সুমনকুমার দাশ
ভূমিকা
বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের তীক্ষ্ণধী-তাত্ত্বিক বাউল-পদকর্তা জালাল উদ্দীন খাঁ রচিত গান তাঁর স্বাতন্ত্র্যকে স্পষ্ট করে তুলেছে। অনেকের ধারণা, লালনের গানে যে-রকম নিগূঢ়তত্ত্বের ছাপ পাওয়া যায়, তেমনি জালালের গানেও একইরকম তত্ত্বই প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলায় বাউল-পরম্পরার ঐতিহ্য ধারণ করে জালাল তাঁর রচিত গানগুলো নানা তত্ত্বনামে চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে আত্মতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, সংসারতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, সাধনতত্ত্ব উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও তাঁর রচিত বেশকিছু বিচ্ছেদ ও গণসংগীত পর্যায়ের গান রয়েছে; সেসব গানেও জালালের স্বকীয়তা লক্ষণীয়।
আবহমান কালের লোকায়ত বাউল-দর্শনের সার্থক উত্তরসূরি জালাল উদ্দীন খাঁ। তাঁর স্বজেলা নেত্রকোনার পূর্বসূরি বাউলসাধক রশিদ উদ্দিন, উকিল মুনশি, চান খাঁ পাঠান, দীন শরৎ-দের সহযাত্রী হয়ে বাউল-মতবাদের ধারাটিকে আজীবন সজীব ও প্রাণবন্ত রেখেছেন। তবে তাঁদের সহযাত্রী হিসেবে থেকেও যেন তিনি একটু আলাদা, একটু ব্যতিক্রম। সেটা কেবল জালালের জীবনাচার ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই নয়, তা তাঁর সরস পদাবলি রচনার জন্যও বটে।
জালালের গানের গাঁথুনি ও কাব্যভাবনা বাউল-দর্শন চর্চার এক অপূর্ব নজির বলা যেতে পারে।
২
জালাল উদ্দীন খাঁর জীবন-কাহিনিও কিন্তু কম আকর্ষণীয় নয়। তাঁর সম্পর্কে কিছু লোকশ্রুতিও প্রচলিত রয়েছে। তাঁর অষ্টম পূর্বপুরুষ ছিলেন হিন্দু ব্রাহ্মণ, তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা ছিল অন্তত ‘দেড় ডজন’। তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায় জালাল-জীবনীকার আজিজুল হক চৌধুরীর বয়ানে। তিনি জানিয়েছিলেন, জালাল মারা যাওয়ার পর যথারীতি ইসলামি রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে পিতাকে বাড়ি
থেকে কিছুটা দূরে একটি রাস্তার পাশে দাফন করেন। জালালের মৃত্যুর পর দেশের নানা প্রান্ত থেকে তাঁর হাজারো শিষ্য-অনুরাগীরা ভিড় জমাতে শুরু করেন। দাফন সম্পন্ন হওয়ার পরও এসব শিষ্যের দাবি—জালালকে নিজ বাড়ির আঙিনায় আমগাছের নিচে পুনরায় কবর দিতে হবে। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী এটি একেবারেই শরিয়তবিরোধী জানিয়ে জালালের পরিবারের পক্ষ থেকে দাবির বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া হয়। কিন্তু শিষ্য-অনুরাগীরা তাঁদের দাবির পক্ষে অনড় থাকেন। ধীরে ধীরে ‘নেংটিপরা জটাধারী’ সাধকদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। এভাবে চারদিন কেটে যাওয়ার পর পঞ্চম দিন বিক্ষুব্ধ জালাল-অনুসারীরা গুরুর মরদেহ কবর থেকে তুলে বাড়ির আঙিনায় জালালের সাধনার বৈঠকখানার পাশের আমগাছের নিচে সমাধিস্থ করেন।
উপর্যুক্ত ঘটনাটি জালালের ভক্ত-অনুসারীদের আবেগকেই চিহ্নিত করে। তবে এও ঠিক যে, জালালের যেমন এ-ধরনের অসংখ্য শিষ্য- ভক্ত রয়েছে, তেমনি তাঁর মতবাদবিরোধী মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবে জালাল কখনোই তাঁর প্রতিপক্ষের আস্ফালনকে আমল দেননি। বরং সমাজের নিম্নবর্ণের হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে ‘নয়া মানবতাবাদ’ প্রতিষ্ঠায় সতত সচেষ্ট ছিলেন। শরিয়তপন্থী আলেমেরা জালালকে নানা অপবাদের মাধ্যমে তাঁর দর্শন-মতবাদের বিকাশ ও প্রসারে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালালেও তাতে সফলতা আসেনি।
একজন বাউলসাধক হিসেবে জালাল উদ্দীন খাঁর পরিচিতি ভারতবর্ষের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সমভাবে পরিচিত ছিল। যোগাযোগ-দূরূহতা সত্ত্বেও তখনকার নাগরিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে জালালের বন্ধুত্ব তাঁর গানের প্রচার ও প্রসারে নবমাত্রা পেয়েছিল। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জয়দেবের কেন্দুলির বাউলদের বার্ষিক মেলায় যোগদানের আহ্বান জানিয়ে জালালের কাছে কলকাতার পূর্ণেন্দুপ্রসাদ ভট্টাচার্যের চিঠি কিংবা সুরকার-শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের সঙ্গে পত্রযোগাযোগ উপর্যুক্ত কথার স্বপক্ষে প্রামাণ্য-নথি হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া যায়। এছাড়া বাউল-গবেষক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সখ্যও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে।
জালাল উদ্দীন খাঁ তাঁর পূর্বসূরি লালনের গানের ‘আট কুঠুরি নয় দরোজা’ পঙ্ক্তির যথোপযুক্ত বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন তাঁর সাধনকক্ষ নির্মাণকালে। জালাল লালনের সেই গানের শারীরিক আদলে আট কোণা ও চালবিশিষ্ট এবং নয়টি দরজা-জানালার সমন্বয়ে সাধন-ভজনের স্থানটি নির্মাণ করেছিলেন। পূর্বসূরির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং দেহতত্ত্বের অপূর্ব বিশ্লেষণই যেন তাঁর সাধনকক্ষের নকশায় পরিস্ফুস্ট হয়েছিল। জালালের যাপিত জীবনের এসব ঘটনায় তাঁর ব্যক্তি- মানসের ছাপ দৃষ্ট হয়। অর্থাৎ তাঁর পুরো জীবন-যাপনে ছিল একেবারেই বাউলসাধনার উপযোগী পরিবেশ।
৩
প্রকৃতপক্ষেই যদি কোনো বাউলসাধককে ‘বস্তুবাদী বাউল’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়োজন দেখা দেয় সেক্ষেত্রে জালাল উদ্দীন খাঁ অগ্রগণ্যদের একজন হিসেবে বিবেচিত হবেন। জালালের গানের পঙ্ক্তিতে বস্তুবাদী চেতনা ও দর্শনের অহরহ উদাহরণ মেলে। তাঁর বিখ্যাত ‘মানুষ থুইয়া খোদা ভজো, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে’ তো রীতিমতো আলোচিত ও বস্তুবাদী বাউল-দর্শনের প্রবাদতুল্য পক্তি হিসেবে ব্যাপক আলোচিত।
জালাল কখনোই প্রথাগত ধর্মবিশ্বাসীদের মতো কোরান-কেতাব কিংবা ধর্মীয় শাস্ত্রগ্রন্থ হিসেবে পরিচিত কোনো পুথি-পুস্তিকা বিবেচনায় নেননি। তাঁর মতে—শাস্ত্রগ্রন্থ-নির্ভর নয়, মানুষ ভজনাই পারে কেবল মানব-মুক্তির পথের সন্ধান দেখাতে। আর এটি সম্ভব হলে জাগতিক হানাহানি, বিদ্বেষ ও হিংসাকে দূরে ঠেলে মানবতাবাদী পৃথিবী গঠন সম্ভব। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, মানুষের মধ্যেই খোদার বসবাস। তাই সেজদা যদি দিতেই হয় তবে ‘নিরাকার সৃষ্টিকর্তা’-কে না-দিয়ে ‘সাকার’ মানুষকে দেওয়াই উত্তম। এ কারণেই জালাল স্বদর্পে ঘোষণা দেন—‘আমি আদি, আমি অন্ত’।
জালাল উদ্দীনের মতে, সৃষ্টিকর্তার ভাবনা কেবল একটা ঘোর। মানুষ যেমন ঘুমের সময় স্বপ্ন দেখে সবকিছু বাস্তব বলে ভেবে নেন, একইভাবে জেগে ওঠার পর স্বপ্নটাকে আর বাস্তব মনে হয় না। ঠিক একইভাবে সৃষ্টিকর্তার ভাবনাটাও একটা স্বপ্নের মতো ঘোর/নেশা বলে জালাল চিহ্নিত করেছেন। জালাল সরাসরি সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির কায়া হিসেবেই বিবেচনা করে থাকেন। তাই এক্ষেত্রে তাঁর ভাবনার সুস্পষ্ট উচ্চারণ :
আমি বিনে কে বা তুমি দয়াল সাঁই,
যদি আমি নাহি থাকি, তোমার জায়গা ভবে নাই ॥
যা করেছো আমায় নিয়ে, সৃষ্টিকে সৌন্দর্য দিয়ে,
প্রাণে-প্রাণে মিশে গিয়ে, মহা-প্রাণে করেছো ঠাঁই ॥
বিশ্ব-প্রাণের স্বরূপ-ছায়া, আমাতে তোমারই মায়া,
ছেড়ে দিলে এসব কায়া, তুমি বলতে কিছুই নাই ॥
তুমি যে অনন্ত অসীম, আমাতে হয়েছ সসীম,
কালী-কৃষ্ণ, করিম-রহিম কত নামে ডাকছি তাই ॥
যথায় বাগান তথায় কলি, যথা আগুন তথা ছালি,
কথা শুধু ভিন্ন বলি, আসলে এক বুঝতে পাই।
মস্ত বড়ো প্রেম শিখিয়ে, তুমি গেছো আমি হয়ে,
ভুলের জালে ঘেরাও দিয়ে, ঘুম পাড়ায়ে খেলছো লাই ॥
জালাল কয় সেই ঘুমে থেকে, ঘর পোড়া যায় স্বপ্নে দেখে,
গলা ভাঙছি ডেকে ডেকে, শক্তি নাই যে উঠে পালাই ॥
এ-রকম অসংখ্য বস্তুবাদী উচ্চারণ রয়েছে জালালের। যেমনটা বলেছেন ওই গানে : ‘আসল নামটি কী হয় তোমার, জানতে আমি জিজ্ঞাস করি/এক বিনে যার দুই মিলে না, সেই শব্দ কই বিশ্ব জুড়ি ॥/ফলে কিন্তু নাম নাই তোমার, ডাকছে মানুষ নানা প্রকার/তবে তুমি কেটা আবার, মিথ্যা নামের ছড়াছড়ি।।/[…]/আমাতে তোর কী অধিকার, আমি যে কেবলই আমার/এভাব-সেভাব স্বভাব আমার, স্বভাবেরই মরা মরি ॥/আমি গেলেই গেল সকল, জালাল কয় মোর নামটি কেবল/থাকবে বাকি, তুই রসাতল, ছুটবে যেদিন ধরাধরি ॥’
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব জালাল বিশ্বাস করতে নারাজ। সৃষ্টিকর্তার নামে-বেনামে যাবতীয় সত্তার যে-দিকটি জনসমাজে প্রচলিত রয়েছে, সেটা তিনি মানুষের অন্ধভক্তি হিসেবেই ভাবেন। জালালের প্রশ্ন, বাস্ত বেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব থাকলে তার সাকার-রূপ কিংবা শারীরিক উপস্থিতি কেন মানুষ টের পান না? জালাল যেমন প্রথাগত ঈশ্বর- ধারণায় বিশ্বাসী নন, তেমনি মৃত্যুর পর বেহেস্ত-দোজখ/স্বর্গ-নরক তত্ত্বেও তাঁর অবিশ্বাস রয়েছে।
৪
জালাল উদ্দীন তাঁর একটি গানে খোদাকে ‘গোপনের গোপন আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, যোগী-ঋষিরা শত সাধন-ভজন করেও খোদার আকৃতি স্বচক্ষে নিরূপণ করতে পারছেন না। মিছরির মধ্যে যে মিষ্টিজাত স্বাদ রয়েছে—সেটা সবাই জানে, তবে এ স্বাদের কোনো দৃশ্যমান উপলব্ধি না-থাকলেও অনুভব করা সম্ভব। অথচ সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন, এমন একটা কল্পনাপ্রসূত তথ্য প্রচারিত থাকলেও তার বিপরীতে কোনো অনুভব কিংবা উপলব্ধি কেন নেই—সেটা জালাল তাঁর গানে বিশ্লেষণ করে সৃষ্টিকর্তা-রহস্যের সমাধান টেনেছেন এভাবেই : ‘তোমার লীলা বোঝা যায় না, আমি নাহি তুমি বিনা/সকলই তোমার বাহানা, আমি কেবল কথন ॥’
জালাল উদ্দীন খাঁ বাউলসাধনার গূঢ়তত্ত্বকেন্দ্রিক অসংখ্য গান রচনা করে বাউল সম্প্রদায়ের কাছে অতুলনীয় সাধক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর গানের কাঠামো-বিন্যাস পুরোটাই বাউলতত্ত্ব নির্ভর। বাউলসাধনার কঠিন ও চিরায়ত পথ অনুসরণ করে জালাল ধাপে ধাপে আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব ও নিগূঢ়তত্ত্বের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করে তত্ত্বজ্ঞানী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর প্রচ্ছন্ন ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে জালালের গানের পঙ্ক্তিতেও। তাই সাধনপথের বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তাঁর গানের পরতে-পরতে পাওয়া যায়।
জালাল জানেন এবং বোঝেন ‘আশি লক্ষ যোনির শেষে’ তিনি যে মানবজীবন পেয়েছেন, সেটা সাধনায় সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেই ভবপারের বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব হবে না। তাই মন ঠিক রেখে সাধন-ভজনের জন্য তাঁর উদগ্রীব মনোভাব আমাদের অবাক করে না। জালাল জানাচ্ছেন, সাধনার জন্য ‘প্রাণ সঁপিয়া দেও গে গুরুর রাঙা পায়’। গুরুই কেবল উদ্ধারকর্তা হিসেবে কঠিন-বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দেশকের ভূমিকা পালন করতে পারেন।
‘ভুলে পড়ে’ যে সাধনহীন জীবন মানুষ যাপন করছেন, সেটা হচ্ছে ‘শমনজারির’ বড়ি/ঔষধ। তাই এমন ‘বিপাক’ এড়াতে ‘কামনদী’তে তরি বাইবার সময় ‘সাবধানী বৈঠা’ বাইতে হবে। তরি বাওয়াকালীন সামান্য এদিক-সেদিক হলেই ‘কামকুম্ভীর’ গ্রাস করে ফেলবে। একজন দক্ষ সাধক ‘কামনদী’তে সুনিপণ হাতে ‘দাঁড়’ টেনে চলেন। ‘কামনদী’তে যেসব মাঝিরূপী নতুন-সাধকেরা তরি বাইতে শুরু করেন, তাঁদের উদ্দেশে জালালের অভিজ্ঞতালব্ধ নিবেদন :
মাঝি বাইও নাইও তরি বেলা থাকতে দেই পাড়ি ॥
গলুই ভাঙা নিশান টাঙ্গা, ছয়জন নায়ের দাঁড়ি
যার-তার ভাবে ফেললে বৈঠা, হয় না আড়া-আড়ি ॥
সোনারগাঁইয়া বাইছা তোমরা বইছ সারি সারি
এমন সময় সাজে কিরে বৈঠা কাড়াকাড়ি?
সেই পারে মথুরার বাজার, প্রাণ বঁধুয়ার বাড়ি
উল্টা হাওয়ায় নাও লইয়া যায় মদনগঞ্জের খাড়ি ॥
পুরান তক্তা পুরান লোহা, গলুই দিছে ছাড়ি
ঝাঁকির চোটে পানি ওঠে, সিঞ্চ তাড়াতাড়ি ॥
সাধনপথে যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রাণায়াম অভ্যাসের পাশাপাশি রেচক-পূরক-কুম্ভক সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভের পাশাপাশি ‘ষট-চক্র-শোন-নিগূমেতে’ ধ্যান করা এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের উপায় বাতলে দিয়েছেন জালাল ‘সাধনতত্ত্ব’ পর্যায়ের তাঁর একাধিক গানে। তিনি মুর্শিদ-বাক্যকে দিগ্দর্শন যন্ত্র ধরে’ ‘সোজা’ রাস্তায় চলার পরামর্শ দিয়েছেন। সাধনপথের সঠিক নির্দেশনার সন্ধান কেবল গুরুই দিতে পারেন। তাই গুরুর প্রতি জালালের সর্বস্ব অর্পণের উচ্চারণ এমনটাই :
গুরু তোমার আশা করে ভাসিলাম এ ভাব-সাগরে
কূল দেও কি অকূলে রাখো, প্রাণ সঁপেছি আজ তোমারে ॥
তের-নদী সপ্ত-সাগর, জলের উপর ভাসে লহর মাঝখানে
এক বালুচর, কাছে গেলে ডাকাইতে মারে ॥
ঘোর অন্ধকার সকল সময়, কূল কোথায় নাহি নিৰ্ণয়
ফিরে এসে কেহই না কয়, কোথায় গিয়ে কিবা করে ॥
দেখে যাও আজ বিশ্ববাসী, জানি না আর কবে আসি
পৃথিবীর ওই কান্না-হাসি মুক্ত করলাম এক্কেবারে।।
জালালউদ্দীর ভাঙা নায়, আর একজন পার হতে চায়
সেই মানুষটি আছে কোথায়, ভাবুক বিনে জানে না রে ॥
সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি জালালের লেখা দেহতত্ত্ব বিষয়ক অসংখ্য রচনা রয়েছে। সেসব রচনায় দেহকেন্দ্রিক সাধনা ও দেহজ-প্রক্রিয়ার নানা উপমাসমৃদ্ধ বয়ান লক্ষ্যণীয়। মানুষের জন্ম-মৃত্যুর সারাসার এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রিয়াদির দুর্বল হতে থাকাসহ নানা ক্রিয়া-করণ ঠাঁই পেয়েছে ওই পর্যায়ের গানগুলোতে। যখন সময় আসে তখন শত অনুরোধ-উপরোধ করেও আত্মারূপী পাখিকে ‘মানবখাঁচা’-য় আটকে রাখা সম্ভব হয় না। ওই পাখি ঠিকই ‘পিঞ্জর’ ছেড়ে চলে যায়। এ প্রসঙ্গে জালালের হাহাকার ধরা পড়ে এ- রকমই : ‘তুই রে সাধনের পাখি তোমায় ডাকি/আঁখি মেলে দেখো না মোরে/সারা জীবন থাকো রে ও মন প্রেমের বাঁধন/কোনোদিনও যাইস না ছিঁড়ে ॥’
৫
‘সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী লোকায়ত মানবতাবাদ’ প্রতিষ্ঠায় জালাল উদ্দীন খাঁ আজীবন কাজ করে গেছেন। সাধনপথের এই সাধক ‘মানবধর্মের পতাকা’ ওড়াতে চেয়েছেন বিশ্বজুড়ে। জালাল প্রকৃতই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন, ‘মানুষ হইতে কয়জন পারে—/হাত পা নিয়া জন্ম নিলেই মানুষ বলে কয় না তারে ॥’ কেবল মানবকূলে জন্মগ্রহণ করলেই জীবনের পরম সার্থকতা লাভ করা সম্ভব নয়। মানবজন্মকে সাফল্যমণ্ডিত করতে হলে মানুষের জন্য অহর্নিশি ইতিবাচক কাজ করে যেতে হবে।
‘স্বার্থময় জগতে’ স্বকার্য উদ্ধার করতে মানুষের আকুলতা-প্রাণান্ত কর প্রচেষ্টা কখনোই মানব-কল্যাণের বার্তা বহন করে না। প্রকৃত মানুষ তিনিই যিনি নিরন্তর মানুষের কল্যাণে নিবেদিত রয়েছেন। যাঁর মধ্যে কোনো ধরনের হীনম্মন্যতা নেই, সাম্প্রদায়িকতা নেই, জাত- পাত-বর্ণ নিয়ে বিদ্বেষ নেই, শ্রেণিগত দ্বন্দ্ব-হিংসা নেই—জালাল সেসব মানুষদের ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ অভিধায় অভিহিত করেছেন। জালাল উদ্দীন খাঁর গান, তাঁর দর্শন, তাঁর মতবাদ সত্যিই মানুষ-বন্দনার এক অনুপম উদাহরণ।
সুমনকুমার দাশ
.
তথ্যসূত্র
যতীন সরকার (সম্পা.), জালালগীতিকা সমগ্র (ঢাকা : নন্দিত, ২০০৫)।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন