সরাইখানার গোলমাল আসে কানে,
    ঘরের সার্সি বাজে তাহাদের গানে,
    পর্দা যে উড়ে যায়
    তাদের হাসির ঝড়ের আঘাতে হায়!
    -মদের পাত্র গিয়েছে কবে যে ভেঙে!
    আজও মন ওঠে রেঙে
    দিলদারদের দরাজ গলায় রবে,
    সরায়ের উৎসবে!
    কোন্‌ কিশোরীর চুড়ির মতন হায়
    পেয়ালা তাদের থেকে থেকে বেজে যায়
    বেহুঁশ হাওয়ার বুকে!
    সারা জনমের শুষে-নেওয়া খুন নেচে ওঠে মোর মুখে!
    পান্ডুর দুটি ঠোঁটে
    ডালিম ফুলের রক্তিম আভা চকিতে আবার ফোটে!
    মনের ফলকে জ্বলিছে তাদের হাসি ভরা লাল গাল,
    ভুলে গেছে তারা এই জীবনের যত কিছু জঞ্জাল!
    আখেরের ভয় ভুলে
    দিলওয়ার প্রাণ খুলে
    জীবন-রবাবে টানিছে ক্ষিপ্ত ছড়ি!
    অদূরে আকাশে মধুমালতীর পাপড়ি পড়িছে ঝরি-
    নিভিছে দিনের আলো
    জীবন মরণ দুয়ারে আমার করে যে বাসিব ভালো
    একা একা তাই ভাবিয়া মরিছে মন!
    পূর্ণ হয় নি পিপাসী প্রাণের একটি আকিঞ্চন,
    নি একটি দল,-
    যৌবন শতদলে মোর হায় ফোটে নাই পরিমল!
    উৎসব-লোভী অলি
    আসে নি হেথায়
    কীটের আঘাতে শুকায়ে গিয়েছে কবে কামনার কলি!
    সারাটি জীবন বাতায়নখানি খুলে
    তাকায়ে দেখেছি নগরী-মরুতে ক্যারাভেন্‌ যায় দুলে
    আশা-নিরাশার বালু-পারাবার বেয়ে,
    সুদূর মরুদ্যানের পানেতে চেয়ে!
    সুখদুঃখের দোদুল ঢেউঢের তালে
    নেচেছে তাহারা- মায়াবীর জাদুজালে
    মাতিয়া গিয়েছে খেয়ালী মেজাজ খুলি,
    মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
    মৃগতৃষ্ণার মদের নেশায় ভুলি!
    মস্তানা সেজে ভেঙে গেছ ঘরদোর,
    লোহার শিকের আড়ালে জীবন লুটায়ে কেঁদেছে মোর!
    কারার ধুলায় লুন্ঠিত হ’য়ে বান্দার মতো হায়
    কেঁদেছে বুকের বেদুঈন মোর দুরাশার পিপাসায়!
    জীবনপথের তাতার দুস্যুগুলি
    হুল্লোড় তুলি উড়ায়ে গিয়েছে ধূলি
    মোর গবাক্ষে কবে!
    কন্ঠ-বাজের আওয়াজ তাদের বেজেছে স্তব্ধ নভে!
    আতুর নিদ্রা চকিতে গিয়েছে ভেঙে,
    সারাটি নিশীথ খুন রোশনাই প্রদীপে মনটি রেঙে
    একাকী রয়েছি বসি,
    নিরালা গগনে কখন নিভেছে শশী
    পাই নি যে তাহা টের!
    -দূর দিগনে- চ’লে গেছে কোথা খুশরোজী মুসাফের!
    কোন্‌ সুদুরের তুরাণী-প্রিয়ার তরে,
    বুকের ডাকাত আজিও আমার জিঞ্জিরে কেঁদে মরে!
    দীর্ঘ দিবস ব’য়ে গেছে যারা হাসি-অশ্রুর বোঝা
    চাঁদের আলোকে ভেঙেছে তাদের “রোজা”
    আমার গগনে ঈদরাত কভু দেয় নি হায় দেখা,
    পরানে কখনও জাগে নি রোজা’র ঠেকা!
    কী যে মিঠা এই সুখের দুখের ফেনিল জীবনখানা!
    এই যে নিষেধ, এই যে বিধান-আইনকানুন, এই যে শাসন মানা,
    ঘরদোর ভাঙা তুমুল প্রলয়ধ্বনি
    নিত্য গগনে এই যে উঠিছে রণি
    যুবানবীনের নটনর্তন তালে,
    ভাঙনের গান এই যে বাজিছে দেশে দেশে কালে কালে,
    এই যে তৃষ্ণা-দৈন্য-দুরাশা-জয়-সংগ্রাম-ভুল
    সফেন সুরার ঝাঝের মতন ক’রে দেয় মজ্‌গুল
    দিওয়ানা প্রাণের নেশা!
    ভগবান, ভগবান, তুমি যুগ যুগ থেকে ধ’রেছ শুড়ির পেশা!
    -লাখো জীবনের শূণ্য পেয়ালা ভরি দিয়া বারবার
    জীবন-পান্থশালার দেয়ালে তুলিতেছে ঝঙ্কার-
    মাতালের চিৎকার
    অনাদি কালের থেকে;
    মরণশিয়ারে মাথা পেতে তার দস্তুর যাই দেখে!
    হেরিলাম দূরে বালুকার পরে রূপার তাবিজ প্রায়
    জীবনের নদী কলরোলে ব’য়ে যায়!
    কোটি শুঁড় দিয়ে দুখের মরুভ নিতেছে তাহারে শুষে,
    ছলা-মরীচিকা জ্বলিতেছে তার প্রাণের খেয়াল-খুশে!
    মরণ-সাহারা আসি
    নিতে চায় তারে গ্রাসি!-
    তবু সে হয় না হারা
    ব্যথার রুধিরধারা
    জীবনমদের পাত্র জুড়িয়া তার
    যুগ যুগ ধরি অপরূপ সুরা গড়িছে মশালাদার!

    টীকা