Chapter Index

    বেলা এগারটা নাগাদ সেই যে সুশান্ত বের হয়ে গিয়েছে, এখনও ফেরেনি।
    রাত প্রায় এগারটা হল।

    রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বলছে। মিত্ৰাণী
    একা দাঁড়িয়ে ছিল জানালাটার সামনে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। অন্ধকার রেলওয়ে ইয়ার্ডে
    বোধ হয় শানটিং হচ্ছে কোথাও, তারই আওয়াজ মধ্যে মধ্যে ভেসে আসছে।

    পশ্চাতে টেবিলের উপরে সদ্য শেষ করা একটা চিঠি। চিঠির মুখটা বন্ধ
    করা। উপরে ঠিকানা লেখা। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত চিঠিটা লিখছিল মিত্ৰাণী। চিঠিটা শেষ
    করে ঐ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

    মিত্ৰাণী একবার ফিরে তাকায় ঘুমন্ত রাহুলের দিকে।

    রাহুল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এখন আর তার ঘুম ভাঙবে না। মিত্ৰাণী এগিয়ে
    এসে আলনা থেকে একটা চাদর টেনে নিল-চাদরটা গায়ে জড়িয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে
    এল। ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে ভেজিয়ে দিল।

    সদর দরজা খুলে বের হল। সদরে ইয়েল লক লাগানো। দরজার কপাট দুটো টেনে
    দিতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

    গেট দিয়ে বের হয়ে মিত্ৰাণী দ্রুত হেঁটে চলে।

    নির্জন চারিদিক-জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্রও নেই কোথাও। কিছুদূর এগিয়ে
    যায় মিত্ৰাণী হনহন করে। রাস্তার মোড়ে একটা লেটার-ব—তার মধ্যে চিঠিটা ফেলে দিল
    মিত্ৰাণী।

    হনহন করে বাড়ির দিকে আবার ফিরে চলে।

    হাতেই চাবি ছিল মিত্ৰাণীর। চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে ভিতরে প্রবেশ
    করল। নিজের ঘরে এসে ঢুকে রাহুলের দিকে একবার তাকাল। রাহুল ঘুমোচ্ছে। বোধ হয়
    দু-মিনিটও হয়নি সদর দরজা খোলার শব্দ পায় মিত্ৰাণী।

    মিত্ৰাণী বুঝতে পারে সুশান্ত ফিরল।

    তার কাছে একটা চাবি থাকে, সেই চাবি দিয়েই রাত্রে এলে দরজা খুলে
    ভিতরে প্রবেশ করে। অনেক সময় রাত্রে তাকে ফিরতে হয়, সে-সময় সে কাউকে ডাকাডাকি করে
    না।

    মিত্ৰাণী কান পেতে থাকে। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। টেবিলের উপরে
    রাখা টেবিলক্লকটার দিকে তাকিয়ে দেখে মিত্ৰাণী। খাবারটা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে।
    খাবারটা গরম করে দিলে সুশান্ত খেতে পারবে না। মিত্ৰাণী ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের
    দিকে গেল।

    .

    সুশান্তর ঘরের দরজাটা খোলা। দরজা-পথে আলোর আভাস আসছে।

    সুশান্তই এসেছে।

    ঘরের সামনে আসতেই চোখে পড়ল সুশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। ঘর থেকে
    বের হয়ে সুশান্ত মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল, রান্নাঘরের দিকেই তার দৃষ্টি মনে হল
    মিত্ৰাণীর।

    ভাতটা একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। নিবন্ত চুল্লীর উপরে যদিও
    ভাতের হাঁড়িটা বসিয়ে রেখেছিল মিত্ৰাণী, চুল্লীর আগুন একেবারে নিভে গিয়েছে।
    মিত্ৰাণী তাই ভাবছিল, কি করে ঠাণ্ডা ভাতটা গরম করবে!

    সুশান্ত এসে রান্নাঘরের খোলা দরজার সামনে দাঁড়াল।

    মিতা!

    আপনি ঘরে গিয়ে বসুন জামাইবাবু, ভাতটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে,
    একটু গরম করে আনছি।

    জনতা স্টোভটায় আগুন দিয়ে মিত্ৰাণী ভাতটা গরম করবার জন্য ব্যস্ত
    ছিল।

    তোমাকে ব্যস্ত হতে হবে না, আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।

    খেয়ে এসেছেন!

    হ্যাঁ, তুমি একটু আমার ঘরে এস, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

    আপনি যান, আমি আসছি।

    সুশান্ত তার ঘরে ফিরে গেল।

    গায়ের জামাটা খুলে একটা পায়জামা পরেছিল সুশান্ত। গলাটা কি রকম যেন
    শুকিয়ে যাচ্ছে, অত্যধিক মদ্যপান করেছে আজ সুশান্ত। সমরেশের ওখানে মধ্যে মধ্যে
    ড্রিঙ্ক করত দুই বন্ধুতে।

    আজ একটু সুবিধাই হয়েছিল। সমরেশের স্ত্রী গৃহে ছিল না, সন্ধ্যা
    থেকে বসে বসে দুই বন্ধুতে পুরো একটা বোতল শেষ করেছে। খাওয়ার কথা মিথ্যা বলেছে
    সুশান্ত।

    খাওয়া মানে দুই বন্ধুতে আকণ্ঠ মদ্যপান!

    রাত অনেক হতে একসময় সমরেশ জিজ্ঞাসা করে, কি রে, যাবি না বাড়ি?

    বাড়ি!

    হুঁ,
    রাত প্রায় সোয়া এগারটা—

    তাই নাকি?

    ঐ দেখ টেবিল-ক্লকটার দিকে চেয়ে।

    সুশান্ত অতঃপর টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়। মাথা হাল্কা, শরীরটাও হাল্কা
    হয়ে গিয়েছে নেশায়। হেঁটে আসার ক্ষমতা ছিল না সুশান্তর। একটা ট্যাক্সি নিয়েই সে
    ফিরে আসে। মোড়ের মাথাতেই ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে সুশান্ত বাকি পথটুকু হেঁটে এসেছিল।
    বাড়ির গেটের কাছে এসেই মিত্ৰাণীর ঘরের আলো জ্বলছে দেখতে পায়।

    আরো দেখতে পায় জানালার সামনে মিত্ৰাণী আছে। মিত্ৰাণী তাহলে জেগেই
    আছে! সুশান্ত এগিয়ে এসে পকেট থেকে চাবিটা বের করে সদর দরজার লক্টা খুলে ভিতরে
    প্রবেশ করে।

    .

    মিত্ৰাণী এসে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়াল।

    সুশান্ত একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছিল।

    আমাকে ডাকছিলেন জামাইবাবু?

    হ্যাঁ-এস,
    ভেতরে এস।

    মিত্ৰাণী একবার সুশান্তর মুখের দিকে তাকাল।

    দু-পা এগিয়ে দরজার গোড়াতেই দাঁড়িয়ে বললে, বলুন—

    একটা কথা ভাবছিলাম—

    কি?

    তুমি তখন বললে চলে যাবে–

    হ্যাঁ।

    ব্যাপারটার অন্যভাবে একটা মীমাংসা হতে পারে না?

    মীমাংসা!

    হ্যাঁ।

    আপনি ঠিক কি বলতে চান বুঝতে পারছি না।

    যদি ধর তোমাকে আমি বিয়ে করি—

    ছি!

    পরিপূর্ণ একটা ঘৃণায় যেন কথাটা উচ্চারিত হল মিত্ৰাণীর কণ্ঠ হতে।

    ছি কেন? আমার বয়স বেশী বলে একটু?

    না।

    তবে?

    তা সম্ভব নয়।

    তাই তো জিজ্ঞাসা করছি, কেন সম্ভব নয়? বাধাটা কোথায়? কিসেরই বা
    বাধা আমাদের বিয়েতে?

    আমি যাচ্ছি। যাবার জন্যই বোধ হয় মিত্ৰাণী ঘুরে দাঁড়ায়–পা বাড়ায়।

    সুশান্ত তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।

    দুপা এগিয়ে এসে বলে, দাঁড়াও-শোন মিতা–

    না, বললাম তো না!

    সুশান্ত হঠাৎ হাত বাড়িয়ে মিত্ৰাণীর একটি হাত চেপে ধরে। বলে,
    বল–কেন না, মিতা?

    আঃ ছাড়ুন, কি করছেন!

    পাশের ঘর থেকে ঐ সময় সুশান্তর বাপ সুকান্তর কাশির শব্দ শোনা গেল।

    হঠাৎ সুকান্ত কাশতে সুরু করেছে।

    সুশান্ত চাপা কণ্ঠে মিত্ৰাণীর হাতটা আরও দৃঢ় মুষ্টিতে চেপে ধরে
    বলে, না, বলতেই হবে তোমাকে, বল-বল–

    সুশান্ত যেন ক্ষেপে গিয়েছে। ভরভর করে সুশান্তর মুখ থেকে মদের গন্ধ
    বের হচ্ছে।

    কেঁপে ওঠে মিত্ৰাণী যেন। এক ঝটকা দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়
    মিত্ৰাণী এবং সুশান্ত কিছু বুঝবার আগেই ছুটে গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে মিত্ৰাণী ঘরের
    দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে খিল তুলে দেয়। সে তখনও রীতিমত হাঁপাচ্ছে। বুকের ভিতরটা
    তখনও তার যেন
    থরথর করে কাঁপছে।

    সুশান্ত বন্ধ দরজার গায়ে মৃদু ধাক্কা দিতে দিতে চাপা কণ্ঠে ডাকে,
    মিতা, মিতা!

    দু-হাতে মুখ ঢেকে ফেলে মিত্ৰাণী। দু চোখের কোল ছাপিয়ে হুঁ হুঁ করে জল নেমে আসে।
    সুশান্তর ইদানীংকার চোখের দৃষ্টিটার তাৎপর্য যেন এক্ষণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মিত্ৰাণীর
    কাছে।

    সুশান্তর মনে তাহলে এই ছিল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

    কুলাদি এইজন্যই তাহলে ইদানীং তার ওপরে এত বিরক্ত হয়ে উঠেছিল?

    সে স্ত্রী হয়ে তার স্বামীর চোখের দৃষ্টিকে ভুল করেনি। আর
    স্বাভাবিক ভাবেই হয়তো সে ভেবে নিয়েছিল মিত্ৰাণীরও সায় আছে।

    ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

    ঘৃণায় লজ্জায় ও একটা অবিমিশ্র ধিক্কারে নিজেকে যেন
    মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মিত্ৰাণীর। এর পর আর এক মুহূর্তও কি তার এখানে
    থাকা নিরাপদ বা যুক্তিসঙ্গত হবে?

    টীকা