Chapter Index

    এক ছিল মুচি। কপালের দোষে মুচি আস্তে-আস্তে ভারি গরিব হয়ে পড়ল। এত গরিব হয়ে পড়ল যে শেষ অবধি তার বাকি রইল একখানি মাত্র জুতো করবার মত চামড়া। আর কিছুই রইল না। সে চামড়াটি কেটেকুটে সাজিয়ে রেখে ঘুমোতে গেল, পরের দিন সকালে যাতে শেষ জুতোটি সেলাই করতে পারে।

    সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ভগবানের নাম করে কাজে বসতে যাবে, দেখে যে, জুতোজোড়াটিকে কে সেলাই-টেলাই করে দিব্যি তৈরি করে রেখে গেছে। টেবিলের উপর সাজানো। মুচি অবাক হয়ে গেল। কী করে যে কী হল বুঝতেই পারলে না।

    জুতোজোড়াটা ভাল করে দেখবার জন্যে হাতে তুলে নিলে। দেখলে একটি সুতোর ফোঁড়ও এদিক-ওদিক হয়নি। এমন সুন্দর করে জিনিসটা তৈরি, যে মনে হয় ওস্তাদ হাতের কাজ।

    একটু পরেই একজন খদ্দের এল। সে জুতো দেখে এত খুশি হল যে সাধারণ দামের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে গেল সেটা। সেই টাকা দিয়ে মুচি দেখল, দু-জোড়া জুতোর মত চামড়া কিনতে পারে।

    রাত্রে সে দু-জোড়া জুতোর চামড়া কেটে রেখে শুতে গেল। পরের দিন সকালে উঠে ভাবল, আজ বেশ ভাল করে কাজে লাগা যাবে। কিন্তু জুতোর টেবিলের কাছে গিয়ে দেখল যে তার কোনো দরকার নেই। দু-জোড়া জুতোই তৈরি। খদ্দেরেরও অভাব হল না। অমন ভালো জুতো— বিক্রি হয়ে গেল চট করে। জুতো বিক্রি করে সে যা টাকা পেল তাতে করে চারজোড়া জুতোর চামড়া কিনতে পারা যায়।

    পরের দিন ভোরে উঠে মুচি দেখল চার জোড়া জুতোই তৈরি। এই ভাবে চলল। যতগুলি জুতোর জন্যে সে রাত্রে চামড়া কেটে রাখত, সকাল বেলা দেখা যেত জুতো আপনি তৈরি হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে তার অভাব ঘুচে গেল। বেশ স্বচ্ছন্দে দিন কাটতে থাকল তার।

    তারপর হল কি, বড়দিন যখন প্রায় এসে পড়েছে তখন একদিন সে রোজকার মত কতকগুলো জুতোর চামড়া কেটে সাজিয়ে রাখছে, এমন সময় তার স্ত্রী এল সেখানে। সে স্ত্রীকে বললে—আজ রাতে আমরা জেগে দেখব কে আমাদের এমন রোজ-রোজ সাহায্য করে যায়।

    মুচির বৌ রাজি হল। একটি মোমবাতি জ্বেলে ঘরের কোণে যেখানে কাপড় ঝুলত তার পিছনে দু-জনে লুকিয়ে রইল। মাঝরাতে ছোট-ছোট দুটি ন্যাংটা পরী ঘরের মধ্যে এল। এসে তারা মুচির টেবিলের উপর বসল। তারপর চামড়া ছুঁচ সুতো আর হাতুড়ি তুলে নিয়ে তাদের খুদে-খুদে হাত দিয়ে এমন পরিষ্কার আর এমন তাড়াতাড়ি কাজ করে চলল যে মুচির নিজের চোখকেই বিশ্বাস হল না। যতক্ষণ না সমস্ত কাজ শেষ হয়ে যায় তারা থামল না। কাজ শেষ করে জুতোগুলি টেবিলে সাজিয়ে রেখে পরী দুটি চট্‌ করে পালিয়ে গেল।

    পরের দিন মুচি-বৌ বললে— ছোট পরী দুটি আমাদের অবস্থা ফিরিয়ে দিয়েছে। আমাদের কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত। ওদের গায়ে তো কিছুই নেই দেখলুম। শীত এসে পড়ল, নিশ্চয় বেচারারা শীতে জমে যাচ্ছে। আমি ওদের জন্যে খুদে-খুদে জামা কোট কুর্তা আর পাজামা করে দেব। একজোড়া করে মোজাও বুনে দেব। তুমি ওদের জন্যে একজোড়া করে জুতো বানিয়ে দাও।

    মুচি রাজি হল। রাত্রে যখন সব কিছু তৈরি হয়ে গেল তারা উপহারগুলি টেবিলে সাজিয়ে রেখে নিজেরা লুকিয়ে রইল দেখবার জন্যে যে পরী দুটি কি করে।

    মাঝরাতে তারা এল। লাফাতে লাফাতে টেবিলে উঠে কাজ আরম্ভ করে দিতে যাবে, হঠাৎ দেখে কাটা চামড়ার বদলে সুন্দর সুন্দর কাপড়-চোপড়, জুতো এইসব।

    প্রথমটা তারা অবাক হয়ে গেল, তারপর ভারি খুশি হয়ে উঠল। চট করে একটার পর একটা পরে ফেলল গায়ে পায়ে আর গান গাইতে লাগল—

    ফিটফাট চোস্ত হয়েছি এবার।
    জুতো সেলাইয়ের কাজ করিব না আর।

    এই গান গেয়ে গেয়ে তারা নাচতে লাগল। তারপর টেবিল চেয়ারের উপর লাফাতে লাফাতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সেই থেকে তারা আর আসেনি। সেই থেকে মুচিকেও কোনদিন আর দুঃখে কষ্টে পড়তে হয়নি। সব সময়েই তার ব্যবসা ভাল চলেছিল।

    টীকা