দেবারতি মুখোপাধ্যায়
প্রথমেই বলি, যে হাড়-হিম-করা কাহিনি আপনাদের শোনাতে বসেছি, তা গল্পকথা নয়, নির্ভেজাল সত্য ঘটনা। সত্যঘটনাকে কাহিনি আকারে পরিবেশন করতে বসলে লেখককে সাধারণত যে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়, ঘটনাপঞ্জির ভাঁজে ভাঁজে জুড়ে দিতে হয় রোমাঞ্চ, কাল্পনিক কথোপকথন, সেই সুযোগ আমি এখানে সামান্যই পেয়েছি। তার কারণ ইংরেজির সেই আদি ও অকৃত্রিম প্রবাদ। Truth is stranger than fiction.
এই হৃদয়বিদারক কাহিনির তীব্রতা এতটাই বেশি, আঘাত এতটাই ভয়ানক, নিষ্ঠুরতার প্রাবল্য এতটাই অবিশ্বাস্য, যে লেখক হিসেবে এখানে আমার খুব বেশি কিছু করার ছিল না। এই গল্প পড়তে পড়তে আপনি শিহরিত হয়ে উঠবেন, পাশবিকতায় কেঁপে উঠবেন, আপনার শিশুসন্তানকে আতঙ্কে জড়িয়ে ধরবেন। আবার এই কাহিনি এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে আপনার শরীরে অ্যাড্রিনালিন নিঃসরণ দ্রুততর হবে। রক্ত ছলকে বেরোতে চাইবে আপনার ত্বক ছিঁড়ে, ক্রমে সেই নিষ্ফল রাগ জন্ম দেবে হতাশার। যদি আপনার হৃদয় দুর্বল হয়, তবে এই লেখা আপনার জন্য নয়।
এই কাহিনি এক দৈত্যের গল্প। শিশুরা ছোটোবেলায় মা-ঠাকুমার কোলে বসে বড়ো বড়ো চোখে যে দৈত্যের গল্প শোনে, দৈত্য যখন রাজপ্রাসাদ থেকে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে নিয়ে চলে যায়, তাদের প্রশ্বাস-নিশ্বাস যেমন ঘন হয়ে ওঠে, এই কাহিনিও তেমনই এক মানুষরূপী দৈত্যের। কিন্তু এই দৈত্য সোনার কাঠি-রুপার কাঠি দিয়ে রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখত না, নির্মম নিস্পৃহতায় শেষ করে ফেলত জীবনদীপ।
গৌরচন্দ্রিকা খুব বেশি দীর্ঘায়িত না করে প্রথমেই চলে যাই ১৯৭৫ সালে। পাঠানকোটের এয়ার ফোর্স স্টেশন। হিমালয়ের কোলে প্রকাণ্ড অঞ্চল জুড়ে ভারতীয় বায়ুসেনার সংরক্ষিত এলাকা। এক শান্ত বিকেলে হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে সেখানে বিস্ফোরণ হল।
মুহূর্তে চারদিকে হইহই পড়ে গেল। সাইরেন বেজে উঠল। বেশ কয়েকটা ফায়ার ইঞ্জিন যতক্ষণে অকুস্থলে এসে পৌঁছোল, ততক্ষণে গলগল করে বেরোতে-থাকা কালো ধোঁয়া আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
দুজন জুনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার ছুটতে ছুটতে এল। কোনো সন্দেহ নেই, জঙ্গিরা অতর্কিতে হামলা চালিয়েছে। এখন কতটা জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত, সেটাই দেখতে হবে। দ্রুতগতিতে এসে তারা থমকে গেল। বিস্মিত চোখে দেখল, বিশেষ একটা বাংলো থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
বাড়িটার সামনের অংশ সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। কিছু জওয়ান বন্দুক তাক করে উবু হয়ে বসে আছে, কয়েকজন ক্রমশ ভস্মীভূত হতে-থাকা বাড়ি থেকে স্ট্রেচারে করে বের করে আনছে একজন আহত মহিলাকে।
এক ওয়ারেন্ট অফিসার আরেকজনকে বলল, ”কী অদ্ভুত দেখো! শুধু মেজর ভি. কে. শর্মার বাড়িতে অ্যাটাক হয়েছে।”
”সেটাই তো দেখছি। টেররিস্টরা তো শুধু একখানা বাড়ির ওপর হামলা করে না।” দ্বিতীয়জন চিন্তিত মুখে বলল, ”এহ, মিসেস শর্মা শুধু নন, ওঁদের ছেলেও দেখছি মারাত্মকভাবে ইনজিয়োরড।”
খবর পেয়ে মেজর ভি. কে. শর্মা যখন এলেন, ততক্ষণে ফায়ার ব্রিগেড বাড়ির আগুন নিভিয়ে ফেলেছে। মেজর শর্মার স্ত্রী ও কিশোর পুত্রকে আর্মি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুজনেরই আঘাত গুরুতর।
আকস্মিক এই হামলার তদন্ত করার জন্য দ্রুত গঠন করা হল স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন কমিটি। সেই কমিটি তদন্ত শুরু করে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কেস সলভ করে দিল।
সেই দুজন জুনিয়র অফিসারের সন্দেহই অমূলক। কোনো জঙ্গি হানা বা বিদেশি শত্রুর আক্রমণ নয়, মেজর ভি. কে. শর্মার বাড়ি লক্ষ করে হ্যান্ড গ্রেনেড ছুড়েছিল এয়ার ফোর্সেরই এক সেনা, তার নাম দরবার সিং। কয়েকদিন আগে কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য দরবার সিং মেজর শর্মার কাছে ধমক খেয়েছিল। এই কদিন মনে মনে ফুঁসেছে সে, তারপর অ্যামিউনিশন ডিপার্টমেন্ট থেকে হ্যান্ড গ্রেনেড চুরি করে মেজরের বাড়ি লক্ষ করে ছুড়েছে। ঠিকমতো লাগলে মেজরের স্ত্রী ও পুত্রের ওখানেই মৃত্যু হত।
দরবার সিংকে গ্রেপ্তার করা হল, কিন্তু একেবারে হাতেনাতে পাওয়া প্রমাণের অভাবে সে ছাড়াও পেয়ে গেল। তবে চাকরি থেকে তাকে তৎক্ষণাৎ বরখাস্ত করা হল। পাঠানকোট এয়ার ফোর্স স্টেশনের সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। স্বাভাবিক, এই ধরনের প্রতিশোধপরায়ণ অসুস্থ মানসিকতার সহকর্মী কে-ই বা চায়!
তারা অনুমানও করতে পারল না, এই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে দরবার সিং একদিন একটা গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেবে। তার নামের আগে শুধু ‘সিরিয়াল কিলার’ নয়, বসবে ‘বেবি কিলার’ শব্দবন্ধ।
পাঠানকোট এয়ার ফোর্স আন্দাজও করতে পারল না, পঁচিশেরও বেশি দুধের শিশুকে কখনো মিষ্টি, কখনো লজেন্স, কখনো আইসক্রিমের লোভ দেখিয়ে ঠান্ডা মাথায় খুন করে চলবে দরবার সিং। এই ভয়ংকর অনুমান তাদের পক্ষে করা সম্ভবও ছিল না।
দরবার সিং জাতে পাঞ্জাবি, তার বাড়ি ছিল পাঞ্জাবের অমৃতসর জেলার জাল্লুপুর খেরা গ্রামে। তার জীবনে তিনটে শখ ছিল। মদ খাওয়া, বউকে পেটানো আর বউকে জোর করে যখন-তখন সহবাসে বাধ্য করা। তার বউ প্রথম কয়েক বছর মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করলেও ক্রমশ তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছিল। ১৯৭৫ সালে দরবার সিং যখন চাকরি থেকে বরখাস্ত হল, তখন বাড়িতে তাদের তিন তিনটে বাচ্চা। অথচ চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে দরবারের হিংস্রতা আরও বেড়ে চলেছিল। সঞ্চয়ের টাকা ভেঙে ভেঙে মদে চুর হয়ে থাকে, আর বাচ্চারা খিদের জ্বালায় কাঁদলেই তাদের মারে, বউকেও রেহাই দেয় না।
তার বউ লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করতে শুরু করল, সেই টাকায় বাচ্চাদের খাবার কিনে আনলে দরবার প্রায় দিন তা ছুড়ে ফেলে দেয়, জোর করে টাকাকড়ি কেড়ে নিয়ে বসে বসে মদ গিলতে শুরু করে। বছরের পর বছর এভাবে চলতে চলতে তার বউও পালটা মারতে লাগল। বাড়িতে অশান্তি, মারধোর লেগেই থাকছিল। ছেলেমেয়েরা ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। খুব বাড়াবাড়ি হলে পাড়ার লোকেরা এসে শান্ত করত।
অবশেষে একদিন দরবারকে বাড়ি থেকে বের করে দিল তার বউ। অন্য সময় হলে দরবার বউকে আধমরা করে দিত, কিন্তু চাকরি খোয়ানো এবং আরও নানা কারণে পাড়া প্রতিবেশী তাকে দেখতে পারে না। তাদের সমর্থনেই ওর বউ এত সাহস পেয়েছে।
”বেরোও! বেরোও বাড়ি থেকে! আমি খেটেখুটে পয়সা আনব, আর উনি মদ গিলে এসে মারধর করবেন! ছেলে মেয়েগুলোকে পর্যন্ত মারছে! একটা বাজে লোক!”
”ঠিক বলেছ। আমিও প্রতিদিন ওর বদমায়েশি দেখি। এইসব লোক সংসারে থাকার নয়!” দরবার সিং-এর প্রতিবেশী অকুণ্ঠভাবে ওর স্ত্রী-কে সমর্থন করে।
বউয়ের একতরফা চিৎকারে রাগে জ্বলতে জ্বলতে দরবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। বেরিয়ে কোথায় যাবে, কী করবে, প্রথমে কিছু ভেবে পেল না। অন্যমনস্কভাবে সে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোল অমৃতসর বাস স্ট্যান্ডে। যেদিকে দু-চোখ যায়, হাতের সামনে যা বাস পেল, তাতেই উঠে বসল।
আর এভাবেই দরবার সিং এসে পৌঁছোল কাপুরথালা শহরে। পাঠানকোট এয়ার ফোর্স নিষ্কৃতি পেল, দরবারের পরিবার মুক্তি পেল।
কিন্তু এবার দরবারের সামনে খোলা পৃথিবী।
অতএব নরক হয়ে উঠল তামাম দুনিয়া!
***
দরবার সিং-এর যৌনখিদে অত্যন্ত বেশি। সেই চাহিদা প্রত্যহ পূরণ না হলেই ও যেন মানুষ থেকে ধীরে ধীরে পশুতে পরিণত হয়। মদের জোগান না হয় কুলিমজুরি করে জোগাড় করা যায়, কিন্তু মেয়েমানুষ? প্রতিদিন পতিতালয়ে যাওয়ার মতো পয়সা কোথায়?
স্টেশনে মুটেগিরি থেকে কারখানায় দৈনিক লেবারের কাজ, বদমেজাজি, রগচটা দরবার কোনো কাজেই মন লাগিয়ে দু-এক সপ্তাহের বেশি করতে পারছিল না। এদিক-ওদিক টুকটাক কাজ করে চলে যাচ্ছিল কোনোমতে, কিন্তু শারীরিক খিদে ওকে উন্মত্ত করে দিচ্ছিল ক্রমশ।
যতদিন যেতে লাগল, দরবার পাগলের মতো হয়ে উঠতে লাগল।
কাপুরথালা একটা বড়ো শহর। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে ব্যস্ত থাকে মানুষ। রাস্তায় হেঁটে চলে অগণিত লোকজন, গাড়িঘোড়ার আওয়াজে কান পাতা দায় হয়ে ওঠে। অবসরে দরবার চুপ করে ফুটপাতে বসে থাকে। একমনে দেখে এই শহরটাকে।
পাঞ্জাবের অনেক ছোটো ছোটো গ্রাম থেকে পেটের দায়ে লোকজন কাজ করতে আসে এখানে। এইসব পরিযায়ী শ্রমিকরা প্রথমে একা এলেও পরে পরিবার নিয়ে চলে আসে। এত বড়ো শহরে ফুটপাতে হোক বা জলের মোটা মোটা পাইপের ভেতরে, থাকার জায়গা ঠিক হয়ে যায়। পরিবার সমেত থাকার সুবিধা দুটো। এক, দু-জায়গায় সংসার খরচ হয় না, আর দুই, বউরাও কামিনের কাজ করতে পারে। পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারগুলো স্বামী স্ত্রী দুজনেই কোনো না কোনো কারখানায় বা কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করে। গাধার খাটুনি খেটে রাতের বেলা ফেরে।
দরবার তীক্ষ্ন চোখে তাদের দেখে। এইসব কামিনগুলোর কাউকে রাতের বেলা তুলে আনলে কেমন হয়? উঁহু, পরক্ষণে সেই ভাবনা নস্যাৎ করে দেয় সে। এইসব ছোটোলোক লেবারারগুলো খুব বজ্জাত, ধরতে পারলে ওর মাথা গুঁড়িয়ে দেবে।
তাহলে? দরবার সময়-সুযোগ পেলেই বসে বসে ভাবে। কুলিকামিনগুলো যখন কাজে যায়, তাদের ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো এদিক-ওদিক ঘোরে। কখনো ভাঙা বালতি বা ফাটা টায়ার নিয়ে খেলে। কখনো ফুটপাতে বসে ধুলো মাখে, আবার কখনো কখনো সেখানে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কেউ দেখার নেই। বাপ-মা কাজে ব্যস্ত। প্রত্যন্ত গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এসে মহানগরে থাকার এইটুকু মাশুল তো দিতেই হবে। ওরাও দেয়।
দরবারের ক্ষুধার্ত চোখে ঝিলিক খেলে যায়। আর পারছে না সে। এইসব খেলতে-থাকা বাচ্চাগুলোই তো পারে তার খিদে মেটাতে।
১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি কাপুরথালার দুটো কনস্ট্রাকশন সাইটে দু-সপ্তাহের ব্যবধানে দুটো বাচ্চা মেয়ে ধর্ষিতা হল। দুজনেই পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের কন্যা, একজনের বয়স আট, একজনের দশ। নির্মীয়মাণ বহুতলের নির্জন করিডরে যখন তাদের উদ্ধার করা হল, তখন দুজনেই ছিল অচৈতন্য, ফ্রকে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
”মেরি গুড়িয়া!” বাবা-মা-র বুকফাটা কান্নার মধ্যেই তড়িঘড়ি তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। হাসপাতাল দুটোকেই রেপ বলে নিশ্চিত করল। বাচ্চা দুটোকে নেশা হওয়ার মতো কিছু খাওয়ানো হয়েছিল, হাসপাতালের বেডে শুয়ে তারা কিছুই বলতে পারল না। আট বছরের ডলির চোখে এত জোরে ঘুসি মারা হয়েছে, চোখের চারপাশটা কালশিটে পড়ে ফুলে উঠেছে। তার অপরিণত যৌনাঙ্গের ওপর দিয়ে যে বীভৎস অত্যাচার গিয়েছে, সেই আতঙ্কে, অবিশ্বাসে সে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রয়েছে মা-কে। আর দশ বছরের রহিমার এখন জ্ঞানই ফেরেনি। তার আঘাত আরো গুরুতর।
শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠল। ওরা সবাই দিন আনে দিন খায়, কতদূর থেকে থেকে সব এসে এসে মুখে রক্ত তুলে বাঁচছে, বাচ্চাগুলো নিজের মনে খেলে বেড়ায়, তাদের সঙ্গে এরকম পাশবিকতা কে করতে পারে? সবাই রাগে-উত্তেজনায় ফুটতে ফুটতে একজোট হয়ে গেল ঠিকাদারের কাছে।
শ্রমিকদের মধ্যে দীনেশ বেশ মুরুব্বি গোছের, অল্প বয়স হলেও লম্বা-চওড়া পেটানো চেহারা। মালিকের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসের জন্য অন্য সব শ্রমিক তাকে বেশ মানে। সে চিৎকার করে বলল, ”রাতে সাইটে চাবি দেওয়া থাকে সাব। ভেতরের কেউই এই কাজ করেছে। এ সাক্ষাৎ রাক্ষস। আমাদের বাচ্চাদের ইজ্জত নিয়ে আমরা কিছুতেই খেলতে দেব না সাব। আমরা থানায় যাচ্ছি, আপনিও চলুন সাব!”
ঠিকাদার অশোক শর্মা সবেমাত্র হাসপাতালের দিকটা ম্যানেজ করে এসেছিল। সাইটে একবার পুলিশ ঢুকলে তার নাম খারাপ হয়ে যাবে। নেতা-মন্ত্রী অনেককে ধরে কোটি কোটি টাকার টেণ্ডার জোগাড় করতে হয়, এইসব বদনাম রটলে পরের বার কি সে আর বরাত পাবে? এইসব অশিক্ষিত বেজন্মাগুলো আর কী বুঝবে, নিজের মনেই বিড়বিড় করে অশোক শর্মা। তারপর বাজখাঁই গলায় চিৎকার করতে গিয়েও থেমে যায়। পালের গোদা এই দীনেশটাকে চটিয়ে লাভ নেই। নরম গলায় একরাশ সমবেদনা ফুটিয়ে অশোক বলে, ”খুব খারাপ লাগছে, দীনেশ। বিমল কোথায়?”
বিমল ডলির হতভাগ্য বাবা। ছলছলে চোখে ভিড় ঠেলে সে এগিয়ে এলে অশোক এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে হাত দেয়, ”আমি এই থানা থেকে আসছি। বড়োবাবুকে বলে এলাম, এই শয়তানকে খুঁজে বের করে যেন ফাঁসিতে চড়ায়।”
গরিব সরল মানুষগুলোর মুখে আলো ফুটে ওঠে। তার মানে ওরা যখন হাসপাতালে, মালিক তখন থানায় ছুটেছিল?
দীনেশ নরম গলায় বলে, ”পুলিশ কাজ কখন শুরু করবে, সাব?”
”দাঁড়া! সবে তো জানিয়ে এলাম।” অশোক বলতে বলতে নিজের হিসেব খাতায় ঝুঁকে পড়ে, ”ওরা ফাইল বানাক, তারপর এই সাইট ফাঁকা করতে হবে!”
আশ্বস্ত হয়ে চলে যেতে যেতে ওরা আবার ঘুরে দাঁড়ায়, ”সাইট ফাঁকা? কেন, সাব? আমরা কাজ করছি তো!”
”বাহ, পুলিশ আসবে, এই টেন্ডারটা কি আমার কাছে আর থাকবে নাকি?” অশোক মুখে সরল হাসি ফুটিয়ে তোলে, ”তোদের সবার কাজ চলে যাবে, এটাই যা খারাপ লাগছে। কিন্তু কিছু করার নেই। ওই পাষণ্ডকে ধরতেই হবে।”
শ্রমিকদের মধ্যে এবার গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। সবাই দ্বিধান্বিত। পুলিশ এলে তাদের সবার কাজ চলে যাবে খাবে কী? বউ-বাচ্চাকে খাওয়াবে কী? সরল মানুষগুলো আইনের প্যাঁচপয়জার বোঝে না। জানে না যে, পুলিশ এলে তাদের বরং বেরোতে দেওয়া হবে না। অশোক শর্মার এই জলজ্যান্ত মিথ্যার ফাঁদে তারা পা দেয়। দুটো বাচ্চার সঙ্গে এমন হয়েছে বলে বাকি সব ক-টা বাচ্চাকে অনাহারে ঠেলে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সবাই ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা দিয়ে দেয়।
দরবার সিং বোকা ছিল না। একটা কনস্ট্রাকশন সাইটে অপরাধ করার পর সে ওখান থেকে অনেক দূরে চলে যেত, নিজের শিকার খুঁজত অন্য কোনো সাইটে।
তবু পরের বার শেষরক্ষা হল না। নিজের যৌনখিদের তাড়নায় উত্তেজনায় ফুটতে-থাকা দরবার সিং সাত বছরের গুড্ডিকে ঘুমের কড়া ওষুধ খাওয়ালেও মুখটা বন্ধ করেনি।
ঘুমের ওষুধের প্রভাবে গুড্ডির মাথা ঝিমঝিম করছিল, চোখ বুজে আসছিল, তবু তার মধ্যেই ও যখন টের পেল, ধীরে ধীরে টফির লোভ-দেখানো লোকটা ওর পোশাক খুলছে, ওর মনে পড়ে গেল মায়ের সাবধানবাণী। আগে দু-দুটো ঘটনার পর প্রতিদিন মা ওকে পাখি পড়ার মতো শেখায়, ”গুড্ডি! বেচাল দেখলেই যত জোরে পারবি, চেঁচাবি!”
গুড্ডির চেতনার সঙ্গে সিডেটিভ প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছিল। হেরে গিয়ে ঘুমে ঢলে পড়ার আগে গুড্ডি তার কচি গলায় প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, ”পাপাআআআ! বাঁচাআআআআও!”
ওই সাইটের শ্রমিকরা সতর্ক হয়েই ছিল। দরবার সিং পালানোর আগেই হাতেনাতে এসে ধরল তাকে। অন্য দুই সাইট থেকেও হইহই করে লোক আসতে লাগল, সবাই বেধড়ক পেটাতে লাগল দরবার সিংকে।
খবর পেয়ে সাইটের মালিক যখন এল, ততক্ষণে দরবার মারের চোটে প্রায় আধমরা হয়ে পড়েছে। মালিক এসে চোটপাট করল, এখানে মরে গেলে ওর ব্যাবসা তো লাটে উঠবে। নিজের কর্মচারীদের অকথ্য গালিগালাজ করে সে পুলিশে খবর দিল।
তিনটে শিশুকে ধর্ষণ ও খুনের চেষ্টার অভিযোগে দরবার সিংকে গ্রেপ্তার করা হল। আদালতে গিয়ে গুড্ডি আঙুল তুলে চিনিয়ে দিল, ”হ্যাঁ, এই লোকটাই সেদিন আমায় টফি দেবে বলে নিয়ে গিয়েছিল!”
ত্রিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হল দরবারকে। কিন্তু এই ‘দরবার সিং’ কেসের আর একটা অদ্ভুত লক্ষণীয় বিষয় হল তার অবিশ্বাস্যরকম সুপ্রসন্ন কপাল। সময়ের সিঁড়ি বেয়ে কাহিনি যত এগোবে, আমরা দেখব, কী অদ্ভূত সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে দরবার। বার বার সে হাতেনাতে ধরা পড়েও ঠিক ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের রাগে হাতের মুঠি শক্ত হবে, বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে চোখে জল আসবে, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারব না!
১৯৯৬ সালে লুধিয়ানা সেন্ট্রাল জেলে ঢুকে সাত বছর দরবার এত ভালো হয়ে থাকল, যে ২০০৩ সালে ‘গুড কনডাক্ট’-এর জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হল।
এইবার আমরা ঢুকছি কাহিনির মূলপর্বে। যে লোকটা লুধিয়ানার সেই জেল থেকে বেরোল, সে আর শুধুমাত্র যৌনখিদেয় ছটফট করা কামুক নয়, সে এক বিকারগ্রস্ত মানুষ। অসহ্য প্রতিশোধস্পৃহায় টগবগ করে ফুটছে সে। সাত বছর ধরে শান্ত থাকার অভিনয় করে গেছে শুধুমাত্র এই দিনের জন্য।
হ্যাঁ। এবার সময় এসেছে। যে পরিযায়ী শ্রমিকগুলো দূরদূরান্ত থেকে পাঞ্জাবে এসে খাচ্ছে, পরছে, তারাই কিনা পাঞ্জাবের ভূমিপুত্র দরবার সিংকে জেল খাটাল? দু-পয়সার একটা শ্রমিকের মেয়ে কিনা ওকে ধরিয়ে দিল? এত সাহস!
প্রতিশোধ নেবে, চরম প্রতিশোধ নেবে সে!
দরবার সিং প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে পরিকল্পনার ছক কষছিল। না, লুধিয়ানা থেকে সে কাপুরথালায় ফিরে যাবে না। যাবে না অমৃতসরেও। ঠিকমতো কাজ হাসিল করতে গেলে চাই নতুন শহর। অদূরের বাসটা দেখে উল্লসিত হয়ে ওঠে ও। হ্যাঁ। জলন্ধর। ও যাবে জলন্ধরে। সেখানে গিয়ে নাম ভাঁড়িয়ে কাজ নেবে কোনো কারখানায়, ভাড়া নেবে কোনো একচিলতে ঘর।
ব্যাস, তারপর অ্যাকশন! এবার থেকে আর চেনানোর সুযোগটুকুও দেবে না শয়তানের বাচ্চাগুলোকে। পাঞ্জাবের বুকে যত কাজ করতে আসা লেবারার, তাদের সবার রাতের ঘুম সে কেড়ে নেবে। ওর জীবন থেকে সাত বছর কেড়ে নেওয়া? ও তাদের জীবনগুলোই কেড়ে নেবে।
একজনকেও ছাড়বে না, যার সন্তান বেঁচে থেকে সূর্যের আলো দেখে!
***
২০০৪ সালের ১৮ এপ্রিল। পাঞ্জাবের জলন্ধর শহর। ওই একই দিনে পাঁচ পাঁচখানা নির্দোষ নিষ্পাপ শিশু দরবারের লালসার শিকার হল। দুজন কোনোমতে পালালেও বাকি তিনজনকে গলা টিপে খুন করেছিল সে।
হাড়-হিম-করা এই কাণ্ডের শুরু সকালবেলা।
ঘুম থেকে উঠে দরবার স্থানীয় দোকানে গিয়ে পঞ্চাশখানা লজেন্স কিনল।
”স্কুল টুলে দেবেন নাকি, এতগুলো নিচ্ছেন?” দোকানদার প্যাক করতে করতে জিজ্ঞেস করল।
”আরে না!” দরবার হাসল, ”বাড়ির জন্যই।”
”ক-টা ছেলেমেয়ে আপনার?”
আহ! এই দোকানদারের কৌতূহলের কোনো শেষ নেই। মনে মনে বিরক্ত হলেও দরবার মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ”তিনটে। এই লজেন্সটা খেতে খুব ভালোবাসে ওরা।”
জলন্ধর মডেল টাউনের এদিকটা বেশ ফাঁকা। নতুন জনবসতি গড়ে উঠছে, বেশ খানিকটা দূরত্ব অন্তর একটা করে বাড়ি। চওড়া ঝকঝকে রাস্তা, অথচ লোকসংখ্যা বেশ কম। এই মডেল টাউনেরই আরেকদিকে অস্থায়ী ছাউনি বেঁধে থাকে পরিযায়ী শ্রমিকরা। সকাল হতেই তারা কাজে বেরিয়ে যায়। মেয়েরা বাড়ির কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, কেউ কেউ স্বামীর সঙ্গেই চলে যায় দিনমজুরি খাটতে।
দরবার বাঁ হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছল। তারপর ধূর্ত নেকড়ের মতো খুঁজতে লাগল তার প্রথম শিকারকে। গ্রীষ্মের দুপুরবেলা। কাটফাটা রোদ্দুর। লেজ গুটিয়ে শুয়ে-থাকা কুকুর ছাড়া রাস্তায় সেভাবে কেউ নেই। তবে এই দুপুরই কিনা আদর্শ সময়।
বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। তিন নম্বর পেরিয়ে চার নম্বর গলিতে ঢোকামাত্র নিজের কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য দেখতে পেয়ে গেল দরবার।
দুটো ছোটো ছোটো বাচ্চা রাস্তায় খেলছে। মেয়েটার বয়স দশ, তার মা কাজে যাওয়ার আগে মাথায় যে বিনুনিটা করে দিয়ে গিয়েছিল, তা এখন ধুলো-মাখা হয়ে লুটোচ্ছে। পাশে খেলতে-থাকা ছেলেটা তার ছয় বছরের ভাই। এরা পরিযায়ী শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েই তো?
দরবার প্রথমে দশ মিনিট একটু দূরে দাঁড়িয়ে সরেজমিনে লক্ষ করল, কেউ আসে কি না। পরিস্থিতি নিরাপদ বুঝে সে এগিয়ে এল। গলায় আদর ঢেলে পাঞ্জাবি ভাষায় বলল, ”কী করছ তোমরা?”
মেয়েটা অবাক চোখে তাকাল। লোকটার ভাষা ও বুঝতে পারছে না।
দরবার পরক্ষণে হিন্দিতে বলল, ”ওহ, পাঞ্জাবি নও তোমরা?”
”না। আমাদের বাড়ি তো বিহারে।” মেয়েটা মুখ নামিয়ে আবার খেলায় মন দিল। একটা ঢিল ও ভাইকে দিচ্ছে, ভাই সেটা লুফে নিয়ে আবার ওর দিকে ছুঁড়ছে।
দরবারের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। এই তো, প্রথমেই পাওয়া গেছে। ও আরও মিষ্টি সুরে হিন্দিতে বলল, ”কী নাম তোমার?”
মেয়েটা বার বার খেলায় বাধা পেয়ে বিরক্ত হচ্ছিল। তবু বিনুনি দুলিয়ে গড়গড় করে বলে গেল, ”আমার নাম গুড়িয়া। আর এই যে আমার ভাই, ওর নাম সতীশ। এবার যাও তো, আমরা খেলছি।”
দরবার আশপাশ একবার দেখে নিল। তারপর পকেট থেকে একতাড়া লজেন্স বের করল। হাত বাড়িয়ে বলল, ”লজেন্স খাবে?”
গুড়িয়া আর সতীশ তো অবাক! ওদের বাপ-মা একখানা লজেন্স চাইলেই বকে, আর সেখানে এই লোকটা যেচে এতগুলো লজেন্স দিচ্ছে?
সতীশ উল্লসিত চোখে দিদির দিকে তাকাল। তারপর দুই ভাই বোন একটার পর একটা লজেন্স খেতে লাগল।
দরবার চুপচাপ দেখছিল ওদের খাওয়া। তিন নম্বর শেষ করে গুড়িয়া যখন চার নম্বর লজেন্স মুখে পুরল, দরবার বলল, ”ভালো খেতে?”
”দারুণ! তুমি কী ভালো গো চাচা!” গুড়িয়া কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল।
”আচ্ছা, তোমরা বড়ো বড়ো ক্যাডবেরি খেয়েছ?” দরবার হাত দিয়ে আকার দেখাল, ”যেগুলো টিভি-তে দেখায়?”
”না গো!” গুড়িয়ার মুখটা নিভে গেল, ”দোকানে দেখেছি। কখনো খাইনি।”
দরবার জিভ দিয়ে ঠোঁটটা আরেকবার চেটে নিল, তারপর মিহি গলায় বলল, ”আমার কাছে ওরকম বড়ো বড়ো ক্যাডবেরি অনেক আছে।”
”তা ই!” গুড়িয়া চোখ বড়ো বড়ো করে ভাইয়ের দিকে তাকাল।
”হ্যাঁ। তোমরা খাবে? তাহলে দেব।”
”হ্যাঁ খাব।”
দরবার এবার উঠে দাঁড়াল, ”তাহলে চলো আমার সঙ্গে।”
গুড়িয়া সতীশের হাত ধরে অমনি দরবারের পিছু নিতে উদ্যত হল। তারা পৃথিবীতে এসেছে এখনও এক দশকও পূর্ণ হয়নি, কী করে জানবে, কার মনে কী বিষ আছে? তাদের সরল মনে তারা কল্পনাও করতে পারল না, ক্যাডবেরি নয়, তারা পা বাড়াচ্ছে মৃত্যুর দিকে।
অদূরে বিস্তৃত শস্যখেত। পাকা সোনার মত ফসল। দরবার সেদিকে হাঁটতে লাগল। গুড়িয়া আর সতীশ নাচতে নাচতে ওর সঙ্গে যাচ্ছিল। সতীশ জিজ্ঞেস করল, ”তোমার বাড়িতে অনেক বড় বড়ো চকোলেট আছে, চাচা?”
”অনেক! এই অ্যাত্ত!” দরবার হাত দিয়ে দেখাল।
ভাই বোনের মুখে আনন্দের আলো খেলা করছিল। হঠাৎ রাস্তায় তারা তাদেরই এক বন্ধুকে দেখতে পেল। শংকর। তার বয়স আট বছর।
”এদিকে কোথায় যাচ্ছিস রে তোরা?” শংকর একটা আখ চিবোচ্ছিল।
গুড়িয়া কিছু বলার আগে সতীশ হড়বড় করে বলল, ”এই চাচার কাছে অনেক চকোলেট আছে রে। আমরা খেতে যাচ্ছি। তুইও আয় না!”
শংকরও ওদের সঙ্গে যোগ দিল।
খাঁ খাঁ রোদে গমখেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দরবার দ্রুত চিন্তা করছিল। অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারলে জানাজানির ভয় থাকবে না। ওই তো ওইদিকটা প্রায় এক-মানুষ সমান গাছ, ওখানটা নিয়ে যেতে হবে।
প্রায় পনেরো মিনিট হাঁটার পর তিনটে বাচ্চা যখন দেখল, তাদের চারপাশে খালি গমখেতের সারি, ওরা একটু ভয় পেয়ে গেল। গুড়িয়া সবার মধ্যে বড়ো, মুরুব্বি গোছের স্বভাবের জন্য ওকে সবাই বেশ মান্যিগণ্যিও করে। ও বলল, ”এদিকে তো কোনো বাড়ি নেই। তুমি যে বললে আমাদের চকোলেট দেবে?”
দরবার থামল। তার শরীরে হরমোনরা দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে। পকেট থেকে চকচকে ছুরিটা বের করল ও, তারপর কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুরিটা সোজা চালিয়ে দিল ছয় বছরের সতীশের কচি গলায়।
সতীশ প্রথমে বুঝতে পারল না কী হচ্ছে। নলি কাটতে গিয়ে যে সূক্ষ্ম ধাতব শব্দটা উৎপন্ন হয়, তাতে একটু বিস্মিত হয়ে ঘাড় হেঁট করে নিজের গলার দিকে তাকাতে চেষ্টা করল। তার আগেই ও ধপ করে পড়ে গেল মাটিতে। মুখ দিয়ে শেষ আওয়াজ বেরোল, ”আঁক!”
গুড়িয়া আর শংকর অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, সতীশের পড়ে যাওয়ার ধপ করে হওয়া শব্দ শুনে ওরা তাকাল। বিস্ফারিত চোখে প্রথমে বুঝতে চাইল পরিস্থিতি। এই আট দশ বছরের ক্ষুদ্র জীবনকালে চোখের সামনে খুন হতে ওরা কাউকে দেখেনি, তবু ওদের দুজনেরই ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিল, ”পালাতে হবে। এখুনি!”
দুজনকে দু-দিকে পালাতে দেখে দরবার রাগে আগুন হয়ে গেল। তারপর ছুটতে শুরু করল গুড়িয়ার পেছনে।
বাচ্চা ছেলে মেয়ে-দুটো নিজেদের উচ্চতার থেকেও লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা গম গাছের সারির মধ্যে দিয়ে পাগলের মতো ছুটছিল। আতঙ্কে-ভয়ে তাদের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। গুড়িয়ার মুখ দিয়ে দমফাটা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। ওর ভাই—ওর আদরের ছোট্ট ভাইটাকে অমন করে মেরে ফেলল? কেন? লোকটা এমন কেন করল? ওরা তো লোকটার কোনো ক্ষতি করেনি!
ভাবতে ভাবতে হঠাৎই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল গুড়িয়া। ধড়ফড় করে উঠে আবার ছোটার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। কারণ, তার আগেই ওর নরম পা দুটো সাঁড়াশির মতো চেপে ধরেছে দরবার সিং।
দশ বছরের গুড়িয়া চেঁচাতে গিয়েও পারল না। দরবার সিং অনেকটা গমের শিষ পুরে দিয়েছে ওর মুখের ভেতরে। ওর গলা আটকে যাচ্ছিল, তার মধ্যেই লোকটা টেনে টেনে তার ফ্রকটা ছিঁড়ছে দেখে গুড়িয়া অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তার শিশুমনে নর-নারীর আদিম সম্পর্ক অজ্ঞাত, তার সরল মাথায় এটা ঢুকছিল না যে, লোকটা করতে কী চাইছে!
হতভাগ্য গুড়িয়ার বেশিক্ষণ মাথা ঘামানোর সুযোগ হল না। অত্যাচারের বীভৎসতায় তার দম বন্ধ হয়ে এল, মনে হল, কেউ যেন টেনে টেনে তার ছোট্ট শরীর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনছে। ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে সব কিছু। ও কথা বলতে পারছিল না, চোখের কোণ দিয়ে অঝোরে গড়াচ্ছিল অশ্রু। মনে মনে সে ডাকছিল, ”মা! মা গো!”
প্রায় পনেরো মিনিট পর নিথর গুড়িয়ার রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ধর্ষিতা দেহটা ফেলে গমখেতের মধ্যে উঠে দাঁড়াল দরবার। হাঁপাচ্ছে সে, কিন্তু শরীরের মধ্যে দিয়ে অ্যাড্রিনালিন ছুটছে উল্কার গতিতে। দু-দুটো লেবারারের বাচ্চাকে শেষ করেছে সে, অরো একটা যদিও পালিয়েছে। কিন্তু ওর খিদে তো মেটেইনি, উলটে টগবগ করে ফুটছে রক্ত!
কী করবে এবার দরবার? কোথায় পাবে আরও শিকার? দ্রুত খেত থেকে বেরিয়ে আসে সে আনন্দে তার শরীর কাঁপছে। অপরিণত হলেও নারীদেহ, এতদিন পর তার যৌনখিদে মিটেছে, কিন্তু আরও চাই। আরও চাই।
উদ্ভ্রান্তভাবে হাঁটতে হাঁটতে দরবার এসে পৌঁছল রাস্তা মহল্লায়। ততক্ষণে ও একটু শান্ত হয়েছে। চোখের মণি স্বাভাবিক হয়েছে। ধীরস্থিরভাবে সে আবার শিকার খুঁজতে লাগল। রাস্তা মহল্লাতেও মূলত পরিযায়ী শ্রমিকরাই থাকে।
ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। দীক্ষা আর আশা দুই বোন। একজনের বয়স আট, অন্যজনের ছয়। বাড়ি থেকে একটু দূরে ফাঁকা একটা মাঠে দু-বোনে ব্যাডমিন্টন খেলছিল। জায়গাটার নাম কোম্পানি বাগ।
ব্যাডমিন্টন অবশ্য নামেই, দুটো প্লাস্টিকের টেবিল টেনিস র্যাকেট কোথা থেকে জোগাড় করেছিল, অনেক বলে-কয়ে বাবাকে দিয়ে আনানো গিয়েছে শাটল কক। দুটোরই অবস্থা শোচনীয়। তবু তা-ই দিয়েই খেলা হচ্ছে।
দরবার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা দেখল। তারপর সমব্যথীর ভঙ্গিতে বলল, ”র্যাকেট দুটোর কী অবস্থা! ক্ষয়ে গেছে পুরো। ককটাও তা-ই। এই দিয়ে কি খেলা হয় নাকি!”
দীক্ষা আর আশা তাকাল। একটা মাঝবয়সি লোক। সাদা শার্ট আর খয়েরি প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটাকে তো এই তল্লাটে কখনো এর আগে দেখেনি! দীক্ষা একটু সন্দিগ্ধভাবে বলল, ”কে তুমি?”
”আমি একটা চাচা।” দরবার হাসল, ”ব্যাডমিন্টন খেলা শেখাই আমি।”
”ব্যাডমিন্টন শেখাও!” আশা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। ব্যাডমিন্টন খেলার ওর অদম্য ইচ্ছে, কিন্তু সুযোগ কই, ”কোথায় শেখাও গো?”
”ওই যে—ওইদিকে আমার কোচিং স্কুল।” দরবার দূরে কোনো অদৃশ্য বাড়ির দিকে আঙুল তুলল, ”তোমরা দেখতে আসবে? অনেক নতুন নতুন র্যাকেট আছে। কক আছে।”
দীক্ষা আর আশা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। কী করবে? বাড়িতে একবার বলে আসবে? না থাক, যদি দেরি করলে লোকটা চলে যায়?
দরবার এবার অনেকগুলো লজেন্স বাড়িয়ে দেয়, ”এই নাও। লজেন্স খেতে খেতে আমার সঙ্গে এসো। অতগুলো রয়েছে, তোমাদের দুজনকে নাহয় একটা করে দিয়ে দেব।”
দীক্ষা আশা আর দ্বিধা করে না। যে লোক যেচে এগিয়ে এসে লজেন্স দেয়, তার মতো ভালো আবার কেউ হয় নাকি? নিশ্চিন্ত মনে আনন্দে প্রায় নাচতে নাচতে ওরা দরবারের পিছু নেয়।
”আচ্ছা, তোমাদের নাম কী?”
”আমার নাম দীক্ষা। ওর নাম আশা।”
”বাহ! কী সুন্দর নাম।”
দরবার হাঁটতে থাকে অনেক দূর। গল্প করতে করতে, একটার পর একটা লজেন্স দিতে দিতে। হাঁটতে হাঁটতে ওরা কোম্পানি বাগ পেরিয়ে যায়। চলে যায় বিয়াস নদীর কাছাকাছি রাইয়া বলে একটা জায়গায়।
সেখানে রয়েছে বিয়াস নদী থেকে কেটে-আনা চওড়া খাল। হু হু করে বইছে বাতাস। সেই ঠান্ডা হাওয়া এই গরমেও মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। নির্জন চরাচর। দু-একটা পাখি ছাড়া কেউ নেই।
দরবার মনে মনে ছকে নেয়। ঘণ্টা দেড়েক আগে একসঙ্গে ধরতে গিয়ে ছেলেটা পালিয়েছিল। এবার সেটা কিছুতেই করা যাবে না। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে, ”আশা, তুমি এখানে একটু চুপটি করে বসো, কেমন? আমি আগে তোমার দিদিকে নিয়ে যাই আমার সেন্টারে, তারপর তোমায় নিয়ে যাব।”
”একসঙ্গেই তো যেতে পারি আমরা!” আশা তীক্ষ্ন চোখে তাকায়।
বোনের মতো দিদি অত সন্দেহপ্রবণ নয়। দরবার সিং উত্তর খোঁজার আগেই দীক্ষা বোনকে বোঝায়, ”আহ! দুজন একসঙ্গে গেলে র্যাকেট দেবে না রে। তুই বোস চুপটি করে। আমি আমারটা নিয়ে এলেই তুই যাবি, বুঝলি বোন?”
খালের ওপর কালভার্ট। আশা সেখানে পা ঝুলিয়ে চুপ করে বসে থাকে। পশ্চিমে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গনগনে লাল হয়ে উঠেছে সেদিকটা। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আশা ফের তাকায় দূরে দরবার সিংহের পিছু পিছু হাঁটতে-থাকা দিদিকে। ওর মনটা কেমন যেন ককিয়ে ওঠে। অস্ত-ওঠা সূর্যের সঙ্গে কি ওর শিশুমন দিদির কোনো মিল পায়?
হয়তো বা পায়! না হলে বেশ কিছুটা দূরে ঝোপের মধ্যে নিয়ে গিয়ে দরবার যখন আট বছরের দীক্ষাকে সর্বশক্তি দিয়ে পিষছিল, রক্তে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল দীক্ষার শরীর, তখন আশা হঠাৎ উঠে পালাতে যাবে কেন? মাত্র ছয় বছর বয়স তার, এতদূরে সে কোনোদিনও একা একা আসেনি। বাড়ির পথও চিনতে পারে না। তবু সে থামে না। ওর মস্তিষ্ক যেন ওকে বার বার বলতে থাকে, ”পালাও! পালাও!”
আশা কতক্ষণ ধরে একটানা ছুটছিল, তার কোনো হিসেব নেই। একসময় ক্লান্ত হয়ে সে থেমে গেল।
সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়েছে। আশা নিজের বাড়ি থেকে একেবারে উলটোদিকে ছুটেছিল, যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেটা পাঞ্জাবের একটা অন্য জেলা। সেই জেলার নাম তার্ন তরণ। মূলত শিখদের বাস এই জেলায়। আশা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশেই একটা মস্ত বড়ো ঝিল। তার নাম বাদশাহুর ঝিল।
আশার খুব ভয় করছিল। ছলছল করছিল তার চোখ। বাড়ি যেতে গিয়ে এ কোথায় এসে পড়ল ও! কাউকেই তো চেনে না। ওর দিদি… ওর দিদি দীক্ষারই বা কী হল?
”তোমার নাম কী বেটি?”
আশা চমকে তাকাল। দরবার সিংহের বয়সীই এক মাঝবয়সী লোক কৌতূহলী চোখে প্রশ্ন করছে।
”আশা।” ও ভাঙা স্বরে বলল।
”এদিকে তো দেখিনি কোনোদিন। কাদের বাড়ির বেটি তুমি?”
”আমি—আমি বাড়ি যাব!” ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল আশা।
লোকটার নাম মালকিয়াত সিং। মালকিয়াত যখন বুঝল, আশা রাস্তা হারিয়ে এদিকে চলে এসেছে, সে আশাকে একটা দোকানে নিয়ে গেল। কেক-বিস্কুট কিনে দিল। জল খাওয়াল। একটু সুস্থির হলে তারপর তাকে নিয়ে গেল খাদুর সাহিব থানায়।
”সাহেব! এই বাচ্চাটা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। ঠিকানা বলতে পারছে না। শুধু নাম বলছে। একটু খোঁজ করুন-না সাব!” মালকিয়াত অঝোরে কাঁদতে-থাকা আশার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তাকে শান্ত করছিল, ”কাঁদে না বেটি। আমি তো আছি! আমি ঠিক তোমায় তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসব।”
লিখতে লিখতে আমার নিজের চোখও ভিজে আসছিল। একদিকে দরবার সিংহর মতো পশুরা থাকে বলে দীক্ষারা এভাবে শেষ হয়। অন্যদিকে মালকিয়াত সিংহর মতো মানুষরা আজও আছে বলে আশারা বেঁচে যায়।
খাদুর সাহিব থানা থেকে খবর গেল তার্ন তরণ জেলায়। ডিফেক্ট কন্ট্রোল রুম থেকে খবর পাঠানো হল সব ক-টা জেলায়। আশা নামের একটা মেয়েকে পাওয়া গেছে। কোনো মিসিং ডায়েরি আছে?
হ্যাঁ আছে। বাড়ির দুই মেয়েকে কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে সেদিন সন্ধ্যাতেই দীক্ষা-আশার পরিবার নিখোঁজ ডায়েরি করেছিল। আশাকে খুঁজে পাওয়ার খবর দ্রুত চলে গেল সেই থানায়।
আর দীক্ষার ক্ষতবিক্ষত নগ্ন দেহ পাওয়া গেল দুদিন পর, বাহাদুর উপ্পল খালের ধারে। একটা বড়ো পাথরের পাশে তার নিষ্প্রাণ দেহটা পড়েছিল। দ্রুত পোস্টমর্টেম হল। ফরেনসিক এক্সপার্ট রায় দিলেন, ”নিউরোজেনিক শকে মৃত্যু। আট বছরের মেয়ে। গোপনাঙ্গে সাংঘাতিক আঘাত, সেই শক শরীর নিতে পারেনি।”
ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ‘নারাচ’ উপন্যাসে লিখেছিলাম, উনিশ শতকে অপরিণত বাচ্চা মেয়েরা কীভাবে বিয়ের পর স্বামীর কাছে ধর্ষিতা হয়ে মারা যেত। ১৮৮৯ সালে তেত্রিশ বছরের এক যুবক হরিমোহন মাইতি বিয়ে করেছিল দশ বছরের ফুলমণিকে। ফুলশয্যার রাতে স্বামীর ভালোবাসা সহ্য করতে পারেনি ফুলমণি, প্রবল রক্তপাতে মৃত্যু হয় তার। তা-ই নিয়ে গোটা দেশ তোলপাড় হয়েছিল। Empress v. Hari Mohan Maiti মামলায় জেল খাটতে হয়েছিল স্বামী হরিমোহনকে। ফুলমণির মৃত্যুর পরই ১৮৯১ সালে পাশ হয়েছিল সেই বিতর্কিত সহবাস সম্মতি আইন।
তারপর চলে গেছে কতগুলো বছর, গঙ্গা দিয়ে গড়িয়েছে কত জল! তবু আজও দরবার সিংহর মতো বিকৃত জন্তুদের লালসার শিকার হতে হয় দীক্ষাদের। যে বাচ্চাটা বড়ো হয়ে কত কী করতে পারত, এই পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ অনুভব করতে পারত, তাকে মরে যেতে হয় অভাবনীয় কষ্ট পেয়ে।
প্রতিটা খুনের পর দরবার সিং যে মদ খেয়ে আনন্দ উদযাপন করত, তা সে নিজেই পরে জেরায় জানিয়েছিল। বলেছিল, ”প্রতিবার যখন ভাবতাম, একটা করে শ্রমিকের বাচ্চাকে সরিয়ে দিতে পেরেছি, কী যে আনন্দ হত!”
ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়, দরবার সিং-এর মতো মানুষগুলোকে আর পাঁচজনের মতোই দেখতে। আর সবার মতোই সে রাস্তা দিয়ে হাঁটে, কথা বলে, খায়। ভাবতে বসলে আঁতকে উঠি। কতটা অসুরক্ষিত আমাদের শিশুরা!
দরবার আবার অভিযানে বেরোল ১৭ জুন। দু-মাস কেটে গেছে। প্রতিশোধে তো সে টগবগ করে ফুটছেই, যৌনখিদেও তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। ছেলে হোক, মেয়ে হোক, বাচ্চা হোক, বৃদ্ধ হোক, তার শুধু রক্তমাংসের শরীর চাই। শরীর!
সেদিন সে পেল যতিন্দরকে। যতিন্দরের বয়স নয় বছর, সে-ও এক পরিযায়ী শ্রমিকের ছেলে। থাকে লেদার কমপ্লেক্স এলাকায়। দরবার সিং তাকে গরম ঝাল ঝাল সামোসার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গেল। যথেচ্ছ বিকৃত যৌন উৎপীড়নের পর তাকে খুন করল।
.
বারো দিন পর দরবার আবার বেরোল। ২৯ জুন। বেরিয়েই দুটো বাচ্চাকে সে একসঙ্গে পেয়ে গেল। রবিনাকুমারী আর পাতালকুমারী। একজনের বয়স চার, আরেকজন সবে সাড়ে তিন পেরিয়েছে। দুজনেই থাকে শাস্ত্রী নগরের লেবার কলোনিতে। তাদের বাবা-মায়েরা কাজে গিয়েছে। দুজনে রাস্তার ধারে বসে রংচটা একটা পুতুল নিয়ে খেলছিল। একটু আগেই পুতুলটা কুড়িয়ে পেয়ে ওরা দুজনেই যারপরনাই উত্তেজিত।
উলটোদিকের চায়ের দোকানের বয়স্ক বিক্রেতাও বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছিল এদিকে। ওদিক দিয়ে সে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, ”ওটা কার পুতুল রে?”
পাতাল আধো আধো স্বরে বল, ”আমাল।”
”ধ্যাত!” দোকানদার মজা করে বলল, ”রবিনা যে বলল, পুতুলটা ওর?”
পাতাল দু-দিকে মাথা ঝাঁকাল, ”না ওতা আমাল। তা-ই তো লবিনা?”
রবিনা উবু হয়ে বসে পুতুলের সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ”পুতুলতা তোর, তুলতা আমাল, কেমন?”
”না না!” দোকানদার রাগিয়ে দিল, ”ওটা তো আমার পুতুল!”
অদূরেই চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দরবার। অপেক্ষা করছিল দোকানদারের অন্যমনস্ক হয়ে পড়ার। সুযোগ এল কিছুক্ষণ পরেই। একটা বড়ো দল দোকানের বেঞ্চে এসে বসল। হইহই করে চা, ডিম-টোস্ট, বিস্কুট অর্ডার দিতে লাগল। দোকানদার ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওদিকে।
দ্রুত এগিয়ে এল দরবার। উবু হয়ে বসে বলল, ”পুতুল নেবে? খুব সুন্দর এই অ্যাত্ত বড়ো পুতুল!”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই বাচ্চা দুটো দরবারের সঙ্গে চলতে শুরু করল। বড়ো বড়ো পুতুল পাবে ওরা। ওদিকে দোকানদার তখন ব্যস্ত।
দরবার সিং বাচ্চা দুটোকে দ্রুত নিয়ে গেল রাস্তার পাশের জঙ্গলের ভেতরে। ওর শরীরের ভেতর রক্ত গরম হয়ে উঠেছে। উহ, দুমাস। দুমাস পর আবার ওর খিদে মিটবে।
কিন্তু সুবিধে হল না। বাচ্চা দুটো বড্ড ছোটো। নিজের বাবা-মা, আশপাশের কয়েকজন পরিচিত মানুষজন ছাড়া অন্য কারোর সঙ্গে বেশিক্ষণ থাকতে এখনও অভ্যস্ত নয়। পুতুলের লোভে প্রথমে উঠে এলেও জঙ্গলের মধ্যে ঢোকামাত্র তারা সিঁটিয়ে গিয়েছিল। দরবার জোর করে টেনে রবিনার জামা খুলতে গেলেই দুজনে মিলে পরিত্রাহি চিৎকার করতে শুরু করল। বাচ্চার গলার স্বর এমনিতেই তীক্ষ্ন হয়, দুজনের সম্মিলিত আর্তনাদে লোকজন ছুটে এল। ঝোপ পেরিয়ে তাদের আসার খচরমচর শব্দ পেয়ে দরবার আর দাঁড়াল না। উলটোদিক দিয়ে পালিয়ে গেল।
দোকানদারটা ছুটতে ছুটতে এল। দোকান ফাঁকা হওয়ামাত্র সে খেয়াল করেছিল রবিনা আর পাতাল নেই। চিৎকার শোনামাত্র সে-ই লোকজন জুটিয়ে জঙ্গলে ঢুকে এসেছে।
মাঝে মাঝে ভাবি, মানুষ যে মন্দির-মসজিদ-গির্জায় যায়, আসলে ঈশ্বর কি সেখানেই থাকেন? না। আমার তো মনে হয়, ঈশ্বর থাকেন মানুষের মনে। পাতাল আর রবিনার কাছে যেমন ঈশ্বররূপে সেদিন এসেছিল সেই চায়ের দোকানদার।
”আমি তখনই দেখেছিলাম, একটা আধবুড়ো লোক ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে। কী হয়েছে, রবিনা? কী হয়েছে, পাতাল?” দোকানদার জিজ্ঞেস করল।
বাকি লোকজনও হইহই করে উঠল, ”কী হয়েছে, বল। চামড়া গুটিয়ে দেব মেরে!”
কিন্তু পাতাল আর রবিনা দুজনেই এত ছোটো, জড়ানো কান্না আর ফোঁপানোর মাঝে তারা গুছিয়ে কিছু বলতেই পারল না। খালি হাপুসনয়নে কেঁদে যেতে লাগল। সবাই মিলে ওদের কোলে করে চায়ের দোকানে নিয়ে এল। জল-বিস্কুট খাইয়ে তাদের শান্ত করা হতে লাগল।
ওদিকে আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে দরবার। একে এতদিন পর বাগে পেয়েছিল, তাও হাতছাড়া হতে ও উন্মত্ত বাঘের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল শহরের অলিতে-গলিতে। বোতলের পর বোতল মদ শেষ করতে লাগল, তীব্র আক্রোশে নিজের মনেই গজরাতে থাকল।
গুমরোতে গুমরোতে দরবারের মাথায় একটা ফন্দি এল। এই বাচ্চাগুলো মহাশয়তান, রেপ করতে করতেই এমন চেঁচাবে, খুন করার আগেই লোকজন এসে পড়বে। তার চেয়ে প্রথমে গলা কেটে দিয়ে তারপর রেপ করলে চেঁচাতে পারবে না।
এগুলো আমার কল্পনা নয়। অ্যারেস্ট হওয়ার পর থানায় বসে পুলিশি জেরায় দরবার নিজের মুখে জানিয়েছিল তার এই প্ল্যান।
মিথ্যা বলব না, এগুলো লিখতে লিখতে বিবমিষায়, আতঙ্কে, অবিশ্বাসে আমার হাত ঠান্ডা হয়ে আসছিল। আমার কলম সরছিল না। কিন্তু এমন একজন লোক যে আমাদের আশপাশেই থাকতে পারে, তা জানানোর দায়িত্বটা যেন পরমুহূর্তে আমার বিমূঢ় অবস্থা কাটিয়ে তুলছিল।
দেড় মাস পর দরবার সিং সফলভাবে নিজের বুদ্ধিকে কাজে লাগাল। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট পুনম নামের এক সাত বছরের বাচ্চা মেয়েকে সে নির্জনে নিয়ে গেল।
”ও চাচা, তুমি যে বললে, আমায় একটা নতুন ফ্রক দেবে, কই দাও!”
দরবার সিং ঘোলাটে চোখে তাকাল। বলল, ”জামা পরতে গেলে তো আগে জামা খুলতে হবে।”
পুনমকে কথা বলতে দিল না দরবার সিং। ধারালো ছুরি দিয়ে গলাটা কেটে হাঁ করে দিল। তারপর ধীরেসুস্থে ধর্ষণে উদ্যত হল। ওইটুকু বাচ্চার ওপর নারকীয় অত্যাচার করে দরবার যখন ক্ষান্ত হল, তার কিছুক্ষণ আগে পুনম মরে শান্তি পেয়েছে। মৃত্যুর আগে গলার মরণাঘাত ও নিম্নাঙ্গের ওপর ভয়ংকর অত্যাচারে তার দু-চোখ দিয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরছিল। সেই অশ্রুধারা মৃত্যুর পরও থামল না।
মরা বিবস্ত্রা মেয়েটাকে দেখতে দেখতে দরবার সিং উল্লসিত হয়ে উঠল। উফ, কী দারুণ একখানা বুদ্ধি ফেঁদেছে ও। আর কোনো ভয় নেই। এবার যত ইচ্ছে বাচ্চা তোলো।
***
দরবার সিং ভেবেছিল, এইসব গরিব শ্রমিকগুলো তাদের বাচ্চা নিখোঁজ হতেও তেমন কিছু হল্লা করবে না। আরে বাবা, চিৎকার করতেও তো টাকার জোর লাগে। কিন্তু দরবারের ভাবনা ভুল ছিল। পাঞ্জাব জুড়ে একের পর এক বাচ্চাকে যৌননিপীড়ন করে খুন— এই খবর ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছিল পাড়ায় পাড়ায়। পুলিশ সেভাবে কাজ শুরু না করলেও রাজ্যের সবাই সতর্ক হতে শুরু করেছিল।
দরবারের মাথায় আবার শয়তান ভর করল ঠিক ন-দিন পর, ১৫ আগস্ট। ইচ্ছে করেই স্বাধীনতা দিবসের দিনটাকে সে বেছে নিয়েছে। এদিন পাড়ায় পাড়ায় পতাকা উত্তোলন হয়, অনুষ্ঠান হয়, সবাই ব্যস্ত থাকে। শিকার ধরার জন্য এর চেয়ে ভালো দিন আর হয় না। নিজের ভাঙা সাইকেল নিয়ে দরবার এ পাড়া থেকে ও-পাড়ায় ঘুরছিল।
বস্তি শেখ এলাকায় রিপুদমন বেশ নামকরা যুবক। বাইরে থেকে এসে শ্রমিক কাজ করলেও এই বস্তির যেকোন উৎসবে-পার্বণে সে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। স্বাধীনতা দিবসের দিনও সে স্বাভাবিকভাবেই খুব ব্যস্ত। পাড়ার বেশ কয়েকজন কচিকাঁচাকে নিয়ে সে দেশাত্মবোধক গান, নাটক করাবে, সেইজন্য পাড়ার মাঠে ম্যারাপ বেঁধে মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। তার বউ কাবেরী অত হুজুগে না হলেও স্বামীর কোনো কাজে সে বাধা দেয় না।
রিপুদমন এই নিয়ে সকাল থেকে দশবার বাড়িতে এল।
”কই গো! কোথায় গেলে?”
”কী হল?” কাবেরী রান্না করতে করতে জবাব দেয়।
”আরে একটা বড়ো কাপড় দাওনা। স্টেজের পেছনটায় বাঁধব!”
কাবেরী এবার রাগ করে উঠে এল, ”সকাল থেকে তুমি কী শুরু করেছ বলো তো! একবার দড়ি, একবার আঠা, একবার কাপড়, একবার কাগজ। সংসারের কাজকর্ম কি সব শিকেয় তুলব নাকি তোমার জ্বালায়? কই, পাড়ার আর কোনো লোক তো তোমার মতো করছে না!”
”আহা চটো কেন!” রিপুদমন হাসে, ”গরিব পাড়া। লোকের অত পয়সা কোথায়?”
”ওহ, আর আমাদের বুঝি কুবেরের ধন রয়েছে?” কাবেরী আরও রেগে যায়।
”আরে তা নয়। একটা ভালো দিন। কাউকে না কাউকে তো উদ্যোগ নিতে হয়। ছেলে-মেয়েগুলোও তো তবে দেশকে ভালোবাসতে শিখবে।”
”তা অন্যের ছেলে-মেয়েকে শেখানোর সঙ্গে সঙ্গে নিজেরটাকেও তো শেখাতে পারো!” কাবেরী মুখঝামটা দিল, ”সকাল থেকে মেয়েটা বাইরে বসে আছে। বলছে বাবা কোথায়। ওকে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?”
”আরে, লক্ষ্মী তো মাত্র পাঁচ বছরের, ও কী বুঝবে বলো। আর দু-বছর যাক, নিয়ে যাব। রাগ কোরো না।” রিপুদমন আর দাঁড়ায় না, কাবেরী কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার একখানা ভালো শাড়ি নিয়ে পালায়।
”অ্যাই, ওটা আমার বিয়েবাড়িতে পরার শাড়ি!” কাবেরী চিৎকার করে হাল ছেড়ে দেয়। তার এই পাগল স্বামীটিকে সে আর মানুষ করতে পারবে না। বাড়ির ভেতরে আসার আগে তার চোখ পড়ে মেয়ের দিকে। পাঁচ বছরের লক্ষ্মী একমনে খেলে চলেছে। মা-কে দেখে সে আধো আধো গলায় বলে, ”বাবা আমাকে থাইকেলে চড়াবে কখন, মা?”
কাবেরী হাসে। ওর মেয়ে সাইকেলে চড়তে পেলে আর কিছু চায় না। রিপুদমন বাড়িতে থাকলেই ওই এক আবদার, ওকে সাইকেলের সামনের রডে বসিয়ে ঘোরাতে হবে।
”চড়াবে, সোনা। তুমি খেলো। আমি রান্নাটা করে আসি, কেমন?”
কাবেরী হয়তো নিজের ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি এই তার মেয়েকে শেষ দেখা।
দরবার সিং দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিল মা-মেয়ের কথোপকথন তার কানে গিয়েছে। কাবেরী ভেতরে যাওয়ামাত্র সে এগিয়ে এল। বলল, ”সাইকেলে চড়বে?”
লক্ষ্মী উজ্জ্বল মুখে তাকাল। ওর ক্ষুদ্র বুদ্ধি ওকে জানান দিল, একটা দাদু সাইকেলে চড়াবে বলে ডাকছে। কী মজা!
লক্ষ্মী দ্রুত উঠে গিয়ে বসল দরবার সিং-এর সাইকেলের রডে। আর তার ক্ষতবিক্ষত দেহ পাওয়া গেল ঠিক দু-মাস পর রাইয়া ক্যানেলের ধারে।
পুলিশের সঙ্গে দেহ শনাক্ত করতে গিয়ে রিপুদমন অজ্ঞান হয়ে গেল। দু-মাস ধরে সে আর কাবেরী পাগলের মতো হয়ে গেছে। যাকে হাসপাতাল থেকে পুঁটলি করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল, যাকে প্রতিদিন একটু একটু করে বেড়ে উঠতে দেখেছে, নিজের স্বপ্ন-শখ মাখিয়ে যাকে ভালোবেসেছে, আদরের মেয়ের সেই পচাগলা শরীর দেখে রিপুদমনের অত বড়ো দেহটা ধড়াস করে পড়ে গেল মাটিতে।
গোটা রাজ্যে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। কয়েক মাস ধরে একটার পর একটা শিশুহত্যা ত্রাস ছড়াচ্ছিল মানুষের মনে। কিন্তু হয়ত বা শ্রমিক পরিবারের দরিদ্র্য-সন্তান বলেই এত কিছুর পরেও পুলিশ সেভাবে গা করছিল না। আর এই চিরাচরিত বৈষম্যের সুযোগ নিয়ে চলেছিল দরবার সিংহর মতো দ্বিপদী পিশাচ।
লক্ষ্মীকে যেদিন দরবার ধর্ষণ করে খুন করে, তার ঠিক পরের দিন ১৬ আগস্ট লেদার কমপ্লেক্সের নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে সে খুন করল ছয় বছরের লালুপ্রসাদকে। অনেক পরে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দরবার নিজেই পুলিশকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল সেখানে পুঁতে রাখা লালুর বিকৃত হয়ে-যাওয়া লাশ। লালুর পায়ুনালি ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।
লালুকে খুন করে দরবার বিশ্রাম নিয়েছিল মাত্র আধ ঘণ্টা। ও রীতিমতো ছক কষে সকাল দশটা থেকে একটার মধ্যে কাজ সারত। কারণ এই সময়টা বাবা-মায়েরা হয় কারখানায় অথবা ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে। গ্রীষ্মের গনগনে রোদে রাস্তাঘাটও ফাঁকা থাকে। লালুকে অত্যাচার করে খুন করার ঠিক এক ঘণ্টা পর দানিশমণ্ডন বস্তিতে দরবার পেয়ে গেল তিন বছরের নিতিকাকে। নিতিকার বাবা ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিল, মা ভেতরে কাজ করছিল। ছোট্ট নিতিকা বাইরে একটা প্রজাপতির সঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছিল আর বকে চলেছিল আপন মনে।
এতটুকু বাচ্চা যখন, দরবার আর লজেন্স বা মিষ্টির লোভ দেখিয়ে সময় নষ্ট করল না। মুখটা চেপে ধরে নিতিকাকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। আগেই রেইকি করে এসেছে, কয়েক পা হাঁটলেই একখানা সিমেন্ট কারখানার পরিত্যক্ত গুদামঘর। বর্ষায় জল জমে ক্ষতি হয়, তাই এখানে কোনো মালপত্র রাখা হয় না। দরবার সন্তর্পণে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
কিন্তু শেষ অবধি নিতিকা বেঁচে গেল। দরজা দিয়ে ঢোকার সময়েই তার গোঙানি শুনতে পেয়েছিল পাশের গুমটি দোকানগুলোর কয়েকজন। পায়ের শব্দ পেতেই দরবার নিতিকাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে পালাল। ছুটতে ছুটতে সে গিয়ে পৌঁছোল বাওয়াখেল বস্তিতে। সেখানে গিয়ে তুলে নিল রাস্তার ধারে খেলতে-থাকা পাঁচ বছরের রাজেশকে। কিন্তু সেখানেও চিৎকারে রাজেশকে ফেলে পালাতে দরবার বাধ্য হল।
যত ঘাঁটছি, যত জানছি, যত লিখছি, তত যেন অবাক হচ্ছি। ভারতবর্ষের মতো দেশেই কি এগুলো সম্ভব? একশো ত্রিশ কোটির দেশ বলেই কি শিশুরা এত অবহেলিত, এত ফেলনা? যে, এতগুলো শিশু পরপর খুন হচ্ছে, তবুও কোনো তদন্ত নেই! একটা করে গা-ছাড়া ডায়েরি আর রুটিন এনকোয়্যারি?
ঠিক ছ-দিন পর দরবার সিং গেল অবতারনগর বস্তিতে। ২২ আগস্ট, ২০০৪। দুই বোন তাজবিন আর মুমতাজ রাস্তার ধারে ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ওদের বাবার কয়েকদিন ধরে কাজ নেই, ঘরে খাবার নেই, ওদের পেটেও কিছু পড়েনি। দুই বোন শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল।
দরবার এগিয়ে গেল। গলায় মধু ঢেলে বলল, ”মিষ্টি খাবে?”
দুই বোন অবাক হয়ে তাকাল। সাইকেলে বসে-থাকা মাঝবয়সি লোকটার হাতে টাটকা মিষ্টির একখানা বড়ো বাক্স। দশ বছরের তাজবিন বোনের দিকে একঝলক তাকাল, তারপরই দু-বোন এগিয়ে এসে গোগ্রাসে খেতে লাগল মিষ্টিগুলো।
দরবার ধীরেসুস্থে ওদের খেতে দিল। খাওয়া হয়ে গেলে একখানা ঝকঝকে নীল কাঁচের বোতল বের করে বলল, ”নাও। জল খাও। কী নাম গো তোমাদের?”
দুই বোন নাম বলবে কি, কাঁচের বোতলটা দেখে ওরা হাঁ। কী সুন্দর দেখতে বোতলটা। নীল রঙের কাঁচের ওপর নকশা কাটা।
বাচ্চা দুটোকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে দরবার সিং মনে মনে হাসল। এইসব ভিখিরির বাচ্চাগুলোকে পটানোর জন্যই তো এইসব রংচঙে জিনিস ওকে কিনে রাখতে হয়। সব ক-টা বেজন্মা শালা! সব ক-টাকে খুন করবে ও। ভাবতে ভাবতে পিচ করে মাটিতে একদলা থুতু ফেলল দরবার।
যত যা-ই হোক, একটা নীতি ও মেনে চলে। পারতপক্ষে কোনো পাঞ্জাবি বাচ্চাকে তোলে না। কেন তুলবে? পাঞ্জাবের ছেলে মেয়ে মানে তো ওদের নিজের মাটির ছেলে মেয়ে। বরং পিষে দলে শেষ করতে হবে এইসব বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে-বসা শয়তানগুলোকে। আমাকে জেলে ভরে দেওয়া? শয়তান!
দরবার আরও মোলায়েম স্বরে বলে, ”এই বোতলটা নেবে তোমরা?”
”হ্যাঁ নেব!” দুই বোনের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। তাজবিন একটু বড়ো, তার বাস্তব বুদ্ধিও বেশি। সে ফিসফিস করে বোনের কানে বলে, ”বাড়িতে বাবা-মা ঝগড়া করছে টাকা নেই বলে। চল, আমরা এই বোতলটা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাই। বাবা-মা কত্ত খুশি হবে!”
মুমতাজ কিছু বলার আগে একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে-থাকা দরবার সিং বলে, ”হ্যাঁ হ্যাঁ, বেচলে অনেক টাকা পাবে গো। চলো, আমি দোকানে কথা বলে দিচ্ছি। আমার সঙ্গে এসো!”
দরবার বাচ্চা দুটোকে দ্রুত নিজের সাইকেলের সামনে-পেছনে উঠিয়ে নিতে চায়, কিন্তু মুমতাজ তার আগেই বেঁকে বসে, ”আমি যাব না!”
”কেন যাবি না, বুদ্ধু?” তাজবিন বোনের এই মূর্খামিতে অবাক হয়, ”চাচাটা কত ভালো, কেমন মিষ্টি খাওয়াল। চল-না!”
”না, আমি যাব না!” মুমতাজ পিছু হটতে থাকে, তারপর একছুট্টে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়।
দরবার বিরক্ত হলেও সময় নষ্ট করে না। একটাকে পাওয়া গেছে, তা-ই বা মন্দ কী!
জলন্ধর ফাগওয়াড়া রোডের পাশে চাহেরু নামের যে ছোট্ট গ্রামটা রয়েছে, সেখানেই এক সপ্তাহ পর তাজবিনের ক্ষতবিক্ষত বিকৃত লাশ মিলল। তাদের বাড়ি থেকে অনেক দূরে। কাপুরথালা থানার পুলিশ অনেক খুঁজেও লাশের পরিচয় জানতে পারল না। বাধ্য হয়ে ফাগওয়াড়াতেই দশ বছরের তাজবিনকে দাহ করা হল। ভারতীয় পিনাল কোডের ৩৭৬ ও ৩০২ ধারায় মামলা রুজু হল বটে, কিন্তু প্রমাণাভাবে পুলিশ একচুলও এগোতে পারল না।
ওদিকে ওই এক সপ্তাহে দরবার সিং উন্মত্ত পশুর মতো নিজের কাজ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ওই এক সপ্তাহের মধ্যেই সে আরও তিনটে বাচ্চাকে খুন করে ফেলেছে। ২৪ আগস্ট খুন হয়েছে পাঁচ বছরের সঞ্জু কুমার। শরীর থেকে প্রাণবায়ু নির্গত হওয়ার আগে চরম বিকৃত যৌন অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তার ঠিক চার দিন পর ২৮ আগস্ট খুন হয়েছে আরও দুই ভাই বোন, সাত বছরের রাজেশ আর পাঁচ বছরের গীতা।
এইরকম যখন পরিস্থিতি, তখন রাজ্যের সংবাদমাধ্যম সক্রিয় হয়ে উঠল। অবশেষে এতদিনের ঘুম ভেঙে তারা প্রকাশ করতে লাগল একের পর এক শিশু নিখোঁজ, অত্যাচার ও হত্যার প্রতিবেদন। গোটা পাঞ্জাবে ধীরে ধীরে অসন্তোষ, রাগ, ভয় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একটা মাঝবয়সি লোক সাইকেলে করে এসে মিষ্টি, লজেন্স বা অন্য কিছু দেওয়ার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যায়, এই একই কথা কোনোমতে বেঁচে-যাওয়া সব ক-টা বাচ্চা বলতে লাগল।
নড়েচড়ে বসল পাঞ্জাব পুলিশ। ওপরমহলের নির্দেশে দ্রুত স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হল। কে দিনের পর দিন এইরকম পাশবিক কাজ করে চলেছে? শংকর, রবিনা, রাজেশের মতো বাচ্চাগুলোকে পুলিশ বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, লোকটাকে কেমন দেখতে?
কিন্তু প্রতিটি বাচ্চাই তো খুব ছোটো। তার ওপর ট্রমা এখনও কাটেনি তাদের। কেউ কেউ বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বলল, কেউ আবার কিছুই বলতে পারল না।
”ও একতা দুত্তু লোক। আমাদের মারছিল।” তিন বছরের পাতালকুমারী ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলল।
ইনভেস্টিগেশন টিমের পুলিশ অফিসাররা সব ক-টা কেস একসঙ্গে জড়ো করেছিলেন। যত জানছিলেন, তাঁদের বিস্ময় ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। একটা পর্বে এসে তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, একজন ব্যক্তির পক্ষে এতগুলো খুন করা সম্ভব!
একজন অফিসার বলেই ফেললেন, ”এটা কখনো একটা লোক করতে পারে? এতগুলো খুন পর পর, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে? অসম্ভব! এ নিশ্চয়ই কোনো শিশু পাচার গ্যাং-এর কাজ।”
”কিন্তু আমার তা মনে হয় না।” আরেকজন অফিসার চিন্তান্বিত স্বরে বললেন, ”যতগুলো বাচ্চা ফিরে এসেছে, প্রত্যেকে একটাই সাইকেল চালিয়ে-আসা আধবুড়ো লোকের কথা বলেছে। আমার মনে হয়, আমাদের চিরুনিতল্লাশি করা উচিত। এ সাংঘাতিক লেভেলের সাইকো। এত বছরের কেরিয়ারে এমন ক্রিমিনাল দেখিনি, ওহ মাই গড! আর একটাও বাচ্চা যাতে এর কবলে না পড়ে!”
পুলিশ কড়া নজর রাখতে শুরু করল। লোকাল থানার কনস্টেবলরা সাদা পোশাকে টহল দিতে শুরু করল পাড়ায় পাড়ায়, কোথাও কি মাঝবয়সি কোনো লোক এসে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলে ফুসলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে?
কিন্তু এত কিছু করেও দরবার সিংকে যখন ধরা গেল না, পুলিশের কাজে বা সদিচ্ছায় গাফিলতি ছিল, তা অস্বীকার করা যায় না। মাত্র দু-মাস ঘাপটি মেরে বসে থাকার পর দরবার আবার বেরোল ১৮ অক্টোবর। সেদিনের ঘটনা শুনলে এমনিতেই শিরদাঁড়া দিয়ে বরফস্রোত নেমে যাবে।
জলন্ধরের আরবান এস্টেট ফেজ টু এলাকার একটা পার্কে অনেকগুলো স্থানীয় বস্তির বাচ্চা হুটোপুটি করছিল। অনেকক্ষণ ধরে তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল দরবার। সাত বছরের নিশু একটু দলছাড়া হতেই তাকে কেক খাওয়ানোর প্রলোভন দেখিয়ে নিজের সাইকেলে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল দরবার সিং।
তার ঠিক আধ ঘণ্টা পর অদূরের আখখেতে কাজ করতে করতে দুজন আখচাষি চমকে উঠল। পেছনের ঘন খেত থেকে একটা বাচ্চা মেয়ের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিৎকারটা কেমন যেন গোঙানির মতো, মনে হচ্ছে, সে গলা খুলে চেঁচাতে পারছে না।
ভানা রাম আর গুরদেব সিং নামের দুজন আখচাষি আওয়াজ লক্ষ করে দৌড়ে গেল ভেতরদিকে। ঘন বনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে যে ভয়ংকর দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল, তা দেখে তাদের কথা বন্ধ হয়ে গেল।
একটা বাচ্চা মেয়ে—পোশাক বিস্রস্ত, আলুথালু অবস্থায় মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। তার কণ্ঠনালী কে যেন ফালাফালা করে কেটে দিয়েছে। সেখান থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। দরবার নির্যাতন করতে উদ্যত হতেই নিশু চেঁচাচ্ছিল, রাগের চোটে দরবার তার গলা কেটে পালিয়ে গিয়েছে।
ভানা রাম আর গুরদেব তড়িঘড়ি আরও চাষিদের হাঁকডাক করে জড়ো করল। অচৈতন্য নিশুকে নিয়ে যাওয়া হল হাসপাতালে।
সাত বছরের নিশু বেঁচে গিয়েছিল। অসীম সাহসের সঙ্গে সে-ই পরে দরবার সিং অ্যারেস্ট হওয়ার পর তাকে শনাক্ত করেছিল।
পুলিশ পাগল হয়ে যাচ্ছিল। এ কোন জন্তু এসে ঢুকল সোনার পাঞ্জাবে! একের পর এক ধর্ষণ, খুন, মায়েদের বুকফাটা কান্না দেখাতে দেখাতে টিভি চ্যানেলগুলোও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল।
কিন্তু দরবার সিং-এর ক্লান্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ ছিল না। মাত্র সাত দিন, তার পরেই মিঠু বস্তির খুরশিদ আর রংকু, দুই ভাইকে খুন করল দরবার। দুজনেরই বয়স পাঁচ থেকে ছয়ের মধ্যে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর দরবার সিং নিজেই কাডিয়ানওয়ালি গ্রামের প্রান্তে নিয়ে গিয়ে খুরশিদ আর রংকুর লাশ দেখিয়েছিল। দুজনেরই গলা ছিল কাটা। আর পায়ুদেশের হাড় বীভৎস যৌন অত্যাচারে ভেঙে গিয়েছিল।
”আমি মারার আগে জিজ্ঞেস করে নিতাম সাব! বিহারের দারভাঙা থেকে ওই ছেলে দুটোর বাপ-কাকা এখানে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল। পাঞ্জাবকে শেষ করছে এরা!” লাশ দেখিয়ে পুলিশকে বলেছিল ভাবলেশহীন দরবার।
রাগে গা নিশপিশ করবে যখন দেখব, গ্রেপ্তার হওয়ার পরেও এই প্রত্যেকটা খুনের জন্য একে একে দরবার সিংকে রেহাই দেওয়া হবে। কারণ একটাই। ‘যথেষ্ট প্রমাণের অভাব’। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দরবার সিং-এর ভাগ্য যেভাবে তার অনুকূল হবে, তা কল্পনাতীত।
এরপর দরবার পর পর খুন করল আরও চারটে বাচ্চাকে। ছয় বছরের কারু, পাঁচ বছরের অমৃত, আট বছরের দীপক আর পূজা।
এদের মধ্যে পূজাকে দরবার সিং যখন চকোলেটের লোভ দেখিয়ে নির্জন খেতে নিয়ে গিয়ে চকচকে ধারালো ছুরি বের করল, পূজা হাত জোড় করে হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। ওর বাবা-মা পইপই করে সাবধান করেছিল, সাইকেলে করে কোনো লোক এসে ডাকলে না যেতে। তবু ও লোভ সামলাতে না পেরে এসে পড়েছে। কান্না-জড়ানো গলায় ও চিৎকার করতে লাগল।
দরবার সিং দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পূজার চুলের মুঠি ধরে গলাটা কেটে দিল। তারপর মুমূর্ষু বাচ্চাটাকে ধর্ষণ করে নিজের খিদে মেটাল। দূরে পড়ে-থাকা চকোলেট-ভরা ব্যাগ নিয়ে যখন দরবার হাঁটতে লাগল, ততক্ষণে পূজার দেহে প্রাণ নেই।
মানুষকে বিশ্বাস করার ফল তাকে তার জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে।
***
ওদিকে দরবার যখন খেত থেকে বেরোচ্ছিল, সেখানে সাদা পোশাকে পাহারা দিচ্ছিল একটা কনস্টেবল। রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। আগের দিনও ভারিয়ানা গ্রামে একটা বাচ্চার কাটা হাত পাওয়া গেছে। ওই একই দিনে রামনগরে মিলেছে আট বছরের বিশ্বজিতের লাশ।
”শালা কোন রাক্ষস এসেছে কে জানে!” নিজের মনে বিড়বিড় করছিল কনস্টেবল সুশান্ত। এমন সময় তার চোখে পড়ল, মাঝবয়সি একটা লোক খেত থেকে বেরিয়ে এল। খেতের বাইরের রাস্তায় একটা সাইকেল রাখা ছিল। সেই সাইকেলে উঠে প্যাডল করতে করতে লোকটা চলে গেল। তার কাঁধে একখানা ঢাউস ব্যাগ।
সুশান্ত ভ্রূ কুঁচকাল। এই কয়েকদিন ধরে ওদের সবার পকেটে দিয়ে দেওয়া হয়েছে অপরাধীর মুখের স্কেচ। বেঁচে-যাওয়া কয়েকটা বাচ্চার বিবরণ অনুযায়ী আঁকা সেই স্কেচ পকেট থেকে বের করামাত্র সুশান্ত চমকে উঠল। অনেকটাই মিলে যাচ্ছে তো! ও আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। ফোন করল থানায়।
অফিসার প্রীতম সিং তক্ষুনি জিপ নিয়ে রওনা হলেন। বাস্তিয়ানের কাছাকাছি এসে দরবার সিংকে দেখতে পাওয়া গেল। দরবার যখন বুঝতে পারল, পুলিশের গাড়ি তাকে ধাওয়া করেছে, প্রথমে কিছুক্ষণ জোরে সাইকেল চালানোর চেষ্টা করে তারপর সে সাইকেলটা পুলিশের গাড়ির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল।
কিন্তু পারল না। পুলিশ গিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করল।
আর এভাবেই শেষ হল দেশের ভয়ংকরতম শিশুহন্তার হত্যালীলা। দরবার সিং গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে উল্কার গতিতে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল গোটা রাজ্যে। শয়ে শয়ে বাচ্চার বাবা-মা আসতে লাগল, সবাই শুধু একবার কাছে পেতে চায় দরবারকে, তার শরীরের সব ক-টা হাড় ভেঙে মনে একটু শান্তি পেতে চায়।
পুলিশের যে স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম তৈরি হয়েছিল, তার প্রধান ছিলেন গুরপ্রীত সিং ভুল্লার। সাধারণ মানুষের উত্তেজনা তো স্বাভাবিক, কিন্তু দরবার যখন নির্বিকারভাবে একটার পর একটা জায়গায় গিয়ে ফুলের মতো শিশুদের পচাগলা বিকৃত লাশ দেখাতে লাগল, পুলিশ অফিসার ভুল্লারেরই উদগ্র বাসনা হচ্ছিল রিভলভার বের করে গুলি চালাতে।
কিন্তু কিছু করার নেই। আইন কেউ নিজের হাতে নিতে পারে না। দরবারকে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে জেরা শুরু হল। দরবার ভীষণভাবে সহযোগিতা করছিল। প্রথমে পুলিশ অফিসাররা ভেবেছিলেন, দরবার কোনো সাইকোপ্যাথ। অকারণে শিশুদের হত্যা করে এক পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে সে। কিন্তু না, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি তার রাগ, আর সেই রাগের কারণেই যে সেই প্রতিশোধপন্থা বেছে নিয়েছে, তা শুনে অফিসাররা হতবাক হয়ে গেলেন।
পরে ট্রিবিউন ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকিয়ে দরবার সিং বলেছিল, ”আমার এক ফোঁটাও দুঃখ নেই। বাইরে থেকে আসা শ্রমিকরাই আমাকে জেলে পাঠিয়েছিল, তাই আমি তাদের বাচ্চাদের খুন করেছি!”
যে নিশুকে দরবার সিং গলা কেটে রেখে ফেলে পালিয়েছিল, সেই নিশু তখনও হাসপাতালে। তখনও তার চিকিৎসা চলছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছে সে। অসমসাহসী নিশু ওই অবস্থাতেও পুলিশের হাত থেকে ফোটোগ্রাফ নিয়ে মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ, এই লোকটাই সেদিন তার ওপর অত্যাচার করেছিল। এই লোকটাই!
কিন্তু এরপর শুরু হল বিচারপর্ব। চরম হতাশাজনক সেই অধ্যায়!
নিশুর শনাক্তকরণের ভিত্তিতে এলাকা ম্যাজিস্ট্রেট কে কে কবির দরবার সিংকে দশ দিনের পুলিশি হেপাজতে পাঠালেন। পুলিশের ইনভেস্টিগেশন টিম তার বিরুদ্ধে ১৮খানা ধর্ষণ, বিকৃত যৌনাচার ও খুনের চার্জশিট দিয়েছিল। প্রীতম সিং থেকে শুরু করে গুরপ্রীত সিং ভুল্লার সবাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, দরবারের ফাঁসি হবেই। আরও কয়েকটা শিশু সেই সময় নিরুদ্দেশ ছিল। আট বছরের মঞ্জু, সাত বছরের বিট্টু, আট বছরের লশকি। তাদের পাওয়া না গেলেও পুলিশের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, তাদের পেছনেও ছিল দরবার সিং। এমন একটা জঘন্য নরকের কীটের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
কিন্তু তা হল না।
২০০৭ সালের শেষে তিনটে খুনের মামলায় ‘যথেষ্ট প্রমাণের অভাব’ দেখিয়ে তাকে মুক্তি দেওয়া হল। ২০০৮ সালের ৭ জানুয়ারি বিচারপতি ইকবাল সিং বাজোয়া খুরশিদ ও রংকুকে ধর্ষণ করে খুনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তার ঠিক দু-দিন পর দরবার সিংকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য জলন্ধর জেল থেকে পাতিয়ালা জেলে আনা হল। লোকজন উপচে পড়তে লাগল রাগে, আক্রোশে।
কী ভাবছেন? দরবার সিং এরপর ফাঁসিকাঠে চড়ল?
না।
দরবার সিং-এর উকিলের ক্রমাগত আবেদনে ২০০৮ সালের ২৫ এপ্রিল জলন্ধর আদালতের বিচারপতি বি কে মেহতা দরবারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন। দীক্ষার বোন আশা তার আগেই দরবারকে শনাক্ত করেছিল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।
২০০৯ সালের ৩০ জুলাই পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্টের বিচারপতি মেহতা সিং গিল এবং জিতেন্দ্র চৌহান দরবার সিং-এর মৃত্যুদণ্ড রদ করে দিলেন। বললেন, ”যথেষ্ট প্রমাণের অভাব।”
এভাবে একটার পর একটা মামলায় ওই একই কারণ দেখিয়ে দরবার সিংকে ছাড় দেওয়া হতে লাগল। হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট, লাভ হল না কিছুই। নিশু, আশা, রাজেশ, রবিনা, পাতালের মতো বাচ্চাদের বার বার সাক্ষ্যদানেও কিছু হল না।
লিখতে অসহ্য বেদনা হচ্ছে, ২০১৮ সালের ৬ জুন দরবার সিং পাতিয়ালা জেলে অসুস্থ হয়ে পড়ে সরকারি রাজেন্দ্র হাসপাতালে স্বাভাবিকভাবেই মারা গেল। খবর পেয়েও তার স্ত্রী ও তিন সন্তান তার দেহ নিতে এল না। বলল, ”ও যা অপরাধ করেছে, তা ক্ষমার অযোগ্য। ওর স্ত্রী, সন্তান হিসেবে আমাদের লজ্জা হয়!”
এমন একজন মানুষ স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে, ভাবলেও যেন রাগ ফেটে বেরোতে চায়। আজও পাঞ্জাবের অলিতে-গলিতে বয়স্ক মানুষরা চমকে ওঠেন, ওই একজন মাঝবয়সি লোক মুখে অনাবিল হাসি নিয়ে হাত ভরতি লজেন্স নিয়ে সাইকেলে চড়ে আসছে! নির্বিকারে একের পর এক নিষ্পাপ বাচ্চাকে চরম অত্যাচার করে চকচকে ছুরি দিয়ে কেটে দিচ্ছে গলার নলি।
এমন জন্তু যেন এই পৃথিবীতে আর একটাও না আসে! বনের জন্তুদের অপমান তারাও অকারণে এমন হিস্র হতে পারে না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন