Chapter Index

    অনেক অনেক দিন আগে এক রাজা ছিলেন, তাঁর জ্ঞানের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। কিছুই তাঁর অজানা ছিল না। যেখানে যা কিছু ঘটত, খুব গোপনীয় খবরও বাতাসে ভর করে তাঁর কানে এসে পৌঁছত।

    তাঁর ছিল এক ভারি অদ্ভুত অভ্যাস। প্রতিদিন সন্ধ্যার ভোজের পর পারিষদ অতিথিরা তখন সবাই চলে যেতেন, রাজা একা হতেন, সেই সময় তাঁর এক বিশ্বাসী চাকর এক পাত্র খাবার নিয়ে আসত। পাত্রটি সব সময় থাকত ঢাকা। চাকরও জানত না তার মধ্যে কী আছে; কেউই জানত না, কারণ সবাই চলে না গেলে রাজা কোনদিন তার ঢাকা খোলেন নি। এইভাবে অনেক দিন চলেছিল; শেষে চাকরটি ঔৎসুকের বশে আর থাকতে না পেরে একদিন পাত্রটি নিজের ঘরে নিয়ে গেল।

    সাবধানে দরজায় হুড়কো দিয়ে সে পাত্রের চাকা খুলে দেখলে তার মধ্যে একটি সাদা সাপ। দেখে তার ভয়ানক খেতে ইচ্ছে হল। কাজেই ছোট্ট একটি টুকরো কেটে মুখে ফেলে দিলে। যেই না চাখা অমনি কানের কাছে এক ফিস্-ফিস্ মিহি শব্দ।

    সে জানলার কাছে গিয়ে খানিক শুনলে। লক্ষ করলে যে চড়াই পাখিরা কথা কইছে। বক-বক করে তারা বনে আর মাঠে যা-যা দেখেছে তাই নিয়ে কত কথাই না বলছে। সাপ খেয়ে তার পশু পক্ষীর ভাষা বোঝবার ক্ষমতা জন্মেছে।

    এখন হল কি, ঠিক সেই দিনই রানীর সবচেয়ে দামি আংটিটি হারিয়ে গেল। সন্দেহ গিয়ে পড়ল সেই বিশ্বাসী চাকরের উপর, কারণ তারই ছিল সর্বত্র গতি। রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন—কালকের মধ্যে যদি জিনিসটা পাওয়া না যায় তাহলে তোকে জেলে পাঠাবো। বৃথাই সে তার নির্দোষিতার কথা বললে। রাজা বিশ্বাস করলেন না।

    দুঃখে উদ্বেগে সে বাগানে গিয়ে ভাবতে বসল কেমন করে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে। নদীর ধারে একদল হাঁস বসে ঠোঁট দিয়ে তাদের পালক সাফ করছিল আর গল-গল করে বকছিল। চাকর চুপটি করে শুনতে লাগল তারা কি বলে। তারা তাদের সকালবেলাকার বেড়াবার সময় কী ঘটেছিল তাই বলাবলি করছিল।

    তাদের মধ্যে একটা হাঁস বললে—আমার পেটটা ভার হয়ে রয়েছে। আজ সকালে তাড়াতাড়িতে আমি রানীর আংটিটা খেয়ে ফেলেছি।

    চাকর তাড়াতাড়ি সেটাকে ধরে, গলা ধরে ঝুলিয়ে রান্না ঘরে নিয়ে গিয়ে রাঁধুনিকে বললে—দেখ কেমন সুন্দর মোটা একটা হাঁস! এটাকে কেটে ফেল।

    রাঁধুনি হাঁসটাকে ঝুলিয়ে ওজন দেখে বললে—ঠিক বলেছ। খেয়ে খেয়ে ফুলেছে এটা। আগেই এটার রোস্ট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। হাঁসটাকে কেটে পেট চিরতেই রানীর আংটি বেরিয়ে পড়ল।

    প্রমাণ হয়ে গেল চাকরের কোন দোষ নেই। রাজা তাঁর অবিচারের ক্ষতিপূরণের জন্যে চাকরকে বললেন—আমার রাজসভার যে-কোন উচ্চ পদ তোমায় দিতে পারি—বল কী চাও। চাকর কিন্তু কোন পদই চাইল না। সে বললে—রাজা যদি তাকে কিছু দিতে চান তাহলে একটা ঘোড়া আর কিছু টাকা দিন। সে দুনিয়া ঘুরে দেখতে চায়।

    রাজা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করতে সে বেরিয়ে পড়ল বেড়াতে। একদিন সে এক দিঘির ধারে এসে দেখল, তিনটি মাছ নলখাগড়ার মধ্যে আটকে গিয়ে খাবি খাচ্ছে। যদিও লোকে বলে মাছেরা বোবা কিন্তু সে বেশ শুনল মাছেরা এইভাবে বিপদে পড়ে কান্নাকাটি করছে। তার মনটা ছিল দয়ালু। সে ঘোড়া থেকে নেমে বন্দী মাছ তিনটিকে তুলে জলে ছেড়ে দিলে। আনন্দে কিলবিল করতে করতে তারা জলের মধ্যে যেতে যেতে মাথা তুলে চেঁচিয়ে বললে—আমাদের বাঁচালে, এ কথা মনে রইল। এর জন্যে পুরস্কার পাবে।

    তারপর আবার সে ঘোড়ায় করে চলল। খানিক পরে পায়ের তলায় বালির মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পেল। সে শুনল পিঁপড়েদের এক রাজা অনুযোগ জানাচ্ছেন এই বলে—এই মানুষ আর তাদের জন্তুগুলো আমাদের কাছ থেকে যদি দূরে থাকে তো বাঁচা যায়। একটা বেয়াড়া ঘোড়া এইমাত্র আমার একদল প্রজার উপর নির্দয়ভাবে তার ক্ষুর চাপিয়ে দিয়েছে।

    চাকর সেখান থেকে তার ঘোড়া সরিয়ে পাশের রাস্তায় নিয়ে গেল। পিঁপড়ের রাজা চেঁচিয়ে বললেন—তোমার এই ব্যবহার আমাদের মনে থাকবে। এর জন্যে পুরস্কার দেব কোনদিন।

    এইবার এক বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা পড়ল। চাকর দেখল একজোড়া দাঁড়কাক তাদের বাসার কাছে দাঁড়িয়ে তাদের বাচ্চাদের দূর করে দিচ্ছে।

    তারা বলছিল—দূর হ, ফাঁসি-কাঠের পাখি! আর তোদের আমরা খাওয়াতে পারব না! যথেষ্ট বড় হয়েছিল, এখন চরে খা গে!

    কচি বাচ্চারা মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাচ্ছিল আর কাঁদছিল এই বলে—অসহায় বাচ্চা আমরা কেমন করে নিজেদের খাওয়াবো? উড়তেই পারি না! না খেয়ে মরব আমরা!

    ভালমানুষ চাকরটি ঘোড়া থেকে নেমে তার তলোয়ার দিয়ে ঘোড়াটাকে কেটে বাচ্চা দাঁড়কাকদের খাবার জন্যে রেখে গেল। তারা লাফাতে লাফাতে সেইদিকে গিয়ে চেঁচিয়ে বললে—তোমার এ দয়া আমাদের মনে থাকবে। তোমায় পুরস্কৃত করব।

    এবার তার হাঁটা ছাড়া আর উপায় রইল না। অনেক দূর হেঁটে সে এক প্রকাণ্ড শহরে এসে পৌঁছল। রাস্তায় খুব গোলমাল শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখে, এক ঘোড়সওয়ার কি যেন ঘোষণা করছে।

    রাজকন্যার জন্যে বর খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু রাজকন্যাকে সে পেতে চায় তাকে এক কঠিন কাজ করতে হবে। কাজ করতে গিয়ে যদি সে সফল না হয় তাহলে তাকে প্রাণ দিতে হবে।

    অনেকেই এর আগে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সকলেরই বৃথাই প্রাণ গেছে।

    চাকরটি যখন রাজকন্যাকে দেখল, রাজকন্যার রূপে তার চোখ এমন ধাঁধিয়ে গেল যে সে সব বিপদের কথা ভুলে গিয়ে রাজাকে বললে যে সে রাজকন্যার পাণি-প্রার্থনা করে।

    তখনই তাকে নিয়ে যাওয়া হল এক সমুদ্রের কিনারায়।

    তাকে দেখিয়ে একটি সোনার আংটি ফেলে দেওয়া হল সমুদ্রের জলে। রাজা বললেন—যাও, সমুদ্র থেকে আংটিটা তুলে দিয়ে এস। যদি খালি হাতে ডাঙায় এসে ওঠ তো তখনই তোমায় সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হবে। যতক্ষণ না ডুবে মর ততক্ষণ তোমায় এভাবে সমুদ্রে ফেলা হতে থাকবে।

    সুন্দর ছেলেটির জন্যে সবার দুঃখ হল! কিন্তু শেষ অবধি তাকে একা সমুদ্রের ধারে রেখে সবাই চলে গেল।

    যখন সে ভাবছে কী করবে, হঠাৎ দেখতে পেল তিনটি মাছ ভাসতে ভাসতে তার দিকে আসছে। যাদের সে প্রাণ বাঁচিয়েছিল, এরা তারাই। মাঝের মাছটির মুখে একটি ঝিনুক। সেই ঝিনুকটি নিয়ে সে ছেলেটির পায়ের কাছে বালির উপর রেখে দিল। সে সেটা তুলে খুলতেই দেখতে পেল তার মধ্যে সোনার আংটিটি।

    মহা আনন্দে সে সেটা রাজার কাছে নিয়ে গেল। ভাবল, এবার রাজা তাঁর অঙ্গীকার-মতো পুরস্কার দেবেন। কিন্তু দাম্ভিক রাজকন্যা যখন শুনলেন যে ছেলেটি নিচু বংশের তখন ঘৃণায় তিনি বললেন, আরো একটি কঠিন কাজ তাকে করতে হবে। তিনি নিজে বাগানে নেমে এলেন। এসে দশ বস্তা জোয়ারের বিচি বড়-বড় ঘাসের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।

    রাজকন্যা বললেন—কালকের সূর্যোদয়ের আগেই ওকে সমস্ত বেছে তুলতে হবে। একটি পড়ে থাকলে চলবে না।

    মনের দুঃখে ছেলেটি বাগানে বসে পড়ল। ভাবতে লাগল, কী করা যায়? সারা রাত ভেবে সে কোন সমাধানই করতে পারলে না। ভোরবেলা তার মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করে বসে রইল।

    কিন্তু সূর্যের প্রথম রশ্মি এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেখল যে দশটা থলি, মুখ পর্যন্ত ভর্তি। একটি বিচিও পড়ে নেই। পিঁপড়েদের রাজা রাত্রে হাজারে হাজারে পিঁপড়ে এনে জোয়ারগুলিকে তুলে বস্তায় ভরিয়ে ফেলেছেন।

    রাজকন্যা নিজে এসে ব্যাপার দেখে অবাক!

    কিন্তু তবুও তাঁর দম্ভ গেল না। তিনি বললেন—এ যদিও দুটি কঠিন কাজ করেছে, কিন্তু যতক্ষণ না এ জীবন-বৃক্ষ থেকে একটি আপেল পেড়ে এনে আমায় দিতে পারছে ততক্ষণ পর্যন্ত এ আমার স্বামী হবে না।

    ছেলেটির কোনই ধারণা ছিল না জীবন-বৃক্ষ কোথায়। যতদূর তার পা চলে ততদূরে যাবে বলে সে বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু মনে কিছু আশা রাখতে পারল না।

    তিন রাজ্য পার হয়ে এক রাত্রে সে এক প্রকাণ্ড বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। সেখানে এক গাছের তলায় শুলো সে ঘুমোবে বলে। গাছের শাখার মধ্যে সে এক খস্-খস্ শব্দ শুনতে পেল, তারপর তার হাতে এসে পড়ল এক সোনার আপেল।

    সঙ্গে-সঙ্গে তিনটি দাঁড়কাক উড়ে এসে তার হাঁটুর উপর বসল। বসে বললে—মৃত্যুর হাত থেকে যে তিনটি দাঁড়কাকের বাচ্চাকে তুমি বাঁচিয়েছিলে, আমরা হচ্ছি তারা। আমরা বড় হয়ে যখন শুনলুম তুমি সোনার আপেল খুঁজতে বেরিয়েছ , অমনি আমরা উড়লুম সমুদ্র পার হয়ে পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত। সেইখানেই জীবন-বৃক্ষ। সেখান থেকে তোমার জন্যে আপেল নিয়ে এসেছি।

    ছেলেটি খুশি হয়ে বাড়ির পথে চলল রাজকন্যার জন্যে সোনার আপেল নিয়ে। এবার আর রাজকন্যার আপত্তি করার কিছু ছিল না।

    জীবন-বৃক্ষের আপেলকে দু-টুকরো করে দু-জনে খেতেই দু-জনের মন ভালবাসায় পূর্ণ হয়ে গেল। বহুদিন তারা সুখে জীবনযাপন করল।

    টীকা