Chapter Index

    তাঁর নাম ছিল ফ্রিয়েম মাস্টার। বেঁটে, রোগা, কিন্তু প্রাণবন্ত লোকটি—এক মিনিট চুপ করে বসতে জানতেন না। মুখের মধ্যে সবচেয়ে চোখে পড়ে উঁচুর দিকে ওঠানো নাকটি আর মুখভরা বসন্তের দাগ। রক্তশূন্য চামড়া, উস্কোখুস্কো পাকা চুল আর কুতকুতে চোখ—সব সময় চারিদিকে ছট্‌ফট্‌ করে দৃষ্টি চলেছে। তিনি সব দেখতেন, সব কিছুর সমালোচনা করতেন, সব কিছু সবার চেয়ে ভালো বুঝতেন আর সব সময় তিনিই ছিলেন নির্ভুল এবং ঠিক। রাস্তায় যখন হাঁটতেন তাঁর হাতদুটো এমন দুলত যে মনে হত যেন দাঁড় বাইছেন। একবার একটি মেয়ে বালতি ভরে জল নিয়ে যাচ্ছিল, তিনি সে সময় তাঁর হাত শূন্যে এত উঁচুতে ছুঁড়েছিলেন যে বেচারার বালতি উল্টে গিয়েছিল আর ফ্রিয়েম মাস্টার নিজেই গিয়েছিলেন ভিজে। তিনি চিৎকার করে বললেন—আচ্ছা গর্ধভ তো! দেখতে পাও না তোমার পিছনে আমি আসছি?

    ফ্রিয়েম মাস্টারের পেশা ছিল জুতো সেলাই। তাঁর জুতোর দোকান ছিল। অবস্থা ভালোই। নিজে যখন চামড়া সেলাই করতেন তখন এমন জোরে তিনি সুতো টানতেন যে কাছ দিয়ে যদি তখন কেউ যেত সে তাড়াতাড়ি সরে না গেলে খেত একটা ঘুসি। কোনো মুচি কোনো সাকরেদ তাঁর দোকানে এক মাসের বেশি টিকতে পারত না। যে যতই ভালো কাজ করুক তিনি ঠিক তার খুঁত ধরে ফেলতেন। কখনো হয়ত ছুঁচের ফোঁড়গুলো সমান হচ্ছে না। আবার কখনো একপাটি জুতো বেজায় বড় কিংবা একটা গোড়ালি অন্যটার চেয়ে ছোট হয়েছে অথবা চামড়া যথেষ্ট বড় করে কাটা হয়নি। ফ্রিয়েম মাস্টার বলতেন—দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি কী করে চামড়া নরম করতে হয়! বলে একটা চামড়ার চাবুক এনে তার পিঠে কয়েক ঘা সপাং সপাং বাড়ি দিতেন। সবাইকেই তিনি বলতেন কুঁড়ের হদ্দ। নিজের হাত থেকে তাঁর খুব বেশি কাজ বেরোতো না, কারণ পনেরো মিনিটের বেশি তিনি কখনো এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারতেন না।

    স্ত্রী হয়ত খুব ভোরে উঠে উনুনে আঁচ দিচ্ছেন, ফ্রিয়েম অমনি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে লাফিয়ে উঠে খালি পায়েই ছুটতে ছুটতে রান্নাঘরে গিয়ে চেঁচামেচি লাগাবেন—বাড়িতে কি আগুন লাগিয়ে দেবে নাকি? যত বড় আগুন করেছ তাতে একটা ষাঁড়কে রোস্ট করা যায়! কাঠের কি দাম নেই?

    চাকরানীরা হয়ত কাপড় কাচবার সময় কাপড়-কাচা টবের ধারে দাঁড়িয়ে একটু হাসি-ঠাট্টা করছে, গল্প-গুজব করছে, অমনি তিনি এসে তাদের বকতে থাকবেন—ঐ দেখ। যেন সব হাঁসের দল! কাজের বদলে সারাক্ষণ ঘুঁটচর্চা! আর, অত সাবানই বা লাগছে কেন? একে সাবান নষ্ট, তার উপর আবার কুঁড়েমি! জলের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ঘস্‌-ঘস্ করে কাপড়গুলোকে ঘসলেই তো হয়— কত সাবান বাঁচে তাহলে! তা নয়, কেবল কী করে নিজেদের আঙুলগুলি বাঁচানো যায় সেই চেষ্টা। এই বলে হুড়োমুড়ি করতে গিয়ে হয়ত সাবান-জল ভরা বালতিই উল্টে ফেলে দিলেন— রান্নাঘর গেল ভেসে।

    হয়ত কেউ একটা নতুন বাড়ি তৈরি কছে। ফ্রিয়েম মাস্টার তাড়াতাড়ি জানলায় গিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন—দেখ কাণ্ড, ওরা আবার ঐ লাল বেলে পাথর লাগাচ্ছে, যা কোনোদিন শুকোবে না। ও বাড়িতে কারুর স্বাস্থ্য ভাল থাকবে না! আর কী বিচ্ছিরি করে লোকগুলো পাথর বসাচ্ছে! তা ছাড়া গাঁথিনির মশলাটা তো কোনো কাজের নয়। কাঁকর দিয়ে মেশানো উচিত ছিল, দিয়েছে বালি। আমার জীবদ্দশাতেই ও বাড়ির বাসিন্দাদের মাথায় ও বাড়ি ভেঙে পড়বে, এ আমি বলে দিলাম। বলে তিনি গিয়ে কাজের জায়গায় বসলেন। দুটো ফোঁড় দিলেন, তারপরেই আবার লাফিয়ে উঠলেন। তাঁর চামড়ার কোমর-ঢাকা খুলে চেঁচিয়ে উঠলেন—আমি এখনই যাচ্ছি। গিয়ে ও বাড়ির লোকদের বুঝিয়ে বলছি!

    প্রথমেই ছুতোরদের গিয়ে ধরলেন।

    —একি? তোমরা তো লাইন ফেলে কাজ করছ না! এরকম করলে কড়িগুলো সোজা হবে ভাবছ? একটা ভুল হলে সমস্ত ভুল হয়ে যাবে। একজন ছুতোরের হাত থেকে যন্ত্র কেড়ে নিয়ে তিনি দেখাতে গেলেন, কেমন করে কাঠ কাটতে হয়। কিন্তু দেখাবার আগেই কাদা-বোঝাই একটা গরুর গাড়ি আসছে চোখে পড়ল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে তিনি যন্ত্রটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যে চাষী গাড়ির পাশে হেঁটে আসছিল তার কাছে দৌড়ে গিয়ে বললেন—তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এইরকম বাচা ঘোড়াকে দিয়ে এত ভারি মাল-বোঝাই গাড়ি টানাচ্ছ? ঘোড়া বেচারা তো এখনই মরে যাবে! চাষী কোন উত্তর দিলে না। তাই রাগে আগুন হয়ে ফ্রিয়েম ফিরে গেলেন নিজের কারখানায়। কাছে গিয়ে বসতেই তাঁর সাকরেদ তাঁকে একটা জতো বাড়িয়ে দিলে। ফ্রিয়েম মাস্টার চেঁচিয়ে উঠলেন— কী হল আবার? একশোবার বলেছি না যে এত চওড়া করে জুতোর মুখ কাটবে না? এরকম জুতো কিনবে কে? আমি যা হুকুম দিই তার একচুল এদিক ওদিক হলে চলবে না বলে দিচ্ছি!

    সাকরেদ বললে—প্রভু, আপনি যখন বলছেন, তখন নিশ্চয়ই জুতোটা কাটা খারাপ কাটা হয়েছে। কিন্তু এটা আপনিই কেটে রেখেছিলেন। ঐ যে যখন লাফিয়ে চলে গেলেন সেই সময় আপনার হাত লেগে ওটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল, আমি তুলে রেখেছিলুম।

    একদিন রাত্রে ফ্রিয়েম মাস্টার স্বপ্ন দেখলেন যে তিনি মারা গিয়ে স্বর্গে চলেছেন। স্বর্গে পৌঁছে তিনি স্বর্গের দরজায় খুব জোরে জোরে গাঁট্টা মেরে শব্দ করতে লাগলেন আর মনে মনে বলতে থাকলেন—এরা যে কেন দরজায় শব্দ করবার জন্যে কড়া লাগায় না বুঝতে পারি না। গাঁট্টা মেরে মেরে আঙুলের গাঁট ক্ষয়ে গেল! মহর্ষি পিটার দরজা খুলে দেখতে এলেন, কে এত শব্দ করে দরজায় ধাক্কা মারছে। তিনি বললেন—ওঃ আপনি ফ্রিয়েম মাস্টার? বেশ আপনাকে ঢুকতে দিচ্ছি বটে, কিন্তু সাবধান, আপনার ঐ পরের দোষ ধরার অভ্যাসটি ছাড়ুন। এখানে এই স্বর্গে যেন কারুর দোষ ধরতে যাবেন না। এ বিষয়ে হুঁস না রাখলে আপনার কপালে দুঃখ আছে।

    ফ্রিয়েম বললেন—আমায় সাবধান করবার কোনো দরকার ছিল না। কোন্ জিনিস সঙ্গত তা আমার ভালোই জানা আছে, আর স্বর্গে তো সবই নির্দোষ, কোনো ত্রুটি নেই। পৃথিবীর মতো তো আর নয়!

    এই বলে তিনি ভিতরে ঢুকে স্বর্গের খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। ডান দিকে দেখলেন, বাঁ দিকে দেখলেন, মাঝে মাঝে ঘাড় নাড়তে থাকলেন অথবা নিজের মনে বিড়-বিড় করে কিছু বললেন। তারপর তাঁর চোখে পড়ল দুটি দেবদূত একটি কুয়ো থেকে বালতি করে জল তুলছে কিন্তু বালতির সর্বাঙ্গে ফুটো—সেই ফুটো দিয়ে সমস্ত জল ঝরে পড়ে যাচ্ছে। ফ্রিয়েম বুঝলেন না আসলে তারা পৃথিবীকে বৃষ্টি দিচ্ছিল।

    —দুত্তোরি! বলে উঠেই তিনি নিজেকে সামলে নিলে। ভেবে নিলেন—ওটা হয়ত একটা খেলা। হয়ত আমোদ করছে। যদি শুধু আমোদই হয় তাহলে দেখতে পাচ্ছি এরা স্বর্গেও এইরকম অদরকারি নানারকম কাজ করে। আমি তো দেখছি এখানে বেশিরভাগ লোকই কুঁড়েমি ছাড়া আর কিছু করে না।

    আর কিছুদূরে গিয়ে তিনি দেখলেন একটা গভীর গর্তে চাকা পড়ে একটা হাতগাড়ি আটকে গেছে। যে লোকটি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে গিয়ে তিনি বললেন—এমন হবে এ আর আশ্চর্য কী? এত বেশি মাল কখনো চাপাতে আছে? কী ভরেছ এতে?

    লোকটি জবাব দিলে—সৎ ইচ্ছা! এগুলি নিয়ে আমি ঠিক পথে যেতে পারিনি। কিন্তু তবু অনেক কষ্টে এতদূর পর্যন্ত এনেছি। এইখানে এসে এদের সঙ্গে আমিও আটকে গেছি। বলতে বলতেই একজন দেবদূত এসে তাতে দুটি ঘোড়া জুতলেন।

    ফ্রিয়েম বললেন—ঘোড়া এনেছ ঠিকই করেছ, কিন্তু দুটো ঘোড়ায় কী হবে! অন্তত চারটে ঘোড়া হলে তবে গাড়ি উঠবে।

    আর-একটি দেবদূত আরো দুটি ঘোড়া নিয়ে এলেন। তিনি সেই দুটি ঘোড়া গাড়ির সামনে না জুড়ে পিছনে জুড়লেন।

    এবারে আর ফ্রিয়েম সহ্য করতে পারলেন না। চেঁচিয়ে উঠলেন—কোনো কম্মের নয়! করছ কী বল দেখি! আজ অবধি কেউ কি ঐরকম করে দু-দিকে ঘোড়া দিয়ে গাড়ি টানা দেখেছে? তোমাদের এতই অহঙ্কার যে তোমরা ভাবো তোমরাই সবচেয়ে ভাল জানো। আরো কি-সব তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু স্বর্গের একজন বাসিন্দা তাঁকে এমন জোরে গলাধাক্কা দিল যে তিনি ছিটকে বেরিয়ে গেলেন। ফটকের ঠিক নিচে পৌঁছে ফ্রিয়েম মাস্টার মাথাটা ঘুরিয়ে একবার হাতগাড়িটা দেখবার চেষ্টা করলেন। দেখলেন চারটে ডানাওয়ালা পক্ষীরাজ ঘোড়া হাতগাড়িটাকে আকাশে তুলে ধরেছে!

    এই জায়গায় ফ্রিয়েম মাস্টারের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি মনে মনে বললেন—স্বর্গে সবকিছু যেমনভাবে ঘটে, পৃথিবীর সঙ্গে তার অনেক তফাত। তা না-হয় বুঝলুম। কিন্তু ঘোড়া সামনে জুতছে পিছনেও জুতছে। এ সহ্য করা যায় কী করে? বুঝলুম না-হয় তাদের ডানা আছে কিন্তু আগে থেকে তা জানব কী করে? তা ছাড়া ঘোড়ার চার চারটে পা আছে ছোটবার জন্যে, তার আবার দুটো ডানায় কী দরকার? কিন্তু নাঃ, আমায় এবার উঠতে হবে, নইলে সারা বাড়িতে লোকে কেবল ভুলই করে যাবে। আমার কপাল ভালো যে সত্যিই আমি মরে যাইনি।

    টীকা