Chapter Index

    অবশ্য
    ন্যায়রত্ন লেনে সত্যশরণের
    বর্ণিত নির্দিষ্ট বাসাটা ঠিক বাসা নয়, সেমি মেসবাড়ি, পূর্বেই সে কথা সত্যশরণ কিরীটীকে জানিয়েছিল।

    বাড়িচা দোতলা; ওপরে ও নীচে চার ও তিন সর্বসমেত সাতটি ঘর। এবং বাড়িটা
    নাতিপ্রশস্ত গলির একপ্রকার শেষপ্রান্তে।

    ওপরের তলার চারটি
    ঘরই মাঝারি আকারের। ছোটও নয় খুব, প্রশস্তও নয়। এবং চারটি ঘরের মধ্যে সর্বশেষ ঘরের আগের দক্ষিণখোলা ঘরটিই খালি ছিল। ঘরটা কিরীটীর
    পছন্দ হওয়ায় গৃহকর্তার সঙ্গে সত্যশরণই
    কিরীটীর হয়ে কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে দিল এবং কিরীটী যথারীতি পরের দিনই
    দ্বিপ্রহরে এসে ঘরটি
    অধিকার করল।

    ঘরটি
    তার পছন্দ হয়েছে এবং বলতে গেলে পূর্বের
    ভাড়ার চাইতে কয়টি টাকা কম ভাড়াতেই পাওয়া গিয়েছে সত্যশরণের সুপারিশে।

    কিরীটীর ঘরে কিরীটী একা। বাকী তিনটি ঘরে সত্যশরণকে নিয়ে মোট ছয়জন বোর্ডার আছেন। সত্যশরণকে বাদ দিয়ে বাকী পাঁচজনের মধ্যে দুইজন
    হরবিলাস ও শ্যামবাবু,
    উভয়েই প্রৌঢ় এবং সর্বাপেক্ষা পুরাতন বাসিন্দা এ বাড়ির। এবং বলতে গেলে তাঁরাই বাকী বোর্ডারদের জুটিয়ে দোতলাটাকে
    সেমি মেসে পরিণত করেছেন। দুজনেই মার্চেন্ট অফিসে কাজ করেন এবং প্রতি শনিবার অফিস
    থেকে আর বাসায় না ফিরে সোজা একেবারে দেশের বাড়িতে চলে যান। শনি ও রবিবারটা সেখানে
    কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে আর মেসে না গিয়ে সোজা একেবারে অফিস করতে চলে যান।
    এমনি করেই প্রতি শনি ও রবিবারটা দেশের বাড়িতে কাটিয়ে সোমবার ভোরের গাড়িতে ফিরে
    অফিস করেন ছাপোষা নিরীহ কেরানীর মত। এবং একেবারে ঘোরতর সংসারী ওঁরা দুইজন এক ঘরেই
    থাকেন।

    আর তিনজনই অল্পবয়সী। জীবনবাবু একটা সিনেমার গেটকীপার। মাসে
    ত্রিশটি টাকা পান ও এক জায়গায় টিউশনি করেন। সুধাংশুবাবু, কোন একটি বিলাতী ঔষধের কোম্পানীর
    নন-মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ এবং রজতবাবু
    একটি নামকরা বিলাতী ইনসিওরেন্স কোম্পানীর ভ্রাম্যমাণ দালাল। সত্যশরণ বাসাটা সেমি মেস বলেছিল, কারণ ওখানে কেবল থাকবারই
    ব্যবস্থা আছে। আহারের কোন ব্যবস্থাই নেই। দুটি ভৃত্য আছে, বলাই ও রতন, বাবুদের প্রয়োজনমত দিনের বা রাত্রের আহার্য
    সামনের ট্রামরাস্তার ঠিক ওপরেই অন্নপূর্ণা হোটেল থেকে নিয়ে আসা থেকে চা জলখাবার ও
    অন্যান্য যাবতীয় সর্বপ্রকার ফুট-ফরমাসই খেটে থাকে। বেশীর ভাগ সময় বেলা বোর্ডাররা
    অবশ্য যে যার হোটেলে গিয়েই আহারপর্বটা
    সেরে আসেন প্রত্যহ।

    অন্নপূর্ণা হোটেলটির ব্যবস্থাও ভালই। দামেও সস্তা এবং সাধারণ ডাল ভাত তরকারি মাছের ঝোল
    এবং মধ্যে মধ্যে মাংসও পাওয়া যায়।

    অন্নপূর্ণা হোটেলটি অনেক দিনকার। এবং তার সামনের অংশে ছোটখাটো
    একটা পার্টিশন
    তুলে ও গোটা দুতিন ভাঙা নড়বড়ে টেবিল ও চেয়ার বেঞ্চ পেতে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাও
    একটা আছে। অন্নপূর্ণা হোটেল রেস্তোরাঁ।

    অন্নপূর্ণা হোটেল ও রেস্তোরাঁর মালিক একজন ঢাকার লোক।

    ভদ্রলোকের নাম ভূপতিচরাণু
    চাটুয্যে।
    সরু
    প্যাঁকাটির মত রোগা ডিগডিগে এবং কালো কালির মত গায়ের রং।

    দাড়িগোঁফ কামানো, তেল-চকচকে ভাঙা তোবড়ানো একখানা মুখ। পানের রস ও
    দোক্তার মেছেতা পড়া ইদুরের মত ছোট ছোট দুপাটি দাঁত। গরুর মত দিবারাত্রই প্রায়
    সর্বদা মুখে পানের জাবর কাটছেন।

    লোকটি কিন্তু ভারি অমায়িক ও মিশুকে প্রকৃতির। খদ্দেরের সুখ-দুঃখ
    সুবিধা-অসুবিধা বেশ বোঝেন। হৃদয়
    আছে লোকটার। এবং সেইজন্যই পাড়াতে হোটেল বনাম রেস্তোরাঁটি চলেও বেশ ভালই।

    সত্যশরণদের
    মেসবাড়ি অর্থাৎ দোতলায় ওঠবার সিঁড়িটার কাছেই নীচের বাঁধানো উঠানের মধ্যে পার্টিশন
    তুলে উপরের তলার অধিবাসীদের কলপায়খানার ব্যবস্থা হয়েছে। মোট কথা ওপরের তলার
    বাসিন্দাদের সঙ্গে নীচের তলার অর্থাৎ বাড়িওয়ালা ও তাঁর পরিবারবর্গের কোন সম্পর্কই
    নেই, যদি ওপরের ঘরের জানালা ও বারান্দা থেকে নীচের তলার পার্টিশনের অপর পার্শ্বের বাঁধানো উঠানের প্রায়
    সবটাই এবং ঘরের সামনেকার বারান্দার কিছুটা অংশ চোখে পড়ে।

    নীচের তলায় থাকেন সবটাই নিয়ে বাড়ির মালিক কবিরাজ শ্রীশশিশেখর
    ভিষগরত্ন সপরিবারে। শান্ত নির্বিরোধী ভদ্রলোক শশিশেখর ভিষগরত্ন।

    কালো আলকাতরার মত গাত্রবর্ণ। মেদবহুল থলথলে চেহারা। পিঠ ও বুকভর্তি ঘন কুঞ্চিত রোমচর্যে মনে হয় যেন একটি অতিকায়
    রোমশ ভাল্লক। বিশেষ করে যখন তিনি বাইরের ঘরের তক্তপোশের ওপরে বিস্তৃত মলিন ফরাসের
    ওপরে বসে থাকেন একটি থেলো হুঁকো
    হাতে নিয়ে।

    দাড়ি-গোঁফ নিখুঁতভাবে
    কামানো। মাথায় তৈলসিক্ত বাবরি
    চুল।
    কপালে আঁকা সর্বদাই একটি রক্তসিন্দরের বিপন্দ্রক। মুলোর মত সাদা ঝকঝুঁকে দন্তপাটি হাসতে গেলেই শুধু, যে বিকশিত হয়ে পড়ে তাই
    নয়, সেই সঙ্গে অতিরিক্ত তাম্রকট সেবনে অভ্যস্ত কালচে বর্ণের মাড়িটিও যেন খিঁচিয়ে
    ওঠে। তাতেই হাসিটা বিশ্রী কুৎসিত দেখায় আরো। কুৎসিত সেই হাসি শশিশেখরের পর কালচে
    ওঠপ্রান্তে যেন লেগেই আছে। কথায় কথায়ই তিনি হাসেন সেই কুৎসিত হাসি। তবে সশব্দ নয়,
    নিঃশব্দ। এবং কথা বলেন অত্যন্ত কম। স্বল্পভাষী। শশিশেখরকে কেউ বড় একটা কথা বলতেই
    দেখে না। ভদ্রলোকের সংসারে স্ত্রী যাকে কখনো বড় একটা দেখাই যায় না এবং গলাও যার বড়
    একটা শোনাই যায় না, মুখের উপরে সর্বদাই দীর্ঘ একটি অবগুণ্ঠন টানা। বাড়ির বাইরেও বড়
    একটা তাকে দেখা যায় না।

    এবং একটি ছেলে অনিলশেখর, বয়স বাইশ-তেইশ হবে। আর একটি মেয়ে অমলা, বয়স
    বছর উনিশ-কুড়ির বেশী হবে না।

    কি চেহারায় বা গাত্রবর্ণে কবিরাজ মশায়ের সঙ্গে তার ছেলে ও মেয়ে
    অনিলশেখর বা অমলার যেন কোন সৌসাদৃশ্যই
    নেই।

    অনিলশেখর ও অমলার রূপ
    যেন ঝলমল
    করে। যেমনই সুঠাম সুন্দর চেহারা তেমনই উজ্জল গৌর গাত্রবর্ণ।

    সংসারে আরো একটি প্রাণী আছে। কবিরাজ মশাইয়ের দুরসম্পর্কীয় ভাগ্নে দ্বিজপদ।

    ছেলেটির বয়স তেইশ-চব্বিশের মধ্যেই। দ্বিজপদই কবিরাজ মশাইয়ের কম্পাউণ্ডার বা
    অ্যাসিস্টেন্ট। নীচের তলার তিনখানি ঘরের মধ্যে বাইরের প্রশস্ত ঘরটিতেই কবিরাজ মশাইয়ের রোগী
    দেখা হতে শুরু করে ডিসপেনসারীর, ঔষধের কারখানা এবং দ্বিজপদর থাকা-শোয়ার সব কিছু ব্যবস্থা।

    ঘরের ২/৩
    ও ১/৩
    অংশের মধ্যে একটি কাঠের ফ্রেমে চটের পার্টিশন বসানো।

    পার্টিশনের একদিকে খানচারেক পুরানো সেকেলে সেগুন কাঠের তৈরি ভারী
    বার্নিশ
    ওঠা আলমারি। তার মধ্যে তাকের উপরে সাজানো
    ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের শিশি, বোতল, বয়ম, জার—নানাবিধ কবিরাজী তৈল, ভস্ম, গুলি,
    বটিচর্ণ প্রভৃতি ঔষধে ভর্তি।

    সামনাসামনি বড় বড় দুটি তক্তপোশ, পাশাপাশি জোড়া দিয়ে উপরে একটি তৈল-চিটচিটে
    মলিন ফরাস বিছানো এবং তদুপরি অনুরুপ চারটি
    তাকিয়া।

    শশিশেখর ভিষগরত্ন ঐ চৌকির ওপরে উপবিষ্ট অবস্থাতেই রোগীদের দেখা ও
    তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালান। একপাশে একটি বেঞ্চ পেতে রঙিন পুরাতন একটি
    শাড়ি দড়ির সাহায্যে টাঙিয়ে আড়াল তুলে

    স্ত্রীরোগীদের দেখবারও ব্যবস্থা আছে।

    বাড়িটার উপরের তলাটা ভাড়া দিয়ে, কবিরাজী ব্যবসা করে, নিজস্ব তৈরি
    পেটেন্ট দ্রাক্ষারিষ্ট, মহাবলচূর্ণ,
    অক্ষয় অমৃত
    সঞ্জীবনী সুধা,
    পারিজাত মোদক,
    মুক্তাভস্ম,
    মহাশান্তি বৃহৎ
    বনরাজী তৈল, ব্যাঘ্রাবল রসবটিকা, নয়নরঞ্জন সুর্মা
    ইত্যাদি সব বিক্রয় করে কবিরাজ মশায়ের যে বেশ দুপয়সা উপার্জন হয় সেটা তাঁর সচ্ছল
    অবস্থা দেখলেই অনুমান করতে একটুও
    কষ্ট হয় না। প্রতি মাসে ২রা তারিখে একটিবার করে সকালে কবিরাজ মশাইয়ের কাষ্ঠপাদুকার
    খটখট শব্দ উপরে ওঠবার সিঁড়ির মুখে ধ্বনিত
    হয়ে ওঠে।

    বোর্ডারদের
    সামনে এসে একের পর এক দাঁড়ান দন্ত ও মাড়িযোগে নিঃশব্দ কুৎসিত তাঁর সেই পেটেন্ট
    হাসিটি নিয়ে।

    দেহরোম ও মেদবাহুল্যের
    জন্যই বোধ হয় কবিরাজ মশাইয়ের গ্রীষ্মবোধটা একটু
    বেশিই। শীত গ্রীষ্মে কোন প্রভেদ নেই। কবিরাজ মশাই তন্ত্রমতে কালীসাধক।

    কপালের রক্তসিন্দূরের
    ত্রিপুন্ড্রকটিই
    তার পরিচয়।

    মাথার ঘন বাবরি
    চুল
    হতে উগ্র কটু
    একটা কবিরাজী তেলের গন্ধ কবিরাজ মশাই সামনে এসে দাঁড়ালেই যেন ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।

    গা পাক দিয়ে ওঠে, বমনোদ্রেক আনে।

    কবিরাজ মশাই বলেন, তেলটি তাঁরই নিজস্ব আবিষ্কার। মহাশক্তি-দায়িনী বৃহৎ বনরাজী তৈল। মস্তিষ্ক
    শান্ত ও শীতল রাখার অব্যর্থ মহৌষধি।

    উপরে এসে একটিমাত্র কথাই বলেন কবিরাজ মশাই, গরীব ব্রাহ্মণকে দয়া করুন।

    ভাড়াটে ও বাড়িওয়ালা পরস্পরের মধ্যে মাসাতে একটিবার মাত্র ও ঐ একটি
    কথারই আদান-প্রদান ছাড়া আর কোন সম্পর্কই নেই।

    ঘরভাড়া অবশ্য যে যার সকলেই
    চুকিয়ে
    দেন চাওয়া মাত্রই।

    বলতে গেলে উপরের তলার অধিবাসীরা প্রতি মাসের দুই তারিখের ঐ সময়টির
    জন্য যেন পূর্ব
    হতে প্রস্তুতই হয়ে থাকেন।

    টীকা