আর্থার কোনান ডয়েল
অস্পষ্টভাবে মনে পড়ে আমার বন্ধু ‘গেজেট’ পত্রিকার এডোয়ার্ড ম্যালোনের মুখে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের কথা শুনেছি; কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অভিযানে সে প্রফেসরের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নিজের কাজে আমি এতই ব্যস্ত থাকি, আর আমার ফার্মে সব সময়ই এত বেশি অর্ডারের ভিড় থাকে যে আমার বিশেষ স্বার্থের বাইরের জগতে কোথায় কী ঘটছে তার কোনও খবরই আমি রাখি না। সাধারণভাবে শুধু এইটুকুই মনে পড়ে যে, দুর্বার ও অসহিষ্ণু প্রকৃতির একটি প্রচণ্ড প্রতিভা হিসাবেই চ্যালেঞ্জারকে বর্ণনা করা হয়েছিল। তাই তাঁর কাছ থেকে নিম্নলিখিত মর্মে একখানি অসাধারণ চিঠি পেয়ে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম।
১৪ বি, এমোর গার্ডেন্স,
কেসিংটন।
মহাশয়,
কূপখনন কর্মে বিশেষজ্ঞ একজন লোককে কাজে নেবার দরকার আমার হয়েছে। আপনার কাছ থেকে লুকোব না যে, বিশেষজ্ঞদের সম্পর্কে আমি উচ্চ ধারণা পোষণ করি না; প্রায়ই দেখেছি, যে লোক নিজেকে কোনও বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী বলে মনে করে (হায়, সে জ্ঞান প্রায়শই একটা বৃত্তির গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে) এবং ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গিটাই হয় সীমিত; তার সঙ্গে তুলনায় আমার মতো যে কোনও সুসমৃদ্ধ মস্তিষ্কের অধিকারী মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি নির্ভুল ও উদার হয়ে থাকে। তৎসত্ত্বেও আপনাকে আমি একটা সুযোগ দিতে নামের সঙ্গে যে চাই। কূপখনন-বিশেষজ্ঞদের তালিকায় আপনার অসাধারণ—আমি তো প্রায় লিখতে যাচ্ছিলাম অবাস্তব—গুণাবলীর উল্লেখ রয়েছে সে দিকে আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে; আরও খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমার যুবক বন্ধু মি. এডোয়ার্ড ম্যালোন আপনার পরিচিত। সুতরাং এই চিঠিতে আপনাকে জানাতে চাই যে, আপনি যদি আমার সঙ্গে একবার দেখা করেন তাহলে আমি খুশি হব, এবং আমার প্রয়োজনগুলি যদি আপনি মেটাতে পারেন—আমার প্রয়োজনের মাপকাঠি খুব ছোট নয়—তাহলে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার আপনার হাতে তুলে দিতেও পারি। ব্যাপারটি খুবই গোপনীয় বিধায় আপাতত এর বেশি কিছু বলতে পারছি না; মুখোমুখিই সে বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। সুতরাং আমার অনুরোধ, আপনার হাতে পূর্ব-নির্ধারিত কোনও কাজ থাকলে অবিলম্বে সে সব বাতিল করে দিন এবং আগামী শুক্রবার সকাল ১০.৩০ মিনিটে উপরের ঠিকানায় আমার সঙ্গে দেখা করুন। আহারাদির সুবন্দোবস্ত আছে, আর মিসেস চ্যালেঞ্জার সে বিষয়ে খুবই সচেতন।
যথাপূর্ব আপনারাই বিনীত
জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার।
জবাব দেবার জন্য চিঠিটা আমার মুখ্য করণিককে দিলাম; সে প্রফেসরকে জানিয়ে দিল, মি. পিয়ারলেস জোন্স সানন্দে যথাসময়ে হাজির হবেন। তাঁর চিঠিটা লেখা হলো সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক রীতিতে, কিন্তু তার গোড়াতেই এই কথাগুলি জুড়ে দেওয়া হলো : “আপনার চিঠি (তারিখবিহীন) পেলাম।” তার টানেই এল প্রফেসরের দ্বিতীয় লিপি :
“মহাশয়” সে লিখল-তার হাতের লেখা যেন কাঁটা-তারের বেড়া— “দেখতে পাচ্ছি, আমার চিঠিটা যে তারিখবিহীন ছিল এই তুচ্ছ ব্যাপারের আপনি সমালোচনা করেছেন। একটা বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি কি যে, একটা ভয়াবহ ট্যাক্সের বিনিময়ে আমাদের সরকার খামের উপরে যে ছোট প্রতীক বা ছাপটা মেরে দেন তাতেই চিঠি ডাকে দেবার তারিখটা বিজ্ঞাপিত হয়ে থাকে? সে প্রতীক যদি না থেকে থাকে বা দুষ্পাঠ্য হয়ে থাকে তো তার প্রতিকারের দায় সংশ্লিষ্ট ডাক-কর্তৃপক্ষের। ইতিমধ্যে আমি আপনাকে বলব, ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়েই আপনার মন্তব্যগুলিকে সীমাবদ্ধ রাখুন এবং আমার চিঠির আকৃতি সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকুক।”
পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, একটি উন্মাদের সঙ্গে কাজ করতে চলেছি; তাই ঠিক করলাম, এ ব্যাপারে আরও অগ্রসর হবার আগে আমার বন্ধু ম্যালোনের সঙ্গে দেখা করব। পুরনো দিনে যখন আমরা দু’জনই “রিচমন্ড”-এর হয়ে “রাগার” (রাগবি) খেলতাম তখন থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। দেখলাম, এখনও সে আগেকার মতোই হাসিখুশি আইরিশটিই আছে। চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে আমার প্রথম ঠোকাঠুকির কথা শুনে সে বেশ মজাই পেল।
বলল, “এটা তো কিছুই না হে বাপু। তাঁর সঙ্গে পাঁচটা মিনিট কাটালেই বুঝতে পারবে; মনে হবে জ্যান্ত তোমার ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। অন্যকে আক্রমণ করার ব্যাপারে তিনি জগৎকে হার মানিয়েছেন।
“কিন্তু জগৎ তা সহ্য করবে কেন?”
“সহ্য তো করে না। তিনি যত জঘন্য কাজ করেছেন, যত হল্লাবাজি করেছেন, যত আক্রমণের মামলা পুলিশ-আদালতে উঠেছে, তা যদি সংগ্রহ কর—”
“আক্রমণ!”
“তবে আর বলছি কি! তাঁর সঙ্গে মতান্তর ঘটলে তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া তাঁর কাছে কিছুই না। তিনি একটি লাউঞ্জ-স্যুট পরা আদিম গুহা- মানব। এক হাতে মুগুর আর অন্য হাতে খাঁজ-কাটা পাথরের খণ্ড—তাঁর এই মূর্তি আমি যেন দেখতে পাই। কোনও কোনও লোক তার শতাব্দীর পক্ষে বেমানান হয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু তিনি জন্মেছেন হাজার বছর এগিয়ে এসে। তিনি যেন প্রথম প্রস্তর যুগ বা ঐ সময়কালের মানুষ।
“আর তিনি একজন প্রফেসর!”
“আসল বিস্ময় তো সেখানেই! ইয়োরোপের শ্রেষ্ঠ মস্তিষ্কের তিনি অধিকারী; তাঁর সব স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবার উপযুক্ত শক্তি তিনি রাখেন। সহকর্মীরা তাঁকে বিষবৎ ঘৃণা করে, আর তাই তাঁকে চেপে দিতে সাধ্যমতো চেষ্টাও করে, কিন্তু মাছ-ধরা জাহাজ কি আর ‘বেরেঙ্গারিয়া’-কে টেনে রাখতে পারে! তাদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি সশব্দে তাঁর পথে এগিয়ে চলেছেন।”
বললাম, “দেখ, একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে আমি চাই না। সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থাটা বাতিল করে দেব।”
“মোটেই তা করো না। ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায় সেখানে হাজির হও—মনে রেখ কাঁটায়-কাঁটায়, নইলে পস্তাতে হবে।”
“কিন্তু কেন?”
“শোন বলি। প্রথমত, বুড়ো চ্যালেঞ্জারের সম্পর্কে যে সব কথা বললাম তাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিও না। যে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয় সেই তাঁকে ভালবেসে ফেলে। বুড়ো ভালুকটি আসলে ক্ষতিকর নয়। আরে, আমার বেশ মনে পড়ে, বসন্ত রোগে আক্রান্ত একটি ভারতীয় ছেলেকে কাঁধে নিয়ে তিনি গ্রামঞ্চল থেকে মাদিরা নদী পর্যন্ত একশ’ মইল পথ হেঁটে গিয়েছিলেন। তিনি সব দিক থেকেই বড়। তাঁর সঙ্গে ঠিক ঠিক চলতে পারলে তিনি তোমাকে কখনও আঘাত করবেন না।”
“সে সুযোগ তাঁকে আমি দেব না।”
“না দিলে বোকামি করবে।”
“দক্ষিণ উপকূলে সুড়ঙ্গ-খননের প্রসঙ্গে ‘হেঙ্গিস্ট ডাউন রহস্য’-এর কথা কি তুমি শোননি?”
“একটা কয়লা-খনি আবিষ্কারের গুপ্ত কথাটা শুনেছি বটে।” ম্যালোন চোখ টিপল।
“তা, ইচ্ছা করলে তাও বলতে পার। কি জান, বুড়ো লোকটি আমাকে বিশ্বাস করেন; তাঁর নির্দেশ ছাড়া আমি কিছু বলতে পারি না। কিন্তু এ কথাটা তোমাকে বলতে পারি, কারণ এটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক বছর আগে বেটার্টন নামক একটি লোক রবারের ব্যবসায় প্রচুর টাকা করে তার সমস্ত সম্পত্তি চ্যালেঞ্জারকে দিয়ে গেছে শুধু এক শর্তে—টাকাটা ব্যয় করতে হবে বিজ্ঞানের স্বার্থে। মস্ত বড় সম্পত্তি—কয়েক লক্ষ টাকা দাম। তখন চ্যালেঞ্জার সাসেক্স-এর হেঙ্গিস্ট ডাউন-এ একটা জমিদারি কিনলেন। খড়ি-অঞ্চলের উত্তর প্রান্তে অবস্থিত একটা অতি বাজে জমি; অবশ্য পরিমাণে অনেকটা; আর সবটা জমিকেই তিনি তার দিয়ে ঘিরে নিলেন। জমির একেবারে মাঝখানে একটা গভীর খাত ছিল। সেখানেই খননকার্য শুরু হলো। তিনি ঘোষণা করলেন—ম্যালোন আবার চোখ টিপল—”ইংলন্ডেও পেট্রোলিয়াম আছে, আর সেটাই তিনি প্রমাণ করতে চান। সেখানে একটা ছোটখাট আদর্শ গ্রাম তৈরি করলেন; ভাল মাইনে দিয়ে কর্মী যোগাড় করে একটা উপনিবেশ গড়লেন; তাদের সকলকেই কথা দিতে হলো যে কেউ মুখ খুলবে না। পুরো অঞ্চলটার মতোই খাতটাকেও কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা হলো; রক্তলোভী শিকারী কুকুরদের পাহারায় বসানো হলো। তাদের হাতে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক প্রায় মরতে বসেছিল, তাদের ট্রাউজারের পিছন দিককার কথা তো বলাই বাহুল্য। বিরাট কর্মযজ্ঞ; স্যার টমাস মর্ডেন-এর ফার্ম কাজটা হাতে নিয়েছে; কিন্তু তাদেরও মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতে হয়েছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এবার কূপখননকারীদের সহায়তা দরকার হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায়, আজ পর্যন্ত যত মানুষের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে বা ভবিষ্যতে হতে পারে, তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর মানুষটির সান্নিধ্যে আসার কথা না হয় নাই বললাম, কিন্তু এমন একটা কাজে এত বড় একটা অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এবং পরিণামে মোটা অঙ্কের একটা চেকপ্রাপ্তি সমন্বিত এ রকম একটা চাকরির প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করাটা কি বোকামি হবে না?”
ম্যালোনের যুক্তি কার্যকর হলো; শুক্রবার সকালে আমি এমোর গার্ডেন্সের পথে পা বাড়ালাম। যথাসময়ে পৌঁছবার অতি-আগ্রহের ফলে নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট আগেই সে-বাড়ির দরজায় পৌঁছে গেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবার সময় আমার খেয়াল হলো, দরজায় দাঁড়ানো রূপোর তীর প্রতীকচিহ্ন লাগানো রোল্স রয়েস গাড়িটা আমার চেনা। মস্ত বড় মর্ডেন ফার্মের ছোট অংশীদার জ্যাক ডেভনশায়ারের গাড়ি ওটা। তাঁকে একজন অত্যন্ত মার্জিত রুচির লোক বলেই জানতাম; তাই তিনি যখন হঠাৎ বেরিয়ে এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে দুই হাত আকাশে তুলে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন; “উচ্ছন্নে যাক! ওঃ, উচ্ছন্নে যাক!” তখন সত্যি আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“কি ব্যাপার জ্যাক? সকালেই বেশ খিঁচড়ে গেছ মনে হচ্ছে। “আরে, পিয়ারলেস! তুমিও এই কাজের মধ্যে আছে?”
“হতেও পারে।”
‘মেজাজে কিন্তু শাণ পড়তে পারে।”
“সে তো বুঝতেই পারছি; তোমার মেজাজই যখন চড়ে গেছে।”
“তা বলতেই হবে। খানসামা এসে খবর দিল : ‘দেখুন স্যার, প্রফেসর আমাকে জানাতে বললেন, তিনি এখন ডিম ভক্ষণে ব্যস্ত আছেন, তাই আরও একটা সুবিধাজনক সময়ে যদি আসতে পারেন তো তিনি সানন্দে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।’ এই বাণী এল চাকরের মারফৎ। এখানে বলে রাখি, তাঁর কাছে আমাদের যে বিয়াল্লিশ হাজার পাউন্ড পাওনা আছে সেটা আদায় করতেই আমি এসেছিলাম।”
আমি শিস্ দিয়ে উঠলাম।
“টাকাটা পেলে না?”
“ওঃ, হ্যাঁ, টাকার ব্যাপারে লোকটি ঠিক আছে। বুড়ো গরিলার প্রতি ন্যায়- বিচারের খাতিরেই বলছি, টাকার ব্যাপারে তিনি দরাজ হাত। কিন্তু টাকাটা দেন যখন তাঁর ইচ্ছা, আর যে ভাবে তাঁর খুশি, তিনি কারও তোয়াক্কা করেন না। যাই হোক, কপাল ঠুকে দেখ কেমন লাগে।” এই কথা বলেই মোটরে ঢুকে সে অদৃশ্য হয়ে গেল।
নির্দিষ্ট সময়টি কখন আসবে তারই প্রতীক্ষায় মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বলতে বাধা নেই, আমি মোটামুটি সুস্থ, সবল মানুষ, “বেলসাইজ বক্সিং ক্লাবের” মিড্ল-ওয়েট প্রতিযোগিতায় রানার-আপ; কিন্তু আগে কখনও এত ভয়ে ভয়ে কোনও সাক্ষাৎকারে হাজির হইনি। ভয়টা দৈহিক নয়, কারণ এ বিশ্বাস আমার আছে যে এই উন্মাদ লোকটি যদি আমাকে আক্রমণ করে বসে তাহলে আমি নিজেকে বাঁচাতে পারব; একটা প্রকাশ্য কেলেংকারির ভয় এবং একটি লাভজনক চাকরি হারাবার আতঙ্ক—এই দু’য়ের একটা মিশ্র অনুভূতি আমাকে তখন পেয়ে বসেছে। যাই হোক, কল্পনার অবসানে যখন কাজ শুরু হয় তখন সব কিছুই সহজতর হয়ে ওঠে। ঘড়িটা চেপে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
কাঠের পুতুলের মতো মুখ একটি বুড়ো খানসামা দরজা খুলে দিল। তার মুখের ভাব, অথবা ভাবের অভাব, দেখেই মনে হলো যে অবাক হতে সে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যার ফলে পৃথিবীর কোনও কিছুতেই সে আর বিস্মিত হয় না।
“আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি স্যার?” সে শুধাল।
“নিশ্চয়।”
লোকটি হাতের তালিকায় চোখ বুলিয়ে নিল।
“আপনার নাম স্যার?…ঠিক আছে, মি. পিয়ারলেস জোন্স।… দশটা ত্রিশ। সব ঠিক আছে। খুব সাবধানে থাকবেন মি. জোন্স, কারণ সাংবাদিকরা আমাদের বড়ই বিরক্ত করেন। আপনি হয়তো জানেন, প্রফেসর সংবাদপত্রকে পছন্দ করেন না। এদিকে আসুন স্যার। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার এখন দেখা করবেন।”
পরমুহূর্তেই তাঁর সামনে হাজির হলাম। আমি বিশ্বাস করি, আমার বন্ধু টেড ম্যালোন তার ‘হারানো জগৎ (Lost World)’ কাহিনিতে লোকটির যে সুন্দর বর্ণনা দিয়েছে আমি তা পারব না, তাই সে চেষ্টাও করব না। আমার শুধু মনে হলো, মেহগেনি ডেস্কটার ওপারে একটি দশাসই চেহারার লোক বসে আছে; বড় কোদাল-মার্কা একজোড়া কালো গোঁফ, আর ঝুলে-পড়া উদ্ধত চোখের পাতায় অর্ধেক ঢাকা দুটো বড় বড় ধূসর চোখ। মস্ত বড় মাথাটা পিছন দিকে ঢালু হয়ে নেমেছে, দাড়ির জঙ্গল ঠেলে উঠেছে সামনের দিকে, আর গোটা চেহারায় উদ্ধত অসহিষ্ণুতার স্পষ্ট প্রকাশ। যেন তার সারা অঙ্গ জুড়ে লেখা রয়েছে : “আরে, তোমার চাইটা কি?” আমার কার্ডটা টেবিলের উপর রাখলাম।
কার্ডটা তুলে নিয়ে তাতে হাত বুলোতে বুলোতে তিনি বললেন, “ওঃ, হ্যা”, যেন কার্ডের গন্ধটা তাঁর মনঃপূত হয়নি। “অবশ্যই। আপনি একজন বিশেষজ্ঞ—তথাকথিত। মি. জোন্স—মি. পিয়ারলেস জোন্স। আপনার ধর্ম-পিতাকে ধন্যবাদ জানাতে পারেন মি. জোন্স, কারণ আপনার নামের এই হাস্যকর উপসর্গটাই আপনার প্রতি প্রথম আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।”
যথাসাধ্য মর্যাদার সঙ্গে বললাম, “প্রফেসর চ্যালেঞ্জার, আমি এখানে এসেছি ব্যবসায়িক সাক্ষাৎকারে, আমার নাম নিয়ে আলোচনা করতে নয়।”
“আচ্ছা; দেখা যাচ্ছে আপনি খুব স্পর্শকাতর লোক মি. জোন্স। আপনার স্নায়ুগুলো বড় বেশি টান-টান হয়ে আছে। আপনার সঙ্গে চলতে বেশ সাবধানে পা ফেলতে হবে মি. জোন্স। দয়া করে বসুন, আরাম করুন। সিনাই উপদ্বীপ পুনরুদ্ধারের উপর লেখা আপনার ছোট পুস্তিকাটি পড়ছিলাম। ওটা কি আপনি নিজে লিখেছেন?”
“স্বভাবতই। ওতে তো আমার নামটাই আছে।”
“তা আছে! তা আছে! কিন্তু তা থেকেই সব সময় বোঝা যায় না, যায় কি? যাই হোক, আপনার কথাই মেনে নিলাম। বইটার যে কোনও গুণ নেই তা নয়। লেখার একঘেয়েমির অন্তরালে মাঝে মাঝে কিছু নতুন ভাবনা-চিন্তা চোখে পড়ে। এখানে-ওখানে নতুন চিন্তার বীজ লুকিয়ে আছে। আপনি বিবাহিত কি?”
“আজ্ঞে না। আমি বিয়ে করিনি।”
“তাহলে কথা গোপন রাখার কিছুটা সম্ভাবনা আছে।”
“কথা যখন দিয়েছি তখন নিশ্চয়ই কথা রাখব।”
“তাই বলছেন বটে। আমার ছোট্ট বন্ধু ম্যালোন”–এমন ভাবে কথাটা বললেন যেন টেডের বয়স দশ বছর—”আপনার সম্পর্কে ভাল ধারণা পোষণ করে। সে বলেছে যে আপনাকে বিশ্বাস করা যায়। এই বিশ্বাসটাই বড় কথা, কারণ এই মুহূর্তে আমি একটা অন্যতম বৃহৎ পরীক্ষায় নেমেছি—পৃথিবীর ইতিহাসের বৃহত্তম পরীক্ষাও বলতে পারি। আপনার সহযোগিতা আমি চাই।”
“তাতে আমি সম্মানিত বোধ করব।”
“সত্যি এটা একটা সম্মান। স্বীকার করছি, আমার এই বিরাট কর্মযজ্ঞে শ্রেষ্ঠ কারিগরী কৌশলের প্রয়োজন যদি না হত তাহলে কারও সঙ্গে কাজের ভাগাভাগি আমি করতাম না। দেখুন মি. জোন্স, আপনার কাছ থেকে অলঙ্ঘনীয় মন্ত্রগুপ্তির প্রতিশ্রুতি পেয়েছি বলেই সরাসরি আসল কথায় যেতে চাই। সেটা এই : যে পৃথিবীতে আমরা বাস করি সেটা নিজেই একটা জীবদেহ; আমি বিশ্বাস করি, তারও নিজস্ব রক্ত-চলাচল, শ্বাস-প্রশ্বাস ও স্নায়ুতন্ত্রর ব্যবস্থা আছে।”
লোকটা নির্ঘাৎ পাগল।
তিনি বলতে লাগলেন, “বুঝতে পারছি যে আপনার মস্তিষ্ক কথাটা ধরতে পারছে না। ধীরে ধীরে পারবে। একটা জলাভূমি বা ঝোপে-ঢাকা প্রান্তর যে কোনও দৈত্যাকার জন্তুর লোমশ অংশের মতো দেখায় সেটা নিশ্চয় আপনি মনে করতে পারেন। সেই সব জমি যে কখনও ওঠে, কখনও নামে সেটা ভাবলেই প্রাণীটির মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন। সর্বশেষ, আমাদের মতো ক্ষুদ্রকায় (Lilliputian) প্রাণীরা যাকে ভূমিকম্প ও পৃথিবীর আলোড়ন বলে মনে করে তার মধ্যেই তো আপনি দেখতে পাবেন সেই প্রাণীটির নড়াচড়া ও শরীর চুলকানোর প্রমাণ।”
“আর আগ্নেয়গিরির ব্যাপারটা কি?” আমি শুধালাম।
“চুপ! চুপ! সেগুলো তো আপনার শরীরের ঘামাচির মতো।”
এইসব ভয়াবহ বক্তব্যের জবাব খুঁজতে গিয়ে আমার মাথাটা ঘুরে উঠল। চেঁচিয়ে বললাম, “আর তাপমাত্রা! এটা কি সত্যি নয় যে যতই নিচে নামা যায় ততই তাপমাত্রা বাড়তে থাকে এবং পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলটা তরল অগ্নিপ্রবাহ?”
মাথা নেড়ে তিনি যেন আমার বক্তব্যকে সরিয়ে দিতে চাইলেন।
“দেখুন স্যার, কাউন্সিল-স্কুলগুলো তো এখন বাধ্যতামূলক, তাই আপনি হয়তো অবগত আছেন যে দুই মেরুতে পৃথিবীটা চাপা। তার অর্থ, পৃথিবীর অন্য যে কোনও অংশের চাইতে মেরু অঞ্চলই পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলের সব চাইতে নিকটবর্তী, আর তাই আপনি যে উত্তাপের কথা বলছেন তার প্রভাব ঐ অঞ্চলের উপরেই সর্বাপেক্ষা বেশি পড়বার কথা। অবশ্য এ কথা তো সর্বজনবিদিত যে মেরু অঞ্চলের অবস্থা গ্রীষ্মমণ্ডলীয়। তাই নয় কি?”
“পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন।”
“তা তো বটেই। যে সব ধারণা সাধারণ মানুষের কাছে নতুন, এবং স্বভাবতই যাকে তারা স্বাগত জানাতে পারে না, সেগুলোকে সকলের সামনে তুলে ধরাই তো মৌলিক চিন্তানায়কদের কাজ। আচ্ছা, এটা কি বলুন তো?” টেবিল থেকে একটা ছোট জিনিস তিনি তুলে ধরলেন।
“আমার তো মনে হয় একটা সমুদ্র-সজারু।”
কোনও শিশু একটা বুদ্ধির কাজ করে ফেললে লোকে যেমন করে থাকে তেমনি অতিমাত্রায় বিস্মিত হবার ভঙ্গিতে তিনি বলে উঠলেন, “ঠিক। এটা একটা সামুদ্রিক সজারু—একটা সাধারণ প্রাণী। নানা মাপের নানা আকারে প্রকৃতি নিজেকে প্রকাশ করে থাকে। এই সজারুটি পৃথিবীর একটা মডেলস্বরূপ, ঠিক তার প্রতিরূপ। ভাল করে দেখুন, প্রাণীটি মোটামুটি গোলাকার, কিন্তু দুই প্রান্তে চাপা। তাহলে পৃথিবীটাকে একটা প্রকাণ্ড সমুদ্র-সজারু হিসাবে কল্পনা করা যেতে পারে। এতে আপনার কি আপত্তি আছে?”
আমার প্রধান আপত্তি, একটা বিতর্কের পক্ষে বিষয়টা অত্যন্ত অবাস্তব, কিন্তু সাহস করে সে কথা বলতে পারলাম না। অপেক্ষাকৃত মোলায়েম কোনও কথা হাতড়াতে লাগলাম।
বললাম, “যে কোনও জীবিত প্রাণীরই আহার্য দরকার। পৃথিবী কী খেয়ে এত বড় দেহটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে?”
“চমৎকার প্রশ্ন—চমৎকার!” পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে প্রফেসর কথাটা বললেন, “যেটা স্পষ্ট তাকে আপনি বেশ তাড়াতাড়ি ধরতে পারেন, কিন্তু সূক্ষ্ম জিনিসকে ধরতে আপনার বড় বেশি সময় লাগে। পৃথিবী তার পুষ্টি যোগায় কেমন করে? আর একবার এই ছোট্ট বন্ধু সজারুটির দিকেই তাকানো যাক। এর চারপাশে যে জল থাকে সেটাই এই ছোট প্রাণীটির নলের ভিতর দিয়ে প্রবেশ করে একে পুষ্টি যোগায়।”
“তাহলে আপনি মনে করেন যে জল—”
“না স্যার। ইথার। পৃথিবীটা চক্রাকার পথে মহাশূন্যে ঘোরে, আর সেই চলার পথেই ইথার অনবরত পৃথিবীর মধ্যে ঢুকছে আর তাকে প্রাণ-শক্তি যোগাচ্ছে। এই ধরনের আরও অনেক পৃথিবী-সজারু দলে দলে এই একই কাজ করে চলেছে—বৃহস্পতি, মঙ্গল ও অন্যরা; অবশ্য প্রত্যেকেরই আহার্য সংগ্রহের নিজ নিজ ক্ষেত্র রয়েছে।”
লোকটি নেহাৎই পাগল, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তর্ক করা চলে না। আমার নীরবতাকেই তিনি সম্মতি বলে ধরে নিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে সদয় ভঙ্গিতে হাসতে লাগলেন।
বললেন, “মনে হচ্ছে আমরা ঠিক পথেই এগোচ্ছি। সবে আলো দেখা দিতে শুরু করেছে। প্রথমে একটু চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে বটে, কিন্তু অচিরেই সেটা সয়ে যাবে। আমার হাতের এই ছোট প্রাণীটি সম্পর্কে আরও দু’একটা কথা বলছি; দয়া করে এদিকে মনোযোগ দিন।”
“আমরা ধরে নিচ্ছি যে, বাইরের এই শক্ত খোলাটার উপরে এক ধরনের অসংখ্য ছোট কীট চলাফেরা করত। সজারুগুলো কি কখনও তাদের অস্তিত্ব টের পেত?”
“তা পেত না।”
“তাহলে আপনি এটাও কল্পনা করতে পারেন যে, মানবজাতি কী ভাবে পৃথিবীটাকে কাজে লাগাচ্ছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণাও পৃথিবীটার নেই। পুরনো পাত্রের গায়ে যে রকম শামুকরা জমে থাকে, ঠিক তেমনি সূর্যকে পরিক্রমা করে চলার পথে পৃথিবীর বুকে যে সব গাছপালা জন্মেছে এবং ছোট ছোট প্রাণীদের যে বিবর্তন ঘটে চলেছে তার কোনও খবরই পৃথিবীও রাখে না। এই হচ্ছে বর্তমান ব্যবস্থা, আর এটাকেই আমি বদলে দিতে চাই।”
সবিস্ময়ে তাকালাম। “আপনি বদলে দিতে চান?”
“আমি চাই পৃথিবী জানুক যে অন্তত একজন মানুষ, জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার আছে যার দিকে মনোযোগ দিতে হবে—আসলে মনোযোগ সে দাবি করছে। পৃথিবীর কাছে এ ধরনের বার্তা এই প্রথম পাঠানো হচ্ছে
“কেমন করে এটা আপনি করবেন?”
“সেখানেই তো কাজের কথা আসছে। আপনি ঠিক জায়গায় হাত দিয়েছেন। আমার হাতে যে ছোট প্রাণীটি রয়েছে তার প্রতি আবার আপনার মনোযোগ আকর্ষণ করব। এর শক্ত আত্মরক্ষাকারী খোলটার নিচে রয়েছে যত স্নায়ু ও ইন্দ্ৰিয়সমূহ। এটা কি পরিষ্কার নয় যে, কোনও পরগাছা-প্রাণী যদি এই প্রাণীটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় তাহলে সে এটার খোলে একটা ছিদ্র করে এর ইন্দ্রিয়-যন্ত্রগুলিকে উত্তেজিত করে তুলবে?”
“নিশ্চয়।”
“অথবা, মানুষের দেহের উপর বিচরণকারী সাধারণ মাছি বা মশার কথাই ধরা যাক। তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা সব সময় সজাগ না থাকতে পারি। কিন্তু যে মুহূর্তে সে তার হুলটা চামড়ার ভিতরে ফুটিয়ে দিচ্ছে, তখনই তো অত্যন্ত অস্বস্তির সঙ্গে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা একেবারেই একা নই। এতক্ষণে বোধ হয় আমার পরিকল্পনাটা আপনার মাথায় ঢুকছে। আলো পড়ে আঁধার দূর হয়ে যাচ্ছে।”
“হা ঈশ্বর! আপনি চাইছেন ভূ-পৃষ্ঠের ভিতর দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়তে?” অবর্ণনীয় প্রশান্তির সঙ্গে তিনি চোখ দুটি বুজলেন।
বললেন, “আপনার সামনে সেই লোকটিকেই দেখছেন যে প্রথম এই কঠিন চামড়াটাকে ছিন্ন করবে। এমন কি বর্তমান কাল ব্যবহার করেও বলতে পারি, যে সেটাকে ছিন্ন করেছে!”
“আপনি সে কাজটা করেছেন!”
“হ্যাঁ, আমি বলতে পারি যে মর্ডেন অ্যান্ড কোং-এর সুযোগ্য সহায়তায় সে- কাজটি আমি করেছি। কয়েক বছর ধরে দিন-রাত অবিশ্রাম কাজ করার ফলে এবং ড্রিল, বোরার, ক্রাশার ও বিস্ফোরক ব্যবহারের ফলে অবশেষে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি।”
“আপনি নিশ্চয়ই বলছেন না যে আপনারা ভূ-পৃষ্ঠ ভেদ করেছেন!”
“আপনার কথায় যদি বিস্ময় প্রকাশ পেয়ে থাকে তো সেটা দূর করুন। আর যদি প্রকাশ পেয়ে থাকে অবিশ্বাস—”
“না, না, মোটেই তা নয়।”
“আমার সব কথা আপনাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে। আমরা ভূ-পৃষ্ঠকে ভেদ করেছি। সেটা ঠিক চোদ্দ হাজার চারশো বিয়াল্লিশ গজ, অথবা মোটামুটিভাবে আট মাইল পুরু। আপনি জেনে খুশি হবেন যে এই সুড়ঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে এমন সব কয়লা-খনি আমরা আবিষ্কার করেছি, যার দ্বারা হয়তো একসময়ে এই কর্মযজ্ঞের সব খরচ উঠে আসবে। আমাদের প্রথম অসুবিধা দেখা দিয়েছিল নিচেকার খড়ির স্তর এবং হেস্টিংস্ বালুর স্তরে ঝর্ণার জল নিয়ে; কিন্তু সে অসুবিধাকে আমরা জয় করেছি। এবার আমরা শেষ স্তরে এসে পৌঁছেছি—আর সেই শেষ স্তর আর কেউ নয়, সে আপনি মি. পিয়ারলেস জোন্স। আপনি হলেন মশার প্রতীক। যে খনিত্র দিয়ে আপনি কূপ খনন করবেন সেটা হলো আপনার হুল। মস্তিষ্কের যা কাজ তা সে করেছে। এবার চিন্তানায়কের প্রস্থান। প্রবেশ করুন যন্ত্রবিদ, যিনি তুলনাহীন, যাঁর হাতে আছে ধাতু-যষ্ঠি। আমার কথা বুঝতে পেরেছেন তো?”
“আপনি আট মাইলের কথা বললেন!” আমি চেঁচিয়ে বললাম। “আপনি কি জানেন স্যার যে কূপখননের শেষ সীমা পাঁচ হাজার ফুট বলে মনে করা হয়ে থাকে? উত্তর সাইলেসিয়াতে একটি সুড়ঙ্গের কথা আমি জানি যেটা ছ’হাজার দু’শ ফুট গভীর, কিন্তু সেটাকে একটি আশ্চর্য ঘটনা বলে মনে করা হয়।”
“আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন মি. পিয়ারলেস। হয় দোষটা আমার বোঝানোর, আর না হয় আপনার মস্তিষ্কের; আসলে কোনটা সে কথা থাক। কূপখননের সীমা আমার ভালই জানা আছে। একটা ছ’ইঞ্চি মাপের খনন-যন্ত্রেই যদি আমার প্রয়োজন মিটত, তাহলে আমার এই প্রকাণ্ড সুড়ঙ্গের পিছনে আমি লক্ষ লক্ষ পাউন্ড ব্যয় করতাম না। আমি আপনার কাছে চাই, এমন একটা ড্রিল তৈরি করুন যেটা যথাসম্ভব তীক্ষ্ণধার হবে, দৈর্ঘ্যে একশ’ ফুটের বেশি হবে না, আর যেটাকে চালানো হবে বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে। ভারী জিনিস দিয়ে চালিত একটা সাধারণ ‘পার্কাশন ড্রিলে’ই সব প্রয়োজন মিটে যাবে।”
“একটা বৈদ্যুতিক মোটর কেন তাহলে?”
“মি. জোন্স, আমার কাজ হুকুম করা, কারণ দর্শানো নয়। কাজ শেষ হবার আগেই এমনও ঘটতে পারে—আমি বলছি, ঘটতে পারে—যে দূর থেকে বিদ্যুতের সাহায্যে ড্রিলটা চালাবার উপর আপনার জীবনটাই নির্ভর করছে। আমার তো মনে হয় এটা করা যাবে?”
“নিশ্চিয়ই করা যাবে।”
“তাহলে সেটার জন্য প্রস্তুত হন। ব্যাপারটা যে অবস্থায় আছে তাতে এখনই আপনার উপস্থিতিটা দরকারী নয়, কিন্তু আপনি কাজের উদ্যোগ শুরু করে দিতে পারেন। আর আমার কিছু বলার নেই।”
আমি বললাম, “কিন্তু কি ধরনের মাটির ভিতর দিয়ে ড্রিলটা যাবে সেটা যে আমাকে জানতেই হবে। বালি, বা মাটি, বা চক—প্রত্যেকের জন্যই আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে।”
“যদি বলি জেলি”, চ্যালেঞ্জার বললেন “হ্যা, আপাতত আমরা ধরে নেব যে জেলির মধ্যেই আপনাকে ড্রিল করতে হবে। আচ্ছা, মি. জোন্স, কিছু জরুরি কাজে এবার আমাকে মন দিতে হবে, কাজেই আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে। আমার নির্দিষ্ট কাজের জন্য একটা মজুরি উল্লেখ করে একখানা আনুষ্ঠানিক চুক্তি- পত্র আপনি তৈরি করতে পারেন।”
মাথা নুইয়ে মুখ ঘোরালাম, কিন্তু দরজায় পা দেবার আগেই কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসল। একটা পালকের কলম দিয়ে খস্ খস্ শব্দে কাগজের উপর তিনি যেন এর মধ্যেই প্রচণ্ড বেগে কী লিখতে শুরু করেছেন। আমি বাধা দেওয়ায় তিনি রাগত দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকালেন।
“আরে, আবার কি? আমি আশা করেছিলাম আপনি চলে গেছেন।”
“দেখুন, আমি আপনাকে শুধু জিজ্ঞাসা করতে চাইছি যে এ রকম একটা অসাধারণ পরীক্ষার উদ্দেশ্যটা কি?”
তিনি সরোষে বলে উঠলেন, “চলে যান স্যার, চলে যান! ব্যবসার হীন লেন- দেন ও ভালমন্দের ঊর্ধ্বে মনটাকে রাখতে চেষ্টা করুন। আপনার তুচ্ছ ব্যবসায়িক আদর্শকে ঝেড়ে ফেলুন। বিজ্ঞান জ্ঞানের সন্ধানী। জ্ঞান আমাদের যেখানে নিয়ে যায়, যাক, তবু তাকেই আমরা অনুসরণ করব। আমরা কি, আমরা কেন, কোথায় আছি—চূড়ান্তভাবে এই সব জানতে পারাটাই কি মানুষের সব আকাঙ্ক্ষার শ্রেষ্ঠ আকাঙ্ক্ষা নয়? যাই হোক, এবার আপনি আসুন!”
তাঁর মস্ত কালো দাড়ি আবারও কাগজের উপর ঝুঁকে পড়ে মাথার সঙ্গে মিশে গেল। পালকের কলম আরও জোর শব্দে চলতে লাগল। আমিও তাঁকে, এই অসাধারণ লোকটিকে ছেড়ে এলাম; যে বিচিত্র কর্মসাধনায় এখন থেকে আমিও তাঁর অংশীদার হলাম সে কথা ভেবে মাথাটা ঘুরতে লাগল।
আপিসে ফিরে দেখি টেড ম্যালোন আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তার দন্তপাটি বিকশিত। আমার সাক্ষাৎকারের ফলাফল জানতেই সে এসেছে।
বলে উঠল, “আরে! খারাপ তো মনে হচ্ছে না। কোনও রকম আক্রমণ বা কামান দাগাই নয়? নিশ্চয় খুব বুদ্ধির সঙ্গে তাকে খেলিয়েছ। তা সেই বুড়ো খোকাটিকে কেমন লাগল?”
“এ রকম কোপনস্বভাব, উদ্ধত, অসহিষ্ণু, স্ববুদ্ধিপরায়ণ লোক আমি দ্বিতীয় দেখিনি, কিন্তু—”
“ঠিক”, ম্যালোন বলল। “সকলকেই ওই ‘কিন্তু’তে এসে থামতে হয়। অবশ্য তুমি যা যা বললে সে সব তিনি তো বটেই, বরং আরও কিছু বেশি, কিন্তু সকলেরই মনে হয় যে এ রকম বড় মাপের একটা লোককে আমাদের মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা যায় না, এবং অন্য কোনও লোকের কাছ থেকে যে ব্যবহার আমরা সহ্য করতে পারতাম না তাঁর বেলায় সেটা সহ্য করা যায়। তাই নয় কি?”
“দেখ, তাঁর সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করবার মতো পরিচয় তাঁর সঙ্গে এখনও আমার হয়নি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করছি যে তিনি যদি একটি তর্জনগর্জন-সর্বস্ব আত্মম্ভরী লোক না হয়ে থাকেন, আর তিনি যা বলছেন তা যদি সত্য হয়, তাহলে লোকটি অবশ্যই একমেবদ্বিতীয়ম্। কিন্তু এ সব কি সত্য?”
“নিশ্চয় সত্য। চ্যালেঞ্জার যা বলেন তা-ই করেন। আচ্ছা, এ ব্যাপারে এখন তোমরা কোথায় আছ? হেঙ্গিস্ট ডাউন-এর কথা কি তিনি তোমাকে বলেছেন?”
“হ্যাঁ। সংক্ষেপে বলেছেন।”
“দেখ, আমার কথায় তুমি আস্থা রাখতে পার; পুরো ব্যাপারটাই বিশাল—পরিকল্পনা বিশাল, রূপায়ণেও বিশাল। সাংবাদিকদের তিনি ঘৃণা করেন, কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করেন, কারণ তিনি জানেন যে তাঁর অনুমতি ছাড়া কোনও কিছুই আমি প্রকাশ করব না। সুতরাং তাঁর পরিকল্পনাগুলি আমি পেয়েছি, অন্তত কতকগুলো পেয়েছি। তিনি এতই উঁচু আকাশে ওড়া পাখি যে তাঁর নাগাল পাওয়া ভার। যাই হোক, আমি যতটা জানি তার ভিত্তিতেই তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি যে ‘হেঙ্গিস্ট চর’ একটি বাস্তব ঘটনা এবং প্রায় সমাপ্তির মুখে। এ অবস্থায় আমার পরামর্শ, আরও ঘটনার জন্য অপেক্ষা করে থাক, আর ততদিনে নিজেকে সম্পূর্ণ তৈরি করে রাখ। অচিরেই তাঁর কাছ থেকে অথবা আমার কাছ থেকে ডাক আসবে।”
তাই হলো; ডাক এল ম্যালোনের কাছ থেকেই। কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন বেশ সকালে সে আমার আপিসে এল সংবাদবাহক হয়ে।
বলল, “চ্যালেঞ্জারের কাছ থেকে আসছি।”
“তুমি যেন হাঙরের মুখে মাছের টোপ।”
“তাঁর সঙ্গে যে কোনও সম্পর্ক রাখাই আমার পক্ষে গর্বের। তাঁর যা করণীয় তিনি ঠিকই করেছেন, এবার তোমার পালা। ওখানে তিনি তো যবনিকা তুলবার জন্য তৈরি হয়েই আছেন।”
“দেখ, চোখে না দেখা পর্যন্ত আমি এসব বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু এদিকে সব কিছুই প্রস্তুত, একেবারে লরিতে বোঝাই। যে কোনও মুহূর্তে সব নিয়ে রওনা হতে পারি।”
“তাহলে এখনি রওনা হও। কর্মশক্তি ও সময়ানুবর্তিতার বিচারে একটি প্রচণ্ড চরিত্র তোমাকে দিয়েছি, দেখো আমাকে যেন ডুবিও না। ইতিমধ্যে রেলপথে আমার সঙ্গে চল; কী করতে হবে তার একটা ধারণা আমিই তোমাকে দিতে পারব।”
বসন্তকালের এক মনোরম সকালে—সঠিকভাবে বললে ২২শে মে—এমন একটা ভয়ংকর যাত্রায় আমরা পা বাড়ালাম যা আমাকেও একটি ঐতিহাসিক রঙ্গমঞ্চে হাজির করে দিল। পথেই আমার জন্য চ্যালেঞ্জারের নির্দেশসংবলিত একটা চিঠি ম্যালোন আমার হাতে দিল।
“মহাশয়,
হেঙ্গিস্ট ডাউন-এ পৌঁছে আপনি মুখ্য যন্ত্রবিদ্ মি. বারফোর্থ-এর হেফাজতে থাকবেন; আমার সব পরিকল্পনাই তার কাছে আছে। এই পত্রবাহক আমার তরুণ বন্ধু ম্যালোনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে এবং কোনও রকম ব্যক্তিগত দেখাসাক্ষাতের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করে। সুড়ঙ্গের চোদ্দ হাজার ফুটের স্তরে এবং তারও নিচে সম্প্রতি এমন কতকগুলি ঘটনার অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে যাতে একটি গ্রহমণ্ডলের প্রকৃতি সম্পর্কে আমার মতটাই সম্পূর্ণ সমর্থিত হয়েছে; কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক জগতের নিশ্চল বুদ্ধির উপর একটা প্রভাব বিস্তার করবার আগে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর প্রমাণ পাওয়া দরকার। সেই প্রমাণ দেবেন আপনি, আর সেটা দেখবে তারা। লিফটের সাহায্যে নেমে যেতে যেতে আপনি দেখতে পাবেন, অবশ্য দেখবার মতো বিরল গুণ যদি আপনার মধ্যে থেকে থাকে, যে আপনি পর পর পার হয়ে যাচ্ছেন মধ্যম খড়ির স্তর, কয়লার স্তর, কিছু ডেভোনিয়ান ও ক্যাম্ব্রিয়ান স্তরের ইঙ্গিত, এবং শেষ পর্যন্ত গ্যানিট পাথরের স্তর যার ভিতর দিয়ে নেমে গেছে আমাদের সুড়ঙ্গের বেশির ভাগ অংশ। নিচটা এখন ত্রিপল দিয়ে ঢাকা আছে; আমার হুকুম সেটাতে এখন হাত দেবেন না, কারণ পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ অত্যন্ত স্পর্শকাতর আবরণটাকে যেমন-তেমনভাবে নাড়াচাড়া করলে তার ফল খারাপ হতে পারে। আমার নির্দেশমতো সুড়ঙ্গের নিচ থেকে বিশ ফুট উপরে আড়াআড়িভাবে দুটো শক্ত কড়ি-কাঠ বসানো হয়েছে। কড়ি-কাঠ দুটোর মাঝখানে যে জায়গাটা থাকবে সেটাই আপনার কূপের নলকে ধরে রাখবে। পঞ্চাশ ফুট ড্রিলই যথেষ্ট হবে,—তার বিশ ফুট থাকবে কড়ি-কাঠের নিচে বেরিয়ে, আর তার ফলে ড্রিলের মুখটা প্রায় ত্রিপলের কাছে পৌঁছে যাবে। যেহেতু আপনার জীবনের একটা মূল্য আছে, সেটাকে আর বেশি নিচে নামতে দেবেন না। তাহলে ত্রিশ ফুট তাকবে সুড়ঙ্গের উপরের দিকে বাড়ানো; তাই আপনি যখন সেটুকুও ছেড়ে দেবেন তখন আমরা ধরে নেব যে ড্রিলের অন্তত চল্লিশ ফুট পৃথিবীর পদার্থের মধ্যে ডুবে যাবে। যেহেতু এই পদার্থটা খুবই নরম, তাই আমার মনে হয় তারপরে হয়তো সেটাকে আরও নামাতে কোনও শক্তির দরকার হবে না; নলটা ছেড়ে দিলে নিজের ভারেইসেটা খোলা স্তরের মধ্যে ঢুকে যাবে। যে কোনও সাধারণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের পক্ষেই এই নির্দেশাবলী যথেষ্ট মনে হওয়া উচিত, কিন্তু আমার ঈষৎ সন্দেহ আছে যে আপনার আরও কিছু নির্দেশের প্রয়োজন আছে; আমাদের তরুণ বন্ধু ম্যালোনের মাধ্যমে সেটা আমাকে জানাতে পারবেন।
জর্জ এডোয়ার্ড চ্যালেঞ্জার।”
দক্ষিণ পাহাড়ের উত্তর পাদমূলের নিকটবর্তী স্টরিংটন স্টেশনে যখন পৌঁছলাম তখন আমার স্নায়ুতে যে প্রচুর টান পড়েছে সেটা কল্পনাই করা যেতে পারে। একটা জীর্ণ “ভহল ৩০” গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। গাড়িটা ধাক্কা খেতে খেতে অনেক অলিগলি পেরিয়ে ছ’সাত মাইল পথ আমাদের নিয়ে পাড়ি দিল; জায়গাটা স্বভাবতই নির্জন হলেও রাস্তায় গভীর চাকার দাগ দেখেই বোঝা যায় যে প্রচুর যানবাহন এ পথে চলে। এক জায়গায় একটা ভাঙা লরিকে ঘাসের উপর পড়ে থাকতে দেখেই বুঝলাম যে আমাদের মতো আরও অনেককেই এ পথে চলতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। একবার দেখলাম মরচে-ধরা একটা প্রকাণ্ড যন্ত্রাংশ—দেখে মনে হলো একটা হাইড্রলিক পাম্পের ভালভ্ ও পিস্টন—ফার্জ- গাছের জঙ্গলের ভিতর থেকে মাথা বের করে আছে।
মুচকি হেসে ম্যালোন বলল, “ঐ দেখ চ্যালেঞ্জারের কীর্তি। বলেছিলেন, যন্ত্রটা এক-দশম ইঞ্চির বে-মাপ হয়েছে, আর তাই সেটাকে পথের পাশেই ফেলে দিয়েছেন।”
“কোনও সন্দেহ নেই তারপরেই শুরু হয়েছিল একটা মামলা।”
“মামলা! আরে বাবা, তাহলে তো আমাদের নিজেদেরই একটা আদালত বসাতে হয়। এমনিতেই আমাদের যত মামলা হয় তাতেই একজন জজ সারা বছর ব্যস্ত থাকেন। সরকারেরও সেই অবস্থা। বুড়ো শয়তান কারও তোয়াক্কা করেন না। রেক্স বনাম জর্জ চ্যালেঞ্জার এবং জর্জ চ্যালেঞ্জার বনাম রেক্স। এক আদালত থেকে আর এক আদালতে চমৎকার ভূতের নৃত্য চলতেই থাকবে। আরে, আমরা তো এসে পড়েছি। ঠিক আছে জেংকিন্স, আমাদের ঢুকতে দিতে পার।”
ফুলকপির মতো দর্শনীয় কানওয়ালা একটি প্রকাণ্ড লোক আমাদের গাড়িতে উঁকি দিয়েছিল; তার মুখে সন্দেহের ভ্রূকুটি। আমার সঙ্গীকে চিনতে পেরে সে শান্ত হয়ে স্যালুট করল।
“ঠিক আছে মি. ম্যালোন। আমি ভেবেছিলাম ‘আমেরিকান এসোসিয়েটেড প্রেস’-এর কেউ।”
“ওঃ, তাহলে তারাও যাতায়াত করছে, কি বল?”
“তারা এসেছিল আজ, আর কাল এসেছিল ‘দি টাইমস্,’। ওঃ, তারা তো একেবারে মৌমাছির মতো ভিড় করছে। ঐ দেখুন!” অনেক দূরে আকাশ-পটে একটা বিন্দুর দিকে আঙুল বাড়িয়ে সে বলল, “ঐ যে চকচক করচে। ওটা শিকাগোর ‘ডেইলি নিউজ’-এর টেলিস্কোপ। হ্যাঁ, ওরা এখন আমাদের নিয়েই আছে। অদূরবর্তী ‘বিয়েকন’-এ যেমন কাকদের ভিড়, তেমনি ওদের দেখছি দলে দলে আসতে।”
দুর্ভেদ্য কাঁটা-তারের বেড়ার ফটক দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে ম্যালোন বলল, “বেচারি সাংবাদিকের দল! আমিও তো ওদেরই একজন, তাই অবস্থাটা ভালই বুঝতে পারি।”
ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের পিছন থেকে কে যেন সখেদে আর্তস্বরে ডাক দিল, “ম্যালোন! টেড ম্যালোন!” মোটর বাইকে চেপে সদ্য আগত একটি ছোট মোটা লোকের গলা; ফটক-রক্ষীর হারকিউলিসের মতো কব্জিতে বাঁধা পড়ে সে ছটফট করছে।
মুখে থুথু ছিটিয়ে সে বলল, “এই, আমাকে যেতে দাও। তোমার হাত সরাও! এ্যালোন, তোমাদের এই গরিলাকে ডেকে নাও।”
ম্যালোন চেঁচিয়ে বলল, “ওকে যেতে দাও জেংকিন্স! উনি আমার বন্ধু! আরে, বুড়ো মাকাল, এটা কি হচ্ছে? এ অঞ্চলে তুমি কি জন্য এসেছ? তোমার চরে বেড়াবার জায়গা তো ফ্লীট স্ট্রীট-সাসেক্সের জঙ্গল নয়।”
আগন্তুক বলল, “আমি কি জন্য এসেছি সেটা তো তুমি ভালই জান। ‘হেঙ্গিস্ট চর’-এর উপর একটা গল্প ফাঁদবার ভার পড়েছে আমার উপর, আর সেটা না লিখে আমি বাড়ি ফিরতে পারব না।”
“আমি দুঃখিত রয়, এখান থেকে তুমি কিছুই পাবে না। কাঁটা-তারের ওপাশেই তোমাকে থাকতে হবে। তার বেশি কিছু চাও তো প্রফেসার চ্যালেঞ্জারের সঙ্গে দেখা করে তাঁর অনুমতি নিয়ে এস।”
সাংবাদিক সখেদে বলল, “গিয়েছিলাম। আজ সকালেই গিয়েছিলাম।”
“তিনি কি বললেন?”
“বললেন আমাকে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।”
ম্যালোন হাসল।
“আর তুমি কি বললে?”
“আমি বললাম, দরজাটা কি দোষ করল?” বলেই দরজা দিয়ে কেটে পড়লাম; বুঝিয়ে দিলাম যে দরজাটা ঠিকই আছে। তখন তর্কের সময় নয়। সোজা বেরিয়ে এলাম। লন্ডনে এক দাড়িওয়ালা এসিরীয় ষাঁড়, আর এখানে এই ঠগী; সে তো আমার সেলুলয়েডটাই নষ্ট করে দিয়েছে; আচ্ছা সঙ্গী জুটিয়েছ বটে টেড ম্যালোন।”
“তোমাকে কোনও রকম সাহায্য করতে পারছি না রয়; পারলে করতাম। ফ্লীট স্ট্রীটে সকলে বলে, তোমাকে কেউ কখনও মারতে পারেনি, কিন্তু এখানে এসেই মার খেলে। তুমি আপিসে ফিরে যাও; কয়েকটা দিন যদি অপেক্ষা করতে পার, তাহলে বুড়োর অনুমতি পাওয়া মাত্রই আমি তোমাকে কিছু খবর দিতে পারব।”
“ভিতরে যাবার কোনও উপায় নেই?”
“পার্থিব কোনও উপায় নেই।”
“টাকায় কিছু হতে পারে?”
“সেটা তো তোমারই ভাল জানা উচিত।”
“সকলে বলছে এটা নিউজিল্যান্ড যাবার একটা সোজা পথ।”
“দেখ রয়, ভিতরে ঢুকতে গেলে হাসপাতালের সোজা পথটাই পেয়ে যাবে। এখনকার মতো বিদায়। নিজেদের কিছু কাজ রয়েছে।”
উঠোন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ম্যালোন বলল, “এ হচ্ছে রয় পার্কিন্স, সমর- সংবাদদাতা। আমরা তার রেকর্ড ভেঙে দিলাম, কারণ সকলেই তাকে অপরাজেয় বলে মনে করে। তার ঐ ছোট, মোটা, নির্দোষ মুখটাই তাকে সব ব্যাপারে জয়ের মুখ দেখিয়ে দেয়। একসময় আমরা এক আপিসেই কাজ করতাম। ঐ দেখ”–এক সারি লাল ছাদওয়ালা সুদর্শন বাংলো দেখিয়ে সে বলল—“ঐগুলো হচ্ছে শ্রমিকদের বাসস্থান। তারা সকলেই বাছাই করা লোক; সাধারণ মজুরির চাইতে অনেক বেশি মাইনে তাদের দেওয়া হয়। তাদের সকলকেই অবিবাহিত ও পানদোষবর্জিত হতে হবে, আর মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিতে হবে। এখনও পর্যন্ত কোনও সংবাদ পাচার হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ঐ মাঠে তারা ফুটবল খেলে, আর ঐ একটেরে বাড়িটা তাদের লাইব্রেরি ও বিনোদন-কক্ষ। বুড়ো যে ভাল সংগঠক সেটা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি। ইনি মি. বারফোর্থ, ভারপ্রাপ্ত মুখ্য যন্ত্রবিদ।”
একটি ঢ্যাঙা, শুকো, বিষণ্নদর্শন মানুষ আমাদের সামনে এসে দেখা দিল; তার সারা মুখে উদ্বেগের গভীর রেখা সুস্পষ্ট।
গম্ভীর গলায় তিনি বললেন, ‘আশা করি আপনিই কূপখননকারী যন্ত্রবিদ। আমাকে আগেই বলা ছিল যে আপনি আসবেন। আপনি আসায় আমি খুশি হয়েছি; বলতে বাধা নেই, এই কাজের দায়িত্ব আমার স্নায়ুর উপর বড় বেশি চেপে বসেছে। আমরা তো কাজ করেই চলেছি, কিন্তু ঠিক পরেই কি যে পেয়ে যাব—খড়িগোলা জলের ঝর্ণা, না কয়লার স্তর, না পেট্রোলিয়ামের ছোট ধারা, অথবা নরকের আগুনের ছোঁয়া—তার কিছুই জানিনা। এখনও পর্যন্ত আমাদের তো শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেই দেওয়া হয়নি; তবে যতদূর জানি আপনি হয়তো সেই সংযোগটা করতে পারবেন!”
“নিচে কি খুব গরম?”
“তা, বেশ গরম। অস্বীকার করব না। তবে বায়ুর চাপ ও আবদ্ধ জায়গার কথা চিন্তা করলে খুব বেশি গরম হয়তো নয়। অবশ্য বাতাস চলাচলের ব্যবস্থাটা খারাপ। আমরা পাম্প করে বাতাস নিচে পাঠাই, কিন্তু এক শিফটে কেউ দু’ঘণ্টার বেশি কাজ করতে পারে না,– ছেলেরা কিন্তু কাজ করতে অনিচ্ছুক নয়। কাল প্রফেসার নিচে নেমেছিলেন, সব কিছু দেখে খুব খুশি হয়েছেন। লাঞ্চে আমাদের সঙ্গে যোগ দিন, তাহলে নিজেই সব দেখতে পাবেন।”
খুব দ্রুত যৎসামান্য আহার্য গ্রহণের পরে সহৃদয় যত্নের সঙ্গে ম্যানেজার আমাদের সব কিছু দেখালেন—ইঞ্জিন-ঘর ও সেখানকার জিনিসপত্র এবং বাইরে ঘাসের উপর ইতস্তত ছড়ানো অব্যবহৃত যন্ত্রপাতির নানা ভাঙা-চোরা অংশের স্তূপ। এক পাশে খোলা অবস্থায় পড়ে আছে একটা প্রকাণ্ড “অ্যারল”-জলচালিত শাবল; এটার সাহায্যেই কাজের শুরুতে খুব তাড়াতাড়ি খননের কাজ করা হয়েছিল। তার পাশেই রয়েছে আর একটা বড় ইঞ্জিন; পর পর লোহার খাঁচা বাঁধা একটা লম্বা ইস্পাতের দড়িকে এটার সাহায্যেই চালানো হয়, আর এই খাঁচায় ভরে সুড়ঙ্গের নানা স্তর থেকে আবর্জনার স্তূপ উপরে তুলে ফেলা হয়। পাওয়ার- হউসের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি “এশার উইস্” টার্বাইন যেগুলির অশ্ব-শক্তি এত বেশি যে মিনিটে একশ’ চল্লিশ পাক ঘুরতে পারে এবং হাইড্রলিক অ্যাকুমুলেটরকে এমনভাবে চালাতে পারে যাতে প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে চৌদ্দশ’ পাউন্ড চাপ সৃষ্টি হয়ে তিন ইঞ্চি পাইপ বেয়ে সুরঙ্গের নিচে নেমে “ব্রা” মার্কা ফাঁপা দাঁতসমন্বিত চারটি পাথর-কাটা ড্রিলকে চালাতে পারে। ইঞ্জিন-হাউসের ঠিক গায়েই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিদ্যুৎ-ঘর; সেখান থেকেই আলোক-ব্যবস্থার জন্য সব বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। তার ঠিক পরেই রয়েছে দু’শো অশ্ব- শক্তি সম্পন্ন আর একটা বাড়তি টার্বাইন; সেটার দ্বারা চালিত হয়ে একটা দশ ফুট পাখার হাওয়া বারো ইঞ্চি পাইপ বেয়ে সুড়ঙ্গের একেবারে নিচে যেখানে কাজ চলছে সেখানে নেমে যায়। গর্বিত কর্মীটি নানা রকম যান্ত্রিক ব্যাখ্যা সহ এই সব ক্রিয়াকাণ্ড আমাদের বোঝাতে লাগল; তার ফলে আমি একঘেয়েমিতে কাঠ হয়ে উঠলাম, ঠিক এখন যেমন আমি একঘেয়েমিতে কাঠ করে তুলছি আমার পাঠকদের। যাই হোক, এই সময় আমাদের একঘেয়েমিতে একটা স্বাগত বিঘ্ন ঘটল। চাকার ঘর্ঘর শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই সানন্দে দেখতে পেলাম, আমার তিন টনের লেল্যান্ড লরিটা এগিয়ে আসছে ঘাসের উপর শব্দ তুলে; তাতেই বোঝাই করা রয়েছে আমার যন্ত্রপাতি ও নানা আকারের নল, আর আছে আমার ফোরম্যান পিটার্স ও একটি নোংরা সহকারী। তারা দু’জনই সঙ্গে সঙ্গে মালপত্র নামিয়ে সেগুলিকে ভিতরে নিয়ে যাবার কাজে লেগে গেল। তারা কাজ করতে লাগল, আর ম্যানেজার আমাকে ও ম্যালোনকে নিয়ে সুড়ঙ্গের দিকে এগিয়ে চললেন।
স্থানটা বিস্ময়কর; আমি যতটা কল্পনা করেছিলাম তার চাইতে অনেক বড় মাপের ব্যবস্থা। হাজার হাজার টন মাল যা তোলা হয়েছে তাকে একটা ঘোড়ার ক্ষুরের আকারে ফেলে ফেলে সুড়ঙ্গের চারধারে মোটামুটি একটা পাহাড় গড়ে তোলা হয়েছে। সেই অশ্বক্ষুরের ভিতরের দিকটা ভরাট করা হয়েছে খড়ি, কাদা, কয়লা ও গ্র্যানিট দিয়ে; তার বুক চিরে যে সব লোহার স্তম্ভ ও চাকা বসানো হয়েছে সেখান থেকে লিফট্ ও পাম্পগুলো চালানো হয়। অশ্বক্ষুরের ফাঁকা জায়গাটাতে যে ইঁটের পাওয়ার-হাউসটা তৈরি করা হয়েছে, ঐ সব স্তম্ভ ও চাকার সঙ্গে তার সংযোগ রাখা হয়েছে। তারপরেই সুড়ঙ্গের খোলা মুখটা, প্রকাণ্ড হাঁ-করা একটা গহ্বর, তার ব্যাস প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ ফুট, উপরে ইঁট ও সিমেন্টের আস্তরণ। এক পাশ থেকে গলা বাড়িয়ে সেই ভয়ংকর পাতালপুরীর দিকে যখন তাকালাম – আগেই শুনেছি সেটা আট মাইল গভীর—তখন তা দেখে ও তার কথা ভেবে আমার মাথা ঘুরে গেল। সূর্যের আলো আড়াআড়িভাবে এসে সুড়ঙ্গের মুখে পড়েছে; আমি দেখতে পেলাম কয়েকশ’ গজ জুড়ে শুধু নোংরা সাদা খড়ি; মাঝে মাঝে ইঁট বসিয়ে ঠেকনো দেওয়া। যাই হোক, নিচে তাকিয়ে অনেক অনেক গভীর অন্ধকারে দেখতে পেলাম একটা ছোট্ট আলোর বিন্দু, যত ছোট একটা বিন্দু হওয়া সম্ভব; কিন্তু কালোর উপরে সেই আলোক বিন্দুটিই অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্থির।
“ওটা কিসের আলো?” আমি শুধালাম।
আমার পাশ থেকেই ম্যালোন পাঁচিলের উপর ঝুঁকে দাঁড়াল।
বলল, “ওই তো একটা খাঁচা উঠে আসছে। খুবই অবাক কাণ্ড, তাই না? আমাদের এখান থেকে ওটা প্রায় এক মাইল দূরে, আর ঐ আলোর বিন্দু একটা শক্তিশালী আর্কল্যাম্প। ওটা খুবই দ্রুতগতি, কয়েক মিনিটের মধ্যেই এখানে পৌঁছে যাবে।”
সত্যি তাই; আলোর বিন্দুটা বড় হতে হতে একসময় তার রূপোলি উজ্জ্বলতায় নলটাকে আলোকিত করে তুলল; তার চোখ-ধাঁধানো দীপ্তি থেকে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলাম। একমুহূর্ত পরেই লোহার খাঁচাটা ল্যান্ডিং-এ এসে সশব্দে থেমে গেল, আর চারটি লোক তার ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে প্রবেশ-পথের দিকে এগিয়ে গেল।
ম্যালোন বলল, “অতটা নিচে নেমে দু’ঘণ্টার শিফটে কাজ করা ইয়ার্কির ব্যাপার নয়। তোমার কিছু মালপত্র তো হাতের কাছেই আছে। আমার তো মনে হয় আমাদের একবার নিচে নেমে যাওয়া ভাল। তাহলে নিজের চোখে দেখেই পরিস্থিতিটা বুঝতে পারবে।”
ইঞ্জিন-ঘরের লাগোয়া একটা ঘর ছিল। সে আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। হাল্কা তসরের তৈরি কতকগুলি স্যুট দেয়াল থেকে ঝুলছিল। ম্যালোনের দেখাদেখি আমিও গা থেকে সব পোশাক খুলে ফেলে সেখান থেকে একটা স্যুট নামিয়ে পরে নিলাম; সেই সঙ্গে রাবার-সোলের একজোড়া চটিও পরলাম। আমার আগেই ম্যালোনের পোশাক পরা হয়ে গেল: সে সাজঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুহূর্তকাল পরেই একটা শব্দ কানে এল; যেন দশটা কুকুর একসঙ্গে লড়াই শুরু করে দিয়েছে। ছুটে বাইরে গিয়ে দেখি যে লোকটি আমার সঙ্গে আনা নলগুলো সাজিয়ে রাখছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুটি মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে! লোকটি বেপরোয়াভাবে একটা জিনিস চেপে ধরে আছে, আর বন্ধুটি তার কাছ থেকে সেটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ম্যালোনের গায়ের জোর অনেক বেশি, লোকটার হাত থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে নিয়ে সে তার উপর দাঁড়িয়ে নাচতে নাচতে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। তখন বুঝলাম সেটা একটা ফটো তোলার ক্যামেরা। আমার কাজের লোকটি গোমড়া মুখে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল।
বলল, “এটা কি করলে টেড ম্যালোন! একটা আনাকোরা নতুন দশ গিনি দামের যন্ত্র।”
“উপায় ছিল না রয়। তোমাকে ছবি তুলতে আমি দেখেছি, আর এ অবস্থায় এটাই করণীয় ছিল।”
সক্ষোভে আমি শুধালাম, “আমার লোকজনের সঙ্গে তুমি ভিড়ে গেলে কেমন করে?”
লোকটি চোখ টিপে মুখটা বেঁকাল। বলল, “ব্যবস্থা করে নিতে হয়। কিন্তু তোমার ফোরম্যানকে দোষী করো না। সে ভেবেছিল ওটা একটা বাজে মাল। তার সাহায্যেই পোশাক যোগাড় করে ভিতরে ঢুকে পড়েছি।”
ম্যালোন বলল, “এখনি বেরিয়ে যাও। তর্ক করে কোনও লাভ নেই রয়। চ্যালেঞ্জার এখানে থাকলে তোমার পেছনে কুকুর লেলিয়ে দিত। ও গর্তে তো আমিও ঢুকেছিলাম এক সময়, তাই তোমার উপর বেশি কঠোর হব না, কিন্তু আমি এখানকার রক্ষী-কুকুর, যেমন ঘেউ-ঘেউ করতে পারি তেমনি কামড়াতেও পারি। শোন, সোজা বেরিয়ে যাও।”
দুটি মজুর আমাদের উৎসাহী অতিথিকে উঠোন থেকে বের করে দিল। এই ঘটনা থেকেই জনসাধারণ বুঝতে পারবে—কয়েক দিন পরে ‘দি অ্যাডভাইসার’ পত্রিকায় প্রকাশিত “অস্ট্রেলিয়া যাবার মৌচাক-পথ” উপশীর্ষক “এক বৈজ্ঞানিকের উন্মাদ স্বপ্ন” শীর্ষক একটি বিস্ময়কর চারকলামব্যাপী প্রবন্ধ প্রকাশ, চ্যালেঞ্জারের প্রায় পক্ষাঘাত হবার উপক্রম এবং “দি অ্যাডভাইসার’ পত্রিকার সম্পাদকের পক্ষে জীবনের সব চাইতে অপ্রীতিকর ও বিপজ্জনক সাক্ষাৎকারের সম্মুখীন হওয়া—এ সব কিছুর মূল উৎসটা কোথায়। প্রবন্ধটি ছিল নানা চিত্রশোভিত “আমাদের অভিজ্ঞ সমর-সংবাদদাতা” রয় পার্কিন্সের অভিযানের একটি অতিরঞ্জিত বিবরণ; তাতে ছিল “এন্মো গার্ডেন্সের এই অভদ্র গুণ্ডা”, “কাঁটা-তার ও শিকারী কুকুর দিয়ে ঘিরে-রাখা উঠোন”, এবং “ইঙ্গ-অস্ট্রেলীয় সুড়ঙ্গের প্রান্ত থেকে আমাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে এল দুটি গুণ্ডা; তাদের মধ্যে একজন ছিল আমার মুখ-চেনা এক আধা-সাংবাদিক যে আসলে একটি সর্বঘটের কারবারী, আর অপরজন বিচিত্র পোশাক পরিহিত এক অশুভদর্শন মানুষ; কূপখননকারী যন্ত্রবিদের ভেক ধরে এসেছে, কিন্তু দেখলে ‘হোয়াইট চ্যাপেলের’ লোক বলেই মনে হয়” ইত্যাদি ধরনের সব উজ্জ্বল পঙ্ক্তি। যা হোক, এই ভাবে আমাদের দু’জনের বর্ণনা দিয়ে সেই পাষগুটা গহ্বর-মুখের রেলের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে এবং এমন একটা আঁকা-বাঁকা খননকার্যের উল্লেখ করেছে যার সাহায্যে রজ্জুপথে চালিত ট্রেনগুলো পৃথিবীর অভ্যন্তরে ঢুকে যেতে পারে। এই প্রবন্ধের ফলে একমাত্র বাস্তব অসুবিধা এই দেখা দিল যে, কোনও কিছু ঘটার অপেক্ষায় যে সব অকেজো লোক দক্ষিণ পাহাড়ের উপর বসেছিল তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেল। একদিন সেই প্রত্যাশিত ঘটনাটি যখন ঘটল তখন কিন্তু সকলেরই মনে হয়েছিল যে অন্য কোথাও থাকাই ছিল ভাল।
আমার ফোরম্যান তার নকল সহকারীটিকে নিয়ে আমার যন্ত্রপাতি, আমার বেল-বক্স, আমার ক্রোফ্রুট, ভি-ড্রিল, ডাণ্ডা ও মাপ-যন্ত্র দিয়ে জায়গাটাকে বোঝাই করে ফেলেছে; কিন্তু ম্যালোন পীড়াপীড়ি করতে লাগল—ও সব থাক, আগে নিচে নেমে চল। সেই উদ্দেশ্যে আমরা ইস্পাতের জাফরি-কাটা খাঁচায় ঢুকে পড়লাম, এবং মুখ্য যন্ত্রবিদের সঙ্গে তীরের মতো পৃথিবীর পাকস্থলীতে ঢুকে গেলাম। সুড়ঙ্গের গা কেটে নিজস্ব পরিচালনকেন্দ্র সমন্বিত অনেকগুলি অটোমেটিক লিফ্ট বসানো হয়েছে। লিফ্টগুলো অত্যন্ত দ্রুতগতি; ব্রিটিশ লিফটের মতো সোজা নেমে যাওয়ার পরিবর্তে এই লিফটে চড়লে একটা নিম্নগতি রেল-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়।
খাচাগুলি জাফরি-কাটা এবং আলোকোজ্জ্বল; ফলে যে ভিন্ন ভিন্ন স্তর পেরিয়ে আমরা নামতে লাগলাম সেগুলো বেশ ভালভাবেই দেখতে পেলাম। বিদ্যুৎগতিতে নিচে নামতে থাকলেও প্রতিটি স্তর আমার চেতনায় দাগ কেটে বসল। অগভীর খড়ির স্তর, কফি-রঙের হেস্টিংস স্তর, হাল্কা অ্যাশবার্নহাম স্তর, ঝকঝকে কালো কয়লা, আর মাঝে মাঝেই কাদার একটা করে বৃত্ত। এখানে-ওখানে কিছু ইঁটের দেয়াল তোলা হয়েছে, কিন্তু নীতি হিসাবে সুড়ঙ্গটা স্বয়ংসম্পূর্ণ; এটাকে গড়ে তুলতে যে প্রচণ্ড পরিশ্রম ও যান্ত্রিক কুশলতা প্রয়োজন হয়েছে তা সত্যি বিস্ময়কর। তারপরই আমরা হুশ্ করে পৌঁছে গেলাম একেবারে আদিম গ্র্যানিট স্তরে; সেখানে আগ্নেয় শিলাখণ্ডগুলো এমনভাবে ঝিকমিক করছে যেন কালো দেয়ালের গায়ে হীরের কুচি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিচে—আরও নিচে নামতে লাগলাম; এত নিচে কোনও মানুষ কোনও দিন নামেনি। প্রাচীন পাথরগুলোর কী বিচিত্র বর্ণসমারোহ। গোলাপী রঙের খনিজ পাথরের একটা চওড়া স্তরের উপর আমাদের শক্তিশালী আলো পড়ে সেটা যে রকম অপার্থিব সৌন্দর্যে ঝলমল করছিল তার কথা আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। স্তরের পর স্তর, লিফটের পর লিফ্ট পার হয়ে চলেছি, বাতাস ক্রমেই ঘন ও গরম হয়ে উঠছে, একসময় হাল্কা তসরের পোশাকও অসহ্য হয়ে উঠল, রবার-সোলের চটির মধ্যে ঘাম ঝরে পড়তে লাগল। অবশেষে যখন মনে হচ্ছিল যে এ অবস্থা আর সহ্য করতে পারব না তখন শেষ লিফ্টা থেমে গেল; পাথরের গায়ে কেটে গড়া একটা গোল প্ল্যাটফর্মে আমরা নেমে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম, নামতে নামতেই ম্যালোন চারদিকের দেয়ালের দিকে সন্দেহজনক চোখে তাকাচ্ছে। তাকে অত্যন্ত সাহসী লোক বলে না জানলে হয়তো বলতাম যে তাকে খুবই ভীত মনে হচ্ছিল।
কাছাকাছি পাথরের উপর হাত বুলিয়ে মুখ্য যন্ত্রবিদ বললেন, “কী রকম অদ্ভুত দেখতে।” আলোটা ধরে তিনি দেখালেন, একটা বিচিত্র চটচটে কাদার সর পড়ে সেটা চকচক করছে। “এখানে কেমন যেন একটা থর থর কম্পন অনুভূত হচ্ছে। জানি না কি নিয়ে আমরা কাজ করছি। আমার কাজ করছি। আমার কাছে এ সবই তো নতুন।”
ম্যালোন বলল, “আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে ঐ দেয়ালটাকে আমি রীতিমতো কাঁপতে দেখেছি। শেষবার যখন এখানে নেমেছিলাম তখন আপনার ড্রিলের জন্য কড়ি-কাঠ দুটোকে আড়াআড়িভাবে বসিয়েছিলাম। সেই সময় দেয়ালটাকে যখন কাটছিলাম তখন প্রতিটি আঘাতেই ওটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিল। পুরনো লন্ডনের নিরেট শহরে বুড়ো মানুষটির মতবাদটাকে অবাস্তব মনে হয়েছিল, কিন্তু এখানে ভূ-পৃষ্ট থেকে আট মাইল নিচে এসে সে কথাটা নিশ্চয় করে বলতে পারছি না।’
যন্ত্রবিদ বললেন, “ত্রিপলের নিচে যা ঢাকা আছে সেটা দেখলে আপনার নিশ্চয়তা আরও হ্রাস পাবে। এই সব পাথর মাখনের মতো কাটে, কিন্তু এটাকে পেরিয়ে এমন একটা বস্তু পেয়েছি যে রকমটা পৃথিবীতে কোথাও নেই। প্রফেসার বলেছিলেন, ‘ওটাকে ঢেকে দাও! স্পর্শ করো না! ‘ তাঁর কথা মতোই ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে; সেই থেকে ওই ভাবেই আছে।
“আমরা একবার দেখতে পারি না?”
যন্ত্রবিদের বিষণ্ন মুখে একটা ত্রাসের ভাব দেখা দিল।
বললেন, “প্রফেসারের কথা অমান্য করাটা তামাশার ব্যাপার নয়। লোকটি সাংঘাতিক চতুর, কে জানে কি ভাবে আপনার উপরও নজর রেখেছেন। যাই হোক, একবার উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করব।”
রিফ্লেক্টর ল্যাম্পের আলোটা নিচে ফেলতেই কালো ত্রিপলটা চকচক করে উঠল। তখন ঝুঁকে পড়ে ত্রিপলের কোণে বাঁধা দড়িটা ধরে ত্রিপলের নিচেকার আধ ডজন বর্গ গজ জায়গা দৃশ্যমান করে দিলেন।
সে দৃশ্য যেমন অসাধারণ তেমনি ভয়াবহ। মেঝেটা এক ধরনের ধূসর পদার্থে পূর্ণ; পদার্থটা যেমন পালিশ তেমনি উজ্জ্বল; মৃদু হৃদ্স্পন্দনের মতো সেটা একবার উঠছে, একবার নামছে। কম্পনটা সরাসরি চোখে পড়ে না, শুধু উপরিভাগে ছড়িয়ে পড়া একটা মৃদু ঢেউ বা তালের আভাস পাওয়া যায়। উপরিভাগটাও আগাগোড়া এক রকম নয়, গ্রাউন্ড-গ্লাসের ভিতর দিকে তাকালে দেখা যায় তার নিচে আছে সাদা সাদা ছোপ বা অতি সূক্ষ্ম গর্ত যেগুলির আকার ও আকৃতি অনবরত বদলে যাচ্ছে। এই অসাধারণ দৃশ্য দেখে আমরা তিনজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ভয়ার্ত গলায় ম্যালোন ফিসফিস করে বলল, “অনেকটা ছাল-ছাড়ানো জন্তুর মতো দেখতে। বুড়োর সজারুর কল্পনাটা বোধ হয় একেবারে মিথ্যা নয়।”
আমি চেঁচিয়ে বললাম, “হায় প্রভু! একটা হার্পুন দিয়ে আমাকেও কি ওই জন্তুটাকে বিঁধে ফেলতে হবে!”
ম্যালোন বলল, “সে কাজটা তো তোমারই হাতে বাপু; আর দুঃখের সঙ্গেই বলছি, ভয়ে যদি সরে না পড়ি তো সে কাজটার সময় আমি তোমার পাশেই থাকব।”
“আমি কিন্তু থাকব না”, যন্ত্রবিদ দৃঢ়তার সঙ্গেই বললেন।
“আমি কিন্তু এ বিষয়ে স্থিরসংকল্প। বৃদ্ধ যদি পীড়াপীড়ি করেন তাহলে কাজে ইস্তফা দেব। হায় প্রভু, ওই দেখ!”
হঠাৎ সেই ধূসর উপরিভাগটা ফুলে উঠে আমাদের দিকে এগিয়ে এল, প্রাচীরের উপর থেকে নিচে তাকালে ঠিক যে-ভাবে ঢেউগুলো উপরের দিকে আছড়ে পড়ে। তারপরই ঢেউটা যেন স্তিমিত হয়ে গেল; মৃদু স্পন্দন ও কম্পন আগের মতোই চলতে লাগল। দড়িটা নামিয়ে দিয়ে বারফোর্থ ত্রিপলটা দিয়ে সবটা ঢেকে দিলেন।
বললেন, “দেখে মনে হলো, ওটা যেন প্রায় বুঝতেই পেরেছিল যে আমরা এখানে আছি।”
“ওটা আমাদের দিকে এভাবে ফুলে উঠল কেন? আমার তো মনে হয় ওটার উপরে আলোর কোনওরকম প্রভাব পড়েছিল।”
“এখন আমাকে কি করতে হবে?” আমি শুধালাম।
লিফ্ট যেখানে থেমেছে ঠিক তার নিচে গর্তের মুখে আড়াআড়িভাবে বসানো কড়ি-কাঠ দুটোর দিকে মি. বারফোর্থ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। দুটো কড়ি- কাঠের মাঝখানে ইঞ্চি নয়েকের মতো ফাঁক রয়েছে।
তিনি বললেন, “এটা বুড়ো লোকটিরই ব্যবস্থা। আমার ধারণা আমি এ দুটোকে আরও ভালভাবে বসাতে পারতাম; একটা পাগলা ষাঁড়কে তবু যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু তিনি যা বলেন ঠিক তাই করাটা অনেক সহজ ও নিরাপদ। তাঁর কথা হচ্ছে, এই দুটো কড়ি-কাঠের মাঝখানেই আপনার ছ’ইঞ্চি তুপুর্নটাকে যে কোনও রকমে বেঁধে নেবেন।”
“দেখুন সে ব্যাপারে বিশেষ অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না”, আমি জবাবে বললাম। “আজ থেকেই কাজ শুরু করব।”
পৃথিবীর প্রত্যেকটি মহাদেশে কূপখননের কাজ আমি করেছি; কিন্তু সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে যে আমার বিচিত্র জীবনে এটাই সবচাইতে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রফেসর চ্যালেঞ্জার বার বার বলেছেন বেশ দূরত্বে থেকে কাজটা করতে হবে; কথাটা আমার কাছেও যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়েছিল; তাই বৈদ্যুতিক নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থার কথাই আমার মাথায় এল; আর সুড়ঙ্গের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তার পাতা থাকায় সে কাজটাও বেশ সহজেই হলো। অসীম সতর্কতার সঙ্গে ফোরম্যান পিটার্স ও আমি লম্বা নলগুলোকে নামিয়ে এনে পাথুরে আলিসার উপর জমা করে রাখলাম। তারপর সর্বনিম্ন লিফ্টটাকে তুলে দিয়ে আমাদের জন্যে খানিকটা জায়গা করে নিলাম। কেবলমাত্র মাধ্যাকর্ষণের উপর ভরসা করলে চলবে না ভেবে ঘাত-প্রতিঘাত পদ্ধতি গ্রহণ করাই স্থির করলাম; একটা পুলির সাহায্যে আমাদের একশ’-পাউন্ড বাটখারাটাকে লিফটের নিচে ঝুলিয়ে দিলাম এবং একটা V-আকৃতির যন্ত্রের সাহায্যে নলগুলিকে তার নিচে চালিয়ে দিলাম। আর শেষকালে যে দড়ির সঙ্গে ঐ বাটখারাটা বাঁধা থাকবে সেটাকে সুড়ঙ্গের গায়ে এমনভাবে আটকে দেওয়া হবে যাতে বিদ্যুৎ-সংযোগ ঘটামাত্রই সেটা চলতে শুরু করে। গ্রীষ্মাঞ্চলীয় তীব্র গরমের মধ্যে কাজটা করা খুবই কষ্টসাধ্য; তাছাড়া একবার পা ফস্কালে অথবা কোনও একটা যন্ত্রপাতি নিচের ত্রিপলের উপরে পড়লে যে কী অকল্পনীয় বিপদ ঘটতে পারে, মনের মধ্যে সর্বক্ষণ তার একটা অনুভূতি তো ছিলই। পারিপার্শ্বিক অবস্থাও কম ভয়াবহ নয়। বার বার দেখছি দেয়াল বেয়ে একটা অদ্ভুত শিহরন ও কম্পন বয়ে যাচ্ছে; তার উপর হাত রাখলে একটা একঘেয়ে স্পন্দনও যেন অনুভব করেছি। আমরা যে কাজ শুরু করার জন্য প্রস্তুত, শেষ বারের মতো এই সংকেত যখন পাঠালাম এবং মি. বারফোর্থকে জানালাম যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জার তাঁর ইচ্ছামতো যে কোনও মুহূর্তে পরীক্ষা শুরু করতে পারেন, তখন কিন্তু পিটার্স বা আমি কেউই দুঃখিত বোধ করলাম না।
বেশি সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হলো না। কাজ শেষ করবার তিন দিন পরেই আমার পরোয়ানা হাজির হলো।
ভোজ-সভায় যে ধরনের আমন্ত্রণ-পত্র ব্যবহার করা হয় তেমনি একটা সাধারণ আমন্ত্রণ-পত্র; তাতে লেখা :
প্রফেসর জি. ই. চ্যালেঞ্জার,
এফ. আর. এস., এম. ডি., এস.-সি., ইত্যাদি, (প্রাক্তন সভাপতি, জুওলজিক্যাল ইন্সটিটুট এবং এত বেশি সাম্মানিক ডিগ্রি ও খেতাবের অধিকারী যা উল্লেখ করার মতো স্থান এই আমন্ত্রণ পত্রে নেই)
২১শে জুন মঙ্গলবার সকাল ১১.৩০ মিনিটে জড়বস্তুর উপর মনের উল্লেখযোগ্য জয়লাভকে প্রত্যক্ষ করতে
মি. জোন্সকে (কোনও মহিলা নয়)
উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করছেন।
হেঙ্গিস্ট চর, স্থান সাসেক্স
১০.৫ মিনিটে ভিক্টোরিয়া থেকে বিশেষ ট্রেন ছাড়বে। যাত্রীরাই নিজেদের ভাড়া দেবেন। পরীক্ষা-কার্যের পরে জলযোগের ব্যবস্থা থাকবে কি না সেটা অবস্থার উপর নির্ভর করবে। স্টেশন, স্টোরিংটন।
R.S.V.P (বড় হাতের অক্ষরে নাম লিখে অবিলম্বে), ১৪ বিস, এমোর গার্ডেন্স, এস. ডব্লু.
দেখলাম ম্যালোনও এইমাত্র অনুরূপ পত্র পেয়ে মুচকি-মুচকি হাসছে।
বলল, “আমাদের কাছে এটা পাঠানো তো নিরর্থক। ফাঁসুড়ে যেমন খুনীকে বলে, ঠিক তেমনি যাই ঘটুক না কেন আমাদের তো সেখানে থাকতেই হবে। কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলছি। সারা লন্ডনে হৈ-চৈ পড়ে গেছে।”
অবশেষে একদিন সেই মহা দিবসটি এল। ব্যক্তিগতভাবে আমি ভেবেছিলাম, সব কিছুই যে যথাযথভাবে করা হয়েছে আগের রাতেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের তুর্গুনটা ঠিক জায়গায় বসানো হয়েছিল, বাটখারাটা মাপমতোই রাখা হয়েছিল, বৈদ্যুতিক সংযোগ সহজেই চালু করা যাবে; মোট কথা, এই বিচিত্র পরীক্ষাকার্যে আমার কাজটুকু যে নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হবে সে বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। ব্যক্তিগত বিপদের ঝুঁকিটা যথাসম্ভব কমাবার জন্য বিদ্যুৎ- নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে প্রায় পাঁচশো গজ নিচে রাখা হলো।
এল সেই ভয়ংকর দিনটি। ইংলন্ডের গ্রীষ্মকালের একটি আদর্শ দিন। নিশ্চিন্ত মনে উপরে উঠে এলাম। সাধারণভাবে সমস্ত ব্যাপারটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে নেবার জন্য পাহাড়ের ঢাল বেয়ে অর্ধেকটা পথ উঠে গেলাম।
মনে হলো সারা পৃথিবীটাই বুঝি হেঙ্গিস্ট চরে এসে জমায়েত হচ্ছে। যতদূর দৃষ্টি চলে পথঘাট লোকে লোকারণ্য। নানা অলিগলি বেয়ে মোটর গাড়িগুলো হেলে-দুলে এসে উঠোনের ফটকে যাত্রীদের ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে এসেই সব যাত্রার শেষ হচ্ছে। একদল শক্তিশালী দরোয়ান ফটকে অপেক্ষা করছে। একমাত্র বহু-আকাঙ্ক্ষিত বাদামী টিকিটটটা দেখিয়ে তবেই ভিতরে ঢুকতে পারা যাচ্ছে; কথায় বা ঘুষে কোনও কাজ হচ্ছে না। কাজেই তারা ফিরে গিয়ে অপেক্ষমাণ বিরাট জনতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পাহাড়ের ধারে ধারে শুধুই দর্শনাথীদের ভিড়। ডার্বি খেলার দিন এসম্ পাহাড়ের মতোই সেখানকার অবস্থা। উঠোনের মধ্যে খানিকটা জায়গা কাঁটা-তার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সৌভাগ্যবান লোকদের সেখানে নিয়ে যার যার নির্দিষ্ট আসনটি দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটা অংশ অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য। আর একটা অংশ কমন্স সভার সদস্যদের জন্য, আর একটাতে জায়গা হয়েছে সর্বোন-এর লে পেলিয়ের এবং বার্লিন একাডেমির ডক্টর ড্রিসিঙ্গারের মতো নানা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ ও বিজ্ঞান জগতের খ্যাতিমান মানুষদের। রাজ পরিবারের তিনজন সদস্যের জন্য বালির বস্তা ও করোগেটের ছাদ সমন্বিত একটা বিশেষ অঞ্চল সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
সওয়া এগারোটার সময় পর পর অনেকগুলো লম্বা গাড়িতে করে বিশেষভাবে আমন্ত্রিত অতিথিদের স্টেশন থেকে নিয়ে আসা হলো। তাঁদের অভ্যর্থনা জানাবার কাজে সাহায্য করতে আমিও উঠোনে নেমে গেলাম। বিশেষভাবে ঘেরা জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর চ্যালেঞ্জার। পরনে ঝকঝকে ফ্রক-কোট, সাদা ওয়েস্ট-কোট। বার্নিশ-করা টপ-হ্যাট; মুখে সর্বজয়ী, প্রায় দৃষ্টিকটু উদারতার একটা মিশ্রিত ভাব, আর সেই সঙ্গে এক বিচিত্র আত্মম্ভরিতার প্রকাশ। কোনও সমালোচক তাঁর বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখেছিল, “যিহোভা মানসিকতার এক সুপষ্ট প্রতীক।” অতিথিদের নিজ নিজ স্থানে বসিয়ে দেবার কাজে তিনি সাহায্য করছিলেন। তারপর সমবেত সকলের ভিতর থেকে নির্বাচিত সুধীজনকে সঙ্গে নিয়ে সুবিধামতো একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তিনি চারদিকে তাকাতে লাগলেন; যেন একজন সভাপতি সমবেত সকলের সহর্ষ অভ্যর্থনা প্রত্যাশা করছেন। কিন্তু সে রকম কিছু না ঘটায় তিনি নিজের বিষয়বস্তুর মধ্যে ডুব দিলেন; ঘেরা জায়গাটার দূরতম প্রান্ত পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠস্বর গম্-গম্ করতে লাগল।
সগর্জনে তিনি বলতে লাগলেন, “ভদ্রমহোদয়গণ, এই অনুষ্ঠানে ভদ্রমহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করার কোনও প্রয়োজন আমার নেই। আজ সকালে আমাদের মধ্যে তাঁদের উপস্থিত থাকবার জন্য যদি আমন্ত্রণ না করে থাকি, তার কারণ এ নয় যে তাঁদের গুণাবলীকে আমি স্বীকার করি না, কারণ আমি বলতে পারি”—গজবৎ রসকিতা ও নকল বিনয়ের সঙ্গে—”যে আমাদের উভয় পক্ষের মধ্যে যে সম্পর্ক সেটা চিরদিনই চমৎকার এবং প্রকৃতই ঘনিষ্ঠ। আসল কারণটা হলো, এই পরীক্ষা-কর্মের মধ্যে কিছুটা বিপদের ঝুঁকি আছে, যদিও সে ঝুঁকিটা এত বেশি নয় যাতে আপনাদের অনেকের মুখে যে অস্বস্তির ভাব দেখতে পাচ্ছি তাকে সমর্থন করা চলে। সংবাদপত্রের প্রতিনিধিরা জেনে খুশি হবেন যে আবর্জনা-স্তূপের উপর অনেকগুলো বিশেষ আসন তাঁদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে, কারণ সেখান থেকে প্রকৃত কর্মস্থলটা সরাসরি দেখা যাবে। অনেক সময় তাঁরা এত বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন যেটাকে অশোভন কৌতূহল থেকে আলাদা করে দেখা যায় না; কিন্তু অন্তত এক্ষেত্রে আমি যে তাঁদের সুবিধার দিকে নজর দিইনি সে নালিশ তাঁরা করতে পারবেন না। যদি কিছু না ঘটে, সেটা তো হতেই পারে, তো আমি অন্তত তাঁদের জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। অপর পক্ষে যদি কিছু সত্যি ঘটে তাহলে সেটা দেখবার ও লিপিবদ্ধ করবার চমৎকার সুযোগ তাঁরা পাবেন, অবশ্য শেষ পর্যন্ত সে সামর্থ্য যদি তাঁরা অক্ষুন্ন রাখতে পারেন।
“আপনারা সহজেই বুঝতে পারছেন, অকারণ অশ্রদ্ধা ছাড়াই যাদের আমি সাধারণ ইতরজন বলে বর্ণনা করতে পারি তাদের কাছে নিজের সিদ্ধান্ত অথবা কার্যাবলী ব্যাখ্যা করা একজন বিজ্ঞান-সাধকের পক্ষে খুবই অসম্ভব কাজ। কিছু কিছু অশিষ্ট বিঘ্ন সৃষ্টি করার মতো শব্দ আমার কানে আসছে, আর হাড়ের চশমা পরা যে ভদ্রলোকটি হাতের ছাতা নাচাচ্ছেন তাঁকে আমি থামতে বলছি। (একটি কণ্ঠস্বর : “আপনার অতিথিদের যে বর্ণনা আপনি দিলেন স্যার, সেটা অত্যন্ত আপত্তিকর।”) সম্ভবত আমি ‘সাধারণ ইতরজন’ কথাটা ব্যবহার করাতেই ভদ্রলোকটি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বেশ তো, তাহলে বলা যাক যে আমার শ্রোতারা সব অত্যন্ত অসাধারণ ইতরজন। কথার মারপ্যাচে আমরা যাব না। বাধা পাবার আগে আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে, পৃথিবী প্রসঙ্গে আমার আসন্ন প্রকাশ গ্রন্থে সমস্ত ব্যাপারটাকে অত্যন্ত বিস্তারিত ও পরিষ্কারভাবে আমি আলোচনা করেছি, আর যথাযথ বিনয়ের সঙ্গেই সেই গ্রন্থটিকে পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী গ্রন্থগুলির অন্যতম বলে বর্ণনা করতেও পারি। (অনেকের বাধা ও চিৎকার : “আসল কথায় আসুন! এখানে আমরা কি জন্য এসেছি? এটা কি একটা ঠাট্টার ব্যাপার?”) সেই কথাই তো পরিষ্কার করে বলতে যাচ্ছিলাম। এই ভাবে যদি বাধার সৃষ্টি করা হতে থাকে তাহলে শিষ্টতা ও শৃঙ্খলা রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে আমি বাধ্য হব; তার অভাব কিন্তু বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আসল পরিস্থিতিটা এই : ভূ- পৃষ্ঠের ভিতর দিয়ে আমি একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়েছি; আর পৃথিবীর স্নায়ুতন্তুর বহিরাবরণে একটা প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলে তার ফল কী দাঁড়ায় এখনই সেটা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করব; এই সূক্ষ্ম কাজটা পরিচালনা করবেন আমার অধীনস্থ কর্মীরা,–কূপখননকার্যে স্ব-ঘোষিত বিশেষজ্ঞ মি. পিয়ারলেস জোন্স, আর আমার প্রতিনিধি হিসাবে মি. এডোয়ার্ড ম্যালোন। সেই স্পর্শকাতর পদার্থটিকে খুঁচিয়ে দেওয়া হবে, আর তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা অনুমানের বিষয়। আপনারা দয়া করে আসন গ্রহণ করলে এই দুই ভদ্রলোক গহ্বরের ভিতরে নেমে যাবেন এবং চূড়ান্ত ব্যবস্থাগুলো নিষ্পন্ন করবেন। তারপর এই টেবিলে রাখা বৈদ্যুতিক বোতামটা আমি টিপে দেব। তাহলেই পরীক্ষার কাজ সম্পূর্ণ হবে।”
চ্যালেঞ্জারের যে কোনও উচ্চকণ্ঠ বক্তৃতার পরেই দর্শকদের সাধারণতই মনে হয় যে পৃথিবীর মতোই তাদের বহিরাবরণ-ত্বককে ছিঁড়েখুঁড়ে ভিতরকার স্নায়ুতন্ত্রকে বুঝি মেলে ধরা হয়েছে। আজকের জনতার ক্ষেত্রেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না। সকলে স্বস্থানে ফিরে যেতে যেতেই সমালোচনা ও ক্ষোভের গুঞ্জন শোনা যেতে লাগল। স্তূপের উপর বসে রইলেন চ্যালেঞ্জার একা; পাশে একটা ছোট টেবিল; তাঁর কালো চুল ও দাড়ি উত্তেজনায় কম্পমান; অতীব অমঙ্গলসূচক সে মূর্তি। সে দৃশ্য উপভোগ করবার মতো সময় ম্যালোন অথবা আমার কারও ছিল না; কারণ এক অসাধারণ কর্তব্যপালনে আমাদের ছুটে যেতে হয়েছিল। বিশ মিনিট পরে আমরা সুড়ঙ্গের তলদেশে পৌঁছে গেলাম এবং অনাবৃত স্থানটার উপর থেকে ত্রিপলটাকে তুলে ফেললাম।
আমাদের সামনে দেখা দিল একটা বিস্ময়কর দৃশ্য। একটা অদ্ভুত জাগতিক টেলিপ্যাথির সাহায্যে পুরাতন গ্রহটা বোধ হয় জানতে পেরেছে যে একটা অশ্রুতপূর্ব ব্যাপার ঘটাবার চেষ্টা হচ্ছে। খোলা পদার্থটা টগবগ করে ফুটছে। বড় বড় ধূসর বুদবুদ উঠছে আর সশব্দে ফেটে যাচ্ছে। চামড়ার নিচেকার বাতাস ও সূক্ষ্ম গর্তগুলো আলাদা হয়ে গিয়েও যেন উত্তেজিতভাবে আবার মিলে যাচ্ছে। আড়াআড়িভাবে প্রসারিত ছোট ছোট ঢেউগুলি আগের চাইতে আরও শক্তিশালী ও দ্রুতলয়ে চলছে। উপরিভাগের নিচে যে সব সরু পথ এঁকেবেঁকে মিলিত হয়েছে তার মধ্যে এক ধরনের গাঢ় রক্তিম তরল পদার্থ যেন কাঁপছে বলে মনে হলো। সব কিছুর মধ্যেই জীবনের স্পন্দন। একটা ভারী গন্ধ বাতাসকে মানুষের ফুসফুসের পক্ষে অনুপযুক্ত করে তুলেছে।
একদৃষ্টিতে সেই অদ্ভুত দৃশ্যের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম; হঠাৎ আমার পাশ থেকেই ম্যালোন আর্তস্বরে বলে উঠল, “হা ভগবান, জোন্স! দেখ, দেখ!”
এক পলকের জন্য সে দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তেই আমি বৈদ্যুাতিক সংযোগ ঠিক করে নিয়ে এক লাফে লিফটের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। চেঁচিয়ে বললাম, “চলে এস! বাঁচতে চাও তো শীঘ্ৰ এস!”
যা দেখলাম তা সত্যি ভয়াবহ। মনে হলো, এই মাত্র সুড়ঙ্গের তলদেশে যা দেখেছি সেই বর্ধিত কার্যকলাপে যেন সুড়ঙ্গের নিচের গোটা অংশটাই যোগ দিয়েছে। দেয়ালগুলো সহানুভূতিতে কাঁপছে, দপ্ দপ্ করছে। যে গর্তগুলোর মধ্যে কড়ি-কাঠ দুটো বসানো ছিল তার উপরেও এই স্পন্দনের প্রভাব পড়েছে; পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কড়ি-কাঠ দুটো আর একটু সরে গেলেই—মাত্র কয়েক ইঞ্চি—সে দুটো পড়ে যাবে। তা যদি পড়ে তাহলে আমার দণ্ডটার ধারালো মুখটা বৈদ্যুতিক শক্তি ছাড়াই পৃথিবীকে বিদ্ধ করবে। সেটা ঘটবার আগেই ম্যালোন ও আমাকে সুড়ঙ্গের ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে। যে কোনও মুহূর্তে একটা অসাধারণ আলোড়নের ঝুঁকি নিয়ে ধরিত্রীর আট মাইল গভীরে বসে থাকা ভয়ংকর রকমের বিপজ্জনক। উন্মাদের মতো আমরা ভূ-পৃষ্ঠের দিকে পালাতে লাগলাম।
সেই যাত্রার দুঃস্বপ্নের কথা আমরা কেউ কি কোনওদিন ভুলতে পারব? লিটি শোঁ-শোঁ করে উঠছে, তবু প্রতিটি মিনিটকে একটা ঘণ্টা বলে মনে হচ্ছে। প্রতিটা স্তরে পৌঁছেই এক লাফে লিফ্ট থেকে নেমে আর এক লাফে পরবর্তী লিফটে চেপেই বৈদ্যুতিক বোতাম টিপে দিচ্ছি আর হু-হু করে উপরে উঠছি। ইস্পাতের জাফরি-কাটা ছাদের ভিতর দিয়ে অনেক দূরে একটা ছোট্ট আলোর বৃত্ত দেখতে পাচ্ছি; সেটাই সুড়ঙ্গের মুখ। মুখটা বড় হতে হতে একসময় পূর্ণ বৃত্তের আকার ধারণ করল; আর আমাদের খুশি-ভরা চোখ দুটি সুড়ঙ্গ-মুখের ইঁটের দেয়ালের উপর পড়ল। তীরবেগে উঠছি—উপরে উঠছি—অবশেষে আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার এক উন্মাদ খুশির মুহূর্তে দু’জনই সেই কারাগার থেকে লাফিয়ে নেমে আর একবার সবুজ ঘাসের বুকে পা ফেললাম। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। সুড়ঙ্গ-মুখ থেকে ত্রিশ পাও যাইনি এমন সময় অনেক অনেক নিচে আমার লৌহ শলাকাটি তীব্র গতিতে ছুটে গিয়ে বৃদ্ধা ধরিত্রী মায়ের স্নায়ু-কেন্দ্রে বিদ্ধ হলো; আর মহাসংকটের মুহূর্তটিও এগিয়ে এল।
কী ঘটেছিল? ম্যালোন বা আমি—কারওরই সে কথা বলবার মতো অবস্থা ছিল না, কারণ প্রচণ্ড সাইক্লোনের এক ধাক্কায় স্থানচ্যুত হয়ে আমরা ঘাসের উপর গড়াতে শুরু করলাম; বরফের উপর দুটো গোল পাথরের মতো আমরা দু’জন অনবরত তালগোল পাকিয়ে পাক খেতে লাগলাম। ঠিক একই সঙ্গে অশ্রুতপূর্ব একটা ভয়ংকর আর্তনাদ আমাদের কানের উপর আছড়ে পড়ল। সেখানে সমবেত শত শত লোকের মধ্যে এমন কে আছে যে সেই ভয়ংকর আর্তনাদকে যথাযথভাবে কোনওদিন বর্ণনা করতে পেরেছে? সে এমন একটা আর্তস্বর যার মধ্যে বেদনা, ক্রোধ, ক্ষতি এবং প্রকৃতির লাঞ্ছিত মহত্ত্ব সব মিলেমিশে একটা বীভৎস চিৎকারে পরিণত হয়েছিল। পুরো একটা মিনিট ধরে সেটা চলেছিল; সহস্র সাইরেন যেন এক হয়ে তার তীব্র স্বননে সমবেত জনতাকে পঙ্গু করে দিয়ে, গ্রীষ্মকালের স্তব্ধ বাতাসে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণ উপকূলে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল; এমন কি চ্যানেলকে পার হয়ে আমাদের ফরাসী প্রতিবেশীদের কানেও পৌঁছে গেল। ইতিহাসের কোন ধ্বনি আজ পর্যন্ত আহত ধরিত্রীর সেই আর্তনাদের সমকক্ষ হতে পারেনি।
বিমূঢ় ও বধির হয়েও সেই আকস্মিক আঘাত ও শব্দ সম্পর্কে ম্যালোন ও আমি সচেতন ছিলাম, কিন্তু সেই অসাধারণ দৃশ্যের অন্য সব বিস্তারিত বিবরণ আমরা পরে জেনেছিলাম অন্যের বর্ণনা থেকে।
ধরিত্রীর পাকস্থলী থেকে প্রথম উঠে এসেছিল লিফটের খাঁচাগুলো। অন্য যন্ত্রপাতিগুলো দেয়ালের গায়ে লেগে থাকায় ঝাপটার হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল, কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী স্রোতের পুরো বেগটা আছড়ে পড়েছিল খাঁচাগুলোর নিরেট মেঝের উপর। কয়েকটা বড়িকে আলাদা করে একটা ব্লো-পাইপের মধ্যে রাখলে সেগুলি আলাদা ভাবেই পর পর উপরের দিকে ঠেলে উঠতে থাকে। সেই রকম চোদ্দটা লিফটের খাঁচা একটার পর একটা উড়ে এসে একটা চমৎকার অনুবৃত্ত রচনা করে তাদের একটাকে নিয়ে ফেলল ‘ওদিং’ স্তম্ভের নিকটবর্তী সমুদ্রের জলে এবং আর একটাকে ফেলল চিচেস্টারের অনতিদূরে মাঠের মধ্যে। দর্শকরা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছে যে, আজ পর্যন্ত যত বিস্ময়কর দৃশ্য তারা দেখেছে তার কোনওটাই নীল আকাশের বুকে শান্তভাবে উড়ে চলা চোদ্দটি লিফ্ট-খাঁচার দৃশ্যের মতো বিস্ময়কর হতে পারে না।
তারপর এল উষ্ণ প্রস্রবণ। আলকাতরার মতো কুৎসিত পাতলা পদার্থের একটা প্রকাণ্ড স্তম্ভ আকাশের দিকে উঠে গিয়েছিল দু’হাজার ফুট। একটা কৌতূহলী বিমান ঘটনাস্থলের উপর উড়ে বেড়াচ্ছিল; সেটাকে জোর করে নামিয়ে নিয়ে মানুষ ও যন্ত্র উভয়কেই নোংরার মধ্যে একেবারে পুঁতে ফেলে দিয়েছিল। সেই ভয়ংকর পদার্থটির গন্ধ যেমন তীব্র তেমনি ন্যক্কারজনক; সেটা এই গ্রহের প্রাণ-রক্তও হতে পারে, অথবা প্রফেসর ড্রিসিঙ্গার ও বার্লিন স্কুল-এর মতে উত্তর আমেরিকার এক ধরনের চতুষ্পদ মাংসাসী প্রাণীর দুর্গন্ধ নিঃসরণের মতো আত্মরক্ষাত্মক কোন নিঃসরণও হতে পারে; চ্যালেঞ্জারদের মতো আক্রমণকারীদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য প্রকৃতিই জননী ধরিত্রীকে এই ব্যবস্থাটি দান করেছে। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে তো প্রধান অপরাধী চরের উপরে তার সিংহাসনে বসে রইল অকলঙ্ক দেহে, আর হতভাগ্য সাংবাদিকগণ অগ্নি-প্রবাহের একেবারে এক লাইনে থাকায় এমনভাবে ভিজে-পুড়ে একশা হয়েছিল যে পরবর্তী অনেকগুলি সপ্তাহ তারা কোনও সৌখিন সমাজেই ঢুকতে পারেনি। সেই নোংরা আলকাতরার কাদা বাতাসে ভেসে গিয়েছিল দক্ষিণ দিকে, আর যে বেচারি দর্শকরা কী ঘটে তা দেখবার জন্য ধৈর্য পরে দীর্ঘ সময় পাহাড়ের চূড়ায় অপেক্ষা করছিল তাদের মাথায়ই পড়ল সেই সব পদার্থ। অবশ্য কেউই হতাহত হয়নি, কোনও বাড়িও পরিত্যক্ত হয়নি, কিন্তু অনেক বাড়িই দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছিল এবং সেই বিরাট ঘটনার কিছু কিছু স্মারক এখনও সেই সব বাড়ির চার দেয়ালের মধ্যে রক্ষিত আছে।
তারপর এল সুড়ঙ্গের মুখটা বন্ধ হওয়ার পালা। প্রকৃতিতে যেমন কোনও ক্ষতস্থান ধীরে ধীরে নিচ থেকে উপরের দিকে শুকিয়ে আসতে থাকে, তেমনি ধরিত্রীও অতি দ্রুত গতিতে সেই প্রাণ-পদার্থের ভাঙচুরগুলোকে মেরামত করে ফেলল। সুড়ঙ্গের দেয়ালগুলো বুজে আসতে থাকায় দীর্ঘস্থায়ী ঘর্ঘর শব্দ উঠতে লাগল; সে-শব্দ একেবারে নিচ থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ক্রমাগত উপরে উঠতে লাগল এবং শেষ পর্যন্ত একটা কান-ফাটানো শব্দ করে সুড়ঙ্গ-মুখের ইঁটের গোল দেয়ালটা চ্যাপ্টা হয়ে একসঙ্গে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল; তারপরেই একটা ছোটখাটো ভূকম্পনে জঞ্জালের পাহাড়টাকে ভূমিস্মাৎ করে দিয়ে ঠিক যেখানে গর্তটা ছিল সেইখানে গড়ে তুলল ভগ্নস্তূপ ও ভাঙা লোহা-লক্কড়ের পঞ্চাশ ফুট উঁচু একটা পিরামিড। শুধু যে প্রফেসর চ্যালেঞ্জারের পরীক্ষার অবসান হলো তাই নয়, চিরদিনের মতো সেটা মাটির নিচে মানুষের চোখের আড়ালে চলে গেল। রয়্যাল সোসাইটি যদি একটা স্মৃতিস্তম্ভ না তুলত তাহলে এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঠিক কোথায় ঘটেছিল সেটা আমাদের বংশধররা কোনওদিন জানতে পারত কিনা সন্দেহ।
তারপরেই এল একটি মহৎ পরিণতি। পর পর এই সব ঘটনার শেষে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সব কিছু একেবারে চুপচাপ; একটা উৎকণ্ঠ স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। ক্রমে লোকজনের সম্বিৎ ফিরে এল; তারা ভাল করে বুঝতে চেষ্টা করল ঠিক কী ঘটেছিল এবং কেমন করে ঘটেছিল। তারপরই সহসা এই বিরাট কর্মযজ্ঞ, তার পরিকল্পনার প্রচণ্ড বিস্তার, তাকে রূপায়ণের প্রতিভা ও বিস্ময়,—সব কিছু তাদের কল্পনায় উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হলো। একযোগে তারা চ্যালেঞ্জারের দিকে ফিরে তাকাল। প্রান্তরের প্রতিটি কোণ থেকে উঠল প্রশস্তির চিৎকার; ঢিবিটার উপর থেকে নিচে তাকিয়ে তাঁর চোখে পড়ল ঊর্ধ্বায়িত মুখের একটা হ্রদ, আর তার ফাঁকে ফাঁকে অজস্র রুমালের ওঠা-নামা। পিছনের দিকে তাকালে আজও আমি তাঁর সেই চেহারা স্পষ্ট দেখতে পাই। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন; চোখ দুটি অর্ধ-নিমিলিত, মুখে সচেতন কৃতিত্বের হাসি, বাঁ হাতটা হাঁটুর উপরে রাখা, আর ডান হাতটা রয়েছে ফ্রক-কোটের বুকের মধ্যে। সে ছবি নিশ্চয় চিরকালের জন্য ধরে রাখা হবে, কারণ আমার চারদিক থেকে পাখির কিচির- মিচিরের মতো ক্যামেরার মুহুর্মুহু ক্লিক-ক্লিক শব্দ কানে আসছিল। তিনি যখন মাথাটা নুইয়ে প্রাঙ্গণের চারদিকে তাকাতে লাগলেন তখন জুন মাসের সূর্যের সোনালী কিরণ তাঁকে স্নান করিয়ে দিল। চ্যালেঞ্জার এক মহাবিজ্ঞানী, চ্যালেঞ্জার এক প্রধান পথপ্রদর্শক, চ্যালেঞ্জারই সেই প্রথম মানুষ যাকে মাতা ধরিত্রীও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল।
উপসংহারে একটিমাত্র কথা। এ কথা অবশ্য সর্বজনবিদিত যে এই পরীক্ষার ফল হয়েছিল জগৎ-জোড়া। একথা সত্য যে প্রকৃত ঘটনাস্থলের বাইরে অন্য কোথাওই আহত গ্রহটি এত বেশি গর্জন করেনি, কিন্তু অন্যত্র তার যে ব্যবহার প্রকাশ পেয়েছে তাতেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে যে আসলে সে এক ও অখণ্ড। প্রতি রন্ধ্র, প্রতিটি আগ্নেয়গিরির মুখে ধ্বনিত হয়েছিল তার ধিক্কার। হেলা এমন ভাবে আর্তনাদ করেছিল যে আইসল্যান্ডবাসীরা একটা দারুণ বিপদপাতের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছিল। ভিসুভিয়াসের চূড়াটা উড়ে গেল। এটনার মুখ থেকে এত বিপুল পরিমাণ লার্ভা নির্গত হয়েছিল যে দ্রাক্ষাক্ষেত ধ্বংস করার দায়ে ইটালির আদালতগুলিতে চ্যালেঞ্জারের নামে রুজু করা পাঁচ লক্ষ লিরার ক্ষতিপূরণের মামলার রায় তাঁর বিরুদ্ধেই দেওয়া হয়েছিল। এমন কি মেক্সিকোতে এবং মধ্য- আমেরিকার নানা স্থানে তীব্র নারকীয় বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, এবং স্ট্রম্বোলির হাহাকারে গোটা পূর্ব ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল ভরে উঠেছিল। মুখর হয়ে উঠেছিল সমগ্র মানবজাতি। একমাত্র চ্যালেঞ্জারই পেরেছিলেন সমগ্র পৃথিবীটাকে আর্তনাদে মুখর করে তুলতে।
অনুবাদ : মণীন্দ্র দত্ত
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন