দীনেশচন্দ্র সেন
ভূমিকা
১। ধোপার পাট।
‘ধোপার পাট’ পালাটির অধিকাংশ মৈমনসিংহের অন্তর্গত সাকুয়াইবাট্টাগ্রাম নিবাসী রজনীকান্ত ভদ্র এবং অবশিষ্টাংশ চরশম্ভুগঞ্জবাসী দীন গোপ এবং কীর্ত্তনখোলার ‘মধুর বাপ’ নামে পরিচিত এক ব্যক্তির নিকট হইতে সংগৃহীত হয়। চন্দ্রকুমার ১৯২৪ সালের ১৫ই নবেম্বর তারিখে আমাকে পালা-গানটি পাঠান। পালাটি ৪৬৯ ছত্রে সমাপ্ত; আমি ইহাকে ১৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়াছি।
তরুণ বয়স্ক রাজকুমার ও রজক-কন্যা কাঞ্চনমালার প্রেমকাহিনী অবলম্বনে এই পালা-গানটি রচিত। এই গীতিকাটির অনেক ছত্রই বৈষ্ণবকবিদিগকে স্মরণ করাইয়া দিবে,— সে সম্বন্ধে আমরা পরে আলোচনা করিব। একদিকে চপলমতি নবীন প্রেমিক রাজকুমারের উদ্দাম এবং সাহসিক প্রেমনিবেদন; অপরদিকে স্বীয় অবস্থাবৈগুণ্য এবং সামাজিক-হীনতায় ম্রিয়মাণ ভীরু কাঞ্চনমালার সশঙ্ক, দ্বিধাপূর্ণ অথচ পরিপূর্ণ আবেগময় প্রেমের ভাব কবি অতি সুচারুরূপে অঙ্কন করিয়াছেন গল্প-ভাগও অতি সুকৌশলে গ্রথিত হইয়াছে। এই গীতিকার বৈশিষ্ট্য ইহার অনাড়ম্বর সংযতভাব এবং বাক্যপল্লবশূন্যতা। গল্প-ভাগরচনায় “মহুয়ার” ন্যায় এই গানেও নাট্যকৈৗশল বহুল পরিমাণে দৃষ্ট হয়। পুকুরপাড়ের দৃশ্য, বর্ষার অভিসার, প্রেমিক-প্রেমিকার মিলন প্রভৃতি চিত্র পর-পর অতি সুন্দরভাবে সাজান হইয়াছে। সহসা রাজক্রোধে গল্পের গতি পরিবর্ত্তিত হইয়া পাঠকের চিত্তে পর্য্যাপ্তপরিমাণে কৌতূহল-রসের সৃষ্টি করিয়াছে। রাজকুমারের কাঞ্চনমালার সহিত দেশত্যাগ, নূতন দেশের রজকের গৃহে আশ্রয় গ্রহণ, গৃহকর্ম্মে ও ব্যবসায়ে আশ্রয়দাতাকে সাহায্যপ্রদান প্রভৃতি ব্যাপারে আখ্যান-ভাগের রচনানৈপুণ্য সূচিত হইয়াছে। তার পর রাজকুমারীর প্রেমপত্র প্রণয়ি-যুগলের অনাবিল প্রেমপ্রবাহের মধ্যে একটা বৃহৎ অন্তরায়ের সৃষ্টি করিয়া ফেলিল,— তজ্জন্য পাঠক একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তমসাগাজীর কাহিনীও অপ্রত্যাশিত ভাবে গল্পের বৈচিত্র্য সাধন করিতেছে। তাহার বাণিজ্যযাত্রার বিবরণের শেষভাগে বৃদ্ধ রজকের চিত্রটির অবতারণায় করুণ ‘রসের অভিনব উৎস প্রবাহিত হইয়াছে। পরিত্যক্তা কাঞ্চনমালা যে ভাবে নদীর জলে আত্মবিসর্জ্জন করিল, তাহাতে ত্যাগওপ্রেমের মহিমার অপূর্ব্ব শ্রী ফুটিয়া উঠিয়াছে। পাছে রাজকুমার তাহার মৃত্যু সংবাদে ব্যথিত ও অনুতপ্ত হন, এজন্য কাঞ্চন করজোড়ে প্রকৃতিকে তাঁহার মৃত্যু কথা গোপন করিতে অনুরোধ করিতেছেন। সম্মুখে তাহাঁদের অতীত সুখের স্মৃতি বহন করিয়া পত্র-শয্যার চিহ্ন এখনও বিদ্যমান। যেখান হইতে বঁধুর বংশী-সঙ্কেত শুনিয়া কাঞ্চন পাগলিনী হইয়া ছুটিতেন, নদীতীরে সেই স্মৃতিজড়িত স্থান এখনও রহিয়াছে। এই মিলনের মিলনান্ত অধ্যায় চিরতিমিরাবৃত। অতীত সুখস্মৃতি এবং বর্ত্তমান ব্যথার সন্ধিস্থলে রাজকুমারের পরম কল্যাণ কামনা করিতে করিতে অভিশপ্তা কাঞ্চনমালা নিজদেহ অনন্তে ভাসাইয়া দিয়া তাহার স্বর্গীয় প্রেমের উপসংহার করিলেন। এই গানে বাঁশের বাঁশীর যে সুরটি বাজিয়াছে, আদর্শ প্রেমের যে চিত্রটি ফুটিয়াছে, তাহা অপর এক যুগে বৈষ্ণবেরা ভাষাসম্পদে বিচিত্র করিয়া উপস্থিত করিয়াছেন। যদিও এই গানটির মধ্যে অনেক ছত্র চণ্ডীদাসের পদের সঙ্গে মিলিয়া যায়, তথাপি আমরা বলিতে বাধ্য যে এই সকল কৃষকের গান আদৌ বৈষ্ণবপ্রভাবে রচিত হয় নাই। ইহাতে ছায়া-নিবিড় বাঙ্গলার পল্লী-হৃদয়ের সহজ ভাব-প্রবণতার সেই বিশাল খনি আবিষ্কৃত হইয়াছে, যাহা হইতে বৈষ্ণবেরা তাঁহাদের রত্নরাজী আহরণ করিয়াছিলেন। বৈষ্ণর কবি ও কৃষক কবি, কেহ কাহারও নিকট ঋণী নহেন। ইঁহাদের উভয়েই বাঙ্গালাদেশের ভাবখনির সন্ধান পাইয়াছিলেন; সেই ভাবমূলক যে সব চলিত-কথা দেশময় প্রচলিত ছিল, এবং সহজিয়ারা যাহা সাধনার দ্বারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন, সেই চলিত-কথার ঋণ বৈষ্ণব কবি এবং কৃষক কবি উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি বৈষ্ণব কবিদের অপূর্ব্ব পদের সন্ধান এই সকল কৃষক কবি জানিতেন, তবে তাহাদের ভাষা কিছুতেই এত অমার্জ্জিত এবং প্রাকৃত-প্রধান থাকিতে পারিত না। ভাব ও রচনাভঙ্গীতে অনুমান হয় এই কবিতাটি চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে রচিত হইয়াছিল।
ধোপার পাট
চিতান
বিরহ বিচ্ছেদের জ্বালায় প্রাণ বাঁচে না।
একি যন্ত্রণা পিরীতে দুইদিন আমার সুখ হল না।
(ধুয়া)
(১)
কাঞ্চন।
পুষ্করিণীর চাইর পারেরে ফুট্ল চাম্পা ফুল।
ছাইরা[১] দেরে চেংরা বন্ধু ঝাইড়া[২] বান্তাম[৩] চুল॥২
পুষ্করিণীর পারে বন্ধু পাতার বিছানা।
রাইতে[৪] আইও[৫] রাইতে যাইও বন্ধু দিনে করি মানা॥৪
দুষ্মণ পাড়ার লোক দুষ্মণি[৬] করিবে।
এমন কালে দেখলে বন্ধু কলঙ্ক রটাবে॥৬
বাপ আছে আছে মাও কি বলিবে তারা।
তোমার আমার কলঙ্কে বন্ধু ভাইঙ্গা পড়বে পাড়া[৭]॥৮
হস্ত ছাড় পরাণের বন্ধু চলিয়া যাইতাম[৮] ঘরে।
কি জানি কক্ষের কলসী ভাসাইয়া নেয় সুতে[৯]॥১০
দূরে বাজে মনের বাঁশী ঐ না কলাবনে।
তোমার সঙ্গে অইব[১০] দেখা রাত্রি নিশাকালে[১১]॥১২
(রাজপুত্র)
জল ভরিতে যাওলো কন্যা তিন সন্ধ্যা[১২] বেলা।
এইখানে খারাইয়া শুন আমার মনের কথা॥১৪
হাটু বাইয়া পরে কেশ যৌবন হইল ভারী।
কহিব মনের কথা দণ্ড দুই চারি॥১৬
চইক্ষেতে[১৩] অপরাজিতা গায়ে চাম্পা ফুল।
আমি যে পাগল হইয়াছি কন্যা দেইখ্যা তোমার মাথার চুল॥১৮
রাজ্যধন যা আছে লো কন্যা বাপেরে কহিয়া।
সর্ব্বস্ব তোমারে দিয়া করবাম তোমারে বিয়া॥২০
আমি না পাগল কন্যা যোয়াইয়ের[১৪] চিলা।
এইখানে থাকিয়া কন্যা শুন আমার কথা॥২২
“হাত ছাড় সোনার বন্ধু লাজে মইরা যাই।” ৫ পৃঃ
(কাঞ্চন)
হাত ছাড় সোণার বন্ধুরে লাজে মইরা যাই।
×× ×× ×× ××[১৫]
দিনের বেলায় দেখ্যা লোকে কইব[১৬] কলঙ্কিনী।
মাও আছে বাপ আছে কি কইব শুনি॥২৫
তোমার না বাপ মাও রাজ্যের না রাজা।
বাপের ধোপা আমার বাপ তোমার বাপের পর্জা[১৭]॥২৭
চান্দ হইয়া কেন জমিনে বাড়াও হাত।
লোকে যে বলিবে মন্দ শুনিয়া পরছাৎ[১৮]॥২৯
সোণার ভোমরা তুমি খাইবা ফুলের মধু।
আলাগিয়া[১৯] পিরীতে মজ্লে না পাইবে সুখ॥৩১
হাত ছাড়রে বন্ধু চলিয়া যাইবাম ঘরে।
চিত্তে ক্ষম। দিয়া বন্ধু ছাইড়া দেও মোরে॥৩৩
(রাজপুত্র)
সতা কর সুন্দর কন্যালো সত্য কর রইয়া।
নিশাকালে আইবা[২০] তুমি ফুলের মধু লইয়া॥৩৫
এইখানে থাকিয়া আমি বাজাইবাম বাঁশী।
এইখানে তোমারে লইয়া কাটাইবাম নিশি॥৩৭
এইখানে পাতিয়া রাখ[২১] বাশ পাতার বিছান।
তোমারে লইয়া বুকে দেখবাম স্বপন॥৩৯
(কাঞ্চন)
কাপড় যে ধোওলো কন্যা করিয়া সোহাগ।
এইনা কাপড়ে পাইছি তোমার পাঁচ আঙ্গুলের দাগ॥৪১
এই কাপড় পাইয়া আমার ঘুচিয়াছে সন্দ।
কাপড়ে পাইছি তোমার[২২] মালার গন্ধ॥৪৩
কেমনে সত্য করিরে কুমার ঘরে বাপ মাও।
ছাইড়া দেও চেংরা বন্ধু আমার মাথা খাও॥৪৫
আষাইঢ়া[২৩] নদীরে যেমন পাগল হইয়া যায়।
মনেরে বোঝাইয়া বন্ধু রাখা নাহি যায়॥৪৭
শুইলে স্বপনে দেখি তোমার চান্দমুখ।
নিশাকালে অভাগীর এই মাত্র সুখ॥৪৯
আজি যদি পারিরে বন্ধু আজি যদি পারি।
মাও বাপ ছাড়িয়া আইবাম[২৪] এই সত্য করি॥৫১
দিনের সাক্ষী সুরুজরে রাইতের সাক্ষী তারা।
আর সাক্ষী তুমি কুমার সাম্নে আছ খারা॥৫৩
(২)
কাঞ্চন
পার্লামনা পার্লামনা বন্ধু মইলাম মাথার বিষে,
রে বন্ধু পারলামনা। (ধুয়া)
সত্যভঙ্গ হইলরে কুমার পারলাম না আসিতে।
মাও বাপ জাইগ্যা আছে আসিবাম কেমনে॥২
ঘর কইলাম বাহির রে বন্ধু পর কইলাম আপন[২৫]।
অবলার কুলভয় হইল দূষমণ॥৪
কিসের কুল কিসের মান আর না বাজাও বাঁশী।
মনপ্রাণে হইয়াছি তোমার শ্রীচরণের দাসী॥৬
একটু খানি থাকরে বন্ধু একটু খানি রইয়া।
কাচা ঘুমে বাপ মাও না পড়ুক ঘুমাইয়া[২৬]॥৮
আসমানেতে কাল মেঘ ডাকে ঘন ঘন।
হায় বন্ধু আজি বুঝি না হইল মিলন॥১০
বৃষ্টি পড়ে টুপুর টুপুর বাইরে কেন ভিজ।
ঘরের পাড়ে মানের[২৭] পাতা কাইট্যা মাথায় ধর॥১২
ভিজিল সোণার অঙ্গ রাত্রি নিশাকালে।
অভাগী নিকটে থাকলে মুছাইতাম কেশে[২৮]॥১৪
সংসার ঘুমাইয়া আছে কেবল বাজে বাঁশী[২৯]
হইয়া ঘরের বাহির কোন পথে আসি॥১৬
কাট্যা গেছে কালা মেঘ চান্দের উদয়।
এই পথে যাইতে গেলে কুল মানের ভয়[৩০]॥১৮
ডাল নাই পাল নাই ফুটিয়া না রইছেরে ফুল।
বন্ধুরে পাইলে আমার কিসের জাতি কুল[৩১]॥২০
(৩)
নদীরে কোন দিকে যাও বইয়া
কোত্থেকে আইলেরে নদী, কিসের লাগিয়ারে([৩২])
কোন দিকে যাও বইয়া। (ধুয়া)২
সোণার বরণ পরভাতরে আবের চাকামাখা।
কোন পাখী উড়িয়া আইল সোণার বরণ পাখা([৩৩])॥৪
জমীনে পড়িলে পাখী জমীন খানা বেড়ে।
আশমানে উড়িলে পাখী আশমান না জুড়ে॥৬
এই পাখী ধরিতে গেলে খাচা নাই যে পাই।
কোথায় রাখি প্রাণের পাখী কোন বা দেশে যাই[৩৪]॥৮
কেন বা পোষাইল[৩৫] নিশি কি দোষ দেখিয়া।
নিশি ভোরে গেল বন্ধু আমারে ছাড়িয়া॥১০
বুকেতে লইয়া বন্ধে[৩৬] রাইত করিলাম ভোর।
কোন বা পথে চইল্যা গেল আমার মনচোর॥১২
নিশিভোরে চইল্যা গেল কাচা ঘুম লইয়া।
মাটিতে কি শুইছে বন্ধু খাটপালং ছাড়িয়া[৩৭]॥১৪
আমারে কি আছে মনে সেত রাজার বেটা।
বড়র সঙ্গে ছোটর পিরীত দশের মধ্যে খুটা[৩৮]॥১৬
বাউন[৩৯] হইয়া কেন চান্দে বাড়াই হাত।
পরবোধ[৪০] দিতে পোড়া মনে না পাই কিছু আর॥১৮
ডুবরে গাগড়ী[৪১] তুমি ডুব নদীর জলে।
এই মত ডুবাইল বন্ধু আমারে অকূলে॥২০
ডুবাইয়া গাগড়ী তোমায় তুইলা লইলাম কাঁকে।
আমারে দেখিয়া লোকে কাণাকাণি করে॥২২
গলায় আইঞ্চল[৪২] বাইন্দ৷[৪৩] গাগড়ী লইয়া।
মনে লয় ডুইব্যা মরি বন্ধুর লাগিয়া॥২৪
আইজ যদি আইসরে বন্ধু বাটায় রাখবাম পান।
জীবন যৈবন দিব সইপ্যা দিবাম কুলমান[৪৪]॥২৬
বাপ ছাড়বাম মাও ছাড়বাম বাড়ী ঘরের আশা।
দেশ ছাড়িয়া লইবাম জঙ্গলাতে বাসা॥২৮
(8)
(সংবাদ দাতা)
জমীদার জমীদার কি কর বসিয়া।
তোমার পুত্ত্র পাগল হইল ধুবনীর লাগিয়া॥২
রাজার বাড়ীর কাপড় ধোয়[৪৫] পিরিপাণের খাকী।
তোমার পুত্ত্রু পাগল হইল সেই কন্যা দেখি॥৪
নামত কাঞ্চনমালা কাঞ্চন বরণ।
সেই কন্যার সঙ্গে হইল তাহার মিলন॥৬
চান্দ রাহুতে যেন হইল মিলন।
ঘটাইল দুষমণ্ ধুবা এতেক বিড়ম্বন॥৮
এই কথা শুন্যা রাজা ক্রোধেতে জ্বলিল।
ধুবারে আনিতে রাজা লাঠিয়াল পাঠাইল॥১০
হাতেতে লড়িত ভর[৪৬] কান্ধেতে গাটুরী[৪৭]।
কাঁপতে কাঁপতে আইল গোধা[৪৮] ভগমানের[৪৯] বাড়ী॥১২
পরাস কইরা[৫০] বইসাছে রাজা লোক লস্করে।
হাত যুইড়া দাণ্ডাইল গোধা ধর্ম্মের গোচরে॥১৪
ধোপা— দুইদিন গেছে বিষ্টি বাদল ঝড়ে আর তুফানে।
কাপড় না বাতায়[৫১] এই দারুণ দুর্দ্দিনে॥১৬
তে কারণে মআরাজা[৫২] আমার অবগতি।
বচর[৫৩] না শুকাইতে আইল দুর্গতি॥১৮
ক্রোধেতে কাঁপিছে অঙ্গ কি কহিবাম তোরে।
রাগের সঙ্গে কহে রাজা হাটকাইল্যা[৫৪] গোধারে॥২০
রাজা— বয়স হইয়াছে কন্যার না দিস বিয়া।
আমার পুত্ত্র পাগল হইল কন্যারে দেখিয়া॥২২
আইজ যদি না দেও বিয়া রাত্রি পোষাইলে।
আমার লস্করে গিয়া ধইরা আনব চুলে॥২৪
ধোবা— বাগুয়া[৫৫] যে আছে মালী কামলার কাজ করে।
রাইত পোষাইলে আমি দিবাম বিয়া তার লগে॥২৬
লড়িতে করিয়া ভর ধুবা তার বাড়ী যায়।
ধুবা ধুবনীর কান্দনে রজনী পোষায়॥২৮
কইবা গেল রাজার পুত্ত্র কইবা কাঞ্চন মালা।
দেশেতে পড়িল ঢোল[৫৬] গানের হইল পালা[৫৭]॥৩০
(৫) প্রান্তর-পধ
(কাঞ্চন)
আমি বিরহিনী যে বন্ধু আমি বিরহিনী।
অন্ধকারে বনের পথ না চিনি রে বন্ধু না দেখি না চিনি॥২
নদীর তীরে কেওয়া বন ভইরা রইছে ফুলে।
হস্ত ধরিয়া লও এইনা নদীর কুলে॥৪
চলিতে না পারিরে বন্ধু যৈবন হইল ভারী।
রে বন্ধু যৈবন হইল ভারী।
এইখানে শুইয়া বন্ধু কাটাইবাম নিশি[৫৮]॥৬
(রাজপুত্ত্র)
আরও একটু যাওলো কন্যা বাপের মুল্লুক ছাড়ি।
বাপের মুল্লুক ছাইড়া আমরা হইবাম দেশান্তরী॥৮
রাত্রি বুঝি পোষায় রে কন্যা কালিয়ারী[৫৯] হইল।
এই দেশ ছাড়িয়া কন্যা অন্য দেশে চল॥১০
আশ্রা[৬০] যদি পাইল কন্যা ভাগ্যিমানের[৬১] বাড়ী।
তা না হইলে জন্মের মতন হইবাম বনচারী॥১২
বনে বনে ফিরবাম কন্যালো তোমারে লইয়া।
ভোগ্[৬২] লাগলে বনের ফল খাইবাম পারিয়া॥১৪
গাছের তলায় বাড়ী ঘর পাতার বিছানা।
বনের বাঘ ভালুক তারা হইব আপনা॥১৬
(কাঞ্চন)
রাত যে পোষাইলরে বন্ধু চান্দর ঝিলিমিলি।
তোমার বাপের মুল্লুক বুঝি আইলাম রে ছাড়ি॥১৮
বাপেতে কান্দিবেরে কুমার কালুকা বিয়ানে[৬৩]।
অভাগিনী মায়ে মাথা ভাঙ্গিবে পাষাণে॥২০
তুমি ছাড়লা বাড়ী ঘর আমি কুলমান।
অবলা হইয়া হইলাম নিদয় পাষাণ॥২২
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম খুরাই নদীর ঘাট।
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম হাইল ধানের মাঠ[৬৪]॥২৪
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম তোমার আমার বাড়ী।
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম পাড়ার নরনারী॥২৬
রাত্রি না পোষাইলে শুনবাম অইনা পাখীর গান।
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম ভোরের আসমান[৬৫]॥২৮
রাত্রি না পোষাইলে দেখবাম সেইনা বাগের[৬৬] ফুল।
জন্মের মত ছাইরা আইলাম মাও বাপের কুল॥৩০
রে বন্ধু মাও বাপের কুল॥
(রাজপুত্ত্র)
না কাইন্দ না কাইন্দ লো কন্যা চিত্তে দেও ক্ষমা।
ঘর ছাড়ি বনবাসী হইবাম দুইজনা॥৩২
না কাইন্দ না কাইন্দ লো কন্যা না কান্দিও আর।
এক সুতায় গাথা রইল ঐনা ফুলের হার॥৩৪
কি শুনি কি শুনি কন্যা ঐনা নদীর ঘাটে।
কোন রাজার মুল্লুক এই আইস্যাছি হেথাকে[৬৭]॥৩৬
(৬)
রাজপুত্ত্র (সেই নগরের এক ধোপার প্রতি)
রাজার বাড়ীর ধুবারে কাপড় ধইয়া[৬৮] খাও।
আশা দিয়া রক্ষা কর এই দুইটি প্রাণী।
দুঃখে পইড়াছি আমি সঙ্গেতে দুষ্কিণী[৬৯]॥৩
বাপে দিল খেদাড়িয়া তুমি ধর্ম্মের বাপ।
বিপাকে পড়িয়া আইলাম মনে পাইয়া তাপ॥৫
চান্দ সুরুজে যেন পথে দেখা পাইয়া।
অবাক্ষি[৭০] লাগিয়া ধুবা রহিল চাহিয়া॥৭
সূর্য্যের সমান পুরুষ আর চান্দের সমান নারী।
এহারা হইবে কোন রাজার ঝিয়ারী॥৯
(ধোপা)
পুত নাই ক্ষেত নাই আমার ঘরে থাক।
ঘরেতে অদুনা[৭১] তারে মা বলিয়া ডাক॥১১
তোমরা হইলা পুত্ত্রু কন্যা ঘরের লছ্মী[৭২]।
রাজার বাড়ীর কাপড় ধইয়া খাই আমি॥১৩
(রাজপুত্র)
শুন শুন ধর্ম্মের বাপ কহি যে তোমারে।
রাজার বাড়ীর কাপড় ধইয়া দিবাম তোমারে॥১৫
আমি যে ধুবার পুত্ত্র কাপড় ধইতে জানি।
ঘরের কাজ করব কন্যা হইয়া ধুবানী১৭
তুমিত হইবা বাপ আমরা ছাওয়াল।
এইখানে থাকিয়া আমরা কাটাইবাম কাল॥১৯
(৭)
রাজকন্যা— “নিত্যি নিত্য ধওরে কাপড় বাপের বাড়ীর ধুপা।
এমন কইরা ধইতে কাপড় না দেখি কখন॥”২
ধাই আইসা খবর কয় রুক্মিণীর কাছে।
নূতন আইসাছে ধুপা তোমার কাপড় কাচে॥৪
চান্দের মতন রূপ দেখিতে সুন্দর।
এই ধুপা হইব কোন রাজার কোঙর॥৬
এক কন্যা আসিয়াছে সঙ্গেতে তাহার।
কহিতে তাহার রূপ অতি চমৎকার॥৮
চামর ঢুলাইয়া পড়ে শিরে চিকণ কেশ।
কাঞ্চা সোণার বরণ নবীন বয়েস॥১০
অতসী ফুলের বণ্ণ[৭৩] সব্ব শইল[৭৪] তার।
কহিতে তাহার রূপ লোকে চমৎকার॥১২
এই কথা শুনিয়া কন্যা কি কাম করিল।
ধুপানীরে আন্তে কন্যা ধাই পাঠাইল॥১৪
রাজকন্যা রুক্মিণী ধোপার প্রতি
“আচরিত কথা ধুপানীর শুনাইল ধাই।
গয়বী মিলন নাকি ঝি আর জামাই॥১৬
আজ যে কাপড় লইয়া আইসে তোমার ঝি।
তাহার সহিতে আমি পাতিব সহেলা॥”১৮
আইজ যায় কাইল যায় করে আনাগুনী।
দেখিয়া কন্যার রূপ পাগল রুক্মিণী॥২০
প্রাণ সই বলি করে কুলাকুলি।
দুইজনে মনসুখে হইল মেলামেলি॥২২
(৮)
এক মাস দুই মাস তিন মাস যায়।
একদিন রুক্মিণী তবে কন্যারে সুধায়॥২
“কোথায় বাড়ী কোথায় ঘর কোথায় মাতাপিতা।
কোথা হইতে কেন আইলা যাইবা বা কোথা॥৪
মাও ছাড়লা বাপ ছাড়লা নবীন বয়সে।
দেশ ছাড়লা বাড়ী ছাড়লা কোন কর্ম্মদোষে॥৬
কাঞ্চন পুরুষ দেখি তোমার নাগর।
বলেতে করিয়া চুরি করল দেশান্তর॥৮
অথবা পিরীতে মইজ্যা কইল দেশান্তরী।
পূর্ব্বাপর কথা কন্যা কও সবিস্তারী॥১০
সুবুদ্ধি আছিল কন্যার কুবুদ্ধি হইল।
আদ্যন্ত কথা কন্যা রুক্মিণীরে কইল॥১২
রুক্মিণী (জনান্তিকে)
“কাঞ্চন পুরুষ এই আইসে আর যায়।
এই নাগর ধুবার যুগ্যী[৭৫] মনে না জোয়ায়॥১৪
ধুবার ঘরে না জন্মিল জন্মিল রাজার ঘরে।
কপালে আছিল তাই এত দুঃখ করে॥১৫
নিত্যি নিত্যি আইসে ধুপা কাপড় লইয়া।
উদামা[৭৬] খেড়কীর পথে আমি থাকি চাইয়া॥১৮
ভমরা আছিলা তুমি হইলা গোবরিয়া[৭৭]।
ধুবার কন্যা আনল তোমায় পিরীতে মজাইয়া॥”২০
সুবুদ্ধি রাজার কন্যা কুবুদ্ধি হইল।
কাপড়ের ভাজে পত্র সঙ্কেতে রাখিল॥২২
সঙ্কেত-পত্র
“শুন শুন প্রাণের বন্ধুরে না চিনি না জানি।
দেখিয়া তোমার রূপ হইলাম পাগলিনী॥২৪
কর্ম্মদোষে দোষী তুমি রাজারে ভাঁড়াও।
উড়িয়া বনের মধু বনফুলে খাও॥২৬
আইল বসন্ত কাল ঐনা ফাল্গুন মাসে।
কোকিলার কলরব ফুলে জোয়ার[৭৮] আসে॥২৮
আবির লইয়া খেলে নাগরা নাগরী।
এমন কালে কাপড় লইয়া আইস রাজার বাড়ী॥[৭৯]৩০
একদণ্ড পাইতাম তোমায় কইতাম মনের কথা।
সঙ্কেতে বুঝিয়া লইবা রুক্মিণীর মনের কথা॥৩২
(৯)
পুরুষ ভ্রমরা জাতি ফুলের মধু খায়।
বাসি থইয়া টাট্কা ফুলের মধু খাইতে চায়॥২
একদিন কাঞ্চন মালায় কুমার কহে ডাক দিয়া।
তিন মাস আসি আমি বিদেশ ভরমিয়া॥৪
এই তিনমাস তুমি থাক ধুবার ঘরে।
দুইজনে দেখা হইব এই তিন মাস পরে॥৬
অত না ভাবিল কন্যা শত না ভাবিল[৮০]।
সরল হইয়া কন্যা নাগরে বিদাইল॥৮
একমাস দুইমাস তিনমাস যায়।
রাজবাড়ীতে বাজে ঢোল শব্দ শুনা যায়॥১০
জয় জোকার না উঠে ঐনা রাজার বাড়ী।
অদুনায় জিজ্ঞাসা করে ধোপার ঝিয়ারী॥১২
শুন শুন অদুনা মাগো কহি যে তোমারে।
কিসের বাদ্যি কিসের ঢোল শুনি রাজার পুরে॥১৪
অদুনা সংবাদ কয় ঝিয়েরে আসিয়া।
কোন দেশের রাজার সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়া[৮১]॥১৬
তিন মাস হইল বন্ধু হইল দেশান্তরী।
চাইর মাস হইল বন্ধু না ফিরিল বাড়ী॥১৮
পাঁচ মাস যায় কন্যার আইব[৮২] আমার আশে।
ছয় মাস যায় কন্যার উপাসে আয়াসে॥২০
সাত মাস যায় কন্যার চক্ষে নাহি ঘুম।
আট মাসে কাঞ্চা বাঁশে ধরিলেক ঘুণ॥২২
নয় মাসে না আসিল আশা হইল ফাঁকি।
বছর গোঁয়াইতে আর দুই মাস বাকী॥২৪
দশ মাস দশে শূন্য বুক হইল খালী।
এগার মাসেতে কন্যা কাটিব শিকলী[৮৩]॥২৬
বার মাস তের রাইত এইরূপে যায়।
আসিব বলিয়া বন্ধু আশার আশায়॥২৮
রাত্রিতে জ্বালাইয়া বাতি কাঁদিয়া নেবাইল।[৮৪]
এক বছর গেল বন্ধু ফিরিয়া না আইল॥
কান্দে বিরহিণী কন্যালো নদীর কূলে বইয়া।
কোন দেশ হইতে আইলা নদীরে যাইবা দূরের পানে॥৩২
দুষ্কিণীর দুষ্কের কথা কইও বন্ধুর স্থানে।
আমার মনের কথা কইও বন্ধুর কাণে॥৩৪
দূরে থাক্যা আইলারে ডিঙ্গা পাল টাঙ্গাইয়া।
এই ডিঙ্গায় নি আইছে সাধু বন্ধের খবর লইয়া[৮৫]॥৩৬
কতদেশে যাওরে ডিঙ্গা কত দেশে যাও।
আমার বন্ধুরে তুমি দেখিতে নি পাও॥৩৮
আমার লাগ্যা আন্ব বন্ধে হীরামতীর ফুল।
দুই ফোটা চক্ষের জল দিবাম সেই ফুলের মূল[৮৬]॥৪০
গেল গেলরে বন্ধু এও দিনের আশা।
আজি রাত্রি পোষাইলে কাইল দিনের আশা॥৪২
কাইল দিন চইল্যা গেলে কা’ল হইল কাল।
অপযশী হইলামরে বন্ধু দুষ্কেরি কপাল[৮৭]॥৪৪
(১০)
রাজার বাড়ীর তাগীদদার দুরন্ত হইয়া।
একদিন ধোবারে কয় নিরলে ডাকিয়া॥২
তোমার ঘরেতে আছে নবীন কুমারী।
পাঁচশ’ টাকা দিবাম তোমায় দিবাম জমী বাড়ী॥৪
আমার পর্তাপে গাভুনী গাভ[৮৮] ছাড়ে।
আমার কথা না রাখিলে জানে[৮৯] মারবাম্ তোরে॥৬
দেখা করাইবা তারে আমার না লগে।
কাঁপিয়া ঝাপিয়া ধুবা কয় ধুবনীর আগে॥৮
তাগিদদারে বাড়ী ঘর পুইড়া কর্ব চাই।
পরের কন্যার লাগ্যা কেন আমরা দুঃখু পাই॥১০
ধোপাণী (অদুনা)
ধর সুন্দর কন্যা মোর কথা ধর।
এক বচ্ছর বঞ্চিলা তুমি আমার ঘর॥১২
তুমি লো ধর্ম্মের কন্যা আমি তোমার মাও।
আজ রাত্রি রাখ কথা মোর মাথা খাও॥১৪
দুরন্ত তাগীদ্দারে দুষ্মণ হইল।
কিমত সন্ধানে জানি তোমারে দেখিল॥১৬
তুমি থাকিলে কন্যা মরিব পরাণে।
বাড়ী ঘর পুইড়া ছাই করিব আগুনে॥১৮
ধর্ম্ম রাখ সতী কন্যা যাও অন্য ঠাঁই।
আজ রাইতে বিপদে রক্ষা করকাইন গোঁসাই॥২০
(১১)
পীরের কান্দা[৯০] তামসা গাজী[৯১] ধানের বেপারী।
পাঁচখানা পান্সী লইয়া করে সদাগরী॥২
উত্তর হইতে আসে ভাঙ্গাইয়া ধান।
নদীর পারে লাগাইল ডিঙ্গা পাঁচখান॥৪
সঙ্গে ছিল ভাগীদার কোন কাম করিল।
খারাই নদীর পারে ডিঙ্গা ভিড়াইল॥৬
নদীর কূলেতে বইয়া[৯২] কান্দিছে সুন্দরী।
ভাগীদারের কাছে কথা শুনিল বেপারী॥৮
পোলা[৯৩] নাই পুতী[৯৪] নাই সংসারের আশা।
কন্যারে লইয়া সঙ্গে চলিল তামসা॥১০
তামসা গাজীর বাড়ীত কন্যা গীর[৯৫] কাজ করে।
ভাত রাঁধিতে কন্যার দুই আঁখি ঝুরে॥১২
উঠান ঝাড়িতে কন্যার হইল উনমতি।
কন্যার চক্ষের জলে ভাসে বসুমতী॥১৪
কলসী লইয়া কন্যা যায় নদীর জলে।
বিনা সুতে গাঁথে মালা দুই আঁখির জলে॥১৬
দুইয়েতে সোহাগ করে পাইয়া কন্যায়।
দুষ্কের কারণ কন্যা খুইজা নাহি পায়॥১৮
তমসা গাজি “বাণিজ্যে যাইবাম লো কন্যা মোরে দেও কইয়া।
কিবা চিজ[৯৬] আনিবাম তোমার লাগিয়া॥২০
তুমি ত ধর্ম্মের ঝি আমরা বাপ মাও।
না পাইয়া পাইয়াছি ধন খদার দোয়ায়॥”২২
এই কথা শুনিয়া কন্যা কান্দিতে লাগিল।
কি ধন চাহিবে কন্যা খুজিয়া না পাইল॥২৪
যে ধন হারাইয়াছে কন্যার সে ধনের কথা কভু
কওন না যায়॥৫ ২
তিন মাস তের দিন গুঁজুরিয়া গেল।
নান। দ্রব্য লইয়া গাজী বাড়ীতে ফিরিল॥২৭
ঝিনাইর ফুল[৯৭] আনিয়াছে কটরা[৯৮] ভরিয়া।
মতীর মালা আনিয়াছে কন্যার লাগিয়া॥২৯
আর ত কিনিয়া আন্ছে অগ্নি পাটের সাড়ী।
আর ত কিনিয়া আন্ছে কমরের ঘুঙ্গুরী॥৩১
আর বেকী[৯৯] বেক্ষারু[১০০] নাকের বলাক।
খাইবার জন্য আন্ছে মৌমাছির চাক্॥৩৩
শুক্না মাছ আটীর আটী ঝাপায় ভরিয়া।
কত কত দব্ব আন্ছে ডিঙ্গায় করিয়া॥৩৫
দূর না দেশর কথা এক এক করি।
ঘরের নারীর কাছে গাজী কহিছে বিস্তারী॥৩৭
এক দেশ দেইখ্যা আইলাম উলু ছনের ছানি।
আর এক দেশ দেখ্যা আইলাম গাছের আগ পানি[১০১]॥৪০
মর্দ্দানাতে রান্ধে বাড়ে নারীতে বায় হাল।
হাটবাজারে নারী ফিরে পালের পাল॥৪১
নদীর কিনারে দেখলাম মইষের বাতান।
ছড়াতে[১০২] পড়িয়া হরিণ করে জল পান॥৪৪
পাড়[১০৩] পর্ব্বত কত যাই ডিঙ্গাইয়া।
কত কত দূরের দেশ আইলাম দেখিয়া॥৪৫
কত কত নদী দেখলাম তীরে ছুটে পানি।
কত কত দেখিলাম সাউদের[১০৪] তরণী॥৪৭
কত কত রাজার মুলুক আইলাম দেখিয়া।
ঘরণীর[১০৫] কাছে কথা কয় বিস্তারিয়া॥৪৯
আর এক দেখিলাম আচরিত[১০৬] বাণী।
এমন আচানক[১০৭] কথা কভু নাহি শুনি॥৫১
রাজার মুল্লুক সেই বড় বড় ঘরে।
এক ধুবা কাপড় ধয় নদীর কিনারে॥৫৩
বয়স হইয়াছে বড় চক্ষু দুইটি ঘোলা।
আস্তে কথা নাহি শুনে কানে লাগ্ছে তালা॥৫৫
রাজার বাড়ীর ধুবা কাপড় ধইয়া খায়।
একখান কাপড় ধইতে সাত দিন যায়॥৫৭
বড় দুঃখু হইল মনে ধুবারে দেখিয়া।
জিজ্ঞাসা করিলাম তারে আপনা ভাবিয়া॥৫৯
পুত নাই ক্ষেত নাই অভাগা কপাল।
এক কন্যা ছিল তার শুন কহি হাল॥৬১
কলঙ্কিনী হইয়া কন্যা কুল ভাঙ্গাইল।
কুলটা হইয়া কন্যা বাপেরে ছাড়িল॥৬৩
চক্ষে নাহি দেখে বাপ কাণে নাহি শুনে।
এত দুঃখু ধুবা তবে ধইরা রাখে প্রাণে॥৬৫
নদীর কূলে বইয়া[১০৮] কান্দে মা, মা, বলিয়া।
ধুবার দুগ্গতি আইলাম নয়ানে দেখিয়া॥৬৭
এই কথা কাঞ্চনমালা যখন শুনিল।
বাপের লাগিয়া কন্যা কান্দিতে লাগিল॥৬৯
পুত নাই ক্ষেতরে নাই নাইরে তাতে দোষ।
অইয়া[১০৯] পুত মইরা গেলে সে বড় আপশোষ॥৭১
কাঞ্চন— “শুন শুন ধর্ম্মের বাপ বলি যে তোমারে।
বাপের কাছে লইয়া যাও শীঘ্র কইরা মোরে॥৭৩
ধুবার ঘরে জন্ম লইলাম হইয়া ধুবার ঝি।
কপালের দুঃখু কথা কহিবাম কি॥৭৫
কর্ম্মদোষে ধর্ম্ম গেল হইলাম কলঙ্কিনী।
বুকের মধ্যেতে জ্বলে তোষের[১১০] আগুনি॥৭৭
(১২)
কাঞ্চনের পিতা ধোপা
ঝি গো কি কহিবাম তোরে।
ছোট কালে পাল্যাছিলাম কত দুঃখু করে॥২
তোর দুঃখে মা তোর ছাইড়া সকল আশা।
জন্মের মত লইয়াছে নদীর কূলে বাসা[১১১]॥৪
এই ঘাটে কাপড় ধই চক্ষে বহে পানি।
কন্যা হইয়া হইলা তুমি নিদয়া পাষাণী॥৬
বাপের আগে কাইন্দা কয় যত দুঃখের কথা।
দেশে বিদেশে ঘুইরা পাইল যত বেথা॥৮
রাজার বাড়ীর খবর কন্যা পাইল বাপের আগে।
সকল হারাইছে কন্যা কর্ম্মের অনুরাগে[১১২]॥১০
বিয়া কইরা রাজার পুত্ত্রু সুখে বস্যা খায়।
স্বপ্নেও একদিন কন্যারে না জিগায়॥১২
শুকাইল চক্ষের জল মুখে শব্দ নাই[১১৩].
কর্ম্মদোষে বিড়ম্বনা কার মুখ চাই॥১৪
কলঙ্কিনী হইলাম কেমনে দেখাই মুখ।
এই দেশে থাকিয়া বাপ আছে কিবা সুখ॥১৬
ধোপা— “দুর্ম্মতিয়া হইল কন্যা কি কাম করিলে।
হইয়া কুলের কন্যা কুলে কালি দিলে॥১৮
তোমার লাগিয়া আমি জিয়ন্তে তে মরা।
কর্ম্মদোষেতে আমি হইলাম কপাল পোড়া॥২০
বড়র সঙ্গে ছোটর পিরীত হয় অগঠন[১১৪]।
উচা গাছে উঠ্লে যেমন পড়িয়া মরণ॥২২
জমীন ছাইড়া পাও দিলে শূন্যে না লয় ভর।
হিয়ার মাংস কাট্যা দিলে আপন না হয় পর॥২৪
ফুলের সঙ্গে ভমরার পিরীত যেমন আগে বুঝা দায়।
এক ফুলের মধু খাইয়া আর ফুলেতে যায়॥২৬
মেঘের সঙ্গে চান্দের ভালাই[১১৫] কত কাল রয়।
ক্ষণে দেখি অন্ধকার ক্ষণেকে উদয়॥২৮
কুলোকের সঙ্গে পিরীত শেষে জ্বালা ঘটে।
যেমন জিহ্বার সঙ্গে দাঁতের পিরীত আর ছলেতে কাটে[১১৬]॥৩০
না বুঝিয়া না শুনিয়া আগুনে হাত দিলে।
কর্ম্মদোষে অভাগিনী আপনি মজিলে॥৩২
এক প্রেমেতে মারে কন্যা আর প্রেমে জিয়ায়।
যে প্রেমে কলঙ্ক ঘটে সে প্রেম কেবা চায়॥৩৪
চক্ষের কাজল কন্য। ঠাঁই গুণেতে কালী।[১১৭]
শিরেতে বান্ধিয়া লইলে কলঙ্কের ডালি॥৩৬
বাপে কান্দে ঝিয়ে কান্দে গলা ধরাধরি।
(১৩)
রাজ্যের লোক নাই সে জানে কন্যা আইসে[১১৮] বাড়ী॥৩৮
এক পাগলী আইল রাজ্যে পথে পথে ঘুড়ে।
এই সে দেখি এই সে নাই কেউ না চিন্তে পারে॥২
হাওরের বাকুণ্ডি[১১৯] যেমন ধুলা নেয় সে উড়ি।
এক দণ্ড থির নাই পথে পথে ঘুড়ি॥৪
গাছের তলায় নদীর পারে এই আছে নাই।
কখন হাসে কখন কান্দে কখন গান গায়॥৬
বইসা আছে রুক্মিণী যে পালঙ্ক উপরে।
পন্থের পাগল নারী পরবেশে অন্দরে॥৮
চান্দের সমান রাজার পুত্ত্রু দরবারে বসিয়া।
সবাই বলে পাগল যায় এই পথ দিয়া॥১০
কত দিনে রাজ্য জুইড়া এই আনিগুনি।
আর না দেখিল কেউ সেই পাগলিনী॥[১২০]॥১২
মেঘের মুখে চান্দের আলো তারার ঝিকিমিকি।
ক্ষণে ক্ষণে আন্ধাইর পথ চক্ষে নাহি দেখি॥১৪
আষাঢ়িয়া ভরা নদী ভরা কূলে কূলে।
দৌরিয়া আইল ভাবের পাগল সেইনা নদীর কূলে॥১৬
দেওয়ায় ডাকে ঘন ঘন বিষ্টি পড়ে রইয়া।
নদীর ঘাটেতে কন্যা আইল দৌরিয়া॥১৮
কাঞ্চন— “মনের দুঃখু মিটিয়াছে মিটিয়াছে আশা।
দেখিলাম বন্ধুর মুখ মনের ছিল আশা॥২০
সুখেতে থাকগো বন্ধু সুন্দর নারী লইয়া।
সুখে কর গীর বাস জনম ভরিয়া॥২২
না লইও না লইও বন্ধু কাঞ্চনমালার নাম।
তোমার চরণে আমার শতেক পরণাম[১২১]॥২৪
এইনা ঘাটেতে আছে পাতার বিছানা।
সুখেতে রজনী দোয়ে করেছি বঞ্চনা॥২৬
মনে না রাইখরে বন্ধু সেই দিনের কথা।
আর না রাখিও মনে সেই মালা গাথা॥২৮
রাইতের নিশি আনি গুনি তোমার বাঁশীর গানে।
অভাগিনীর কথা বঁধুরে না রাখিও মনে॥৩০
আমি মইরাছি নদী না বলিও কারে।
টুনী পঙ্খী নাহি জানে না কইও বন্ধুরে॥৩২
নদীর কূলের বিরিক্ষ[১২২] লতা ডালে ঘুমাও পাখী।
আমার কথা না কহিও বন্ধের নিকটে॥৩৪
আশমানের চান্দ তারা কহি যে তোমরারে।
আমি যে মইরাছি কথা না কইও বন্ধেরে॥৩৬
না কইও না কইও বাপ আমি আইছি দেশে।
তোমার চরণে পরণাম জানাই উদ্দিশে॥৩৮
কাণে কাণে কইরে বাতাস কাণাকাণি কথা।
তোমার কাছে কহিবাম যত মনের কথা॥৪০
রাত্রিকালের সাক্ষী তুমি দিবাকালের সাক্ষী।
কলঙ্কিণীর কথা জান দেশের পশু পঙ্খী॥৪২
আমি যে আইছি দেশে আমার মাথা খাও।
আমার মরণ কথা বন্ধে না জানাও॥৪৪
দেশের লোকে নাই সে জানে আমার মরণ কথা।
কি জানি শুনিলে বন্ধু পাইবে মনে বেথা॥৪৬
কোন দেশ হইতে আইছরে ঢেউ যাইবা কোথাকারে।
আমারে ভাসায়ে নেও দুস্তর সাগরে॥৪৮
তারা হইল নিমি ঝিমি রাত্র নিশাকালে।
ঝম্প দিয়া পড়ে কন্যা সেইনা নদীর জলে॥৫০
.
টীকা
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন