বাউল রশিদ উদ্দিনের গান

বাউল রশিদ উদ্দিনের গান

মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলিরে পাগল মন ।
মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন ৷
মানুষ কি আর এমনি বটে যার কারণে জগৎ রটে
ঐ যে পঞ্চভূতের ঘটে খেলিতেছে নিরঞ্জন ॥
চৌদ্দতালার উপরে দালান তার ভিতরে ফুলের বাগান
লাইলী আর মজনু দেওয়ান বরজখে করছে আসন ॥
তালাশে খালাস মিলে তালাশ কর রংমহলে
উঠিয়া হাবলঙ্কের পুলে চেয়ে থাকে সারাক্ষণ ।
উঠিয়া দেখিবে পুলে দুই দিগেতে অগ্নি জ্বলে
ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে চমকিছে স্বর্ণের মতন ॥
দুই ধারেতে দুই কটড়া হায়াত আর মউত মাঝে
ভরা সময় থাকতে খোঁজগে তোরা নিকটেতে কাল সমন ।
সোনারপুরি আঁধার করে যেদিন পাখি যাবে উড়ে
শূন্যখাঁচা থাকবে পড়ে, কে করবে আর তার যতন ॥

(কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ চলচ্চিত্রে ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ/ শুন বলিরে পাগল মন’ গানটি ব্যবহার করেন।
১৯৯৯ সালে গানটির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার (মরণোত্তর) হিসেবে পুরস্কার পান রশিদ উদ্দিন।

এই বিশ্ব মাঝে যেখানে যা সাজে
তাই দিয়া প্রভু রেখেছেন সাজাইয়া ।
যেখানে যা সাজে তাই দিয়া ॥
নিচে বসুন্ধরা উপরে আকাশ, মাঝে শূন্যময় করেছে বিকাশ
ধীরে সমীরে বহিয়া বাতাস, কণা কণা ধূলি যায় উড়াইয়া ॥
প্রেমের কত ছবি তার তারকা গগনে, মুণির মনলোভা নন্দন কাননে
কত আঁধার রাতে, জ্যোৎস্না দানে, অন্ধজনে দেয় পথ দেখাইয়া ॥
ক্ষমা নাই তার দিবা ও শর্বরী, সকল সময় করে যে প্রেম ছড়াছড়ি
কত রসের নাগরি পরান পিয়ারী, রহিল তার প্রেমে মজিয়া ॥
স্থাবর সঙ্গম বিটপী লতায়, অনল অনিলে তার গান শুনা যায়
সে যে প্রেমের মহাজন, রসিক সুজন, যাওনারে তার গান শুনিয়া ॥
সলিলে হিল্লোলে পাষাণের মাঝে, আলোকে তিমিরে বহু রঙে সাঝে,
তোরা প্রেমের অনুরাগে বসে থাক যুগে, কক্ষ দ্বারে দেখবে চাহিয়া
রশিদ উদ্দিন বলে সে যে বিহঙ্গের গায়,
কুয়াশার সনে থাকে হিমানী গুহায়
কত মেঘমালায় মলয় হাওয়ায়, রয়েছে বিশ্ব ব্যাপিয়া ॥

এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া, এত যত্নে গড়িয়াছে সাঁই ॥
কার সঙ্গে যুক্তি করে গড়িলে সংসার,
ভেদেরগঞ্জে গিয়া আমি পাইলাম না কিনার
তুমি সাকার, তুমি নিরাকার, তুমি বিনে আর কেহ নাই ॥
ছায়াবাজির পুতুলরূপে বানাইয়া মানুষ,
যেমনি চালাও তেমনি চলি পুতুলের কী দোষ?
(তোমার) হাতের তারে এমনি কৌশল ছেড়ে দিলে থেমে যাই ॥
তুমি ধর্ম তুমি কর্ম তুমি কর্ণধার,
তোমার কর্ম তুমি কর (কেন) আমরা গোনাগার?
তোমার ইচ্ছায় চলিছে সংসার,
তুমি খাওয়াইলে আমরা খাই ॥
তুমি কখন থাক সিংহাসনে ধরিয়া রাজবেশ
কখন বা ভিখারি হইয়া ভ্ৰম নানান দেশ ।
তোমার রূপের নাই কোন শেষ
জায়গা কইরাছ কোন বা ঠাঁই ॥
তুমি বেহেস্ত তুমি দোযখ তুমি ভাল মন্দ
তুমি ফুল তুমি ভ্রমর তুমি তাহার গন্ধ
তোমার আমার এই সম্বন্ধ, দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই
রশিদ উদ্দিন বলে তোমার পাপ-পুণ্যের ভার
তোমার কর্মে তুমি আবার করিবে বিচার
(তোমার) বেহেস্ত চাই না দোযখ ডরাই না
কেবলমাত্র তোমায় চাই ॥

8

মা-গো মা, ঝি-গো ঝি করলাম কী রঙ্গে
ভাঙ্গা নৌকা বাইতে আইলাম গাঙ্গে ॥
গোমাই নদী নষ্ট করল ঐ না কোলা বেঙে ॥
ভাঙ্গা নৌকায় উঠে জল নদী করে কলকল
কলকলাকল পারি না তার সঙ্গে ॥
নদীর নাম কামনা সাগর বাঁকে বাঁকে উঠে লহর গো…
কত সাধুর ভরাডিঙ্গা পার হয় তার তরঙ্গে ॥
ছিলাম শিশু ছিলাম ভালা না ছিল সংসারের জ্বালা গো…
হাসিতাম খেলিতাম মায়ের সঙ্গে ॥
এই দেহে আইল জোয়ানি ঘরে আইল নয়া পানি গো…
কাম-কামিনী বসিল বাম অঙ্গে ॥
ছিলাম জোয়ান অইলাম বুড়া লইরা গেছে বাকা গোড়া
গলই গোড়া সব গিয়াছে ভেঙ্গে ॥
রশিদ উদ্দিন বলে গানে ভেবে দেখ আপন মনে গো…
একদিন মিশতে হবে মাটির সঙ্গে ॥

ওগো স্ৰষ্টা জাতিভ্ৰষ্টা তুমি হইলা নষ্টার মূল ॥
নাহি তোমার জাতি ধর্ম নাহি তোমার কুলাকুল ॥
তুমি হিন্দু কিবা হও মুসলমান, বৌদ্ধ জৈন কিংবা খৃষ্টান,
নাইকো তোমার মান অপমান সবার কাছে সমতুল ॥
হিন্দু কিবা হোক না মমিন, তোমার উপর সমান স্বাধীন
তুমি আছ সবার অধীন তবে কেন বাজাও গোল ॥
মেথর মুচি ঘৃণার পাত্র, সবি জানি তোমার ছাত্র
উপলক্ষ তুমি মাত্র ঢোল কাঠিতে বাজাও ঢোল ॥
তুমি চোর তুমি সাধু তুমি তিক্ত তুমি মধু
তুমি স্বামী তুমি বধূ আর যত সব সবি ভুল ॥
তুমি স্বর্গ তুমি নরক ইহাতে আর নাই রে পরখ
নাইকো তোমার ছুরত মুরত আশাতেই ফুটাইছ ফুল ॥
বাউলকবি রশিদ বলে তোমার কথা মনে হইলে
পড়ে যাই মস্ত গোলমালে, কোথায় আছে সূক্ষ্ম স্থূল ॥

(আগের গানের জবাব)

(স্রষ্টা কি আর ভ্রষ্টা হইতে পারে?)
ওরে স্রষ্টা যদি ভ্রষ্টা হইত, যাইত জগৎ ভেঙ্গে-চুরে ॥
তুমি দোষী বল কারে ॥
স্রষ্টায় করিয়া সৃষ্টি, তোমার হাতে দিল লিষ্টি
মিলাইয়া দেখ কুষ্টি কোন জনায় কি করে ॥
ইচ্ছা জ্ঞান তোমারে দিয়ে অচল হইয়া পরে
ফুটবলের আকারে আছে যে যে ভাবে বেদায় তারে ॥
ইচ্ছা জ্ঞান দুইটি প্লেয়ার অন্যান্য করে হায়ার
খেলাতে করছে ইন্টার অতি জোরে জারে ॥
চৈতন্য রেফারি হইয়া অফছাইট ফাউল ধরে
কেবা হারে কেবা জিতে তার বিচার মিটারে করে ॥
ইতর ভদ্র মেথার মুচি, প্রভুর কাছে সবি শুচি
তবে কেন খোঁচাখুঁচি করে লোকাঁচারে ॥
চোর কি সাধু নামের মধু উভয়ে পান করে,
বলা ভেমরুল, মৌমাছির দল, এক ফুলেতে আহার করে ॥
আকাশেতে সূর্য উঠে বিশ্বব্যাপী কিরণ ছোটে
ঘটে মাঠে তটে পটে পাহাড়ে পাহাড়ে ।
কেহ কি আর বলতে পারে ভিন্ন বাসে কারে
সবার মন যোগাইয়া চলে যে যেভাবে ডাকছে তারে ॥
নিষ্কলঙ্ক নিষ্কণ্টকে সম্রাটে কি লাটে কণ্ঠে,
চৌদ্দ পটে, নামটি রটে, অন্তরে বাহিরে।
বাউলকবি রশিদ বলে দোষেী যে কয় তারে
সেই পাপিষ্ঠ রাস্তা ভ্রষ্ট, হবে সে সৃষ্টির বাহিরে

(৫ নং ও ৬ নং গানের জবাব)

সংসার জুড়িয়া, দেখেছি ঘুরিয়া,
মতামত আমার মিলে না ॥
কেহ বলে আছে স্রষ্টা কেহ বলে নাই,
থাকলে আছে অচল হইয়া চলনশক্তি নাই ৷
(মোরা) নিজের ইচ্ছায় ঘুরিয়া বেড়াই, করি যে কত কল্পনা ॥
কেহ আছে দ্বৈতবাদী করিয়া পোষণ
কেহ যে অদ্বৈতবাদী সকলি বর্জন,
কেহ আছে ত্রিতবাদী মতবিরোধী কয়জনা ॥
যে যাহা বলিতেছে সবেই বলে ঠিক
কারে কি বলতে পারি আস্তিক নাস্তিক ।
কোনটা সঠিক কোনটা বেঠিক আমি কিছুই বুঝি না ॥
এ বিশ্বের সবাই যদি থাকিত একমত
তবে বোধহয় হইত না আর প্রলয় কিয়ামত
সবি যার তার মতে, চলে যার তার পথে
গোলক ধাঁ-ধাঁ মিটে না ॥
বাউলকবি রশিদ বলে বিবিধ বিষয়
কোন শক্তিতে মুক্তি হবে দেখেন মহাশয়
আমি আমার কারে কেবা কয়
চেনা কিম্বা অচেনা ॥

না ছিল আসমান জমি আগুন হাওয়া মাটি পানি
বেদ বেদান্ত শাস্ত্র এই যে ধর্মের কোরানখানি ॥
নির্বিকল্প নিরাকারে অখণ্ড মণ্ডলাকারে
ছিলেন প্রভু একশ্বরে নাহি সঙ্গিনী ॥
আপন কুদ্রতের জোরে, এস্কের আগুনে পুড়ে
হা নামে করছে ধ্বনি ॥
হা-নামে ছিল হাহাকার সঙ্গেতে কেউ না ছিল তার
এস্কের আগুন অঙ্গার হইলেন আপনি ।
চতুর্দিকে হা-শব্দ, বাজিতে লাগিল বাদ্য,
হায় দয়াল চান গুণমণি ॥
হা, হে দুই মিশল যখন, উদয় হইল পাক নিরঞ্জন
সৃজিবে বলিয়া আদম কইলেন তখনি ।
হুয়েতে আসিয়া পরে, আপনি সাই আসন করে
রাব্বে কুল কাদের গনি ॥হুয়েতে হু ভাবের জন্ম, আপনি করেন আপনার কর্ম্ম
কি বলব তার নিগূঢ় মর্ম ভাবতেছি দিনরজনী।
হু ভাবেতে বিম্ব তৈয়ার, তিন শব্দ গেল তারি মাঝার,
বলব কি আর রইল গোপনী ॥
হায়েতে আপনি সামাদ, হে তে হইলেন মোহাম্মদ
হু-য়েতে আদম বুনিয়াদ এক সুতার গাঁথুনি ।
হু-য়েতে আওয়াজ তখন, উঠতে থাকে ঘনার ঘন
ফুটল একটি নূরের রৌশনি ॥
সেই নুরের আলো ছড়া উপড়ে কাল শেওলা খাড়া
সেই নুরে ফাতেমার চেহারা হায়রে গুলবদনি ।
বিম্ব মিশিয়া গেল, অঙ্গের চারখান গয়না হইল
ডাকল তারা মা-জননী ॥
রশিদ বলে এ সংসারে চিনল না কেউ আপনারে
দিন গেল ঘুরে ফিরে কাঁধে লইয়া কুলুর ঘানি ।
এসে মানুষ ভর ধরায়, মইল শুধু পেটের জ্বালায়
গলায় ফাঁসি কাল রমণী ॥

মানুষ বানাইয়া খোদা গেল ছাপিয়া
পায়না খুঁজিয়া দেয় না ধরা ॥
আপে সাই নিরঞ্জন, আপনি করিয়া পছন্দ
বানাইল আদম তন দেখ না তরা ॥
করিয়া বৃদ্ধি বল, আপনারই অবিকল
আগুন হওয়া মাটি জল দিয়াছে বেড়া ॥
করিল আজব কাণ্ড, বানাইয়া দেহভাণ্ড
অখণ্ড হৃদয়পিণ্ড, ভিতরে ভরা
মস্তক হইতে পাও ধরে, মানুষের ঘরে ঘরে
দুইশত ছয়টি হারে লাগাইছে জোড়া ॥
প্রথমে মস্তকে জান, হাড্ডি দিল আটখান
মুখেতে চৌদ্দটি মান, হাড়ের জোড়া ।
সাতটি হাড় ঘাড়ে বটে, পঁচিশটি হাড় বুকে মোটে
চাব্বিশটি নিয়া দিল পিঠে ইসকুরুপ মারা ॥
দুই হাতে চৌষট্টিটি কোমর হইতে ভাটি
দুই পায়ে বাষট্টি জোড়া তারা ।
এই হইল মোটামুটি, দিয়েছে হাড়ের খুঁটি ॥
নইলে কি আর এই দেহটি থাকিত খাড়া ॥
ঐ সুন্দর ঘরখনি, তিন পাতার দিয়াছে ছানি
তিন তারের গাথুনি সর্বাঙ্গ জোড়া ।
কহে কবি রশিদ উদ্দিন, কই যদি প্রতিদিন
ফুরাইত না দেহার চিন জনমভরা ॥

১০

গন্ধম চিনিয়া বাছিয়া বাছিয়া, সময়মত গিয়া তুল ॥
যে গন্ধম খাইয়া আদম হইল গোনাহগার
আজপর্যন্ত আমরা সবে করিতেছি আহার
যেমন হযরত আদম, হওয়া তাহার গন্ধম
এই হইল তার কথার মূল ॥
গুপ্তকথা ব্যক্ত করতে প্রাণে লাগে ভয়
মুন্সি মোল্লায় লাগাল পাইলে লাঠি হাতে লয়
না বুঝিয়া ঘটায় বিপর্যয়, আসল কথায় করিয়া ভুল ॥
ছুটেছি পাগল বেশে প্ৰাণে নাই শঙ্কা,
আসল কথা ভেঙ্গে বলি মারিয়া ডঙ্কা,
ছারখার করিয়া দিব লঙ্কা,
যার জন্যে এত হুলস্থুল ॥
মানুষ আর কোরানে জোনো রইয়াছে স্বাক্ষর,
আলেপ লাম মীম এই তিন কোরানের অক্ষর
এই তিনে ধরিয়া, বিচার করিয়া, তৈয়ার করগা শানেনুজুল ॥
হাওয়া আদম ছিল যখন বেহেস্তখানায়
তিন ফোঁটা খুন জারি হইল তথায় ।
এই তিন ফোঁটা দ্বারা, দেহ কোরান হইল খাড়া
ভাবিয়া তোমরা হবে আকুল ॥
গন্ধমের রস দিয়া বানাইয়া কালি,
ছাপাখানার ঘরে কোরান দিতেছে তালি
শুনলে লোকে পাড়ে গালাগালি, শুনে এইসব কথার বুল ।
কবি রশিদ উদ্দিন ঘুরতে ঘুরতে হইয়া পেরেশান
গন্ধম গাছের তলে গিয়া পাইয়া ময়দান
সে যে গাছের তলে গিয়া, পড়িল ঘুমাইয়া
চোখেতে পড়িল ধুল ।

১১

খোদা বিশ্ব ব্যাপিত, কণিকার মত, প্রেমে বিরাজিত বাসারে ॥
আগে দীপ্তিমান কর তমিস্রা বাসরে
জ্বলানির কেন্দ্রে গিয়া বস ভক্তির জোরে।
তোরা পরে অলসতায়, যাইওনা তন্দ্রায়, দেখবে যদি তাঁরে কটাক্ষ ভরে ॥
এই চাইয়া দেখ তোমার দেহ পরম যিনি
তাতে ফুটিয়াছে কত ষড়জ ললিনী ।
কত হইতেছে প্রেমের বিকিকিনি, কিনবে যদি আয় সস্তা দরে ॥
সে যে পরম করুণাময় নির্মল আকারে
জগতের বাইরে থাকে স্রষ্টা বলে তারে ।
(সে যে) অনাথিনীর ধন, অনাশ্য রতন, অনাসন অনাতুরে ॥
সর্ব জীবের হস্তা সে যে হয় নিরুপমা
পরম ঐশ্বর্যশালী জীবের জীবন বীমা
(সে যে) প্রেমেরি লুলুপে, বন্ধ মধুকূপে, যেজন তারে খুঁজতে পারে ॥
বাউলকবি রশিদ উদ্দির মন সদা সিক্তময় ভুবন,
ধাত্রী মাতার কুলে তাঁহার যাইতেছে জীবন
কামিনী কাঞ্চন, হইল না বর্জন, পরিয়াছে ঘোর আঁধারে ॥

১২

সে যে স্বয়ং প্রভু কর্তা, সর্ব জীবের সত্তা
তার কোন অসমর্থা নাই সংসারে ॥
ঊর্দ্ধ-অধঃ দশদিক ব্যাপিয়া, অনল অনিলে আছে সমীরে ছাপিয়া
ভূগর্ভ সলিলে, পত্র পুস্প ফলে, ইন্দুা বিন্দু সিন্ধু ভাস্করে ॥
ইরানে তুরানে প্যারিসে মদিনে, গয়া গঙ্গা বেনারসে কাশী বৃন্দাবনে ।
আসমানে জমিনে, বিজলী বিমানে নক্ষত্র নিকার সাকারে ॥
স্থাবর জঙ্গমে অনাদি নিধন, আকারে হয় তার আদর্শ লিখন ।
নিত্য নিরঞ্জন, ব্যাপিয়া গগন, আলোকে তিমিরে সাগরে ॥
সে যে সারঙ্গ মৃদুঙ্গ জয় ঢাকে ঢোলে, খোলে করতালে তার মধু নাম বুলে
যেখানে তার নাম, সেখানে তাঁর ধাম, আনন্দে প্রভূ বিরাজ করে ॥
বাউলকবি রশিদ বলে কেন ভ্রম দূরে
তর্কবিতর্ক ছেড়ে ফিরে আস ঘরে।
মঠ কি মন্দিরে, মরো কেন ঘুরে, আছে তোমার অন্তঃপুরে ॥

১৩

কী আশ্বর্য রূপমাধুর্য মানবদেহ-খান ।
দেখিলে তার রূপের ছটা আকুল হইয়া যায় পরান ॥
দেখতে তারে কেমন শোভা মহন্তেরি মনলোভা
নয়ন মেলে দেখরে তোরা, বেঁধেছে কাবা কাউছান ।
মক্কা-কাশি-বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গহন কাননে
তপস্যারই পীঠস্থানে পড়তে দিচ্ছে বেদ কোরআন ॥
মণিপুরের স্বাধীন রাজা উড়াইয়া ধর্মের ধ্বজা
শাসনের রাখিয়া প্রজা, সঙ্গে নিয়া স্বাধিষ্ঠান ।
রাজনীতি রক্ষার জন্য নেপালি আর গুর্খা সৈন্য
এই দেহ করিতে ধন্য আরোহী হলেন সবে জান ॥
যেমন বিলাতে সাইবের কাঁচারি ইংলান্ডে হয় বসতবাড়ি
পঞ্চম জজ আর রানী মেরী সেনা সৈন্য নেঘাবান ।
চৌদ্দ পোয়া জমিদারী পাঁচজনা তার কর্মচারী
ষোলজনা মালপ্রহরী ছয়জন রাখছে দারোয়ান ॥
লাকসামে লাইনের গুঁড়ি হওয়াতে চালাইছে গাড়ি
বাহত্তর হাজার নারী তিন তারে গাড়া নিশান ।
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা তারে মাঝে রেখে সুষুম্নারে
তিন তারে তিন শব্দ করে উভয়ে সমান ॥
জানবে যদি এসব খবর আগে ছাড় ভাত কাপড়
গাছতলায় বান্ধিয়া বাসর পড়ে লও বিশ্ববিজ্ঞান ৷
বলে কাঙ্গাল রশিদ উদ্দিন এসব তথ্য বড়োই কঠিন
বেহুঁশের হালতে কয়দিন, ঘুরলাম কত পাহাড় ময়দান ॥

১৪

অন্তরে অন্তরে দেখ সবে চিন্তা করে ।
প্রভু সাঁই পরোয়ারে কি খেলা খেলায় ॥
বসিয়া নিরালা ঘরে, কার্য করে ধীরে ধীরে
বিচিত্র কৌশল করে মানুষ বানায় ।
ছিয়া, ছফেদ, লাল, জর্দা চাইর রঙ্গে করিয়া
কাঁদা বানাইয়া নর মাদা ভবেতে পাঠায় ॥
মানুষের ভিতর মানুষ, আত্মা দিয়া করছে হুঁশ
কেউরে রাখিয়া সন্তোষ, কেউরে কাঁদায়।
প্রথম গড়ে নাভী কুণ্ড অধঃ পদে ঊর্ধ্বে মুণ্ড
তিনশ দশ দিন দশ দণ্ড রাইখা একজাগায় ॥
নাভী হইতে উর্ধে সিনা, দেখতে তারে কি নমুনা
দুই দিগেতে দিছে টানা প্রেমের আর্চালায়
যেমন একটা রাজবাড়ি, থরে থরে কর্মচারী
তুলনা রাবণের পুরি করা নাহি যায় ॥
নাভির চারি আঙ্গুল নিচে, তিনটি কটরা আছে
তিনটি জিনিস ভরা আছে, তিনটি কটরায় ।
উপরে হাওয়া নিচে পানি, মাঝখানে আগুনের খনি
ক্ষমা নাই দিবসরজনী তিনজনায় চালায় ॥
কলিজা রয়েছে ডাইনে, বায়ে ফুসফুস সবাই জানে
দিল রয়েছে মধ্যখানে মানুষের দেহায় ॥
কলিজাতে শাহা আলী, ফুসফুসে রাগের থলি
দিলের ভিতর আক্কেল আলী গোদা নিরালায় ॥
গোর্দার ভিতর পাঁচটি কোঠা সুন্দর সুন্দর নকশাকাটা
পাঁচজনা অতিথি বেটা থাকে সেই জায়গায় ৷
পাঁচ পাঁচা পঁচিশের গুণে, কাম চালাইতেছে রাত্রদিনে ।
তাঁরা পাঁচজন বইসা থাকে ঘরের কোনায় ॥
চার আত্মা একসঙ্গে মিশে, তাস খেলায় স্কুলের দেশে
একজন আছে কাছে বসে, হিসাব করায় দায়
ডাকিতেছে দমের ভিনতি, একশ হাজার ছয়শ গুনতি
কাবার করে কড়া ক্রান্তি চব্বিশ ঘণ্টায় ॥
কইতে গেলে এসব কাণ্ড, ফেটে যাবে হৃদপিণ্ড
ছেড়ে দিবে দেহভাণ্ড জোড়ায় জোড়ায় ।
ভেবে রশিদ উদ্দিন কয় ভাঙ্গেতে ব্রক্ষ্মাণ্ডে রয়
 তালাশেতে পরিচয় করলেন সাধু রায় ॥

১৫

মাটির পিঞ্জিরা হাওয়ার পাখি ভরা
কোনদিন জানি মারে উড়া ॥
যেদিন হইতে এই পাখি হইয়াছে বন্দি
উড়িয়া যাইতে কত করিতেছি ফন্দি
কখনও বাহিরে কখনও পিঞ্জরে,
এই বুঝি তার স্বভাবধারা ॥
বাসিয়াছে এই পাখি শূন্য ভরে
বাঁধা রহিয়াছে শুধু কৰ্ম্মডুরে।
নামের মধু আহার করে নিত্যনতুন রসে ভরা ॥
হাওয়ার পাখি শুনরে মন হাওয়ার সনে গাঁথা ৷
হাওয়ার দ্বারা চলে মানুষ হাওয়াতে কয় কথা
ঊর্ধ্ব পদ নিচে মাথা, নামের আহার সামনে ধরা ॥
যেদিন হইতে এই পাখি পলাইবে উড়ি
ছিন্ন হয়ে যাবে এসব সব মায়ার বেড়ি
ভেঙ্গে যাবে সোনারপুরী মানবে না আর জোড়া তারা ॥
রশিদ উদ্দিনের মন আকুল সদায়
কোন দিন নাকি এই পাখি ছোটে জঙ্গলায়
দিন গেল ভাবনা চিন্তায়
ছুটলে পাখি দিবে না ধরা ॥

১৬

প্রেমের গাছে একসঙ্গেতে, ফল ধরছে একজোড়া ।
গাছের তলে ফল পাড়িতে, খাড়া আছে তিন চোরা ॥
তার গোড়া ডালা বোঁটা কালা, কষ পড়ে তার ধলা
ধলা ভাল ছাড়া তার বটা গোলা, সর্পের মত ফণা ধরা ॥
গাছের তলায় কালের বাসা, ফল পাড়িতে নাইরে আশা
ভক্তি ছাড়া যুক্তি করলে, প্রাণে মারা যাবে তোরা ॥
বলে বাউল রশিদ উদ্দিন, কামরতি আর প্রেমরতি
সঙ্গে নিয়া শুরু রতি সিঁদ কাটরা চোর বাইরে খাড়া ॥

১৭

ও তুই দেখবে, দেখবে রে দেখবে বল কারে
সকল গোল মিটিয়া যাবে, তারে দেখলে সুনজরে ॥
জীবাত্মা আর পরমাত্মা দুই জনাতে এই সন্ধান
কেউরে ছাড়া কেউ বাঁচে না উভয়ে সমান সমান ।
জীব হইয়াছে কর্মকর্তা পরমে হুকুমে করে
পরমে কয় জীবের কাছে তোমার মাঝে দাও হে ঠাঁই,
তুমি ভিন্ন এ জগতে আমার কোন জায়গা নেই ।
তুমি থাকলে আমি আছি নইলে আর বাঁচি না রে ॥
মিস্ত্রির মধ্যে মিঠা আছে ব্যক্ত আছে চড়াচড়।
মিঠা নি কেউ দেখে চোখে, বলতে পারে সে খবর
মিস্ত্রি সবাই চোখে দেখে, মিটাতো কেউ দেখে না রে ॥
ফুলের মধ্যে মধু থাকে উড়ে চলে মধুকর
মধু খেয়ে উড়ে যায় সে গন্ধ থাকে বরাবর
ফুলে গন্ধে কি সম্বন্ধ দেখ না রে তুই বিচার করে ॥
চিনা মানুষ অচিন হইয়া ঘুরতেছে দ্বারে দ্বারে
নয় দরজা বালাখানা বসতি চুলার পারে
সে তো কখন বাইরে কখন ঘরে বাতাসে ঘুরে ॥
বাউলকবি রশিদ বলে দেখতে যদি চাও তারে
নিজে আগে শুদ্ধ হও স্নিগ্ধ জলে স্নান করে
দর্পণেতে চেয়ে দেখ কোন জনায় লড়ে চড়ে ॥

১৮

আপন ঘরের খবর জানতে ও মন তাড়াতাড়ি আয় ॥
মায়াফাসে বন্দি হইয়া চিনলেনা তুমি তোমায় ॥
মনরে…আপনি হইয়া মেস্তরী, পঞ্চভূতে বানছে তরী
আপনি নিজের কাঁচারি কৌশল করে বানায় ৷
ক্ষিতি, অব, তেজ, মরৎ, ভূমে এইঘর বানাইয়া শ্যামে
রাধাকে রাখিয়া বামে কি সুন্দর বাঁশী বাজায় ॥
মনরে… পঞ্চ আত্মা পঞ্চ প্ৰাণ, এই দেহে লাগায় ভগবান
প্রাণ-অপ্ৰাণ সমান বিয়াম, উদ্যাম আছে এই দেহায় ৷
এই পাঁচজনায় ছয়টি পদ্মে, ঘুরে বেড়ায় দুইটি শব্দে
অহং শব্দ উঠে ধ্বনি, সুহং বলে বাইরে যায় ॥
মনরে…চাষ করিবার জিনিষ আছে, সকলি বিফল যাইতেছে
আবাদ জামি পতিত পরছে, ছয় বলদে বেড়াইয়া খায় ৷
সময় থাকতে গুরু ধর পতিত জমি আবাদ কর
ফসল দিয়া গোলা ভর শেষকালে তোর নাই উপায় ॥
মনরে… চেয়ে দেখ আপন চোখে, তোমারই নিজ বুকে
এমন একজন মানুষ থাকে কি সুন্দর পাখা চালায় ।
যেদিন পাখা বন্ধ হবে, আর না ফিরে ঘরে আসবে
দেশের মানুষ দেশে যাবে, নিবে রে সমন বেটায় ॥
মনরে…ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে, যারে নিয়া দিন কাটাইলে
সে থাকিবে রঙমহলে তুই থাকিবে গাছতলায় ৷
জমাখাতায় দেখ দেখি, জমা নাই তর সবি বাকি
যমে যেদিন মারবে উঁকি, পলাইয়া থাকবে কোথায়?

১৯

এই ভবসাগরে প্রেমেরই লহরে
বাইয়া যাও মানবতরী মনে আছে যার ॥
চৌদ্দ পোয়া লম্বা তরী ষোলজনা দাঁড়ের দাড়ি
পাঁচজনা প্রহরী, চারজনা চরণদার ।
বাও দেখি তাড়াতাড়ি বেলা আছে দণ্ড চারি
নৌকায় তোমার মনবেপারী ধরিবে কাণ্ডার ॥
নায়ে দুইশ ছয়টি জোড়া চব্বিশখানা দিছে গোরা
মানবতরী করল খাড়া কেমন পরিষ্কার ॥
লোহা ছাড়া তক্তা গাড়া চার রঙ্গে তার বার্নিশ করা ।
কোঠায় কোঠায় জিনিস ভরা অনেক প্রকার ।
বাইও তরী ধীরে ধীরে মাল ভরিও মণিপুরে
থাইকো নদীর দক্ষিণ পাড়ে করিলে বেপার ॥
মদনগঞ্জের বাজারে বিকি দিয়ো লাভ করে
আসলেতে খাস্তা পড়ে যায় না যে কাহার
সাবধান সাবধান বলি সঙ্গে রাইখ পুঞ্জির থলি
সেদেশের লোক বড়ই খলি ঠগেরি কারবার ॥
রশিদ উদ্দিন বলে খাঁটি গুরু নামের নিয়ো চিঠি
সেই বাজারে একজন বেডি মোহাল তহশীলদার ॥

২০

আমি দয়াল গুরু বিনে গো কইব কথা কার সনে ॥
দয়াল গো…
আশা রইল সুন্দরবনে লেংটি রইল ডালে
বিড়ালে এক হাতি ধইরা ডুব দিয়া নেয় পাতালে গো ॥
দয়াল গো…
চৈত্রমাসের সংক্রান্তিতে করলাম দুর্গাপূজা
জন্মাষ্টমীর দিনে রাখলাম কোন বা নয়তের রোজা ॥
দয়াল গো…
সাগরে নাই একবিন্দু জল মাছ উঠিল গাছে।
ষাঁড়ের পেটে গাইয়ের বাছুর কি খাইয়া প্রাণ বাঁচে গো ॥
দয়াল গো….
জলের নিচে লাগছে আগুন লাগছে দৌড়াদৌড়ি
বাপের বিয়ার তারিখ আনতে গেছলাম নানার বাড়ি গো ॥
দয়াল গো…
একটা জীবের ফলের জন্য অন্যেতে ফল ধরে
একটা জীবের মার্গে দিয়া অন্যের উদর ভরে গো ॥
দয়াল গো …
ছোবাছানাইর হাঁড়ি ভাইঙ্গা খায়া গেছে শ্যামে
এইসব কথার ভাব ঝোটাইতে রশিদ উদ্দিন ঘামে গো ॥

২১

বাজাও বাজাও বাজাও রে মন, তিন তারের বীণা ।
দিয়া রজন, বাজায় যেজন, তার বিপদ আর রবে না ॥
তারে তারে তার মিশাইয়া, হৃদয় পদ্মে বাঁজাও যাইয়া
গুরুর পদে আশ্রয় নিয়া, শিখরে তানা না না ॥
ইঙ্গিলা পিঙ্গিলা তারে, মাঝে রেখে সুষুম্নারে ।
ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরে কর জপনা ॥
হস্তিনী আর প্রসূরা নারী, দিব্যা আর নামে গান্ধারী
দক্ষিণা আর আলম্বোষা ঝংকারে টানা
কাম ক্রোধ পশুগুলি, মায়ের নামে দাও গো বলি
ধরবে পাতা ফুঠবে কলি, পুরবে কামনা ॥
রশিদ উদ্দিন বলে মুশকিল, ঝিল তারে ফালাইসনা ঢিল
তিন তারে না হইলে একমিল, ঘটবে রে যাতনা ॥

২২

শিকড় কাটলে বাঁচেরে গাছ, না কাটলে বাঁশ বুকে বসে
আজব রঙ বাঁচি না হুতাসে ॥
গাছের শিকড় মধ্যভাগে, ফুল ফুটল তার চারিযোগে
প্রেমেরি অনুরাগে ভ্রমর তাতে বসে ৷
একটি ফুলের তিনটি কলি জলাকারে ভাসে।
একটি ফুলের নকশাভরা টাটকা রসে ॥
ফুলের নামটি স্বর্ণলতা, ধরিয়াছে দুইটি পাতা
ফলে খায় ফুলের মাথা, শুনলে লোকে হাসে ।
ডাল ছাড়িয়া দুইটি পাতা আছে শূন্য দেশে ।
পাথর শিলা পাতার নামটি শিকড় নাই তাহার শেষে ॥
চাইয়া দেখ ফুলের বিচে, কালসাপিনী ঘুম দিয়াছে
মন্ত্র ছাড়া গেলে কাছে পুড়ে যাইবে শ্বাসে ।
সেই ফুলেতে মুখ দিয়া মধু খাইও চুষে
রশিদ উদ্দিন করে সন্ধান পাইড়না সাপিনীর গ্রাসে ॥

২৩

চুলা বানাইল কি কৌশলে ॥
কলের চুলায় জল দিলে আগুন জ্বলে
কেমন সুন্দর কলের চুলা কত লোকের উলা-মেলা ।
(কত) ধনীমানি পান্থশালায় আসে যায় দলে দলে ॥
গরীবদুঃখির অতিথিখানা খাইতে গেলে পেট ভরে না,
এক তরকারির বেশি দেয় না পাক কইরা দেয় এক জ্বালে ॥
সেই খাওনের কেমন মজা ঘৃত ছানা মুণ্ডা ভাজা,
(যত) ভিখারী গিয়া সাজে রাজা সেই খাওনের মায়ায় ভুলে ॥
হিমালয় পর্বতের পরে জল রেখেছে সরোবরে,
যার যেদিন দরকার পড়ে জল আসে তার টিপ দিলে ॥
যত আছে খোদার বান্দা এই চুলাতে সবার রান্দা,
গরম থাকতে হয়রে গান্ধা, ভাবিয়ে রশিদ বলে ॥

২৪

দেশের দেখলে না নমুনা ॥
যেই দেশেতে মানুষ গেলে আল্লা নবীর নামটি লয় না
সেই দেশেতে এক যুবতি, ইশারায় করে ডাকাতি
কত লোকের হয় ক্ষতি বাও যারা জানে না ।
বিদেশের বাণিজ্য গেলে লাইও ষোল আনা
লাভের আশা থাকলে মনে পুঞ্জি বিনে কেই যাইও না ॥
সে যখন করে ডাকাতি, কেউ নয় কারো পক্ষপাতি
আদালতের নাইরে নথি, ফৌজদারি কারখানা ।
কেবা মারে কেবা মরে কেউ কারে ফিরায় না
মাতা পিতা ভাই বেরাদর কেউ তখন কাছে থাকে না ॥
সে যখন ডাকাতি করে কেহ যদি দেখে তারে
কোন জনায় কারে মারে কেউ চিনতে পারে না
আল্লা নবীর দোহাই দিলে ও কিছুতেই শুনে না ।
চোখ রাঙিয়ে বলে তোমার, আল্লা নবীর ধার ধারি না ॥
সেই দেশটা ভাই অতি গরম, অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে হরদম
লোহা দিলে হয়রে নরম কাঠখড়ি লাগে না ।
শ্মশানেতে মরা পোড়ে সবার আছে জানা ৷
এই শ্মশানে জেতা পোড়ে মরা গেলে পোড়া যায় না ॥
ঐ ঘাটের যে হয় ঘাটুনি, নামটি তাহার কাম কামিনী
মায়াবিনী রাক্ষসীনী মানুষ ছাড়া খায় না
সেই শ্মশানে পোড়া গাড়া না করলেও চলে না
রশিদ উদ্দিন পুড়তে পুড়তে পুড়ে গেল চৌদ্দ আনা ॥

২৫

আপন দেশে যাইতে বোধ হয় বেশি দেরি নাই ।
দিতেছে প্রমাণ শরীরে শুন ওরে মনা ভাই ৷
উঠেছে মুখের স্বাদ, লড়ে চাপার দাঁত,
ভীষণ যন্ত্রণা বাড়ে খাইতে গেলে ভাত ।
আমি চক্ষে দেখি কম, আর ঘন বহে দম
পিছে থেকে ডাকতেছে যম, আয় তরে দেশে পাঠাই ॥
পাকল মাথার চুল, কথায় পড়ে ভুল
ছেলে মেয়ে বলে ব্যাটা হয়েছে বাতুল।
আমি হইয়াছি দুৰ্বল, আমার বন্ধ চলাচল
ভাইবেরাদর বলে সকল খাওগারে তোমার কামাই ॥
সকলি তারার, কিছুই নাই আমার,
মিছামিছি খাটলাম কয়দিন ভূতের বেগার
আমার ঘরের রমণী, সেও বলে শুনি
অচল হইয়া গেছ তুমি, বিদায় কর আমি যাই ॥
এই ভাবে যাইবে সকল, শেষে আমি বেআক্কল
মিছামিছি সার করিলাম দুই নয়নের জল
ভেবে রশিদ উদ্দিন কয়, আমার মনে লাগে ভয়
পারঘাটাতে পারি দিতে খেওয়ার পয়সা নাই ॥

২৬

তরী বাইওরে সুজন নাইয়া বেলার দিগে চাইয়া ॥
অকুল নদীর বিষম পানি কেনবা রইলে বইয়া ॥
অসময়ে খোলছ তরী সময় না বুঝিয়া ।
হাওয়ার জোরে ভক্তি ডুরে বাদাম দাও তুলিয়া ॥
বায়াত্তর বছরের রাস্তা যাইতে পাড়ি দিয়া ।
নয়ন ফলক ঠিক রাখিয়া যাইও গো উজাইয়া ॥
কারবালা প্রান্তরের মধ্যে যাও হুঁশিয়ার হইয়া ।
রক্তবরণ জল চলে তার শঅজে চুঁইয়া চুঁইয়া ॥
মারাজাল বাহরাইন নদীদ্বয় যাইতে হবে বাইয়া ॥
গুলাইর নদী পাতাল ভেদি জানো রে সব নাইয়া ॥
রশিদ উদ্দিন ভাঙ্গা তরী গিয়াছে ডুবিয়া ॥

২৭

দেখবেরে মারফতের কল,
জোয়ারভাটার পাড়ঘাটে আমার সঙ্গে চল ৷
মাসে মাসে জোয়ার আসে শহর বাজার করে তল ॥
সেই নদীতে আছে তিনটি খাল
তিন ধারাতে চলে নদী বাজে তিনটি তাল
তিন রঙ্গেতে চলে পানি সাদা সবুজ লাল টলটল ॥
যেজন সাধুপুরুষ হয়, জোয়ার ভাটার খবর জেনে নদীর পাড়ে রয়,
দুগ্ধ জলে এক হইলে, দুগ্ধ খায় ফালাইয়া জল ॥
সেই নদীর মাঝে ত্রিবেণী, বার মাসে একদিন ভাসে চন্দ্র রুহিনী ।
সেই চন্দ্র যে ভেদ কইরাছে, গায়ে পাইয়াছে অতি বল ॥
আদি চন্দ্ৰ অনুগত মূল, চারিচন্দ্রের উৎপত্তি করে জীবের সঙ্গেতে গরল
সেই চারি যার হইল অধিকার, মরবে না খাইলে হলাহল ॥
আছে একটা রুহিনী চন্দ্র, মায়ের সঙ্গে খুব গোপনে কইরাছে কেন্দ্ৰ
পুরুষের কাছে জানি তার কিছু নকল ॥
কাহারে না বিশ্বাস করি, মালা তিলক জঠা মাথে দশ পাঞ্জাধারি
এরা আশায় আশায় ঘুরছে যেমন ভলন্টিয়ার দল ॥
রশিদ উদ্দিন ধইরা বহুকাল দেশবিদেশে ঘুরছে কত পাইতে মতিলাল ।
কামসমুদ্র মন্থন করে পাইল কিছু মন্দের ফল ॥

২৮

তারে ভাবতে গেলে প্রাণ আকুল
ফুলবাগানে নানান রঙ্গের ফুটল ফুল ॥
সে ফুল আধঃ মুখে রয়, তারে তত্ত্বশাস্ত্রে কয়
কারো ভাগ্যে ঊর্ধ্বমুখী কারো ভাগ্যে বাঁধলো গোল ।
যখন লাগে অমাবস্যা, তখন দেখা দেয় সমস্যা
অন্ধকারে চন্দ্র লোকায় ভ্রমর এসে হয় আকুল ॥
দেখতে পূর্ণমাসির দিন, একটি পদ্মপাতার চিন
পূর্ণচন্দ্র জলে ভাসে আলো করে গগন মূল ॥
কাঙ্গাল রশিদ উদ্দিন কয়, তারে খুব তালাশ করতে হয়
বাগান মূলে গভীর জলে, ডুব দিয়া সেই রত্ম তোল ॥

২৯

পুরুষকে ঘুরাইলে মায়ে কি যাদু জানে ॥
ধুনকে টংকার দিয়া বধে পরানে ॥
কি বলব মায়ের মহিমা বলতে কথা নাইরে সীমা
অপরূপ সাজিল মায়ে চল্লিশটি গুনে ॥
নয়নে কাজল কালি নাকেতে নাক্কুল বালি
হস্তেতে অনন্ত বালা, মাকড়ি দুই কানে ॥
ফুল চিরুনি মাথায় দিয়া দুই হাতের ঘুমটা টানিয়া
মিষ্টবাক্য প্রকাশিয়া পুরুষকে টানে ॥
দাড়ি-মুছ মুখেতে হয় না কাপড় পরতে কাঁচা দেয় না
গৃহকে পরিষ্কার রাখে অতি যতনে ॥
আদ্যশক্তি কুলবালা মাসে মাসে রজঃশলা
সন্তানকে গর্ভেতে রেখে কষ্ট পায় প্রাণে ॥
সস্তান যদি প্রসব করে স্তন্য দিয়া পালন করে
কত অত্যাচার করে কুলের সন্তানে ॥
মায়ের সংসারে কর্ম পাইতে গিয়া মায়ের মর্ম
রশিদ উদ্দিন মন দিয়াছে মায়ের চরণে ॥

৩০

কারে লইয়া কাটাইলে নিশি প্রাণের বন্ধুয়ারে ॥
কারে লইয়া কাটাইলে নিশি ॥
আগে যদি জানতাম বন্ধু হইবে পরের বাসী ।
তবে কি আর পরান খুলিয়া এতো ভালবাসি ॥
প্রথম পিরিতের কালে দিলে মুখের হাসি ।
কীজন্যে ছাড়িয়া গেলে আমারে বানাইয়া দোষী ॥
কুল কলঙ্কের ভয় রাখি না অভাগিনী দাসী
চাতকিনীর মত হইলাম তোমার প্রেমের পিয়াসী ॥
কবি রশিদ কেন্দে বলে, যারা প্রেমের বিলাসী
বিদেশি পুরুষের সঙ্গে কইরওনা মিশামিশি ॥

৩১

সোনা বন্ধুরে তোর লাগিয়া অন্তর করলাম শেষ ॥
আউলা কেশে বাউলা বেশে ঘুরিতেছি নানান দেশে ॥
যেদিন হইতে আইলে ঘরেতে আমার,
আমারে আর দেখা দেও না ঘরের মারিলে কেওয়ার।
আমি বাইরে ঘুরে করি চিৎকার দয়ার নাই তোর লেশ ॥
অন্দরে থাকিয়া তুমি সবারি মন রাখ,
আমি তরে দেখতে গেলে ঘুমটা দিয়া থাক ।
দেখা দিতে কিবা দুঃখ মনের কি উদ্দেশ্য ॥
একত্বের ভিতরে থেকে বহুত যোগাও, মেথর,
মুচি, ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবার ঘরে খাও ৷
আমার সঙ্গে করলে না রাও একি তোমার বেশ ॥
সতী কি অসতী তুমি কিছুই ত বুঝি না ।
লক্ষ স্বামীর ঘর করতেছ, তৃপ্তি কি মিটে না ।
কার সঙ্গে নাই চেনাজানা, সবই তোমার খেশ ॥
বাউলকবি রশিদ বলে কেমন তোমার প্রীতি
সুন্দরী কি অসুন্দরী পুরুষ কি প্রকৃতি ।
তুমি বৃদ্ধা কিবা হও যুবতী, কেমন তোমার বয়স ॥

৩২

দারুণ প্রেমে দিল এত জ্বালা ॥
আমি না জানিয়া প্রেম করিয়া কান্দি বসে নিরালা ॥
সহে না সহে না প্রাণে, তুই বন্ধুয়ার প্রেমবাণে গো
জলধারা দুই নয়নে বহিয়ে সারা বেলা ॥
হীরার কলসি কাঙ্কে লাইয়া, জল ভরতে যমুনায় যাইয়া গো
অভাগিনী রইলাম চাইয়া শূন্যময় কদমতলা ॥
কহে বাউল রশিদ উদ্দিন, প্রেম করা যে বড়ই কঠিন গো
যে বাঁচো ভবে যত দিন, কেউ যাইওনা প্রেমতলা ॥

৩৩

প্রেমপিপাসা আমার রইল রে মনে ॥
প্রেমের মতি বাড়াইয়া অতি
কেন বন্ধু তুই রইলে গোপনে ॥
ফুটিয়াছে পদ্ম আসিল না অদ্য
মধুভরা সদ্য আছে সন্ধানে ॥
কথায় করে বাধ্য প্রেম করিয়া সিদ্ধ
বাঁশি বাজায় গদ্য বসিয়া কোন বনে।
ফুটছে নানান রঙের ফুল জাতি, যুতি, বকুল
গন্ধেতে অতুল প্রেমকাননে ॥
হইয়াছি আকুল অন্তরে ব্যাকুল
ভ্রমরার গুনগুন শুনিয়া কানে ॥
কোকিলার ধ্বনি কর্ণেতে শুনি
আমি অভাগিনী থাকি কেমনে ॥
আসিলে রজনী ভাটিয়াল রাগিণী
প্রতিধ্বনি শুনি কানে কানে ।
নিবিড় অনন্ত জাগিল বসন্ত
প্রাণের কান্ত এল না কেনে ॥
রশিদ উদ্দিন মন হল উচাটন
শান্ত হইতাম যোগল মিলনে ॥

৩৪

যৌবন আমর হইল বৈরী ॥
যৌবন সময় কষ্ট কি সহ্য হয়
স্বামী হইল রে আমার দেশান্তরী ॥
যৌবন তাড়ন কে করে বারণ
বাইর হইয়া যায় প্রাণ আমি নারী।
যার ঘরে থাকি তারে নাহি দেখি।
স্বামী থাকতে আমি হইয়াছি বাড়ি ॥
যৌবনের টানে মদনের বাণে ।
প্রেমাগুনে আমি জ্বইলা মরি।
আমারে দেখিলে পাড়ার গুণ্ড ছেলে
দলে দলে আইসা ঘিরিয়া লয় বাড়ি ॥
জীবনে ত্যাজিব প্রাণ ঘুচাব আপমান।
রাখিব যশমান জগজুড়ি।
নইলে ভালবাসা করিব জিজ্ঞাসা
মন প্রাণ কেন আমার করেছিলে চুরি ॥
রশিদ উদ্দিন বলে পড়েছি জঞ্জালে।
কোন দেশে গেলে মিলে প্রেমের মাধুরী।
সইয়া লোকের গালাগালি কান্দে লইয়া ভিক্ষার ঝুলি।
গলেতে বান্ধিয়াছি প্রেমের ডুরি ॥

৩৫

রশিদ উদ্দিন ঘুরে ফিরে কাজ পাইলা না এই সংসারে
দুই সতিনের গান একটা বসিয়া বানায় ॥
দুই সতীন যার ঘরে কথায় কথায় বিবাদ করে।
আয়ু থাকতে স্বামী মরে দ্বন্দ্বেরি জ্বালায়।
অল্প কিছু রাগ করে দুই জনে দুই বিছানা করে।
ঠেকলো স্বামী ভীষণ ফেরে কার বিছানায় যায় ॥
যাবে স্বামী কার বাসারে বসে বসে চিন্তা করে
টিক্যা জ্বালায় তামুক ভরে নারিকেলের হুক্কায়।
গরু মরে দু’ঘাসায় মানুষ মরে দু’আশায়
এই ভাবে রাত্রি কাটায় হুক্কায় আর চোঙ্গায় ॥
দুই সতীনের দেখে দ্বন্ধ রশিদ উদ্দিন জবান বন্ধ।
দুই সাদি গিয়া কর বন্ধ কম শক্তিওয়ালায়,
কম শক্তি যার গায় উঠলে গিয়া দৌড়ের নায়
রাইতে দিনে জ্বর বায় বাইছেরি ঠেলায় ॥
মনে হইল আরেক কথা কেউ যাইওনা ঘরজামাতা
একজন মারলে লাগে ব্যাথা বাড়ির সমুদায়।
বেশি কথা কও যদি যত শালা-সমন্দি
লাঠি লইয়া কুদাকুদি মাথা ভাঙ্গতে চায় ॥

৩৬

(বিচ্ছেদ)

আমি কৈ যাইরে ঘোর সন্ধ্যা সময়
কার বাড়িতে যাইব আমি কে দিবে আশ্রয় ॥
গুরুগো …
একতো আঁধার রাতি, নাইকো আমার সঙ্গের সাথী
গতিবিধি কি জানি কি হয়।
চলছি আমি এক পথে ভারি বুঝা আছে সাথে
পথে পথে ভূত-পিচাশের ভয় ॥
গুরুগো …
যারা ছিল আমার আপন, সকলেই হইয়াছে দুষ্মন
আত্মীয়স্বজন কথা নাহি কয়।
ডাকিলে না দেয় সাড়া, সবায় বলে তাড়া তাড়া
কপাল পুড়া দেরি নাহি সয় ॥
গুরুগো …
কেবা কার পর কেবা আপন, এ সংসার নিশির স্বপন
ঘুম ভাঙ্গিলে এসব কিছুই না।
আজ হইতে ভূতের কাঁচারি, ভেঙ্গে যাবে বসতবাড়ি
কাড়াকাড়ি হবে সবসময় ॥
গুরুগো …
আগে যদি জানতাম আমি এই সবে করবে বেঈমানি
তবে কি আর করতাম পরিচয়।
যাই চলে যাই নাই ভাবনা, আর যেন আসিতে হয় না।
রশিদ উদ্দির এই প্রার্থনা রয় ॥

৩৭

জীবন সঙ্গীতে, ইশারা ইঙ্গিতে, কতভাবে গাইছি গান ॥
ঠুমরি টেস্ কাওয়ালি, কাশ্মিরি ধামাল,
মাঝে মাঝে তেহাই কেটে বাজাইছি ত্রিতাল
আদ্দা চৌতালে, পড়িয়া গোলেমালে, দিতে পারলাম না মধ্যমান ॥
আশা ভুপালিতে করে এত জোড়
স্বপ্নরাজ্য পাইয়া আমি হইয়াছি বিভোর।
যদি পুস্ত আরা, পুত্র কন্যা দারা, আমাকে করেছে হয়রান ॥
পূরবী ভৈরবী সুরে মারছি যখন টান,
কুল ছড়িয়া কুলবধূ হইছে পেরেশান
(পরে) বাজাইয়া আরা টেকা হইল বিষম ঠেকা
হইলাম কত অপমান ॥
ঝিঁঝিট বেহাগ সুরে তুলিয়া রাগিণী।
ললিত খাম্বাজে কত করছি টানাটানি
সুহিনী সুরটে বসে নদীর তটে
তরঙ্গে তরঙ্গে কত গাইছি উজান ॥
বাউলকবি রশিদ বলে সবি গেছে ছেড়ে
তাল, মান, লয়, সুর গেছে একেবারে
দীপক রাগিণী, উঠে দিনরজনী উধ্বশ্বাসে অগ্নিবাণ ।

৩৮

আসিলে সমন, শরীরের শক্তি তখন।
কোথায় করবে পলায়ন ভাবলে না একবার ॥
ছেলেমেয়ে শিশুকালে, কত কষ্টে মায়ে পালে
ক্ষুধা হইলে দুগ্ধ কলা খাওয়ায় বারবার।
কান্দে যদি পুত্রধন, চমকে উঠে মায়ের মন
কাম ছাড়িয়া দেয় মায়ে, শুনিয়া চিৎকার ॥
মায়ের মত স্নেহহময়ী এই জগতে আছে কই।
দধি চিড়া মুড়ি খই করে গো তৈয়ার ॥
পুত্র গেলে পরবাসে থাকে তার আশায় আশে
কবে বা আসিয়া পুত্র করিবে আহার ॥
পুত্র সেয়ান হইলে পরে দিনে দিনে হিংসা বাড়ে
মা কিছু কইলে তারে ফিরায়া দেয় ঘাড়
শুন বলিগো বুড়ি মাতা সাবধানে বলিও কথা
উঠাইয়া নিব মমতা মারিয়া আছাড় ॥
পুত্র যদি সাদী করে মনে মনে ভাবনা করে
থাকতাম না একঘরে ভাবনা কি আমার ॥
কথায় কথায় বিবাদ করে দেও আমারে পৃথক করে
পারি আমি যেমন করে চালাইব সংসার।
পিতাপুত্রের দেখে দ্বন্দ্ব রশিদ উদ্দির নাপছন্দ
ভাগ্যগুণে কপাল মন্দ হইয়াছে তাহার।
হায়রে কঠিন সংসার ঘটিতেছে কি অবিচার
পিতাপুত্রের এই ব্যবহার সহ্য করা ভার ।।

৩৯

গুইল মারা যায় গাতে মানুষ, গুইল মারা যায় গাতে ॥
অভাবেতে দেশ খাইয়াছে পয়সা নাই ভাই লোকের হাতে ॥
এইবার দেইখাছি কত, ভিজা শিয়ালের দল যত
দল বান্ধিয়া ঘুরে পথ মিল্যা বাপে পুতে।
মোটা মোটা লাঠি গিয়া দেখ তারার হাতে।
বাড়ি দিয়া মারে না গুইল জাবুরিইয়া গিয়া ধরে হাতে ॥
গুইল যদি পরে বেড়ে, পুতে উঠ্যা কয় বাপেরে
গুইল যদি আইজ ছুডে পরে কইলাম আচ্ছামতে।
একটা গুইল ছুঁইট্যা গেল ওই না জঙ্গলাতে।
বাপে পুতে কাইজ্যা লাইগ্যা বাপরে ধইর‍্যা পুতে জাতে ॥
বুইড়া বাড়িত গিয়া পরে, বুড়ির লগে আলাপ করে
রাখছে না আইজ মাইরা ফালইছেরে পুঙ্গির পুতে।
বুড়ি বলে গেছলা কেরে তুমি পোলার সাথে
তুমি যদি মইরা যাইতা করাবার চলত কার সাথে ॥
টাকার লোভেতে পড়ে, গুইল মাইরা দেশ উজার করে
ভাত যদি না থাকে ঘরে কি করবে তার জাতে।
গুইলের চামড়া পাঁচ টাকা হুনছি না হাতেগুতে
গুইলের চামড়া বিক্রি কইরা মিশি লাগায় বৌয়ের দাঁতে ॥
রশিদ উদ্দিন বানছে গান, শুন হিন্দু মুসলমান
ভারতের গিয়াছে সম্মান পইড়া অভাবেতে।
গুইল হইল গিয়া দেশের সম্পদ বুঝাই কত মতে।
ভদ্রলোকে গুইল মারে না গুইল মারে গোলামের জাতে ॥

৪০

আরবদেশে মানুষ বেশে এল একজনা।
যার পরশে লোহা ঘষে হয়ে যায় সোনা ॥
ধরিয়া মোহন ছবি, মক্কাতে উদিত রবি।
সকলেরই শেষ নবী কেউতো চিনল না
যে চিনিল দূর হইল ভব যাতনা ॥
আছো যত যাত্রীর দল, গাটুরী বাধিয়া চল
আরবসাগর পাড়ি দিতে দেরি কইর না
আবে যমযম কূয়ার পানি খাইয়া দেখলাম না ॥
আছে জান মক্কার ঘর, দরজা খোলা তওবা কর
কেন আছ বে-খবর করিয়া গোনা
হুজরে আসওয়াদ না চুমিলে (তওবা) কবুল হবে না ॥
এই জানো যে খোদার ঘরে, ফেরেস্তারা নামাজ পড়ে
সেই ঘরেতে তোয়াফ করতে হইয়া যাও রওয়ানা ॥
তের মঞ্জিল পাড়ি দিলে মিলবে মদীনা ॥
মনে প্রাণে এক্বিদাতে পড়গা নবীর রওজাতে
উম্মতের কারণে নবী বেহেস্তে গেলেন না
রশিদে কয় আর কিসের ভয়, নামটি ভুইল না ॥

৪১

এই ভবের বাজার, নূর নবী ম্যানেজার।
খোদ কম্পানী মহারাণী মায়ের অধিকার ॥
বাজারেতে বেচাকিনা, মেয়ে পুরুষ দুইজনা।
অন্য কেউরে যাইতে দেয় না, করিতে ব্যাপার।
পুরুষের ধন মাথায় করে নিয়ে গেলে সেই বাজারে,
মাইয়া লোকে খরিদ করে মূল্য দেয় না তার।
যত আছে মায়ের বংশ, আদ্যের শক্তি অর্ধেক অংশ,
আবেমণি জলের অংশ তাহাতে তৈয়ার ॥
মায়ের কাছে আগুন পুরুষের কাছে নয়গুন।
দশটি গুণ আছে বেশি মায়ের ভাণ্ডার ॥
উনিশ গুণে টাইন্যা মারে, নয় গুণে কি করতে পারে।
এই ভাবেতে মায়া-পুরুষ টানাটানি সার ॥
চুম্বকে লোহা পাইলে টানে যেমন কৌশলে
চুম্বকের টানে হালে লোহার পাহাড় ॥
গাছে যদি ফল ধরে কেউ যদি দেখে তারে
কার না মনে পড়ে করিতে আহার ॥
দেখিলে নারীর যৌবন কে-বা আছে এমন জন
লোভ করিতে সম্বরণ পৃথিবীর মাঝার।
মায়ের কাছে নাহি গেলে সব কিছু যাবে বিফলে
গতি কি আর পরকালে হইতে উদ্ধার।
রশিদ উদ্দিন কয় কথা ফাতেমা জগতের মাতা
তার সিকিমে আছ গাঁথা তামাম সংসার ॥

৪২

খুঁজবি বলে দিন ফুরাইলে খুঁজলে দেখা দিতে তোরে
খুঁজলিনা কেন তারে ও তুই খুঁজলিনা কেন তারে ॥
হাওয়াতে লাগাইয়া ডুরি উড়াইয়াছি রঙিন ঘুড়ি
বসিয়া মথুরাপুরি টানা-টানি করে।
ঘুড়ির ভিতর নামটি লিখা আছে দুই অক্ষরে
পইড়া গেলে দেয় উড়াইয়া দেখ রে বর্যক পাহাড়ে ॥
সব রাস্তা করিয়া বন্ধ বস গিয়া গোয়ালন্দ
চিত্তরঞ্জন প্রেমানন্দ আসা যাওয়া করে।
একবার যদি দেখা পাও বেঁধে রেখো তারে ॥
দিও না কষ্ট, রাইখ তুষ্ট বাইন্ধা রাইখো ভক্তির ডুরে ॥
সহজভাবে পাইবা তারে যাওগা তোরা শান্তিপুরে
অশান্তি করিলে দূরে মিলবে এক বছরে
তিনশত ষাইট দিনে বছর হিসাব করে
আছে একদিন বড়ই কঠিন নিজ ছুরতে দেখা করে ॥
শরিয়ত কয় খুদ ভরসা রাসূলউল্লার চরণ আশা।
নামাজ রোজা করলে নিশা তরবে গিয়া আখেরে
মারফতে কয় মুশকিল খোশা ব্যক্ত এ সংসারে
আপনি খোদা নিজের মুখে মা বলিয়া ডাকছে যারে ॥
রশিদ উদ্দিন মনের ব্যথা বলতে গেলে গুমর কথা
শইরতউলা ভাঙ্গতে মাথা চায় যে আমারে।
লোকনিন্দা কূল কলঙ্ক সব রাইখাছি দূরে
আছি বাধা, হইয়া গাঁধা, পড়িয়া এই ঘোর আঁধারে ॥

৪৩

কর্ণে শুনিবে যাহা প্রত্যক্ষ প্রমাণ তাহা
মানব একটি কলের গাড়ি হওয়াতে চালায় ॥
দুই ধারে কম্পাসের গোড়া সম্মুখে দুই নয়ন
তারা উপরে এক নিশান গাড়া বাতাসে নাড়ায়।
মাঝখানেতে কয়লার গাড়া পাঁচজনা তার দরজায় খাড়া
ডালিতেছে কয়লার গুঁড়া ইস্টিমের দায় ॥
একসঙ্গেতে দুইটি বোম চলছে অগ্নির ধূম
কেনরে মন দিছ ঘুম ঐ দেখা যায়।
উপরে জলের ভাণ্ড নিচে আগুনের কুণ্ড
ক্ষমা নেই এক দণ্ড চালায় দুইজনায় ॥
অষ্টধাতুর মেশিন চলিতেছে রাত্রদিন
তৈল সলিতা কেরোসিন কিছু নাহি চায়।
ইলেকট্রিক বিদ্যুতের জুড়ে মিনিটে ব্রক্ষ্মাণ্ড ঘুরে
গ্রীষ্মকাল আসিলে পরে অমনি থেমে যায় ॥
পাখার বলে চাকা ঘুরে বাহাত্তর হাজার তারে
দিল্লী কিংবা মণিপুরে খবর নিয়া যায়।
রশিদ উদ্দীন বেকারার মেশিনের পড়েছে ঝংকার
ইঞ্জিন ধরেছে বিকার কি করে উপায় ॥

৪৪

লাইনের উপর চলছে গাড়ি কেমন আজব কল
সকল সময় সমান চলে পুরান হইলে হয় দুর্বল ॥
অষ্টধাতুর মেশিনখানি আপনি চালায় খোদ কম্পানি
হাওয়া কলে মা জননী বসেছে মণিপুর দল।
নামে কুলকুণ্ডলিনী হাওয়ার কলে দিলে টিপনি
অহং বলে উঠে ধ্বনি সুহং বলে চলাচল ॥
এই গাড়িতে ছয়জন সোয়ারি নানান জিনিস বোঝাই করি
পাছে বেন্ধে মালগাড়ি করিতেছি কোলাহল।
যাইতে গাড়ি স্বর্গপুরে রাস্তায় ডাকাইতে মারে
নিয়ো রাইফেল তেমরা সঙ্গে করে তাহারি নামের ॥
জলের কলে ঝঙ্কার দিলে জল চলে তার ঊর্ধ্বনালে
ব্রহ্মছালে দুইটি নালে টপটপ করে পড়ে জল।
সম্মুখে তার দুইটি বাতি ক্ষমা নাইরে দিবারাতি
চার রঙ্গে ধরছে আকৃতি ব্রহ্মাণ্ড করে উজ্জ্বল ॥
দুই দিকে দুই হাইত না তাওয়া দুইটি চাকা ডাইনা বাওয়া
ঘুরিতেছে নিত্তি নয়া এই মাত্র গাড়ির সম্বল।
লাইন ছাড়িয়া গাড়ি পরলে পেসেঞ্জার সব যাবে চলে
কেউ না দিবে তারে তোলে সকলি বিদেশির দল ॥
যার হইয়াছে মেশিন খাঁটি কুমারের পুড়া মাটি
রঙ দিয়া করছে পরিপাটি চেনা যায় আসল নকল।
রসিদ উদ্দিন কর্ম বুড়া নতুন মেশিন হইল টেরা।
লাইন ছাড়িয়া হইল খাড়া, এই বুঝি তার কর্মফল ॥

৪৫

চলছে দমের গাড়ি
দিবানিশি বিশ্রাম হয় না (যাইতে) রাজা কুণ্ডের বাড়ি ॥
মুলাধার গুহ্যমূলে, প্রথম গাড়ির লাইন খুলে,
রক্তবরণ চতুর্দলে আছে সারি সারি।
জীবাত্মা পেসেঞ্জার হইয়া করছে বাবুগিরী
কুণ্ডলীনি মহারাণী চতুর্ভুজাধারী ॥
শিক্ষাগুরু টিকেট মাস্টার, শ্রী গুরু হইয়াছে ড্রাইভার।
ডাকিনী শক্তির সঞ্চার, করছে ইঞ্জিনিয়ারী
অপাঙ বায়ুর চোটে গাড়ি চলছে তাড়াতাড়ি।
তিনহাজার ছয়শ মাইল দূরে, দিছে সিগন্যাল ডাউন করি ॥
ষড়দল সাদিস্টিনে, বোম্বাই জেলার ইস্টিশনে
বস্তাভরা মাল আনে, করতে দোকানদারি।
মাল টানিতে ছয় ডাকাতে করছে ওরা-ওরি।
কারো কথা কেউ শুনে না লাগছে বিষম মারামারি ॥
ডাকেনি শক্তি তাতে টিকেট সাইন করে হাতে
ভূতাত্মা তার মাঝেতে করছে পেসেঞ্জারি
মণিপুরে যাইতে গাড়ি ঘন্টিত পড়ল বারি
সাবধানে থাকিও তোমরা হয় যে কত চুরিজারি ॥
মণিপুরে কি চমৎকার, লাইন খুলেছে বাহাত্তর হাজার
আত্মারাম হইয়া পেসেঞ্জার করছে দৌড়াদৌড়ি
পদ্মযোনি ইঞ্জিনিয়ার করছে ট্রাই গাড়ি।
মাধবী গোস্বামী তাতে করছে টিকেট কালেকটারি ॥
দ্বাদশ গোপাল টিকেট কাটে, চলছে পরাণ বায়ুর চোটে
‘ডাকিনী’ শক্তি তাতে আহা মরি মরি।
বার দলে হৃদকমলে দমদমার কাচারী
রামেশ্বর পেছেনজার হইয়া হাওয়ার গাড়ি দিল ছাড়ি ॥
ষোল দলে কি চমৎকার, শ্রী গোবিন্দ স্টেশনমাস্টার,
পরমাত্মা হয় পেসেঞ্জার, দেখ না বিচার করি।
এখান থেকে এরোপ্লেনে উদানবায়ু ভরি
সহস্রারে উঠ যাইয়া রশিদে কয় বিনয় করি ॥

৪৬

ঐ দেখ মেন্টেলে তৈল ঝরে বাতির মেন্টেলে তৈল ঝরে
কেমন সুন্দর পরিপাটি, আয়না গাড়া চতুৰ্ধারে ॥
সধ্যমত তৈল ভরে পাম দিও তার মিটার ধরে
মিটারে বেটারা হইলে, ব্রাস্ট হইতে পারে।
একুশ হাজার ছয়শ পাওয়ার মেন্টেলের ভিতরে
পাম করিও রীতিমত, পিন করিও হুঁশিয়ারে ॥
প্রাণায়াম অভ্যাস কর, কুম্ভক সাধন কর।
ধীরে ধীরে কর্ম সার সাধ্য অনুসারে।
রেচক পুরক দুইটা ধারা উঠাপড়া করে।
তার ভিতরে জীবন মরণ কমাইতে বেশাইতে পারে ॥
কর গিয়া তাহার সন্ধান, দেখিতে পাইবে বর্তমান
মানুষেতে আছে প্রমাণ প্রতি ঘরে ঘরে।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা কর বিশ্ববিজ্ঞান পড়ে।
কোন কলেতে চাবি দিলে, কোন কলে গিয়া ধুয়া ছাড়ে ॥
বাউলকবি রশিদ বলে, দেহ মণ্ডল কলে চলে
নদী নালা খালা বিলা কান্তারে প্রান্তরে।
দেহরাজ্যের আচার বিচার যে জন করতে পারে।
কি করবে তার তপে জপে, কি করবে তার নামায রোজার
স্বর্গে যাবে সশরীরে ॥

৪৭

দেহরাজ্যের অভ্যন্তরে বিরাট একটি বল খেলা
লাথা-লাথি গুতাগুতি হইতেছে সারা বেলা ॥
ইচ্ছা জ্ঞান দুইটি পিয়ার, মাঠেতে উড়াইয়া ধুলা।
হুরাহুরি দৌড়াদৌড়ি মারে কত ধাক্কা ঠেলা ॥
সুনামগঞ্জে কুনামগঞ্জে উভয় দলের মোকাবিলা।
দুই পক্ষের দুই গৌলি খাড়া সুমতি কুমতি দুইলা ॥
সুমতির প্লিয়ার যত সংযম ক্ষমাগুলা।
কাম, ক্রোধ, লোভ আদি এইসব হয় কুমতির চেলা ॥
চৈতন্য রেফারি হইয়া অফসাইট ফাউল ধরে দিলা।
চতুর্পার্শ্বে আছে বসে তামসা দেখে বুড়াপুলা ॥
কুমতির প্রতিযোগী আছে কয়টা গুণ্ডাপুলা
দিচ্ছে তারা হাততালি সুসময়ে করে হল্লা ॥
বাউলকবি রশিদ বলে, লাগছে বড় উলা মেলা।
লাথির চোটে যাবে ফেটে, কোনদিন জানি বলের তালা ॥

৪৮

এই ভবসাগরে প্রেমেরই লহরে
বাইয়া যাও মানবতরী মনে আছে যার ॥
চৌদ্দ পোয়া লম্বা তরী মোল জনা দাঁড়ের দাঁড়ি
পাঁচজনা প্রহরী, চারজনা চরণদার।
বাও দেখি তাড়াতাড়ি বেলা আছে দণ্ড চারি।
নৌকায় তোমার মন-বেপারী ধরিবে কাণ্ডার ॥
নায়ে দুইশ ছয়টি জোড়া চব্বিশখানা দিছে গোরা
মানবতরী করল খাড়া কেমন পরিষ্কার ॥
লোহা ছাড়া তক্তা গাড়া চার রঙে তার বার্নিশ করা।
কোঠায় কোঠায় জিনিস ভরা অনেক প্রকার।
বাইয়ো তরী ধীরে ধীরে মাল ভরিও মণিপুরে
থাইকো নদীর দক্ষিণ পাড়ে করিলে বেপার ॥
মদনগঞ্জের বাজারে বিকি দিয়ে লাভ করে
আসলেতে খাস্তা পড়ে যায় না যে কাহার
সাবধান সাবধান বলি সঙ্গে রাইখ পুঞ্জির থলি
সেদেশের লোক বড়ই খলি ঠগেরি কারবার ॥
রশিদ উদ্দিন বলে খাঁটি গুরু নামের নিয়ে চিঠি
সেই বাজারে একজন বেটি মহাল তশীলদার ॥

৪৯

কামনদীতে জোয়ার আইলে থাইকরে সাবধান
বায়ুকোণে সাঁঝ বাঁধিয়া হঠাৎ কুন ছুটবে তুফান ॥
যখন নদী হুমা ডাকে, জাহাজ নৌকা দূরে থাকে।
ত্রিবেণী আর গোল্লার বাঁকে সাধু যারা করে স্নান।
সেই নদীতে তিনটি ধারা, তিন পর্দাতে আছে বেড়া
হিমালয় পর্বতের চূড়া, ভেঙে আসে জলের টান।
অমাবস্যা পূর্ণিমাসি সাবধানে থাকিও বসি।
জাহাজ নৌকা বান্ধ কষি, নিয়ে সমুদ্রের উজান।
ছয়জনারে বাধ্য করে, ছাড় নৌকা তিন দিন পরে
বেপার করে আসবে ঘরে, না হইলে পড়বে লোকসান ॥
কৃষ্ণপক্ষের প্রতিপদে থাকিও খুব সংযমেতে
ষষ্ঠী ও অষ্টমী গতে, চক বাজারে দাও চালান।
চতুর্থ তারিখে সোনা, বেপার হইবে দুনা।
নবমীতে কেউ যাইয়ো না রশিদ উদ্দির কথা মান ॥
যখন নদীর জোয়ার আসে রত্ন মানিক কতই ভাসে
সাধুজনায় আশার আশে, নদীর পাড়ে নিল স্থান।
মায়ায় জমাইছে বাজার, তিনদিন মাত্র চলে কারবার
কিনতে গিয়া সব দোখানদার, হইল কত পেরেশান ॥
আবরণ সম্বরণ নামে, দুইটি সুতা ডাইনে বামে
চলিতেছে যার তার কামে, বেদের তত্ত্ব তার প্রমাণ।
আর এক সুতার নাম প্রসারণ, সেই সুতায় সাধন করণ
মনের আশা হবে পূরণ, সম্মুখে পইবে ময়দান ॥

৫০

ভক্তির জাঙ্গি হাতে নিয়া পাখি ধরতে যাই
পাখির দলে গভীর জলে খেলছে প্রেমের লাই ॥
ত্রিবেণীর উজান বাঁকে, নাভিপদ্মের চতুর্দিকে
শব্দ উঠে থেকে থেকে, নামটি তাহার আলেক সাই ॥
দেখরে আজব তামাসা, হওয়ার উপর বানছে বাসা।
জলের সনে মিলা মিশা ঘরবাড়ি তার কিছুই নাই ॥
তরঙ্গে তার আনাগোনা, এক জাগাতে নাই ঠিকানা।
ধরবে যদি অধরারে নিয়া দেও নামের মিঠাই ॥
রশিদ উদ্দির গবেষণা কেমন সুন্দর পাখির ছানা।
ধরতে গেলে ধরা দেয় না অযথা পিছে দৌড়াই ॥

৫১

ঘাটে ডুব দিয়া তুল মণি ॥
ডুবলে পরে, অতুল নীরে, মিলবে রতি সাদা লনি ॥
কী লীলা কইরাছে বিধি, পুলের উপর বানছে নদী
অধঃমুখে নদীর গতি আজব কাহিনী
তিন ধারেতে স্রোত চলছে নাম ধরে ত্রিবেণী
মাঝখানেতে সিংহাসনে বইসাছে খোদ মহারাণী ॥
নদীর নামটি কীর্তিনাশা জলের নিচে সাপের বাসা।
চৌদিকেতে মাছি মশা দিতেছে জয়ধ্বনী।
মন্ত্র ছাড়া কাছে গেলে অমনি ধরে ফণী ॥
মাথা তুলে দংশে যারে মিলে না তার অষুধ পানি।
ঘাটের পাড়ে দেও পাহারা, ভেসে উঠবে চমক তারা।
তিন দিন তিন মহাজনে করে মহাজনি।
আগে দাদা পাছে পিতা মাঝের দিনে মা জননী ॥
যদিরে কেউর মনে থাকে, যাইওরে বিরজার পাঁকে
তালাস কইর বাঁকে বাঁকে ভেসে উঠবে লনী।
গভীর জলে ডুব দিলে ভাই মিলবে সোনার খনি।
সন্ধানে উঠাইয়ো মাল বাকসেতে লাগাইয়া ছুড়ানি ॥
রশিদ উদ্দিন কপাল মন্দ, পাড় ঘাটায় গোদারা বন্ধ।
এখন কি করে পছন্দ ভাবছে বসে দিনরজনী
সেই পাড়ে মথুরার বাজার লাগছে বিকিকিনি
যে থাক সে থাক কর্ম কপালে ঝাঁপ দিয়া খাব লোনা পানি ॥

৫২

পিনরায় কেন ছটপট দেখি, ওরে আমার ময়না পাখি।
দুধকলা খাওয়াইলে কত, তেও তুমি হইলে না সুখি ॥
অন্ন দিতাম স্বর্ণের থালে, আরকি তোমার রাখলাম বাকি।
তোমায় লয়ে পরম সুখে, করতাম প্রেমের মাখামাখি ॥
জঙ্গলায় থাকে ছয়টি পাখি, তাদের যুক্তি লইছ নাকি?
বুঝি না তোর ভাবের ধারা, কোনদিনবা তুই মারছ লুকি ॥
তোমার খুঁজে পাইনি কোথাও করলাম কত ডাকাডাকি।
তোমার জন্য রশিদ উদ্দিন, ঘোর কইরাছে দুইটি আঁখি ॥

৫৩

জোয়ারভাটার খবর জেনে জালুয়ায় ফালাইছে জাল।
অতি তরঙ্গের নদী বয় না চিরকাল ॥
মনরে…শুন বলি জালুয়ার ছেলে, বসে থাকে নদীর কূলে
যখন নদীর জোয়ার চলে, ভেসে যায় তার অনেক মাল।
ষোল আনা টিকেট করে, পারঘাটা লও রির্জাভ করে
ভয় পাইয়া পলাইসনা দূরে, দেখিয়া তরঙ্গের তাল ॥
মনওে…অনুরাগের কুড়া দিয়া বিশ্বাসের বঁড়শি লাগাইয়া
ভক্তির আটায় টোপ গাঁথিয়া, বঁড়শির দিকে রাখিস খেয়াল
গুরু গোসাইর সঙ্গ ধর, প্রেম চরকায় সুতা ছাড়
সাধ্য মত যেমন পার দিও সুতায় তিনটি নাল ॥
মনরে…গহীনের ডুবালো যারা, সেই নদীতে ডুবছে তারা
ভয় করে না বিন্দু জড়া, গায় পইড়াছে রেশমী শাল।
যেখানেতে মালের কোঠা, দরজায় দিয়াছে কাঁটা।
সাহস করে যাইসরে বেটা সর্পের মাথায় জ্বলছে লাল ॥
মনরে…শুন বলি আর একটি কথা, সেই নদীর হয় তিনটি সুতা
আছেরে তো গাঙ্গের মাথা, কুম্ভীর ভাসে পালের পাল
ভক্তি ছাড়া যুক্তি করে যে গিয়াছে নদীর পাড়ে
কুম্ভিরিনী আহার করে ডুব দিয়া গেছে পাতাল ॥
মনরে…রশিদ উদ্দিন কয়রে সাধু খাবি যদি চাকের মধু
বাধ্য কর ঘরের বধূ, যে হইল ভবের জঞ্জাল।
নামের হলুদ গায় মাখিলে ছোঁয় না পোকায় গন্ধ পাইলে
সে ধন কি সহজে মিলে ভাণ্ডারেতে নিয়া সামাল ॥

৫৪

হবে মন তোর কী উপায়, ভজরে কিশোরীর পায়
কিশোরী ভজন, কিশোরী পূজন, কিশোরী বিনে নাই উপায় ॥
কিশোরী তোর কমরের ঘুঙ্গুর, তোমারি চরণের নূপুর,
গলাতে কণ্টকের মালা মস্তকে ময়ূর তোমার।
চলিতে কিংকিনি বাজে, কী চমৎকার শুনা যায় ॥
আদ্যশক্তি আস্বাদনে জীতেন্দ্রিয় সাধুগণে।
মজে রইল রাত্র দিনে, কিশোরীর চরণ সেবায়।
তারে রেখে সতি, করে স্তুতি, সন্ধানে গিয়া মাল উঠায় ॥
আছে নারী চারি জাতি পদ্মিনী পদ্মেতে মতি।
জ্বলছে রতন দিবা রাতি, খোঁজ মন তুই সেই জায়গায়
অমূল্য ধন আছে, গোপন বন্ধ যে উল্টা তলায় ॥
লাল সাদা দুইটি মতি, সাবধানে রাখিও অতি
লক্ষ রেখ তাহার প্রতি, যে তোমার অভিপ্রায়।
তারে করিলে অর্জন, করো না বর্জন, বন্ধ রেখ কটরায় ॥
ললনা প্রেম সোহাগিনী ভুবনহরা মন মোনিনী
তরুণী বালিকার মণি, তুলবে যদি শীঘ্র আয়।
এই মণি হল সাধন, সমনকে কলা দেখায় ॥
ক্ষীরোদ তটিনীর তটে, জলের নিচে এক চন্দ্র উঠে
রুহিনী তার নামটি বটে তরঙ্গে তরঙ্গে ধায়।
সেই চন্দ্র যার সাধন হইল সোনার অঙ্গ হইয়া যায় ॥
জলের নিচে মানুষ একজন, বসনভূষণ রক্তবরণ।
সুধার হড়ি হাতে নিয়া, নিমন্ত্রণ করিয়া যায়।
রশিদ উদ্দিন নাইকো দেশে সে নিমন্ত্রণ কেবা খায় ॥

৫৫

আচম্বিতে মরা গাঙ্গে জোয়ার গেল ভেসে
হায়রে বেহুদা মন তুই পাড়ি দিবে কিসে ॥
কত সাউদ মহাজন পাড়ি দিতে পায় না নদীর দিশে।
সাঁতার দিয়া জল খাইয়া মারা গেল বিষে ॥
নদীর উপর বৃক্ষ একটি একটুক উজান ঘেসে।
পাথর শিলা বৃক্ষের নামটি শিকড় নাই তার শেষে ॥
সেই নদীতে জল আনিতে একজন নামিল সাহসে।
জল আনিয়া পাড়ে উঠে পরে বেহুশে ॥
সেই নদীর তরঙ্গ ভারি চলে অতি জোসে।
জলের নিচে পাখির বাসা ভাঙ্গল বাতাসে ॥
সিদ্ধ মানুষ দিছে পাড়ি গুরুজির পরশে
রশিদ উদ্দিন নদীর পাড়ে খাড়া আছে আশে ॥

৫৬

আমার সোয়াচান পাখি
আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি?
তুমি আমি জনমভরা ছিলাম মাখামাখি
আজি কেন তুই হইলে নীরব মেল দুইটি আঁখি ॥
বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নাম তর রাখি
শিকল কেটে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি ।
তোমার আমার মধুর পিরিত চন্দ্র সূর্য সাক্ষী।
অকস্মাৎ কেন ভেঙে দিলে বুঝলাম না চালাকি ॥
বিশ্বজোড়া এই পিরিতি সবই দেখছি ফাঁকি।
বাউলকবি রশিদ বলে ডাকলেই বা হবে কি ॥

৫৭

শুন ওরে দোকানদার, বেচাকিনায় খবরদার
সভ্যতা আজ নাই রে দেশে, ঠগামি কারবার ॥
দেখিয়াছি ভবের বাও, জিনিস লইয়া ধরে পাও
মুখে নাহি করে রাও সাধু ব্যবহার।
তোমার পাঁচ মসল্লার দোকান, রেখে যাইও সাবধান
সঙ্গী করে আরও কয়জন রেখো পাহারাদার ॥
পঁচাশি দশ আনার ভাণ্ডী, মহাজনের করা গুন্তি
চৌদ্দ পোয়া লম্বা ডাণ্ডি করেছ তৈয়ার।
ওজন দিও ষোল আনা, বেপারের কাম হবে দু’আনা
সাবধান কেউ বেশকম দিও না হবে গোনাহগার ॥
ঠিক রেখ আপনার পাল্লা, লইও না কেউ পরের সল্লা
ওজন দিও বিসমিল্লা দিনেতে পঁচবার।
সঙ্গে নিয়া সাফায়াত উল্লা, কিনবেন এসে রাসুল উল্লা
ভরতে যদি পার গোল্লা হবে তোর বাহার ॥
সই রাখিও ডাণ্ডির কাটা পাছে খাড়া পুলিশ বেটা
সঙ্গে তোমার রিপু ছয়টা বড় যুক্তিদার।
রশিদ উদ্দিন বলে যায়, যদি পাল্লার ফের পায়
নিয়ে যাবে জেলখানায় করিয়া বিচার ॥

৫৮

মন বলব কি তোমারে ॥
এলে ভবে, যাইবে কবে, একদিন নি তোর মনে পড়ে ।
করবে নামাজ বন্দেগি, অজুদ তোমার হবে নেকি
বিনয় ডাকবে খাকি, আয় তুই আমার ঘরে।
খাগ যাবে খাগেতে মিশে, বাতাস যাবে উড়ে
আতসে আব জ্বালাইয়া রুহু নিবে নিরাকারে ॥
ইমানকে করিও শক্ত, হওগা রাসুলের ভক্ত
কাজের কাজী হবে উক্ত সন্দেহ কি অন্তরে।
ইছমেজাতে ভক্ত তাতে হইতে যেজন পারে
ভবের বন্ধন ঘুইছা যাবে উজ্জ্বল হবে খোদার নূরে ॥
কেউ যদি হজ্ব করিবা নিজের ঘরে আগে কাবা
আছে বস্তু মনলোভা, দেখলে না সেই ঘরে।
নিজের ঘরে কাবা থুইয়া (কেন), হজ্ব করতে যাও দূরে।
চাইয়া দেখ তোর কাবা ঘরে, চৌদিকেতে আযান পড়ে ॥
শুন রশিদ উদ্দির বাণী, খোদে খোদা খোদরব্বানী
কোরানে রইল গুপনি চিনতে যেজন পারে।
পাঞ্জেগানা ত্রিশ রোজা বৎসরতে ঘুরে
একটি নামাজ একটি রোজা আদমের করিলেই সারে ॥

৫৯

সমুদ্রের মাঝেখানেতে বাঘে গিয়া হরিণী ধরে ॥
চুপ করিস না গোল করতে থাক, সজাগ হয়ে ঘুমারে।
তালগাছের গোড়ায়রে মন, শকুনে গিয়া বাসা করে
চৌদ্দ হাত পানির নিচে, মাঝে মাঝে আণ্ডা পাড়ে।
সেই দেশের উল্টা কথা নিচের দিকে গাছের মাথা।
নাম ধরেছে আলোক লতা শিকড় আছে শূন্য ভরে ॥
মায়ের বিয়া যে দিন তারিখ, আনতে গেল নানার বাড়ি
তাড়াতাড়ি আনলো সওয়ারি পিতাপুত্রে যুক্তি করে ॥
তুমি আমি যত সবে এক ঘাটেতে নামলে পরে
ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে নদীর পাড়ে উঠলেই মরে ॥

৬০

আগে তিমির নাশিয়া কটাক্ষ স্বরূপে দেখ নারে চাহিয়া ॥
তিরোধানে আছে তোমার স্বয়ং ভগবান
তিথীষু থাকিলে তারে খোঁজ রে পাষাণ ।
সে যে ত্রিলোক বিজয়, নাহি তাতে সংশয়, অমিয় দিতেছে ঢালিয়া ॥
পরম আত্মা শ্রীগুরুকে করবে যদি লাভ, চপলার সনে কর বন্ধুত্ব ভাব।
সে যে বিদ্যুতের সনে, চলে নিশিদিনে, ক্ষণে ক্ষণে উঠে চমকিয়া ॥
বৃক্ষের পল্লবে ধরছে মুকুল, ডালে ডালে নাচিতেছে পাপিয়া বুলবুল।
মুদিত কাননে, ভ্রমরার গুঞ্জরণে ফুলগুলি দিতেছে ফুটাইয়া ॥
মৃদু মৃদু সমীরণে জাহ্নবীর নীরে
উজান ভাটি সমান চলে তরঙ্গে জোরে।
(সে যে) অস্তিত্ববিহীন, কয় রশিদ উদ্দিন
আকাশ পাতাল গেছে ভেদ করিয়া ॥

৬১

পাড়ঘাটায় কি মরে মানুষ পাড় ঘাটায় কি মরে?
আল্লাহ নবী আদম ছফি, তিন জনাতে খেলা কারে ॥
রাঙ্গা জলে ঢেউ ছুটেছে দেখ সেই সাগরে,
ঢেউয়ের ফেনা, কণা, কণা, গিয়া আকাশেতে উড়ে ॥
দশ ইন্দ্রিয় ছয় জন মাঝি লওগা বাধ্য করে
লগি বৈঠা সলা হাতে, নিয়া বাইও নৌকা ধীরে ধীরে ॥
সেই নদীর তরঙ্গ ভারি যাইয়ো না কিনারে
পাড়ের সাথে ঠেস লাগিয়া ভাঙ্গবে নৌকা জুরে জারে ॥
সপ্তসুতায় চলছে নদী চতুর্থ প্রকারে
ধারায় ধারায় উঠে পানি প্রবল জোয়ারে
অষ্টবাঁকের উজানেতে হিমালয় পাহাড়ে
সপ্তসুতায় প্রবাহিত যাইতে নিতাই এর বাজারে ॥
সপ্তসুতায় চার রঙ্গের জল বহে ধীরে ধীরে
বাউলকবি রশিদ বলে, কোন সুতাতে যাইবে সেই পাড়ে?

৬২

রবিকিরণচাঁদের আলো পায় কি আর সব জনে,
হাসে রবি হাসে শশী নিত্য নতুন ফুল বাগানে ॥
জ্বালাইয়া জ্ঞানের বাতি, যে জাগিল সারা রাতি
চন্দ্র সদয় তারি প্রতি, ভাসতে থাকে চোখের কোণে ॥
ঝঞ্ঝা রাতে পাক বাতাসে, কখন ভাসে কখন হাসে
যে রয়েছে আশার আশে, সহ্য করে ঝড় তুফানে ॥
বলে বাউল রশিদ উদ্দিন, অমাবস্যা লাগে যেদিন
নহে রাত্র নহে দিন, বীজ বুনিল সাধুগণে ॥

৬৩

মা মা বলে মায়ের পায়ে পরবি লুটে আয়,
এমন মায়ের পায়ে ভজতে কে তোরে ফিরায় ॥
মা তোমার আদ্যের শক্তি, তার চরণে রাখ ভক্তি,
অনায়াসে দিবে মুক্তি, সমনের কি দায় ॥
মায়ের পদে সুরধ্বনি, শক্তিরূপা বিনোদিনী
পার হইতে বৈতরণী উঠবে মায়ের নায় ।।
শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম, সকলি তোর মায়ের বাধ্য
ষড়রিপু মদন সিদ্ধ জানেরে তোর মায় ॥
রশিদ উদ্দিন কান্দে একা, চতুর দিকে বিভীষিকা,
কঠিন হইল জীবন রাখা, যাবি তরায় মায় ॥

৬৪

আমি কিছু বুঝি না বুঝি না ॥
আঁখি বুজি কারে খুঁজি কেবা আছে আপনা ॥
কিবা ছিলাম, কি হইলাম, কোথা হইতে কোথায় আইলাম
আনাগোনা বড় যন্ত্রণা ॥
আবার হেথা হইতে কোথায় যাব হে…জানি না তার ঠিকানা ॥
আকাশেতে ছিল ইন্দু, উথলিয়া কাম সিন্ধু, বন্দু রূপে ভাসিল ফেনা
ইন্দু বিন্দু সিন্ধু নীরে হে…বন্ধুত্ব হয় দুইজনা ॥
দুইজনে করিয়া খেলা বনল এক সুন্দর পুতলা
উলা মেলা কমতো দেখিনা।
পুতুল বানাইল কি নিজেই বনল হে…কোনটা করি ধারণা ॥
এই দেহে স্বভাবিক, কি হয় কাল্পনিক, ভৌতিক কিংবা হবে মৌলিক
কোন বিষয় চিন্তায় ধরে না।
এদিক ওদিক কেনটা সঠিক হে…কে করে আলোচনা।
একই উপাদান হইতে মানুষ বনল এই জগতে
জাত বিজাতের দরকার দেখি না।
কোন বিধির বিধান মতে হে…নারীপুরুষ দুইজনা ॥
কোন স্বভাবে হইল নারী কোন অভাবে নাই তার দাড়ি
নিলাম্বরী পরনে কিনা।
বিধি কি অবধির মতো হে…ধরল এই সব নমুনা ॥
কী উদ্দেশ্যে মানুষ বনল তাতে কি দরকার পড়িল
মর্ম খুলে কেউতো বলে না ॥
মানুষ নশ্বর কি অবিনশ্বর যুক্তি তর্কে ধরে না ॥
সবে বলে সে পারে যাই, পাহাড়ে কিন্তু উদ্দিশ না পাই
শুনিতে পাই এই সব ঘোষণা।
তবে এপাড় সেপাড় কতদূরে হে…নির্ণয় জানি না।
বাউলকবি রশিদ বলে, কেবা আছে সৃষ্টি মূলে
দৃষ্টি খুলে পাওয়া যায় না।
থাকলে যে দেখা দেয় না হে…করিলে আরাধনা ॥

৬৫

ভবে মানুষ বলে কারে ॥
মাইন্সের মত এই সংসারে কেউরে নাহি পয়দা করে ॥
মানুষের হইলে পরিচয়, ভেঙ্গে যাবে সকল সংশয়।
থাকবে না কেউর আশর বিষয় চিনতে পারলে তারে
আদম তন করিয়া যতন পয়দা যখন করে।
ষাইট গজ লম্বা দিয়া তারে সাত হাত রেখেছিল ফাড়ে ॥
আব আতস খাক বাদে, আট চাইর আর বার জাতে
লাগাইল আদম তনেতে আপে পরোওয়ার
ছালছাবিল নামে কুয়া আরশের কিনারে।
রহিম নূরের পানি দিয়া সেই মাটিকে মাওন করে ।
মক্কা হইতে এনে মাটি, মাথা করল পরিপাটি
বায়তুল মুকাদ্দাসের খাকে গর্দান দুটি গড়ে (সিনাও তৈরি করে)
হিন্দুস্তানের মাটি দিয়া চামড়া তৈয়ার করে।
পূর্ব পশ্চিমের মাটিতে হাত পায়ের কাজ দিলেন সেরে ॥
বেহেস্তের মাটি দিয়া, আদমের কপাল বানাইয়া।
মদিনার মাটি দিয়া জিহ্বা তৈয়ার করে
হউজে কাউসারের মাটিতে চক্ষু তৈয়ার করে
পরশমণি পাথর দুটি বসাইলেন তার ভিতরে ॥
মোকাদ্দসের মাটি দিয়া আদমের সিনা বানাইয়া
নিজে খোদা রইলেন চাইয়া এস্কেরি জোওয়ারে।
এয়ামেন শহরের মাটিতে জানু তৈরি করে।
নানান রঙে সাজাইয়া রাখিলেন বেহেস্তের ঘরে ॥
রশিদে কয় আদমপুরে, বাজিগরে বাজি করে
পুতুল খেলে হইয়া সখা বইসা অন্তঃপুরে
বেরঙেতে রং ছড়াইয়া আজগুবি ব্যাপারে
পুতলার মাথায় তার বান্দিয়া বইয়া টানাটানি করে ॥

৬৬

তারে চিনা কঠিন ভাবে ॥
তারে চিনবার আগে কিন্তু আপনারে চিনতে হবে ॥
কে জানে তার ভাজিভুজি, সকল কাজে থাকে রাজি
কখন কখন সরার কাজী কখন চোরের ভাবে।
কখন রাজা কখন প্রজা মাথায় মুকুট শোভে
কখন রোগী কখন ওজা সর্প হইয়া দংশন করে ॥
শুধু এক পরীক্ষার ছলে, জন্ম দিল মানুষকুলে
ছাত্র যেমন যায় ইস্কুলে এমনি ভাবে সবে।
শুভঙ্করী কর কড়ি গুইনা নিতে হবে।
উচ্চশ্রেণী পাবেন তিনি যেজন পাশ করিয়া যাবে ॥
হুঁশ আক্কেল সঙ্গে দিয়া, ভবের মাঝে দেন পাঠাইয়া
ভাল মন্দ বিচার কইরা চিনে চিনে খাবে।
আর কিছু ধন চায় না সেজন, কী ধন তারে দিবে
নামের কাঙ্গালি হইয়া শুধু কেবল চাইয়া রবে ॥
বানাইয়া রঙের কাছারি দিল কত কর্মচারী
গায়না কড়ি সাব সাকারি একদিন তারে দিবে।
সার্টিফিকেট পাবে সেদিন যার তার কর্মফলে।
রশিদ উদ্দিন আর কতদিন এমনিভাবে চাইয়া রবে ॥

৬৭

কুসুমবাগে তরুশাখে ফুটল গোলাপফুল
অনুরাগে গীতি ডাকে কোকিলা বুলবুল ॥
সেই ফুলেরি মুকুরন্দে, মোহিত করেছে গন্ধে
আকাশ জমি প্রেমানন্দে গাইছে একটি বুল ॥
কাঁটাবনে ফুটিয়াছে মোহাম্মদ রাসুল ॥
যখন ফুলে ধরল কলি, সারে জাহান পড়ল ঢলি
পাগল হইয়া ভ্রমর অলি করে গণ্ডগোল।
মধুর লোভে মইল ডুবে গাছের নাম আব্দুল ॥
সেই ফুলেরী গন্ধ নিলে, ক্ষুধা তিষ্টা যাবে চলে
পাড় হইবে অবহেলে ফুলছেরাতের পুল।
ভয় কি আছে বিষম নদীর উঠিলে কল্লোল ॥
মোহাম্মদের জন্ম কালে, হুরী নূরী গগণমূলে
খেচরে ভুচরে মিলে করেছে কুলকুল
বাউলকবি রশিদ বলে, নদীর জলে ঢেউ দুলা দুল দুল ॥

৬৮

শুনরে মমিন, বিছমিল্লা পড়লে ফল পাইবে একদিন ॥
বিছমিল্লার উল্লিশটি হরফ দোযকের জাবিন ॥
কোরানেতে প্রথম লেখা আলিফ, লাম আর মীম
সাত মুবিনে বান্ধা আছে ছুরে ইয়াসীন ॥
আল হামদু লিল্লাহে পড় রাব্বিল আলামীন।
সঙ্গে আদায় কর আর রাহমানির রাহীম ॥
আলীমুল গাইব আল্লা করবে একিন ॥
লাক্কাদ কাররামনা বাণী আদাম ভেদ বড় কঠিন
আদম খোদা নয়রে জুদা কুলুবিল মুমীন ॥
ভাবতে ভাবতে সোনার অঙ্গ হইয়াছে মলিন
রশিদ উদ্দিন আর কি করবে আল্লাহু আমিন ॥

৬৯

মরুতে আজ ফুটল কুসুম বাজিল ভেরী
ভ্রমর বুলবুল হইয়া আকুল আসিল উড়ি ॥
সেই ফুলেরি সৌরভেতে হুরপুরি কি নুরী।
সেই ফুল নিয়া চন্দ্র সূর্য করছে কাড়াকাড়ি।
অনল অনিলে ভূধর সলিলে ভাসছে লহরী ॥
শাহে গোলজার দীপ্ত পুরে উজ্জল সোনার পুরী।
পাতায় পাতায় গুল্ম লতায় গাহে নামের সারি ॥
চারি রঙ্গে ফুটছে ফুল কুমকুম কুস্তরী
সেই ফুলের আজ মধু লুটে যত নরনারী
আউয়ালে ফুটেছে ফুল আখেরে জাহেরী
সেই ফুলেরি গন্ধ নিলে দোয়ক হারাম তারি ॥
রশিদ উদ্দিন বলে হায় আহা মরি মরি
সেই ফুলের আজ পাপড়ি টুটে লাগছে গড়াগড়ি ॥

৭০

পুরুষ পাগল করলো মায়ে নয়নের বাণে ॥
কি ধন দিয়া পাগল করে সন্ধান জানে কয়জনে ॥
পুরুষ ভ্রমরা জাতি, মায়ের কাছে জ্বলছে বাতি
প্রদীপ লাগাইয়া বধে পরানে ॥
মা তোমার আদ্যের শক্তি, তার চরণে কর ভক্তি
অনায়াসে দিবে মুক্তি শেষের দিনে ॥
মায়ের গর্ভে জন্ম নিয়া, সেই মায়েরে করলে বিয়া
পায়ের ধুলা বানাইয়া রাখলে কেমনে ॥
ছাড়িয়া সংসারের কর্ম পাইতে গিয়া মায়ের মর্ম
রশিদ উদ্দিন মন দিয়াছে মায়ের চরণে ॥

৭১

মায়াপুরে পাইত্যা জাল আটকাইছে পুরুষের পাল
ছুটিবার আর নাইরে নাল কি হবে উপায় ॥
আছে একটি মায়ানগর আগুনে বেঁধেছে ঘর
দেখিলে পতঙ্গ নর ঝাঁপ দিতে চায়।
বেশি গরম খায় যারা অল্পেতেই মুখ পুড়া
ধনে প্রাণে হইয়া সাড়া সকলি হারায় ॥
মায়বিনী রাক্ষসিনী কিছুতেই নয় সে দোষী
যার চরণে মক্কা, কাশী, সবি পাওয়া যায়।
মায়ের চরণ ছাড়া যোগী, ঋষি আউলিয়ারা
আসা যাওয়ার রাস্তা তারার আছে বা কোথায় ॥
মায়া কি আর অমনি বটে যাহারি পায়ের খুঁটে।
শিব রয়েছে অকপটে দেখলে পরান যায়।
একমাত্র প্রেমের কারণ শ্রীকৃষ্ণ মধুসুদন।
দাসখত করিল পূরণ শ্রী রাধিকার পায় ॥
সারাদিনমান কার্য করে সন্ধ্যা সময় নিয়া ঘরে
মায়ের কাছে হাজির করে যাহা কিছু পায় ॥
যার ঘরে নাই ঘরনি হয় যদি সে বেশী ধনী
তার মালের গড়গড়ানি সহ্য হয় না গায় ॥
কেউ যদি শিন্নি মানে মায়ের পায়ে লাড়াধানে
পাও দিয়া মায় বাড়া বানে সেই দেবতার দায়।
কবি রশিদ উদ্দিন কয় মা কিন্তু দোষী নয়।
জগত খেয়ে চেয়ে রয় আরো খাইতে চায় ॥

৭২

গিন্নি বিদায় দাও আমারে ॥
যথা ইচ্ছা তথা যাও ভাত কাপড় সব থুইয়া ঘরে ॥
পইড়াছি কি অভাবেতে, পয়সা কড়ি নাইরে হাতে
কী লইয়া যাই বাজারেতে, কাপড় কিনিবারে?
এতই যদি অভাব ছিল বিয়া করছিলি কেরে?
এমন মাইন্সে বিয়া করে না, ভাত কাপড় যে দিতে নারে ॥
কয়েকটা দিন ধৈর্য ধর, বসে থাক চুলার পাড়
পয়সাকড়ি যোগাড় কর কাপড় কিনিবারে।
কন্টোলের কাপড় পিন্তাম না বলি যে তোমারে
মেনেকা যমুনা ছাড়া আনলে কিন্তু ফালবাম ছিঁড়ে ॥
মেনেকাত পাওয়া যায় না, যমুনারও রঙ থাকে না
এমন কথা আর কইও না বলি বারেবারে।
কাপড় চোপড় চাই না তোমার কপালে যা করে।
আবুদুবডি দেও রাখিয়া থাক্তাম না আর তোমার ঘরে ॥
ও গিন্নি তর পায়ে ধরি, আর দিও না মাথায় বাড়ি
যদি করন লাগেও চুরি কাপড় দিবাম তরে।
এমন কাপুরুষের ঘর কোন বেইট্যানে করে।
ভাত কাপড় তো দূরের কথা তেল সাবানডাও মিলে নারে ॥
এখন আর উপায় দেখি না, বোধ হয় সম্মান আর রবে না।
ঘরের গিন্নি কথা কয় না কাপড়ের খাতিরে।
বাউলকবি রশিদ বলে, বস্ত্ৰসংকট কে দূর করতে পারে
বঙ্গরাণী উলঙ্গিনী সম্মান রাখে পত্র ছিঁড়ে ॥

৭৩

তোর সনে মোর কিসের মাখামাখি ॥ (বিশ্ববাসী গো)
আমি রোগী, আমি ভোগী, অন্য লোকে বুঝবে কি?
প্রকৃতির বিধানের বিধি পরস্পরে মমতা
আসলেতে কেউ কারো না শৃঙ্খলে আছে বাঁধা।
মাতা-পিতা, ভগ্নি-ভ্রাতা কয়দিনের ডাকাডকি ॥
নিয়তির নির্বন্ধ গুণে চলিছে এ বিশ্বময়
ভবের খেলা দোলনা দোলা আসা যাওয়া সব সময়
বন্ধু-বান্ধব আশয়-বিষয় শেষকালে সবই ফাঁকি ।
লম্প ঝম্প কতই করি আমার আমার বলিয়া
যাবার কালে কেউ কিছুই নিছে সঙ্গে করিয়া
আলমগিরি থুইয়া সবাই হইল পরলোকী ॥
মনে কত যুক্তি করে বিছানাতে শুইয়া
রাত পোহালে কাল সকালে যাবে কিছু হইয়া
এরে মারি তারে ধরি একদিনে হব সুখী ॥
বাউলকবি রশিদ বলে করি কত কল্পনা
ভাঙ্গিলে নিশির স্বপন জলে বুদবুদ থাকে না।
যা ছিল মনের ধারণা সকলি রইল বাকি ॥

৭৪

আমায় পার কর রাসুল ॥
আখেরাতে আঁধার রাতে পুলছেরাতের পুল ॥
তুমি সবার নায়ের মাঝি, অকূলেতে কূল
তুমি হাওয়া তুমি বাদাম তুমি হও নায়ের মাস্তুল ॥
না জানি কী রূপ ধরিয়া বাধিয়াছ গোল
(তোমার) ফুলের বাসে মধুর আশে ভ্রমর বুলবুল
দোহাজানের রঙিন হয়ে ফুটল গোলাপ ফুল।
সারে জাহানে তোমার গুনগান গায় খোদার মকবুল ॥
তোমার তরে রশিদ উদ্দিন কাঁদিয়া আকুল।
এই নিবেদন করি আমি দিও চরণ ধূল ॥

৭৫

কলিজা ছেদিল রে শ্যাম পিরিতের বিষে ॥
প্রেমজ্বালায় মইলাম গো সই বারণ হবে কিসে?
কেউ কিছু জানলে তোরা আমার বুকে দেও গো ঘষে
সর্ব অঙ্গ ঝরঝর রক্ত নিল চুষে ॥
যাও যাও সখি তোরা অষুধের তালাসে
মহাব্যাধি দূরে যাবে কৃষ্ণ শান্তিরসে ॥
রশিদ উদ্দিন বলে তোমার কর্মে যদি ভাসে
শ্রীকৃষ্ণধন মধুসূদন আসবে বৈদ্য বেশে ॥

৭৬

শুন দাদা মহাশয় কহিতে লাগে ভয়।
দেখিয়া বিষয় আসয় সহ্য হয় না গায় ॥
তোমারা ঐ নারী রাধিকা সুন্দরী
সঙ্গে লইয়া সহচরী পাড়ার পাড়ায় যায়।
ভিন্ন পুরুষের সনে কয় কথা গোপনে।
মিলিয়া দুই চার জনে, তাসখেলা খেলায় ॥
ঐ বাড়ির কুটনি বুড়ি সেও তো মন্ত্রণাকারী
জানে কত ছল-চাতুরি বলব কি তোমায়।
জানে কত যাদুটোনা আরো কত কুমন্ত্রণা,
কুলমান রবে না করি কী উপায় ॥
ভেবে রশিদ উদ্দিন কয় চুরা তো সামান্য নয়
লোহার সিন্দুক টিনের বাক্স চুরি কইরা যায়।
চুরায় চুরি কইর‍্যা গোপালপাড়া সেথায় গিয়া পড়ল ধরা
সেই জন্য ননী চুরা নামটি কালায় ॥

৭৭

দেখবি যদি মোহন ছবি চর্ম চোখের পর্দা খোল
ভাবের দেশে চল রে মন ভাবের দেশে চল ॥
গিয়া মন তুই ভাবের ঘরে চেয়ে থাক রূপ নেহারে
সজল নয়নে তারে ফটোগ্রাফে তুল।
মনরঙে প্রেম তরঙ্গে দিলের কপাট খোল
দেখবি রে তোর মনের মানুষ করিতেছে ঝলমল ॥
দেখবি তাহার রঙ ছুরত অবিকল তোমারি মত
তোমার সঙ্গে অবিরত করে চলাচল।
তোমার রঙে রঙ ধরেছে হইয়াছে একমিল
তোরে দেখলেই তারে মিলে আর কারে তুই দেখবি বল ॥
মক্কা কাশী বৃন্দাবনে পাহাড় পর্বত ময়দানে
বন উপবন শ্মশানে কত মানুষ গেল ॥
কারে জানি দেখব বলে পাষাণ মূর্তি হইল
কেউরে তো আর দেখতে পায় না আশায় আশায় জীবন গেল ॥
ছিয়া ছফেদ লাল জরদা চার রঙে করিলে কাঁদা।
আরেকটি রঙ হবে যুদা রশিদ উদ্দিন কৈল।
বিশ্বজোড়া যত রঙ তোর প্রকাশিত হইল
সকল রঙ করিয়া বর্জন নিজের রঙটা গড়ে তুল ॥

৭৮

ঢেউয়ের তালে নদীর জলে ছোটেছ উজানে ॥ (প্রাণের বন্ধুরে)
আমারে নি আছে তোমার মনে ॥
কলসি কাঁখে ঘুর্ণিপাকে ঠেকলাম ঝড় তুফানে ॥ (প্রাণের বন্ধুরে)
আমি অভাগীনি, জনম দুঃখিনী,
দিনরজনী কাঁদি একা বনে।
হইলে তোমার সঙ্গে নিবে নইলে কি তাই বলে যাবে।
নইলে বেঁচে কি ফল হবে ঝাঁপ দিব জীবনে ॥
সরধ্বনির তীরে, নাও লাগাইয়া) দেখলাম ফিরে
আঁখিনীরে ধৈর্য কি আর মানে।
তপ্ত নীরে সজল আঁখি শাড়ি ভিজা আছে সাক্ষী
মরণমাত্র আছে বাকি তুই বন্ধুর চরণে ॥
কহে বাউল রশিদ উদ্দিন, নাইওরে হইল অনেক দিন
ভাবতে ভাবতে তনুক্ষীণ বাঁচব কেমনে।
মাতাপিতা রাজি হইয়া ভাঙ্গা ঘরে দিছে বিয়া
আর কতকাল থাকব সইয়া রাস্তার পানে ॥

৭৯

প্রেম করে কি হইল রে জ্বালা ॥
জনম ভরিয়া পিরিতি করিয়া
সার হইল কলঙ্কের ডালা।
শিশুকাল হইতে, মজিয়া পিঁড়িতে,
ভাবিতে হইল সারা বেলা ॥
আগে যদি জানিতাম পিরিতি করিতাম
সুখে থাকিতাম বসে নিরালা।
যৌবন তাড়ন কে করে বারণ
বুকের মাঝে আগুনের ঢালা ॥
কত সইয়া থাকি আর কতদিন বাকি
মরতাম যদি হইতরে ভালা।
আশা দিয়া টেনে কেন ভবে এনে
বসাইলে পরানে মদীনালা ॥
হৃদয়েতে গাঁথা বলেছিলে কথা
বসে বসে তরুলতা।
সেই কথা বলে বান্ধিয়া জঙ্গলে
কোন বা দেশে তুই করেছ মেলা ॥
রশিদ উদ্দিন ঘরে আসা-যাওয়া করে
একটি ঘরে নয়টি জানালা।
আগে যদি জানি লইয়া প্রেমের ছুরানি
নয় দরজায় মারিতাম তালা ॥

৮০

পরের কথা ছেড়ে দিয়ে নিজের কথা কও ।
দর্শন শ্রবণ ঘ্রাণ পরিচয় আগে গিয়া লও ।
(যদি) দাবি কর মনুষত্ব, অনিত্য কে কর নিত্য
ছাড়িয়া অকথ্য পথ্য সত্য গিয়া হও ।
যদি দেখবে পরের কাষ্ঠা, মনকে মধুর কর নিষ্ঠা
(তোমার) ঘরে কয়টা আছে দুষ্টা চেষ্টা করে লও ॥
ভয় করো না জ্বরব্যাধি, নাম অমৃত মহৌষধি
নিবৃত্তি করিবে যদি, নিজের ঘরে বও ॥
বাউলকবি রশিদ বলি স্বাধীনতার এই প্রণালী।
অহং দিয়া জলাঞ্জলি গালাগালি সও ॥

৮১

জৈষ্ঠ মাইস্যা বৃষ্টির জলে আইল আষাঢ়িয়া পানি (মন মাঝিরে)
কে কে যাবে নাও দৌড়ানি ॥
মাঝিরে…শ্রাবণ মাসের সানাই বৰ্ত্ত খেয়ে দেখছনি।
বাইছ্যা বাইছা তোল বাইছ্যা জোওয়ানি ॥
মাঝিরে…সুরমাই নদীর মাইজখানেতে পানির খুব ঘুরানি।
পাতা বৈঠার সাঁতার দিয়া গাড় মস্তুলখানি ॥
মাঝিরে…কাইস্যা বনের আরে আরে চালাইও তরণী।
ধীরে ধীরে মাইরো বৈঠা লড়ে না যে পানি ॥
মাঝিরে…দুয়ে নায়ে বাইছ ধইরাছে পাছে মাইরো তুমি।
পাছে যে পড়িতে পারে তারে কয় জিতানি ॥
মাঝিরে…রশিদ উদ্দিন ভাঙ্গা নৌকা সিছতে নাহি জানি।
পাছার বৈঠায় হাইল মানে না বাইনে চুয়ায় পানি ॥

৮২

বন্ধুর বাড়ির ফুল বাগানে গেলে তরা কই।
কম্পাসেতে জরিপ করে সীমা আগে কর সই ॥
সেই বাগানের চতুর্পাশে
ঘিরিয়াছে দূর্বাঘাসে
উঠবে না লাঙ্গলের চাষে দিতে হবে মই।
বাগান আছে নন্দনকানন।
কর্মচারী আছে মদন
জল ঢালিয়া কর যতন চুঙ্গা ভরা দৈ ॥
সেই বাগানে যাবে যারা
দম থাকতে হয় প্রেমের মরা
রশিদে কয় আয়না তোরা হাত বাড়াইয়া লই।

৮৩

আরে ও লাল শিমুলের ফুল।
গন্ধবিহীন মধুশুন্য, ভিতরে নাই মূল ॥
ভ্রমর অলি ঘুরছে খালি কইরা গণ্ডগোল।
ডালে কাটা বসতে লেটা বাসনা বুলবুল ॥
পূজাতে না লাগ তুমি হয়েছ বাতুল ॥
রূপ দেখাইয়া পাগল করলে ঘৃত ছাড়া গুল ॥
ভাবতে ভাবতে রশিদ উদ্দিন হয়েছে ব্যাকুল।
রূপ দেখিয়া গাছে উইঠ্যা গেল জাতি কুল ॥

৮৪

আরে ও ডালের কোকিল,
তোমারি রব শুনিয়া ঘটিল মুশকিল ॥
কুহু কুহু স্বরে তোমার উজাইল সলিল ॥
মুই অভাগির মনে দুঃখ জ্বলিয়া উঠিল ।
তোমার গানে আকুল প্রাণে কলিজা ছেদিল ॥
এ সুখ বসন্তকালে বন্ধু না আসিল ৷
আমার বন্ধু কার বাগানে মালী গিয়া সাজিল ॥
রশিদ উদ্দিনের জনম ভরা শান্তি না আসিল ৷
সোনা বন্ধের নামটি আমার অন্তরে রহিল ॥

৮৫

প্রেমের বাজারে যাইতে কয়জন পারে
কিনতে গেলে জিনিস বড় দর ॥
চাঁদের মেলা চাঁদের খেলা চাঁদের বিকিকিনি ৷
মাসেতে তিনদিন জমে সেই বাজারখানি
যে কিনিল হইল ধনী, অন্ধকারে দেখল চাঁদের পসর ॥
অমাবস্যা প্রতিপদ লাগে বারমাস,
তৃতীয়া পর্যন্ত মানুষ থাকে উপবাস ।
অমাবস্যার সময় জাননি বিষয়, চন্দ্র উদয় কোন দেশে ভিতর ॥
ঐ যে চান্দের গায় কাল চিহ্ন দেখা যায়
বুরাক লইয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন নবী মোস্তফায় ।
নবী মেরাজ যাইতে ঐ শূন্যপথে দাঁড়াইয়া ছিলেন চান্দের উপর ॥
অমাবস্যায় নিগুম থাকে অটল নদীর জল
সাধু যারা পাতিয়াছে চন্দ্র ধরার কল ॥
গভীর জলের তলে, দীপ্তি মানিক জলে, রাখনি কেউ তার খরব ॥
রশিদ উদ্দিন ঘুরতে ঘুরতে হাতে নিয়া ডাল
নদীর পাড়ে বসে আছে ধরিয়া বহুকাল ।
কামকামিনী ঘটাইল জঞ্জাল নাও ডুবাইল কামসাগর ॥

৮৬

প্রথম যেদিন ফুটে ফুল, প্রথম যেদিন ফুটে ॥
দিন নক্ষত্র ঠিক করি যাইও, মাইয়া চান্দের হাটে ॥
অষ্টমীতে থাক বসি, নবমিতে হবে দোষী
দশমী আর একাদশিতে ফুলের রসটি ঝুটে
পাগল মদন করিতে রণ, মাথা যদি খুটে
চিন্তা চাপ রাগ রশি দিয়া, বেঁধে পাঠাও জজ হাইকোটে ॥
তিন রঙ্গে হয় ফুলের শোভা, মনিগণের মনোলোভা
ফুলটা যেমন রক্ত জবা, চমৎকার রঙ্গ বটে,
সেই ফুলে নিজে খোদা, তিনদিন থাকে মোটে প্রে
মিক যেন চিনতে পারে, কামোকের ধন যাইরে ছোটে ॥

***
অসমাপ্ত গান, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি

৮৭

দিল কোরআনের হাফেজ যে জানে তার পদ্ধতি
মরা ছেলে বিয়া করল, নব এক যুবতী ॥
সেই বিয়াতে কেউ গায়রে গান,
কেউ পড়ে বাইবেল-গীতা, কেউ পড়ে কোরআন ৷
কেউ আবার দিতেছে আজান, যার যার ধর্মের যে নীতি ॥
মরা স্বামী ঘরে তোইয়া, সারা রাত্র রঙ্গ করে পর পুরুষ লইয়া,
আবার ঘরেতে আসে ফিরিয়া, চাইর যুগে থাকে সতী ।
রসের কন্যা রূপের নাগরি, একেলা করেছে পিরিত, ত্রিজগত জুড়ি
বাউলকবি সাধক রশিদ বলে, সেই নাগরি
আমারে ধরছে পতি ॥

৮৮

আলিফ সাদা, লামে লাল, সিমেতে লোকাইয়াছে রমণীর কাছে ।
সুন্দর দুইটা ফল ধইরাছে রমণীর গাছে ॥
গাছে ছয় লতিফা আছে, পঞ্চ কণ্টক রয়েছে
ছয় লতিফা জাগিয়া উঠে সেই গাছে ॥
আছে মোহাম্মাদী ছয় তরিকা, জেনে উঠ সেই গাছে ॥
যদি নামাজ পড়তে চাও, জায়নামাজ বিছা ও
অর্ধ অঙ্গ লুটাইয়া সেজদায় পড়ে যাও ।
হেজরাতুলে চুম্বন দিলে দেখবে মৌলায় খেলিতেছে
বাউলকবি রশিদ উদ্দিন কয়, কাবাঘর কাল পর্দায় ঢাকা রয়,
সেই জায়গায় গিয়া নামাজ আদায় করতে হয়।
নামাজ মমিনের মেহেরাজ, আশেক যারা পড়িতেছে ॥

৮৯

তার সাথে প্রেম করতে চাইলে ভাবের পাল্লায় ওজন দিস ।
সুজন চিনিয়া গোড়ায় প্রেম করিস ॥
প্রেম করা যে বড়ই লেটা, হৃদয় মাঝে বাঝে কাঁটা,
যৌবনকালে লাগে মিঠা, ভাটার বেলায় গোলমরিচ ॥
প্রেম কর রসিকের সনে, যে জন প্রেমের ভাব জানে,
মনের মানুষ পাও সেখানে, না নিলেও প্রেম যাইত্তা দিশ ॥
বাউলকবি রশিদ উদ্দিন কর্ম দোষে, হারাইল মন মানুষে,
জীবন গেল হায় হুতাসে, তোরা সব সাবধান থাকিস ॥

৯০

কোন ঘাটের কেওয়ানি তুমি কোথা চইলা যাও
মন মাঝিরে একবার এসে ঘাটে নাও লাগাও ॥
নিত্য নিত্য আইস যাও, ডাকলে নাহি চাও ।
মাঝি রে–ঘরের কোনার বউ হইয়াছি ধরি তোমার পাও,
নি দয়া হইয়াছে বুঝি আমার বাপ মায় ॥
মাঝিরে যে অবধি আসলাম নাইয়র মুখের পাইনা রাও,
জানি না জানি না বুদয় স্বামী সেবার ভাও
মাঝিরে রশিদ উদ্দিন কহে মাঝি দেশে যদি যাও,
নাইয়র নিত কইও যাইয়া নইলে মাথা খাও ॥

৯১

কুটুম পাখিরে কোন দেশের জঙ্গলে তোমার বাস?
রূপের কাছে কইয়ো গিয়া আমারি দুর্দশা ॥
আকাশছুঁয়া করইগাছে নিত্য থাক বসা,
আমি রূপের পানে হইলাম পাগল, লাগছে রূপের নেশা ॥
মনে লইলে কইও খবর আমার ভালেবাসা,
ছায়েদ বাদশাহ কারাগারে বন্দি রহিম বাদশা ॥
অসমাপ্ত গান, পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

৯২

পরের বেদন পরে কি জানে ॥
পিরিতে আমার কলিজা অঙ্গার
ঘুরিয়া ফিরি আমি তার সন্ধানে ॥
কত দেশে গেলাম কত যে দেখিলাম
কত শুনিলাম আমারি কানে ।
(লোকের) সইয়া গালাগালি দিবানিশি জ্বলি
বেঁধেছ তুমি মোরে মনপাষাণে ॥
(আমায়) দিয়া প্রেমফাঁসি হইয়াছ উদাসী
রইয়াছ বসি কোন অভিমানে ।
(আমি) গরল খাইবমরিয়া যাইব
ফাঁসিটি ছিড়িব ইসকের টানে ॥
সখি তোমরা আসিও কাছেতে বসিও
বন্ধের নামটি শুনাইও আমারি কানে ।
রশিদ উদ্দিন বলে দেশে যাব চলে
ছাই দিয়া সব কুলমানে ॥

৯৩

দেখবি কি, শুনবে কি, বুঝবে কিরে ধুন্দা
এই দুনিয়া মায়ার প্রেমে বান্ধা ॥
কতজনা পাগল হইয়া মায়াতে মন মজাইয়া
আপনার ধন পরকে দিয়া সার করেছে কান্দা ।
বহুরূপী রঙ বাজারে মন থাকে না মনের ঘরে
রূপ দেখাইয়া প্রাণে মারে লাগাইয়া ধান্ধা ॥
দিবে যদি ভব পাড়ি আগে ছাড় মায়াপুরি
শুন রে ও মনব্যাপারি বেলা নাই রে সন্ধ্যা ॥
নিজে যদি ভাল বুঝ সময় থাকতে গুরুভজ
জ্ঞান থাকিতে পাগল সাজ চোখ থাকিতে আন্ধা ॥
আগে দেশের মায়া ছাড় গুরুরূপে মনকে গাড়
নিজের কর্ম নিজে সার করুক লোকে নিন্দা ।
যে কইরাছে মায়ার সাধন সে হইয়াছে পুরুষ রতন
রশিদ উদ্দিন বলছে এখন মরণ নয় সে জিন্দা ॥

৯৪

যখন কিছু নাহি ছিলা তখন তুমি কোথায় ছিলা
কে বুঝে তোর লীলা মৌলা ॥
নিজরূপ করিয়া গোপন আহম্মদকে করলা সৃজন
উদ্দেশ্যে করিতে সাধন আরশে লটকিলা ।
মানুষ বানাইতে তুমি হুকুম করিলা ।
ফেরেস্তার কি আছে শক্তি নিজেই মানুষরূপ ধরিলা ॥
নিজরূপ করে দর্শন আনন্দে হইয়া মগন
কাহাকে করিতে ওজন, সেজদার হুকুম দিলা ।
তুমি বিনে নাই সজিদা কোরআনে ফরমাইলা ।
তবে কেন লান্নতের তকতা মুকরুমের গলেতে দিলা ॥
ঘুরে ফিরে তামাম সংসার গিয়াছ বেহেস্ত মাজার
মদনজ্বালা হইল তোমার বেহুঁশ হইয়া পড়লা ।
শক্তিবলে মায়ার ছলে প্রেমের মূর্তি হইলা।
হাওয়া বিবি রূপ ধরিয়া আদমেরে ভুলাইলা ॥
নিজে আবার হইয়া ভ্রমর বসলে হাওয়ার ফুলের উপর
কোরানে বলেছ হাজার, নিজে গন্দম খাইলা
গন্দম খাইয়া লেংটা হইয়া দুনিয়ায় আসিলা ৷
সাড়ে তিনশ বছর পরে কার মুখ দেইখা প্রাণ জুড়াইলা ॥
মানুষ দিয়া মানুষ বানাও মানুষ রূপে ঘুরে বেড়াও
দুঃখে সুখে দিনটি কাটাও করে উলামেলা ।
‘মাকারাল্লাহু মাকেরিন’ মক্কর করিলা ।
রশিদ উদ্দির হাতে এসে মানুষ রূপে ধরা দিলা ॥

৯৫

জপে রামের মরা মন্ত্র বাল্মীকি রচিল গ্রন্থ
শিরে পরি ব্রহ্মপদধুলা মন পাগেলা ॥
রাম নামে বান্ধ পারের ভেলা ॥
জনক দুহিতা সীতা নাহি মাতা নাহি পিতা
মিথিলা নগরে ভেসেছিলা ।
হরধনু ভঙ্গ করে বিয়ে করলেন জানকিরে
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলা ॥
পিতৃ-আদেশ করতে পালন গিয়াছিলা পঞ্চবটিবন
সেবক লক্ষণ সঙ্গে করে নিলা ।
পদচক্র রেখে মাথে রাজত্ব করলেন ভারতে
অযোধ্যাতে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলা ॥
লতাপাতা দিয়া পরে কুঁড়েঘর তৈয়ার করে
সেই ঘরে বসতি করিলা ।
সূর্পণখার অপমানে হঠাৎ একদিন দশাননে
শূন্য ঘরে সীতা হরে নীলা ॥
অসূর মারিচ হত্যা করে দেখাইলেন জগতেরে
কতপাপী উদ্ধার করিলা ।
বাউলকবি রশিদ বলে নামেতে গুণ না থাকিলে
গহীন জলে ভাসিত কি শিলা ॥

৯৬

যারে যা প্রাণের পাখি প্রেমের দেশে যা রে উড়ে
কইও খবর বন্ধুর কাছে রাধা তোমার প্রাণে মরে ॥
কইও গিয়া আমার কথা পাষাণে ভাইঙ্গাছে মাথা ৷
শুইনা যে তার লাগে ব্যাথা সেও যেন প্রাণে মরে ॥
প্রেম সলিলে ঝাঁপ দিয়াছি মরি কিম্বা প্রাণে বাঁচি।
তবু বন্ধুর আশায় আছি একদিন যদি দেখা করে ॥
প্রেমে অঙ্গ জরজর, কাঁপে অঙ্গ থরথর।
সখি তরা ধর ধর, প্রাণটি গেল দেহ ছেড়ে ॥
বাউল রশিদ উদ্দিন জন্মবধি পদে পদে অপরাধী ।
জেলখানাতে যেন কয়েদি রাখছে তারে বন্দি করে ॥

৯৭

রেল কোম্পানি আইল দেশে জার্মনি যায় জলে ভেসে
দুর্ভিক্ষ সেই দোষে ভাবে বোঝা যায় ॥
কচুরি যায় জলে ভেসে চাষী লোকে জমি চষে
চৈত্র আর বৈশাখ মাসে মনেরি আশায় ।
আসিয়া বৈশাখের ঢল বাড়িয়া কচুরির দল
নষ্ট করিয়া ফসল উজাইয়া যায় ॥
কু-পিত্ত বায়ু হয় মানুষের শরীলে রয়
ত্রিদোষে আয়ু ক্ষয় ডাক্তারে বুঝায় ।
তিন দোষে দেশের কপালে ভেবে দেখ আগুন জ্বলে
জল দিলে আরো জ্বলে নিভে নাতো হায় ॥
জমিজমার বিক্র বন্ধ বেশ কইরা করছে পছন্দ
মেয়েলোকের নিরানন্দ পড়ছে দুর্দশায়।
বুবুর গলার আছলি ছড়া হাতের চুড়ি পায়ের খাড়ুয়া
বেচতে হইলে মাথার ছড়া পেটেরি জ্বালায় ॥
লুটা, বাটি, ঘটি, ঝাড়ি একচালা, টিনের চৌহারি
কয়েক জোড়া পাতিল হাড়ি বাজারে বিকায় ৷
গহর্মেন্টে কইরা পরামিশ খুলল একটা নতুন অফিস
কাঁস ফটিকের ভাঙা জিনিস সবই নিয়া যায় ॥
গহর্মেন্টে কইরা বুদ্ধি আরেকটা কাম করল বৃদ্ধি
চোরের মাইর হইল ভাই জাগায় জাগায় ।
যার ঘরেতে তামাকাসা অন্ধকারে চোরের বাসা
রশিদ উদ্দিন সর্বনাশা করি কী উপায় ।

৯৮

জামাই থুইয়া বৌ হইল বৈদেশি নাগরবাসী গো
জামাই থুইয়া বৌ হইল বৈদেশি ॥
আচম্বিত এক বিকট মূর্তি আসিয়া সন্ন্যাসী
ঘরে থাইকা বাহির করল গলে দিয়া রশি ॥
শ্বশুরবাড়ি জামাই যাইতে মুখে নাই তার হাসি
ঢোল বাজে খোল বাজে বাজল না কেন বাঁশি ॥
শ্বশুরবাড়ি অগ্নিগিরি উঠে উল্কা রাশি ।
অগ্নিতে জলপান করাবে বড় পুতে আসি ॥
রশিদ উদ্দিন বলে হায়রে বৌ যে সর্বনাশী
কখন হাসে কখন কাঁদে যাহা তাহার খুশি ॥

৯৯

আরে ও পুবালী বাতাস
অনলেতে অনিলেতে সলিলে তোর বাস রে ও…
পৃথিবী ব্রহ্মা তুমি ঘুরছ বার মাস,
অচিন দেশে কইর আমার বন্ধুর তালাস রে ও…
পাও যদি বন্ধুর দেখা জানাইও অভিলাষ
মুই দুখিনী অভাগিনী হইয়াছে উদাস রে ও…
আর কতকাল ঐ বিদেশে থাকব পারবাস
আমার মনের দুঃখ আমি করিলাম প্রকাশ রে ও…
রশিদ উদ্দিন বলে আমার জীবনের নাই আশ
না পাইলে তোমার দেখা আমি গলে লইব ফাঁস রে ও…

১০০

প্রেম শিখাইয়া কত গেলে পাগল বানাইয়া ॥
হস্তে ধরে প্রেম শিখাইয়া কতই রঙের কথা কইয়ারে…
এখন হইছ রে নিদয়া কি দোষ জানিয়া ॥
ফুলবাগানে শুভা মালি, গাছের গোড়ায় জল ঢালি রে…
তাজা রাইখ বাগানগুলি যত্ন করিয়া ॥
ফুটিয়াছে যৌবনকলি আইলো না শ্যাম ভ্রমর অলি ॥
চতুর্দিকে উড়ছে ভ্রমর গুনগুন করিয়া ॥
ফুটিয়াছে দুইটি কমল যেমন পদ্মপাতার জল রে
বাতাসে টলমল কোনদিন যায় রে ঝরিয়া ।
আকাশ থেকে শিশির পড়ে, মাকড় আশে বন্ধ করে ॥
রবির জোর কিরণ লেগে যায় রে শুকাইয়া ।
রশিদ উদ্দিন সেই বাগানে, ছিল বসে এই ধ্যানে রে
কে যেন আসিয়া দিল বাগান জ্বালাইয়া ॥

১০১

ফুটিয়াছে রাঙা গোলাপ বাতাসে মিলায় রে
কাল যৌবনের জ্বালা সহ্য নাহি যায় রে…
সখি রে বোবা স্বামীর ঘরে বিয়া দিছেন বাপে-মায়…  
একদিন সে কথা বলে না রাত্র দিন ঘুমায় রে ॥
সখিরে… আমার গায়ে দিয়া বোঝা দেশ বিদেশে ঘুরায়
চিনি মুণ্ডা মিস্ত্রি দানা সে ঘরে বইয়া খায় রে ॥
সখিরে… একদিনও অবসর দিল না পরেরি সল্লায়
এমন স্বামীর ঘর করতাম না খালি বঁড়শি বায় রে ॥
সখিরে… ছয় ডাকাতের জ্বালাতন আর সহ্য হয় না গায়…
যার তার সঙ্গে ঝগড়া করে পরের কিল খায় রে ॥
সখি রে… রশিদ উদ্দিন বলে এইবার চাহিলাম বিদায়…
বাপের বাড়ি নাইওর যাইতাম আগামী বাইশ্যায় রে ॥

১০২

বধিব পরান গো শ্যাম, তোমারে না পাইলে গো শ্যাম…
আসবে বলে, গেলে চলে আর তো না আসিলে গো শ্যাম…
প্রথম পিরিতের কালে, কতই বইলাছিলে
এখন কেন সেসব কথা লোকে জানাইলে গো শ্যাম…
(আমার) সোনার কমল রসে ভরা শুকাইলে গো শ্যাম…
বসন্তের আগমনের ভ্রমর কোথায় রইলে গো শ্যাম…
(আমার) সিঁথির সিঁদুর নাকের বেসর চন্দন কপালে,
অভাগিনীর কর্মদোষে সব গেল বিফলে গো শ্যাম…
আমার কুল গেল কলঙ্ক হইল লোকে মন্দ বলে,
রশিদ উদ্দিন স্বামীসেবা ঘটল না কপালে গো শ্যাম…

১০৩

নারীলোকের মুখে মধু অন্তরে গরলে ভরা ॥
নারীলোকে যারে ধরে তারে কি সহজে ছাড়ে
আগে আশা দিয়া তাকে, শেষে করে জেতা মরা ॥
নারীলোকের এমনি ধারা পরাইলে প্রেমের হাতকড়া
হাত ইশারা আঁখি ঠারা, পাগল করে কালো ভ্রমরা ॥
নারী তো কঠিন জাতি হাতে হাতে দেখায় মতি
মুখে মুখে থাকে সতী কাল যুবতীর এমনি ধারা ॥
প্রেম করিয়া রশিদ উদ্দিন অল্প বয়সে গেল জাতি
এমন কি তার হবে গতি, হইয়া গেছে কপাল পুড়া ॥

১০৪

অন্তরায় কি রোগ হইয়াছে ॥
যে অবধি, হইয়াছে ব্যাধি
কইনা দুঃখ লোকের কাছে ॥
যেদিন হইতে পারননাথে
প্রণয়সূতে বাঁধিয়াছে
না দেখিলে তারে দুইটি আঁখি ঝরে
না জানি কপালে আরও কি আছে ॥
হৃদয়মন্দিরে কেমন চোরে
কৌশল করে সিঁদ কেটেছে।
শুইলে বাসরে… নিদ্রা নাহি ধরে
কেমন জনে আমারে জাগাইয়া দিছে।
অভাগিনীর মন সদা উচাটন
না জানি কেমন জন ঘরেরি পাছে ॥
(আমার) ছল-ছল আঁখি বাহির হইয়া দেখি
ননদী বিবাদী কপাট লাগাইছে
প্রেমেরি যন্ত্রণা পরানে সহে না
কঠোর যাতনায় প্রাণ কি বাঁচে ।
রশিদ উদ্দিন বলে মরণের কালে
প্রাণনাথ আমার থাকিও কাছে ॥

১০৫

শুভদিনে উদয় হইলেন পাক নাম মোহাম্মদ ॥
যেইছা ওয়াক্তে জন্ম নিলেন আসমান জমিন সুবেসাদ ॥
আউয়ালে ছিলেন বাতিনে ইছিম হইতে জিছিম বনে
যার কারণে এই ভুবনে পয়দা করলেন আদমজাত ॥
একশত তিরিশটি ফরজ মুসলমানের উপর গরজ
শীঘ্র শীঘ্র কর আদায় দুরুদে আকবার পাক ছালাত ॥
রশিদ বলে হইয়া কাতর নবী আমার দয়ার সাগর
উদ্ধারিয়া নিবেন হাসর পার করিয়া পুলসেরাত ॥

১০৬

শুন রাই বিনোদিনী কেন বা কাঁদ তুমি
পাবে রে শ্যাম গুণমণি বলে যাই তোমায় ॥
শুন রাধা পিয়ারি প্রাণেতে ধৈর্য ধরি
বলতে থাক হরি হরি থাকিয়া আশায় ॥
সন্ধ্যা আহ্নি কর তুলসী প্রণাম কর
নামের মালা জপ কর যদি পাওয়া যায় ॥
শুন বৃষ ভানুর নন্দিনী, কুলের কলঙ্কিনী ॥
হইলে কেন পাগলিনী উদাসিনী প্ৰায় ॥
কান্দিলে আর কিবা হবে, কান্দিলে কি পাগল পাবে
পাগল হইয়া পাগল ধরা বিষম দায় ॥
সত্য রজঃ তম গুণে ব্রক্ষ্মা বিষ্ণু মহেশ বিনে
ছিল তারা নামসাধনে যোগমায়ার দায় ॥
যোগমায়া যোগিনী কুল কুণ্ডলিনী
মরা হয়ে ভেসে তিনি বাসনা পুরায় ॥
এক পাগল নারদ ঋষি, বীণা হাতে দিবা নিশি
গাছতলায় বসি বসি, ঝঙ্কারে বাজায় ॥
আর এক পাগলা ভোলা, কৈলাসে করেছে খেলা
করল কত আজব লীলা, বুঝা বড় দায় ॥
পশুপঙ্খী পাগলপারা দুর্গাহাতে পরল ধরা
ভবানী, মাকালী, তারা বুকেতে দাঁড়ায় ॥
আরেক পাগল গৌরহরি নামের মালা সঙ্গে করি
ব্রজধাম আঁধার করি নদীয়াতে যায় ॥
হরি হইয়া বলছে হরি, ধুলাতে দেয় গড়াগড়ি
বাবা শ্যাম বংশীধারী মাথাটি মুড়ায় ॥
ভেবে রশিদ উদ্দিন কয়, সেই পাগল তোমার হয় ।
ধরতে যদি মনে লয় করবে কী উপায় ॥
সেই পাগলকে ধরতে গিয়া, কুলমান সব যায় ভাসিয়া
থাকতে পারলে রইয়া সইয়া তবেই পাওয়া যায় ॥

১০৭

উল্টা দেশের উল্টা মাইনি কইতে কথা লাগে ভয় ।
মরা গাঙ্গে জেতা কুম্ভীর আরে আরে চাইয়া রয় ॥
সেই গাঙ্গেতে নামলে পরে অমনি ধরে আহার করে
খাইলে তারে কয়দিন পরে একটা মানুষ জন্ম লয় ॥
সেই দেশেতে উল্টা কারবার দিনে আঁধার রাত্রে বাজার
এক দোকানদার এক খরিদ্দার, কিনতে গেলে বেচতে হয় ॥
খুড়া যখন দাদীর পেটে পিতা তখন তোমার হাটে
এই হল তোর বয়স মোটে ছিল রে বৎসর পাঁচ ছয় ॥
ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে সেই দেশে কেউ নাহি গেলে
পিতার সঙ্গে গিয়া ছেলে মারে বিয়ার কথা কয় ॥

১০৮

তিন বেড়ের বাগানেতে ভ্রমর এসেছে ॥
ফুলের কলি দোলি দোলি ঝিলমিল করতেছে ॥
হায় মরি কি মনোলোভা, ঝুলিতেছে রক্তজবা,
ডাল ছাড়া ফুল কেমন শোভা, জ্বলুনির উপর ভাসিতেছে
দেখতে বাগান কী চমৎকার, দুই দিকে পাতাবাহার
মাঝখানে সমুদ্রের মাজার গোলাপ ফুটেছে ॥
বসে মালী বাগানমূলে মাসে তিনদিন ফুল তুলে
ডাল ছাড়া ফুল পাতায় ঝুলে রস বিলাইছে
জ্ঞানস্ত সে ভক্তি পানে, খাইছে মধু সাধুগণে
রশিদ উদ্দিন ক্ষুদ্র জ্ঞানে সকল হারাইছে।

১০৯

গন্ধম অমূল্য নিধি, গন্ধমই সংসারের ধন
দিন থাকিতে চিনিয়া লও গন্ধমের সাধন ॥
যেজনা চিনল না তারে জানিল গরল ।
চিনলে পরে এ সংসারে ইচ্ছামত হয় মরণ
সেই ফল খাইতে খুব মজা, ও তার ভেদ খুবই সোজা
সময়মত তুলতে পারলে হইবে রাজা।
ধরবে লতা ঝরবে পাতা ভাঙ্গলে মাথা যার কারণ ॥
কথাটা শুনিতে অতি শক্ত রহিয়াছে অতি গুপ্ত
গন্দম গাছটা চুঁয়াইয়া পড়ে তিন ফোঁটা রক্ত ।
সেই রক্ত দিয়া স্তুল বান্ধিয়া ইসমে আজম হয় মিলন ॥
রশিদ উদ্দিন হইল ঐ অভ্যাস, পাইয়া গন্দম গাছের চাষ
দেশ বিদেশে ঘুরে ফিরে, হইয়া হুতাশ ॥
যতই পাই ততই খাই, জীবন থাকতে নাই বারণ ॥

১১০

ছাড়িলে বিদ্বেষ পাবে মাইন্সের উদ্দেশ
কেন ঘুর দেশ বিদেশ ঘরে গেলে না ।
কাম ক্রোধ লোভ মায়া এই সমস্ত ছেড়ে দিয়া
মাইজ ঘরে থাক বসিয়া ওরে সোনা ।
সে যে থেকে তোমার ঘরে, ডাকিতেছে তোমারে
তুমি থাক দূরে কাছে ভির না ॥
ঘরের ভিতর ঢুকলে পরে, দেখবে গিয়া নজর করে
হায় কি কলিকাতার শহর চিড়িয়াখানা ।
কত হস্তী বাঘে খেলা করে, সর্প পালায় ময়ূরের ডরে
ফুলের বাগান সরোবরে আজব নমুনা ॥
সুন্দর বাড়ি বানছে ঢাকা, ডাইন পাশে তার কলিকাতা
দালান কোঠা সবই পাকা, বাকি রাখছে না ।
হায় রে কলিকাতার শহর, বান্দিয়াছে জলের উপর
কাঁপিতেছে সদা থরথর ঠিক থাকে না।
ঢাকাতে নবাবের বাড়ি, থাকেন তিনি দিল্লীপুরী
মণিপুরে হয় কাঁচারী, সঙ্গে দুইজনা ॥
ডাইনে বামে দুই ফিরিস্তা, আইনমতে করে ব্যবস্থা
কালি কলম কাগজের বস্তা সঙ্গে রাখে না
মণিপুরে বসে কর্তা, দিনাজপুরে রেখে রাস্তা
মাল বিকাইছে বড় সস্তা কিনৈয়া মিলে না ।
নারায়ণগঞ্জে ডাকের গাড়ি, মকদ্দস ইস্টিমারি
টেলি হয় কলপুরের বাড়ি, খবর রাখলে না ॥
শুন রশিদ উদ্দির বাণী, মন মহাজন বড় ধনী
চৌদ্দ পোয়া বাড়ি জমি আবাদ করলে না ।
একশ তিরিশ দিয়া খাজনা, চাষ করিবে যেই জনা
ফসল তাহার হবে দুনা, ফলবে রে সোনা ॥

১১১

ছাড়িয়া সোনার সংসার কোথায় চলে যাও,
ডাকছে তোমার অর্ধাঙ্গিনী একবার ফিরে চাও ।
ডাকছে তোমার জন্মদাতা ডাকছে তোমার মাও ॥
ডাকছে তোমার প্রতিবেশী ডাকছে তোমার গাঁও
ডাকছে তোমার পুত্র কন্যা ঘাটে নাও লাগাও ॥
এত ডাকাডাকির পরেও মুখে নাহি রাও ।
ডাকছে তোমার আমিরানায় পাপুস লাগাও পাও ৷
বাউলকবি রশিদ বলে আরকি পাবে রাও ॥
সংসারের এই রীতি নীতি সবেই দেখে যাও ৷
ছেড়ে দিয়া কান্নাকাটি যার তার নৌকা বাও ॥

১১২

উগারতলের কুনি বেঙ্গী, সর্প ধইরা আহার করে ॥
দেখ না রূপের ঘরে তোরা দেখ না রূপের ঘরে ॥
বেঙ্গীর গন্ধ পাইলে পরে, সর্প তখন ফনা ধরে
তাই দেখিয়া কুনি বেঙ্গী গাল ফুলাইয়া মরে
সর্পজাতি ক্ষুব্ধ অতি থাকিতে না পারে
রাগের মর্দ্দ নাই তার দর্দ্দ বেঙ্গীরে গিয়া ছোবল মারে ॥
বলব কি আশ্চর্য কথা বেঙ্গীর নাই মুণ্ডু মাথা
শুধু একটি মুখের গাতা জিহ্বা তার উপড়ে
কত মুণির পরশমণি ঢালে এই গহ্বরে
এই বেঙ্গীডা নলি বেঙ্গী চাবাইয়া চাবাইয়া মারে ॥
বেঙ্গী যেদিন লাল ছাড়ে সর্প থাকে অনেক দূরে
ঘরে ঘরে কপাট লাগায় যায় না কেউ বাহিরে
অন্ধকারে বেঙ্গীর লাল ছাড়ে মাসকাবারে
লাল কি লাল সকলি লাল, লাল দিডহতে নিশান উড়ে ॥
যে পাইয়াছে বেঙ্গীর লাল, ঘরভরা তার আছে রে মাল
কাল বিকাল মহাকাল, ডরায় কিছু তারে
এক লাল হইল সাত রাজার ধন যে পাইল সংসারে
বাউলকবি রশিদ বলে সাত পুরুষে খাইতে পারে ॥
সর্পের বাড়ি নারিকেল ডাঙ্গা, বেঙ্গী থাকে মাইজ গাঙ্গে
সর্পের ডিম বেঙ্গীর গাথায় কায়দা পইলেই ছাড়ে
নির্বুদ্ধিয়া বেঙ্গীর জাতি উম পারে আদরে,
দশমাস দশদিন গত হইলে, মাইন্সের বাচ্চা প্রসব করে ॥

১১৩

চল যাই শিকারে মানুষ চল যাই শিকারে
বাঘের ডাকে অন্তর কাঁপে ঐ না মধুপুরের গড়ে ॥
গুলি বারুদ বন্দুক লইয়া, কত মানুষ পাগল হইয়া
বাঘের উপর নিশান দিয়া বইছে গিয়া পাহাড়ে ।
মরার মত আছে বাঘ নাহি লড়েচড়ে।
কত মানুষ খাইল বাঘে গুলি বন্দুক সহকারে ॥
বাঘের নামটি ফুলেশ্বরী, মুখে আছে ঘন দাড়ি
চোখ নাই তার অন্ধ নাড়ি গন্ধে আহার করে ।
কেহ যদি যাইতে চাও সাহসেরি জোরে।
(হবে) এক আওয়াজে বন্দুক নষ্ট এক গুলিতে বাঘ না পড়ে ॥
বাঘিনীর নাকটি পেঁচা কেউ দিওনা তারে খোঁচা
বাঘলার কিন্তু কোমর উচা কইলাম ঠারেঠিরে।
মানুষেরি গন্ধ পাইলে জিহ্বার পানি পড়ে।
বাঘিনীর দাঁত নাই মুখে রক্ত খায় সে চুমুক মেরে ॥
বাঘ মারার সন্ধান আছে, শিক্ষা কর গুরুর কাছে
তা না হইলে থাইক পাছে যাইও না তার ধারে ।
যখন বাঘে অতিরাগে খাব ধরে খুব জোরে
থাইকা সাবধান চৌদ্দটি বান মারিও সেই বাঘিনীরে ॥
শোন বলিরে ওরে পাষাণ চৌদ্দ জাগায় মারিলে বাণ
কাল বাঘিনী হইয়া অজ্ঞান অবস হইয়া পড়ে
কলাকৌশলে বাঘিনীর বিষ যে নামাইতে পারে ।
ধন্য সে শিকারী বটে, ধন্য মানুষ এ সংসারে ॥
ভেবে রশিদ উদ্দিন বলে ঠেকলাম এসে মায়া জালে
দিন আমার গেল গোলমালে ঠেকছি এসে মায়ার ফেরে।
কাল বাঘিনী কাল নাগিনী আছে সবার ঘরে
এই চিন্তাতেই দিন গেল মোর, কোনদিন জানি আমায় ধরে ॥

১১৪

স্নান কর ভাই ডুব দিও না যমুনায় গিয়ে
তবে হয়ত ডুবতে পার, রাজহংসের ভাব ধরিয়ে ॥
খেলাও যদি জল-তরঙ্গ, হয়ে যাবে রতিভঙ্গ
আরশে অবশ অঙ্গ মূলধন হারাইয়ে ॥
সেই নদীতে লোনা পানি, ডুবছে কত ধনীমানি
কাউকে নিয়ে টানাটানি, জোয়ার ভাটায় পড়িয়ে ॥

***
এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি

১১৫

কোথায় যে জন, জানে বা কোন জন
যে জন সৃজন, পালন, লয় করে ॥
আকাশে, পাতালে, গহীন কাননে
ভূতর সলিলে, কি প্রান্তরে গগনে
সে দূরে না কাছে, আগে না পিছে
আছে না মরেছে, কেউ কি বলতে পারে ॥
সে বাংলায় কি হিন্দুস্তানে, আফ্রিকায় কি লন্ডনে
ভূটান কি চীন শহরে ।
সাকার কি নিরাকারে ॥
সে তটে না পটে, ঘাটে না মাঠে
হাটে না হোটেলে কি বাজারে, কাশি কি গয়ায়
মসজিদ কি মন্দিরে ॥
সে তপনে না পবনে, ভূবনে না বিমানে
গহনে কাননে, কি সাগরে ।
সে ঢাকে না ঢোলে, করতালে কি খোলে
গায়কের দলে রয় স্বরে ॥
কেহ পূজায় পূজে, কেহ ডাকে নামাজে
বাউল রশিদ উদ্দিন স্বরাজে ডাকে তারে ।
এখন হয়েছে আশ্বাস, করছি বিশ্বাস
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস প্রেষ্ট সংসারে ॥

১১৬

স্বভাবে সাকার মানুষ আকার
অভাবে অবশিষ্ট থাকবে নিরাঞ্জন ।
শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ আদি রূপ-রস তার
চতুর্বিংশ তত্ত্ব নিয়ে গঠিত সংসার
অহং জ্ঞানে আমার আমার
ভোগ-বিলাসে লিপ্ত অনুক্ষণ ॥
আমিত্ব আরোপ করি, ঐ দেহধারী জীব
কর্মভেদ নাম ধরেছে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু-শিব
কেহ ধনী কেহ গরীব, যোগ-বিয়োগে আর ভাগ-পূরণ ॥
জীবাত্মায় ফুটবে যখন সুহং ব্ৰহ্ম ভাব
বিশ্বপ্রেমের ভাণ্ডারেতে, হবে প্রীতি লাভ
চায়না তখন, কোরান কিতাব স্বপ্ন রাজ্যের সিংহাসন ।
রশিদ উদ্দিন ভাবতে ভাবতে বুঝিবে আর কত
অবহেলায় দিন যে আমার, হয়ে গেল গত ৷
আসল কাজে হইনা রত, কাঁচামাটির করছি যতন ॥

১১৭

তোরা দেখ যমুনার কূলে
সাঁই নিরঞ্জন আছে গোপনে মিশিয়া তার রাঙা জলে ॥
সেই নদীর উজান বাঁকে দুইটি ধারা মিশিয়াছে
মধ্যখানে একটি গাছ, তিনটি কোমল ঝুলে
নিত্য আসে মন মধুকর ডাল ছাড়া সেই ফুলে
চাইব যুগে এক ডিম পেড়েছে, কাঁচা কুসুম মধ্যখানে ॥
লাগে না ভাই তন্ত্র-মন্ত্র, আসন কিংবা কোনো যন্ত্ৰ
হলে পরে শুদ্ধ শান্ত মাসের মাসেই মিলে ।
পূর্ণ-চন্দ্রের খাসা পানি, অমাবস্যা কালে
খাইলে নারে ও পাগল মন, ভেবে বাউল রশিদ বলে ॥

১১৮

কুল আলমে সেজদা দিয়া, সাকারে চিন্ নিরঞ্জন
নূরের তত্ত্ব, আছে সত্য, রাছুলে করেছে গোপন ॥
চিনে লও কুদরতি মুছলা, কুলু বেল মমিনে আল্লা ।
সাইয়িন মুইতো বরজাকুল্লা, কুরানেতে হয় বর্ণন ।
মান্ আরাপা নাফছে গনি, ফাকাঁদে রাব্বহু মানি ।
নাফাক্কু হায়াতে পানি, দিন থাকতে করগে তা যতন ॥
নাহেনু আকরাবু বলে, কোরান হাদিছ খুলে
রক্ত ধাতু একত্রে মিলে, খুদা-খুদি দরশন ॥
রশিদ উদ্দিন কয় ভাবিয়া, কত ভাবেই যাই খুঁজিয়া ৷
এখন নীরবেতে চুপ করিয়া, ভাবছি বসে অকারণ ॥

১১৯

আঁধারে ঘিরিল, কোথায় যাই বল
কে দিবে পথ দেখাইয়ারে ॥
ঐ চেয়ে দেখ তোমার ডুবে গেছে বেলা
প্রাণপণে খেলিতেছি মিছে ধুলো খেলা ।
মায়া কামিনীর সঙ্গে, কতই রঙে ঢঙে
ত্রিভঙ্গে তরঙ্গে ভাসিয়ারে ॥
কাছেতে শিয়াল ডাকে, আসে মরার গন্ধ
ভয়ে হা-হুঁতাশ, আমার নিঃশ্বাস হয় বন্ধ ।
ভুতে আগুন জ্বালায়, মাঝে মাঝে নিভায়
খিল খিল করে উঠে হাসিয়া রে ॥
সামনেতে শশ্মান ভূমি, সঙ্গে নাই মোর কেহ
ভারি বোঝা মাথে আমার, শিহরিছে দেহ।
প্রভূ বিপদ হারি, রশিদের কাণ্ডারি
বিপত্তি বিপাক, তুমি দাও নাশিয়া রে ॥

১২০

মানুষ বানাইয়া, খেলছ তারে লাইয়া
সেই মানুষ কেমনে গোনাগার-রে ॥
মানুষে করে না গোনা, তুমি করাও পাপ
অনুমানে বুঝি আল্লা, ভালো না তোমার স্বভাব
বলিয়া কি লাভ, দিতেছে এতো তাপ
কহিলে মান্যতা, রবে না আর-রে ॥
কিছু কিছু যাই বলিয়া, সহে না মোর গায় ।
আদমের কালভূত যখন ফেরেশতায় বানায় ৷
রুহু দিয়া ভিতরে বলছিলা তাহারে
সেজদা কর, আদম আমার ॥
ফেরশতায় সেজদা করে, মনে নিয়া ভর
না জানি নাল্লাতের তখত পরে কার উপর।
মাথাটি উঠাইয়া, চাহিলেন ফিরিয়া
দাঁড়াইয়া রয়েছে মকরুম আল্লর-রে ॥
এই বুঝিয়া রশিদ উদ্দিন, হইল না পেরেশান
ধরিল পিরিতের রোগে, চলে না ইনজেশান
তোমারই শোগে, মরতেছি ভুগে
ভাগ্যে ঘটলো না, চরণ তোমার-রে ॥

১২১

কেয়াস দলিল, হাদিস ফেকা, কোরানের মাইনি কঠিন
বিসমিল্লাহির উনিশটি হরফ, রয়েছে দোজখের জামিন ॥
তারপরে ঘুরে–ফাতেহা বলে, পিছের কথা মন আগেই চলে
আলিফ-লাম-মিম যোগে মিলে, ইছমে আজম রয় বাতিল ॥
সাত খণ্ড দোজখের নিচে, উনিশ জনে ফেরেশতা আছে
আউযবিল্লা বান্ধা আছে, শয়তানে রেখেছে জামিন
একরা বিছাম যখনরে কয়, ফয়েজ হাসিল তখনই হয়
প্রাণের তারে কথারে কয়, ফয়েজ হাসিল তখনই হয়
প্রাণের তারে কথারে কয়, নায়েবে-নবী-মোয়াজ্জেরিন ॥
নাজিল হওগা সুরে রহমান, ফাবি আইয়্য তোকাজ্জিবান
নারী-পুরুষ লুলু ওয়া মারজান, ভাসতে আছে প্রতিদিন ॥
কইতে গেলে কথারই মূল, মুনসী-মোল্লায় কয়রে বাতুল
নিরানব্বই নামের ফুল, ফুটিলেন হযরত ইয়াসমিন ॥
কোলহু আল্লা কলিজাতে, হুএখফা নাসিকাতে
কালেমা তোর দিলের সাথে, তখতে রাব্বেল আলামিন ।
রশিদ উদ্দিন কয় ভাবিয়া, দিল কোরান আগে লও পড়িয়া ॥
মমিন গেল কাফের হইয়া, কইতে ওলাদ, দোয়াল্লিন ॥

১২২

হিরামন মাণিক্যর দেশে
আমার মুর্শিদ আছে ।
সাত সমুদ্দুর পাড়ি দিয়া কে
মনে যাই তার কাছে ॥
সাত সমুদ্দুর তেরো নদী,
পার হইতে পারি যদি
দেখবো সেরূপ নিরবধি
যদি প্রাণ আমার বাঁচে ॥
আমার মুর্শিদ চান্দের বাড়ি
ঠিক যেমন মদিনার পুরি,
ফেরেশতারা দেয় পাহারা
হুর আনন্দে নাচে ॥
মুর্শিদ আমার নায়ের মাঝি
তার নামের করিয়া পুঁজি
খোলিয়া জান্নাতের কুঞ্জি
যাবরে ফেরদাউছে ॥
মুর্শিদ আমার ঘাটের মৌলাদার
তার নামে হইব আমি পার
বাউলকবি রশিদ উদ্দির
মুর্শিদ বিনে কেউ নেই শেষ ॥

১২৩

কেমনে চিনা জানা, তারে কেমনে চিনা জানা
স্বর্বজীবের ঘটে–ঘটেই সাঁই এলাহির বারামখানা ॥
চিনতে চাইবে যদি তারে, বিষয়াদি দাও গো ছেড়ে,
ভাব-ভক্তি যোগে মিলে, ধ্যানে কর কল্পনা
অধরাকে ধরতে গেলে আগে চিন আপনা
চাবি দিয়া দমের কোটায় ‘হু হু’ শব্দ কর জপনা ॥
কুলবেল মমিনের কাছে কলবেতে আঁকা আছে
দ্বিলের পর্দায় রং দিয়াছে, ছফেদ তার নমুনা;
আল্লা রাসুল দুই পাশেতে, কলিজাতে থানা
শব্দ করে দিল রজনী, ঘুমাইলে বারণ থাকে না ॥
শ্রীকালার বাজারে খেলা, যত কাল্লা তত আল্লা
লক্ষ ছিফতে ঘুরে, মূলে হয় একজনা;
নিজেই নিজের নামটি জপে, আলেক সাই পাক রব্বানা
 লাহুত হইতে শুরু করে, নাড়ুতে তার আনাগোনা ॥
রাজা প্রজা যেথায় আছে, বেহেস্ত দোযখ তাদের কাছে
বায়তুল্লার পাল্লার নিচে মক্কা আর মদিনা
মগজে মুনতাহাপুরি আসল তার ঠিকানা
বাউল রশিদ খুঁজলো কত দয়া করে দেখা দেয় না ॥

১২৪

চিনি খাওয়া রাক্ষসীরে মারো
যদি পারো ।
খাইল কত সাদা চিনি
ধনী-মানি করতাছে লুজার ॥
চেয়ে দেখ ঘরে ঘরে
সেই রাক্ষসী বিরাজ করে ।
মারলে তারে বন্দুক যোগাড় কর ॥
কী বলিব রাক্ষসীর কথা
মুখ আছে তার নাইরে মাথা
শুনে কাঁপিল ভয়ে অন্তর ॥
সেই রাক্ষসী কোমর উচা
তারে কেউ দিওনা খুঁচা
রাকলা পেঁচা
কইলাম ঠারেঠুরে ॥
বাউলকবি রশিদ কয়
জানবে যদি সেই পরিচয় ॥
আগে দিয়া মুর্শিদ ভজন কর ॥

১২৫

জীবনপ্রদীপ করে নিমিঝিমি
তেল সলিতা সবই ফুরাইল রে ॥
জীবন ভরা এই প্রদীপে ঢালছি কত তৈল
মাজিয়া ঘসিয়া কত সাফ কইরাছি মৈল ।
এখন পারিনা গো আর, করতে পরিষ্কার জংকারে ধরিল রে ॥
একুশ হাজার ছয়শত পাওয়ার বাতির মেন্টেল
পাম্প দিতে দিতে বাতির পাওয়ার বাড়িয়া গেল ।
আজকাল চব্বিশ হাজার, উপায় নাই গো আর, বাতাসে ধরিল রে ॥
যার বাতির পাওয়ার ভাইরে বসাইয়া নিল
তার বাতির সব সময়, স্বপনেই জ্বলিল ।
বিত্তি বিপর্যয় নাই কোন হয়, নিষ্কণ্টকে জ্বলিলরে ॥
বাউলকবি রশিদ বলে, বাতিত নাই তর জোর
ও দিগেতে চাইয়া দেখি, নিশি হইল ভোর ৷
দিনে লইল গুড়গুড়, ঘোর আঁধারে ঘিরিল রে ॥

১২৬

রাম নামে বান্ধ পাড়ের ভেলা রে মন পাগলা
রাম নামে বান্ধ পাড়ের ভেলা ।
জপে রামের মরা মন্ত্র-বাল্মিকী রচিল গ্রন্থ ।
শিরে রেখে ব্রহ্ম পদ ধুলা ॥
জনক দুহিতা সীতা, নাহি মাতা নাহি পিতা
মিথিলা নগরে ভেসেছিলা
হরধনু ভঙ্গ করে, বিয়া করে জানকীরে
প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলা ॥
পিতৃশর্ত করতে পালন, গিয়া পঞ্চবটী বন
সেবক লক্ষণ সঙ্গে কওে নিলা
পদছত্র রেখে মাথে, রাজত্ব করলেন ভরতে
অযোধ্যাতে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলা ॥
লাত পাতা দিয়া পরে, কুঁড়ের ঘর তৈরি করে
সেই ঘরেতে বসত করিলা ।
হঠাৎ এক দিন দশানন, সেই বনে দিয়া দর্শন
শূন্য ঘরে সীতা হবে নিলা ॥
কত অসুর মারিস হত্যা করে, দেখাইলা জগতেরে
কত পাপী উদ্ধার করিলা।
বাউলকবি রশিদ বলে নামের গুণ না থাকিলে
গহীনে জলে ভাসে কেন শিলা ॥

১২৭

জান্নাতেরই সেরা ফল এলো নেমে দুনিয়ায়
মরুর বুকে রসের মেলা, পবিত্র পদের ছায়ায় ॥
আউয়ালেতে ছিলরে ফুল, আরশেরই শিঃস্তানে
আখেরাতে ফুটিল ফুল, কুরেসেরই বাগানে
আব্দুল্লাহরই উছিলাতে, পাইলেন মা আমেনায় ॥
উটের শাবক দুম্বার ছানা, আনন্দেতে নাচিয়া
মারহাবা-মারহাবা গান, ফেরেশতারা যায় গাইয়া
শুকনা নদী আসিল জল, শুধু রহমতের হাওয়ায় ॥
যেদিন নবী জন্ম নিলেন, মক্কারই শহরেতে
জিবরাইল উঠাইয়া নিল, গোপনে আরশেতে
তিনদিন নবী ছিলেন গোপনে আরশেরই মোয়াল্লায় ॥
মা আমোনারই কোলে এনে দিয়ে গেল যখনে
আনন্দে নাচিয়া উঠল হুরপুরী আর ইনসানে
রশিদ মিয়া রয় এন্তেজার, শুধু সেই ফুলের আশায় ॥

১২৮

পিরীতি করা পরানে মরা রে
যারাই করিল, তারাই জানে ॥
প্রেম করিলেন ইউনুছ নবী মাছের পেটে থাকিয়া
নামের সুধা পান করিয়া রইলেন ইউনুছ বাঁচিয়া
আশেকে দয়াময় দেয় মাশুকের পরিচয়
ইব্রাহিম বাঁচিয়া রয়, জলন্ত আগুনেরে ॥
ইউসুফকে কুয়াতে ফেলে মিলিয়া ভাই দশজন
দয়াল আল্লা দয়াল প্রভু দেখাইলেন তখন
সওদাগরে পাইল, মিশরের বাদশাহী দিল
কেমন ভাগ্য ফিরাইয়া আপে পরোয়ারে রে ॥
এই দিকে জ্বলেখা বিবি, আশি বছরের বুড়ি
প্রেমের কারণে আল্লা বানাইলেন যুবতী
আশেকের বেদনা, মাশুক বিনে জানে না
পরে আল্লা পরোয়ার, মিলাইছে দুইজনাবে ॥
নূহকে ভাসাইলেন ঝড়, বৃষ্টি, তুফানে
মুসাকে পাঠাইলে জলন্ত আগুনেরে
বলে অধম গোনাগার রশিদ উদ্দিন হয় তোমার
আমারে তরাইও আল্লা হাশরও-মিজানেরে ।

১২৯

ঘরবাড়ি ছাড়িলাম-রে নদীর পারে ঘুরি
সাগর সিচিলাম রে মানিক পাইবার আসে ॥
সখি রে…
না খাইল জঙ্গলার বাঘে না খাইল কুম্ভীরে
হায়রে না খাইল কুম্ভীরে
মুই অভাগী ঘুইরা ফিরি
এই দুনিয়ার পারে-রে
মানিক পাইবার আশে ॥
সখি রে…
যৌবন জোয়ারের পানি, রূপ গেল তার পাছে
হায়রে রূপ গেল তার পাছে
মুই দুঃখিনীর দুঃখ দেইখ্যা,
কান্দে পানির মাছেরে…
মানিক পাইবার আশে ॥
সখি রে …
মাখিলাম কলঙ্কের কালি, চন্দন জানিয়া
হায়রে চন্দন জানিয়া
লোকের মন্দ পুষ্প চন্দন
রশিদ উদ্দিন বুঝে রে
মানিক পাইবার আশে ॥

১৩০

আসলে সমন, শরীরের শক্তি তখন
কোথায় করবে পলায়ন ভাবলেনা একবার ॥
ছেলে মেয়ে শিশু কালে, কত কষ্টে মায়ে পালে
ক্ষুধা হলে দুগ্ধ কলা খাওয়ার বারবার ।
কান্দে যদি পুত্র ধন, চমকে উঠে মায়ের মন
কাম ছাড়িয়া দেয় মায়ে, শুনিয়া চিৎকার ॥
পুত্র গেলে পরবাসে মা থাকে তার আসার আশে
কবে বা আসিয়া পুত্রে করিবে আহার ॥
পুত্র সেয়ান হইলে পরে দিনে দিনে হিংসা বাড়ে
মা কিছু কইলে তারে ফিরাইয়া দেয় বার
শুন বলিগো বুইড়া মাতা সাবধানে বলিও কথা
উঠাইয়া নিব মমতা মারিয়া আছাড় ॥
পুত্র যদি সাদি করে মনে মনে ভাবনা করে
থাকতাম না একত্তরে ভাবনা কি আমার ॥
কথায় কথায় বিবাদ করে দেও আমরে পৃথক করে
পারি যেমন করে চালাব সংসার
পিতাপুত্রের দেখে দ্বন্দ্ব রশিদ উদ্দিন নাপছন্দ
ভাগ্যগুণে কপাল মন্দ হইয়াছে তাহার ॥
হায়রে কঠিন সংসার ঘটিতেছে কী অবিচার
পিতাপুত্রের এই ব্যবহার সহ্য করা ভার ॥

১৩১

আমার মন পরানের নাও শূন্য ভরে উড়াল দিয়া যাও
পাড়ে নিবে যদি নেকি, কারবা পানে চাও ৷
নায়ের যত দাঁড়ের দাড়ি করছে হুড়াহুড়ি
দৌড়াদৌড়ির লেগে গেছে বাও ॥
দেইখ্যা নদীর কোলাকুলি, করছে সবাই ফালাফালি
নৌকাখানি হইয়াছে উধাও ।
চলছেরে পরানের নৌকা, বাইছাগণকে দিয়া ধোঁকা
সবাই বোকা মুখে নাই রাও ॥
নৌকা বাতাসের আগে চলে, পেসেঞ্জার নাহি তুলে
না জানি সে বাদী নৌকা কোন ঘাটে লাগাও ॥
নৌকারে আমার কথা মান
কোন বিদেশি কোথায় বাসি মারবে তোরের টান
একবার ফিরে আও ৷
নদীর পাড়েতে বইয়া তামাসা দেখেছে গিয়া,
বিজলীর সমান বেগে চলছে সোনার নাও ৷
বাউলকবি রশিদ বলে, আমরি ঐ ভাঙ্গা কূলে
সোনার নৌকা কলে বলে আর একবার ভিড়াও ॥

১৩২

পিরিতে কইয়াছে আমারে লেঙ্গা
তোর সনে আমার পিড়িতে
পুড়ে মারলো দিনে রাতে
না পারিলাম মন জায়গাইতে
তুই তো বড় ডাঙ্গা ॥
কত বুঝালাম তোরে কত বা তোষিলাম,
কত ভালবাসিলাম তবু
তোমার মুখখানা চোঙ্গা ॥
আমার বলতে যাহা ছিল
তোর পিরিতে সবই গেল
আর দেবার মত সম্বল নাইরে
এখন আমর দম চলে না
গান বাদ্য করতে পারি না
তালেতে বেতাল হলো
গলায় বাজলো বেঙ্গা ॥
প্রেম করে বিদেশির সঙ্গে
বেড়ি দিলাম নিজের ঠেঙ্গে
রঙ্গে রঙ্গে গান বান্দিয়া ঠেকছিরে ॥
এখন তুমি কি যে চাওনা,
ডাকলে তুমি কথা কওনা
উপরন্তু দেখাও লাঠি টেংঙ্গা ॥
আমার চাষের লাঙ্গল ভেঙ্গে গেছে
ছয় বলদ বেড়ে পড়ছে
আবাদ জমি পতিত পড়ছে
গোলায় ধান ইন্দুরে খাইছে
সুরঙ্গেতে লাইয়া গেল
মালসামাল পড়ে গেল তঙ্গা ॥
বাউলকবি রশিদ বলে
আশীর্বাদ করবেন সকলে
সুনামেতে কুনামেতে
যে রটনা আমার কল্পনায়
কাব্য বুঝে না মুখে বাক্য ফোটে না
তবে বসে হয়ে আছি গোঙ্গা ॥

১৩৩

তোমারি মহিমা বুঝিতে এ সংসারেতে কে আছে এমনি
তোমারি নামে, তোমারি কামে, এসেছি যে সংসার ত্যাগিনী ॥
তোমারি নামে জগৎ বাঁধা, তোমারি নামে শেরে খোদা,
তোমারি লহরে মুক্তা বা জহুরা শুদ্ধা চারি ধনী।
তোমারি দুলাল হাসান হোসেন দিয়াছ কোরবানী
বিনিময়ে তার করিবে উদ্ধার যত পাপী-তাপিনী,
নারীকুলে ফতিমা, সেরা সেরা গুলে গুলে সাহারা
তার প্রেমে হইয়া মাতুয়ারা ভোমরা বেড়ায় গুণগুনি
মেরি কুলে জগৎ জলে, তাতে মোরা রইয়াছি ভুলে,
রশিদ উদ্দিনের সংকটকালে কোলে তুলে নিবেনি ॥

১৩৪

নিষ্কলঙ্ক নিষ্কলঙ্ক রূপে তোমায় দিল পাঠাইয়া
নিষ্কলঙ্ক নিধি বাড়াইতে পরিধি শক্তিময় বিশ্ব সৃজন করিয়া
শক্তি কেন্দ্রপূর্ণ সৃষ্টি করিয়া হইল তুষ্টি, মিলাইয়া দেখ কুষ্টি দিব্যজ্ঞান লইয়া
আশরাফুল মাখলুক রূপে মানুষকে সৃষ্টিয়া
নিজে শক্তি করে মুক্তি গেছে, শক্তি বিলীন হইয়া ॥
শক্তির যা শক্তি ছিল, মানুষকে সঁপিয়া দিল ধরাধামে পাঠাইয়া ॥
ইচ্ছা জ্ঞান দুইটি শক্তি আগে পাছে দিয়া
মহাযুদ্ধে পাঠাইল বিধির কি বিচিত্র ক্রিয়া ॥
এ বিশ্বের যে মহান স্রষ্টা সকল সময় সময় থাকে নিষ্ঠা
সৃষ্টিতত্ত্বের পরাকাষ্ঠা দিয়াছে দেখাইয়া ॥
ইচ্ছাজ্ঞান তোমাকে দিয়া, গেছে তুমি অচল হইয়া
যা করার তো কর তুমি তামাসা দেখছ বইয়া ॥
বাউলকবি রশিদ বলে, যে হইয়াছে সৃষ্টিমূলে
যাহারে যে স্রষ্টা বলে দুরন্ত পাপিয়া ॥
রাজকীয় কর্মচারী তোর ভিতরে দিয়া
আমলা-কামলায় মামলা চালায় কর্তা আছে নীরব হইয়া ॥

১৩৫

মনের কথা লোকের কাছে প্রকাশ করতে লাগে ভয়।
ঘোমটা দিয়ে থাকবো কত জ্বালাপোড়া নাহি সয় ॥
লোকসমাজে ঘুমটা দিয়া আর কতকাল থাকবো রইয়া
দেখতো একা বাহির হইয়া, হয়নি কিছু পরিচয় ॥
কারে জানি দেখিবার, মুসা গেল কোহেতুরে।
পাইল কারে চিনলো কারে দেখলো শুধু অসীময় ॥
মোহাম্মদে (সঃ) সিঁড়ি বাইয়া, ঊর্ধ্বশ্বাসে উঠলো গিয়া
খালি ময়দান পাইল শেষে দেখলো শুধু আমীময় ॥
লইয়া কত ভিক্ষার ঝুলি গেল কত পাহাড়তলী
সইয়া কত গালাগালি ঘুমটা খুলি লেঙ্গটা হয় ॥
যেদিন হতে হইলো লেংটা তাল বেতালে বাজার খেমটা,
উদাম করে দিলে ঘুমটা, লেংটা বিনা কিছুই নয়।
বাউলকবি রশিদ বলে, লাগছে গুলমাল ঘুমটার তালে,
ঘুমটা ছেড়ে লেংটা হলে আর কিছু থাকবে না ভয় ॥

১৩৬

তনের নাও, সাবধানে সন্ধানে মাঝি ধীরে ধীরে বাও
বৈইঠা মার সন্তপনে তোমার ভাঙ্গা নাও ॥
অকূল সমুদ্র পাড়ি ধরছে যখন
ছাড়িল বন্ধুর সঙ্গ করেছে গমন
কঞ্জি বাদাম দিয়া প্রবল বাতাস ভয়
বাদাম তিনি কাঞ্জি টাঙ্গাইয়া লও ॥
দিবারাত্রি চব্বিশ ঘণ্টা ভাত পানি নাহি খাইয়া
একুই হাজার ছয়শত ঘুরান, বৈঠায় মার খেঁছকিটান
যদি পার কমতি কর নাও যদি বাঁচাও ৷
রঞ্জু ছাড়া বৈঠাখানি রহিয়াছে লটকিয়া
কোনদিন জানি কোন বা বানে যায়রে বৈঠা ছুটিয়া
তার কূল পাবে না, তাল পাবে না পড়ে থাকবে নাও ॥
দীন রশিদের নৌকাখানি হইয়া গেছে জীর্ণকায়
হুড়াহুড়ি ঘুরাঘুরি লেগেছে তাহার নায়
এখন বাইছালি ছাড়িয়া বাইছা চলছে যার তার গাও ॥

১৩৭

এই যে দেহভাণ্ড হবে লণ্ডভণ্ড আসিলে প্রবল তুফান
যখন ছুটিবে বাতাস, হবে সর্বনাশ, ভেঙ্গে নিবে পাকা দালান ॥
এই যে শরীরে অতি যতন করে আতর চন্দন আর মাখিতে সাবান
ঘরের উপড়ে মাটি পরিপাটি ভিতরে কাদা রেখেছে পাষাণ,
পাইয়া টাকা-কড়ি দৌড়াও কত গাড়ি, হাতে ছড়ি মুখেতে পান ॥
কানে চুরট-বিড়ি হাতেবান্দা ঘড়ি, কেন করিতেছ এত গোমান
কাঙাল রশিদ উদ্দিন বলে, দেশে মরিবারকালে আঁখি জলে ইবে হারাম
শেষের দিনের গতি নাই সঙ্গের সাথী আঁধার বাতি ঘটবে নিদান ॥

১৩৮

দেশে বাঘ আইল বাঘ আইল বাঘ আইলরে
বুড়া মানুষ খায় না বাঘে জোয়ান পাইলে ধরে ॥
বাঘের রাগ দেখিলে শিকারী ধরে
আওয়াজ করবার আগে বন্দুকের গুলি ছুটাইয়া পড়ে ॥
যখন বাঘ বাহির হয়, সুন্দরবন বন্দরে ॥
পুরুষের গন্ধ পাইলে আইলুম আইলুম ডাকছাড়ে
দরবেশ পির পয়গাম্বরে সেই বাঘিনীর হুংকারে
হইতে স্বর্গীয় দ্রুত মাটিতে গারাইয়া পারে ॥
জমিনে মুখ রাখিয়া চোখ ঘুড়ায় তার পানে
বক্ষস্থলে বিষ রাখিয়া মন্ত্রকে সে আহার করে ॥

***
এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

১৩৯

জীবনের সম্বল করে টলমল কোনদিন নাকি যায় উড়িয়া
রাত্রেতে জীবনের গতি হয় উত্থাপন,
দিবসে সূর্যের তাপে করে বিসর্জন ॥
জীবনের ভিতরে জীবন করে আরোহণ জীবনের আবার হইয়াছে বাহন
ইহাতে কি আছে বেশ-কম কূল পাই না তার ভাবিয়া ॥
জীবনতরীতে জীবন করে বুঝাই কোন দেশেতে চালান করি কিছু বুঝি নাই,
এপার সেপার কোন পারে যাই কে দিবে পথ দেখাইয়া ॥
কাণ্ডারে কি প্রাপ্তরে কোন সুদূরে ঠাই।
স্থাবরে কি অস্থাবরে তুল কেমনে যাই-যাই ভাঙ্গিয়া ॥
বাউলকবি রশিদ বলে, জীবন আমার কি উগ্র কি নিগ্রহ
বুঝিতে বাকি জীবন যাপন ফাঁকি ফাইলাম শুধু ভাবিয়া ॥

১৪০

ও ঘরে গিন্নি-গো, তাড়াতাড়ি কর গো বিদায়,
ফিরে আসিব কিনা, কত দিন যে বয়ে যায় ।
কত খাইলাম, কত শুইলাম, কইলাম কত বায়,
কত রঙ্গের আতর সাবান মাখলাম মাটির গায়।
নিলাম্বরে পিতাম্বরে তব পড়িলাম মনের সাধনায়,
কত না সুরে অম্বরে শুধাইলাম ফুলের গালিচায় ॥
সঙ্গী যারা গেল তারা যার তার বায়,
যাবার বেলায় কথা কয়না ফিরে নাহি চায় ॥
দুইিটি ভ্রাতা গর্ভ সহোদর তারাই আমার হইয়াছে গো পর,
ছাড়িয়া সাবধানে বাড়ির ঘর, কোনবা দেশে যায় ॥
ও আমার সোহাগিনী-অর্ধাঙ্গিনী তোর হাতের ছোঁয়ায়,
তোর বাণীতে, তোর চাউনিতে তাপিতে প্রাণ জুড়ায় ॥
মাতা-পিতার কোল ছাড়িয়া গেছে যে সে দূরে থুইয়া
বাউলকবি রশিদ বলে, জীবন গেল আশায় আশায় ॥

১৪১

মাটির ঢেলা, পচা গলা দেখলাম কত যতন করে,
ভূতের খেলা ভূতের মেলা উলামেলা সদা করে ॥
এদের মন যোগাইতে কোন মতো পারলাম না এই জীবন ভরে,
এই কাঁচা মাটির রঙ্গ ছড়াইতে সঙ্গ সাজিতে সাজলাম কত ওয়ালষ্টারে ॥
কত চশমা ঘড়ি বাহাদুরী বাবুগিরি দেখছি করে,
পঁচা পাঁচলা বিষ্টা মাটি ঘটি বাটি তৈয়ার করে কুম্ভকারে ॥
এ মাটি ভাঙ্গলে পরে অনাদরে রাখে তারে ঘরের বাইরে
যে দিন ভাঙ্গলে পরে অনাদরে রাখে তারে ঘরের বাইরে।
যে দিন ভাঙ্গবে ঘটি কান্নাকাটি লেগে যাবে ঘরে ঘরে ॥
এ সব কিসের কান্দা চোখের ধান্ধা কাঁদবে কি আর দুই দিন পরে ॥

১৪২

এ সংসার সকলি আমার–
কিছু না কিছু সংসার সাগরে হাবুডুবু করে
বুন বাজির ফেরে কেউ কিছু বুঝি না ॥
কাম ক্রোধ লোর্ভ আঁদি আছে পিছে নিরধি
ওরাই বলে আমার আমার, আমার বলে কিছু না ॥
সাংসারসাগর মাঝে নাও বাইয়া যায় সবজনা
কেউ ভাসে কেউ ডুবে ভাসা-ডুবির কারখানা,
সার হইয়াছে আনা জানা এই গুলমাল আর মিটবে না ।
মট মন্দির বালাখানা বান্দিয়াছে বাড়িঘর–
দৈন্য যে তার কারিগরি নিরুদ্দেশী কারিগর ॥
সে যে সুন্দর কিংবা হয় অসুন্দর কাজে কর্মে মিলে না ॥
চিত্রকরে চিত্র আঁকে নিয়া একটা উদ্দেশ্য।
ক্যামেরাতে ফটো তুলে কেমন মজার রহস্য
সে যে সূর্য কিম্বা অসূর্য ভেদ মাইনি তার বুঝি না
এমন কিছু না থাকিলে তার ছায়া পড়ে না ॥
নিঃসঙ্গেতে শব্দ হয় না গাছ বিনে গুটা হয় না।
বাউলকবি রশিদ বলে মনে আছে বেদনা
জনমভরা বাইলাম নৌকা কূলকিনারা পাইলাম না ।

১৪৩

আমারেই ঘরের পাছে কিসের শব্দ শুনা যায়।
কে জানি কোথায় চইল্যা যায় ॥
সখিরে জিগাইয়া দেখ তারে নিবেনি তার নায়,
ঝুম ঝুমা ঝুম বাদ্য বাজে শুনতে পাওয়া যায়।
তুলিয়া মধুর রাগিণী কি সুন্দর গান গায় ॥
সখিরে শিশুকালে দিল বিয়া নির্দয় বাপ-মায়
খাইবার কালে ভাত মিলে না সুখ পাই না নিদ্রায় ॥
সখিরে ভাঙ্গা ঘরে মশা ধরে মশুর কে টাঙ্গায়,
ভাঙ্গা লাঠি ভিজা মাটি উরশে কামরায় ॥
সখিরে কবি রশিদ উদ্দিন বলে, আমার সহ্য হয় না গায়ে
আর কতদিন থাকব শুইয়া ভাঙ্গা বিছানায় ॥

১৪৪

ভূতের খেলা ভূতের মেলা যা দেখি সব ভূতের চেলা
ভূত প্রেতের উলা-মেলা বাজে কাজে সাজে টং ॥
ভূতের ঘরে প্রেমের জন্ম নাহিবা তার জন্মধর্ম
তারা নিত্য নৈমিত্তিক কর্ম করে, পথে ঘাটে সাজে সং ॥
ভূতে কেউর কথা মানে না মিষ্টি মণ্ডা খাইতে চায় না
তেঁতুল গাছের আটছালায় করে কত ছং বঙ ॥
ভৌতিক দেহে যত সৃষ্টি সব দেখি ভূতের গোষ্ঠী
মিলাইয়া দেখ কুষ্টি আরো কয়জন আছে গং ॥
ভূতের বাসায় নাট্যশালা জেতা পুরান শশ্মানখানা
তেতাল চৌতালা বেলা তালবেলে গাছে ছং ॥
বাউলকবি রশিদ বলে পড়িয়া এই ভূতের দলে
হারাইয়াছি লাভে মূলে সঙ্গীগণে ধরছি ভঙ ॥

১৪৫

গাড়ি টানছেরে ইঞ্জিনে।
দুইটি দিলে জমে ময়লা কার সন্ধানে ॥
মাঝাঘষা করে তারে অতিশয় যতনে
আবর্জনা কি যন্ত্রণা সাফ করে প্রতিদিন বিয়ানে ॥
দুইটি চাকা, দুইিট পাখা, হাওয়া পানি দুই মাখা
আগুনে মারিলে ধাক্কা ড্রাইবার কি আর মানে ॥
আগুন পানি পাওয়া গুণে চলে রাত দিনে।
বাতাসেরও আগে গতি নাগাল পায়না উরোপ্লেইনে ॥

***

এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

১৪৬

কোন ঘাটের খেয়ানি তুমি কোথা চাইলা যাও
মনমাঝি রে একবার এসে ঘাটে নাও নাগাও ॥
নিত্য নিত্য আইস যাও, ডাকলে নাহি চাও
মাঝিরে, ঘরের কোনার বউ হইয়াছি ধরি তোমার পাও
নিদয় হইয়াছে বুঝি আমার বাপ-মায় ॥
মাঝিরে যে অবধি আসলাম নাইয়র মুখের পাই না রাও
জানি না জানি না বোধ হয় স্বামী-সেবার ভাও ॥
মাঝি রে রশিদ উদ্দিন কহে মাঝি দেশে যদি যাও,
নাইয়র নিতে কইয়ো যাইয়া নইলে মাথা খাও ৷

১৪৭

মানুষ সে জনা মানুষ হও, ভিতর কর পরিষ্কার
তুমি মানুষ আমিও মানুষ আরো মানুষ দেখতে যাও ॥
তবে কেন মানুষ হইয়া ধরবে মানুষের পাও
তোমার মন মাঝি বাধ্য করতে আপন দেশে চইলা যাও ৷
মানুষে মানুষে পিরিত পশুর পিরিত মানে না
মানুষ চিনে করলে পিরিত পশুর পিরিত মানে না
মানুষ চিনে করলে পিরিত এই পিরিত ভাঙ্গে না।
মানুষ রাস্তাঘাটে পাওয়া যায় না আবর্জনা খোঁজে নাও ॥
মোহ যেদিন ভেঙ্গে যাবে দেখবি লীলা দোষবি কারে
মনুষত্ব প্রকশবে উত্তম কি বিকার
সংসার সবি হবে অসার আমি আমার ফুটবে রাও ॥
বাউলকবি রশিদ বলে–মানুষ পাই না খুঁজিয়া
চর্মাকৃতি মানুষ মিলে পশুর প্রকৃতি হইয়া
জনমভরে বইঠা বাইলাম ঘাটেতে বাধিয়া নাও ॥

১৪৮

আরে ও সোনার বুলবুলি
শোনাই তোরে মধুর কথা, কত কষ্টে পালি।
বেইমানি করিলেরে তুই ছাড়লে জাতের বুলি ॥
লজ্জা ছেড়ে শয্যা পরে করতাম গালাগালি
আমারে তুই ঘুম পাতাইয়া কোথায় বা লুকালি ॥
কাকের বাসায় কোকিল ছাগ যেদিন হতে এলি
সেদিন হইতে বাইরে যাইতে করছ ফালাফালি ॥
বাউলকবি রশিদ বলে–পাখিটা জঙ্গলী
ছুটিলে ধরা দিবে না ধরবে না আর বুলি ॥

১৪৯

যায় গো ছোট দেওর
কেন বা জল ভরতে আইস সরোবর ॥
জলে ঘাটে আছাড় খাইয়া ভাঙ্গল নাকের বেসর ॥
মুই অভাগী জলে যাইতে চালের ছাপর ঠেকলো সাথে
উপায় কি গো পাও টানিয়া।
রাজপথে শিঘ্ন আমরে ধর গো ধর ॥
যখন গেলাম নদীর কুলে রূপ দেখিয়া নয়ন ভুলে
শ্যামল সুন্দর পদ্ম যেমন ভেসে ফিরে জলেরি উপর ॥

***

এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

১৫০

শক্তিতে বিদ্যুৎ দেখতে পাই
কাকলি গায় কোকিলায়
শূন্যগর্ভে ফুটলো আলো।
আকাশেতে শোভা পায় ॥
জিল জসে করিয়া জয়
ফুটলো আলো এই নিরালয়
নিশি মায়ে এই চন্দ্র সূর্যের
যোগে চলে ইশারায় ॥
সংক্ষেপে কিত্তি করে
নিমিষে ব্রহ্ম-ঘোরে
ষড়রিতে প্রকাশিতে
জগৎ জুড়ে ফুল ফোঁটায় ॥
থাকিলে একজন সাকার
কেমনে হইল প্রচার
কিট পতঙ্গ ডিম্বের থাকায়
সকলি একজনকে চায় ॥
শূন্যের পিটে লক্ষ কোটি
জানতো সে মোটামুটি,
থাকিলে একজন খাঁটি
কার কাছতে কে সুধায় ॥
শূন্যের ভিতর আছে দৃশ্য
ফুটিয়া আছে আদর্শ
ইহাতে কেন অবশ্য
রহমতে বুঝা যায় ॥

***
এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

১৫১

অজানা এক পথে আমি করেছি গমন,
জানি না শুনি না চিনি না দেশের কী-বা আচরণ ॥
কে-বা আছে পথের পথিক বলছে কি কেউ সার-সঠিক,
এদিক ওদিক যাব কোনদিক কিবা আছে নিদর্শন ॥
খুদে নোতার ডাক পড়েছে মন কি আর ঘরে আছে,
প্রাণ গিয়াছে ডাকের পাছে ডাকের আকর্ষণ ॥
আমারি এই গমন পথে বাধা বিঘ্ন শতে শতে,
স্বাধীনতার পর স্বার্থে গতি রুদ্ধে কি কারণ?
আপন দেশে যেদিন হইতে ছেড়ে আইলাম এদেশেতে,
সেইদনি হইতে ধরছে ভূতে ছাড়িয়া যায় না কখন ॥
রশিদ উদ্দিন যাবার কালে ডাইনে বামে দলে দলে,
যাইও না যাইও না বলে ওরাই আমার হয় দুশমন ॥
সারিষা আর তিল পড়ায় ওজাগণে ভূত ছাড়ায়,
এই সব দিলে ভূতেরই গায় আনন্দে নাচে তখন ॥

১৫২

বিচার নাই হেড পোস্টে বয়
তারা দুইটি ভাই।
এক রাজ্যের দুইটি রাজা দুই পক্ষে সিপাই
তাদের ঝগড়া বিনে আর কিছুই নাই,
অবিশ্রান্ত সব সময় ॥
এই রাজ্যের ভিতরে দস্যু আছে ছয়
তাদের আক্রমণে মনে লাগে ভয়
তাদের সঙ্গে করিতে জয়, পারিল কেউ এ বিশ্বময় ॥
এই দেহের যত্ন নিতে কতই না করিলাম
স্নো পাউডার আতর সাবান কতই যে মাখিলাম
কত আরিষ্ট বলিষ্ঠ খাইলাম
তবু দিনে দিনে ক্ষয় ॥
সেনা সৈন্য আছে যত আমার এই শহরে
দুর্বলতা দেখা দিল বেলা দ্বিপ্রহরে
আমার দশটা যাবে ছার খায়ে।
প্রাণেতে হইল সংশয় ॥
বাউলকবি রশিদ বলে আর ভরসা নাই
আপন বলতে যে আছে আর কার কাছে দাঁড়াই।
এই রাজ্যে আর আমার বাগা নাই হইয়া গেলাম নিরাশ্রয় ॥

১৫৩

এপার থেকে জানতে গিয়ে, সেই পারের মানুষের খবর
হয়ে গেলাম সর্বস্বন্ত, ভাত মেলে না, ছেঁড়া কাপড় ॥
গেল যারা গঙ্গায় ভেসে, কয় না কথা ফিরে এসে,
সুখের না হয় দুখের দেশে, একা একাই বাঁধছে ঘর ॥
আছেন গুরু সেই পারেতে, প্রাণী যেথায় পারে না যেতে,
ঘুরবে বলে দিনে রাতে, বন্ধ রাখছে ডিমের ভিতর ॥
ডিম্ব যেদিন ফুটে যাবে, সেই দিন তার নাগাল পাবে,
মন মজিবে প্রেমের ভাবে, দেখবে সেরূপ নিরন্তর ॥

১৫৪

কামপাহাড়ে ধাক্কা লেগে মণিলাল পাথর ছুঁয়ায় ॥
উপরতলার রত্ন মণি সিন্ধুরূপে ভেসে যায় ॥
মণিপুরের পেলে সন্ধান, প্রেমিকের কপালে প্রমাণ
মাসে একদিন করে সে দান, শুধু সৃষ্টি রক্ষার দায় ॥
সোনাতে সোহাগ দিলে, কঠিন সোনা যেমনি গলে
লোহাতে পরশ মিলে, সোনার বর্ণ তেমনি পায় ॥
পরশপাথর রাখ তাজা, চাইলে তোমারা ভবের মজা
আমানতি খোদার বস্তু, হিসাব যেন পাওয়া যায় ॥

***
এই গানটি অসমাপ্ত, বাকি অংশ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঠোদ্ধার করা যায়নি।

১৫৫

শুনবে কে রে আয়না শীঘ্র করে
রঙমহল কাঁচারি ঘরে হয়রে কলের গান ॥
আশা ভূপালি, ঠুংরী আর টেস কাওয়ালি।
হিন্দুস্থানি নেপালি, অনেক জাতি গান ॥
সারঙ্গ ভৈরবীতে, মধ্যাহ্ন প্রভাতে,
বন্ধুজনার কাছে গায় সুললিত তান ॥
সুহিনী সুরটে, গাহিতেছে নিষ্কপটে
পিন ছাড়া রেকটে, করিয়া সন্ধান ॥
যদ পুস্ত আড়া, পুত্র কন্যা দারা,
বেদ বেদী ছাড়া, আর মধ্য মান ॥
দেখিলে সেই গানের কল, দূরে যাবে বুদ্ধি বল
ভাটিয়ালি নদীর জল, ধরবে উজান ॥
আদ্বা আর চৌতালে, মন্দা মন্দা হিল্লোলে,
ঢেউয়ের তালে নদীর জলে, ছুটেছে তুফান ॥
একটি কলের চৌদ্দ তালা, মাইজভাণ্ডারে যাত্রার পালা,
তানসেন আর বয়জুবালা, উভয়ে সমান ॥
দমকলে চাবি দিলে, শব্দ উঠে সুহং বলে
সুহংগে অহং মিশিলে ঘটিবে নিদান ॥
ছত্রিশ রাগিণী, গাহিতেছে দিনরজনী
তিন তারে উঠে ধ্বনি খোলাসা বয়ান ॥
রশিদ উদ্দির মনে, উঠে রাত্রদিনে
মজিয়া তার কলের গানে, মারছে একটি টান ॥

১৫৬

হাতে নিয়া গুড্ডির নাটাই, খেলিতেছে আলেক সাঁই,
দেখবে যদি চল যাই, মাইজভাণ্ডারে ॥
অনুমানে বুঝতে পারি, প্রেমেতে বানাইয়া ঘুড়ি
হাতে নিয়া আপন জুরি নজর করে ॥
চালাইয়া হাওয়ার পথে, চেয়ে রইল এক জ্যোতে
ক্ষমা কি আর আছে তাতে, হাওয়াতে ঘুরে ॥
তিন রকম বাতাসে, উড়ছে গুডি আকাশে।
কখনো বা মন্দা বেশে কখনো জোরে।
কোন সময় অতি হ্রাস, এই ভাবেতে বার মাস
বহিতেছে নিঃশ্বাস, মানবের ঘরে ॥
প্রভাতে মলয় রাশি, শান্তির দ্বারা প্রকাশি
মধ্যাহ্নে কি চঞ্চল বেশে সময় দুপুরে।
সন্ধায় সমীরণে, চেয়ে দেখো বায়ু কোণে
উড়া গুড্ডি পবন হইতে ভূমিতে পড়ে ॥
বেলা হইলে অবসান, ডুরি ধরে মারবে টান।
কর্মক্ষেত্র উপাদান হাওয়াতে উড়ে।
রশিদ উদ্দিন কয় কথা, বার আঙ্গুল গুড্ডির সূতা
টানিতেছে বিধাতা ধীরে ধীরে ॥

১৫৭

খুঁজলে না কেন তারে।
খুঁজবি বলে দিন ফুরাইলে খুঁজলে দেখা দিতো তোরে ॥
হাওয়াতে লাগাইয়া ভুরি উড়াইয়াছে রঙ্গিন ঘুড়ি।
বসিয়া মথুরাপুরি টানাটানি করে।
গুড্ডির ভিতর নামটি লিখা আছে দুই অক্ষরে
পইড়া গেলে দেয় উড়াইয়া দেখ রে বির্যক পাহাড়ে ॥
সব রাস্তা করিয়া বন্ধ বস গিয়া গোয়ালন্দ
চিত্তরঞ্জন প্রেমানন্দ আসা যাওয়া করে।
একবার যদি দেখা পাও বেঁধে রেখো তারে ॥
দিয়ো না কষ্ট, রাইখ তুষ্ট বাইন্ধা রাইখো ভক্তির ডুরে ॥
সহজভাবে পাইবা তারে যাওগা তোরা শান্তিপুরে
অশান্তি করিলে দূরে মিলবে এক বছরে
তিনশত ষাইট দিনে বছর হিসাব করে
আছে একদিন বড়ই কঠিন নিজ ছুরতে দেখা করে ॥
শরিয়ত কর খুদ ভরসা রাসুলুল্লার চরণ আশা
নামাজ রোজা করলে নিশা তরবে গিয়া আখেরে
মারফতে কয় মুশকিল কুশা-ব্যক্ত এ সংসারে।
আপনি খোদা নিজের মুখে মা বলিয়া ডাকছে যারে ॥
রশিদ উদ্দিন মনের ব্যথা বলতে গেলে গুমর কথা
শইরুত উলা ভাঙ্গতে মাথা চায় যে আমারে
লোকনিন্দা কূল-কলঙ্ক, সব রাইখাছি দূরে।
আছি বাঁধা, হইয়া গাধা, পড়িয়া এই ঘোর আঁধারে ॥

১৫৮

চিরদিন কি বাঁচে মানুষ চিরদিন কি বাঁচে?
কইরো না কেউ দেহার গৈরব এই দেহার কী মূল্য আছে ৷
পাছের কথা দেখ খুঁজে, পয়দা হইলে রজঃবীজে,
এখন গেলে মস্ত সেজে সেদিন গেল পাছে।
বাল্য যৌবন পৌর বৃদ্ধ এই চার কালাও প্রায় গেছে,
এখন বল কোথায় যাবে শমন পাছে ফিরিতেছে ।
করিয়া দেহের গুমান মাখলে কেউ আতর-সাবান।
বিলাসে বিলাইলে পরাণ রমণীদের কাছে
মনে কি পড়ে না তোমার তোর একদিন আছে?
রাজা-প্রজা-ফকির-দরবেশ যাইতে হবে মাটির নিচে ॥
ছাড়িয়া মনের অহংকার তাড়াতাড়ি হও গা পার
সামনে আছে ঘোর অন্ধকার বেলা ডুবে গেছে,
একা একা যেতে হবে বন্ধুবান্ধব মিছে,
ঘোর বিপদে ঠেকবে পরে ভূতপিশাচের ভয় রইয়াছে ।
আছে যত রং-তামাসা ছেড়ে দিয়ে বাজে নেশা।
মুর্শিদের চরণ ভরসা যেজন করেছে
মরণযন্ত্রণা হতে মুক্তি সে পেয়েছে ।
রশিদ বলে কল্লোল কয়দিন জানি বাকি আছে ৷

১৫৯

(আমার) পয়লা গাছের পয়লা ফুল
ফাল্গুনী লক্ষত্র যোগে গিয়া তুল।
সাবধান গাছে উঠ না, গাছে ঝাঁকার দিও না
অনুরাগের কুটা লাগাও, ঠিক রাখিয়া গাছের মূল ॥
ফুল ফুটে দুইরকম, তারে কি বেশ-কম,
কইরে তোরা মন-ভ্রম খবরদার বাধাস না গোল ॥
ফুলের দুই ছিফাত, ফুলে শরীয়ত-মারফত।
এক ছিফাত তার আলেমে পাইল, আরেকটা আওলিয়াকুল ॥
ফুলে রস পড়ে তিন ফোঁটা, তাতে হরফ হয় তিনটা,
তিন হরফে দিয়ে গাট্টা ইছমে-আজম বান্ধ ফুল ॥
ভেবে বলে রশিদ উদ্দিন সে ফুল তোরা তুলবে যদি
(গিয়ে) গাছের তলে খুব নিরলে ডালে ধরে পাড় ঝুল ॥

১৬০

মহব্বতে বানাইল, আল্লাহ কাদের
গনিরে ঐ মানব দেহখানি।
দইজনে করিয়া খেলা, বানাইল মাটির পুতলা
এই ঘরেতে উলামেলা খোদায়, করে দিনরজনীরে ॥
আপনা দোস্তের খাতিরে; মানবদেহ পয়দা করে
পাঠাইল ভবের বাজারে পুরুষ আর রমণীরে ॥
ফকির দরবেশ নবী অলী, এই ঘরে ফুটাইতেছে কলি
এই ঘরেতে পুড়ে ছালি, কত ধনী মানিরে ॥
দেখ তোমার বস্ত্র তুলি, তিন নামের হয় তিনটি বুলি
দুই শব্দতে আল্লাহ-নবী, মুইধ্যের শব্দ তুমিরে ॥
আট মুরীচৌদ্দ কামান, বার বুরুজ তাতে প্রমাণ
বারমাসে বারটি চান, বুরুজে ঘুরানি-রে ॥
মাথা হইতে পা পর্যন্ত, এই হইল বুরুজের অন্ত।
রশিদে কয় দিলাম কান্ত, বুজবেন থাকলে জ্ঞানীরে ॥

১৬১

বছরেতে ত্রিশদিনে ফুল ফুটে গুপ্তবাগানে
সাধুজনে তুলে আনে অনুরাগের ছুঁয়াতে।
প্রেমিক যেজন খেলিতেছে বসিয়া সেই ঘাটে
পঞ্চরসে মাখা যেজন শুদ্ধ মানুষ তারাই বটে ॥
প্রথম মাসে প্রথম দিনে
ফুলের রসটা যে খায় চিনে–
জন্ম-মৃত্যুর এই ভুবনে
হইবে না তার মোটে ॥
বাউলকবি রশিদ উদ্দিন যে ফুল হইয়া ভূতের বেগার খাটে
বোঝাতে পাবে সেদিন গিয়া পুলছেরাতের ঘাটে ॥

১৬২

পুরুষ আর রমণীর চারি জাতি জানি
হস্তিনী, পদ্মিনী, চিত্রানী আর শঙ্খিনী ॥
কী বলিব কী বলিব পদ্মিনী নারী লক্ষণ
যারে দেখলে ভুলিয়া যায় সাধু-সন্ন্যাসীর মন।
হাঁটে নারী হংসের মতন, কাঁধে তার মাথার বেণী ॥
চিত্রানী নারী এই রূপ বটে, কপালে আর গালেতে।
দেখতে সুন্দর অতি, তিল তার মুখেতে নয়ন বাঁকা,
ভঙ্গি আঁকা, বাঁকা তার চাহনি ॥
কী বলিব কী বলিব হস্তিনী নারীর কথা
কপাল উঁচু, চক্ষু গোল তার, ঘারখানি মোটা
নাপাকেতে থাকে সদা, হাঁটতে পায়ের শব্দ শুনি ॥
শঙ্খিনী নারী এই রূপ বটে, থাকে সদা বেপর্দায়
ভিনপুরুষ দেখলে নারী, ঘোমটা টেনে আড়ে আড়ে চায়।
বলেছেন বাউলকবি রশিদ উদ্দিন নারী লইবেন দেখে-শুনি ॥

অধ্যায় ১ / ৩

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন