Chapter Index

    এক রাজার ছিল বারোটি কন্যা। প্রত্যেক মেয়েটি ছিল অপর মেয়েটির চেয়ে আরো সুন্দরী। এক প্রকাণ্ড হলে তারা সবাই একসঙ্গে ঘুমোতো—পাশাপাশি সাজানো থাকতো তাদের বিছানা। রাত্রে তারা সবাই ঘুমোতে গেলে রাজা হলের দরজা বন্ধ করে তাতে তালা লাগিয়ে দিতেন। কিন্তু সকালবেলা যখন তিনি তালা খুলতেন, তিনি লক্ষ করতেন, খুব করে নাচলে যেমন জুতো ক্ষয়ে যায় রাজকন্যাদের জুতোগুলি ঠিক তেমনিভাবে ক্ষয়ে গিয়েছে। কী করে যে এমনটা হত কেউ বলতে পারত না।

    কাজেই রাজা ঘোষণা করে দিলেন, কেউ যদি খুঁজে বার করতে পারে রাজকন্যারা রাত্রিবেলা কোথায় নাচতে যান তাহলে রাজকন্যাদের মধ্য থেকে যে-কোন একটিকে পছন্দ করে সে বিয়ে করতে পারবে আর রাজার মৃত্যু হলে সে-ই রাজ্য পাবে। কিন্তু ‘খুঁজে বার করব’ বলে এগিয়ে এসে কেউ যদি তিন দিনের মধ্যে কিছুই আবিষ্কার করতে না পারে তাহলে তার প্রাণদণ্ড।

    কিছুদিনের মধ্যেই একজন রাজপুত্র এসে বললেন তিনি ঝুঁকি নিতে রাজি আছেন। তাঁকে খাতির করে নিয়ে যাওয়া হল। রাত্রিবেলা রাজকন্যারা যে ঘরে ঘুমোন তার লাগাও এক ঘরে তাঁকে থাকতে দেওয়া হল। তাঁর বিছানা এমন করে দেওয়া হল যাতে করে বিছানা থেকে তিনি লক্ষ করতে পারেন রাজকন্যারা কোথায় নাচতে যাচ্ছেন। ঘরের দরজা খুলে রাখা হল যাতে করে তারা ঘর থেকে বেরোতে গেলেই চোখে পড়ে যাবে। কিন্তু রাজপুত্রের চোখের পাতা এত ভারি হয়ে এল যে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালবেলা যখন তাঁর ঘুম ভাঙল, রাজকন্যারা সবাই নেচে নিয়েছেন, কারণ তাঁদের জুতোর নিচে বড়-বড় গর্ত।

    দ্বিতীয় রাত, তৃতীয় রাতেও একই ব্যাপার। কাজেই রাজপুত্রকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল, তাঁর গলা কাটা গেল। তাঁর পরে আরো অনেকে এলেন, কিন্তু সকলেই প্রাণ দিলেন।

    এক ছিল গরিব সৈনিক। বেচারার চোট লেগেছিল, তাই তার পক্ষে যুদ্ধ করা আর সম্ভব ছিল না। সে একদিন এক রাজার রাজধানীর দিকে হাঁটছিল এক রাস্তা ধরে। তার সঙ্গে এক বুড়ির দেখা। বুড়ি তাকে জিজ্ঞেস করলে—কোথায় চলেছ গো?

    সে বললে—কোথায় যাচ্ছি জানি না। তারপর ঠাট্টার সুরে বললে—রাজার মেয়েরা কোথায় গিয়ে নেচে নেচে তাদের জুতো ক্ষইয়ে ফেলেন সেটাই আমার আবিষ্কার করবার ইচ্ছে। তাহলে আমি রাজাই হতে পারব।

    বুড়ি বললে—ওটা এমন কিছু শক্ত নয়। ওরা সন্ধেবেলায় যে সরাব এনে তোমায় খেতে দেবে সেটা খেয়ো না। ভাব দেখিয়ো যে তুমি অঘোরে ঘুমোচ্ছ। আর এই নাও একটা চাদর। এটা মুড়ি দিলেই তুমি অদৃশ্য হয়ে যাবে। তখন বারোজন রাজকুমারীর পিছনে পিছনে যেতে পারবে। বলে বুড়ি তাকে একটা চাদর দিল।

    বুড়ি উপদেশ শুনে সৈনিক খানিকটা ভাবল, তারপর সাহসে ভর করে রাজার কাছে গিয়ে বললে—মহারাজ, আমি রাজকন্যা লাভের আশায় এসেছি। রাজা তাকে খাতির করলেন, রাজোচিত পোশাক দিলেন। তারপর বললেন— তুমি তো জানো আমার শর্ত? সৈনিক বললে—জানি মহারাজ।

    রাত্রে যখন শোবার সময় হল তখন সৈনিককে রাজকন্যাদের পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। সৈনিক বিছানায় শুতে যাবে, ঠিক সেই সময় বড় রাজকন্যা হাতে এক পেয়ালা সরাব নিয়ে হাজির হলেন। সৈনিক করেছিল কি, তার খুতনির নিচে একটুকরো স্পঞ্জ লুকিয়ে রেখে দিয়েছিল। সে যখন ঠোঁটের কাছে পেয়ালা নিয়ে সরাব ঢেলে দিল তার সমস্তটাই স্পঞ্জে শুষে নিল। এক ফোঁটাও গলায় পড়ল না। তারপর সৈনিক শুয়ে পড়ল, আর একটু পরেই নাক ডাকাতে লাগল, যেন কত ঘুমোচ্ছে।

    বারোজন রাজকন্যা তাই শুনে হাসতে লাগলেন। বড় রাজকন্যা বললেন—একেও প্রাণটি রেখে যেতে হবে।

    রাজকন্যারা উঠে পড়লেন, আলমারি খুললেন, দেরাজ খুললেন, আর তার মধ্যে থেকে তাঁদের সুন্দর সুন্দর পোশাক বার করলেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা সাজতে থাকলেন। ঘুরতে লাগলেন, লাফাতে লাগলেন, নাচে যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠলেন।

    শুধু ছোট রাজকন্যা বললেন—তোমরা সবাই আনন্দ করছ বটে, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার কেন জানি না অদ্ভুত লাগছে! মনে হচ্ছে আমাদের মাথার উপর ঝুলছে এক দুর্ভাগ্য।

    বড় রাজকন্যা বললেন—তুমি হচ্ছ ভিতুর সর্দার। সব সময় ভয় পাও। কত বড় বড় বীর রাজপুত্র এখানে এসে ব্যর্থ হয়েছেন তা কি ভুলে গেছ? আর, ঐ বোকা সৈনিকটাকে ভয়! ওকে তো ঘুমের ওষুধই দেবার দরকার ছিল না—এমনিতেই ঘুমিয়ে পড়ত!

    রাজকন্যারা যখন সবাই তৈরি হলেন, তাঁরা একবার সৈনিকের দিকে দেখলেন। দেখলেন তার চোখ বোজা—একেবারে নিথর। তাঁরা ভাবলেন, আর কোন ভয় নেই। বড় রাজকন্যা তখন একটি বিছানার কাছে গিয়ে বিছানার উপর ধাক্কা দিলেন। দিতেই বিছানাটি মাটির মধ্যে ঢুকে গেল আর প্রথমে বড় রাজকন্যা, তারপর তাঁর পিছনে অন্যান্য বোনেরা একে-একে সেই গর্তের মধ্যে দিয়ে নেমে গেলেন।

    সৈনিক সবই দেখছিল। সে আর দেরি না করে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে ছোট রাজকন্যার পিছনে পিছনে নেমে গেল। অর্ধেক পথ গিয়ে সে হঠাৎ ছোট রাজকন্যার পোশাক মাড়িয়ে দিলে।

    রাজকন্যা ভয় পেয়ে বলে উঠলেন—কী হল? কে আমার পোশাক ধরে টানল?

    বড় রাজকন্যা বললেন—বোকামি কোরো না। নিশ্চয় পেরেকে লেগে গিয়েছিল তোমার কাপড়।

    তারপর তারা একেবারে নিচে নেমে গেল। যেখানে এসে পৌঁছল সেখানে দু-ধারে গাছ দেওয়া চমৎকার একটি রাস্তা। গাছের সমস্ত ডাল পাতা রুপোর। আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

    সৈনিক ভাবল, সঙ্গে করে কোন একটা চিহ্ন নিয়ে যেতে হবে। এই ভেবে সে গাছের একখানা ডাল ভেঙে নিল। রুপোর ডাল ভাঙার চড়-চড় করে একটা আওয়াজ হল।

    ছোট রাজকন্যা চেঁচিয়ে উঠলেন—লক্ষণ ভাল নয়। আওয়াজ শুনতে পেয়েছ তোমরা?

    বড় রাজকন্যা বললেন—ও কিছু নয়। সৈনিকরাজকে আমরা আজ ঠকিয়ে আসতে পেরেছি বলে হাততালি দিয়ে আমাদের সংবর্ধনা জানানো হচ্ছে।

    তারপর তারা একটি বীথিতে এল তার দু-ধারের গাছে শুধু সোনার পাতা, আর শেষে এল আরেক বীথিতে যার গাছগুলিতে শুধু হিরে ঝকমক করছে। সৈনিক দু-বারই দুটি গাছ থেকে দুটি ডাল ভেঙে নিল। ছোট রাজকন্যা শব্দে আঁতকে উঠলেন। কিন্তু বড় রাজকন্যা বললেন—হাততালির শব্দ। আমাদের সংবর্ধনা জানাচ্ছে। চলতে চলতে তারা শেষে এক প্রকাণ্ড হ্রদের ধারে এসে হাজির। জলের ধারে ছোট-ছোট বারোখানি নৌকো বাঁধা আর প্রত্যেক নৌকোয় একটি করে সুন্দর রাজপুত্র। রাজকন্যাদের জন্যেই এঁরা অপেক্ষা করছিলেন। তাঁরা আসতেই প্রত্যেক রাজপুত্র এক-একটি রাজকন্যার সঙ্গে নৌকোয় গিয়ে বসলেন আর সৈনিক গিয়ে বসল যে নৌকোয় ছোট রাজকুমারী উঠেছিলেন তাতে।

    ছোট রাজকন্যার রাজপুত্র বললেন—আজকে আমাদের নৌকো এত ভারি ঠেকছে কেন বুঝতে পারছি না। বেজায় জোর লাগছে নৌকো বাইতে!

    রাজকন্যা বললেন ব্যাপার কী? গরমের জন্যে ঐরকম মনে হচ্ছে না তো? উঃ আজ যা গরম!

    হ্রদের অপর পারে একটি অপূর্ব রাজপ্রাসাদ আলোয় ঝলমলে। সেখান থেকে ড্রামের আর শিঙের ভারি উৎফুল্ল সঙ্গীত ভেসে আসছে। তারা সবাই নৌকো বেয়ে ওপারে গিয়ে উঠল। রাজপুত্রেরা রাজকন্যাদের সঙ্গে নাচলেন। সৈনিকও অদৃশ্য হয়ে নাচল। কোন রাজকন্যা যখন পেয়ালা-ভরা সরাব নিয়ে মুখে ঠেকাতে যাচ্ছেন সৈনিক অমনি পেয়ালায় চুমুক দিয়ে শেষ করে দিতে থাকল। ছোট রাজকন্যা এতে ভয় পেয়ে গেলেন; কিন্তু বড় রাজকন্যা তাঁকে শান্ত করলেন।

    রাত তিনটে অবধি চলল নাচ। নেচে নেচে যখন জুতোর তলায় গর্ত দেখা দিল তখন তাঁরা থামতে বাধ্য হলেন। রাজপুত্রেরা তাঁদের হ্রদের ওপারে নিয়ে গেলেন। এবারে সৈনিক গিয়ে বসল বড় রাজকুমারীর নৌকোয়। হ্রদের তীরে তাঁরা রাজপুত্রদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন আর বললেন— কাল রাত্রে আবার আসব।

    সিঁড়ির কাছে এসে যখন রাজকন্যারা পৌঁছলেন, সৈনিক ছুটে আগে গিয়ে উঠল আর তার বিছানায় চুপটি করে শুয়ে পড়ল। রাজকন্যারা যখন ক্লান্ত পায়ে একে-একে ঘরে এসে ঢুকলেন সৈনিক এমন জোরে নাক ডাকাতে লাগল যে তাই শুনে রাজকন্যারা বললেন— নাঃ কোন বিপদ হয়নি, সবই ঠিক আছে। তারপর তাঁরা কাপড় ছেড়ে বাক্স-আলমারি-বন্দী করে ক্ষয়ে-যাওয়া জুতোগুলিকে বিছানার তলায় রেখে শুয়ে পড়লেন।

    পরের দিন সৈনিক ঠিক করল যে কিছু বলবে না। আবার এক রাত ঐ সব আশ্চর্য ব্যাপার দেখবে। ঠিক আগের রাতেরই মতো সব কিছু ঘটল। যতক্ষণ পর্যন্ত না জুতোর তলায় গর্ত হয়ে যায় ততক্ষণ পর্যন্ত রাজকন্যারা নাচলেন। তৃতীয় রাত্রে সৈনিক করল কি, একটা সরাবের পেয়ালা চিহ্ন হিসেবে রেখে দিল।

    তিন দিন পরে সময় হলে সে তিনটি শাখা আর পেয়ালাটি নিয়ে রাজার কাছে গেল। বারো রাজকন্যা দরজার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলেন সৈনিক কি বলে শোনবার জন্যে।

    রাজা জিজ্ঞেস করলেন—বল, আমার রাজকন্যারা কোথায় নাচতে গিয়ে তাঁদের জুতোর তলা ক্ষইয়ে এসেছেন?

    সৈনিক বললে—মাটির নিচে পাতালে এক প্রাসাদ-পুরীতে বারোজন রাজপুত্রের সঙ্গে। বলে চিহ্নগুলি রাজার হাতে এগিয়ে দিল।

    রাজা মেয়েদের ডেকে পাঠালেন। জিজ্ঞেস করলেন—বল তোমরা এই সৈনিক সত্যি কথা বলছে কি না। রাজকন্যারা দেখলেন লুকিয়ে আর লাভ নেই। তাই তাঁরা স্বীকার করলেন।

    রাজা বললেন—বল সৈনিক কোন কন্যাকে তোমার পছন্দ?

    সৈনিক বললেন—আমি তো আর ছেলেমানুষটি নই। বড় রাজকন্যাকেই আমায় দিন।

    সেইদিনই বিয়ে হয়ে গেল। রাজা বললেন—আমার মৃত্যু হলে এ-ই রাজত্ব পাবে।

    রাজকন্যারা এতদিন যে মায়ার মধ্যে পড়েছিলেন তা আস্তে আস্তে কেটে গেল। সবশুদ্ধ তাঁরা যে ক-দিন পালের রাজপুত্রদের সঙ্গে নেচেছিলেন ঠিক ততদিন লাগল তাঁদের মায়া কাটতে।

    টীকা