প্রমোদ-উদ্যানে কাঁদে দানব-নন্দিনী
    প্রমীলা, পতি-বিরহে কাতরা যুবতী।
    অশ্রুআঁখি-বিধুমুখী ভ্রমে ফুলবনে
    কভু,ব্রজ-কুঞ্জ-বনে,হায়রে, যেমনি
    ব্রজবালা,নাহি হেরি কদম্বের মূলে
    পীতধড়া পীতাম্বরে,অধরে মূরলী।
    অবচয়ি ফুল-চয়ে সে নিকুঞ্জ বনে,
    বিষাদে নিশ্বাস ছাড়ি,সখীরে সম্ভাষি
    কহিলা প্রমীলা সতী; “এইত তুলিনু
    ফুলরাশি; চিকনিয়া গাঁথিনু,স্বজনি,
    ফুলমালা;কিন্তু কোথা পাব সে চরণে,
    পুস্পাঞ্জলি দিয়া যাহে চাহি পূজিবারে;
    কে বাঁধিল মৃগরাজে বুঝিতে না পারি।
    চল,সখি, লঙ্কাপুরে যাই মোরা সবে।”
    কহিল বাসন্তী সখী;–“কেমনে পশিবে
    লঙকাপুরে আজি তুমি? অলঙ্ঘ্য সাগর-
    সম রাঘবীয় চমূ বেড়িছে তাহারে;
    লক্ষ লক্ষ রক্ষঃ- অরি ফিরিছে চৌদিকে
    অস্ত্রপাণি,দন্ডপাণি দন্ডধর যথা”
    রুষিলা দানব-বালা প্রমীলা রূপসী;–
    “কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
    বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
    কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
    দানব-নন্দিনী আমি,রক্ষ-কুল-বধূ;
    রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,–
    আমি কি ডরাই,সখি,ভিখারী রাঘবে?
    পশিব লঙ্কায় আজি নিজ ভূজ-বলে;
    দেখিব কেমনে মোরে নিবারে নৃমনি?
    যথা বায়ু-সখা সহ দাবানল গতি
    দুর্ব্বার,চলিলা সতী পতির উদ্দেশে।
    টলিল কনক-লঙ্কা, গর্জ্জিল জলধি;
    ঘনঘনাকারে রেণু উড়িল চৌদিকে;–
    কিন্তু নিশা-কালে কবে ধূম-পুঞ্জ পারে
    আবরিতে অগ্নি-শিখা? অগ্নিশিখা-তেজে
    চলিলা প্রমীলা দেবী বামা-বল-দলে।
    কতক্ষনে উতরিলা পশ্চিম দুয়ারে
    বিধুমুখী। একবারে শত শঙ্খ ধরি
    ধ্বনিলা, টঙ্কারি রোষে শত ভীম ধনুঃ,
    স্ত্রীবৃন্দ; কাঁপিল লঙকা আতঙ্কে; কাঁপিল
    মাতঙ্গে নিষাদী; রথে রথী; তুরঙ্গমে
    সাদীবর; সিংহাসনে রাজা;অবরোধে
    কুলবধূ; বিহঙ্গম কাঁপিল কুলায়ে;
    পর্ব্বত-গহ্বরে সিংহ ; বন-হস্তী বনে
    ডুবিল অতল জলে জলচর যত ;
    শিবিরে বসেন প্রভু রঘু-চুড়ামণি
    করপুটে শূর-সিংহ লক্ষণ সম্মুখে,
    পাশে বিভীষণ সখা, আর বীর যত,
    রুদ্র-কুল-সমতেজঃ,ভৈরব মুরতি ।
    সহসা নাদিল ঠাট; ‘জয় রাম’-ধ্বনি
    উঠিল আকাশ-দেশে ঘোর কোলাহলে,
    সাগর-কল্লোল যথা;ত্রস্তে রক্ষোরথী,
    দাশরথি-পানে চাহি , কহিলা কেশরী,–
    “চেয়ে দেখ,রাঘবেন্দ্র, শিবির-বাহিরে ।
    নিশীথে কি ঊষা আসি উতরিলা হেথা?”
    বিস্ময়ে চাহিলা সবে শিবির-বাহিরে।
    “ভৈরবীরূপিণী বামা,” কহিলা নৃমণি,
    “দেবী কি দানবী,সখে, দেখ নিরখিয়া ;
    মায়াময় লঙ্কা-ধাম; পূর্ণ ইন্দ্রজালে ;
    কামরূপী তবাগ্রজ। দেখ ভাল করি;
    এ কুহক তব কাছে অবিদিত নহে।
    শুভক্ষণে, রক্ষোবর,পাইনু তোমারে
    আমি। তোমা বিনা,মিত্র,কে আর রাখিবে
    এ দুর্ব্বল বলে,কহ,এ বিপত্তি-কালে?
    রামের চির-রক্ষণ তুমি রক্ষঃপুরে ;”
    হেনকালে হনু সহ উতরিলা দূতী
    শিবিরে। প্রণমি বামা কৃতাঞ্জলিপুটে,
    ( ছত্রিশ রাগিণী যেন মিলি এক তানে; )
    কহিলা; “প্রণমি আমি রাঘবের পদে,
    আর যত গুরুজনে;— নৃ-মুন্ড-মালিনী
    নাম মম;দৈত্যবালা প্রমীলা সুন্দরী,
    বীরেন্দ্র-কেশরী ইন্দ্রজিতের কামিনী,
    তাঁর দাসী।” আশীষিয়া, বীর দাশরথি
    সুধিলা; “কি হেতু,দূতি, গতি হেথা তব?
    বিশেষিয়া কহ মোরে, কি কাজে তুষিব
    তোমার ভর্ত্রিনী,শুভে ? কহ শীঘ্র করি;”
    উত্তরিলা ভীমা-রূপী; “বীর-শ্রেষ্ঠ তুমি,
    রঘুনাথ; আসি যুদ্ধ কর তাঁর সাথে;
    নতুবা ছাড়হ পথ; পশিবে রূপসী
    স্বর্ণলঙ্কাপুরে আজি পূজিতে পতিরে ।”
    এতেক কহিয়া বামা শিরঃ নোয়াইলা,
    প্রফুল্ল কুসুম যথা ( শিশির মন্ডিত )
    বন্দে নোয়াইয়া শিরঃ মন্দ-সমীরণে ;
    উত্তরিলা রঘুপতি ;”শুন, সুকেশিনী,
    বিবাদ না করি আমি কভু অকারণে।
    অরি মম রক্ষ-পতি ;তোমরা সকলে
    কুলবালা,কুলবধূ; কোন অপরাধে
    বৈরি-ভাব আচরিব তোমাদেরসাথে?
    আনন্দে প্রবেশ লঙ্কা নিঃশঙ্ক হৃদয়ে”।
    এতেক কহিয়া প্রভু কহিলা হনুরে;–
    “দেহ ছাড়ি পথ, বলি। অতি সাবধানে,
    শিষ্ট আচরণে তুষ্ট কর বামা-দলে।”
    প্রণমিয়া সীতানাথে বাহিরিলা দূতী
    হাসিয়া কহিলা মিত্র বিভীষণ “দেখ,
    প্রমীলার পরাক্রম দেখ বাহিরিয়া,
    রঘুপতি;দেখ, দেব, অপূর্ব কৌতুক।
    না জানি এ বামা-দলে কে আঁটে সমরে
    ভীমারূপী, বীর্য্যবতী চামুন্ডা যেমতি–
    রক্তবীজ-কুল-অরি?” কহিলা রাঘব;–
    ” চল, মিত্র, দেখি তব ভ্রাতৃ-পুত্র-বধূ।”
    যথা দূর দাবানল পশিলে কাননে,
    অগ্নিময় দশ দিশ ;দেখিলা সম্মুখে
    রাঘবেন্দ্র বিভা-রাশি নির্ধূম আকাশে,
    সুবর্নি বারিদপুঞ্জে ;শুনিলা চমকি
    কোদন্ড-ঘর্ঘর ঘোর,ঘোড়া-দড়বড়ি,
    হুহুঙ্কার,কোষে বদ্ধ অসির ঝনঝনি।
    সে রোলের সহ মিশি বাজিছে বাজনা,
    ঝড় সঙ্গে বহে যেন কাকলী লহরী;
    উড়িছে পতাকা —রত্ন-সঙ্কলিত-আভা;
    মন্দগতি আস্কন্দিতে নাচে বজী রাজী;
    বোলিছে ঘুঙ্ঘুরাবলী ঘুনু ঘুনু বোলে।
    গিরিচূড়াকৃতি ঠাট দাঁড়ায় দুপাশে
    অটল,চলিছে মধ্যে বামা-কুল-দল;
    উপত্যকা-পথে যথা মাতঙ্গিনী-যূথ,
    গরজে পূরিয়া দেশ, ক্ষিতি টলমলি।
    সর্ব-অগ্রে উগ্রচন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী,
    কৃষ্ণ-হয়ারূঢ়া ধনী, ধ্বজ-দন্ড করে
    হৈমময় ; তার পাছে চলে বাদ্যকরী,
    বিদ্যাধরী-দল যথা, হায় রে ভূতলে
    অতুলিত; বীণা বাঁশী, মৃদঙ্গ, মন্দিরা-
    আদি যন্ত্র বাজে মিলি মধুর নিক্কণে;
    তার পাছে শূল-পাণি বীরাঙ্গনা-মাঝে
    প্রমীলা,তারার দলে শশিকলা যথা;
    চলি গেলা বামাকুল। কেহ টঙ্কারিলা
    শিঞ্জিনী; হুঙ্কারি কেহ উলঙ্গিলা অসি;
    আস্ফালিলা শূলে কেহ ;হাসিলা কেহ বা
    অট্টহাসে টিটকারি ;কেহ বা নাদিলা,
    গহন বিপিনে যথা নাদে কেশরিণী,
    বীর-মদে, কাম-মদে উন্মাদ ভৈরবী;
    লক্ষ্য করি রক্ষোবরে ,কহিলা রাঘব;–
    ” কি আশ্চর্য্য, নৈকষেয়? কভু নাহি দেখি,
    কভু নাহি শুনি হেন এ তিন ভুবনে;
    নিশার স্বপন আজি দেখিনু কি জাগি?”
    উত্তরিলা বিভীষণ; ” নিশার স্বপন
    নহে এ,বৈদেহী-নাথ,কহিনু তোমারে।
    কালনেমি নামে দৈত্য বিখ্যাত জগতে
    সুরারি,তনয়া তার প্রমীলা সুন্দরী ।
    মহাশক্তি-সম তেজে;দম্ভোলি-নিক্ষেপী
    সহস্রাক্ষে যে হর্ষ্যক্ষ বিমুখে সংগ্রামে,
    সে রক্ষেন্দ্রে,রাঘবেন্দ্র,রাখে পদতলে
    বিমোহিনী,দিগম্বরী যথা দিগম্বরে;”
    লঙ্কার কনক-দ্বারে উতরিলা সতী
    প্রমীলা। বাজিল শিঙ্গা,বাজিল দুন্দুভি
    ঘোর রবে;গরজিল ভীষণ রাক্ষস,
    প্রলয়ের মেঘ কিম্বা করীযুথ যথা;
    উচ্চৈস্বরে কহে চন্ডা নৃ-মুন্ডমালিনী;—
    ” কাহারে হানিস্ অস্ত্র,ভীরু,এ আঁধারে ?
    নহি রক্ষোরিপু মোরা, রক্ষঃ-কুল-বধূ,
    খুলি চক্ষুঃ দেখ চেয়ে।” অমনি দুয়ারী
    টানিল হুড়ুকা ধরি হুড় হুড় হড়ে ;
    বজ্রশব্দে খুলে দ্বার। পশিলা সুন্দরী
    আনন্দে কনক লঙ্কা জয় জয় রবে ।

    টীকা