Chapter Index

    একটি গরিব লোকের বারোটি ছেলেমেয়ে ছিল। এই এতগুলি ছেলেমেয়ের মুখের ভাত জোগাবার জন্যে তাকে সারাদিন সারারাত খাটতে হত। এর উপর তার যখন আরও একটি ছেলে হল তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। কী যে করবে ভেবে পেল না। সে দৌড়ে বড়রাস্তার উপরে হাঁটতে শুরু করলে। ভাবলে প্রথমেই যার সঙ্গে দেখা হবে তাকেই বলবে তার ছেলের ধর্মবাপ হতে।

    প্রথমেই তার দেখা হল স্বয়ং ভগবানের সঙ্গে। ভগবান মানুষের বেশে রাস্তা দিয়ে আসছিলেন। গরিব লোকটির মনে যে কি হচ্ছে তা ভগবান সবই জানতেন। তিনি বললেন— শোনো ভাই, তোমায় দেখে মায়া হয়। তোমার ছেলের নামকরণের সময় আমি তার ধর্মবাপ হব। আমি তার ভার নিয়ে তাকে জীবনে সুখী করব।

    লোকটি বলল— তুমি কে?

    —আমি ঈশ্বর।

    —তাহলে আপনাকে আমি আমার ছেলের ধর্মবাপ করব না। আপনি বড়লোকদের সব কিছু দেন। গরিবদের দিকে ফিরেও তাকান না।

    এইভাবে সে ঈশ্বরের মুখের উপর জবাব দিল। সে জানতোই না ভগবান কত যত্নে সকলের মধ্যে ধন এবং দারিদ্র্য বণ্টন করে দেন। সে ভগবানের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের পথে চললো।

    তারপর শয়তান এসে তাকে বলল— তুমি কাকে খুঁজছ? আমাকে যদি তুমি তোমার ছেলের ধর্মবাপ করো আমি তাকে এত সোনা দেব, এত ফূর্তির ফোয়ারা দেব যে সারা জীবনে ভোগ করে সে তা শেষ করে উঠতে পারবে না।

    লোকটি জিজ্ঞেস করল— আপনি কে বটেন?

    —আমি শয়তান।

    —তাহলে আপনাকে আমার ছেলের ধর্মবাপ করতে চাই না। আপনি লোকেদের ঠকিয়ে তাদের বিপথে নিয়ে যান।

    এই বলে লোকটি এগিয়ে চলল।

    কিছুদূর যাবার পর যমরাজের সঙ্গে দেখা।

    শুকনো কাঠির মত পা ফেলে ফেলে যমরাজ এগিয়ে এসে বললেন— আমাকে ধর্মবাপ কর।

    লোকটি জিজ্ঞেস করল— কে তুমি?

    —আমি যম। সবাইকে আমি সমান করে দিই।

    —তবে তো আসল ব্যক্তি পেয়েছি। আপনি কোনো বাছবিচার না করে ধনীকেও যেমন নেন, গরিবকেও তেমনি। আপনিই আমার ছেলের ধর্মবাপ হোন।

    যম বললেন— তোমার ছেলেকে আমি ধন দেব খ্যাতি দেব। আমি যার বন্ধু হই তার কোনো কিছুরই অভাব থাকে না।

    লোকটি বলল— সামনের রবিবার নামকরণ। ঠিক সময় তাহলে আসবেন।

    যম এলেন। এসে লোকে যেমন ধর্মবাপ হয় ঠিক তেমনি তিনিও হলেন।

    ছেলেটি যখন বড় হল, ধর্মবাপ একদিন এসে তাকে ডাকলেন— এসো আমার সঙ্গে। বলে তাকে এক বনের মধ্যে নিয়ে গিয়ে একটি ওষধি দিয়ে বললেন— তোমার ধর্মবাপ তোমায় যে উপহার দিচ্ছেন তা গ্রহণ কর। তুমি হবে বিখ্যাত চিকিৎসক। দেশ জোড়া তোমার নাম হবে। রুগীর কাছে যখন লোকে তোমায় ডাকবে, আমি সব সময় সেখানে উপস্থিত থাকব। যদি দেখ রোগীর মাথার কাছে আমি দাঁড়িয়ে তাহলে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো যে রোগীকে তুমি সারাতে পারবে। এই ওষধি বেটে খাইয়ে দিলেই সে সেরে উঠবে। কিন্তু যদি দেখ আমি রোগীর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে আছি, বুঝবে তার আর কোনো আশা নেই। তখন বলে দিও দুনিয়ার কোনো কবিরাজ তাকে সুস্থ করতে পারবে না। কিন্তু সাবধান, আমি যেমন চাইলুম ঠিক সেই ভাবেই এই ওষধি ব্যবহার করবে। এর উল্টো করলে নিজেই বিপদে পড়বে।

    কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসক হয়ে গেল। লোকে তার সম্বন্ধে বলতে লাগল— উনি শুধু একবার রোগীর দিকে তাকাবেন্‌। বাস্‌ আর কিছু করতে হবে না। ঠিক বুঝে যাবেন রোগী বাঁচবে কি মরবে। দূর দূরান্তর থেকে তার কাছে লোক আসতে থাকল, তাকে ডেকে পাঠাতে লাগল আর তাকে এত টাকা দিতে লাগল যে বড়লোক হতে তার দেরি হল না।

    এখন হল কি দেশের রাজা একবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসকের ডাক পড়ল। চিকিৎসক এসে দেখলেন রাজার পায়ের কাছে স্বয়ং যম দাঁড়িয়ে। বুঝলেন কোনো ওষধিতেই তাঁর কিছু হবে না।

    চিকিৎসক ভাবলে— একবার যমরাজকে একটু সামান্য একটু ঠকিয়ে দেখি না। হয়তো খানিক রাগ করবেন। তা হলেও আমি তো ওঁর ধর্মছেলে, আমায় নিশ্চয় ক্ষমা করবেন। দেখি বরং ঝুঁকিটা নিয়ে।

    ভেবে সে রোগীকে তুলে যেদিকে মাথা ছিল সেইদিকে পা করে শুইয়ে দিল। এখন যম রোগীর মাথার কাছে রইলেন। সে তখন রাজাকে ওষধি বেটে খাইয়ে দিতেই রাজা সুস্থ হয়ে উঠে বসলেন।

    যমরাজ রাগে মুখ কালো করে এসে বললেন— আমার আজ্ঞা তুমি লঙ্ঘন করেছ। নেহাত তুমি আমার ধর্মছেলে তাই এবারকার মতো ক্ষমা করলুম। কিন্তু এর পর আবার যদি এইরকম ঘটে তো তোমার ঘাড় মটকে তোমাকেই নিয়ে চলে যাবো।

    এর কয়েকদিন পরেই রাজকন্যা এক কঠিন অসুখে পড়লেন। এইটিই রাজার একমাত্র সন্তান। তাই রাজা দিন রাত চোখের জল ফেলতে থাকলেন। তাঁর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এল। রাজা ঘোষণা করে দিলেন যে তাঁর কন্যাকে সুস্থ করে তুলতে পারবে তার সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন, সেই সঙ্গে তাঁর রাজ্য।

    চিকিৎসক রাজকন্যাকে দেখতে এসে দেখল যমরাজ তার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। রাজকন্যার রূপ দেখে সে তার ধর্মবাপের আজ্ঞা, তাঁর সতর্কবাণী সব ভুলে গেল। রাজকন্যাকে পাবার লোভে তার কিছুই মনে রইল না। যমরাজের রাগতঃ মুখের দিকে দৃষ্টিপাত না করেই সে রোগীকে কোলে করে যেদিকে তার মাথা ছিল সেইদিকে পা করে শুইয়ে দিল। তার পরে তাকে ওষধি বাটা খাইয়ে দিতেই রাজকন্যার রক্তশূন্য মুখে লাল আভা দেখা দিল। রাজকন্যার দেহে জীবনের লক্ষণ দেখা দিল।

    যম যখন দেখলেন দ্বিতীয়বার তাঁর কথা অমান্য করা হয়েছে, তিনি যাকে যাকে দাবী করেছিলেন দু’দুবার তাঁর হাত থেকে তাদের ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, তখন গম্ভীর ভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে বললেন— তোমার আর রক্ষা নেই। এবার তোমার পালা।

    বলে শক্ত হাতে তাকে চেপে ধরে নিয়ে গেলেন পৃথিবীর পেটের মধ্যে এক গুহার ভিতরে। সেখানে পৌঁছে সে দেখল সারির পর সারি হাজারে হাজারে মোমবাতি জ্বলছে। কোনোটা বড়, কোনোটা মাঝারি, কোনটা ছোট। প্রতি মুহূর্তেই কতকগুলো নিভে যাচ্ছে, কোনো কোনোটা জ্বলে উঠছে। দেখে মনে হয় মোমবাতির শিখাগুলি সারা গুহাময় নেচে বেড়াচ্ছে।

    যম বললেন— দেখ এগুলি হচ্ছে মানুষের জীবনদীপ। সবচেয়ে বড়গুলি শিশুদের, মাঝারিগুলি মাঝবয়সী লোকেদের আর ছোটগুলি বুড়োদের। তবে কখনও কখনও শিশুদের বা বালকদেরও ছোট মোমবাতি হয়।

    চিকিৎসক বললে— আমার জীবনদীপটি দেখান তো।

    সে ভেবেছিল একটা লম্বা মোমবাতি হবে।

    যম আঙুল দিয়ে দেখালেন ছোট্ট একটি মোমবাতির শেষ অংশ নিভু নিভু হয়ে এসেছে।

    —ঐ দেখ, ঐ তোমার জীবন।

    চিকিৎসক ভয় পেয়ে বললে— ধৰ্মবাপ, আমার জন্যে বড় একটা মোমবাতি জ্বেলে দিন না! আপনি যে আমায় ভালোবাসেন। তাই করুন যাতে আমি জীবন উপভোগ করতে পারি, রাজা হতে পারি, সুন্দরী রাজকন্যার স্বামী হতে পারি।

    যমরাজ বললেন— তা পারি না। একটা মোমবাতি নিভে যাবার পর তবে আর একটা বাতি জ্বালা যায়।

    চিকিৎসক তখন বললেন— তবে পুরোনো বাতিটা একটা নতুন বাতির উপরে রাখুন। তাহলে পুরোনোটা ফুরোতে ফুরোতেই তার শিখায় নতুনটা জ্বলে উঠবে।

    যমরাজ একটু মুচকি হেসে লম্বা একটা বাতি নিয়ে পুরোনো বাতিটা তার উপর বসিয়ে দিলেন। কিন্তু ছোট্ট বাতির টুকরোটা দুবার কেঁপে উঠেই টুপ করে মাটিতে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে নিভে গেল।

    চিকিৎসকেরও নির্জীব দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

    টীকা