রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
স্তব্ধ বাদুড়ের মতো জড়ায়ে অযুত শাখা
 দলে দলে অন্ধকার ঘুমায় মুদিয়া পাখা ।
 মাঝে মাঝে পা টিপিয়া বহিছে নিশীথবায় ,
 গাছে নড়ে ওঠে পাতা , শব্দটুকু শোনা যায় । 
আকাশের পানে চেয়ে জাগিয়া রয়েছি বসি ,
 মাঝে মাঝে দু -এক টি তারা পড়িতেছে খসি ।
 ঘুমাইছে পশুপাখি , বসুন্ধরা অচেতনা —
 শুধু এবে দলে দলে আঁধারের তলে তলে
 আকাশ করিয়া পূর্ণ স্বপ্ন করে আনাগোনা । 
স্বপ্ন করে আনাগোনা! কোথা দিয়া আসে যায়!
 আঁধার আকাশ-মাঝে আঁখি চারি দিকে চায় ।
 মনে হয় আসিতেছে শত স্বপ্ন নিশাচরী
 আকাশের পার হতে , আঁধার ফেলিছে ভরি ।
 চারি দিকে ভাসিতেছে চারি দিকে হাসিতেছে ,
 এ উহারে ডাকিতেছে আকাশের পানে চেয়ে —
 বলিতেছে , “ আয় বোন , আয় তোরা আয় ধেয়ে । ” 
হাতে হাতে ধরি ধরি নাচে যত সহচরী ,
 চমকি ছুটিয়া যায় চপলা মায়ার মেয়ে ।
 যেন মোর কাছ দিয়ে এই তারা গেল চলে ,
 কেহ বা মাথায় মোর , কেহ বা আমার কোলে ।
 কেহ বা মারিছে উঁকি হৃদয়-মাঝারে পশি ,
 আঁখির পাতার’পরে কেহ বা দুলিছে বসি ।
 মাথার উপর দিয়া কেহ বা উড়িয়া যায় ,
 নয়নের পানে মোর কেহ বা ফিরিয়া চায় ।
 এখনি শুনিব যেন অতি মৃদু পদধ্বনি ,
 ছোটো ছোটো নূপুরের অতি মৃদু রনরনি ।
 রয়েছি চকিত হয়ে আঁ খির নিমেষ ভুলি —
 এখনি দেখিব যেন স্বপ্নমুখী ছায়াগুলি । 
অয়ি স্বপ্ন মোহময়ী , দেখা দাও একবার ।
 কোথা দিয়ে আসিতেছ , কোথা দিয়ে চলিতেছ ,
 কোথা গিয়ে পশিতেছ বড়ো সাধ দেখিবার ।
 আঁধার পরানে পশি সারা রাত করি খেলা
 কোন্খানে কোন্ দেশে পালাও সকালবেলা!
 অরুণের মুখ দেখে কেন এত হয় লাজ —
 সারা দিন কোথা বসে না জানি কী কর কাজ ।
 ঘুম-ঘুম আঁখি মেলি তোমরা স্বপনবালা ,
 নন্দনের ছায়ে বসি শুধু বুঝি গাঁথ মালা ।
 শুধু বুঝি গুন গুন গুন গুন গান কর ,
 আপনার গান শুনে আপনি ঘুমায়ে পড় ।
 আজি এই রজনীতে অচেতন চারি ধার —
 এই আবরণ ঘোর ভেদ করি মন মোর
 স্বপনের রাজ্য-মাঝে দাঁড়া দেখি একবার ।
 নিদ্রার সাগরজলে মহা-আঁধারের তলে
 চারি দিকে প্রসারিত এ কী এ নূতন দেশ —
 একত্রে স্বরগ-মর্ত , নাহিকো দিকের শেষ ।
 কী যে যায় কী যে আসে চারি দিকে আশেপাশে —
 কেহ কাঁদে কেহ হাসে , কেহ থাকে কেহ যায়!
 মিশিতেছে , ফুটিতেছে , গড়িতেছে , টুটিতেছে ,
 অবিশ্রাম লুকাচুরি-আঁখি না সন্ধান পায় ।
 কত আলো কত ছায়া , কত আশা কত মায়া ,
 কত ভয় কত শোক , কত কী যে কোলাহল-
 কত পশু কত পাখি , কত মানুষের দল । 
উপরেতে চেয়ে দেখো কী প্রশান্ত বিভাবরী —
 নিশ্বাস পড়ে না , যেন জগৎ রয়েছে মরি ।
 একবার করো মনে আঁধারের সংগোপনে
 কী গভীর কলরব চেতনার ছেলেখেলা ,
 সমস্ত জগৎ ব্যেপে স্বপনের মহামেলা ।
 মনে মনে ভাবি তাই এও কি নহে রে ভাই ,
 চৌদিকে যা-কিছু দেখি জাগিয়া সকালবেলা ,
 এও কি নহে রে শুধু চেতনার ছেলেখেলা! 
স্বপ্ন , তুমি এসো কাছে , মোর মুখপানে চাও ,
 তোমার পাখার’পরে মোরে তুলে লয়ে যাও ।
 হৃদয়ের দ্বারে দ্বারে ভ্রমি মোরা সারা নিশি
 প্রাণে প্রাণে খেলাইয়া প্রভাতে যাইব মিশি ।
 ওই যে মায়ের কোলে মেয়েটি ঘুমায়ে আছে ,
 একবার নিয়ে যাও ওদের প্রাণের কাছে ।
 দেখিব কোমল প্রাণে সুখের প্রভাতহাসি
 সুধায় ভরিয়া প্রাণ কেমনে বেড়ায় ভাসি ।
 ওই যে প্রেমিক দুটি কুসুমকাননে শুয়ে ,
 ঘুমাইছে মুখে মুখে চরণে চরণ থুয়ে ,
 ওদের প্রাণের ছায়ে বসিতে গিয়েছে সাধ —
 মায়া করি ঘ টা ইব বিরহের পরমাদ ।
 ঘুমন্ত আঁখির কোণে দেখা দিবে আঁখিজল ,
 বিরহবিলাপগানে ছাইবে মরমতল ।
 সহসা উঠিবে জাগি , চমকি শিহরি কাঁপি
 দ্বিগুণ আদরে পুন বুকেতে ধরিবে চাপি ।
 ছোটো দুটি শিশু ভাই ঘুমাইছে গলাগলি ,
 তাদের হৃদয়-মাঝে আমরা যাইব চলি ।
 কুসুমকোমলহিয়া কভু বা দুলিবে ভয়ে ,
 র বির কিরণে কভু হাসিবে আকুল হয়ে । 
আমি যদি হইতাম স্বপনবাসনাময়
 কত বেশ ধরিতাম , কত দেশ ভ্রমিতাম ,
 বেড়াতেম সাঁতারিয়া ঘুমের সাগরময় ।
 নীরব চন্দ্রমা-তারা , নীরব আকাশ-ধরা-
 আমি শুধু চুপি চুপি ভ্রমিতাম বিশ্বময় ।
 প্রাণে প্রাণে রচিতাম কত আশা কত ভয় —
 এমন করুণ কথা প্রাণে আসিতাম কয়ে ,
 প্রভাতে পুরবে চাহি ভাবিত তাহাই লয়ে ।
 জাগিয়া দেখিত যারে বুকেতে ধরিত তারে ,
 যতনে মুছায়ে দিত ব্যথিতের অশ্রুজল ,
 মুমূর্ষু প্রেমের প্রাণ পাইত নূতন বল ।
 ওরে স্বপ্ন , আমি যদি স্বপন হতেম হায় ,
 যাইতাম তার প্রাণে যে মোরে ফিরে না চায় ।
 প্রাণে তার ভ্রমিতাম , প্রাণে তার গাহিতাম ,
 প্রাণে তার খেলাতেম অবিরাম নিশি নিশি ।
 যেমনি প্রভাত হত আলোকে যেতাম মিশি ।
 দিবসে আমার কাছে কভু সে খোলে না প্রাণ ,
 শোনে না আমার কথা , বোঝে না আমার গান ।
 মায়ামন্ত্রে প্রাণ তার গোপনে দিতাম খুলি ,
 বুঝায়ে দিতেম তারে এই মোর গানগুলি ।
 পরদিন দিবসেতে যাইতাম কাছে তার ,
 তা হলে কি মুখপানে চাহিত না একবার ?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন