বাংলা কবিতার মূলধারা ও জালাল উদ্দীন খাঁ – যতীন সরকার

বাংলা কবিতা তথা বাংলা সাহিত্যের কোনো ইতিহাস গ্রন্থেই কবি জালাল উদ্দীন খাঁর নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না। আধুনিক বাংলার বিদগ্ধ কবি বা কবিতা- অনুরাগীদের মধ্যে যাঁরা জালাল উদ্দীন খাঁর সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত তেমন মানুষের সংখ্যাও নিশ্চয়ই বেশি নয়। সেই বিরলসংখ্যক মানুষের মধ্যেও কি এমন কাউকে পাওয়া যাবে যিনি অকুণ্ঠচিত্তে জালাল খাঁর রচনাকে বাংলা কবিতার মূলধারার অন্তর্গত বলে বিবেচনা করতে পারবেন? মনে তো হয় না।

আমরা, ‘শিক্ষিত’ মানুষজন, আসলে কতকগুলো দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এগুলো ‘আধুনিকতা’র কুসংস্কার। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাই আমাদের মস্তিষ্ককোষে সেইসব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে নিদারুণ মানস-প্রতিবন্ধের সৃষ্টি করেছে। সে রকম মানস-প্রতিবন্ধের দরুনই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসকেও আমরা খণ্ডিত করে ফেলেছি, একটা খণ্ড অংশকেই সমগ্রের মর্যাদা দিয়েছি। বাংলা সাহিত্যের মূলধারা বলে আমরা ধরে নিয়েছি ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সৃষ্ট সাহিত্যকে। এর বাইরে বিশাল বাংলায় গ্রামীণ কৃষিজীবী বা অন্যান্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন যে-সব কবি, শতকরা নব্বুই জন মানুষ যাঁদের কবিতা বা গান তথা সাহিত্যের উপভোক্তা—তাঁদের তো আমরা গণনীয়ই বিবেচনা করিনি। অথচ এঁরাই আবহমান বাংলার গণকবিতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন। বাংলা সাহিত্যের এক অদ্ভুত ইতিহাস আমরা রচনা করেছি। এবং এ-রকম অদ্ভুতত্ব কেবল সাহিত্যের ইতিহাসে নয়, অন্যত্রও। ইতিহাসে ‘আধুনিক’ যুগ বলে যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেটির অবস্থান যেন সকল প্রকার ধারাবাহিকতার বাইরে। দেশের মাটিতে তার কোনো শিকড় বা উৎস নেই, দেশের বাইরে থেকে আনা কলমের চারা যেন তা। এই ‘আধুনিক যুগ’ যেন এক ‘বৃন্তহীন পুষ্প’। এ যুগের নামকরণেও, তাই, বৃন্তহীনত্বের ও ধারাবাহিকতা-বর্জনের ছাপ। আগের যুগের নামগুলো ধর্মসাম্প্রদায়িকতা-চিহ্নিত—হিন্দু-বৌদ্ধ যুগ, মুসলিম যুগ। কিন্তু এর পরের যুগটি খ্রিস্টান যুগ নয়, ব্রিটিশ যুগ বা আধুনিক যুগ। ব্রিটিশ আর আধুনিক এখানে সমার্থক।

সাহিত্যের ইতিহাসেও প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ—এ-রকম যুগবিভাগ আমরা করেছি। রাজনৈতিক ইতিহাসে যাকে ‘বৌদ্ধ-হিন্দু যুগ’ বলা হয়েছে, সাহিত্যের ইতিহাসে সেটিই হয়েছে প্রাচীন যুগ, আর ‘মুসলিম যুগ’ হলো মধ্যযুগ। কেন যে এর নাম মধ্যযুগ, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা বাংলা সাহিত্যের কোনো ইতিহাসকার দিতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ইতিহাসকারদের ভাবনায় ভেতরে ভেতরে কাজ করেছে ইউরোপ-মনস্কতা। ইউরোপের ইতিহাসে যেমন মধ্যযুগ আছে, সে-রকমই মধ্যযুগ থাকতে হবে আমাদের ইতিহাসে। ইউরোপের মধ্যযুগে ছিল ধর্মান্ধতার নিরেট অন্ধকার, আমাদের ইতিহাসকেও তারই সঙ্গে খাপে খাপে মেলাতে গিয়ে এখানেও বানানো হলো এক মধ্যযুগ। ইউরোপে মধ্যযুগের অবসান ঘটে আধুনিক যুগ এসেছে সেখানেই উদ্ভূত রেনেসাঁস-রিফর্মেশন- এনলাইটেনমেন্টের মধ্য দিয়ে, কিন্তু আমাদের মধ্যযুগটির কোনো নড়ন-চড়ন নেই। অতঃপর এক সময় ইউরোপ থেকে আধুনিক ব্রিটিশরা আমাদের কাছে এল, শ্বেতমানুষেরা তাদের মহান দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিল, তাদের আধুনিকতা দিয়ে আমাদেরকে মধ্যযুগ থেকে টেনে তুললো! তাই এ-যুগ আমাদের ইতিহাসে ব্রিটিশ যুগ, এবং ব্রিটিশ যুগই হলো আমাদের জন্য আধুনিক যুগ!

এই যে ইতিহাস, এর সবটাই মিথ্যা—এমন কথা অবশ্যই বলবো না। শুধু বলবো: সত্যের এক খণ্ডাংশই এ-ইতিহাসে বিবৃত হয়েছে, এবং খণ্ডকেই অখণ্ড বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়। কেশের আড়ালে পাহাড় লুকানোর মতো করে খণ্ডের আড়ালে অখণ্ড এখানে চাপা পড়েছে। ইউরোপীয় আধুনিকতা আমাদের দেশে অবশ্যই এসেছে। সে-আধুনিকতায় আলোকিত হয়েছে নতুন-জেগে-ওঠা নগরে নতুন-সৃষ্ট এক মধ্যবিত্ত গোষ্ঠী। সে-গোষ্ঠীসঞ্জাত তরুণরাই আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ হয়েছে, বহু বদ্ধ-সংস্কারের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছে। ইউরোপীয় আধুনিকতার ধারাতেই আমাদের পূর্বতন সাহিত্যের থেকে গুণগতভাবে পৃথক এক বিশ্বমানের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে আমাদের সাহিত্যে যে- যুগান্তর ঘটে গেল তাকে ‘আধুনিক যুগ’ বলতে আপত্তি করার কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। কিন্তু এই ‘আধুনিক যুগ’ যে দেশের বৃহত্তর ভূখণ্ডের এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে গেছে, সেই নির্মম সত্যকেও তো অস্বীকার করতে পারি না। এখন প্রশ্ন : এই নাগরিক মধ্যবিত্ত-অধ্যুষিত আধুনিকতার বাইরে গরিষ্ঠসংখ্যক কৃষিজীবী ও অন্যান্য বৃত্তিজীবী মানুষগুলো কোন যুগে অবস্থান করছে? কালের বিচারে আধুনিক হয়েও ভাবের জগতে কি তারা মধ্যযুগেই রয়ে গেছে? না কি তারা নিজেদের মতো করেই নিজেদের আধুনিকতা সৃষ্টি করে নিয়েছে? নাগরিক মধ্যবিত্ত যখন ইউরোপীয় ধারায় আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টি করছে, তখন কি পল্লীর মানুষের সাহিত্যের প্রবাহ একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেছে? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে সে-সাহিত্য কোন ধারায় প্রবাহিত হয়েছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের জন্য আমাদের অবশ্যই সংস্কারমুক্ত হতে হবে। সংস্কারমুক্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকালেই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা মননের ইতিহাসের প্রকৃত রূপটি আমরা অবলোকন করতে পারবো। তখন দেখবো : ব্রিটিশ রাজসৃষ্ট আধুনিক নগর ও নাগরিক মধ্যবিত্ত সমাজের বাইরে অবস্থিত বিশাল দেশ ও বিপুল জনসমষ্টিতে মননের ধারাপ্রবাহটি অত্যন্ত বেগবান রূপেই প্রবহমান থেকেছে। এবং আজও আছে। নিরক্ষর বা প্রায়-নিরক্ষর সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষেরা অশিক্ষিত নন মোটেই, মননশীলতাতেও তাঁরা শহুরে আধুনিক শিক্ষিতদের চেয়ে কোনো অংশেই খাটো নন। এঁদের ভেতর সৃজনশীল প্রতিভার অধিকারী মানুষের সংখ্যাও মোটেই কম নয়। এই মানুষেরা তাঁদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটান যে-সৃষ্টিকর্মে তা তো তাঁদের আশপাশের মানুষদের ভাব-ভাবনা- আশা-আশঙ্ক্ষারই ভাষারূপ। তাঁদের ভাব-ভাবনা আশপাশের মানুষদের ভাব- ভাবনা থেকে পৃথক নয় অবশ্যই, আবার পুরোপুরি অভিন্নও নয়। ‘অপূর্ববস্তু নির্মাণক্ষমা প্রজ্ঞা’র অধিকারী যাঁরা, তাঁদেরই তো বলে প্রতিভাবান। যাঁরা প্রতিভাবান তাঁরা নিতান্তই অন্য দশজনের একজন নন, দশের বাইরে এগারো। তবু, এগারো হয়েও, দশের আশা-আশঙ্কা-আনন্দ-বেদনার তাঁরা অংশীদার। এবং সে-কারণেই সেই ‘এগারো’ ‘দশ’কে অনায়াসে জানিয়ে দিতে পারেন যে ‘আমি তোমাদেরই লোক’।

এই এগারো-স্বরূপ প্রতিভাবান কবি-শিল্পী-সাধকগণ প্রতিযুগেই চিরন্তন আধুনিকতাকে ধারণ করেছেন, অন্য দশজনকে সেই আধুনিকতার পথে চলার জন্য ডাক দিয়েছেন। আদিপর্ব থেকেই বাঙালি সমাজেও এ-রকম আধুনিকতার ধারক- বাহকদের আবির্ভাব ঘটেছে। চর্যাপদের কবি কিংবা দোহাকোষের সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে আমরা প্রবল ও প্রচণ্ড আধুনিকতাকে প্রত্যক্ষ করেছি। তাঁদের আধুনিকতা ছিল একান্তই প্রতিবাদী ও বিপ্লবী। ব্রাহ্মণ্য এস্টাব্লিশমেন্টকে তাঁরা চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন, অভিজাতদের ধর্মদর্শন ও ধর্মানুষ্ঠানকে তাঁরা বিদ্রূপবিদ্ধ করেছেন। ব্রাহ্মণরা দাবি করতো যে তারা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার ‘মুখ’ থেকে জন্ম নিয়েছে, সমাজে তাই তারা মুখ্য, তারা বর্ণশ্রেষ্ঠ। আর ক্ষত্রিয়ের জন্ম ব্রহ্মার বাহু ও বৈশ্যের জন্ম ব্রহ্মার উরু থেকে হওয়ায় তারা ব্রাহ্মণের সমান হতে পারে না কিছুতেই, বর্ণগত অবস্থানে তারা অবশ্যই গৌণ। সবার নিচে হচ্ছে শূদ্রের অবস্থান, কারণ তাদের জন্ম ব্রহ্মার পা থেকে। তাই শূদ্র কোনোরূপ সামাজিক মর্যাদা পেতেই পারে না, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের সেবা করেই তাদের তৃপ্ত থাকতে হবে। ব্রাহ্মণ-সৃষ্ট এ- রকম সামাজিক বিধানই মান্যতা পেয়ে আসছিল বহুকাল ধরে। কিন্তু সে-মান্যতা যে নিরঙ্কুশ ছিল না, ইতিহাসে তারও সাক্ষ্য আছে। লোকায়তিকরা, বৌদ্ধরা, জৈনরা, ব্রাহ্মণ্যবিধানকে অমান্য করে এসেছে খ্রিস্টপূর্ব কাল থেকেই। সেই

অমান্যতারই ধারা বহন করে এসেছেন এখন থেকে হাজার বছর আগেকার আদি বাঙালি সমাজের চর্যা ও দোহাকোষ-রচয়িতা কবিবৃন্দ। তাঁদের বক্তব্য ছিল মোটামুটি এ-রকম : কোনো এক সময় ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম যদি হয়ে ও থাকে, এখন ব্রাহ্মণদের জন্মপ্রক্রিয়ায় অন্য সকলের সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই; এখন ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের জন্ম যেভাবে হয়, ব্রাহ্মণেরও হয় সেভাবেই। কাজেই এখন কেন ব্রাহ্মণ-শূদ্রের প্রভেদ থাকবে? ব্রাহ্মণরা যে তাদের চার বেদের মহিমা প্রচারে পঞ্চমুখ, বেদকে যে তারা বলে অপৌরুষেয়, বেদপাঠের ফলেই যে তারা ব্রাহ্মণত্ব লাভ করতে পেরেছে বলে গর্ব করে বেড়ায়—সে-সবেরও কোনো ভিত্তিই নেই। বেদের অনেক কথাই অর্থহীন, বাজে কথা, বিশেষ করে চতুর্থ বেদ-বলে- প্রচারিত অথর্ববেদের তো কোনো প্রামাণ্যতাই নেই। আবার, সকল বেদকেই ব্রাহ্মণরা রেখেছে নিজেদের কুক্ষিগত করে। শূদ্রদের তো তারা বেদপাঠ বা শ্রবণের অধিকার থেকেই শুধু বঞ্চিত করেনি, এর জন্য শাস্তিরও বিধান রেখেছে। বেদপাঠের দরুনই ব্রাহ্মণসন্তান যদি ব্রাহ্মণত্ব লাভের অধিকারী হয়ে থাকে, তবে শূদ্র কেন বেদপাঠ করে ব্রাহ্মণ হতে পারবে না? আগুন জ্বেলে তাতে ঘি ঢেলে যজ্ঞ নামের যে-অনুষ্ঠান করে ব্রাহ্মণরা, তাতে কারো কোনো লাভ হয় না, কেবল এর ধোঁয়ায় চোখের পীড়া হয় মাত্র।

এ-ধরনের কথা সবচেয়ে স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন দোহাকোষের কবি সরহপাদ। অন্য অনেকেও নানাভাবে নানা কায়দায় বলেছেন। বলা যেতে পারে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্মই হয়েছে এ-রকম এস্টাব্লিশমেন্ট-বিরোধী বক্তব্যকে ধারণ করে। এস্টাব্লিশমেন্ট যখন যত বেশি গণবিরোধী হয়েছে প্রাকৃতজনের কবি- শিল্পীরা তখন তত বেশি জনগণের অধিকারের পক্ষে দৃঢ়তর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, তাঁদের সৃষ্টিতে জনগণের মনের কথা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে। দ্বাদশ শতকের বাংলায় বিভাষী সেনবংশীয় শাসকরা যখন সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে সংস্কৃত ভাষাকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে থাকে, দেশীয় প্রাকৃতজনের মাতৃভাষা বাংলার বিকাশকে রুদ্ধ করে দিতে চায়, এমনকি সংস্কৃত ব্যতীত অন্য ভাষায় পুরাণ বা শাস্ত্রকথা শ্রবণের বিরুদ্ধেও ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে যখন, তখনও প্রাকৃতজনের কবিরা কর্তৃত্বশীলদের প্রতাপের সামনে শির অবনত করেননি। ব্রাহ্মণ্যবিধানের প্রতিবাদে তাঁরা সতত নিজেদের শাস্ত্রপুরাণ সৃষ্টি করে চলেছেন, পুরনো শাস্ত্র-পুরাণে নবতর ব্যাখ্যা-ভাষ্য সংযোজন করে তার নবায়ন ঘটিয়েছেন, অভিজাতদের তথাকথিত শিষ্টধর্মের বিপরীতে লোকধর্মের মুক্তধারায় অবগাহন করেছেন। ব্রাহ্মণ্যধর্মীয় সেনরাজাদের পর ইসলামধর্মীয় সুলতানদের আমলেও যে এর ব্যত্যয় ঘটেনি তার প্রমাণ বাঙালি প্রাকৃতজনের হাতে ‘লৌকিক ইসলাম’-এর সৃজন। লৌকিক হিন্দু, লৌকিক বৌদ্ধ, লৌকিক ইসলাম—এ-রকম

সকল লৌকিককে নিয়েই গড়ে ওঠে বাঙালি জাতিসত্তা। এই লৌকিক অনভিজাত তথা প্রাকৃত বাঙালিই হচ্ছে প্রকৃত বাঙালি। এই বাঙালিরাই, অন্তত আঠারো শতক পর্যন্ত, বাংলাভাষায় যে-সাহিত্য সৃষ্টি করেছে তাতে বিষয় ও ভাবনার বৈচিত্র্য ছিল অবশ্যই, তবে সে-সাহিত্য উপভোগ্য ছিল সকল বাঙালিরই। এমন কথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য, বাংলায় রূপান্তরিত রামায়ণ- মহাভারত-ভাগবত, রাধাকৃষ্ণের প্রণয়-মহিমাজ্ঞাপক পদাবলি, চৈতন্যের জীবনী, নবী- -রসুলদের চরিতকথা, দৌলত কাজি বা আলাওলদের রচিত রোমান্টিক প্রণয়কাহিনী,—এবং এ-রকম সকল সাহিত্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। রাজন্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজসভার অভিজাত পরিবেশে যে-সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, সে- সাহিত্যের উপভোগ্যতাও কেবল অভিজাতদের মধ্যে সীমিত থাকেনি। কিংবা অভিজাতরাও এমন কিছু সৃষ্টি করেননি বা করতে পারেননি যার মর্মগ্রাহিতায় অনভিজাতরা অক্ষম হবে। অর্থাৎ তথাকথিত মধ্যযুগের বাংলায় সামাজিক বৈষম্য যতই প্রকট থাকুক, মোল্লা-পুরুতের দাপট যতই অকরুণ হোক, সময়ে-অসময়ে সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের ওপর সমাজপতিদের উৎপীড়ন যতভাবেই নেমে আসুক—সে-যুগের বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে প্রাকৃতজনেরই ছিল আধিপত্য। সে-কালের বাংলার পণ্ডিত কবিরাও পাণ্ডিত্যের গজদন্তমিনারে আশ্রয় নিয়ে লোকসাধারণের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাননি; তাঁদের পাণ্ডিত্যের নির্ঝরে অপণ্ডিত লোকেরাও যাতে অনায়াসে স্নাত হতে পারে, সেদিকেই বরং সতত মনোযোগী ছিলেন এই পণ্ডিত কবিবৃন্দ। যেমন—নানা শাস্ত্রে গভীর পাণ্ডিত্যের অধিকারী কৃত্তিবাস তাঁর আত্মবিবরণীতে রামায়ণ-রচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন—

সাতকাণ্ড কথা হয় দেবের সৃজিত।
লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পণ্ডিত ॥

বাংলায় ভাগবত-রচয়িতা মালাধর বসুরও একই কথা—

ভাগবত অর্থ যত পয়ারে বাঁধিয়া।
লোক নিস্তারিতে কহি পাঁচালী রচিয়া ॥

এবং

ভাগবত কথা যত লোক বুঝাইতে।
লৌকিক করিয়া কহি লৌকিকের মতে ॥

বোঝা যায়: ‘লোক বুঝাইতে’ বা ‘লোক নিস্তারিতে’ ‘লৌকিক করিয়া’ ‘লৌকিকের মতে’ কবিতা সৃষ্টিই যে-যুগের কবিদের লক্ষ্য, সে-যুগে প্রাকৃতজন-সংস্কৃতজন নির্বিশেষে সকলের জন্য সাহিত্যের একটিই ছিল মূলধারা। তথাকথিত শিষ্ট সাহিত্য ও লোকসাহিত্যের জল-অচল বিভাজন তখন সৃষ্টি হয়নি, কোনো কবিকে আলাদাভাবে ‘লোককবি’ বলে চিহ্নিত করার কথা কেউ ভাবতেই পারেনি, সকল কবিই ছিলেন সে-সময়ে লোকসাধারণের কবি।

দুই

সমগ্র বাংলা সাহিত্যের এই একক অভিন্ন ধারাটির বিলুপ্তির সূচনা ঘটে আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, এবং উনিশ শতকে ঘটে তার পূর্ণ বিলুপ্তি। একালের সব কিছুই তৈরি হয়ে এল বিদেশী রাজার কল থেকে, পণ্ডিতরাও বেরিয়ে এলেন বিদেশী বিদ্যার পাঠশালা থেকে। কবিরাও তা-ই। কবিদের সামনে এখন নতুন এক পাঠক সমাজ; সে-পাঠকরা কবিদের মতোই বিদেশী বিদ্যার পাঠশালার শিক্ষায় শিক্ষিত। তাই ‘লোক বুঝাইতে’ বা ‘লোক নিস্তারিতে’ ‘লৌকিকের মতে’ কবিতা বা সাহিত্য রচনার দায় একালের কবিসাহিত্যিকরা বহন করতে রাজি হলেন না, একটি নির্বাচিত পাঠক সমাজের রসপিপাসার নিবৃত্তি ঘটানোই হলো তাঁদের লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁরা একেবারে অভিনব ও একান্ত সমৃদ্ধ সাহিত্যের সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারাপ্রবাহের সৃষ্টি করে ফেললেন। এ-ধারার সাহিত্য জাতীয় গণ্ডি ভেদ করে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে মননের ঐশ্বর্য আহরণ করতে মনোযোগী হলো, বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের মান অর্জনের প্রয়াস পেলো, এবং সে-প্রয়াস উত্তরোত্তর ফলপ্রসূও হতে থাকলো। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকসাধারণ বঞ্চিত হয়ে রইলো সাহিত্যের এই নতুন ধারাপ্রবাহে অবগাহন করার অধিকার থেকে। এ-রকম অধিকার-বঞ্চিত লোকসাধারণ রসপিপাসা-নিবৃত্তির জন্য কোন পথে অগ্রসর হলো, তাদের মননচর্চা কোন কোন মাধ্যম বা রীতিপদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করলো, তারা অন্যতর কোনো সাহিত্যধারার সৃষ্টি করলো কিনা, করে থাকলে সেটির প্রকৃতি ও স্বরূপই-বা কী—এ-সব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন ‘আধুনিক’ ‘শিক্ষিত’ বাঙালি অনুভব করলো না, –অন্তত নতুন সাহিত্যধারা সৃষ্টির প্রথম পর্বে তো নয়ই। তখনকার ‘শিক্ষিত’ বাঙালির দৃষ্টিতে ইংরেজ-অধিকারের পূর্বেকার বাংলা ছিল নিতান্তই স্থূল, অমার্জিত ও গ্ৰাম্য; সেই গ্রাম্যতার সকল উত্তরাধিকারকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত তারা সূক্ষ্ম, মার্জিত ও নাগরিক বৈদগ্ধ্যমণ্ডিত হয়ে উঠতে চাইলো। সদ্যলব্ধ নাগরিকতার দম্ভে তারা গ্রামীণ পূর্বপুরুষের সকল কৃতিকেই অস্বীকার করে বসলো।

তবে, বিষয়টি অবশ্যই পুরোপরি একমাত্রিক হয়ে থাকেনি। শিক্ষিত ও অনুভূতিপ্রবণ নাগরিকদের কেউ কেউ কখনো কখনো বিচ্ছিন্নতার বেদনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন, এবং সে-বেদনা নিরসনের লক্ষ্যেই নাগরিকতা ও আধুনিকতার দম্ভ ও উন্নাসিকতাকে পাশ কাটিয়ে দেশীয় ঐতিহ্য সন্ধানে মনোযোগ দিয়েছেন, বিস্মৃত ইতিহাস পুনরুদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের একেবারে গোড়াতেই আমরা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসচেতনা-সমৃদ্ধ সমালোচনার সূত্রপাত ঘটে যেতে দেখি সে-সময়কার বিশিষ্ট কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। ১৮৫২ সালের এপ্রিল মাসে হরচন্দ্র দত্ত নামক এক নব্যশিক্ষিত বাঙালি যুবা বাংলা সাহিত্যের প্রচুর নিন্দামন্দ করে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন, প্রবন্ধে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের তুলনায় বাংলা সাহিত্যের অকিঞ্চিৎকরতার কথা তুলে ধরেছিলেন; তখনকার দিনে প্রচলিত বিদ্যাসুন্দর ও কবিগানের স্থূলতা ও রুচিহীনতা তাঁকে পীড়িত করেছিল, এ-সবকেই বাংলাসাহিত্যের উপাদান ও বৈশিষ্ট্যরূপে অবলোকন করে এ-সাহিত্য সম্পর্কে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এ-রকম হতাশ আত্মনিন্দার বিরুদ্ধে অনতিবিলম্বে নগরবাসী নব্যশিক্ষিত সমাজেই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সে-সমাজেরই অন্যতম মুখপাত্ররূপে কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সে-বছরের মে মাসেই ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ’ নামে যে-রচনাটি বিটন সোসাইটিতে পাঠ করেছিলেন সেইটি দিয়েই, বলা যেতে পারে, বাংলা সমালোচনা সাহিত্যের শুভ যাত্রারম্ভ। রঙ্গলাল দূর অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করে চণ্ডীমঙ্গলের মুকুন্দরাম ও রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদক কৃত্তিবাস-কাশীরামের প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। ইংরেজি সাহিত্যের অনেক রচনা যে ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরের চেয়ে অনেক বেশি কুরুচিপূর্ণ সে-কথার বিশেষ উল্লেখ করে তিনি হরচন্দ্রের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানালেন। তবে ইতিহাস-আশ্রয়ী হলেও রঙ্গলালের এই প্রবন্ধে চণ্ডীদাস- জ্ঞানদাসের মতো বৈষ্ণব পদকর্তাদের পদাবলির কাব্যসৌন্দর্য আলোচিত হয়নি। কিংবা বাংলা সাহিত্যের পুরো ইতিহাসও এতে বিধৃত হয়নি। তবু ওই প্রবন্ধটিতেই বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যের সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- অনুসন্ধানেরও সূচনা ঘটে গিয়েছিল। পুরো ইতিহাস-উদ্ধারে অবশ্যি এরপর আরো অনেক সময় লেগেছিল। বিশ শতকে ‘চর্যাপদ’ ও ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর আবিষ্কার, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যের ও বৈষ্ণবসাহিত্যের পুনরুদ্ধার, এবং মুসলিম কবিদের রচিত সাহিত্যের বিপুল সম্ভারকে জনসমক্ষে উদঘাটনের মধ্য দিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, হরেন্দ্রকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সাহিত্যরত্ন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ প্রমুখ মনীষী সাহিত্যের ইতিহাসকারদের হাতে যে- সব উপাদান তুলে দিলেন তাই দিয়ে রচিত হলো তথাকথিত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। আর উনিশ-বিশ শতকের নাগরিক সাহিত্য নিয়ে ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’। এ-রকম ‘মধ্যযুগ’ ও ‘আধুনিক যুগ’ নিয়ে দীনেশ চন্দ্র সেন, সুকুমার সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং তাঁদের অনুসারী ও উত্তরসূরিদের হাতে রচিত হয়েছে ও হয়ে চলছে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসকারদের প্রায় সবার দৃষ্টিতেই মধ্যযুগের শেষ উল্লেখযোগ্য কবি হলেন ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর, আর আধুনিক যুগের প্রবর্তক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এঁদের মাঝখানে ঈশ্বরগুপ্ত হলেন ‘যুগসন্ধির কবি’। ‘প্রাচীন যুগের ভগ্নদূত ও আধুনিক যুগের অগ্রদূত’ বলেও তিনি চিহ্নিত হয়ে থাকেন কখনো কখনো। ইতোমধ্যেই উদ্ভব ঘটে যায় বাংলা গদ্যের। উদ্ভবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেই নবীন গদ্য বিচিত্রবিধ ভাবপ্রকাশের উপযোগী হয়ে ওঠে। গদ্যই হয়ে ওঠে আধুনিক সাহিত্যের প্রধান বাহন।

মোটামুটি এ-রকমই হলো এতাবৎকাল-চর্চিত আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসের ছক।

কিন্তু বাংলার যে-সব কবি ‘আধুনিক নাগরিক মধ্যবিত্তে’র পরিমণ্ডলে প্রবেশ করেননি বা করতে পারেননি, নগর পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে গানে ও কবিতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির আর্তি ও প্রাপ্তির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন যাঁরা, বাংলা সাহিত্যের কোনো পর্বে বা অধ্যায়েই তাঁদের স্থান হলো না। এঁরা যেন ত্রিশঙ্কু–না স্বর্গের, না মর্ত্যের। মধ্যযুগেরও নন, আধুনিকও নন।

অথচ এ-রকম কবিদের কৃতিকে একেবারে অস্বীকার বা উপেক্ষা করাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। উনিশ শতকের শেষ দু-দশকেই শিক্ষিত নাগরিক বাঙালিদের নজর পড়লো পল্লীর কবিদের দিকে। তাঁরা লক্ষ করলেন : পল্লীর এই কবিদের অনেকেই নিরক্ষর হলেও—কিংবা কেউ কেউ নিরক্ষরতার সীমা অতিক্রম করে সাক্ষরতার এলাকা স্পর্শ করলেও—তাঁরা কেউই ইংরেজের পাঠশালায় ‘আধুনিক’ শিক্ষায় শিক্ষিত হননি। অথবা সংস্কৃত-আরবি ভাষার ধ্রুপদী শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ করে ধর্মদর্শনে পাণ্ডিত্য লাভ করেননি। একরকম ‘অশিক্ষিত’ই বলা চলে তাঁদের। অথচ তাঁদের সৃষ্টিতে (কবিতায়-গানে) ও মননে কী অসাধারণ দ্যুতি! তথাকথিত আধুনিক শিক্ষা না-নিয়েও তাঁদের বচনে আধুনিকতার প্রকাশ কতোই-না গভীর! ‘বাউল’ নামে পরিচিত কবিদের—বিশেষ করে লালন ফকির নামক এক কবির—সৃষ্টিতে গভীর মননশীলতা, দার্শনিকতা, চিরন্তন আধুনিকতা ও অসাধারণ শিল্পকুশলতার পরিচয় পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো আধুনিকোত্তম কবি-দার্শনিকও বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়েন। ক্রমে সে-বিস্ময় নাগরিক বুধমণ্ডলীতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আবিষ্কৃত হন লালনের মতোই আরো-আরো কবি। বিশ শতকে সে-আবিষ্কারের পরিধি অনেক প্রসারিত হতে থাকে। নব-আবিষ্কৃত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র মাধ্যমে নাগরিক পরিমণ্ডলের বাইরের অনক্ষর কবিদের বিস্ময়কর প্রতিভার পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়ে যান বিদেশের রসিকজনও। ময়মনসিংহের মনসুর বয়াতি নামক এ-রকমই এক অনক্ষর পল্লীকবি-রচিত ‘দেওয়ানা মদিনা’র কাহিনী পড়ে ‘অশ্রু সংবরণ’ করতে পারেন না রম্যাঁ রলাঁর মতো বিশ্বনাগরিক মনীষীও।

তবু, যতোই বিস্ময়কর প্রতিভা বলে বিবেচিত হোন না কেন, লালন ফকির কিংবা মনসুর বয়াতি কিংবা এ-রকম আরো সব নগরান্তবাসী প্রাকৃতজনের কবিদের কেউই ‘সাহিত্যের আনন্দের ভোজে’ নাগরিক কবিদের সঙ্গে একই পংক্তিতে আসন গ্রহণের অধিকার পান না। তবে বিশ শতকে ‘লোকসাহিত্য’-চর্চার প্রসারের সুবাদে ওই সব কবিদের জন্য অন্য একটি নিরাপদ স্থান নির্ধারণের ব্যবস্থা করে দেন বিদগ্ধ সাহিত্যশাস্ত্রীগণ। তাঁরা এঁদের জন্য বরাদ্দ করেন ‘লোককবি’ অভিধাটি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে : লোকসাহিত্যের যে-সংজ্ঞা ও চরিত্র একালের সাহিত্যশাস্ত্রীগণ নিজেরাই নির্দেশ করেছেন তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকলে তাঁরা কি কোনো বিশেষ বা নির্দিষ্ট কবিকে ‘লোককবি’ আখ্যা দিতে পারেন? লোককবিতা তথা লোকসাহিত্য তো, তাঁরাই বলেন, লোকসমাজের সমবায়ী সৃষ্টি (Collective creation of the folk)। ছড়া, প্রবাদ, ধাঁধা, সংগীত, কিংবদন্তি, রূপকথা ইত্যাদি যে-সব সৃষ্টি কোনো ব্যক্তি-রচয়িতার পরিচয় বহন করে না, লোকসাধারণের যৌথ বা সমবায়ী যে-সব রচনা বংশানুক্রমে শ্রুতিপরম্পরায় চলে এসেছে, সে-সবই লোকসাহিত্য (Folk literature is simply literature transmitted orally)। এ-রকম এক কষ্টিপাথরে বিচার করেই লোকসাহিত্য-তাত্ত্বিকরা লোকসমাজে রচিত ও প্রচলিত “কবিগান’কেও লোকসাহিত্যের অন্তর্গত বলে বিবেচনা করতে রাজি হন না। কারণ কবিগানের রচয়িতা একেক জন ব্যক্তিকবি (যদিও সেই কবি বা কবিয়াল আসরে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মুখে-মুখেই (orally) কবিগান রচনা করে থাকেন)। ব্যক্তি-রচয়িতার ভণিতাযুক্ত বলেই তত্ত্বসংগীতকে লোকসংগীত বা লোকসাহিত্য বলা হয় না। তাহলে লালন, দুদ্দু শাহ, পাগলা কানাই, হাছন রাজা, জালাল খাঁ কিংবা দ্বিজদাস, হরিচরণ, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল, নিবারণ পণ্ডিত প্ৰমুখ স্পষ্ট ব্যক্তিবৈশিষ্ট্য-চিহ্নিত কবিকে লোককবি বলা হবে কোন যুক্তিতে বা কোন নিরিখে? এ-ছাড়া এঁদের রচনা যে কেবল মুখে-মুখেই রচিত এবং শ্রুতিপরম্পরা-বাহিত, তা-ও নয়। এঁদের অনেকেই নিজে অথবা অন্য লিপিকারদের দিয়ে আপন আপন রচনা কলমবন্দি করে রাখেন, অনেকেই মুদ্রিত রূপেও প্রকাশ করেন। তাই, এঁদের রচনাকে কোনোমতেই নৈর্ব্যক্তিক লোকসাহিত্যের পর্যায়ভুক্ত করা চলে না। তবু এঁরা লোককবি?

দেখা যাচ্ছে : ‘লোককবি’ কথাটিই একালীন সাহিত্যশাস্ত্র-সম্মত নয়। তাহলে ওই সব শক্তিমান কবিকে ও-রকম একটি অসঙ্গত আখ্যা দিয়ে অবমানিত করা হবে কেন?

তিন

‘লোককবি’র প্রসঙ্গ নিয়ে আরো কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার।

এক শ্রেণীর কবিকে ‘অবমানিত করা’র সচেতন উদ্দেশ্য নিয়েই ‘লোককবি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে—এমন বললে নিশ্চয়ই তা হবে অতি সরলীকরণ। আসলে ‘লোককবি’ ছাড়া অন্য কোনো জুৎসই অভিধা এঁদের জন্য খুঁজে পাওয়াই শক্ত। একালের সাহিত্যশাস্ত্রীদেরও তাই নিরুপায় হয়েই এঁদের পরিচয় দিতে গিয়ে ‘লোককবি’ শব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, একালে ইংরেজি folk-এর প্রতিশব্দরূপে ব্যবহৃত হলেও আমাদের ভাষায় ‘লোক’ শব্দটির তাৎপর্য বহুমাত্রিক। সেই বহুমাত্রিকতাকে বিবেচনায় রাখলে ‘লোককবি’ কথাটির একটি সদর্থক তাৎপর্য নিষ্কাশন করা যাবে এবং এক বিশেষ কবিবৰ্গকে ‘লোককবি’ আখ্যা দেবার যৌক্তিকতাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে।

প্রাচীন ভারতে ‘লোকায়ত’ দর্শন বলা হয়েছে সেই দর্শনকে, যে-দর্শন বেদের প্রামাণ্যতা ও ব্রাহ্মণের আধিপত্য অস্বীকার করেছিল। যা ‘লোকেষু আয়ত’ অর্থাৎ লোকের ভেতর যা বিস্তৃত তাই লোকায়ত। ‘লোক’ শব্দের অর্থ এখানে দ্বিবিধ— ১. সাধারণ লোকজন বা লোকসাধারণ (public) এবং ২. ইহলোক বা বাস্তব ও পার্থিব (temporal) বিষয়। লোকসাধারণের মধ্যে যা বিস্তৃত, লোকসাধারণের চিন্তা -চেতনাকে যা ধারণ করে, এবং যা একান্ত ইহলোক-সম্পৃক্ত—সে-রকম দর্শনই যদি হয় লোকায়ত দর্শন, তবে সে-রকম সাহিত্যও অবশ্যই লোকায়ত সাহিত্য। লোকায়ত সাহিত্য অর্থেই আমরা ‘লোকসাহিত্য’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারি। এবং এ-ক্ষেত্রে আধুনিক কালের ফোকলোরিস্টদের দেওয়া লোকসাহিত্যের সংজ্ঞার্থ বা চরিত্রলক্ষণকে (‘collective creation of the folk’ এবং ‘orally transmitted’) অক্ষরে অক্ষরে মেনে নেওয়ার কোনো দায় আমাদের নেই। প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্মণদের অভিজাত দর্শনের বিপরীতে যেমন ছিল লোকায়ত দৰ্শন, তেমনি অভিজাত ধর্মের প্রতিবাদে উদ্ভূত হয়েছিল নানা লোকায়ত বা লোকধর্মও। বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্ম এবং এই দুটো ধর্মের প্রবর্তক বুদ্ধ ও মহাবীরের পূর্বে বা তাঁদের সমসাময়িককালে প্রচলিত বিভিন্ন শ্রমণপন্থাও ছিল এ-রকমই লোকধর্ম। এ-সব লোকধর্মের অনুসারী লোকসাধারণ তাদেরই ভাব-ভাবনা নিয়ে, তাদেরই আপন মাতৃভাষায়, সেই প্রাচীন কালেও যে-সাহিত্যের চর্চা করেছে—তা-ই ছিল সে-কালের লোকসাহিত্য। অভিজাত ব্রাহ্মণদের তথাকথিত শিষ্ট সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে লোকসাধারণের অবোধ্য কৃত্রিম ভাষা সংস্কৃতে, আর অনভিজাত লোকসাহিত্যের বাহন হয়েছে লোকসাধারণ্যে প্রচলিত বিভিন্ন প্রাকৃত ভাষা। মৌখিক ও লিখিত—দু-রীতিতেই রচিত হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাকৃতজনের লোকসাহিত্য এবং এ-রকম লোকসাহিত্যের ওপর ভর করেই প্রাকৃত ভাষা এমন এগিয়ে যায় যে এক সময় সংস্কৃত ভাষার সাহিত্য হয়ে পড়ে রুদ্ধস্রোত। প্রাকৃত ভাষারই স্বাভাবিক বিবর্তন থেকে সারা উপমহাদেশে উদ্ভূত হতে থাকে নানা ভাষা। সে-সব ভাষারই একটি বাংলা।

প্রাকৃত ও প্রাকৃতজ সকল ভাষার মতোই বাংলাকে যে জন্মলগ্ন থেকে অনভিজাত লোকসাধারণই লালন-পালন করে এসেছে এবং অভিজাত ক্ষমতাধররা যে একে আঁতুড়েই মেরে ফেলতে সচেষ্ট থেকেছে, তবু কয়েক শতাব্দী ধরে যে লোকসাধারণের সাহিত্য রূপেই বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের জয়যাত্রা অব্যাহত

থেকেছে—এ-সব বিষয় আমরা আগেই লক্ষ করেছি। সে-সঙ্গে আমরা এ-ও দেখেছি : অন্তত আঠারো শতক পর্যন্ত বাংলা ভাষার সাহিত্যের যে-অভিন্ন ধারাটি প্রবাহিত ছিল, উনিশ শতক থেকে সেটি আর অভিন্ন থাকেনি। বিদেশী শিক্ষাপ্রাপ্ত একটি সংখ্যালঘু নাগরিক মধ্যবিত্তগোষ্ঠীর হাতে রচিত সাহিত্যই তখন থেকে প্রবল প্রতাপান্বিত হয়ে ওঠে তবু নাগরিক সাহিত্যের এই নতুন ধারাটি যতই প্রতাপান্বিত হোক না কেন, বাংলা সাহিত্যের সনাতন ধারাটির প্রবাহ কিন্তু কখনো রুদ্ধ হয়নি, আগের মতোই প্রাকৃতজন বা লোকসাধারণের মধ্যে তা যথারীতি প্রবহমান থাকে। বাংলার সনাতন ধারার এ-সাহিত্য যেহেতু একান্তরূপেই ‘লোকায়ত’, তাই ‘লোক’ কথাটির সনাতন অর্থের বিচারে তাঁদের ‘লোককবি’ অবশ্যই বলা যেতে পারে। তবে ‘লোককবি’ আখ্যা দিয়ে তাঁদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেওয়া একান্তই অন্যায়। বরং বলা উচিত : এঁরাই বাংলা সাহিত্যের সনাতন ধারার বা মূলধারার কবি।

উনিশ-বিশ শতকের ‘আধুনিক’ বাংলা সাহিত্যের সমান্তরালে বহমান এই ‘সনাতন’ ধারার কয়েকজন কবির নামের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন ডক্টর সৈকত আসগর। [দ্রষ্টব্য : বরুণকুমার চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ’ (কলিকাতা ১৯৯৫) পৃ: ৬১]। তালিকাটি এ-রকম : লালন শাহ (১৭৭৪-১৮৯০), শীতালং শাহ (১৮০০-১৮৮৯), পাগলা কানাই (১৮০৯-১৮৮৯), দেওয়ান রশিদ (১৮৩০-১৯৪০), দুদ্দু শাহ (১৮৪১-১৯১১), নেধু শাহ (১৮৪৩-১৯৬৮), শাহ আরকুম (?), পাঞ্জু শাহ (১৮৫১-১৯১৪), হাছন রাজা (১৮৫৫-১৯২২), শাহ আজাহার (আজাহার বয়াতি) (১৮৬৫-১৯৬০), রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭), মুকুন্দ দাস (১৮৭৮-১৯৩৪), মনোমোহন দত্ত (১৮৭৮-১৯১০), কানাইলাল শীল (১৮৯৫-১৯৭৪), ভবা পাগলা (১৮৯৭-১৯৮৪)।

এ-তালিকা অবশ্যই সম্পূর্ণাঙ্গ নয়। আসলে বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এ-রকম কবিদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা রচনা করা খুবই কঠিন; প্রায় অসম্ভবই বলা চলে। তবু সৈকত আসগর রচিত এই তালিকাটিকে মোটামুটি প্রতিনিধিত্বশীল বলে আমরা ধরে নিতে পারি। লালন শাহের থেকে ভবা পাগলা পর্যন্ত অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শেষ অবধি সময়-পরিসরে যতসংখ্যক নাগরিক কবির অভ্যুদয় ঘটেছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি কবি সক্রিয় থেকেছেন নাগরিক পরিমণ্ডলের বাইরে বৃহত্তর লোকসমাজে। শুধু সংখ্যায়ই এঁরা গরিষ্ঠ নন, বৈচিত্র্যও এঁদের রচনায় প্রভূত। সে-বৈচিত্র্য রূপেও যেমন, ভাবেও তেমনি। এঁদের কবিতা (তথা গান) নানাবিধ রূপাঙ্গিককে আশ্রয় করে থাকে। সে-সবের মধ্যে কাহিনীধর্মিতা যেমন আছে, তেমনি আছে গীতিধর্মিতাও। কোনো কোনো রচনা নাট্যগুণ-সমৃদ্ধ, কোনোটাতে তত্ত্বধর্মিতা প্রবল। কোনোটা কল্পনার জগতের অভিসারী, কোনোটায় বিধৃত আকাড়া বাস্তবতা। ওই কবিদের কেউ কেউ রূপকথা ও ইতিহাসের জগতে যেমন অভিসার করেন, তেমনি অনেক কবি ভীষণভাবে আলোড়িত হন আপন আপন সমকালীন সমাজের সমস্যায়-সংকটে-সম্পদে- সম্ভাবনায়। তবে এসব কবিদের রচনার সকল প্রকার আঙ্গিক ও ভাববস্তুই সকল বাঙালি লোকসাধারণের অনুভববেদ্য ও হৃদয়বেদ্য—ঠিক যেমনটি ছিল আগের শতকগুলোর কবিদের রচনা। তাই—উনিশ শতকে ‘নাগরিক আধুনিক কবিতা’র ভিন্ন একটি ধারার উদ্ভব হওয়ার পরও—লোকসাধারণের ভেতরে সক্রিয় থেকে আবহমান বাংলা কবিতার সনাতন ধারাটিকে প্রবহমান রেখেছেন যে-কবিরা, সেই কবিদেরই কি মূলধারার কবি বলে গণ্য করা সংগত নয়? বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে যে এই কবিদের বাংলা কবিতার সনাতন প্রবাহের অন্তর্ভুক্ত না করে নিতান্ত ব্রাত্য বানিয়ে ত্রিশঙ্কু অবস্থানে রাখা হয়েছে, সেটি কি একান্তই অসংগত হয়নি?

চার

‘আবহমান বাংলা কবিতার সনাতন ধারা’ বলছি যাকে, তার ‘সনাতন’ শব্দটি স্থবিরতার দ্যোতক নয় নিশ্চয়ই। কিংবা নয় রক্ষণশীলতার সমার্থক বা ‘প্রগতি’ ও ‘আধুনিকতা’র বিরোধী। চিরকাল ধরে চলমান যা, তা-ই তো সনাতন। যা চলমান, রক্ষণশীলতা তাতে বাসা বাঁধতে পারে না; তাই তা প্রগতির ধারক, আর প্রগতি ও আধুনিকতা তো অভিন্ন। জন্মলগ্ন থেকেই বাংলা কবিতার সনাতন ধারা এই প্রগতি ও আধুনিকতাকে অঙ্গীকৃত করে নিয়েছে। প্রচলিত ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে যেখানে এই ধারাটির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় (অর্থাৎ ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদ পর্যন্ত), প্রকৃতপক্ষে তারপরও যে এই ধারাটি অব্যাহত থেকেছে, অষ্টাদশ শতকে লালন শাহের অভ্যুদয়ই তার প্রমাণ। লালনের জন্মবর্ষ বলে নির্ধারিত হয়েছে ১৭৭৪ সালটি। ওই সালটিই রাজা রামমোহনেরও জন্মবর্ষ বলে কথিত। (অবশ্যি লালন ও রামমোহন উভয়েরই সঠিক জন্মবর্ষ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবু এই দুজনের জন্ম যে কাছাকাছি সময়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।) রামমোহনের মৃত্যু ১৮৩৩ সালে। অন্যদিকে দীর্ঘজীবী লালন মৃত্যুবরণ করেন ১৮৯০ সালে। অর্থাৎ প্রায় সমগ্র উনিশ শতক ছিল লালনের সৃষ্টি ও সাধনার কাল। রামমোহন অবশ্যই উনিশ শতকের বঙ্গীয় রেনেসাঁস ও আধুনিকতার পথিকৃৎ ছিলেন, এবং সে-শতকেই তাঁর উত্তরসূরি বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মনীষীর দানে নাগরিক বাংলার মধ্যবিত্তের নবজাগরণ তুঙ্গ স্পর্শ করেছিল। কিন্তু সেই একই সময়- পরিসরে গ্রামবাংলার নিম্নবর্গীয় লোকসাধারণের অবস্থা কেমন ছিল? তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত নয়া সামন্ততন্ত্র, ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র ও মোল্লাতন্ত্রের মার খেয়েছে, নতুন বিজ্ঞান-দর্শনের আলো থেকে বঞ্চিত থেকেছে, পেটের ক্ষুধা ও মনের ক্ষুধা নিবৃত্তির স্বাস্থ্যসম্মত সকল উপকরণ উচ্চবর্গের সমাজ-বিধায়করা তাদের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছে। অথচ এ-রকম একান্ত বিরূপ পরিবেশেও যে লোকসাধারণের মনীষার প্রবাহ শুকিয়ে যায়নি, আবহমান বাংলার গান-কবিতা- শিল্প-সংস্কৃতির সনাতন ধারাটি যে সঞ্জীবিত থেকেছে, লোকসাধারণের ভেতর থেকে উদ্ভূত দার্শনিক-চিন্তকরাই যে চিরায়ত ও লোকায়ত বিদ্রোহী চিন্তার অনুশীলন করে চলেছেন, লালন ফকির ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের সৃষ্টি ও সাধনাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। রামমোহন আর তাঁর অনুসারিবৃন্দের হাতে ছিল আধুনিক তথা পাশ্চাত্য দর্শন-বিজ্ঞানের আলোর মশাল, লালন ফকিররা সে-আলোর প্রত্যক্ষ স্পর্শ থেকে ছিলেন বঞ্চিত। তবু লালন ফকির ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা তাঁদের বক্তব্যে যে-সব তত্ত্বকথার অবতারণা করেছেন, সে-সবকে রামমোহনদের প্রচারিত তত্ত্বের চেয়ে পশ্চাৎবর্তী বলা যাবে না কোনোমতেই।

বস্তু ছাড়া নাহি আর আল্লা কিংবা হরি।
এহিমত দেখ সবে নরবস্তু ধরি ॥
রজঃবীর্য এই দুই বস্তু যেবা চিনে।
লালন সাঁইজিকে সেই জন জানে ॥

লালনদের এ-রকম বক্তব্যে তাঁদের তো বস্তুবাদী বলেই শনাক্ত করা যায়। হতে পারে তাঁদের এই বস্তুবাদ নিতান্তই প্রাক-আধুনিক কালের একান্ত সরল বস্তুবাদ। তবু বুদ্ধির মুক্তিসাধনার নাগরিক পুরোহিত রামমোহনের ব্রহ্মবাদের চেয়ে এ-বস্তুবাদকে বেশি অবৈজ্ঞানিক বলতে পারি কি? বাংলার নগরজীবনে মুক্তবুদ্ধির বিস্তার ঘটানোর যে-কাজটি রামমোহন ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যরা করে চলেছিলেন, গ্রামীণ জীবনে মোল্লা-পুরোহিতদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মৌলবাদী ধর্মচেতনা- বিরোধী লালন ও তাঁর সহযোগীরা সেই একই কাজ যে চালু রেখেছিলেন—সে- কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। প্রাচীন ক্লাসিক শাস্ত্রসমূহের আধুনিক ব্যাখ্যা ছিল রামমোহনের উপজীব্য। আর লালন ফকিররা আবহমান বাংলার লোকসাধারণের সংস্কৃতির বিদ্রোহী উপাদানকে সংহত করে নিয়ে গ্রামীণ নিস্তরঙ্গ জীবনে এক ধরনের মুক্তবুদ্ধির তরঙ্গ প্রবাহ বইয়ে দিতে থাকেন।

রাজা রামমোহন ও ইয়ং বেঙ্গলদের মুক্তবুদ্ধিচর্চার আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা আধুনিক নাগরিক বাংলা সাহিত্যে দেব-বিরোধিতা ও মানব-মহিমার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটান মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু তারই সমান্তরালে প্রবাহিত মূলধারার সাহিত্যে লালন ফকির যখন বলেন—’রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি, চোরেরও সে শিরোমণি’, তখন তা শুধু দেব-বিরোধিতা থাকে না, একেবারে স্বয়ং বিশ্বপালক ঈশ্বরের প্রতিই অভিযোগের আঙুল তুলে ধরে। পাশ্চাত্ত্য-থেকে-আনীত বুর্জোয়া মানবতাবাদের দৃষ্টি দিয়ে বঙ্গীয় রেনেসাঁসের নায়করা সকল মানুষের সমান মর্যাদার বিষয়টি অবলোকন করেছিলেন, আর লালন-দুদ্দু-পাগলা কানাই প্রমুখ লোকসাধারণের কবিরা আবহমান বাংলার লোকায়ত ভাবনা থেকেই নিয়েছিলেন মানবতার পাঠ—নানান বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ/জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’ লালন যখন সুন্নত দিয়ে মুসলমান বা পৈতা দিয়ে ব্রাহ্মণ চিহ্নিত হওয়াকে বিদ্রুপবিদ্ধ করেন, তখন কি তাঁর এই বক্তব্যকে পাশ্চাত্ত্য শিক্ষাপ্রাপ্ত আধুনিক নাগরিক বাঙালিদের চেয়ে অনেক বেশি র‍্যাডিক্যাল মনে হয় না? শুধু এ-ক্ষেত্রেই নয়। বাংলার সনাতন ধারা তথা মূলধারার সকল কবিই আবহমান বাংলার অসাম্প্রদায়িক তথা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করেছেন। অন্যদিকে নাগরিক বিদগ্ধ কবিরা (অন্তত উনিশ শতকের মাইকেলোত্তর কবিদের একটি বড় অংশ তো বটেই) একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকেই আশ্রয় করেছেন এবং কখনো কখনো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। মাইকেল মধুসূদনের মতো মহৎ কবি, যাঁকে বলা যায় শতকরা একশত ভাগ অসাম্প্রদায়িক, যিনি অনায়াসে পৈতৃক হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু সংস্কার পরিত্যাগ করে খ্রিস্টান হয়ে যেতে পেরেছিলেন, কাব্যে তাঁরও অবলম্বন হয়েছিল হিন্দু পৌরাণিক ঐতিহ্যই। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর এই কবি স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন : ‘আমাদের’ (অর্থাৎ হিন্দুদের) এপিক রচনার মতো কোনো বিষয়বস্তু নেই, অথচ ‘কারবালার ট্র্যাজেডি’র মতো মহাকাব্যের উপাদান আছে মুসলমানদের। তাই তিনি একটি পত্রে লিখেছিলেন যে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো শক্তিমান কবির আবির্ভাব ঘটলে তাঁরই হাতে মহরম নিয়ে যথার্থ মহাকাব্য রচিত হতে পারে। বাংলা কাব্যের মূলধারার কবিদের কিন্তু এ-রকম সাম্প্রদায়িক বিভাজন করতে হয়নি। গরিবুল্লাহর মতো মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত কবির ‘জঙ্গনামা’র পাশাপাশি ‘হিন্দু’ কবি রাধাচরণ গোপও কারবালার ট্র্যাজেডি নিয়ে অনায়াসে ‘ইমামের জঙ্গ’ লিখে ফেলতে পারেন। ‘মুসলমান’ কবিও লিখতে পারেন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদাবলি বা শ্যামাসংগীত। যে হাছন রাজা আকুল হয়ে বলেন—’হাছন রাজায় কান্দে কান্দে রে/আল্লাজির লাগিয়া।/স্বপনে দেখিলাম তারে/ না দেখি জাগিয়া,’ তিনিই ব্যাকুল চিত্তে কৃষ্ণ বা কানাইকে ডেকে বলতে পারেন—’দয়াল কানাই, দয়াল কানাইরে/পার করিয়া দাও কাঙালিরে।/ভবসিন্ধু পার হইবার/পয়সা কড়ি নাই।/দয়া করিয়া পার করিয়া দাও/বাড়ি চলে যাই।’ যিনি জন্মসূত্রে হিন্দু, তেমন কবিও পারেন ইসলামি বিষয়বস্তুকে তাঁর রচনার অবলম্বন করতে। যেমন—নেত্রকোনার কবি শরৎচন্দ্র নাথ রচনা করেছেন ‘দীন শরতের এসলাম সংগীত’। রচনায় হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যের চমৎকার সংশ্লেষণ ঘটিয়েছেন কুমিল্লার মনোমোহন দত্ত। নরসিংদির কবি বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী ‘দ্বিজদাস’ ছদ্মনামে যে-সব সঙ্গীত রচনা করেছেন তাতে আবহমান বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন ঘটেনি শুধু, প্রথাবদ্ধ ধর্মীয় ভাবনার তীব্র সমালোচনাও তাতে ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ ধর্মসম্প্রদায়- নির্বিশেষে পুরো বাঙালি জাতির লোকসাধারণের ঐতিহ্যকে একই আধারে ধারণ করেই প্রবাহিত হয়েছে বাংলা কবিতার মূলধারাটি। নবোদ্ভূত নাগরিক মধ্যবিত্ত বাঙালির হাতে রচিত নতুন ধারাটির সঙ্গে বাংলা কবিতার মূলধারার আসল পার্থক্য এখানেই।

পাঁচ

বিশ শতকে যখন বাংলার নাগরিক সাহিত্যে হিন্দু রিভাইভ্যালিজমের প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম রিভাইভ্যালিজমের সাম্প্রদায়িকতা প্রকট হয়ে উঠেছে, তখনও কিন্তু মূলধারার কবিরা সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা ও রিভাইভ্যালিজমের কু-প্রভাব থেকে মুক্ত থেকেছেন। শুধু তাই নয়। নাগরিক মধ্যবিত্তের বাংলা কবিতায় যখন কলাকৈবল্যবাদেরই প্রাধান্য, তখন বাংলা কবিতার মূলধারার অনুসারী কবিদের মধ্য থেকে প্রতিনিধিত্বশীল রূপে অন্তত চারজন কবির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। এঁরা হচ্ছেন হরিচরণ আচার্য, মুকুন্দ দাস, রমেশ শীল ও নিবারণ পণ্ডিত। মূলধারার কবিতা তথা সাহিত্যের বিভিন্ন প্রকরণ এঁরা অবলম্বন করেছেন বটে, কিন্তু স্থবিরতা ঘুচিয়ে সে-সব প্রকরণকে জীবন্ত ও গতিশীল করে তুলেছেন। হরিচরণ আচার্য ও রমেশ শীল ‘কবিগান’ নামক প্রকরণটিতে অভিনবত্বের সঞ্চার ঘটিয়েছেন। ‘যাত্রা’র আঙ্গিকে ও বক্তব্যে বিপ্লব নিয়ে এসেছেন মুকুন্দ দাস। আর নিবারণ পণ্ডিত প্রাচীন পাঁচালির খোলনলচে পালটে দিয়েছেন, পাঁচালি তাঁর হাতে সমাজতান্ত্রিক ভাবনার বাহন হয়ে উঠেছে। মূলধারার কবিতার যে একটি বিশেষ প্রকরণ কবিগান, সেই প্রকরণটি আঠারো-উনিশ শতকের কলকাতায় মারাত্মক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। তখনকার নতুন নগরে উদ্ভূত ‘হঠাৎ নবাব’রাই সে- সময়ে কবিগানের পৃষ্ঠপোষকরূপে মঞ্চাবতীর্ণ হন। পৃষ্ঠপোষকদের অসুস্থ চেতনা ও অশ্লীল জীবনাচরণ থেকেই কবিগানে অসুস্থতা ও অশ্লীলতার সঞ্চার ঘটে। তবে এই বিকৃতমতি পৃষ্ঠপোষকদের আওতা যেখানে প্রসারিত হতে পারেনি, নগরসীমার বাইরে অবস্থিত সেই সনাতনী গ্রামগুলোতে—বিশেষ করে সে-সময়কার পূর্ববাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে—কবিগান তার সুস্থতা ও শ্লীলতা বহুল পরিমাণেই বজায় রাখতে পেরেছে। শুধু বজায় রাখতে পারাই নয়, এই ধারাটিকে আরো বলিষ্ঠ করে তুলেছে। কবিগানে এ-রকম বলিষ্ঠতা সহকারে যাঁরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন তাঁদেরই একজন হরিচরণ আচার্য ও অন্যজন রমেশ শীল।

কবিগানের আরেক নাম কবির লড়াই। মুখে মুখে তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে তা-ই দিয়ে দুই কবি ‘লড়াই’য়ে অবতীর্ণ হন বলেই এর এ-রকম নাম। কবির লড়াই তো কবিতাকে একেবারে জনতার ভেতরে নিয়ে যায়, কবি আর কবিতা- রসিকের মধ্যে কোনো বিচ্ছিন্নতা এখানে থাকে না। শুধু তাৎক্ষণিক কবিতার লড়াই নয়, কবিগানের আসরে কবিরা অন্যরকম গান বা কবিতাও পরিবেশন করেন ও করতেন। সেইসব কবিতা-গানের আঙ্গিক আর ভাববস্তু বাংলার মূলধারার কবিতারই বিবর্তনজাত। সেই বিবর্তনে কবিরা বারবার প্রথাবদ্ধতাকে ভেঙেছেন, সামাজিক জড়তাকে আঘাত করেছেন। অথচ এই কবিরা নাগরিক অভিজাতদের হাতে রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি বলেই স্বীকৃতি পাননি। যাঁরা এঁদের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তাঁরাও এঁদেরকে ‘কবি’ বলেননি, বলেছেন—’কবিওয়ালা’ বা ‘কবিয়াল’। কেন এই অবজ্ঞাসূচক ‘ওয়ালা’ বা ‘আল’ প্রত্যয়ের ব্যবহার?

আসলে শিক্ষিত নাগরিক মানুষেরা সহজে তাঁদের শিক্ষাভিমান ত্যাগ করতে পারেন না, এক ধরনের উন্নাসিক ও উঁচকপালে মনোবৃত্তির বৃত্তাবদ্ধ হয়ে থাকতেই তাঁরা স্বস্তি বোধ করেন। তাঁদের পরিমণ্ডলের বাইরেকার মানুষদের কৃতিকে যখন স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন, তখনও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা তাঁরা করে যান। লোকসাধারণের প্রতিভাবান কবিকেও ‘কবি’ না-বলে ‘কবিওয়ালা’ বা ‘কবিয়াল’ বলাটাও তাঁদের সেই স্বাতন্ত্র্য-রক্ষা-প্রয়াসেরই পরিচয়বহ।

কবিয়াল কিংবা এ-রকম অন্য যা কিছু আখ্যা দিয়েই আলাদা করে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, হরিচরণ আচার্যের মতো অসাধারণ শিল্পী-মনীষীর কবিকৃতিকে কিন্তু কিছুতেই অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অনুসন্ধানে স্পষ্ট হয়ে ওঠে: বাংলার নাগরিক কবিতায় যখন রবীন্দ্রযুগ, নাগরিক পরিমণ্ডলের বাইরে লোকসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত মূলধারার কবিতায় তখন অসামান্য কৃতির স্বাক্ষর রাখছেন হরিচরণ আচার্য। এখানে একটি তথ্য খুবই কৌতূহল-উদ্দীপক যে রবীন্দ্রনাথ ও হরিচরণের জন্ম একই বছরে (১৮৬১), এবং রবীন্দ্রনাথের যে-বছর জীবনাবসান ঘটে সে- বছরেই (১৯৪১) মৃত্যুবরণ করেন হরিচরণ আচার্যও। রবীন্দ্রনাথ ও হরিচরণের জন্মবর্ষ ও মৃত্যুবর্ষ অভিন্ন হয়ে যাওয়াটা যে নিতান্তই আপতিক ব্যাপার, নিশ্চয়ই এ-বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনো হেতু নেই। একান্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন না হলে আমরা কেউই এ-ঘটনার পেছনে কোনো অলৌকিক বা অদৃশ্য শক্তির সচেতন পরিকল্পনা খুঁজতে যাবো না অবশ্যই। তবু প্রলুব্ধ হই এ-ঘটনাটিকে ইতিহাসের অমোঘ বিধানের একটি নিদর্শন বলে ভাবতে। ইতিহাস যে কেবল তথাকথিত ভদ্রজন বা মুষ্টিমেয় নাগরিক শিক্ষিতজনদের জন্যই সংস্কৃতি-সম্পদের জোগান নিয়ে আসে না, ব্রাত্যজন তথা অনক্ষর গ্রাম্যজনের জন্যও যে রয়েছে তার দাক্ষিণ্য—বাংলার সংস্কৃতি-জগতে রবীন্দ্রনাথ ও হরিচরণের আগমন-নিক্ৰমণ যেন তারই প্রমাণ বহন করে। অসাধারণ উৎকর্ষমণ্ডিত রবীন্দ্র-কবিতা তথা সাহিত্যের রসোপভোগের ক্ষমতা-বঞ্চিত লোকসাধারণ অনায়াসে তাদের স্বাভাবিক কাব্যরস- পিপাসার তৃপ্তি ঘটাতে পেরেছে হরিচরণের কবিতায় বা গানে। তাদের অনেকেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ নামক কোনো কবির নামই শোনেনি, কবিয়াল-বলে-পরিচিত হরিচরণরাই তাদের কবি। এ-বিষয়ে খুবই কৌতুকজনক ঘটনার উল্লেখ করেছেন একজন লেখক। তিনি লিখেছেন-

“রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকীর বছরের গল্প শুনছিলাম। কোন নিতান্তই অজ পাড়াগেঁয়ে শতবার্ষিকীর উদ্যোক্তাদের বিপন্ন করে এক কৌতূহলী মানুষ নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘বাপু এই যে কবি কবি বলছ, এই কবি রবি ঠাকুরটি কে? কই আমাদের গাঁয়ের দিকে তো কোনদিন গান গাইতে আসেনি।’ অবাক হওয়ার কিছু নেই এই গল্পে, কারণ এমনকি আজকের দিনেও গ্রামের মানুষের এক বিশাল অংশের কাছে কবি মানেই কবিয়াল। মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির নায়ক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবিয়াল রমেশ শীল, গোমানি দেওয়ানদের পার্থক্য খুবই মৌলিক, একেবারে শ্রেণী-অবস্থানের। গ্রামীণ সংস্কৃতির কবি তাই অশিক্ষিত বা স্বল্পশিক্ষিত কবিয়ালেরাই। বলাই বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ নন।”-পুলক চন্দ [‘গণকবিয়াল রমেশ শীল ও তাঁর গান’ কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃষ্ঠা-এক]

নাগরিক কবিতার অতিসমৃদ্ধ রবীন্দ্রযুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্রাত্যদের মধ্যে মূলধারার বাংলা কবিতায় যিনি ‘হরিচরণ-যুগে’র সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন, সেই হরিচরণ আচার্যের কবিকৃতি শুধু কবির লড়াইয়ের আসরেই স্ফুলিঙ্গের মতো ‘উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে’ যায়নি। ‘কবির ঝংকার’ নামক দুই খণ্ডের একটি বইয়ে তিনি তাঁর কবিতা তথা গানের সংকলন করে রেখে গেছেন। তাঁর শেষ বয়সের চিন্তা-চেতনার পরিচয় বিধৃত হয়েছে ‘অমিয় লহরী’ নামক সংকলন গ্রন্থটিতে। এছাড়া তৎকালীন বাংলার বিভিন্ন জেলার কবিগানের আসরের বর্ণনা আছে তাঁর গদ্যে রচিত ‘বঙ্গের কবির লড়াই’ বইয়ে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিকের একটি চমৎকার দলিল এই বইটি। হরিচরণ ছাড়াও আরো অনেক কবি নাগরিক কবিতার রবীন্দ্রযুগেও বাংলা কবিতার মূলধারাকে সঞ্জীবিত রেখেছেন, হরিচরণের বইয়ে তারই কিছুটা আঁচ পাই আমরা। হরিচরণ-যুগ তো বাংলায় স্বদেশী-চেতনার উদ্বোধনেরও যুগ।

তবে হরিচরণও স্বয়ম্ভূ নন নিশ্চয়ই। মূলধারার কবিতা ও সংগীতের যে-প্রকরণটিতে তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন, সে-প্রকরণটিতে তাঁর গুরু ছিলেন বৈকুণ্ঠনাথ চক্রবর্তী। ‘দ্বিজদাস’ ছদ্মনামে রচিত বৈকুণ্ঠনাথের অনেক সংগীত একসময় অসাধারণ লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। সে লোকপ্রিয়তার কারণ দ্বিজদাসের লোকায়ত মুক্তবুদ্ধিচর্চা, তাঁর প্রতিবাদী চেতনা, তাঁর সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী মনোভঙ্গি। দ্বিজদাস, এমনকি, ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং ধর্মশাস্ত্র মেনে চলার সার্থকতা সম্পর্কে সন্দেহকেও তাঁর সংগীতের মধ্যে চারিয়ে দিয়েছেন। ঈশ্বরকে সম্বোধন করে রচিত সংগীতেই তাঁর সেই সন্দেহের প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি—

কেউ বলে আছ তুমি কেউ বলে নাই
আমি বলি থাকলে থাকুক না থাকিলে নাই।
যারে নয়নেও দেখি নাই শ্রবণেও শুনি নাই
আছে কি না আছে মেলে না প্রমাণ।
পাগল দ্বিজদাসের গান….
হিন্দুগণের বান্ধা আছে ত্রিসন্ধ্যা কাজ
মুসলমানের বান্ধা আছে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ।
যে-জন সপ্তাহ পরেতে যায় গীর্জাতে
তাহারাই এ-জগতে মানুষ প্ৰধান।
পাগল দ্বিজদাসের গান….
বেদ পুরাণ বাইবেল আদি যত ইতি পুঁথি
মানি বলেই মোদের এতই দুর্গতি।
মানতে মানতে শাস্ত্র পাই না অন্নবস্ত্ৰ
ঘটি বাটি লাঠি বেচে কৰ্মে দিছি দান॥
পাগল দ্বিজদাসের গান….

শুধু দ্বিজদাসের গানে নয়, এ-রকম বক্তব্য প্রাকৃত বাংলার আরো অনেক কবির কবিতা-গানেই পাওয়া যাবে। এ-চেতনা তো, আমরা জানি, বাঙালির মূলধারার কবিতার একেবারে গোড়া থেকেই বিদ্যমান। সেই ধারাটিই বাংলায় ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর যুগে এক বিশেষ পরিণতি পায় হরিচরণ আচার্য ও মুকুন্দ দাসের হাতে। এরপর এদেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা সাম্যবাদী ভাবনার বিস্তার যখন ঘটতে থাকে, তখন এই মূলধারাটিতে তারও স্পর্শ লাগে। সেই স্পর্শেই রমেশ শীল ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যদের প্রয়াসে কবিগানে যুক্ত হয় অন্যতর মাত্রা, এবং পুরনো পাঁচালির আধারে বিপ্লব-ভাবনার নতুন আধেয় ভরে দেন কবি নিবারণ পণ্ডিত।

ছয়

বাংলা কবিতার এই মূলধারা তথা প্রাকৃত বাংলার কবিরূপেই বিংশ শতাব্দীতে মঞ্চাবতরণ করেন নেত্রকোনার কবি জালাল উদ্দীন খাঁ। ঊনিশ শতকের শেষ দশকে—১৮৯৪ সালে তাঁর জন্ম। আর মৃত্যু ১৯৭২ সালে। বিশ শতকের বিশ ত্রিশ চল্লিশ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে প্রাকৃত বাঙালিজনের এই কবি তাঁর সাধনায় সক্রিয় ছিলেন। যে-অঞ্চলে তিনি জন্মেছিলেন ও জীবন যাপন করেছিলেন, সে অঞ্চলটির লৌকিক ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। তখনকার অখণ্ড বাংলার বৃহত্তম জেলা ময়মনসিংহের যে-অংশটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘পূর্ব ময়মনসিংহ’ নামে, জালাল উদ্দীন খাঁ সেখানকারই মানুষ। সেখান থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র গাথাগুলো। মৈমনসিংহ গীতিকার মাধ্যমেই সে-অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সম্পদ বিশ্বের বুধজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবু, বলতেই হবে যে, মৈমনসিংহ গীতিকার গাথাগুলোর মধ্যে এখানকার ব্যাপক ও গভীর জনসংস্কৃতির অতি অল্প অংশই ধরা পড়েছে। একান্ত রক্ষণশীল তথা প্রথাগত অ্যাকাডেমিক বিচারে যে-সব সাহিত্য ও সংস্কৃতি-সম্পদ লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি রূপে বিবেচিত হয়ে থাকে, সে-সব তো আছেই, এর বাইরেও এ-অঞ্চলে আছে এমন সব সাহিত্যসম্পদ যেগুলো সৃষ্টি করেছেন সেই ধরনের প্রতিভাবান কবিবৃন্দ, যাঁদের আমি বলেছি ‘বাংলার মূলধারার কবি’। এককালের পূর্ব ময়মনসিংহের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও তার আশপাশের সুনামগঞ্জ ও সিলেটের কিছু অংশ, এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী প্রভৃতি এলাকা নিয়েই গড়ে উঠেছিল একটি বিশিষ্ট সংস্কৃতি-অঞ্চল। সে-অঞ্চলের কবিদের মধ্যে নারায়ণ দেব, দ্বিজবংশী দাস, চন্দ্রাবতী, গঙ্গারাম—এরকম কয়েকজনই মাত্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থগুলিতে ‘মধ্যযুগের কবি’ বলে স্থান পেয়েছেন। এঁদের বাইরে আছেন যে-কবিবৃন্দ, তাঁদের সবাইকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘লোককবি’ অভিধায়। এ-রকমই ‘লোককবি’ সুনামগঞ্জের হাছন রাজা ও রাধারমণ, নরসিংদীর দ্বিজদাস ও হরিচরণ আচার্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনোমোহন দত্ত, নেত্রকোনার লাল মামুদ, সুলা গাইন, বিজয় নারায়ণ আচার্য, দীন শরৎ (শরৎচন্দ্র নাথ), কিশোরগঞ্জের রামু মালী, রামগতি শীল, রামকানাই নাথ। এঁরা এবং এ-রকম আরো যে-সব কবি পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ঊনিশ শতকে বাংলা কবিতার মূলধারাকে সচল রেখেছিলেন, তাঁদেরই প্রত্যক্ষ উত্তরসাধক বিশ শতকের জালাল উদ্দীন খাঁ। এবং খুবই কৃতী, সার্থক উত্তরসাধক।

জালাল খাঁ যাঁদের উত্তরসাধক তাঁরা জন্মসূত্রে কেউ ছিলেন হিন্দু, কেউ মুসলমান। কিন্তু ওই হিন্দুত্ব বা মুসলমানত্ব ছিল তাঁদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ বাস্তবতা। সেই অমোঘ বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাঁরা হিন্দু কিংবা মুসলমান সমাজের অন্তর্গত হয়ে জীবন যাপন করেছেন, সেই সমাজের আচার-রীতিও বহুল পরিমাণে মেনে চলেছেন। কিন্তু অন্তরের গভীরে তাঁরা ছিলেন অন্যরকম। তাঁদের নিজস্ব ধর্মবোধে শাস্ত্রীয় হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইসলাম ধর্মের হুবহু অনুসৃতি ছিল না। তাঁদের ঈশ্বর-বিশ্বাসও শাস্ত্রীয় ঈশ্বর-বিশ্বাস থেকে পৃথক। ঈশ্বরকে ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তাঁরা মানবদেহের মধ্যেই উপলব্ধি করেছেন। ‘যা নাই ভাণ্ডে, তা নাই ব্রহ্মাণ্ডে’– অর্থাৎ সারা ব্রহ্মাণ্ডে যা আছে তার সবই আছে মানবদেহের ভেতরে—এটিই তাঁদের ধর্মবোধ ও জীবনবোধের ভিত্তি। এই বোধ থেকেই তাঁরা ‘সোহংবাদী’ বা ‘আনাল হকবাদী’ অর্থাৎ আমিই ঈশ্বর বা আমিই সত্য—এ রকম ভাবনার অনুসারী।

আবার সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা ‘মানুষভজন’কারীও, মানুষ গুরুকেও তাঁরা ঈশ্বররূপে মান্য করেন। তাঁদের ঈশ্বর-উপাসনার রীতি-পদ্ধতিও শাস্ত্রীয় ধর্মের রীতি-পদ্ধতি থেকে অন্যরকম না-হয়ে পারে না। এবং সে-কারণেই শাস্ত্র-ব্যবসায়ী ধর্মযাজক বা মোল্লা-পুরোহিতের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ উত্তুঙ্গ হয়ে ওঠে। শাস্ত্রের পুঁথিপত্র না-ঘেটে তাঁরা যে নিজেদের মতো করে ‘সত্যসিন্ধু জলে’ ডুব দিতে চান, তাঁরা যে শাস্ত্রীয় পুরাণের লৌকিক ভাষ্য রচনা করেন কিংবা সম্পূর্ণ পৃথক পুরাণই নির্মাণ করে নেন—এ-রকম সব কিছুই শাস্ত্রীয় ধর্মের চাঁইদের ক্রুদ্ধ করে তোলে। তবে সেই ক্রোধকে তাঁরা থোড়াই পরোয়া করেছেন। কখনো সোজাসুজি তাঁরা শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রবক্তাদের বিরোধিতায় নেমেছেন, কখনো নানা গলি খুঁজে নিয়ে বাঁকা পথে হেঁটেছেন। কখনো কখনো তাঁরা আপন আপন সাধনার কথা সর্বসমক্ষে প্রকাশ না-করে নানা আড়ালের আশ্রয় নিয়েছেন, প্রকাশ্যে সমাজের কর্তৃত্বশীল ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললেও ভেতরে ভেতরে আপন স্বাতন্ত্র্যকেই বজায় রেখেছেন। কথায় ও আচরণে তাঁরা এক ধরনের ক্ষ্যাপামি ও পাগলামিরও প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং স্বরচিত গানের ভণিতায় পাগল বলে আত্মপরিচয় দিয়েছেন। ‘পাগল’-এর প্রতিশব্দই তো ‘বাতুল’, এবং বাতুল থেকে ‘বাউল’ শব্দের উদ্ভব বলে অনেক পণ্ডিতেরই অভিমত। তাই পূর্ব ময়মনসিংহ ও তার আশপাশের অঞ্চলের পাগল পরিচয়দানকারীদের রচিত গানও হয়তো ‘বাউল’ বা ‘বাউলা’ গানরূপেই পরিচিত হয়ে উঠেছে। আসলে কিন্ত ‘বাউল’ নামের বিশিষ্ট সাধন-প্রণালীটির সঙ্গে এ-অঞ্চলে প্রচলিত বাউল বা বাউলা গানের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। তবে, তা না-থাকলেও, বাউলসহ সকল লৌকিক ধর্মেরই অন্তঃসার যে বিদ্রোহী-চেতনা, সে-চেতনা এ-গান পুরোপুরিই ধারণ করে। শুধু কথায় বা গানে নয়, এক সময় এ- রকম বিদ্রোহী-চেতনা এ-অঞ্চলে সমাজ-বিপ্লবের অগ্নিকুসুমও ফুটিয়ে তুলেছিল। টিপু পাগলা নামক একজন লৌকিক ধর্মগুরুই হয়েছিলেন সেই সমাজ-বিপ্লবের নায়ক। টিপু পাগলার পিতা (মতান্তরে তাঁর গুরু বা পীর) ছিলেন করম শাহ্। করম শাহ্ ১৭৭৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এ-অঞ্চলে ‘পাগলপন্থা’ নামে পরিচিত একটি লৌকিক ধর্মের প্রচার করেছিলেন। “সকল মানুষই এক আল্লার সৃষ্ট, কোনো মানুষই কোনো মানুষের অধীন হতে পারে না কিংবা কেউ ছোট বা কেউ বড় হতে পারে না; সকল মানুষই আল্লার বান্দা, আল্লার সৃষ্ট সম্পদে তাঁর সকল বান্দারই সমান অধিকার; তাই আল্লার সৃষ্ট জমিনের ওপর মালিকানা দাবি করে ‘জমিদার’ হওয়ার বা জমির খাজনা পাওয়ার অধিকার কারো থাকতে পারে না।”—এ-রকমই ছিল করম শাহ্- প্রচারিত পাগলপন্থার মূলমর্ম। করম শাহ্ মারা যান ১৮১৩ সালে। এরপর নেত্রকোনারই এক গ্রাম লেডিরকান্দায় টিপু পাগলা পাগলপন্থার প্রচারক ও সংগঠকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, এবং কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন কৃষক-বিদ্রোহের নায়ক। তাঁরই নেতৃত্বে বিদ্রোহী কৃষকরা সুসঙ্গ ও শেরপুরের জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেমে পড়ে, এবং এরই এক পর্যায়ে, ১৮২৫ সালে, জমিদারদের উৎখাত ও শেরপুর শহর দখল করে এক স্বাধীন কৃষকরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। এই কৃষকরাজ্যের ব্যবস্থাপনা ছিল অনেকটা আদিম সাম্যসমাজের মতো। দুবছর সে-রাজ্যটি টিকে ছিল। এরপর ইংরেজ সৈন্যদের কামান-বন্দুকের আক্রমণে এর পতন ঘটে, টিপু পাগলা বন্দি হন, এবং ইংরেজের বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। টিপুর উত্তরাধিকারীরা কৃষক-বিদ্রোহের নায়ক হতে পারেননি কেউ, কিন্তু পাগলপন্থার বিদ্রোহী ধর্মচেতনার ধারাটি তাঁরা বংশানুক্রমে ও শিষ্যানুক্রমে বহন করতে থাকেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ প্রসিদ্ধ ছিলেন আছমত আলী শাকির। ইনি ছিলেন পাগলপন্থী কৃষক-বিদ্রোহের নেতৃত্বদানকারী কোনো এক ফকিরের প্রত্যক্ষ বংশধর। পাগলপন্থী বিদ্রোহটি দমিত হয়ে যাওয়ার পর লেডিরকান্দায় টিপু পাগলের বাড়িটি লৌকিক ধর্মচেতনার ধারক-বাহকদের তীর্থকেন্দ্রে পরিণত হয়, এই তীর্থকেন্দ্রটিকে ঘিরেই জমে ওঠে নেত্রকোনা ও এর সন্নিহিত এলাকার বিশেষ ধরনের ‘বাউল গান’। গোলাম এরশাদুর রহমান তাঁর ‘নেত্রকোনার বাউলগীতি’ বইয়ে টিপু পাগলার শিষ্য-প্রশিষ্যদের পরিচয় সন্নিবেশিত করে লিখেছেন—

“টিপু পাগল ছিলেন নিঃসন্তান। কিন্তু টিপু পাগলের একান্ত ভক্ত শিষ্যকন্যার বিয়ে হয় করম শাহ্ পাগলের সঙ্গী কাইদা পাগলের সঙ্গে। কাইদা পাগলের দুই ছেলে—বরণ পাগল ও বাদল পাগল। এ বাদল পাগলের ঘরে ১৮৮৪ সালের ২৮ জুলাই জন্ম নেয় প্রখ্যাত সেকান্দর পাগল। সেকান্দর পাগল তাঁর পুত্র বুরুজ পাগলকে রেখে ১৯৪৪ সালের ১২ ডিসেম্বর নিজের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। উক্ত বুরুজ পাগল, নিজ গ্রামের গোলাম হোসেন তালুকদারের কন্যাকে বিয়ে করেন। বিখ্যাত আছমত আলী ফকির ছিলেন উক্ত তালুকদারের বড় মেয়ের জামাতা। লেডিরকান্দার পাগল বাড়ির সঙ্গে মোহনগঞ্জের ঝিমটি গ্রামের খ্যাতনামা পীর বাড়ির ফতেহ্ আলী শাহ্ সাহেবদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। তাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল বারহাট্টা থানার নোয়াগাঁওয়ের পাঠানবাড়ি, মোহনগঞ্জের সুবিখ্যাত মুসলিম পরিবারগুলোর। তা ছাড়া আছমত ফকিরের প্রিয় ভক্ত ছিলেন মুক্তাগাছার জমিদার রাজা জগৎকিশোর।”

রাজা জগৎকিশোরের পুত্র জিতেন্দ্র কিশোরের জন্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আছমত ফকিরের ‘কেরামত’ সম্পর্কীয় একটি লোকশ্রুতি উল্লেখ করার পর গোলাম এরশাদুর রহমান জানিয়েছেন,

“জিতেন্দ্র কিশোর বড় হয়ে গ্রহণ করেন আছমত ফকিরের শিষ্যত্ব। জিতেন্দ্র কিশোর ছাড়া পুরাকান্দুলিয়ার গৌরাঙ্গ সাহা, ধর্মপাশা থানার আহমদপুরের সোনা মিঞা ফকির, মোহনগঞ্জ থানার সহিলদেও গ্রামের মনফর ফকির, লেন্দু ফকির, কেন্দুয়া থানার ধাইবন্যা গ্রামের রইস উদ্দিন ফকির, নেত্রকোনা থানার বালি অনন্তপুর গ্রামের হাছেন আলী ফকির, হরমুজ তালুকদার, মিরাজ আলী এবং বালুয়াকান্দার তোতা মিঞা ফকির সহ এ-অঞ্চলের অসংখ্য সম্ভ্রান্ত পরিবার ছিল আছমত আলী ফকিরের শিষ্য ও ভক্ত।”

এখানে এই ‘সম্ভ্রান্ত পরিবার’-এর প্রসঙ্গটি উল্লেখ করার বিশেষ তাৎপর্য আছে। সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে, এ-অঞ্চলে এই সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর প্রায় সবাই ছিল মূলত বর্ধিষ্ণু কৃষক বা জোতদার। এই পরিবারগুলোর সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট। সম্ভ্রান্ত হলেও এ-সব পরিবারের সদস্যরা সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন বা স্বতন্ত্র ছিলেন না, কৃষির সূত্রেই উৎপাদন-প্রক্রিয়ার সঙ্গে এঁদের ছিল প্রত্যক্ষ সম্পর্ক, কৃষক সমাজের মূলধারার সঙ্গেই সম্পৃক্ত এঁদের জীবনদর্শন। তাই এঁদের ধর্মচিন্তায় গোঁড়ামি বা রক্ষণশীলতা ছিল না, ধর্মের লৌকিক ভাষ্য বা লৌকিক ধর্মের প্রতিই ছিল এঁদের আনুগত্য। বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ও অনেক কম বাধায় এ-অঞ্চলের লৌকিক ধর্মানুসারী পীর-ফকিররা যে তাঁদের সাধনা চালিয়ে যেতে ও নিজেদের মতবাদ প্রচার করতে পেরেছেন, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে ওই কৃষক-চেতনাদীপ্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর আনুকূল্য। এখানকার বিদ্রোহী চেতনা-সম্পন্ন কবি, গায়েন ও বয়াতিরা সব সময়েই ওই সব পরিবারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছেন। এবং এ-রকম পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েই লেডিরকান্দা ‘পাগলবাড়ি’র মতো আরো অনেক পীর-ফকিরের মাজারই রক্ষণশীল শাস্ত্রীয় ধারার বিরোধী লৌকিক ধর্মানুসারীদের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এ-সব মাজারের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো শাহ্ সুলতানের মাজার। এটির অবস্থান নেত্রকোনা শহরের ছয় মাইল দক্ষিণে মদনপুর গ্রামে। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসে ‘উরস’ উপলক্ষে এখানে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাবেশ ঘটে। এছাড়াও বছরের প্রায় সব দিনেই এখানে বসে হাল্কা- জিকির ও বাউল-মারফতি গানের আসর। এসব হাল্কা-জিকির ও সংগীত- সাধনাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না ‘বিশুদ্ধ’ শরিয়তের প্রবক্তাবৃন্দ। তা না দেখলে কি হবে? এ-অঞ্চলে লৌকিক ধর্মচর্চাকারীদের প্রতাপের সামনে তাঁদের অবস্থান যে একান্তই দুর্বল, তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। শরিয়তপন্থীরা যাঁদের ‘বেশরা ফকির’ বলে নিন্দা করেন, তাঁদের কেউ কেউ এখানে মসজিদের ইমামতিও করেছেন। বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে এ- রকমটি হতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একান্ত বিস্ময়ের সঙ্গে গোলাম এরশাদুর রহমান লিখেছেন—

“……অবাক হতে হয়, যখন দেখা যায় বিরহী উকিল মুনশি একদিকে যেমন করেছেন মসজিদে বা ঈদের জামাতে, মিলাদ মাহফিলে ইমামতি অন্যদিকে একতারা হাতে করেছেন বাউল গান। এক্ষেত্রে শরিয়তপন্থী আলেমরা ছিলেন অসহায়। উকিল মুনশি মদন থানার বরান্তর, শ্যামপুর, জালালপুর, চানগাঁও মসজিদে এবং ঈদের জামাতে ইমামতি করেছেন। এ বিচিত্র কর্মকাণ্ড অকল্পনীয় হলেও সত্য। আর এ ইমামতির জন্য তিনি মুনশি উপাধি লাভ করেন। এ- অঞ্চলে মসজিদের ইমামদের মুনশি বলে ডাকার প্রথা চালু আছে।”

তবু ‘শরিয়তপন্থী আলেম’রা যে একেবারে নিশ্চেষ্ট ও নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে ছিলেন, তা নয়। বিশেষ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর নতুন পাকিস্তানি জোশকে তাঁরা বাউল- মারফতি গান তথা লৌকিক ধর্মের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইলেন। এ-বিষয়ে গোলাম এরশাদুর রহমানের পর্যবেক্ষণ :

“…বাউল গানকে নিষিদ্ধ করার জন্য ১৯৫১ সালের ২৮ জানুয়ারি এ-অঞ্চলের শরিয়তপন্থী আলেম সমাজ নেত্রকোনা সদর থানার বালি-অনন্তপুরে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বাউলগান-বিরোধী প্রচারপত্র বিলি করে এক বিরাট ধর্মসভার আয়োজন করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে শরিয়তপন্থী আলেমদের এটাই ছিল মালজোড়া বাউলগান-বিরোধী সবচেয়ে বড় সাহসী উদ্যোগ। এ-ধর্মসভায় মৌলানা আতাহার আলী, মৌলানা মঞ্জুরুল হক এবং মৌলানা আকবর আলী রেজভী সাহেব বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আলেম সমাজের এ- উদ্যোগে বাউল সাধকগণ আদৌ ভীত হন নি। বাউল সাধকগণ লেডিরকান্দার আছমত আলী শাহ্ ফকিরের পৌরহিত্যে ঐ দিন একই সময়ে বালি-অনন্তপুর গ্রামের মিরাজ আলীর বাড়ির সামনে রশীদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, উপেন্দ্র সরকার, মিরাজ আলী সহ এ-অঞ্চলের খ্যাতনামা বাউল সাধক ও পীর-ভক্তদের উপস্থিতিতে জলসার আয়োজন করেন। ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা- -আন্দোলনের অন্যতম তীর্থস্থান, ১৯৪৫ সালের সারা ভারত কৃষক সমাবেশের অন্যতম সংগঠক ‘রেড’ বালিতে, এ-অঞ্চলের জনগণ সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদী চেতনায় সৃষ্ট পাকিস্তান আন্দোলনের চার বছরের মাথায় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়—মৌলবাদ অপরাজেয় নয়। বাউল সাধকদের গান ও পীরভক্তদের জিকিরের জোয়ারে ভেসে গেল আহূত বাউল-বিরোধী ধর্মসভা। তড়িঘড়ি ধর্মসভা শেষ করে সসম্মানে বিদায় নিতে বাধ্য হন আলেমগণ। আর সেই স্থানে সে দিন থেকে শুরু করে রাত অবধি চলে বাউলের জলসা। এ-পরাজয়ের পর আর কোনো দিন বাউল গানের বিরুদ্ধে কোন প্রকাশ্য বিদ্রোহ এ-অঞ্চলে সৃষ্টি হয় নি। তাই বাউল সাধকদের জন্য এ-অঞ্চলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সহ সার্বিক সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল খুবই উপযোগী। আর বাউল গান ছিল জনমানুষের প্রাণ।”

‘মালজোড়া’ হচ্ছে বাউল গান পরিবেশনেরই একটি বিশেষ রীতি বা প্রকরণ। একতারা বাজিয়ে আপন মনে গায়ক যে একক সংগীত পরিবেশন করেন, মালজোড়া বাউল গানের রীতি তার থেকে আলাদা। এতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গায়ক বিভিন্ন তত্ত্বকথা নিয়ে গানে গানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হন। গানের ভেতর দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতিটি দীর্ঘকাল ধরেই প্রচলিত ছিল ‘কবিগান’ বা ‘কবির লড়াই’য়ে। পরে সেটি বাউল গায়কদের মধ্যে নতুন রূপ ধারণ করে হয়ে যায় মালজোড়া গান। কবিগান ও মালজোড়া গানের প্রতিদ্বন্দ্বিতার রীতিতে কিছুটা পার্থক্য আছে। কবির লড়াইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দুই কবি আসরে ওঠেন দুটি সামাজিক বা পৌরাণিক চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে। যেমন—একজন কবি আসরে উঠে নিজের পরিচয় দিলেন ‘রাবণ’ বলে, আর প্রতিপক্ষের কবিকে সম্বোধন করলেন ‘রাম’ বলে। অর্থাৎ একজন কবি রাবণের ও অন্যজন রামের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেলেন। তারপর রাবণ রামকে নানা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলবেন, এবং রাম সে-সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন। প্রশ্ন ও উত্তর—দুই-ই হবে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত গানে গানে। মালজোড়া বাউল গানেও দুই কবি গানের মাধ্যমেই বিতর্কের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন, তবে কবিগানের কবিদের মতো তাঁরা অন্য কোনো পৌরাণিক বা সামাজিক চরিত্রের ভূমিকা গ্রহণ করেন না—সোজাসুজিই একে অন্যকে নানা প্রশ্ন করেন ও প্রশ্নের উত্তর দেন। কবিগান ও মালজোড়া গান—উভয় প্রকরণেই লোকমানসের একটি বিশেষ প্রবণতার পরিচয় ধরা পড়ে। সে-প্রবণতাটি হচ্ছে যুক্তিবাদের। আধুনিক নাগরিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষদের ধারণা: গ্রামীণ সমাজের মানুষ একান্তই বিশ্বাস- প্রবণ, তারা যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে, যুক্তিবিচারের ধার তারা ধারে না, যুক্তি দিয়ে কোনো কিছুকে বিচার করে নেওয়ার মতো শিক্ষা বা যোগ্যতাই তাদের নেই। এ-রকম ধারণা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। লোকসমাজের মানুষ কোনো কিছু বিশ্বাস করার আগে তা যুক্তির কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে চায়, লৌকিক ধর্মও তাই ‘অনুমান’-এর উপরে স্থান দেয় ‘বর্তমান’কে। লৌকিক ধর্মের অনুসারী কবিরাও যুক্তির সুতো দিয়েই তাঁদের গানের মালা গাঁথেন, এক কবি আরেক কবির যুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানান, জনসমক্ষে তাঁরা বিতর্কে অবতীর্ণ হন। জনগণও নিজেদের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করেই কবিদের যুক্তির সারবত্তা বিচার করেন, নিজেরাও যুক্তিবিচারে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। ধর্মকে এভাবে বিশ্বাসের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে যুক্তির খোলা হাওয়ায় নিয়ে আসাটা শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রবক্তারা একেবারেই পছন্দ করেন না। সর্বপ্রযত্নে তাঁরা একে প্রতিহত করতে চান। তবে, আমরা দেখেছি যে, নেত্রকোনা অঞ্চলে তাঁদের সে-প্রযত্ন সার্থক হতে পারেনি। এ-অঞ্চলের মালজোড়া গানে কবিরা ঈশ্বরের স্বরূপ সম্পর্কে নানা মতের বিচার করেছেন, এমনকি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপনেও দ্বিধা করেননি। ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া থানার বাসাটি গ্রামে এক মালজোড়া গানের আসরে জালাল উদ্দীন খাঁ ‘ধরাট’ বা প্রশ্ন রেখেছিলেন—

আল্লা বলতে কেউ নাই এ সংসারে।
মিশে গেছে আলো হাওয়ায়
বিশ্ব জুড়ে তালাশ কর কারে?

জালালের প্রতিপক্ষ বাউল ইদ্রিস এই ধরাটের উত্তর দিয়েছিলেন নেত্রকোনার

আরেক প্রখ্যাত বাউল কবি রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি গানের সাহায্য নিয়ে

জালাল তুমি ভাবের দেশে চল
আল্লাকে দেখবে যদি
চর্মচক্ষের পর্দা খোল।
গিয়া তুমি ভাবনগরে
চেয়ে থাকো রূপ নেহারে
সজল নয়নে ফটোগ্রাফ তোল—
মনরঙে প্রেমতরঙ্গে তোমার দিলের কপাট খোল।
দেখবে তোমার মাবুদ আল্লা
সামনে করে ঝলমল॥
দেখবে আল্লার রঙ ছুরত
অবিকল তুই জালালের মত
তোর সঙ্গে অবিরত
করে চলাচল।
তোমার রঙে রঙ ধরেছে
হয়েছে এক মিল
তোরে দেখলে তারে মিলে
আর কারে তুই দেখবে বল ॥

এখানে আল্লার অস্তিত্ব ও স্বরূপ-প্রকৃতি নিয়ে যে-ধরনের যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, এবং সে-রকম যুক্তি-প্রয়োগে লোকসমাজের কবিরা যে-দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করেছেন, প্রথাবদ্ধ শাস্ত্রীয় ধর্মের অনুসারীরা অবশ্যই এ-রকম যুক্তি ও দৃষ্টিভঙ্গির ঘোর বিরোধী। এঁদের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করেই লোকসমাজ ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের স্বাধীন চিন্তার উৎসারণ ঘটিয়েছে। সে-সমাজের কবি নিজের ভেতরেই যেমন ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তেমনই বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের সংকীর্ণ ঈশ্বর- ভাবনাকেও প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ-রকম প্রত্যাখ্যান তো বিদ্রোহী-চেতনারই দ্যোতক।

জালাল খাঁর রচনায় ঘটেছে এ-রকম বিদ্রোহী চেতনারই স্পষ্ট ও সার্থক অভিব্যক্তি। নেত্রকোনা অঞ্চলে তাঁরই সমগোত্রীয় কবি ছিলেন অনেক। বিশ শতকের গোড়ায় এখানে একজন অসাধারণ প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর নাম—শরৎচন্দ্র নাথ। তাঁর রচনায় তিনি ‘দীন শরৎ’ ভণিতা ব্যবহার করতেন। দীন শরতের বাড়ি ছিল কেন্দুয়া থানার সাজিউড়া গ্রামে, জালাল খাঁর বাড়ি থেকে মাইল আটেক দক্ষিণে। দীন শরতের দেহতত্ত্বের গানগুলি আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে এক সময় সমগ্র বাংলাভাষী অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘দীন শরতের বাউল গান’ ও ‘দীন শরতের এসলাম সংগীত’ নামে তাঁর দুটো সংকলনগ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছিল। দুটো গ্ৰন্থই এখন দুষ্প্রাপ্য। তবে পল্লী অঞ্চলে এখনো তাঁর গান লোকপ্রিয়তা হারায়নি। ‘দীন শরতের বাউল গান’ (প্রকাশ ১৩৪১)-এর একটি দীর্ঘ ভূমিকা লিখেছিলেন কামিনীকুমার কর রায়। তিনি দীন শরতের বৈষ্ণবভাবাপন্ন কতকগুলো গানের উল্লেখ করে মন্তব্য করেছিলেন— “এই গানগুলি যেন ঠিক চণ্ডীদাসের প্রতিধ্বনি। কোনও ভূর্জপত্রে এইগুলি পাওয়া গেলে, ‘দীন শরৎ’ চন্ডীদাসের মর্যাদা নিশ্চয় লাভ করিতেন। ইহা কিরূপে সম্ভব হইল? আমরা বলিব, এই গ্রাম্য কবিও সেই চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দ দাস, জ্ঞানদাস প্রভৃতিরই কনিষ্ঠ সহোদর, সকলেই একই রাজ্যের লোক, তাই এই রূপ সম্ভব হইয়াছে, যুগে যুগে আরও হইবে।”

জালাল খাঁও ‘একই রাজ্যের লোক’। সে-কারণেই দীন শরতের রচনা তাঁকে খুবই অনুপ্রাণিত করতো। দীন শরতের অনেক গান তিনি খাতায় লিখে রেখেছিলেন। তবে জালাল খাঁ প্রত্যক্ষ প্রেরণা পেয়েছিলেন কবি রশিদ উদ্দিন (১৮৮৯-১৯৬৪)- এর কাছ থেকে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকেই রশিদ উদ্দিন খ্যতিমান হয়ে উঠেছিলেন। ১৯২৯ সনে ‘স্বররাজ লহড়ী’ নামে তাঁর একটি গানের বইও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সে-বইটির এখন আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না, পল্লীর মানুষের কণ্ঠই কেবল তাঁর অনেকগুলো গান এখনও ধরে রেখেছে। জালালের চেয়ে রশিদ বছর পাঁচেকের বড় ছিলেন। অগ্রজ কবি রশিদের বাড়ি ছিল নেত্রকোনা শহরের পাশের গ্রাম বাহিরচাপড়ায়। এই বাহিরচাপড়ায় রশিদের বাড়িতে থেকে জালাল খাঁ কিছুদিন নেত্রকোনা দত্ত হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রেই রশিদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসে জালালের কবিপ্রতিভা বিকশিত হওয়ার পথ খুঁজে পায়। রশিদ উদ্দিন ছাড়াও ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’ অঞ্চলে জালালের সমসাময়িক অগ্রজ ও অনুজ কবিদের মধ্যে ছিলেন—উকিল মুনশি, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিছ মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জমশেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার। এঁদেরই ধারাবাহী কবিদের মধ্যে এখন, এই একুশ শতকের প্রারম্ভেও সক্রিয় আছেন খোরশেদ মিয়া, সিরাজউদ্দিন পাঠান, আবদুল হাকিম এবং মহিলা কবি আনোয়ারা বেগম।

আর জালাল-রচিত সংগীতের ধারাটিকে সজীব রাখছেন সারা দেশের অনেক গায়কই। এঁদের মধ্যে ফুলপুরের আবুল কাশেম তালুকদার ২০০৩ সালে প্রয়াত হয়েছেন। অন্ধ গায়ক সুনীল কর্মকার এ-দেশে তো বটেই, মার্কিন দেশে গিয়েও জালাল-গীতি পরিবেশন করে রসিকজনের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। জালালের শেষতমা পত্নীর গর্ভজাত পুত্র আবদুল হামিদ খান (ভাসানী)-ও পিতার সাধনার ধারাকে আপন সাধ্যমত বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন।

সাত

‘বাউল কবি’ বলে পরিচিত হলেও জালাল উদ্দীন খাঁ সংসার-বিরাগী, উদাসী কিংবা আখড়াবাসী ছিলেন না। ঘোর সংসারী ছিলেন তিনি। তবে সংসারবাসী হলেও একধরণের নির্লিপ্তি তাঁর সমগ্র সত্তায় পরিব্যাপ্ত ছিল। এদিক দিয়ে তাঁর সঙ্গে মূলধারার আরেক প্রখ্যাত কবি সুনামগঞ্জের হাছন রাজার অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হাছন রাজা জমিদার পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর জীবনচর্যায় পরম নির্লিপ্তির সঙ্গে চরম ভোগাসক্তির এক অদ্ভুত সম্মিলন ঘটেছিল। জালাল খাঁর জীবনচর্যাও ছিল অনেকটা সে-রকমই। জালাল খাঁর যদিও জমিদারি ছিল না, তবু তাঁর সংসারে সচ্ছলতা ছিল যথেষ্ট। হাছন রাজার মতোই জালাল খাঁ-ও অনেকগুলো বিবাহ করেছিলেন, দুজনের একজনও নারীসঙ্গ-বিতৃষ্ণ ছিলেন না। আবার দুজনের কাব্যভাবনা, ধর্মভাবনা ও সমাজভাবনাও ছিল প্রায় একই রকম।

ধর্মভাবনায় শুধু যে হাছন রাজা ও জালাল খাঁরই ঐক্য ছিল, তা তো নয়। আমরা দেখেছি : এ-অঞ্চলের জলহাওয়া তথা সামাজিক সংগঠনই এখানকার মানুষদের ধর্মভাবনাকে শাস্ত্রীয় ধর্মের কট্টরতার বাইরে টেনে এনেছে। কট্টর ব্রাহ্মণ-মোল্লাদের দাপট-যে একেবারে ছিল না এমন কথা বলা যাবে না। ব্রাহ্মণ-সমাজের অকরুণ বিধানে অনেক হিন্দুকেই সমাজচ্যুত হয়ে মুসলমান সমাজে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আবার সে-সমাজে আশ্রিত হয়ে মোল্লার ফতোয়ার উৎপাতও সইতে হয়েছে। তবু কোনো বিধান বা ফতোয়াই এ-অঞ্চলের লোকসাধারণকে পুরোপুরি স্মৃতিশাসিত হিন্দু বা কট্টর শরিয়তপন্থী মুসলমান করে তুলতে পারেনি। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘হিন্দু’ বা ‘মুসলমান’ সমাজের অন্তর্গত থেকেও দু-সমাজেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ঐক্যসূত্রে গেঁথে রেখেছিল যা, মনীষী অধ্যাপক বিনয় সরকারের অনুসরণে তাকে বলতে পারি ‘বাঙালি ধর্ম’। এ-অঞ্চলের ‘বাঙ্গাল’-দের সেই বাঙালি ধর্মেরই মর্মবাণী ধারণ করেছে যে হাছন রাজা, দীন শরৎ, মনোমোহন, দ্বিজদাস, রশিদ উদ্দীন প্রমুখ কবির কবিতা তথা গান, জালাল খাঁ তো ছিলেন তাঁদেরই সহযাত্রী ও সহমর্মী, ধর্মভাবনার মতো তাঁদেরই সমাজভাবনা ও কাব্যভাবনার ধারক-বাহক ছিলেন জালাল খাঁ-ও।

এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা পীর-ফকির-দরবেশ প্রভাবিত এবং খানকা ও মাজার-কেন্দ্রিক লৌকিক ইসলামের অনুসারী। হিন্দু থেকে যাঁরা মুসলমান হয়েছিলেন তাঁরাও ছিলেন এই পীর-ফকিরদেরই প্রভাবাধীন, যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমান হননি তেমন হিন্দুদেরও বৃহদংশের ওপর পীর-ফকিরদের ছিল গভীর প্রভাব। আবার ধর্মান্তরিত মুসলমানরাও বংশানুক্রমে লৌকিক হিন্দুত্বের নানা উপাদান বিশ্বাসে ও আচরণে বহন করে চলেছেন। জালাল খাঁ ছিলেন এমন ধর্মান্তরিত মুসলমানেরই বংশধর।

তাঁর অষ্টম পূর্বপুরুষ ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ, নাম শচীন্দ্র শর্মা। মদনপুরের শাহ্ সুলতানের মাজারের অদূরবর্তী মনাং গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। একবার তিনি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তাঁর পাশের গ্রাম তেতুলিয়ার এক পীরের শরণাপন্ন হন। সাধারণ্যে ‘বুড়াপীর’ নামে পরিচিত এই পীরের আসল নাম ছিল সৈয়দ খোয়াজ। শোনা যায় : এই বুড়াপীরের দেওয়া ‘পানিপড়া’ খেয়ে শচীন্দ্র শর্মা রোগমুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলমানের হাতের পানি খাওয়ার দরুন ব্রাহ্মণসমাজ তাঁকে সমাজচ্যুত করে। শচীন্দ্র শর্মা তখন মুসলমান সমাজে আশ্রয় গ্রহণ করেন—অর্থাৎ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। ধর্মান্তরিত শচীন্দ্র শর্মার নতুন নাম হয় সুলতান উদ্দিন খাঁ। মুসলমান হয়ে তিনি মনাং গ্রাম ছেড়ে তেতুলিয়াতে গিয়ে সংসার পাতেন।

সুলতান উদ্দিন খাঁর উত্তরপুরুষ সদরুদ্দিন খাঁ ছিলেন জালাল খাঁর পিতা। সদরুদ্দিন খাঁ বিয়ে করেন কেন্দুয়া থানার আসদহাটি গ্রামে। শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে তিনি আসদহাটি গ্রামেই বসবাস করতে থাকেন এবং সে-গ্রামেই জালাল খাঁর জন্ম হয় ১৮৯৪ সালের ২৫ এপ্রিল। গ্রামের পাঠশালার পাঠ সমাপ্ত করে হাইস্কুলেও ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু দশম শ্রেণীতে উঠেই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটান।

এরপরই তিনি সিংহের গাঁওয়ের হাসমত আলী তালুকদারের একমাত্র কন্যা ইয়াকুতুন্নেছার সঙ্গে পরিণয়-বন্ধনে আবদ্ধ হন। সদরুদ্দিন খাঁ যেমন পিতৃভূমি তেতুলিয়া ছেড়ে আসদহাটিতে উঠে আসেন শ্বশুরের সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে, তাঁর পুত্র জালাল খাঁ-ও তেমনি শ্বশুরের বিরাট সম্পত্তির মালিক হয়ে যান, এবং আসদহাটি ছেড়ে সিংহের গাঁওয়ের অধিবাসী হন। আমৃত্যু তিনি সিংহের গাঁওয়েই অবস্থান করেন।

জালাল-পত্নী ইয়াকুতুন্নেছা একমাত্র পুত্র খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ও কন্যা করিমুন্নেছাকে রেখে যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন জালালের বয়স মাত্র ঊনত্রিশ এ-রকম পূর্ণ যৌবনকালে পত্নী-বিয়োগে জালাল ব্যথাতুর হয়েছিলেন নিশ্চয়ই কিন্তু মৃতা পত্নীর স্মৃতি বুকে ধারণ করে আজীবন ব্রহ্মচারী হয়ে কাল কাটাবেন—জালাল খাঁ এ-রকম কল্পস্বর্গীয় আদর্শবাদী ছিলেন না, ‘বাউল কবি হয়েও ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি’ তাঁর অন্বিষ্ট ছিল না। তাই প্রথমা পত্নীর মৃত্যুর পর একের পর এক অনেক নারীর সঙ্গেই তিনি পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে থাকেন, এবং তাঁর সে-রকম পরিণয়ের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব কেউ রাখেনি। জালাল- জীবনীকার আজিজুল হক চৌধুরীর মতে সে-সংখ্যা ‘দেড় ডজন’। জালাল খাঁর পৌত্র গোলাম মোরশেদ খান লিখেছেন—

“দাদা মোট কতবার দারপরিগ্রহ করেছেন—এ সংখ্যাটা আমার জানা নেই। একেক জনের মুখে একেক রকম তথ্য শুনেছি। সংখ্যাটা ভয়াবহ রকম স্ফীত বলে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকছি।”

যাই হোক, ‘দার পরিগ্রহ’ যতবারই করে থাকুন না কেন, জালাল যে ‘অসংখ্য বন্ধন মাঝে মহানন্দময় মুক্তির স্বাদ’-এরই অভিলাষী ছিলেন—এ-কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি। আবার, সংসারের কোনো বন্ধনই যে তাঁর জীবনসাধনায় বাধার সৃষ্টি করতে বা সে-সাধনা থেকে তাঁকে নিবৃত্ত করতে পারেনি—সারাজীবন তিনি তার ও প্রমাণ রেখেছেন। অবিরাম সাধনার মধ্য দিয়েই তিনি তাঁর নিজস্ব জীবনদর্শনটি গড়ে তুলেছেন, এবং সে-সাধনার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন গুরুর শরণাপন্ন হয়েছেন। তাঁরই কিঞ্চিৎ অগ্রজ কবি রশিদ উদ্দিনের সাহচর্য যেমন তাঁর সংগীতচর্চার সহায়ক হয়েছে, তেমনই লাউয়া (একতারা) শেখার জন্য তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন গোবর্ধন সাধুর। সিংহের গাঁওয়েরই আরেক বাউল গায়ক গোমেজ আলী ফকিরের সান্নিধ্যও তাঁর সংগীতসাধনার ক্ষেত্রে খুবই ফলপ্রসূ হয়ে উঠেছে।

সারা জীবন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জালাল খাঁ যে-ভাবাদর্শকে ধারণ করেছেন, সে- ভাবাদর্শটির অনেকটাই তিনি তাঁর পরিবেশ-পরিপার্শ্ব থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো একান্ত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছেন। আবার সেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতে ও গতিসঞ্চারে সাহায্য করেছেন তাঁর অনেক গুরুজন। যেমন—সিলেটের বিথঙ্গল (বা বিথলং) আখড়ার প্রতিষ্ঠাতা রামকৃষ্ণ সাধু। এই সাধুর প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য তিনি লাভ করতে পেরেছিলেন কিনা সে-সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত করার মতো কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। তবে রামকৃষ্ণ সাধুর শিষ্যদের মাধ্যমে জালালের ওপর যে তাঁর পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল, এবং সে-প্রভাব যে হয়েছিল খুবই গভীর—সে- বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। বিথলং-এর আখড়ার রামকৃষ্ণ সাধুকে কেন্দ্র করে যে-বিশিষ্ট লৌকিক ধর্মটির উৎসারণ ঘটেছিল, তা এক সময় সিলেট ও ময়মনসিংহের লোকমানসে খুবই নাড়া দিয়েছিল। শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রতিবাদী মানুষদের অনেকেই রামকৃষ্ণ সাধুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যেমন করেছিলেন ‘দীন শরতের বাউল গান’ ও ‘দীন শরতের এসলাম সংগীত’-এর রচয়িতা দীন শরৎ বা শরৎচন্দ্র নাথ। জালাল রামকৃষ্ণ সাধুর মন্ত্রশিষ্য না-হলেও ভাবশিষ্য ছিলেন নিঃসন্দেহে।

তিনি মন্ত্রশিষ্য হয়েছিলেন চট্টগ্রামের আকুবদণ্ডি গ্রামের পীর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস সাহেবের। এই পীর সাহেবকেই তিনি তাঁর ‘বিশ্বরহস্য’ নামক গদ্যপুস্তকটি উৎসর্গ করেছিলেন। সুফিপন্থার অনুসারী এই পীরের মন্ত্রশিষ্যত্ব জালালের ভাবজগতে একটি নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল, এবং তাতে তার লৌকিক ধর্মাশ্রয়ী ভাবাদর্শটিই আরও পুষ্ট হয়ে উঠেছিল। এই ভাবাদর্শটিকে আপন সত্তায় বহন করে জালাল হয়ে উঠেছিলেন ‘একাধারে কবি, বাউল, গায়ক, সাধক, সুরকার, গীতিকার ও প্রবন্ধকার’। এবং ‘তিনি সকল ক্ষেত্রেই নিজস্ব একটি ভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্যের স্বাক্ষর’ রেখেছিলেন। তাঁর খ্যাতি শুধু গ্রামীণ লোকসমাজের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকেনি, শহুরে এলিট সমাজেরও অনেকেই তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। এঁদেরই একজন ‘ব্রতচারী আন্দোলন ‘-এর প্রতিষ্ঠাতা ও আই.সি.এস. গুরুসদয় দত্ত। তিনি যখন ময়মনসিংহের জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, তখনই জালালের গানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। জালালের ভক্ত ও গুণমুগ্ধ সুহৃদদের মধ্যে ছিলেন কালীপুরের জমিদার ও বিশিষ্ট লেখক ধরণীকান্ত লাহিড়ী এবং ছান্দসিক কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য যতীন্দ্রপ্রসাদের পুত্র কবি পূর্ণেন্দুপ্রসাদও জালালের বিশেষ অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন।

কলকাতা-প্রবাসী পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্য ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে একটি চিঠিতে জালাল উদ্দিন খাঁকে লিখেছিলেন-

“…..জয়দেব কেন্দুলি গ্রামে প্রতিবছর পৌষসংক্রান্তির সময় বাউলদের বার্ষিক মেলা হয়। এই বছর সেই সময় সেখানেই আমাদের সমিতি ‘সারা বাংলা সাহিত্য মেলা’র তৃতীয় বার্ষিক সম্মেলন হবে। ১৩ই জানুয়ারি শুক্রবার ইদল ফেতরের দিন থেকে ১৫ই জানুয়ারি রবিবার পর্যন্ত তিনদিন এই সম্মেলন হবে। সে-সময় আপনি অনুগ্রহ করে এই সম্মেলনে আসুন। পাবনা রাধানগরের কবি বন্দে আলী মিয়াকেও অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছি”।

ইচ্ছা থাকাসত্বেও জালাল খাঁ এই সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি। কারণ তাঁর পাসপোর্ট-ভিসা ছিল না। তবে, সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে তিনি একটি শুভেচ্ছা-বাণী পাঠিয়েছিলেন।

ঢাকার সাহিত্য-অঙ্গনেরও অনেকেই-যে জালালের গুণগ্রাহী ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে তিনি ভাবের আদান-প্রদান করতেন—বিভিন্ন সূত্র থেকে তেমন কথাও জানা যায়। আহমেদ ফখরুদ্দীন নামক একজন লেখক ও সাংবাদিক জানিয়েছেন,

“বাউল বিশেষজ্ঞ মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন ও বিশিষ্ট লালন-গবেষক আবু তালিবের কাছ থেকে জানা যায়, জালাল খাঁ উভয়েরই সুপরিচিত ছিলেন এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে কোন আলোচনা করতে পারেননি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সম্ভবত ১৯৩২ সালে জালাল খাঁ জনাব মনসুর উদ্দীন সাহেবের বাসায় এসেছেন বলেও তিনি স্বীকারোক্তি করেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, জালাল খাঁ ঢাকার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সুধীবৃন্দের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন।”

(সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, ঢাকা ২ জুলাই ১৯৭৬)

এ-রকম সুধীজনের মধ্যে জালাল খাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল প্রখ্যাত সুরশিল্পী আব্বাস উদ্দিনের সঙ্গে। ‘জালালগীতিকা’ পাঠ করে ১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ আব্বাস উদ্দীন সাহেব জালাল খাঁকে এক পত্রে লিখেছিলেন,

“আপনার প্রেরিত ‘জালালগীতিকা’–একবার দুইবার পড়িয়াছি। মুগ্ধ হইয়াছি, বিস্মিত হইয়াছি। কোন্ অজ্ঞাতনামা গ্রামে ফুটিয়া আপন সৌরভে আপনি মাতোয়ারা হইয়া রহিয়াছেন। আপনাকে লোকচক্ষুর অন্তরাল হইতে টানিয়া রেডিওর বুকে ছড়াইয়া দিতে চাই।”

আব্বাস উদ্দিন তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে জালালের অনেক গান ঢাকা রেডিও থেকে প্রচারিত হয়েছিল, শহুরে মানুষেরাও জালালের গানের অনুরাগী হয়ে উঠেছিলেন।

তবে শহুরে মানুষদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা থাকলেও জালাল কখনো শহরবাসী হননি, আমৃত্যু গ্রামেই তিনি নির্বাহ করে গেছেন স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রা।

নিজ হাতে তাঁকে কৃষিকাজ করতে হয়নি বটে, কিন্তু কৃষকসাধারণের সঙ্গেই ছিল তাঁর অন্তরঙ্গতা। নিজ হাতে মাছ ধরতেন, মাছ ধরার কাজে অন্যকেও উৎসাহিত করতেন। শুধু কবি বা সংগীতশিল্পীই ছিলেন না তিনি, হস্তশিল্পেও ছিল তাঁর কুশলতা। বাঁশ দিয়ে মাছ ধরার বিভিন্ন সরঞ্জাম থেকে শুরু করে হাতপাখা, কুলা, বসার মোড়া ইত্যাদি তৈরিতে তাঁর অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যের প্রকাশ ঘটতো। ফুলের বাগান করাতেও ছিল তাঁর অসীম উৎসাহ।

তাঁর বসার ঘরটি তিনি তৈরি করিয়েছিলেন বাউল সাধকদের দেহতত্ত্বের বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে। সেই-যে লালনের গানে আছে ‘আট কুঠুরি নয় দরোজা আঁটা, মধ্যে মধ্যে ঝলকা কাটা/তার ভিতরে সদর কোঠা, আয়না মহল তায়’—এই নকশার অনুসরণেই যেন জালালের গোলাকৃতি ঘরটি ছিল আট কোনাবিশিষ্ট, এর ছিল আটটি চাল আর নয়টি দরজা-জানালা।

লোকায়ত ধর্মের মর্মসন্ধানী এই মানুষটি লোক-জীবনের সব কিছুর সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। তিনি পরিপার্শ্ব-সচেতন ছিলেন অবশ্যই, দেশে সংঘটিত সামাজিক-রাজনৈতিক আলোড়ন-আন্দোলনের সব খবরও তিনি রাখতেন। তবে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তিনি কোনোদিনই নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। শোনা যায় : গান্ধীজীর আইন-অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলনের দিকে তিনি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন এ-ঝোঁক তাঁর থাকেনি। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন যখন গ্রামের সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল, পল্লীর অনেক কবিও তখন পাকিস্তানি জোশে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের কবিতা-গানে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনা একান্ত প্রকট হয়ে উঠেছিল। জালাল খাঁর অন্যতম ছাত্র, কবি আবদুল মজিদ তালুকদার তো তখন ‘পাকিস্তান সংগীত’ নামে একটা গানের বই-ই প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। অথচ, জালাল খাঁর চেতনায় পাকিস্তান আন্দোলন একটুও দাগ কাটতে পেরেছে বলে মনে হয় না। পাকিস্তানের ভাবনা যদি তাঁকে প্রাণিত করতো, তা হলে তাঁর কোনো-না- কোনো গানে এর পরিচয় ধরা পড়তো। কিন্তু তেমনটি তো হয়নি। বোঝা যায় : জালাল খাঁ একদিনের জন্যও সাম্প্রদায়িক চেতনাকে প্রশ্রয় দেননি, সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-রূপে পরিকল্পিত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্রও আগ্রহ ছিল না।

কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমুক্ত ছিলেন বলেই-যে তাঁর আপন সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো প্রীতি ছিল না, তা নয়। যে-ধর্মীয় সম্প্রদায়টিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই মুসলমান সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষের দারিদ্র্য, পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা ও কুসংস্কার তাঁকে খুবই বিচলিত করতো। এই সমাজটিকে তিনি ঘা মেরে জাগিয়ে তুলতে চাইতেন। তাঁর গরিষ্ঠসংখ্যক প্রতিবেশীই ছিল দরিদ্র মুসলমান কৃষক। এরা নানারকম অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হতো, শোষকদের হাত থেকে এদের বাঁচাবার একটা অভীপ্সা জালাল খাঁর মনে সর্বদাই জাগরূক ছিল। পাশের গ্রাম আশুজিয়ার প্রতাপান্বিত মধ্যস্বত্বভোগী ব্রাহ্মণ ভূস্বামী বা তালুকদারদের নির্যাতনের থাবা থেকে তাঁর প্রতিবেশী দরিদ্র মুসলমান প্রজাদের রক্ষা করতে জালাল খাঁ সব সময়েই সচেষ্ট থাকতেন। এর ফলে ওই ভূস্বামীদের সঙ্গে কখনো কখনো তাঁকে বিরোধেও জড়িয়ে পড়তে হতো। কিন্তু সে-বিরোধকে কখনো সাম্প্রদায়িক বিরোধে পরিণত হতে দেননি তিনি।

সিংহের গাঁও আশুজিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের (বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ) অধীন একটি গ্রাম। ব্রিটিশ জামানাতে তো বটেই, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও প্রায় সাত বছর ওই ইউনিয়ন বোর্ডটিতে আশুজিয়ার ভূস্বামীদেরই ছিল প্রাধান্য। দরিদ্র প্রতিবেশীদের কল্যাণের কথা ভেবেই হয়তো জালাল খাঁ এক সময় আশুজিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিপক্ষ ভূস্বামীদের প্রবল প্রতাপ তাঁর সে-ইচ্ছা বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। এ-জন্যে তাঁর ভেতরে অবশ্যই ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল। সে-ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছিল তাঁর পুত্র খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম আশুজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর। আবদুল হাকিমের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার সময়টিতে (পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি) জমিদার-তালুকদারি প্রথার অবসান ঘটেছে, এবং স্বভাবতই আশুজিয়া গ্রামের ভূস্বামীদের প্রতাপও প্রায় শূন্যে মিলিয়ে গেছে। তাঁদের অনেকেই দেশত্যাগ করলেও যাঁরা অনন্যোপায় হয়ে গ্রামের ভিটেমাটি কামড়ে পড়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন খুবই শঙ্কাগ্রস্ত। নিজেদের কিংবা অব্যবহিত পূর্বপুরুষদের দুষ্কৃতির দায়ে এখন তাঁদের দুর্ভোগ পোহাতে হতে পারে,—এমন দুর্ভাবনা তাঁদের অনেককেই পেয়ে বসেছিল। বিশেষ করে, যে-জালাল খাঁর প্রতি তাঁরা মোটেই সুবিচার করেননি, তাঁরই পুত্র যখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়ে বসেছেন তখন তাঁর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাবেন কিনা—সে-বিষয়ে তাঁদের মনে উদ্বেগ ও সংশয় বাসা বেঁধেছিল।

কিন্তু নতুন চেয়ারম্যান আবদুল হাকিমের চমৎকার ব্যবহার ও সদাচরণ অচিরেই তাঁদের সব উদ্বেগ ও সংশয় দূর করে দেয়। আবদুল হাকিম আমৃত্যু—প্রায় সিকি শতাব্দী কাল ধরে—আশুজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেই ইউনিয়ন পরিষদের অধীন সবগুলো গ্রামেরই হিন্দু অধিবাসীদের ভরসাস্থল হয়ে উঠেছিলেন তিনি। প্রাক্-পাকিস্তান যুগে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত ভূস্বামী কিংবা তথাকথিত উচ্চবর্ণের ‘ভদ্রলোক’ গোষ্ঠীর শোষণ-উৎপীড়নের শিকার হয়েছিল সকল সম্প্রদায়েরই নিম্নবর্গের মানুষজন। নিম্নবর্গের মানুষদের ভেতর অবশ্যি মুসলমানদেরই ছিল সংখ্যাধিক্য। এই মুসলমানদের অধিকার আদায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রে উচ্চ-নিম্ন নির্বিশেষে সকল বর্ণের হিন্দুরাই হয়ে গিয়েছিল নিজ বাসভূমে পরবাসী-প্রায়। প্রায়শই তাদের নানা ধরনের বঞ্চনা ও অবিচারের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করতে ও মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে থাকতে হতো। কোনো কোনো গ্রামীণ জনপদের হিন্দু অধিবাসীদের জন্য পরিস্থিতি একান্তই বিরূপ ও প্রতিকারহীন হয়ে পড়েছিল। অন্যতম ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তস্বরূপ ছিল খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমের নেতৃত্বাধীন আশুজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলো। এখানকার হিন্দুরা চেয়ারম্যান আবদুল হাকিমের ছত্রছায়ায় নিরাপত্তা ও নিশ্চিন্তির সন্ধান পেয়েছিল।

এর প্রধান কারণ: জালালপুত্র খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমও কবি ছিলেন। একজন সংবেদনশীল কবির দৃষ্টিতেই তিনি মানুষকে প্রত্যক্ষ করতেন, গ্রাম্য মোড়লের ধূর্ততা দিয়ে তিনি চেয়ারম্যানগিরি করেননি। তাঁর কবিতা অবশ্যি মূলধারার কবিতার অনুবর্তী ছিল না, বিশ শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকের নাগরিক কবিতার ধারাতেই তিনি কাব্যচর্চা করতেন। কিন্তু তাঁর মানস গঠিত হয়েছিল পিতার ভাবাদর্শের উপাদান দিয়েই। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েও সে-ভাবাদর্শ তিনি পরিত্যাগ করেননি, সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী লোকায়ত মানবতাবাদ আমৃত্যু তাঁর মানসসঙ্গী ছিল।

এ-রকম একজন কবিপুত্রের সহায়তাতেই কবিপিতা জালাল উদ্দীন তাঁর নিজ এলাকার সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। আশুজিয়াতে একটি হাইস্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। কিন্তু পাকিস্তানের দুষ্ট হাওয়া লেগে সেই শিক্ষায়তন প্রায়-বিলুপ্তির পথেই চলে গিয়েছিল, হিন্দু শিক্ষকদের দেশত্যাগের ফলে শিক্ষক-সংকট প্রকট হয়ে উঠেছিল, স্কুলটির ভাঙাঘর মেরামতের জন্য অর্থের জোগান পাওয়াও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ-রকম এক দুঃসময়ে সেই স্কুলটিকে নবায়িত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন কবি জালাল উদ্দীন খাঁ, এবং সে-দায়িত্ব পালনে তাঁর সক্রিয় সহযোগী করে নিয়েছিলেন পুত্র খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিমকে। আশুজিয়া হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি হয়ে জালাল খাঁ অচিরেই স্কুলটিকে মরণদশা থেকে বাঁচিয়েছিলেন, এবং এ-অঞ্চলের সাধারণ মানুষের ছেলেদের শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

এ-রকম নানাভাবেই তিনি সমাজচেতনা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়েছেন। এই সমাজবোধ ও দায়িত্ব-চেতনাই তাঁর কবিতা-গানেও নতুনতর মাত্রার সংযোগ ঘটিয়েছে। সে-মাত্রাটি প্রত্যক্ষ করা যায় ‘জালালগীতিকা’র ‘সংসারতত্ত্ব’ ও ‘দেশতত্ত্ব’-এর গানগুলোতে।

জালাল খাঁ ধর্মের আনুষ্ঠানিকতার দিকগুলোকে মোটেই গুরুত্ব দিতেন না। এগুলোকে নিয়ে তিনি বরং হাসিমস্করা করতেন। কট্টর শরিয়তপন্থীরা এর জন্য জালাল খাঁর প্রতি যে মোটেই প্রীত থাকতে পারেন না, সে তো সহজেই বোঝা যায়। তাঁরা এখানে-সেখানে জালালের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতেন, রোজা না- রাখা ও নামাজ না-পড়ার জন্য তাঁকে ‘বেদ্বীন’ বলে আখ্যায়িত করতেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে লোক ক্ষেপিয়ে তোলারও চেষ্টা করতেন। কিন্তু এ-সবই তাঁরা করতেন পরোক্ষে—অর্থাৎ জালালের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু বলার বা তাঁকে অভিযুক্ত করার সাহস তাঁদের ছিল না। জালালের ব্যক্তিত্বকে সবাই সমীহ করতেন। তাঁর বিরোধীদের বিরোধিতা পরোক্ষ হলেও তাঁর অনুরাগীদের অনুরাগ প্রকাশ পেতো একান্ত সরাসরি ও তীব্র সংরাগের সঙ্গে। তাঁর জীবৎকালেই শুধু নয়, মৃত্যুর পর তাঁর অনুরাগীদের অনুরাগে বরং যে আরো তীব্রতার সঞ্চার ঘটে তারই প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর মরদেহটিকে সমাধিস্থ করার ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে।

জালাল খাঁ মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭২ সালের ৩১ জুলাই,—বাংলা ১৩৭৯ সালের ১৬ শ্রাবণ। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরেকার ঘটনার বর্ণনা করে জালাল-জীবনীকার আজিজুল হক চৌধুরী লিখেছেন,

“জালাল উদ্দীন খাঁ-র মৃত্যুকালে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র খান মোহাম্মদ আবদুল হাকিম ছিলেন আশুজিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি যথারীতি ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী পিতাকে সমাহিত করেন বাড়ির আঙ্গিনা থেকে একটু দূরে কেন্দুয়া-নেত্রকোনা বড় রাস্তার পাশে। জালাল খাঁ-র মৃত্যুর খবর পেয়ে সিলেট-ময়মনসিংহ-সহ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে আসেন হাজার হাজার শিষ্যভক্ত-অনুরক্তগণ। ইতিমধ্যে জানাজা সম্পন্ন—তাঁদের পরম আরাধ্য গুরুকে এখানে রাখা চলবে না, এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাড়ির আঙ্গিনায় প্রয়াত গুরুর স্মৃতিধন্য বৈঠকখানার পাশে আম্রকুঞ্জে। গুরু সেখানেই শীতল-ছায়ে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকবেন।

ইসলামী শরিয়তে এ দাবি কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। চেয়ারম্যান হাকিম খান ভক্ত-শিষ্যদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। এভাবে চারদিন কাটলো, কোন সুরাহা হলো না। সময় যতই যায়, ভক্ত-পাগলদের সংখ্যাও বেড়ে যায়। নেংটিপরা জটধারীরা ক্রমেই অধৈর্য হয়ে ওঠে। পঞ্চম দিনে বিক্ষুব্ধ ভক্তগণ বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং নিজেরাই কবর’ থেকে গুরুর শবদেহ তুলে এনে গুরুর সাধনার বৈঠকখানার পাশে আমের ছায়ায় যথারীতি ভক্তি-অর্ঘ্য দিয়ে নতুন করে সমাধিস্থ করেন।”

স্পষ্টই বোঝা যায়: জালালের ভাবাদর্শের বিরোধীদের চেয়ে অনুরাগীদের সংখ্যাশক্তি ও প্রাণশক্তি দুই-ই অনেক বেশি। সেই অনুরাগীরাই জালালের জীবৎকালে যেমন, তেমনই তাঁর মৃত্যুর পরও তাঁর সাধনার ধারাকে প্রবহমান রেখেছেন, বিরোধীরা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়েছে।

আট

জালাল খাঁ-র যাপিত জীবন ও জীবনদর্শন—এই দুয়ের মধ্যে কোনো অনৈক্য বা বৈপরীত্য ছিল না। তাঁর কবিতাচর্চা তথা সংগীত-সাধনাও ছিল তাঁর যাপিত জীবন ও জীবনদর্শনের সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। আর এ-সবের সঙ্গেই জড়িত-মিশ্রিত ছিল লোকায়ত ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। সেই উত্তরাধিকারের কেবল ভারবাহী ছিলেন না তিনি, কিংবা উত্তরাধিকার-সূত্রে-প্রাপ্ত সম্পদের নির্বিচার ভোগেই জীবন কাটিয়ে দেননি। সময় ও পরিপার্শ্ব সম্পর্কে সচেতন এই মানুষটি ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারকে আপন সময় ও পরিপার্শ্বের উপযোগী করে নেওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সেই অবহিতির পরিচয়ই তাঁর রচনার পরতে পরতে ধরা আছে। জালাল তাঁর কবিতা তথা গানগুলো ‘জালালগীতিকা’ নাম দিয়ে চার খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় ‘জালালগীতিকা’র পঞ্চম খণ্ড। [‘গীতিকা’র বদলে ‘গীতি’ নাম দিলে হয়তো অ্যাকাডেমিক ধারার আলোচকরা স্বস্তি পেতেন। কারণ দীনেশ চন্দ্র সেন-সম্পাদিত ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশের পর থেকে ‘গীতিকা’ শব্দটি আর কবিতা বা গান অর্থে ব্যবহৃত হয় না, এখন এর অর্থ দাঁড়িয়েছে গাথা বা ballad। তবু ‘জালালগীতিকা’কে আমাদের জালাল-রচিত গীতি রূপেই গ্রহণ করতে হবে। মূলধারার গীতিকবিতায় গীতি (গান) আর কবিতা তো সমার্থক। এখানে গীতিই কবিতা, কবিতাই গীতি। এরই অনুস্মৃতি আমরা রবীন্দ্রনাথের গীতালি-গীতিমাল্য-গীতাঞ্জলি পর্যন্ত দেখতে পাই।] ‘জালালগীতিকা’র প্রথম খণ্ডে ২০২টি ও দ্বিতীয় খণ্ডে ২২৮টি গীতি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং দুই খণ্ডেই গীতিগুলোকে কবি ১৪টি ‘তত্ত্ব’-এ বিভক্ত করে প্রকাশ করেছিলেন। সেই তত্ত্বগুলো হচ্ছে—আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, মাতৃতত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব ও ভাটিয়ালি। শেষোক্ত ‘ভাটিয়ালি’কে অবশ্যই তত্ত্ব বলা চলে না, এটি আসলে প্রাকৃত বাংলার একটি বিশিষ্ট গীতিরূপের নাম। ‘জালালগীতিকা’র তৃতীয় খণ্ডে পূর্ববর্তী দুই খণ্ডের মতো চৌদ্দটি ‘তত্ত্ব’-এর উপস্থিতি ছিল না, ছিল মাত্ৰ সাতটি তত্ত্ব বিষয়ে ৭৮টি গীতি এবং ১৪টি ‘মুর্শিদী’ ও ১১টি ‘মারফতী’ নামাঙ্কিত গান। ‘জালালগীতিকা’র চতুর্থ খণ্ডে কোনো ‘তত্ত্ব’ নির্দেশ ছাড়াই বাউল সুর, ঝাপতাল, চৌপদী, প্রসাদ সুর, মুকুন্দ সুর, খেমটা নামে মোট ১০১টি গান সংকলিত হয়েছিল, এবং তাঁর মৃত্যুর পরে উত্তরসূরিদের হাতে যে পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয় তাতে গীতিগুলোর কোনোরূপ শ্রেণীবিন্যাস ও নামাঙ্কন করা হয়নি। এটি আসলে জালালের জীবৎকালে অপ্রকাশিত বিভিন্ন ধরনের ৭২টি গীতির সংকলন। অর্থাৎ মোট ৭০২টি গীতি নিয়েই ‘জালালগীতিকা’।

জালাল যে ১৩টি তত্ত্ব নির্মাণ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে দেহতত্ত্বই সবচেয়ে বেশি পরিচিত, এ-তত্ত্বের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা যায় প্রায় সকল লোকায়ত ধর্মেই। অন্য যে-সব তত্ত্বের কথা জালাল বলেছেন সে-সবও কোনো-না-কোনো ভাবে এই দেহতত্ত্বের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। দেহতত্ত্ব থেকেই তিনি ‘আত্মতত্ত্ব’ উপলব্ধি করতে পেরেছেন, এবং দেহতত্ত্বভিত্তিক আত্মতত্ত্বকেই পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব ইত্যাদি নানা নামে বিশেষায়িত করে তুলেছেন। জালাল গীতির যে-কোনো শ্রোতার কাছে ওই সব আলাদা আলাদা তত্ত্বনামের বিশেষ কোনো গুরুত্বই হয়তো ধরা পড়বে না। তবে ‘জালালগীতিকা’ যিনি বিশেষ মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে পাঠ করবেন, তেমন পাঠক জালালকৃত বিভিন্ন তত্ত্বের ভেতরকার সূক্ষ্ম পার্থক্য উপলব্ধি করতে পারবেন এবং সে-উপলব্ধির ফলে প্রত্যেকটি গীতির তাৎপর্য তাঁর কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিন্তু বই থেকে পাঠ না-করে যিনি কেবল গীতিগুলোর শ্রোতা হবেন, তিনি প্রায় সবগুলোকেই দেহতত্ত্ব-গীতি বলে শনাক্ত করবেন। এবং এ-রকমটি করে-যে খুব ভুল করবেন, তেমন মনে হয় না। তাই তো দেখি : বর্তমান কালের বাংলাভাষী লেখকদের মধ্যে লৌকিক ধর্ম ও লোকায়ত তত্ত্বসংগীত সম্পর্কীয় আলোচনায় সবচেয়ে বেশি দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন যিনি, সেই তীক্ষ্ণধী ও স্থিতধী চিন্তক শ্রীসুধীর চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ শীর্ষক সংকলনটিতে কবি জালাল উদ্দীন খাঁ-র যে-দশটি গানকে স্থান দিয়েছেন সেগুলোর একটিকেও কবি নিজে তাঁর ‘জালালগীতিকা’য় দেহতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত করেননি। জালাল এই দশটির চারটিকেই চিহ্নিত করেছেন ‘আত্মতত্ত্ব’ নামে, এবং অন্যগুলোকে সৃষ্টিতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব ও নিগূঢ়তত্ত্ব- এর গান রূপে। তবু, এ-রকম সব তত্ত্বই-যে উদ্ভূত হয়েছে লোকায়ত দেহতত্ত্ব থেকে—সে-কথা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না। তাই শ্রীসুধীর চক্রবর্তী ‘জালাল- গীতিকা’য় বিভিন্ন তত্ত্ব-নামে বিন্যস্ত গানগুলোকে স্ব-সম্পাদিত সংকলনে ‘দেহতত্ত্বের গান’ রূপে পরিচিত করে মোটেই বেঠিক কাজ করেননি।

আবার শ্রীসুধীর চক্রবর্তীই যখন জালালের গানগুলোকে ‘জনপদাবলি’ নামে চিহ্নিত করে অন্য একটি সংকলন গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেন, তখনও এগুলোতে নতুন তাৎপর্যের দ্যোতনা দেখা দেয়, লোকায়ত জীবনভাবনার গভীরতর তাৎপর্যের প্রকাশ ঘটে। শ্রীসুধীর চক্রবর্তী-সম্পাদিত ‘বাংলা দেহতত্ত্বের গান’ ও ‘জনপদাবলি’—এই দুটো সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৯০ ও ২০০১ সালে। প্রথম সংকলনটির অনেক-গানই তিনি দ্বিতীয় সংকলনটিতেও গ্রহণ করেছেন। বাংলার লোকায়ত চেতনার ধারক আটান্ন জন কবির একশো পঞ্চাশটি গান শ্রীচক্রবর্তীর ‘জনপদাবলি’তে সংকলিত। এর ভেতর জালালের গান তেরোটি। এই তেরোটির সাতটিই শ্রীচক্রবর্তী সম্পাদিত পূর্ববর্তী সংকলনটিতে চিহ্নিত হয়েছিল ‘দেহতত্ত্বের গান’ রূপে। দেহতত্ত্বের গান ‘জনপদাবলি’ হলো কী করে?

এর উত্তর শ্রীচক্রবর্তীর কথাতেই এভাবে দেওয়া যায় :

“‘জনপদাবলি’-র অন্তর্গত গানগুলির পরিচয় দেওয়া হয়েছে ‘ইহবাদী লোকায়ত মানবমুখী’ বলে। কথাকটির দ্যোতনা স্পষ্ট তবু আলাদা করে ‘ইহবাদী’ শব্দবন্ধের ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। গানগুলি মন দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে এর বেশির ভাগ রচনাই পারমার্থিকতা বা পারত্রিক বিষয়ে অনীহ—অর্থাৎ গীতিকাররা জীবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার আকাঙ্ক্ষা, বৈরাগ্যপন্থী হওয়া কিংবা ‘হরি পার করো আমারে’ জাতীয় মিনতি এ-বর্গের গানে দেননি—বরং পুনর্জন্ম ও পৃথিবীতে ফিরে আসার আকুতি ভরে দিয়েছেন তাঁদের উচ্চারণে। প্রকৃতপক্ষে লোকায়ত গীতিকার তথা সাধকরা মানুষের মধ্যে খোঁজেন তাঁদের উপাস্যকে এবং মানবধর্ম নামান্তরে মানুষভজনকে শ্রেয় বলে মনে করেন। সেই কারণে ধর্মসাধনার নামে অন্ধবিশ্বাস, বিগ্রহপূজা ও যুক্তিহীন লোকাচার পালনকে তাঁরা ভ্রান্ত বলে জানিয়েছেন। কবচ, তাবিজ, দৈব, মন্ত্রশক্তি, কোনো কিছুকেই তাঁরা মানেন না। শাস্ত্র মন্দির মসজিদ রোজা উপবাস তীর্থভ্রমণ আর জাতিভেদ বর্ণভেদকে তাঁরা ধিক্কার দেন। বলিষ্ঠ জীবনপ্রত্যয়, ইহলোকের প্রতি বাসনাময় দৃষ্টি, শরীরতত্ত্ব বিষয়ে সচেতনতা ও মানবপ্রেমকে এঁরা প্রাধান্য দিতে চান।”

শ্রীসুধীর চক্রবর্তী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে যে-সব গীতিকে ‘জনপদাবলি’ আখ্যা দিয়েছেন, সে-সবকেই আমি বলি বাংলার ‘মূলধারার কবিতা’ এবং সে-সবের রচয়িতাকেই ‘মূলধারার কবি’। এ-রকমই একজন মূলধারার কবি রূপে জালাল খাঁ- ও ছিলেন ইহবাদী। এই ইহবাদিতাই তাঁর প্রতিটি রচনার মর্মমূলে ক্রিয়াশীল। মূলধারার সমস্ত কবিই মূলত ইহবাদী হলেও তাঁদের ভেতর অবশ্যই প্রতিভা ও শক্তির তারতম্য ছিল ও আছে। তা ছাড়া সকল কবির ব্যক্তিত্বও নয় একই রকম। কিংবা তাঁদের সকলের ব্যক্তিত্বও একই রকম সময়, পরিবার ও অঞ্চল-পরিবেশে গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন কবির ব্যক্তিত্বের টাইপ ও পরিবেশের ভিন্নতাই তাঁদের প্রাতিস্বিকতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে, এবং প্রকাশরূপেও ভিন্নতা নিয়ে এসেছে। জালাল খাঁ-র সৃষ্টিসম্ভারেও সেই ভিন্নতা ও প্রাতিস্বিকতার প্রকাশ অবশ্যই ঘটেছে।

লোকায়ত ঐতিহ্যের অনুসারী সকল কবি ও সাধকের রচনার মতোই জালালের অধিকাংশ রচনাকেই যদিও দেহতত্ত্বের গানের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া যায়, তবু তিনি যে তাঁর রচিত গীতিগুলোকে অন্য অনেকগুলো তত্ত্বনামে চিহ্নিত করেছেন—এবং সবার প্রথমে স্থান দিয়েছেন ‘আত্মতত্ত্ব’কে—এটিও তাঁর বিশিষ্ট কবিব্যক্তিত্ব তথা প্রাতিস্বিকতারই দ্যোতক। লোকায়ত দেহতত্ত্ব-থেকে-উৎসারিত জীবনদৃষ্টি দিয়েই জালাল নিজের দিকে তাকিয়েছেন, এবং নিজেকে চিনে নিয়েছেন। নজরুলের মতোই তিনিও বলতে পারতেন যে, ‘আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ’। জালাল নিজেকে চিনে নেওয়ার ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর তাই সকল তত্ত্বের আগে উল্লেখ করেছেন আত্মতত্ত্বের কথা। আবার এই নিজেকে চিনে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি-যে কখনোই ‘ফুরিয়ে যাওয়া’ বা শেষ হয়ে যাওয়ার নয়, সে-বিষয়েও তিনি ছিলেন সদা-সচেতন। সেই সচেতনতা থেকেই তিনি রচনা করেছেন অন্য অন্য তত্ত্ব। সে-সব তত্ত্বের মধ্য দিয়ে নিজেকেই আরো ভালোভাবে, গভীরভাবে, নিগূঢ়ভাবে জেনে নিতে চেয়েছেন। আত্মতত্ত্বের মধ্য দিয়েই তিনি হয়েছেন পরমতত্ত্ব ও নিগূঢ়তত্ত্বের সন্ধানী। শুধু নিজেকে নয়; সৃষ্টিকে, সংসারকে, দেশকে এবং লোকসমাজকেও তিনি দেখতে চেয়েছেন আত্মতত্ত্বেরই দর্পণে। আত্মতত্ত্বেরই সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন সৃষ্টিতত্ত্বে, সংসারতত্ত্বে, লোকতত্ত্বে, দেশতত্ত্বে। তাঁর সাধনতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, মাতৃতত্ত্ব ও বিরহতত্ত্বও তা-ই।

বাংলার লৌকিক ধর্ম শুধু ‘ইহবাদী’ নয়, ‘সোহংবাদী’-ও। অর্থাৎ এ-ধৰ্ম আকাশে বা কাল্পনিক স্বর্গে অবস্থিত কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না; এ-ধর্ম আস্থা রাখে ‘অনুমান’-এ নয়—’বর্তমান’-এ; এ-ধর্মের অনুসারী মানুষ নিজের ভেতরেই ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করে; এ-ধর্মে ‘খোদ’ই ‘খোদা’। এই ‘খোদ’ বা ‘অহং’ বা ‘আমি’ই দৃশ্য ও অদৃশ্য রূপে সমগ্র বিশ্বে পরিব্যাপ্ত পরিব্যক্ত,–এই ‘আমি’র বাইরে অন্য কিছুরই অস্তিত্ব নেই। এই ‘আমি’কে চিনলেই ‘খোদা’কেও চেনা যায়। ‘সোহং’ বা ‘আনাল হক’ বা ‘আমিই ঈশ্বর’-এর তত্ত্বই লোকায়ত বাংলার কবি জালাল খাঁর ‘আত্মতত্ত্ব’। এই আত্মতত্ত্ব দিয়েই শুরু হয়েছে ‘জালালগীতিকা’, এ- তত্ত্বের স্পষ্ট অভিব্যক্তি ঘটেছে ‘জালালগীতিকা’র প্রথম গীতিটিতেই—

আমার আমার, কে কয় কারে ভাবতে গেল চিরকাল,
আমি আদি আমি অন্ত—আমার নামটি রুহুজ্জামাল॥
আমারি এশকের তুফান, আমার লাগি হয় পেরেশান,
আবাদ করলাম সারে জাহান, আবুল বাশার বিন্দু-জালাল॥
আমিময় অনন্ত বিশ্ব—আমি বাতিন আমি দৃশ্য,
আমি আমার গুরুশিষ্য, ইহকাল কি পরকাল॥
আমার লাগি আমি খাড়া, আমার স্বভাব হয় অধরা,
আমি জিতা, আমিই মরা—আমার নাহি তাল-বেতাল॥
আমি লায়লা আমি মজনু, আমার ভাবনায় কাষ্ঠ তনু,
আমি ইউসুফ, মুই জোলেখা, শিরি-ফরহাদ কেঁদে বেহাল॥
আমি রোমের মৌলানা, শাম্‌ছ-তাবরেজ দেওয়ানা,
‘জুমলে-আলম’ মোর শাহানা, খাজা, সুলতান, শাহ-জালাল॥
আমার বান্ধা কারাগারে আমিই বদ্ধ অন্ধকারে,
মনের কথা বলবনারে, কেঁদে কহে দীন জালাল॥

‘জালালগীতিকা’র প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে যথাক্রমে ১৪, ১১ ও ৯টি অর্থাৎ মোট ৩৪টি গানই ‘আত্মতত্ত্ব’ নামাঙ্কিত। প্রচলিত ধারণায় যে-শক্তি ‘দয়াময়’ খোদা বা ঈশ্বর বলে চিহ্নিত, তাঁকে জালাল স্পষ্ট জানিয়ে দেন—

আমি বিনে কে-বা তুমি দয়াল সাঁই
যদি আমি নাহি থাকি, তোমার জায়গা ভবে নাই।
… ….. ….
বিশ্ব-প্রাণের স্বরূপ-ছায়া, আমাতে তোমারি মায়া;
ছেড়ে দিলে এ-সব কায়া, তুমি বলতে কিছুই নাই॥
তুমি যে অনন্ত অসীম, আমাতে হয়েছ সসীম
কালী-কৃষ্ণ করিম-রহিম কত নামে ডাকছি তাই॥

‘খোদ’-এর ভেতর ‘খোদা’কে না-দেখে নানা রকম আচার-অনুষ্ঠান-জপ-তপ ও কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে দিয়ে আল্লাহ-ভগবানের অনুসন্ধান-প্রয়াস যে ব্যর্থ হতে বাধ্য—এ-বিষয়ে জালালের বিন্দুমাত্রও সন্দেহ নেই :

দরবেশ তুমি আল্লা খোঁজ ঋষি খোঁজে ভগবান
হয় না দেখছি কারও সাধ্য করতে তার অনুসন্ধান॥
ছিঁড়া কাঁথা লেংটি জটা ঊর্ধ্ব অঙ্গে দীর্ঘ ফোঁটা
মিছে এ-সব ফন্দি আঁটা সার করিয়া বন-শ্মশান॥
ভগবান নয় জানোয়ার কিসে দেখা পাবি তাহার
পাইলে পাবে স্বরূপসাকার যেরূপ আছ বৰ্তমান।

‘স্বরূপ-সাকার’ ও ‘বর্তমান’ যে মানুষ, সেই মানুষই সব রহস্যের আধার, ভজনা করতে হবে সেই মানুষকেই, সেই মানুষই গুরু বা মুরশিদ, সেই মানুষই সেজদার অধিকারী। মানুষকে সেজদা দিয়েছে ফেরেশতারাও। যে-ফেরেশতা মানুষকে সেজদা দিতে অস্বীকার করেছে সেই তো হয়ে গেছে শয়তান। তাই, জালালের সাফ কথা :

আদমকে করতে এতেকাদ, শয়তান হয়ে যাবে তফাত
থাকে যদি দিলের সাধ, সেজদা দেও মানুষের পায়।

এবং

মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে
মানুষ ভজ কোরান খোঁজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।

কোরান-কেতাবকে তো সাক্ষী মানেন শাস্ত্রীয় ধর্মবিশ্বাসীরাও। তাঁরাই বরং সে- রকম সাক্ষী বেশি করে মানেন; কারণ তাঁদের ধর্মবিশ্বাস তো একান্তভাবেই শাস্ত্রগ্রন্থ-নির্ভর, গ্রন্থের বিধানের বাইরে এক পা রাখতে গেলেই তাঁরা পাপের ভয়ে শিউরে ওঠেন। অন্যদিকে লৌকিক ধর্ম হলো ‘অপুথ্যা’–কাগজের পুঁথির পাতায় নয়, ‘দ্বেল কেতাবে’ই এ-ধর্মের সাধকদের সত্যানুসন্ধান। জালালও লৌকিক ধর্মসাধক কবি। তা হলে তিনি কোরানের ‘পাতায় পাতায়’ তাঁর যুক্তির সমর্থন খোঁজেন কেন?

আসলে জালাল কিংবা তাঁর মতো অন্য সব লোকায়ত ধর্মসাধকদের কোরান- কেতাবকে সাক্ষী মানার ব্যাপারটি মোটেই প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসীদের মতোন নয়। কোরানের বাণীর যা ‘জাহেরি’ বা প্রকাশ্য অর্থ, তাতে লোকায়ত ধর্মসাধকরা মোটেই তৃপ্তি পান না, তাঁরা খোঁজেন ‘বাতেনি’ বা অপ্রকাশ্য অর্থ। ধর্মশাস্ত্রের এই বাতেনি অর্থ সন্ধান ও নির্মাণের মধ্য দিয়েই অভিজাতদের ধর্মভাবনার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের মানুষের স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী ধর্মচেতনাটি রূপলাভ করে। এ-রকম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই লোকায়ত বাংলার ধর্মসাধনার অনুসারীরা বলেন : আল্লার সঙ্গে মহানবীর নব্বই হাজার ‘বাতচিত’ হয়েছিল, সে-সব বাতচিতের ত্রিশ হাজার মাত্র কোরানে লেখা আছে—ষাট হাজারই রয়ে গেছে বাতেন। সেই বাতেনি কথাগুলো জাহেরি টেক্সট্ থেকেই নিষ্কাশন করে নিয়ে আসতে চান লোকায়ত কবি-সাধকরা। এ-রকম করতে গিয়েই তাঁরা পুরাণের পুনর্জন্ম ঘটান, এবং এভাবে ধর্মশাস্ত্রের লৌকিক ভাষ্য নির্মাণ করে তোলেন। সে-রকম লৌকিক ভাষ্যের অন্যতম প্রবক্তা ও নির্মাতারূপেই জালাল খাঁ তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে কোরান-কেতাবকে সাক্ষী মানেন। এ-রকম ‘সাক্ষী মানা’র স্বতন্ত্র প্রকৃতি ও পদ্ধতিকে বুঝে নিতে না-পারলে জালালের গীতিগুলোর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কিছুতেই উপলব্ধ হবে না।

বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ইতিহাসে যাকে ‘মধ্যযুগ’ বলা হয়, সেই মধ্যযুগের কবি- সাহিত্যিকেরাই ধর্মশাস্ত্রের লৌকিক ভাষ্য নির্মাণের সূচনা করে গেছেন। তাঁদের সে-ভাষ্য হয়ে উঠেছে একান্তভাবেই ‘দেশী’ তথা ‘বাঙালি’ তথা ‘ভারতবর্ষীয়’। যেমন—সে-যুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ধর্মভাষ্য। সে-ভাষ্যে ইসলামি সৃষ্টিতত্ত্ব মিলে-মিশে গেছে প্রাচীন ভারতীয় তথা হিন্দু দার্শনিক ও পৌরাণিক চিন্তার সঙ্গে—

রজঃগুণ ধরি প্রভু সংসার সৃজএ
সত্ত্বগুণ ধরি প্রভু সংসার পাল এ
তমগুণ ধরি প্রভু করএ সংহার
এই তিনগুণে তার মহিমা অপার।

এই ‘তার’ মানে ‘স্রষ্টার’। সৈয়দ সুলতানের মতো প্রাক্-আধুনিক কালের বাঙালি কবিরা এই স্রষ্টাকেই বলেন ‘নিরঞ্জন’। এই নিরঞ্জন শুধু স্রষ্টা নন, সৃষ্টিও। অর্থাৎ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিরঞ্জন নিজেকেই অভিব্যক্ত করেন—স্রষ্টা নিজেই সৃষ্টিতে পরিণত হন। তাই স্রষ্টা ও সৃষ্টি এক ও অভিন্ন। এই সৃষ্টির সর্বোত্তম অভিব্যক্তি ঘটে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ মানুষের মধ্যে। লালন ফকিরের ভাষায়—’অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/দেখি মানবের উত্তম কিছু নাই’। শুধু তাই নয়, ‘দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে মানবে’। দেব-দেবতাগণ স্রষ্টা ঈশ্বরেরই অংশ, এবং স্ৰষ্টা নিজেই মানবরূপে জন্মগ্রহণ করেন—কঠোর একশ্বরবাদী ইসলামে এমন চিন্তার অনুমোদন নেই। স্রষ্টার সঙ্গে মানুষ বা অন্য যে-কোনো কিছুকে অংশীদার করা ইসলামে সবচেয়ে বড় পাপ–কবিরা গুনাহ্। তবু এই ইসলামের আওতাতেই যে সর্বেশ্বরবাদী ও ‘আনাল হক’বাদী চিন্তাচেতনারও বিস্তার ঘটেছে, উদ্ভব ঘটেছে সুফিবাদের মতো তত্ত্বপ্রস্থান ও মরমিয়া সাধনপন্থারও, এবং এই সুফিবাদই-যে পারস্যের সীমানা উল্লঙ্ঘন করে নানা দেশ পেরিয়ে বাংলায় এসে বাঙালির লোকায়ত ইসলাম-চেতনাকে নানাভাবে ছুঁয়ে গেছে—সে-কথাও তো অস্বীকার করতে পারি না। এ-রকম সর্বেশ্বরবাদী ভাবনার অনুসরণেই সৈয়দ সুলতান লেখেন তাঁর “নবীবংশ’। সেই ‘নবীবংশে’ই স্রষ্টা ও সৃষ্টিকে তিনি দেখেন একীভূত রূপে—

যেহেন আছয়ে ননী গোরস সহিত
সেমত আছয়ে প্রভু জগত ব্যাপিত।

সৈয়দ সুলতান এখানেই থেমে থাকেননি। মহানবীর স্বরূপ সম্পর্কেও তাঁর অভিমত—

মুহম্মদ রূপ ধরি নিজ অবতার
নিজ অংশ প্রচারিল হইতে প্রচার।

ইসলামি দৃষ্টিতে এ-রকম অভিমত অবশ্যই শির্কের পরিচায়ক। অথচ বাংলার লোকায়ত ধর্ম ইসলামকে তাঁর নিজের মতো করে পরিগ্রহণ করতে গিয়ে শির্ক সম্পর্কীয় ধারণাকেই বদলে দিয়েছে; সাধারণ মানুষ থেকে মহানবী পর্যন্ত সকলকে বিশ্বের সৃষ্টি ও পরিচালনার মূল শক্তির সঙ্গে একীভূত করে ফেলেছে; আদম ও আহাদকে একই মূল সত্তার অন্তর্গত বলে বুঝে নিয়েছে; মহানবীর আহমদ ও মুহম্মদ নাম দুটির অভিনব অর্থ ও তাৎপর্য উদ্ঘাটন করেছে। মুহম্মদ ও আহমদ শব্দের আরবি বর্ণমালা নিয়ে বাংলায় লোকনিরুক্তির উদ্ভব ঘটেছে, এবং সে-রকম লোকনিরুক্তি (folk etymology)-র প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করেছেন গ্রামবাংলার বাউল-ফকির-গীতিকার থেকে শুরু করে নগর-বাংলার সাহিত্যাঙ্গনে প্রবিষ্ট ‘বিদ্রোহী কবি’ কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত অজস্র কবিকুল। আলেফ, হে, মিম, দাল—এই চারটি আরবি বর্ণ-দিয়ে-তৈরি ‘আহমদ’ শব্দটি থেকে ‘মিম’ বাদ দিলে (‘মিমের পর্দা’ তুলে নিলে) হয় ‘আহাদ’, অর্থাৎ একমেবাদ্বিতীয়ম্ স্রষ্টা বা আল্লাহ্। লোকনিরুক্তির অনুসরণেই লোকায়ত ধারার কবি ও সাধকরা আহমদ ও আহাদকে অভিন্নরূপে অবলোকন করতে চান। জালালও আহাদ, আদম, আহমদ ও মুহম্মদ—এই চারটি শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য নিষ্কাশন করে আনেন এ-ধারাতেই—

বুঝে দেখ ভাবের ঘরে, খেলছে খেলা চার রং ধরে
আলেফ-হে-মিম-দাল অক্ষরে যুগে যুগে হয় মিলন॥
মোহাম্মদে আলেফ নাই, স্বরূপে মিলিলেন সাঁই
এক মিমে ঘেরিল তাই, আহাম্মদের গুলবদন॥
আউয়ালে আহাদ ইছিম, আহম্মদে পাইল জিছিম
কালেব লইয়া মিম আলাপেতেই হয় গোপন॥
আদমের “হে” উঠাইয়া নিল, হাওয়াতে মিশায়ে দিল
ধরা মানুষ অধর হইল, জালালে কয় পাই না এখন॥

এ-কথাগুলোকে জালাল ‘পরমতত্ত্ব’ বলে বিবেচনা করেছেন। আত্মতত্ত্ব অনুধাবন করেই তাঁর এই পরমতত্ত্বে উত্তরণ। কোরান-কেতাবকে তিনি পরিত্যাগ করেননি অবশ্যই; তবে কোরান-কেতাবের যে ‘পরমতত্ত্ব’ ও নিগূঢ়তত্ত্ব’ তিনি উদ্‌ঘাটন করেন, তার সঙ্গে প্রথাগত মৌলবি-মৌলানাদের তত্ত্ব-ব্যাখ্যার পার্থক্য একেবারে আকাশ-পাতালের। জালাল তো কেতাব পাঠ করে অনায়াসে কেতাবের ঊর্ধ্বে উঠে যান। মানুষ গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে ও ‘গুরুতত্ত্ব’ জেনে নিয়ে অনায়াসে তিনি বলতে পারেন—

কোরান পড় তৌহিদ কর চরণ ধর মুর্শিদের
মিছামিছি মূল্য দিনে, বাক্সভরা কেতাবের॥
কেতাব তোমার কালির লেখা, চক্ষু বিনে যায় না দেখা
অন্ধ হয়ে রইলে একা, মানুষ থুইয়া পিরিতের।

এবং

আসল কোরান দেহ তোমার এর মধ্যে রয় তখত খোদার
কালির লেখা আরবি আল্লার মর্তবা রয় ইয়াসিনে,
জালালে কয় দেহের বিচার করতে বাকি রইল তোমার
খুদি খোদার একই আকার নিগূঢ় তত্ত্ব-সন্ধানে॥

জালাল আত্মতত্ত্ব জেনেছেন, পরমতত্ত্ব ও নিগূঢ়তত্ত্ব তাঁর নখদর্পণে। কিন্তু তিনি এ- ও জানেন যে একলাফে পরমতত্ত্ব ও নিগূঢ়তত্ত্বে পৌঁছানো যায় না; এর জন্য অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়, সাধারণ মানুষকে প্রচলিত ধর্মসাধনার খুঁটি ধরে আস্তে আস্তে পা ফেলতে হয়। ‘শরিয়ত’ বা নামাজ-রোজা প্রভৃতির অনুষ্ঠানিকতা হলো সাধনার প্রথম ধাপ, এরপর ‘তরিকত’ ও ‘হকিকত’ এবং সবশেষে ‘মারেফাত’। আরবি ‘শারউন’ (শুরু বা আরম্ভ) থেকে শরিয়ত’ কথাটির সৃষ্টি। অর্থাৎ শরিয়ত দিয়েই ধর্মসাধনা তথা জীবনসাধনার শুরু। কিন্তু লোকায়ত জালাল খাঁ-দের কথা : এই শুরুর মধ্যে আটকে না-থেকে লক্ষ্য রাখতে হবে ‘মারেফাতে’র দিকে। আরবি ‘আরাফা’ (চেনা বা পরিচিত) শব্দজাত ‘মারেফাত’ মানে ‘অচেনাকে ভালো করে চিনে নেওয়া’। এই ভালো করে চিনে নেওয়াই ‘অধ্যাত্মজ্ঞান’ বা ‘প্রকৃতজ্ঞান’। এই প্রকৃতজ্ঞানই ‘জালালগীতিকা’র ‘নিগূঢ়তত্ত্ব’। এই নিগূঢ়তত্ত্বে পৌঁছানোর জন্যই জালালের কথা—

মারিফত বিচার কর, বসিয়ে শরিয়তের কোলে,
ষাইট হাজার গোপনের কথা নিষেধ করেছেন রছুলে॥
শরিয়তে নামাজ-রোজা, এবাদতের রাস্তা সোজা
মারফতে আলী-মর্তুজা, মধু খেয়ে গেছেন ফুলে॥
শরিয়তে নাও সাজাইয়া, তরিকতে মাল ভরিয়া
হক সাহেবের হাটে গিয়া, দেও মারফতের পাল্লায় তুলে॥

‘হক সাহেবের হাট’ মানে হকিকত। শরিয়তে নাও সাজালেই শুধু চলবে না, তাতে ভরতে হবে তরিকতের মাল, সেই মাল নিয়ে যেতে হবে হকিকতের বা সত্যসন্ধান ও সত্যাচরণের হাটে, সেই মাল ওজন করা হবে মারেফাত বা নিগূঢ়তত্ত্বের পাল্লায়। হাটবাজারে পণ্যবিক্রির উপমা-দিয়ে-তৈরি চিত্রকল্পে জালাল এখানে লোকায়ত ধর্মভাবনার স্বরূপকে একেবারে জীবন্ত করে তুলেছেন। তারই আগে তিনি পাঠক- শ্রোতাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ‘ষাইট হাজার গোপনের কথা’। সেই ‘গোপনের কথা’র সন্ধান না-করে ‘লেখা কথা’কেই চূড়ান্ত বলে ধরে নিলে ‘মূলে’র কিছুই জানা যাবে না—

কানে কানের কথা শুনে, সন্দেহ লেগেছে প্রাণে
লেখা কথায় পাই কেমনে, কোন কথা রয়েছে মূলে॥
লেখা ছেড়ে দেখা বিচার, করলেই বুঝবে সারাসার
জালাল না পেয়ে কিনার, পড়িতেছে বিষম গোলে॥

সারা পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ঈশ্বরের বাণী বলে বিভিন্ন গ্রন্থের ‘লেখা কথা’কে বিশ্বাস করে এসেছে, আবার এক গ্রন্থের অনুসারীরা অন্য গ্রন্থের অনুসারীদের সঙ্গে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়েছে, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের গ্রন্থকে ঈশ্বরের বাণী বলে মানতে অস্বীকার করেছে। গ্রন্থ নিয়ে এ-রকম ভেদ-বিবাদ জালালের বিচারে একেবারেই অর্থহীন। একজন আধুনিক মুক্তবুদ্ধি মানুষের মতোই সকল গ্রন্থ সম্পর্কে তাঁর নির্দ্বিধ প্রত্যয়-

এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ভরে ভাষা সৃষ্টি মানুষেই করে
তাই দিয়েই লেখে পড়ে নানা রঙ্গের বই ছাপায়,
তৌরিত জবুর ইঞ্জিল কোরান আমরা বলি আল্লার দান
ইসলামে মানতেছে ফুরকান আরবি ছাপা হইল মক্কায়॥
পৃথিবীতে এই মত আছে আরও শত শত
নাম করে আর বলব কত এর খবর কে রাখতে যায়,
সবেই যার তার মতে মতে চলতে গিয়া সত্যের পথে
থাকবার ইচ্ছা শৃঙ্খলাতে আছে সবের অন্তরায়॥
আল্লার বাক্য আর কিছু না সবেই মনের কল্পনা
যার ভেতরে যে ধারণা ভাসে খুদির প্রেরণায়,
খাঁটি হইলে সবই খাঁটি তা না হলে ছালি মাটি
অনর্থক এই লাঠালাঠি দল সাজাইয়া দুনিয়ায়॥
জালালে তাই ভাবছে এবার ধর্ম বলতে নাই কিছু আর
শুদ্ধ হলে মনের ভাণ্ডার ভয় বিপদ সব দূরে যায়।

জালালের ‘মনের ভাণ্ডার’ শুদ্ধ বলেই অনায়াসে বলে ফেলতে পারেন-

ধর্ম হতে এই জগতে দলাদলিই কেবল সার
… … … … …
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডময় একের মন্দ অন্যে কয়
করে কত হিংসা উদয় ঘৃণার চক্ষে চায় আবার,
কাগজের এই বস্তা ফেলে মহাসত্যের দেশে গেলে
ভেসে যাবে সব সলিলে ধর্ম বলতে নাই কিছু আর॥

‘কাগজের এই বস্তা ফেলে’—অর্থাৎ শুষ্ক গ্রন্থ-নির্ভরতা পরিত্যাগ করে— ‘মহাসত্যের দেশে’ অভিসার করতে পেরেছেন বলেই জালাল খাঁ অতি সহজে ধর্মতন্ত্রী সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ করতে পারেন, ‘জাত বিচার’কে অস্বীকার করতে পারেন, সাহসের সঙ্গে বলতে পারেন : মানুষই ‘জাতে জাতে যার যার মতে, গেছে ধর্ম বিভাগ করে’। এবং ‘হিন্দু কিংবা মুসলমান, শাক্ত বৌদ্ধ/খ্রিশ্চিয়ান/বিধির কাছে সবাই সমান পাপ পুণ্যের বিচারে’।

পাপ-পুণ্য সম্পর্কেও লোকায়ত বাংলার এই সাধক কবির চিন্তাভাবনা রীতিমতো র‍্যাডিক্যাল। প্রথাগত গ্রন্থানুসারী ধর্মতন্ত্রীদের মুখের ওপর যে-সব প্রশ্ন তিনি ছুঁড়ে মারেন, সে-সবের জবাব দেওয়া তাদের সাধ্যের বাইরে। পাপ-পুণ্যের স্রষ্টা কে? সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের শক্তি ও ইচ্ছার বাইরে যদি কোনো কিছুরই সৃষ্টি না-হতে পারে তো ঈশ্বরই কি স্বাধিকার-প্রমত্ত হয়ে কাউকে দিয়ে পাপকর্ম করিয়ে নেন, কাউকে দিয়ে করান এর বিপরীতটি?

আল্লার যত ছলচাতুরি বুঝতে গেলে হাসি পায়
মিছামিছি মানুষের ঘাড়ে কেন এ-সব দোষ চাপায়॥
বাজিকরের খেইল পাতিয়া থাকতে আছে শুদ্ধ হইয়া
সারা জীবন তালাশিয়া কেউ নাহি আর তারে পায়,
হারামি আর চুরি যত করতেছে তার ইচ্ছামত
খুন ফসাদি শতে শত হইতেছে তার ইশারায়॥

তা ছাড়া ঈশ্বর যদি দয়াময় হন তো পাপীই সেই দয়া পাবার প্রকৃত অধিকারী, যে পুণ্যবান তার তো ঈশ্বরের দয়ার কোনো প্রয়োজনই নেই। তাই ঈশ্বরের উদ্দেশে জালালের বক্তব্য—

পাপীর আছে তোমার কাছে দয়া পাইতে অধিকার
পাপ করে নাই জন্মে যে-জন ভাগী নয় সে করুণার॥
পাপ না হলে মাফ করবে কি তখতে তোমার বসিয়া
মাফ না দিলে রহমানি নাম যাইবে সব মুছিয়া;
পুণ্য করে কাজ কি আছে তোর কাছে হাত পাতিবার॥

এবং

যত কিছু পাপ করিয়া কলঙ্কিত হয় মানুষ
তোমারই ইশারা দেওয়া তোমাতে রয় সকল দোষ
গেলে তারি সার মীমাংসায় তোমার ঘাড়েই দোষ চাপায়
রাগ করো না আমার কথায় ক্ষমা চাও আজ মানুষের কাছে॥
মানুষেরে হীনচেতা দিন দিন করে নিছ সারা
চুরি-জারি হারামখোরি কই থেকে আজ আনলো তারা?
তুমি যখন সঙ্গে থাক খবর কেন নাহি রাখ
সর্বদা সব চক্ষে দেখ সামনে সবাই পড়িতেছে॥

জালাল ধর্মাধর্ম ও পাপপুণ্য সম্পর্কে এ-রকম আরো যে-সব যুক্তির অবতারণা করেন, সে-সব যুক্তির মূল তো লোকায়ত ঐতিহ্যের অনেক গভীরে প্রোথিত। প্রাচীন লোকায়ত ঐতিহ্যকে মর্মে ধারণ করেই এই উপমহাদেশে আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ তখনকার কায়েমি স্বার্থের ধারক ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে উড্ডীন করেছিলেন বিদ্রোহী মানবধর্মের পতাকা। গৌতম বুদ্ধেরও পূর্বে উদ্ভব ঘটেছিল যে আদিম বস্তুবাদ-সম্মত যোগ ও তন্ত্রের, তারই ধারাবাহিকতায় হাজার বছরেরও আগেকার বাঙালি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও দোহাকোষ-রচয়িতারাও তীক্ষ্ণ যুক্তিবাণে কায়েমি স্বার্থবাহী অভিজাত ধর্মধ্বজীদের বিদ্ধ করে অনেক চোখা চোখা কথাই বলে গেছেন। সন্দেহ নেই : বুদ্ধের শিক্ষাই তাঁদের এ-রকম তীক্ষ্ণ যুক্তিপ্রয়োগ ও চোখা কথা বলার সাহস জুগিয়েছে। এ-যুগের জালালও মনে করেন—

সাম্যবাদের গম্যপথে বুদ্ধই শুদ্ধ এ জগতে
আর সকলেই মতে মতে করছে কিছু অনাচার,
সত্যনিষ্ঠা রাখতে গিয়া মারপিটের আশ্রয় নিয়া
ধর্ম গেল প্রচারিয়া বাতির নিচে রয় অন্ধকার॥

“বাতির নিচে’র অন্ধকারকে দূর করার জন্যই জালাল লোকায়ত ঐতিহ্যের আলোর মশালটি হাতে তুলে নেন। ‘খুদি খোদার একই আকার’ কিংবা ‘আদমের কালেবের মাঝে এলাহির বারামখানা’–এই ‘নিগূঢ়তত্ত্ব’ ভুলিয়ে দিয়ে লোকসমাজের সামনে অতিবর্তী ঈশ্বরের এক স্বৈরাচারী রূপ এবং শেষ বিচারের দিনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে যারা, সেই সব ধর্মধ্বজীদের বিদ্রূপে জর্জরিত করে জালাল বলেন—

মোল্লার মুখে একি শোনা যায়—
আল্লা একটা মস্ত মানুষ কিতাব পড়লে বোঝা যায়॥
দামি কাপড়ে পোশাক পরা সাথে লম্বা তসবি ছড়া
কোরান শরীফ হাতে ধরা দেইখ্যা দেইখ্যা কইয়া যায়॥
আরশেতে শুইয়া আছে লাঠি একটা রহে কাছে
সত্তর হাজার খাড়া আছে কাজ করিতে ফেরেশ্তায়॥
দুনিয়া কেয়ামত হয়ে গেলে যত আছে মাটির তলে
ডাক দিয়া উঠাবে বলে মোল্লার মুখে শোনা যায়॥
তারপরে বায়তুল্লায় নিয়া পাল্লার উপর উঠাইয়া।
নেকি বদি ওজন দিয়া ডাইনে বামে ফেলবে তায়॥
ডাইনে বেহেস্ত, বাঁয়ে দোজখ, মাঝখান দিয়া পাকা সড়ক
কোটি বছর জ্বলতে থাকবে এই ভাবেতে সেই জায়গায়॥
তখন আল্লায় করবে কী, বসে বসে আর একাকী
আরশ থুইয়া চলে যাবে জালাল বলে আর কোথায়?

আপাতশ্রুতিতে অনেকেই মনে করতে পারেন যে জালাল এখানে আল্লাকে নিয়েই ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করছেন, পবিত্র কিতাবের অনুশাসনের প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করছেন, শেষ বিচারের কথা নিয়ে হাসি-মস্করা করছেন। প্রকৃত ব্যাপার কিন্তু মোটেই সে- রকম নয়। এক শ্রেণীর ‘মোল্লা’ আল্লার স্বরূপকে যেভাবে জনগণের কাছে উপস্থাপন করেন, পবিত্র কিতাবের যে-রকম ব্যাখ্যা দেন, শেষ বিচারের দিনের যে-ভয়ংকর চিত্র তুলে ধরেন—জালাল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন সে-সবকেই। অন্যদিকে আশরাফুল মখলুকাত-রূপে-সৃষ্ট মানুষের যে পাপভয়ে সর্বদা জবুথবু হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই, সেই অভয়বাণীই শোনান তিনি—

কী ছুরত বানাইলে খোদা রূপ মিশায়ে আপনার
এই ছুরত দোজখে যাবে, যে বলে সে গোনাগার।

‘খোদার ঘর হয় মক্কা শরীফ এই কথা পাগলে বলে’—নিজের ‘বিচারবোধ জাগ্রত’ হয়েছে বলেই জালাল এ-কথা নিজে জানতে পেরেছেন এবং অন্যকেও জানিয়ে দেবার তাগিদ অনুভব করেছেন। ‘প্রতি ঘটেই খোদা আছে এ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডময়’–এ- বিষয়ে তাঁর প্রত্যয় অত্যন্ত দৃঢ়, তাই নিজের প্রতি তিনি আহ্বান জানান—

খুদ ভাণ্ডারেই খোদা গোপন খুদিকে কর সাধনা
সময় তোমার সঙ্গের সাথী তারে কেন বাঁধনা॥

এই ‘খুদির সাধনা’ই প্রকৃত ধর্মসাধনা ও জীবনসাধনা। এ-সাধনার জন্য মোল্লাপুরুতের কথা শোনার কিংবা গ্রন্থনির্ভর হয়ে-থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। (জালালের নিজের ভাষায়—’মিছামিছি মূল্য দিনে বাক্সভরা কেতাবের।) আসল বিষয় হচ্ছে—

ন্যায়ে থাক সত্য রাখ, ধর্মরক্ষা তারেই কয়
বিশ্ববোধের ধর্মে দেওয়া মানবত্বের পরিচয়।
মিথ্যাটাকে দেও বিসর্জন সত্য সেবায় রাখ জীবন
হিংসা হতে আপনি আপন থাকবে সরে সব সময়।
কুচিন্তা না আসলে মনে পাপ হবে তার কী কারণে
যেতে হয় না জঙ্গল বনে আপন ভাবে যদি রয়।
দেখছি সব খোঁজ করিয়া আসল ধর্মে বিদায় দিয়া
গেছে মানুষ দল পাকাইয়া দিল হিংসার পরিচয়।
গাছের আগায় জল যে ঢালে গোড়া কাটার থাকেই তালে
বুদ্ধিহারা হলেম হালে ছাড়ল জালাল পাছের ভয়॥

জালাল এখানে মহাসত্যের একেবারে চূড়াটিকে স্পর্শ করে ফেলেছেন, লোকায়ত ধর্ম যে আসলে ‘বিশ্ববোধের ধর্ম’ ছাড়া আর কিছু নয়—সে-বিষয়টিই এখানে স্পষ্ট করে তুলেছেন। অহিংসা, সত্য, অস্তেয় (চুরি না-করা) এবং কুচিন্তা ও কুকর্ম পরিহার—এ-সবই-যে আসলে ধর্মের সার, সেই সারসত্য বুঝে নিলে আনুষ্ঠানিক ও সাম্প্রদায়িক ধর্মাচারের-যে আর কোনো প্রয়োজনই থাকে না, জালাল সেই চিরপুরাতন ও চিরনতুন কথাটিরই লৌকিক গীতিরূপ দান করেছেন।

কিন্তু ধর্মের ভেকধারীরাই যুগ যুগ ধরে চিরায়ত মানবধর্ম-প্রতিষ্ঠার পথে প্রতিবন্ধকতার পাহাড় খাড়া করে রেখেছে। সেই পাহাড় সরানোর দায়িত্বই বহন করতে হয়েছে লোকায়ত ধর্মের সাধকদের, বাংলার মূলধারার কবিদের। বিশ শতকের বাংলায় অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গেই সে-দায়িত্ব বহন করেছেন নেত্রকোনার কবি জালাল উদ্দীন খাঁ। তিনি যখন প্রৌঢ়ত্বে উপনীত, তখনই ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ধর্মের নামে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা। যদিও পাকিস্তান-আন্দোলনে যোগদান কিংবা এ-আন্দোলনের বিরোধিতা—কোনোটাই তিনি করেননি, তবু পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ-রাষ্ট্রটির আসল চরিত্র তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ-সময়েই ‘দেহতত্ত্বে’র গান রচনা করতে গিয়ে ধর্মের-নামে-প্রতিষ্ঠিত চূড়ান্ত অধার্মিক রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’-এর রূপক ব্যবহার করে এ-রাষ্ট্রটির প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণার প্রকাশ ঘটান—

শিরে তারা ভালে শশী উড়ছে রে বিজয় নিশান
স্বাধীন আমি নই পরাধীন দেহ আমার পাকিস্তান॥
পাক মাটিতে রোদ বাদলে কত রঙের ফসল ফলে
হাহাকারের কোলাহলে উধাও তবু সবার প্রাণ॥
রাজধানীতে সহস্র চোর উজান রাজ্যে লাট বাহাদুর
শাসনতন্ত্র কয়টার উপর দেওয়াতে আজ দেশ হয়রান॥
মন্ত্রী আমলা দালাল সিপাই রক্ত চুষে খাইল তাই
অন্ত্রেতে পাটোয়ারি ঠাঁই হজমিতে হয় বলীয়ান॥
যে যথা রয় যেমনি পদে, রাতদিন শুধু পোটলা বাঁধে,
নাগরিক তাই বসে কাঁদে কোন্ দিন হয় রে বন শ্মশান॥
ঠিক নাই যেথা কর্তা কর্ম রয় না হেথা ধর্মাধর্ম
ভোগী জানে ভোগের মর্ম স্বার্থ নিয়ে পেরেশান॥
পাক দেশে নাই ত্যাগ সাধনা ভুল পড়েছে দূরের ভাবনা
জালালের হয়েছে জানা ভোগের দেহ সন্দিহান॥

এটি ‘দেহতত্ত্বের গান’ নামাঙ্কিত হয়েছে বটে, কিন্তু পরম্পরাগত যে-দেহতত্ত্বের কথা আমরা জেনে এসেছি তার কতটুকু আছে এর মধ্যে? দেহতত্ত্বের একটি পর্দা এতে আছে ঠিকই, তবে পর্দাটা এতই পাতলা ও পল্‌ল্কা যে একটানেই তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, ‘সন্ধ্যাভাষা’র কোনো আবরণ এতে থাকে না, স্পষ্ট হয়ে যায় যে : ‘পাকিস্তান’ নামক একটি কৃত্রিম ও অসঙ্গত রাষ্ট্রের স্বরূপ প্রকাশের জন্যই রচিত হয়েছে এই পংক্তিমালা।

তবু, পাকিস্তান-প্রতিষ্ঠার আগেও যেমন পরেও তেমনই, জালাল কোনো রাজনৈতিক আদর্শ গ্রহণ করে তার প্রচার-প্রসারে—কিংবা কোনো সামাজিক- অর্থনৈতিক বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে—নিজেকে যুক্ত করেননি। বিশ শতকের বাংলার মূলধারার তিন বিশিষ্ট কবি মুকন্দদাস-রমেশ শীল-নিবারণ পণ্ডিতের সঙ্গে এখানেই জালালের পার্থক্য। তাই বলে এর মানে এমনও নয় যে জালালের কবিতায়- গীতিতে তাঁর সমকালীন সমাজের বাস্তবতা তথা সমস্যা-সংকট-সম্ভাবনার কোনো প্রতিফলনই পড়েনি। সে-প্রতিফলন বরং বেশ স্পষ্টভাবেই পড়েছে। তাই উচ্চ উচ্চ সব তত্ত্ব-সন্ধানে ব্যাপৃত থেকেও তাঁকে গীত রচনা করতে হয়েছে ‘দেশতত্ত্ব’ ও ‘সংসারতত্ত্ব’ নিয়ে। দেশ-সংসার-সমাজের নানা অসঙ্গতি তাঁকে বিস্মিত ও ব্যথিত করেছে—

তাজ্জব হয়ে গেলাম বাবা দিন দুনিয়ার ব্যবহারে
চোরেরা খায় খোরমা পোলাও সাধু ঘুরায় দ্বারে দ্বারে।
পরের সম্পদ করে শোষণ ধনীর ঘরে হয়েছে ধন
খাট পালঙ্কে শুইয়ে এখন গাঁজা মদের আড্ডা মারে॥

শোষণই ধনীর ধনের উৎস—এ-সত্য যিনি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর বস্তুজ্ঞান ও সমাজ-সচেতনতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা চলে কি? তাঁর জিজ্ঞাসা : ‘পেট ভরে যে খেতে পায় না অন্যচিন্তা করবে কিসে?’ তিনি জানেন : ‘অর্থ ছাড়া ফকিরি কই, তালাশিয়ে দেখরে মন/ দুনিয়ার দরবেশি যত, টাকা পয়সাই মূল কারণ।’ এবং ‘টাকা কলির পরম ধর্ম, টাকাতে সকল কর্ম, টাকা বিনে কোনো কর্ম করা নাহি যায়।’

এ-রকম পরিপার্শ্ব-চেতনা ও কাল-চেতনা নিয়েই কবি জালাল উদ্দীন খাঁ মূলধারার কবিতাতে শুধু চিরকালীনতারই ধারা বহন করেন না, আধুনিকতারও সঞ্চার ঘটান। আর তাঁর এ-আধুনিকতাও মূলধারার ধারাবাহিকতা থেকেই উপজাত, – বিদেশ থেকে ধার করে আনা নয়; উৎকেন্দ্রিক নাগরিক আধুনিকতা থেকে এর চরিত্র সম্পূর্ণ পৃথক। লোকায়ত-ঐতিহ্যস্নাত এ-আধুনিকতা লোকসাধারণের দুঃখ-দৈন্য- পশ্চাৎপদতার কারণ অনুসন্ধান করে, তাদের শত্রুকে চিহ্নিত করে, শত্রুকে মোকাবেলা করার পথ দেখায়। জালাল-যে তাঁর গীতিতে বারবার মুন্সি-মোল্লাদের বিদ্রূপে ও ধিক্কারে জর্জরিত করেছেন তার কারণ: এরা লোকসাধারণের আত্মজ্ঞান লাভের ও আধুনিক হওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে রেখেছে, এমনকি ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে ভাষা শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত রাখতে চেয়েছে। এ-সম্পর্কে লোকসাধারণকে সচেতন করে তোলার উদ্দেশ্যেই লোকায়ত-আধুনিকতাদীপ্ত কবি জালাল খাঁর উচ্চারণ :

বিজাতি ইংরেজি শিক্ষায় বেহেস্ত না পাওয়া যায়
মোল্লাজিদের কথা শুনে শিল না মানুষে,
সকল ভাষা সমান বুঝে ধর এবার কষে—
কবে আবার সুদিন উদয় জালালে কয় চল্ সাহসে॥

এই ‘সুদিন উদয়’-এর তীব্র আকাঙ্ক্ষা জালালকে শুধু সাহসী জীবন-পথিকই করে তোলেনি, তাঁকে একধরনের বৈপ্লবিকতায়ও উদ্বুদ্ধ করেছে। রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাচেতনা থেকে লোকসাধারণকে মুক্ত করে আনার আকুতি ঝরে পড়েছে জালালের অনেক রচনাতেই। ‘জন্মনিরোধ না করিলে সুখ পাবে না এ সংসারে’—আজকের দিনে এমন কথার মধ্যে আমরা নিশ্চয়ই কোনো বৈপ্লবিক চিন্তা-চেতনার খোঁজ পাবো না, কিন্তু জালাল যে-সময়ে যে-পরিবেশে যে- লোকসাধারণের মধ্যে এ-বক্তব্য প্রচার করেছিলেন তাতে অবশ্যই রক্ষণশীল চিন্তাচেতনায় প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল। নানাভাবে এ-রকম ধাক্কা লাগানোর মধ্যেই মূর্ত হয়েছে জালালের আধুনিকতা।

আজকে আমরা যাকে ‘স্বদেশপ্রেম’ বলি, প্রাক্-আধুনিক কালে সে-রকম কোনো চেতনার স্ফুরণ ঘটেনি; বলা হয়ে থাকে, স্বদেশপ্রেমের ধারণাটি আধুনিকতারই অবদান। এ-কথাগুলিকে সাধারণভাবে আমরা মেনে নিতে পারি অবশ্যই, কিন্তু নিরঙ্কুশ সত্য বলে গ্রহণ করতে পারি না। তথাকথিত এক আধুনিক যুগে বৃন্তহীন পুষ্পের মতো হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে স্বদেশপ্রেম গজিয়ে উঠেছে, এর আগে এর কোনো অস্তিত্বই ছিল না—এমন কথা কোনোমতেই গ্রাহ্য নয়। কবি জালাল উদ্দীন খাঁ প্রচণ্ড স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন, সেই স্বদেশপ্রেম তিনি আবহমান কালের লোকায়ত ঐতিহ্য থেকে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো একান্ত স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছেন এবং এভাবেই তাঁর চেতনায় যে-স্বদেশপ্রেমকে তিনি ধারণ করেছেন ও যে-ভাষাভঙ্গিতে তাঁর রচনায় এর উৎসারণ ঘটিয়েছেন, তাকে কেউই ‘অনাধুনিক’ বলে অবজ্ঞা করতে পারবে না। স্বদেশ বন্দনামূলক গীতিতে তাঁর স্পষ্ট উপলব্ধি :

জীবন আমার ধন্য যে হায়
জনম মাগো তোমার কোলে
স্বর্গ যদি থেকেই থাকে
বাংলা মা তোর চরণমূলে॥
মলয় ধোয়া সবুজ শ্যামল
ছায়া-ঢাকা অঙ্গ শীতল
গাহে পাখি কুঞ্জবনে
অমিয় ঝরে ফুলে ফুলে॥
নীল আকাশে রাতের বেলা
হাজারো চাঁদ তারার মেলা
হুর-পরীরা বেড়ায় খেলে
কাজল নদী দোদুল দোলে॥
হেথা আমি কুসুম সাথে
জনম নিলাম অরুণ প্রাতে
শুয়ে ঘাসের গালিচাতে
মরণ যেন হয় বিভোলে॥
মরার পরে ভুল ভাঙ্গিয়া
তোমার সনে মিশাইয়া
রেখ আমায় যুগে যুগে
জালালে কয় পরাণ খুলে॥

স্বদেশের জল-হাওয়া এবং স্বদেশের প্রতি ভালোবাসাই যে তাঁর কবিসত্তাকে গড়ে তুলেছে, সে-বিষয়েও জালাল ছিলেন পূর্ণ সচেতন—

আমার এই গান গাওয়াটা
নয়ত কভু ভুল
কোন্ আকাশনীলায় ডুবে আছে
এ মোর সুরের মূল।
নদীনালার কলগীতে
বেড়েছে সে আমার চিতে
এ যে আকুল হয়ে কোন্ সুদুরে
পেতে চায় অসীমের কোল।
এদেশেরই ভালবাসা
এগানে মোর পেল ভাষা
আমি তাই বাউল সাজিয়া
ভালবাসি দেশের ধূল
জালালের এই ছন্নছাড়া
বেহিসাবি জীবনধারা
মাটির রসেই ভিজে আছে
যেমন শিশির ভিজায় ফুল।

নয়

আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে যাকে বলা হয় ‘মধ্যযুগ’, সে-যুগের কবিদের একের রচনা প্রায়শই অন্যের নামে চলে যেতো, এক নামে একাধিক কবিরও দেখা মিলতো। এই নিয়ে সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতারা অনেক সময় ফাঁপড়ে পড়ে যান। তাঁরা পরস্পরের মধ্যে বিতর্ক-বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়েন। চণ্ডীদাস-বিতর্ক হলো এ-রকম বিতর্ক-বিবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চণ্ডীদাস-সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হয়ে গেছে—এমন কথা আজও হয়তো বলা যাবে না।

যখন মুদ্রণযন্ত্রের প্রবর্তন হয়নি—এবং কবিদের রচিত পদাবলি লোকের মুখে মুখেই সাধারণত প্রচারিত হতো—তখনকার দিনে কোনো রচনার প্রকৃত রচয়িতার পরিচয় নিয়ে বিভ্রাট সৃষ্টি হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক ছিল না। তাই একান্ত স্বাভাবিকভাবেই চণ্ডীদাস-সমস্যার মতো অনেক সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক সমস্যার দায় আমাদের এখনো বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর কবি জালাল উদ্দীনের প্রায় সব রচনাই তো জালাল-গীতিকায় মুদ্রিত রূপে প্রকাশিত হয়েছে; তাই তাঁর কোনো রচনাই অন্যের নামে প্রচারিত হওয়ার কথা নয়। অথচ বাস্তবে এমনটিও ঘটে গেছে। জালালের কিছু গান একসময় ‘রেডিও পাকিস্তান’-এর ঢাকা কেন্দ্র থেকে ‘প্রচলিত পল্লীগীতি’ পরিচয়েও প্রচারিত হয়েছিল। এর প্রতিবাদ হওয়ার পরে অবশ্য আর তেমনটি হয়নি।

কিন্তু এর পর ঘটেছে এর চেয়েও মারাত্মক ঘটনা; অনামী রচয়িতার বরাতে ‘প্রচলিত পল্লীগীতি’ বা ‘লোকগীতি’ রূপে নয়, একেবারে অন্য কবির নামে জালাল উদ্দীন খাঁর রচনাকে গ্রন্থবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। আর, সীমাহীন পরিতাপের বিষয় যে, সে-ব্যাপারটি ঘটেছে এমন একজন মনীষীর হাতে, যাঁর কাছে বাংলার মূলধারার কবিকূল ও তাঁদের কবিতার রসগ্রাহীদের ঋণ অপরিশোধ্য। তিনি ‘হারামণি’-খ্যাত মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন (১৯০৪-১৯৮৭)।

বাঙালি সুধীজনের কাছে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের সারস্বত অবদান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার কোনোই প্রয়োজন নেই। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্নেহাশীর্বাদ শিরে ধারণ করে তাঁর ‘হারামণি’ প্রথম খণ্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে তথা ১৯৩৩ খ্রিস্টীয় সালে। বাংলা একাডেমী থেকেই এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় ১৯৭৮ সালে। ৭ম খণ্ডের পর বের হয় আরো চারটি খণ্ড। লোকায়ত বাংলার অজস্র কবির রচনা মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের ‘হারামণি’র ১১টি খণ্ডে গৃহীত হয়ে এ-সবকে বিস্মৃতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। বাঙালিকে চিরকাল এই মনীষীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।

কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক, মনসুর উদ্দীনের ‘হারামণি’র সপ্তম খণ্ডে কিছু বিভ্রান্তি ও তথ্যবিকৃতি ঘটে গেছে। আর সেই বিভ্রান্তি-বিকৃতির শিকার হয়েছেন লোকায়ত বাংলার অন্যতম প্রধান কবি জালাল উদ্দীন খাঁ। জালালের ভণিতাযুক্ত কোনো গীতি ‘হারামণি’র সপ্তম খণ্ডে ছাপা হয়নি, কিন্তু অন্যের ভণিতা নিয়ে ছাপা হয়ে গেছে জালালের রচনা। ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ, এ-মন্ত্রণা কে দিয়াছে?’ এই বিখ্যাত গীতিটি যে জালাল উদ্দীন খাঁ-রই রচনা, এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণের সামান্যতম অবকাশও নেই। ‘হারামণি’র সপ্তম খণ্ডের প্রথম সংস্করণ প্রকাশের অনেক আগেই এটি ‘জালালগীতিকা’র প্রথম খণ্ডে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল, জালাল সম্পর্কে অনেক আলোচনাতেও বরাবর এটি উদ্ধৃত হয়েছে, জালালের বন্ধু-শিষ্য-প্রশিষ্যের কণ্ঠে গীত হয়ে এই জালালগীতিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছে। জালালের কবিকৃতির প্রধানতম বৈশিষ্ট্যও ধারণ করেছে এই গীতিটিই অথচ, কী আশ্চর্য, নেত্রকোনার কবি জালাল উদ্দীনের এই গীতিটি কিনা মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের সংগ্রহে হয়ে গেল মুন্সিগঞ্জের কবি ওসমান বয়াতির! এমনকি জালাল উদ্দীনের মৃত্যুর (১৯৭২) ছবছর পর (১৯৭৮) প্রকাশিত ‘হারামণি’র সপ্তম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণেও এই ভুলটি সংশোধিত হলো না।

অথচ আমরা তো জানি, জালাল উদ্দীন খাঁ ও মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন পরস্পর পরিচিত ছিলেন; ‘১৯৩২ সালে জালাল খাঁ জনাব মনসুর উদ্দীন সাহেবের বাসায় এসেছেন’ বলেও আমরা শুনেছি। তবু, এর পরও, মনসুর উদ্দীন কেন জালাল খাঁ- র রচনাকে ওসমান গনির রচনা বলে প্রকাশ করলেন? এবং তিনি আরো লিখলেন, ‘বর্তমানে ওসমান গনির সাকরেদ মুন্সিগঞ্জের নিকটবর্তী ষোলগ্রাম নিবাসী জালাল উদ্দীন’। মনসুর উদ্দীন কি সে সময়ে নেত্রকোনার জালাল উদ্দীনের কথা একেবারেই বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলেন? এ রকম বিস্মৃতি ঘটা অবশ্যই বিস্ময়কর বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ‘মুনিনাঞ্চ মতিভ্ৰম’—মুনিদেরও ভুল হয়। মনসুর উদ্দীন বিপুল পরিমাণ গীতি সংগ্রহ করেছেন বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষদের কাছ থেকে। এই মানুষদের কেউ ছিলেন গীতিকার, কেউ নিজে গীতিকার না হয়ে ছিলেন অন্যের রচিত গীতিকার গায়ক, কেউ বা গীতিকার কিংবা গায়ক কোনোটাই ছিলেন না—অন্যের কাছ থেকে শুনে গীতির কথাগুলো লিখে এনেছিলেন মাত্র। এ- রকম বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সহায়তায় গীতিসংগ্রহের যে বিপুল স্তুপ তিনি জমিয়েছিলেন, সেই স্তুপ থেকে ঝাড়াই-বাছাই করে নিয়ে আলাদা আলাদা প্রতিটি গীতির খাঁটিত্ব যাচাই করা কিংবা গীতিটির প্রকৃত রচয়িতাকে শনাক্ত করা ছিল খুবই কঠিন। সেই কঠিনতার ছিদ্রপথে ঢুকে পড়েছিল কিছু কিছু বিভ্রান্তি, এবং এ-রকম বিভ্রান্তিই ঘটেছিল জালাল খাঁ-র রচনাকে ওসমান গনির রচনা বলে নির্দেশ করার মধ্যে। ওসমান গনি ছিলেন একজন বয়াতি। কোনো বয়াতি নিজে গীতরচয়িতা হতে পারেন, নাও হতে পারেন। বয়াতিরা আসরে দাঁড়িয়ে নিজের বা অন্যের রচিত গীত পরিবেশন করে থাকেন—এঁরা মূলত পারফর্মার। এই পারফর্মারদের অনেকে অনেক সময় তাদের পরিবেশিত গীতে মূল রচয়িতার বদলে নিজের নামের ভণিতা ব্যবহার করে বসেন, এবং এদের এরকম আচরণে শ্রোতারাও সাধারণত আপত্তি করেন না। এভাবেই হয়তো ওসমান গনি বয়াতি জালাল খাঁ-র গানে নিজের ভণিতা ব্যবহার করেছেন এবং সেটিকেই মনসুর উদ্দীন ধরে নিয়েছেন ওসমান গনি বয়াতির নিজের রচনা বলে। এমনটি হতেই পারে। আমাদেরই উচিত ছিল মনসুর উদ্দীনের জীবৎকালেই এই ভুলটি তাঁকে ধরিয়ে দেওয়া। অথচ আমরা কেউই সেই উচিত কাজটি করিনি। বিষয়টি আমাদের কারো নজরেই পড়েনি।

কিন্তু আজ থেকে পঞ্চাশ বা একশো বছর পরে কোনো গবেষক যদি মনসুর উদ্দীন- সম্পাদিত ‘হারামণি’ প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণের বরাত দিয়ে ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজ’ গীতিটির রচয়িতা বলে ওসমান গনি বয়াতিকেই সাব্যস্ত করে বসেন এবং এই গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখিত বক্তব্যকে প্রমাণরূপে হাজির করে বলেন যে, জালালের নামে যে-সব গান প্রচারিত আছে সেগুলোর রচয়িতা ওসমান গনিই—তা হলে কেমন হবে? কিংবা ওসমান গনি বয়াতির ‘সাকরেদ’ ও ‘মুন্সিগঞ্জের ষোলগ্রাম নিবাসী জালাল উদ্দীন’কেই আসল ‘জালালগীতিকা’কার বলে প্রমাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি বাগিয়ে নেন যদি ভবিষ্যতের কোনো গবেষক? আমার একান্ত স্নেহভাজন ছাত্র ফয়েজুর রহমান খোকন যখন আমার সামনে মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের ‘হারামণি’ সপ্তম খণ্ডের দ্বিতীয় সংস্করণ (ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৭৯)-এর বিশেষ কয়েকটি পৃষ্ঠা [উক্ত গ্রন্থে মুদ্রিত], ‘প্রথম সংস্করণের ভূমিকা’, পৃষ্ঠা ৫৯-৬১, এবং মূল গ্রন্থের ২৯৮ পৃষ্ঠা পর পর খুলে ধরলো, তখন আমি একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম। নিজের চোখকে আর বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রয়াত মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন তো বাংলার সারস্বত সমাজে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। এমন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির অনিচ্ছাকৃত ভুলের দরুন কি লোকায়ত বাংলার অন্য আরেকজন শ্রদ্ধেয় কবি-মনীষী জালাল উদ্দীন খাঁ-র অবদান কিছু পরিমাণে হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে?

এ-রকম অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির উদ্ভব যেন কোনো দিনই না ঘটে—এবং জালাল উদ্দীন খাঁ-র মতো মূলধারার অন্য কবিদেরও প্রত্যেকেই যেন যাঁর যাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত না হন—সেই আশাতেই এতগুলো কথা বললাম।

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন