সুলতান কুকুরের গল্প
ব্রাদার্স গ্রিম দ্বারাএক গ্রামবাসীর একটি বিশ্বাসী শিকারী কুকুর ছিল তার নাম ছিল সুলতান। বহুদিন সে তার প্রভুর সেবা করে এসেছিল, তারপর সে বুড়ো হয়ে পড়ল। তার দাঁত পড়ে গেল, শিকারী কুকুরের দলের সঙ্গে সে আর ছুটতেও পারত না।
একদিন শিকার থেকে ফিরে এসে কর্তাটি বাড়ির দরজায় ঢোকবার সময় তাঁর গিন্নিকে বললেন— বুড়ো সুলতানকে দিয়ে আর কোনো কাজ হয় না। কাল ওকে আমি গুলি করে মারব।
গিন্নিটি বিশ্বাসী সুলতানকে বড় ভালবাসতেন। তিনি অবাক হয়ে বললেন— এতদিন ধরে যে আমাদের সেবা করে এসেছে, এতদিন ধরে যে আমাদের সঙ্গে বাস করছে তাকে তুমি মারবার কথা ভাবলে কী করে? বুড়ো হয়েছে বলে কি মায়াও হয় না?
কর্তা বললেন— না না, ও কথা আমি শুনব না! সারা মুখে ওর একটি দাঁত নেই। চোর তাড়াবার কাজে আর লাগবে না। চোরেরা ওকে দেখে ভয়ই পায় না। ওর যাওয়াই ভাল। এতদিন ধরে ও আমাদের সেবা করেছে, তার জন্যে এতদিন ধরে ওকে আমরা খাইয়েছি তো। যত চেয়েছে ততই তো খেতে দিয়েছি।
বেচারি কুকুর একটু দূরে রোদে গা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল। তার কানে সব কথাই গেল। কালই যে তার জীবনের শেষ দিন, এটা জেনে তার ভারি মন খারাপ হয়ে গেল।
সুলতানের ছিল একটি খুব ভাল বন্ধু— এক নেকড়ে। কাছেই থাকত। সন্ধে হতে সে চুপিচুপি বনে গেল নেকড়ের সঙ্গে দেখা করতে। সুলতান তার নেকড়ে বন্ধুকে বললে তার ভাগ্যের কথা।
নেকড়ে বললে— শোনো দাদা। একটু সাহস কর। তোমার বিপদ থেকে আমি তোমায় উদ্ধার করব। কাল সকালে তোমার প্রভু আর তাঁর গিন্নি মাঠে যাবেন ঘাস কাটতে, সঙ্গে নিয়ে যাবেন তাঁদের ছোট ছেলেটাকে। যখন তাঁরা কাজ করবেন ছেলেকে বেড়ার ছায়ায় রেখে দেবেন, তুমি থাকবে শুয়ে ছোট ছেলেটার কাছে, যেন তুমি ছেলে পাহারা দিচ্ছ। আমি অপেক্ষা করব যতক্ষণ না সব চুপচাপ হয়ে যায়। তারপর বন থেকে সাঁ করে বেরিয়ে আমি বাচ্চাটাকে নিয়ে দৌড়ে পালাবো। সেই সময় তৎপর হয়ে উঠে তুমি ছুটবে আমার পিছনে, যেমন আগেকার দিনে শিকারের পিছনে ছুটতে। আমি বাচ্চাটাকে ফেলে দেব আর তুমি তাকে কুড়িয়ে ফিরে যাবে বাপ-মার কাছে। তাঁরা ভাববেন আমার মুখ থেকে তুমি তাঁদের বাচ্চাকে উদ্ধার করেছ। তাঁরা তোমার উপর আগের চেয়েও বেশি সদয় হবেন দেখে নিও। তোমার আদর হবে আগের চেয়েও বেশি। আর কোনোদিন তাঁরা তোমায় ছাড়তে চাইবেন না।
কুকুর নেকড়ের উপদেশ অনুসারে সব কিছু করল। যেমন মতলব করা হয়েছিল, হলও ঠিক তাই। বাবা যখন দেখলেন নেকড়ে ছেলেকে মুখে করে বনের মধ্যে পালাচ্ছে, তিনি চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু যখন বেচারা বুড়ো সুলতান তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এল তিনি আনন্দে আত্মহারা হলেন। বুড়ো কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে তার পিঠ চাপড়ে আদর করে বলতে লাগলেন—আর তোর কোনোদিন কোন কষ্ট হবে না কুত্তা। যতদিন বাঁচিস তোর খাবারের অভাব হবে না। আশ্রয়েরও অভাব হবে না।
গিন্নিকে তিনি বললেন— গিন্নি, এখনি বাড়ি গিয়ে দুধের সঙ্গে পাঁউরুটি সিদ্ধ করে সুলতান বুড়োকে খেতে দাও। খেতে নরম হবে, চিবোবার জন্যে দাঁতের দরকার হবে না। আর আমার আরাম কেদারা থেকে বালিশটা নিয়ে ওর একটা বিছানা করে দিও।
সেই থেকে বুড়ো সুলতান যত আরাম যত যত্ন চায় সব পেতে লাগল। তারপর একদিন সুলতান গেল নেকড়েকে তার সৌভাগ্যের খবর, আর আনন্দের খবর দিতে।
নেকড়ে তখন ধূর্তামি করে বললে— দাদা, এবারে আমি যখন মোটা-সোটা দেখে একটা ভেড়ার বাচ্চাকে তোমার প্রভুর ভেড়ার পাল থেকে টেনে নিয়ে পালাবো তখন তুমি আশা করি চোখ বুজে থাকবে। বুঝছই তো, আজকাল ভাল খাবার পাওয়া কত কঠিন।
কুকুর বললে— তা তো পারব না। আমার প্রভু আমার উপর বিশ্বাস রাখেন। তাঁর সম্পত্তিতে আমি তোমায় হাত দিতে দিই কী করে!
নেকড়ে ভাবলে কুকুর বুঝি ঠাট্টা করছে। কাজেই সে রাত্তিরবেলা এসে গা-ঢাকা দিয়ে ভেড়ার খোঁয়াড়ে ঢুকল। কুকুর আগেই তার প্রভুকে সাবধান করে রেখেছিল, কাজেই ভেড়ার বাচ্চা নিয়ে তার পালানো হল না। তার বদলে এমন ঠ্যাঙানি খেল যে তার গায়ের সমস্ত রোঁয়াই গেল উঠে।
নেকড়ে পালাতে পালাতে চেঁচিয়ে কুকুরকে বললে— দাঁড়াও অবিশ্বাসী বন্ধু, এর ফল তোমায় ভুগতে হবে!
তার পরদিন নেকড়ে বাঘ তার বন্ধু বুনো শুয়োরকে ডেকে বললে— যাও তুমি সুলতান কুকুরকে আমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে এস। এক বনের মধ্যে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবার কথা হল। কুকুরের সঙ্গে তার সঙ্গী হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আর কেউ ছিল না, ছিল কেবল একটি তে-ঠেঙা বেড়াল। তিন পা থাকলে কী হয়, বেড়ালের সাহস ছিল খুব। তিন পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে সে চলল বটে, কিন্তু ল্যাজ খাড়া করে শূন্যে— দেখে মনে হয় পৃথিবীতে কারুর সে তোয়াক্কা করে না। নেকড়ে বাঘ আর তার সঙ্গী বুনো শুয়োর আগেই যুদ্ধের জায়গায় এসে পৌঁছেছিল। তারা দূর থেকে যখন দেখল শত্রুপক্ষ আসছে, তারা বেড়ালের ল্যাজটাকে দেখে ভাবল ওটা একটা তলোয়ার। আর যতবার বেড়াল খোঁড়াচ্ছে, তার পিঠটাও ততবার কুঁজের মতো খাড়া হয়ে উঠছে। দুর থেকে সেই কুঁজো পিঠ দেখে তারা ভাবলে সুলতান বুঝি একটা মস্ত পাথর নিয়ে আসছে তাদের দিকে ছুঁড়বে বলে। দেখে দুজনে এমন ঘাবড়ে গেল যে শুয়োর গিয়ে লুকোলো শুকনো পাতার মধ্যে আর নেকড়ে লাফিয়ে উঠল একটা গাছে।
কুকুর আর বেড়াল বনের মধ্যে পৌঁছে কাউকে দেখতে না পেয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল। কিন্তু বেড়াল দেখলে মাটিতে কি একটা রয়েছে। সে ভাবল বুঝি ইঁদুর।
শুয়োর শুকনো পাতার মধ্যে গিয়ে যখন লুকিয়েছিল তার ছাই রঙের কান দুটোকে লুকোতে পারেনি। সে দুটো পাতার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছিল। বেড়াল গিয়ে শুঁকতে আরম্ভ করতেই কানদুটো নড়ে উঠল। বেড়াল ভাবলে, ইঁদুর না হয়ে যায় না। সে একটাকে কামড়ে ধরে আধখানা করে ছিঁড়ে নিলে। শুয়োর লাফিয়ে উঠে বললে— আসল পাপী ঐ গাছে! ঐ গাছে! এই বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়। কুকুর আর বেড়াল উপরদিকে তাকিয়ে দেখল, নেকড়ে। নেকড়ে লজ্জায় ঘাড় নিচু করে নেমে এল। আর তার ভীরু অবিশ্বাসী নকল বন্ধু শুয়োরের উপর এমন চটে গেল যে কুকুর আর বেড়ালের সঙ্গেই বরাবরের জন্যে বন্ধুত্ব করে ফেলল।