হোগলামারির নরঘাতক

    সচ্চিদানন্দ পুরকায়স্থ নিজের জীবনের শুরুটা প্রায় শূন্য দিয়েই করেছিলাে। সম্বল বলতে একখানি খােলা-নির্মিত ভগ্নপ্রায় গৃহ, সামান্য কাঠাখানেক ভূমিতে গুটিকতক খেজুর গাছ, কুড়িটি টাকা নগদ এবং বিধবা মা। শেষের সম্বলটি কিন্তু সচ্চিদানন্দের জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল। মা চন্দ্রাবলী একসময়ে বড়াে ঘরের কন্যা ছিলেন কিন্তু সচ্চিদানন্দের বাপ সদানন্দকে ভালােবেসে বিবাহ করার পরেই বড়ােলােক বাপ কন্যার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। বিবাহের তিনটি বৎসর অতীত না হতেই এক বর্ষায় হেঁতালমারির জঙ্গলে সাপের ছােবলে প্রাণ দিলাে সদানন্দ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের আর দশটি ঘরের মেয়েরা যেমন কেঁদেকেটে পিতৃগৃহে ফিরে যায়, চন্দ্রাবলী কিন্তু তা করলেন না। তিনি কঠিন মুখে সন্তানকে আঁকড়ে ধরে কইলেন, “আমার ভাগ্যে যদি কখনও শান্তি হয়, তবে পুত্র হতেই হবে, নচেৎ আমার সন্তানকে আমি মাতৃকুলের অন্নদাস করে তুলতে পারবাে না”। সচ্চিদানন্দ যােলাে বৎসরে পড়ে মায়ের পরামর্শে কুড়িটি টাকা সম্বল করে গুড়ের ব্যবসা আরম্ভ করল। বাড়ির সুমুখের জমিতে শাল খুঁড়ে, সেই শালের উপরে বিরাট কড়া চাপিয়ে সে গুড় জ্বাল দিতাে। ঝােলাগুড়, বালিগুড়, দানাগুড়, রসগুড়, নলেনের পাটালি গুড়, চিট, বাদামচাকতি প্রভৃতি প্রস্তুত হতাে তার হেঁসেলে। খেজুরের গাছে নলকাঠি লাগিয়ে রস সংগ্রহ হয় বলে এর নাম নলেন গুড়। এই পদ্ধতিটি কিন্তু একেবারেই সােজা নয়। প্রথমেই তােমাকে নলকাঠি পুঁতবার সঠিক স্থানটি বুঝতে হবে, কুয়াশা লক্ষ্য রাখতে হবে, মধ্যরাত্তিরে রস নামাতে হবে, রসের পাক জানতে হবে, আরও নানান হাঙ্গামা। তা, এই সচ্চিদানন্দের নলেনগুড়ের নাম ছড়িয়ে পড়া ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। ছয় বৎসরের মধ্যে সে বিরাট দালান তুললাে হােগলামারির ধারে। হেঁসেলটি পরিণত হয়েছে কারখানায়। সেইভেনে দিনে রাতে এখন ত্রিশজনা মজুর ঠাকুর কাজ করে। চন্দ্রাবলী ছেলের বিবাহ দিলেন সুপাত্রী দেখে। যথাসময়ে তাদের ঘর আলাে করে ভূমিষ্ঠ হলাে পুত্রসন্তান। একটি নয়, একজোড়া। বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। যমজ সন্তান দুটি অবিকল একই ছাঁচে তৈরি। কেবল বড়ােটির বাঁ গালে একটি লাল জডুল, ছােটোটির ডান গালে। এই দিয়েই কেবল তাদের চেনা যেতাে। সন্তানের পয়’তেই হয়তাে বাপের কারবার আরও ফুলে ফেঁপে উঠলাে। আশেপাশের তিনটি পরগণা খরিদ করে সে এখন ছােটোখাটো একজন ভূস্বামী হয়ে বসেছে। সচ্চিদানন্দ আজও মাঝে মাঝে মাকে বলে – “মাগাে, ভাগ্যিস তুমি ছিলে”।

    এসব অনেক পূর্বের কথা। ইতিমধ্যে পৃথিবী নিজের কক্ষপথে চল্লিশবার প্রদক্ষিণ করেছে। চন্দ্রাবলী, সচ্চিদানন্দ কেউই আর বেঁচে নাই। তার দুই পুত্র জীবানন্দ আর মহানন্দ বর্তমানে জমিদারির মালিক। এইখানে একটা কথা কয়ে রাখা দরকার, সচ্চিদানন্দের দুই পুত্র দেখতে প্রায় একরূপ হলেও স্বভাব চরিত্রে কিন্তু সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। জীবানন্দ আত্মভােলা সাত্বিক পুরুষ। সে দার পরিগ্রহ করেনি। সংসারের মারপ্যাঁচও তত বােঝে না। গাঁয়ের লােকে তাকে ঋষি জ্ঞানে সম্মান করে। আর মহানন্দ ছােটো থেকেই ভীষণ বিষয়লুব্ধ। সে যথেষ্ট বুদ্ধি ধরে এবং কূটনীতিক সুচতুরও বটে। বাপের অন্তিমকালে সে যে কি বুঝিয়েছিলাে তা জানিনে, কিন্তু দেখা গেল সচ্চিদানন্দ তার সমগ্র জমিদারির দায়িত্ব মহানন্দের কাঁধেই অর্পিত করে ইহলােক ত্যাগ করেছে। মহানন্দ জমিদারির একচ্ছত্র মালিক হয়ে বসেই। প্রবলবেগে মামলা, মােকদ্দমা, তদবির, আদায় শুরু করে দিলাে। গাঁয়ের প্রজারা জীবানন্দকে ঋষি ভাবতাে, কিন্তু মহানন্দ মনে মনে নিজের দাদাকে দেবতা জ্ঞান করতাে। সে জমিদারির সমগ্র আয়ের নিখুঁত দুইখানি অংশের একটি জীবানন্দকে সমর্পণ করতাে, কিন্তু দাদার গ্রাসাচ্ছাদনের সমস্ত খরচ সে নিজের ভাগের থেকেই ব্যায় করতাে। জীবানন্দ নিজ অংশের টাকাকড়ি পূজা এবং জনসেবায় ব্যয় করতাে। পুস্করিণীর জলে আঁচড় কাটলে যেমন জলরাশি দুই ভাগ হয় না, তেমনই ক্ষুদ্র কয়েকটি আইনী কালির আঁচড়ও দুই ভাইকে পৃথক করতে পারলাে না।

    মহানন্দের একমাত্র পুত্র শিবার বয়স বর্তমানে উনিশ বৎসর। শাস্তরে যারে কল্পকান্তি বলা হয়ে থাকে, শিবা ছিলাে ঠিক তাই। দুধের মতাে গাত্রবর্ণ, ভাসা ভাসা চোখ, লম্বা একহারা গড়ন, চওড়া কাঁধ, সব মিলিয়ে অপরূপ সৌষ্ঠবের অধিকারী। সে লাঠি খেলতাে চমৎকার। পড়াশুনাতেও তার মেধা অসাধারণ। গাঁয়ের প্রজারা তাকে ভারী ভালােবাসতাে। সেইবারে দূর্গোৎসবের সময়ে হােগলামারি তালুকে প্রতিমা দর্শন করতে অন্যবারের মতােই শয়ে শয়ে মানুষ এসেছিলাে। তাদের নিজের হাতে প্রসাদ বিতরণ করার সময়ে শিবার আলাপ হয় সুলতার সাথে। সুলতা হােগলামারি তালুকেরই ঘােষাল বাড়ির মেয়ে। এতদিন কোনও কারণে সে হুগলীতে মামার গৃহেই থাকতাে। কিছুদিন হলাে গাঁয়ে ফিরেচে। ঘােষালরা আর্থিকভাবে শিবার পরিবারের সমকক্ষ না হলেও যথেষ্ট সম্পন্ন ঘর। সুলতার অবয়বটি স্বয়ং শ্রীভগবান যেন নিজের হাতে গড়েচেন। অসাধারণ লাবণ্যময়ী এই মেয়েটিকে দেখামাত্র শিবা ভালােবেসে ফেললাে। সঙ্গে সুলতাও। শিবা ঘােষালবাড়ির সকলকেই চিনতাে, কিন্তু নবাগত মেয়েটি পুরকায়স্থ বাড়ির কাউকেই তখনও চেনেনি। এদের প্রেমের পরিণতিও হয়তাে একটি সুখী সংসারেই পর্যবসিত হতে পারতাে কিন্তু নিয়তির কুটিল অভিসন্ধি ছিল একেবারেই ভিন্ন। নাহলে আমাকে আজ এই ভয়ংকর ঘটনাটা বলতে বসতে হতাে না।

    **********

    শিবার একটা তেজী পােষা কুকুর ছিল। নাম পাকরু। ভারী চঞ্চল এবং ছটফটে কুকুর। গােটা জমিদারবাড়িকে প্রহরীদের সঙ্গে সে চিৎকার করে পাহারা দিতাে। তাকে নিজের হাতে চরাবার নাম করে শিবা অপরাহ্নে বাইরে বেরুতে। কাব্যে বসন্ত ঋতুকে অভিসারের আদর্শ বলা হয়ে থাকে কিন্তু আমি, লেখক নিজে জোর দিয়ে বলচি তােমার হৃদয়ে যদি পরিপূর্ণ প্রেমরস থাকে তবে ঘাের বর্ষাকালেও তুমি কোকিলের গানের স্নিগ্ধতা পাবে। শিবারও তাইই হলাে। শরৎকালের মনােরম বিকেলে কিছুদিন নিভৃতে দেখাসাক্ষাৎ চললাে দুইজনের। দিনকতক পরেই শিবার মনে একটা খটকা লাগলাে। সুলতার মধ্যে কিছু একটা আচরণ যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়। ঠিক ধরতে পারা গেল না কেন এমন মনে হয়। কোথাও একটা যেন গলদ রয়েছে।

    একদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ শিবা দেখলাে পূবের জঙ্গলের ওপারে, মানে চিতিগাঙের শ্মশানের দিকটায় একটা আলাে উঁকি মারচে। পাকরুর দিকে চেয়ে সে ঠোটে আঙুল দিয়ে কইলাে “শশশশশ”। কৌতূহলী হয়ে জঙ্গল ঠেলে এগিয়ে গিয়ে শিবা বিস্মিত হয়ে দেখলাে গাঁয়ের নিশাপদ সাপুড়ের মেয়ে ঝুমরী লণ্ঠন জ্বেলে কি যেন খুঁজচে। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে শিবা একলাফে তার সামনে এসে দাঁড়ালাে। বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ হতচকিত হয়ে গিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাে। শিবা কঠিন স্বরে শুধালাে – “তুই নিশাপদর মেয়ে না? এই আঁধারে শ্মশানে কী করছিস?”

    জেরার মুখে ঝুমরী উত্তর করল সে সাপ খুঁজছে। অবাক হয়ে শিবা প্রশ্ন করল, “লতা খুঁজচিস? এই সময়ে ? কী এত দরকার তার?”

    —“ঝুমরী অধােবদনে কাঁদোকাঁদো হয়ে বললে আজ রাতেই যে বরাত রয়েচে দাদাবাবু। আজকেই দিয়ে আসতে হবে যে।”

    —“দিয়ে আসতে হবে? কাকে?”

    —“লতা দিদিমণিকে”

    —“লতা! কোন লতা?”

    —“আজ্ঞা, হােই উত্তরদিকের ঘােষাল বাড়ির সেই দিদিমণিকে। সেই যে বড়াে পূজার দিন যে এসেছিলাে গাে। সেই সুন্দ..”

    —“সুলতা! সে সাপ দিয়ে কী করবে?”

    ঝুমরী ভয়ার্ত চোখে চারপাশে একবার দেখে নিয়ে বললে “রক্ষে করাে দাদাবাবু, কারুকে কয়াে না, মা মনসার কিরা। সে মেয়েমানুষ নয়, রাক্কুসীই হবে। সে কাঁচা সাপ চিবিয়ে খায় গাে। সাপই নয়, ব্যাঙ, খরগােশ, কুকুর, বেড়াল সব জ্যান্ত খায় সে। আমিই তাে দিয়ে আসি। একবার আমি ফিরে আসার সময়ে আবার লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়েছিলাম সেইভেনে। গিয়ে দেখি… উঃ মাগাে…

    শিবার মাথা টলমল করছিলাে। সে কঠোর স্বরে বললাে “আমাকে দেখা একবার। আমি দেখতে চাই সেই দৃশ্য। চল।”

    একটু ইতস্ততঃ করে ঝুমরী নিমরাজী হলাে। তারা উত্তরপানে চলতে শুরু করল। এইবারে শিবার মনে পড়েছে খটকাটা। পাকরুর মতাে এত তেজী। আর ছটফটে কুকুর সুলতাকে দেখলেই কেমন যেন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তাে। ল্যাজখানি গুটিয়ে নিয়ে কেবল কুঁইকুঁই আওয়াজ করে চলতাে। হয়তাে তার সহজাত ক্ষমতায় সে সুলতার ভিতরের পশুবৃত্তিটাকে দেখতে পেয়েছিলাে। অথচ এই কুকুরকেই সে দুইজন সশস্ত্র ডাকাতের টুটি কামড়ে ধরতে দেখেচে।

    তারা এসে থামলাে ঘােষালবাড়ির পিছনের ঝােপে ঢাকা জমিটায়। একটা  নিকটবর্তী ঝােপে দাঁড়িয়ে, চতুর্দশীর ক্ষীণকায় চাঁদের আলােতেও একখানা ভয়াবহ দৃশ্য চোখে পড়ে শিবার পা দুটি একেবারে অচল হয়ে গেলাে। এঁদো ডােবার জলে পা ঝুলিয়ে বসে একখানা নধর শিয়ালকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্চে সুলতা। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি। কষ বেয়ে কালচে তরল চিকচিক করচে। প্রাণীটা পুরাপুরি মরেনি। সুলতা দাবনার দিকে একেকবার কামড় বসাচ্চে আর শিয়ালটা অতি ক্ষীণ ভাবে চিৎকার করে উঠচে। শিবা আর নিজের স্নায়ুতন্ত্রের উপরে বশ রাখতে পারলাে না। তার মুখ থেকে একটা ভয়ার্ত শব্দ বেরিয়ে আসা মাত্র উল্টোদিকে মুখ করে দৌড় দিলাে। কাঁটায়, ডালে চোখমুখে ক্ষত সৃষ্টি হলেও সে থামলাে না। মেঠো পথ পেরিয়ে যখন বড়ােরাস্তায় উঠবার শেষ ঝােপটা পেরােচ্চে, হঠাৎ সশব্দে শ্বাস নিয়ে শিবা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাে! সামনে সুলতা দাঁড়িয়ে। তার ঠোঁট, মুখ চটচটে শৃগালের শােণিতে মাখা। বেশবাস অবিন্যস্ত। তার মুখে রহস্য কৌতুকের ছায়া। সে শিবার দিকে চেয়ে বললাে, “হ্যা। খাই আমি কাঁচা মাংস। তাে? মামাবাড়িতেও খেতুম লুকিয়ে, এইখানেও খাই। নিরীহ জীবগুলাের শেষ আর্তনাদ শুনতে আমি ভালােবাসি যে। তাদের জীবন্ত অবস্থায় একটু একটু করে… যা হােক, এই অভ্যাস আমি কিন্তু বিয়ের পরেও ছাড়তে পারবাে না এই বলে রাখলুম।”

    বিয়ে! এ ডাইনী এখনাে বিয়ের স্বপ্ন দেখছে! আশ্চর্য! শিবা মনে সাহস সঞ্চয় করে কইলাে, “বিবাহ তাে দূরস্ত, তাের মুখদর্শন করাও পাপ হতভাগী। ভালাে চাস তাে এইসব শয়তানী নষ্টামী ছেড়ে সুস্থ্য জীবন যাপন কর। পথ ছাড়।”

    এইবার শিবার প্রত্যয় হলাে, সুলতা কেবল নররাক্ষসীই নয়, বদ্ধ উন্মাদও বটে। একথা শােনার পরেই তার আচরণ মুহূর্তের মধ্যে বদলে গেল। চোখ মুখ ক্রোধে ঘূর্ণিত করে হিংস্র কণ্ঠে কইলাে, “করবি নে বিয়ে? তবে সােহাগ করে দেখা করতে আসতি কেন? আমারে বিয়ে না করলে আমি নিজে গিয়ে তােদের ঘরে উঠবাে দেখিস। এত সহজে ছাড়চি নে।”

    মেয়েমানুষের মুখে এত বড়াে নির্লজ্জ উক্তি শুনে শিবা কাঠ হয়ে গিয়েছিলাে। পরে বিরস স্বরে প্রত্যুত্তরে বললাে, “তাের মাথা ঠিক নাই লতা। ঘরে যা। তাের যে রাক্ষুসে রূপ আজ দেখেছি, তারপর তাের ছায়াও আমার গায়ে পড়লে পাপ হবে। বিবাহ তাে দূর। আজ থেকে কক্ষণাে কথা কইবিনে আমার সাথে।” – এই বলে শিবা হনহন করে হাঁটা দিলাে বাড়ির দিকে।

    সুলতা বাস্তবিকই উন্মাদ ছিল। বহির্বরণ দেখলে কোনওভাবেই তার আসল নৃশংস রূপটা আঁচ করা যেতাে না। বস্তুতঃ এই কারণেই তাকে গাঁয়ের বাড়ি থেকে সরিয়ে মামাবাড়ির কড়া নজরে রাখা হতাে। শিবা নিজের প্রেয়সীর রাক্ষুসে বা পাগলামির রূপ দেখেচিলাে, কিন্তু তার হিংস্র চেহারা সে ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি। পারলে তাকে পিছনে ফেলে যেতে না। গাছের মধ্য দিয়ে সামান্য কিছু পথ চলার পরেই শিবার মনে হলাে পিছনে পিছনে একটা খসখস শব্দ আসছে। পিছন ঘুরে তাকাতেই ভয়ে তার প্রাণ ধড়াস্ করে উঠলাে। ঠিক তাদের থেকে হাত দশেক দূরেই ভয়ঙ্কর হিংস্রভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই উন্মাদিনী। হাতে একখানি ধারালাে রক্তমাখা টাঙ্গি। চক্ষু আরক্ত। সেই মূর্তিময়ী শমন হিসহিসিয়ে আত্মতৃপ্তির স্বরে বলে উঠলাে,

    – “শুনেছি মানুষের মাংস খেতে নাকি বড়াে মিষ্ট। আজ সেই তুলতুলে মহামাংস খাবাে আমি।”

    চাপা গলায় গরগর করতে করতে হঠাৎ ছুটে এসে শিবার কণ্ঠ লক্ষ্য করে টাঙ্গি চালালাে সুলতা। আকস্মিক এই ঘটনায় শিবা হতচকিত হয়ে পড়েচিলাে, ফলে প্রতিরােধের কথা ঐ মুহূর্তে তার মাথাতেও এল না। সুতীক্ষ্ণ প্রাণঘাতী অস্ত্র তার কণ্ঠনালী লক্ষ্য করে ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেল। একটা ঝটপটির শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শিবা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখলাে সুলতার টুটি ধরে প্রাণপণে ঝুলে পড়েছে পাকরু। যে কুকুর মেয়েটার সুমুখে আতঙ্কে জড়ােসড়াে হয়ে থাকতাে, আজ প্রভুর বিপদকালে তার শরীরে দুনাে বল ফিরে এসেচে। ঝুলন্ত অবস্থাতেও পাকরুর শরীরে পরপর টাঙ্গির কোপ পড়ছে, কিন্তু প্রভুভক্ত সেই পশু তাতে ভ্রুক্ষেপ করচে না। একটা চাপা গোঁ গোঁ শব্দ করে সুলতা মাটিতে পড়ে গেল। পাকরু যখন তাকে ছেড়ে দিয়ে হিমে ভেজা মাটিতে মুখের রক্ত ঘষচে, শিবা সভয়ে তাকিয়ে দেখলাে সুলতার দেহে আর প্রাণ নাই। ঘাড়টা অস্বাভাবিক ভাবে কাত হয়ে পড়ে রয়েছে। একটা অস্ফুট শব্দ করে কম্পিত পায়ে টলতে টলতে সে বাড়ির ফটকে এসে মুর্ছিত হয়ে পড়লাে।

    **********

    সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে পুরকায়স্থ গৃহে হৈচৈ পড়ে গেল। পরদিবসে সকাল থেকেই লালপাগড়ী আর প্রজাদের ভিড়। পুলিশের বড়ােসায়েব সক্কলকে জেরা করে, জবানবন্দি নিয়ে মহামারী কাণ্ড বাধিয়ে তুললাে। প্রজারা কিন্তু নিজেদের জমিদার পরিবারটিকে খুব ভালােবাসতাে। বিশেষ করে শিবাকে। তাদের জবানবন্দি এদের পক্ষেই থাকলাে। ঘােষালবাড়িতে সুলতার বাপ মা শােকে অধীর হয়ে হাঙ্গামা শুরু করেছিলাে বটে, কিন্তু পুরকায়স্থদের দিকে গােটা তালুকের প্রতিটি রায়তের পক্ষপাতিত্ব থাকাতেই হােক অথবা জলে বাস করে কুম্ভীরের সঙ্গে বিবাদের ফল চিন্তা করেই হােক, তারা নিজেদের মেয়ের কুকীর্তি চাপা দিয়ে ঘটনা এখানেই আপস করে নিলাে। পুলিশ সায়েব প্রবীণ এবং বুদ্ধিমান লোক। সে এই কুৎসা নিয়ে ঘােষালবাড়িকে আর অযথা জেরা করল না, বিশেষতঃ মরণ আঘাত যেখানে একটি মনুষ্যেতর জীবের থেকে এসেছে সেখানে দোষী হবে কে?

    সুলতার বাপ লাশ জ্বালাবার অনুমতি পেলাে। কালীপূজার রাত্তিরে গভীর অমাবস্যার মধ্যে দুই পরিবারের লােকজন এবং অপরাপর শ’খানেক লােক জড়াে হয়ে ঐ রাক্ষসীর মৃতদেহ জ্বালিয়ে ফেললাে। দেহ নব্বইভাগ দগ্ধ হয়ে যাবার পর যখন আগুনের ধূয়া সাদা থেকে প্রায় কালাে হয়ে এসেছে, উপস্থিত লােকেরা যখন ক্লান্ত হয়ে একটু বসে পড়েচে, হঠাৎ পাকরু বসা থেকে সটান উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে মুখে ভীষণ ভীতিসূচক কুঁইকুঁই করে উঠলাে। শ্মশানের চারদিকের লম্বা গাছের মাথাগুলি যেন হঠাৎ ঝােড়াে হাওয়ায় নড়তে শুরু করল। কুকুরটা এইবার পেটের ভিতরে লেজ ঢুকিয়ে দূর্বোধ্যভাবে মড়াকান্না আরম্ভ করল। গাঁয়ের ঝুমরী নদীর তীরে এক মুসলমান ফকীর বাস করতাে। নাম যতদূর মনে পড়ে খয়রুল না মঈনুল কি যেন। লােকজন এক বাক্যে ফকীরবাবা বলে তাকে চিনতাে। দাহ সংস্কারের সময় কিছুটা তফাতে সেও উপস্থিত ছিল। কুকুরের চিৎকারে লােকেরা ততটা অবাক না হলেও এই ফকীর কিন্তু কিছুটা বিচলিত হয়ে এদিকে ওদিকে তাকাতে শুরু করল। তার এই কান্না একেবারেই স্বাভাবিক বােধ হচ্ছে না।

    পাকরুর দেহের সমস্ত রােমকূপ শিহরিত হয়ে উঠেছে। তার চার পা ঠকঠক করে কাঁপছে। চিতার কালাে ধূয়ার মধ্যে থেকে আরও কৃষ্ণবর্ণ একখানি লিকলিকে ছায়াশরীর লাফিয়ে নেমে এল ভূমিতে। কুকুরটা কাঁপতে কাঁপতে অবসন্ন হয়ে মাটিতে বসে পড়লাে। ছায়ামূর্তিটার চোখে তখন মৃত্যুর হিমশীতল ঘাের। সে সামনে দন্ডায়মান কারুকে লক্ষ্য না করে এলােমেলাে পদবিক্ষেপে এগিয়ে চললাে গাঁয়ে ফেরার পথ ধরে । মরণের ওপার থেকে ফেরৎ আসা এক পরলােকের অতৃপ্ত বিচরণকারী ফিরে চলেছে তার জীবৎকালের রঙ্গমঞ্চে।

    হাঁটতে হাঁটতে সে এসে পৌছুলাে জমিদারবাড়ির ফটকে। বাড়ির খাঁচাবন্দী পাখিগুলাে ডানা ঝটপট করে চেঁচামেচি শুরু করে দিলাে। দেউড়িতে খােট্টা দ্বারপাল খৈনি ডলচে, বামুন ঠাকুর রাতের রান্নার জন্য উঠানে কাঠ ফাড়ছে, কাজের লােকেরা যে যার কাজ করছে। এদের সকলের মুখের সামনে দিয়ে সুলতার বুভুক্ষু প্রেতাত্মা ঢুকে পড়লাে বাড়ির একেবারে ভিতরের দো-মহলায়। দ্বারবান লছমি প্রসাদ হঠাৎ নাকে একটা গন্ধ পেলাে। গন্ধটা ভাষায় বােঝানাে সম্ভব নয়। কোনও বাক্সে বা ঘরে বহু প্রাচীনকালের সামগ্রী স্তুপ করা অবস্থায় আবদ্ধ থাকলে তার যেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ জন্মায়, ঠিক সেইরকম একটা তীব্র এবং তীক্ষ আঘ্রাণ। সেই ঘ্রাণ নাকে প্রবেশ মাত্র এক মুহূর্তের জন্য লছমি যেন দুর্বল হয়ে পড়লাে। তার হাতের নেশাদ্রব্যটি হাত থেকে খসে পড়লাে। এর কোনও কারণ সে ধরতে পারলাে না এবং পরক্ষণেই দ্বিগুণ উৎসাহে খৈনি নিয়ে বসলাে।

    দো-মহলা হলাে প্রকাণ্ড বৃহৎ একখানি প্রাঙ্গনের মতাে ঘর। তার অনেকগুলি ভাগ কিন্তু কোনওটিই স্বতন্ত্র নয়, বরং সংলগ্ন। একদিকে বসার স্থান। সেটি মূল্যবান গদি যুক্ত কৌচ, প্রকাণ্ড ফিরােজা ঝাড়লণ্ঠন, একখানা কষ্টিপাথরের যক্ষিনীর মূর্তি, সুদৃশ্য রঙিন গালিচা, সেগুন কাঠের কাঠামাে বন্দী বিরাট বেলুচি আয়না, রূপার কাজ করা গড়গড়া প্রভৃতি দিয়ে সুসজ্জিত। আরেকদিকে পূজাঘর। সাদা পাথরের তৈরি বিগ্রহ, কাঁসা পেতলের পূজার্চনার তৈজসপত্র, পঞ্চপ্রদীপে আর চন্দনে সুরভিত। একেবারে শেষের দিকে প্রজাদের নালিশ জানাবার মহল। সেই স্থানে কাঠের দুইখানি কেদারা, মাটিতে শতরঞ্জি, থেলাে হুঁকা, জলের তিনখানা কুঁজো প্রভৃতি। সুলতার প্রেত মােহগ্রস্ত চক্ষে চতুর্দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলাে। আতিপাতি করে প্রতিটা আসবাবপত্র ছুঁয়ে দেখতে লাগলাে এবং এতক্ষণে তার বিহ্বল মুখে সামান্য হাসির রেখা দেখা দিলাে। পবিত্র হাসি নয়, হিংস্র কুটিল হাসি।

    হয়েছে…

    এইবারে উপযুক্ত হয়েছে…

    এই ঘরই হবে তার ডেরা। এই ঘরই হবে পুরকায়স্থ পরিবারের অজানা মহাশত্রুর আস্তানা। সব ছারখার করে দেবে সে।

    না, একবারে নয়, তিলেতিলে মারবে সে তার শত্রুদের। সেই ভয়ংকরী প্রেতিনী অট্টহাসি হেসে ঘরের মধ্যে এক কোণায় মিলিয়ে গেল। বাইরে পাখিগুলাে তখনও ছটফট করে চলেছে।

    সেদিন রাত্তিরে শ্মশান থেকে ফিরে চাট্টি নাকেমুখে খেয়ে যে যার শুয়ে পড়লাে। প্রতিটি মানুষের শারীরিক, তদুপরি মানসিক ধকল গিয়েছে প্রচুর। শিবা রাতে যখন নিজের কক্ষে শয়ন করতে যাচ্ছে, তখন জীবানন্দ পিছু ডেকে কইলাে, “শােনাে বাবা, এই ক’টা দিন আর একা শুয়ে কাজ নাই। আমার একটা সন্দেহ হচ্চে। ফকীরবাবাও সে কথাই বলচিলাে। যাই হােক, মহী আর বৌমার ঘরেই কয়টা দিন তুমি শােবে। আমিও বাকী পুরুষদের নিয়ে শয়ন করবাে। মেয়েছেলেরাও একত্রে শােবে। কেবল দ্বারবান তিনজন একজোট হয়ে প্রহরা দেবে। কথার অন্যথা না হয়।”

    কথা অমান্য করার অবকাশ ছিলাে না। জীবানন্দের কথা সকলেই অক্ষরে অক্ষরে মান্য করতাে। সেই ব্যবস্থাই বহাল রইলাে। কিছুক্ষণ শয়নকক্ষে নিষ্ফলা অপেক্ষার পর সেই প্রেতিনী শিবার ঘর ছেড়ে গরগর করতে করতে পুনরায়ঃ দো-মহলায় ফিরে এসে বিলীন হয়ে গেল।

    দুইটি দিন নিরুপদ্রবে কেটেছে। মহলের মানুষদের জন্য বিধিবিধান হলেও অপরাপর কারুর জন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল না। পাকরু সেই রাতে দুয়ারের কাছে শুয়েচিলাে। লছমি, শুকো আর রটন্তী, তিনজন দ্বারবান মিলে একসাথে হেঁটে হেঁটে গােটা বাড়িটার পরিধি ধরে পাক দিয়ে চলেচে। পাকরু ঘরের দিকে মুখ করে শুয়েচে। তিনজন যখন আবার বাড়ির দক্ষিণদিকে আড়াল হয়ে গেল, সহসা তার কানে এল শিবার চাপা গােঙানির শব্দ। সে কান খাড়া করে উঠে বসলাে। আবার একই শব্দ কানে এল। কুকুরটা দুয়ারের পার্শ্ববর্তী জানালা দিয়ে এক লাফে ভিতরে প্রবেশ করল। আবার সেই গােঙানি। এবার আরও কাতর স্বরে। কুকুরটা ভীষণ ভয়ের সঙ্গে সেই শব্দ অনুমান করে এসে দাঁড়ালাে দো-মহলার ঝাড়বাতির নীচে।

    কেউ কোথাও নেই। চারদিকের বাতাসে কিসের যেন ফিসফাস গুঞ্জন তার প্রবল প্রখর কানে ধরা পড়ছে। এক অচেনা, ভ্যাপসা গন্ধ তার অতি সংবেদনশীল ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। পাকরু পলকে পলকে চমকে উঠচে, কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্চে না! হঠাৎ পিছনে ঘুরতেই তার চোখে পড়লাে একটা আবছা ছায়ামূর্তি মাটি থেকে শূন্যে ভাসছে, তার চোখদুটি আগুনের গােলার মতাে লাল শরীর থেকে ধূসরবর্ণ ধূয়া বেরুচ্চে। কুকুর লেজ গুটিয়ে এক পা এক পা করে পিছােতে শুরু করা মাত্র সেই অপয়া অপচ্ছায়া তার উপরে তীব্র জিঘাংসায় লাফিয়ে পড়লাে। কুকুরের মরণ চিৎকারে রাত্তিরের নৈশব্দ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল।

    দ্বারবানেরা, গৃহের অপরাপর সদস্যরা তড়িঘড়ি ছুটে এসে লক্ষ্য করল

    এক ভয়াবহ দৃশ্য। কুকুরটার মুন্ডটা ছিড়ে গড়াগড়ি খাচ্চে গালিচার উপর,

    পা গুলিকে যেন শক্তিশালী চোয়ালের দ্বারা খন্ড করে ফেলা হয়েছে, তার

    ধড়খানা হেলায় পড়ে রয়েচে কৌচের উপরে, গােটা ঘরে বইছে টাটকা

    রক্তের স্রোত।

    শিবা প্রিয় কুকুরের এমন ভয়ঙ্কর পরিণতি চাক্ষুস করে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেল। তার দু চোখে তপ্ত অশ্রুর ধারা, হৃদযন্ত্রে রণ-দামামার গতি। কে তার সাথীর এই বীভৎস পরিণামের জন্য দায়ী? কে সেই নৃশংস ঘাতক যার কাছে শারীরিক পরাক্রমে পাকরুর মতাে কুকুর পরাস্ত হলাে? কে সেই। গুপ্ত হননকারী যার নিরীহ কুকুরটার প্রতি এত ক্ষোভ? তবে.. তবে কি…

    এই নিষ্ঠুর এবং অদ্ভুত হত্যাকাণ্ডের পর প্রত্যেকের হৃদয় অবসন্ন হয়ে পড়েছিলাে। তারা একত্রে বসে এই নিয়ে আলােচনা করছে, এমন সময়ে রটন্তীপ্রসাদ ছুটতে ছুটতে এসে মহানন্দের কানে কানে কিছু বলা মাত্র সে ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়ে অলিন্দের জাফরীর কাছে এসে দেখলাে ছাতের কড়ির থেকে পােষা পাখিদের পিঞ্জরগুলি ঝুলচে, কিন্তু একটিও খাঁচার ভিতরে একখানি পাখিও জীবন্ত নাই। পিঞ্জরাবদ্ধ প্রাণীগুলি অবিকৃত অবস্থাতেই যেন প্রবল আতঙ্কে মরেছে। তাদের চোখের সামনে তারা ভীষণ ভয়ের কিছু একটা দেখেছে এবং তা দেখামাত্রই তাদের ক্ষুদ্র হৃদয় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে।

    গাঁয়ে পুরকায়স্থদের পালটি ঘর হলাে বাঁড়ুজ্যেরা। এই হােগলামারি করতালুকের দ্বিতীয় ক্ষুদ্র জমিদার। এই পরিবারের প্রধান অম্বিকা বাঁড়ুজ্যের আন্তরিক বাসনা ছিলাে শিবানন্দের সঙ্গে নিজের একমাত্র মেয়ের বিবাহ দেয়, কিন্তু শিবার পরিবারের তরফে কোনও ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেল না। এর কিছু কারণ ছিল। পুরকায়স্থরা ভূস্বামী হলেও কখনওই প্রজাদের প্রতি অবিচার বা জুলুম করতাে না। বাঁড়ুজ্যেরা ততাে বড়াে কিছু জমিদার না হলেও প্রভূত অর্থের মালিক এবং ততােধিক অত্যাচারী। সামান্য যে কয় ঘর প্রজা তাদের ছিল, তাঁরা মাঝে মাঝে মহানন্দের কাছে এসে কান্নাকাটি করতাে। এইসকল কারণেই এই বিবাহে চূড়ান্ত বিমুখ ছিল এই তরফের সবাই। ফলে সম্পর্কটা দাঁড়ালাে শত্রুর মতাে। পরের দিন মহানন্দ অনুরােধ করে ফকীরবাবাকে একটিবার ডেকে পাঠালাে। ফকীর যখন গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, এমন সময়ে অম্বিকা বাঁড়ুজ্যে নিজের কয়েকজন লেঠেল সমেত তার পথ রােধ করে দাঁড়ালাে। এরা খন্ড ঘােষ এলাকার লেঠেল। নৃশংস এবং দুর্দান্ত। পুরকায়স্থদের পােষা লেঠেল ছিল না। অম্বিকা জীবানন্দের দিকে চেয়ে মুখে একটা চুক চুক শব্দ করে কইলাে, “আর তাে আর জীবানন্দ মশায়, আমি আপনাকে অন্ততঃ ধার্মিক বলেই জানতুম। মনে হতাে, নাহ, এই লােকটি নিদেনপক্ষে ভন্ড, জুয়াচোর নয়। সেই আপনি আজ হিদুর অন্দরমহলে একজন মুসলমানকে ঢােকাচ্চেন? ছছাঃ ছােঃ। শুনুন মশায়, আপনারা ভিতরে ভিতরে যা করুন আমাদের কিস্যু যায় আসে না, কিন্তু ধর্ম নিয়ে অনাচার হলে কিন্তু দেশছাড়া করে ছাড়বাে বলে রাখলেম। আমরা ব্রাহ্মণবংশের লােক। ধর্মরক্ষা আমাদের কর্তব্য। হ্যা, জীবানন্দ মশায়, আপনাদের বংশের ছেলেটিকে তাে ভালাে বলেই ধারণা ছিলাে। তা সেই ছেলে নাকি ঐ ঘােষালবাড়ির মেয়েটির সাথে যাকে বলে… কি যেন বলে? আরে অ্যাই নিতাই, বল না।”

    নিতাই লেঠেল বিশ্রীভাবে হেসে বললে, “হুজুর, পেরেম জমে গিয়েচিলাে”।

    জীবানন্দকে সকলে অতি মান্য করে। তার সুমুখে এমন দুর্বাক্য উচ্চারণ করার কথা কেউ স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারে না। আজ অবস্থা দুর্বিপাকে একজন লেঠেল অবধি কুবাক্য কয়ে গেল। মহানন্দের মুখ লজ্জায় অধােবদন হয়ে রইলাে। ফকীর ফিরে গেল। গােটা মহলে একটা মৃত্যুপুরীর নৈশব্দ চেপে বসে রইলাে। কিসের যেন একটা অশুভ ইঙ্গিত চারদিকে কানাকানি করে চলেছে। এই ইঙ্গিতটুকু যে নিতান্তই মনের ভ্রান্তি নয়, তার প্রমাণ অবশ্য পাওয়া গেল অনতিবিলম্বেই। জীবানন্দ সমস্ত ব্যাপার বুঝে নিশ্ৰুপ হয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে শােবার ঘরের দেরাজের ভিতর থেকে একতাড়া পুরনাে জমিদারি মামলা সংক্রান্ত দেওয়ানীর নথিপত্র বের করে আতিপাতি করে কি যেন খুঁজতে শুরু করল এবং প্রায় এক প্রহর ধরে সন্ধানের পর তার ঠোটে হালকা সন্তুষ্টির ভাব ফুটে উঠলাে। একটা ডাকের রঙীন কাগজে খসখস করে কিছু লিখে হাঁক দিলে, “লছমি…’

    *********

    দেউড়ির দ্বারবানদের মধ্যে শুকবাহাদুর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হয়েছে। বয়স আন্দাজি সাতান্ন আটান্ন হবে। সেইদিন রাতে প্রহরা দিতে দিতে প্রায় শেষ রাত্তিরের দিকে শুকো বড্ড পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাে। বাকি দুইজন যখন বাড়িটাকে আবার চক্কর মারতে চলেছে, তখন শুকো দাওয়ার উপর বসে জিরােতে লাগলাে। লছমি তার উদ্দেশে শুধােলাে, “কি চাচা, বসলে যে বড়াে?”

    শুকো ক্লিষ্টভাবে একটু হেসে জবাব দিলাে, “আর পারচি নে বাপ। একটু জিরিয়ে নিই। তােরা বরং আরেকবার ঘুল্লা দিয়ে আয়’খন।”

    লছমি শুষ্ক স্বরে কইলাে, “না, না, তা হয় না চাচা, ঘুল্লা দিলে একসাথেই দোবাে। বড়ােকর্তার কথা মনে রয়েছে তাে?”

    – “রয়েচে রে বাপ, রয়েছে। আমার কিছু হবে না। আমি বুড়া মানুষ। তােরা যা দিকি।”

    একটু ইতস্ততঃ করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও লছমি আর রটন্তী টহল দিতে দিতে অন্য দিকে চলে গেল। শুকো দেউড়িতে রাখা বেলকষের হুঁকোটা তুলে নিয়ে কিঞ্চিৎ ধূমপানের মানসে পাশে রাখা দিয়াশলাইটা ঠুকচে, এমন সময়ে বাড়ির পিছন থেকে একটা ভয়ার্ত আর্তনাদ ছিটকে এল এবং সেই সঙ্গে লছমির আতঙ্কমাখা চিৎকার, “চাচাআআআআ”

    শুকো হুঁকোটা ফেলে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে সেইদিক লক্ষ্য করে ছুটলাে। পরক্ষণেই আবার লছমির ভয়ঙ্কর আকুতি, “চাচা গােওওও”

    প্রৌঢ় হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়নাের মধ্যেই ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিলে – “এই যাইইই..” শুকো যখন ভদ্রাসনের পিছনে পৌঁছে গিয়েছে তখন আবারও সেই এক চিঙ্কার, কিন্তু এইবারের আর্তনাদটা শােনামাত্র শুকোর সর্বশরীর কাঁটা দিয়ে উঠলাে। তার থেকে হাত দুই চারেক দূরত্বেই চিৎকারটা এল, কিন্তু তার আশপাশে ত্রিসীমানাতেও কেই নাই। তবে শূন্য বাতাসে এই চিৎকার আসচে কোথা থেকে! এ তাে লছমির কণ্ঠ। কিন্তু…

    বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলাে না। বাম দিকে চোখ ঘােরাতেই নজরে এল একটা মসীকৃষ্ণ বর্ণ ধোঁয়ার পিন্ড খুব দ্রুত মানুষের মতাে আকৃতি পরিগ্রহ করচে। তার চোখে আগুনের ফুলকি। শুকো টের পেলে যে সেই সন্ধিক্ষণ আজ আসন্ন এবং তার গলা তীব্র পিপাসায় শুকিয়ে উঠেছে। আওয়াজ করারও ক্ষমতা নাই। এক লহমা প্রতীক্ষা করেই সেই প্রেতমূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়লাে তার উপর। জলাভাবে রুদ্ধ হয়ে যাওয়া কণ্ঠ থেকে একটা অস্ফুট ধ্বনি নির্গত হলাে মাত্র।

    বাকি দুইজন ঘুরে এসে খেয়াল করল শুকো দেউড়িতে বসে নেই। তারা ভাবলে যে হয়তাে জিরেন শেষ করে সে তাদের খোঁজেই গিয়েচে। লছমি ভারী অসন্তোষ প্রকাশ করে বললাে, “চাচার এ কেমন মতি বলাে দেখি ভায়া। বড়ােকর্তা পইপই করে কইলেন যে আলাদা আলাদা না থাকতে। তবু…”

    বাক্য শেষ হবার পূর্বেই রটন্তী ভয়ানক চিৎকার করে উঠলাে। তার অঙ্গুলি যেইদিকে নিবদ্ধ রয়েছে, সেদিকে নজর করে লছমির প্রাণ উড়ে গেল। শুকোর মুন্ডটা পাকুড় গাছের তলে পড়ে রয়েছে। দেহটা উলটো হয়ে অবিন্যস্ত ভঙ্গিতে ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। তাজা রক্তের অবিরত ধারা তখনও ধড়ের থেকে ভলকে ভলকে বেরিয়ে আসছে। রটন্তী দুইবার বমন করার মতাে শব্দ করে বেহুশ হয়ে পড়ে গেল। লছমি প্ৰসাদ ঠকঠক করে কম্পিত শরীরে কোনওভাবে দৌড়ে এসে জীবানন্দের ঘরে ঢুকেই জ্ঞান হারালাে।

    পুলিশের সেই বড়ােসায়েব এসে তদন্ত করলেন পুরাদমেই কিন্তু আততায়ী সম্পর্কে কোনও আলােকপাত হলাে না। অচেনা পায়ের কিছু গভীর এবং গুরুভার চিহ্ন পাওয়া গেল বটে, কিন্তু প্রথমতঃ এত বিশাল পদচিহ্ন কোনও মনুষ্য শরীরধারীর হতে পারে না, দ্বিতীয়তঃ ছাপগুলি মৃতদেহের আশপাশেই কেবল পাওয়া গেল, অথচ আর কোথাও নাই, যেন হত্যাকারী আসেওনি, যায়ওনি, সে শূন্য থেকে প্রকট হয়েছে।

    **********

    দুইটি মৃত্যু। মৃত্যু নয়, হত্যা। একটি মানুষ, অপরটি সারমেয়। দুটি হত্যাই ভয়াল এবং নৃশংস। সর্বক্ষণ মৃতদেহ এবং অপরাধী নিয়ে নাড়াচাড়া করা পুলিশকর্তাই যেখানে লাশগুলি দেখে অসুস্থ বােধ করছে, সেইখেনে সাধারণ গৃহস্থ ছা-পােষা লােকেদের মনে কি মনােভাব চলছে তা আন্দাজ করা নিতান্ত দুরুহ নয়। একটা অব্যক্ত ভীতি রাত হলেই সকলকে গ্রাস করচে। কথা নাই, শব্দ নাই, হাসি নাই, এই অবস্থায় বসতবাটি এবং মহাশ্মশানে পার্থক্য বিশেষ থাকে না। মহানন্দ সব দেখে শুনে কচুদহের থেকে পদ্মগুণীনকে ডেকে পাঠালাে। পদ্মগুণীন এসে বৈঠকখানায় আসন পেতে বসলাে। বাড়ির প্রত্যেকে তাকে ঘিরে দাঁড়ালাে। এটা ওটা দেখে, সবার কথা শুনে পদ্ম কইলাে, “এমন পাষন্ডের মতাে নিষ্ঠুর শয়তান প্রেতাত্মা আমি পূর্বে দেখিনি। তবে দুশ্চিন্তা করিসনে, আমি একে জব্দ করে ছাড়বাে।”

    গুণীন মহানন্দের পানে চেয়ে বললাে, “এইবেলা যা বলি শুনে রাখ বাছা, তুই আমাকে ডাকিয়েচিস, আমার কালকের যজ্ঞে তুইই হবি আমার সংকল্প। তাজ থেকে কাল কেবলমাত্র সাবুমাখা আর ফল খেয়ে থাকবি। আমি কাল দ্বিপ্রহরে হাজির হবাে সব উপাচার নিয়ে। বাড়ি থেকে বেরুবি নে, কারণ তােকে সংকল্প ব্যতীত যজ্ঞ হয় না।” গুণীন চলে গেল। গৃহের লােকেরা অনেকখানি আশ্বস্ত বােধ করল। আজকের রাত্তিরটুকু সাবধানে কাটালেই কাল মুক্তি। তারা এইটুকু বুঝতে পারছিলাে যে এই শয়তানী মানুষকে একা পেলে তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে, কিন্তু একসাথে থাকলে সে কেন জানি সামনে আসে না। ঠিক কি পন্থায় সে নরহত্যা করে তা জানা না থাকলেও এই যােগসূত্রটুকু বােঝার পরে লােকজন সামান্য হলেও নিশ্চিন্ত বােধ করল। বৈঠকঘরের দৈত্যাকার ঘড়িটার পেতলের সূই দুটি রাত দশটার কক্ষে প্রবেশ করল। আজ দ্বারবানেরা রাতপ্রহরায় নিযুক্ত নেই। তারা বডােকর্তার সঙ্গে শয়ন করেছে। মহানন্দ, করুণাময়ী (শিবার মাতা) এবং শিবা একটি ঘরে, এবং অন্যান্য কর্মচারীরা নিম্নস্থ একটি স্বতন্ত্র কক্ষে। যখন মােটামুটি সকলেই নিদ্রালু হয়ে পড়েছে, হঠাৎ বাইরে একটা খুট করে শব্দ পাওয়া গেল। জীবনানন্দ নিদ্রা জড়িত স্বরে শুধােললা, “ও কিসের আওয়াজ রে? ঠিক ঠাহর হলাে না যেন। তবে কানে এল যেন!”

    রটন্তী ঘুমিয়ে পড়েছে। লছমি ভ্রু কুঞ্চিত করে দ্বিধাজড়িত ভাবে বললাে, “কর্তা, মনে হচ্চে দরজার শেকল খােলার আওয়াজ। হয় বাইরের অলিন্দের পানের দুয়ােরটা, আর নয়তাে…’

    জীবানন্দ উদ্বিগ্ন হয়ে বললাে, “আর নয়তাে কি! মহীর ঘরের শিকল?”

    – “হাঁ কর্তা। তেমনটাই মনে হচ্ছে।”

    -“বলিস কি ব্যাটা? সে কেন দোর খুলবে এই রাতদুপুরে? বিশেষতঃ আমি নিজে যখন বার বার করে…”

    -“নাহ, একটিবার দেখতে হচ্চে। ভয় নাই কর্তাবাবা, আমি উঁকি মেরে দেখেই ফিরে আসছি।”

    -“খুব সাবধান লছমি! তেমন কিছু হলেই হাঁক দিবি যেন।”

    -“আজ্ঞা।”

    লছমিপ্রসাদ মনে মনে ভীত হলেও বাইরে প্রকাশ করল না। সে যে এই বাড়ির দ্বাররক্ষী, সেই কর্তব্যবোেধ সে বিস্মৃত হয়নি। দুই ভায়ের শয়নকক্ষের মধ্যে দূরত্ব মােটামুটি হাত চল্লিশেক। বড়ােকর্তার ঘর থেকে সােজা এগিয়ে তারপর দক্ষিণদিকে বাঁক নিলেই মহানন্দের ঘর। লছমি মাঝখানের লম্বা মতাে টানা গলিটায় হাঁটতে শুরু করল। ডান দিকে ঘুরেই টের পেলাে তার অনুমান একদম সঠিক। মহানন্দের ঘরের কবাট ফাঁক হয়ে রয়েছে। তার মধ্যস্থল দিয়ে কেরােসিন ল্যাম্পের হলদেটে, তেরছা আলাে এসে মেঝেতে পড়েছে। এইবারে লছমি সামান্য ইতস্ততঃ করল। শয়নরত অবস্থায় প্রভুগৃহে উঁকিঝুঁকি দেওয়াটা মােটেও শােভনীয় আদব নয়, কিন্তু বর্তমানে যা বিপদ চলছে তাতে অগত্যা কি আর করা। লছমি দোরের ফাঁক দিয়ে শয্যার দিকে তাকানাে মাত্রই আঁতকে উঠলাে এবং প্রচণ্ড ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেল। শয্যার উপরে বালাপােষ গায়ে দিয়ে তিনজনেই নিদ্রামগ্ন রয়েছে, আর একটা বিরাট কালসর্পের ন্যায় ঘাের ছায়ামূর্তি মহানন্দের চারপাশে ঘুরে ঘুরে কি যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে চলেছে। আকস্মিক ত্রাসে লছমির কণ্ঠতালু শুষ্ক হয়ে উঠলাে। যে অপদেবতার অস্তিত্বের কথা কেবলমাত্র গল্পে, লােককথায় শােনা যায়, আজ সেই সাক্ষাৎ শমন সত্যসত্যই তার দুই চক্ষের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ যে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নেরও অতীত! এই অবস্থায় সে হয়তাে বা চিৎকার করেই উঠতাে, কিন্তু তার আগেই শয়তানটা ভােজবাজির মতাে বাতাসে মিলিয়ে গেল। লছমির হাত, পা শিথিল হয়ে নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অত্যন্ত দ্রুত হয়ে এল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে জীবানন্দকে ডাকতে থাকলাে, কিন্তু সে কণ্ঠ এতই অস্ফুট যে প্রায় শােনাই যায় না। লছমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে হাঁপাতে লাগলাে।

    লছমি ফিরে না আসায় জীবানন্দ তখনও পুরােপুরি ঘুমায়নি। হঠাৎ বাইরে থেকে খুব নিস্তেজ এবং দুর্বল স্বরে লছমির ‘কর্ততা’ ডাক কানে প্রবেশ করল। সেই কণ্ঠ পরিস্কার বলে দেয় যে স্বরের মালিক কোনও কারণে ভীষণ ভয় পেয়েছে। জীবানন্দ বাটের বাইরে এসে দাঁড়ালাে এবং আবার লছমির গােঙানি এবং ডাক কানে এল, “কর্ত্তা, বড় বিপদ”।

    স্বরটা কাছের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, যেন লছমিকে কেউ টেনে হিচড়ে নিয়ে চলেচে। শােবার ঘরের বাইরেটায় বাতি নাই, ফলে চাপ চাপ আঁধার জমে রয়েছে চারদিকে, কিন্তু জীবানন্দ বুঝলাে যে লছমি নেহাৎ খুব বিপদে পড়েই তাকে এভাবে কাতরভাবে ডাকচে। কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে এগােতে এগােতে আচমকা শােনা গেল একটা ভারী জিনিস পতনের মতাে শব্দ। সেই সঙ্গে লছমির হাহাকার করা আর্তনাদ, “কর্তাআআআআ”।

    জীবানন্দ আর থাকতে পারলাে না। সিঁড়ি দিয়ে যত জোরে সম্ভব দৌড়ে সেই শব্দের উৎপত্তিস্থলে এসে পৌঁছুলাে এবং হতভম্ব হয়ে দেখলাে অতবড়াে বৈঠকখানা খাঁ খাঁ করছে। এই প্রথমবার জীবানন্দ অনুভব করল যে কেবলমাত্র একটা স্বর অনুসরণ করে এত দূরে একলা আসা তার উচিৎ হয়নি। তাছাড়া লছমি গিয়েছিলাে মহানন্দের কক্ষের দিকে। সে নীচের মহলে আসবে কেন? তড়িঘড়ি ফিরবার জন্য পা বাড়াতেই একটি মেয়েমানুষের গলা খিলখিল করে রক্ত জল করা হাসি হেসে উঠলাে আর মুহূর্তের মধ্যে জীবানন্দের উপরে সেই অন্ধকারের আততায়ী নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লাে।

    **********

    ভােরবেলায় লছমি, মহানন্দ, শিবা এবং বাড়ির প্রতিটি মানুষ জীবানন্দের মৃতদেহ দেখে আঁতকে উঠলাে। তীব্র আক্রোশে শরীরটাকে টুকরাে টুকরাে করে ফেলা হয়েছে। কোনও সর্বনাশা অপশক্তি যেন নিজের শত জন্মের জিঘাংসা চরিতার্থ করেচে দেহটার উপর। বাড়িতে মড়াকান্নার রােল উঠলাে। মহানন্দ ছােট শিশুর মতাে কাঁদতে কাঁদতে হা-হুতাশ করে কইলাে

    “আমি গুণীনকে ডেকেচি, আমি যজ্ঞের আয়ােজন করচি, তাই বুঝি ওই নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠা আমাকে হত্যা করতে এসে ভ্রান্ত হয়ে আমার দেবতা সমান নিস্পাপ দাদাকে এমন জন্তুর মতাে নৃশংসভাবে হত্যা করে গিয়েছে। শুধু আমিই এর জন্য দায়ী। ভগবান কেন আমাদের একরকম দেখতে বানালেন। হা ঈশ্বর…।”

    পদ্মগুণীন এল দ্বিপ্রহরের সামান্য পূর্বে। তার হাতে দুই থলি ভর্তি যজ্ঞের উপকরণ। সব কথা শুনে পদ্ম ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বললাে, “হতভাগী সর্বনাশী ভেবেচে এসব করে ওর বিনাশ আটকাতে পারবে? আজ সন্ধ্যাই হবে ওই রাক্ষসীর শেষ সন্ধ্যা। আমি সাঁঝবেলাতেই আমার আরাধ্যা দেবী মনসার আবাহন করবাে। মন্ত্রপূতঃ পঞ্চমূখী পুষ্প নিবেদন করা মাত্র মহাশক্তি প্রকট হবেন। তার পর দেখি ঐ শয়তানী কত শক্তি ধরে। আমাকে বহু সময় ঘুরে ঘুরে এসব পূজার উপচার সংগ্রহ করতে হয়েছে। এগুলি ঐ বামদিকের ঘরটায় রেখে আয়। আমি ঐ ঘরেই এখন কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করবাে। ভয় নাই, আমাকে প্রহরায় রাখতে হবে না। সামান্য এক অশরীরী দ্বারা আমার বিশেষ হানি হবে না।”

    কথা মতােই কাজ হলাে। আজকের আকস্মিক দুর্ঘটনায় পরিবারের সকলের মনে যত বেদনাই থাকুক, ঐ অদেখা নরঘাতিনীর কবল থেকে রক্ষা পাবার আশায় সকলে নীরবে পদ্মর আদেশ পালন করল। গুণীন পালঙ্কের পাশে ঘরের মেঝেতে কম্বল বিছিয়ে নিদ্রিত হলাে। শােকের গুরুভার পাথর বুকে। আঁকড়ে মহানন্দ স্ত্রী, পুত্র এবং বাকিদের নিয়ে পুলিশের সহায়তায় মৃতদেহ স্থানান্তর, সাফ সাফাই প্রভৃতি কাজ সম্পন্ন করতে শুরু করল এবং সব কাজ হয়ে গেলে পর সকলে মিলে বৈকালের পড়ন্ত রৌদ্রে খােলা ছাতে গিয়ে অপেক্ষা করা শুরু করল।

    পুরকায়স্থদের এস্টেটের বৃদ্ধ নায়েব ষষ্ঠীচরণের পৌত্র সাড়ে ছয় বৎসরের রঙ্গলাল সকাল থেকেই পিতামহের কাছে বায়না ধরেচিলাে যে শিবা দাদার বাড়িতে পূজা দেখতে যাবে, কিন্তু ষষ্ঠীচরণ সেই আব্দার তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দিয়ে বললে, “বলিস কি রে হতভাগা, সে বাড়িতে পূজা দেখতে যাবি কেমন রে? জানিসনে সে বাড়িতে ভূত ধরেছে? তাদের বড় বিপদ। খপরদার অমন কথা মুখে আনিস নে যেন।”

    রঙ্গলাল শুনলাে, কিন্তু বুঝলাে না। তাদের বিপদ ধরেছে? তবে তাে বেশি করে যাওয়া প্রয়ােজন। শিবা দাদাকে সে বড়াে ভালােবাসে। তার কিছু হয়নি তাে? বিকেল একটু পড়তেই যখন তার মা উঠানে রান্না নিয়ে বসলাে, এবং ষষ্ঠীচরণের বৈঠকে পাড়ার কয়েকজন বৃদ্ধ এসে জুটলাে, তখন সুযােগ বুঝে সেই সাড়ে ছয় বৎসরের দামাল বাড়ি থেকে লুকিয়ে দৌড় দিলাে জমিদার বাড়ির দিকে।

    পড়তি বেলার মুখে মহলে পা দিয়ে সে দেখলাে ঘরে কারুর সাড়াশব্দ নাই। তবে বােধহয় শিবা দাদারা ছাতেই রয়েছে। সে লঘু পদে উপরে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে যখন প্রায় দুইতলায় উঠে এসেছে, তখন হঠাৎ তার মনে হলাে নীচতলায় একটা ঝােড়াে বাতাসের মতাে কি যেন একটা দক্ষিণের ঘরখানিতে সবেগে ঢুকে পড়লাে। কৌতূহলের বশে আবার অতি সন্তর্পণে নীচে নেমে সে চোখ রাখলাে বাটের ফোকরে আর সঙ্গে সঙ্গে তার ঘাড়ের রোঁয়া অবধি কাঁটা দিয়ে উঠলাে।

    একটা কৃষ্ণবর্ণ পুঁয়ার কুন্ডলী অনেকটা যেন মানুষের আকৃতি ধারণ করে ঘরময় পাক খেয়ে চলেছে। লিকলিকে শরীর, উদগ্র হিংস্র মুখ, খােলা কেশ রাশি বিক্ষিপ্ত হয়ে হাওয়ায় ভাসছে। সে অতি মাত্রায় ব্যগ্রভাবে গােটা ঘরে কি যেন খুঁজে চলেছে, অথচ তার কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি খুঁজে পাচ্ছে না।

    এই রূপে বেশ কিছুক্ষণ সন্ধানের পর মূর্তি মিলিয়ে গেল।

    শিশুদের মনগড়া বা কল্পিত বস্তুর নাম করে ভয় দেখানাে সহজ, কিন্তু  বাস্তবে শিশুদের ভীতি বড়দের তুলনায় অনেক কম। তাদের বােধ বা বুদ্ধি কম, অভিজ্ঞতাও লঘু, তাই একটা বস্তু ঠিক কেন ভয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে, বা তার থেকে ঠিক কি ক্ষতি হতে পারে, সে সম্বন্ধে তাদের ধারণা থাকে না। মূর্তির অপসারণের পর যখন উল্টোদিকের কক্ষের থেকে পদ্ম গুণীনের নাসিকা গর্জনের ধ্বনি রঙ্গলালের শ্রুতিগােচর হলাে, তখন সে সতর্ক পদক্ষেপে সেই ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কোনও বয়স্ক বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই সাহসটুকু দেখাতে পারতাে কিনা সন্দেহ। গুণীনের ঘরের দরজা ঈষৎ ফাঁক রয়েছে। সেইখানে চোখ লাগানাে মাত্র রঙ্গলাল আবার চমকে উঠলাে। সেই অদ্ভুতদর্শন মূর্তিটা এইবারে এইখানে প্রবেশ করেছে। চতুর্দিকে তাকিয়ে সে এসে থামলাে পূজার বস্তুগুলির সামনে। রঙ্গলাল একটা রুদ্ধকণ্ঠের আবছা হাসি শুনতে পেলাে। এই চলমান মৃত্যুদূতের দৈহিক বল সম্পর্কে তার কোনও ধারণা ছিলাে না, কিন্তু পূজার জন্যে রাখা স্কুল এবং বিলক্ষণ ভারী থালা বাসন গুলিকে যখন শয়তানটা খােলামকুচির ন্যায় দুমড়ে মুচড়ে দিতে শুরু করল তখন এই দুরন্ত বালক প্রথম ভয় পেলাে। পূজার যত উপকরণ রাখা ছিল, সেগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছত্রখান হয়ে গেল। ছায়া শরীরটা এইবারে গুণীনের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে তার মাথার দিকে কিছু সময় নিমেষহীনভাবে চেয়ে রইলাে। তারপর আবার হাসতে হাসতে ঘরের বাতাসে মিশে গেল।

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুণীন খোঁচা খাওয়া ব্যাঘ্রের মতাে একটা চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে পড়লাে। আওয়াজ শুনে ছাতের থেকে সকলেই হুড়ােহুড়ি করে নীচে এসে দেখে পদ্মগুণীন ক্রোধে থরথর করে কাঁপছে। গােটা ঘরময় দোমড়ানাে বাসন এবং ঘি, মধু, কাঠ ছড়িয়ে রয়েছে। পদ্ম দাঁতে দাঁত ঘষে কইলাে, “সে শয়তানীর এত বড়াে ধৃষ্টতা, সে আমার সঙ্গে মােকাবেলা করতে চায়? আমাকে স্বপ্নের মধ্যে সে শাসিয়ে গিয়েছে যে আমি যেন নিজের হাতে মন্ত্রপূতঃ পুস্পার্ঘ্য দিয়ে দেবীর আবাহন না করি। নচেৎ সে আমার ঐ হাত নাকি কেটে নেবে! একবার ভাবতে পারাে তােমরা! কত বড়াে স্পর্ধা তার? বেশ। দেখি কার জোর বেশি। আজ তাই প্রমাণ হােক। আমি, পদ্ম গুণীন বলচি, এই অবশিষ্ট যজ্ঞােপচার দিয়েই আমি যজ্ঞ সম্পন্ন করবাে।” শিবা তাকিয়ে দেখলাে ক্ষোভে, অবমাননায় গুণীনের চক্ষু থেকে আগুন ঠিকরে পড়চে।

    ঠিক গােধূলি উত্তীর্ণ হতেই পূজা আরম্ভ হলাে। মনসাদেবীর ঘট প্রতিষ্ঠা করে পদ্ম বিধি মতাে ক্রিয়াকরণ শুরু করল। হঠাৎ কোথাও থেকে যেন দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ আসতে লাগলাে। উপস্থিত সকলে তা পরিষ্কার শুনলাে। দুঃখ বা হতাশা জড়িত নিঃশ্বাস নয়, বরং ভীষণ ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে কেউ যেন পূজা পন্ড করার আয়ােজন করেছে। গুণীনের পুস্পার্ঘ্য নিবেদনের সময় যত এগিয়ে আসতে থাকলাে, ততােই গর্জনের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেতে থাকলাে। এই ফোঁস ফোঁসানি শব্দটিকে পদ্ম এবং প্রত্যেকেই ওই শয়তান প্রেতাত্মার অসহায় আর বিফল আক্রোশ বলেই ভেবেছিলাে, ফলে তাদের ভুলটা ভাঙলাে বড়াে ভয়ংকরভাবে।

    পদ্ম পুস্পার্ঘ্য হাতে নিয়ে চতুর্দিকে চোখ ফেরালাে। আর কোনও আওয়াজ আসচে না। মানুষগুলােও অবধি উত্তেজনায় শ্বাস বন্ধ করে রেখেচে। গুণীন মন্তর পড়া ফুল সজোরে ছুঁড়ে দিলাে ঘট এর দিকে। এতক্ষণের জমে থাকা মৃত্যুশীতল নিস্তব্ধতা এইবারে সশব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কোথা থেকে একটা বজ পড়ার মতাে ভয়াবহ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মানুষ সভয়ে দেখলাে একটা নক্ষত্রবেগ ছায়ামূর্তি ফুলগুলিকে মাঝপথেই যেন গিলে ফেললাে। বিস্মিত গুণীন উঠে দাঁড়ানাের চেষ্টা করতেই সেই ছায়া এসে সবেগে ধাক্কা মেরে মেঝেতে চিতিয়ে ধরাশায়ী করল তাকে। মহা আতঙ্কিত হয়ে সবাই অনুভব করল যে, একটা অদৃশ্য কিছু পদ্মগুণীনের ডান হাতটাকে কামড়ে ধরেচে। গুণীন চিৎকার করে তা ছাড়ানাের চেষ্টা করে চলেচে, কিন্তু সেই অশরীরীর দৈহিক বল সাধারণ মনুষ্যদেহের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। গুণীন অচৈতন্য হয়ে মাটিতে ঢলে পড়লাে। তার ডান হাতটা ছিন্ন হয়নি বটে, কিন্তু পক্ষাঘাতগ্রস্তের ন্যায় চিরতরে অকর্মণ্য হয়ে গিয়েছে।

    **********

    ছােট্ট শিশুকে কোনও একটা আশায় প্রলুব্ধ করতে করতে হঠাৎ তার গন্ডদেশে সপাটে চড় মারলে তার মুখ এবং মনের ভাব যা দাঁড়ায়, পুরকায়স্থ গৃহের সদস্যদেরও সেই অবস্থাই হলাে। পদ্মগুণীনের আসার পরে তাদের মনে ক্ষীণ ভরসা ফিরে এসেছিলাে এই সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের, কিন্তু খােদ গুণীনের দশা দেখার পরে সে ভরসা সমূলে উৎপাটিত হলাে। পূনর্মুষিকের ন্যায় তারা পুনর্বার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়লাে। এক উপায়, বাড়ি ত্যাগ করে অন্যত্র উঠে যাওয়া, কিন্তু পরিণতি হিসেবে কারবারটুকু এবং আয় তত বন্ধ হবেই, বাপের তৈরি ভদ্রাসনে সাতজন্মেও আর সন্ধ্যাবাতি পড়বে না। হয়তাে অম্বিকা এসে ঘরবাড়ি দখল করে বসবে। দুয়াে দেবে। তাছাড়া ঘর ছাড়লেই যে রাক্ষসী তাদের পরিত্যাগ করবে তারই বা নিশ্চয়তা কি?

    প্রতিটি মানুষ নারী-পুরুষ, বড়াে-ছছাটো নির্বিশেষে যখন আতঙ্কে শুষ্ক হয়ে পড়েচে, সে সময় একটা অদ্ভুত পরিবর্তন দেখা গেল দ্বারবান লছমি প্রসাদের মধ্যে। সে আর ভয়ে ভীত নয়, বরং ভিতরে ভিতরে ফুসচে ওই বিভীষিকার মােকাবেলা করার জন্য। চাইচে একটিবার সেই যমের মুখােমুখি হতে, যে তার দেবতুল্য মনিবের সম্পূর্ণ বিনা কারণে প্রাণহরণ করেচে। লছমি সামান্য দ্বারপাল হলেও জীবানন্দের থেকে সে ভাইয়ের মতােই স্নেহ পেয়ে এসেছে। একখানি পােক্ত বাঁশের লাঠি হাতে সে রাতে একাই মহলের বাইরে এসে দাঁড়ালাে। মহানন্দ অনেকবার বাধা দেবার চেষ্টা করে দেখেচে লছমি সে কথা শুনচে না। একটা মরীয়া জিদ তাকে দানাের মতাে পেয়ে বসেছে যেন।

    তখন রাত্তির তত বেশি হয়নি। গাঁ তখনও ঘুমিয়ে পড়েনি পুরােপুরি। জমিদার বাড়ির অন্দরে রাতের আহার চলচে। লছমি দুইখানা রুটি খেয়েচে মাত্র, আর তারপরেই প্রহরা দিতে চলে গিয়েচে। লছমি হাঁটতে হাঁটতে সময় অনুমান করার চেষ্টা করল। গাছের মাথায় রাতচরা পাখি তখনও ডাকা শুরু করেনি। পটপটি ফুল তখনও ফোটা শুরু করেনি। পাশের ঝুমরী নদীতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কুলি মজুরদের রাতের শেষ নৌকা এসে ভিড়লাে। মহলের ভিতর থেকে থালা বাসনের টুংটাং শব্দ আসছে। এখনও তাকে লম্বা সময় অপেক্ষা করতে হবে। রাতে আহারান্তে সকলে শয়ন করেছে। মহানন্দ শােবার পূর্বে দুইতলার ঘরের আগল দিতে গেল, আর সহসা তার চোখে পড়লাে নীচের তলায় যেন একটা ছায়ার মতাে কি জিনিস ঘুরে বেড়াচ্চে। মহানন্দের বুকটা ভয়ে ছাঁৎ করে উঠলাে। এক মুহূর্তের মধ্যেই সেই পুঞ্জীভূত অন্ধকার রাশি নীচতলার খােলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে ধেয়ে গেল। মহানন্দ প্রবল ভীতিবশতঃ দৌড়ে কক্ষে প্রবেশ করেই কবাট বন্ধ করতে যাচ্চে, হঠাৎ তার মনে তীব্র ধিক্কার জন্মালাে। এ কি করছে সে! ছিঃ ছিঃ। একটা দ্বারবান নিজের জান-প্রাণ তুচ্ছ জ্ঞান করে তাদের প্রহরার জন্য খােলা অঙ্গনে রাত কাটাচ্চে, আর সে? বিপদকে লছমির দিকে ধেয়ে যেতে দেখেও একটিবার তাকে সতর্ক অবধি করবে না? ছিঃ।

    নীচে নামার বদলে কক্ষের লাগােয়া খােলা অলিন্দে দাঁড়িয়েও লছমিকে ডাকা যেতে পারে। তবে অলিন্দের দিকেও একলা যাওয়া উচিৎ কর্তব্য। হবে না। মহানন্দ শয্যার কাছে এসে ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে কইলাে, “শিবা। এই শিবা। শিগগির ওঠ একবার।” শিবা ধড়মড় করে উঠে বসলাে।

    লছমি শ্রান্ত হয়ে মূল ফটকে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রয়েছে। অন্ধকারের পিন্ডটি অলক্ষ্যে তার থেকে হাত বিশেক তফাতে একটা রঙ্গনের ঝােপের পিছনে এসে স্থির হলাে। ধোঁয়ার কুন্ডলীটি একটা আবছা মেয়েমানুষের মূর্তি ধারণ করল। তার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি, চোখে আগুনের ভাঁটি জ্বলচে, চুলের রাশি বাতাসে ভেসে ভেসে যেন শয়তানীর জাল বিস্তার করচে। মূর্তিটা একবার মহলের পানে তাকিয়ে অবিকল মহানন্দের কণ্ঠে ডেকে উঠলাে, “লছমিইইইই”।

    লছমি প্রসাদ যথার্থই পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাে। হঠাৎ প্রভুর ডাক শুনে সে চমকে উঠে সাড়া দিলাে, “এই যে ছােটোকর্ততা…”

    উত্তর দেওয়া মাত্র লছমির মনে হলাে তার শরীরটা যেন শিহরিত হয়ে উঠলাে। খুব ভয়ের কিছু একটা আশপাশে ঘাপটি মেরে থাকলে যেমনটি হয়। সামান্য বিলম্বেই আবার মহানন্দের স্বরে ডাকলাে রাক্ষসীটা, “কোথায় রে লছমি?”

    লছমি ভাবলে নিশ্চয়ই ঘরে কোনও বিপদ ঘটেছে। সে সটান উঠে দাঁড়িয়ে গলা আরও তুলে উত্তর করলে, “কর্তা, আমি বড়াে ফটকে…

    রাক্ষসী এইবারে ঝােপের আড়ালে শিকারের জন্য প্রস্তুত হয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালাে, তার সূচাগ্র নখর গুলি থাবার থেকে মার্জারের ন্যায় বাইরে বেরিয়ে এল, তীক্ষ দাঁতের রাশি ঝলক দিয়ে উঠলাে এবং মহানন্দ যেন শুনতেই পায়নি এমনভাবে পুনরায় শুধােলাে, “আরে ও লছমি, সাড়া দিচ্চিসনে কেন?”

    বিস্মিত লছমি এইবারে প্রায় উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে বলতে গেল কিছু একটা, কিন্তু আচমকা তার পিছনে ফটকের দিক থেকে ভীষণ শক্তিমান একটা প্রশস্ত হাত এসে তার মুখ আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরলাে। লছমি বােবার মতাে গোঁ গোঁ করে ভয়ার্ত, অস্ফুট স্বরে বললাে, “কে? কে পিছনে!”

    চাপা নীচু কণ্ঠে প্রত্যুত্তর এল, “ব্রাহ্মণ। নাম কালীপদ মুখুজ্জে। নিবাস রায়দীঘড়া।”

    **********

    লছমি ভয় এবং বিস্ময়ের যুগপৎ আবেশে কিছু সময় আবিষ্ট হয়ে থেকে সহসা সম্বিৎ ফিরে পেলাে। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে দীর্ঘদেহী এক পুরুষ মূর্তি। গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ শরীর। প্রশস্ত স্কন্ধদেশ, দীপ্ত মুখ, কঠিন চিবুক অথচ মােহময় স্নিগ্ধ দুইখানি চক্ষুতে বুদ্ধি, মেধা এবং পৌরুষ একত্রে ফুটে রয়েছে।

    এ ছাড়াও তার মধ্যে এমন কিছু একটা রয়েছে, যার ফলে তাকে দেখলেই মনে ভরসা জাগে যে- নাহ, আর কোনও ভয় নাই। তার পশ্চাতে একখানি বাঁশের লাঠি হাতে আরেকটি মানুষ। ভারী তাগড়া জোয়ান।

    উল্টোদিকের রঙ্গনের ঝােপের মধ্যে একটা আবছা গরগর গর্জনের সঙ্গে হুড়মুড় শব্দ উত্থিত হলাে। একটা ভারী কিছু যেন সেখানে লুক্কায়িত ছিলাে এবং আচমকা পালিয়ে গেল। লছমি বিহুলভাবে শুধােললা, “আজ্ঞা আপনি… মানে…!”

    কালীপদ সামান্য হেসে কইলাে, “তুমি বুঝি এই বাড়ির দ্বাররক্ষক? তােমার মতাে সাহসী মানুষ আমি অতি অল্পই দেখেচি। জীবানন্দ পুরকায়েৎ মশায়ের সঙ্গে একটি মামলার সূত্রে আমার আলাপ। সেই মােকদ্দমায় আমি এবং পুরকায়েৎ মশায় প্রজাদের স্বার্থরক্ষার স্বপক্ষে সাক্ষী ছিলুম। সেই মামলার কিছু দরবারী নকল এই বাড়িতে ছিল। তােমার মনিব সেই দস্তাবেজেই আমার রায়দীঘড়ার ঠিকানা পান এবং একখানি দীর্ঘ পত্র মারফৎ প্রায় সকল ঘটনা আমাকে অবগত করেন।”

    লছমি আনন্দে বললাে, “হাঁ হাঁ, আমিই সে লেফাফা ডাকে দিয়ে এসেছিলাম।”

    -“জীবানন্দ মশায়ের পত্র পাঠ মাত্র আমি আর বিলম্ব করিনি। আসতে যেইটুকু সময় আবশ্যক সেইটুকুই নিয়েছি। এই রাতে দেখলুম শেষ একখানা জনমজুরদের পানসি ছাড়চে। তাতেই উঠে বসলাম। তাঁকে খবর দিয়ে বলল কালীপদ মুখুজ্জে এসেচে।”

    লছমির মুখ থেকে আনন্দ তিরােহিত হয়ে চোখে অশ্রু ঠেলে এল। জড়িত বাষ্পরুদ্ধ স্বরে সে বললাে, “ঠাকুর মশায়, আমরা অনাথ হয়ে গিয়েছি। সেই রক্তলােলুপ পিশাচী ঐ দেবতার মতাে মানুষটারে ছিড়ে কুটিকুটি করেছে। এতবড়াে তালুকের কুড়ি খানা গাঁয়ের লােক যাঁর নামে পেন্নাম ঠোকে, যার একটিও শত্রুর নাই, সেই ভগবানতুল্য..” লছমি সজোরে কেঁদে উঠলাে।

    কালীপদর মুখে একবার মাত্র ঔদাসীন্য দেখা দিয়েই অদৃশ্য হলাে। তার চক্ষু শাণিত হয়ে উঠলাে। চিবুক কঠিনতর হলাে। সেই সময়ে উপরের অলিন্দে আবছা আঁধারে দুইটি মানুষকে দেখা গেল। মহানন্দ চিৎকার করে বললাে, “লছমি। হুঁশিয়ার। নীচে একটা ছায়ার মতাে কি যেন নামতে দেখলাম।”

    কালীপদ অনেকটা আত্মগতভাবে কইলাে, “কানাই, অন্দরে চল”। খবর পেয়ে রাত্তির হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেকেই নীচে নেমে এল। মহানন্দকে দেখে কালীপদ সবিস্ময়ে উঠে দাঁড়ালাে। মহানন্দ বিস্ময়ের হেতু অনুমান করে বললাে, “মুখুজ্জেমশায়, আমি মহানন্দ পুরকায়স্থ। জীবানন্দ পুরকায়স্থ আমার দাদা। যদিও বয়সের ফারাক আমাদের নামমাত্র। আমি তাঁর যমজ।”

    কালীপদ সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাে। স্বগতােক্তির ঢঙে বললে, “দুই সহােদরের এতখানি সাদৃশ্য আমার এই প্রথম দেখা।”

    মহানন্দের মুখে এতক্ষণ সামান্য কৌতুক দেখা দিয়েছিলাে। এইবারে তা মিলিয়ে গিয়ে সে আকুল কণ্ঠে কইলাে, “এই সাদৃশ্যই তাে দাদার জীবন ছিনিয়ে নিলাে ঠাকুর। আমার ভাগের অপঘাত দাদাকে গ্রাস করল।”

    ধীরে ধীরে খুঁটিনাটি প্রশ্ন করে করে প্রায় সমস্তটাই শুনলাে কালীপদ। সারা রাত্রি তার ভ্রুকুটি কুটিল হয়ে রইলাে। খুব ভােরে যখন সকলের নিদ্রা ভাঙলাে, তখন লছমি, মহানন্দ, শিবানন্দ আর কানাই সর্দারের সঙ্গে চারপাশটা দেখতে বেরুলাে কালীপদ। চতুর্দিকে তীক্ষ্ণ নজর করতে করতে পিছনের পাকুড় গাছের তলে এসে কালীপদ থামলাে। তার লক্ষ্য নিবদ্ধ রয়েছে হিমে ভেজা মাটির উপরে অঙ্কিত কয়েকটা পায়ের ছাপের দিকে।

    কালী সেদিকে পর্যবেক্ষণ করে ধীরে ধীরে বললাে, “দেখ কানাই, পায়ের চিহ্নগুলাে বড়াে এলােমেলাে। ফটকের দিক থেকে কেউ যেন হঠাৎ তড়িঘড়ি কিছুদূর এসেছে, তারপরেই থমকে দাঁড়িয়েছে, আবার হন্তদন্ত হয়ে এগিয়েচে, ফের থমকে গিয়েছে, আর এইখেনে এসে সে চিহ্ন অগােছালাে হয়ে পড়েছে। ঠিক যেন কেউ পরিচিত লােকের স্বর পেয়ে পরপর তিনবার তাকে অনুসরণ করেছিলাে।”

    লছমি আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলাে, “শুকো!”

    কালী তার পানে চেয়ে উত্তর দিলাে, “সম্ভবতঃ সঠিক। শুকোকে ঐ রাত্তিরে কেউ হয়তাে তােমাদেরই গলা নকল করে ডেকেচিলাে। কথায় বলে বার বার তিনবার। রাতভিতে এক ডাকে সাড়া দিতে নাই। নিশিতে ধরে। কিন্তু এক্ষেত্রে পুরাে উলটো ব্যাপার। তৃতীয়বার সাড়া দিলেই সর্বনাশ। লছমির সময়ও আমি সঠিক সময়ে বাধা না দিলেই হয়েছিলাে চিত্তির। শুকোর বেলাতেও দেখছি তাইই ঘটেছে। হয়তাে জীবানন্দ মশায়ের সময়ও একই ভাবে…

    তারপর ধরাে ঐ কুকুরটা। সে তাে শুনলাম রােজ রাতেই তােমাদের সঙ্গে রাতপ্রহরা দিতাে। তা, সেদিন হঠাৎ সদর বন্ধ থাকা সত্ত্বেও জানালার ফোকর টপকে ভিতরে গিয়েচিলাে কেন? কুকুর এমনটি তখনই করে, যখন সে তার প্রভুর কণ্ঠস্বরের ডাক শােনে।

    আচ্ছা লছমি, এই ঘরে কোনও অনেক পুরনোে কক্ষ রয়েছে যেটি বহুদিন উন্মুক্ত হয়নি?”

    লছমি জবাব দিলাে।

    -“আছে ঠাকুরমশায়। বালাখানার ঘর আছে।”

    সকলকে নিয়ে সেই ঘরের সামনে গিয়ে, চাবি ঘুরিয়ে কুলুপ খুলে ফেললাে কালীপদ। এক ধাক্কায় কবাট খােলা মাত্র একটা পুরনাে ভ্যাপসা ঘ্রাণ সকলের নাকে পৌঁছুলাে। কালীপদ সকলের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, “এই যে পুরনাে গন্ধটা তােমরা পেলে, খুব ভালো করে স্মরণ করে বলাে তাে, এই রকম ঘ্রাণ কি তােমরা নিতান্ত অকারণে বা অসময়ে কখনও অনুভব করেচো এর মধ্যে?”

    লছমি ইতস্ততঃ করে বললে, “আজ্ঞা ঠাকুর, মানে সঠিক মনে পড়চে না, তবে ঐ দাহ কাজের দিন, অর্থাৎ কালীপূজার রাত্তিরে আমরা ঘরের দেউড়িতে বসেছিলাম। তখন যেন এইরকমই একটা গন্ধ নাকে এসেছিলাে।”

    কালীপদ নিষ্পলক চেয়ে শুধােললা, “বেশ। ঐ আঘ্রাণ পাবার পর কি তােমার শরীর বেশ ভারী বা অবশ হয়ে পড়েচিলাে? মনে করতে পারাে কি?”

    লছমি এবার ভীষণ উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলাে।

    —“ হয়েছিলাে কৰ্ত্তা, আলবৎ হয়েছিলাে। আমি গন্ধখানা পাওয়া মাত্তর আমার হাত অবশ হয়ে খৈনি পড়ে গিয়েছিলাে।”

    উত্তেজনার বশে কথাগুলাে বলেই মহানন্দের পানে তাকিয়ে লজ্জায় জিভ কাটলাে।

    কালীপদ কিছুক্ষণ একেবারে নির্বাক থেকে মুখ খুললাে। মহানন্দের উদ্দেশ্যে বললাে, “আপনার গৃহে কিন্তু এক ভয়াবহ অপদেবতা বাসা বেঁধেছে। তন্ত্রের পরিভাষায় এদের রক্তকুঁড়াে বা কুঁড়ােবাস বলা হয়। এরা নিজেদের সঙ্গে এক প্রাচীন গন্ধ বহন করে। অনেকটা নিশির মতােই এদের চলাফেরা, কিন্তু শিকার পন্থা নিশির সম্পূর্ণ বিপরীত। এদের ডাকে তিনবার সাড়া দিলেই মরণ অনিবার্য। এরা দ্রব্যাশ্রয়ী, অর্থাৎ কোনও পার্থিব বস্তুকে আশ্রয় করে এরা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু সে কোন বস্তু, তা ধরা প্রায় অসম্ভব। আপনার গৃহেও সেই শয়তানী কোনও একটা বস্তুর মধ্যেই আত্মগােপন করে রয়েছে, কিন্তু তা খুঁজে বের করার একটা বড়াে বাধাও রয়েছে।

    এই কুঁড়ােবাস প্রেতাত্মারা ভীষণ ধূর্ত এবং মাত্রাতিরিক্ত হিংস্র। একটিবার যদি সে আঁচ করতে পারে যে আমরা তার অস্তিত্ব সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েছি, তবে সে তৎক্ষণাৎ সেই স্থান বদলে ফেলে নুতন বস্তুতে ভর করবে। তাই যে কোনও উপায়ে প্রথমবারেই এত বড়ড়া মহলের মধ্যে তার সঠিক বাসস্থানটি খুঁজে বের করা চাই।

    আমার কিছু একটা মনে পড়বাে পড়বাে করেও যেন মনে আসছে না। এখনও অবধি যতগুলি ঘটনা শুনলাম, তার মধ্যে কি যেন একটা মিল রয়েছে। কিছুতেই ধরতে পারচি নে।

    আর একটা কথা, এই কাজে আমার একজন স্বজাতীয় জুড়িদার আবশ্যক। একজন পবিত্র এবং তন্ত্রবিদ ব্যক্তি। সে আমি জোগাড় করে নেবাে’খন। লছমিকে আমার কিছুক্ষণের জন্য চাই।”

    ***********

    লছমি আর কানাই গাঁয়ে বেরুলাে। কালীপদ ছাতে একখানা চৌপাইতে বসে বসে গভীর মনে চিন্তা করে চলেছে, হঠাৎ একখানা সুন্দর, কচি মুখ চিলেকোঠার দিক থেকে চোখে পড়লাে। কালীপদ একটু হেসে কইলাে,

    “কে ও?”

    বালক উত্তর দিলাে, “আমি রঙ্গলাল।”

    কালীপদ বাচ্চাদের ভীষণ ভালােবাসে। সে রঙ্গলালকে হাসিমুখে পাশে বসাতেই বালকের দ্বিধা দূর হলাে। সে নিঃসংকোচে বললাে, “দাদু, তুমি কি সন্নিসী?”

    কালী হােঃ হােঃ করে হেসে উঠে বললাে, “হ্যাঁ রে হতভাগা, আমারে বুঝি সন্নিসী মনে হলাে তাের?”

    —“তবে যে শিবা দাদা আনন্দ করে বললাে তুমি নাকি ভূত তাড়াতে এসেছো?

    -“ধুর ব্যাটা। ভূত তাড়াবাে কেমন রে? আমি তাে এসেচি তােদের গাঁয়ে দুই দিন থাকতে। ওসব ভূতপ্রেতে আমার বড়াে ভয় রে বাপ।”

    বালক সামান্য আশাহত হয়ে বললাে, “তবে শিবা দাদা কিচ্ছুটি জানে না। আগেরবার যে সন্নিসী এসেছিলাে, তার জানাে হাত কামড়ে দিয়েছিলাে ভূতে। আমি এসেছিলাম মনসাপূজা দেখতে। সন্নিসীটা যখন ঘুমুচ্চিললা তখন কি হয়েছিলাে সে কথা তাে তুমি শুনেছো। তাই দেখে ঘুম থেকে উঠে সে কী রাগ তার। হ্যাঁ দাদু, ভূত কি তােমারও হাতে কামড়ে দিতে পারে?”

    কালীপদ অন্যমনস্কভাবে বললাে – “হুঁ, পারে বৈকি।

    বালক একটু পাশে ঘেঁষে বসে শুধােলাে,

    -“দাদু, এই মনসাঠাকুরই তাে চাঁদ বণিকের শব্দুর, তাই না? আমি গল্প শুনেছি কত্তো বার।”

    কালী স্নেহের স্বরে বললে,

    -“ছিঃ দাদুভাই। শত্রু কেন হতে যাবে ? ও তাে পূজা নেবার জন্য মনসাদেবী ছল করেছিলেন মাত্র।

    বালক বিস্ময়ের সুরে শুধােললা,

    -“কিন্তু মা মনসাই তাে জিতে গিয়েছিলাে শেষ অবধি? গল্পে শুনেচি যে!”

    -“না দাদুভাই, তা নয়। চাঁদ বণিকও কিন্তু ঠিক হারেননি। ভারী কঠিন পুরুষ ছিলেন। তিনি পূজা দিয়েছিলেন বটে, তবে…”

    কালীপদ বালকের সাথে কথা কইতে কইতেই নানারকম চিন্তাজাল বুনে চলেছিলাে। নিজের শেষ কথাটি হঠাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই সে এক লাফে উঠে দাঁড়ালাে।

    আবেগ ঘন গলায় চিৎকার করে উঠলাে,

    “তাই তাে দাদুভাই! তাই তাে! এতক্ষণ ধরে আঁধারে হাতড়ে চলেছি, অথচ এই সােজা জিনিসটা চোখের সামনেই পড়ে রয়েছে! শাস্ত্রে সত্যি কথাই কয় যে শিশুর জিহ্বাতে ভগবানের বাস। আজ তুমি আমার চোখ খুলে দিলে দাদুভাই।”

    অপরাহ্নে কালীপদ বাগানে ঘুরে ঘুরে দুই চারিটি উৎকৃষ্ট বারােমেসে গােলাপফুল পর্যবেক্ষণ করচিলাে, এমন সময়ে কানাই আর লছমি ঝুমরী নদীর ধার থেকে ফকীরকে নিয়ে উপস্থিত হলাে। মহানন্দ বিস্মিত হয়ে বললাে, “এ যে ফকীরবাবা! এঁকে আপনার প্রয়ােজন?”

    কালীপদ উত্তর করল, “এই আমার স্বজাতীয় জুড়িদার”।

    **********

    বড়াে বড়াে বিপদের কালে আনুসঙ্গিক হিসেবে কিছু উটকো ঝঞ্ঝাটও থাকে। সকলে মিলে যখন গৃহে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা চেঁচামেচির শব্দে তারা ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাে সঙ্গে ছয়জন ডাকাইতের মতাে চেহারার লেঠেলকে নিয়ে হাজির হয়েছে দোর্দণ্ডপ্রতাপ অম্বিকা। মহানন্দ মনে মনে প্রমাদ গােণে কালীপদকে শুষ্ক কণ্ঠে কইলাে,

    – “এই হতভাগা হচ্চে অম্বিকা বাঁড়ুজ্যে। আমাদের শত্রুর ঘব। না জানি কি মৎলবে লেঠেল নিয়ে হাজির হয়েছে আজ!”

    অম্বিকার অধরােষ্ঠে একচিলতে ব্যাঙ্গ মিশ্রিত হাসি খেলা করছে। সেই শয়তান বাজখাঁই কর্কশ স্বরে কালীপদর উদ্দেশ্যে শুধােললা,

    -“তা, মশায় আপনিই তাে সেই গুণীন, যাকে বড়াে তরফ ডেকে পাঠিয়েছিলাে, তাই না ? হুঁ হুঁ, সব খবর পেয়েছি ইতিমধ্যেই। তা মন্তর তন্তর যত ইচ্ছে কষে করুন, ক্ষতি নাই, কিন্তু বামুনের সন্তান হয়ে মােছলমানের ছেলেকে হিদুর ঘরের অন্দরে ঢােকাবেন, সেই মলব এই হােগলামারিতে অন্ততঃ চলবে না। এইভেনে ধার্মিক লােকজন বাস করে, অতঃপর এসব অনাচার গাঁয়ের ভিতর হতে পারবে না আমি থাকতে। আমি অম্বিকাচরণ বাঁড়ুজ্যে। চারভিতের চারখানা গাঁ আমার এই পােষা লেঠেলদের দাপটে কাঁপে। এতগুলাে ঘরে বামুন থাকতে তার জুড়িদার হিসেবে পছন্দ হলাে কিনা একটা বেজাতের মানুষকে? ছোঃ। কলি কলি।”

    এই অবধি বলে সেই নরাধম নিজের ষন্ডামার্কা অনুচরদের প্রতি আদেশ করল, “এই, তােরা গিয়ে ওই হতভাগা ফকীরটাকে আবার ঝুমরীর পাড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আয়। এই হিন্দু গুণীনটাকে তাও থাকতে দিতুম, কিন্তু নাহ, এটাকেও গাঁয়ের বাইরে করে দে।”

    প্রভুর আদেশে ছয়খানা সাক্ষাৎ যমানুচর মােটা লাঠি হাতে এগিয়ে আসতে থাকলাে বাড়ির প্রবেশদ্বারের পানে। মহানন্দ অত্যন্ত অপমানিত ও বিচলিত হয়ে অসহায়ের মতাে অধােবদনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কালীপদ গলাটা সামান্য খাঁকারি দিয়ে অম্বিকার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাে, “আপনাদের হিসেবে জুড়িদার আর একজন তান্ত্রিকের হিসেবে জুড়িদারের মধ্যে আকাশপাতালের তফাৎ রয়েছে। ও কথা ছাড়ুন। আমাকে তাড়াতে চান জেনে বড়াে প্রীত হলাম, কিন্তু প্রশ্ন হলাে আমাদের তাড়াবার মতাে লােকবল কোথা আপনার?”

    অম্বিকা চিরকাল লেঠেলদের সামনে রেখে জবরদস্তি বা অন্যায় করে এসেছে, কিন্তু এ যাবৎ তাকে এই ধরনের অসম্ভব প্রশ্নের সম্মুখীন কক্ষণােই হতে হয়নি। সে সত্যিই বিস্মিত হয়ে বললাে, “আপনার কি বায়ুবিকার ধরেচে নাকি মশায়? চোখের ওপরে এতগুলাে যমদূতকে দেখতে পাচ্ছেন না! এরা কি যথেষ্ট নয়?”

    কালীপদ হতভম্ব হয়ে কইলাে, “এই ছয়জন মাত্র ? এই মুষ্টিমেয় কয়েকখানা পিঁপড়া আমার কানাই সর্দারের সামনে কতক্ষণ টিকবে? ঠিকঠাক মওড়াই তাে নিতে পারবে না। কানাইয়ের তাে একটা সম্মান রয়েছে।”

    কালীপদর কথা শেষ হতেই তার পার্শ্বে কানাই এসে লাঠি ঠুকে দাঁড়ালাে। পরনে খেটো ধুতি, গা আদুড়, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, গােটা শরীরে বলিষ্ঠ পেশীগুলি কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। কানাই বােধহয় পৃথিবীর একমাত্র লেঠেল যার মুখে সবসময় হাসি লেগে রয়।

    এত বড়াে স্পর্ধার কথা অম্বিকা ইহজন্মে শােনেনি কখনও। তিলমাত্র বিলম্ব না করে, দাঁত কড়মড় করে তার অনুচরদের কালীপদর দিকে লেলিয়ে দিলাে। সেই কালান্তক দানবেরা ঝড়ের মতাে কানাইকে ঘিরে ফেললাে। কানাই লাঠি চালালাে।

    কোমল ননীর পিন্ডের ভিতরে সুতীক্ষ্ণ ছােরা চালানাের ন্যায় দলটা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়লাে। এক ভাগের তিনজন নিজেদের লাঠি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করচে কানাইয়ের লাঠিকে হটাবার, আর অপর তিনজন মাটিতে রক্তাক্ত হয়ে চিতিয়ে পড়ে রয়েছে। কারুর দাঁতের পাটি ভগ্ন হয়েছে, কারুর হাত। কালীপদর কথাই সত্য। ন্যূনতম মহড়া নেবার সময়টুকুও তারা পায়নি। সুদক্ষ জাত লাঠিয়াল, রায়দীঘড়ার জল মাটিতে লালিত কানাই সর্দারের হাতের সামান্য লাঠি সর্বনাশা বজ্রের ন্যায় প্রতিপক্ষের প্রতিটি লক্ষ্যকে বিদ্ধ করেচে। ছয়জন ভয়ানক আহত মানুষের ছটফটানি আর গােঙানির আওয়াজ শুনে অম্বিকা বাঁড়ুজ্যে ধর্ম এবং গাঁয়ের প্রতি দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগালাে বাইরের রাস্তার দিকে।

    ফকীর প্রশ্ন করল, “মুখুজ্জেমশায়, আপনি কেন যে বেছে বেছে আমাকেই নিজের সঙ্গে রাখতে চাইচেন তা জানিনে, তবে আমি জীবানন্দ মশায়ের মিত্রস্থানীয় ছিলেম। এ বাড়ির মঙ্গলাকাঙ্খী আমি। তত অধিক বিদ্যে আমার নাই, তথাপি আমার দ্বারা যদি কণামাত্র উপকারও সম্ভবে, তবে নিজেরে ধন্য জ্ঞান করবাে।”

    – “আপনাকে এই কাজে আমার সঙ্গে থাকার জন্য অনুরােধ করেছি, তার একটা বিশেষ কারণ রয়েছে ফকীরসাহেব। আপনি প্রাচীন ইসলামী পবিত্র শাস্ত্র চর্চা করেছেন নিশ্চয়ই? আপনি কি তৈমূরবংশীয় সম্রাট বাবরশাহের ভগ্নী গুলবদন বানাে বেগমের দ্বারা রচিত তিলস্ম-এ-হােশরূবা পুঁথিখানি অধ্যয়ন করেছেন?

    ফকীর সাহেব রীতিমতাে চমকে উঠে কইলাে,

    -‘সেকি মুখুজ্জেমশায়! আপনি সে গ্রন্থ অবগত আছেন? আমার ধারণা ছিল কোনও হিন্দু তান্ত্রিক সেই পদ্ধতি জানেন না হয়তাে! হাঁ, আমি ওখানা বিলক্ষণ চর্চা করেছি, কিন্তু আপনি ঠিক কি চান বলুন তাে?”

    কালী হেসে বললাে,

    –“সাহেব, আমি অঘােরীর শিষ্য। আমার গুরুদেব হলেন রাজপুত বংশীয় মহারাণা ভীমসিংহের বংশধর। তিনি একজন যথার্থ অ-ঘােরী ছিলেন বলেই হিন্দুয়ানী, মুসলমানী বা খ্রীষ্টিয়ানীর ঘাের তাকে বশ করতে পারেনি কখনও। তিনি নিজের তন্ত্রের মধ্যে সবকয়টি পদ্ধতির সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। এই দুর্দান্ত অশরীরীকে বিনাশ করতে হলে আমার একখানি বিশেষ তিলস্মি বস্তু আবশ্যক, এবং সে বস্তু আপনি প্রস্তুত করতে পারেন নিশ্চিতরূপে।”

    —“তিলস্মি কেয়ামতি? আমি তৈয়ারী করতে সক্ষম? কি সে বস্তু?”

    কালীপদ দুইদিকে তাকিয়ে নীচু স্বরে বললাে, “আপনি সুলেমানি সুর্মা প্রস্তুত প্রণালী বেশ জানেন তাে?”

    ফকীর হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থেকে একটু পর বিস্ময় কাটিয়ে শুধােলাে, “মুখুজ্জেমশায়!… সুলেমানি সুর্মা? তবে কি আপনি সন্দেহ করছেন যে এই ঘরেই…

    কালী ঠোটে আঙুল ছুঁয়ে জবাব দিলাে,

    – “শশশশশ। হাঁ ফকীরসাহেব। আমি তাইই সন্দেহ করচি। তন্ত্রবিদ্যের জগতে এই তিলস্মি পদ্ধতি হলাে এক মহা শক্তিশালী আবিষ্কার। একাধারে তন্ত্র, অপরপক্ষে বিজ্ঞান, এই দুই মিলিয়েই এই শাস্ত্র তৈরি। বহুকাল পূর্বেই তাঁরা শব্দতরঙ্গ সনাক্তকরণের পদ্ধতি আবিষ্কার করে, এবং সেই প্রণালীতেই আবু হােসেনের স্বরে শিমশিম গুহার দ্বার উন্মুক্ত হতাে। যা হােক, আপনাকে সন্ধ্যায় এই সুর্মা তৈয়ারী করতে বসতে হবে। আমিও পারি, কিন্তু আমার মনঃসংযােগ তখন অপরাপর দিকে ব্যপ্ত থাকবে, তাই…

    -“বেশ ঠাকুর, আমি সুর্মা তৈয়ারীর চেষ্টা করবাে, তবে তার জন্য একখানা বস্তু আবশ্যক।”

    কালীপদ মুঠি খুলে একখানা গােলাপ গাছের শেকড় তার সামনে তুলে ধরলাে। ফকীরের মুখে প্রশংসা মিশ্রিত হাসি খেলে খেল।

    দো-মহলের ভিতরে প্রবেশ করে কালীপদ মহানন্দের উদ্দেশে অত্যন্ত চাপা স্বরে, সতর্কভাবে চতুর্দিকে একবার চেয়ে নিয়ে কইলাে,

    -“শুনুন কায়েত্মশায়, আজ সন্ধ্যায় আমি একখানি হােম করবাে এই ঘরে। এই দুষ্ট আত্মাকে বিতাড়ন করতে গেলে আপনাকে খুব গােপনে একটা কাজ করতে হবে। তবে এখন নয়, আমি তখনই আপনার কানে কানে বলে দেবাে’খন। জোরে বলায় বিপদ আছে। সেই শয়তানী এই কথা একবার শুনতে পেয়ে গেলেই কিন্তু সব পরিশ্রম পন্ড।”

    মহানন্দ উত্তরে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাে। কালীপদ মহল থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাে। মহানন্দ ভিতরবাড়িতে পা বাড়ানাের সময় মনে হলাে তার ঠিক ঘাড়ের পিছনে কেউ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথা ঘুরিয়ে সে দেখলাে মহলে দ্বিতীয় জনপ্রাণী নাই। একটা আশঙ্কায় মহানন্দ চিন্তিত হয়ে পড়লাে। সেই সাক্ষাৎ কালরাক্ষসীকে লুকোবার জন্যই কালীগুণীন একটু আগেই তাকে কথাগুলি অত্যন্ত রুদ্ধ কণ্ঠে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলেছিলেন। শয়তানীটা শঠতা করে সেসবই শুনে ফেললাে না তাে? দুশ্চিন্তার দোলাচলের মধ্যে মহানন্দ মহল ত্যাগ করল।

    ***********

    কালীপদর নির্দেশে মহলের প্রত্যেকটি কাচের তৈরি বস্তুকে কাপড় দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। একখানিও কাচের অথবা কোনও চকচকে বস্তু রাখা চলবে না। নীচের মহলে ফকীর বসে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ে খল আর নুড়ি নিয়ে সুর্মা তৈরি শুরু করল, “বিসমিল্লাহ ই রহমান ই রহিম, ইয়াঃ সুলেমান কর মদৎ..।

    কালীপদ একখানা আঁশবটি নিয়ে এসে তেপায়ার উপরে রেখেই উধাও হলাে। আবার কিছুক্ষণ পরে এসে প্রবেশ করল। তার ক্ষিপ্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় ফকীরসাহেব মন্ত্রোচ্চারণ থামিয়ে মুখ খুললাে, “সুর্মা-এ-সুলেমানি প্রস্তুত মুখুজ্জেমশায়।”

    কালীপদ ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠলাে কিন্তু বহিরঙ্গে তার প্রকাশমাত্র নাই। নীচু হয়ে গুরুদেবকে এবং পরম শক্তিমান ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রণতি জানিয়ে একখানি পানের বোঁটায় করে সেই ঘন কৃষ্ণবর্ণ দৈব রসায়ন নিজের চোখের কোণে লেপন করল। ফকীর সাহেবও কিছুটা সুর্মা নিজের চোখে মেখে নিলাে, এবং তার স্পর্শমাত্র একটা তীব্র, ঝাঁঝালাে কটু গন্ধে চোখ জ্বালা করে উঠলাে। খুব ঝাল মরিচকে যেন পিষ্ট করে চোখের তারায় ঘষে দেওয়া হয়েছে এমনই প্রদাহ হতে শুরু করল।

    মহলে অনেক মানুষজন দাঁড়িয়ে রয়েছে ইতস্ততঃ। কালীপদর চোখও  আরক্ত হয়ে রয়েচে জ্বলুনির ফলে। অতি ক্লেশে চক্ষু মেলে কালী নিম্নস্বরে একবার বলে উঠলাে, “কায়েশায়, একবার এইদিকে শুনবেন। সেই কথাটা তাে জোরে বলা যাবে না, কানে কানে বলতে হবে, কারণ রাক্ষসীটা শুনে ফেলতে পারে।”

    কালীপদ তাকে পূর্বেই তালিম দিয়ে রেখেচিলাে কি করতে হবে, কিন্তু তবুও আশঙ্কায় দুরুদুরু চিত্তে কয়েক পা এগিয়ে এল মহানন্দ। কালীপদ নিজের মুখ এগিয়ে তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, “বৈঠৎ”

    মহানন্দ গুণীনের শেখানাে মতােই বিদ্যুতের বেগে মাটিতে নীচু হয়ে বসে পড়লাে আর তার মাথার উপর দিয়ে ক্ষিপ্রবেগে লাফ দিয়ে কালীপদ শূন্যে অদেখা কাউকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে চিৎকার করল, “ফকীরসাহেব…

    ফকীর চোখের পাতা মেলেই ভয়ানক চমকে উঠে দেখলাে তার সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। মহানন্দ মাটিতে উবু হয়ে বসে রয়েছে। তার পিছনে প্রবল আক্রোশে ছটফট করে চলেছে এক হিংস্রদর্শন প্রেতিনীর বীভৎস অবয়ব এবং তাকে বজ্রকঠিন বেষ্টনীতে জাপটে রেখেচে কালীপদ মুখুজ্জে। রাক্ষসীটা অমানুষিক শক্তিতে সেই বাঁধন কাটার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে এও বুঝতে পারছে যে, ‘এ বড়াে কঠিন ঠাই’। তার ভীষণ গর্জনের অভিঘাতে গােটা মহলটা থরথর করে কাঁপচে। সুলেমানি জাদু সুর্মার অমােঘ শক্তিতে সেই অদৃশ্য প্রেতাত্মা তাদের চর্মচক্ষে ধরা পড়ে গিয়েছে। মহলে উপস্থিত বাকি মানুষেরা সেই রক্ত জল করা হুঙ্কারের সঙ্গে সঙ্গে দেখলাে একটা সচল অথচ অদৃশ্য কাকে যেন কালীগুণীন দুই সবল হাতের গ্রন্থিতে আটকে রেখেছে। তারা সভয়ে পিছিয়ে দাঁড়ালাে।

    সেই প্রেতমূর্তি কোনওভাবেই মুক্তিলাভ করতে না পেরে এইবার হিচড়ে হিচড়ে এগােতে শুরু করল মহলের কোণায় স্থাপিত বিরাট বেলুচি আয়নাটার দিকে। কালীপদ আর সেই অদেখা অশরীরীর সঙ্গে শক্তিতে এঁটে উঠচে না। শয়তান পদে পদে তাকে ছাড়াবার চেষ্টা করচে। এইবার কালীপদকে সামান্য শ্রান্ত হতে দেখে সেই অপদেবতা শেষ একটা প্রবল ঝাড়া দেবার জন্য তৈরি হচ্ছে, এমন সময় অনেকটা অনুমানের ভিত্তিতেই অবস্থান নির্ণয়ের মতাে করে সেই প্রেতিনীর একখানি অদৃশ্য হাত সজোরে চেপে ধরলাে কানাই সর্দার। সেই মুগুরের মতাে গুরুভার হাত যখন রাক্ষসীটাকে অবলীলায় চেপে ধরে রেখেছে, তখন কালীপদ ফকীরকে হাঁক দিয়ে বললে,

    “আঁশবটি”।

    ফকীর অপেক্ষায় ছিল। তৎক্ষণাৎ দৌড়ে এসে ঝকঝকে বঁটিখানা তুলে দিলাে গুণীনের হাতে, আর কালীর এক কোপে সেই প্রেমূর্তির দীর্ঘ শ্যাওলা রঙের চুলের গােছা সমূলে ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। এতক্ষণের ভয় দেখানাে গর্জনটা এইবার বুকফাটা আর্তনাদে পরিণত হলাে। সে ভয়ংকর কান্নার শব্দ ভাষায় লিখে বােঝানাে যায় না। সেই ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদা শয়তানী মায়া স্বর কেবলমাত্র কানে শুনলেও হৃদযন্ত্র ধড়াস করে ওঠে। গলা শুকিয়ে যায়। ভয়াবহ কোনও একটা ক্ষতি হতে চলেছে, এমন একটা মনােভাব আসে, শরীর অবসন্ন হয়। এইবারে কালীপদ আর কানাই হাতের আগল সামান্য দুর্বল করতেই সেই প্রেমূর্তি এক লাফে আয়নার ভিতরে প্রবেশ করে কোনও গহীন রাজ্যে হারিয়ে গেল। কালীপদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাতের ভারী আঁশবঁটিটা সবেগে নিক্ষেপ করল আয়নার দিকে। মহা মূল্যবান দর্পণ সহস্র খণ্ডে বিক্ষিপ্ত হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লাে।

    **********

    কালীগুণীনের আদেশে সকলে মিলে সেই কাচের টুকরােগুলি দুইখানা আলাদা আলাদা থলিতে পূর্ণ করে সেইগুলি তার পায়ের কাছে রাখলাে। কৌচের উপরে কালীপদ, ফকীরবাবা আর মহানন্দ বসে রয়েছে এবং বাকিরা পুরু গালিচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে। প্রত্যেকের হৃদয় আনন্দ এবং উচ্ছ্বাসে পূর্ণ। অবশেষে সেই নরহন্তা বুভুক্ষু রাক্ষসীর বিনাশ হয়েছে। আর কেউ এই ভদ্রাসনে তার হাতে অপঘাতে মরবে না। মহানন্দ বিস্মিত এবং সন্তষ্ট চিত্তে বললাে, “ঠাকুর, আমি দেবতা চোখে দেখিনি, তবে আপনাকে দেখে আজ সেই অভাব পূর্ণ হলাে। দাদা লোেক চিনতেন। তাই চূড়ান্ত আপদকালে তিনি আপনার শরণেই এসেছিলেন। কিন্তু আপনি এই রাক্ষসীকে ধরলেন কেমন ভাবে?”

    কালীপদ একচিলতে হেসে উত্তর করল, “প্রথম যেটা আমার জানার ছিল তা হলাে শয়তানটার বাসস্থান। এত বিশাল মহলের কোন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোণে যে সে আস্তানা গেড়ে বসে রয়েছে তা খোঁজা বড়াে দুরূহ। তবে সে যে এই দো-মহলারই কোথাও নিশ্চিতরূপে রয়েছে তা বুঝেছিলাম আগেই, কারণ একমাত্র এই মহলেই তাে পদ্মগুণীন এসে আপনাকে তার যজ্ঞের সংকল্প হতে বলেছিলাে। সে কথা ওই অশরীরী দিনেদুপুরে শুনলাে কেমন করে? তার মানে সে এই মহলেই বাস করে। আপনাদের ঐ কুকুরটার মৃত্যুর অকুস্থলও সেটাই প্রমাণ করে। কিন্তু প্রশ্ন হলাে এতবড়াে মহলটার কোথায়। খুঁজবাে? অনুমানের উপরে আতিপাতি করে খোঁজা সম্ভব নয়, কারণ হতভাগী রাক্ষসীটা একবার জানতে পারলেই স্থান বদলে ফেলবে।

    তারপর ধরুন সুলতার প্রেতটি তাে জীবানন্দ মশায় এবং আপনি, দুজনকে পাশাপাশি একসাথেই ঘরে দেখেচিলাে, তাই আপনার দাদাকে কিন্তু সে আপনি ভেবেই ভূল করে মােটেই হত্যা করেনি, বরং যেন অনেকটা দুজনকেই পর পর মেপে নিয়ে একেবারে চিহ্নিত করেই একজনকে হনন করেছে। লছমি নিজের চোখে দেখেচে, সেই ছায়া প্রথমে আপনার কক্ষে এবং পরে জীবানন্দের ঘরে প্রবেশ করেছিলাে। কিন্তু কেন? যে মানুষটা গুণীনকে আহ্বান করেচে, গুণীনের যজ্ঞের সংকল্প হবে বলে স্থির করেছে, তাকে পেয়েও ছেড়ে দিয়ে, পরে নির্দোষকে হত্যা করল কেন সে?

    রঙ্গলাল বলেচে সে নাকি প্রথমে পদ্মগুণীনের শােবার ঘরের বিপরীত ঘরটিতে আগে দেখেচিলাে যে শয়তানটা কিছু খুঁজে চলেচে। পরে সে আসে পদ্মর কক্ষে। কেন? সে তাে পদ্ম ঘরে ঢােকার সময়েও দেখেচিলাে নিশ্চয়ই।

    আমার প্রথম থেকেই একটা খটকা লাগচিললাে, তবে যথার্থ কারণটা ধরতে পারছিলাম না। শয়তানীটার কার্যকলাপে কি যেন একটা গলদ রয়েছে। কোথাও একটা ফাঁক রয়েছে। সেদিন ছাতে বসে আপনার নায়েব না কার নাতি, ঐ যে রঙ্গলাল বলে বাচ্চা ছেলেটি, ওর সাথে আলাপ করছিলাম। সে কথায় কথায় আমার কাছে চাঁদ সওদাগরের গল্পটা জানতে চেয়েছিলাে। সেইটা বলতে গিয়েই ঐ প্রেতিনীটার সব জারিজুরি আমার কাছে সব ধরা পড়ে গেল।

    মনসার ছলে অতিষ্ঠ হয়ে চন্দ্ৰধর অবশেষে তার পূজা দেবে বলে স্বীকার করে ঠিকই, কিন্তু বাম হাতে। সেই নিয়মেই আজও পূজা হয়ে আসছে। তাে পদ্মগুণীনও নিশ্চয়ই বাম হস্তেই পুস্পার্ঘ্য নিবেদন করেছিলাে। তবে তার ডান হাতে আক্রমণ হলাে কেন?

    এইবারে সেই মনের অবচেতনে হাতড়ানাে সূত্রটা আমার হাতে এল। সুলতার প্রতিহিংসাপরায়ণ প্রেতাত্মা বারে বারেই এই ভুলটা করেছে। আপনার আর জীবানন্দের মধ্যে চিহ্নিতকরণের একটিই উপায় ছিল। গালের এই লাল জডুলটা। সেক্ষেত্রেও এই ভুল হয়েছে। পদ্মগুণীনের যজ্ঞসামগ্রী তছনছ করার সময়ও সে প্রথমে ঘর ভুল করেছে, আবার গুণীনের হাতে আক্রমণের সময়েও একই ভুল করেছে। যেমন তেমন ভুল নয় কায়েত্মশায়, বরং প্রতিবারই সে সম্পূর্ণ উল্টো দেখেচে। ডান বাম গুলিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এর কারণ কি?

    একটাই কারণ। সে নিশ্চয়ই কোনও আয়নার ভিতর দিয়ে সব ঘটনা আড়ি পেতে দেখেচে, ফলে প্রতিচ্ছবিতে বারবারই তার এই ভ্রান্তিটা হয়েছে। এছাড়া অন্য কিচ্ছুটি হতে পারে না। আয়নায় বাস করা প্রেত বড়াে ভয়ানক প্রেত হয় কায়েৎমশায়। এক লক্ষ প্রেতাত্মার মধ্যে একটি ‘ধূমল’ প্রেত জন্মায়। এদের বাসস্থান হয় প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারে এমন স্বচ্ছ কোনও দ্রব্য। জল, দর্পণ, তেল, ধাতু, হীরা প্রভৃতি দ্রব্য এদের পছন্দ। এদের গায়ের একটা অদ্ভুত আঘ্রাণ থাকে। অতি প্রাচীন জমা বাতাসের মতাে গন্ধ। যে গন্ধ আপনার দ্বারবান পেয়েছিলাে এবং অবশ হয়ে পড়েছিলাে।

    এইটুকু নিশ্চিত হবার পরে শুধু দরকার ছিলাে সুলতাকে স্বেচ্ছায় আমার সামনে ডেকে আনা। আমি ইচ্ছে করেই এই মহলে ঢুকে সতর্কতার সঙ্গে আপনাকে বললুম যে রাতে আপনার কানে কানে একটা কথা কইবাে। আমি জানতুম রাক্ষসীটা সেই কথা শােনার জন্য একেবারে আপনার কাছাকাছি এসে ঘাপটি মারবেই। ধন্য ফকীর সাহেবের বিদ্যে। সুলেমানি সুর্মার জাদুতে অশরীরী আমাদের চোখে প্রকট হলাে। প্রেতিনীদের শক্তি সঞ্চিত রয় তাদের জটিল বিনুনিতে। সেই কেশ কাটা যায় একমাত্র এমন কোনও অস্ত্রে, যা বহু প্রাণীর রক্ত পান করেছে। কেশরাশি খণ্ডিত করা মাত্র বিপাকে পড়ে তখন তাকে তার নিরাপদ ঘাঁটিতেই ফিরে যেতে হলাে, আর ফেরৎ যাওয়া মাত্র আমি তার আসার পথ বন্ধ করে দিলুম।

    এখন বহু বৎসর এই ‘মায়া কেশ’ না থাকার কারণে সে দুর্বল হয়ে থাকবে, কিন্তু শক্তি ফেরৎ পাওয়া মাত্তর সে চেষ্টা করবে কাচের টুকরােগুলিকে জোড়া লাগিয়ে ইহলােকে আবার পদার্পণ করার। এই খণ্ডগুলিকে লােকচক্ষুর আড়ালে এমন স্থানে নিক্ষেপ করতে হবে, যাতে কারুর দ্বারা তা জোড়া লাগার ভয় না থাকে।”

    **********

    পুরকায়েৎ বাড়ি থেকে বিদায় নেবার পর কালীপদ, কানাই এবং ফকীরবাবা সােজা চলে গেল কলকাতা শহরের প্রাচীন একটা প্রান্তরে। সেইভেনে কালীঘাটের মা ভবাণীর মন্দিরে পূজার্চনা করে কালীপদ এসে দাঁড়ালাে শহরের অন্য একটি স্থানে। আমাদের পৃথিবী যখন সবে গঠিত হয়, তখন এই কলকাতা শহরের আদি ভূখণ্ড থেকে সােজা ময়মনসিংহের ভূখণ্ড অবধি মাটির তলে একখানি প্রকাণ্ড চ্যুতি বা ফাটল তৈরি হয়েছিলাে। কালীপদ মন্তর পড়ে কাচের টুকরােগুলি সেই অতি প্রাচীন ফাটলে প্রতিস্থাপন করে সজোরে ফু দিলাে। মন্ত্রের আঘাতে কাচের খণ্ডগুলি শহর কলকাতা হতে সেই সুদূর মায়ানমার অবধি ছড়িয়ে পড়লাে।

    তােমরা আজও অনায়াসে সেই ফাটলের অস্তিত্ব যাচাই করতে পারাে। ভূত্বকের থেকে অনেক অনেক নীচে সর্বগ্রাসী হাঁ করে সে ফাটল আজও তাকিয়ে রয়েছে। সেই প্রেতিনীর শক্তি বহুকাল হলাে ফিরে এসেছে। আজও যখন পৃথিবী কখনও ভূকম্পনের দাপটে নড়েচড়ে ওঠে, তখন ঐ শয়তানী প্রাণপণ চেষ্টা করে কাচের টুকরােগুলিকে মায়াবলে কাছাকাছি নিয়ে আসার, কিন্তু কলকাতার রক্ষয়িত্রী দেবী কালীকার অপার মহিমা এবং রায়দীঘড়ার মহাতেজস্বী এক গুণীনের মন্ত্রের অক্ষয় তেজ আজও হােগলামারির সেই হিংস্র নরঘাতিনীর অপচেষ্টা সফল হতে দেয়নি।

    -: সমাপ্ত :—

    টীকা