অস্তে গেল দিনমণি; আইলা গোধূলি,—একটি রতন ভালে। ফুটিলা কুমুদী;মুদিলা সরসে আঁখি বিরসবদনানলিনী; কূজনি পাখী পশিল কুলায়ে;গোষ্ঠ-গৃহে গাভী-বৃন্দ ধায় হাম্বা রবে।আইলা সুচারু-তারা শশী সহ হাসি,শর্বরী; সুগন্ধবহ বহিল চৌদিকে,সুস্বনে সবার কাছে কহিয়া বিলাসী,কোন্ কোন্ ফুল চুষি কি ধন পাইলা।আইলেন নিদ্রা দেবী; ক্লান্ত শিশুকুলজননীর ক্রোড়-নীড়ে লভয়ে যেমতিবিরাম, ভূচর সহ জলচর-আদিদেবীর চরণাশ্রমে বিশ্রাম লভিলা।

    উতরিলা শশিপ্রিয়া ত্রিদশ-আলয়ে।বসিলেন দেবপতি দেবসভা মাঝে,হৈমাসনে; বামে দেবী পুলোম-নন্দিনীচারুনেত্রা। রজ-ছত্র, মণিময় আভা,শোভিল দেবেন্দ্র-শিরে। রতনে খচিতচামর যতনে ধরি, ঢুলায় চামরী।আইলা সুসমীরণ, নন্দন-কানন-গন্ধমধু বহি রঙ্গে। বাজিল চৌদিকেত্রিদিব-বাদিত্র। ছয় রাগ, মূর্তিমতীছত্রিশ রাগিণী সহ, আসি আরম্ভিলাসঙ্গীত। ঊর্বশী, রম্ভা সুচারুহাসিনী,চিত্রলেখা, সুকেশিনী মিশ্রকেশী, আসিনাচিলা, শিঞ্জিতে রঞ্জি দেব-কুল-মনঃ!যোগায় গন্ধর্ব স্বর্ণ-পাত্রে সুধারসে!কেহ বা দেব-ওদন; কুঙ্কুম, কস্তুরী,কেশর বহিছে কেহ; চন্দন কেহ বা;সুগন্ধ মন্দার-দাম গাঁথি আনে কেহ।বৈজয়ন্ত-ধামে সুখে ভাসেন বাসবত্রিদিব-নিবাসী সহ; হেন কালে তথা,রূপের আভায় আলো করি সুর-পুরীরক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী আসি উতরিলা।

    সসম্ভ্রমে প্রণমিলা রমার চরণেশচীকান্ত। আশীষিয়া হৈমাসনে বসি,পদ্মাক্ষী পুণ্ডরীকাক্ষ-বক্ষোনিবাসিনীকহিলা; “হে সুরপতি, কেন যে আইনুতোমার সভায় আজি, শুন মন দিয়া।”

    উত্তর করিলা ইন্দ্র; “হে বারীন্দ্র-সুতে,বিশ্বরমে, এ বিশ্বে ও রাঙা পা দুখানিবিশ্বের আকাঙ্খা মা গো! যার প্রতি তুমি,কৃপা করি, কৃপা-দৃষ্টি কর, কৃপাময়ি,সফল জনম তারি! কোন্ পুণ্য-ফলে,লভিল এ সুখ দাস, কহ, মা দাসেরে?”

    কহিলেন পুনঃ রমা, “বহুকালাবধিআছি আমি, সুরনিধি, স্বর্ণ-লঙ্কাধামে।পূজে মোরে রক্ষোরাজ! হায়, এত দিনেবাম তার প্রতি বিধি! নিজ কর্ম-দোষে,মজিছে সবংশে পাপী; তবুও তাহারেনা পারি ছাড়িতে, দেব। বন্দী যে, দেবেন্দ্র,কারাগার-দ্বার নাহি খুলিলে কি কভুপারে সে বাহির হতে? যত দিন বাঁচেরাবণ, থাকিব আমি বাঁধা তার ঘরে।মেঘনাদ নামে পুত্র, হে বৃত্রবিজয়ি,রাবণের, বিলক্ষণ জান তুমি তারে।একমাত্র বীর সেই আছে লঙ্কাধামেএবে; আর বীর যত, হত এ সমরে।বিক্রম-কেশরী শূর আক্রমিবে কালিরামচন্দ্রে; পুনঃ তারে সেনাপতি-পদেবরিয়াছে দশানন। দেব-কুল-প্রিয়রাঘব; কেমনে তারে রাখিবে, তা দেখ।নিকুম্ভিলা যজ্ঞ সাঙ্গ করি, আরম্ভিলেযুদ্ধ দম্ভী মেঘনাদ, বিষম সঙ্কটেঠেকিবে বৈদেহীনাথ, কহিনু তোমারে।অজেয় জগতে মন্দোদরীর নন্দন,দেবেন্দ্র! বিহঙ্গকুলে বৈনতেয় যথাবল-জ্যেষ্ঠ, রক্ষঃ-কুল-শ্রেষ্ঠ শূরমণি!”

    এতেক কহিয়া রমা কেশব-বাসনানীরবিলা; আহা মরি, নীরবে যেমতিবীণা, চিত্ত বিনোদিয়া সুমধুর নাদে!ছয় রাগ, ছত্রিশ রাগিণী আদি যত,শুনি কমলার বাণী, ভুলিলা সকলেস্বকর্ম; বসন্তকালে পাখীকুল যথা,মুঞ্জরিত কুঞ্জে, শুনি পিকবর-ধ্বনি!

    কহিলেন স্বরীশ্বর; “এ ঘোর বিপদে,বিশ্বনাথ বিনা, মাতঃ, কে আর রাখিবেরাঘবে? দুর্বার রণে রাবণ-নন্দন।পন্নগ-অশনে নাগ নাহি ডরে যত,ততোধিক ডরি তারে আমি! এ দম্ভোলি,বৃত্রাসুর-শিরঃ চূর্ণ যাহে, বিমুখয়েঅস্ত্র-বলে মহাবলী; তেঁই এ জগতেইন্দ্রজিৎ নাম তার। সর্বশুচি-বরেসর্বজয়ী বীরবর। দেহ আজ্ঞা দাসে,যাই আমি শীঘ্রগতি কৈলাস-সদনে।”

    কহিলা উপেন্দ্র-প্রিয়া বারীন্দ্রনন্দিনী;—“যাও তবে সুরনাথ, যাও ত্বরা করি।চন্দ্র-শেখরের পদে, কৈলাস-শিখরে,নিবেদন কর, দেব, এ সব বারতা।কহিও সতত কাঁদে বসুন্ধরা সতী,না পারি সহিতে ভার; কহিও, অনন্ত,ক্লান্ত এবে। না হইলে নির্মূল সমূলেরক্ষঃপতি, ভবতল রসাতলে যাবে!বড় ভাল বিরূপাক্ষ বাসেন লক্ষ্মীরে।কহিও, বৈকুণ্ঠপুরী বহু দিন ছাড়িআছয়ে সে লঙ্কাপুরে! কত যে বিরলেভাবয়ে সে অবিরল, এক বার তিনি,কি দোষ দেখিয়া, তারে না ভাবেন মনে?কোন্ পিতা দুহিতারে পতি-গৃহ হতেরাখে দূরে — জিজ্ঞাসিও, বিজ্ঞ জটাধরে!ত্র্যম্বকে না পাও যদি, অম্বিকার পদেকহিও এ সব কথা।” — এতেক কহিয়া,বিদায় হইয়া চলি গেলা শশিমুখীহরিপ্রিয়া। অনম্বর-পথে সুকেশিনী,কেশব-বাসনা দেবী গেলা অধোদেশে।সোনার প্রতিমা, যথা! বিমল সলিলেডুবে তলে জলরাশি উজলি স্বতেজে!

    আনিলা মাতলি রথ, চাহি শচী পানেকহিলেন শচীকান্ত মধুর বচনেএকান্তে; “চলহ, দেবি, মোর সঙ্গে তুমি।পরিমল-সুধা সহ পবন বহিলে,দ্বিগুণ আদর তার! মৃণালের রুচিবিকচ কমল-গুণে, শুন লো ললনে।”শুনি প্রণয়ীর বাণী, হাসি নিতম্বিনী,ধরিয়া পতির কর, আরোহিলা রথে।

    স্বর্গ-হৈম-দ্বারে রথ উতরিল ত্বরা।আপনি খুলিল দ্বার মধুর নিনাদেঅমনি! বাহিরি বেগে, শোভিল আকাশে।দেবযান, সচকিতে জগত জাগিলা,ভাবি রবিদেব বুঝি উদয়-অচলেউদিলা! ডাকিলা ফিঙা, আর পাখী যতপূরিল নিকুঞ্জ-পুঞ্জ প্রভাতী সঙ্গীতে!বাসরে কুসুম-শয্যা ত্যজি লজ্জাশীলাকুলবধূ, গৃহ কার্য উঠিলা সাধিতে!

    মানস-সকাশে শোভে কৈলাস শিখরীআভাময়, তার শিরে ভবের ভবন।শিখী-পুচ্ছ-চূড়া যেন মাধবের শিরে।সুশ্যামাঙ্গ শৃঙ্গধর, স্বর্ণ-ফুল-শ্রেণীশোভে তাহে, আহা মরি পীত ধড়া যেন।নির্ঝর-ঝরিত-বারি-রাশি স্থানে স্থানে-বিশদ চন্দনে যেন চর্চিত সে বপু!

    ত্যজি রথ, পদব্রজে, সহ স্বরীশ্বরী,প্রবেশিলা স্বরীশ্বর আনন্দ-ভবনে।রাজরাজেশ্বরী-রূপে বসেন ঈশ্বরীস্বর্ণাসনে, ঢুলাইছে চামর বিজয়া,ধরে রাজছত্র জয়া। হায় রে, কেমনে,ভবভবনের কবি বর্ণিবে বিভব?দেখ, হে ভাবুক জন, ভাবি মনে মনে!পূজিলা শক্তির পদ মহাভক্তি ভাবেমহেন্দ্র ইন্দ্রাণী সহ। আশীষি অম্বিকাজিজ্ঞাসিলা;— “কহ, দেব, কুশল বারতা,—কি কারণে হেথা আজি তোমা দুই জনে?”

    কর-জোড়ে আরম্ভিলা দম্ভোলি-নিক্ষেপী;—“কি না তুমি জান, মাতঃ, অখিল জগতে?দেবদ্রোহী লঙ্কাপতি, আকুল বিগ্রহে,বরিয়াছে পুনঃ পুত্র মেঘনাদে আজিসেনাপতি-পদে? কালি প্রভাতে কুমারপরন্তপ প্রবেশিবে রণে, ইষ্টদেবেপূজি, মনোনীত বর লভি তার কাছে।অবিদিত নহে মাতঃ, তার পরাক্রম।রক্ষঃ-কুল-রাজলক্ষ্মী, বৈজয়ন্ত-ধামেআসি, এ সংবাদ দাসে দিলা, ভগবতী।কহিলেন হরিপ্রিয়া, কাঁদে বসুন্ধরা,এ অসহ ভার সতী না পারি সহিতে;ক্লান্ত বিশ্বধর শেষ; তিনিও আপনিচঞ্চলা সতত এবে ছাড়িতে কনক-লঙ্কাপুরী। তব পদে এ সংবাদ দেবীআদেশিলা নিবেদিতে দাসেরে, অন্নদে!দেব-কুল-প্রিয় বীর রঘু-কুল-মণি।কিন্তু দেবকুলে হেন আছে কোন্ রথীযুঝিবে যে রণ-ভূমে রাবণির সাথে?বিশ্বনাশী কুলিশে, মা, নিস্তেজে সমরেরাক্ষস, জগতে খ্যাত ইন্দ্রজিৎ নামে!কি উপায়ে, কাত্যায়নি, রক্ষিবে রাঘবে,দেখ ভাবি। তুমি কৃপা না করিলে, কালিঅরাম করিবে ভব দুরন্ত রাবণি।”

    উত্তরিলা কাত্যায়নী;— “শৈব-কুলোত্তমনৈকষেয়, মহা স্নেহ করেন ত্রিশূলীতার প্রতি, তার মন্দ, হে সুরেন্দ্র, কভুসম্ভবে কি মোর হতে? তবে মগ্ন এবেতাপসেন্দ্র, তেঁই, দেব, লঙ্কার এ গতি।”

    কৃতাঞ্জলি-পুটে পুনঃ বাসব কহিলা;—“পরম-অধর্মাচরী নিশাচর-পতি—দেব-দ্রোহী! আপনি, যে নগেন্দ্র-নন্দিনি,দেখ বিবেচনা করি। দরিদ্রের ধনহরে যে দুর্মতি, তব কৃপা তার প্রতিকভু কি উচিত, মাতঃ? সুশীল রাঘব,পিতৃ-সত্য-রক্ষা-হেতু, সুখ-ভোগ ত্যজিপশিল ভিখারী-বেশে নিবিড় কাননে।একটি রতনমাত্র তাহার আছিলঅমূল; যতন কত করিত সে তারে,কি আর কহিবে দাস? সে রতন, পাতিমায়াজাল, হরে দুষ্ট, হায়, মা, স্মরিলেকোপানলে দহে মনঃ! ত্রিশূলীর বরেবলী রক্ষঃ, তৃণ-জ্ঞান করে দেব-গণে!পর-ধন, পর-দার লোভে সদা লোভীপামর। তবে যে কেন (বুঝিতে না পারি)হেন মূঢ়ে দয়া কর, দয়াময়ি?”

    নীরবিলা স্বরীশ্বর; কহিতে লাগিলাবিণাবাণী স্বরীশ্বরী; কহিতে লাগিলা“বৈদেহীর দুঃখে দেবি, কার না বিদরেহৃদয়? অশোক-বনে বসি দিবা নিশি(কুঞ্জবন-সখী পাখী পিঞ্জরে যেমতি)কাঁদেন রূপসী শোকে! কি মনোবেদনাসহেন বিধুবদনা পতির বিহনে,ও রাঙা চরণে, মাতঃ, অবিদিত নহে।আপনি না দিলে দণ্ড, কে দণ্ডিবে, দেবি,এ পাষণ্ড রক্ষোনাথে? নাশি মেঘনাদে,দেহ বৈদেহীরে পুনঃ বৈদেহীরঞ্জনে;দাসীর কলঙ্ক ভঞ্জ, শশাঙ্কধারিণি!মরি, মা, শরমে আমি, শুনি লোকমুখে,ত্রিদিব-ঈশ্বরে রক্ষঃ পরাভবে রণে।”

    হাসিয়া কহিলা উমা; “রাবণের প্রতিদ্বেষ তব, জিষ্ণু! তুমি, হে মঞ্জুনাশিনীশচি, তুমি ব্যগ্র ইন্দ্রজিতের নিধনে।দুই জন অনুরোধ করিছ আমারেনাশিতে কনক-লঙ্কা। মোর সাধ্য নহেসাধিতে এ কার্য। বিরূপাক্ষের রক্ষিতরক্ষঃকুল; তিনি বিনা তব এ বাসনা,বাসব, কে পারে, কহ, পূর্ণিতে জগতে?যোগে মগ্ন, দেবরাজ, বৃষধ্বজ আজি।যোগাসন নামে শৃঙ্গ, মহাভয়ঙ্কর,ঘন ঘনাবৃত, তথা বসেন বিরলেযোগীন্দ্র। কেমনে যাবে তাঁহার সমীপে?পক্ষীন্দ্র গরুড় সেথা উড়িতে অক্ষম!”

    কহিলা বিনত-ভাবে অদিতিনন্দন;—“তোমা বিনা কার শক্তি, হে মুক্তি-দায়িনিজগদম্বে, যায় যে সে যথা ত্রিপুরারিভৈরব? বিনাশি, দেবি, রক্ষঃকুল, রাখত্রিভুবন; বৃদ্ধি কর ধর্মের মহিমা,হ্রাসো বসুধার ভার, বসুন্ধরাধরবাসুকিরে কর স্থির; বাঁচাও রাঘবে।”এইরূপে দৈত্য-রিপু স্তুতিলা সতীরে।

    হেন কালে গন্ধামোদে সহসা পূরিলপুরী; শঙ্খঘণ্টাধ্বনি বাজিল চৌদিকেমঙ্গল নিক্কণ সহ, মৃদু যথা যবেদূর কুঞ্জবনে গাহে পিককুল মিলি!টলিল কনকাসন! বিজয়া সখীরেসম্ভাষিয়া মধুস্বরে, ভবেশ-ভাবিনীশুধিলা, “লো বিধুমুখি, কহ শীঘ্র করি,কে কোথা, কি হেতু মোরে পূজিছে অকালে?”

    মন্ত্র পড়ি, খড়ি পাতি, গণিয়া গণনে,নিবেদিলা হাসি সখী; “হে নগনন্দিনি,দাশরথি রথী তোমা পূজে লঙ্কাপুরে।বারি-সংঘটিত-ঘটে, সুসিন্দূরে আঁকিও সুন্দর পদযুগ, পূজে রঘুপতি,নীলোৎপলাঞ্জলি দিয়া, দেখিনু গণনে।অভয়-প্রদান তারে কর গো, অভয়ে।পরম ভকত তব কৌশল্যা-নন্দনরঘুশ্রেষ্ঠ; তার তারে বিপদে, তারিণি!”

    কাঞ্চন-আসন ত্যজি, রাজরাজেশ্বরীউঠিয়া, কহিল পুনঃ বিজয়ারে সতী;—“দেব-দম্পতিরে তুমি সেব যথা বিধি,বিজয়ে। যাইব আমি যথা যোগাসনে(বিকটশিখর।) এবে বসেন ধূর্জটি।”

    এতেক কহিয়া দুর্গা দ্বিরদ-গামিনীপ্রবেশিলা হৈম গেহে। দেবেন্দ্র বাসবেত্রিদিব-মহিষী সহ, সম্ভাষি আদরে,স্বর্ণাসনে বসাইলা বিজয়া সুন্দরী।পাইলা প্রসাদ দোঁহে পরম-আহ্লাদে।শচীর গলায় জয়া হাসি দোলাইলাতারাকারা ফুলমালা, কবরী-বন্ধনেবসাইলা চিররুচি, চির-বিকচিতকুসুম-রতন-রাজী, বাজিল চৌদিকেযন্ত্রদল, বামাদল গাইল নাচিয়ামোহিল কৈলাসপুরী, ত্রিলোক মোহিল!স্বপনে শুনিয়া শিশু সে মধুর ধ্বনি,হাসিল মায়ের কোলে, মুদিত নয়ন!নিদ্রাহীন বিরহিণী চমকি উঠিলা,ভাবি প্রিয়-পদ-শব্দ শুনিলা ললনাদুয়ারে। কোকিলকুল নীরবিল বনে।উঠিলেন যোগীব্রজ, ভাবি ইষ্টদেব,বর মাগ বলি, আসি দরশন দিলা!

    প্রবেশি সুবর্ণ-গেহে, ভবেশ-ভাবিনীভাবিলা, “কি ভাবে আজি ভেটিব ভবেশে?”ক্ষণ কাল চিন্তি সতী চিন্তিলা রতিরে।যথায় মন্মথ-সাথে, মন্মথ-মোহিনীবরাননা, কুঞ্জবনে বিহারিতেছিলা,তথায় উমার ইচ্ছা, পরিমলময়-বায়ু তরঙ্গিণী-রূপে বহিল নিমিষে।নাচিল রতির হিয়া বীণা-তার যথাঅঙ্গুলির পরশনে। গেলা কামবধূ,দ্রুতগতি বায়ুপথে, কৈলাস-শিখরে।সরসে নিশান্তে যথা ফুটি, সরোজিনীনমে ত্বিষাম্পতি-দূতী ঊষার চরণে,নমিলা মদন-প্রিয়া হরপ্রিয়া-পদে।আশিষি রতিরে, হাসি কহিলা অম্বিকা,—“যোগাসনে তপে মগ্ন যোগীন্দর, কেমনে,কোন্ রঙ্গে, ভগ্ন করি তাঁহার সমাধি,কহ মোরে, বিধুমুখি?” উত্তরিলা নমিসুকেশিনী,— “ধর, দেবি, মোহিনী মূরতি।দেহ আজ্ঞা, সাজাই ও বর বপুঃ, আনিনানা আভরণ, হেরি যে সবে, পিনাকীভুলিবেন, ভুলে যথা ঋতুপতি, হেরিমধুকালে বনস্থলী কুসুম-কুন্তলা!

    এতেক কহিয়া রতি, সুবাসিল তেলেমাজি চুল, বিনানিলা মনোহর বেণী।যোগাইলা আনি ধনী বিবিধ ভূষণে,হীরক, মুকুতা, মণি-খচিত, আনিলাচন্দন, কেশর সহ কুঙ্কুম, কস্তুরী;রত্ন-সঙ্কলিত-আভা কৌষেয় বসনে।লাক্ষারসে পা’দুখানি চিত্রিলা হরষেচারুনেত্রা। ধরি মূর্তি ভুবনমোহিনী,সাজিলা নগেন্দ্র-বালা, রসানে মার্জিতহেম-কান্তি-সম কান্তি দ্বিগুণ শোভিল।হেরিলা দর্পণে দেবী ও চন্দ্র-আননে,প্রফুল্ল নলিনী যথা বিমল সলিলেনিজ-বিকচিত-রুচি। হাসিয়া কহিলা,চাহি স্মর-হর-প্রিয়া স্মর-প্রিয়া পানে;—“ডাক তব প্রাণনাথে।” অমনি ডাকিলা(পিককুলেশ্বরী যথা ডাকে ঋতুবরে!)মদনে মদন-বাঞ্ছা। আইলা ধাইয়াফুল-ধনুঃ, আসে যথা প্রবাসে প্রবাসী,স্বদেশ-সঙ্গীত-ধ্বনি শুনি রে উল্লাসে!

    কহিলা শৈলেশসুতা; “চল মোর সাথে,হে মন্মথ, যাব আমি যথা যোগীপতিযোগে মগ্ন এবে; বাছা, চল ত্বরা করি।”

    অভয়ার পদতলে মায়ার নন্দন,মদন আনন্দময়, উত্তরিলা ভয়ে,—“হেন আজ্ঞা কেন, দেবি, কর এ দাসেরে?স্মরিলে পূর্বের কথা, মরি, মা, তরাসে!মূঢ় দক্ষ-দোষে যবে দেহ ছাড়ি, সতিহিমাদ্রির গৃহে জন্ম গ্রহিলা আপনি,তোমার বিরহ-শোকে বিশ্ব-ভার ত্যজিবিশ্বনাথ, আরম্ভিলা ধ্যান, দেবপতিইন্দ্র আদেশিলা দাসে সে ধ্যান ভাঙিতে,কুলগ্নে গেনু, মা, যথা মগ্ন বামদেবতপে; ধরি ফুল-ধনুঃ, হানিনু কুক্ষণেফুল-শর। যথা সিংহ সহসা আক্রমেগজরাজে, পূরি বন ভীষণ গর্জনে,গ্রাসিলা দাসেরে আসি রোষে বিভাবসু,বাস যাঁর, ভবেশ্বরি, ভবেশ্বর-ভালে।হায়, মা, কত যে জ্বালা সহিনু, কেমনেনিবেদি ও রাঙা পায়ে? হাহাকার রবে,ডাকিনু বাসবে, চন্দ্রে, পবনে, তপনে;কেহ না আইল; ভস্ম হইনু সত্বরে!—ভয়ে ভগ্নোদ্যম আমি ভাবিয়া ভবেশে;—ক্ষম দাসে, ক্ষেমঙ্করি! এ মিনতি পদে!”

    আশ্বাসি মদনে, হাসি কহিলা শঙ্করী;—“চল রঙ্গে মোর সঙ্গে নির্ভয় হৃদয়ে,অনঙ্গ। আমার বরে চিরজয়ী তুমি!যে অগ্নি কুলগ্নে তোমা পাইয়া স্বতেজেজ্বালাইল, পূজা তব করিবে সে আজি,ঔষধের গুণ ধরি, প্রাণ-নাশ-কারীবিষ যথা রক্ষে প্রাণ বিদ্যার কৌশলে!”

    প্রণমিয়া কাম তবে উমার চরণে,কহিলা, “অভয় দান কর যারে তুমি,অভয়ে, কি ভয় তার এ তিন ভুবনে?কিন্তু নিবেদন করি ও কমল-পদে;—কেমনে মন্দির হতে, নগেন্দ্র-নন্দিনি,বাহিরিবা, কহ দাসে, এ মোহিনী-বেশে?মুহূর্তে মাতিবে, মাতঃ, জগৎ, হেরিলেও রূপ-মাধুরী, সত্য কহিনু তোমারে।হিতে বিপরীত, দেবি, সত্বরে ঘটিবে।সুরাসুর-বৃন্দ যবে মথি জলনাথে,লভিলা অমৃত, দুষ্ট দিতিসুত যতবিবাদিল দেব সহ সুধামধু-হেতু।মোহিনী মূরতি ধরি আইলা শ্রীপতি।ছদ্মবেশী হৃষীকেশে ত্রিভুবন হেরি,হারাইলা জ্ঞান সবে এ দাসের শরে!অধর-অমৃত আশে ভুলিল অমৃতদেব-দৈত্য, নাগদল নম্রশিরঃ লাজে,হেরি পৃষ্ঠদেশে বেণী, মন্দর আপনিঅচল হইল হেরি উচ্চ কুচ-যুগে!স্মরিলে সে কথা, সতি, হাসি আসে মুখে।মলম্বা অম্বরে তাম্র এত শোভা যদিধরে, দেবি, ভাবি দেখ বিশুদ্ধ কাঞ্চন-কান্তি কত মনোহর!” অমনি অম্বিকা,সুবর্ণ বরণ ঘন মায়ায় সৃজিয়া,মায়াময়ী, আবরিলা চারু অবয়বে।হায় রে, নলিনী যেন দিবা-অবসানেঢাকিল বদনশশী! কিম্বা অগ্নিশিখা,ভস্মরাশি মাঝে পশি, হাসি লুকাইলা!কিম্বা সুধা-ধন যেন, চক্র-প্রসরণে,বেড়িলেন দেব শত্রু সুধাংশু-মণ্ডলে!

    দ্বিরদ-রদ-নির্মিত গৃহদ্বার দিয়াবাহিরিলা সুহাসিনী, মেঘাবৃতা যেনঊষা! সাথে মন্মথ, হাতে ফুল-ধনুঃ,পৃষ্ঠে তূণ, খরতর ফুল-শরে ভরা-কণ্টকময় মৃণালে ফুটিল নলিনী।

    কৈলাস-শিখরি-শিরে ভীষণ শিখরভৃগুমান্, যোগাসন নামেতে বিখ্যাতভুবনে; তথায় দেবী ভুবন-মোহিনীউতরিলা গজগতি। অমনি চৌদিকেগভীর গহ্বরে বদ্ধ, ভৈরব নিনাদীজলদল নীরবিলা জল-কান্ত যথাশান্ত শান্তিসমাগমে, পলাইল দূরেমেঘদল, তমঃ যথা ঊষার হসনে!দেখিলা সম্মুখে দেবী কপর্দী তপসী,বিভূতি-ভূষিত দেহ, মুদিত নয়ন,তপের সাগরে মগ্ন, বাহ্য-জ্ঞান-হত।

    কহিলা মদনে হাসি সুচারুহাসিনী;—“কি কাজ বিলম্বে আর, হে শম্বর-অরি?হান তব ফুল-শর।” দেবীর আদেশেহাঁটু পাড়ি মীনধ্বজ, শিঞ্জিনী টঙ্কারি,সম্মোহন-শরে শূর বিঁধিলা উমেশে!শিহরিলা শূলপাণি! লড়িল মস্তকেজটাজূট তরুরাজী যথা গিরিশিরে।ঘোর মড় মড় রবে লড়ে ভূকম্পনে।অধীর হইলা প্রভু! গরজিলা ভালেচিত্রভানু, ধকধকি উজ্জ্বল জ্বলনে!

    ভয়াকুল ফুল-ধনুঃ পশিলা অমনিভবানীর বক্ষঃ-স্থলে, পশয়ে যেমতিকেশরী-কিশোর ত্রাসে, কেশরিণী-কোলে,গম্ভীর নির্ঘোষে ঘোষে ঘনদল যবে,বিজলী ঝলসে আঁখি কালানল তেজে!উন্মীলি নয়ন এবে উঠিলা ধূর্জটি।মায়া-ঘন-আবরণ ত্যজিলা গিরিজা।

    মোহিত মোহিনীরূপে, কহিলা হরষেপশুপতি, “কেন হেথা একাকিনী দেখি,এ বিজন স্থলে, তোমা, গণেন্দ্রজননি?কোথায় মৃগেন্দ্র তব কিঙ্কর, শঙ্করি?কোথায় বিজয়া, জয়া?” হাসি উত্তরিলাসুচারুহাসিনী উমা, “এ দাসীরে, ভুলি,হে যোগীন্দ্র, বহু দিন আছ এ বিরলে;তেঁই আসিয়াছি, নাথ, দরশন-আশেপা দুখানি। যে রমণী পতি পরায়ণা,সহচরী সহ সে কি যায় পতি-পাশে?একাকী প্রত্যূষে, প্রভু, যায় চক্রবাকীযথা প্রাণকান্ত তার!” আদরে ঈশান,ঈষৎ হাসিয়া দেব, অজিন-আসনেবসাইলা ঈশানীরে। অমনি চৌদিকেপ্রফুল্লিল ফুলকুল; মকরন্দ-লোভেমাতি শিলীমুখবৃন্দ আইল ধাইয়া;বহিল মলয়-বায়ু, গাইল কোকিল;নিশার শিশিরে ধৌত কুসুম-আসারআচ্ছাদিল শৃঙ্গবরে। উমার উরসে(কি আর আছে রে বাসা সাজে মনসিজেইহা হতে!) কুসুমেষু, বসি কুতূহলে,হানিলা, কুসুম-ধনুঃ টঙ্কারি কৌতুকেশর-জাল;— প্রেমামোদে মাতিলা ত্রিশূলী!লজ্জা-বেশে রাহু আসি গ্রাসিল চাঁদেরে,হাসি ভস্মে লুকাইলা দেব বিভাবসু!

    মোহন মূরতি ধরি, মোহি মোহিনীরেকহিলা হাসিয়া দেব; “জানি আমি, দেবি,তোমার মনের কথা,— বাসব কি হেতুশচী সহ আসিয়াছে কৈলাস-সদনে,কেন বা অকালে তোমা পূজে রঘুমণি?পরম ভকত মম নিকষানন্দন;কিন্তু নিজ কর্ম-ফলে মজে দুষ্টমতি।বিদরে হৃদয় মম স্মরিলে সে কথা,মহেশ্বরি! হায়, দেবি, দেবে কি মানবে,কোথা হেন সাধ্য রোধে প্রাক্তনের গতি?পাঠাও কামেরে, উমা, দেবেন্দ্র সমীপে।সত্বরে যাইতে তারে আদেশ, মহেশি,মায়াদেবি-নিকেতনে। মায়ার প্রসাদে,বধিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।”

    চলি গেলা মীনধ্বজ, নীড় ছাড়ি উড়েবিহঙ্গম-রাজ যথা, মুহূর্মুহূ চাহিসে সুখ-সদন পানে! ঘন রাশি রাশিস্বর্ণবর্ণ, সুবাসিত বাস শ্বাসি ঘন,বরষি প্রসূনাসার—কমল, কুমুদী,মালতী, সেঁউতি, জাতি, পারিজাত-আদিমন্দ-সমীরণ-প্রিয়া—ঘিরিল চৌদিকেদেবদেব মহাদেবে মহাদেবী সহ।

    দ্বিরদ-রদ-নির্মিত হৈমময় দ্বারেদাঁড়াইলা বিধুমুখী মদন-মোহিনী,অশ্রুময় আঁখি, আহা! পতির বিহনে!হেন কালে মধু-সখা উতরিল তথা।অমনি পসারি বাহু, উল্লাসে মন্মথআলিঙ্গন-পাশে বাঁধি, তুষিলা ললনেপ্রেমালাপে। শুখাইল অশ্রুবিন্দু, যথাশিশির-নীরের বিন্দু শতদল-দলে,দরশন দিলে ভানু উদয়-শিখরে।পাই প্রাণ-ধনে ধনী, মুখে মুখ দিয়া,(সরস বসন্তকালে সারী শুক যথা)কহিলেন প্রিয়-ভাষে; “বাঁচালে দাসীরেআশু আসি তার পাশে, হে রতি-রঞ্জন!কত যে ভাবিতেছিনু, কহিব কাহারে?বামদেব নামে, নাথ, সদা, কাঁপি আমি,স্মরি পূর্ব-কথা যত! দুরন্ত হিংসকশূলপাণি! যেও না গো আর তাঁর কাছে,মোর কিরে প্রাণেশ্বর!” সুমধুর হাসেউত্তরিলা পঞ্চশর; “ছায়ার আশ্রমে,কে কবে ভাস্কর-করে ডরায়, সুন্দরি!চল এবে যাই যথা দেবকুল-পতি।”

    সুবর্ণ-আসনে যথা বসেন বাসব,উতরি মন্মথ তথা, নিবেদিলা নমিবারতা। আরোহি রথে দেবরাজ রথীচলি গেলা দ্রুতগতি মায়ার সদনে।অগ্নিময় তেজঃ বাজী ধাইল অম্বরে,অকম্প চামর শিরে; গম্ভীর নির্ঘোষেঘোষিল রথের চক্র, চূর্ণি মেঘদলে।

    কত ক্ষণে সহস্রাক্ষ উতরিলা বলীযথা বিরাজেন মায়া। ত্যজি রথ-বরে,সুরকুল-রথীবর পশিলা দেউলে।কত যে দেখিলা দেব কে পারে বর্ণিতে?সৌর-খরতর-কর-জাল-সঙ্কলিতআভাময় স্বর্ণাসনে বসি কুহকিনীশক্তীশ্বরী। কর-জোড়ে বাসব প্রণমিকহিলা; “আশীষ দাসে, বিশ্ব-বিমোহিনি!”

    আশীষি শুধিলা দেবী;— “কহ, কি কারণে,গতি হেথা আজি তব, অদিতি-নন্দন?”

    উত্তরিলা দেবপতি;— “শিবের আদেশে,মহামায়া, আসিয়াছি তোমার সদনে।কহ দাসে, কি কৌশলে সৌমিত্রি জিনিবেদশানন-পুত্রে কালি? তোমার প্রসাদে(কহিলেন বিরূপাক্ষ) ঘোরতর রণেনাশিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।”

    ক্ষণ কাল চিন্তি দেবী কহিলা বাসবে,—“দুরন্ত তারকাসুর, সুর-কুল-পতি,কাড়ি নিল স্বর্গ যবে তোমায় বিমুখিসমরে, কৃত্তিকা-কুল-বল্লভ সেনানী,পার্বতীর গর্ভে জন্ম লভিলা তৎকালে।বধিতে দানব-রাজে সাজাইলা বীরেআপনি বৃষভ-ধ্বজ, সৃজি রুদ্র-তেজেঅস্ত্রে। এই দেখ, দেব, ফলক, মণ্ডিতসুবর্ণে, ওই যে অসি, নিবাসে উহাতেআপনি কৃতান্ত, ওই দেখ, সুনাসীর,ভয়ঙ্কর তূণীরে, অক্ষয়, পূর্ণ শরে,বিষাকর ফণী-পূর্ণ নাগ-লোক যথা!ওই দেখ ধনুঃ, দেব!” কহিলা হাসিয়া,হেরি সে ধনুর কান্তি, শচীকান্ত বলী,“কি ছার ইহার কাছে দাসের এ ধনুঃরত্নময়! দিবাকর-পরিধি যেমতি,জ্বলিছে ফলক-বর ধাঁধিয়া নয়নে।অগ্নিশিখাসম অসি মহাতেজস্কর!হেন তূণ আর, মাতঃ, আছে কি জগতে?”

    “শুন দেব।” (কহিলেন পুনঃ মায়াদেবী)“ওইসব অস্ত্রবলে, নাশিলা তারকেষড়ানন। ওই সব অস্ত্রবলে, বলি,মেঘনাদ-মৃত্যু, সত্য কহিনু তোমারে।কিন্তু হেন বীর নাহি এ তিন ভুবনে,দেব কি মানব, ন্যায়যুদ্ধে যে বধিবেরাবণিরে। প্রের তুমি অস্ত্র রামানুজে,আপনি যাইব আমি কালি লঙ্কাপুরে,রক্ষিব লক্ষ্মণে, দেব, রাক্ষস-সংগ্রামে।যাও চলি সুর-দেশে, সুরদল-নিধি।ফুল-কুল সখী ঊষা যখন খুলিবেপূর্বাশার হেমদ্বারে পদ্মকর দিয়াকালি, তব চির-ত্রাস, বীরেন্দ্রকেশরীইন্দ্রজিৎ—ত্রাস-হীন করিবে তোমারে—লঙ্কার পঙ্কজ-রবি যাবে অস্তাচলে!”

    মহানন্দে দেব-ইন্দ্র বন্দিয়া দেবীরে,অস্ত্র লয়ে গেলা চলি ত্রিদশ-আলয়ে।

    বসি দেব-সভাতলে কনক-আসনেবাসব, কহিলা শূর চিত্ররথ শূরে,—“যতনে লইয়া অস্ত্র, যাও মহাবলিস্বর্ণ-লঙ্কা-ধামে তুমি। সৌমিত্রি কেশরীমায়ার প্রসাদে কালি বধিবে সমরেমেঘনাদে। কেমনে, তা দিবেন কহিয়ামহাদেবী মায়া তারে! কহিও রাঘবে,হে গন্ধর্ব-কুল-পতি, ত্রিদিব-নিবাসীমঙ্গল-আকাঙ্ক্ষী তার; পার্বতী আপনি আজি।অভয় প্রদান তারে করিও সুমতি!মরিলে রাবণি রণে, অবশ্য মরিবেরাবণ, লভিবে পুনঃ বৈদেহী সতীরেবৈদেহী-মনোরঞ্জন রঘুকুল-মণি।মোর রথে, রথীবর, আরোহণ করিযাও চলি। পাছে তোমা হেরি লঙ্কা-পুরেবাধায় বিবাদ রক্ষঃ; মেঘদলে আমিআদেশিব আবরিতে গগনে, ডাকিয়াপ্রভঞ্জনে, দিব আজ্ঞা ক্ষণ ছাড়ি দিতেবায়ুকুলে, বাহিরিয়া নাচিলে চপলা,দম্ভোলি-গম্ভীর-নাদে পূরিব জগতে।”

    প্রণমি দেবেন্দ্র-পদে, সাবধানে লয়েঅস্ত্রে, চলি গেলা মর্ত্যে চিত্ররথ রথী।

    তবে দেব-কুল-নাথ ডাকি প্রভঞ্জনেকহিলা, “প্রলয়-ঝড় উঠাও সত্বরেলঙ্কাপুরে, বায়ুপতি, শীঘ্র দেহ ছাড়িকারাবদ্ধ বায়ুদলে; লহ মেঘদলে;দ্বন্দ্ব ক্ষণ-কাল বৈরী বারি-নাথ সনে,নির্ঘোষে!” উল্লাসে দেব চলিলা অমনি,ভাঙিলে শৃঙ্খল লম্ফী কেশরী যেমতি,যথায় তিমিরাগারে রুদ্ধ বায়ু যতগিরি-গর্ভে। কত দূরে শুনিলা পবনঘোর কোলাহলে; গিরি (দেখিলা) লড়িছেঅন্তরিত পরাক্রমে, অসমর্থ যেনরোধিতে প্রবল বায়ু আপনার বলে।শিলাময় দ্বার দেব খুলিলা পরশে।হুহুঙ্কারি বায়ুকুল বাহিরিল বেগেযথা অম্বুরাশি, যবে ভাঙে আচম্বিতেজাঙাল! কাঁপিল মহী; গর্জিল জলধি!তুঙ্গ-শৃঙ্গধরাকারে তরঙ্গ-আবলীকল্লোলিল, বায়ু-সঙ্গে রণরঙ্গে মাতি!ধাইল চৌদিকে মন্দ্রে জীমূত; হাসিলক্ষণপ্রভা; কড়মড়ে নাদিল দম্ভোলি।পলাইল তারানাথ তারাদলে লয়ে।ছাইল লঙ্কায় মেঘ, পাবক উগরিরাশি রাশি; বনে বৃক্ষ পড়িল উপড়িমড়মড়ে; মহাঝড়ি বহিল আকাশে।বর্ষিল আসার যেন সৃষ্টি ডুবাইতেপ্রলয়ে। বৃষ্টিল শিলা তড়তড়তড়ে।

    পশিল আতঙ্কে রক্ষঃ যে যাহার ঘরে।যথায় শিবির মাঝে বিরাজেন বলীরাঘবেন্দ্র, আচম্বিতে উতরিলা রথীচিত্ররথ, দিবাকর যেন অংশুমালী,রাজ-আভরণ দেহে! শোভে কটিদেশেসারসন, রাশি-চক্র-সম তেজোরাশি,ঝোলে তাহে অসিবর—ঝল ঝল ঝলে!কেমনে বর্ণিবে কবি দেব-তূণ, ধনুঃ,চর্ম, বর্ম, শূল, সৌর-কিরীটের আভাস্বর্ণময়ী? দৈববিভা ধাঁধিল নয়নেস্বর্গীয় সৌরভে দেশ পূরিল সহসা।

    সসম্ভ্রমে প্রণমিয়া, দেবদূত-পদেরঘুবর, জিজ্ঞাসিলা, “হে ত্রিদিববাসি,ত্রিদিব ব্যতীত, আহা, কোন্ দেশ সাজেএহেন মহিমা, রূপে?—কেন হেথা আজি,নন্দনকানন ত্যজি, কহ এ দাসেরে?নাহি স্বর্ণাসন, দেব, কি দিব বসিতে?তবে যদি কৃপা, প্রভু, থাকে দাস প্রতি,পাদ্য, অর্ঘ্য লয়ে বসো এই কুশাসনে।ভিখারী রাঘব হায়।” আশীষিয়া রথীকুশাসনে বসি তবে কহিলা সুস্বরে,—

    “চিত্ররথ নাম মম, শুন দাশরথি;চির-অনুচর আমি সেবি অহরহঃদেবেন্দ্রে, গন্ধর্বকুল আমার অধীনে।আইনু এ পুরে আমি ইন্দ্রের আদেশে।তোমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী দেবকুল সহদেবেশ। এই যে অস্ত্র দেখিছ নৃমণি,দিয়াছেন পাঠাইয়া তোমার অনুজেদেবরাজ। আবির্ভাবি মায়া মহাদেবীপ্রভাতে, দিবেন কহি, কি কৌশলে কালিনাশিবে লক্ষ্মণ শূর মেঘনাদ শূরে।দেবকুল-প্রিয় তুমি, রঘুকুল-মণি।সুপ্রসন্ন তব প্রতি আপনি অভয়া!”

    কহিলা রঘুনন্দন; “আনন্দ-সাগরেভাসিনু, গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ, এ শুভ সংবাদে!অজ্ঞ নর আমি; হায়, কেমনে দেখাবকৃতজ্ঞতা? এই কথা জিজ্ঞাসি তোমারে।”

    হাসিয়া কহিলা দূত; “শুন, রঘুমণি,দেব প্রতি কৃতজ্ঞতা, দরিদ্র-পালন,ইন্দ্রিয়-দমন, ধর্মপথে সদা গতি,নিত্য সত্য-দেবী-সেবা; চন্দন, কুসুম,নৈবেদ্য, কৌষিক বস্ত্র আদি বলি যত,অবহেলা করে দেব, দাতা যে যদ্যপিঅসৎ! এ সার কথা কহিনু তোমারে!”

    প্রণমিলা রামচন্দ্র; আশীষিয়া রথীচিত্ররথ, দেবরথে গেলা দেবপুরে।থামিল তুমুল ঝড়, শান্তিলা জলধি;হেরিয়া শশাঙ্কে পুনঃ তারাদল সহ,হাসিল কনকলঙ্কা। তরল সলিলেপশি, কৌমুদিনী পুনঃ অবগাহে দেহরজোময়; কুমুদিনী হাসিল কৌতুকে।আইল ধাইয়া পুনঃ রণ-ক্ষেত্রে, শিবাশবাহারী; পালে পালে গৃধিনী, শকুনী,পিশাচ। রাক্ষসদল বাহিরিল পুনঃভীম-প্রহরণ-ধারী—‍—মত্ত বীরমদে।

    ইতি শ্রীমেঘনাদবধে কাব্যে অস্ত্রলাভো নাম দ্বিতীয়ঃ সর্গঃ।

    টীকা