গ্লানির্ভবতি ভারত – ২৫

দেবারতি মুখোপাধ্যায়

“মানে! এরকম লোকজন সত্যিই আমেরিকাতে আছে?” হতভম্বমুখে বলল প্রিয়ম।

রুদ্র ল্যাপটপে হুমড়ি খেয়ে কী দেখছিল আর একটা খাতায় নোট নিচ্ছিল, “আছে কী বলছ! শুভাশিসবাবু না বললে জানতেই পারতাম না! প্রায় দু’লাখের ওপর আমীশ লোক আছে আমেরিকায়। যারা মনে করে, আধুনিক সভ্যতা সমাজের জন্য অভিশাপ। তাই তারা প্রায় মধ্যযুগের মতো থাকে। কোনো মোটরগাড়ি ব্যবহার করেনা, ভিক্টোরিয়ান যুগে যেমন ঘোড়ার গাড়ি চলত, তাতে করে যাওয়া আসা করে। ছেলেরা পুরনোদিনের স্টাইলের লম্বা ওভারকোট আর টুপি পরে, মেয়েরা পরে সর্বাঙ্গ ঢাকা গাউন। ফোন বা ইলেক্ট্রিসিটি ব্যবহার তো দূর, এরা দেশের কারেন্সিও ব্যবহার করে না।”

“মানেটা কী!” প্রিয়ম হাঁ করে শুনছিল, “খাওয়াদাওয়া পায় কোত্থেকে? বেঁচে থাকে কী করে?”

“এরা বিশাল কোনো অঞ্চল জুড়ে থাকে। সেখানে নিজেরাই চাষবাস করে, গরু পোষে, ভেড়া পোষে। নিজের ক্যাটল, নিজেদের ফার্ম। কেউ ঘোড়ার নাল তৈরি করে, কেউ পোশাক তৈরি করে। টাকাপয়সার কোনো ব্যাপার নেই, পুরোটাই চলে বিনিময় প্রথায়। অর্থাৎ তুমি আমাকে দুধ দাও, আমি তোমায় জামা দেব, এইরকম আর কী। বাচ্চাদের জন্য ওই অঞ্চলের মধ্যেই স্কুল আছে। তাতে প্রধানত পড়ানো হয় বাইবেল। ধর্মীয় পাঠ দেওয়া হয়। তাও তেরো-চোদ্দো বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর আর পড়িয়ে কি হবে, সবাই তো নিজেদের মধ্যেই থাকবে।”

প্রিয়ম বলল, “কী অদ্ভুত! কেন, এরা কেন করে এরকম?”

রুদ্র নোটবুকে কী লিখতে লিখতে বলল, “এরা মনে করে, সমাজ যত আধুনিক হচ্ছে, প্রযুক্তি, যান্ত্রিকতা তত বেশি গিলে খাচ্ছে মানুষকে। পারিবারিক সময় কমে যাচ্ছে। তাই এরা কম্পিউটার তো দূর, টেলিফোনও ব্যবহার করে না। এমনকি ইলেক্ট্রিসিটিও নয়। আর একটা আধটা জায়গা নয়, আমেরিকার পেনসিলভ্যানিয়া, নিউ ইয়র্ক, ওহিও, মেরিল্যান্ড, মিশিগান এরকম বহু জায়গায় নিজেদের ক্লোজড এরিয়ায় বাস করে এই আমীশরা। এদের বার্থ রেটও ভীষণভাবে বেশি। একটা আমীশ দম্পতির গড়ে ছ’ থেকে সাতটা করে সন্তান। গোঁড়া ক্যাথলিক বলে এরা গর্ভপাতকেও পাপ মনে করে। আর নিজেদের মধ্যেই বিয়ে হয় বলে এদের মধ্যে বামন বা ওইজাতীয় জিনগত সমস্যা অনেক বেশি। এরা আধুনিক কোনো ওষুধও ব্যবহার করে না। কোনো মানুষের আয়ু শেষ হওয়ার সময় এলেও ওষুধ দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখাকে এরা তীব্র পাপ মনে করে। শারীরিক কোনো অসুস্থতায় কষ্ট পাওয়াটাও এদের কাছে পুণ্য। একবার এক ডাক্তারের ওপর ওরা হামলাও চালিয়েছিল। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আমীশ সমাজে বিনা চিকিৎসায় একেকজনকে মেরে ফেলার খবর নিয়ে গোটা আমেরিকায় অনেক ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কিছু হয়নি। এখন সরকারও এদের বেশি ঘাঁটায় না। ওদের জন্য অনেকরকম ছাড়ও রয়েছে। গোটা সমাজের দণ্ডমুণ্ড কর্তা হয় চার্চের ধর্মযাজক। তাঁর কথাই একটা আমীশ সম্প্রদায়ে শেষ কথা।”

প্রিয়ম ততক্ষণে নিজের ফোন ঘাঁটতে শুরু করেছিল, “সত্যিই তো। এই তো আমীশদের ছবি। মাঝে মাঝে দেখছি তাদের দু-একজন আধুনিক সমাজে পালিয়েও আসে। খুব অদ্ভুত!”

“অদ্ভুত হতে পারে।” রুদ্র বিড়বিড় করল, “কিন্তু এই অদ্ভুত বিষয় ধরেই আমি অনেকটা আলো দেখতে পাচ্ছি, প্রিয়ম! তোমার ওই শুভাশিসবাবু আমাকে যে সাহায্য করলেন, তা বলে বোঝাবার নয়।”

“কীভাবে?” প্রিয়ম বলল, “আমেরিকার আমীশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে তোমার এই সিরিয়াল কিলিং এর কী সম্পর্ক?”

 রুদ্র বলল, “তর্কপঞ্চাননের ফ্যামিলিতে তিন প্রজন্ম আগে একজনকে দত্তক নেওয়া হয়। শুভাশিসবাবুরা তাঁকে ডাকতেন নকল দাদু বলে। সেই দত্তকপুত্র অল্প বয়সেই আমেরিকায় চলে যান। পড়াশুনো করতে। সেখানে গিয়ে কোনভাবে একটা আমীশ সম্প্রদায়ের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। সাধারণত আমীশরা বাইরের জগতের সঙ্গে তেমন মিশতে চায় না, কিন্তু ইনি কোনোভাবে তাদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। বলা ভালো, আমীশদের জীবনযাত্রায় তিনি বেশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এটা গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা।”

“ইন্টারেস্টিং!” প্রিয়ম মন দিয়ে শুনছিল। রুদ্র থামতেই বলে উঠল, “তারপর? তিনি কি ক্যাথলিক ধর্মগ্রহণ করেছিলেন?”

“সেই ব্যাপারে শুভাশিসবাবু আর কিছু বলতে পারলেন না। তবে বললেন, একবার দেশে এসে তিনি নিখোঁজ হয়ে যান। তাও প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। তারপর তিনি আবার আমেরিকায় ফিরে গিয়েছেন, না কী করেছেন, কেউ জানে না।”

“তো? তার সঙ্গে তোমার এই খুনগুলোর কি সম্পর্ক?”

“সম্পর্ক আমি একটা পেয়েছি। কিন্তু, সেটা কতটা জোরালো, তা বুঝতে সময় লাগবে। বাসুদেব ভবন নার্সিং হোমের মালিক ড. সুবল ভট্টাচার্য খুন হওয়ার পরই সেটা আরও বেশি করে মাথায় এল। বোঝাচ্ছি, দ্যাখো।” রুদ্র টেবিল থেকে একটা খাতা টেনে নিল।

“এই যে সাতজন খুন হয়েছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যোগসূত্রটা কী জানো প্রিয়ম? আমাদের চোখের সামনেই জ্বলজ্বল করছে, অথচ আমরা কেউ ধরতে পারিনি! কখনো হুগলী, কখনো ব্যবসায়ী এইসব উলটোপালটা লিঙ্কে বিভ্রান্ত হয়েছি।” রুদ্র বলল।

“কী?”

“এরা প্রত্যেকেই এমন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, যেগুলো আধুনিক সভ্যতার অঙ্গ। তুমি দ্যাখো। সাইবার ক্যাফে, মোবাইল, ইনভার্টার, চশমা, রিয়েল এস্টেট। সব! এমনকি হাসপাতালও। যেখানে অসুস্থকে সুস্থ করে তোলা হয়। যেখানে অপারেশন করে কৃত্রিমভাবে সারিয়ে তোলা হয়। আমীশরা এইসবকিছুকে ঘৃণা করে। এই সব ক’টাকে জিনিসকে তারা মনে করে প্রাকৃতিক নিয়মের পরিপন্থী!”

প্রিয়ম মন দিয়ে দেখছিল। তারপর বলল, “তার মানে তুমি বলছ, শুভাশিসদা’র ওই নকলদাদু এখানে এসে আমীশ সমাজের শাখা খুলেছেন?”

“সেটা বলার মতো সময় এখনো আসেনি, প্রিয়ম।” রুদ্র বলল, “তবে আমার মনে হচ্ছে, এদের মধ্যে একটা বিরাট সুতো রয়েছে। সেই সুতোটাকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তার জন্য আমায় আবার যেতে হবে বাগডাঙার ওই আশ্রমে। যেতে হবে বদনপুর বলে একটা গ্রামেও।”

“বাগডাঙার আশ্রম মানে যেখানে ওই স্বপন সরকার আর হৃষীকেশ জয়সোয়াল একসঙ্গে যেতেন?” প্রিয়ম বলল, “সেটা আবার পিকচারে আসছে কী করে!”

“পিকচারে আসছে কারণ, বাগডাঙার সেই আশ্রমের বইয়ের তাকে আমি একটা বহু পুরনো বই দেখতে পেয়েছিলাম।” রুদ্র বিড়বিড় করল, “বিবাদভঙ্গার্ণব! আমি নিঃসন্দেহ, এই গোটা ব্যাপারটার সঙ্গে জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন বিরাটভাবে জড়িয়ে আছেন। দেখি, সব শুনে এস পি স্যার কী বলেন!”

২৬

বদনপুর গ্রামের একেবারে নদীর ধারে যে চণ্ডীমন্দিরটা রয়েছে, তা কতকালের পুরনো কেউ জানেনা। মন্দিরের একদিক ভেঙে ভেতরের হাড়পাঁজরা বেরিয়ে এসেছে। সেই গর্তের মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে বট অশ্বত্থের ঝুরি। মন্দিরের চূড়াটা এককালে বেশ উঁচু ছিল বোঝা যায়। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মাঝে মাঝেই ইট খসে পড়ে সেখান থেকে।

ভেতরের গর্ভগৃহের মাঝখানে থাকা মা চণ্ডীর বিগ্রহটি পাথরের। পর্যাপ্ত সূর্যালোকের অভাবে মা সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

যে গ্রামে মানুষই পেট পুরে খেতে পায় না, সেই গ্রামে আবার মন্দিরের সংস্কার কে করে?

অথচ বছর পঞ্চাশ আগেও বদনপুর গ্রাম বেশ সচ্ছল ছিল। চৌধুরীরা ছিল উচ্চবংশজাত পরিবার। এখানকার সাবেক ভূম্যধিকারী, তাদের প্রচুর জমিজমার ওপর ভিত্তি করে মূলত চলত বদনপুরের গরিব কৃষিজীবী পরিবারগুলো। চৌধুরীদের ঠাটবাট, দুর্গাপুজোর আশনাই গোটা হুগলীর লোকেদের চোখ ট্যাঁরা করে দিত। ছোটবড় জমিদাররা তো বটেই, শোনা যায়, সাহেবসুবোরাও নাকি নিয়মিত আসত চৌধুরীবাড়ির নাচমহলের আসরে।

কিন্তু চৌধুরীরা এখানকার পাট চুকিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছে বহুবছর হল। তারপর থেকেই গ্রামটা আস্তে আস্তে শ্মশান হয়ে যাচ্ছে।

এখন গ্রামে সাকুল্যে ত্রিশ ঘর লোক বাস করে। অধিকাংশই দিন আনে দিন খায়। আর যারা একটু পয়সার মুখ দেখে, চলে যায় চুঁচুড়া বা চন্দননগরের দিকে। এইভাবেই গত অর্ধশতকে বদনপুর প্রায় ফাঁকা হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু একটা মানুষ শতকষ্টেও বদনপুর ছাড়ার কথা ভাবতে পারে না।

সে হল চণ্ডী মন্দিরের বংশপরম্পরায় পুরোহিত কানু চক্রবর্তী। প্রায় ছয় প্রজন্ম ধরে কানু চক্রবর্তীর পরিবার চণ্ডী মন্দিরের পুজো করে আসছে। চৌধুরীরা গ্রামে থাকাকালীন তারাই এই মন্দিরের সেবাইত ছিল, তাদেরই বেতনভুক পুরোহিত হিসেবে কানু চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষরা চণ্ডী মন্দির দেখভাল করত।

কিন্তু এখন আর ওসবের কোনো পাট নেই। কানু চক্রবর্তী নিজেও ওসবের পরোয়া করেনা। সে একটু খ্যাপাটে গোছের লোক, বিয়ে থা করেনি। বয়স ষাটের ঘরে হলেও খিটখিটে স্বভাবের জন্য তাকে আরও অনেক বেশি বয়স্ক দেখায়। মন্দির থেকে কয়েক গজ হাঁটা পথে তার বাপঠাকুরদার আমলের একচিলতে কুঁড়েঘর। সেখানে অবশ্য সে শুধু রাতটুকু থাকে। দিনের বাকি সময়টা পুরোটাই সে কাটায় চণ্ডী মন্দিরে আর নদীর ধারে। সপ্তাহে শুধু একদিন ঢোকে গ্রামের ভেতরে। গরিবগুর্বো মানুষরা এই ‘ক্ষ্যাপা পুরুত’কে চালডাল যেটুকু সামান্য পারে, দেয়। কানু চক্রবর্তী একাহারী, ওতেই হয়ে যায়।

সবসময় সপ্তমে চড়ে থাকে তার মেজাজ। গ্রামের লোকেরা তার সেই তিরিক্ষি মেজাজের ভয়ে পারতপক্ষে এদিকে আসেনা, দুষ্টু ছেলেছোকরারা কেউ কখনো এসে চণ্ডী মন্দির তল্লাটে খেলতে চেষ্টা করলে চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে অকথ্য গালাগালি করে তাদের পালাতে বাধ্য করে কানু চক্রবর্তী।

গ্রামের লোকেরাও তাই তাকে ঘাঁটায় না। একেই সব দীনদরিদ্র, রোজ মন্দিরে আসার সময় কোথায়? তার ওপর নামেই চণ্ডী মন্দির, এতকালের অযত্নে যেন পোড়োবাড়িতে পরিণত হয়েছে মন্দিরটা। পাশেই সরু নদী, সেই নদীর হাওয়া গায়ে মেখে এক প্রাচীন আত্মার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

গোটা চত্বরটাই যেন কেমন ভূতুড়ে!

গ্রামের সবাই জানে, কানু চক্রবর্তী মরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই মন্দিরও মরে যাবে।

কানু চক্রবর্তী নিজের মনেই থাকে। ভোরবেলা উঠেই সে চলে আসে মন্দিরে। তারপরের কয়েকঘণ্টা ধরে চলে পুজোর আয়োজন, উপাচার। সে নিজেই পূজারি, নিজেই দর্শক, নিজেই ভক্ত। প্রায়ান্ধকার গর্ভগৃহে একাকী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সে কী করে জানে!

দিনান্তে সব মিটে গেলে কিছু মুখে দেয়, তারপর চুপচাপ গিয়ে বসে থাকে নদীর পাড়ে।

গ্রামের সবাই নদী বলে বটে, আসলে এটা একটা খাল। গঙ্গা থেকে পশ্চিমমুখে বয়ে এসেছে। তবে গভীর, গ্রীষ্মকালেও বেশ জল থাকে। খালের একটা দিক আবার গিয়ে মিশেছে রুগণ সরস্বতী নদীতে।

সূর্য পশ্চিমে ধীরে ধীরে হেলতে থাকে, পাখিরা ক্লান্ত দেহে ঝাঁক বেঁধে ফেরে বাসায়, কানু চক্রবর্তী একা উদাস মুখে বসে থাকে। বসে বসে সে কী যে ভাবে! তার কাঁচাপাকা দাড়ি নেমে এসেছে গলার নীচ পর্যন্ত, ঘাড় পর্যন্ত চুল আর সাদা ধুতি ফতুয়ায় তাকে কেমন যেন অরণ্যের প্রাচীন ঋষি বলে মনে হয়। তারপর একসময় ঝুপ করে নেমে আসে সন্ধ্যা। অন্ধকার গভীর হলে কানু চক্রবর্তী ধীর পায়ে ফিরে যায় নিজের বাসস্থানে। তার চোখদুটো তখন থাকে অন্যমনস্ক।

সেদিনও সে এইভাবে বসে ছিল নদীর চরে। বসে বসে কত কী ভাবছিল। তার গোটা শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতিতে উজ্জ্বলভাবে রয়েছে গ্রামের আলোকিত ছবি। চৌধুরীবাড়ির দুর্গাপুজো, নদীর চরে মায়ের বিসর্জন, নানারকমের পুজোপার্বণ।

সব মুছে গিয়েছে। শুধু সে একা বেঁচে রয়েছে অতীতের গৌরবের জীবাশ্ম হয়ে। হাজার ঘটনা বুকে চেপে। তার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে সেইসব স্মৃতি। বিলুপ্ত হয়ে যাবে অনেক ঘটনা।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা কাতড়ানোর শব্দে বর্তমানে ফিরে এসেছিল কানু চক্রবর্তী। এই নির্জন নদীর চরে হঠাৎই যেন শুনতে পেয়েছিল কারুর গুমড়নোর আওয়াজ।

একটু খুঁজতেই দেখতে পেয়েছিল ছেলেটাকে। চরের কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে পড়েছিল সে। চোখ প্রায় দেখা যাচ্ছিল না। পাড়ের লাল পিঁপড়েগুলো কামড়ে সে’দুটোকে ফুলে ঢোল করে দিয়েছে। হাতপায়ে ছড়ে যাওয়ার অজস্র দাগ।

প্রচণ্ড জ্বরে ছেলেটা বেহুঁশ, ওই অবস্থাতেই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে যন্ত্রনার গোঙানি।

কান পেতে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে বোঝা যায়।

“উঃ মাগো কী কষ্ট! … ওকে ছেড়ে দাও … বাইরে … বাইরে চলে যাওয়াই ভাল … আহ! লাগছে … আমাকে ছাড়ো!”

কানু চক্রবর্তী কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে ছেলেটাকে সরিয়ে আনতে যেতেই থমকে গিয়েছিল।

ছেলেটার ঘাড়ের কাছটায় দগদগে ঘা, অনেকটা জায়গা যেন খুবলে খেয়েছে কোনো বন্য জন্তু! রক্ত আর মাংস ডেলা পাকিয়ে আছে সেখানটায়।

কানু চক্রবর্তী সাময়িক থমকালেও অবাক হয়নি।

কারণ কাদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকলেও ছেলেটার মুণ্ডিত মস্তক ও পেছনের লম্বা টিকিটা ততক্ষণে ওর চোখে পড়ে গিয়েছিল।

২৭

আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ। একটু আগেই একপশলা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে এদিকে। চারপাশের সবুজ গাছপালা, শস্যখেত ভিজে গিয়ে ঝকঝক করছে। ভিজে মাটিতে সোঁদা গন্ধ। পাখির কিচিরমিচির। বাগডাঙা গ্রামের হাট, বসতি এলাকা একটু দূরে। এদিকটা শুধুই বিঘের পর বিঘে খেত। তারই মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরলাশ্রম। নিস্তব্ধ, নীরব হয়ে।

রুদ্র গাড়ি থেকে নেমে সোজা এগিয়ে গেল আশ্রমটার দিকে। সঙ্গে এসেছেন লোকেশ ব্যানার্জি আর জয়ন্ত। রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে আল বরাবর হাঁটছিল ওঁরা।

আগেরদিন গাড়ির শব্দ পেয়েই যেমন বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন সেই ভর্তৃহরি মহারাজ, আজ তেমন কেউ এল না। বাইরে একটা সাধারণ কচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা গেট। রুদ্ররা সেটা খুলে ঢুকল আশ্রমের মধ্যে।

আগেরদিন সামনের দালান দিয়ে মাঝে মাঝেই হেঁটে যাচ্ছিল ধুতি ফতুয়া পরিহিত মুণ্ডিত মস্তক আবাসিক ছাত্ররা। আজ তারাও কেউ নেই।

জয়ন্ত ফিসফিস করল, “কোনদিকে যাবেন ম্যাডাম?”

রুদ্র উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল সেইদিকে, যেদিকে আগের দিন ওকে নিয়ে গিয়েছিলেন মহারাজ। চাতাল পেরিয়ে সেই উপাসনাগৃহ। কিন্তু বাইরে বড় তালা ঝুলছে।

“ভাঙব?” জয়ন্ত বলল।

“না।” রুদ্র চাপাস্বরে বলল। ওয়্যারান্ট ছাড়া এভাবে প্রাইভেট প্রপার্টি ভেঙে ঢুকে সার্চ করা যায় না, সেটা আইনবহির্ভূত। ও ভেতরে ঢোকার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে গোটা আশ্রমটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল।

আশ্রমের আয়তন খুব বড় না হলেও ভেতরে বেশ বৈচিত্র্য রয়েছে। একদিকে উপাসনাঘর, অন্যদিকে দুটো ছোট ছোট একতলা বাড়ি। বোধ হয় ছাত্রদের থাকার আবাস। মাঝখানটা বেশ কিছুটা খোলা জায়গা, তাতে বেশ যত্ন করে ফুলের চাষ করা হয়েছে।

“অদ্ভুত ব্যাপার!” লোকেশবাবু বললেন, “গোটা আশ্রম পড়ে রয়েছে, সব গেল কোথায়?”

আশ্রমের একেবারে পেছনদিকে চলে গেল রুদ্র। সেদিকে একটা ঘাট। সামনে সরু একটা খাল।

“এই খালটা কোথায় গিয়ে মিশেছে?” রুদ্র জিজ্ঞেস করল।

“কী জানি, বুঝতে পারছি না।” জয়ন্ত ঠোঁট উলটোল। দশমিনিটের মধ্যে ও আশ্রমের বাইরে গিয়ে রাস্তায় পৌঁছে একটা স্থানীয় লোককে ডেকে আনল।

রুদ্র তখন হাঁটু গেড়ে বসে রয়েছে ঘাটে। ঘাটটা বাঁধানো হলেও বেশ ভগ্নদশা। সিঁড়ির ধাপের ওপর আশপাশের নারকেল গাছের ডালপালা পড়ে রয়েছে।

প্রায় আটটা ধাপের পর ছলাত ছলাত এসে পড়ছে খালের জল।

স্থানীয় লোকটির নাম পরেশ। সে বাগডাঙা হাটের দিকে থাকে।

রুদ্রর প্রশ্নের উত্তরে বলল, “এই আশ্রম অনেক পুরোনো দিদিমণি। তা প্রায় বছর পঁচিশ তো হবেই। কিন্তু আমরা বিশেষ আসি না। আসলে আশ্রমের সন্ন্যাসীরা কারুর সঙ্গে মেশেন না। নিজেদের মতো থাকেন।”

“বাইরে থেকে যারা আসেন, তাঁরা?”

পরেশ হকচকিয়ে বলল, “সবাই তো আশ্রমের নৌকোতে করেই আসেন, দিদি। খুব কমই গাড়িতে করে আসেন।”

“আশ্রমের নৌকো?” রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কোথায় সেই নৌকো?”

পরেশ আঙুল তুলে বলল, “এখানেই বাঁধা থাকে। আজ তো দেখছি না।”

“এই খাল কোথায় গিয়েছে?”

“আজ্ঞে, এঁকেবেঁকে অনেকটা গিয়েছে, তারপর গিয়ে মিশেছে সরস্বতী নদীর সঙ্গে। সেই নদীও এখন সরু, অ্যাত্তটুকুন।” লোকটা হাত দিয়ে দেখাল, “সেই সরস্বতী বরাবর গেলেই গঙ্গা।”

“গঙ্গা!” বিড়বিড় করল রুদ্র। তারপর বলল, “এদিক থেকে সুগন্ধা কতদূর?”

“সুগন্ধা?” লোকটা মাথা চুলকোল, “বলতে পারব না দিদি। এদিক থেকে পুবদিক বরাবর গেলে পরপর অনেকগুলো গ্রাম পড়বে। জারুরা, ভুশনারা, বদনপুর …।”

লোকেশবাবু রুদ্রর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাতেই রুদ্র চোখের ইশারায় চুপ করতে বলল।

২৮

নবদ্বীপাধিপতি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় গুণগ্রাহী যুবাপুরুষ। তিনি নিজে সংস্কৃত ও ফারসি ভাষায় সুপণ্ডিত, সুযোদ্ধা এবং সংগীতজ্ঞ। মুঘল সম্রাট আকবরের মতো তাঁর রাজসভাতেও নবরত্নের সমাহার।

নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক শঙ্কর তর্কবাগীশ, পণ্ডিত গোস্বামীপাদ গোপালকৃষ্ণ বিদ্যাবাচস্পতি, কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, হরিরাম তর্কালঙ্কার ছাড়াও তাঁর রাজসভার শোভাবর্ধন করে থাকেন কালীভক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। এছাড়া ছায়ার মতো সভা আলোকিত করেন ঘূর্ণি গ্রামের গোপাল চন্দ্র ভণ্ড।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্র দ্বৈত চরিত্রের সমাহার। একদিকে তিনি প্রজাবৎসল, বিদ্যা ও শিল্পকলার পরম পৃষ্ঠপোষক, সমগ্র রাঢ়বাংলার অসংখ্য পণ্ডিত তাঁর বৃত্তিভোগী। অন্যদিকে তিনি অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী, কূটকৌশলী ও আদিরসাত্মক রচনায় উদগ্রীব। নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে কারুর সম্পত্তি গ্রাসে তাঁর হৃদয় কাঁপে না। অন্নদামঙ্গলের মতো অনন্য রচনার পর তাঁরই প্ররোচনায় ভারতচন্দ্র লিখেছেন বিদ্যাসুন্দর। যার ছত্রে ছত্রে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি আহত করেছে পাঠককুলকে।

আজ কৃষ্ণচন্দ্রের আয়োজিত সুবিশাল বাজপেয় যজ্ঞের অন্তিম দিবস। বিদেশের সমস্ত স্বনামধন্য পণ্ডিতদের উপযুক্ত পারিতোষিকসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করানো হচ্ছে। তাঁর যজ্ঞ সার্থক হয়েছে। যজ্ঞের আয়োজনে হৃষ্টচিত্ত হয়ে তামাম পণ্ডিতকুল তাঁকে ভূষিত করেছেন বহুকাঙ্ক্ষিত ও অতিসম্মানীয় উপাধি ‘অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী’তে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো অজ্ঞাত কারণে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিমর্ষ চিত্তে বসেছিলেন নিজের রাজসভায়। তাঁর মুখমণ্ডল থেকে ঝড়ে পড়ছিল হতাশা।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভার দুটি ভাগ। প্রথমার্ধে তিনি শুধুই রাজকার্যে ব্যস্ত থাকেন। থাকেন মন্ত্রী, দেওয়ান, সেনাপতি ও অন্যান্য অমাত্যরা। প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শোনা, আদেশনামা জারি করা, দলিলে স্বাক্ষর করা এইসব প্রশাসনিক কাজ চলে। সেইসব কাজ সমাপ্ত হলে একদণ্ডের বিরতি। রাজা তখন পার্শ্ববর্তী কক্ষে প্রাতঃরাশ সারেন। প্রশাসনিক কর্মচারীরা প্রস্থান করেন, আগমন হয় পণ্ডিত, সংগীতজ্ঞ ও কবিদের।

আজ অবশ্য দ্বিতীয়ার্ধে রাজসভা প্রায় জনশূন্য। সভাসদরা সকলেই গিয়েছেন বাজপেয় যজ্ঞে অভ্যাগতদের বিদায় জানাতে। কয়েকদিন সভা বন্ধ থাকার পর আজই খুলেছে, কাজ বিশেষ নেই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ, কবি বাণেশ্বর বিদ্যালংকার ও রামপ্রসাদ ছাড়া কেউ নেই সভায়। তিনজনে আলোচনা করছিলেন যজ্ঞ উপলক্ষ্যে সংঘটিত হওয়া সাম্প্রতিক নানা শাস্ত্রবিচার সম্পর্কে।

কৃষ্ণচন্দ্রের মুখ যদিও ম্লান। কাশী, মিথিলা, কান্যকুব্জ, এমনকি সুদূর দ্রাবিড় থেকে বহু অর্থব্যয়ে তিনি একাধিক পণ্ডিতকে সমাদরে নিয়ে এসেছিলেন নবদ্বীপে। সমানে সমানে হওয়া তর্কযুদ্ধ দেখার বাসনায়।

কিন্তু তাঁর সেই বাসনা পূর্ণ হয়নি বললেই চলে। যজ্ঞের প্রথম চারদিন সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু তাঁকে স্তম্ভিত করে পঞ্চম দিনে এসে প্রায় একশো ছাত্র নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন ত্রিবেণীর জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন। বিনা আমন্ত্রণে আগমনে রাজা প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও সৌজন্যবশত তিনি আতিথেয়তা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ব্যবস্থা করতে গিয়েছিলেন পণ্ডিতের আহারাদি-বাসস্থানেরও। রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে দুটি বিশাল ইমারত গড়ে তোলা হয়েছে পণ্ডিতদের জন্য। সেখানে আরো একজন পণ্ডিতের ব্যবস্থা করা একেবারেই কঠিন নয়।

কিন্তু রোমশ পণ্ডিত সেসবের ধার মাড়াননি। কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে কোনরকম বাক্যবিনিময় না করে তিনি সটান উপনীত হয়েছিলেন শাস্ত্রবিচার মণ্ডপে। স্মৃতি থেকে ন্যায়, বেদান্ত থেকে অদ্বৈতবাদ, সভামণ্ডপে একের পর এক অনুষ্ঠিত হওয়া তর্কযুদ্ধে পরাস্ত করতে শুরু করেছিলেন দেশ বিদেশের সমস্ত পণ্ডিতকে। জগন্নাথতোড়ে ভেসে গিয়েছিলেন আসমুদ্রহিমাচলের সব পণ্ডিত।

তাঁর পাণ্ডিত্যপ্রতিভার সামনে, অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তির সামনে কেউ সেভাবে দাঁড়াতেই পারেননি। দর্শকমণ্ডলী পর্যন্ত ক্রমাগত জগন্নাথ পণ্ডিতের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।

এখানেই শেষ নয়। দিনান্তে কৃষ্ণচন্দ্র আবার গলবস্ত্রে আতিথেয়তা গ্রহণ করার অনুরোধ নিয়ে গিয়েছিলেন। অন্তর থেকে সেই ইচ্ছা না থাকলেও লোকনিন্দার ভয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের সামনে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেছিলেন অনেক কায়ক্লেশে বাজপেয় যজ্ঞ করছেন, পণ্ডিতও তাতে যোগদান করলে রাজা আহ্লাদিত হবেন।

আর তখন পণ্ডিত কী বললেন?

ভাবলেই এখনো শরীরে রক্তসঞ্চালন দ্রুত হয়ে উঠছে কৃষ্ণচন্দ্রের। নিঃশ্বাস পড়ছে দ্রুত। স্তম্ভিত হচ্ছেন একজন ব্রাহ্মণের ঔদ্ধত্যে।

জগন্নাথ পণ্ডিত প্রকাশ্য সভায় রাজার কাতর অনুরোধে শ্লেষসূচক হেসে বলেছিলেন, “বাজপেয় যজ্ঞ? হাসালেন রাজা। যে যজ্ঞে স্বয়ং জগন্নাথ রবাহূত, সে আবার কীসের যজ্ঞ?”

কথাটা বলে সদর্পে প্রস্থান করেছিলেন রাজমণ্ডপ থেকে। অদূরে কোন এক ব্রাহ্মণ আবাসে তিনি নিজেই সশিষ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।

তারপর যজ্ঞের অবশিষ্ট প্রতিটি দিন এসেছেন, সমস্ত অতিথি পণ্ডিতের দর্পচূর্ণ করেছেন, আবার ফিরে গিয়েছেন।

এইভাবে গোটা যজ্ঞের পরিবেশ পণ্ড করার পর অবশেষে জগন্নাথ পণ্ডিত কাল নদীয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।

সঙ্গে ভূলুণ্ঠিত করে দিয়ে গিয়েছেন কৃষ্ণচন্দ্রের সম্মান। এক কলসি দুগ্ধে একফোঁটা গোমূত্রের মতোই।

এত দম্ভ? এত দার্ঢ্য? কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং নদীয়াধিপতি, হিন্দুকুলপতি, শাস্ত্রচূড়ামণি তাঁর প্রতি কোনো সম্মান প্রদর্শন নেই?

পণ্ডিত শঙ্কর তর্কবাগীশ বললেন, “আর বিমর্ষ হয়ে থাকবেন না রাজামশাই। অতিথিরা একে একে প্রস্থান করছেন, তাঁদের বিদায় সম্ভাষণ করার জন্য আপনার সেখানে উপস্থিতি একান্তই প্রয়োজন। অন্যথায় বড় দৃষ্টিকটু দেখায়।”

কৃষ্ণচন্দ্র রক্তাভ চোখে তাকালেন। এখনো অবধি এই প্রসঙ্গে সভাসদদের সকলেই তাঁকে সমর্থন করেছেন, একযোগ হয়ে প্রত্যেকে নিন্দা করেছেন তর্কপঞ্চাননের এই মাত্রাহীন ঔদ্ধত্যের।

ব্যতিক্রম শুধু একজন। রামপ্রসাদ সেন একটি মাত্রও কথা বলেননি। সেই কারণটিও তাঁর জানা।

রাজা ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললেন, “আপনারা সবাই যতই সমালোচনা করুন, সাধক রামপ্রসাদ যে কিছুতেই রোমশ পণ্ডিতের সমালোচনা নিতে পারেন না! তাই তিনি মৌন। তাঁর কালী মায়ের গাত্রবর্ণের সঙ্গে পণ্ডিতের বড় মিল কিনা, হা হা!”

 রামপ্রসাদ কী যেন ভাবছিলেন। রাজার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বললেন, “না তা নয়, রাজামশায়। তবে এটা তো মানবেন, জগন্নাথ পণ্ডিত একাই বাংলার মান রক্ষা করল। নাহলে আমাদের রাঢ়বাংলার পণ্ডিতরা তো বিদেশিদের যুক্তির সামনে দাঁড়াতেই পারছিলেন না! আমার মনে হয়, আপনি আর উনি, দুজনেই সমান বিদ্বান, নিজেদের মধ্যে আর এমন কলহ করে আমাদের বেদনার উদ্রেক করবেন না।”

“তুমি ভোলাভালা মানুষ, রামপ্রসাদ!” কবি বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার বলে উঠলেন। জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের জন্য তাঁর সেই হেনস্থার কথা তিনি এখনো বিস্মৃত হননি। উষ্মাভরা কণ্ঠে বললেন, “ত্রিবেণীর জগন্নাথ পণ্ডিত অত সোজা মানুষ নয়। সে রাজার যজ্ঞে নিমন্ত্রণ না পাওয়ার অপমান এত সহজে ভুলবে বলে মনে হয় না। দেখবে, এর প্রতিশোধ সে নেবেই!”

“প্রতিশোধ?” শঙ্কর তর্কবাগীশ ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন, “নদীয়াধিপতির প্রতি?”

“অসম্ভব কিছু নয়।” বাণেশ্বর স্বগতোক্তি করলেন, “ইংরেজরা বলুন কিংবা মুর্শিদাবাদের নবাব সকলেই তর্কপঞ্চাননের পরম অনুরাগী। তার ওপর মুর্শিদাবাদের দেওয়ান নন্দকুমার জগন্নাথ পণ্ডিতের পরম সুহৃদ। আর নবাব নিজে নন্দকুমারের কথায় অন্ধ আস্থা রাখেন। ক্ষতি করতে চাইলে রোমশ পণ্ডিতকে খুব একটা বেগ পেতে হবে না।”

২৯

লোকেশবাবু সামান্য ইতস্তত করে বললেন, “ম্যাডাম, আমাকে এক সপ্তাহ ছুটি দিতে হবে।”

রুদ্র সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছিল। ওদের গাড়ি প্রায় দেড়ঘণ্টা ছোটার পর এখন বদনপুরের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।

চুঁচুড়া মহকুমার পোলবা দাদপুর ব্লকের এক প্রত্যন্ত গ্রাম বদনপুর। অজ পাড়া গাঁ বললেও অত্যুক্তি হয়না। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে রুদ্র অবাক হয়ে ভাবছিল, সরকারের এত ধরনের প্রকল্পের পরেও এখনো এত মাটির বাড়ি এই গ্রামে?

একদিকে যতদূর চোখ যায়, সবুজ চোখ জুড়নো খেত। অন্যদিকে ছোটবেলায় আঁকা ছবির মতো মাটির কুঁড়েঘর, বড় বড় নারকেল গাছ। গরু ছাগলের নির্বিচারে আনাগোনা। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।

লোকেশবাবুর কথায় রুদ্র ঘাড় ঘোরাল। বলল, “এক সপ্তাহ! এই ডেলিকেট সময়ে? কী ব্যাপার, লোকেশবাবু? বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?”

জয়ন্ত একদিন কথায় কথায় বলেছিল, লোকেশবাবুর স্ত্রী ক্যানসার আক্রান্ত। নিঃসন্তান দম্পতি। লোকেশবাবুকে প্রায়ই স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য ছুটি নিতে হয়।

কিন্তু লোকেশবাবু একদিকে ঘাড় হেলিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। আসলে সামনের সপ্তাহে শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি। আমরা বৈষ্ণব, এইসময়টা মায়াপুরে যাই। খুব ধুমধাম করে পালন হয় ওখানে। তিনদিন ধরে উৎসব চলে। আমরা গোটা সময়টায় ওখানে ভলান্টারি সার্ভিস দিই।”

রুদ্র কিছু বলার আগেই প্রিয়াঙ্কা ঈষৎ প্রগলভ সুরে বলল, “আচ্ছা লোকেশদা, কী হয় এইসময় মায়াপুরে? সবাই মিলে দু-হাত তুলে হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে করে নেচে বেড়ান?”

লোকেশবাবু বিরক্তস্বরে বললেন, “নেচে বেড়াব কেন? জন্মাষ্টমীতে ওখানে অনেকরকম অনুষ্ঠান হয়। সারা পৃথিবী থেকে ভক্তরা আসেন। কোনোদিনও তো যাওনি, একবার গেলে বারবার যেতে ইচ্ছে করবে। শুধু জন্মাষ্টমী কেন, দোলপূর্ণিমা, রথযাত্রা। দোলে তো একবার আমার সঙ্গে এস পি সাহেবের দেখা হয়েছিল, জানো!”

প্রিয়াঙ্কা বলল, “তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। এস পি সাহেব ওখানকার কমিটিতেও আছেন। উনি তো খুব বনেদি বংশের ছেলে।” লোকেশবাবু বলে চলেছিলেন, “নিশ্চয়ই প্রচুর টাকা ডোনেট করেন। একেবারে প্রথম সারিতে বসেছিলেন। আমি আর ডাকিনি। একবার তো যেতে পারো ঘুরতে। বাড়ির এত কাছে।”

“আচ্ছা, সে না হয় যাব।” প্রিয়াঙ্কা বলল, “আপনি আগে বলুন না, কী হয় ওখানে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে।”

লোকেশবাবু এবার একটু নরম গলায় বললেন, “তিনদিন ধরে উৎসব চলে। জন্মাষ্টমীর আগের দিনকে বলা হয় অধিবাস, পরের দিনটা নন্দোৎসব। প্রথমদিন কীর্তনমেলা চলে, তারপর মধ্যরাতে রাধামাধব মন্দিরে মহা অভিষেক হয়। জন্মাষ্টমীর দিন ভোর থেকে একে একে চলে মঙ্গল আরতি, নানারকম যজ্ঞ, ভজন কীর্তন। তারপর অনুকল্প প্রসাদ বিতরণ। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। হাজার হাজার লোক একসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের নাম করছে, ভজন করছে, বিশাল চত্বরে একসঙ্গে খাচ্ছে। এত ভালো লাগে! গায়ে কাঁটা দেয়। ওই যে খুন হলেন ড. সুবল ভট্টাচার্য, উনি তো প্রতিবছর থাকতেন, মহারাজদের সঙ্গে মিলে সব তদারক করতেন। তোমার বউদি তো অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রতিবছর ছোটেন, মনটা এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ভরে যায়।”

রুদ্র এবার মাঝপথে গলাখাঁকারি দিল, “বদনপুর ঢুকে গেছি। মন্দিরটা কোনদিকে লোকেশবাবু? পাঁচুকে একটু গাইড করুন।”

পরম বৈষ্ণব লোকেশবাবু মায়াপুরের উৎসবের কথা বলতে বলতে কেমন ভাবাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, হঠাৎ আদেশে একটু হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “সোজা গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। একেবারে শেষ প্রান্তে, নদীর ধারে।”

মন্দিরের সামনে গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ানো মাত্র একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। পরনে ধুতি, ফতুয়া। কাঁচাপাকা দাড়ি গলা ছাড়িয়ে প্রায় বুক পর্যন্ত নেমেছে। মাথার চুলও সাদা। রোগাটে গড়ন। কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে জরিপ করার চেষ্টা করলেন রুদ্রদের।

লোকেশবাবু চাপাগলায় বললেন, “ইনি মন্দিরের পূজারি। কী যেন চক্রবর্তী নাম। পল্টু বলে গ্রামের একটা ছেলে তারেকের ছবি দেখে চিনতে পেরেছিল, তারপর সে-ই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল।”

“পল্টুকে আসতে বলুন এখানে।” চাপা গলায় বলল রুদ্র।

লোকেশ বাবু বললেন, “বলেছিলাম। কিন্তু সে এখন শহরে গেছে কাজ করতে।”

“আমার নাম কানু চক্রবর্তী।” গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ।

রুদ্র বলল, “আপনি কি এখানেই একাই থাকেন?”

“হ্যাঁ।” কিছুটা রুক্ষস্বরে বললেন কানু চক্রবর্তী, “আমি তো আগের দিনও বলেছি, পল্টু যখন নিয়ে এল ওঁকে। সেই ছেলেটা কয়েকদিন এই মন্দিরে ছিল, তা প্রায় দু’বছর আগে। তারপর একদিন হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যায়। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।”

রুদ্র বলল, “এই মন্দিরটা কতদিনের পুরোনো?”

এই অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে কানু চক্রবর্তী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। তারপর বললেন, “একশো বছরের বেশিই হবে। এই গ্রামের জমিদার চৌধুরীরা বানিয়েছিল।”

রুদ্র সামান্য ঘাড় নেড়ে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। চারপাশে জঙ্গল, আগাছায় ভরতি। রুদ্র জুতো খুলে উঠতে লাগল মন্দিরের সিঁড়িতে। সিঁড়ি অবশ্য নামেই, ধাপগুলো অযত্নে এতটাই ভেঙে গিয়েছে, আর ঝোপঝাড় এতই গজিয়েছে যে সাপখোপ থাকা বিচিত্র নয়।

কানু চক্রবর্তী আর লোকেশবাবু নীচে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। প্রিয়াঙ্কা রুদ্রর পেছন পেছন উঠে এসেছিল মন্দিরের ওপরে। গর্ভগৃহের ভিতরটা একেবারে অন্ধকার। বিগ্রহ বোঝা যাচ্ছে, তবে খুব অস্পষ্ট। রুদ্র চারপাশ জরিপ করতে করতে বলল, “আপনি থাকেন কোথায়?”

“পাশেই।” কানু চক্রবর্তী এবারেও বিরস গলায় বললেন।

“পাশে বলতে?”

কানু চক্রবর্তী এবারে খুবই অনিচ্ছার ভঙ্গিতে হাত তুলে দূরের একটি কুঁড়েঘরের দিকে নির্দেশ করলেন।

“দু’বছর আগে হলেও আপনার নিশ্চয়ই ঘটনাটা মনে আছে।” রুদ্র পায়ে পায়ে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে, “আরেকবার একটু বলুন না! ছেলেটি খুন হয়েছে।”

কানু চক্রবর্তীর চোখের পাতা একবার সামান্য কেঁপেই স্থির হয়ে গেল। বললেন, “একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, ছেলেটা এই চাতালে ঘুমোচ্ছে। গা বেশ গরম। তিনদিন ওইভাবে ছিল। তারপর একদিন হাওয়া।”

লোকেশবাবু এবার একটু রুষ্টগলায় বললেন, “আপনি পুরোটা কেন খুলে বলছেন না কানুবাবু? আগেরদিন তো পল্টু বলল, ছেলেটা এই সিঁড়িতে বসে কৃষ্ণনাম জপ করত। আর আপনি তাই নিয়ে রেগে যেতেন? বলতেন, চণ্ডী মন্দিরে বসে কৃষ্ণের নাম করা মহা পাপ?”

কানু চক্রবর্তী হঠাৎ ক্ষেপে উঠল। বলল, “অতদিন আগের কথা, আমার ভাল করে মনে নেই। পল্টুর যখন সব মনে আছে, তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করুন না। আমায় কেন করছেন?”

লোকেশবাবু পুলিশসুলভ ধমকানি দিলেন এবার, “বেশি তড়পাবেন না একদম। পুলিশ কাকে কী জিজ্ঞেস করবে, তার জন্য কি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে নাকি? যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, উত্তর দিন। নাহলে সোজা লক আপে পুরে দেব।”

“পুরে দিলে দিন। কানু চক্কোত্তি কোনো জেলখানা বা পুলিশকে ডরায় না।”

লোকটা ঝাঁঝিয়ে কথাগুলো বলল বটে, কিন্তু রুদ্র লক্ষ্য করল, তারপর কেমন যেন মিইয়ে গেল। শুকনো ঠোঁটটা কিছু দুর্বোধ্য শব্দ বিড়বিড় করতে লাগল। চোখদুটোও বুজে গেল ধীরে ধীরে।

লোকেশবাবু কড়াগলায় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু রুদ্র ইশারায় থামিয়ে দিল। চুপচাপ ও ফিরে যেতে লাগল গাড়ির দিকে।

গাড়িতে উঠেই প্রিয়াঙ্কা উত্তেজিত গলায় বলল, “ম্যাডাম, লোকটা বলল বটে একা থাকে, কিন্তু …!”

“দেখেছি।” রুদ্র বলল, “লোকেশবাবু, লোকাল থানার সঙ্গে কথা বলে এই কানু চক্রবর্তীর পেছনে লোক লাগান। ওরা সারাদিন ফলো আপ করুক। লোকটার সঙ্গে আরও কেউ রয়েছে এখন। কানুবাবু তো ধুতি ফতুয়া পরেন দেখছি, কিন্তু ওর কুঁড়েঘরের সামনের তারে দুটো হাফপ্যান্ট ঝুলছে।”

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন