হাজার টুকরা পাজল – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

রাত্রিবেলা সবাই তাদের কাজকর্ম শেষ করে দাদির (কিংবা নানির) ঘরে একত্র হয়েছে। দাদি তার সোফায় বসে টিভি দেখছেন। দাদির পায়ের কাছে ঝুমু খালা বসে আছে। টেলিভিশনে একটা বাংলা সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে। দাদি এবং ঝুমু খালা মনোযোগ দিয়ে সেই সিরিয়াল দেখছে। একটু পরপরই যখন বিজ্ঞাপনের জন্য সিরিয়াল দেখানো বন্ধ করে তখন ঝুমু খালা সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকাদের এমনভাবে সমালোচনা করে যে সেটা শুনে মনে হবে এরা সবাই সত্যি মানুষ এবং ঝুমু খালার খুবই পরিচিত। সাধারণত রাতে যখন দাদি আর ঝুমু খালা টিভি দেখেন তখন বাচ্চারাও থাকে, তারা এমন চেঁচামেচি করে যে এই ঘরে কান পাতা যায় না। আজকেও ঘরে বাচ্চারা আছে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারা টু শব্দটি করছে না। কারণ সবাই মিলে নিঃশব্দে একটা গভীর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

বিষয়টা শুরু হয়েছে এক দিন আগে। ছোটাচ্চু পলিথিনের একটা ব্যাগে একটা প্যাকেট নিয়ে বাচ্চাদের ডেকেছে। তারা আসার পর ছোটাচ্চু মুখ গম্ভীর করে বলল, “তোরা কি জানিস দেশের বর্তমান প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?”

মুনিয়া জানতে চাইল, “প্রজন্ম মানে কী?”

ছোটাচ্চু মুনিয়ার কথা না শোনার ভান করে বলল, “আন্তর্জাতিক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান প্রজন্মের ভেতর কোনো সৃজনশীলতা এবং মননশীলতা নাই।”

মুনিয়া আবার জিজ্ঞেস করল, “সৃজনশীলতা আর মননশীলতা মানে কী?” ছোটাচ্চু এবারও না শোনার ভান করল, বলল, “তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা।”

মুনিয়া হাল না ছেড়ে আবার জিজ্ঞেস করল, “আত্মকেন্দ্রিকতা মানে কী?”

শান্ত মুনিয়ার মাথায় একটা চাটি দিয়ে বলল, “গাধা! এই সোজা শব্দগুলো তুই জানিস না? এইগুলি হচ্ছে বোলচাল কথা। এইগুলির কোনো মানে নাই।”

ছোটাচ্চু চোখ পাকিয়ে শান্তর দিকে তাকাল, শক্ত গলায় বলল, “কী বললি? এইগুলির কোনো মানে নাই?”

শান্ত কিছু একটা বলতে চাইছিল, টুনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, তুমি কী বলতে চাইছিলে বলে ফেলো।”

ছোটাচ্চু বলল, “আমি বলতে চাইছিলাম, বর্তমান প্রজন্মের যে দুর্দশা তোরা কি সেই দুর্দশা থেকে মুক্ত? তোরা কি নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত?”

টুম্পা গম্ভীর হয়ে বলল, “আমরা কেন ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হব? ভবিষ্যৎ আমাদের জন্য প্রস্তুত হবে। আমরা যখন বড়ো হব তখন আমাদের কিছু করতে হবে না, সবকিছু রোবট আমাদের করে দেবে।”

ছোটাচ্চু একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। টুম্পার দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থমথমে গলায় বলল, “তোরা প্রস্তুত না। কিন্তু তোদের প্রস্তুত হতে হবে। তোরা যেন প্রস্তুত হতে পারিস সে জন্য আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।”

শান্ত মুখ হাঁ করে হাই তোলার ভঙ্গি করে বলল, “তুমি যেটা বলতে ডেকেছো সেটা বলে ফেলো। আমাদের কাজকর্ম আছে।” তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে?”

ছোটাচ্চুর লম্বা বক্তৃতা শুনে সবাই মনে মনে একই জিনিস ভাবছিল কিন্তু ছোটাচ্চুর বকুনি শোনার ভয়ে কেউ শান্তর কথা শুনে মাথা নাড়তে সাহস পেল না। ছোটাচ্চু তার বক্তৃতা শেষ করে কী বলে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

ছোটাচ্চু বিষ দৃষ্টিতে শান্তর দিকে একবার তাকাল তারপর অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য প্রথম ধাপ হচ্ছে মনোযোগ। তোদেরকে মনোযোগ দেওয়া শিখতে হবে।”

টুনি আস্তে আস্তে বলল, “আমরা তো মনোযোগ দিতে পারি ছোটাচ্চু।”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “আমি এ রকম টুকটাক মনোযোগের কথা বলছি না। আমি সত্যিকারের মনোযোগ দেওয়ার কথা বলছি। তীব্র মনোযোগ—যখন তোরা তোদের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে কেন্দ্রীভূত করে মনোযোগ দিবি।”

কোনো লাভ হবে না জেনেও মুনিয়া দুর্বলভাবে জিজ্ঞেস করল, “ইন্দ্ৰিয় মানে কী?” আসলেই কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিলো না।

টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তোমার কি ধারণা আমরা বেশি মনোযোগ দিতে পারি না?”

“আমি সেটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই।”

“তুমি কীভাবে সেটা পরীক্ষা করবে?”

ছোটাচ্চু তার মুখটাকে আগের থেকে গম্ভীর করে তার পলিথিনের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা চারকোনা বাক্স বের করল। বাক্সটা কীসের দেখার জন্য সবাই এগিয়ে যায়। ছোটাচ্চু বাক্সটা উপরে তুলে ধরে বলল, “থাউজেন্ড পিস পাজল! হাজার টুকরার পাজল!”

বাচ্চারা হতাশার মতো শব্দ করল। মুনিয়ার এ রকম খেলনা আছে, একটা প্লাস্টিকের ডাইনোসরের ছবি, যেটা পাঁচ-ছয়টা টুকরায় ভাগ হয়ে যায়, সেগুলো একসাথে লাগালে ডাইনোসরের ছবিটা তৈরি হয়। ছোটাচ্চু এই বাক্সে এ রকম একটা ছবি এনেছে, বাক্সের উপর সেই ছবিটা দেখা যাচ্ছে। যেটা হাজার টুকরা করে বাক্সে রাখা আছে। এই হাজারটা টুকরা একত্র করে ছবিটা তৈরি করতে হবে। পৃথিবীতে নিশ্চয়ই অনেক মানুষ আছে, যাদের অনেক সময়, তারা সময় কাটানোর জন্য এগুলো করে। যাদের বিশ-পঁচিশ বছর জেল হয় তারা নিশ্চয়ই জেলখানায় এগুলো করে সময় কাটায়। দেখতে দেখতে তাদের কয়েক বছর কেটে যায়।

বাচ্চাদের ভেতর যে রকম উত্তেজনা দেখা যাবে বলে ছোটাচ্চু ভেবেছিল সে রকম উত্তেজনা দেখা গেল না বলে ছোটাচ্চু একটু চুপসে গেল। তারপরেও ছোটাচ্চু উত্তেজনা তৈরি করার চেষ্টা করল, বলল, “এটি হচ্ছে মনোযোগের চূড়ান্ত পরীক্ষা। আমি এই অসাধারণ পাজলটি তোদের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দিচ্ছি। দেখি তোরা এটি সমাধান করতে পারিস কি না।”

শান্ত মুখ বাঁকা করে বলল, “এটা না পারার কী আছে?”

ছোটাচ্চু মুখ শক্ত করে বলল, “তোর ধারণা তোরা এটা করতে পারবি?”

শান্ত বলল, “একশবার।”

টুনি বলল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি এই চ্যালেঞ্জটা নিলে, আমরা কিন্তু কেউ কিছু বলি নাই!

ছোটাচ্চু টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন, তুই কি এই চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পাচ্ছিস?”

টুনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই শান্ত বলল, “ভয় পাব কেন? এর মাঝে ভয় পাওয়ার কী আছে? দাও পাজলটা শেষ করে দিই।”

ছোটাচ্চু পাজলটা শান্তর হাতে দিয়ে বলল, “শেষ করতে কয়দিন লাগবে?” “দেখি, আজ বিকেলে শেষ করতে পারি কি না।”

টুনি হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি এটা আজ বিকেলে শেষ করতে পারবে না।”

“ঠিক আছে। তাহলে দুই দিন সময় দাও।”

ছোটাচ্চু মুখে চওড়া একটা হাসির ভান করল, তারপর বলল, “ঠিক আছে, দুই দিনের চ্যালেঞ্জ। যখন এটা শেষ করবি তখন তোদের কত আনন্দ হবে চিন্তা করতে পারিস? নয়শ নিরানব্বই টুকরা বসানোর পর শেষ টুকরাকে বসানোর আনন্দই অন্য রকম। তার ওপর পাজলটা হচ্ছে ভ্যান গগের বিখ্যাত স্টারি নাইটের পাজল। মনে হচ্ছে আমিই শুরু করে দিই।”

টুনি দুর্বলভাবে বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার যখন এত ইচ্ছা তুমিই না-হয় করো—”

ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “না, না, না। এটা হচ্ছে তোদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। তোরা শেষ কর। দুই দিন সময়।”

ছোটাচ্চু ঘর থেকে বের হওয়ার পর টুনি শান্তকে বলল, “শান্ত ভাইয়া, তুমি আগে কখনো পাজল করেছো?”

“নাহ্। আমি এই রকম ফালতু কাজের মাঝে নাই।”

“তাহলে আজকে এইটা নিয়ে আসলে কেন? যখন শেষ করতে পারবে না তখন ছোটাচ্চু সারা জীবন এইটা দিয়ে খোঁটা দিবে।”

“শেষ করতে পারব না কেন? সবাই মিলে বসলে দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে।”

টুনি বলল, “না, এটা মোটেও দেখতে দেখতে শেষ হবে না।”

“কেন শেষ হবে না?”

“দেখতে চাও?”

“দেখা।”

তখন টুনি এক হাজার টুকরা পাজলের বাক্সটা নিয়ে তাদের পড়ার টেবিলে গেল। টেবিলের মাঝামাঝিটা খালি করে সেখানে বাক্সটা রাখল। তারপর খুব সাবধানে একটা কাঁচি দিয়ে বাক্সটা খুলল। নাড়ালে এর ভেতরে চানাচুরের মতো কিছু একটা শব্দ করছিল। টুনি সেগুলো টেবিলের উপর ঢেলে দিলো, ছোটো ছোটো অসংখ্য পাজলের টুকরা স্তূপ হয়ে পড়ল। শান্ত ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এগুলো কী?”

টুনি বলল, “পাজলের টুকরা। মোট এক হাজারটা।”

বাক্স থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে টুনি ভাঁজ খুলে টেবিলে রাখল। ভ্যান গগের আঁকা স্টারি নাইট পেইন্টিংয়ের একটা ছবি। টুনি বলল, “এইটা হচ্ছে ছবি। এই ছবি দেখে দেখে তুমি পাজলের টুকরাগুলি বসিয়ে ছবিটা বানাবে।”

শান্ত পাজলের একটা টুকরো হাতে নিয়ে সাবধানে উল্টেপাল্টে দেখে আবার স্তূপের মাঝে রেখে সেটার দিকে আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রইল। টুনি টেবিলে বিছানো স্টারি নাইটের ছবিটা দেখিয়ে বলল, “এই ছবিটা সাইজে ছোটো। তুমি পাজল বসিয়ে যেটা তৈরি করবে সেটা হবে বিশাল সাইজ—প্ৰায় আমাদের টেবিলের অর্ধেক।”

শান্ত বলল, “আমি বুঝতে পারছি না।”

“কী বুঝতে পারছো না?”

“আমি ভেবেছি পাজলগুলোর পেছনে এক দুই তিন করে নম্বর দেওয়া থাকবে, আমরা নম্বর দেখিয়ে বসিয়ে যাব।”

টুম্পা বলল, “তুমি যে ছোটো মাছ খাও না সেই জন্য-

শান্ত অবাক হয়ে বলল, “ছোটো মাছের সাথে এই পাজলের কী সম্পর্ক?”

“ছোটো মাছ খেলে মাথায় বুদ্ধি হয়। তুমি ছোটো মাছ খাও না দেখে তোমার মাথায় বুদ্ধি হয় নাই আর তাই তুমি ভাবছো পাজলের পেছন নম্বর দেওয়া থাকে।”

মুনিয়া বলল, “আমার ডাইনোসরের পাজলের পেছনেও কোনো নম্বর নাই।”

টুম্পা আর মুনিয়ার দিকে শান্ত বিষ দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর মানুষ যেভাবে একটা বিষাক্ত পোকাকে ধরে সেভাবে একটা পাজলের টুকরা ধরে সেটার দিকে তাকাল, তারপর টেবিলে বিছানো ছবিটার দিকে তাকাল, তারপর বলল, “কিন্তু, কিন্তু “

টুনি বলল, “কিন্তু কী?”

“পাজলের এই টুকরাটা ছবির কোথায় বসবে? ছবির অনেক জায়গায় এই রকম নীল—”

টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “মনোযোগ দিয়ে তুমি সেটা বের করবে। ছোটাচ্চু সে জন্য তোমাকে দিয়েছে। এটা তোমার দুই দিনের প্রজেক্ট।”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “অসম্ভব।”

টুনি বলল, “জানি। কিন্তু তুমি ছোটাচ্চুকে বলেছো এটা দুই দিনে করে ফেলবে। নাও শুরু করো।”

শান্তি বলল, “আমি আসলে বুঝি নাই।”

টুম্পা বলল, “এই জন্য ঝুমু খালা সবসময় তোমাকে ছোটো মাছ খেতে বলে।”

শান্ত টুম্পার দিকে তাকিয়ে একটা দাবড়ানি দিয়ে বলল, “তুই চুপ করবি?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন তাহলে আমরা কী করব?”

টুনি বলল, “আমরা না, বলো আমি কী করব। আমরা কেউ নিতে রাজি হই নাই, তুমি আগ্রহ করে এনেছো।”

শান্ত মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “যেটা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন এই বিপদ থেকে কীভাবে রক্ষা পাব?”

টুনি বলল, “এটা ছোটাচ্চুকে ফেরত দিয়ে আসো। বলো যে তুমি আসলে বুঝতে পারো নাই।”

শান্ত মনমরাভাবে বলল, “আর কোনো উপায় নাই?”

“না। আর অন্য কোনো উপায় নাই।”

টুনি তখন পাজলের এক হাজার টুকরা বাক্সের ভেতর ভরে বাক্সটা আবার

বন্ধ করে শান্তর হাতে দিয়ে বলল, “গুড লাক।”

শান্ত বলল, “আমি একা যাব, তোরা আসবি না?”

সবাই একসাথে মাথা নাড়ল, বলল, “না, না—আমরা যাব না।” টুনি বলল, “তুমি এই ঝামেলা পাকিয়েছো, তুমি এটা সামলাও।” শান্ত মুখ ভোঁতা করে পাজলের বাক্সটা নিয়ে ছোটাচ্চুর ঘরে ঢুকল। কিছুক্ষণের মাঝে শান্ত বের হয়ে এলো, তার হাতে পাজলের বাক্স। টুনি জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে শান্ত ভাইয়া? ছোটাচ্চুকে বাক্সটা ফিরিয়ে দিলে না?”

শান্ত মুখ ভোঁতা করে বলল, “ছোটাচ্চু বাক্সটা ফিরিয়ে নেবে না।”

টুনি বলল, “কী বলল ছোটাচ্চু?”

“বলেছে আমরা যেহেতু বলেছি দুই দিনে করে দেবো, আমাদের দুই দিনে করে দিতে হবে।”

“আর যদি না দেই?”

“তাহলে ছোটাচ্চু ধরে নেবে আমরা অমনোযোগী, অলস, অকর্মণ্য, অযোগ্য, অপদার্থ আরও কয়েকটা খারাপ খারাপ শব্দ। এখন ভুলে গেছি।

মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “আমরা সবাই, নাকি খালি তুমি?”

“আমরা সবাই।”

শান্ত বলল, “ছোটাচ্চু বলেছে এইটা নাকি একটা চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি এই চ্যালেঞ্জে হেরে যাই তাহলে—”

টুনি জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কী?”

“তাহলে কী না যেন কী হবে। এখন মনে নাই। মনে হলো খুব খারাপ কিছু।”

টুম্পা বলল, “হলে হবে। কয়দিন পরে ছোটাচ্চু ভুলে যাবে।”

তারপর টুম্পা আর মুনিয়া দুইজন দুই দিকে চলে গেল। শান্ত বাক্সটা হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে একটু নরম গলায় বলল, “টুনি।”

“কী হলো?”

“কিছু একটা করা যায় না? ছোটাচ্চু সারা জীবন খোঁটা দিবে—এটা কি ঠিক হবে?”

টুনি বলল, “দুই দিনে এটা শেষ করতে হলে স্কুল, খাওয়া-দাওয়া, গোসল, ঘুম, লেখাপড়া বাদ দিয়ে সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু কার এত সময় আর এত শখ আছে?”

শান্ত মাথা চুলকাল, বলল, “না মানে আমি বলছিলাম কি, কোনো দুই নম্বুরি বুদ্ধি নাই?”

টুনি চোখ বড়ো বড়ো করল, “দুই নম্বুরি?”

“হ্যাঁ, কিংবা তিন নম্বুরি চার নম্বুরি —

টুনি হতাশভাবে মাথা নাড়ল, বলল, “ছোটাচ্চু দেখতে চাচ্ছে আমাদের মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না আর তুমি একটা তিন নম্বুরি কিংবা চার নম্বুরি ফাঁকিবাজি করতে চাচ্ছ?”

শান্ত মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, তুই ঠিক ধরতে পেরেছিস। যদি মাথায় বুদ্ধি থাকে তাহলে খামোখা মনোযোগ দিয়ে কী হবে?”

টুনি বলল, “না শান্ত ভাইয়া, এক হাজার টুকরা জিগস পাজল বানানোর কোনো দুই, তিন কিংবা চার নম্বুরি বুদ্ধি নাই।”

টুনি যখন চলে যাচ্ছে তখন শান্ত বলল, “তবু তুই একটু চিন্তা করে দেখিস, তোর মাথায় তো অনেক রকম ফিচলে বুদ্ধি।”

ফিচলে বুদ্ধি শব্দটা শোনার পর হঠাৎ করে টুনির মাথায় চিড়িক করে উঠল। হঠাৎ করে টুনি বুঝতে পারল ছোটাচ্চুর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বোকা বানানোর একটা বুদ্ধি আসলেই আছে। টুনি দাঁড়িয়ে গেল।

শান্ত উত্তেজিত হয়ে বলল, “তুই পেয়েছিস কোনো বুদ্ধি?”

টুনি বলল, “হ্যাঁ। মনে হয় একটা বুদ্ধি আছে—একেবারে খাঁটি চোট্টামি বুদ্ধি।”

শান্ত হাতে কিল দিলো, মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “এই তো চাই, খাঁটি চোট্টামি দিয়েই তো জীবন! বুদ্ধিটা কী বল!”

টুনি বলল, “আমি ঠিক সিওর না এই চোট্টামি করা ঠিক হবে কি না।” শান্ত গর্জন করে উঠল, “একশবার ঠিক হবে। তুই নিজেই তো বলেছিস সব রকম কাজকর্ম করে দুই দিনে এটা করা অসম্ভব ব্যাপার। ছোটাচ্চু কেন আমাদের একটা অসম্ভব কাজ করতে দিচ্ছে? কেন জেনেশুনে আমাদের অলস, অমনোযোগী, অকর্মণ্য, অযোগ্য, অপদার্থ সার্টিফিকেট দিতে চাচ্ছে?”

শান্তর কথায় যত রাগই থাকুক একটুখানি যুক্তি আছে। টুনি তাই শান্তকে দুই নম্বুরি বুদ্ধিটা বলতে রাজি হলো। এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “এই পাজলটা যখন তৈরি করা হবে তখন সেটা বিশ ইঞ্চি বাই সাতাইশ ইঞ্চি একটা ছবি তৈরি হবে। ছবিটা খুবই বিখ্যাত। ভ্যান গগের পেইন্টিং। স্টারি নাইট।”

শান্ত মাথা নাড়ল। টুনি বলল, “কাজেই কষ্ট করে এক হাজার টুকরা পাজল না বসিয়ে এই বিখ্যাত পেইন্টিংটা বিশ ইঞ্চি বাই সাতাইশ ইঞ্চি কাগজে প্রিন্ট করে একটা বোর্ডে লাগিয়ে নিয়ে আসো।”

শান্ত বলল, “কিন্তু কিন্তু —”

“কিন্তু কী—

“ছোটাচ্চু দেখে বুঝে যাবে না, এটা পাজল না—এটা শুধু একটা ছবি?”

টুনি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, যদি শুধু ছবি প্রিন্ট করো তাহলে তো বুঝবেই। কাজেই প্রিন্ট করার আগে পাজলের যে নকশা আছে সেটা ছবির উপর বসিয়ে নিতে হবে। দেখে যেন মনে হয় এটা পাজল।”

শান্ত হাতে কিল দিয়ে বলল, “ইয়েস! এই সহজ বুদ্ধিটা আমার মাথায় কেন আসে নাই? টুম্পা ঠিকই বলেছে, আমার মনে হয় ছোটো মাছ খাওয়া শুরু করতে হবে।”

টুনি বলল, “এই ছবিটার উপর হাত বুলালে ছোটাচ্চু বুঝে যাবে এটা পাজল না, এটা পাজলের ছবি। তাই আরেকটা কাজ করতে হবে।”

“কী কাজ?”

“একটা পেরেক কিংবা সুচালো কিছু দিয়ে এই পাজলের জয়েন্টগুলোর যে দাগ হবে সেটার উপর শক্ত করে চাপ দিয়ে টেনে নিবে, যেন হাত দিলে রীতিমতো খাঁজ মনে হয়।”

শান্তর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “টুনি! তুই একটা জিনিয়াস। বড়ো হয়ে তুই দেশের সেরা মাফিয়া গডফাদার হতে পারবি!”

টুনি বলল, “ব্যাপারটা আরও বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমরা কাঁচি দিয়ে এক কোনার আট-দশটা পাজল পিস কেটে রাখতে পারি। সেগুলো ছোটাচ্চুর সামনে বসাব–ছোটাচ্চু তাহলে একেবারেই সন্দেহ করবে না।”

শান্তর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠল, বলল, “টুনি, তার মানে বুঝতে পারছিস?”

টুনি বলল, “কী?”

“ছোটাচ্চু আমাদের দুই দিন সময় দিয়েছে, কিন্তু আমরা চাইলে এক দিনের ভেতর—কালকেই করে ফেলতে পারব!”

টুনি বলল, “কিন্তু সবাই এই দুই নম্বুরি বুদ্ধি কাজে লাগাতে রাজি হবে কি না বুঝতে পারছি না।”

শান্ত বলল, “কী বলছিস তুই? একশবার রাজি হবে। ছোটাচ্চুর সাথে আমাদের সবসময় বুদ্ধির ফাইট! ছোটাচ্চুকে বোকা বানানোর মতো আনন্দ আর কীসে আছে?”

টুনি বলল, “সেটা অবশ্য সত্যি কথা!”

শান্তর ধারণা সত্যি, ছোটাচ্চুকে বোকা বানানোর এই বুদ্ধিটা সবাই লুফে নিয়েছে এবং দাদি (কিংবা নানি) যখন ঝুমু খালাকে নিয়ে সিরিয়াল দেখছেন তখন সব বাচ্চা মিলে একটা বোর্ডে আঠা দিয়ে লাগানো ভ্যান গগের স্টারি নাইট পেইন্টিংয়ের ওপর পাজলের দাগ দেওয়া ছবি নিয়ে বসেছে। সবাই একটা করে পেরেক নিয়ে এই দাগের উপর চাপ দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেন হাত দিলে জোড়াগুলোকে পাজলের টুকরার জোড়ার মতো মনে হয়। প্রমি খুবই সাবধানে একটা কোনা থেকে আট-দশটা টুকরা কেটে রেখেছে। ছোটাচ্চুর সামনে এগুলো বসানো হবে।

টুম্পাকে পাঠানো হয়েছে দরজার কাছাকাছি থাকার জন্য। যখন ছোটাচ্চু আসবে তখন সে ছুটে এসে খবর দেবে।

শেষ পর্যন্ত যখন ছোটাচ্চু বাসায় এসেছে তখন টুম্পা ছুটে এসে অন্যদের খবর দিয়েছে এবং সাথে সাথে সবাই উবু হয়ে ছবিটার উপর ঝুঁকে পড়েছে। তারা ভান করতে শুরু করেছে যে পাজলটার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ছোটাচ্চু এসে তাদের দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, “তোরা পাজলটা সলভ করে ফেলেছিস?”

প্রমি বলল, “পুরোটা এখনও শেষ হয় নাই, আট-দশটা টুকরো বসানো এখনও বাকি আছে।”

“মাত্র আট-দশটা?”

“হ্যাঁ। এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে!”

ছোটাচ্চু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! আমি ধরেই নিয়েছিলাম এক-দুই সপ্তাহ লেগে যাবে। তোরা এক দিনে করে ফেলেছিস?”

শান্ত মুখ গম্ভীর করে বলল, “তুমি যখন বলেছো আমরা অলস, অমনোযোগী, অকর্মণ্য, অযোগ্য এবং অপদার্থ তখন আমাদের ভেতর একটা জেদ চেপে গেল। আমরা ভাবলাম যেভাবেই হোক আমরা দেখাব আমরা অলস না—অমনোযোগী না—”

ছোটাচ্চু শান্তর কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলল, “অবশ্যই তোরা অলস, অমনোযোগী, অপদার্থ না—আমি তোদের মনোযোগের লেভেল দেখে রীতিমতো বেকুব হয়ে গেলাম। আই অ্যাম সরি যে আমি তোদের এত আন্ডার এস্টিমেট করেছি।”

শান্ত বলল, “হ্যাঁ ছোটাচ্চু, এরপর থেকে আমাদের আর ফাঁকিবাজ ভেবো না। আমরা যখন মনোযোগ দিতে চাই তখন মনোযোগ দিতে পারি।”

“অবশ্যই পারিস!”

সবাই মিলে শেষ আট-দশটা টুকরা বসানোর পর টুনি পাজলের একটা টুকরা ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “ছোটাচ্চু, নাও সবচেয়ে শেষ টুকরাটা তুমি লাগাবে।”

ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “আমি?”

প্রমি বলল, “হ্যাঁ। তুমি বলেছিলে নয়শ নিরানব্বই টুকরা বসিয়ে দেওয়ার পর শেষ টুকরাটা বসানোর আনন্দ অন্য রকম। আমরা তোমাকেই সেই আনন্দটা দিতে চাই।”

“থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু।” বলে ছোটাচ্চু সবার পাশে গিয়ে বসল। পাজলটার ওপর খুবই স্নেহভরে হাত বুলাল—পেরেক দিয়ে জোড়াগুলোতে খাঁজ করে রাখার কারণে বুঝতে পারল না এটা ভুয়া! হাতে শেষ টুকরাটা ধরে ফাঁকা জায়গাটাতে বসানোর আগে বলল, “এই ঐতিহাসিক মুহূর্তটার একটা ছবি তুলে রাখা দরকার।”

ছোটাচ্চু পকেট থেকে তার স্মার্টফোনটা বের করে শান্তকে দিলো, শান্ত ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে দিলো। ঠিক তখন মুনিয়া কিছুতেই তার হাসি গোপন করতে পারল না। ছোটাচ্চুকে বোকা বানানোর এ রকম ঘটনা তো আর প্রত্যেক দিন ঘটে না—তার হাসি আসতেই পারে!

ছোটাচ্চু মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই এভাবে হাসছিস কেন?” মুনিয়া কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সবাই একসাথে বলল, “আনন্দে! আনন্দে! মনের আনন্দ!”

ছোটাচ্চু বলল, “এ রকম অসাধারণ কাজে আনন্দ হতেই পারে!”

এ রকম সময়ে টেলিভিশনের সিরিয়ালে একটা বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু হলো এবং দাদি এবং ঝুমু খালা এদিকে তাকালেন। ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছো মা, তোমার নাতি-নাতনিরা কী রকম অসাধারণ?”

দাদি (কিংবা নানি) জিজ্ঞেস করলেন, “কেন? কী করেছে?”

“একটা অসাধারণ ধৈর্য, মনোযোগ আর টিম ওয়ার্কের পরীক্ষা দিয়েছে।”

দাদি মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ তাই তো দেখছি। কোনো হইচই নাই, চেঁচামেচি নাই, ঝগড়াঝাঁটি নাই, চুপচাপ বসে পেরেক দিয়ে দাগ দিয়ে যাচ্ছে।”

ছোটাচ্চু অবাক হয়ে বলল, “পেরেক দিয়ে দাগ দিয়ে যাচ্ছে? পেরেক দিয়ে কীসের উপর দাগ দিয়ে যাচ্ছে?”

ঝুমু খালা বলল, “ওই যে ছবিটা—আঠা দিয়ে যেটা বোর্ডের উপর লাগাইছে।”

ছোটাচ্চু চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “ছবি? কীসের ছবি? আঠা দিয়ে কোথায় লাগিয়েছে?”

“এই যে মাটিতে ফালাইয়া রাখছে ছবি—”  

ততক্ষণে বাচ্চারা উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে এবং হুটোপুটি করে পালিয়ে যেতে শুরু করেছে। মুনিয়া পালিয়ে যাওয়ার সময় আছাড় খেয়ে পড়ল। সে পাজলের বাক্সটা ধরে রেখেছিল এবং তার হাত থেকে সেটা ছিটকে পড়ে খুলে গেল এবং পাজলের এক হাজার টুকরা সারা ঘরে ছিটিয়ে পড়ল! মুনিয়া সেগুলো উদ্ধারের কোনো চেষ্টা করল না, অন্যদের পিছু পিছু পালিয়ে গেল।

ছোটাচ্চু পাজলের টুকরাগুলো হাতে নেয়, তারপর মেঝেতে বিছিয়ে রাখা ভ্যান গগের বিখ্যাত স্টারি নাইট পেইন্টিংয়ের দিকে তাকায়। সেটা হাতে তুলে উল্টেপাল্টে দেখে তার কয়েক সেকেন্ড লাগল পুরো ব্যাপারটা বুঝতে

দাদি এবং ঝুমু খালা কী হচ্ছে না বুঝে এদিক-সেদিক তাকালেন। ছোটাচ্চু এক খাবলা পাজলের টুকরা হাতে নিয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, তোমার নাতি-নাতনিরা শুধু ধৈর্য, মনোযোগ আর টিম ওয়ার্কের পরীক্ষায় পাস করে নাই, আরও একটা পরীক্ষায় পাস করেছে।

“কী পরীক্ষায়?”

“ফিচলে বুদ্ধির পরীক্ষায়! দুই নম্বুরি বুদ্ধির পরীক্ষায়!”

“কেন? কী করেছে?”

“কী করেছে জানতে চাও? ঠিক আছে, তাদের মুখ থেকেই শোনো। ছোটাচ্চু খুব ভালো করেই জানে তারা ঘরের বাইরে দরজার আশেপাশে আছে। তাই গলা উঁচিয়ে হাঁক দিলো, “এই তোরা কোথায়? এখানে আয়।”

কয়েকবার ডাকার পর সবাই ভেতরে আসতে শুরু করল। প্ৰথমে শান্ত, তারপর টুনি, তার পেছনে প্রমি, টুম্পা, মুনিয়া সবাই নিজের কান ধরে মাথা নিচু করে একে একে ঢুকল। সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করছে হাসি চেপে রাখতে কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না।

একেবারে হঠাৎ করে সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করল। কিছুতেই আর হাসি থামাতে পারে না। ছোটাচ্চু তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে রইল, কিন্তু বেশিক্ষণ মুখ শক্ত করে থাকতে পারল না—সে নিজেও হাসতে শুরু করল।

শুধু দাদি (কিংবা নানি) এবং ঝুমু খালা বুঝতে পারল না কেন সবাই হাসছে কিন্তু তারপরও সবাইকে হাসতে দেখে তারাও হাসতে শুরু করে।

হাসি বড়ো সংক্রামক একটা ব্যাপার।

অধ্যায় ১ / ৬

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন