দরিয়া-ই-নুর – ৭

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন

অধ্যায় ৭

সান্ধ্যা সাতটার দিকে বাড়িতে ফিরলো মির্জা আশেক। ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, রোজি টিভি দেখছে। চমকে গেল সে।

“আর্জুমান্দ ঘুমায়া গেছে?” জামা ছাড়তে ছাড়তে জানতে চাইলো।

“একটু জ্বর আইছে।’

“ওষুধ দিছোস?”

“ওষুধ খাইবার চায় না। কয়, বেশি বাড়লে দিতে…”

আশেক আর কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর্জুমান্দের ঘরে গিয়ে দেখে বিছানায় শুয়ে আছেন, তার মাথার কাছে বসে আছে চার্লি।

“ঘুমাইতাছে,” বলল ছেলেটা।

আস্তে করে আর্জুমান্দের কপালে হাত রাখলো আশেক, তারপর কিছু না বলে চলে গেল বাথরুমের দিকে। হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এসে রোজির দিকে তাকালো সে। মেয়েটা তার দিকে তাকাচ্ছে না, মুখ ভার করে রেখেছে।

“মন বেজার ক্যান?” বিছানায় বসে জানতে চাইলো।

রোজি কিছু বলল না, টিভিতে সিরিয়াল দেখছে। একগাদা সাজগোজ করা নারী-পুরুষ ড্রইংরুমে এসে দুনিয়ার সবচেয়ে জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপে ব্যস্ত।

“হইছেটা কী?”

রিমোট দিয়ে টিভির সাউন্ড কমিয়ে স্বামীর দিকে তাকালো সে। “পাভেলের লগে তর কী কাম?” কটাকাটাভাবে জানতে চাইলো।

মাথা চুলকালো মির্জা। “চার্লিরে এত কইরা কইলাম…”

“ওরে এইটা নিয়া কিছু কইলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়া দিমু কইলাম!”

হেসে ফেলল আশেক। “আপনেরে তুলকালাম কিছু করা লাগবো না, ম্যাডাম…ওরে কিছু কমু না।”

“ম্যাডাম কইবি না, খবরদার!” রেগে গেল সে।

আবারো হেসে ফেলল মির্জা আশেক। এফডিসিতে ঐ ঘটনার পর থেকে ম্যাডাম বলে সম্বোধন করতো তাকে। সম্পর্ক হবার পর

মাঝেমধ্যে খুনসুটির সময় ম্যাডাম বলে ডাকলেই রোজি ক্ষেপে যেত।

মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। কেমন পাথরের মূর্তির মতো বসে আছে, কোনো সাড়া নেই। “যা মনে আছে কইয়া ফালা…খামোখা কষ্ট পাতাইছোস।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রোজি। “আমার কপালে আছেই কষ্ট…কী আর করুম!”

আশেক মাথা দোলালো। “এমনে কয় না, ময়না আমার।”

“পিরিতি দেখাইবি না,” ঝাড়া মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো সে। “পাভেলের লগে ক্যান দেখা করতে গেছোস? ঠিক কইরা ক…আমার লগে মিছা কথা কইবি না।“

“অনেক দিন পর বাইর হইলাম, ওর লগে দেখা করুম না? পিচ্চিকালের দোস্ত…”

“দোস্ত না বাল!” রেগে গেল রোজি। রাগলে ছেলেদের মতোই গালাগালি করে সে। “ভিরে যখন আছিলি একবারও গেছে তর লগে দেখা করতে? এখন তুই বাইর হইয়া দোস্ত মারাইতে গেছোস!”

“ওর তো প্রবলেম আছিল…বুঝোস না ক্যান।”

“কী প্রবলেম আছিল?”

“অবুঝের মতো কথা কইতাছোস…ভয়ে আমার লগে দেখা করবার যায় নাই।“

“একজন সব কিছু নিয়া ভাগলো, আরেকজন এই শহরে থাইকাও এতগুলান বছরে একবারও খোঁজ নিবার আইলো না!…দোস্তের কী নমুনা!“

“ডরাইতো…শরম পাইতো…বুঝলি না?

পাইতো…বুঝলি না? আমরা তো একলগেই কামটা করছিলাম। তুই আর আর্জুমান্দ যদি ওরে কথা শোনাস…”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রোজি। “সবাই নিজেরটা দেখলো আর মাঝখান থিকা জেল খাটলি তুই!”

এ নিয়ে আশেকের মনের গভীরে যে কষ্টটা আছে সেটা কেউ জানে না। সবচেয়ে বেশি কষ্টের ঘটনাটা দুদুকে নিয়ে।

“তর উচিত আছিল সবগুলার নাম বইলা দেওয়া।”

“তাতে কী লাভ হইতো? আমি জেল থেইকা বাইর হয়া যাইতাম?…খালাস পাইতাম?”

“না পাইতি, তর লগে লগে ওরাও জেল খাটতো। কাম করছোস এক লগে, জেলও খাটতি এক লগেই!”

“পাভেরে ঐ ঘটনায় আমি ইনভল্‌ব করছিলাম, ওর নাম কইলে অন্যায় হইতো। আর ভুইলা যাইস না, আমার কারনেই সব কিছু গুবলেট হইছে।”

“আর দুদু যে বেঈমানি করলো? ওর নামটা কইলি না ক্যান?”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আশেক। “আমারে যখন রিমান্ডে নিছে তখন তো জানতাম দুদুমাস্টার গা ঢাকা দিছে।“

রোজি রাগে ফুঁসলেও কথাটা মেনে নিলো। আশেককে রিমান্ডে নেবার পর দুদু লাপাত্তা হয়ে যায়। তার আগে হুট করে একদিন হাজির হয়েছিল এই বাড়িতে। রোজি তখন অকুল পাথারে পড়ে গেছে। একদিকে আশেক পুলিশ রিমান্ডে, অন্যদিকে আর্জুমান্দ তখনও হাসপাতালে। তাকে আশেকের ব্যাপারটা তখনও জানায়নি। দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকতো রোজি। এ রকম সময়ে এক রাতে দুদুমাস্টার এসেছিল একটা ব্যাগ নিয়ে। ঢাকায় থাকা নিরাপদ না, কিছু দিনের জন্য সে চলে যাবে ঢাকার বাইরে, এক বন্ধুর বাড়িতে-হাসপাতালে রাতে খাবার দিতে এসে চার্লি জানিয়েছিল তাকে।

তখনও রোজি জানতো লোকটা নিরাপত্তার কথা ভেবে গা ঢাকা দিচ্ছে। সেই যে দুদু চলে গেল, এরপর তার টিকিটাও দেখা যায়নি। কোটি কোটি টাকা নিয়ে ভেগে গেছে আদর্শের বুলি কপচানো লোকটা। বিদেশে গিয়ে মওজ করে বেড়াচ্ছে নিশ্চয়।

“দুই বচ্ছর বাদে তর সাজা হওনের পর পাভেল আইছিল একদিন,” আস্তে করে বলল রোজি।

কথাটা শুনে অবাক হলো আশেক।

“আমারে সান্ত্বনা দিয়া কয়, কোনো কিছুর দরকার পড়লে যেন তারে জানাই। এরপর যাওনের আগে কয়, তর ভাগের ট্যাকাগুলান হিসাব কইরা খরচ করলে আমাগো আর চিন্তা করতে হইবো না। চাইলে আমার নামে ব্যাঙ্কে একটা ডিপোজিট কইরা দিবো, মাসে লাখ টাকা পামু ওইখান থেইকা। আমি তাজ্জব হয়া কইলাম, আমার কাছে এক ট্যাকাও নাই, সব দুদুর কাছে…হেয় তো ভাগছে।” স্বামীর দিকে তাকালো রোজি। বিমর্ষ মুখটা নিচু করে রেখেছে। “এরপর পাভেল মিয়ারও আর খোঁজ নাই। মনে করছে খোঁজখবর নিতে গেলে আমরা তার কাছ থিকা টাকা-পয়সা ধার চামু।”

রোজির হাতটা আস্তে করে ধরলো আশেক। “বাদ দে না, পুরানা কথা কইয়া কী হইবো?”

রোজি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।

“কই যাস?”

“মায়ের ঘরে যাই। “

রোজি চলে গেলে উদাস হয়ে চেয়ে রইলো মির্জা আশেক যে কাজ করতে যাচ্ছে সেটা যদি রোজি জানতে পারে তাহলে অনেক কষ্ট পাবে। কিন্তু একটা সময় মেয়েটাকে সব বলতে হবে। হয়তো সে বুঝবে, কখনও কখনও ন্যাড়াকে বেল তলায় দু-বারও যেতে হয়।

দ্বিতীয় বার যেতে হয় বেলটা কুড়িয়ে আনার জন্য!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন