দিয়া কিনলে দস্তা-সিসা রে ॥
মিছা মায়ায় রইলে বেহুঁশ, পরের বোঝা টানো
শমনজারির পিয়ন আসবে, কোনদিন কি তাই জানো রে ॥
সিন্দুকে তোর লাখ রুপিয়া, পারের কড়ি নাই
খাতিরে কি ছাড়বে তোরে, খেয়াঘাট ভাই রে ॥
জালাল উদ্দীন বলে তোমার, দেশে যাবার পথে—
জালাল যদি হয় কাণ্ডারি, পারবি কোন মতে রে ॥

৯৯

স্কুলেতে ভুলিয়া রইলে সার হলো তোর ধুলাখেলা
সূক্ষ্ম তত্ত্ব বিচার করে জপো তাঁহার নামের মালা ॥
শান্ত, দাস্য, মধুর, সখ্য, বাৎসল্য ভাব করে লক্ষ্য
ছয়জনাকে করো পক্ষ, ঘুচিবে ত্রিতাপের জ্বালা ॥
বিয়োগে সংযোগের প্রীতি, ভাবো তারে দিবারাতি
কামে জ্বালাও প্রেমের বাতি, পূর্ণ হবে ষোল কলা ॥
মরতে পারলে প্রেমের মরা, হিসাবনিকাশ হবে সারা
সমুদ্দুরেও যায় না মারা ভাসতে থাকে সারাবেলা ॥
জালাল উদ্দীন ভাবছে বয়ে, সূক্ষ্ম চিন্তাধারা লয়ে
গুরু যদি দয়াল হয়ে বেন্ধে দেয় তার পারের ভেলা ॥

১০০

স্নান করো ভাই ডুব দিও না যমুনায় গিয়ে
তবে হয়তো ডুবতে পারো, রাজহংসের ভাব ধরিয়ে ॥
খেলাও যদি জল-তরঙ্গ, হয়ে যাবে রতিভঙ্গ
আবেশে অবশ অঙ্গ-মূলধন হারাইয়ে;
সেই নদীতে নোনাপানি, ডুবছে কত ধনী মানী
কাউকে নিয়ে টানাটানি, জোয়ার-ভাটায় পড়িয়ে।।
সাপিনী যে উজান বাঁকে, কয়জন সেই খবর রাখে
সদায় লুকি দিয়ে থাকে, পাওয়া যায় না খুঁজিয়ে;
যখন জলে ঢেউ ছোটে, সাপের মাথায় চন্দ্ৰ ওঠে
প্রেমিক সাধু এসে জোটে, কাষ্ঠের মালা ফেলিয়ে ॥
হিমালয় পর্বতের উপর, আছে একটি সরোবর
জেনে লও সেই খবর শিক্ষাগুরু ভজিয়ে;
কাল কুম্ভীর করে ভ্রমণ, ধরলে খাবে জন্মের মতন
জালাল কয় লাই খেলো মন, বিবেক-হলদি গায় মাখিয়ে ॥

***

অধ্যায় ২ / ২

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন