কলকাতা ত্রয়ী : রাজনীতির সন্ধানে

কলকাতা ত্রয়ী : রাজনীতির সন্ধানে

“কারা আমাদের শত্রু ? কারা আমাদের বন্ধু? এটাই হলো বিপ্লবের জন্য সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অতীতে চীনের সমস্ত বিপ্লবী সংগ্রামগুলো কেন যে অত অল্প সাফল্য অর্জন করেছিল তার মূল কারণ হচ্ছে, প্রকৃত শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য প্রকৃত বন্ধুদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারা।”- মাও সে তুঙ (২০১৫: ১)

“আসল শত্রুকে সরাসরি চিনিয়ে দেবার প্রয়োজন সব সময়েই আছে বলে আমি মনে করি না। … শত্রু কে একথা সব সময়েই যে খোলাখুলি বলতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা আছে বলে আমি মনে করি না। ওটা মানুষ নিজেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে connect করে নিতে পারবে। এই connect করাটাই বড় কথা এবং শিল্পের দায়িত্ব।” -মৃণাল সেন (২০১৫: ৮৯)

.

ষাট ও সত্তরের দশকে গোটা দুনিয়া হয়ে উঠেছিল উত্তাল, নানা কারণেই। সবদিক থেকেই যেন পুরনোকে ভাঙার এক বেনজির প্রতিযোগিতা শুরু হয় এসময়টায়, বিপ্লবের নেশা পেয়ে বসে সবাইকে। পোশাক, সঙ্গীত, সাহিত্য, মাদক, যৌনতা থেকে শুরু করে সমাজের প্রচলিত বিধিনিষেধ বা ট্যাবু ভাঙা যেন মূল বিষয়ে পরিণত হয়। রাষ্ট্র, রাজনীতি, বিপ্লব, যুদ্ধ সব মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি হয় ষাটের দশকে, যার রেশ চলে সত্তরের দশক পর্যন্ত। ঠাণ্ডা যুদ্ধের এই কালে একদিকে বুর্জোয়া শাসনের বিরোধিতা, অন্যদিকে উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার আন্দোলন, একদিকে নিজেদের নাগরিক অধিকার আদায়ে মানুষ সোচ্চার হচ্ছে, অন্যদিকে নিজের সঙ্গী বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে রাজপথে নামছে মানুষ। একদিকে দরিদ্র, অভুক্ত মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণপণ লড়াই, অন্যদিকে পুঁজিপতিদের সম্পদ লুণ্ঠনের উৎসব। দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাদের কর্মকাণ্ড, ঘটানো হচ্ছিল চোরাগুপ্তা হামলা। বাড়ছিল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও দ্বন্দ্ব।

একদিকে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা, দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও পাকিস্তানের সাথে ভারতের যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের সঙ্গে মিশর, জর্ডান, সিরিয়ার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আবার শরিক হয় ইরাক, সৌদি আরব, সুদান, তিউনিশিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া। এসময়টায় প্রায়ই প্রতিবেশি তিন দেশ মিশর, জর্ডান ও সিরিয়ার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় ইসরাইল। ইসরাইল-আরব দেশগুলোর মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হওয়ার বছর পাঁচেক আগে, ১৯৬২ সালে, শেষ হয় আলজেরিয়ার ফরাসি উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন ও যুদ্ধ। এই ষাটের দশকেই আবার গৃহযুদ্ধ শুরু হয় কয়েকটি দেশে। সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনাও ঘটেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ তথা বামপন্থী বাঙালিদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে চীনে। দেশটিতে মাও সে তুঙের নেতৃত্বে সম্পন্ন হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬-৭৬)। চীনে যখন চেয়ারম্যান মাওয়ের নেতৃত্বে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব সাধিত হচ্ছে তখন বিপ্লবের এক প্রতিভূ হয়ে লাতিন আমেরিকা চষে বেড়াচ্ছেন চে গেভারা, বলিভিয়ায় বিপ্লব ঘটাতে গিয়ে শেষটায় দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন চে, সেটা ১৯৬৭ সাল, এরপর মৃত চে হয়ে ওঠেন আরো অপ্রতিরুদ্ধ।

একই সময়ে ফ্রান্সেও ঘটে যাচ্ছে যুব ও শ্রমিক আন্দোলন (১৯৬৮), সেই সময়েই বাংলাদেশে ঘনীভূত হচ্ছে স্বাধীনতার আন্দোলন, যা পরে মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সেই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যেমন ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে রেহাই পায়, তেমনি ষাট দশক জুড়েই আফ্রিকার বহুদেশ ইউরোপিয় অনেক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে লাভ করে স্বাধীনতা। এমনই এক উত্তাল সময়ে ঔপনিবেশিক মানসিকতা, শোষণের অর্থনীতি, তোষণ ও সংশোধনবাদী রাজনীতি, সর্বোপরী সামন্তযুগের ভূমি ও কৃষি ব্যবস্থাকে বিলুপ্ত করতে ভারতে একদল মানুষ চরমপন্থার আশ্রয় নেয়। দার্জিলিংয়ের নকশালবাড়িতে কৃষকদের হাত দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হলেও পরে তা আন্দোলিত করে শহরের যুবক ও ছাত্রদের। এই আন্দোলিত তরুণদের দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করেন চারু মজুমদার, কানু স্যান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রমুখের দল সিপিআই (এমএল)। শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সিপিআই (এমএল) দলটির রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে কৃষক ও তরুণ সকলের বিদ্রোহই মাঠে মারা যায়। প্রাণ যায় শতশত মানুষের।

 ১৯৬৭ সালে যখন পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের নির্বাচনে কংগ্রেসকে পরাজিত করে বামফ্রন্ট জয়ী হয়, সেই বছরই নকশালবাড়িতে সংগঠিত হয় সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের আগুন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশের উত্তরাঞ্চল, কেরালা ও পূর্ব উড়িষ্যায়। এই বিদ্রোহ দমনে তখন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার উভয়েই কঠোর হয়, রক্তে রঞ্জিত হয় প্রশাসনের হাত। যদিও এই বিদ্রোহ কয়েক মাসের বেশি টেকেনি, তারপরও এর উন্মাদনা পুরোপুরি নিকেষ হয় ১৯৭২ সালে, সিপিআই (এম-এল) পার্টির অবলুপ্তির মধ্য দিয়ে। এই সময়ে ভারতে বিভিন্ন ভাষায় বিদ্রোহ ও রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে যেমন সাহিত্য রচিত হয়, তেমনি কলকাতাতেও ছবি বানান সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন। যদিও মূল ধারার বাণিজ্যিক ছবিতে নকশালবাড়ি আন্দোলন বা নকশালপন্থী আন্দোলন কোন প্রসঙ্গই উঠে আসতে দেখা যায়নি। ঋত্বিকের ছবিতে এসব বিষয় তাঁর মত করেই এসেছে, দেশভাগের বেদনা সেখানে মিশে আছে, আর সত্যজিৎ বিষয়টিকে দেখেছেন একজন আগন্তুকের চোখে। এই দুজনের তুলনায় মৃণাল যেন কলকাতার রাজনীতির মনোস্তত্ত্বে প্রবেশ করতে চাইলেন, সেকালের তরুণদের চোখ দিয়ে কলকাতার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে চাইলেন। তাঁর এই চাওয়ার ধরন নিয়েই বর্তমান প্রবন্ধ।

মূল আলোচনায় ঢোকার আগে বলা অপ্রয়োজনীয় নয় যে কলকাতা ত্রয়ীর মধ্যে প্রথম নির্মিত হয় ‘ইনটারভিউ’, ১৯৭০ সালে, আশীষ বর্মনের গল্প অবলম্বনে। এরপর ১৯৭২ সালে সেন নির্মাণ করেন ‘কলকাতা ৭১’। এই ছবিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবোধ স্যান্যাল ও সমরেশ বসুর গল্প ব্যবহার করা হয়। তৃতীয় ছবিটি সেন তৈরি করেন পরের বছর, ১৯৭৩ সালে, ‘পদাতিক’। আশীষ বর্মনের গল্প ও নিজের কল্পনা মিলিয়ে এই ছবিটি বানান তিনি।

ঔপনিবেশিক জড়তার বিপরীতে

ইনটারভিউ বা সাক্ষাৎকারকে ঘিরেই ‘ইনটারভিউ’ ছবিটি এগিয়েছে। যারা ছবিটি দেখেছেন তারা জানেন পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পুষে রাখার প্রবণতাকে তীব্র সমালোচনা করেছেন পরিচালক। পশ্চিমা পোশাক- কমপ্লিট সুট পরতে পারেনি বা জোগাড় করতে পারেনি বলে চাকরি হয়নি রণজিৎ মল্লিকের। যদিও পুরো ছবিতে একটি কমপ্লিট সুট জোগাড়ের জন্য প্রায় অর্ধেক কলকাতা চষে ফেলে রণজিৎ। একটি প্রেসে কাজ করে সে, কিন্তু আরো একটু ভালো থাকার প্রত্যাশায় প্রাণপণে সে সুট জোগাড়ে নেমে পড়ে। চাকরিপ্রার্থী কি চাকরিদাতা দুই পক্ষের মগজেই সদ্য বিদায় হওয়া ব্রিটিশ প্রভুদের প্রেত্মাতা ভর করে আছে। তাই চাকরি পাওয়ার জন্য অন্য সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু পোশাকের কারণে চাকরি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয় রণজিৎ। অবশ্য এই ক্ষোভ ভেতর থেকে বের করে আনতে সাহায্য করেছে দর্শকদের প্রশ্ন।

ছবির শেষ প্রান্তে দেখা যায় দর্শক প্রশ্ন করে অস্থির করে তুলছে রণজিৎকে। প্রথমে রণজিৎ চাকরিটি পায়নি বলে বেশ নির্লিপ্ত ভাব দেখাচ্ছিল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে যে আফসোস আর ক্ষোভের আগুনে পুড়ছিল, সেটা বেরিয়ে আসে দর্শকের উসকানিতেই। তাই সবশেষে কাচ ঘেরা সুট-টাই-টুপি পরা এক ম্যানেক্যন বা পুতুলের উপর হামলা চালায় রণজিৎ। ভেঙে চুরমার করে কাঁচ, টেনে ছিড়ে ফেলে পুতুলের গায়ের পশ্চিমা কাপড়। এই কর্মটি করার আগে সে ওই পুতুলের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে- কমপ্লিট সুটে। পরে পুতুলকে নগ্ন করার মধ্য দিয়ে রণজিৎ নিজের ভেতরকার পশ্চিমা প্রভুর প্রতি যে অবনত ভাব সেটাকে দূর করে, ঔপনিবেশিক মানসিকতার অবসান ঘটাতে চায় রণজিৎ। এখানটায় ছবির শুরুতে যেসব দৃশ্য দেখানো হয়েছিল, সেগুলোই আবার পুনরায় দেখানো হয়। দেখানো হয় কলকাতার রাস্তা থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ব্রিটিশ রাজের বসানো বড়লাটের মূর্তি। গলায় দড়ি বেঁধে নামানো হয় বড়লাটকে। ছবির শুরুতেও মূর্তি অপসারণ ও ভিক্টোরিয়া ম্যামোরিয়ালের দৃশ্য দেখানো হয়।

রণজিৎ শেষ দৃশ্যে যখন সব ভাঙচুর করছে তখন হঠাৎ করেই দেখা যায় একজন স্লোগান দিচ্ছেন ‘ইনকিলাব …’, সাথে সাথে ক্যামেরা চলে যায় কৃষকদের মিছিলে, ভিয়েতনামের যুদ্ধে, ভিনদেশের বিপ্লবে, আবার ফেরে কলকাতার রাজপথে, প্রতিবাদ মুখর শ্রমিক কৃষক জনতার ভিড়ে, মারমুখী তারা, রণজিতের মতোই, তারাও প্রচলিত সবকিছুকে ভেঙে ফেলতে চায়, রণজিৎ যেমনটা চাইছে। সমাজের মনে গেড়ে বসা ঔপনিবেশিক প্রতিমাকে গুড়িয়ে দিতে চায় রণজিৎ। শেষ দৃশ্যটি অঙ্কিত হওয়ার আগে বা দর্শক রণজিৎকে উসকে দেয়ার আগে রঞ্জিতের যে সামাজিক চরিত্র দেখা যায় সেটা দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়ার চরিত্র।

দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়া চরিত্র বলার কারণ হল রণজিৎ ছবির শুরুতেই মাকে বলছে, সে নতুন চাকরিতে বর্তমান চাকরির চেয়েও অনেক বেশি বেতন পাবে। আর বাড়তি কমিশন তো থাকবেই। মানে বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে রণজিৎ, তার অবস্থা যদি হয় মধ্যবিত্ত, সে উচ্চমধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রেমিকাকে বিয়ে করে আর দশটা বুর্জোয়া পরিবার যেমন, ঠিক তেমনটি হওয়ার ইচ্ছা তারও আছে। মনে করে দেখুন, রণজিৎ ইনটারভিউ দেয়ার দিন সকালে গুণগুণ করে গাইছে- ‘আমার সোনার হরিণ চাই’, ঠাকুরের এই সোনার হরিণ বুর্জোয়া সমাজে ফ্যাটিশ বা বাড়তি ভোগলিপ্সা বৈ কিছু নয়। এই ফ্যাটিশ বা বাড়তি চাকচিক্যময় জীবন যা জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য নয়, সেই জীবন যাপনের জন্য রঞ্জিতের একখানা ‘জাতে ওঠার’ মত চাকরির দরকার ছিল। এই দিকটাই এক দর্শক রণজিৎকে ধরিয়ে দেন ছবির শেষ পর্বে। এখানে যেন রণজিতের ভেতরকার প্রতিবাদী মানুষটাকে টেনে হিচড়ে বের করে আনা হয়- প্রতিবাদ করার জন্য- অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে। বিপ্লবী হয়ে ওঠার মন্ত্র যেন বুক থেকে টেনে মুখে, তারপর ক্রোধে পরিণত করা হয়। যে ক্রোধ সামিল হয় বিশ্বের আরো সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে।

 এই দোদুল্যমান মাঝারি বুর্জোয়া সম্পর্কে মহাত্মা মাও সেতুঙ বলেছিলেন, এরা আসলে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি। এই শ্রেণিটি তখনই অসহায় বোধ করে যখন বিদেশী পুঁজির আঘাতে নিদারুণ উৎপীড়ন ভোগ করে। রণজিৎ কিন্তু বিদেশী কোম্পানির মোটা অঙ্কের মাইনে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু কোম্পানির ঔপনিবেশিক মানসিকতার কারণে সে বঞ্চিত হয়, এটা উৎপীড়নই বটে। মাও সেতুঙ বলছেন, উৎপীড়িত হলে তখন এই মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণিটি “বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তাকে উপলব্ধি করে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সমরনায়কদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনকে সমর্থন করে।“ (সে তুঙ ২০১৫: ২) সমরনায়কের বিষয়টি ‘ইনটারভিউ’তে নেই, তবে সাম্রাজ্যবাদ কিন্তু আগাগোড়াই আছে। এই সাম্রাজ্যবাদী নীতিরই বিরোধিতা করেছে রণজিৎ।

মৃণাল সেন ছবির নায়ক রণজিৎ সম্পর্কে বলছেন, শেষভাগে রণজিৎ যখন ভাংচুর শুরু করে তখন রণজিৎ আর সেই চাকুরিপ্রার্থী রণজিৎ নেই, “সে তখন সেই মুহূর্তে একটি idea, একটা concept। সে যখন সমস্ত কিছু ভাঙতে আরম্ভ করে তখন একটা concept-এর স্তরে তার উত্তরণ ঘটেছে, মানুষের চেহারা নিয়ে একটা idea-তে এসে দাঁড়িয়েছে। সে যখন ভাঙতে আরম্ভ করে তখন সমস্ত ব্যাপারটা একটা symbol-এর পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়।” (সেন ২০১৫: ৮৬)

 মাও সে তুঙের কথা অনুযায়ী রণজিতের মত এই মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণিই বিপ্লবের শত্রু হয়ে উঠতে পারে, নিজেদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হলে। শত্রু হওয়া মানে অসহযোগিতা করা, নিজেদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করা। আর সেটা করতে গেলে অবধারিত ভাবেই বিরোধিতা করতে হবে তাদের, যারা এই ঔপনিবেশিক শক্তির পুরোপুরি অবসান চায়। সুবিধা বঞ্চিত হয়ে রণজিৎ বিদ্রোহী হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু এক পর্যায়ে রণজিৎ বারবারই নিজেকে কল্পনা করছিল পশ্চিমা সাহেবদের পোশাকে, তখন কিন্তু এই শ্রেণির দোদুল্যমানতাই ফুটে ওঠে, দৃশ্যমান হয় মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রেণিচরিত্র। ধরুন, রণজিৎ চাকরিটা পেয়ে গিয়েছে, সে কি বিদ্রোহী হয়ে উঠত? উঠত না। সে চাকরি পেয়ে বিয়ে করে আর দশটা সুবিধাভোগী মানুষের মত জীবন কাটাতো। সেই স্বপ্নই দেখে আসছিল রণজিৎ। তবে তেমনটি হয়নি। আমরা দেখি, বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কালে মৃণাল সেন আমাদের কয়েক ফ্রেমের বিস্ফোরণের দৃশ্য দেখালেন, ঠিক যেন সেই মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির ‘জ্যাবরিস্কি পয়েন্টে’র শেষ দৃশ্য, যেখানে বুর্জোয়া স্থাপনাকে বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়া হয়, সেরকমই এক মূর্তিভঙ্গকারী দৃশ্য আমরা রচিত হতে দেখি ‘ইনটারভিউ’তে। পরিচালক বিষয়টিকে একটি প্রতীক বা সিম্বলে পরিণত করতে চেয়েছিলেন বলেই ছবিতে রণজিৎ শেষ পর্যন্ত রণমূর্তি ধারণ করেছিল, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে।

 পর্যটকের দৃষ্টিতে নয়, বরং স্থানীয় বাসিন্দা হয়েই সংবেদনশীল শিল্পীর মত কলকাতা শহরের নানা সঙ্কটের ভেতর এই ঔপনিবেশিক মানসিকতার সঙ্কটকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন মৃণাল সেন। এবং এটিকে একটি ধারণা বা কনসেপ্ট হিসেবে নিয়ে কিছু প্রতীক হাজির করতে চাইলেন দর্শকের সামনে। এবং এই প্রতীকে দুটি প্রতিপক্ষকে যতটা সম্ভব শৈল্পিক করে তুলতে চাইলেন তিনি, আর এতে অনুসরণ করলেন পূর্বসুরীদের দেখানো পথ। বলছি জর্মন কবি, নাট্যকার ও মঞ্চ নির্দেশক বেরটল্ট ব্রেখটের কথা। নাটক সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত চিন্তামালার ভেতর তিনি মঞ্চে এলিয়েনেশন এফেক্ট বা পরকীয়া প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছিলেন, এই কৌশলটি মূলত নতুন সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির পক্ষে হাজিরা দিয়ে যায়, যে পদ্ধতি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নামে পরিচিত। এলিয়েনেশন এফেক্ট নতুন কিছু নয়, চীনের মঞ্চে এটি পুরনো একটি বিষয়, ‘এলিয়েনেশন এফেক্টস ইন চাইনিজ অ্যাক্টিং’ শিরোনামের বিখ্যাত প্রবন্ধে ব্রেখট সেটা আলোচনা করেছেন। কিন্তু এটিকে নতুন করে মঞ্চে প্রবেশ ঘটানোর উদ্দেশ্য কিন্তু দর্শককে আধুনিক সময়ের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের মুখোমুখি করা। নতুন করে পরকীয়া চালানের কৌশল প্রয়োগের ফলে, ব্রেখট বলছেন, দর্শক মঞ্চে উপস্থাপিত বিষয়টিকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারে। সে কল্পিত চতুর্থ দেয়ালের ওপারে অদৃশ্য অবস্থায় বসে আছে, এমন ভ্রমের মধ্যে থাকে না। অভিনেতারা কৌশলটির মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন দর্শকের একটি ভিন্ন অবস্থান রয়েছে, তার অভিনীত চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হওয়া বা চরিত্রের অধীন হওয়ার দরকার নেই। (ব্রেখট ১৯৭৪: ৯২)

ব্রেখট চীনা অভিনয় ও পরকীয়া করার কৌশল সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, বুর্জোয়া নাটক পুরো মানবজাতির কথা বলতে চায়, ভুলিয়ে দিতে চায় দর্শকের বিশেষ পরিস্থিতির কথা। ‘অভিনয়ের নয়া কৌশলের উপর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা’ রচনায় ব্রেখট এই এলিয়েনেশন এফেক্ট জিনিসটা আসলে কেমন সেটা বুঝাতে গিয়ে উদাহরণ টানেন প্রাত্যহিক জীবন থেকে। তিনি বলেন, এই কৌশল অনেকটা এমন প্রশ্নের মত- তুমি কি কখনও তোমার ঘড়ির দিকে ভালো করে তাকিয়েছ? আমরা ঘড়ির দিকে সারাদিনে বহুবার তাকাই, সময় দেখার প্রয়োজনে, কিন্তু ঘড়িটিকে লক্ষ্য করার জন্য কি তাকানো হয়? সময়টাকে লক্ষ্য করা হয়, কিন্তু সময়দানকারী যন্ত্রটির দিকে আমরা নজর দেই না। পরকীয়া করার কৌশলটি অনেকটা সেরকমই। (ব্রেখট ১৯৭৪: ১৪৪)

মানুষকে নাটকের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম করে, দর্শককে নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভুলিয়ে দিয়ে একধরনের ক্যাথারসিস ঘটাতে নারাজি ব্রেখট। তাঁর দেখানো এই ভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই আমরা দেখি ‘ইনটারভিউ’ ছবিতে ‘বাস দৃশ্য’ রচনা করছেন মৃণাল সেন। সেই দৃশ্যে ব্রেখটিয় কায়দায় রণজিৎ হুট করে দর্শকের দিকে, মানে ক্যামেরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলতে শুরু করে তার আসল নাম এবং পেশার কথা। তখন তিনি অভিনেতা রণজিৎ। আরো বলতে থাকেন রণজিতের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা নারীটিও একজন অভিনেত্রী। তখন ‘পথের পাঁচালী’র কিছু দৃশ্য দেখিয়ে দেয়া হয়। করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ছবিতে সর্বজয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এই দৃশ্যে রণজিৎ যে শুধু নিজেদের অভিনয়ের কথা ফাঁস করেন তা নয়, পরিচালক মৃণাল সেনকেও এখানে দৃশ্য ধারণ করতে দেখা যায়। মানে দর্শক যে একটি কাহিনীচিত্র দেখছেন সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝিয়ে দেয়া হয় কৌশলটির মাধ্যমে। এমনটা করা হল কেন?

কারণ, মৃণাল সেন রণজিতের ভেতর দিয়ে মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণীর মনোবাসনা পূরণ করতে চাননি, বরং চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চেয়েছেন, পরিচালক হিসেবে তিনি কিছু কথা বলতে চান, এবং সেসব কথা কয়েকটি চরিত্র ও কাহিনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চান। এভাবেই তিনি একটি ধারণাকে রূপক আকারে হাজির করার কথা বলতে চান, সেটা দর্শককে অদৃশ্য চতুর্থ দেয়ালের ওপারে রেখে নয়, দর্শককে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করেই বলতে চান। দর্শক যেন নিষ্ক্রিয় না থেকে, সক্রিয় হয়ে ওঠে, একটা মিথষ্ক্রিয়া যেন তৈরি হয়, সেই প্রয়াসটাই আমরা দেখি ‘বাস দৃশ্যে’। একই রকম দৃশ্য রচিত হতে দেখা যায় শেষ পর্যায়ে। যখন দর্শকের পক্ষে দর্শকরূপী একজন বাহাসে যায় রণজিতের সঙ্গে। রণজিৎ চরিত্রটি একটি চরিত্রই মাত্র। মৃণাল সেন কাহিনীচিত্রটি সাজিয়েছেন শুধু উদাহরণ দেয়ার জন্য, বলতে পারেন রণজিতের চাকরির জন্য হন্যে হয়ে পশ্চিমা পোশাক খোঁজা একটি উপলক্ষ্য মাত্র, লক্ষ্য হল বাঙালির ঔপনিবেশিক মনোভাব, ভৃত্যের জীবনকে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতাকে কটাক্ষ করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা। মধ্যবিত্ত মনকে যেন ঘা দিয়ে জাগাতে চাইছেন মৃণাল। সেই জাগরণের সাথে আবার মিশিয়ে দিতে চাইছেন আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ বিরোদী চেতনাকে।

সাম্রাজ্য বিস্তার ও ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাস এক পর্যায়ে কমে এলেও, নয়া উপনিবেশ, স্থানীয় বুর্জোয়া ও মুৎসুদ্দিদের হাত থেকে যেন রক্ষা নেই সাধারণ মানুষের। তাই মৃণাল হাত দিলেন এমন এক ছবিতে, যেখানে শোষণ ও বঞ্চনার যে ধারাবাহিক ইতিহাস, সেখানে আবিষ্কার করতে চাইলেন নানা মাত্রা। আবারো তিনি জাগাতে চাইলেন সেই মধ্যবিত্তকেই, তৈরি করলেন ‘কলকাতা ৭১’।

প্রশ্নবিদ্ধ ইতিহাস

মৃণাল সেনের ত্রয়ী চলচ্চিত্রের দ্বিতীয় অর্থাৎ ‘কলকাতা ৭১’ শুরু ও শেষ হয় এক যুবকের স্বগতোক্তি দিয়ে। সেখানে যুবক যেন রক্ত মাংসের কোন মানুষ নয়, যেন ইতিহাস স্বয়ং। অবশ্য মৃণালের ভাষ্যে ‘ইনটারভিউ’ ছবিতে রণজিত যেমন কনসেপ্ট, তেমনি এই ছবির যুবকটিও একটি কনসেপ্ট, পরিচালক বলছেন, ‘এখানেও (কলকাতা ৭১) ছেলেটি একটা concept, যার বয়স কুড়ি বছর। … ছেলেটির বয়স আমি কুড়ি বছর রেখেছি এ কারণে যে কুড়ি বছর মানেই হচ্ছে ভীষণ youthful। যে youthful, যে সংগ্রামী, যে militant, যে কোনো কিছুকে পরোয়া করে না, যে sensitive এবং যে পবিত্র: এইরকম একটা concept-এর কথাই আমি ভেবেছি। সে হাজার বছর ধরে নানা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এসেছে এবং এই সিদ্ধান্তে এসে দাঁড়িয়েছে যে আমাদের ইতিহাস হাজার বছর বা আরো বেশি সময় ধরে দারিদ্রের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস।’ (সেন ২০১৫: ৮৬) একারণেই ছবির নানা পর্যায়ে আমরা দেখি ইতিহাস স্বাক্ষ্য দিচ্ছে- ‘দারিদ্র, মালিন্য, আর মৃত্যুর ভিড় ঠেলে আমি পায়ে পায়ে চলেছি, হাজার বছর ধরে। হাজার বছর ধরে দেখছি ইতিহাস’ – এই ইতিহাসকেই চারভাগে দেখিয়েছেন মৃণাল সেন। ১৯৩৩, ১৯৪৩, ১৯৫৩ ও ১৯৭১- এই চারটি ভাগ উপস্থাপনের আগে প্রস্তাবনা পর্বে দেখা যায় কিছু কোলাজ। সেখানে কলকাতার দুই শ্রেণীর মানুষকেই তুলে আনেন পরিচালক। শ্রমিক, ক্লাবে নৃত্যরত ধনী যুবক যুবতী, ময়দানে গুলি খেয়ে পড়ে থাকা সংগ্রামী ও সাহসী যুবক, অভুক্ত নারী ও শিশুর মুখ, এমনকি ‘ইনটারভিউ’ ছবিতে যে সাহেব পুতুলকে দেখা গিয়েছিল, সেই পুতুলকে এখানেও দেখা যায়, তাকে ঘিরে থাকা কাঁচে ঢিল পড়ায় ঝনঝন করে ভেঙে পড়ছে। এমন দ্বান্দ্বিক ছবির কোলাজ দিয়েই শুরু হয় মৃণালের ‘কলকাতা ৭১’।

 চারটি ভিন্ন গল্প হলেও পুরো ছবিতে মৃণাল একটি কথাই বলতে চেয়েছেন- সেটি হল শ্রেণীর পার্থক্য, শ্রেণীর অবস্থা ও তাদের স্বরূপ অর্থাৎ যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। মৃণাল যেমন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শত্রু কে তা সরাসরি চিনিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই শত্রুমিত্র চিহ্নিত হয়ে যাবে, তবে সেজন্য দর্শককে সক্রিয় হতে হবে। মৃণাল ইঙ্গিত করেন দর্শককে শিক্ষিত হতে হবে, দায় নিতে হবে শিল্পকে সঠিক তর্জমা করার। শুদ্ধ শ্রেণীর পার্থক্য নয়, চারটি গল্পেই আমরা দেখি কোন না কোনভাবে মা বা মাতৃরূপ উপস্থিত হয়েছে। সেই মাতৃরূপের উপস্থাপন নিয়েও দুই এক লাইন আলাপ করার চেষ্টা করব।

প্রথম ভাগে ১৯৩৩ সালের প্রেক্ষাপটে পরিচালক বেছে নেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘আত্মহত্যার অধিকার’। গল্পে দেখা যায় এক তুমুল ঝড় বৃষ্টির রাতে নির্ঘুম রাত পাড় করছে বস্তির একটি পরিবার। একটি শিশুসহ পরিবারের পাঁচ সদস্য ঘুমাতে পারছে না, কারণ ভাঙা ঘরের সবদিক দিয়ে জল ঢুকছে। বেগতিক এই অবস্থার জন্য গৃহকর্ত্রী দোষারোপ করছেন কর্তাকে। এরইমধ্যে আচমকা ঘরের চাল উড়ে যায়, ঘরের ভেতর এরপর থাকাটা হয়ে ওঠে অসহনীয়। এমন অবস্থায় বৃষ্টি মাথায় নিয়েই পরিবারটি ঘর ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। উদ্দেশ্য অদূরের একটি পরিবারের দালান বাড়ি আছে, সেটির বারান্দায় আশ্রয় নেয়া। প্রথমে পরিবারের পুরুষটি সেখানে আশ্রয় নিতে রাজি হয়নি, কারণ হিসেবে তিনি স্ত্রীকে মনে করিয়ে দেন পূর্বের কোন অপমানের কথা। স্ত্রী জবাবে বলেন, গরীবের আবার “মান অপমান জ্ঞান” কিসের? এই নারী শুধু স্ত্রী নন, সন্তানদের মাও বটে। তাই সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মা মরিয়া, ভর্ৎসনা করছেন সন্তানের পিতাকে। দুদিন পর রাস্তায় ভিক্ষা করতে হবে- এমন কথা শোনাতেও ছাড় দেন না স্ত্রী। এমন উত্তরে স্বামী পুরুষটি চটে গেলেও পরে পরিস্থিতির চাপে পড়ে স্ত্রীর কথাই মানতে হয় তাকে, সেই বাড়ির বারান্দাতেই ঠাঁই নিতে হয় সপরিবারে। সেখানে আরো অনেক গরীব পরিবারও আশ্রয় নিয়েছে, আশ্রয় নিয়েছে রাস্তার কুকুরটিও। কুকুর আর গরীব মানুষগুলোর ছাদ অভিন্ন করে দেয়ার মধ্য দিয়ে একটি বার্তা পরিষ্কার হয়- দরিদ্র মানুষের জীবন কুকুরের চেয়ে উন্নত নয়, তাদের সঙ্গে বড়লোকের পার্থক্য হল একটি দেয়াল, দেয়ালের একদিকে নিরাপদ জীবন, আরেকদিকে অনিরাপদ ও অবহেলিত কুকুরের জীবন। ছবিতে ক্যামেরা যখন কুকুরের মুখ থেকে পুরুষের মুখে এসে থামে তখন সে বলে ওঠে, ‘ভগবানের সন্তান সবাই’, এরপরের আক্ষেপটি আমাদের সকলেরই জানা, সকলেই যদি ভগবানের সন্তান হবে তাহলে কেন এই বৈষম্য?

ধনী ও গরীবের ভেদ রেখার কথা বলতে মৃণাল এবার বেছে নেন ১৯৪৩ সালকে, এজন্য তিনি বাছাই করেন প্রবোধকুমার সান্যালের ‘অঙ্গার’ গল্পটিকে। দুর্ভিক্ষ চারিদিকে, কলকাতা শহরে অভুক্তদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। ভাতের ফ্যানের জন্য মানুষ ভিক্ষা করছে। কেউ বা না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে দিন গুজরান করছে। দুই নম্বর বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এমন আর্থসামাজিক অবস্থার ভেতর একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। এটা করতে গিয়ে তারা ইজ্জত বিক্রি করছে এবং সেটা করতে ইন্ধন দিচ্ছে স্বয়ং মা। পরিবারে রয়েছে দুই বোন শোভনা ও মিনু, এক ছোট ভাই হারু, আর মা। বড় ভাই নটু ছিল, কিন্তু সে আর পরিবারের সাথে থাকে না। শোভনা আর মিনু যখন নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছে, যখন ছোট ভাই হারু মায়ের প্ররোচনায় চা-বিস্কিটের দোকান থেকে পাউরুটি চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে আর চাকরিটা খোয়ায়, ঠিক তেমন একটি সময়ে তাদের খোঁজে বাড়িতে এসে হাজির হয় দূর সম্পর্কের আত্মীয় নলীনাক্ষ। তার জুতো চকচকে। ভালো চাকরি করে। বোঝাই যাচ্ছে শোভনাদের চেয়ে তার আর্থিক অবস্থা ভালো।

কিছুটা হয় তো শোভনার টানে অথবা নিছক কুশল বিনিময়ের জন্য নলীনাক্ষ যখন প্রায় পরিত্যাক্ত বাড়িটিতে এসে পিসিমার খোঁজ করছিল, তখন পিসিমাদের সংসারে বেশ টানাটানি অবস্থা চলছে। এতটাই টানাটানি যে কিশোরী মেয়ে মিনুকে মেছবাড়িতে পুরুষদের কাছে টাকার জন্য পাঠাতেও বাধছিল না পিসিমার। কারণ কলকাতায় তখন ভাতের ফ্যান পাওয়ার জন্যও মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সেই বাজারে মিনু আর শোভনার বদৌলতে টিকে থাকার চেষ্টা করছিল নলীনাক্ষের পিসিমা। শোভনা আর তার মায়ের তর্ক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে নলীনাক্ষ যখন বাস্তবতা টের পেল, তখন সে দিল্লিতে ফেরার তাড়া অনুভব করল, যেন পালাতে পারলে বাঁচে। শোভনাদের দায় সে আর নিতে চায় না। বাড়িটির ছাদে দাঁড়িয়ে শোভনার সব কথা শুনে নলীনাক্ষ বুঝতে পারে শোভনাদের শ্রেণি তার শ্রেণির চেয়ে নিচে অবস্থান করে, তাই তাড়াতাড়ি প্রস্থানের কথা ঘোষণা করে সে, অথচ শুরুতে তার দেহভঙ্গী বলছিল উল্টো কথা।

 যুদ্ধের কালে শোভনার মা নিজের কথা, নিজের মেয়েদের বেঁচে থাকার কথাই ভেবেছে, কিন্তু শোভনারও যে একটি সন্তান রয়েছে, সে সন্তান থেকে শোভনাকে দূরে সরিয়ে রেখে মা কতটা স্বার্থপর আচরণ করছে সেটার সমালোচনাও আমরা করতে শুনি শোভনাকে। যে মা, সে তো কেবল নিজের সন্তানের কথা ভাববে না, অন্য মায়েদের কথাও ভাববে, এটাই বলতে চাইছিল শোভনা। মা যদি রাষ্ট্রের রূপান্তর হয়, তাহলে রাষ্ট্র তো শুধু ধনীর প্রতি সদয় হবে না, গরীবের দিকেও সে নজর দেবে। কিন্তু সেটা কি হচ্ছিল সে সময়? আমরা তো জানি, যুদ্ধের সময় অনেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস মজুদ করে ফেলে বিপুল মুনাফার লোভে। আর ওদিকে সঙ্কট আরো প্রকট হয়। শোভনাদের মত আরো অনেক পরিবারেরই তখন পথে বসার জোগাড় হয়। নলীনাক্ষ যখন ছাদে শোভনার কাছে বিদায় চায়, তখন যে করুণ সুরে শোভনা বলে, ‘এসো’, তাতে মনে হয় কণ্ঠটি এসেছে সেই সুদূর অন্ধকার থেকে। যে অন্ধকার যুগযুগ ধরে বিরাজ করছে, যে অন্ধকার থেকে শোভনাদের মুক্তির পথ যেন নেই, আছে শুধু ‘দারিদ্র, মালিন্য আর মৃত্যুর ভিড়।’

এই দারিদ্র আর মালিন্যের আরেকটি উদাহরণ মৃণাল হাজির করেন সমরেশ বসুর ‘স্মাগলার’ গল্পের বরাত দিয়ে। গল্পের সময়কাল ১৯৫৩ সাল। গৌরাঙ্গ গ্রামের দরিদ্র ঘরের এক কিশোর। গ্রামের আর্থসামাজিক কারণেই বাধ্য হয়ে চাল পাচার করে সংসারের খরচ জোগায় সে। পুলিশি পরিভাষায় সে হয় তো ‘স্মাগলার’, কিন্তু সামান্য কয়েক কেজি চাল এদিক সেদিক করেই অন্নের সংস্থান করতে হয় তাকে। গৌরাঙ্গের মাকে দেখা যায় পনেরো সের চাল একটি বস্তায় ভরে দিচ্ছে, আর ছেলেকে বলছে পুলিশের চোখ এড়িয়ে চলতে। যে মা ছেলেকে চুরির চাল বিক্রিতে পাঠায়, সেই মাকেই দেখা যায় মেয়েকে পুকুরে সাপের কামড় থেকে বাঁচাতে আগলে রাখে। বোঝাই যাচ্ছে মা যা করছেন বেঁচে থাকার তাগিদে, সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখার আকাক্সক্ষায়। তারপরও রাষ্ট্রের চোখে মা-ছেলে অপরাধী, অপরদিকে ধনীর চোখেও ছোটলোক।

 ট্রেন দৃশ্যে আমরা দেখি তথাকথিক শহুরে বাবুরা, যারা পাতি বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধি, গৌরাঙ্গের মত কিশোরদের ভালো চোখে দেখে না। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশে, যখন মাত্র কয়েক বছর আগে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কঠিন সেই সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একাংশ দুঃসাহসী হয়ে ওঠে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য। মৃণালের ভাষায়, ‘অনাহার ছাড়া আর কিছুকেই তারা ভয় পায় না।’ এমন বেপরোয়া সংস্কৃতিতে অনেকটা বিপন্ন বোধ করে মধ্যবিত্ত বাবুরা। ট্রেনের এক যাত্রী যখন অবিরাম খেয়েই চলে, তখন গৌরাঙ্গদের দলে থাকা ছেলেগুলো টিটকারি মারতে থাকে। এতে আরো ক্ষেপে যায় বাবুদের দল। শ্রেণির দ্বান্দ্বিক এই বহিঃপ্রকাশ থেকে এটাও বোঝা যায়- তাদের খাবার না আবার কেড়ে নেয় গরীব ছেলেগুলো- এমন এক অনুভূতি তাদের আরো বিপন্ন করে তোলে, সেজন্যই তাদের বলতে শোনা যায়, ‘ছেলেগুলো ভদ্রলোককে খেতে দেবে না দেখছি।’ এই বিপন্ন বোধ দূর করতেই দেখা যায় ডাকাবুকো লোকটি, যার নাম বিস্ময়, সে গৌরাঙ্গকে উত্তম মধ্যম দেয়। অন্য যাত্রীদের সামনে সে নিজের শরীরের প্রশংসাও করে, বলে তার শরীর না কি মেহনতির শরীর, খাটতে হয়! কি পরিহাস! চেহারা সুরত দেখে কিন্তু কোনভাবেই বিস্ময় বাবুকে মেহনতি বলে মনে হয় না। কিন্তু সে নিজেকে ওটা বলে পরিতৃপ্তি লাভ করে, এটাই মধ্যবিত্তের সঙ্কট। মধ্যবিত্ত নিজেকে গরীব ভাবতে ভালোবাসে, বিলাসী ভাবনা, কিন্তু গরীবকে সে অপছন্দ করে, কারণ সে নিজে সত্যিকার অর্থে গরীব নয়, ধনী হতে চায়। এমনকি ন্যূনতম সিগারেটের আগুনও সে দিতে চায় না গরীবকে।

 গৌরাঙ্গ সিগারেটের আগুন চাইলে এক যাত্রীর কাছে, সে যাত্রীর আঁতে ঘা লাগে, বিষয়টি বাবুদের অহমেও লাগে বৈকি। গৌরাঙ্গ একটি সিগারেটই ধরাতে চেয়েছিল, সেটা না পেয়ে নিজেই বিরবির করে কিছু একটা বলে। এতে আরো ক্ষিপ্ত হন বাবুরা, নির্দিষ্ট করে বললে বিস্ময় বাবু। কথায় কথায় তিনি গৌরাঙ্গকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ব্যাটাদের শুধু উঠতে বসতে লাথাতে হয়, শালা।’ গালি শুনে গৌরাঙ্গ গান ধরে, ‘যে বলে মুখে শালা, তার বোনেরে দেব মালা।’ ব্যাস মাথায় আগুন ধরে যায় বিস্ময় বাবুর। মধ্যবিত্ত অহমের সঙ্কট ও বিপন্নবোধ থেকেই বিস্ময় বাবু দরিদ্র ও দুর্বল গৌরাঙ্গের উপর চড়াও হন।

 অবশ্য প্রতিশোধ ঠিকই নেয় গৌরাঙ্গ। ট্রেন থেকে নামার সময় পা টেনে ধরে নিচে ফেলে দেয় লোকটিকে, এতে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় লোকটির দুই হাতে থাকা মিষ্টির হাড়ি; মিষ্টি নয়, মাটিতে যেন গড়াগড়ি যায় মধ্যবিত্তের অহম। এরপর দেখা যায় রেললাইনের দৃশ্য, গতিশীল দৃশ্য, লাইনগুলো পেছনের দিকে চলে যাচ্ছে। মৃণাল যেন বোঝাতে চাইছেন এই বৈষম্য, দুই লাইনের ফারাকের মতই, যুগযুগ ধরে বহমান। মৃণাল সেন যেমনটা প্রত্যাশা করেন, দর্শক ইন্টেলেকচুয়াল পারসেপশন ওরফে ‘চৈতন্য’ দিয়ে ছবিকে বিচার করবে, সেরকম বিচারে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক, ধনী-গরীবের দূরত্ব ঘুচছে না, বরং রেললাইনের মত সমান্তরালে বেড়েই চলেছে। এভাবেই শ্রেণীর তফাত নির্দেশ করে শেষ হয় গল্পটি।

 এর পরের কাহিনীটি ১৯৭১ সালের পরিপ্রেক্ষিতে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিজে যোগ করে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন মৃণাল। আগের অংশে গৌরাঙ্গ পেটের তাড়নায় স্মাগলিং করলেও, এই শেষ অংশে ব্যানার্জি কিন্তু আরো বড়লোক হওয়ার বাসনায় স্মাগলিং অর্থাৎ চোরা কারবারি করে। ‘কলকাতা ৭১’ ছবিটির এই শেষ অংশ শুরু হয় বুর্জোয়া ব্যানার্জি আয়োজিত এক পার্টিতে পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূর্ছনা দিয়ে। সেখানে নানা কিসিমের এলিট লোকেদের সমাবেশ হয়। সাধারণত যা হয়, এসব পার্টিতে সকলেই সকলের স্বার্থ সিদ্ধির কথা ভাবে, ঘনিষ্ঠতা লাভের চেষ্টা করে কোন প্রভাবশালীর। আবার কেউ বা নারীসঙ্গের লোভেও হাজির হয় এখানে। কেউ কেউ নিছক ব্যবসায়ের অংশীদার বলে উপস্থিত থাকে। উপরে উপরে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের সদ্ভাব থাকলেও, ভেতরে ভেতরে বিদ্বেষের চিত্রটিও দেখা যায় এই অংশে। বুর্জোয়া সমাজে উঁচু শ্রেণির যে সঙ্কট- গরীবকে শোষণ করতে তাদের বাধে না, আবার গরীবের জন্যই তারা কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে- সেটাও মৃণাল রাষ্ট্র করেন এই খণ্ডে। ব্যানার্জির এক কর্মচারীই বিষয়টি খোলাসা করেন। তিনি বলেন, তেতাল্লিশে দুর্ভিক্ষের সময় এক সওদাগরী অফিসে কাজ করতেন এই ব্যানার্জি। যুদ্ধের সময় বলে চুটিয়ে কালোবাজারি করে বিপুল সম্পদের মালিক হন তিনি। তাই সোয়াইন বা শুয়োর বলেও ব্যানার্জিকে গালি দেন তারই কর্মচারী।

 দুর্ভিক্ষের সময় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আটকে রেখে যে গরীব মানুষের সঙ্কটকে আরো প্রকট করে তুলেছিল, সেই ব্যানার্জিকেই দেখা যায় খাওয়ার টেবিলের সামনে তেতাল্লিশের মন্বন্তরের ছবি- মা ও শিশুর, যারা খাদ্যের অভাবে কঙ্কাল সাড় হয়ে গেছে- টাঙিয়ে রেখেছে। কেন? ব্যানার্জিকে নাকি এই ছবি চাবুকের অনুভূতি দেয়, একইরকম অনুভূতি তিনি অন্যদেরও দিতে চান, তিনি বলেন, পঞ্চাশ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। মদের গেলাস হাতে, বিলাসী ভবনে ফূর্তি করতে করতে এভাবেই কুমীরের কান্না করেন তিনি। এটা যে একটা ভণ্ডামি, সেটাই পাশ থেকে অন্য এক অতিথিকে বলছিলেন ব্যানার্জির সেই কর্মচারী।

 ভণ্ডামির আরো রূপ উন্মোচিত হয় বুর্জোয়া ব্যানার্জির। তাকে বলতে শোনা যায়, নতুন জাতির জন্ম হচ্ছে, তাই সেখানে নতুন সম্ভাবনা দেখেন তিনি। অথচ মৃণাল আমাদের দেখিয়ে দেন, নতুন জাতি কি জিনিস। ব্যানার্জির নতুন জাতি জন্ম নেয়ার কথা বলার পরপর দর্শক দেখতে পান একাধিক ক্ষুধার্ত বাচ্চার চিৎকার, গরীব নিরণ্ণ মানুষের ভিড়। গরীবদের অধিকার নিয়ে বেশ লম্ব চওড়া বক্তৃতা দিচ্ছিলেন ব্যানার্জি। অথচ নিজের কারখানার শ্রমিক সাড়ে বারো শতাংশ বোনাস চাইলে লকআউট করে দেন দুটো কারখানাই। পথে বসে যায় শ্রমিকরা। ব্যানার্জির মত লোকেরা দেশের আপামর সাধারণ জনগণের দুঃখ দুর্দশায় সহমর্মী হন না, বরং সেই অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নতুন সম্ভাবনার কথা ভাবেন, ব্যানার্জির সমগোত্রীয়রা সব জায়গা থেকেই ব্যবসায়িক লাভালাভের হিসেব ও নিজের আরাম আয়েশটাই খুঁজে নিতে চান। বাড়ির দেয়ালে শীর্ণকায়, ক্ষুধার্ত মায়ের ছবি টাঙানো থাক, আর বাস্তবেই সেই মায়েরা যতই কষ্টে থাকুক না কেন, ব্যানার্জিদের তাতে কিছু যায় আসে না। তারা মুখে মুখেই গরীবের বন্ধু সাজে, কিন্তু অন্তরে তাদের জমা থাকে ঘৃণা মিশ্রিত আতঙ্ক।

ছবির এই অংশে আমরা দেখি বাংলাদেশের জন্য অর্থ সংগ্রহের সময় গরীব মানুষ নয়, এলিট শ্রেণির স্বেচ্ছাসেবকদের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে গরমে আইসক্রিম খাওয়া। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হাজার হাজার গৃহহীন মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। সেসময় ভারতের অনেকেই নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে এসেছিলেন এই অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে। এদের মধ্যে মৃণাল সেনও ছিলেন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তুলে ধরেছেন লোকদেখানো সমাজসেবা করতে আসা এলিটদের। তাদের কাছে টিনের বাক্সে ঠনঠন করে পয়সা চাওয়াটা অস্বস্তিকর, কিন্তু অসহায় মানুষগুলোর জন্য চাদা তুলতে এসে আইসক্রিমের ভাবনায় ডুবে যাওয়াটা লজ্জাজনক নয়। এদেরকে লজ্জা দেয়ার জন্যই মৃণাল বাংলাদেশ থেকে যাওয়া নিরণ্ণ, অসহায়, শরণার্থীদের ছবি আর আইসক্রিম খাওয়ার কথাটি একসাথে চালিয়ে দেন, একবার নয়, বারবার। একদল মানুষ দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে দেশত্যাগ করে চরম প্রতিকূলতায় অবস্থান করছে, আরেকদল মানুষ এদের পাশে দাঁড়ানোকে কেবল ফ্যাশন হিসেবে গণ্য করছে, তারা ইতিহাসের এই বিপর্যয় বুঝতে তো পারেইনি, উল্টো বেহায়া, নির্লজ্জের মত রোদ, গরম আর আইসক্রিমের আলাপে মেতে ওঠে।

 মৃণাল এই ছবির মধ্য দিয়ে ধনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যে দ্বন্দ্ব হাজির করতে চেয়েছেন, সেটি বেশ তীক্ষ্ণ ও তীব্র আকারেই পেরেছেন। ব্যানার্জির পার্টি অন্ধকার করে পর্দায় যখন ভেসে আসে সেই মৃত যুবকের মুখ, তার রক্তাক্ত মুখম-ল, যখন সে বলতে শুরু করে কে তাকে মেরেছে সে জানে, কিন্তু বলবে না, যখন ঐ মৃত যুবক দর্শকদের উদ্দেশ্য করে বলে, আপনারাই খুঁজে বার করুন কে বা কারা মারছে তরুণদের, খুঁজতে গিয়ে কষ্ট পান, যন্ত্রণা পান, এতো নিষ্পৃহ থাকতে পারবেন না, এত নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন না, তখন মৃণালের ছবি প্রকৃত অর্থেই দ্বান্দ্বিক হয়ে ওঠে, দর্শকরা একধরনের নৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে যান। মৃণাল তো বলেছেন, শিল্পে শত্রুকে সরাসরি চিনিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট, মৃণাল মনে করেন ছবি দেখে দর্শক কানেক্ট করতে পারলেই হলো। দর্শকের সঙ্গে শিল্পীর বক্তব্যের সংযোগ ঘটাই আসল কথা। তাই যারা বুদ্ধিমান কিন্তু নিষ্ক্রিয় তাদের উদ্দেশ্যে মৃত যুবকের জবানে মৃণাল প্রশ্ন ছুড়ে দেন, ‘আচ্ছা এত নিশ্চিন্ত কেন আপনারা? এত নিষ্পৃহ কেন? এত অন্ধ কেন? এত জড় কেন? আপনারা এদেশের মানুষ না? আপনাদের ইচ্ছে করে না আমার এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর জন্য আপনারা যন্ত্রণা পান? ইচ্ছে হয় না ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যান? হতাশায় কষ্টে রাগে শরীর রিরি করে ওঠে?’

শোষণের অর্থনীতি, ঔপনিবেশিক মানসিকতা, দুর্বলের প্রতি সবলের অত্যাচার, সামাজিক ও মানবিক মর্যাদা আদায়ের লক্ষ্যে যে তরুণরা ষাট দশকের শেষভাগে জ্বলে উঠেছিল তাদের কেন বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে? কেন ঔপনিবেশিক শোষণ ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছুটে আসা অসহায় মানুষগুলো বড়লোকদের করুণা আর উপহাসের পাত্র হবে? কেন মুনাফাখোরদের জন্য কিশোরদের চোরাচালানি করতে হবে? কেন ঝড়বাদলের রাতে মানুষ নিদেনপক্ষে একটু চোখ বুজতে পারবে না? কেন মা হয়ে সন্তানদের ‘অনৈতিক’ কাজে মা উৎসাহ দেবেন? কেনই বা ক্ষুধাক্লিষ্ট মায়ের কান্না বুর্জোয়াদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না? এসব প্রশ্নই মৃণাল ফিরিয়ে আনেন ‘কলকাতা ৭১’ চলচ্চিত্রের শেষ ভাগে, আর এও বুঝিয়ে দেন এসব প্রশ্ন যে করে, যে এসব শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাসে সমাপ্তি টানতে চায়, তারা শাসকদের হাতে বেঘোরে প্রাণ দেয়, যেমন ওই যুবকটি দিয়েছে, ময়দানের পশ্চিম দিকে। তবে প্রাণহীন হয়েও সে প্রশ্ন করতে ভোলে না, তাই মৃত্যুর পরও প্রশ্ন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘এই গ্লানি, এই অপমান, এই মৃত্যুর গভীর থেকে গুমড়ে গুমড়ে উঠছে একটা ভাষা, একটা প্রতিবাদ, যেন কৈফিয়ত তলব করছে, কতকাল, আর কতকাল?’

বস্তুত পক্ষে ‘ইনটারভিউ’ ছবিটির মতো এটিতেও মৃণাল হয়ে ওঠেন রাগ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ‘ইনটারভিউ’তে যেমন দোদুল্যমানতার ভেতরেই রাগটা দানা বেধে উঠছিল, সেখানে ঔপনিবেশিক মানসিকতাকে গুড়িয়ে ফেলার বাসনা ছিল, ‘কলকাতা ৭১’-এ সেই রাগটাই ধাবিত হয়েছে শ্রেণি বিভেদ, পাতি বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া শ্রেণির দিকে, এই রাগের জন্ম দারিদ্র ও বঞ্চনা থেকে। মৃণাল ‘কলকাতা ৭১’ নিয়ে বলছেন, “১৯৩৩ সালে cold cynicism। তার মধ্যে কি anger নেই? Anger আছে। Ferment করছে ভেতর থেকে। ১৯৪৩ সালে এসে দেখেছি একটা প্রচণ্ড anger এবং vengeance সমস্ত সামাজিক মূল্যবোধগুলি নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা ভাঙছে। কোথায় একটা প্রচণ্ড রাগ আছে যা আসছে সেই hunger থেকেই। এই রাগ কিন্তু definitely ১৯৩৩ সালের চেয়ে এক ধাপ ওপরে। ১৯৫৩ সালে যে ধহমবৎ দেখতে পাই তা অনেক বেশি creative। ১৯৫৩ সালের ছেলেরা চাল smuggle করছে, পুলিশের হাতে ধরা না পড়ার জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা, কায়দা-কানুন চালিয়ে যাচ্ছে। সেখানে রাগ অনেক বেশি creative। তারপর ৭১ সালে আমরা চেষ্টা করেছি, এতকাল ধরে হাজার বছর বা আরো বেশি সময় ধরে যারা poverty জিইয়ে রেখেছে যারা শোষণের কারবারি, যারা এই বঞ্চনাকে বাড়িয়ে তুলেছে তাদের expose করবার এবং যখন আমরা মনে করি এই class এর hypocrisy এবং তাদের এই stupidity একটা চূড়ান্ত চেহারা নিয়েছে তখন হঠাৎ ফিল্ম টিল্ম সব যেন ছিঁড়ে যায়। হঠাৎ সব অন্ধকার, চ্যাঁচামেচি, pandemonium, ভীষণ অন্ধকার।” (সেন ২০১৫: ৬১)

এই অন্ধকার নেমে আসার ভেতর দিয়ে রাগ যেন কিছুটা ধরে আসে। দ্রোহের আকাক্সক্ষা যেন এইখানটায় কিছুটা থমকে দাঁড়ায়। এবার মৃণাল সেন ক্ষাণিক ভাবতে চান, আত্মমূল্যায়ন করতে চান। কি এই রাগ বা ক্ষোভ? এর কারণ জানা থাকলেও মৃণাল অনুসন্ধান করতে চান ক্রোধ প্রকাশের ধরন ঠিক আছে কি না, কোন ভুল হচ্ছে না তো? ‘কলকাতা ৭১’-এ তিনি এই মূল্যায়ন করেননি, সেজন্য তিনি আলাদা ক্ষেত্র তৈরি করলেন এবং নাম দিলেন ‘পদাতিক’ (১৯৭৩)।

পলাতক বিপ্লব

‘পদাতিক’ ছবিতে কোথাও বলে না দিলেও বোঝা যায় এর মূল চরিত্র সুমিত একজন নকশালপন্থী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কর্মী। সে পুলিশের গাড়ি থেকে পালিয়ে যায়, পালানোর সময় দুই কমরেড গুলিতে মারা গেলেও তার কিছু হয়নি। গ্রেফতার ও গুলি থেকে বাঁচতে সুমিত তাই গা ঢাকা দিয়ে থাকে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে। কলেজ স্ট্রিটে শীলা মিত্র নামের এক অবাঙালি নারীর ফ্ল্যাটে এসে আশ্রয় নেয় সুমিত। এখানে অবস্থানকালে সুমিতের মনে নকশালপন্থী আন্দোলন ও এর কর্মপন্থা নিয়ে প্রশ্ন জাগতে থাকে। সংশয়গুলো লিখিত আকারে সে পাঠিয়ে দেয় দলের এক নেতার কাছে। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়। এই ভুল বোঝার সাথে যুক্ত হয় শীলা মিত্রের সঙ্গে সুমিতের সম্পর্ক গড়ে ওঠার ভ্রম। এসব নিয়ে যখন সুমিত মোটামুটি জেরবার, তখন অন্তিম শয্যায় মা তাকে দেখতে চাইছে এমন সংবাদ আসে। বাড়িতে গিয়ে সুমিত দেখে মা আর নেই। সুমিত যে পলাতাক সেটা কমবেশি সকলেরই জানা। তাই আলগোছে একজন পুলিশকে খবর দেয়। বাবা সুমিতকে বলে, পালিয়ে যেতে আর সাহসী হতে। সেখানে সুমিতের চেহারার উপর ফ্রিজ শট দিয়েই শেষ হয় ছবিটি। এটাই এই ছবির কাহিনী সংক্ষেপ।

‘পদাতিক’ শুরু হয় কলকাতার রাজনৈতিক অস্থিরতার দৃশ্য দিয়ে। পত্রিকা ছাপানোর দৃশ্যের উপর লেখা হতে থাকে রাজবন্দীদের মুক্তি প্রসঙ্গে, পরীক্ষায় গণটোকাটুকি, শ্রমিক ইউনিউনের আন্দোলন, গ্রেফতার, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দাবি ইত্যাদি প্রসঙ্গে। এতে বোঝা যায় পরিচালক পরিষ্কার বার্তা দিতে চাচ্ছেন, কোন প্রেক্ষাপটে এই ছবির কাহিনী তিনি বলবেন। তাঁর ‘কলকাতা ৭১’ ছবির সেই যুবকটির দেখাও মেলে এই ছবিতে। এ থেকে বোঝা যায় পরিচালক একটি যোগসূত্র তৈরি করতে চাইছেন, বলতে চাইছেন হাজার বছর ধরে পথ চলা যুবকটি কোন না কোনভাবে প্রাসঙ্গিক এই সুমিতের সময়ে, যে সময়ে বঞ্চিত কৃষকরা ভূমি সংস্কার আন্দোলনের ডাক দিয়ে, সামন্ত যুগের জমিদার ও জোতদারদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে। সেই বজ্রনির্ঘোষ তখন ছড়িয়ে পড়ছে ভারতের নানা প্রান্তে। আন্দোলিত করছে সুমিতের মতো যুবকদের।

ভারতে ১৮৫৭ সালের পর থেকে বহুবার সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছে, কিন্তু কোনবারই সেসব বিদ্রোহ সফল হয়নি। ব্রিটিশদের হটানোর জাতীয় মুক্তির সংগ্রামও হয়েছে বিপথগামী, অর্থাৎ এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বেগবান তো হয়ইনি, উল্টো শক্তিশালী হয়েছে পুঁজিপতি ও মুৎসুদ্দিরা। রাশিয়ায় বিপ্লব সম্পন্ন ও চীনে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম শুরু হয়ে গেলেও ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টি যেন সঠিক দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না ষাটের দশকে এসেও। তাই সেই পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, নতুন করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়, সশস্ত্র আন্দোলন, গঠিত হয় নতুন পার্টি, যা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) নামে আত্মপ্রকাশ করে। তারা বলতে থাকে ভারতের অন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলো দেশীয় বুর্জোয়া শাসকদের সঙ্গে আঁতাত করে ফেলেছে, এর ফলে তারা আর বুর্জোয়াদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে, জমিদার শ্রেণির সাম্রাজ্যবাদী প্রভু সেবার প্রতিবাদে ও কৃষকদের শোষণ বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারছে না।

১৯৬৯ সালে নতুন গঠিত সিপিআই (এম-এল) চাইলো মাও সেতুঙের পথ ধরে কৃষকদের সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে সারা ভারতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। নিজেদের কর্মসূচীতে তাই তারা ঘোষণা দিল, “ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে মাও সে-তুঙ-এর যুগে, যখন বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণ ধ্বংসের দিকে চলেছে এবং সমাজতন্ত্র বিশ্বব্যাপী জয়লাভের পথে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের বিপ্লব হচ্ছে সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ, যা চীনে সমাজতন্ত্র ও সর্বহারা একনায়কত্ব সংহত করেছে এবং যা চীনকে বিশ্ববিপ্লবের নির্ভরযোগ্য ঘাঁটি এলাকায় পরিণত করেছে। আমাদের বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে এমন এক সময়, যখন হচ্ছে গৌরবময় ও নির্ভুল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মহান নবম কংগ্রেস- ঐক্য ও জয়ের কংগ্রেস- আন্তর্জাতিক সর্বহারাকে প্রচ-ভাবে উদ্দীপিত করে তুলছে। এ বিপ্লব সংগঠিত হচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন চেয়ারম্যান মাও এবং ভাইস চেয়ারম্যান লিন পিয়াও-এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণিকে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার কাজে-সারা দুনিয়ার মানবজাতিকে সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে মুক্ত করে এই পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম কায়েম করার কাজে পরিচালিত করছে। আমরা আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণির এই মহান সৈন্যবাহিনীরই একটা অংশ।” (উদ্ধৃত, পাল ২০১৭: ২৭৯)

সিপিআই (এম-এল)-এর বাসনাকৃত জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিদেশী পুঁজির সকল ব্যাংক ও সংস্থাগুলোকে বাজেয়াপ্ত ও সাম্রাজ্যবাদী ঋণ নাকচ থেকে শুরু করে মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিপতিদের সংস্থা ও জমিদারদের মালিকানাধীন সমস্ত জমি বাজেয়াপ্ত করা, কৃষি, শিক্ষা, শিল্প ও শ্রমিকদের মান উন্নয়ন, জাতিতে জাতিতে বৈষম্য দূর সহ নানাবিধ কাজ করার অঙ্গীকার করে। এই কর্মকা- তারা করতে চেয়েছিল চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক সর্বহারা শ্রেণি ও নিপীড়িত জাতিসমূহের সাথে মৈত্রী গড়ে তোলার মাধ্যমে। এমন অঙ্গীকারের প্রতিই আকৃষ্ট হয়ে সেই ষাটের দশকের শেষভাগে দলটিতে সামিল হয়েছিল ‘পদাতিকে’র সুমিতের মতো অনেকে। জান বাজি রেখে সশস্ত্র আন্দোলন করে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল। যদিও তাদের পূর্ব প্রজন্ম বিষয়টিকে সাগ্রহে অনুমোদন করেনি। সুমিতের বাবা যেমন।

 আমরা দেখেছি, সুমিতের বাবা বলছেন, তিনিও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন, জেল খেটেছেন, লেনিনের বই পড়েছেন কিন্তু সুমিতদের মতো এমন দায়িদ্বজ্ঞানহীন ছিলেন না। একথা বলার অবশ্য সঙ্গত কারণ ছিল, কারণ দেখা যাচ্ছিল অসুস্থ মায়ের সেবা, রেশন তোলা, রান্নাবান্না করা, অফিস করা, সবই এক হাতে সামলে চলছিলেন সুমিতের বাবা। ছেলে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। ঘরে থাকে কি থাকে না। সুমিতের বাবা মনে করেন, সুমিতের নেতারা সব অন্ধকারে আছেন। চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সুমিতের নেতারা প্রজ্ঞাবান ছিলেন না। কমিউনিস্ট পার্টিকেই ইঙ্গিত করছিলেন তিনি। জাতিকে তখন পথ প্রদর্শন করতে পারেনি বলেই সুমিতের বাবার এই ক্ষোভ। সুমিতও তখন উল্টো রেগে গিয়ে বলে, যা বোঝো না সেটা নিয়ে কথা বলো না। তবে পিতা-পুত্রের এই বাহাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।

 সুমিতের পথ যে ভুল, সেটা সুমিতের কাছেই হয় তো পরিষ্কার হচ্ছিল ধীরে ধীরে। পার্টির সক্রিয় কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থেকে, অনেকটা নির্মোহ জায়গা থেকে বিচার করা শুরু করেছিল সুমিত। শুধু কলকাতা বা ভারতের প্রেক্ষাপট নয়, পরিচালক মৃণাল সেন আমাদের তখন ফেলে দিতে চাইছিলেন এমন এক বিশ্ব রাজনীতির ভেতর, যেখানে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রামী মানুষ ফুঁসে উঠছে। বৈষম্য ও দারিদ্র দূর করতে হবে, সাম্রাজ্যবাদ ঠেকাতে হবে, বুর্জোয়াদের শোষণ বন্ধ করতে হবে, সবই ঠিক আছে, কিন্তু এসব লক্ষ্য অর্জিত হবে কোন উপায়ে, সেটি নিয়েই দ্বন্দ্ব হাজির হয় সুমিতের মাঝে, পরিচালকও চান দর্শক ভাবুন বিষয়টি নিয়ে। তাই মৃণাল সেনের ছবি মাঝে মাঝে হয়ে ওঠে প্রবন্ধের মতো।

সুমিত নিজের ভাবনার জগতে টেনে নিয়ে যায় দর্শককে এবং শোনাতে থাকে শ্রেণি সম্পর্কে মাও সেতুঙের বিশ্লষণ। আমরা শুনি সুমিত আওড়াচ্ছে মাওকে: “আমাদের শত্রু কে? আমাদের বন্ধুই বা কে? বিপ্লবের ক্ষেত্রে এটাই হলো সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন। আমরা বারবার দেখেছি যে শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে হাত মিলাতে পারিনি বলেই অতীতের বহু সংগ্রাম ব্যর্থ হয়েছে। সংগ্রামী সংগঠনের প্রাথমিক দায়িত্ব জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। পথ বাতলে দেওয়া। কোন বিপ্লবই সফল হতে পারে না, যদি সংগ্রামী সংগঠন জনগণকে ভুল পথে নিয়ে যায়। প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারলে তবেই সংগ্রাম সফল হবে।”

এই ভাবনাটি মাও সেতুঙ তুলে ধরেছিলেন তাঁর ‘চীনা সমাজের শ্রেণী বিশ্লেষণ’ (১৯২৬) প্রবন্ধে। চীনের তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির ভেতর দুটি বিচ্যুতির বিরোধিতা করার জন্যই এই প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। তু-সিউয়ের নেতৃত্বে যে বিচ্যুতি ছিল, সেটি পরিচিতি পায় দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদ নামে, আর চাং কুও-থাওয়ের নেতৃত্বে থাকা অপর বিচ্যুতিকে ডাকা হতো বামপন্থী সুবিধাবাদ নামে। এই দুই দলই ভুলে যায় কৃষকদের কথা। মাও তাদের কৃষকদের ব্যাপারে সচেতন করতে চাইলেন, বললেন, চীনে কৃষকরাই মূল শক্তি। তারাই সর্বহারা শ্রেণির সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা, সবচেয়ে বড় মিত্র। চীনা বিপ্লবের মিত্র কে, সেটারই নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন চেয়ারম্যান মাও। উল্লিখিত প্রবন্ধেই মাও সেতুঙ বলেছিলেন, সেসময়ের জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি ছিল একটি দোদুল্যমান শ্রেণি, বিপ্লবের উত্তাল জোয়ারে তা বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং দক্ষিণপন্থী অংশ চলে যাবে সাম্রাজ্যবাদের সমর্থনে। জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি বলতে মাও বুঝিয়েছিলেন মাঝারি বুর্জোয়া শ্রেণিকে। “চীনা বিপ্লবের প্রতি তাদের মনোভাব পরিবর্তনশীল” (সেতুঙ ২০১৫: ২), বিদেশী পুঁজির আঘাত ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে অত্যাচার হলে এরা বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। আবার যখন দেশের সর্বহারা শ্রেণি ভয়ভীতির উর্ধ্বে উঠে বিপ্লবে ঝাপিয়ে পড়ে, সেখানে বিদেশের সর্বহারা গোষ্ঠীরও সমর্থন জুটে যায়, তখন সে বুঝতে পারে, বড় বুর্জোয়া হওয়ার পথে এ বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন এই শ্রেণি বিপ্লবের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে।

এখন প্রশ্ন হলো সুমিত কি তবে বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করা শীলা মিত্রের ছিমছাম ফ্ল্যাটে থেকে বড় বুর্জোয়া হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল? মৃণাল কেন তবে সুমিতকে ওভাবে ঝর্ণার জলে স্নানের দৃশ্যে দেখালেন, যেখানে আয়েশি জীবনযাপনকেই মনে পড়বে আপনার? কেনই বা বারবার শীলার কাছ থেকে কফির আমন্ত্রণ পাচ্ছিল সুমিত, যদিও প্রতিবারই সে চায়ের পেয়ালাকেই বেছে নিচ্ছিল? মাঝারি বুর্জোয়া শীলার কাছ থেকে কফির প্রস্তাব পাওয়া যেন শ্রেণি উত্তরণের ইঙ্গিতকেই উসকে দিচ্ছিল, চা থেকে কফি, বিপ্লবী থেকে বুর্জোয়া! এসব কারণেই কি সুমিত বিপ্লবের প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠছিল, না সত্যিই সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল?

নকশালবাড়িতে জমির মালিকানা কৃষকের হাতে আনার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিলম, সেটিকেই কাজে লাগিয়ে শ্রেণি শত্রু খতম করার নামে জোতদার, জমিদার থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশকে টার্গেট করে ছোট ছোট সশস্ত্র দল তৈরি করাকে অনেক ইতিহাসবিদই মনে করেন ভুল বা হঠকারী সিদ্ধান্ত ছিল। আর এর খেসারত দিতে হয়েছে অজস্র তরুণকে, ‘পদাতিকে’র শুরুতে গুলি খাওয়া সেই যুবকটির মতো।

ভারতের পণ্ডিত গৌতম ভদ্র এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, “শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত না-রাঙালে কমিউনিস্ট হওয়া যায় না, এই তত্ত্বটা একেবারেই চারু মজুমদারের অরিজিনাল কন্ট্রিবিউশন। মনে রাখতে হবে যে এই অবস্থানটা একেবারে তাত্ত্বিক, পার্টির মিটিঙে তাই বলা হত। খতম লাইনের বিরোধিতা করা মানে চারু মজুমদারের বিপ্লবী কর্তৃত্বের বিরোধিতা করা, ওই বিরোধিতা করে কমরেড পূর্ণ বা সুশীতল রায়চৌধুরীর মতো নেতাও unceremoniously বিতাড়িত হন। চিনে কাংসেনের মতো নেতারাও তত্ত্বটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারেননি। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন যে ‘খতম’ বা Annihilation মানে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করা, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেওয়া। গায়ে-গতরে নিকেশ করার ধারণা তাঁদের মাথায় আসেনি। তাই শ্রেণিশত্রুর রক্তে হাত রাঙানোর মন্ত্র বিপ্লবের নয়, বরং দ্রোহকালের ব্রত, সেই মন্ত্রেরই উচ্চারণ চারু মজুমদার ও সরোজ দত্ত করেছিলেন, তার মূল্যও তাঁরা দিয়েছেন, দিয়েছেন সমাজবদলের স্বপ্নে বিভোর অজস্র কর্মীরা।” (ভদ্র ২০১৭: ১৮৯)

তাহলে কি স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছিল চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্টের? সুমিতের কি তবে ‘সুমতি’ ফিরে আসছিল? সেটির উত্তর জানা না গেলেও সুমিতের মতিগতি ভালো ঠেকছিল না পার্টির লোকজনদের। সুমিতেরও আর ভালো লাগছিল না হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে। তাই আশ্রয়টি ছাড়তে মনোস্থির করে সুমিত। এর মধ্যে মৃত্যুশয্যায় মাকে দেখতে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি গেলে সে দেখে অনেক লোকের সমাগম। সে বুঝে নেয় মা পরলোকগকত হয়েছেন। বাবা তাকে আশ্বস্ত করে, বলে, সৎকারের কাজ তিনি একাই সামলাতে পারবেন। ছেলেকে চলে যেতে বলেন। এরই মাঝে পুলিশ খবর পেয়ে যায়। গাড়ি থামার শব্দ পাওয়া যায় দূর থেকে। সুমিত বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে বাবা যখন বলে, বন্ডে সই করতে বলেছিল, সই করিনি, সাহসী হও, তখন সুমিতের ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। এ যেন পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমর্থন পাওয়া। সুমিতের রাজনৈতিক অবস্থানকে এখানে যেন মেনে নিলেন বাবা। মাঝে এই দারিদ্র পীড়িত বাবাটিও জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। ধর্মঘটে যোগ দেন তিনি। এই আন্দোলন রুটি-রুজির জন্য। বেতন-ভাতা বৃদ্বির জন্য। শ্রমিক ছাটাইয়ের বিরুদ্ধে। শ্রমিক ঐক্যের আন্দোলন।

আন্দোলন যে একটা দরকার সেটা শেষ পর্যন্ত সুমিতের বাবাও বুঝতে পারেন। তবে সেটা কোন মত ও পথের সেটি কিন্তু সুনির্দিষ্ট করে দেয়া নেই। সুমিতকেও দেখা যায় না একটি নির্দিষ্ট দলের রাজনীতি করতে। আলামত দেখে যদিও বোঝা যায় সুমিত সিপিআই (এম-এল)-এর কর্মীই ছিল। নয় তো সেসময় কাদের ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছিল? নকশাল বাড়ির আন্দোলনকে সশস্ত্র উপায়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার চারু-ডাকে কারা সাড়া দিয়েছিল? এই দলটির তরুণরাই তো। তবে ‘পদাতিক’ ছবির শেষ পর্যন্ত একটি বিষয় জিইয়ে রাখা হয়, সেটি হলো আন্দোলন করেই টিকে থাকতে হবে, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ছবিটি প্রসঙ্গে মৃণাল বলছেন, “এ কথাই বলতে চেয়েছি, সত্যিকারের বামপন্থী আন্দোলনের প্রয়োজন আছে। এবং এই বামপন্থী আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আমরা বারবার দেখেছি, যেমন দেখেছি অপরাপর দেশেও, যে আমরা সব সময় secretarianism-এর বলি হয়ে দাঁড়াই, সব সময়েই আমরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। এবং বিচ্ছিন্নতা মানেই হচ্ছে শেষ পর্যন্ত সমস্ত ব্যাপারটা ধসে যায় এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরো চাগাড় দিয়ে ওঠে, আরও জোরদার হয়। ছবিতে তাই আমরা বলেছি প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে, বামপন্থী সংগ্রামী আন্দোলনকে জোরদার করতে গেলে, আমাদের বন্ধুদের বুঝতে হবে, বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং সমস্ত রকম secretarianism-এর বিরুদ্ধে সমস্ত রকম সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে সমস্ত রকম বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। এ কথাটাই আমরা বলার চেষ্টা করেছি পদাতিক-এ এবং এ প্রশ্নগুলিই আমাদের কাছে জরুরি হয়ে উঠেছিল।” (চৌধুরী ২০১৭: ১৩২)

কল্পিত পার্টির নেতাকে লেখা চিঠিতে তাই সুমিতকে বলতে শুনি, “ভারতবর্ষে আজ সর্বস্তরে বিপ্লবের প্রয়োজন। অন্ধকার, কুসংস্কার, দারিদ্র আর শোষণের বিরুদ্ধে, সমস্ত রকম আক্রমনের বিরুদ্ধে, নতুন সমাজ, নতুন মানুষ গড়ার কাজে। কিন্তু এই চূড়ান্ত লড়াইয়ে যদি কখনো আমরা ভুল করে বসি, অন্ধ আক্রোশে যদি বিপথগামী হই, বিভ্রান্তি আর বিচ্যুতির মধ্যে যদি তলিয়ে যাই তাহলে ইতিহাস আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না।”

সুমিতের ভাবনা সম্পর্কে মৃণাল উবাচ, “সে ভাবে-আমরা যেভাবে এগোচ্ছিলাম, যে ভাবে এগোচ্ছি সেটা বিচ্ছিন্নতার পথ, সে পথে আমরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি, জনসাধারণের সমর্থন আমরা পাচ্ছি না, জনসাধারণের সাহায্য-সহযোগিতা-সহানুভূতি আমরা পাচ্ছি না, জনগণকে যথেষ্ট সচেতন করে তুলতে পারছি না, এ পথ মারাত্মক হয়ে পড়ছে, ক্ষতিকারক হচ্ছে এবং এ ভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে, আরো জোরদার হয়ে উঠছে, এ পথে চললে আমরা শেষ হয়ে যাবো।” (মৃণাল ২০১৫: ৯৪)

সুমিতের লেখা চিঠিতে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতির কথা, আর মৃণালের দেয়া সাক্ষাৎকারে পথ মারাত্মক হয়ে পড়ার কথা থেকেই ঠাওর করা যায় কোন মত ও পথের কথা বোঝাতে চাইছেন পরিচালক। সবকিছু বলেও, কিছু না বলার নীতিতে চলেছেন তিনি। কারণ তিনি চাননি কোন দলের ভেতর গণ্ডীবদ্ধ করতে তাঁর ভাবনাকে, চলচ্চিত্রের বক্তব্যকে। মৃণালের বক্তব্য খুব পরিষ্কার: ক্ষুধা, দারিদ্র, শ্রমিকদের সঙ্কট, সর্বোপরী মানুষ যেন মানুষের মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে সেজন্য একটি শ্রেণীসংঘাত প্রয়োজন। এবং এই সংগ্রামে দলে দলে বিভক্ত হয়ে পড়লে লাভবান হবে মুনাফাখোর বুর্জোয়ারাই। শুধু স্থানীয় পর্যায়ে লড়াকু বন্ধুদের ঐক্য নয়, প্রয়োজন আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বেরও।

নিজের বক্তব্যের সমর্থনে তাই একদিকে তিনি কলকাতার মিছিলের সঙ্গে মিলিয়ে দেন ভিয়েতনাম, মোজাম্বিক ও আর্জেন্টিনার লড়াইকে। অন্যদিকে, তিনি প্রামাণ্যচিত্রের ঢঙে নারী মুক্তির প্রশ্নেও সামনে নিয়ে আসেন সামগ্রিক মুক্তির কথা। দর্শকের ভাবনাকে ঝাকি দিতে তিনি বড়লোক বাড়ির শিশুদের খাওয়ানোর জন্য বেবিফুডের বেশ তুলতুলে ও অভিজাত গন্ধের এক বিজ্ঞাপনের সাথে জুড়ে দেন উদ্বাস্তু-গরীব-ক্ষুধার্ত-জীর্ণ শিশুর মুখ। তিনি যেন দর্শকের চৈতন্যে প্রবেশ করিয়ে দিতে চান এই মেকি দুনিয়া গুড়িয়ে দেয়ার মন্ত্র, কারণ লাখলাখ মানুষকে দরিদ্র রেখে মানুষের প্রকৃত মুক্তি আসতে পারে না। তাই তিনি মনে করেন, শ্রেণির প্রশ্নকে মাথায় রেখেই সংগ্রাম করতে হবে। শুধু মিটিং বা মিছিল করে যে সমাজের পরিবর্তন ঘটবে না সেটা বুঝেই বোধহয় সুমিতের বাবা শেষ পর্যন্ত ছেলের রাজনীতিকে সমর্থন দেন।

‘পদাতিক’ ছবিটিকে তাই বলা যেতে পারে আত্মবিশ্লেষণ পূর্বক সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্রণা। তবে লক্ষ্য করার বিষয় ছবিটিতে ব্যক্তি যেভাবে ফুটে উঠেছে বা সাবজেক্ট হিসেবে এসেছে, জনগণ ঠিক ততোটাই গৌণ হয়ে রয়েছে বা নেই বললেই চলে। জনতার শক্তিকে এখানে বিষয় করা হয়নি। বরং সুমিতকে ও তার দলকে জনবিচ্ছিন্ন বলেই মনে হয়। তারা তাদের দলীয় কর্মকাণ্ডে কিভাবে জনগণের সমর্থন আদায় করবে সেই তরিকার কথা বলা হয়নি কোথাও। শুধু বলা হয়েছে জনগণকে ভুল পথে পরিচালিত করা চলবে না। আমার মনে হয় একজন পরিচালক যদি আরো বেশি কিছু দেখাতে চাইতেন সেটি অতিকথন হয়ে উঠত। বুদ্ধিমান দর্শকের জন্য ইশারাই যথেষ্ট।

শেষ কথা নয়

মৃণাল সেনের এই কলকাতা ত্রয়ীকে অনেকেই নানাদিক থেকে সমালোচনা করেছেন। তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমালোচনা করেছেন বলে মনে হয়েছে সোমেশ্বর ভৌমিক। তিনি বলছেন, “ভারতীয় ছবির জগতে তো বটেই, গোটা ভারতীয় শিল্পজগতের পরিপ্রেক্ষিতেই মৃণাল সেনের এই আন্তরিক মননশীলতার একটি ইতিহাস। তবে শ্রেণিসংগ্রামের বিপ্লবী রাজনীতি যে-শিল্পের উপজীব্য, শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নটি সেখানে প্রাধান্য পেতে বাধ্য। রাজনৈতিক শিল্পের জন্য উদারতা বা আন্তরিকতাই তো যথেষ্ট শর্ত নয়? আমাদের তো তাই মনে হয়, দরদী হয়েও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নে মৃণাল সেন যথেষ্ট সতর্ক হননি। কিংবা, কে বলতে পারে, হয়তো অতি সতর্কতাই সমস্ত গ-গোলের মূল? কোন দলীয় রাজনীতির মুখপাত্র হতে চাননি পরিচালক। কিন্তু সেই অজুহাতে সঠিক শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিকেই এড়িয়ে গিয়ে মধ্যবিত্ত-অভিজ্ঞতাকে করেছেন বিপ্লব-মূল্যায়নের নিরিখ! ফলে বিপ্লবী আন্দোলনের চরিত্র নির্ধারণেই থেকে গেছে মারাত্মক ত্রুটি। ছবিগুলো পৌঁছতে পারেনি পরিচালকের অভিপ্রেত লক্ষ্যে।” (ভৌমিক ২০১৬: ২০৯)

মৃণাল সেন মানব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যে শোষণ, বঞ্চনা ও দারিদ্রের ক্রম বর্ধমান রূপ দেখিয়েছেন এবং সেখান থেকে উদ্ধারকল্পে যে ক্রোধকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেই রাগ বা ক্রোধকে সোমেশ্বর ভৌমিক সঠিক রাজনীতির ভাষায় অনুবাদ করে বলতে চান “বিশুদ্ধ অ্যানার্কিস্ট রাগ”। ‘ইনটারভিউ’তে রণজিতের রাগ, ‘কলকাতা ৭১’ ছবিতে হাজার বছর ধরে হাঁটা এক যুবকের রাগ ও ‘পদাতিক’ ছবিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তরিকা নিয়ে সুমিতের রাগ, এগুলোর মধ্যে ক্রোধান্ধ নৈরাজ্য, মধ্যবিত্তের নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য হীনতাকেই আবিষ্কার করেন সোমেশ্বর। যদিও নৈরাজ্য, শ্রেণি হিসেবে মধ্যবিত্তের মনোভঙ্গি ও বিপ্লবী রাজনীতি আসলে কি জিনিস সেটি পরিষ্কার করেন না এই সমালোচক।

এই সমালোচনাকে বিবেচনায় নিয়েই আমরা বলতে চাই, বিদ্যমান সকল অনিয়ম ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে রণজিতের মতো ভাঙচুর, কিংবা হাজার বছরের স্বাক্ষী সেই যুবকের সর্বোচ্চ প্রতিবাদ ও প্রাণদান, অথবা সুমিতের মতো পলাতক বিপ্লবীর আত্মসমালোচনা ইতিহাসেরই কোন না কোন কালপর্বকে ধরার প্রয়াস পায়। এসব রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-আত্মত্যাগ-দ্রোহ তো বিপ্লবেরই উপাদান। এটা তো ঠিকই শ্রেণির উর্ধ্বে উঠে মৃণাল ছবিগুলোতে গল্প বলতে পারেননি, প্রশ্ন হলো তিনি সেটা চেয়েছেন কি? মধ্যবিত্তের বয়ানেই তিনি রণজিৎ, যুবক ও সুমিতের কথা আমাদের বলতে চেয়েছেন। এবং সেটাতে তিনি সফল। তিনি মনে করেন বাম আন্দোলন ভীষণ প্রয়োজন, আবার তিনি মনে করেন লেফট এসটাবলিশমেন্টের শিকার হওয়া যাবে না। মৃণাল মনে করেন, বামপন্থীদের ভেতর সকল ধরনের বিভাজন ও সংকীর্ণতা দূর হওয়া দরকার। এই বিশ্বাস থেকেই মৃণাল বলার চেষ্টা করেছেন রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-আত্মত্যাগ-দ্রোহের কথা, ব্যক্তি পর্যায় থেকে দল পর্যন্ত তিনি দেখাতে চেয়েছেন কি করে ব্যক্তি বঞ্চনার শিকার হলে প্রতিক্রিয়া করে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বঞ্চনার বোধকে আবিষ্কার করতে পারলে সেটার বহিঃপ্রকাশ কেমন হয়, আর জনগণকে সঠিক পথ ও মতকে থেকে বঞ্চিত করলে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে থাকা একজন কর্মীরই বা কোন ধরনের ভাবনার উদয় হয়। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ জারি রাখার যে বার্তা আমরা পাই, আমার মনে হয় সেটাই শেষ কথা। মৃণাল তাঁর যাপিত জীবনে যা কিছু অন্যায্য ও অন্যায় বলে ঠাওরেছেন, সেটার জবাব শৈল্পিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছেন এই রাজনৈতিক ত্রয়ীতে। এখানে নৈরাজ্য হয় তো আছে, প্রশ্ন হলো কোন বিপ্লব শতভাগ নৈরাজ্য বিবর্জিত? মধ্যবিত্তের দৃষ্টিভঙ্গিও আছে, প্রশ্ন হলো বিপ্লব কি মধ্যবিত্তকে বাদ দিয়ে হয়? কাজেই সবকিছু মিলিয়ে আমরা বলতে চাই, মৃণাল তাঁর সময়ের সবচেয়ে বেশি পরিণত রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তিনি সিনেমার ভাষায় যেভাবে সমকালের সঙ্কটকে ব্যাঙের দৃষ্টি থেকে পাখির দৃষ্টিতে পরিণত করে দেখাতে চেয়েছেন তা অতুলনীয়।

পুঁজি

১. মাও সে তুঙ, ২০১৫, নির্বাচিত রচনা, কলকাতা: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড।

২. মৃণাল সেন, ২০১৫, আমি ও আমার সিনেমা, বাণীশিল্প ২০১৫, কলকাতা।

৩. Bertolt Brecht, 1974, Brecht on Theatre (edited and translated by John Willett), London: Hill and Wang.

৪. গৌতম ভদ্র, ২০১৭, বিস্মরণের বিপরীতে, চর্চা (রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত নকশাল বাড়ি ক্রোড়পত্র), কলকাতা: তৃতীয় পরিসর প্রকাশনা।

৫. সোমেশ্বর ভৌমিক, ২০১৬, রাজনীতি, সিনেমা এবং মৃণাল সেন, বিভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত চলচ্চিত্র চর্চা (প্রসঙ্গ: মৃণাল বিশ্লেষণ মূল্যায়ন অন্বেষণ), সংখ্যা-২২, কলকাতা।

৬. সত্যজিৎ চৌধুরী, ২০১৭, মৃণাল সেন-এর পদাতিক, বিভাস মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত চলচ্চিত্র চর্চা (প্রসঙ্গ: মৃণাল সেন চলচ্চিত্র সমালোচনা), সংখ্যা-২৪, কলকাতা।

৭. মধুময় পাল (সম্পাদিত), ২০১৭, নকশালবাড়ি: বজ্রনির্ঘোষের আগুনগাথা (প্রথম খণ্ড), সহযোগী সম্পাদক অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা: দীপ প্রকাশন।

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন