উত্তম পুরুষ – ১

রশীদ করীম

এক

আমি সবসময়েই উত্তম পুরুষ। কিন্তু কাহিনীকার স্বয়ং যখন ‘আমি’—তখন তাঁকে অধমও হতে হয়। তা না হলে হয়তো তাঁর নিজের মর্যাদা থাকে, কিন্তু সত্যের থাকে না।

একজন উত্তম পুরুষ প্রথম বচনে এই কাহিনী লিখছেন। উপন্যাসের আঙ্গিক হিসেবে এই কৌশলটি অভিনব বা মৌলিক নয়—এমনকি বাংলা সাহিত্যেও নয়। শুরুতেই বলে রাখা ভালো, সাধারণত গল্পের ‘আমি’ পাঠক-মনে যে আদর্শ পুরুষের ছবি তুলে ধরে, বর্তমান আমি সে ধারণা অনুসারে খাটো।

আমি আদর্শ পুরুষ নই। আদর্শ পুরুষের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সবটুকুই এক নিরবচ্ছিন্ন সূত্রে গাঁথা। সবটাই চির পরিচিত রেলগাড়ির লাইন; কোন স্টেশনে গাড়ি কতক্ষণ দাঁড়াবে তাও আগে থেকেই জানা। কোথাও অপ্রত্যাশিত বিস্ময় বা অজ্ঞতার চমক নেই। সুতরাং আমি আদর্শ পুরুষ নই। চরিত্র যথেষ্ট বলীয়ান নয় বলেও বটে, মনের স্বাভাবিক প্রবণতাও কিছুটা অন্যদিকে প্রবহমান বলেও বটে।

আমি লোকটি মোটের ওপর নিরিবিলি একাকী থাকতে ভালোবাসি। আড্ডা বা উত্তেজনা যে আমার রুচির খেলাফ তা নয়, এমনকি সৎসঙ্গেও আমার অরুচি নেই। বরঞ্চ গুটিকয়েক অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সন্ধ্যার অলস মুহূর্তগুলোকে চা আর সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে ফুঁকে দেওয়া আমার জীবনের একটা বড় বিলাস। কিন্তু এই ভালোলাগাটুকু প্রাকৃতিক নিয়মের মতো অলঙ্ঘ্য বা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার নয়। এই ভালোলাগাটুকু একান্তভাবেই আমার নিজের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।

পূর্ব সন্ধ্যায় যে-লোকটি আমার অতি প্রিয় ছিল, হয়তো পরদিন সকালে তারই সঙ্গ আমাকে পীড়া দেয়। তার চলন-বলন আমার স্নায়ুর ওপর জুলুম করতে থাকে।

অথচ বিনয়ী ও সামাজিক প্রকৃতির বলে আমার একটা খ্যাতি আছে। লোকটাও আমি, দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও, এমন আর মন্দ কি!

এই সংসারে এক শ্রেণীর লোক আছেন। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-পরিজন সম্বন্ধে তাঁরা তাঁদের সত্য ধারণাটা মনের চারিটি দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রাখেন না। এমনকি ধারণাটা অপ্রিয় হলেও নয়। এই লোকগুলোকে কেউ বলে দুর্মুখ, কেউ বলে সৎসাহসী। আমি তাঁদের দলে নই। মতামত বস্তুটিকে বিস্ফোরক পদার্থের মতোই সাবধানে সঙ্গোপনে সন্তর্পণে রাখি।

নতুন জুতোর কামড় খেয়ে এরা মুখব্যাদান করেন। আমার মুখের সৌম্য ভাবটুকু অবিকৃত থাকে। বোধ করি এইখানেই ভব্যজীবনের ট্রাজেডি।

যাকে বলে আত্মকেন্দ্রিক, আমি সেই বহু নিন্দিত জীব। সমাজে যদি চলাফেরা করি তো সে পরার্থপরতায় অনুপ্রাণিত হয়ে নয়; বরঞ্চ নিজেরই কোনো প্রয়োজন, সঙ্গের বা অন্য কিছুর, পূরণের জন্য। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য সুখী হওয়া, এই আমার জীবনাদর্শ। যদি কখনো কারো উপকার করি—পারতপক্ষে করি না—তো সে গ্রহীতা উপকৃত হবে বলে নয়, দাতা স্বয়ং এক সূক্ষ্ম অনির্বচনীয় সুখলাভ করে বলে। এখানে আমি নিজেকে আর দশজনের মতো ফাঁকি দিই না।

কোনো বন্ধু ঋণপ্রার্থী হলে তৎক্ষণাৎ তাঁকে বাধিত করি, নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই করি। উসুলের জন্য তাগাদা দিই না। কারণ আমি দেখেছি, বন্ধু-বান্ধব যখন ঋণ পরিশোধ করে, তখন আরো মোটা অঙ্কের ঋণের পথ প্রশস্ত করবার জন্যই করে। আমি এই পথটুকু রুখে দাঁড়াতে চাই।

ঋণী বন্ধু হয়তো দামি আসনে বসে সিনেমা দেখছেন। দীর্ঘকাল পর তাঁর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ। অপ্রত্যাশিত, এবং বলা বাহুল্য, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমাকে দেখে চকিতে তাঁর মুখভাবের যে পরিবর্তন ঘটে, আমার পোড়া চোখে তা বড়ই দর্শনীয় মনে হয়। আমি সজ্জনের মতো অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিই না, বরঞ্চ তাঁরই কাছাকাছি আলগোছে দাঁড়িয়ে থাকি। বন্ধুর বিব্রত ভাব দেখে আমার মনের মধ্যে এক প্রকার রস সঞ্চারিত হয়। এ রসকে কিছুতেই বীর- রস বলা চলে না। তবু এতেও আমার অরুচি নেই।

আত্মপরিচয় হিসেবে এই পূর্বলেখটুকু অসম্পূর্ণ। পরের পৃষ্ঠাগুলোতে যে কাহিনীর ক্রমবিকাশ হবে, সেখানে পরিচয়ের পরিপূরক থাকবে। হয়তো তবু পরিচয় সম্পূর্ণ হবে না!

কোনো ব্যক্তিকেই পুরোপুরি জানা বা বোঝা যায় না।

অধ্যায় ১ / ৩১

সকল অধ্যায়

১. উত্তম পুরুষ – ১
২. উত্তম পুরুষ – ২
৩. উত্তম পুরুষ – ৩
৪. উত্তম পুরুষ – ৪
৫. উত্তম পুরুষ – ৫
৬. উত্তম পুরুষ – ৬
৭. উত্তম পুরুষ – ৭
৮. উত্তম পুরুষ – ৮
৯. উত্তম পুরুষ – ৯
১০. উত্তম পুরুষ – ১০
১১. উত্তম পুরুষ – ১১
১২. উত্তম পুরুষ – ১২
১৩. উত্তম পুরুষ – ১৩
১৪. উত্তম পুরুষ – ১৪
১৫. উত্তম পুরুষ – ১৫
১৬. উত্তম পুরুষ – ১৬
১৭. উত্তম পুরুষ – ১৭
১৮. উত্তম পুরুষ – ১৮
১৯. উত্তম পুরুষ – ১৯
২০. উত্তম পুরুষ – ২০
২১. উত্তম পুরুষ – ২১
২২. উত্তম পুরুষ – ২২
২৩. উত্তম পুরুষ – ২৩
২৪. উত্তম পুরুষ – ২৪
২৫. উত্তম পুরুষ – ২৫
২৬. উত্তম পুরুষ – ২৬
২৭. উত্তম পুরুষ – ২৭
২৮. উত্তম পুরুষ – ২৮
২৯. উত্তম পুরুষ – ২৯
৩০. উত্তম পুরুষ – ৩০
৩১. উত্তম পুরুষ – ৩১

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন