Chapter Index

    একটি লোকের ছিল সাত ছেলে কিন্তু একটিও মেয়ে ছিল না। মেয়ের জন্যে সে আঁকুপাঁকু করত। কিন্তু মেয়ে আর হত না। শেষে তার বৌয়ের একটি মেয়ে হল।

    মেয়ে যখন একটু বড় হল মেয়েকে হলুদ মাখিয়ে স্নান করাবার জন্যে বাপ এক ছেলেকে পাঠালো নদী থেকে জল তুলে আনতে। অন্য ছ’ ভাইও ছুটলো তার পিছু পিছু। কে জল তুলবে এই নিয়ে ভাইয়েদের মধ্যে লেগে গেল কাড়াকাড়ি। হুটোপুটিতে ঘড়া গেল নদীর জলে পড়ে ভেসে। ভয়ে কাঠ হয়ে তারা দাঁড়িয়ে রইল নদীর ধারে। —কেউ আর সাহস করে ঘরে ফিরতে পারল না।

    এদিকে বাপের আর ধৈর্য থাকে না। তিনি বললেন— বজ্জাতগুলো নিশ্চয় খেলা করতে করতে জল আনার কথা ভুলেই গেছে। রাগের চোটে তিনি বলে ফেললেন— হতভাগাগুলো দাঁড়কাক হয়ে গেলে বাঁচি।

    যেই না বলা অমনি মাথার উপর একটা শোঁ শোঁ শব্দ শোনা গেল আর দেখা গেল সাতটি কালো কুচকুচে দাঁড়কাক উড়তে উড়তে দূর থেকে দূরান্তরে চলে যাচ্ছে।

    যে অভিশাপ একবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে তাকে ফিরিয়ে নেবার কোনো রাস্তা বাপ-মায়ের জানা ছিল না। সাত সাতটি ছেলে হারিয়ে তাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। তবু মেয়েটি ছিল, তারই মুখ চেয়ে তারা শান্তি পেত। মেয়েটি দিন দিন যেমন বড় হয়ে উঠল তেমনি সুন্দরী হয়ে উঠল। মেয়েটি জানতোই না যে তার কোনো ভাই ছিল। কারণ কোনোদিন তার বাপ-মা ভাইয়েদের কথা মুখেও উচ্চারণ করেনি।

    একদিন মেয়েটি জল আনতে যাচ্ছে, তার কানে এল কয়েকজন তাকে দেখিয়ে বলাবলি করছে— মেয়েটা কেমন সুন্দরী হয়ে উঠছে দেখছ? আর একজন বললে— সবই তো ভাল কিন্তু ঐ মেয়ের জন্যেই তো ওর সাত ভাইয়ের এমন সর্বনাশটা হল।

    শুনে মেয়েটি ভাবল, এ আবার কি? তার মন বেজায় খারাপ হয়ে গেল। সে বাপ-মার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে— মা, বাবা? আমার কোনো ভাই ছিল কি? কি হল তাদের?

    তখন আর লুকোনো গেল না। তাঁরা সব বলে বললে— তোমার এতে কোনো হাত ছিল না। যা হয়েছে তা ভগবানের অভিপ্রেত।

    মেয়েটির কিন্তু মন ভার হয়ে রইল। সারাদিন সে গালে হাত দিয়ে ভাবত। ভাবত, ভাইদের তাকে উদ্ধার করে আনতেই হবে। সারাক্ষণ এই চিন্তায় তার মনের শান্তি নষ্ট হয়ে গেল। শেষে একদিন সে চুপিচুপি বেরিয়ে পড়ল ভাইদের খুঁজতে। সে ঠিক করলে যেখানেই তারা থাকুক, তাদের খুঁজে বার করবে, যেমন করে পারে তাদের উদ্ধার করবে।

    সঙ্গে করে সে কিছুই নিল না, শুধু নিল বাপ-মায়ের স্মৃতির জন্য ছোট্ট একটি আংটি, ক্ষিদে মেটাবার জন্যে একখানি রুটি, তেষ্টা মেটাবার জন্যে এক ঝারি জল আর ক্লান্তি মেটাবার জন্যে ছোট্ট একখানি আসন। এই ভাবে চলতে চলতে চলতে চলতে সে পৌঁছল এসে একেবারে পৃথিবীর শেষে।

    তারপর সে গেল সূর্যের কাছে। কিন্তু দেখল সূর্য বড় গরম, বড় ভীষণ, তাছাড়া ছেলে ধরে খায়। তখন সে ছুটে গেল চাঁদের কাছে। কিন্তু গিয়ে দেখল বড় ঠাণ্ডা, বড় নিরানন্দ আর বিষণ্ণ। দাঁড়িয়ে ভাবছে, কি করি; হঠাৎ শুনলে চাঁদ বলছে, হুঁ হুঁ, মানুষের গন্ধ পাচ্ছি!

    দৌড়ে এক ছুট দিয়ে সে চলে গেল তারাদের কাছে। তারারা ছিল দয়ায় মায়ায় ভরা। তারা প্রত্যেকেই নিজের নিজের আসনে সমাসীন।

    শুকতারা উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির হাতে একটি ছোট্ট হাড় দিয়ে বলল— এই হাড়টি নিয়ে যাও। এই হাড় ছাড়া কাঁচের পাহাড়ের দরজা খোলা যাবে না। কাঁচের পাহাড়ের মধ্যেই আছে তোমার সাত ভাই।

    মেয়েটি হাড়টি নিয়ে যত্ন করে রুমালে মুড়ে রাখল, তারপর চললো কাঁচের পাহাড়ের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখল কাঁচের পাহাড়ের দরজা বন্ধ। সে ভাবলে এবার রুমাল খুলে হাড়টা বার করি। কিন্তু রুমাল খুলে সে দেখল রুমাল খালি। তারাদের দেওয়া উপহার কোথায় পড়ে গেছে।

    হায়, এখন কি করা যায়? কেমন করে ভাইদের উদ্ধার করা যায়? কাঁচের পাহাড়ে ঢোকবার চাবি কোথায় পাওয়া যায়? তখন সে করল কি, একটা ছুরি বার করে নিজের কড়ে আঙুলটি কেটে ফেলল। তারপর সেই কড়ে আঙুল চাবির গর্তে ঢুকিয়ে খুলে ফেলল দরজাটা।

    মেয়েটি ভিতরে ঢুকতেই তার সঙ্গে এক বামনের দেখা। বামন বললে— খুকী! কি খুঁজছ তুমি?

    মেয়েটি বললে— আমি আমার সাত ভাইদের খুঁজছি। তারা সবাই দাঁড়কাক হয়ে গেছে।

    বামনটি বললে— দাঁড়কাকেরা আমার প্রভু। তাঁরা তো এখন বাড়িতে নেই। তবে আপনি যদি তাঁদের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান তো ভিতরে আসুন।

    মেয়েটি ভিতরে যেতে বামন দাঁড়কাকদের জন্যে খাবার গোছাতে বসল। সাতটি ছোট ছোট থালা এবং সাতটি ছোট ছোট পেয়ালা। মেয়েটি প্রত্যেক থালা থেকে একটি করে রুটির টুকরো আর প্রত্যেক পেয়ালা থেকে এক চুমুক করে পানীয় খেয়ে নিল। তারপর যে আংটিটা এনেছিল সেটিকে টুপ্‌ করে ফেলে দিল শেষের পেয়ালাটিতে।

    হঠাৎ বাতাসে একটা শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া গেল আর বামন বললে— ঐ আমার দাঁড়কাক প্রভুরা ফিরছেন।

    দাঁড়কাকেরা এসেই বসে গেল খেতে।

    একজন বললে— এ কি? কে আমার থালা থেকে খেয়েছে? কে আমার পেয়ালা থেকে খেয়েছে? এখানে কোনো মানুষ এসেছে নিশ্চয়!

    আর একজনও তাই বললে। পর পর সবাই একই কথা বললে। শেষে ছোট দাঁড়কাক যখন চুমুক দিয়ে তার পেয়ালা শেষ করে ফেলল, তার মুখে একটা কি ঠেকল।

    মুখ থেকে বার করে দেখে তাদের বাবা-মার আংটি। সে বললে— ভগবান করুন যে আমাদের বোন এখানে এসেছে। সেই আমাদের উদ্ধার করবে।

    মেয়েটি দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিল। ভাইয়ের কথা শুনে বেরিয়ে আসতেই এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দেখা গেল দাঁড়কাকেরা আবার তাদের মানুষের রূপ ফিরে পেয়েছে। তখন সবাই সবাইকে আলিঙ্গন করল। তারপর আনন্দ করতে করতে সবাই মিলে দেশে ফিরে গেল। বাবা-মা হারানো সন্তানদের ফেরত পেয়ে যারপর নাই খুশি হলেন।

    টীকা