Chapter Index

    আমি তাকিয়ে ছিলাম দেওয়ালে টাঙানো পাশাপাশি অয়েল-পেন্টিং দুটোর দিকে।

    সোমলতা আর বনলতা শিল্পী রণধীর
    চৌধুরীর দুই মেয়ে। টুইন যমজ বোন। এবং ওদেরই একজনের ছেলে শতদল। কিন্তু শতদল কার
    ছেলে–বনলতার
    না সোমলতার! শশাঙ্ক চৌধুরীর ছেলে রণধীর
    চৌধুরী আর হিরণ্ময়ী
    দেবী।

    হিরণ্ময়ী
    দেবীর মুখের দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছে আরো যেন তাঁর কিছু বলার আছে, কিন্তু তিনি যেন
    বলতে পারছেন না। চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে কিরীটীর দিকে তাকালাম। গভীর কোন চিন্তার
    মধ্যে ও ড়ুবে আছে। হস্তধৃত
    জলন্ত সিগারেটটা নিঃশব্দে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। কোন একটা
    বিশেষ চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কিন্তু সেটা কী? হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর মধ্যে কী এমন সে পেল
    চিন্তার খোরাক?
    শতদল-রহস্য-কাহিনীর কোন সূত্র
    কি সে খুঁজে পেল? একটু আগে
    রাস্তায় আসতে আসতে কিরীটী বলেছিল, অন্ধকারে সে আলো দেখতে পেয়েছে। মাত্র একটি জায়গায়
    সুত্রে এসে জট পাকিয়ে রয়েছে। সেই জটটি খুলতে পারলেই সব বোঝা যাবে। হিরণ্ময়ী দেবী বর্ণিত কাহিনীর
    মধ্যে কি সেই সূত্রটিই ও খুঁজে পেল? আমি
    তো কই কিছুই এখনো ভেবে পাচ্ছি না! কেন শতদলবাবুর প্রাণের ওপরে এমনি বার বার
    প্রচেষ্টা হল? আর কেই বা তাঁকে বার বার হত্যা করবার চেষ্টা করছে?

    আচমকা কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।

    এইটুকুই
    কি আপনার বলবার ছিল হিরণ্ময়ী
    দেবী? আর কি কিছুই আপনার বলবার নেই? কিরীটীর দু’চক্ষুর শাণিত দৃষ্টি সম্মুখে উপবিষ্ট হিরণ্ময়ী দেবীর মুখের ওপরে
    স্থিরনিবদ্ধ।

    অ্যাঁ! হিরণ্ময়ী
    যেন চমকে উঠলেন। আপনার কি বলবার আর কিছুই নেই?

    না।
    ক্ষীণকণ্ঠে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ।

    আপনি তো কই এখনো বললেন না, আপনার স্বামী কবিতা দেবীর বাড়িতে কেন
    গিয়েছিলেন?

    আমি যতদূর
    জানি আমার স্বামী এ দুদিন মোটে বাড়ি থেকে বেরই হননি।

    হ্যাঁ, আপনার জানিত-ভাবে বের হননি এটা বিশ্বাস করি, কিন্তু তিনি
    যে গিয়েছিলেন এটাও ঠিক। কারণ
    দৈবক্রমে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা সেখানে খসে পড়ে গিয়েই, সেখানে যে তিনি গিয়েছিলেন
    সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে হিরণ্ময়ী
    দেবী! এক্ষেত্রে অস্বীকার করেও তো উপায় নেই। দৈবই যে প্রতিকূল!

    কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন
    মিঃ রায়, আমার স্বামীর শতদলকে হত্যা করবার কোন কারণই নেই এবং তিনি তা করবার চেষ্টাও করেননি।

    আমি বিশ্বাস করি হিরণ্ময়ী
    দেবী, হরবিলাসবাবু
    সে কাজ করেননি কিন্তু তিনি যে শরৎবাবুর বাসায় গিয়েছিলেন, যে
    কোন কারণেই হোক—সেটা আমার স্থিরবিশ্বাস। এবং অনুমান যদি আমার মিথ্যা না হয় তো
    হরবিলাসবাবু,
    আপনার জ্ঞাতসারেই সেখানে গিয়েছিলেন!

     কিরীটীর স্পষ্টাস্পষ্টি
    অভিযোগেও হিরণ্ময়ী
    দেবী নিঃশব্দে বসে রইলেন। কোন সাড়া দিলেন না।

    আমার কি বিশ্বাস জানেন হিরণ্ময়ী
    দেবী! কিরীটী আবার কথা বললে। হিরণ্ময়ী
    কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

    দূতরূপেই মিঃ ঘোষ কবিতা দেবীর
    ওখানে গিয়েছিলেন। এবং সে-কথা কবিতা দেবীর কাছ হতে বের করতে আমায় বিশেষ কষ্ট পেতে
    হবে না। কিন্তু আমি চাই আপনিই সব কথা আমাকে খুলে বলুন।

    আমি কিছু জানি না। হিরণ্ময়ী
    দেবীর সমস্ত মুখখানা যেন পাথরের মত কঠিন মনে হয়।

    তাহলে একান্ত দুঃখের সঙ্গেই আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এর পর আপনার
    স্বামীকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া আর আমাদের দ্বিতীয় পথ থাকবে না!

    কিন্তু আপনি নিজের মুখেই তো একটু আগে বললেন যে, আমার স্বামী শতদলকে হত্যা
    করবার প্রচেষ্টার ব্যাপারে নিদোষ?

    তা বলেছি। তবে তাঁকে ঘিরে যে সন্দেহ জমে উঠেছে, সেটা যতক্ষণ না
    পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তাঁকে মুক্তি দেওয়াও তো সম্ভব নয়। আপনিই বলুন না! শুনুন হিরণ্ময়ী দেবী, আমি জানি এ সব কিছুর মূলে কে–

    বিদ্যুৎ-চমকের মতই হিরণ্ময়ী
    কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন, আপনি —আপনি জানেন?

    হ্যাঁ, জানি।

    তবে—তবে আপনি তাকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন?

    ব্যস্ত হবেন না। সময় হলে আপনা হতেই তাকে হাজতে গিয়ে ঢুকতে হবে।

    কিন্তু

    আপনার কাছে আমি যা জানতে চাইছি বলুন!

    কি বলব?

    বলুন
    কেন সেদিন আমাদের কাছে আপনি মিথ্যা কথা বলেছিলেন যে, স্বর্গত রণধীর
    চৌধুরীর দ্বিতীয় মেয়েটির কথা আপনি কিছু জানেন না? সোমলতা
    আর বনলতা—তাদের সমস্ত কথা এখনো আপনি বলেননি!

    বনলতা আর সোমলতা দুজনেই মারা গেছে।

    শতদলবাবু
    কার ছেলে?

    সোমার।

    আর বনলতার স্বামীই বা কে? আর তার সন্তান কটি?

    বনলতার স্বামীর নাম ডঃ শ্যামাচরাণ সরকার।

    হিরণ্ময়ী
    দেবী কথাটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর সমস্ত সত্তা যেন সহসা বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত সজাগ হয়ে ওঠে। উদগ্রীব ব্যাকুল কণ্ঠে
    প্রশ্ন করে, কী– কী বললেন?

    ডঃ শ্যামাচরণ
    সরকার—বনলতার স্বামী।

    কোন শ্যামাচরণ
    সরকার? অধ্যাপক ডঃ শ্যামাচরণ
    সরকার কি?

    হ্যাঁ।

    কিরীটীর চোখে-মুখে ক্ষণপূর্বে
    যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, সেটা যেন আবার নিভে এল। সে দ্বিতীয় প্রশ্ন করলে,
    তাহলে—তাহলে হরবিলাসবাবু
    কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন কেন?

    আপনাকে তো আমি বললাম, আমার স্বামী সেখানে যাননি! এবং কবিতার সঙ্গে
    তাঁর পরিচয়ও নেই।

    তা হতে পারে না। Simply absurd! একেবারে অসম্ভব। নিশ্চয়ই
    হরবিলাসবাবু কবিতা দেবীর ওখানে গিয়েছিলেন। এবং তিনি শতদলবাবুকে নার্সিং হোমে ফুল ও মিষ্টি পাঠাতে বলেও
    এসেছিলেন, এ-ও সত্যি। কিন্তু এইটাই বোঝা যাচ্ছে না, কেন—কেন তিনি ও-কথা কবিতা
    দেবীকে বলতে গেলেন। তারপর একটু
    থেমে কতকটা আত্মগত ভাবেই বললে, আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা হয় তাহলে–,কিরীটী শেষের কথাগুলো
    খুব ধীরে যেন উচ্চারণ
    করল এবং পরক্ষণেই হিরণ্ময়ী
    দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, আপনার স্বামীর হাতের আংটিটা কত দিন ওঁর হাতে
    আছে বলতে পারেন?

    তা দশ-বারো বছর তো হবেই।

    বলতে পারেন আপনার স্বামীর হাতের আংটিটার পাথরটা—যেটা তাঁর আংটিতেই
    আছে, শেষবারে কবে আপনার নজরে পড়েছিল?

    সীতার মৃত্যুর আগের দিনও আংটির পাথরটা ঠিক ছিল—যেন দেখেছি বলেই
    মনে হয়।

    তাহলে আর কি হবে! চল সুব্রত,
    ওঠা যাক। আমার দিকে তাকিয়ে কিরীটী বলল।

    কিরীটীই প্রথমে কক্ষত্যাগের জন্য প্রস্তুত হয় এবং আমিও উঠে দাঁড়াই।

    আমাদের কক্ষত্যাগ করতে উদ্যত দেখে ব্যাকুল কণ্ঠে হিরণ্ময়ী বলে ওঠেন, কিন্তু আমার
    স্বামী?

    কিরীটী ঘুরে দাঁড়িয়ে শান্তকণ্ঠে বললে, আংটির পাথরের ব্যাপারটা
    যতক্ষণ না মীমাংসিত হচ্ছে, আপনার স্বামীকে হাজতে নজরবন্দী থাকতেই হবে হিরণ্ময়ী দেবী। আমি দুঃখিত।

    বিনা দোষে আমার স্বামীকে হাজতবাস করতেই হবে?

    দোষের কথা তো এখানে নয়, সন্দেহক্রমে—

    অতঃপর হরবিলাসকে সঙ্গে নিয়েই আমরা নিরালা থেকে বের হয়ে এলাম। পথে
    বের হয়ে কিরীটীর নির্দেশক্রমে দুজন সেপাইয়ের হেপাজতে হরবিলাসকে থানায় পাঠিয়ে দিয়ে
    কিরীটী ঘোষাল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললে, চলুন, আর একবার শরৎ উকিলের বাসাটা ঘুরে যাওয়া যাক!

    এখুনি? বেলা অনেক হয়েছে, সন্ধ্যার দিকে গেলে হত না? প্রশ্নটা
    করলেন থানা-অফিসার রসময় ঘোষাল।

    না, শুভস্য শীঘ্রম। কিরীটীর কণ্ঠস্বরে অদ্ভুত একটা দৃঢ়তা প্রকাশ
    পায়।

    শহরের পথে চলতে চলতে আমি একটা কথা কিরীটীকে না স্মরণ করিয়ে দিয়ে পারলাম না, নিরালার
    উপরের ঘর—যার তালা ভাঙা ছিল, সে ঘর দেখা হল না!

    কিরীটী মৃদুকণ্ঠে
    বললে, ব্যস্ততার কী আছে? দেখলেই হবে! বেলা তখন প্রায় একটা হবে।

    মধ্যাহ্ন-সূর্য
    মাথার উপরে প্রচণ্ড তাপ বর্ষণ করছে। কিরীটীর দ্রুত পদবিক্ষেপ দেখে মনে হচ্ছিল, মনে
    মনে সে যেন বিশেষ কোন একটা মীমাংসায় উপনীত হতে চলেছে। বারবারই লক্ষ্য করেছি,
    কিরীটী যখন কোন একটা জটিল ব্যাপারে মীমাংসার কাছাকাছি আসে, তার চালচলন কথাবার্তা এমনি দ্রুত ও ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে।
    তার অত্যন্ত ধীর-স্থির ভাব যেন সহসা অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে ওঠে।

    ঠিক দ্বিপ্রহরে ঐদিন দ্বিতীয়বার আবার আমাদের তাঁর ওখানে আসতে দেখে
    কবিতা দেবী বেশ যেন কিছুটা বিস্মিতই হন।

    শরৎবাবু
    বাসায় ছিলেন না, একটু
    আগে আদালতে বের হয়ে গিয়েছেন। কবিতা দেবী আমাদের বসতে বললেন।

    আবার আপনাকে বিরক্ত করতে আসতে হল কবিতা দেবী! কিরীটীই কথা শুরু করে।

    না,
    না—এর মধ্যে বিরক্তির আর কী আছে!

    ঘোষাল সাহেব হরবিলাসবাবুকে শতদলবাবুর হত্যা-প্রচেষ্টার ব্যাপারে অ্যারেস্ট
    করেছেন কিছুক্ষণ আগে

    সে কি! হরবিলাসবাবু–

    হ্যাঁ, তবে তাঁর মুক্তির ব্যাপারটা নির্ভর করছে আপনার evidence-এর
    ওপরে।

    আমার evidence-এর ওপরে?

    হ্যাঁ।

    কিন্তু আমি তো আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না মিঃ রায়!

    হরবিলাসবাবু
    বলতে চান যে, তিনি আপনার কাছে গত পরশু
    এসে শতদলবাবুকে
    ফুল
    ও সন্দেশ পাঠাতে বলেননি, অথচ ঘোষাল সাহেবের ধারণা তিনিই এসেছিলেন! কিরীটী জবাব দিল।

    কিন্তু আমি তো বলিনি যে হরবিলাসবাবু এসেছেন! একটা ঢোক গিলে কবিতা জবাব দেন।

    তিনি যদি না-ই এসে থাকবেন, তাহলে তাঁর হাতের আংটির পাথরটা আজ
    সকালে আপনার এই ঘরে কুড়িয়ে পাওয়া গেল কি করে? কথাটা বললেন ঘোষাল।

    আংটির পাথর কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছে এই ঘরে?

    হ্যাঁ।

    কে পেয়েছেন?

    মিঃ রায়।

    সত্যি! কথাটা বলে কবিতা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।

    হ্যাঁ।

    কই দেখি সে পাথরটা?

    কিরীটী একান্ত নির্বিকার ভাবেই যেন জামার পকেট হতে হাত ঢুকিয়ে প্রবাল পাথরটা বের করে কবিতার
    চোখের সামনে ধরল।

    আশ্চর্য! এই তো—এটা তো আমার আংটির পাথরটা! কাল কখন আংটি থেকে পড়ে
    গিয়েছে, খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

    আপনার আংটির পাথর! কই, আপনার আংটিটা কই?

    আংটি হতে পাথরটা পড়ে যাওয়ায় আজ সকালেই বাক্সে তুলে রেখেছি।

    দয়া করে আংটিটা আনবেন কি?

    নিশ্চয়ই। কিরীটীকে আর দ্বিতীয় প্রশ্নের সময় না দিয়ে কবিতা উঠে ঘর
    হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাথরহীন একটা আংটি নিয়ে এল।

    এই দেখুন!

    কিরীটী আংটিটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে আড়চোখে একবার কবিতার দিকে
    তাকিয়ে বললে, কিন্তু এ আংটিটা তো আপনার হাতের আঙুলে fit করবার কথা নয় কবিতা দেবী!
    এটা কার আংটি?

    কেন, আমার?

    উঁহু।
    কই পরুন তো!

    এবারে কবিতা দেবী যেন একটু বিমূঢ়
    হয়ে পড়েন। একটু
    বিহ্বল।
    হতচকিত।—অবিশ্যি আংটিটা একটু
    আঙুলে আমার বড়ই হয়—

    তাই তো বলছিলাম, সত্যি করে বলুন তো আংটিটা কার?

    আমারই।

    না,
    কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে আংটিটা দিয়েছেন! তাই নয় কি কবিতা দেবী?

    হ্যাঁ। নিম্নকণ্ঠে জবাব
    দিলেন কবিতা।

    কে কে দিয়েছেন?

    ক্ষমা করবেন কিরীটীবাবু, ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিগত।

    হুঁ।

    অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে।

    পরশু
    কে আপনাকে এসে বলেছিল, শতদলবাবুকে ফুল
    ও সন্দেশ পাঠাতে নার্সিং হোমে?

    তাকে চিনি না, দেখিনি কখনো।

    দেখতে কেমন?

    বয়েস পঞ্চাশের নীচে হবে বলে মনে হয় না। মুখে দাড়ি-গোঁফ ছিল। একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।

    নাম কিছু বলেনি?

    না,
    জিজ্ঞাসা করিনি।

    কোথা হতে আসছে তা বলেনি?

    হ্যাঁ, বলেছিল নার্সিং হোম থেকেই। সেখানেই নাকি কাজ করে।

    আচ্ছা কবিতা দেবী, বিখ্যাত সুইমার কুমারেশ সরকারের নাম শুনেছেন?

    কিরীটীর আচমকা বিষয়ান্তরে গিয়ে সম্পূর্ণ ঐ নতুন প্রশ্নে কবিতা
    প্রথমটা বোধ হয় একটু
    কেমন বিস্ময়ে বিহবল হয়ে পড়ে এবং ক্ষণকাল কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

    তারপর
    কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়েই জবাব
    দেয়, নাম শুনেছি, কিন্তু সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় নেই।

    কিরীটী এরপর
    আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আচ্ছা তাহলে চলি। নমস্কার।

    হোটেলে প্রত্যাগমন করে আহারাদির পর কিরীটী ঘরের মধ্যে একটা
    আরামকেদারায় শুয়ে চোখ বুজল।

    আমি একটা বাংলা বই নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিলাম। সারা সকাল
    হাঁটাহাঁটির ক্লান্তিতে কখন দু-চোখের পাতা বুজে এসেছিল টের পাইনি।

    ঘুম ভাঙল একেবারে সন্ধ্যার দিকে। তাড়াতাড়ি শয্যার ওপরে উঠে বসতেই
    নজরে পড়ল কিরীটী নিঃশব্দ অস্থির পদে ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। এবং হাতে তার শতদলবাবুর নিকট হতে চেয়ে নিয়ে আসা
    রণধীরের
    চিত্রাঙ্কিত চিঠিটা।

    চা খেয়েছিস? প্রশ্ন করলাম।

    বাবাঃ, ঘুম ভাঙল তোর?

    হ্যাঁ। খুব ঘুমিয়েছি
    নাকি?

    না,
    মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা! চল, চা খেয়ে একটু
    বেরনো যাক।

    আগে শয্যা হতে উঠে সুইচ টিপে আলোটা জাললাম। তারপর বেরিয়ে গিয়ে বেয়ারাকে চায়ের অর্ডার দিয়ে ফিরে
    এসে দেখি, চেয়ারটার উপরে উপবেশন
    করে সেই চিত্রাঙ্কিত হিজিবিজি-মাকা চিঠিটা কিরীটী গভীর মনোযোগ সহকারে দেখছে।

    ব্যাপার কি তোর বল, তো কিরীটী? চিঠিটার মর্মোদ্ধারের প্রতিজ্ঞা নিয়েছিস
    নাকি?

    মর্মোদ্ধার হয়ে গিয়েছে এবং নিরালার রহস্যের উপরেও কাল প্রত্যুষেই যবনিকাপাত!

    সত্যি?

    হ্যাঁ।

    চা-পান করে দুজনে হোটেল থেকে বের হলাম।

    পথে নেমে কিরীটী বললে, চল, একবার ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে দেখা করে
    আসি।

    ঘোষাল সাহেব থানাতে ছিলেন না। কাছে-পিঠেই নাকি কোথায় এনকোয়ারিতে
    গিয়েছেন। এ, এস,
    আই, রামকিঙ্কর ওঝা ছিলেন। খসখস করে কাগজ ও পেন দিয়ে একটা চিঠি লিখে চিঠিটা খামের
    মধ্যে পরে সেটা ওঝার হাতে দিয়ে আমরা থানা হতে বের হয়ে এলাম। বুঝতে পারছি কিরীটীর
    বাইরের শান্ত ভাবটা মুখোশ মাত্র। ভিতরে তার যে ঝড় চলেছে সেটাকে সে চাপা দিতে পারছে
    না। এবং রহস্যের মীমাংসার শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে বলেই নিজেকে সে যথাসাধ্য চেষ্টা
    করছে বাইরে ধীর ও শান্ত রাখার জন্য।

    শামুকের মত নিজেকে ও এখন গুটিয়ে রেখেছে। হাজার খোঁচাখুচি করলেও
    এখন ও মুখ খুলবে না। এ যেন ওর রহস্যের মীমাংসার শেষ চৌকাঠের সামনে এসে নিঃশব্দে
    শক্তিসঞ্চয় করা। ঘণ্টাখানেক প্রায় সমুদ্রের কিনারে কাটিয়ে রাত সাড়ে আটটা নাগাদ হোটেলে
    ফিরে এলাম। এবং হোটেলে পৌঁছেই
    আমাকে কোন কথার অবকাশ মাত্র না দিয়ে কিরীটী দোতলার দিকে চলে গেল।

    আমি দ্বিপ্রহরের অর্ধসমাপ্ত উপন্যাসটা নিয়ে চেয়ারে বসলাম।

    উপন্যাসের কাহিনীর মধ্যে একেবারে ড়ুবে গিয়েছিলাম, হোটেলের ওয়েটারের
    ডাকে খেয়াল হল।

    সার, আপনাদের খানা কি ঘরে দিয়ে যাব?

    খানা! হ্যাঁ, নিয়ে এস।

    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নটা। আশ্চর্য! এখনো কিরীটী ফিরল
    না? উঠে ডাকতে যাব, কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।

    এতক্ষণ কোথায় ছিলি?

    সমুদ্রের
    ধারে রাণু
    দেবীর সঙ্গে গল্প করছিলাম।

    এতক্ষণ ধরে কি এমন গল্প করছিলি?

    গল্প নয়, শুনছিলাম। এক প্রেমের জটিল উপাখ্যান।

    কার—রাণুর?

    হ্যাঁ—তা নয় তো কি হিরণ্ময়ী
    দেবীর!

    ওয়েটার ট্রেতে করে খানা সাজিয়ে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

    খানা খাবার পর কিরীটী চেয়ারে শুয়ে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।

    শয়নের যোগাড় করছি, কিরীটীর কথায় ফিরে তাকালাম, উঁহু, এখন নয়।

    তার মানে?

    এখন একবার বেরুতে
    হবে।

    এত রাত্রে আবার কোথায় যাবি?

    নিরালায়।

    টীকা