আশাপূর্ণা দেবী
ট্রেন থামার আগেই নিজের সাইট ব্যাগটা কাঁধে জম্পেস করে তুলে নিয়ে, আর সুদত্তার স্যুটকেসটাকে বাগিয়ে ধরে দরজার কাছে চলে এসেছিল প্রবাল সুদত্তাকে হাতের ইঙ্গিতে অনুগামিনী করে নিয়ে। থামা মাত্রই খালি হাতটা বাড়িয়ে সুদত্তাকে প্রায় হিঁচড়ে টেনে লাফিয়ে নেমে পড়ল।
টেনে নামানো ছাড়া উপায় কি? ট্রেন তো এখানে মাত্র এক মিনিট থামে। আর লাফানো ছাড়াই বা উপায় কি? প্ল্যাটফর্ম বলতে তো ট্রেনের দরজা থেকে অনেকটা নীচে এবড়ো—খেবড়ো খানিকটা জমি।
নামার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়িটা ঘসঘস করে বেরিয়ে গেল। সুদত্তা সেই দিকে একটু তাকিয়ে থেকে হাঁফ—ছাড়ার মতো একটা নিশ্বাস ফেলে বলে উঠল, বাবাঃ, এমন ভাবে টেনে নামালে যেন নারীহরণের নায়ক! এদিক ওদিক থেকে হৈ—চৈ করে লোক ছুটে এলে আশ্চর্য হতাম না।
আমি হতাম। প্রবাল কাঁধের ঝোলাটা আবার টেনে কাঁধের ওপর তুলে নিয়ে পা চালানো শুরু করে বলল, নারীহরণ হচ্ছে দেখে ছুটে আসবার মতো লোক ধারে—কাছে আছে বলে মনে হচ্ছে?
সত্যি, স্টেশন এত চুপচাপ কেন!
এক মিনিট স্টপেজের স্টেশনে কত জনসমাগম আশা কর?
আশা—টাসা কিছু করছি না। সুদত্তা বলল, ভাবনা করছি কতখানি হাঁটাবে। গাড়ি—টাড়ি পাওয়া যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না।
প্রবাল হাসল, এখনি ভয় ধরছে? একপা—ও তো হাঁটনি এখনো।
সুদত্তা রেগে উঠে বলল, হাঁটতে ভয় পাচ্ছি না কি আমি?
তবে?
তবে আবার কি? এখন এই দুপুর রোদে, সূর্যের দিকে মুখ করে হাঁটাটা খুব আরামদায়ক হবে কিনা সেটাই ভাবা হচ্ছে। কতটা রাস্তা কে জানে!
আমি তো জানি।
আহা, কতই জানো। নিজেই বলেছ দশ বছর পরে এই আসছ। সব কিছু মনে আছে যেন।
দশ বছরের বিরতিতে মামার বাড়ির রাস্তা ভুলে যাব?
ছেলেরা এ সব খুব তাড়াতাড়িই ভোলে।
ছেলেদের সম্পর্কে এমন জোরালো অভিজ্ঞতাটি কবে হল?
হিসেব দিতে হবে না কি?
নাঃ। প্রবাল কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তেমন সৌভাগ্য করে কি আর পৃথিবীতে এসেছি?
সুদত্তা ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে দেখে নিল। রোদ পড়ে প্রবালের ফর্সা মুখটা আরো ফর্সা লাগছে, কপালে ঘাম জমেছে ছোট ছোট ফোঁটায়।
সুদত্তা শাড়ির আঁচলটা টান—টান করে কোমরে এঁটে নিয়ে বলল, স্যুটকেসটা এবার আমায় দাও তো।
প্রবাল গম্ভীর ভাবে বলল, কেন? টাকা—কড়ি গহনা—পত্র অনেক আছে বুঝি?
তার মানে?
মানে তো সোজা। অন্যের হাতে রেখে স্বস্তি পাচ্ছ না।
পাচ্ছি না—ই তো। সুদত্তা রেগে রেগে বলল, ঝোঁক করে চলে তো এলাম, এখন এই ক’টা দিনই তোমার সঙ্গে আমার বনলে হয়। যা না তুমি।
চমৎকার! দোষটা আমারই হল তাহলে?
ওঃ বলতে চাও আমিই ঝগড়াটি?
আমি তো কিছুই বলতে চাইনি। নিঃশব্দেই যাচ্ছলাম। তুমিই—
বেশ নিজে খুব ভালো। সুদত্তা বলল, বীরপুরুষ তো এইটুকু রাস্তা এতটুকু একটা স্যুটকেস বয়েই ঘামতে শুরু করেছেন।
প্রবাল সুদত্তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে।
সুদত্তারও কপালে ঘাম জমে উঠেছে।
চুলের গোড়ায় গোড়ায় ভুরুর খাঁজে, চোখের কোলে।
সুদত্তার রং শ্যামলা, তবু রোদের আঁচে লালচে হয়ে উঠেছে।
প্রবালের ইচ্ছে হল পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘামটা মুছিয়ে দেয়। কিন্তু পাগল তো নয় প্রবাল, তাই এই দৌলতপুর হেন গণ্ডগ্রামের রাস্তার মাঝখানে এমন একটা অনাসৃষ্টি কাণ্ড করে বসে। ত্রিসীমানায় লোক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বটে, কিন্তু ভয়ঙ্কর কোন মুহূর্তে মাটি ফুঁড়েও মানুষ উঠে পড়ে এটা তো ঠিক। মমতাটুকু এখন তোলা থাক।
অতএব দুষ্ট বুদ্ধিকেই প্রশ্রয় দেওয়া যাক। স্যুটকেসটাকে একটু তুলে ধরে দুলিয়ে বলল, খুব এতটুকু অবশ্য নয়। ভেতরে ক’ডজন শাড়ি ভরা হয়েছে? ডজন তিন চার? না আরো বেশি?
ডজন তিন চার? আরো বেশি? কেন, আমি কি তোমার মামার বাড়ির দেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাস করতে এসেছি? ক’টা শাড়ির ভার এত ভার? সুদত্তা আচমকা প্রবালের হাত থেকে স্যুটকেসটায় হ্যাঁচকা টান মেরে মাটিতে নামিয়ে ফেলেই হি হি করে হেসে বলে ওঠে, এমা! কী বোকা! বয়ে নিয়ে যাবার দরকার কি ছিল? এটার তো চাকা রয়েছে। টেনে নিয়ে গেলেই তো হল।
প্রবাল ওর হেসে গড়ানো মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। সুদত্তার হাসিটা একেবারে মার—কাটারি। হাসিটা দেখলে মনে থাকে না সুদত্তা ফর্সা কি কালো, সুদত্তার চোখ দুটো বড় বড় ভাসা ভাসা না ছোট ছোট নাচুনে মার্কা।
কিন্তু সুদত্তার হাসিটি কি সুলভ? সুদত্তা এ যুগের তরুণীদের মতো ভুরু প্লাক করে না, তার নিজস্ব ধনুকাকৃতি ভুরুজোড়া প্রায় সর্বদাই উঁচিয়ে রেখে কথা বলে। তবু সুদত্তা কী অদ্ভুত আকর্ষণীয়া।
প্রবাল অবশ্য এই পরম সত্যটি প্রকাশ করে না, বরং সুদত্তাকে ক্ষেপিয়ে তার ভ্রুধনুটি আরো উৎক্ষিপ্ত করিয়ে মজা দেখে। এখন বেশ গম্ভীর গলায় বলল, চাকাটার সাহায্যে কি টেনে নিয়ে যাবার ভূমিকাটা পোষা কুকুরের ম্যাডাম!
পোষা কুকুরের!
হ্যাঁ। তা জানো না তুমি? স্যুটকেসের তলায় চাকা লাগানোর ফন্দীটা মাথায় আনা হয়েছিল কুকুরের কথা ভেবেই।
কে বলেছে তোমায় এমন অদ্ভুত কথা! ওটা বানানোর উদ্দেশ্য কুলির কথা না ভেবে নিজের ভার নিজে বইবার জন্যে। বুঝলেন মশাই।
ওটা তোমার ভুল ধারণা। প্রথম যখন ওটা হাটে—বাজারে ছড়াল, আডভার্টিজমেন্টের ছবি দেখেছিলে? নব—দম্পতি হনিমুন—এ যাচ্ছে প্রেমে ভাসতে ভাসতে, পিছনে পোষা কুকুর। আর তার পিছনে ঢাউশ এক স্যুটকেস চলেছে কুকুরের মুখে চেপে ধরা দড়ির টানে। তা নইলে হয়তো আর কারো টানে অন্য দিকে চলে যেতো।
কই, এমন ছবি আবার কবে দেখলে তুমি? আমি তো দেখিনি।
আহা সবই কি আর সবাই দেখতে পায়? চোখ সজাগ থাকা চাই।
সুদত্তা হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলে ওঠে, যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছ মানে? এটা হনিমুন অভিযান?
প্রবাল বলতে যাচ্ছিল, আহা সেই মনোরম অবস্থাটা ভাবলেই বা ক্ষতি কি। বলল না। বরং বলে উঠল, কী সর্বনাশ! এ কথা আবার কখন বললাম? বলেছি, যারা যায়, তাদের পক্ষে মালপত্র সামলাতে একটা পোষা কুকুর এসেনসিয়াল। আর তার কথা ভেবেই এই স্যুটকেসে চাকার আবিষ্কার। তবে যদি বল, যে কোন পোষ্যপ্রাণী হলেও কাজ চলে যায়, তাহলে অবশ্য—
এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, চাকা যে খুব মসৃণ ভাবে এগোতে পারছিল তা নয়। সুদত্তা থেমে পড়ে বলে, এই ভাবে ইয়ার্কি মারতে মারতে হাঁটলে পৌঁছতে ক’ঘণ্টা লাগবে খেয়াল আছে?
যতক্ষণ লাগে ততক্ষণটাই লাভ। গিয়ে পড়লেই তো সেই সমাজ সংসার সভ্যতা ভদ্রতা।
আহা, কী একেবারে সুখকর অবস্থা।…. সুদত্তা বলে ওঠে, তাই ভাবতে হবে ‘সমাজ সংসার মিছে সব’ এর নাম তোমার নব ফাল্গুন! মলয় বাতাসের বহর বটে! আর রোদের তাত জুন মাসকেও হার মানাচ্ছে।
প্রবাল ঘড়ি দেখল। বেলা দেড়টা। প্রখর রোদেরই সময়। আর পাড়াগাঁয়ের রোদের তাত বেশী। রাস্তা আর বেশী নেই, কিন্তু এটুকুও সত্যিই কষ্টকর।
হঠাৎ যেন ভুঁইফোঁড়ের মতো একটা সাইকেল বোঁ করে পাশ দিয়ে চলে গেল। আরোহীর জামার লাল রংটা বিদ্যুতের ঝিলিকের মতো চোখ ঝলসে দিয়ে।
সুদত্তা বলে উঠল, আরে সাইকেল—ফাইকেল আছে তাহলে তোমার মামার বাড়ির দেশে?
দেশটাকে ভাবছ কি? নেহাৎ একটা অসময়ে এসে পড়েছ তাই। ছেলেবেলায় যখন আসতাম, যথেষ্ট সমারোহময় অবস্থা দেখেছি। বড়মামার আবার একটা টমটম জাতীয় ঘোড়ার গাড়ি ছিল। তিনি তাতে চেপে রোগী দেখতে বেরোতেন।
আছেন এখনো তিনি?
কে বড়মামা? নাঃ। বড়মামা বিগত, মেজমামা সপরিবারে কানপুর—বাসী। ছোটমামা জাপানে গিয়ে সেখানেই সেটল করেছেন। বড়মামার ছেলেরা কলকাতায় থাকে।
ও মা, তবে তোমার মামার বাড়িতে আছে কে?
কেন, আমাদের সেই বিখ্যাত নেবুমাসী আছেন। যাঁর কথা শুনে আকৃষ্ট হয়ে তুমি দেখতে আসতে চাইলে।
সুদত্তার হঠাৎ মনে হল কাজটা বোকার মতো হয়ে গেছে। অথচ তখন ভীষণ আগ্রহ অনুভব করেছিল যখন প্রবালের কাছে শুনেছিল তার ছেলেবেলায় মামার বাড়ি মানেই ছিল নেবুমাসী। আর তাঁর নিতান্ত নির্বেদেই নাকি ক’দিনের জন্যে মামা বাড়ির দেশে যাচ্ছে প্রবাল।
নেবুমাসী নাকি বাল্যকালে এমন সুন্দরী ছিলেন যে হেতমপুরের না কোথাকার যেন রাজা সন্ধান পেয়ে ছেলের বৌ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নেবুমাসীর বাবা সে অফার নেননি। অবহেলায় ত্যাগ করেছিলেন। বলেছিলেন না কি রাজবাড়িতে মেয়ের বিয়ে দেওয়া আর মেয়েকে বেচে দেওয়া সমান। মেয়ে জামাই নিয়ে আমোদ আহ্লাদ হবে না, সাতজন্মে বাপের বাড়ি আসতে পাবে না। আমার একটা সন্তান, লোভে পড়ে বিসর্জন দেব?
তা এমন অহঙ্কারের কথা মানাতোও তাঁর মুখে। এই সারা দৌলতপুরটাই ছিল তাঁর অধিকারভুক্ত। বনেদী জমিদার। তৎপরে তিনি তখনকার কালে মেয়েকে প্রায় অরক্ষণীয়া করে তুলে বিয়ে দিয়েছিলেন এমন ঘটা করে যে নেবুমাসীর বিয়ের ঘটার গল্প দৌলতপুরের প্রায় একটা ঐতিহাসিক গল্প হয়ে থেকেছে অনেক কাল। প্রবালদের তো শুনে শুনেই মুখস্থ ছিল।
বলে বসেছিল সুদত্তা, আমি যাব তোমার সঙ্গে—।
কিন্তু সে উৎসাহ কি শুধুই ওই ঐতিহাসিক গল্পের আর সে গল্পের নায়িকাকে চাক্ষুষ দেখার আগ্রহে? তাহলে এখন হঠাৎ মনে হচ্ছে কেন কাজটা বোকার মতো হয়ে গেছে?… আর নিজেকে তলিয়ে দেখে মনে হচ্ছে কেন এই একটা ছুতোয় ছুটির ক’টা দিন প্রবালের সান্নিধ্যের আশাতেই তার এই ঝাঁপিয়ে পড়া। অবশ্য জেদটা আরো বেড়ে উঠেছিল প্রবালের প্রতিকূল বাণীতে।
সে যাবে শুনে প্রবাল তো প্রথমটা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল, তুমি যাবে? তাহলেই হয়েছে!
হয়েছে মানে? কি হয়েছে?
ব্যাপারটা অসম্ভব তাই বলছি।
অসম্ভবটা কিসে?
আরে বাবা সে একটা অজ পাড়া গাঁ। বেণুদা সেদিন বলেছে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না কলকাতার প্রায় নিকটবর্তী এখনও এমন জায়গা আছে, যেখানে সভ্যতার আলোক স্পর্শ করেনি।
সভ্যতার আলোকের দাহ তো জন্ম থেকেই অনুভব করছি, একটু অন্ধকারের শীতলতাই দেখা যাক না। আর তোমাদের সভ্যতা তো ক্রমশই পিছু হেঁটে হেঁটে আলোক থেকে অন্ধকারের দেওয়ালে গিয়ে ঠেকছে।
আহা এ সব তো পুঁথির বুলি, প্র্যাকটিক্যাল কথা হচ্ছে জায়গাটায় এখনো ইলেকট্রিসিটি যায়নি।
খুব বেশী তফাৎ মনে হচ্ছে কি? তোমার এই সাধের শহরে সেই ইলেকট্রিসিটির দাক্ষিণ্য কতক্ষণ?
তবু প্রবাল আরো কত কি বলেছিল, বাড়িটা ভীষণ পুরনো, কাজ করার লোকজন আছে কি নেই কে জানে ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটের মাথায় সুদত্তার এই প্রস্তাবটা তার কাছে পরম লোভনীয় মনে হলেও নিবৃত্ত করার বেশ খানিকটা চেষ্টা করেছিল প্রবাল। কারণ জানে তো এখনও পল্লী—সমাজ বস্তুটা একেবারে তিরোহিত হয়নি। ওর সঙ্গে সুদত্তাকে দেখলে—
কিন্তু প্রবাল যত নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছে সুদত্তার জেদ ততই প্রবল হয়ে উঠেছে। এটাই তার প্রকৃতি। ও বলেছে, তুমি ভাবছ অসুবিধেকে আমি ভয় খাই? যে কোন অবস্থার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে নেবার ক্ষমতা আমার আছে! শুধু নাম—করা শহর খুঁজে বেড়াতে যাব, নামী—দামী হোটেলে গিয়ে উঠব, গাড়ি চড়ে দ্রষ্টব্য দেখে বেড়াব, একে আমি বেড়ানোই বলি না। ছেলেবেলা থেকে এই নিয়ে মা বাবার সঙ্গে ঝগড়া হয় আমার। আমার ইচ্ছে হয় সেকালের মতো পায়ে হেঁটে পাহাড় ডিঙোই, গ্রামে গ্রামে যা—হোক তা—হোক করে ঘুরে বেড়াই। তবে তোমার যদি আমায় তোমার মামাবাড়িতে নিয়ে যাবার কোন বাধা থাকে তো আলাদা কথা।
এরপর আর ঠেকাবার চেষ্টা করা চলে না।
এবং সত্যিই যখন মা বাপের অনুমতি আদায় করে সুদত্তা প্রবালের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল, তখন অপূর্ব এক পুলক রসে মন কাণায় কাণায় ভরে উঠল।
সেই ভরা মনটাকে কি এখন ব্যাহত করবে প্রবাল সুদত্তাকে মনে করিয়ে দিয়ে যে, গ্রামে গ্রামে যেমন তেমন করে বেড়ানো রোদের আঁচ বাঁচিয়ে সম্ভব নয়।
বরং বলল, আশ্চর্য, দূরে দূরে অত ঝোপ—জঙ্গল দেখতে পাওয়া যাচ্ছে; অথচ রাস্তায় একটাও ছায়াশীতল বৃক্ষতল নেই যে তার তলায় তলায় হাঁটা যাবে। তোমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে।
সুদত্তা ভুরু তুলে বলল, শুধু আমার? কেন, আমিই বুঝি মোমের পুতুল? নিজেরও যে এদিকে শার্টের পিঠ ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ফ্লাস্কের জলটা ট্রেনেই ফুরনো হল।
আমি ভেবেছিলাম স্টেশনে অরেঞ্জ স্কোয়াশ জাতীয় কিছু একটা খেয়ে নেওয়া যাবে। এতদিনে কি আর এটুকু উন্নতি হয়নি? তা দেখছি—
ওদের কথার মাঝখানে আবারও হঠাৎ সেই লাল শার্ট—বাহী সাইকেলটা বোঁ করে ঘুরে এসে এদের কাছে দাঁড়াল।
সুদত্তা নীচু গলায় বলল, দুর্বৃত্ত বলে মনে হচ্ছে।
প্রবাল হাসল। তাকাল লাল শার্টের দিকে।
লাল শার্ট বলে উঠল, পলুদাদাবাবু তো?
হুঁ! তুমি কে?
আমি বাচ্চু! মণিরাম পালের নাতি।
আরে তাই নাকি? তা তুমি আমায় চিনলে কি করে?
বাচ্চু একটু আত্মতৃপ্তির মধুর হাসি হেসে বলল, অনুমানে।…..
ইস্টিশান মাস্টারের লোক গিয়ে বুড়ো দাদুকে খবর দিল, সে যাক! কথা পরে হবে। এখন রেকশোটায় চড়ে পড়ুন।
রেকশো! এই অভাবিত শব্দটি শুনে সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখল এরা, সত্যিই একটা সাইকেল রিকশা চলে আসছে স্টেশনের দিক থেকে।
প্রবাল বলল, এটিকে কোথায় পেলে হে?
আজ্ঞে দাদাবাবু ইস্টিশানের ওধার থেকে।
কই, আমি তো একখানার ছায়াও দেখতে পেলাম না।
ইদিকে আর কোথায় পাবেন দাদাবাবু? ইদিকটা তো ওঁচা দিক। ওই দোকখিন দৌলতপুরের দিকে যা কিছু বোলবোলা। উদিকে সিনেমা হল রয়েছে তো। ইলেকটিক এয়েচে।
সুদত্তা মুচকি হেসে নীচু গলায় বলল, শুনে প্রাণে ভরসা পাচ্ছ। দেখ তোমার আর আক্ষেপের কিছু নেই, সভ্যতার আলোক যথেষ্ট পরিমাণেই এসে পৌঁচেছে। সাইকেল রিকশায় উঠে পড়ল ওরা।
বাচ্চু রিকশাওলাটাকে বলল, নন্দদা, তুমি এগিয়ে যাও। আমি আসছি।
আর রিকশাওলাটা নিজের আসনে উঠে বসতে বসতে বলল, কাপড়ের আঁচলটা সাবটে নিল বৌদি, পুরাতন গাড়ি, পেরেক ফেরেক আচে।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
সুদত্তা বিরস গলায় বলল, বৌদি মানে?
বাঃ, আমি কি করে জানব? তুমিও যেখানে আমিও সেখানে।
ওর ভুল ভাঙাতে হবে কিনা?
প্রবাল নড়ে চড়ে বসল। সুদত্তার রাগ রাগ মুখের দিকে তাকাল। তারপর উদাস অবহেলার গলায় বলল, পৃথিবীতে কত লোক তো কত ভুল ধারণা নিয়ে জীবন কাটিয়ে ফেলছে, তখন তুচ্ছ এই নন্দদার এই ক্ষণিকের ভুলটুকু ভাঙল আর না ভাঙল তাতে ক্ষতি কী?
ক্ষণিকের মানে?
মানে আর কি! ও তো আমাদের লাহিড়ীবাড়ির দেউড়িতে পৌঁছে দিয়েই, আবার সেই ওর দোকখিন দৌলতপুরে ফিরে যাবে।
তাই বলে ও এই সব যাতা বলবে?
ওঃ যাতা! প্রবাল একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার অবশ্য তা মনে হয়নি। আচ্ছা দিচ্ছি ভুল ভাঙিয়ে। বলে গলাটা একটু বাড়িয়ে ডাক দিল, ওহে শুনছ, ও নন্দদা—
সুদত্তার এখন অস্বস্তি হল। কি না কি বলে বসবে কে জানে। বিশ্বাস নেই ওকে। তাড়াতাড়ি ওর পিঠে আঙুলের একটা খোঁচা দিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আচ্ছা থাক, আর হৈচৈতে দরকার নেই।
প্রবাল কান দিল না ওর কথায়, আবার ডাক দিল, ও নন্দদা!
সুদত্তা রীতিমত নার্ভাস হয়ে পড়ে। যা ছেলে, সুদত্তাকে জব্দ করতে হয়তো বলে বসবে, শোন, একে বৌদি বলায় ভীষণ চটে গেছেন। আসলে তো বৌদি নয়।
নাঃ ওই বিরক্তি দেখানোটা ঠিক হয়নি। ভাবল সুদত্তা, যাচ্ছি তো এক রিকশায় দিব্যি পাশাপাশি। পাড়াগাঁয়ের লোক, প্রকৃত সত্য উদঘাটনে আবার কি ভেবে বসবে কে জানে! ইস!
নন্দ ঘাড় ফিরিয়ে বলল, দাদাবাবু কিছু বলছেন?
হ্যাঁ বলছিই তো, না হলে ডাকব কেন? বলছি—
সুদত্তার বুক ঢিপ ঢিপ করে ওঠে। সুদত্তা জোর করে হালকা হবার চেষ্টা করে। আর তখনই শুনতে পায় প্রবালের গলা, বলছি দেশলাই আছে তোমার কাছে? আমারটা হঠাৎ ফুরিয়ে গেল।
দেশলাইটা বাড়িয়ে ধরে নন্দ বলল, থাকছেন তো ক’দিন?
ক’দিন আর কি? দিন চার পাঁচ।
নন্দ আস্তে আস্তে প্যাডেল করতে করতে পরিচিতের ভঙ্গীতে গ্রাম্য অন্তরঙ্গ সুরে বলল, থাকলে পাত্তেন দু—দশ দিন। জন মনিষ্যি তো আসে না। ওই ভগ্নো অট্টালিকেয় শুদু দুটো বুড়ো মনিষ্যি। আপনাকে পেয়ে বত্তে যাবে। … ক’দিন আগে শুনেচি আসতেচেন। বৌদির কতা শুনি নাই, তো ভালই হল। শহরের মেয়ে, গাঁ ঘর দেকুন একবার। তা এসে য্যাখোন পড়েচেন, বুড়ি সহজে ছাড়লে হয়।
বোঝা যাচ্ছে নন্দ একটু বাক্যবিলাসী। কিন্তু ব্যাপার তো বেশ ঘোরালো হয়ে উঠছে। প্রবাল ভয়ে আর সুদত্তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস করে না। নন্দকে থামানোর জন্যেই আলগা গলায় বলে, উপায় নেই। ছুটি নেই বেশী।
ওই তো—নন্দ দার্শনিক গলায় বলে, এই দুরন্তো যুগে এক তিল ছুটি তো নাই কারো। রাতদিন শুদু ছুটোছুটিই আচে। কে কার মুক চাইতে আসচে। দুদ্দশা শুদু জেবন ফুরিয়ে যাওয়া বুড়ো বুড়ি গুলানের। জেবনও নাই, মরণও নাই এই সসেমিরে আবস্থা।
তা ঠিক! প্রবাল নন্দর উৎস—মুখে পাথর চাপা দেয়, তা পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে?
কতক্ষণ আবার? নন্দর রেকশো রকেট গাড়ি!
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট মারে নন্দ এখন।
সুদত্তা তীক্ষ্ন গলায় বলল, ব্যাপারটা কী হচ্ছে?
‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ নয়। স্রেফ ভাগ্যচক্র।
কলকাতায় ফেরার ট্রেন কখন?…. সুদত্তার কণ্ঠে ছুরির ধার।
প্রবালের অমোঘ গলা, রাত তিনটেয়।
রিকশা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বল। ওয়েটিং রুমে বসে তাকব।
ওয়েটিং রুম! প্রবাল নিরীহ গলায় বলল, সেটা কি রকম দেখতে?
ওঃ! কেন মরতে আমি—
প্রবাল আসতে ওর হাতটা একটু ছুঁয়ে বলল, ওই একটা বোকা বুড়োর ভুল ধারণা নিয়ে এত উত্তেজিত হবার কি আছে?
আমার খুব খারাপ লাগছে।
মন থেকে ঝেড়ে ফেল। ওই নন্দ রিকশাওলা তো ক্ষণিকের ব্যাপার।
নিশ্চয় ও সক্কলকে গৌরব করে বলে বেড়াবে—
কী বলে বেড়াবে?
রাগ বাড়িও না। বুঝতে পারছ না যেন। বলে বেড়াবে শহর থেকে বৌদি এসেছে। আমি তাকে পৌঁছে দিয়ে এলাম—এই সব।
প্রবাল হঠাৎ হেসে ওঠে, কার কাছে বলে বেড়াবে? ওর সার্কেলে তো? তাতে তোমার কি এসে যাচ্ছে?
থাম! বেশ মজা দেখা হচ্ছে, না?
ঠিক ধরেছ তো! প্রবাল আবার হেসে ওঠে।
কাঁচা পাকা চুল নন্দ এই হাসির শব্দে একটু পাকা হাসি হাসে।… ভাবে নতুন বে, নতুন ভালোবাসা, এখন ফী কথায় হাসি।
সুদত্তা একটুক্ষণ গুম হয়ে থেকে হঠাৎ বলে উঠল, তুমি যে বলেছিলে তোমার ওই নেবুমাসি বালবিধবা?
বলেছিলাম তো, কিন্তু সেটা নাকচ করলাম কখন?
ওই নন্দ না কে যে বলল, দুই বুড়ো বুড়ি—
প্রবাল ঠাট্টার গলায় বলল, তাহলে দেখছ, হাঁদা নন্দ রিকশাওলা আর রিসার্চ স্টুডেন্ট সুদত্তা মুখার্জি একই ভুল করতে পারে। বুড়ো বুড়ি হলেই যে তাদের কর্তাগিন্নীই হতে হবে তার কী মানে? ঢ্যাঙাদাদু তো আসলে এই লাহিড়ী বংশেরই কেউ নয়।
সুদত্তার ভুরু উঁচিয়ে ওঠে, কী দাদু?
ওহো হো। ওটা একটা মজা।
নন্দকে আরও একবার নাড়া দিয়ে হেসে উঠল প্রবাল, বেচারী ভদ্রলোক একটু বেশী লম্বা বলে নেবুমাসি ওকে ঢ্যাঙা বলে ডাকতেন। আমরা ছোটরাও শুনে শুনে বলতাম ঢ্যাঙাদাদু। এখনও সেই অভ্যেসে—
একটা ঝাঁকুনি খেয়ে রিকশাটা থেমে যায়।
রাশিকৃত ভাঙা ইট—পাটকেলের বোঝা রাস্তা আটকে রেখেছে। আসলে একটা জঙ্গল—সদৃশ ব্যাপার।
বোঝা যাচ্ছে নন্দ বর্ণিত ‘ভগ্নো অট্টালিকা’র সামনের অংশটার স্মৃতিচিহ্ন ওই ইঁট—পাটকেলের স্তূপ। তারই খাঁজে খাঁজে গাছ গজিয়ে জঙ্গলের সৃষ্টি করেছে।
গাড়ি থেকে নেমে পড়ে নন্দ সবিনয়ে বলল, এখেনেই নামতে হবে দাদাবাবু। চাকা আর চলবে না।
প্রবাল বিপন্ন গলায় বলল, এটা কী ব্যাপার বল তো? এমন অবস্থা তো ছিল না।
কত দিন আসেন নাই?
প্রবাল সাল তারিখটা এড়িয়ে গিয়ে বলল, তা অনেক দিন। তখনো তো এই ঠাকুর দালানে—
অল্পে অল্পে ধসছিল। গেলবারের বন্যে বর্ষায় ভূমিস্যাং হয়েচে। এই দু’বছর ভেতর বাড়ির ঠাকুরঘরে নমো নমো করে পূজো হয়েছে।
প্রবাল আস্তে আস্তে ওই স্তূপ বাঁচিয়ে নেমে পড়ে সুদত্তাকে নামার সাহায্যকল্পে হাত বাড়াতে যাচ্ছিল সুদত্তা অপর দিক দিয়ে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়ে শাড়ির ধূলো ঝেড়ে নিল। এবং বেশ সতেজ ভাবে এবড়ো খেবড়ো ডিঙিয়ে এদিকে চলে এলো।
প্রবাল মনে মনে হেসে নন্দকেই উদ্দেশ্য করে বলল, পূজো এখনো হয়?
তা হয় দাদাবাবু। বুড়ির গোঁ। বলে বাপের বিষয়টি খাব বসে বসে আর বাপের কুলকম্মোটি পালব না?
হুঁ, তা করে কে?
নন্দর গলায় আবার দার্শনিকতার সুর, ও যাঁর কাজ তিনিই করিয়ে ন্যান। চেরকালের নোকেরা ঠিক ঠাক সময়ে আপন আপন কাজ করতে এসে যায়! তো আসেন, কলকেতা থেকে কেউ কেউ আসেন নেমন্তন্ন খেতে আসার মতন। এই যে ইদিক দিয়ে চলে আসুন। অ্যাখোন পাশদোরই সদর হয়েছে। আসুন, আমি এগুয়ে গিয়ে খপরটা দিইগে—
তুমি আগে প্রথম সম্ভাষণ করোগে যাও—সুদত্তা তার টান টান করে গোঁজা সিল্কের শাড়ির আঁচলটা আলগা করে ছেড়ে দিয়ে রুমালে ঘাড় গলা মুছে নিয়ে বলল, আমি এই বাইরের রকে আছি। তুমি আগে আমার সঠিক পরিচয়টা দিয়ে ডাকবে, তবে যাব।
কিন্তু অতখানি অবকাশ হতভাগ্য প্রবালকে দিচ্ছে কে?
সুদত্তার কথা শেষ হবার আগেই তো চাঁচাছোলা গলায় সোল্লাস বাণী উচ্চারণ করতে করতে বেরিয়ে এসেছেন বিখ্যাত নেবুমাসি।
কইরে পলা কোতায়? দেকি মুখখানা। বলি বে করেচিস তা এই বুড়িকে অ্যাকবার খপরও দিতে নেই?…. তা তোরই বা দোষ কী? টুনু চলে গ্যাচে, তা যাক সতীনক্ষ্মী হাতের নো সিঁতের সিঁদুর নে। অ্যাগে গ্যাচে, ভালই গ্যাছে। কিন্তু জামাই? তোর বাপ? তার কতা একটু মনে পড়ল না? … না কি অ্যাকোনকার মতন ‘লবম্যারেজ’ করেচিস? তাই—
পুরুষালী ধরণে হা হা করে হেসে ওঠেন নেবুমাসি। পোশাকী নাম যার শরদিন্দুনিভাননী। এ নামটা আবিষ্কার করেছিল প্রবাল কত যেন বয়েসে। দোতলার বড় ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো ফ্রেমে বাঁধানো একখানা জীর্ণপ্রায় কার্পেটের ছবিতে লতাপাতা মণ্ডিত বর্ডারের মধ্যে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘পতি পরম গুরু’। আর তার নীচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ‘শ্রীমতী শরদিন্দু—নিভাননীদেবী।’
বাবা রে, কত বড় একখানা নাম! প্রবাল লাফাতে লাফাতে নেমে এসে ওই নেবুমাসিকেই জিজ্ঞেস করেছিল, ওপরে ওই কার্পেটের ছবিটা কে করেছে গো নেবুমাসি? শ্রীমতী শরদিন্দুনিভাননী দেবী কে!
নেবুমাসি হেসে উঠেছিলেন হাহা করে। পুরুষালী ভঙ্গীতে। চিরকাল এক ধরণ। তারপর ডাক দিয়ে বলেছিলেন, অ টুনু, তোর ব্যাটার কথা শোন। আমায় শুদোচ্ছে কার্পেটের ছবিতে কার নাম! হ্যাঁ লা, এত কালেও ছেলেকে বলিসনি মাসির নামটা কি।
হ্যাঁ মাসিই বলেছিলেন কারণ শরদিন্দুনিভাননী প্রবালের নিজের মাসি নয়, মায়ের মাসি। তাও নিজের মাসি নয়, বোধ হয় জ্ঞাতি গোছের।
নেবু তো তাঁর মা বাপের সবেধন নীলমণি।
কিন্তু টুনুর জীবনে বাপের বাড়ি বলতে তো এই দৌলতপুরই। প্রবালদেরও তাই মামার বাড়ি বলতে এটাই। ছেলেবেলায় যখন আসত প্রবালরা, আরো অনেক সমবয়সী ছেলেমেয়ে দেখতে পেত, তাদের সঙ্গে কার কি সম্পর্ক সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রশ্ন ছিল না, খেলাটা উদ্দাম হত, সেটাই মজা।
তা ওই শরদিন্দুনিভাননী অপভ্রংশে ‘নেবু’ তিনিই ছিলেন সেই অপোগণ্ড বাহিনীর আশ্রয়স্থল। সম্পর্ক যার যা থাকুক, সবক’টাই ওই একই নামে ডাকত। তাদের মায়েরাও।
প্রবাল এই কথার তোড়ের মুখেই প্রণাম করে ফেলে বলে উঠল, তুমি তো দেখছি একটুও বদলাওনি নেবুমাসি। ঠিক যেমন ছিলে তেমনি আছো।
নেবুমাসি তেমনি হাহা করে হেসে উঠে সতেজ গলায় বললেন, বদলাবো কেন? ভদ্দরনোকের অ্যাক কতা। বুজলি? তা তুই মস্তান আসল কতাটি চেপে রেকে চিটি দিছলি কেন? নিকবি তো একা যাচ্চিনে, জোড়ে যাচ্ছি। মহারাণীর উপযুক্তো ব্যবস্তা করতাম। যাক যা করেচিস বেশ করেচিস, দেকাতে যে নিয়ে এলি এই ঢের। এসো ভাই, রাজরাণী হও।
সুদত্তা রুষ্ট মুখে একটা প্রণামের মতো করে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করছে দেখে প্রবাল মরীয়া হয়ে বলে উঠল, যা প্রাণ চায় বলে তো চলেছ, যা ভাবছ তা নয় বাবা! নাতবৌ দেখবার কপাল তোমার হয়নি এখনো। এ আমার সঙ্গে পড়ে, পাড়াগাঁ দেখাতে নিয়ে এসেছি।
অ! নেবুমাসি একটু দুষ্টু হাসি হেসে বলেন, বান্দবী? তা ওকেই আমরা হবু বৌ বলি। যাক এনে দেকিয়ে যাবার বুদ্দি হয়েছে তাও ভাল। সত্যি তো আর নেবুমাসি অমর বর নিয়ে পৃথিবীতে আসেনি। যখন বে করবি, তখন হয়তো থাকব না। এসো ভাই। পাড়াগেঁয়ে বুড়ির কতায় কিছু মনে কোরো না। অনেক দিন পরে ছেলেটাকে দেকে প্রাণে বড় আহ্লাদ হল তাই।….
হঠাৎ পাশের দিকে তাকিয়ে ধিক্কারের গলায় বলে উঠলেন নেবুমাসি, কী রে ঢ্যাঙা, তুই যে অমন সঙের মতন দাঁড়িয়ে রইলি? আয় ইদিকে? মুকচোরা লজ্জাবতী! চিরটাকাল অ্যাক রকমে গেল। তোদের ঢ্যাঙা দাদুকে কেমন দেকচিস রে পলা? হাড়বুড়ো হয়ে গেচে না?
ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন এখন। তাকিয়ে দেখল প্রবাল।
হাড়বুড়োর কোন লক্ষণ দেখল না। দিব্যি সোজা সতেজ ঋজুভঙ্গী। গড়নটা একহারা বলেই লম্বাত্বটা চোখে পড়ে। বিশেষের মধ্যে দেখল মাথা ভর্তি চুলগুলোর খাঁজে খাঁজে যে কালোর ছিটে ছিল, সেগুলো সব নির্মল শুভ্র হয়ে উঠে, মাথার ওপর একটা সাদা পশমের টুপির মতো বিরাজ করছে।
প্রবাল এখন সপ্রতিভ হবার চেষ্টা করছে, কারণ খুব গুরুতর একটা কাজ সে করে ফেলেছে, আর সুদত্তার কিছু বলার নেই। যদিও নেবুমাসির পরবর্তী কথাগুলো খুব স্বস্তিদায়ক নয়। তবু প্রবালকে তো আর দোষ দিতে পারবে না সুদত্তা।
তথাপি সুদত্তার দিকে না তাকিয়েই, সরোজমোহনকে, যিনি ঢ্যাঙা নামে অভিহিত, প্রণাম করে বলল, কই, আমি তো তা দেখছি না। দাদুও তো একই রকম রয়েছেন।
সরোজমোহন মৃদু হাস্যে বললেন, ওনার মতন লম্ফঝম্ফ করতে না পারলেই সে হাড়বুড়ো। তো বুড়ো হব নাই বা কেন? আশী বছর বয়েস তো হল।
সরোজমোহনের দাঁত বোধ হয় নতুন বাঁধানো, অতএব প্রকৃতির নিজস্ব মাধুর্যের সঙ্গে বাড়তি ও শুভ্রতার যোগ হয়ে হাসিটি শুভ্রমধুর।
কিন্তু নেবুমাসির তো বাঁধানো দাঁত নয়। নীচের দিকের একটা দাঁতের অনুপস্থিতির শূন্যতা তার প্রমাণ দিচ্ছে। সারি দিয়ে সাজানো এই মুক্তোর মতো দাঁতের পাটিকে এখনো অটুট রেখেছেন নেবুমাসি!
সুদত্তা দেখছিল। নাঃ, বয়েসকালে ছিলেন বটে একখানি।
আচ্ছা, চুলও তো এখনো বারো আনা অংশ কালো। রেশম মসৃণ ঈষৎ কোঁকড়ানো ওই চুলের গোছাও অবাক করে সুদত্তাকে। এই পরিবেশে, এই বয়েসে মহিলা নিশ্চয় চুলে কলপ দেননি। কে জানে বয়েস কত। ওই বুড়ো ভদ্রলোককে তো তুই তুই করছেন। কোন সম্পর্কে?
এতক্ষণের বিরক্ত বেজার মনটা হঠাৎ কৌতূহলী হয়ে উঠল। তাছাড়া আর প্রবালের ওপর রাগ রাখা উচিত নয়। ওর পক্ষে যথেষ্ট করেছে। আমাকেই ফ্রী হতে হবে। সুদত্তা এগিয়ে এসে সরোজমোহনকে প্রণাম করে উঠল, গাড়া—গাঁ আমার দেখা হয়নি কখনো, তাই চলে এলাম।
বেশ করেছ দিদি! নাম কি?
সুদত্তা। সুদত্তা মুখার্জি। বলেই দুষ্টু হাসি হেসে বলল, আপনার নাম তো জেনেই ফেললাম। ঢ্যাঙা। তাই না?
সরোজমোহন হেসে উঠলেন হো হো করে।
হাসল সকলেই। সুদত্তা আরো একবার ওই মুক্তোর সারি দেখে নিঃসংশয় হল। নাঃ, বাঁধানো নয়। বাস্তবিকই কালে রীতিমত রূপসী ছিলেন। কিন্তু জীবনের কী অপচয়! কী অপচয়!
হাসি থামিয়ে নেবুমাসি ঠোঁটে একটি অপরূপ ভঙ্গী করে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, এখন তো শুদু নাম জেনে ফেলেচ। রূপও দেখলে। এরপর গুণ বুঝবে।
ঢ্যাঙা অবলীলায় বললেন, তোর গুণ ছাপিয়ে চোখ অন্যত্র যাবার অবকাশ পেলে তো বুঝবে! বলি এদের এখানে দাঁড় করিয়ে রেখে শুধু বাকতাল্লা মারবি? এসো তো ভাই তোমরা। সুখীর মা, ভেতর বাড়ির নাইবার ঘরের চৌবাচ্চাটা চটপট ভরে দাও তো। আর তোমার সুখীকে ডেকে দিয়ে যাও, এই দিদিমণিকে কোথায় কি রাখবে দেখিয়ে দিতে।
ওঃ খুব হে কত্তব্যগ্যান! নোক দেকিয়ে আর বাহাদুরী দেকাতে আসিসনে ঢ্যাঙা। তোকে আর ও সব ব্যবস্তায় নাক গলাতে হবে না। … এসো ভাই আমার সঙ্গে …. ইয়ে, কি যেন নাম বললে?
সুদত্তা।
কী বললে? সু—
দত্তা। সুদত্তা।
সু—দ—ত্তা। তা এ নামের মানে কী রে পলা?
প্রবাল গম্ভীর গলা করে বলল, এ নিয়ে কোন দিন মাথা ঘামিয়ে দেখিনি।
শোনো কতা! যা বলে ডাকচি, তার মানেটা কি সেটা ভাবতে হবে না?
আবার কথা? ঢ্যাঙা তেড়ে ওঠেন, ছেলে মেয়ে দুটোকে হাত—মুখ ধুতে দিতে হবে না? চা—টা খাবে না? এখন পুঁথি খুলে বসল, নামের মানে কী? বলি তোর নামটারই বা মানে কি? বোঝা ওদের।
নেবু মাসি ঝঙ্কার দিয়ে হেসে উঠলেন, ওর আবার বোজবার কী আছে? নেবু মানে জানে না? তবে হ্যাঁ, কি নেবু, সেটা অ্যাকটা কতা! তা বাপু কাগজি নয়, গন্ধরাজ নয়, পাতিও নয়, একেবারে মোক্ষম মান—গোঁড়া নেবুই। টকের জ্বালায় ভূত পালায়।
নেবুই বুঝি তোর নাম? ঢ্যাঙা প্রায় খেঁকিয়েই উঠলেন, আসল নাম নেই?
আসল নাম!…. শোনো কতা! জম্মো গেল নেবু নামে, এখন আসল নামের খোঁজ। সে নাম তাঁবাদি হয়ে গ্যাচে।
সুদত্তা ঈষৎ হেসে বলল, তা কেন? আপনার আসল নাম আমি জানি। তার মানেও জানি। এখন প্রমাণও পেলাম যাঁরা নাম রেখেছিলেন, তাঁরা বাজে কথার মানুষ ছিলেন না।
ও বাবা, মেয়ের তো খুব কতার বাঁদুনি। চল বাছা, চল।
নেবু মাসি ওকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন, থমকাতে হল। বাইরে সাইকেলের কিড়িং কিড়িং শব্দ জানান দিল সেই লাল শার্টের আবির্ভাব ঘটল।
নেবুমাসি গলা তুলে বললেন, কে বাচ্চু? তা পেলি কিচু? না বিরিঞ্চি মুখপোড়া এখনো ঝাঁপ বন্দ করে ঘুম মারচিলো?
বাচ্চু ইঁট—পাটকেল বাঁচিয়ে সাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে এগিয়ে নিয়ে বাড়ির ভেতর উঠোনে ঢুকল। তার সাইকেলের দু’হ্যাণ্ডেলে দুটো বড় সড় মাটির হাঁড়ি ঝোলানো। আর পিছনে ক্যারিয়ারে একটা পদ্মপাতা ঢাকা চ্যাঙারি।
নামাবো কোথায় এগুলো?
নেবুমাসি চড়া গলায় বললেন, নতুন হসনে বাচ্চু! জুতো খোল,, দালানে ঢুকে যা। বেঞ্চের ওপর বসিয়ে রাক। রেকেই যেন বাইসাইকেল উড়িয়ে হাওয়া হয়ে যাসনে। চা হলে গিলে তবে যাবি।
বাচ্চু বলল, সে আপনি না বললেও থাকতাম। মিষ্টি—মাষ্টি এনে রাখলাম, কচুরি এখনো ভাজেনি। কড়া চাপা করিয়ে তবে এলাম। যাব আবার একটু বাদে।
প্রবাল এতক্ষণ উঠোনের চারধার ঘুরে ফিরে গাছপালা বেড়া ইঁদারাটা, বাড়ির ভগ্নদশা দেখছিল, এখন বলল, এত সবের কি দরকার? বাড়িতে কি রাক্ষস এসেছে? যা মাল তোমার ওই হ্যাণ্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়ে এলে তা তো দশ কুড়ি জনের মতো।
পোড়া কতা কসনে পলা। কলকেতয় থেকে থেকে খুব কলকেত্তাই হয়েচিস। কলকেতার নোক তো নিখাগী! ছাড় ও সব কায়দা। এই দৌলতপুরের ছানার জিলিপি কী ভালোই বাসতিস! মনে আচে—যকন তকন বলতিস, এত সব কুটনো তরকারি ভাত—ডাল করে কি হয় নেবুমাসি? শুদু ছানার জিলিপি খেয়ে থাকলেই তো হয়।
বলতাম বুঝি? প্রবাল হেসে ওঠে। এখন তো আমার ওই মিষ্টি—ফিষ্টি বেশী দেখলে ভয় লাগে।
তা নাগবে বৈ কি। শহুরে হয়েছিস তো! আচ্চা, আমার হাতে পড় না, দেখব অখন। সুখীর মা চায়ের জল চাপা। সু—সুদত্তা এসো ভাই। পলা, তোকেও কি দেকিয়ে দিতে হবে?
ঢ্যাঙা বললেন, তা হবে না? আগের মতো সব আছে? বারবাড়ি তো জবাব দিয়েছে। বাচ্চু দাদাবাবুকে নতুন দিকে টিউবওয়েলের ধারে নিয়ে যা।
বাড়ির বাইরের চেহারা দেখে ধারণা করা সম্ভব হয়নি ভিতরে এমন একখানি মনোরম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে।
দোতলায় বারান্দায় চায়ের আসরে এসে অবাক হয়ে গেল সুদত্তা। ইতিপূর্বে অবাক হয়েছে দোতলার চওড়া দালানের ধারের সারি সারি ঘর দেখে। বৃহৎ বৃহৎ শার্সি খড়খড়ি সম্বলিত জানালা দরজা বহুল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সব ঘর, তালা চাবি খুলে দেখিয়েছেন নেবুমাসি। চাবির গোছা অবশ্য সুখীর মা’র হাতে।
দরজায় দরজায় লাগানো ভারী তালাগুলো খুলে খুলে দেখাবার কাজটা তার। নেবুমাসি আছেন সঙ্গে সঙ্গে। ঘরে ঘরে পুরনো আমলের আসবাবপত্রও আছে অনেক।
এই সব ঘর দোরে আগে লোক ধরত না। একন মানুষ বিহনে পড়ে আচে। নেবুমাসি আক্ষেপের গলায় বলেন, কাকাদের ছেলেপুলে নাকি কলকেতায় অ্যাতোটুকুন ফেলাটে অ্যাতো অ্যাতো টাকা ভাড়া দে বাস করচে।
সুদত্তা ইতিমধ্যেই বেশ সহজ হয়ে উঠেছে। সে হেসে বলে, এই বাড়িটা যদি উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে কলকাতায় বসিয়ে ফেলতে পারতেন, কত লাখ টাকা যে দাম হত কে জানে। উঃ, ভাবা যায় না যে এক সময় এখানে লোক ধরত না।
সেই তো। নেবুমাসি বললেন, এ সব দেকে দেকে ভাবতে বসলে মনে হয় কত কাল পৃথিবীতে এয়েচি। নচেৎ—মনেও পড়ে না এতখানি বয়েস হল। ছোটকালে যখন শুনতুম কারুর আশী বছর বয়েস মনে হত ও বাবা! একনো বেঁচে আচে কী করে। হাটচে চলচে খাচ্চে দাচ্চে কেমন করে? এখন তাই ভেবে হাসি পায়। অনুমানে দেকি, সেই তো সক্কাল হলেই ওই বাঁশজাড়ের ওধার থেকে সূয্যি উঁকি মারে, সন্দেয় ওই দত্তবাড়ির চিলেকোটার পিছনে ডুব মারে, সেই তো বোশেকে বোশেকী ফুলে বাগান ভরে যায়, বর্ষায় কদম গাচে ফুল ধরে। শীতে গ্যাঁদা গাচ সোনা ঢালে। শীতের পর বসন্ত আর বসন্তর পর গ্রীষ্মি বর্ষা আসে।…. কোতা দিয়ে যে অ্যাতোগুলো দিন কেটে গেল ভগবান জানে।
সুদত্তা অবাক হয়ে তাকায়।
নেবুমাসির পরণে ধবধবে ফর্সা মিহি থান আর ধবধবে ফর্সা মিহি সেমিজ। নেবুমাসির ঈষৎ কোঁকড়া কাঁচা পাকা খাটো চুলের গোছা রেশমের মসৃণতা নিয়ে ছড়িয়ে আছে মুখের পাশে কাঁধে ঘাড়ে। আর নেবুমাসির চোখে অধুনা দুর্লভ সোনার ফ্রেমে বাঁধানো চশমা। নেবুমাসির কাঁচা হলুদ রঙা মুখে পাতলা টিকটিকে নাকের ওপর এই পুরনো স্টাইলের চশমাখানাই যেন ঠিক। এ ছাড়া আর কিছু মানাতো বলে মনে হচ্ছে না।
সুদত্তার হঠাৎ মনে হল, অভিজাত চেহারা বলে যে একটা শব্দ আছে, সেটার মানে পাচ্ছি। অথচ—
হ্যাঁ, অথচ একটা আছে। কথাবার্তায় তো স্রেফ গ্রাম্যভঙ্গী।
নইলে বাচ্চু নামের ছেলেটাকে খেতে দিয়ে—তুই শুদ্দু যদি আর দিও না আর দিও না করিস বাচ্চু তো তোর হাড় একঠাঁই মাস একঠাঁই করব।
বাচ্চু তার সামনে পদ্মপাতায় রক্ষিত একরাশ মুড়ির সঙ্গে বেশ কিছু কচুরি মিহিদানা ছানার জিলিপি আর গজার মুখোমুখি বসে করুণ স্বরে বলেছে, আমাদের বাপ ঠাকুদ্দার মতন খাবার ক্ষ্যামতা কি আর আছে ঠাকুমা? ঠাকুদ্দা তো শুনি আপনাদের পুরনো বাগানের ঢাকাই কাঁঠালের গাছের একটা আস্ত কাঁঠাল একাই খেত! সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। আপনি একদিন দিচ্ছেন তাই, নইলে আমাদের এ যুগে না খেয়ে খেয়ে পেটের খোলা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে।
নেবুমাসি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, সরোজমোহন বলে ওঠেন, সেই রাম অযোধ্যা যে আর নেই, এ কথা তোদের ঠাকুমা মানতে রাজী নয় রে বাচ্চু।
তবে আর কি, তুইও ওদের দেকাদেকি বলতে বোস আর দিও না অত দিও না। আজ আমার পলা এয়েচে, কত আল্লাদের দিন। আয় রে, তোরা বোস।
খালি খালি ঘরগুলো দেখে মনটা কেমন এক রকম বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগছিল সুদত্তার, এই চা খাবার বারান্দায় এসে যেন মনটা একটা আনন্দের স্বাদে ভরে গেল।
জীর্ণদশাগ্রস্ত হলেও জোড়া জোড়া থামের মধ্যে মধ্যে রেলিঙে লাইন ঘেরা মার্বেল মোড়া বারান্দাটা যেন একটা অপ্রত্যাশিত দৃশ্য।
চায়ের টেবিলও অভিনব। মাটিতে শতরঞ্জ পাতা, আর তার ওপরে কারুকার্য করা কাঠের পায়াদার পাথরের টপ বসানো নীচু নীচু চারটে চৌকী ঈষৎ দূরে দূরে। তার ওপরেই চা খাবার রক্ষিত।
সুদত্তা মোহিত কণ্ঠে বলে ওঠে, কী চমৎকার! চা খাবার জন্যে এমন সুন্দর জিনিস! দেখিনি কখনো।
নেবুমাসি হেসে ওঠেন, চা খাবার জন্যেই বটে! যে কালে এ সব বানানো হয়েচিল, তখন চায়ের পাট ছিল না কি? ছেলেদের পড়তে বসার জন্যে দশখানা করিয়ে রেকেছিলেন, বাবা বলতেন মাদুরে বই শেলেট রেকে ঘাড় গুঁজে বসে নেকাপড়া করলে পিটের শিরদাঁড়া বেঁকে যায়। এতে খাড়া থাকবে।
প্রবাল ঢ্যাঙা দাদুর সঙ্গে বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় কী আলোচনা করছে, তাকিয়ে দেখল সুদত্তা। পড়ন্ত বেলায় আলো পড়ে ঝকঝক করছে ওর মুখটা। হওয়াই স্বাভাবিক। রূপ আছে যৌবন আছে।
কিন্তু ওই বৃদ্ধের মুখটাও সে আলোয় এমন ঝকঝক করছে কী করে? যেন একটা অলৌকিক মাধুর্যের আভা এসে পড়েছে দুজনারই মুখে। কিসের আলোচনা হচ্ছে?
সুদত্তা বলল, আচ্ছা, এরা তো শুনছি মাঝে মাঝে মামার বাড়ি আসত, আর আপনি আপনার মা বাবার একমাত্র মেয়ে, তাহলে এত সব ছেলেমেয়ে কারা?
এই দ্যাকো, ‘মেয়ে’ আবার কখন বললাম গো। মেয়েরা বসবে শিরদাঁড়া খাড়া করে টুল নিয়ে পড়তে? ছেলে। সবই ছেলে। যত জ্ঞাতিগুষ্টির ছেলের পাল। বাবার আমার যে সদাব্রতর ব্রত। নিজের একটা মাত্তর সন্তান তাও মেয়ে সন্তান। কপাল—ক্রমে বাপের ঘর আগলে বসে আছি। নচেৎ তো পরঘরী হয়ে যাবার কতা। লাহিড়ী বংশের কুলপিদ্দিমদের মানুষ করতে হবে না? তাছাড়া আমার নিজের কাকা ছিল দুজন, তাদের ছেলেরা।… সবক’টাকে পড়িয়েছেন বাবা, সব মেয়েগুলোর বে দিয়েছেল। যেমন তেমন করেও দেননি, ঘটাপটাই করেচেন মোটামুটি। তবে কি আর আমার বে—র মতন?
পুরুষ দুজন রেলিঙের ধার ছেড়ে চায়ের সেই অভিনব টেবিলের ধারে বসেছে আসন পিঁড়ি হয়ে, শেষ সূর্যের আলো এসে পড়েছে একটা খিলেনের মধ্যে দিয়ে। সকলের মুখেই কনে দেখা আলো।
নেবুমাসির সেই শানানো গলা খানিকটা খাদে নামা। মুখে স্মৃতি রোমন্থনের পরিতৃপ্তির ছাপ।
বয়েস তখন দশ, জগৎপুরের রাজবাড়ি থেকে সম্বন্ধ এল। কোতা থেকে কার মুখে নাকি শুনেচে দৌলতপুরের লাহিড়ীবাড়িতে এক রূপের ধ্বজা মেয়ে আচে বে’র যুগ্যি—পাটিয়ে বসল ঘটকী। বাবা তাকে কুটুমের মতন আদর যত্ন করলেন, একজোড়া কাপড় আর সিদে দিয়ে বিদেয় দিলেন, কিন্তু বিয়ের মত দিলেন না। রাজবাড়িতে মেয়ে দেওয়া মানে মেয়েকে জন্মের শোদ বিলিয়ে দেওয়া। জামাই—মেয়ে নিয়ে আদর আহ্লাদ করতে পারব না, মেয়েকে ইচ্ছে মতন আনা নেওয়া করতে পারব না, একটা সন্তান, মায়ের প্রাণ বোধ মানচে না। মায়ের দোহাই—ই দিলেন ভদ্দরতার দায়ে।… ঘটকী না কি হেসে বলেছিল, তার মানে ঘরজামাই রাকতে মন? বাবা বলেছিলেন, তা ককখোনো না। ঘরজামাইয়ে আমার ছেদ্দা নেই। কথায় বলে, কালো বামুন কটা শুদ্দর বেঁটে মোছলমান, ঘরজামাই আর পুষ্যিপুত্তুর সবকটা সমান।
হঠাৎ ঢ্যাঙা বলে ওঠেন, তা আমিও তো কালো বামুন—আমাকেও ওই দলে ফেলছিস তো?
নেবুমাসি ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, তোর আবার বেশি বেশি বিনয় ঢ্যাঙা। তুই আবার কালো কোতা? এখনই দিন দিন পোড়াকাটের মতন হয়ে যাচ্ছিস। ছোটকাল দিব্যি ঘিওলো ঘিওলো রং ছিল। বাতিকে বাতিকেই গেলি তুই। দুধ খাব না, ঘি খাব না, অধিক মিষ্টি খাব না—এতে কি আর চেহারায় শরীরে লাবণ্য থাকে?
ঢ্যাঙা চড়া গলায় বলেন, খাব না বললেই রেহাই দিস যে? জোর করে খাইয়ে খাইয়ে আমাশার ধাত জম্মিয়ে দিলি। আশী বছরের বুড়োর চেহারায় আবার লাবণ্য।
নেবুমাসি তেড়ে উঠলেন, সেই ইস্তক আশী বচর আশী বচর করচিস ক্যানরে ঢ্যাঙা? বলি, আমি বড় না তুই বড়?
ওঃ, ভারী তো বড়! তিন মাসের বড়, তার আবার বড়াই!
তিন মাস নয়, সাড়ে তিন মাস। নেবুমাসি দৃঢ় গলায় বলেন, আমি আশ্বিনের পয়লা, আর তুই পৌষের মাঝামাঝি। তা যে যাই হোক, বড় বৈ তো ছোট নয়? তবে আমার আশী না হতেই তোর আশী হয় কী করে?
তোরই বা হতে কতক্ষণ?
নেবুমাসী আরো দৃঢ় গলায় বললেন, যতোক্ষণ না সামনের আশ্বিন আসবে, ততক্ষণ?… হচ্ছিল লাহিড়ীবাড়ির সবধেন নীলমণি মেয়ের বিয়ের ঘটার গপপো, দিলি তো ভণ্ডুল করে? দিবি বৈকি! হিংসের জ্বালা! নিজের তো ও গুড়ে বালি! তা বুঝলে বাছা—আঃ তোমার নামটি বাপু কেমন যেন পেটে আসে মুখে আসে না। বলি ডাক—নাম নেই?
সুদত্তা কিছু বলার আগে প্রবাল বলে ওঠে, আছে। জানি।
সুদত্তা রেগে বলল, আছে! জানো? কোথা থেকে জেনেছ শুনি?
কোথা থেকে? নাঃ সোর্সটা বলব না, তবে জেনেছি—বলি?
না বলে ছাড়বে ভেবে কি আর প্রসঙ্গটা তুলেছ?
রেগে যাচ্ছ মনে হচ্ছে। তবে থাক।
সুদত্তা বলল, থাক—এর কিছু নেই। মা বাবা খুকু বলে ডাকে। একেই যদি ডাক নাম বলতে চাও বল।
খুকু! নেবুমাসি এক গাল হেসে বললেন, আহা, এমন মিষ্টি নামটি থাকতে আমি হোঁচট খেয়ে মরচি! তা বুজলে বাছা খুকু! আমার বাবা ওর বে দেবার জন্যে কম ব্যস্ত হননি, কিন্তু বাবুর এক গোঁ, ঘর নেই বাড়ি নেই বৌ এনে রাকবো কোতায়।…. বাবা শেষ অবদি রেগেই গেলেন, বললেন, অ্যাতো বড় বাড়িখানায় তোর একটা বৌয়ের জায়গা হবে না? তবু গোঁ ছাড়ল না। নিজের পায়ে দাঁড়াব বলে কোতায় যেন চলে গিয়ে কত দিন কাটিয়ে এলো। …. তারপর বাবার মৃত্যুকালে বাবা—
সরোজমোহন রেগে বললেন, হচ্ছিল জমিদার কন্যে শরদিন্দু—নিভাননীর বিয়ের ঘটার গল্প, তার মধ্যিখানে এ হতভাগার জীবন কাহিনী ফাঁদতে বসছিস কেন? হ্যাঁ, ঘটা একখানা হয়েছিল বটে। …… পলা তোরা ছোটবেলায় সে কাহিনী শুনেও থাকবি।
অসতর্কে নিজেই তিনি গল্পের খেই হাতে তুলে নিয়ে বসলেন। এবং চালিয়েও গেলেন। অবশ্য নির্বিঘ্নে নয়। প্রতি ধাপে প্রতিবাদের ধাক্কা খেতে খেতে।
তবু প্রবালের শোনা গল্প আবার ঝালানো হল আর খুকুরও শোনা হল—
নেবুমাসির বিয়েতে নাকি সেই পাকা দেখার দিন থেকে বিয়ের অষ্টমঙ্গলা পর্যন্ত রোজ দুবেলা যজ্ঞি চলেছিল। পাকা দেখা উপলক্ষে দিক দিগন্তর থেকে যত আত্মীয় কুটম্ব এসেছিল, শশাঙ্ক লাহিড়ী তাদের আর ফিরে যেতে দেননি, আটকে ফেলেছিলেন। এক মাসের আগে আগে ছাড়েননি।
শ্রোতারা বলে ওঠে, চমৎকার। তিনি না হয় আটকে ফেললেন, লোকেরাও আটকে গেল? কাজ ছিল না কারুর?
তা একেবারেই ছিল না কি? ছিল। তবে তখনকার মানুষের এই এ যুগের নূতন এমন কাজ কাজ বাতিক ছিল না। থাকুক কাজ, তা বলে মান্যিমান একটা লোকের অনুরোধ অগ্রাহ্য করবে? শশাঙ্ক লাহিড়ী সবাইকে হাত জোড় করে বলেছিলেন না—আমার জীবনে এই একটাই কাজ! এই প্রথম, এই শেষ! হবে না হবে না করে সাত ঠাকুরের দ্বোর ধরে বুড়ো বয়সে এই মেয়ে। প্রাণ ভরে সাধ আহ্লাদ করব এই বাসনা।
তবে? এমন একটা আবেগময় অনুরোধের সামনেও লোকে নিজের কাজ দেখাবে? যাদের আপিস ইস্কুল, তারা কামাই করবে। চুকে গেল সমস্যা। তাছাড়া আসল কাজটি তো সমাধা হবে।
শ’দুই লোক বাড়িতেই ছিল, এ বাড়ি, কাছারী বাড়ি, জ্ঞাতিদের বাড়ি সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তবে খাবার ব্যবস্থা এইখানে। বিরাট বিরাট দুটো চালা বানানো হয়েছিল, একটা মেয়েদের একটা পুরুষের। তাতে সকাল থেকে রাত অবধি পাত পড়ার বিরাম নেই। জনা দশ কাজের লোক মোতায়েন ছিল সারাক্ষণ পাতা ফেলতে আর পাতা পাততে।
এখানে ঠিকরে উঠেছিলেন নেবুমাসি, হাঁদার মতন কতা বলিসনে ঢ্যাঙা। যারা পাত ফেলছিল, তারাই পাত পাতছিল? বলি এ বাড়িতে এমন মেলেচ্ছ কাণ্ড কবে দেকেচিস? পাত পেতেচে স্বজাতির মেয়ে পুরুষে।
তোর তো বিয়ে, তুই সব দেকতে গিয়েছিলি?
না যাই। জ্ঞানগম্যি তো আচে একটা! গোয়াড়ি না হাঁসখালি কোতা থেকে যেন এক কুড়ি হালুইকরকে এনে স্থাপনা করিয়ে রাকা হয়েচিল, তারা কি ঘোড়ার ঘাস কাটচিল?
তবে তুইই বল।
কেন, এটুকু বলতেই তোর মুক ব্যথা হয়ে গেল? তো আমিই বলচি। বুঝলে খুকু, ওই ওদিককার মাঠে চালা তুলে জোল কেটে উনুনই বানানো হয়েছিল আটটা দশটা।
আটটা দশটা? তবে তো খুব বললি। এদিকে জলপানির দিকে আরো চারটে উনুন কাটা হয়নি? ফি দিন সক্কাল না হতেই ঝোড়া ঝোড়া কলাই ডালের বোঁদে ভাজা হচ্ছিল না? তার সঙ্গে ঝুড়ি ঝুড়ি খাস্তা নিমকি?
হ্যাঁ সে খবর তো তোরই বেশী জানবার কতা—নেবুমাসি হি হি করে হেসে উঠলেন, সেইখানেই তো পড়ে থাকতিস সকাল থেকে!
অকৃতজ্ঞতা করিসনে নেবু, শালপাতার ঠোঙা বানিয়ে বানিয়ে চুপি চুপি সাপ্লাই করা হত না তোর কাছে? বুঝলি পলা, বিয়ের দিন সকালে নিমকি খাব বলে কি ঝুলোঝুলি! বলে কিনা শেষ রাত্তিরে খানিকটা দই চিঁড়ে গিলিয়ে গেল, আমার গা কেমন করছে?।… দোহাই ঢ্যাঙা, দু’চারখানা নিমকি এনে দে চুপি চুপি। যা সুবাস ছাড়ছে। ওই মাঠে কড়া চাপিয়েছে, এখানে ঘিয়ের গন্ধ ভেসে আসছে। কোথা থেকে যেন ঘি আনিয়েছে।
ওঁদের কথার ভঙ্গী শুনলে মনে হতে পারে, ঘটনাটা বুঝি এখনই ঘটছে। সত্যিই বুঝি সেই কোথা থেকে আনানো ভালো গিয়ের গন্ধ ভেসে আসছে।
থাক, ওই নিয়ে আবার অত বিশদ কিসের রে ঢ্যাঙা? দিয়েছিলি?
বাঃ! সেদিন না তোর উপোস করার কথা! দিয়ে অমঙ্গল করি আর কি!
আহা, না দিয়েও কি মঙ্গলের বাহার! হেসে গড়িয়ে পড়লেন নেবুমাসি, বচর না ঘুরতেই তো ঘরের মাল ঘরে ফিরে এলো।
এলো, সে বিধাতার লিখন। কিন্তু তখন তো আর সে বুদ্ধি হয়নি। নির্ঘাৎ মনে হত বিয়ের দিন খেয়েই এই কাণ্ডটি হল। আর নিজেকে মহাপাপী ভেবে—ঢ্যাঙা হাসলেন। চিরদিনের মজ্জাগত কুসংস্কার। ছেলে বুদ্ধি! কেবল মনে হয়েছে নিশ্চয় কোথাও কোন দোষত্রুটি ঘটেছে।
নেবু ঝঙ্কার দিলেন, ছেলেবুদ্ধি আবার কী? বুড়ো বুদ্ধিতেও তো ওই কথা বলছে। কেউ বলল, রাজার মুখের ওপর না করায় অপমানে শাপ দিয়েছে রাজা তাই এই দশা। দ্বিরাগমন না হতেই কপাল পুড়ল মেয়ের। হি হি হি, আমার কিন্তু তখন কি মনে হয়েছিল জানিস রে পলা, বাঁচলাম বাবা। আর শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে না।
চমৎকার! এদিকে তো কার্পেটে ‘পতি পরম গুরু’ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
ও মা! শোন কতা? সে তো একটা শিল্পকাজ শিকচি বলে। ঘরে গুণে গুণে বুনলেই তো কতাটা নেকা হয়ে যায়। ‘বন্দেমাতরম’ ছিল ‘জননী জন্মভূমিশ্চ’ ছিল। যে যেমন প্যাটার্ণ ধরেছিল। আমি ওটা নিয়েছিলাম সোজা বলে। তা হটাৎ যকন খবরটা এলো, পিসি চেঁচিয়ে উঠে ছুটে এসে বলল, ‘ওরে নেবু, তুই এখানে প্যায়রা গাছে চড়ে বসে আছিস। তোর যে কপাল পুড়ল।’ শুনে চমকে গিয়ে তাড়াতাড়ি কপালে হাত দিয়ে দেকচি আগুনের ধারে কাচে আসিনি, পুড়ল কি করে! অবিশ্যি সেকালের তুলনায় আমি কিছু খুকী ছিলাম না, কিন্তু ববরাবরই ডাকাবুকো ছিলাম, আর যত বেটাছেলের মতন খেলায় হুড়িয়ে বেড়াতাম, তাই মেয়েলি কথা বেশী শিখিনি তখনো। তা আমার সকল ডানপিটেমির আজ্ঞাবাহী ছিল ঢ্যাঙা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন