১৯৪৬-৪৭
    দিনের আলোয় ওই চারি দিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা :
    পথে-ঘাটে ট্রাক ট্রামলাইনে ফুটপাতে;
    কোথায় পরের বাড়ি এখুনি নিলেম হবে—মনে হয়,
    জলের মতন দামে।
    সকলকে ফাঁকি দিয়ে স্বর্গে পৌঁছুবে
    সকলের আগে সকলেই তাই।
    অনেকেরই ঊর্ধ্বশ্বাসে যেতে হয়, তবু
    নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব—অথবা যা নিলেমের নয়
    সে সব জিনিস
    বহুকে বঞ্চিত ক’রে দু জন কি একজন কিনে নিতে পারে।
    পৃথিবীতে সুদ খাটে : সকলের জন্যে নয়।
    অনির্বচনীয় হুণ্ডি একজন দুজনের হাতে।
    পৃথিবীর এইসব উঁচু লোকদের দাবি এসে
    সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।
    বাকি সব মানুষেরা অন্ধকারে হেমন্তের আবিরল পাতার মতন
    কোথাও নদীর পানে উড়ে যেতে চায়,
    অথবা মাটির দিকে—পৃথিবীর কোনো পুনঃপ্রবাহের বীজের ভিতরে
    মিশে গিয়ে। পৃথিবীতে ঢ়ের জন্ম নষ্ট হয়ে গেছে জেনে, তবু
    আবার সূর্যের গন্ধে ফিরে এসে ধুলো ঘাস কুসুমের অমৃতত্বে কবে
    পরিচিত জল, আলো আধো অধিকারিণীকে অধিকার করে নিতে হবে :
    ভেবে তারা অন্ধকারে লীন হয়ে যায়।
    লীন হয়ে গেলে তারা তখন তো—মৃত।
    মৃতেরা এ পৃথিবীতে ফেরে না কখনও।
    মৃতেরা কোথাও নেই; আছে?
    কোনো কোনো অঘ্রানের পথে পায়চারি-করা শান্ত মানুষের
    হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও নেই বলে মনে হয়;
    তা হলে মৃত্যুর আগে আলো অন্ন আকাশ নারীকে
    কিছুটা সুস্থিরভাবে পেলে ভালো হত।
    বাংলার লক্ষ গ্রাম নিরাশায় আলোহীনতায় ড়ুবে নিস্তব্ধ নিস্তেল।
    সূর্য অস্তে চলে গেলে কেমন সুকেশী অন্ধকার
    খোঁপা বেঁধে নিতে আসে—কিন্তু কার হাতে?
    আলুলায়িত হয়ে চেয়ে থাকে–কিন্তু কার তরে?
    হাত নেই–কোথাও মানুষ নেই; বাংলার লক্ষ গ্রামরাত্রি একদিন
    আলপনার, পটের ছবির মতো সুহাস্যা, পটলচেরা চোখের মানুষী
    হতে পেরেছিল প্রায়; নিভে গেছে সব।
    এইখানে নবান্নের স্ত্রাণ ওরা সেদিনও পেয়েছে;
    নতুন চালের রসে রৌদ্রে কতো কাক
    এ-পাড়ার বড়ো মেজো…ও-পাড়ার দুলে বোয়েদের
    ডাকশাখে উড়ে এসে সুধা খেয়ে যেত;
    এখন টু শব্দ নেই সেই সব কাকপাখিদেরও;
    মানুষের হাড় খুলি মানুষের গণনার সংখ্যাধীন নয়;
    সময়ের হাতে অন্তহীন।
    ওখানে চাঁদের রাতে প্ৰান্তরে চাষার নাচ হত
    ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে মাঝি-বাগ্‌দির
    ঈশ্বরী মেয়ের সাথে
    বিবাহের কিছু আগে—বিবাহের কিছু পরে—সন্তানের জন্মাবার আগে।
    সে সব সন্তান আজ এ যুগের কুরাষ্ট্রের মূঢ়
    ক্লান্ত লোকসমাজের ভিড়ে চাপা পড়ে
    মৃতপ্রায়; আজকের এই সব গ্রাম্য সন্ততির
    প্রপিতামহের দল হেসে খেলে ভালোবেসে–অন্ধকারে জমিদারদের
    চিরস্থায়ী ব্যবস্থাকে চড়কের গাছে তুলে ঘুমায়ে গিয়েছে।
    ওরা খুব বেশি ভালো ছিল না; তবুও
    আজকের মন্বন্তর দাঙ্গা দুঃখ নিরক্ষরতায়
    অন্ধ শতচ্ছিন্ন গ্ৰাম্য প্রাণীদের চেয়ে
    পৃথক আর-এক স্পষ্ট জগতের অধিবাসী ছিল।
    আজকে অস্পষ্ট সব? ভালো করে কথা ভাবা এখন কঠিন;
    অন্ধকারে অর্ধসত্য সকলকে জানিয়ে দেবার
    নিয়ম এখন আছে; তারপর এক অন্ধকারে
    বাকি সত্য আঁচ করে নেওয়ার রেওয়াজ
    রয়ে গেছে; সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখে।
    সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়—দ্বেষ।
    সৃষ্টির মনের কথা : আমাদেরই আন্তরিকতাতে
    আমাদেরই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা
    খুঁজে আনা। প্রকৃতির পাহাড়ে পাথরে সমুচ্ছল
    ঝর্নার জল দেখে তারপর হৃদয়ে তাকিয়ে
    দেখেছি প্রথম জল নিহত প্রাণীর রক্তে লাল
    হয়ে আছে বলে বাঘ হরিণের পিছু আজও ধায়;
    মানুষ মেরেছি আমি–তার রক্তে আমার শরীর
    ভরে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার
    ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু
    হৃদয়ে কঠিন হয়ে বধ করে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর
    কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে
    বধ করে ঘুমাতেছি—তাহার অপরিসর বুকের ভিতরে
    মুখ রেখে মনে হয় জীবনের স্নেহশীল ব্ৰতী
    সকলকে আলো দেবে মনে করে অগ্রসর হয়ে
    তবুও কোথাও কোনো আলো নেই বলে ঘুমাতেছে।
    ঘুমাতেছে।
    যদি ডাকি রক্তের নদীর থেকে কল্লোলিত হয়ে
    বলে যাবে কাছে এসে, ‘ইয়াসিন আমি,
    হানিফ মহম্মদ মকবুল করিম আজিজ—
    আর তুমি?’ আমার বুকের ‘পরে হাত রেখে মৃত মুখ থেকে
    চোখ তুলে শুধাবে সে—রক্তনদী উদ্বেলিত হয়ে
    বলে যাবে, গগন, বিপিন, শশী, পাথুরেঘাটার;
    মানিকতলার, শ্যামবাজারের, গ্যালিফ স্ট্রীটের, এন্টালির—’
    কোথাকার কেবা জানে; জীবনের ইতর শ্রেণীর
    মানুষ তো এরা সব; ছেঁড়া জুতো পায়ে
    বাজারের পোকাকাটা জিনিসের কেনাকাটা করে;
    সৃষ্টির অপরিক্লান্ত চারণার বেগে
    এই সব প্রাণকণা জেগেছিল–বিকেলের সূর্যের রশ্মিতে
    সহসা সুন্দর বলে মনে হয়েছিল কোনো উজ্জ্বল চোখের
    মনীষী লোকের কাছে এই সব অণুর মতন
    উদ্ভাসিত পৃথিবীর উপেক্ষিত জীবনগুলোকে।
    সূর্যের আলোর ঢলে রোমাঞ্চিত রেণুর শরীরে
    রেণুর সংঘর্ষে যেই শব্দ জেগে ওঠে
    সেখানে সময় তার অনুপম কণ্ঠের সংগীতে
    কথা বলে; কাকে বলে? ইয়াসিন মকবুল শশী
    সহসা নিকটে এসে কোনো-কিছু বলবার আগে
    আধ-খণ্ড অনন্তের অন্তরের থেকে যেন ঢের
    কথা বলে গিয়েছিল; তবু—
    অনন্ত তো খণ্ড নয়; তাই সেই স্বপ্ন, কাজ, কথা
    অখণ্ড অনন্তে অন্তৰ্হিত হয়ে গেছে;
    কেউ নেই, কিছু নেই–সূর্য নিভে গেছে।
    এ যুগে এখন ঢের কম আলো সব দিকে, তবে।
    আমরা এ পৃথিবীর বহুদিনকার
    কথা কাজ ব্যথা ভুল সংকল্প চিন্তার
    মর্যাদায় গড়া কাহিনীর মূল্য নিংড়ে এখন
    সঞ্চয় করেছি বাক্য শব্দ ভাষা অনুপম বাচনের রীতি।
    মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো
    না পেলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল
    জ্ঞানের নিকট থেকে ঢের দূরে থাকে।
    অনেক বিদ্যার দান উত্তরাধিকারে পেয়ে তবু
    আমাদের এই শতকের
    বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু—বেড়ে যায় শুধু;
    তবুও কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময়
    জ্ঞান নেই আজ এই পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্ৰেম নেই।
    এ-যুগে কোথাও কোনো আলো—কোনো কান্তিময় আলো
    চোখের সুমুখে নেই যাত্রিকের; নেই তো নিঃসৃত অন্ধকার
    রাত্রির মায়ের মতো : মানুষের বিহ্বল দেহের
    সব দোষ প্রক্ষালিত করে দেয়—মানুষের বিহ্বল আত্মাকে
    লোকসমাগমহীন একান্তের অন্ধকারে অন্তঃশীল ক’রে
    তাকে আর শুধায় না–অতীতের শুধানো প্রশ্নের
    উত্তর চায় না আর—শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন
    অন্ধকারে ঘিরে রাখে, সব অপরাধ ক্লান্তি ভয় ভুল পাপ
    বীতকাম হয় যাতে–এ জীবন ধীরে ধীরে বীত শোক হয়,
    স্নিগ্ধতা হৃদয়ে জাগে; যেন দিকচিহ্নময় সমুদ্রের পারে
    বাতাসের প্রিয়কণ্ঠ কাছে আসে–মানুষের রক্তাক্ত আত্মায়
    সে-হাওয়া অনবচ্ছিন্ন সুগমের—মানুষের জীবন নির্মল।
    আজ এই পৃথিবীতে এমন মহানুভব ব্যাপ্ত অন্ধকার
    নেই আর? সুবাতাস গভীরতা পবিত্রতা নেই?
    তবুও মানুষ অন্ধ দুৰ্দশার থেকে স্নিগ্ধ আঁধারের দিকে
    অন্ধকার হতে তার নবীন নগরী গ্রাম উৎসবের পানে
    যে অনবনমনে চলেছে আজও—তার হৃদয়ের
    ভুলের পাপের উৎস অতিক্রম ক’রে চেতনার
    বলয়ের নিজ গুণ রয়ে গেছে বলে মনে হয়।
    পূর্বাশা। কার্তিক ১৩৫৫

    টীকা