য়োরিন্ডা আর য়োরিঙ্গেল
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারায়োরিণ্ডা আর য়োরিঙ্গেল
প্রকাণ্ড গভীর এক বনের মধ্যে ছিল এক পুরোনো প্রাসাদ। তার মধ্যে থাকত এক বুড়ি—একলা। সে ছিল ডাইনি। দিনের বেলা সে বেড়াল কিংবা পেঁচার রূপ নিত কিন্তু প্রতি রাত্রে সে আবার মানুষ হয়ে যেত। এমনি করে সে বুনো জন্তু ও পাখিদের ভুলিয়ে এনে ধরে মেরে সিদ্ধ করে খেত। প্রাসাদের একশো পায়ের সীমানার মধ্যে যদি কোন মানুষ এসে পড়ত সে আটকে যেত মাটিতে। যতক্ষণ না ডাইনি ছেড়ে দেবার মন্ত্র পড়ত ততক্ষণ পর্যন্ত সে নড়তে পারত না। কিন্তু যদি কোনো ভালোমানুষ মেয়ে সেই প্রাসাদের কাছে এসে পড়ত তাহলে ডাইনি তাকে পাখি বানিয়ে খাঁচায় পুরে রেখে দিত। তারপর সেই খাঁচা টাঙিয়ে রেখে দিত প্রাসাদের এক ঘরে। ডাইনির বাড়িতে এমনি হাজার হাজার খাঁচা ছিল—তাদের মধ্যে সুন্দর সুন্দর পাখি।
সেই সময় ছিল একটি মেয়ে য়োরিণ্ডা—সে ছিল পৃথিবীর সব মেয়ের চেয়ে সুন্দরী। তার সঙ্গে বিয়ে হবার কথা ঠিক হয়ে গিয়েছিল একটি খুব সুন্দর ছেলের—তার নাম য়োরিঙ্গেল। বিয়ের আগে তারা দুজনে একসঙ্গে বেড়িয়ে বেড়াত—ভারি ভালো লাগত তাদের। একদিন বেড়াতে বেড়াতে তারা বনের মধ্যে গভীরে গিয়ে পড়েছিল। য়োরিঙ্গেল বললে—সাবধান য়োরিণ্ডা, প্রাসাদটার বেশী কাছে না যাওয়াই ভাল।
ভারি মনোহর সন্ধ্যা। ঘন সবুজ বনের গাছের গুঁড়ির মধ্যে দিয়ে সূর্যকিরণ নেচে বেড়াচ্ছে। বুড়ো বীচ গাছের মধ্যে থেকে করুণ সুরে ডেকে চলেছে ঘুঘু। য়োরিণ্ডা পড়ন্ত রোদে বসে, কেন জানে না, কাঁদতে সুরু করে দিলে। তাই দেখে য়োরিঙ্গেলও চোখের জল ফেলে মনের দুঃখ উজাড় করে দিতে থাকল। তাদের এত দুঃখ হল যে তাদের মনে হল তারা মরতে চলেছে। চারিদিকে তাকিয়ে তারা দেখল যে তাদের পথ হারিয়ে গেছে। কেমন করে যে বাড়ি ফেরা যায় তা আর তারা বুঝতে পারল না। সূর্যের আধখানা তখনও পাহাড়ের উপরে ছিল। বাকি আধখানা অস্ত গেছে।
য়োরিঙ্গেল ঝোপের মধ্যে থেকে উঁকি মেরে দেখল প্রাসাদের প্রাচীন দেয়াল খুব কাছেই। দেখে ভারি ভয় পেয়ে গেল সে। মড়ার মতো সাদা হয়ে গেল তার মুখ।
য়োরিণ্ডা তখন গাইছিল—
লাল ঝুঁটি পরে গায় যে আমার পাখি
দুঃখের গাথা করুণ সুরেতে ডাকি।
মরিয়া যাইলে আমার পরাণ সখা
কাঁদিবে যে কত ভেবে মোর কথা—চিক্ চিক্!
য়োরিঙ্গেল য়োরিণ্ডার দিকে তাকালো। কিন্তু সে ততক্ষণে রাত-বুলবুলি হয়ে গিয়ে ‘চিক্চিক্’ শব্দে গান গাইছে। কোথা থেকে একটা জ্বলজ্বলে চোখ-ওয়ালা প্যাঁচা এসে তার চারিদিকে তিন পাক ঘুরল আর বলল—শূ-হূ-হূ। য়োরিঙ্গেল দেখল সে আর নড়তে পারছে না। পাথরের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে—হাত নাড়াবার পা নাড়াবার উপায় নেই, কথা কইতে বা চেঁচাতেও পারছে না।
সূর্য ততক্ষণে ডুবে গেছে। প্যাঁচাটা একটা ঝোপের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গেই ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল এক কুঁজো বুড়ি—গায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে; হলদে তার রং। বড় বড় রক্তবর্ণ চোখ, ধনুকের মতো বাঁকা নাক থুঁতনি পর্যন্ত নোয়ানো। বিড় বিড় করে কি একটা বলে রাত-বুলবুলিটাকে খপ করে ধরে নিয়ে চলে গেল। য়োরিঙ্গেল নড়তেও পারল না, একটি কথাও বলতে পারল না; বুলবুলি গেল চলে।
অনেকক্ষণ পরে বুড়ি ফিরে এল। তারপর ঘ্যানঘ্যানানি সুরে বলল—প্রণাম জানাই জাখিয়েল! খাঁচার উপর যখন চাঁদের আলো পড়বে তখন বন্দীকে খুলে দিও জাখিয়েল!
বলতেই য়োরিঙ্গেল দেখল সে ছাড়া পেয়েছে। ডাইনি বুড়ির সামনে সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। হাত জোড় করে বলল য়োরিণ্ডাকে ফিরিয়ে দিতে। ডাইনি বললে—য়োরিণ্ডাকে তুমি আর কোনোদিন ফিরে পাবে না। বলে চলে গেল। য়োরিঙ্গেল কত কাঁদল, কত কাকুতি-মিনতি করল কিন্তু সবই বৃথা। য়োরিঙ্গেল বললে—হায় আমার কি হবে ?
শেষে সে সেখান থেকে চলে গিয়ে এক অজানা গ্রামে পৌঁছল। সেখানে রাখাল হয়ে রইল সে অনেকদিন। প্রায়ই সে প্রাসাদের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখত কিন্তু কখনও বেশী কাছে আসত না। তারপর এক রাতে সে স্বপ্ন দেখল যে সে একটি রক্তরাঙ্গা ফুল পেয়েছে যার মাঝখানে মস্ত বড় সুন্দর একটি মুক্তো। সে ফুলটি তুলে প্রাসাদে নিয়ে গেল। সেই ফুল দিয়ে সে যা ছোঁয় তারই মায়া কেটে যায়। শেষে সে স্বপ্নে দেখল যে এমনি করে সে তার য়োরিণ্ডাকে মুক্ত করলে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে সে পর্বত উপত্যকা সর্বত্র খুঁজে বেড়াতে লাগল, কোথায় পাওয়া যায় ঠিক সেই রকম একটি ফুল। ন’ দিন ধরে সে খুঁজল। ন’ দিনের দিন ভোর বেলা সে খুঁজে পেল ফুলটি। ফুলের মাঝখানে একটি মস্ত শিশির বিন্দু, প্রকাণ্ড এক মুক্তোর মত। এই ফুলটি নিয়ে সে না-থেমে দিন রাত চলে শেষে প্রাসাদের কাছে এসে হাজির হল। এবারে প্রাসাদের কাছে এক-শ পায়ের মধ্যে এসে পড়তেও সে অচল হয়ে গেল না। সোজা চলে গেল সে দরজা অবধি।
য়োরিঙ্গেলের আনন্দ আর ধরে না। দরজায় ফুল ছোঁয়াতেই দরজা খুলে গেল। উঠোনের মধ্যে গিয়ে সে খুঁজতে লাগল পাখির শব্দ কোন দিকে শোনা যায়। অবশেষে সে এক হল্-এ এসে উপস্থিত হল; সেখানে ডাইনি দাঁড়িয়ে সাত হাজার খাঁচার পাখিকে খাওয়াচ্ছিল। য়োরিঙ্গেলকে দেখে সে চটে গেল, ভীষণ চটে গেল। তাকে গালাগালি দিতে লাগল, থুতু ছিটতে লাগল তার দিকে, থুতুর সঙ্গে বিষ; য়োরিঙ্গেল কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে খাঁচার মধ্যে তার পাখিকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। কত শত রাত-বুলবুলি সেখানে রয়েছে, তার মধ্যে কেমন করে সে য়োরিণ্ডাকে পাবে?
সে যখন চারিদিকে খুঁজছে, হঠাৎ দেখতে পেল যে বুড়ি চুপিচুপি একটা খাঁচা সুদ্ধ পাখি সরিয়ে দরজার দিকে পালাচ্ছে। য়োরিঙ্গেল এক লাফে বুড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ফুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল খাঁচাটা আর বুড়িকে। সঙ্গে সঙ্গে বুড়ির সব জারিজুরি শেষ হয়ে গেল। দেখা গেল য়োরিণ্ডা সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে—আগেরই মতো সুন্দরী। য়োরিণ্ডা য়োরিঙ্গেলের গলা জড়িয়ে ধরল।
তারপর য়োরিঙ্গেল সব পাখিকে আবার কুমারী-মেয়ে করে দিল। তারপর য়োরিণ্ডার সঙ্গে বাড়ি ফিরে গিয়ে তাকে বিয়ে করে বহু কাল সুখে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিলে।