Chapter Index

    বিশেষ করে কিরীটীর মুখে উচ্চারিত শেষের কথাগুলো মিত্ৰাণীকে যেন
    সত্যিই পাথর করে দেয়, সে তার প্রতিরোধক্ষমতা হারায়।

    কিরীটী চেয়ে আছে তখনও মিত্ৰাণীর দিকে।

    সে-রাত্রে কেউ তাহলে আপনার ঘরে এসেছিল।

    মৃদু-অত্যন্ত মৃদু কণ্ঠে এবার জবাব দেয় মিত্ৰাণী। সে বলে, হ্যাঁ।

    কে? কে সে?

    সঞ্জীব।

    সে তাহলে আপনার বিশেষ পরিচিত?

    হ্যাঁ। মালদহে আমরা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম।

    তার সঙ্গে আপনার তাহলে বলুন অনেক দিনের পরিচয়! কিরীটী পুনরায় শুধায়।

    হ্যাঁ।

    কত দিনের পরিচয়?

    আট-নয় বছর হবে।

    কি করে সে?

    জানি না, কলকাতা পোর্ট কমিশনারে যেন কিছুদিন হল কি একটা চাকরি পেয়েছে।

    এখানে কোথায় থাকে?

    মানিকতলায় থাকে, তবে কোথায় তা ঠিক জানি না।

    জানেন আপনি, মিথ্যা বলছেন। বলুন তার ঠিকানা কি?

    সে একটা বস্তী
    শুনেছি-খালের ওপারে।

    হুঁ।
    তা অত রাত্রে কেন এসেছিল সঞ্জীব দত্ত? আপনার সঙ্গে দেখা করতে নিশ্চয়ই?

    হ্যাঁ।

    এর আগে কখনও এসেছে?

    হ্যাঁ।

     নিশ্চয়ই সব সময় রাত্রেই
    সে এসেছে?

    হ্যাঁ।

    দিনের বেলা এলে পাছে জানাজানি হয়ে যায় বলে বোধ হয়?

    হ্যাঁ। সুশান্তবাবু বা তার স্ত্রী নিশ্চয়ই জানতেন
    ব্যাপারটা?

    না।

    সে-রাত্রে বোধ হয় ঘর অন্ধকার করে সঞ্জীবকে ঘরে এনেছিলেন?

    হ্যাঁ।

    তাই–তাই
    রাহুল মধ্যে মধ্যে অন্ধকারে সঞ্জীববাবুকে দেখত বলেই বোধ হয় ভয় পেয়েছে। ঠিক আছে
    আপনি যান, সুশান্তবাবুকে একবার পাঠিয়ে দিন।

    মিত্ৰাণী উঠে দাঁড়াল।

    শিথিল ক্লান্ত পায়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল মিত্ৰাণী।

    অবনী এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল ওদের কথাবার্তা। একটি কথাও বলেনি।
    মিত্ৰাণী চলে যেতে সে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে ডাকে, মিঃ রায়?

    উঁ।

    আপনি জানলেন কি করে কথাটা—ঐ সিগারেটের টুকরোটা থেকেই?

    না,
    বাগানে জুতোর ছাপ আর ঐ সিগারেট—দুই মিলে চার হয়েছে, তারপর এই চিঠি।তা তো হল!
    ব্যাপারটা যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে এখন!

    কেন?

    মিত্ৰাণী যদি সঞ্জীবকেই ভালবাসত, তাহলে–

    শুনলেন তো, সেটা সম্ভবত সুশান্তবাবু এখনও জানেন না!

    তা অবিশ্যি—তাহলে অন্য পক্ষের সক্রিয় সহযোগিতা না থাকলে—

    অবনীবাবু, রহস্যের জালটা সবে একটু সরেছে, এখনও অনেকটা ঝাপসা
    অস্পষ্ট—

    কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুশান্ত এসে সামনে দাঁড়াল।

    আপনারা!

    হুঁ,
    বসুন।

    সুশান্ত বসল চেয়ারটায়। সুশান্ত চেয়ারে বসে কিরীটীর মুখের দিকে
    সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকায়।

    তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয় যেন সে একটু বিস্মিত হয়েছে।
    গত-রাত্রের অত্যধিক মদ্যপানের জন্য মাথাটা তখনও বেশ ভারী, চোখের পাতা থেকেও ঘুম
    একেবারে মুছে যায়নি।

    কিরীটী মৃদু কণ্ঠে ডাকে, সুশাবাবু!

    বলুন।

    সঞ্জীব দত্ত বলে কাউকে চেনেন?

    সঞ্জীব দত্ত।

    হ্যাঁ, নামটা কখনও শুনেছেন?

    না তো!
    কে সে?

    নামটাও শোনেননি তাহলে? মিত্ৰাণীর মুখেও কখনও শোনেননি?

    না।
    বুঝতে পারছি আপনি জানেন না, কিন্তু সেই ভদ্রলোক মধ্যে মধ্যে এখানে আসতেন। এখানে
    আসতেন মানে? আপনার কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না!

    এখানে আসতেন মানে মিত্ৰাণী দেবীর সঙ্গে দেখা করতে—

    মিত্ৰাণীর সঙ্গে!

    হ্যাঁ, আর সেই দুর্ঘটনার রাত্রেও সেই সঞ্জীব দত্তই মিত্ৰাণী দেবীর
    ঘরে এসেছিল।

    সে কি! কেন?

    কারণ সেই যুবক দীর্ঘদিন থেকে মিত্ৰাণীর সঙ্গে পরিচিত এবং ওদের
    মধ্যে ঘনিষ্ঠতাও আছে।

    না, না-মিথ্যা–

    মিথ্যা নয় সুশান্তবাবু, নিষ্ঠুর নির্মম সত্য। কথাটা বলেই হঠাৎ উঠে
    দাঁড়াল কিরীটী। আচ্ছা আজ এবার আমরা উঠব। আর একটা কথা, অবনীবাবুকে না জানিয়ে
    কলকাতার বাইরে আপাততঃ কোথাও আপনি যাবেন না যেন।

    যাব না?

    না,
    তাতে কিন্তু আপনার বিপদ ঘটতে পারে!

    তারপরই কিরীটী অবনী মিত্রের দিকে তাকিয়ে বলে, উঠুন অবনীবাবু–যাওয়া যাক।

    সুশান্ত স্থাণুর মত চেয়ারটার ওপর বসে রইল। তার মাথার ঝিমঝিম ভাবটা
    তখন কেটে গিয়েছে। চোখের ঘুম-ঘুম ভাবটাও চোখ থেকে সম্পূর্ণ মুছে গিয়েছে।

    মিত্ৰাণী—তার কাছে সঞ্জীব দত্ত মধ্যে মধ্যে আসত! তারা অনেক দিনের
    পরস্পরের পরিচিত! মিত্ৰাণী-সঞ্জীব দত্ত-মাথাটার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে-সুশান্ত চেয়ারের
    হাতলটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরে। চোয়াল দৃঢ় হয়—মিত্ৰাণী-সঞ্জীব।

    .

    কিরীটী আর অবনী সুশান্তর কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে এল।

    বেলা তখন সাড়ে বারোটা। আকাশের মেঘ তখনও কাটেনি। কিন্তু বৃষ্টিও আর
    নামেনি। কেবল একটা ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল। দুজনে জীপে উঠে বসে। অবনীই স্টীয়ারিং
    ধরেন। কিরীটী পাশে বসে একটা সিগারেট ধরায়।

    অবনী সাহা জীপ চালাচ্ছিলেন।

    মৃদু কণ্ঠে একসময় কিরীটী ডাকে, অবনীবাবু।

    বলুন? অবনী সাড়া দিলেন।

    আজ একবার বিকেলের দিকে এক জায়গায় চলুন—

    কোথায়?

    মানিকতলা খালের ওপারে—শ্রীমান সঞ্জীবচন্দ্রের দেখা যদি পাওয়া যায়।

    কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু।

    কি?

    সঞ্জীব দত্তর শকুন্তলা দেবীকে হত্যা করবার কি এমন কারণ থাকতে
    পারে?

    কার কোথায় কি ইন্টারেস্ট থাকতে পারে, তা এত সহজেই বলা যায় না মিঃ
    মিত্র! চলুন না—আলাপ
    করে দেখাই যাক ভদ্রলোকের সঙ্গে আগে একটিবার!

    বেশ।

    টীকা