সুন্দর কনে আর কালো কনে
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাসুন্দর কনে আর কালো কনে
এক বুড়ি তার মেয়ে আর তার সৎমেয়েকে নিয়ে বনে গিয়েছিল ঘোড়ার ঘাস কেটে আনতে। সেই সময় ভগবান দরিদ্রের ছদ্মবেশে সেইখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন— গ্রামে যাবার পথ কোন দিকে মা লক্ষ্মীরা?
বুড়ি জবাব দিলে— নিজের পথ বাছা নিজে দেখ, আমাদের কেন জ্বালাচ্ছ?
মেয়ে বলল— পথ হারিয়ে ঘুরে মরবার যদি অত ভয় তো একজন পাণ্ডা নিয়ে বেরলেই তো পারতে বাছা।
সৎমেয়ে বললে— এসো ভালমানুষের পো, আমি তোমায় পথ দেখিয়ে দিচ্ছি।
ভগবান তো বুড়ি আর বুড়ির মেয়ের উপর খুব রাগ করলেন। তিনি শাপ দিলেন, ওদের চেহারা কুচ্কুচে কালো হয়ে যাক।
তিনি সৎমেয়ের সঙ্গে হেঁটে চললেন। যখন গ্রামের কাছে পৌঁছলেন ঠাকুর সৎমেয়েকে আশীর্বাদ করে বললেন— তোমায় মা আমি বর দেব। তুমি তিনটি বর চাও।
মেয়েটি বলল— আমি সূর্যের মতো সুন্দর হতে চাই।
অমনি সে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বল আর সুন্দর হয়ে গেল।
—আর চাই একটি থলি যার মধ্যে থেকে আমার টাকা কোনোদিন ফুরোবে না।
ঠাকুর সেটাও তাকে দিলেন। দিয়ে বললেন— শেষ বর চাইবার আগে সবচেয়ে যা প্রিয় সবচেয়ে যা কাম্য তা যেন ভুলো না।
তখন মেয়েটি বলল— আমার তৃতীয় ইচ্ছে— মৃত্যুর পরে আমি যেন অক্ষয় স্বর্গ পাই।
তৃতীয় ইচ্ছা পূর্ণ করে ঠাকুর অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
সৎমা বাড়ি ফিরে দেখল নিজে আর তার মেয়ে কয়লার মতো কালো কুৎসিত হয়ে গেছে। সৎমেয়ে যখন ফিরল তারা দেখল সে দিনের আলোর মতো সুন্দরী হয়ে এসেছে।
দেখে হিংসেয় তারা জ্বলে গেল। সারাক্ষণ ভাবতে লাগল কি করে সৎমেয়ের ক্ষতি করা যায়।
সৎমেয়ের রেজিনার নামে একটি ভাই ছিল, তাকে সে খুব ভালবাসত। মেয়েটি গিয়ে ভাইকে সব কিছু বলে এল।
রেজিনারও তার বোনকে খুব ভালবাসত। তাকে অত সুন্দরী হয়ে যেতে দেখে রেজিনার বলল— দেখ বোন, আমি তোমার একটি ছবি লিখে আমার এখানে রেখে দেব, যাতে যখন খুশি তোমায় দেখতে পাই।
বোন বলল— কিন্তু অন্য কেউ যেন আমার ছবি না দেখে।
ভাই তখন বোনের ছবি লিখতে শুরু করল। ছবি লেখা শেষ হলে নিজের ঘরের এক কোণে টাঙিয়ে রাখল। ভাই থাকত রাজপ্রাসাদের এক অংশে। সে ছিল রাজবাড়ির ঘোড়ার গাড়ির কোচুয়ান। প্রত্যেক দিন সে কিছুক্ষণের জন্যে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তার বোনের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখত, আর ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতো এই বলে যে তিনি এমন সুন্দরী বোন তাকে দিয়েছেন।
এখন হল কি, রাজার রানী হঠাৎ মারা গেলেন। রানীর মতো সুন্দরী, সারা দেশে আর একটিও ছিল না। রাজা তাই দুঃখে একেবারে ভেঙে পড়লেন। এদিকে রাজবাড়ির চাকরেরা কোচুয়ানের ঘরে উঁকি মারলেই দেখতে পেত সে এক ছবির সামনে মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কার ছবি তারা বুঝতে পারত না— কোচুয়ান সব সময় ছবি ঢাকা দিয়ে চলে যেত। শেষে তারা রাজাকে খবর দিলে। রাজা আদেশ দিলেন, ছবি তাঁর সামনে নিয়ে আসা হোক।
রাজা দেখলেন, কি আশ্চর্য, এও তাঁর মৃত রানীর তুল্য সুন্দরী এক স্ত্রীলোক। তফাত শুধু রানীর চেয়েও এ আরও সুন্দরী। রাজা দেখেই তাকে ভালবেসে ফেললেন। কোচুয়ানকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন— এ কার ছবি?
সে বলল— এটি আমার বোন।
রাজা স্থির করলেন, যদি আবার বিয়ে করেন তো একে ছাড়া আর কাউকেই তিনি বিয়ে করবেন না। কোচুয়ানকে বললেন— গাড়ি সাজাও। ঘোড়া জোতো। সোনার পোশাক নিয়ে যাও। আমার পছন্দ-করা কনেকে নিয়ে এস।
রেজিনার যখন ঘোড়ার গাড়ি আর পোষাক আর রাজার বার্তা নিয়ে তার বোনের কাছে হাজির হল, বোন তো খুব খুশি। কিন্তু তার সৎবোন আর সৎমা হিংসের জ্বলে গেল। রাগে অন্ধ হয়ে সৎবোন তার মাকে বললে— এদ্দিন ধরে তুমি যেসব ডাইনী বিদ্যে শিখলে কী তার ফল হল? এমন ভাগ্য আমার না হয়ে শেষে হল কিনা তোমার সৎ মেয়ের?
বুড়ি ধমকে বললে— চুপ কর্। দেখ্না কেমন করে ভাগ্যের মোড় ফিরিয়ে দিই। বলে সে বিড়বিড় করে মন্তর আওড়াতে থাকল।
দেখতে দেখতে কোচুয়ান হয়ে গেল আধকালা আর তার সুন্দরী বোন আধ-কালা। তারপর তারা সকলে মিলে গাড়িতে উঠল। প্রথমে উঠল সোনার সাজে সুন্দরী মেয়ে, তারপর কালো বুড়ি আর তার কালো মেয়ে। রেজিনার গাড়ির ছাদে বসে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। কিছুদূর যাবার পর ছাদ থেকে রেজিনার ছড়া কেটে বলল—
ভালো করে ঢেকে বসো বোনটি আমার
ঘূর্ণি ধুলোয় দেখ ঢাকে চারিধার
মলিন না হয় যেন চোখ মুখ নাক
বৃষ্টির জলে যেন ভেজে না পোষাক।
পেতে যদি চাও বোন রাজার যতন
রাজার সমুখে যাবে ফুলের মতন।
সুন্দরী কন্যা তখন কানে ভালো শুনছে না— সে জিজ্ঞেস করল— কি বলছে আমার ভাই?
বুড়ি বললে— ও বলছে তোমার সোনার পোষাক খুলে তোমার দিদিকে দিতে।
মেয়েটি তার সোনার পোষাক খুলে কালো মেয়েকে পরিয়ে দিল। কালো মেয়ে তার নোংরা পোষাক সুন্দরী মেয়ের গায়ে জড়িয়ে দিল। তারপর আরো কিছুদূর গিয়ে রেজিনার আবার চেঁচিয়ে উঠল—
ভালো করে ঢেকে বসো বোনটি আমার
ঘূর্ণি ধুলোয় দেখ ঢাকে চারিধার—
মলিন না হয় যেন চোখ মুখ নাক
বৃষ্টির জলে যেন ভেজে না পোষাক।
পেতে যদি চাও বোন রাজার যতন
রাজার সমুখে যাবে ফুলের মতন।
কন্যা জিজ্ঞেস করল— কি বলছে আমার ভাই?
বুড়ি বললে— তোমার ভাই বলছে তোমার সোনার মুকুট খুলে দিদির মাথায় পরিয়ে দাও।
মেয়েটি তখন নিজের মুকুট খুলে কালো কন্যের মাথায় পরিয়ে দিল। নিজে খালি মাথায় রইল।
গাড়ি আরো কিছুদূর যাবার পর কোচুয়ান চেঁচিয়ে বলল—
ভালো করে ঢেকে বসো বোনটি আমার
ঘূর্ণি ধুলোয় দেখ ঢাকে চারিধার—
মলিন না হয় যেন চোখ মুখ নাক
বৃষ্টির জলে যেন ভেজে না পোশাক।
পেতে যদি চাও বোন রাজার যতন।
রাজার সমুখে যাবে ফুলের মতন।
কন্যা বলল— কি বলছে আমার ভাই?
বুড়ি বলল— তোমার ভাই বলছে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে।
সেই সময় তারা যাচ্ছিল এক সাঁকোর উপর দিয়ে, তার নিচে গভীর জল।
সুন্দরী কনে যেই না উঠে দাঁড়িয়ে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল অমনি বুড়ি আর তার কালো মেয়ে দুজনে মিলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল। মেয়েটি গিয়ে পড়ল জলের ঠিক মাঝখানে। মেয়েটি যেই ডুবল অমনি সেই আয়নার মতো মসৃণ জলের মধ্যে থেকে একটি বরফের মতো সাদা হাঁস বার হয়ে ভাসতে ভাসতে নদীর স্রোত ধরে চলে গেল।
কোচুয়ান আধকানা, সে এসব কিছুই দেখতে পেলে না। গাড়ি হাঁকিয়ে সে রাজপ্রাসাদে ঢুকল। চোখে ভাল দেখতে পায় না— বুড়ি তার কালো মেয়েকে এগিয়ে দিতে কোচুয়ান তাকে নিয়েই রাজার সামনে হাজির হল; তার সর্বাঙ্গে ঝলমলে সোনার পোষাক— দেখে ভাবল এ-ই বুঝি তার নিজের বোন।
রাজা যখন দেখলেন এক হত-কুৎসিত কনে নিয়ে তাঁর কোচুয়ান হাজির হয়েছে, তিনি এমন রাগ করলেন যে তখ্খনি হুকুম দিলেন কোচুয়ানকে বিষাক্ত সাপের বাসার মধ্যে ফেলে দেওয়া হোক।
কোচুয়ান বিদায় হলে ডাইনিবুড়ি নানারকম মন্তরতন্তর আউড়ে রাজার মন আস্তে আস্তে তার মেয়ের প্রতি নরম করে আনলে। শেষে রাজার চোখে সে আর কুচ্ছিত ঠেকল না। রাজা তাকে বিয়ে করলেন।
একদিন সন্ধ্যার সময় রাজার পাশে তার কালো কনে বসে আছে, সেই সময় একটি সাদা হাঁস রাজবাড়ির রান্নাঘরের পিছনে যে নর্দমা তাইতে সাঁতার দিতে দিতে রান্না ঘরে এসে উঠল। উঠে রান্নাঘরের ছোকরাকে বললে— ছোকরা, একটু আগুন কর, আমার ভিজে পালকগুলো একটু শুকিয়ে নিই।
ছোকরা আগুন জ্বালাতে হাঁস গা ঝাড়া দিয়ে ঠোঁটে করে পালক সাফ করতে করতে আরাম করে বসল। বসে বলল— বল তো ভাই, আমার ভাই রেজিনার কি করছে?
ছোকরা জবাব দিলে— তাকে তো রাজার হুকুমে সাপের বাসায় ফেলে দেওয়া হয়েছে।
তখন হাঁস বললে— এই রাজবাড়িতে কালো ডাইনির মেয়েটা কি করে আজকাল?
ছোকরা বললে— সে তো রাজাকে ভুলিয়ে ফেলেছে। রাজা তাকে রানী করেছেন।
শুনেই হাঁস রান্নাঘর ত্যাগ করে নর্দমা ধরে সাঁতার কাটতে কাটতে চলে গেল।
পরদিন সন্ধ্যাবেলা হাঁস আবার এল, আবার সেই একই প্রশ্ন করল, একই উত্তর পেল। তৃতীয় দিন সন্ধ্যাবেলায়ও সেই একই ব্যাপার।
রান্নাঘরের ছোকরা আর সহ্য করতে পারল না। রাজাকে গিয়ে সব বললে।
রাজা বললেন— আমি নিজে গিয়ে দেখব।
পরদিন রাজা রান্নাঘরে লুকিয়ে রইলেন। সময় হলে নর্দমা দিয়ে সরসর আওয়াজ। কে যেন সাঁতার কেটে আসছে। তারপর ঘুলঘুলি দিয়ে যেই না সাদা হাঁস রান্নাঘরের মধ্যে তার গলা বাড়িয়ে দিয়েছে অমনি খাপ থেকে তলোয়ার বার করে রাজা ঘ্যাঁচ করে তার মাথা কেটে ফেলেছেন। অমনি হাঁসের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল এক পরমা সুন্দরী কন্যা। ছবিতে যেমন দেখেছিলেন রাজা ঠিক তেমনটি।
রাজা আনন্দে আত্মহারা হলেন। মেয়েটির সর্বাঙ্গ ভিজে দেখে রাজা দামী পোষাক আনিয়ে মেয়েটিকে পরিয়ে দিলেন।
মেয়েটি তখন যা-যা ঘটেছিল সব বললে। কেমন করে মন্তর পড়ে মিছে কথা বলে তাকে ঠকানো হয়েছে। কেমন করে তাকে ঠেলে জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, সব বললে।
বলে সে বললে— আমার প্রথম অনুরোধ আমার ভাইকে সাপের বাসা থেকে তুলে আনা হোক।
রেজিনারকে উদ্ধার করে রাজা ডাইনিবুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ডাইনিবুড়ি তখনও এ সবের কিছুই জানে না। রাজা তাকে বললেন— আচ্ছা, এই এই ঘটনা, যদি ঘটে তাহলে যে এইসব ঘটনা ঘটায় তার কি শাস্তি? বলে আনুপূর্বিক যা-যা ঘটেছিল তাই বলে গেলেন— শুধু কারো নাম করলেন না।
ডাইনিবুড়ি তখন রাজসুখে অন্ধ। রাজার উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারলেন না। সে বললে— এই পাপের শাস্তি হচ্ছে পাপীকে উলঙ্গ করে কাঁটাওয়ালা পিপের মধ্যে পুরে ঘোড়ায় করে টেনে টেনে সারা রাজ্যে ঘোরানো।
রাজা বললেন— তথাস্তু। বলে বুড়ি আর মেয়ের জন্যে সেই শাস্তির ব্যবস্থা করলেন।
তারপর সুন্দরী কনেকে বিয়ে করে তার বিশ্বস্ত ভাই রেজিনারকে প্রচুর ধনরত্ন দিয়ে, খেতাব দিয়ে রাজ্যের মধ্যে গণ্যমান্য করে দিলেন।