০৫. শ্মশান হতে ফিরে
নীহাররঞ্জন গুপ্ত দ্বারাশ্মশান
হতে ফিরে সবিতা স্নান সেরে তার নিজের ঘরে শয্যার উপরে গা এলিয়ে পড়েছিল। সমস্ত
শরীরে একটা ক্লান্ত অবসন্নতা।
কানাইয়ের মা এক গ্লাস
সরবৎ হাতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
দিদিমণি, এই সরবটুকু খেয়ে নাও দেখি—
ওই টেবিলের উপর রেখে যা কানাইয়ের মা।
না। এই সরবটুকু তুমি খেয়ে নাও।
বিরক্ত করিস না। যা বলছি তাই শোন। সত্যজিৎবাবুকে চা-জলখাবার দিয়েছিস?
হ্যাঁ, তৈরী হয়ে গেছে, এবার দেব।
তোদের দিয়ে কোন কাজ হয় না। আগে কোথায় তাঁকে চা-জলখাবার। দিবি, তা
নয় আমার জন্য সরবৎ নিয়ে এসেছিস!
লজ্জিত কানাইয়ের মা সরবতের গ্লাসটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে
সত্যজিৎকে চা-জলখাবার দেবার জন্য ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সত্যজিৎ তার নির্দিষ্ট ঘরের মধ্যে জানালার ধারে একটা চেয়ার টেনে
নিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপটি করে বসেছিল।
বনমালী ঘরের মধ্যে সেজ বাতিটা জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে বটে তবে আলোর শিখাটা কমানো।
খাবারের প্লেট ও চায়ের কাপ হাতে কানাইয়ের মা ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল,
বাবু!
কে?
চা এনেছি বাবু।
তোমার দিদিমণিকে কিছু খেতে দিয়েছিলে কানাইয়ের মা?
হ্যাঁ, সরবৎ দিয়ে এসেছি।
খাবারের প্লেটটা ও চায়ের কাপ পাশের একটা চৌকির উপরে নামিয়ে রেখে
কানাইয়ের মা ঘর হতে বের হয়ে যাবার জন্য উদ্যত হল।
সত্যজিৎ ডাকল, কানাইয়ের মা!
সত্যজিতের ডাকে কানাইয়ের মা ফিরে দাঁড়াল।
ওইখানে এসে বসো কানাইয়ের মা। তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
সত্যজিতের আহবানে কানাইয়ের মা তার সামনে এসে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে
থাকে।
ওইখানে বসো।
কানাইয়ের মা মাটিতেই বসল।
চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বললে, তুমি তো এ বাড়িতে অনেক
দিন আছ শুনলাম, পুরনো লোক—
দিদিমণির এককুড়ি তিন বছর বয়স হল। তা ধর না গো—তারও দুবছর আগে থেকে
এ বাড়িতে আমি আছি বাবু।
পুরনো নোক বইকি।
অর দিদিমণিও তো শুনেছি তোমারই কোলেপিঠে মানুষ।
তা ছাড়া আর কার?
আমারই কোলেপিঠে দিদিমণি মানুষ হল তো!
আচ্ছা কানাইয়ের মা, তোমাদের দিদিমণির বাবা মানে কর্তাবাবু, তুমি তো জান তাকে কেউ
খুন করেছে—
আহা! আর বোলোনি গো বাবু,
মেয়েটার কি দুঃখের কপাল! ওর মা আহা সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-ঠাকরুণ ছিলেন গো—স্বগগের দেবী, মেয়েটার চার বছর বয়সের সময় অঘোরে
মারা গেল এই হতচ্ছাড়া বাড়িতেই। কত্তাবাবুও
এই বাড়িতেই মারা গেল অঘোরে। এই বাড়িটাই অলুক্ষুণে
বাবু
তোমার দিদিমণির মাও এই বাড়িতেই মারা গিয়েছিলেন নাকি?
তাছাড়া আর কি! এই বাড়িতেই তো!
কি হয়ে মারা যান তিনি?
কাউকে বোলোনি বাবু।
কেউ জানে না। কত্তাবাবুর
মানা ছিল, এতদিন কাউকে বলিনি
তোমার দিদিমণিও জানে না?
না।
এক কত্তাবাবু
জানতেন—আর জানতাম আমি
সত্যজিৎ কৌতূহলে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সবিতার মার মৃত্যুর মধ্যেও তাহলে একটা রহস্য রয়ে গিয়েছে। কেবল
জমিদার মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীরই রহস্যময় মৃত্যু ঘটেনি, উনিশ বছর আগে সবিতার মার মৃত্যুর ব্যাপারেও এমনি কোন রহস্য ছিল। এবং শুধু
তাই নয়, উভয়েরই মৃত্যু একই বাড়িতে ঘটেছে।
কানাইয়ের মা অনেক কথা জানে। হয়ত সেসব কথা জানতে পারলে বর্তমান
রহস্যের উপরে অনেকখানি আলোকসম্পাত হবে।
সব গুছিয়ে কৌশলে কানাইয়ের মার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
কানাইয়ের মার কয়েকটি কথাতেই সত্যজিৎ বুঝেছিল, মেয়েমানুষ হয়েও
এতকাল একমাত্র জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর ভয়েই হয়ত কানাইয়ের মা যেসব গোপন কথা
এতকাল কারো কাছে মন খোলসা করে বলতে সাহস পায়নি, অথচ ভিতরে ভিতরে যে কথাগুলো তার
স্বাভাবিক নারীমনের বৃত্তিতে
কারো কাছে উগরে দেবার জন্য ছটফট করেছে—সত্যজিতের কাছে তারই কিছু হয়ত হঠাৎ বলে
ফেলেছে।
সত্যজিতের ধারণা যে মিথ্যে নয় সেটা সে পরমুহূর্তে বুঝতে পারে কানাইয়ের মায়ের পরবর্তী কথায়, অনেক কথা বলে ফেননু বাবু। কাউকে আবার যেন বলোনি। কত্তাবাবু, আজ আর বেঁচে নেই বটে তবে ধর্মের ভয় তো
আছে গো।
তা তো নিশ্চয়ই। তোমার কোন ভয় নেই কানাইয়ের মা। আমি সব শুনেছি,
তুমি এদের কত বড় আপনার লোক। দিদিমণির তুমি মায়ের সমান। দিদিমণিই বলছিল তুমি তো তার
মায়ের মতই
তা বইকি বাবু!
আনন্দে গদগদ হয়ে ওঠে কানাইয়ের মা। হাজার হলেও
নারীর মন তো। সত্যজিতের কথাগুলো তার নারীচিত্তের ঠিক জায়গাটিতেই গিয়ে ঘা দিয়েছে।
আমিও তো তাই বলি কানাইয়ের মা। পেটে ধরলেই কি কেবল মা হয়! দেখো তোমরা
যাই বল, অপঘাতে বাবুর
মৃত্যু
হয়েছে, আমার কিন্তু ধারণা এ কোন দুষ্ট লোকের কাজ—
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা,
সত্যজিতের মুখের দিকে।
হ্যাঁ। সব তোমাকে আমি বলব কিন্তু তার আগে তোমার কাছ থেকে আমার
কতকগুলো কথা জানা দরকার।
আমি কি জানি বাবু
আজ রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর একবার আসতে পার কানাইয়ের মা এ ঘরে? আমি আর তোমার দিদিমণি
থাকব। তোমার সঙ্গে কথা আছে।
তা আর পারবোনি
কেন, আসবোখন।
বাইরে এমন সময় বনমালীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, অ কানাইয়ের মা; কুণ্ঠে
গেলি
মুখপোড়া বনমালী মিনষে আবার চেঁচাতে নেগেছে,
যাই বাবু
বলি অ কানাইয়ের মা, কানের মাথাটি খেয়ে বসে আছিস নাকি! রা-টি কাড়ছিসনি
কেন রে বুড়ী
বলতে বলতে ঘরের মধ্যে বনমালীর আবির্ভাব, এই যে তু ইখানটিতে বসে।
ঠাকুর যে উদিকে চেচায়ে মরছে। রান্নাবান্না হবে, না হবেকনি—
যাচ্ছি, যাচ্ছি—চল।
কানাইয়ের মা বনমালীকে সঙ্গে করে নিয়েই ঘর হতে বের হয়ে গেল।
সবিতা এসে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করল, সত্যজিৎবাবু
আসুন
সবিতা দেবী।
কানাইয়ের মা বুঝি বকরবকর করে আপনাকে বিরক্ত
করছিল?
সত্যজিৎ সবিতার কথায় মৃদু
হাসল, না, বরং আমিই তাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছিলাম।
অমন কাজটিও করবেন না। একবার বকতে শুরু করলে ও আর থামতে চায় না।
বসুন
মিস চৌধুরী।
সবিতা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সত্যজিতের মুখোমুখি উপবেশন করল।
আপনি হয়ত জানেন না মিস চৌধুরী, অনেক সময় অবান্তর বাজে কথার মধ্যে
থেকেই কাজের ও প্রয়োজনীয় কথা খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু ওর যে ষোল আনার মধ্যে সাড়ে পনের আনা কথাই অবান্তর!
তা হোক, বুড়ী
লোকটি ভাল।
কি করে বুঝলেন?
শুনন মিস
চৌধুরী, ওকে আজ রাত্রে এ ঘরে আসতে বলেছি। আরো বলেছি, আমি ও আপনি এ ঘরে থাকব।
কেন বলুন তো?
আচ্ছা আপনি আপনার মায়ের মৃত্যু-ব্যাপার সম্পর্কে কিছু জানেন?
বিস্ময়ের সঙ্গে সবিতা সত্যজিতের মুখের দিকে তাকায়, কেন, এ কথা
জিজ্ঞাসা করছেন কেন হঠাৎ?
কানাইয়ের মা কিছু
সে সম্পর্কে বলছিল নাকি?
না, কিছু বলেনি বটে তবে আমার মনে হয় কানাইয়ের মা হয়ত কিছু জানে।
সবিতা প্রথমটায় একটু
ইতস্তত করে, তারপর
বলে, হ্যাঁ। আমিও একবার ছোটবেলায় কানাঘুষোয় মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে কি একটা রহস্য জড়িয়ে
আছে শুনেছিলাম বটে, তবে details কিছুই জানি না। কিন্তু কানাইয়ের মা সে কথা জানবে
কি করে
সত্যজিৎ তখন একটু পূর্বে
কানাইয়ের মার সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সব বিশদভাবে খুলে বললে।
সবিতা নিঃশব্দে সব শুনে গেল।
তাই আমি ঠিক করেছি, যতটা পারি প্রশ্ন করে ওর কাছ থেকে আমাদের জেনে
নিতে হবে। আরো একটা কথা, আপনার মাও নাকি এই বাড়িতেই মারা যান!
কই, সে কথা তো আমি শুনিনি?
শুনলেও হয়ত আপনার মনে নেই। একেবারে ছোট্টটিই তো ছিলেন আপনি তখন।
আপনার কি মনে হয় সত্যজিৎবাবু,
এ রহস্যের আপনি মীমাংসা করতে পারবেন?
আমার কি ধারণা জানেন মিস চৌধুরী? মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। মানুষই যদি হত্যা
করে থাকে তাঁকে তবে মানুষই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারে। মানুষই problem তৈরী
করে, আবার মানুষই সেটা solve করে।
দীর্ঘ উনিশ বছর ধরে কানাইয়ের মা যে কথাগুলো একমাত্র চৌধুরী মশায়ের
ভয়ে বুকের মধ্যে জমা রেখে দিয়েছিল, সেগুলো সত্যজিৎ ও সবিতার কাছে বলতে পেরে যেন
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। দীর্ঘ উনিশ বছর আগেকার কাহিনী।
সবিতার মা হেমজার শরীরটা কিছুদিন ধরে ভাল যাচ্ছিল না।
তাই স্ত্রী হেমপ্রভা, ছোট চার বছরের মেয়ে সবিতা ও কানাইয়ের মাকে
নিয়ে প্রমোদভবনে এক মাসের জন্যে বিশ্রাম নিতে এলেন মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
চারদিকে খোলা-মেলা বিলের হাওয়া, নির্জনতা স্ত্রীর মন ও শরীরের
উপরে একটা পরিবর্তন ঘটাবে এইটাই ভেবেছিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
শহর থেকে দূরে নির্জন এই বিলের ধারে যেন অবারিত মুক্তির একটা কোমল
স্পর্শ।
প্রমোদভবনের তিন দিক ঘিরে দেড়মানুষ সমান উঁচু, প্রাচীর।
বায়ুর তাড়নায় বিলের জল প্রাচীরের গায়ে ছলছলাৎ করে আছড়ে আছড়ে পড়ছে।
প্রমোদভবনের পশ্চাতের দ্বার খুললেই চোখে পড়ে প্রায় শদুই গজ দূরে একটা ছোট দ্বীপের মত।
প্রমোদভবন থেকে সেই দ্বীপে যাওয়ার জন্য সেগুন,
শালকাঠ ও পাথর বিলের জলের মধ্যে ফেলে একটা রাস্তা তৈরী করা হয়েছে।
রাস্তাটা অপ্রশস্ত—তিনজনের বেশী লোক একত্রে পাশাপাশি হাঁটতে পারে
না।
দ্বীপটা
ত্রিভুজাকার। দ্বীপের মধ্যে ছোট বড় নানাজাতীয় বৃক্ষ যেন একটা অরণ্যস্ততা এনেছে। দ্বীপের ঠিক
মধ্যস্থলে একটি চমৎকার পাথরের তৈরী একতলা ছোট বাড়ি। বাড়ির মধ্যে খানতিনেক ঘর
মাঝারি আকারের। বাড়িটার চতুষ্পার্শ্বে
দেশী-বিদেশী নানাজাতীয় ফলের গাছ।
বহুদিনের
অযত্ন-বর্ধিত হয়ে এখন সম্পূর্ণ বাগানটি একটা যেন ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে।
আপন মনেই এখন ফুল ফোটে, ফল ঝরে, আগাছা বেড়ে চলে।
দীর্ঘকালের অযত্নে বাড়িটার ঘরের জানালা-কবাটগুলো জীর্ণ ও ধংসপ্রায়।
দিবারাত্র বাতাসে মচমচ, খটখট শব্দ করে।
জমিদার বাটি থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে ছিল এক দিগন্তপ্রসারী বিল।
এই বিলের যোগাযোগ ছিল একেবারে পদ্মার
সঙ্গে।
চারপুরুষ
আগে করালীপ্রসন্ন চৌধুরী তাঁর প্রিয়তমা মহিষী রাণী কাঞ্চনমালার জন্যে ঐ বিলের
মধ্যে পাথর ফেলে এক প্রমোদভবন গড়ে তোলেন। এবং বিলের মধ্যেই পাথর ফেলে মাটি ঢেলে
তৈরী করেন এক নকল দ্বীপ। ফুলফলের
গাছগাছড়া লাগিয়ে দ্বীপের প্রাণসঞ্চার করেন।
নির্মাণ করেন দ্বীপের মধ্যস্থলে একটি সুরম্য ছোট বিশ্রামভবন। তার
চারপাশে দিগদেশ হতে নানাবিধ, আকার, গন্ধ ও বর্ণ-বৈচিত্র্যের ফুলের গাছ এনে রচনা করেন এক উদ্যান; তারই নাম
দেন নন্দনকানন।
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী যখন তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভাকে নিয়ে প্রমোদভবনে
এলেন, বহুদিনের
অবহেলায় ও অব্যবহার্যে এবং কালের নিষ্ঠুর
আঘাতে আঘাতে প্রমোদভবন জীর্ণ ভগ্নপ্রায় এবং দ্বীপের মধ্যে নন্দনকানন জঙ্গলাকীর্ণ ও
ভীষণ কালনাগের আবাসস্থল হয়ে উঠেছে।
প্রমোদভবনকে যথাসাধ্য মেরামত ও সংস্কার করে নিলেন মৃত্যুঞ্জয়।
অল্পদিনের মধ্যেই হেমপ্রভার স্বাস্থ্যেরও উন্নতি দেখা গেল। কিন্তু
নিষ্ঠুর
ভবিতব্য যা মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীর জন্যে অলক্ষ্যে অপেক্ষা করছিল, জীবনের সুধার পূর্ণ
পাত্রটিকে সহসা ছিনিয়ে নিয়ে গেল।
দাসী কানাইয়ের মা ও সবিতাকে নিয়ে রুগ্না হেমপ্রভা একটি কক্ষে
শুতেন। পাশের ঘরেই শয়ন করতেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মার নিদ্রারোগটা চিরদিনই বেশী। একদিন সকালে কানাইয়ের মার
ডাকাডাকি ও চেঁচামেচিতে
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘুম ভেঙে জানলেন হেমপ্রভাকে বাড়ির মধ্যে কোথাও খুঁজে পাওয়া
যাচ্ছে না।
হন্তদন্ত হয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন, শয্যার
উপরে তখনও চার বছরের শিশুকন্যা সবিতা অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।
মাকে যে তার পাওয়া যাচ্ছে না, কিছুই তার সে জানে না। বাড়ির
অন্যান্য ভৃত্যরা—তখনও সকলে
ঘুম ভেঙে ওঠেনি।
মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরী যেন পাগলের মত হয়ে গেলেন।
কোথায় গেল হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে! তাঁদের দীর্ঘ দশ বৎসরের
বিবাহিত জীবনের প্রতিটি দিনরাত্রির ইতিহাসকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করেও
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী হেমপ্রভার আকস্মিক অন্তধানের কোন কারণ বা মীমাংসা খুঁজে পেলেন না।
কোনদিনের জন্যও তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এতটকু ভুল বোঝাবুঝি
বা মনোমালিন্যের কারণ
ঘটেনি যাতে করে সহসা এমনিভাবে হেমপ্রভা কাউকে কিছু না জানিয়ে গৃহত্যাগ (?) করতে পারে।
হেমপ্রভাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না, একমাত্র কানাইয়ের মা ও তিনি নিজে
ছাড়া তৃতীয় আর কেউ জানে না।
কানাইয়ের মাকে নিজের ঘরে ডেকে এনে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ঘরের দরজায় খিল তুলে দিলেন।
শোন কানাইয়ের মা, তোর মাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না একথা যেন কেউ জানতে
পারে। একমাত্র তুই ও আমি ছাড়া তৃতীয় কেউ জানে না। ঘুর্ণাক্ষরেও একথা কেউ কোনদিন যদি জানতে পারে তবে তোকে
জ্যান্ত নন্দনকাননে মাটির তলায় কবর দেব।
কানাইয়ের মা থরথর করে কাঁপছিল। গলাটা তার শুকিয়ে গিয়েছে, কোনমতে
একটা ঢোক গিলে শুষ্ক নিম্নকণ্ঠে
বললে, মরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না বাবু
মনে থাকে যেন। হ্যাঁ দেখ, আজই রাতে আমি সবিতাকে নিয়ে কাশী যাব।
তুইও আমার সঙ্গে যাবি। নিচের ঠাকুর চাকর কেউ যেন ওপরে না আসে। বলবি তোর মার কাল
রাত থেকে অসুখের খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে। যা–
বাড়ির সকলেই
জানল গত রাত থেকে হেমপ্রভা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন খুব খারাপ অবস্থা চলছে। আজ
রাত্রেই জমিদারবাবু
অসুস্থা
স্ত্রী, কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় যাচ্ছেন।
স্ত্রীর অসুখের সংবাদ দিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী রাত এগারোটায়
স্টেশনে যাবার জন্যে দুখানা পাল্কির
ব্যবস্থা করতে বললেন নায়েবকে। রাত দুটোর গাড়িতে তিনি সস্ত্রীক কলকাতায় যাবেন।
নায়েব বসন্ত সেনকে আদেশ দিয়েই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আবার দোতলায় চলে
গেলেন।
সমস্ত দিন বাড়িটা অসহ্য নিস্তবতায় থমথম করতে লাগল। যেন একটা ভয়াবহ সতর্কবাণী বাড়ির লোকজনদের
বিভীষিকার মত ঘিরে
রইল।
সমস্ত বাড়িটার মধ্যে কোথাও এতটুকু কোন শব্দ নেই, এমন কি ছোট মেয়ে
সবিতার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত একবারের জন্যে শোনা গেল না।
নিচের তলায় ঠাকুর চাকর দাসীর দল কেবল সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
রাত এগারোটার সময় একখানা পাল্কি বেহারারা উপরে নিয়ে গেল এবং আধ ঘণ্টা বাদে
কাহার-বাহিত কবাট-বন্ধ করা পাল্কির পিছনে পিছনে ঘুমন্ত সবিতাকে বুকে নিয়ে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নেমে এলেন এবং
তাঁর পশ্চাতে নেমে এল কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা সবিতাকে নিয়ে অন্য খালি পাল্কিটায় গিয়ে উঠে বসল। ঘোড়ায় জিন দেওয়া ছিল।
নিঃশব্দে রাত্রির অন্ধকারে পাল্কি দুটো প্রমোদভবনের গেট দিয়ে বের
হয়ে গেল।
পশ্চাতে ঘোড়ার উপর সওয়ার হয়ে পাল্কি দুটোকে অনুসরণ করলেন জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী।
মাথার উপরে নক্ষত্রখচিত রাতের কালো আকাশ কেমন বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, আর
বৌরাণীর বিলের ধারে ধারে ঝাউগাছগুলো নিঃশব্দে অন্ধকারে সকরুণ একটা দীর্ঘশ্বাস যেন সেই বোবা আকাশের গায়ে
ছড়িয়ে দিতে লাগল।
চারদিন বাদে মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরী আবার কন্যা সবিতা ও কানাইয়ের মাকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। এবং এসে উঠলেন আবার
প্রমোদভবনেই।
লোকে জানল কলকাতাতেই হেমপ্রভার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু ঐ চারদিনের
মধ্যেই অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীর। তাঁর মাথার অর্ধেকের বেশী চুল পেকে সাদা হয়ে গিয়েছে, আর তাঁর দুচোখের
কোলে পড়েছে গাঢ় কালো একটা রেখা।
সারাটা রাত মৃত্যুঞ্জয় ঘুমাল না।
নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে ভূতের মত প্রমোদভবনের কক্ষে কক্ষে ছাতে ও
বারান্দার অলিন্দে ঘুরে ঘুরে বেড়ান।
দিন দুই বাদে কি খেয়াল হতে ভোররাতের দিকে হাঁটতে হাঁটতে নন্দনকাননের দিকে চললেন প্রমোদভবনের
খিড়কির দরজাটা
খুলে।
বহুদিন
মানুষের পায়ের ছাপ এখানে পড়েনি।
জঙ্গলে আকীর্ণ চারিদিক। পা ফেলা যায় না।
হঠাৎ সেই নন্দনকাননের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে প্রকাণ্ড একটা বকুল গাছের
তলায় এসে হঠাৎ ভূত দেখার মতই যেন চমকে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ঠিক সামনেই বকুল গাছটার
তলায় ঘাসের উপরে পড়ে আছে হেমপ্রভার মৃতদেহটা।
ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে দেহটা। এই সাতদিনে পচে দেহটা একটু ফুলেও উঠেছে।
পরিধানে এখনো সেই সাতদিন আগেকার চওড়া লালপাড় শাড়িটা। চিরদিন চওড়া
লালপাড় শাড়ি পরতেই হেমপ্রভা ভালবাসতেন।
স্তম্ভিত বিস্ময়ে মৃত্যুঞ্জয় কতক্ষণ যে ঐখানে তাঁর প্রিয়তমা
স্ত্রীর শবদেহের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন মনে নেই।
শোক দুঃখ বেদনা সকল অনুভূতি যেন বুকের মধ্যে জমে পাথর হয়ে গিয়েছে।
সহসা একটা খসখস শব্দে চমকে ফিরে তাকালেন মৃত্যুঞ্জয়। ঠিক পশ্চাতে
হাত-চারেকের ব্যবধানে দাঁড়িয়ে কানাইয়ের মা।
কানাইয়ের মা তুই এখানে?
কঠিন একটা উষ্মার
ভাব মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীর কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ে।
কানাইয়ের মা কোন জবাব
দিতে পারে না।
নিঃশব্দে মাথা নিচু করে যেমন দাঁড়িয়েছিল তেমনিই দাঁড়িয়ে থাকে।
কানাইয়ের মাও হেমপ্রভার মৃতদেহটা
দেখতে পেয়েছিল।
সত্যই কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করত ও
ভালবাসত।
হেমপ্রভাই তাঁর বাপের বাড়ি থেকে অল্পবয়সী বিধবা সদ্যপুত্রহারা কানাইয়ের মাকে
খাস দাসী করে নিয়ে এসেছিলেন।
কলকাতা থেকে ফিরে রাত্রে যখন অত বড় বাড়িটার মধ্যে নিঃশব্দে একা
একা ছায়ার মত মৃত্যুঞ্জয়
ঘুরে বেড়াতেন, অলক্ষ্যে থেকে সদাসতর্ক দৃষ্টি দিয়ে কানাইয়ের মা মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর উপরে নজর রাখছিল। মৃত্যুঞ্জয় যে তাঁর
স্ত্রী হেমপ্রভাকে কত গভীরভাবে ভালবাসতেন কানাইয়ের মা তা জানত। এবং সেই কারণেই
হেমপ্রভার এই আকস্মিকভাবে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটা মৃত্যুঞ্জয়ের মনের মধ্যে যে কত নিদারুণ আঘাত
হেনেছে তাও সে বুঝেছিল।
স্ত্রীর শোকে মনের ঝোঁকে মৃত্যুঞ্জয়
হঠাৎ আত্মহত্যা বা ঐ ধরনের কিছু
করে ফেলেন এই ভয়েই কানাইয়ের মা সদা-সতর্ক দৃষ্টিতে মৃত্যুঞ্জয়কে দিবারাত্র
অলক্ষ্যে থেকে ছায়ার মত অনুসরণ
করছিল।
এবং ঐভাবে অনুসরণ
করতে করতে ভোররাত্রে মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরীর পিছু পিছু
নন্দনকাননে এসেছিল সে।
হেমপ্রভার মৃতদেহ ঐভাবে নন্দনকাননের বকুলতলায় দেখে সেও কম বিস্মিত
হয়নি।
বল, কেন তুই এখানে এসেছিস?
আবার রুক্ষকঠিন
কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মৃত্যুঞ্জয়
চৌধুরী।
কানাইয়ের মা তখন অকপটে প্রভুর কাছে সব কথা খুলে বললে।
মৃত্যুঞ্জয়
এর পর আর কিছু বলতে পারলেন না কানাইয়ের মকে। কানাইয়ের মা যে তাঁর প্রতি গভীর
মমতাবশেই ঐখানে ঐভাবে তাঁকে অনুসরণ
করে এসেছে জানতে পেরে কেন যেন তাঁর অন্তরটা স্নিগ্ধ হয়ে এল।
ঐদিনই গভীর রাত্রে নিজ হাতে বকুলতলাতেই মাটি খুড়ে কানাইয়ের মার
সাহায্যে মৃতা
স্ত্রীর শেষকৃত্যটকু পালন করলেন মৃত্যুঞ্জয়।
কানাইয়ের মা ভিন্ন আর দ্বিতীয় কোন প্রাণীই ঐ ব্যাপারটা জানতে পারল
না।
এবং সেই দিন থেকেই মৃত্যুঞ্জয়
সবিতার সমস্ত ভার কানাইয়ের মার হাতেই তুলে দিলেন।
আর কানাইয়ের মাকে বিশেষ করে সাবধান করে দিলেন লোকে যেমন জেনেছে যে হেমপ্রভার
কলকাতাতেই রোগের মৃত্যু
হয়েছে তাই যেন জানে, এর বেশী কেউ যেন কিছু না জানতে পারে।
মৃত্যুঞ্জয় জমিদার-ভবনে আর ফিরে গেলেন না।
প্রমোদভবনকেই আরো ভাল করে সংস্কার করে নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু
করে দিলেন।
আর কেউ না জানলেও কানাইয়ের মা জানত, প্রায়ই গভীর রাত্রে জমিদার মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী নন্দনকাননে গিয়ে
অন্ধকারে বকুলতলায় ঘুরে
ঘুরে
বেড়ান।
প্রিয়তমা স্ত্রীকে যেখানকার মাটিতে শেষ শয়ানে শুইয়ে রেখেছিলেন,
সেখানকার মাটিই যেন তাঁকে অন্ধকার নিঝুম রাতে হাতছানি দিয়ে ডাকত।
এ খবর আর কেউ জানে না বাবু
একমাত্র আমি ছাড়া। বলে চুপ
করল কানাইয়ের মা।
সবিতার চোখের কোল দুটো ছলছল করছিল জলে ভরে গিয়ে।
তার মায়ের মৃত্যুর সকরুণ কাহিনী তাকে যেন নির্বাক করে দিয়েছে।
এদিকে রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।
রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঝিরঝির করে খোলা জানলা-পথে কক্ষমধ্যে
এসে প্রবেশ করছিল।
কানাইয়ের মার কণ্ঠনিঃসৃত
বেদনাক্লিষ্ট কাহিনী যেন সমগ্র কক্ষটা জুড়ে জমাট বেধে আছে এখনো!
অন্তত বোঝা যাচ্ছে,
মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর হত্যার ব্যাপা একটা মস্ত বড় রহস্য!