সুমনকুমার দাশ
ঊনবিংশ শতাব্দীর তাত্ত্বিক-সাধক পাগলা কানাই। ঝিনাইদহ জেলায় জন্মগ্রহণকারী এ সাধকের পরিচিতির গণ্ডি তাঁর জীবদ্দশাতেই নিজের এলাকা ছাড়িয়ে আশপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর সমকালে নবীন-প্রবীণ সাধকদেরও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল তাঁর তত্ত্বপ্রধান গানের পঙ্ক্তি। যথার্থ সাধকের গানের বিশেষত্বই হচ্ছে রূপকের আশ্রয়ে নিগূঢ় তত্ত্বের উপস্থাপন। সেক্ষেত্রে পাগলা কানাই অর্জন করেছিলেন বিশিষ্টতা। তাঁর মৃত্যুর (১৮৮৯) এত-এত বছর পরও পাগলা কানাইয়ের রচিত তত্ত্ববহুল গানের সমকক্ষতা খুব সংখ্যক সাধকই অর্জন করতে পেরেছেন।
পাগলা কানাই তাৎক্ষণিক গান রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন বলে গবেষকদের অভিমত। যে-ব্যক্তি তাৎক্ষণিক রচনায় পটু ছিলেন, তাঁর গান অতিমাত্রায় তত্ত্বাশ্রয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়াই যুক্তিসঙ্গত। কারণ তাৎক্ষণিক রচনায় অধিকমাত্রায় তত্ত্বের শৈল্পিক উপস্থাপনা একটু কঠিনই বটে! তবে পাগলা কানাইয়ের গান-পাঠে মোটেই তেমনটি মনে হয় না। বরং এ ধারণাই পাকাপোক্ত হয় যে, তিনি অনেক ভেবে-চিন্তে তত্ত্বপ্রধান গান রচনা করেছেন।
পাগলা কানাইয়ের গানের বিশ্লেষকদের ধারণা, মূলত বাউল- সাধনার তাত্ত্বিক ও গুহ্য খুঁটিনাটি বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর বলিষ্ঠ ধারণা থাকার সুবাদে তাৎক্ষণিকভাবেও তিনি তত্ত্বাশ্রয়ী গান রচনায় দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন। কানাই একসময় সুফি-মতবাদে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। সে সময়টাতে ভাব-সাধনায় ব্যাপক গভীরতা অর্জন করেছিলেন। সেসব জ্ঞানার্জন পরবর্তীতে তিনি বাউল-সাধনার সঙ্গেও সন্নিবেশিত করেন। এ কারণেই তাঁর গানে ভাবাশ্রয়ী দার্শনিক তত্ত্ব প্রচণ্ডভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
বাউল গান রচনার পাশাপাশি একজন কবিয়াল-গায়ক হিসেবে তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। হাজারো মানুষ সামনে রেখে গানের আসরে দাঁড়িয়ে রাতের পর রাত কাটিয়ে দিয়েছেন পাগলা কানাই। দর্শক-শ্রোতারা বুঁদ হয়ে শুনেছেন তাঁর গান। ‘আত্মগোপন’ করা বাউলদের সাধনার প্রাসঙ্গিক-অনুষঙ্গ হলেও পাগলা কানাই প্রকাশ্য জীবনযাপনে সে রীতিনীতি ধারণ করেননি। বরং মানুষের সান্নিধ্যে থাকাই ছিল তাঁর পছন্দ। শিষ্যদের নিয়ে দলবেঁধে এ গ্রাম-ও গ্রামে বায়না রেখে গান গাইতে বেরোতেন। গান গেয়ে টাকা উপার্জন করে সংসার চালাতেন। পুরোদস্তর একজন সংসারী মানুষ ছিলেন।
অপরাপর বাউলদের মতো পাগলা কানাই সংসার-বিবাগী না- হয়েও বাউলসাধনা চালিয়েছেন। এমনকি সংসারে বসবাস করেও ‘আত্মগোপন’ করে ‘আত্মানুসন্ধান’ করেছেন। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ‘কবিয়াল’ পেশা ধারণ করেছিলেন, কিন্তু সেটা ছিল তাঁর বাহ্যিক দিক। এর বাইরে তাঁর ভেতরের সত্তা পুরোটাই নিবেদিত ছিল বাউলসাধনায় এবং ‘মনের মানুষ’-এর সন্ধান-লাভের প্রচেষ্টায়।
বাঙালির চিরায়ত মানস-ঐতিহ্য অনেকটা ভাবমুখী। লালন সাঁই সেই ভাবমুখী-সত্তাকে অনেকটা মানুষ-বন্দনা ও বস্তুবাদী চেতনার আড়ালে নতুনরূপে বাউল-সাধনায় উপস্থাপন করেছিলেন। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে পরবর্তী কালের গ্রামীণ বাউলসাধকদের ওপরও। লালন সাঁই সেসব সাধকদের প্রতিভূ হলেও পাগলা কানাইয়ের অবদানের মূল্যকেও কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।
পাগলা কানাইয়ের রচিত গানে দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক চিন্তার সংমিশ্রণসহ মানুষ-বন্দনার বিবিধ প্রসঙ্গও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুষ্ট হয়েছে। এ চেতনার কারণেই বোধহয় তিনি রামপ্রসাদের বিখ্যাত একটি গানের মতোই উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন—’মানুষ জমিন ভাই/যতন করা চাই/যতন না করলে ফসল মেলে না’। এ পঙ্ক্তিগুলোতে তাঁর চিন্তার দূরদর্শিতা, প্রাজ্ঞতা এবং জ্ঞানমুখী চেতনার বিষয়টিই উপলব্ধি করা যায়। রামপ্রসাদ তাঁরও আগে একইভাবে বলেছিলেন—’এমন মানব জমিন রইল পতিত/আবাদ করলে ফলতো সোনা’। এটি যেন ঐতিহ্য- পরম্পরারই জাজ্বল্যমান উদাহরণ।
বাউল গানে সাধকেরা গাঁথুনির পরিপক্কতা এবং পরিকল্পিত শব্দচয়ন করে থাকেন। সাধনার গোপনীয় নানা তথ্য এসব গানের পঙক্তিতে চোরাবালির মতো নিরন্তর ফাঁদ পেতে থাকে। সাধারণ অদীক্ষিত ব্যক্তিরা এসব ফাঁদে না-পড়লেও তাঁরা গানের পারিপাট্যে বিমুগ্ধ হন। তবে চোরাবালির এ ফাঁদের গূঢ়-রহস্য ভক্ত-শিষ্যদের অবশ্যই উদ্ঘাটন করা সাধনায় শাস্ত্রসম্মত বিধি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের কাছে এসব গানের নান্দনিক আদল বিমুগ্ধতা ছড়ালেও একমাত্র রসজ্ঞ সাধকেরা তার ভেদ অনুসন্ধান করতে পারেন। আর এসব রসজ্ঞদের জন্যই পাগলা কানাই রচনা করেছেন তাঁর তত্ত্বাশ্রয়ী অসংখ্য গান
পাগলা কানাইয়ের গান রচনার অন্যতম বিষয়বস্তু ছিল হিন্দু- মুসলমান সম্প্রদায়ের নানা পুরাণ ও আখ্যাননির্ভর। এর বাইরে আসর বন্দনা, সৃষ্টিতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, কামতত্ত্ব, গুরু-শিষ্য বিষয়ক গান, বিচ্ছেদসহ সমকালীন নানা ঘটনা নিয়ে লেখা গানও রয়েছে। সৃষ্টি ও জীবন সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এসব গানে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
পাগলা কানাই কেবল গান রচনাই করেননি বরং তিনি তাঁর প্রতিটি গানেই সুরারোপ করে গিয়েছিলেন। তাঁর বিচিত্রধর্মী গানের পক্তির মতোই সুরগুলোও প্রাণবন্ত ও অভিনব। তাঁর দেওয়া সুর সে-সময়ে ‘পাগলা কানাই সুর’ হিসেবে প্রচলিত ছিল। এ বিষয়টি সংগ্রাহক দুর্গাদাস লাহিড়ী তাঁর সম্পাদিত বাঙালির গান গ্রন্থেও উল্লেখ করেছিলেন।
২
বাউলসাধনায় ‘নিগূঢ়তত্ত্ব’ সম্পর্কে প্রচ্ছন্ন ধারণা না-থাকলে সফলতা অর্জন সম্ভব নয়। গুরু নির্দেশিত তত্ত্ব-নির্ভর পথ ভুলে বেপথে চললে সাধনার প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না। তাই পাগলা কানাইয়ের সাবধাণী উচ্চারণ : ‘পাখি নিগূঢ়তত্ত্ব গেছে ভুলে/বন্দি রইল মায়াজালে/আমার খাঁচার ভিতর’।
‘মায়াজালে’ বন্দি হওয়ার কোনো সুযোগ বাউলসাধনায় নেই। এর ফলে জাগতিক ‘ভববন্ধন’ থেকে সাধকদের বিরত থাকতে হয়। ‘ভববন্ধন’ থেকে মুক্ত থাকতে চাইলে ‘জন্মবীজ’ কোনোভাবেই নারীর মধ্যে দেওয়া যাবে না। এজন্য সাধককে ‘অটল’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পূর্বসূরিরা। ‘অটল’ থাকতে হলে কোনোভাবেই মনে ‘কামভাব’-কে স্থান দেওয়া যাবে না। ‘কামভাব’-কে দূরে রাখতে হলে কঠোর এবং নির্মোহ সাধনার চেষ্টা জীবনভর করে যেতে হয়।
একজন সাধকের কঠোর সাধনায় পথ-প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকেন তাঁর সাধনগুরু। তিনিই সঠিক পথে পরিচালিত করেন। তাই তাঁর নির্দেশিত-বাণী ‘বেদবাক্য’ হিসেবে সাধনসংক্রান্ত রীতিনীতিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পাগলা কানাইও এ-বিষয়টি ধারণ করে একাধিক গান রচনা করেছেন। এসব গান ‘রসজ্ঞ সাধক’ হতে ইচ্ছুক উত্তরসূরি ভক্ত-অনুসারীদের ‘ভববন্ধনমুক্ত’ জীবনযাপনের পথ দেখিয়ে এসেছে যুগের পর যুগ ধরে।
‘আমি সাধন ভজন করি কেমন করে?’—শিষ্যের এ-রকম প্রশ্নের জবাবে পাগলা কানাইয়ের উত্তর : ‘কাম ক্রোধ লোভ মোহ মায়া/ও যার অন্তরেতে নাই/তারই হচ্ছে সাধন ভজন/এই অধীনের শক্তি নাই’। গানের পঙ্ক্তিতে ‘এই অধীন’ শব্দবন্দটি পাগলা কানাই নিজেকে উদ্দেশ্য করে বললেও এটি মূলত একটি রূপকধর্মী-উপমা। আসলে ‘এই অধীন’ শব্দটি সাধনভজনহীন ব্যক্তিকেই বোঝায়। তাই সাধনভজনহীন ব্যক্তির উচিত শীঘ্রই গুরু/মুর্শিদের সাহায্য নিয়ে সাধনায় উতরানো। এ-বিষয়টি পাগলা কানাই নিম্নোক্ত গানে এভাবেই উপস্থাপন করেছেন :
ওরে মনের দুখ বলবো কারে শোনো ভাই সকল,
আমি হয়েছি উলাই পাগল।
ছয় জনা আমার দেহের মদ্দি করে গণ্ডগোল,
আমার আমি ভাই চিনলাম না রে,
আমি ভুলেছি সেই গুরুর বোল,
লোকে বলে হয়েছিস পাগল,
আমি কেমন করে যাব ভবপারে
আমার পারের নাই সম্বল ॥
সেই পারের ঘাটে দিচ্ছে খেয়া গুরু কর্ণধার
সে যে ধরে না পয়সারই ধার, রসিকজনে পাইলে পরে অমনি করে পার
যদি প্রেম-রসিক হইতে পারো,
আগে বান্দো রে সেই প্রেমের ধার,
গুরুর চরণ করো রে নেহার,
ও সেদিন গুরু হবে ভবতরি ভাই,
শিষ্য হবে কর্ণধার ॥
পাগলা কানাই বলে শোনো রে কোরবান কই তোরে,
তুই যাবি যদি ভবপারে
গুরুর চরণ সম্বল রেখে চড়ো ইস্টিমারে,
সে যে অনায়াসে পার করে নিবে,
গুরুর ঐ চরণের জোরে-
পয়সা কড়ি লাগবে না পারে সেদিন চরণ টিকিট দেখাইলে ভাই
ওমনি দিবে ছাড়ে ॥
এমনিভাবে পাগলা কানাই অসংখ্য গানে গুরু ভজনার নির্দেশনাসূচক গান রচনা করেছেন। গুরুর মাধ্যমেই ‘পরমতত্ত্ব’-এর অর্থ উদ্ঘাটনের পাশাপাশি সঙ্গমকালে শ্বাস-প্রশ্বাস আয়ত্তে এনে বস্তু নিয়ন্ত্রণ’-এর প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকার কথাও বলেছেন। তবে সবার আগে ‘কামকুম্ভীর’ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। এটিকেই গুরুত্ব দিয়ে তিনি ‘সাঁতার না-জেনে’ ‘কামসাগর’-এ না-যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
পাগলা কানাইয়ের অভিমত, কামসাগরের ‘ঘাটে’ নামার আগে গুরু ভজনা করতে হবে। সেই গুরু অটল সাধনায় শিষ্যকে প্ৰস্তুত করলেই কেবল ‘ঘাটে’ নামা যাবে। তাহলেই ‘কামকুম্ভীর’ শত চেষ্টা করেও সাধনপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারবে না। কানাই তাই বলেছেন—’ঘাটে নামলে মরা মানুষ, কুম্ভীর হয় বেহুঁশ/[…]/তাজা দেখলে ধরে খায় মরা দেখলে দৌড়ে পালায়’। এই ‘মরা মানুষ’ বলতে ‘সাধক ব্যক্তি’-কে বোঝানো হয়েছে।
‘সাধক ব্যক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বশর্তই হচ্ছে ছয় রিপুকে বশে নিয়ে আসা। মানববিধ্বংসী এসব রিপুকে সংহার করতে না-পারলে মানুষ মুক্তির সন্ধান পাবে না। ছয় রিপু যে কেবল নিজের ইচ্ছায়ই মনের মধ্যে জাগ্রত হয় তাও কিন্তু নয়। মনের অজ্ঞাতসারেও এসব রিপু সাধকের চারিত্রিক ও নৈতিক দৃঢ়তাকে ভেঙেচুরে দিতে পারে। তাই সর্বদা ষড়রিপু থেকে মুক্ত থাকার জন্য সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয়।
পাগলা কানাই ‘ষড়রিপু’ থেকে দূরে থাকার জন্য মুর্শিদ ভজনার প্রতি গুরাত্বারোপ করেছেন। কেবল মুর্শিদই পারেন জাগতিক দুঃখ- কষ্ট-জ্বরা-ব্যাধি থেকে সরিয়ে রাখতে। মুর্শিদ-প্রদত্ত বাণী হৃদয়ে ধারণ করে পথ চললে ‘ভবপার’-এ যাওয়া সম্ভব। এ বিষয়টিই পাগলা কানাই উপস্থাপন করেছেন এভাবে— ‘ভবপারে যাবি রে অবুধ মন/ও আমার মন রে রসনা/দিন থাকতে মুর্শিদ ধরে সদা ভজন করলে না’।
পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে ‘মায়ার বশে’ মজে থাকলে চলবে না। কারণ কখন যে ‘পিঞ্জিরা আঁধার করে প্রাণপাখি যাবে ছেড়ে তার ঠিকঠিকানা নেই। আর ‘প্রাণপাখি’ চলে গেলে ‘ভবের কামাই ভবে থুয়ে খালি হাতে যেতে হবে’। এ উপলব্ধি থেকেই পাগলা কানাই মনে করেন—পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে অবহেলায় দিন কাটানোর সুযোগ নেই। কোনো ধরনের মায়ার বন্ধনে না-জড়িয়ে আমৃত্যু সাধনার পথে মনোনিবেশ করা উচিত। কেবল সাধনভজনকারী ব্যক্তিরই জন্মগ্রহণ সার্থক।
৩
পাগলা কানাইয়ের গানে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি মানুষ-বন্দনাও স্থান পেয়েছে। মানুষের জাতি-ধর্ম-বর্ণ তাঁর কাছে মুখ্য ছিল না, কেবল মানুষ হিসেবেই তিনি অপরকে মূল্যায়ন করতেন। তাই কানাই এক গানে লিখেছিলেন, ‘শত রঙের দেখি রে গাভী/একই রঙের দুধ গো দেখি/তবে কেন ত্রিজগতে মানবিচ করত্যাচি/এক মায়ের দুধ গো আমরা/বাপে-বেটায় খ্যাতাছি’।
পাগলা কানাইয়ের উদার ধর্মীয় চেতনা ও অসাম্প্রয়াকিতাবোধ তাঁর প্রায় গানেই পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী একজন মুসলিম ব্যক্তি মৃত্যুর পরে ‘পুলসিরাত’ এবং হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুয়ায়ী একজন ব্যক্তি ‘বৈতরণী’ পার হতে হয়। কানাইয়ের মতে, ‘পুলসিরাত’ ও ‘বৈতরণী’ শব্দ-দুইটি একই বিষয়ের এপিঠ-ওপিঠ। তাই তাঁর সুষ্পষ্ট উচ্চারণ :
আছে হিন্দু আছে মুসলমান,
এক মায়ের দুটি সন্তান,
মউতকালে তৌবা পড়ে যত মুসলমান,
হিন্দু পার হয় বৈতরণী,
সকলের এক প্রাণ তো জানি,
কাজের বেলায় সকল এক সমান।
আছে এই ভবে সবার মরণ,
মুসলমানের গোর কাফন,
হিন্দু মলি শ্মশানে দাহন,
হবে, এ দেহ চার চিজে মিলন ॥
পাগলা কানাইয়ের মতে, মানুষের জন্ম-মৃত্যুতে বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতির আচার-আচরণগত কিছু সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে—এটা সংস্কৃতিজাত ভাবনা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। তবে ‘তুমিও মানুষ আমিও মানুষ’ এটিতে ঘোরতর সত্যবাণী। আর এ বাণী সমাজে যত প্রচার করা সম্ভব হবে ততই মানুষে-মানুষে কৃত্রিম ভেদ-বিভেদ দূরীভূত হবে।
৪
বাউলসাধনায় দেহতত্ত্ব বিষয়ক গানের কদর শিষ্য-ভক্তসমাজে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। যেহেতু দেহবাদী সাধনাই বাউলদের কাছে মুখ্য, তাই এ-সংক্রান্ত পঙ্ক্তির গুরুত্ব অপরিমেয়। পাগলা কানাইও ব্যাপকসংখ্যক দেহতত্ত্ব পর্যায়ের গান রচনা করেছিলেন। সাধুসমাজে সেসব গানের আলাদা স্বীকৃতিও মেলেছে।
পাগলা কানাই দেহের মধ্যে এক ‘মহাজন’ লুকিয়ে রয়েছেন জানিয়ে একটি গানে লিখেছিলেন
পাগলা কানাই কয় এ দেহের মধ্যে আছে আরেক মহাজন,
আমি নিরবধি নদী-স্থিতি পাই না তাহার নিরূপণ।
আমি ক্ষণে হেরি, ক্ষণে ফিরি, ক্ষণে যোগায় সাধুজনার মন,
ওরে মহাজন সামান্য কথা মর্ম কথা মনে ভাই দূরে তাই,
সাধুজনার দয়া হলে ত্রিবেণীতে হয় জোয়ার,
আছে লাহুত চন্দ্ৰ ইন্ন্দ্রগুলি সকল তারা একই তারের তার,
কালোচন্দ্ৰ আছিল ভাই মণিকোঠার কাছে
তার আজ্ঞাচন্দ্র নষ্ট হলে বিভ্রান্তি হয় শেষে।
তুমি শাস্ত্র মানো দিন গা গোনো
গুরুর বচন মিথ্যা নয়,
আছে চাঁদের কিরণ সূর্যের কিরণ
গণকেতে গুণে কয়
পাগলা কানাই বলে ভাই সকল রে
আমার জীর্ণ দেহ কি হবে উপায় ॥
পাগলা কানাই যে ‘মহাজন’-এর কথা গানে উল্লেখ করেছেন, সেটি সাধকদের কাছে ‘পরমাত্মা’ রূপে পরিচিত। সেই ‘পরমাত্মা’-কে চেনার সাধনাই বাউলদের চিরায়ত রীতি। আর এ রীতি অনুসরণ করেই সাধক সাধনার সর্ব্বোচ্চ ‘লাহুত’ স্তরে পৌঁছে যান।
পাগলা কানাইয়ের দেহতত্ত্ব পর্যায়ের গানগুলোতে সাধনার নিগূঢ় ও গুহ্য বিষষের তথ্যও উল্লেখিত হয়েছে। নারীর রজঃস্বলা অবস্থায় সাধকের কর্তব্য কিংবা কামের প্রবৃত্তিকে উৎপাটন করে সাধনায় রূপান্তর করা—এসব কিছুই এসব গানের মূল উপকরণ। দেহবিহীন সাধকের সাধনা যে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার সেটিও তাঁর গানে আলোচিত হয়েছে।
‘যা আছে ভাণ্ডারে তাই রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডে’ সেটির পরিপূর্ণ নির্যাসই হচ্ছে পাগলা কানাইয়ের গানের বিষয়বস্তু। দেহকে উপজীব্য করে কানাই তাঁর গানের শিল্পকুশলতা বাউলসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই সাধকদের কাছে তাঁর গানের আবেদন চিরকালীন।
সুমনকুমার দাশ
.
তথ্যসূত্র
মযহারুল ইসলাম, কবি পাগলা কানাই (ঢাকা : আগামী প্রকাশনী, ১৯৯৭ দ্বি. সং.)।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন