Chapter Index

    মাঝরাতের অতিথি

    মাঝরাত্তিরে অনেকগুলো কুকুর একসঙ্গে ডাকছে৷ সেই ডাক শুনে সনাতন গোস্বামীর ঘুম ভেঙে গেল৷

    গ্রামের একেবারে একপ্রান্তে সনাতনের বাড়ি৷ বাড়ি মানে দু-খানা খড়ের ছাউনির মাটির ঘর আর সামনে একচিলতে দাওয়া৷ বৃদ্ধ সনাতন আর তার বউ মানদা ছাড়া সে বাড়িতে আর কোনো তৃতীয় প্রাণী নেই৷

    মানদা ঘুমিয়ে আছে, সনাতন উঠে বসল৷ এত কুকুর ডাকছে কেন? ডাক শুনে মনে হয় কুকুরগুলো কারুকে তাড়া করেছে৷ চোর এল নাকি? কিংবা বাঘডাসা? বাঘডাসা ঠিক বাঘ নয়, নেকড়ের মতন একরকম প্রাণী, গায়ে সাদা সাদা ছোপ আছে৷ ওরা হাঁস-মুরগি চুরি করতে আসে৷

    সনাতনের বাড়ির পরেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি, তার মাঝে ঝোপ-জঙ্গলও রয়েছে, সেখানে নানারকম জন্তু-জানোয়ার আছে৷

    চোর হলেও চিন্তার কিছু নেই৷ কারণ সনাতনের বাড়িতে কোনো চোর ভুল করেও ঢুকবে না৷ ঢুকলে তার পরিশ্রমটাই নষ্ট৷

    সনাতন বৈষ্ণব মানুষ৷ সে হাঁস-মুরগিও পোষে না, সুতরাং বাঘডাসাও আসবে না৷ তবু মাঝরাতে এরকম কুকুরের ডাক শুনলে গা-টা ছমছম করে৷

    কুকুরগুলো প্রায় ঘরের পাশে চলে এসেছে আর হিংস্র ভাবে গর্জন করছে৷ সনাতন চৌকি থেকে নেমে পড়ল৷ তার বাড়ির দরজাটা খুব পলকা, কেউ জোরে ধাক্কা মারলে খুলে যাবে৷ যে রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হয়, সেই সব রাতে সনাতন তার টিনের সুটকেসটা টেনে এনে দরজার সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখে৷ অন্য রাতগুলোতে দরকার হয় না৷ এই গরিব বুড়ো-বুড়ির কাছে রাত্তিরবেলা তো কেউ আসবে না৷

    সনাতনের একটিমাত্র ছেলে ছিল৷ অনেকদিন আগে সে নদীতে ভেসে গেছে৷ তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি৷ ওদের আর কেউ নেই৷ সনাতন গান গেয়ে সংসার চালায়৷ তা বলে সে ভিক্ষে করে না৷ প্রত্যেক দিন ভোরবেলা সে গ্রামের পথ দিয়ে ভগবানের গান গাইতে গাইতে যায়৷ কোনো বাড়ির দরজার সামনে থামে না৷ তার গান শুনে অনেকের ঘুম ভাঙে৷ মাসের প্রথমে গ্রামের লোকেরা নিজে থেকেই তার বাড়িতে কিছু কিছু চাল, ডাল, ফল-তরকারি আর দু-একটা করে টাকা পৌঁছে দিয়ে যায়৷ সনাতন একটু একটু কবিরাজি চিকিৎসাও জানে৷ আগে তার কাছে কিছু কিছু লোক আসত৷ কিন্তু এখন পাশের গ্রামে একজন নতুন পাশ করা ডাক্তার এসেছে বলে সনাতনের চিকিৎসার ওপরে কেউ ভরসা করে না৷

    হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল৷ কী যেন একটা বেশ বড়সড় প্রাণী দরজা ঠেলে ঢুকে পড়েছে পাশের ঘরে৷ সেই শব্দে মানদারও ঘুম ভেঙে গেল৷ সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কে? কে?

    পাশের ঘরে কোনো জন্তু ঢোকেনি, ঢুকেছে একজন মানুষ৷ মানদার চিৎকারের উত্তরে পাশের ঘর থেকে শোনা গেল, চুপ! চুপ!

    যে ঢুকেছে সে বাইরের দরজাটা বন্ধ করে দিল৷ তারপর দু-ঘরের মাঝখানের দরজাটায় এসে দাঁড়াল৷ অন্ধকারের মধ্যেও বোঝা গেল একজন বিশাল চেহারার লোক৷ সে ধমকের সুরে বলল, চুপটি করে থাকো, কোনো শব্দ করবে না! গোঁসাই এদিকে এসো, বাতি জ্বালো!

    এ ঘরেই একটা তাকের ওপর কুপি আর দেশলাই থাকে৷ কিন্তু কুপি জ্বালতে গিয়ে সনাতনের হাত থরথর করে কাঁপতে লাগল৷ এ রকম ঘটনা তো আর জীবনে আগে ঘটেনি৷ ছেলেটা নদীতে ভেসে যাবার পর তার জীবনে আর কোনো ঘটনাই ঘটেনি৷

    সনাতনের চেয়ে মানদার সাহস বেশি৷ সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? মাঝরাতে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লে?

    ছায়ামূর্তি কর্কশ গলায় বলল, আমি কে তা জেনে তোমার দরকার নেই৷ যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, আমি যা বলছি তাই করো৷ বিছানা থেকে ওঠো, ঘরে কি খাবার আছে, বার করো!

    আট-দশটা দেশলাই-এর কাঠি নষ্ট করে সনাতন কুপিটা জ্বালল৷

    সেই আলোতে মানুষটাকে দেখে আরও ভয় লেগে গেল৷ সাঙ্ঘাতিক চেহারা! মুখ ভর্তি দাড়ি-গোঁফ, চোখ দুটো জ্বল জ্বল করছে, সারা গায়ে জল-কাদা মাখা, তার ডানহাতে একটা মস্ত বড় ছোরা৷ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে এক ঠ্যাঙে, আর একটা পা মোড়া, সেই পায়ের উরুর কাছে জমাট বেঁধে আছে রক্ত৷

    লোকটা ছুরিটা তুলে বলল, টুঁ শব্দ করলে খুন করে ফেলব! আমার পায়ে গুলি লেগেছে, তিনদিন জল-কাদার মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম৷ গোঁসাই তোমার কি ওষুধপত্তর আছে লাগিয়ে দাও৷ আর ঘরে কী খাবার আছে শিগগির আনো, খিদেয় আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাচ্ছে!

    লোকটা বোধহয় এতখানি হেঁটে এসেছে মনের জোরে৷ এবারে সে দরজার চৌকাঠের সামনেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল কাত হয়ে, ছুরিটা রাখল মাথার কাছে৷ তারপর ফিসফিস করে বলল, আমার সঙ্গে কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করো না৷ এখনো গায়ে যেটুকু শক্তি আছে তাতে তোমাদের মতন দুটো বুড়ো-বুড়িকে সাবাড় করে ফেলতে পারব৷

    সনাতন এবারে কাতরভাবে বলল, বারবার ওকথা বলছ কেন, বাবা! আমাদের মারলেই বা কী আর না মারলেই বা কী! আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছ, আমরা যেটুকু পারি সেবা করব!

    লোকটি বলল, আমার পায়ে অসহ্য ব্যথা৷ ওষুধ দাও!

    সনাতন এবারে এগিয়ে এসে লোকটির উরু পরীক্ষা করে দেখল৷ যেখানে গুলি ঢুকেছে সেখানে কুচিকুচি মাংস আর পুঁজ জমে এর মধ্যেই থকথকে ঘা হয়ে গেছে৷ গুলিটা বেরিয়ে গেছে না ভেতরেই রয়েছে তাই বা কে জানে৷ সনাতনের অত বিদ্যে নেই৷

    সনাতন বলল, এর চিকিৎসা আমি কি করব বাবা? এ যে অনেক বড় ব্যাপার৷ পাশের গ্রামে ভালো ডাক্তার আছে, তুমি তার কাছে যাও! যদি বলো তো, আমি তোমাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে পারি৷

    লোকটি বলল, চুপ! ওসব কথা শুনতে চাই না৷ তুমি যা পারো শিগগির করো!

    সনাতনের কাছে খানিকটা পুরোনো মলম আছে, তা-ই লাগিয়ে দিতে হবে৷ সে আগে জলের কুঁজো এনে ক্ষতস্থানটা ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করতে লাগল৷

    লোকটা যে কে তা এতক্ষণে সনাতন বুঝে গেছে৷ তিন রাত আগে এখান থেকে খানিকটা দূরে খলসেখালি গ্রামে দারুণ ডাকাতি হয়েছে৷ তবে ডাকাতরা নিশ্চিন্তে লুটপাট চালাতে পারেনি৷ ডাকাতরা দু’জন লোককে মেরে প্রচুর জিনিসপত্র নিয়ে যখন পালাবার উপক্রম করছে, তখন পাশের গ্রামের জমিদার হরবল্লভ রায় আর তাঁর ভাই ঘোড়ায় চেপে বন্দুক নিয়ে উপস্থিত৷ তাদের গুলি খেয়ে একজন ডাকাত সেখানেই মারা যায়, দুজন আহত অবস্থায় ধরা পড়ে, আর বাকিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালায়৷

    এই লোকটা নিশ্চয়ই সেই পলাতক ডাকাতদেরই একজন৷ এই ক’দিন জলায়- জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল৷

    মানদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে৷

    লোকটি বলল, কই, খাবার দিলে না?

    মানদা বললে, ও ঘরে যেতে হবে৷ যাব কী করে?

    লোকটি বললে, আমায় ডিঙিয়ে যাও!

    মানদা বললে, জ্যান্ত মানুষকে কেউ ডিঙিয়ে যায় নাকি? সে আমি পারব না!

    লোকটি চোখ কটমট করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, তারপর অতি কষ্টে মাথাটা সরাল৷ সেই ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল মানদা৷

    লোকটি সনাতনকে বলল, তোমার বউকে ডেকে দাও, সে যদি বাইরে বেরিয়ে গিয়ে গ্রামের লোকদের ডেকে আনে, তাহলে কিন্তু তুমি বাঁচবে না৷ এই বাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেব৷ তারপর আমার যা হয় হবে৷

    সনাতন বলল, তুমি কথায় কথায় খুনোখুনির কথা বলছ৷ আমরা স্বামী-স্ত্রীতে কোনোদিন একটা পিঁপড়েও মারিনি! তুমি খাবার চেয়েছ, ও ঠিক খাবার এনে দেবে!

    ক্ষতটা পরিষ্কার হয়েছে কোনোমতে৷ এবারে মলম লাগাতে হবে৷

    চৌকিটার নীচেই সনাতন তার ওষুধপত্তর রাখে৷ সেখানে মাথা গলিয়ে সে মলম খুঁজতে লাগল৷

    লোকটা আর ধৈর্য রাখতে পারছে না৷ সে বিকৃত গলায় বলল, কই গো, গোঁসাই, এত দেরি হল কেন? তোমার বউ খাবার নিয়ে এল না!

    সনাতন বললে, এই যে আসছি, আসছি!

    ওষুধ নিয়ে এসে সনাতন ক্ষতস্থানে লাগাতেই লোকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল৷ সে বলতে লাগল, উঃ, জ্বলে গেল! জ্বলে গেল! ও গোঁসাই কী লাগালে?

    সনাতন বলল, ওষুধে তো একটু জ্বালা করবেই বাবা! একটু পরে কমে যাবে৷

    সনাতন এক টুকরো কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল সেই জায়গাটায়৷ মানদা একটা কলাই করা থালায় খানিকটা খই আর একটা পাটালি গুড় এনে বলল, এখন এই খেয়ে নাও৷ কাল সকালে ভাত রেঁধে দেব!

    লোকটি অদ্ভুত চোখে মানদার দিকে তাকিয়ে বলল, কাল সকালে? হেঃ! ততক্ষণ আমি থাকছি আর কি! সূর্য ওঠার আগেই আমাকে সটকে পড়তে হবে৷ দাও দাও, কী আছে দাও!

    সেই খই জলে ভিজিয়ে তাতে পাটালি গুড় মেখে লোকটা হ্যাংলার মতন গপ গপ করে খেতে লাগল৷

    কিন্তু সবটা সে খেতে পারল না৷ হঠাৎ তার মাথাটা ঢলে পড়ল৷ চোখ দুটো গেল বুজে৷

    মানদা বলল, আহা রে৷ ঘুমিয়ে পড়েছে৷ শরীরের ওপর এত ধকল সহ্য হবে কেন? থাক, জেগে উঠে বাকিটা খাবে৷

    সনাতন বলল, ঘুমোয়নি৷ অজ্ঞান হয়ে গেছে!

    মানদা বলল, এই লোকটা একটা ডাকাত, না গো?

    সনাতন বলল, তাতে আর সন্দেহ আছে? দেখছ না মুখখানা একেবারে রাক্ষসের মতন৷

    মানদা বলল, ঘুমোলে কিন্তু সব মানুষেরই মুখ সরল দেখায়!

    সনাতন লোকটির হাত থেকে ছুরিটা খুলে নিয়ে চৌকির তলায় সরিয়ে রাখল৷ তারপর বিড়বিড় করে বলল, একটা খুনে! পাপী! শিলের নোড়াটা এনে ওর মাথাটা ছেঁচে দিলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়৷

    মানদা আঁতকে উঠে বলল, সে কি! তুমি লোকটাকে মেরে ফেলার কথা ভাবছ নাকি? সে কি গো?

    সনাতন বললে, একটা নৃশংস খুনি! ওর বেঁচে থেকে লাভ কী? কত মানুষ মেরেছে৷ আরও কত মারবে৷ আমাদের অসহায় বুড়ো-বুড়ি পেয়ে কতবার মেরে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল৷ আমরা বুঝি কিছু করতে পারি না?

    মানদা বলল, ছি ছি, অমন কথা মনেও স্থান দিও না৷ হ্যাঁগো, এই লোকটার চোখ দুটো দ্যাখো, আর নাকটা? অনেকটা আমাদের খোকনের মতন নয়?

    সনাতন বলল, যাঃ, কী যে বলো! আমাদের খোকন অনেক সুন্দর ছিল৷ একটা ডাকাতের সঙ্গে তুমি ওর তুলনা করছ?

    মানদা বলল, একেও দেখতে খুব খারাপ নয়৷ মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল হয়ে আছে! আচ্ছা, এ লোকটা তো এ গ্রামের কেউ নয়৷ একে কোনোদিন দেখিনি৷ কিন্তু তোমাকে চিনল কী করে? তোমাকে গোঁসাই বলে ডাকছে৷ তুমি যে ওষুধ-পত্তর দাও, তা ও জানে!

    সনাতন বলল, আশেপাশের আট-দশখানা গ্রামের মানুষ সনাতন গোস্বামীকে চেনে৷ তুমি ভাবো কী?

    মানদা ধরা গলায় বলল, আমাদের খোকন বেঁচে থাকলে এতদিন এত বড়োটিই হত৷ হ্যাঁ গো, আমাদের খোকনই ফিরে আসেনি তো? নদীতে ভেসে গিয়েছিল, হয়তো মরেনি৷ কোন দূর দেশে গিয়ে উঠেছিল৷

    সনাতন বলল, কী যে বলো তুমি! তা কখনো হতে পারে? যদি বা বেঁচে থাকে, আমাদের খোকন ডাকাত হবে কেন? বৈষ্ণবের রক্ত আছে তার গায়ে!

    মানদা বলল, যদি কোনো খারাপ লোকের পাল্লায় পড়ে থাকে৷ হয়তো কোনো ডাকাতের বাড়িতেই সে মানুষ হয়েছে!

    সনাতন বলল, থাক ওসব বাজে কথা৷ চলো আমরা শুয়ে পড়ি৷ খোকন যখন নদীতে ভেসে যায়, তখন তার চোদ্দো বছর বয়েস৷ যদি সে বেঁচে থাকত, তাহলে সে তখনই বাড়ি ফিরে আসতে পারত না? এই লোকটা খোকন হলে নিজের বাড়ি চিনতে পারত না? আমাদের ওরকম ধমকে ধমকে কথা বলবে! একটা ডাকাতকে তুমি নিজের ছেলে ভাবছ! হুঁঃ!

    মানদা বলল, প্রথমে ওরকম কথা বলছিল, পরে নিশ্চয়ই সব খুলে বলত! খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতেই এসেছে৷ তা ছাড়া ও যে ডাকাত তা বুঝলে কি করে? যারা দেশের কাজ করে তাদেরও তো পুলিশে গুলি করে মারতে চায়৷ আহা, আমার কাছে খাবার খেতে চাইল ঠিক আমার খোকনের মতন৷ খোকন খুব পাটালি গুড় ভালোবাসত৷

    হুঁঃ যত সব! বলে সনাতন ফুঁ দিয়ে কুপিটা নেভাতে যেতেই মানদা বললে, দাঁড়াও, একটা জিনিস দেখি৷ আমাদের খোকনের বাঁ কানের পেছনে একটা কাটা দাগ ছিল মনে আছে! সেই যে একবার বঁটি নিয়ে খেলা করতে গিয়ে কেটে গিয়েছিল! দ্যাখো তো এর সেইরকম দাগ আছে কি না!

    সনাতন বলল, ডাকাতের গায়ে কতরকম কাটাছেঁড়া দাগ থাকে৷ ওরকম মিল থাকলেই বা কি?

    মানদা বলল, তবু তুমি একবার দ্যাখো!

    কুপিটা এগিয়ে অজ্ঞাত লোকটির বাঁ কানটা উল্টে দুজনেই একসঙ্গে দেখল৷ ঠিক সেখানে একটা কাটা দাগ! লোকটির মুখে বা গায়ে আর কোথাও কিন্তু কোনো কাটা দাগ নেই!

    মানদা চেঁচিয়ে উঠল, এই তো খোকন, এ নিশ্চয়ই আমাদের খোকন!

    সনাতনও আর ঠিক অবিশ্বাস করতে পারল না৷ কাঁপতে কাঁপতে সে কুপিটা নামিয়ে রাখল৷ জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ দিয়ে৷ দু-হাত জোড় করে সে মুখটা উঁচু করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ঠাকুর তুমি আমায় রক্ষা করেছ৷ তুমি আমায় বড় বাঁচা বাঁচিয়েছ!

    মানদা আনন্দে চ্যাঁচামেচি করছে তবু সনাতন কোনো সাড়া দিচ্ছে না৷ তখন মানদা অবাক হয়ে সনাতনের দিকে তাকাল৷ আর তখনই তার নজরে পড়ল সনাতনের পাশে রাখা ছোট্ট হোমিওপ্যাথি শিশিটা৷

    সে হাহাকার করে বলে উঠল, একি? তুমি ওষুধে বিষ মিশিয়ে দিয়েছ নাকি? হায়, হায়, কী সর্বনাশ করেছ! আমাদের খোকন!

    সনাতন এবারে মানদার হাত চেপে ধরে বলল, না, দিইনি, বিশ্বাস করো দিইনি৷ একবার দিতে ইচ্ছে করেছিল সত্যি কথা বলছি! কিন্তু পাপের ভয়ে দিতে পারিনি৷

    সত্যি বলছ দাওনি?

    সত্যি দিইনি!

    ওই ছোট্ট শিশিটায় রয়েছে কেউটে সাপের বিষ৷ একবার গ্রামের ছেলেরা একটা কেউটে সাপকে মারছিল, তখন সনাতন তার বিষদাঁতটা কামিয়ে বিষটা জমিয়ে রেখেছিল৷ সূচের ডগায় সামান্য একটু ওই বিষ অনেক সময় মুমূর্ষ রোগীদের খাইয়ে দিলে তারা বেঁচে ওঠে৷ কিন্তু মলমের মধ্যে ওই বিষ মিশিয়ে দিয়ে সেই মলম কাটা জায়গায় লাগালে নির্ঘাৎ মৃত্যু৷

    মানদা বলল, খোকনকে ডাকো! ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দাও!

    সনাতন বলল, দাঁড়াও, আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরবে৷ খোকন সত্যিই ফিরে এসেছে? খোকনের সঙ্গে এর মুখের অনেক মিল আছে তো সত্যি!

    মানদা বলল, আমার খোকন কিছুতেই ডাকাত হতে পারে না৷ আহারে ছেলেটা কত কষ্ট পেয়েছে! বুকটা একেবারে কাদায় মাখামাখি!

    মানদা একটা গামছা এনে লোকটির বুকের কাদা মুছে দিতে লাগল৷ মুছতে মুছতে হঠাৎ একসময় বলল, দ্যাখো তো, এটা কি?

    সনাতন ঝুঁকে পড়ে দেখল লোকটির বুকে একটা লাল, গোল দাগ৷ খুব ছোট গাড়ির চাকার মতন৷

    সনাতন বলল, এ তো জড়ুল! জন্ম জড়ুল! খোকনের তো এরকম ছিল না৷

    মানদা ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করল, পরে হতে পারে না?

    সনাতন বলল, না, এ তো জন্মের সময় থেকেই হয়, দাঁড়াও, আর একটা জিনিস দেখি তো!

    সনাতন লোকটির মুখখানা ফাঁক করে দেখল৷ তারপর সনাতনের মুখে হাসি ফুটে উঠল৷

    সে বলল, এই দ্যাখো, এই লোকটার সব কটা দাঁত রয়েছে৷ খোকনের সামনের ওপরের একটা দাঁত ভাঙা ছিল না? নতুন করে তো দাঁত গজাবে না! এ আমাদের খোকন হতেই পারে না!

    মানদার মুখখানি ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ আপন মনেই বলে উঠল, যাঃ, খোকন নয়! খোকন ফিরে আসবে না!

    সনাতন বলল, আর খোকনের কথা ভেবো না৷ চলো শুয়ে পড়ি!

    মানদা উঠে দাঁড়াতেই লোকটির বুকে বিচ্ছিরি শব্দ হতে লাগল৷ যেন গাড়ির চাকা চলছে৷ একটু পরে অ্যাঁক করে শব্দ হয়ে সব থেমে গেল৷

    সনাতন লোকটির ডান হাতের নাড়ি দেখে বলল, যাঃ, সব শেষ!

    মানদা বললে, সব শেষ? না, না, না, ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করো৷ ওকে ওইটা দাও!

    মানদা হাত দিয়ে ছোট শিশিটা দেখাল৷

    সনাতন বলল, কী বলছ পাগলের মতন কথা! ওটা দিলে এখন কী হবে? তা ছাড়া ও মরেছে, আপদ গেছে! ও বেঁচে উঠলে আবার কী কাণ্ড করত কে জানে! হয়তো আমাদের মেরে রেখে যেত৷

    মানদা বলল, তা বলে শেষ চেষ্টা করবে না? ওকে ওটা একবার দিয়ে দ্যাখো অন্তত৷

    সনাতন বলল, আমি পারব না, আমার হাত কাঁপছে৷ তুমি যদি পার তো দাও!

    মানদা বিছানার তলা থেকে একটা সূচ নিয়ে এল৷ সেটা বিষের মধ্যে ডুবিয়ে বার করে ফুঁ দিয়ে দিয়ে বেশিটা ঝরিয়ে দিল৷ তারপর সেই সূচটা ছোঁয়াল লোকটার জিভে৷

    কোনো কাজ হল না৷ লোকটা একেবারে নিথর!

    মানদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল৷

    সনাতন তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, আর কাঁদছ কেন? যা হবার ভালোই হয়েছে, ও তো খোকন নয়৷ একটা ডাকাত!

    মানদা বলল, তুমি কি ওর মলমে বিষ দিয়েছিলে? তাহলে এবার আর কোনো কিছুতেই কাজ হবে না!

    সনাতন বলল, না দিইনি৷ সত্যি দিইনি৷ বিশ্বাস করো!

    মানদা বলল, হ্যাঁ, তুমি বিষ দাওনি! তবু আমি কাঁদছি, ও খোকন না হলেও একজন মানুষ তো! চোখের সামনে একজন মানুষ মরে গেলে কাঁদব না?

    মানদার চোখে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়তে লাগল লোকটার বুকের ওপর৷

    টীকা